অর্জুন এবং চাইনিজ সিগারেট
কাল রাত্রে পর পর কয়েকটা বোমা বিকট শব্দে ফেটেছিল। শহরের এদিকটায় যাঁরা বাস করেন, যেমন সেনপাড়া, হাকিমপাড়া বা আদালত এলাকার মানুষ ওই শব্দের সঙ্গে জন্ম ইস্তক পরিচিত। শুকনো খটখটে তিস্তায় যখন বালি ওড়ে, কাশের জঙ্গল যখন মাথাচাড়া দেয়, নদীর ধারা যখন শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে আসে, তখন পাহাড়ে বৃষ্টি নামলেও সমতলের আকাশে এক ফোঁটা মেঘ দেখা যায় না। এইরকম সময়ে আগাম জানান না দিয়ে আচমকা মধ্যরাতে তিস্তার শুকনো পাঁজরা ফাটিয়ে বোমার বিকট আওয়াজ উঠে আসে। শহরের তিন পাড়ার মানুষ জানে, কাল ভোর ভোর অন্ধকারে যাঁরা তিস্তার ধার ঘেঁষে বেড়াতে যাবেন, তাঁরা দেখতে পাবেন তিস্তার ওপরের বালির স্তর ভিজে গেছে, বাতাসের দাপটও তাকে ওড়াতে পারছে না। তারপর যত বেলা বাড়বে, বালির নীচ দিয়ে চুঁইয়ে আসা জল ওপরে উঠে আসবে। গত রাতে বালির নীচে জমে থাকা বাতাস যা গ্যাসের মতো চেপেছিল, তা চুঁইয়ে আসা জলের চাপে ঊর্ধ্বমুখী হতেই বালির স্তর ফেটে বোমার বিকট শব্দ তৈরি করেছিল।
কিন্তু প্রতি বছরের এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে এবছর প্রাতঃভ্রমণকারীরা কোনো মিল দেখতে পেলেন না। তিস্তার বুকে এই ভোরেও শুকনো বালি উড়ছে, কাশগাছগুলো নির্বিকার দুলছে। কোথাও বালি ভিজে যায়নি। শুধু তিস্তার গায়ে সরকারি বাড়িটা যা বাতিল হয়ে পড়েছিল, যার জানলা দরজা প্রয়োজন পড়ায় মানুষ গোপনে খুলে নিয়ে গিয়েছিল, যার একপাশে মাঠ আর অন্যপাশে তিস্তা, তা ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে। এতদিন দোতলা করার পরিকল্পনায় তৈরি পরিত্যক্ত বাড়িটিতে কেউ কেউ ভূতের আস্তানা ভেবে এড়িয়ে যেত। উঠতি বয়সের ছোকরারা যার আড়ালে গিয়ে সিগারেট খাওয়া রপ্ত করত, সেটা শুধু ইটবালির স্তূপ হয়েই থাকেনি, তার ভেতর থেকে মানুষের শরীরের অংশবিশেষ বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
আতঙ্ক ছড়াল। বাতাসের আগে পৌঁছে গেল সরকারের কানে। পুলিশের গাড়ি ছুটে এল, জেলাশাসক, এসপি—ও। কর্ডন করে বাড়িটিকে জনতার আওতা থেকে আলাদা করে দেওয়া হল। সকালটা আচমকাই ছুটির সকাল হয়ে গেল শহরবাসীর কাছে। সবাই দু’চোখ মেলে দেখতে চায়, ওরা কারা, যারা ইটের তলায় চাপা পড়ে আছে?
একটা দুটো নয়, চার—চারটে শরীর যা এখন লাশ হয়ে গেছে। পুলিশ ধ্বংসস্তূপ ঘেঁটে বের করল। কারওর হাত উড়ে গেছে, কারওর মাথা। কিন্তু পরনের পোশাক বলছে সেগুলো কমদামি নয়।
গাড়িতে চাপিয়ে তাদের নিয়ে পুলিশ চলে যাওয়ার পর ভিড় পাতলা হতে লাগল। তারপর নানান ভাবনা ছড়িয়ে পড়ল শহরের মানুষগুলোর মনে। ওরা কারা? কী করছিল ওই পরিত্যক্ত বাড়ির ভিতরে? মধ্যরাত্রে যে—বোমা ফাটার বিকট শব্দ হয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই ওই বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। তাহলে কি তারা সন্ত্রাসবাদী! ওই বাড়িতে বসে এই শহরটাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল অথবা তার প্রস্তুতি নিচ্ছিল?
পুলিশের বোম স্কোয়াড এল একটু বেলা করে। ঘিরে রাখা বাড়িটার ভেতরে খুঁজতে গিয়ে আবার একটা বোমা ফাটল, যার শব্দে আতঙ্কিত তখনও দাঁড়িয়ে থাকা কিছু দর্শক দে দৌড় দিল। বোমায় অতি ক্ষুদ্র অংশের আঘাতে বোম স্কোয়াডের একজন কর্মী আঘাত পেলেন ; উপযুক্ত রক্ষাব্যবস্থা থাকায় তা গুরুতর হয়নি। কিন্তু তাঁকে হাসপাতালে পাঠাতে হল।
বিকেল নাগাদ পুলিশ ধ্বংসস্তূপ যাচাই করে একটা বড় টিনের ট্রাঙ্কে যে—অস্ত্র সম্ভারের দর্শন পেল, তা দেখে তাদের চোখ বিস্ফারিত। এত আধুনিক অস্ত্র পুলিশের অনেকেই এর আগে দ্যাখেনি, ব্যবহার করার কৌশল তাই জানার কথা নয়।
দেশ—বিদেশের টিভি চ্যানেল, কাগজের সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। টিভিতে বাড়িটির ছবি বারংবার দেখানো হল। বলা হচ্ছিল, যেসব মৃতদের মর্গে নিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের পরিচয় এখনও জানা যায়নি। এদের কারওর পকেটে এমন কিছু পাওয়া যায়নি যা থেকে এদের সম্পর্কে কোনো ক্লু পাওয়া যায়। পুলিশ সূত্রে বেসরকারিভাবে জানা গিয়েছে, ওই চারজনের একজনের পকেটে এক প্যাকেট চাইনিজ সিগারেট ছিল।
সিগারেট খাওয়ার চল এই অঞ্চলে আগের থেকে অনেক কমে গিয়েছে। দাম লাগামছাড়া বলে নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনরা বিড়ি খেয়ে নেশা মেটায়। দামি বিদেশি সিগারেট কিনতে হলে বড় দোকানে ঢুঁ মারতে হয়। এককালে কিছু চিনে সিগারেট নেপালের ধূলাবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারতে আসত। হংকং মার্কেটে পাওয়া যেত। বোধ হয় চাহিদা নেই বলেই চিনে সিগারেট এই অঞ্চলের বাজার গুটিয়ে নিয়েছে।
সেই সিগারেটের প্যাকেট মৃত লোকটির পকেটে পাওয়া গেল কী করে? স্কচ হুইস্কি যে খায়, সে স্কটল্যান্ডে গিয়ে খাওয়া শিখেছে এমন ধারণা অতি মূর্খও করবে না, তাই চিনে সিগারেট পকেটে পাওয়া গিয়েছে বলে লোকটা চিনে গিয়েছিল তা পুলিশ ভাবছিল না।
কিন্তু স্থানীয় পুলিশের ওপর নির্ভর করতে চাইল না জাতীয় সরকার। তারা তাদের প্রশিক্ষিত দল পাঠাল জলপাইগুড়িতে। তারা দেখল, উদ্ধার করা অস্ত্রের গা থেকে সযত্নে লেখাগুলো মুছে ফেলা হয়েছে যাতে ওগুলো কোথায় তৈরি হয়েছে বোঝা না যায়। কিন্তু ওদের অভিজ্ঞতা থেকে ওরা বুঝল, অস্ত্রগুলো বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। যে—বোমাগুলো ফেটেছিল, তা ব্যবহার করার উপযুক্ত শিক্ষা না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। ওই দুর্ঘটনা না ঘটলে যা অস্ত্র ছিল, তা দিয়ে জলপাইগুড়ি শহরের অর্ধেকটা গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হত।
ঘটনার পর তৃতীয় রাত্রে আবার বোমা ফাটার বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে শহরের লোক ভয়ে ঘরের বাইরে এল না। সশস্ত্র পুলিশ, জাতীয় বাহিনীর লোকজন রাত্রেই ছুটে গেল তিস্তার পাড়ে। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে তারা তিস্তার বুকে আলো ফেলে অবাক হয়ে দেখল, ওপরের বালি ভিজে চপ চপ করছে। সকাল হতেই তিরতিরিয়ে জল উঠে এল ওপরে। শুকনো বালির মরা খাত জলে টলমল করতে লাগল। কোথাও কোনো ধ্বংসস্তূপ নেই। স্থানীয় মানুষ জানাল, ওই শব্দ তিস্তার বুক থেকে উঠে এসেছিল, প্রতি বছর যা হয়।
ভারতে জয়গাঁ আর ভুটানের ফুন্টশোলিং বর্ডার পোস্ট থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে সারাদিন ধরে বাসে চেপে রাজধানী থিম্পু বা পারোতে যাওয়া যায়। বিদেশি টুরিস্টরা যাঁরা বিমানে যান না, তাঁরা এই পথেই যাতায়াত করেন। কিন্তু থিম্পু বা পারো নয়, ফুন্টশোলিং ছাড়িয়ে পাহাড়ে ওঠার সময় এমনসব জায়গা দিয়ে যেতে হয় যার প্রচার তেমনভাবে হয়নি। এইরকম একটা জায়গার নাম চাপসা।
নামটা অর্জুন জেনেছিল অমল সোমের চিঠি পড়ে। দীর্ঘদিন অমল সোম বাইরে বাইরে ঘুরছেন। পাহাড় তাঁর প্রিয় জায়গা। মাঝে দু’তিন সপ্তাহের জন্যে জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ার বাড়িতে আসেন। তখন অর্জুনের সঙ্গে দু’বেলা দেখা হয়। অমলদা এখন ভুটানে। হাইওয়ে থেকে এক মাইল ভেতরে যে—বাংলোয় তিনি থাকেন, তার মালিক ভুটানের রাজার পিসি। বৃদ্ধা মহিলা অমলদাকে খুব পছন্দ করেন। তাঁর অনুরোধেই অমলদা এই বছর ওই বাংলোতে আছেন। অমলদা লিখেছিলেন, ‘চলে এসো অর্জুন, জায়গাটা তোমার ভালো লাগবে। রাজার পিসির বাংলো, ঘরের অভাব নেই। কাজের লোক দূরত্ব রেখে সেবার জন্যে তৎপর। এসো, দিনকয়েক থেকে যাও। তবে একটাই শর্ত, সকালে ব্রেকফাস্টের সময় এক ঘণ্টা আর বিকেলে চা পানের সময় ছাড়া আমাকে কথা বলতে বাধ্য করবে না।’
মাকে বলতেই অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল। জলপাইগুড়ির কদমতলা থেকে বাসে উঠে বীরপাড়া—হাসিমারা হয়ে সোজা জয়গাঁতে গিয়ে নেমেছিল। জয়গাঁ অবাঙালি ব্যবসায়ীদের জায়গা। বেশ নোংরা। কিন্তু সীমান্তের গেট পেরিয়ে ভেতরে পা দিলেই ফুন্টশোলিং দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ওখান থেকে নিজের আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে ফোটোকপি জমা দিয়ে আবেদন করলে ভুটানে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়। অর্জুন থিম্পু বা ভুটানে বেড়াতে যাচ্ছে না। ভুটানের রাজার পিসির বাংলোয় যাচ্ছে শুনে অফিসাররা সানন্দে অনুমতি দিয়ে দিলেন।
ওখান থেকেই বাসে উঠল অর্জুন। সীমান্তের কাছাকাছি ভারতীয় অঞ্চলের বাজারে ভুটানের টাকা স্বচ্ছন্দে চলে। বেআইনি ব্যাপার হলেও কোনো ব্যবস্থা সরকার নেয় না। বাসের ভাড়া ভারতীয় টাকায় দেওয়া সত্ত্বেও কিছু টাকা অর্জুন ভাঙিয়ে ভুটানি টাকা করে নিয়েছিল।
বাস ছাড়ার আগে অর্জুন জেনে নিয়েছিল, ফুন্টশোলিং থেকে চাপসার দূরত্ব প্রায় আটানব্বই কিলোমিটার। পাহাড়ি পথ। পৌঁছতে অন্তত চার ঘণ্টার একটু বেশি সময় লাগবে। চাপসার আগে পড়বে তিনটে ছোট শহর। গেদু, চুখা, ব্যান্ডেল। এতটা সময় চুপচাপ বসে না থেকে ঘুমিয়ে নেওয়াই ভালো। অর্জুন বাসের যাত্রীদের দিকে তাকাল। বেশিরভাগই ভুটানের মানুষ। তারা বসে আছে চুপচাপ। যত বকবকানি কয়েকজন বাঙালি টুরিস্টের মুখে। থিম্পুতে কী কী বিদেশি জিনিস কিনতে পাওয়া যায়, তাই নিয়ে তিনজন জোরে জোরে আলোচনা করছিল। একজন জল ঢালতে চাইল—’দূর, আমেরিকান বা জাপানি মাল ওখানে পাবি না। যা পাবি তা আসে চিন থেকে। চিনা হুইস্কির চেয়ে ইন্ডিয়ান হুইস্কি অনেক ভালো। চিনের সিগারেট খুব কড়া।’
সঙ্গীদের একজন বলল, ‘তুই তো কখনও ভুটানে আসিসনি—’
‘তাতে কী হয়েছে? যারা গেছে তাদের কাছে শুনেছি।’
অর্জুন চোখ বন্ধ করল।
ব্যান্ডেল পার হতেই শীত শীত অনুভূতি হতেই চোখ খুলল সে। ব্যাগ থেকে জ্যাকেট বের করে পরার পরে আরাম হল। একটু পরে দূরে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়োগুলো দেখতে পেল। চাপসায় নেমে পড়ল সে বাস থেকে। বেশ খিদে পেয়েছিল। অমল সোমের কাছে পৌঁছতে এক মাইল হাঁটতে হবে। অর্জুন চারপাশে তাকিয়ে খাবারের দোকানটা দেখতে পেল। ভেতরে ঢুকে জানতে চাইল চিকেন মোমো পাওয়া যাবে কিনা! ভুটানি মহিলা একগাল হেসে বললেন, ‘অবশ্যই যাবে। আর আপনাকে জানিয়ে রাখি, আজ আমার ফার্মের চিকেনই মোমোতে খেতে পারবেন।’
কাঠের চেয়ার টেবিলে আরও কয়েকজন বসে ভাত আর মাংসের ঝোল খাচ্ছিল। একটু দূরত্বে বসে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, রাজার পিসির বাংলোতে কোন রাস্তা দিয়ে যাব?’
মহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি সাধু সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন?’
‘সাধু সাহেব? না—না। ওখানে অমলদা আছেন, অমল সোম, উনি আমার গুরু বলতে পারেন।’ অর্জুন বলল।
মহিলা বললেন, ‘ওখানে যিনি আছেন, তিনি তো সাধুর মতো জীবনযাপন করেন। আবার বিকেলে কোট টাই পরে বাংলোর সামনে হাঁটেন। যারা ওই বাংলোতে চাকরি করে তারা বলে, উনি কারওর সঙ্গে কথা বলেন না। খুব জরুরি হলে সকালে আর বিকেলে দেখা করতে পারেন। তাই আমরা ওঁর নাম দিয়েছি সাধু সাহেব।’
অর্জুন বুঝতে পারল, মহিলা অমলদার কথাই বলছেন।
মোমোটা মোটেই সুস্বাদু ছিল না। কিন্তু দাম বেশি নয়। খাওয়ার পর মহিলা যে—পথ দেখিয়ে দিলেন, সেই পথে হাঁটতে শুরু করল অর্জুন।
খানিক বাদে ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে জঙ্গুলে পাহাড়ি পথ ধরতে হল। তবে কাঁচা নয়। রাস্তাটা যত্নে পিচ দিয়ে বাঁধানো, যদিও বেশি চওড়া নয়। এখন প্রায় বিকেল। গাছে গাছে প্রচুর পাখি ডাকছে। বাঁ দিকটায় খাদ থাকায় দূরের বরফমাখা পাহাড়গুলো চমৎকার দেখাচ্ছে। শেষসূর্যের রোদে তাদের রূপ যেন আরও খুলে গিয়েছে। অমলদা এরকম জায়গা ছেড়ে জলপাইগুড়িতে কেন থাকতে চাইবেন! বড় বড় পাইন আর দেবদারু গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অর্জুনের মনে হল, ওইসব গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে লক্ষ করছে। একটা পাথর তুলে জঙ্গলে ছুড়তেই যে—প্রাণীটিকে এক পলকের জন্যে সে দেখতে পেল, তাকে বাইসন বলেই মনে হল। খুব উঁচুতে নয়, তবু পাহাড় বটেই, এই উচ্চচতায় বাইসন থাকে কিনা তা জানে না অর্জুন।
শেষপর্যন্ত পিচের পথ যেখানে শেষ হয়ে গেল, সেখানে বড় লোহার গেট। গেটের দু’পাশ দিয়ে পাঁচিল চলে গিয়েছে দু’দিকে। ভেতরের দোতলা বাংলোর ছাদ গেটের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। অর্জুন গেটের গায়ে পৌঁছে দেখল, ভেতর থেকে তালা দেওয়া রয়েছে।
সে শব্দ করার আগেই একজন ভুটানি কর্মচারী ছুটে এল। গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপকা নাম?’
‘অর্জুন’
সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কপালে আঙুল ছুঁইয়ে হেসে তালা খুলতে খুলতে বলল, ‘আইয়ে সাব।’
ভেতরে ঢুকল অর্জুন। সুন্দর ফুলের বাগান, সাজানো লন। লোকটা তাকে নিয়ে গেল দোতলার একটি ঘরে। অর্জুন দেখল যে—কোনো দামি হোটেলের ঘরের থেকে কোনো অংশে কম আরামদায়ক নয়। লোকটা বলল, ‘স্যার, ইয়ে আপকো কামরা।’
ব্যাগটা রেখে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘অমল সোম কাঁহা হ্যায়?’
‘আউর দশ মিনিট, দশ মিনিট বাদ সাবকো টি টাইম হোগা। আপ ফ্রেশ হোকে নীচে আ যাইয়ে।’ লোকটা চলে গেল।
বাথরুমের আয়তন শোয়ার ঘরের মতনই। গিজার থাকা সত্ত্বেও এই অবেলায় স্নানের ঝুঁকি নিল না অর্জুন। একটু তাজা হয়ে নীচে নামল সে। একটা বিশাল কুকুরকে চেনে বেঁধে আর একটি লোক হাঁটছিল লনে। অর্জুনকে দেখে কুকুরটা এত দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল যে মনে হল, বাঁধা না থাকলে ওটা ঠিক ঝাঁপিয়ে পড়ত। ওর পালক ওকে বেশ জোরে ধমক দিল। তারপর ভুটানি ভাষায় বেশ কিছু কথা বলল। কুকুরটার দাঁত দেখা গিয়েছিল। শোনার পর মুখ বন্ধ হল। এবার লোকটি কুকুর নিয়ে অর্জুনের দিকে এগিয়ে গেল। অর্জুন প্রতিবাদ করল, ‘আরে, কী করছ তুমি। এনো না ওকে।’
পিছন থেকে অমল সোমের গলা ভেসে এল— ‘আরে, তোমার ঘ্রাণ ওকে নিতে দাও। ওটা নেওয়ার পর তোমাকে আর শত্রু ভাববে না।’
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অর্জুন। চেনে বাঁধা বিশাল কুকুরটা তার চারপাশে ঘুরে শরীরে নাক ঠেকিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে লোকটার কাছে লনের দিকে চলে গেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল অর্জুন। সে অমল সোমের দিকে তাকাল।
পরনের পোশাক পরিপাটি। কোটের তলায় হাফ স্লিভ সোয়েটার, হাতে ছড়ি। বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই একটু পরিশ্রান্ত?’
‘না। তেমন নয়। এতক্ষণ তো বাসে বসে ঘুমাচ্ছিলাম।’ অর্জুন বলল।
‘সে কী? তুমি বাসে বসে ঘুমাও নাকি? তাহলে দু’পাশের জায়গাগুলো, গাছপালাকে তো দেখতে পাবে না। বাসের ভেতরের অন্য যাত্রীরা কে কেমন বিহেভ করছে, তাও অজানা থেকে যাবে। তাই না?’
‘হ্যাঁ, অমলদা, আপনি ঠিকই বলেছেন।’ অর্জুন স্বীকার করল।
‘তোমার ঘর পছন্দ হয়েছে?’ অমল সোম এগিয়ে এলেন।
‘হ্যাঁ। খুব ভালো ব্যবস্থা।’
‘মিসেস দোরজির বয়স এখন পঁচাশি। বিয়ে করেননি। রাজার পিসিমা বলে প্রচুর সম্পত্তির মালিক। কিন্তু নরম মনের মানুষ। ওঁর অনেকগুলো বাংলোর মধ্যে এটি একটি। এখানে আমি আছি বলে উনি খুব খুশি কিন্তু আমাকে একেবারেই বিরক্ত করেন না। সমস্যা সেখানেই।’
‘কীরকম?’
‘এতবড় বাংলোর ভাড়া কত হবে জানি না কিন্তু আমি আমার সাধ্যমতো যদি দিতে চাই, তাহলে তিনি অপমানিত বোধ করবেন। এই বাংলোর কর্মচারীদের মাইনে, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ —সব স্টেট থেকে আসে। আমি জোর করে আমার খাওয়ার খরচ দিই। আমাকে ভদ্রমহিলা খুব পছন্দ করেন। মুসৌরিতে প্রথম আলাপ হয়েছিল। কিন্তু এখানে আছি বলে মাঝে মাঝে এমন কিছু অনুরোধ করেন যে না বলতে পারি না। ওঁকে কী করে বোঝাই, পুরনো জীবন থেকে আমি সরে এসেছি!’ অমল সোম বললেন।
কৌতূহল হল, অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘কীরকম অনুরোধ?’
ঘড়ি দেখলেন অমল সোম। বললেন, ‘ভদ্রলোক যদি সময়ের দাম বোঝেন তাহলে কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর দর্শন আমরা পাব। ইনি প্রবীণা রাজকুমারীর সূত্রে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।’ অমল সোম কথা শেষ করতেই গেটের বাইরে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। যে—লোকটি অর্জুনের বেলায় দরজা খুলেছিল, সে দৌড়ে গিয়ে প্রশ্ন করে তালা খুলল। অর্জুন বুঝতে পারল, কে কখন দেখা করতে আসবে তার লিস্ট লোকটির কাছে আছে।
গাড়ি বাইরে রেখেই যে—ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলেন, তাঁর পরনে ভুটানি পোশাক। মাথায় ভুটানি টুপি। যে দরজা খুলেছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করে ভদ্রলোক অর্জুনদের দিকে এগিয়ে এসে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, ‘গুড আফটার নুন। আমি থিম্পু থেকে আসছি। আমার নাম লেনডুপ।’
‘গুড আফটার নুন। আমি অমল সোম আর ইনি আমার তরুণ বন্ধু অর্জুন।’ হাত বাড়িয়ে দিলেন অমল সোম। করমর্দন শেষ করে অর্জুনের সঙ্গে হাত মেলালেন ভদ্রলোক।
‘ঠিক সময়ে এসেছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আসুন, আমরা চায়ের টেবিলে বসে কথা বলি।’ অমল সোম বাংলোর ভেতরে পা বাড়ালে ওঁরা তাঁকে অনুসরণ করলেন। বাংলোর নীচতলার একদিকে সুন্দর বসার ব্যবস্থা, অন্যদিকে বিরাট ডাইনিং টেবিল, চেয়ার। সেখানে ইতিমধ্যে খাদ্যবস্তু সাজিয়ে অপেক্ষা করছে দু’জন বেয়ারা। তাদের সাদা পোশাকে এক ফোঁটা ময়লা নেই।
চিকেন স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে লেনডুপ বললেন, ‘আমি খুব সমস্যায় রয়েছি। রাজার পিসি। মানে, প্রিন্সেসের সঙ্গে আমার মায়ের যোগাযোগ ছিল। ওঁরা দু’জন একসময় ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করেছিলেন। মায়ের কাছে শোনার পর প্রিন্সেস পরামর্শ দেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের সৌভাগ্য যে আপনি এই সময় ভুটানে আছেন। আমি অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।
অর্জুন লক্ষ করছিল, ভদ্রলোকের ইংরেজি উচ্চচারণ প্রায় বিদেশিদের মতো। অমল সোম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘প্রিন্সেস বোধ হয় জানেন না যে, আমি ওই প্রফেশন থেকে অবসর নিয়েছি। তাছাড়া আপনি ভুটানের মানুষ, আমি এখানে বিদেশি। আপনার সমস্যার গভীরতা আমার পক্ষে কি জানা সম্ভব?’
লেনডুপ বললেন, ‘মিস্টার সোম, আমি কি সমস্যার কথা বলতে পারি?’
অমল সোম মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।
‘আমি ব্যবসা করি। ছাত্রাবস্থা কেটেছে বস্টন শহরে। এখন ব্যবসার জায়গা থিম্পু আর নিউ ইয়র্ক। গত সাত—আট বছর ধরেই আমাকে এই কারণে ঘন ঘন বিদেশে যেতে হয়। আমার স্ত্রী অত্যন্ত বিদুষী কিন্তু একটু বেশি পুত্রস্নেহে কাতর। আমি চেয়েছিলাম, ছেলেকে ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় পড়াতে। কিন্তু দেরাদুনে স্কুল শেষ করার পর ওর মা ওকে অতদূরে পাঠাতে চাইল না। ছেলে তখন আবদার করল, সে বেজিংয়ে গিয়ে পড়াশুনা করবে। হয়তো দূরত্ব কম বলে ওর মা রাজি হল। ছেলে বেজিং থেকে মাস্টার্স করলে আমি ওকে ব্যবসায় আসতে বললাম। কিন্তু সে রাজি হল না।’ আপশোসে মাথা নাড়লেন লেনডুপ।
‘ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। পড়াশুনা করার পর ছেলে— মেয়েরা বাবার ব্যবসায় যেতে চায় না।’ অমল সোম বললেন, ‘তারপর?’
‘ইদানীং আমাকে একটু বেশি বাইরে থাকতে হচ্ছিল। থিম্পুতে এলে ছেলেকে দেখতে না পেয়ে যখন স্ত্রীকে ওর কথা জিজ্ঞাসা করতাম, তখন শুনতাম হয় পারোতে বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছে, নয় তো দিল্লিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছে। মোটকথা, গত ছয় মাস আমি ছেলেকে দেখতে পাইনি।’
‘এখন তো সবাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আপনার ছেলের কাছে নিশ্চয়ই দামি মোবাইল ফোন রয়েছে। ফোনে কথা বলেছেন?’
‘করেছি। কিন্তু তার ফোন সবসময় সুইচ অফ করা থাকে।’
‘আপনার ছেলেই কি সমস্যার কারণ?’ অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন।
‘হ্যাঁ।’ লেনডুপ দু’বার মাথা ওপর—নীচ করলেন— ‘আমি জানতাম না সে গত ছয় মাস ধরে বাড়িতে নেই।’ আমাকে খবরটা বলাই হয়নি।’
‘আপনার স্ত্রী তো জানতেন।’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু বললে আমাকে ডিসটার্ব করা হবে, আমি রেগে যেতে পারি, এই ভয়ে ওর মা ব্যাপারটা একদম লুকিয়ে রেখেছিল।’ লেনডুপ বললেন।
‘ছেলের খোঁজ পেয়েছেন?’
‘না।’
‘কেউ বা কোনো দল কি ওকে কিডন্যাপ করতে পারে?’
‘জানি না। তবে ছয় মাস ধরে সে নিখোঁজ, তাকে যদি কিডন্যাপ করা হয়, তাহলে কি কিডন্যাপাররা এতটা সময় মুখ বন্ধ করে থাকবে? তারা অবশ্যই আমার কাছে টাকা চাইবে। খামোকা ছেলের থাকা—খাওয়ার জন্যে খরচ করবে কেন? ছয় মাস লুকিয়ে রাখার তো কোনো যুক্তি নেই।’ লেনডুপ অমল সোমের দিকে তাকালেন।
‘পুলিশকে জানিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। কিছুদিন আগে ওর মা যখন আর লুকোতে না পেরে আমাকে সত্যি কথা বলল, তখন প্রথমেই পুলিশকে জানিয়েছি।’
‘পুলিশ কিছু জানিয়েছে?’
‘না। ওর ছবি প্রতিটি থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওর মতো বয়সের কোনো মৃতদেহ গত ছয়মাসে কোথাও পাওয়া যায়নি। তাই পুলিশ এটাকে মার্ডার কেস হিসেবে না দেখে মিসিং কেস বলে ভেবে নিয়েছে। আপনি যদি এই ছেলের সন্ধান নিতে রাজি থাকেন!’
হাত তুলে লেনডুপকে থামালেন অমল সোম—’আপনাকে আমি প্রথমেই বলেছি, আমার সম্পর্কে আপনি কী শুনেছেন জানি না। কিন্তু আমি একদম অবসর নিয়েছি। আমাকে মার্জনা করবেন। প্রিন্সেসকে আমি আমার অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেব। তবে—’ একটু থামলেন অমল সোম—’তবে আমার এই তরুণ বন্ধু অর্জুন এখন সত্যান্বেষণে খুব দক্ষ হয়েছে। শুধু দেশ নয়, বিদেশে গিয়েও ও এই কাজে সফল হয়েছে। ওর যদি আগ্রহ থাকে আর আপনি যদি ওকে দায়িত্ব দেন, তাহলে কাজটা হতে পারে।’
অর্জুনের দিকে তাকালেন লেনডুপ— ‘আপনি কোথায় থাকেন?’
‘জলপাইগুড়ি শহরে।’ অরুন বলল,
‘জলপাইগুড়ি? কলকাতায় নয়?’ অবাক হলেন ভদ্রলোক।
‘না। জলপাইগুড়ি শহরেই আমার জন্ম, পড়াশুনা। ওখানেই অমলদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। যা কিছু শিখেছি তা ওঁর কাছেই শেখা।’ অর্জুন বলল।
‘আচ্ছা!’ একটু ভাবলেন লেনডুপ— ‘ঠিক আছে। মিস্টার সোম যখন বলছেন, তখন আমার আপত্তি নেই। ছেলেকে খুঁজে বের করতে যা যা সাহায্য করার তা আমি করব। আপনি কাজ শুরু করুন।’
এতক্ষণ অর্জুন চুপচাপ দু’জনের কথা শুনছিল। অমল সোম যে তার কথা মিস্টার লেনডুপকে বলবেন সে অনুমান করতে পারেনি। থিম্পু বিদেশি একটি রাষ্ট্রের রাজধানী। কখনও যায়নি সে থিম্পুতে। সেই শহরের একটি যুবক গত ছয় মাস ধরে বাড়িতে নেই, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। কী করে সেটা সম্ভব, এটা তো প্রায় খড়ের গাদা থেকে সুচ খুঁজে বের করা।
অর্জুন বলল, ‘দেখুন, আমি ওখানে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ভুটান আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। কিন্তু খুব অল্প তথ্য আমার জানা আছে। আপনার ছেলে সম্পর্কেও আমি কিছুই জানি না। তাই আমার মনে হয়, আপনাদের এখন পুলিশের ওপর নির্ভর করলেই ভালো হবে।’
কাঁধ নাচালেন লেনডুপ। তারপর ম্লান হাসলেন— ‘মিস্টার সোম, আমি আপনার কথা অনেক শুনেছিলাম। ভুটানে পুলিশের বাইরে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা নেই, যাঁরা সত্য খুঁজে বের করতে সাহায্য করে থাকেন। আপনি এসেছেন জেনে আমার মা প্রিন্সেসের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম।’ ভদ্রলোক মাথা নিচু করলেন।
‘এত হতাশ হবেন না মিস্টার লেনডুপ। অর্জুন ওর অজ্ঞতার কথা বলল, এটা মিথ্যে নয়। তবে অর্জুন, তুমি একবার থিম্পু শহরে যেতে পার। ছেলেটির বাড়ি, ওর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পার।’ অমল সোম বললেন।
অর্জুন তাকাল— ‘ঠিক আছে।’
অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার ছেলে বেজিংয়ে পড়াশুনা করতে গিয়েছিল। সে কি তার পরেও চিনে গিয়েছে?’
‘হ্যাঁ, একবার গিয়েছিল। বলেছিল, পুরনো সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। তবে ওর পাসপোর্টে যে—ভিসার স্ট্যাম্প ছিল, তার মেয়াদ শেষ হতে আরও চার বছর দেরি আছে।’ লেনডুপ বললেন।
‘তাহলে তো সে ছয় মাস আগে, আপনি যখন বিদেশে ছিলেন, তখন চিনে চলে যেতে পারে। সেখানে ওর যেসব বন্ধু রয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?’ অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন।
‘হ্যাঁ, তাদের একজনের ফোন নাম্বার ওর ঘরে রাখা একটা ডায়েরিতে পেয়েছিলাম। কিন্তু যতবার ফোন করেছি, কথা বলতে পারিনি। ফোন বন্ধ নয় কিন্তু কোনো শব্দই হয়নি।’ লেনডুপ বললেন।
সন্ধে এখানে ঝুপঝাপ নেমে পড়ে। বেয়ারারা এসে ঘরে আলো জ্বেলে দিয়ে গেল। লেনডুপ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মিস্টার অর্জুন কি এখন আমার সঙ্গে থিম্পু যেতে পারবেন?’
অমল সোম বললেন, ‘একী! আপনি এখন যাবেন নাকি! অন্ধকারে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো নিরাপদ নয় বলে জানতাম!’
‘আমরা অভ্যস্ত মিস্টার সোম। তাহলে কাল সকাল ন’টায় এখানে গাড়ি চলে আসবে। আপনি যদি তৈরি থাকেন তাহলে ভালো হয়।’ উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার লেনডুপ— ‘আমি জানি না, আপনি কীরকম পারিশ্রমিক নেন। ও ব্যাপারে কোনো অসুবিধে হবে না। আচ্ছা, এখন আমি চলি।’
ঘড়ি দেখলেন অমল সোম। তারপর উঠে হাতে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘অর্জুন, ওঁকে এগিয়ে দিয়ে এসো আর হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে কাল সকালে আবার কথা হবে। তুমি টিভি দেখতে পার, বই পড়তে চাইলে তাও পাবে। খেয়ে—দেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। আমি চললাম।’
‘কোথায় যাচ্ছেন?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
‘ধ্যানে বসব।’
মিস্টার লেনডুপকে গেটের বাইরে রাখা গাড়িতে তুলে দিল অর্জুন। গাড়ি বেরিয়ে গেলে সে অন্ধকারে চারপাশে তাকাচ্ছিল। এই সময় পেছন থেকে দরজা—খোলা লোকটা এগিয়ে এসে বলল, এখানে এখন দাঁড়িয়ে থাকবেন না সাহেব। ভেতরে আসুন, গেট বন্ধ করে দিতে হবে।’
অর্জুন বলল, ‘কেন এখানে দাঁড়াতে নিষেধ করছ?’
‘সাহেব, এই জঙ্গলের ভয়ংকর জানোয়াররা অন্ধকারে বেরিয়ে আসে। আসুন আসুন সাহেব।’ লোকটা এমন ব্যস্ত হল যে, অর্জুন ভেতরে চলে এল। সে যখন দরজা বন্ধ করছিল, তখন অর্জুনের মনে পড়ল, সে যখন এই বাংলোয় আসার জন্যে জঙ্গলের পথে হাঁটছিল, তখন একটা প্রাণীকে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল।
রাতটা ভালোই কাটল। মাঝে একবার ঘুম ভেঙেছিল। তখন আশপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত শব্দগুলো কানে এসেছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, এই জঙ্গলের প্রাণীরা রাত্রে সক্রিয় হয়।
অর্জুন সকালে যখন অমল সোমের সঙ্গে চায়ের টেবিলে, তখনই অমল সোমের মোবাইল বেজে উঠল। ‘হ্যালো’ বলে তিনি মোবাইল কানে চেপে কিছুক্ষণ শোনার পর বললেন, ‘মাই গড! চারজন মারা গিয়েছে?’ ওদিক থেকে আরও খবর জানানোর পর অমল সোম বললেন, ‘অর্জুন, খুব খারাপ খবর শুনলাম।’
‘কী খবর?’
‘কাল রাত্রে তিস্তার চরের পাশে বাতিল বাড়িতে ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়েছে। চার—চারটে তাজা ছেলে মারা গিয়েছে।’
‘তিস্তার কোন চরে?’
‘হাকিমপাড়া থেকে সেনপাড়ায় যাওয়ার পথে কি কোনো ইমকমপ্লিট বাড়ি ছিল?’ অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন।
অর্জুনের মনে পড়ল। ঠিক সেনপাড়ার শেষে তিস্তা ব্রিজের কাছাকাছি ওইরকম বাড়ি তো ছিলই। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘বিস্ফোরণ কেন হয়েছিল?’ উগ্রপন্থীদের কাজ নাকি?’
অমল সোম বললেন, ‘জলপাইগুড়ির মতো নিরীহ শহরে উগ্রপন্থীরা কোন কারণে বোমা ফাটাবে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। এটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু যে—চারজন মারা গিয়েছে তারা ওখানে কেন ছিল, তা নিশ্চয়ই পুলিশ খুঁজে বের করবে।’
‘এই চারজনের পরিচয় জানা গিয়েছে?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
‘শুনলাম, আইডেন্টিফাই করা যায়নি।’ অমল সোম বললেন, ‘এখান থেকে থিম্পু বেশি দূর নয়। রাস্তাটা দুটো ভাগ হয়ে যাবে। একটা থিম্পুর দিকে, অন্যটা পারো শহরে শেষ হবে। রাজার পিসিমার রেফারেন্সে এসেছেন মিস্টার লেনডুপ। তাই যাও। যদি মনে হয় কেসটা ইন্টারেস্টিং, তাহলে কাজ শুরু করো। নাহলে আজ বিকেলে ফিরে এসো। যা হোক, যা করবে তা আমাকে জানিও। কিছু বলবে?
অর্জুন হাসল— ‘না। একটা নতুন জায়গা দেখা হবে, সেটা আবার দেশের রাজধানী, এটাও তো কম কথা নয়।’
ঘরে ফিরে তৈরি হল সে। ব্যাগটা সঙ্গে নিতে হবে, কারণ যদি থেকে যেতে হয় ওখানে, তাহলে দরকার হবে। কিন্তু মাথার ভেতর থেকে কিছুতেই অমল সোমের কাছে আসা খবরটা মুছে যাচ্ছিল না। আজ অবধি জলপাইগুড়ি শহরে বিস্ফোরণে চারজন মারা গিয়েছে বলে সে শোনেনি। এসব ব্যাপার বীরভূম বা মালদায় প্রায়ই হয়ে থাকে। কাগজে তার খবর বের হয়। সীমান্ত পেরিয়ে প্রচুর উগ্রপন্থী ভারতবর্ষে ঢুকে পড়েছে। তাদের কেউ কেউ বোমা তৈরি করতে গিয়ে ভয়ংকর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। অবশ্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও পরস্পরকে আক্রমণ করার জন্যে গোপনে বোমা তৈরি করতে গিয়ে আহত বা নিহত হয়েছে। এই খবর কাগজেই বেরিয়েছে। কিন্তু জলপাইগুড়ি শহরে এরকম কাণ্ড কী করে হল?
হ্যাঁ, জলপাইগুড়ি শহর থেকে দেশের সীমান্ত বেশি দূরে নয়। উগ্রপন্থীরা চাইলেই ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে লুকিয়ে চলে আসতে পারে। কিন্তু আজ অবধি সেরকম ঘটনা ঘটেনি। অর্জুনের খেয়াল হল, কাল এখানে আসার পরে মাকে ফোন করা হয়নি। মায়ের সঙ্গে কথা বললে নিশ্চয়ই অনেক খবর জানা যাবে। ইদানীং মা সব খবর খুঁটিয়ে জেনে নিচ্ছেন। কিন্তু মোবাইল বের করে অর্জুন বুঝতে পারল, তার সিম কার্ড এখানে কাজ করবে না। হাজার হোক এটা বিদেশ। অমল সোম নিশ্চয়ই তাঁর ফোন রোমিং করে রেখেছেন, তাই অসুবিধে হয়নি।
কাঁটায় কাঁটায় ন’টার সময় মিস্টার লেনডুপের পাঠানো গাড়ি চলে এল। এই সময় অমল সোমকে বিরক্ত করা চলবে না। স্থানীয় মানুষরা ওঁর যে—নামকরণ করেছে তা একদম সঠিক।
গাড়ি চালাচ্ছিল যে তার বয়স পঁচিশের বেশি নয়। হিন্দি এবং ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে। নাম বলল, ‘জিগমে’। বলে শব্দ করে হাসল। মাথা নেড়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ‘এই নাম যার সে হয় রাজা নয় মন্ত্রী হয়, ড্রাইভারি করে না। আমি করি।’
বেশ হাসিখুশি ছেলে, মুখটাও মিষ্টি। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি ইন্ডিয়ার কোন শহরে গিয়েছ?’
‘জয়গাঁ বহুৎ খারাপ জায়গা।’
‘কেন?’
‘আমার পকেট থেকে মোবাইল চুরি করেছিল?’
‘এরকম তো সব শহরেই হয়।’
‘তা হয়—’ স্টিয়ারিংয়ে আঙুল ঠুকল জিগমে— ‘আপনি থিম্পুতে যতদিন থাকবেন, ততদিন আমার গাড়িতে ঘুরবেন। সাহেব বলেছেন।’
‘বাঃ, খুব ভালো। তুমি লেনডুপ সাহেবকে কতদিন চেনো?’
‘পাঁচ বছর। আমি পড়াশুনা করলে সাহেব আমাকে বড় চাকরি দিতেন। আমেরিকাতে যেতে পারতাম।’ জিগমে বলে যাচ্ছিল।
‘সাহেবের ছেলেকে তুমি নিশ্চয়ই চেনো!’
‘হ্যাঁ। কিন্তু ওর কথা বলবেন না।’ গম্ভীর হল জিগমে।
‘কেন?’
‘ওর বাবা কত ভালোমানুষ, আমার মতো সামান্য ড্রাইভারকেও সম্মান করে কথা বলেন আর ছেলে আমাদের মানুষ বলেই মনে করে না। বলে, আমরা নাকি ক্রীতদাস। মেরুদণ্ড নেই।’ মুখ বেঁকাল জিগমে।
সোজা হয়ে বসল অর্জুন— ‘একথা বলার কারণ কী?’
‘আমাদের দেশের প্রধান হলেন রাজা। যুগ যুগ ধরে আমরা তাঁর প্রজা হয়ে আছি। এই রাজাকে মেনে তো আমরা খুব কষ্টে নেই। যেসব দেশে রাজা নেই, পাবলিক প্রধানমন্ত্রীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে, সেই দেশগুলোতে হাঙ্গামা লেগেই আছে। ঠিক কিনা বলুন সাহেব! রাজাকে সম্মান করলে আমরা কেন ক্রীতদাস হয়ে যাব?’ কথাগুলো বলার সময় জিগমের মুখ—চোখ বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠল।
‘তুমি ঠিক কথা বলছ।’ অর্জুন বলল।
‘থ্যাংক ইউ সাহেব।’
‘তোমার সাহেবের এই ছেলের বন্ধুদের চেনো?’
‘না। চিনব কী করে? মনে হয় থিম্পুতে ওর কোনো বন্ধু নেই। ওর সব বন্ধু চিনে থাকে।’
‘চিনে?’
‘হ্যাঁ, বেজিং শহরে।’
‘তুমি কী করে জানলে?’
‘ও ওই শহরে কয়েক বছর পড়াশুনার জন্যে ছিল। আট—নয় মাস আগে ওর তিনজন বন্ধু বেজিং থেকে ভুটানে বেড়াতে এসেছিল। তিনজনেই চিনা।’
‘বন্ধুরা তো আসতেই পারে। তখন মিস্টার লেনডুপ থিম্পুতে ছিলেন?’
‘না। সাহেব তখন আমেরিকায় ব্যবসার জন্যে গিয়েছিলেন।’
‘মিস্টার লেনডুপের ছেলে কি বন্ধুদের বাড়িতে রেখেছিল?’
‘না স্যার। ওরা হোটেল হিমালয়ে উঠেছিল।’
‘তুমি ওদের নিয়ে গাড়িতে ঘুরেছ?’
‘নাঃ। এলভিস নিজেই গাড়ি চালাত।’
‘এলভিস কে?’
হাসল জিগমে— ‘সাহেবের ছেলের ভুটানি নাম থাকলেও সে নিজের নাম এলভিস বলতেই পছন্দ করে।’ মাথা দুলিয়ে স্টিয়ারিংয়ে তবলা বাজাল সে, ‘এলভিস প্রিসলি।’
রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গেল। একটা পথ গিয়েছে পারো শহরে। ওরা থিম্পুর পথ ধরল। বরফে মোড়া পাহাড়ের চুড়োগুলো এখন বেশ কাছে। ঠান্ডাও বাড়ছে একটু একটু করে।
থিম্পু শহরে ঢুকল গাড়ি। সুন্দর সাজানো শহর। অর্জুন একটু অবাক হল। একটা রাস্তার মোড়ে গাড়ি থামলে সে দেখতে পেল কোনো ট্রাফিক লাইট নেই। পুলিশ হাত দেখিয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে। কোনো দেশের রাজধানীতে এই ব্যবস্থা মানে ট্রাফিকের চাপ কম।
গাড়ি থামল হোটেল হিমালয়ের সামনে। জিগমে বলল, ‘সাহেব আপনার থাকার ব্যবস্থা এখানেই করেছেন।’ বলল, ‘সুটকেসটা দিন।’
তিনতারা হোটেল হলেও বেশ কেতাদুরস্ত। রিসেপশনিস্ট বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই স্মোক করেন না?’
‘না।’
‘ভালো হল। আমাদের দুটো স্মোকিং রুম আছে কিন্তু সে দুটো অলরেডি অকুপায়েড। আপনার জন্যে মিস্টার লেনডূপের অনুরাধে হোটেলের সবচেয়ে ভালো ঘরের একটা রাখা হয়েছে।’
লোকটা উর্দি পরা বেয়ারাকে ইশারা করলে সে এগিয়ে এসে জিগমের হাত থেকে স্যুটকেস নিয়ে ইশারা করল অনুসরণ করতে। জিগমে বলল, ‘স্যার, আমি সাহেবের বাড়িতে যাচ্ছি। তা—ই অর্ডার আছে।’
তিনতারা হোটেলের ঘর যেমন হয় তার চেয়ে বোধ হয় একটু ভালো। বাথরুম তো বেশ বড়। ঠান্ডা যা তাতে এসি মেশিন চালু করার দরকার নেই। একটা ব্যালকনি আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে অর্জুন শহরের অনেকটা দেখতে পেল।
বেয়ারা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি ঘরে লাঞ্চ করবেন স্যার?
‘রেস্টুর্যান্ট আছে তো, সেখানেই যাব। লাঞ্চ টাইম কখন?
‘শুরু হয়ে গিয়েছে। আড়াইটের মধ্যে যাবেন স্যার।’
‘ঠিক আছে। আপনি এই হোটেলে কতদিন কাজ করছেন?’
‘তিন বছর। আমি আগে দিল্লির হোটেলে কাজ করেছি।’
‘ঠিক আছে।’ অর্জুন বলামাত্র ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল।
সে এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই মিস্টার লেনডুপের গলা শুনতে পেল— ‘গুড আফটারনুন মিস্টার অর্জুন। থিম্পুতে আসার জন্যে ধন্যবাদ। আশা করি কোনো অসুবিধে হয়নি।’
‘একটুও না।’
‘আপনি কতক্ষণ সময় নেবেন তৈরি হতে?’
‘আমি চাপসা থেকে তৈরি হয়েই বেরিয়েছি।’
‘ও গুড!’ মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘আজ যদি আমাদের বাড়িতে আপনি লাঞ্চ করেন তাহলে খুব খুশি হব। আমার স্ত্রীও চাইছেন!’
‘নিশ্চয়ই।’
‘তাহলে আমি জিমেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। শুনলাম, ওর সঙ্গে আপনার অনেক কথা হয়েছে। বেশি বলে কিন্তু ছেলেটা ভালো।’
জিগমে মিনিট কুড়ির মধ্যে অর্জুনকে মিস্টার লেনডুপের বাড়িতে পৌঁছে দিল। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে তাকিয়ে অর্জুন বুঝতে পারল, মিস্টার লেনডুপ শুধু ধনী মানুষ নন, তাঁর রুচিরও প্রশংসা করতে হয়।
মিস্টার লেনডুপ অপেক্ষা করছিলেন। অর্জুনকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, ‘আমরা একেবারে খাওয়ার টেবিলে চলে যাই। ঠিক সময়ে না খেলে আমার স্ত্রীর অ্যাসিডিটি হয়ে যায়।’
মাথা নাড়াল অর্জুন। ভদ্রলোক যে প্রচুর বড়লোক তা চারপাশের আসবাব দেখলেই বোঝা যায়। খাওয়ার ঘরের মাঝখানে তিনটে টেবিল। জোড়া দিলে তিরিশজন মানুষ আরামসে খেতে পারে।
একদম শেষের টেবিলে অর্জুনকে নিয়ে যেতেই মিসেস লেনডুপ ঘরে ঢুকলেন। মধ্যবয়সিনী মহিলা অত্যন্ত সুন্দরী কিন্তু অর্জুন অবাক হয়ে দেখল, ওঁর মুখে মঙ্গোলিয়ান ছাপ নেই। হাত জোড় করে বললেন, ‘নমস্কার, আপনি এসেছেন তাই আমি খুশি হয়েছি।’
পরিষ্কার বাংলায় কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা।
মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি অবাক হচ্ছেন। হ্যাঁ, আমার স্ত্রী বাঙালি।’
মিসেস লেনডুপ বললেন, ‘বসুন।’
তিনজনে বসার পরে মিস্টার লেনডুপ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লাঞ্চের আগে আপনি কি কোনো হার্ড ড্রিংক নেবেন?’
‘না।’ মাথা নাড়ল অর্জুন।
মিসেস লেনডুপ বললেন, ‘উনি জেমস বন্ড নন, ওঁর লাইটার রহস্য সমাধানের গল্প আমি পড়েছি। আমেরিকাতে গিয়েও ড্রিংক করেননি।’
খাওয়া আরম্ভ হল। মিস্টার লেনডুপ স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমিই বলো।’
ছোট টুকরো করে খাবার মুখে তুলছিলেন মিসেস লেনডুপ। বললেন, ‘আমার ছেলের ব্যাপারটা তো আপনি শুনেছেন। আমি যদি স্নেহে অত কাতর না হয়ে যেতাম, তাহলে ও এত বেপরোয়া হতে পারত না। দোষ আমারই।’
বলতে বলতে গলা ধরে এল মিসেস লেনডুপের। মিস্টার লেনডুপ একটা পেপার ন্যাপকিন এগিয়ে দিলেন।
তিরিশ সেকেন্ড পরে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘এলভিস কোথায় যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? কোনো ধারণা আছে?’
‘না। বিন্দুমাত্র না। সে এখানকার কোনো ছেলের সঙ্গে মিশত না। তবে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে যখন ফিরে আসত, তখন জিজ্ঞাসা করলে বলত, ইন্ডিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।’ মিসেস লেনডুপ শ্বাস ফেললেন।
‘ওর চেহারায় কি আপনার আদল বেশি?’
মিস্টার লেনডুপ জবাব দিলেন, ‘চোখ আমার মতো, পাহাড়ের মানুষদের যেমন হয় কিন্তু মুখ বিশেষ করে, নাক ওর মায়ের মতো। আমি ওর ছবি আপনাকে দেব।’
অর্জুন বলল, ‘ওর পাসপোর্ট কি বাড়িতেই আছে?’
‘না।’ মিসেস লেনডুপ মাথা নাড়লেন—’পাসপোর্ট নিয়ে গেছে।’
‘ইন্ডিয়ায় যেতে পাসপোর্ট—ভিসার দরকার হয় না। ও তো বেজিংয়ে পড়াশুনা করেছে। সেখানে চলে যায়নি তো?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘যতদূর জানি, ওর স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর এখন চিনা সরকার টুরিস্টদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ভিসা ইস্যু করে। মায়ের সঙ্গে ব্যাঙ্কে একটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। সেই অ্যাকাউন্টের প্রায় সব টাকা সে তুলে নিয়ে গেছে।’
‘কত টাকা?’
‘আঠাশ লক্ষ টাকা।’
হকচকিয়ে গেল অর্জুন। এত টাকা নিয়ে ওই অল্পবয়সি ছেলে কোথায় যেতে পারে? সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কি জানেন, ওর কোনো বান্ধবী আছে কিনা? থিম্পুতে না থাক, চিন বা ভারতে?’
মাথা নাড়লেন মিসেস লেনডুপ— ‘না। আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ করে না এলভিস। আমি জানি।’
খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। হাত—মুখ ধোয়ার পর অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘এলভিস নিশ্চয়ই এই বাড়িতেই থাকত?’
মিসেস লেনডুপ একটু প্রতিবাদের স্বরে বললেন, ‘থাকত বলছেন কেন? যে—কোনো মুহূর্তে ফিরে এলে সে এই বাড়িতেই থাকবে। এটা তো ওর নিজের বাড়ি।’
‘আই অ্যাম সরি!’ অর্জুন বিব্রত হল— ‘আমি কিছু না ভেবে বলেছি। এলভিসের ঘরে আমরা যেতে পারি?’
‘মুশকিলে ফেললেন।’ মিস্টার লেনডুপ বললেন।
‘কী রকম?’
‘সে চলে যাওয়ার সময় তার ঘরের দরজা লক করে গেছে। চাবি ওর কাছেই আছে। এই কয়মাস ঘর বন্ধ হয়েছে।’
‘সে কী! আপনারাও ওটা বন্ধ রেখেছেন?’
মিসেস লেনডুপ বললেন, ‘ওর ঘর খুললে রেগে যেতে পারে ভেবে খুলিনি। ছেলেবেলায় ওকে শিখিয়েছিলাম, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কৌতূহল দেখাবে না।’
‘ঠিক আছে। এমন তো হতে পারে, ওই ঘরে খোঁজ করলে জানতে পারতেন সে কোথায় গেছে! তাহলে এত দুশ্চিন্তা করতে হত না।’ অর্জুন বলল।
‘আমি সেটা ভেবেছিলাম।’ মিস্টার লেনডুপ বললেন।
‘আপনি যখন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, তখন এলভিসের বেডরুমটা আমি দেখতে চাই। হয়তো এমন কোনো ক্লু পাওয়া যাবে যা আমাকে সাহায্য করবে।’ অর্জুন বেশ জোরের সঙ্গে বলল কথাগুলো।
মিস্টার লেনডুপ তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন— ‘আমি মনে করি, উনি ঠিক কথা বলছেন। বেশ কয়েক মাস তো অপেক্ষা করলে, এখন দরজার তালা ভাঙাই যেতে পারে।’
ভদ্রমহিলা কোনো কথা বললেন না।
বাড়ির কাজের লোককে দায়িত্ব দেওয়া হল। বাইরে ঝোলানো তালা নয়, ল্যাচ কি! খুলতে অনেক কসরত করতে হচ্ছিল। শেষপর্যন্ত ভেঙে ফেলা ছাড়া উপায় থাকল না। ঘরের সবক’টা জানলা বন্ধ। দীর্ঘমাস হাওয়া না ঢোকায় গুমোট গন্ধ পাক খাচ্ছিল। জানলা খুলে পাখা চালিয়ে দেওয়ার পর ওঁরা ঘরে ঢুকলেন। অর্জুন দেখল, তিন দেওয়ালে তিনজন বিখ্যাত মানুষের বিশাল ছবি সাঁটা রয়েছে। মাও সে তুং, হো চি মিন এবং চে গুয়াভেরা। তিনজনের শরীরে সৈনিকের পোশাক।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার ছেলে কি রাজনীতি করত?’
মিস্টার লেনডুপ মাথা নাড়লেন— ‘জানি না। এদের ছবি যে সে এত পছন্দ করে, তাও তো জানা ছিল না।’
টেবিল এবং শেলফে অনেক বই। বেশিরভাগ ইংরেজি। কিছু চিনা বই রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটা চিনা ভাষা জানে। পোশাক ঝুলছে অনেকগুলো। ড্রয়ারে বেশ কয়েকটা দামি কলম এবং সিগারেটের প্যাকেট।
‘আপনার ছেলে দেখছি বিদেশি সিগারেট খেত।’ প্যাকেটটা তুলে দেখল অর্জুন। অর্ধেক খালি।
‘থিম্পুতে থাকতে খেত বলে মনে হয় না।’
‘তাহলে বেজিংয়ে গিয়ে শুরু করেছিল।’
মিস্টার লেনডুপ কথা বললেন না। প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রেখে বইয়ের আলমারিটা ভালো করে দেখল অর্জুন। সেই আলমারির মাঝখানের তাকে পেয়ে গেল লাল ডায়েরিটা। কয়েকটা পাতায় চোখ বুলিয়ে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা আমি একদিনের জন্যে হোটেলে নিয়ে যেতে চাই। আপত্তি আছে?’
এবার হাসলেন মিস্টার লেনডুপ— ‘একদম না। আমি চাই আপনি এলভিসকে খুঁজে বের করুন। ও আমার একমাত্র ছেলে।’
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার ছেলের ঘরে কোনো মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট দেখতে পাচ্ছি না। বাড়িতে কি গানের জন্যে আলাদা ঘর আছে?’
‘না। এই বাড়িতে কেউ গান—বাজনা করে না। তবে এলভিস খুব গান শুনত। পড়াশুনা করার সময় ছাড়া ওর কানে তার গোঁজা থাকত।’ মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘এই কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?’
‘যার নাম এলভিস সে গান—বাজনার সঙ্গে যুক্ত থাকবে না তা ভাবতে অসুবিধে হয়, তাই। হ্যাঁ, ও যেসব গান শুনত তার সিডিগুলো কোথায়?’
মিসেস লেনডুপ এতক্ষণ ছেলের বিছানার ওপর পাথরের মতো বসেছিলেন। এবার কথা বললেন, ‘ও কোথায় কী রেখে গেছে আমাকে বলে যায়নি।’
হোটেল হিমালয়ে ফিরে আসতে না আসতেই বৃষ্টি নামল। পাহাড়ে যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, তখন মনে হয় প্রলয় শুরু হয়ে গিয়েছে। ঘরের আলো জ্বেলে এই অপরাহ্নে ডায়েরিটা নিয়ে বসতেই অর্জুনের মনে এল জলপাইগুড়ির কথা তিস্তার চরের পাশে আচমকা যে বোমা বিস্ফোরণ হল, তার পুরো খবর জানা হয়নি। অমলদাকে যিনি জানিয়েছিলেন, তিনি কতটা নির্ভরযোগ্য তা কে জানে! অমলদাকেও এ ব্যাপারে কৌতূহলী মনে হল না।
নিজের মোবাইল অন করে হতাশ হল অর্জুন। কোনো নেটওয়ার্ক নেই। কিন্তু জলপাইগুড়ির কদমতলার জগুদার সঙ্গে একটু কথা বললে অনেক খবর জানা যাবে যা মায়ের পক্ষে বলা সম্ভব হবে না।
সে ঘর থেকেই হোটেলের অপারেটরকে ফোনে ধরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাকে ইন্ডিয়ার লাইন দেওয়া কি সম্ভব হবে?’
অপারেটর নাম্বার জিজ্ঞাসা করলে অর্জুন জলপাইগুড়ির কোড এবং টেলিফোন নাম্বার জানিয়ে দেওয়ার দশ সেকেন্ডের মধ্যেই রিং শুরু হল। আবার রিসিভার তুলতেই ওপাশে জগুদার গলা শোনা গেল— ‘হ্যালো! কে?’
‘জগুদা, আমি অর্জুন।’
‘আরে, তুমি কোথা থেকে, লং ডিসটেন্স মনে হচ্ছে!’
‘হ্যাঁ, আমি এখন থিম্পুতে। শুনলাম, জলপাইগুড়ির তিস্তার পাশে বোমা ফেটেছে। ওটা কেউ ইচ্ছে করে ফাটিয়েছে, না ফেটে গেছে?’
‘এটাও নিশ্চয়ই শুনেছ, চারজন মারা গিয়েছে। যারা ফাটিয়েছে, তারা যদি ইচ্ছে করে ফাটিয়ে থাকে, তাহলে নিজেরাই মারা যেত না। তাছাড়া অত শক্তিশালী বোমা আর্মি ছাড়া কারওর কাছে নেই।’
‘কিন্তু কেন, কী উদ্দেশ্যে ওরা এসেছিল?’
‘বোঝা যাচ্ছে না। উচ্চচপর্যায়ের তদন্ত চলছে।’
‘যে—চারজন মারা গিয়েছে, তারা কি শহরের ছেলে?’
‘না। অন্তত এখনও পর্যন্ত কেউ ক্লেম করেনি। দু’জনের মুখ উড়ে যাওয়ায় আইডেন্টিফাই করা সহজ হবে না। তবে, পোশাক এবং জুতো দেখে পুলিশের মনে হয়েছে, ওরা বেশ ধনী পরিবারের ছেলে। আমি জলপাইগুড়ির ওসির কাছে জানতে পারলাম।’ জগুদা বললেন।
‘এরা চারজনেই বাঙালি’?
‘তাই—বা বলি কী করে! ওসি বুঝতে পারছেন না এদের পরিচয়। যে—বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হয়, সেখানে ওরা যে ছিল তা কেউ টের পায়নি। মনে হয়, আগের দিন ওরা ওখানে আশ্রয় নিয়েছিল।’
‘আর কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি?’
‘এখনও পর্যন্ত নয়। তবে, একজনের পকেটে চাইনিজ সিগারেট ছিল।’
‘সে কী! কী সিগারেট, প্যাকেটে কী নাম লেখা ছিল খোঁজ নেবেন?’
‘ওসি নামটা বলেছেন। বেশ মজা লেগেছে শুনে? সিগারেটের প্যাকেটের নাম যে চাইনিজ ওয়াল হতে পারে ভাবিনি, কবে ফিরছ?’
‘এখনও ঠিক নেই। গিয়ে দেখা করব। রাখছি।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল অর্জুন। না, এই প্যাকেটের কোথাও কোনো ইংরেজি শব্দ ছাপা নেই। যা লেখা তা চিনা ভাষায় লিখেছে। অতএব এটা যে ‘চাইনিজ ওয়াল’ সিগারেট তা বলা যাচ্ছে না। অর্জুনের মনে হল, এটা আলাদা কোম্পানির তৈরি সিগারেট যা সম্ভবত চিন ভূখণ্ডেই বিক্রি হয়! প্যাকেটের ওপর তাই ইংরেজিতে লেখার প্রয়োজন হয়নি। ইংরেজিতে লেখা ‘চাইনিজ ওয়াল’ সিগারেট সম্ভবত বিদেশে বিক্রি হয়। সিঙ্গাপুর, তাইল্যান্ড ইত্যাদি জায়গার সঙ্গে ভারতের পূর্বাঞ্চলেও চলে আসে প্যাকেটগুলো। এলভিসের ঘরে পাওয়া চিনে সিগারেটের প্যাকেটের সঙ্গে বোমা বিস্ফোরণে নিহত যুবকের পকেটে পাওয়া সিগারেট মিলে গেল না। মিলে গেলে সমস্যাটা অনেক সহজ হয়ে যেত।
ডায়েরিটা নিয়ে বসল অর্জুন। বেশিরভাগই ইংরেজিতে লেখা। কিছু পাতা চিনে ভাষায়। বোঝাই যায়, এলভিস ভাষাটায় তেমন স্বচ্ছন্দ ছিল না। ইংরেজি লেখাটা যত চোস্ত হাতে লেখা, চিনা শব্দগুলো লিখেছিল আড়ষ্ট হাতে। কিন্তু ইংরেজি লিখতে লিখতে আচমকা চিনা ভাষা লিখল কেন? অচেনা ভাষা পড়া যখন যাবে না, তখন ইংরেজিতে চোখ রাখল অর্জুন। মাও সে তুঙের লংমার্চের কথা লিখেছে সে। কীভাবে চিনের মানুষ সেই দীর্ঘ যাত্রাপথে এক হয়ে গিয়েছিল, অনেক প্রতিবন্ধকতা সামনে এলেও তারা হার মানেনি, তা লিখতে লিখতে মন্তব্য করে গিয়েছে এলভিস।
আর একটি পাতায় সে প্রশ্ন তুলেছে। বুদ্ধদেব যখন বৌদ্ধ ধর্ম বা যিশু যখন খ্রিস্ট ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন, তখন পৃথিবীর অবস্থা কীরকম ছিল তার বর্ণনা লিখেছে সে। সেই সময়ের মানুষ তাদের জীবনযাত্রার ধরন, তাদের অস্তিত্বের আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। তাহলে সেই সময়ের মানুষের জন্যে তৈরি ধর্মভাবনা এখানকার মানুষের ক্ষেত্রে কী করে প্রযোজ্য হবে? সে লিখেছে, ওইসব মেকি ধর্ম এখনই বাতিল করে দেওয়া উচিত। কিছু লোক গোটা পৃথিবীর মানুষকে বোকা বানিয়ে ওইসব ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেরা মহাআরামে আছে। এদের মুখোশ খুলে দেওয়া উচিত।
অর্জুনের মনে হল, এই যুবক নানান কারণে নিশ্চয়ই খুব ক্ষুব্ধ ছিল। ছেলের মনের এই অবস্থা তার বাবা—মা নিশ্চয়ই জানতেন না।
আর একটি পাতায় চোখ রাখতেই সোজা হয়ে বসল অর্জুন। এলভিস লিখেছে— ‘নিজের জন্মের ওপর মানুষের কোনো হাত থাকে না। জ্ঞান হওয়ার পর সে বুঝতে পারে কোন পরিবারে সে জন্মেছে! যেমন আমি। মিস্টার লেনডুপ আমার জন্মদাতা। এব্যাপারে আমার তো কিছু করার ছিল না। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর আমি দেখলাম, ওই ভদ্রলোক টাকা ছাড়া কিছু চেনেন না। আরও টাকার জন্যে তিনি দেশ ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। কোন দেশ? না আমেরিকা। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বুর্জোয়া দেশ যারা গরিব দেশগুলোকে মানুষ বলে মনে করে না। সেই দেশের মানুষের চাটুকারিতা করে মিস্টার লেনডুপ কোটি কোটি টাকা রোজগার করছেন। প্রশ্ন হল, সেই টাকা নিয়ে তিনি কী করছেন? ভুটানের হাজার হাজার শিশু দু’বেলা খাবার পায় না। কত মানুষ চিকিৎসা করাতে পারে না পয়সার অভাবে। মিস্টার লেনডুপ টাকার পাহাড়ের স্বপ্ন পূর্ণ করতে আমেরিকায় বছরের বেশিরভাগ সময় পড়ে থাকেন, অথচ তার দশ শতাংশ গরিব মানুষদের বাঁচার জন্যে সাহায্য করেন না। এই লোকের টাকায় আমি বড় হয়েছি, আমার পড়াশুনার খরচ এই লোকটা দিয়েছে তা ভাবলেই!’
এই অবধি লেখার পর বাকি পাতা সাদা রেখে দিয়েছিল এলভিস। অর্জুনের মনে হচ্ছিল, এই ছেলেটার মনে যে—জ্বালা ছিল, তা ওর বাবা—মা টের পাননি। বাংলায় প্রবাদ আছে, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। কিন্তু মাস্টার লেনডুপকে দৈত্য বলে মনে হয়নি তার।
বাইরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। অর্জুনের ইচ্ছে হল এক কাপ চা খেতে। রিসিভার তুলে রুমসার্ভিসকে চায়ের অর্ডার দিল সে।
যে—বেয়ারা তাকে এই ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল সে—ই চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। জিজ্ঞাসা করল চা তৈরি করে দিতে হবে কিনা? অর্জুন মাথা নাড়লে লোকটা যত্ন করে চা বানাতে লাগল।
অর্জুন কথা বলল, ‘আমি যাঁর গেস্ট হয়ে এখানে আছি সেই মিস্টার লেনডুপের ছেলে এলভিসকে কি তুমি দেখেছ?’
মাথা নেড়ে লোকটা বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। মিস্টার এলভিস এই হোটেলকে খুব পছন্দ করতেন।’
‘কীরকম?’
‘যখন থিম্পুতে থাকতেন, তখন মাঝে মাঝে এই হোটেলে দু’দিন থেকে যেতেন।’ চায়ের কাপ এগিয়ে দিল লোকটা।
‘তাই? হোটেলে থাকতেন কেন? ওঁর বাড়ি তো এখানেই।’
‘বড়লোকের ছেলের তো অনেক রকমের খেয়াল হয়। হোটেলে থাকার সময় তিনি বই পড়তেন আর ঘুমাতেন।’
‘বাঃ, বেশ শখ তো! কয়েক মাস আগে ওঁর কয়েকজন বিদেশি বন্ধু থিম্পুতে এসেছিল। তারা কি এই হোটেলেই উঠেছিল?’
‘হ্যাঁ।’ হাসি ফুটল লোকটার ঠোঁটে— ‘হ্যাঁ। মিস্টার এলভিসের তিনজন চিনা বন্ধু এসেছিল। ওরা হিন্দি দূরের কথা, ইংরেজিও জানত না। মিস্টার এলভিস দোভাষীর কাজ না করলে আমরা খুব অসুবিধায় পড়তাম।’
‘মিস্টার এলভিস কি তখন বাড়ি থেকে আসা—যাওয়া করতেন?’
‘না—না। তিনি তখন এই হোটেলেই থেকে গিয়েছিলেন।’
‘ওঁর বন্ধুরা কেমন ব্যবহার করেছিল?’
‘ভালোই। ওদের সঙ্গে একটা গ্রুপ ফোটো তুলেছিলাম।’
‘বাঃ। ছবিটা আছে?’ অর্জুন চায়ে চুমুক দিল।
‘নিশ্চয়ই। আমার একজন বন্ধু হোটেলে দেখা করতে এসেছিল। তার মোবাইলে তুলে দিয়েছিল। পরে প্রিন্ট করে কপি দিয়েছে আমাকে।’
‘সেই ছবি আপনার কাছে আছে?’
‘নিশ্চয়ই। মিস্টার এলভিস ছবির একটা কপি চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি যখন কপি হাতে পেলাম, তখন থেকে তিনি থিম্পুর বাইরে চলে গিয়েছেন। আর আসেননি।’ বেয়ারা বলল।
‘আপনি কি ছবিটা আমাকে দেখাতে পারবেন।’
‘আপনি দেখতে চাইছেন। বেশ। দেখাব।’
চায়ের ট্রে নিয়ে লোকটা চলে গেল।
হোটেলের ঘর থেকে বেরুবার প্রশ্ন নেই, অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যে মিস্টার লেনডুপের ফোন এল—’কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?’
‘বৃষ্টিতে বেরুতে পারছি না, এইটুকুই।’
‘ওটা আমার হাতে নেই।’
‘আচ্ছা, আপনার ছেলের তিন বন্ধু এই হোটেলে ক’দিন থেকেছিল। তাদের হোটেলের বিল কি আপনি দিয়েছিলেন?’
‘আমি তখন বিদেশে ছিলাম। ফিরে এসে শুনেছি। হ্যাঁ, বিল আমাব স্ত্রী পে করেছিলেন। ভেবেছিলেন, ছেলে তার বিদেশি বন্ধুদের তো বাড়িতেও তুলতে পারত। তা না করে হোটেলে রেখে বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। তাই বিল পে করে দিয়েছিলেন। কেন বলুন তো?’
‘সেসময় এলভিস বন্ধুদের সঙ্গে এই হোটেলেই ছিল।’
‘তাই নাকি? আমি তো জানি না।’
‘শুধু তা—ই নয়, মাঝে মাঝে, আপনার অনুপস্থিতির সময় সে এই হোটেলে দু’তিনদিন থেকে যেত।’ অর্জুন জানাল।
একটু চুপ করে থেকে মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘এই ব্যাপারগুলো আমার কাছে কখনওই বলেননি আমার স্ত্রী। যাক গে, আজ রাত্রে আপনি কি বাইরে ডিনার করতে আগ্রহী?’
‘না—না বৃষ্টি পড়ছে। এখানেই যা হোক কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ব।’
‘যদি দরকার হয় তাহলে আমাকে জানাবেন। গুডনাইট।’
অর্জুন গুডনাইট বলার আগেই লাইন কেটে দিলেন মিস্টার লেনডুপ।
রাত ন’টা নাগাদ পোশাক বদলে হোটেলের ডাইনিং রুমে এল অর্জুন। বেশ বড় হলঘর। চারটে চেয়ার এক টেবিলে যার অধিকাংশই এখন খালি। সম্ভবত বৃষ্টির কারণেই বাইরে থেকে কেউ খেতে আসতে পারেনি। অর্জুন দেখল যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাই বিদেশি, ভারতীয়রাই সংখ্যায় বেশি।
কোণের দিকের টেবিলের চেয়ার টেনে বসল সে। বেয়ারা মেনু কার্ড দিয়ে গেলে সে দেখল ভারতীয় খাবারই বেশি। বিশেষ করে, পাঞ্জাবি খাবার। চিকেন আর তন্দুরি রুটির অর্ডার দিয়ে সে চারপাশে তাকাল কিন্তু পরিচিত বেয়ারার দেখা পেল না। সম্ভবত লোকটার কাজের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে অথবা তার ডিউটি এখন এই ডাইনিং রুমে নয়।
যে—ভুটানি ছেলেটি খাবার নিয়ে এল সে বেশ হাসিখুশি। অর্জুন তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাই, আমি একজন বেয়ারাকে খুঁজছি যে আমাকে হোটেলের ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। তার নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি। শুধু সে বলেছে আগে দিল্লির হোটেলে চাকরি করেছে। এরকম কাউকে কি বুঝতে পারছ?’
ছেলেটা চট করে চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘খুব খারাপ খবর স্যার। ওর চাকরি চলে গিয়েছে।’
‘সে কী? কেন?’ অবাক হয়ে গেল অর্জুন।
‘আমি বলতে পারব না।’ ছেলেটি খাবার টেবিলে সাজিয়ে চলে গেল।
অর্জুনের মাথায় ব্যাপারটা ঢুকছিল না। লোকটাকে বেশ দক্ষ কাজের মানুষ, বলেই মনে হয়েছে তার। এরকম একজনকে হোটেল কর্তৃপক্ষ কেন আচমকা সরিয়ে দেবে? বেয়ারারা যেসব অপরাধের জন্যে চাকরি খোয়ায় সেসব অপরাধ ওই অভিজ্ঞ লোকটি কেন করবে? আর তার প্রশ্নের জবাবে এই হাসিখুশি বেয়ারার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল এবং কিছু বলতে পারবে না বলে চলে গেল, এটাও তো স্বাভাবিক নয়।
খাওয়া শেষ হলে সেই বেয়ারা এল সই করাতে। অর্জুন সই করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ডিউটি শেষ হবে কখন?’
‘সকাল ছ’টায়।’
‘আমি হোটেলের সামনে তোমার জন্যে দাঁড়াব।’
বেয়ারা কোনো কথা না বলে তার কাজ শুরু করলে অর্জুন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল।
ঘরে এসে ভাল করে তাকাল অর্জুন। না, কোনো ক্যামেরা চোখে পড়ল না। হোটেলের ঘরে গোপনে ক্যামেরা রাখা সৌজন্যের বিরোধী। টেবিল ল্যাম্প, খাটের নীচে, দরজায় পর্দার পাশে নজর দিয়ে অর্জুন হাসল। ছবি তোলা সৌজন্যবিরোধী হতে পারে কিন্তু এই ঘরে যা শব্দ হবে তা বাইরে রেকর্ড করার ব্যবস্থা করলে তাকে কী বলা যেতে পারে?
অর্জুন মনে করার চেষ্টা করল। এই ঘরে আসার পর সে দু’জনের সঙ্গে কথা বলেছে। এক, ওই বেয়ারাটির সঙ্গে, দুই, টেলিফোনে জগুদার সঙ্গে। নিশ্চয়ই সেইসব কথা রেকর্ডেড হয়েছে। কেন? হোটেলের কর্তৃপক্ষের কি ইন্টারেস্ট হবে তার কথাবার্তা সংরক্ষণ করায়? বেয়ারার সঙ্গে কথা বলার সময় সে মিস্টার লেনডুপ এবং এলভিসের প্রসঙ্গ এনেছিল। এলভিস ও তার চিনে বন্ধুদের কথায় বেয়ারা তাকে এমন কোনো তথ্য দেয়নি যা তৃতীয় ব্যক্তিকে রুষ্ট করতে পারে!
জলপাইগুড়ির জগুদার সঙ্গে কথা বলার সময় সে বোমা বিস্ফোরণের ব্যাপারটা জানতে চেয়েছিল। জগুদা যেটুকু জেনেছিলেন সেটুকুই বলেছিলেন। কিন্তু সেই কারণে বেয়ারার চাকরি চলে যাবে কেন?
ফোন বাজল। রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই মিস্টার লেনডুপের গলা কানে এল, ‘ডিনার হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ। খুব ভালো খাবার। এই হোটেলে ব্যবস্থা করার জন্যে ধন্যবাদ।’
‘শুনে খুশি হলাম। বাই দ্য বাই, ছেলের ডায়েরি থেকে কিছু জানতে পারলেন? ওর মা খুব অধৈর্য হয়ে পড়েছেন।’
‘না না। ওঁকে বলুন সব ঠিক হয়ে যাবে। ভিনসেন্ট খুব ভালো ছাত্র ছিল। ডায়েরি পড়লে বোঝা যায় একথা।’
‘কিন্তু কোথায় যেতে পারে সে?’
‘দেখুন, ওর বয়সের ছেলেরা অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালোবাসে। অজানাকে জানতে চায়। তার জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছুপা হয় না। কিন্তু একা একা তো অ্যাডভেঞ্চার করা যায় না। সমস্যা এখানেই। আপনারা বলেছেন থিম্পুতে এলভিসের কোনো বন্ধু ছিল না। তাহলে কাদের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে যাবে।’
‘আপনি ভুল করছেন মিস্টার অর্জুন। আমার ছেলে খুব নরম প্রকৃতির। ছেলেবেলায় প্রজাপতি দেখে ভয় পেত। একবার একটা নিরীহ পিঁপড়ে ওর হাতে ওঠায় ঘণ্টাখানেক ধরে কেঁদেছিল। ওর পক্ষে অ্যাডভেঞ্চারের কষ্ট সহ্য করা সম্ভব নয়।’ মিস্টার লেনডুপ একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন। ‘আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, কতদিন লাগবে ওকে খুঁজে বের করতে?’
‘এর উত্তর এই মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব নয়। আপনি আপনাদের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ঠিক আছে, গুড নাইট।’ মিস্টার লেনডুপ যেন হতাশ হয়েই লাইন কেটে দিলেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকল অর্জুনের কাছে। সে আজই প্রথম থিম্পু শহরে এসেছে। আট ঘণ্টাও কাটেনি। অথচ এর মধ্যেই মিস্টার লেনডুপ এত অধৈর্য হয়ে পড়লেন কেন? সে বিছানায় চলে এল। এতক্ষণ যেসব কথা হল তা নিশ্চয়ই হোটেল কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছে যাবে। কোনো বিরূপ কথা বলেনি সে। তাই রাতটা নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারবে।
ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল অর্জুনের। জানলার পর্দা ফাঁক করে দেখল বাইরে বৃষ্টি পড়ছে না কিন্তু আকাশ মেঘলা। ধীরে—সুস্থে তৈরি হয়ে নিল সে। নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। ছায়ায় মোড়া চওড়া রাস্তা, একটাও মানুষ চোখে পড়ল না। সে অপেক্ষা করল।
আলোর তেজ বাড়ল না কিন্তু একটু একটু করে পথে মানুষ, গাড়ি দেখা গেল। হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল একটা বেকারির ভ্যান। তা থেকে নানা সাইজের প্যাকেট নামিয়ে ঢোকাচ্ছিল ভ্যানের লোকেরা। অর্জুন বুঝতে পারল, হোটেলের দরজা খুলে গিয়েছে। সে ঘরে ঢুকে জুতো পরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে প্যাসেজ দিয়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে নামতে চোখ বোলাল চারদিকে। ভিজিটর দূরের কথা, কোনো বেয়ারাকেও দেখা যাচ্ছে না। না গেলেও অর্জুন জানে ক্লোজ সার্কিট টিভি ক্যামেরা সর্বত্র চোখ রাখছে।
রিসেপশনিস্ট তাকে দেখে হাসল, ‘মর্নিং ওয়াক?’
মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল অর্জুন।
রিসেপশনিস্ট বলল, ‘আপনি সোজা ক্লক টাওয়ারের দিকে চলে যান। রাস্তাটা ভালো। এখন তো একদম ফাঁকা পাবেন।’
‘ধন্যবাদ।’ বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল অর্জুন।
কিন্তু কয়েক পা হেঁটে একটা বড় বাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে সে হোটেলের সামনেটা নজরে রাখল। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, রেস্টুরেন্টের সেই হাসিমুখের ছেলেটাকে সধারণ শার্ট—প্যান্টে বেরিয়ে আসতে দেখল সে। যেখানে অর্জুন দাঁড়িয়ে সে পথ ধরে হেঁটে আসছে ছেলেটা। ছেলেটা তাকে লক্ষ করেনি দেখে অর্জুন ডাকল না। খানিকটা এগিয়ে যেতে দিয়ে সে ছেলেটাকে অনুসরণ করল। আপনমনে হেঁটে যাচ্ছিল ছেলেটা। হঠাৎ রাস্তার একপাশ দিয়ে নেমে যাওয়া সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে লাগল। অনেকটা নীচের পথে নেমে ছেলেটা যখন হাঁটছে, তখন দ্রুত পা চালিয়ে অর্জুন ওর পাশে চলে এল।
যেন ভূত দেখল ছেলেটা— ‘আপ?’
‘মর্নিং ওয়াক।’ অর্জুন হাসল।
ছেলেটা সতর্ক চোখে পেছনে তাকিয়ে নিল। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘কোনো অন্যায় কাজ না করে কিছু রোজগার করতে চাইলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।’
‘কীরকম?’
‘আমি তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তুমি যা সত্যি তা—ই বলবে!’
ছেলেটা মাথা নাড়ল— ‘আমার মা বলত, সবসময় সৎপথে রোজগার করতে।’
‘গুড। যে—বেয়ারার চাকরি কাল চলে গেছে, তা কেন গেল তুমি বলতে পারবে না বলেছিলে। কেন ভয় পেয়েছিলে?’
‘ঝামেলার ভয়ে।’
‘কীসের ঝামেলা?’
‘আমাদের এব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করা হয়েছে।’
‘ওই বেয়ারার নাম কী?’
‘পদম।’
‘নিশ্চয়ই পদম চুরিচামারি করেছিল!’
‘একদম না। ও খুব সৎমানুষ।’
‘বিশ্বাস করি না। সৎমানুষ হলে চাকরি যাবে কেন?’
‘আমি জানি না।’
‘পদম থাকে কোথায়?’
‘চ্যাঙলানের ওপাশে।’
‘জায়গাটা এখান থেকে কতদূরে?’
‘আধঘণ্টা হাঁটতে হবে।’
‘আমি তোমাকে পাঁচশো টাকা দিতে পারি যদি ওর বাড়ি দেখিয়ে দাও।’
‘ওর বাড়িতে আপনি কেন যাবেন?’
‘পদমের কাছে একটা ছবি আছে। তিনজন চিনা যুবকের সঙ্গে এখানকার একজন ভুটানি যুবকের ছবি। ওটা দেখতে চাই।’
‘হায়!’ অদ্ভুত গলায় আওয়াজ করল ছেলেটি।
‘কী হল?’
‘ওই ভুটানি ছেলের নাম কি এলভিস?’
‘হ্যাঁ। কেন?’
‘সাহেব, আমাকে আপনি যেতে দিন। আমি টাকা চাই না।’
‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’
‘হোটেলের কেউ যদি আপনার সঙ্গে আমাকে দেখতে পায় তাহলে চাকরি চলে যাবে। বোধ হয় পদম আপনাকে ছবি দিতে চেয়েছিল, তাই ওর চাকরি গেল।’
‘এলভিসের ছবি যদি পদম আমাকে দেয় তাহলে অপরাধ কোথায়?’
‘আমি জানি না সাহেব।’
‘তুমি জানো কিন্তু বলতে চাইছ না।’
‘ঠিক আছে! চলুন। আমি দূর থেকে দেখিয়ে দেব পদম কোথায় থাকে কিন্তু কাছে যাব না।’ হাঁটতে শুরু করল ছেলেটি।
প্রায় চল্লিশ মিনিট হাঁটল ওরা। চ্যাঙলান ব্যবসাকেন্দ্র। সেটা ছাড়িয়ে বস্তি মতন জায়গায় এসে ছেলেটি বলল, ‘সাহেব, ওই বস্তিতে পদম থাকে। নাম বললেই দেখিয়ে দেবে সবাই।’
অর্জুন পকেট থেকে পার্স বের করে পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে ধরতেই ছেলেটি মাথা নাড়ল— ‘না সাহেব, আমি অসৎ পথে টাকা নেব না।’
‘তার মানে?’
‘আমি তো আপনাকে সত্যি কথা বলিনি।’ বলেই ছেলেটা হনহনিয়ে পেছনে হেঁটে গেল। এরকম ছেলে বোধ হয় ভুটান ছাড়া অন্য কোথাও বেশি নেই, অর্জুনের মনে হল।
বস্তির সামনে এক বৃদ্ধ কুকুর নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পরনে ভুটানি পোশাক। অর্জুন তাকে নমস্কার করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, পদম কোথায় থাকে?’
‘এখানেই থাকত; আজ এখানে নেই।’ নিরাসক্ত গলায় বৃদ্ধ বললেন।
‘কোথায় গেলে ওকে পাওয়া যাবে?’
‘হাসপাতালে।’ বৃদ্ধ কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে বস্তির ভেতর ঢুকে গেলেন।
কাল যে—লোকটা স্বাভাবিকভাবে তার সঙ্গে কথা বলল তার চাকরি চলে গেল এবং এখন তার ঠিকানা হাসপাতাল। ঘটনার আকস্মিকতায় অর্জুন হতভম্ব হয়ে গেল। কিন্তু লোকটা নিশ্চয়ই একা থাকত না। তার সংসারে যারা আছে তাদের সঙ্গে তো সে কথা বলতে পারে। কিন্তু কী পরিচয় দিয়ে কথা বলবে?
অর্জুন দেখল, একটা বাচ্চচা মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে একটি যুবক বস্তি থেকে বেরিয়ে আসছে। অর্জুন তাকে হাতজোড় করে নমস্কার জানাতেই সেও ফিরিয়ে দিল।
‘আপনার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে পারি?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘আমি দিল্লিতে থাকি।’ অর্জুন কথা বানাল— ‘ওখানে একজন ভুটানি ভদ্রলোক, যিনি হোটেলে কাজ করতেন, তাঁর সঙ্গে ভালো পরিচয় হয়েছিল, উনি বলেছিলেন থিম্পুতে এলে দেখা করতে। এখানকার ঠিকানা দিয়েছিলেন, ওঁর নাম পদম। আপনি ওঁকে চেনেন?’
‘হ্যাঁ। কাল ওর খুব জোর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ভাগ্য ভালো ছিল তাই বেঁচে গেছে।’
‘কী অ্যাক্সিডেন্ট?’
‘গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল।’
‘কোন হাসপাতালে আছেন?’
যুবক তাকে হাসপাতালের হদিশ দিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল।
এখন সকাল সাড়ে সাতটা। তবু খোঁজ নিতে হাসপাতালে পৌঁছে গেল অর্জুন। এই সময় যেমন হয়, বাইরের লোকেদের ভেতরে ঢোকা যেমন নিষেধ, তেমনই ভেতরের খবর বাইরের লোকদের জানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। অর্জুন প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর দেখতে পেল, একজন বাঙালি ভদ্রমহিলা হাসপাতালে ঢুকছেন। ভঙ্গিতে মনে হল, হয় ইনি হাসপাতালের নার্স অথবা ডাক্তার। সে এগিয়ে গিয়ে নমস্কার করল, ‘আপনার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে পারি?’
‘হ্যাঁ, বলুন।’ পরিষ্কার বাংলায় বললেন ভদ্রমহিলা।
‘আমি উত্তরবাংলার জলপাইগুড়ি শহরে থাকি। গতকাল আমার একজন পরিচিত মানুষ দুর্ঘটনায় পড়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হতে অনেক দেরি আছে। তিনি কেমন আছেন তা যদি দয়া করে আমাকে জানান তাহলে—’ অর্জুন কথা শেষ করল না।
‘কী নাম?’
‘পদম। ও বাঙালি নয়।’
‘আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন।’ ভদ্রমহিলা ভেতরে পা বাড়ালে দারোয়ান তাঁকে সেলাম জানাল। অর্জুনের মনে হল, এই মহিলা কোনো সাধারণ কর্মচারী নন। নাহলে দারোয়ান ওভাবে সোজা হয়ে সেলাম করত না।
মিনিট কুড়ি পরে একটি লোক ভেতর থেকে বেরিয়ে চারপাশে দেখতে দেখতে অর্জুনের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’
‘জলপাইগুড়ি।’
‘আমার সঙ্গে আসুন। ম্যাডাম ডেকেছেন।’
অর্জুন লোকটিকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকে হাসপাতালের দোতলায় উঠে যে—ঘরের সামনে পৌঁছল, তার দরজার পাশের বোর্ডে লেখা রয়েছে— ডক্টর আই রায়? পর্দা সরিয়ে লোকটা তাকে ভেতরে যাওয়ার জন্যে ইশারা করল।
ভদ্রমহিলা, যাঁর নাম ডক্টর রায় তখন ফোনে কথা বলছিলেন, ইশারায় উলটো দিকের চেয়ারে বসতে বললেন। কথা শেষ করে ভদ্রমহিলা অর্জুনের দিকে তাকালেন— ‘আপনার নামটা জানতে পারি?’
‘আমি অর্জুন।’
ভদ্রমহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল— ‘আপনি নিশ্চয়ই সেই অর্জুন নন, যিনি জলপাইগুড়ির মতন মফসসল শহরে থেকেও রহস্যসন্ধান করে যাচ্ছেন, একের পর এক। ওঁর অনেক অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি আমি পড়েছি। যাক গে, এই পদম লোকটি আপনার খুব পরিচিত?’
‘না। গতকালই এখানকার হোটেল হিমালয়ে পরিচয় হয়েছিল। ওর কাছে একটা ছবি আছে যা আমাকে দেবে বলে কথা দিয়েছিল।’
‘কিছু মনে করবেন না, ও কি ওখানে চাকরি করে?’
‘করত। বেয়ারার চাকরি। কালই চাকরিটা চলে গিয়েছে।’
‘অর্জুন, আমি খুব দুঃখের সঙ্গে বলছি, লোকটা আজ ভোরবেলায় মারা গিয়েছে। হেড ইনজুরি। এবং সেটা ইচ্ছাকৃত। পুলিশ একবার এসে ঘুরে গেছে। এখনই এখানকার অফিসার ইনচার্জ হাসপাতালে আসবেন।’
‘মারা গিয়েছে?’ হতাশ গলায় বলল অর্জুন— ‘বেচারা।’
‘হ্যাঁ। ওর ইনজুরি দেখে মনে হয়েছে এটা একটা খুনের কেস।’
‘অনেক ধন্যবাদ আমাকে খবরটা দেওয়ার জন্যে, আচ্ছা—’
অর্জুন উঠে দাঁড়াতেই ডক্টর রায় বললেন, ‘প্লিজ, একটু বসুন। আপনি বলেছিলেন পদম আপনাকে কোনো ছবি দিতে চেয়েছিল!’
‘হ্যাঁ।’
‘কিছু মনে করবেন না। আপনি কি হোটেল হিমালয়ে উঠেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর কালই যে—বেয়ারার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল সে কেন আপনাকে ছবি দিতে যাবে? ছবি মানে ফোটোগ্রাফ না পেন্টিং?
‘ফোটোগ্রাফ!’ অর্জুন হাসল।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডক্টর রায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, আপনি জলপাইগুড়ির কোন পাড়ায় থাকেন?’
‘কদমতলায়।’
‘তার মানে আপনি কি সেই অর্জুন যার কাহিনি আমি পড়েছি?’
‘বোধহয়।’ অর্জুন হাসল।
‘আরে সর্বনাশ।’ করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন ডক্টর রায়। তারপর হাসিমুখে বললেন, ‘জরুরি কোনো কাজ না থাকলে বসুন না।’
অর্জুন আবার বসল। কিন্তু তখনই বাইরে থেকে গলা ভেসে এল— ‘আসতে পারি?’
‘আসুন, আসুন। ডক্টর রায় অর্জুনকে বললেন, ‘অফিসার এসে গেছেন।’
যে—ভদ্রলোক ঘরে এলেন, তাঁকে আপ্যায়ন করে বসতে বললেন ডক্টর রায়। তারপর বললেন, ‘ইনি পুলিশের বড়কর্তা, মিস্টার ওয়াংচু। আর এঁর নাম অর্জুন। বিখ্যাত ডিটেকটিভ।’
অর্জুন হাত মিলিয়ে বলল, ‘একটু ভুল হল, আমি ডিটেকটিভ নই, সত্যসন্ধান করি।’
‘আই সি।’ ওয়াংচু বললেন, ‘থিম্পুতে কি বেড়াতে এসেছেন?’
‘না। ঠিক বেড়াতে নয়। মিস্টার লেনডুপ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ছেলের খোঁজ করার জন্যে। তাকে চার—পাঁচ মাস ধরে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘আই সি। ব্যাপারটা আমরা জানি। ছেলেটা চিনে যাতায়াত করত, সেখানেই পড়াশুনা করেছিল। আমার ধারণা সে সেখানেই চলে গিয়েছে। আপনি থিম্পুতে কতদিন হল এসেছেন?’
‘গতকাল দুপুরে এসেছি।’
‘নিশ্চয়ই হোটেল হিমালয়ে উঠেছেন?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি বললেন কী করে?’
‘বাঃ। ওই হোটেলের অন্যতম শেয়ার হোল্ডার হলেন মিস্টার লেনডুপ। তাই আপনাকে উনি নিজের হোটেলেই তো রাখবেন।’ মিস্টার ওয়াংচু ডক্টর রায়ের দিকে তাকালেন— ‘ডক্টর, পদমের পোস্টমর্টেম কবে হবে? এটা যখন মার্ডার কেস, তখন এ নিয়ে হইচই হবেই।’
ডক্টর রায় বললেন, ‘আশা করি, দুপুরের মধ্যে রিপোর্ট পেয়ে যাব।’
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘অ্যাক্সিডেন্ট কীভাবে হয়েছিল?’
‘লোকটা হেঁটে আসছিল। পেছন থেকে গাড়ি ওকে ধাক্কা দেয়। লোকটা ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। গাড়ির যেখানে ওঠার কথা নয়।’
‘গাড়িটাকে ধরা সম্ভব হয়েছে?’
‘না। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। রাস্তার লোক ছিল না। পদম ছাতার তলায় হাঁটছিল। ইচ্ছাকৃত খুন।’
‘কেন?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
‘প্রশ্নটা সহজ কিন্তু উত্তরটা বেশিরভাগ সময় খুঁজে পাওয়া যায় না।’
মিস্টার ওয়াংচু কথা শেষ করতেই ডক্টর রায় বললেন, ‘অর্জুন কালই পদমের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।’
‘আই সি! হ্যাঁ, পদম তো হোটেল হিমালয়ে কাজ করত। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে জিজ্ঞাসা করব, কীরকম কথা হয়েছিল?’
‘স্বাভাবিক কথা। পদম ঘরে চা সার্ভ করতে এসেছিল। কথা প্রসঙ্গে মিস্টার লেনডুপের ছেলে এলভিসের কথা বলি। তখন পদম বলে, এলভিস তার তিনজন চিনা বন্ধুদের সঙ্গে হোটেল হিমালয়ে একসময় থেকে গিয়েছে। পদম ওদের সঙ্গে ছবি তুলেছিল। আমি সেই ছবি দেখতে চেয়েছিলাম। সে দেখাবে বলে কথা দিয়েছিল। রাত্রে শুনতে পেলাম, পদমের চাকরি গিয়েছে। আজ সকালে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারলাম, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। পদম মারা গিয়েছে শুনে খুব খারাপ লাগছে।’
মাথা নাড়লেন মিস্টার ওয়াংচু। তারপর ডক্টর রায়কে বললেন, ‘ডক্টর, আমি একবার পদমের ডেডবডি দেখতে চাই!’
‘সিয়োর।’ বলে ডক্টর রায় ফোনের রিসিভার তুলে কাউকে নির্দেশ দিয়ে বেল বাজালেন। যে—লোকটি অর্জুনকে ওই ঘরে নিয়ে গিয়েছিল সে চলে এল সঙ্গে সঙ্গে। ডক্টর রায় বললেন, ‘আমাকে একটা জরুরি মিটিংয়ে যেতে হবে। আমি যদি সঙ্গে না যাই—’
‘ইটস ওকে। এই লোকটি নিয়ে যাবে তো? ঠিক আছে। তাহলে চলি ডক্টর রায়।’ বলে মিস্টার ওয়াংচু অর্জুনের দিকে তাকালেন— ‘আপনি যদি ইচ্ছে করেন তাহলে আসতে পারেন। অবশ্য মৃত মানুষকে দেখতে ইচ্ছে না হওয়া স্বাভাবিক।’
‘না। আমি তা মনে করি না। চলুন। নমস্কার ডক্টর রায়।’ অর্জুন বলল।
যে—ঘরে পদমের শরীর রাখা হয়েছে সেখানে আর কোনো মৃতদেহ ছিল না। লোকটি সেখানে ওদের নিয়ে এলে ঘরের দায়িত্বে যে ছিল সে এগিয়ে এসে মিস্টার ওয়াংচুকে সেলাম জানিয়ে পদমের ঊর্ধ্বাঙ্গের সাদা কাপড় সরিয়ে দিল। মাথার অনেকটাই ব্যান্ডেজে মোড়া। ডান দিকের হাত থেঁতলে গেছে, খানিকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘রাস্তার বাঁ দিক ধরে হাঁটছিল লোকটা। গাড়ি ফুটপাতে উঠে এসে ওর ডান দিকটা স্ম্যাশ করেছে। মিস্টার অর্জুন, আপনার আর কিছু দেখার আছে?’
‘না।’
‘চলুন।’
হাসপাতালের বাইরে এসে অর্জুন মিস্টার ওয়াংচুকে বলল, ‘আমি একবার পদমের বাড়িতে যেতে চাই। ওর বাড়ির লোক বলতে পারলেও পারে কোনো শত্রু ছিল কিনা?’
‘পদমের বাড়িতে কেউ নেই। বস্তির একটা ঘরে একাই থাকত। কিন্তু লোকটা বিবাহিত, বউ থাকে দিল্লিতে। সেখানেই চাকরি করে। এই খবর আমরা পেয়ে গেছি।’ বলে হাসলেন মিস্টার ওয়াংচু— ‘তাছাড়া পদমের মার্ডার কেস নিয়ে আপনার তো আগ্রহ থাকার কথা নয়। আপনার ক্লায়েন্ট মিস্টার লেনডুপ, যিনি আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর ছেলে এলভিস লেনডুপকে খুঁজে বের করতে। তাই না?’
‘ঠিক কথা? কিন্তু আমার মনে হচ্ছে পদমের মৃত্যুর সঙ্গে এলভিসের কোনো—না—কোনো যোগাযোগ আছে।’ অর্জুন বলল।
‘সেটা তো জানার উপায় নেই। মৃত মানুষ কথা বলে না।’
‘কিন্তু আমরা যাকে জড়পদার্থ বলি তা অনেকসময় কথা বলে।’
‘আপনি কি সেরকম কিছুর সন্ধানে ওর বাড়িতে যেতে চাইছেন?’
‘হ্যাঁ, অবশ্য আপনি যদি সাহায্য করেন!’
একটু ভাবলেন মিস্টার ওয়াংচু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি এখানে হোটেলের গাড়িতে এসেছেন?’
‘না। আমি হেঁটে এসেছি।’
পদম যে—বস্তিতে থাকত তারা বোধ হয় পুলিশের গাড়ি চেনে। তাই মিস্টার ওয়াংচুর গাড়ি দেখে নির্লিপ্তভঙ্গিতে সরে দাঁড়াল। অর্জুন বুঝতে পারল, বস্তির মানুষ পুলিশকে এড়িয়ে চলে। মিস্টার ওয়াংচুকে দেখে একজন সেপাই এগিয়ে এসে সেলাম করল। তাকে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক’জন ডিউটিতে আছ?’
‘দু’জন স্যার।’
‘হুঁ। কেউ ঘরে ঢুকতে চেয়েছিল?’
‘একজন এসেছিল। ওর ভাইপো, আমরা ঢুকতে দিইনি।’
‘সে যে ভাইপো তা জানলে কী করে?’
‘ছেলেটা নিজেই বলল।’
‘বস্তির লোকজন ওকে ভাইপো হিসেবে জানে?’
লোকটা মুখ নিচু করল— ‘জিজ্ঞাসা করা হয়নি স্যার।’
পদমের ঘরের সামনে দাঁড়ানো দ্বিতীয় সেপাই সোজা হয়ে সেলাম জানাল। অর্জুন দেখল, শুধু পদমের ঘর নয়, আশপাশের ঘরের দরজাও বন্ধ। জলপাইগুড়ির কোনো পাড়ায় খুন হয়ে যাওয়া মানুষের বাড়িতে পুলিশ এলে কৌতূহলীদের সামলানো মুশকিল হয়। এখানে ঠিক তার উলটো। পুলিশ দরজার তালা আগেই খুলেছিল। ওয়াংচুর পেছনে অর্জুন ভেতরে ঢুকল। আট বাই বারো ঘরে একটা তক্তাপোশ, বাঁ দিকে রান্নার সরঞ্জাম, দুটো ছোট আলমারি আর একটা মিটকেস। এই ছিল পদমের সংসার। ছোট আলমারির একটার মাথায় ফ্রেমে বাঁধানো মহিলার ছবি। অনুমানে বোঝা গেল, ইনিই পদমের স্ত্রী।
মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘কী দেখতে চাইছেন, দেখুন!’
অর্জুন কাচের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল। ভেতরে বেশ কিছু জামা—প্যান্ট ভাঁজ করে রাখা। আলমারির গায়ে তালা নেই। ওটা খুলে দেখতে গিয়ে বড় খামটার ওপর চোখ পড়ল। খামের ভেতর পদমের ব্যক্তিগত কাগজপত্র, চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার থেকে জীবনবিমার কাগজ। শেষপর্যন্ত একটা ছোট অ্যালবামের সন্ধান পেল। কিন্তু তার ভেতরে পদমের বাল্যকালের ছবিগুলো রয়েছে। অ্যালবাম রাখতে যেতেই কার্ডটা চোখে পড়ল— ফোটো ওয়র্ল্ড, থিম্পু। কী মনে হতে কার্ডটা তুলে নিল অর্জুন। মিস্টার ওয়াংচু তখন তার দিকে তাকিয়ে।
‘ওটা কার কার্ড?’ মিস্টার ওয়াংচু জিজ্ঞাসা করলেন।
‘ফোটো ওয়র্ল্ড নামের একটি দোকানের।’
‘ছোট ফোটোর দোকান। চ্যাঙলানে। ওটা কী দরকার?’
অর্জুন বলল, ‘বাংলায় একটা ছড়া আছে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দ্যাখো তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্যরতন।’
‘পেলে খুশি হব। এবার যেতে হবে।’ বাইরে বেরিয়ে মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘আমি আমার রিপোর্টে আপনার কথা লিখব না। আপনি যে সঙ্গে এসেছিলেন তা জানাবার দরকার মনে করছি না। দয়া করে আপনিও কাউকে একথা বলবেন না!’
‘কাউকে বলতে আপনি কি মিস্টার লেনডুপের কথা বলছেন?’
মিস্টার ওয়াংচু জবাব না দিয়ে কাঁধ নাচালেন। তারপর পুলিশের গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলেন।
একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে ঢুকে টোস্ট—ওমলেট আর চা খেয়ে নিল অর্জুন। কয়েকটা কথা তার মাথায় জট পাকাচ্ছিল। হোটেল হিমালয়ের অন্যতম অংশীদার যে মিস্টার লেনডুপ, তা তাকে জানানো হয়নি। হয়তো এটা বড়লোকের বিনয়। কিন্তু সেই হোটেলেই এলভিস তার চিনে বন্ধুদের নিয়ে কয়েকদিন থেকেছে, এটা কী করে সম্ভব? এলভিস তার বাবার বিরুদ্ধে যাবতীয় ঘৃণা তার ডায়েরির পাতায় উগরে দিয়েছে। যে—বাবাকে সে বুর্জোয়া বলে মনে করে, তার হোটেলে সে কেন চিনে বন্ধুদের নিয়ে থাকল? ওই হোটেলের দুটো ঘরের দৈনিক ভাড়া কম নয়। সেটা কে দিয়েছিল? এলভিসের মা জানেন, হোটেলটার মালিকানায় তাঁর স্বামীর ভাগ আছে। তিনি কেন টাকা দিতে যাবেন? চিনে ছেলেরা কি দিয়েছিল? যদি না দিয়ে থাকে, যদি আদৌ কোনো পেমেন্ট না দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে এলভিসের সততা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবেই। সে কি মায়ের প্রশ্রয় পেয়ে বাবাকে ব্যবহার করেছিল?
দ্বিতীয় ভাবনাটা স্রেফ অনুমানের ওপর নির্ভর করে মাথায় এল। মিস্টার ওয়াংচু যেন তাকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, তাকে মিস্টার লেনডুপ দায়িত্ব দিয়েছেন এলভিসকে খুঁজে বের করতে, পদমের মৃত্যুরহস্য সমাধান করতে নয়। মিস্টার ওয়াংচুর কথার ভঙ্গিতে মনে হয়েছিল তিনি মিস্টার লেনডুপকে চটাতে চাইছেন না। কেন? মিস্টার লেনডুপ একজন ধনী ব্যবসায়ী, থিম্পুর রাজনৈতিক মহলে ভদ্রলোক ক্ষমতাবান, তা অর্জুনের অবশ্য জানা নেই। কিন্তু পুলিশের একজন বড়কর্তা তাঁকে এত সমীহ করবেন কেন?
এখন সকাল দশটা বেজে গিয়েছে। চ্যাঙলান একটি কমার্শিয়াল এলাকা। দোকানপাট, অফিস খুলে গিয়েছে, ফোটো ওয়র্ল্ড খুঁজে বের করতে বেশি পরিশ্রম করতে হল না। সাধারণ ফোটোর দোকান; এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন— ‘টুরিস্ট? ছবি তুলবেন?’
মাথা নাড়ল অর্জুন— ‘না। আপনি কি দোকানের মালিক?’
বৃদ্ধ হাসলেন— ‘মালিক থেকে চাকর, আমিই সব কিছু।’
‘আপনি হোটেল হিমালয়ে চাকরি করত একজন যার নাম পদম, তাকে মনে করতে পারছেন?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ওর বউয়ের ছবি তো আমি এনলার্জ করে বাঁধিয়ে দিয়েছি। আপনি পদমের কাছ থেকে আসছেন?’
‘হ্যাঁ, পদম কি আপনাকে ওর মোবাইলে তোলা কোনো ছবি প্রিন্ট করতে দিয়েছিল?’
বৃদ্ধ মনে করার চেষ্টা করলেন— ‘হতে পারে? অনেকেই তো দেয়।’
‘সেই ছবিতে তিনজন চিনে ছেলে ছিল।’
হঠাৎ বৃদ্ধের মুখের চেহারা বদলে গেল— ‘আপনি জানলেন কী করে?’
‘পদমই বলেছে।’
‘ও। তাহলে তো এটাও বলেছে, সেই ছবি একটা লোক এসে পদমের নাম করে নিয়ে গেছে, যাকে পদম পাঠায়নি আমার কাছে।’ বৃদ্ধ বললেন।
‘সে কী?’ অবাক হল অর্জুন।
‘সামান্য একটা ছবি যে কেউ মিথ্যে বলে নিয়ে যেতে পারে, তার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। পরে পদম যখন এসে শুনল, তখন সে—ও অবাক হয়ে গেল। যদিও মোবাইলটা আমার কাছেই ছিল বলে আমি আবার পদমকে প্রিন্ট বের করে দিয়েছিলাম—’ বৃদ্ধ বললেন।
‘যে—লোকটি মিথ্যে বলে নিয়ে গিয়েছিল সে কি এখানকার মানুষ?’
‘বোধ হয়, তার মুখ মনে নেই। তবে ভুটানিতেই কথা বলছিল। কিন্তু আপনি আমাকে এসব জিজ্ঞাসা করছেন কেন?’
‘কারণ সেই ছবি পদমের কাছে নেই। আপনার কাছে কি এক্সট্রা কপি আছে?’
‘না, নেই।’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।
‘কোনোভাবে কি অন্তত দেখানো যায় না। আমি কপি চাই না, কিন্তু শুধু দেখার জন্যে দু’শো টাকা দিতে রাজি আছি।’ অর্জুন বলল।
‘কী আশ্চর্য! ছবিটা তো আপনি পদমের কাছে গেলেও দেখতে পাবেন।’
মৃত্যুর খবরটা দিতে গিয়েও সামলে নিল অর্জুন। বলল, ‘পদম থাকলে সমস্যা হত না, ও এখন থিম্পুতে নেই।’
‘ও। একটু অপেক্ষা করুন, খুঁজে দেখতে হবে। বউনির সময়ে দু’শো টাকা দিতে চাইছেন, না বলা ঠিক নয়। একটু অপেক্ষা করুন।’ বৃদ্ধ ভেতরে চলে গেলেন। অর্জুন রাস্তার দিকে তাকাল। বেশ শান্ত পরিবেশ। তাহলে পদম জানত, ওই ছবি তার নাম করে কেউ বা কারা নিয়ে গিয়েছে কিন্তু একথা তাকে বলেনি সে। অবশ্য বলার কোনো কারণ ছিল না। ছবিটা কার দরকার হতে পারে? যে নিয়েছে সে মোবাইলের চিপস রেখে যাবে কেন? নাকি শুধু দেখতে চেয়েছিল ছবিটায় কী আছে!’
বৃদ্ধ ফিরে এল— ‘দুটো ছবি তোলা হয়েছিল। যেটা ভালো সেটাই পদম নিয়ে গিয়েছে। একটু আউট অফ ফোকাস প্রিন্টটা আমার পুরনো ছবির প্যাকেটে পড়েছিল। দেখুন, এতে যদি আপনার কাজ হয়!’
একটা না—ছাঁটা ছবি এগিয়ে দিল বৃদ্ধ। সামান্য নড়লেও ছবিটা বোঝা যাচ্ছে। তিনটে চিনা ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এলভিস। ওর বাবা যে ভুটানের মানুষ তার ছাপ ছেলেটির মুখে বিন্দুমাত্র নেই।
পার্স খুলে দুটো একশো টাকার নোট এগিয়ে দিল অর্জুন। টাকা নিয়ে বৃদ্ধ বলল, ‘ছবিটা ইচ্ছে করলে রাখতে পারেন। প্যাকেট ভর্তি হয়ে গেলে তো ফেলেই দিতাম।’
ধন্যবাদ জানিয়ে ছবি নিয়ে রাস্তায় নামল অর্জুন।
হোটেলে পৌঁছে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকল অর্জুন। তারপর ছবিটা সামনে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। এলভিসের বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপরে ওটা কী? অনেকক্ষণ লক্ষ করে অর্জুনের মনে হল, ওটা বেশ বড়সড় জড়ুল। ছবিতে বেশ কালচে দেখাচ্ছে। চিনে ছেলেগুলোর কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই, চিনেরা যেমন হয়, তেমনই।
অর্জুন উঠে বসে রিসিভার তুলে অপারেটরকে বলল মিস্টার লেনডুপকে ফোনে ধরতে। আধ মিনিট পরে মিস্টার লেনডুপের গলা কানে এল— ‘ইয়েস, মিস্টার অর্জুন, গুড মর্নিং, বলুন কী করতে পারি?’
‘আপনাকে জানানো হয়নি, এলভিসের একটা ছবি আমার দরকার!’
‘কেন?’
‘যাকে খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছেন, তার চেহারা না জানলে খুঁজব কী করে?’
‘তা অবশ্য। কিন্তু ওর এখনকার চেহারার কোনো ছবি আছে কিনা আমি জানি না। বাড়িতে এলভিসের শৈশব এবং বাল্যকালের অনেক ছবি আছে।’
‘পাসপোর্ট ভিসার জন্যে ছবি তুলতে নিশ্চয়ই হয়েছিল। আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই খবর রাখেন।’ অর্জুন বলল।
‘ঠিক আছে। আমি দেখছি। পেলে পাঠিয়ে দেব। আর হ্যাঁ, আমাকে এখনই পারো শহরে যেতে হচ্ছে, সারাদিন দেখা হবে না।’
‘ঠিক আছে। আমিও একবার মিস্টার অমল সোমের কাছে যেতে পারি।’
‘বেশ তো। আমি জিগমেকে বলে দিচ্ছি। হোটেলের অপারেটরকে বললে সে জিগমেকে ডেকে দেবে, আর কিছু?’
‘না। ধন্যবাদ।’
‘বাই দ্য ওয়ে, আপনি কতটা এগিয়েছেন?’
প্রশ্ন শুনে অর্জুন ইচ্ছে করেই সশব্দে হাসল— ‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? সময় এলে আমিই আপনাকে জানাব।’
ঘণ্টাখানেক পরে দরজায় শব্দ হল। অর্জুন দরজা খুলতেই একজন বেয়ারা সেলাম করে খামটা দিয়ে চলে গেল। খাম থেকে ছবি বের হল। এলভিসের ছবি। বছর পনেরো—ষোলো বছরের এলভিস। সরল চোখে সামনে তাকিয়ে আছে। বাঁ হাতের কনুইটা যেন ইচ্ছে করেই পেছনে রেখে ছবি তোলা হয়েছে। ফলে বাঁ হাতের কনুই ক্যামেরায় ধরা পড়েনি আর সেইজন্যে জুড়ুলটাকে দেখা যাচ্ছে না।
অর্জুন হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু এলোমেলো হাঁটল। সে যখন বুঝতে পারল, তাকে কেউ অনুসরণ করছে না, তখন একটা টেলিফোন বুথে ঢুকে ভারতে ফোন করতে চাইল। ছোট দুটো খোপ। তার একটায় ঢুকে জিরো নাইন ওয়ান ঘুরিয়ে জলপাইগুড়ির কোড নাম্বার এল, ফোন নাম্বার ডায়াল করতেই জগুদার ফোন জানান দিল।
জগুদা সাড়া দিলেন—’হ্যালো।’
‘আমি অর্জুন বলছি।’
‘হ্যাঁ, বল।’
‘বোমা বিস্ফোরণের কিনারা হল?’
‘নাঃ। যে—ছেলে চারটে মারা গিয়েছে, তাদের পুলিশ এখনও আইডেন্টিফাই করতে পারেনি। অবশ্য এখন লোকাল পুলিশ নয়, তদন্ত হাতে নিয়েছে আইএনআই।’
‘যে—ছেলেটার পকেটে চাইনিজ সিগারেট পাওয়া গিয়েছে তাকে কীরকম দেখতে বলতে পারবেন?’
প্রশ্ন করামাত্র লাইন কেটে গেল। কয়েকবার হ্যালো বলার পর রিসিভার নামিয়ে রাখল অর্জুন। বুথের লোকটা বলল, ‘একশো আশি টাকা হয়ে গেছে। আবার ফোন করবেন?’
‘হ্যাঁ।’ অর্জুন রিসিভার তুলল। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও জগুদার গলা শুনতে পেল না। অদ্ভুত সব আওয়াজ ভেসে এল।
বুথের লোকটা বলল, ‘পাচ্ছেন না? ইন্ডিয়ার ফোন সবসময় গোলমাল করে। আপনি চিন কিংবা আমেরিকায় ফোন করুন, সঙ্গে সঙ্গে লাইন পেয়ে যাবেন।’
একশো আশি টাকা খরচ হল কিন্তু কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। অর্জুন হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভাবল একবার অমল সোমের সঙ্গে দেখা করা দরকার। যে—সন্দেহটা মনে পাক খাচ্ছে সেটা তো ভুল হতে পারে। আর সঠিক হলে তার এক মুহূর্ত ভুটানে থাকা নিরাপদ নয়। এ বিষয়ে অমল সোমের মতামত জানা তার কাছে খুব জরুরি।
রিসেপশনিস্ট হাসল। হেসে বলল, ‘পুলিশ আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল।’
‘আমার জন্যে?’ অর্জুন অবাক হল— ‘কেন? কিছু বলেছে?’
‘না না, এটা রুটিন ডিউটি। আসলে আমরা আমাদের ক্লায়েন্টদের নিরাপত্তার ব্যাপারটায় খুব গুরুত্ব দিই। কারওর কোনো অসুবিধে বা গোলমাল হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।’
‘আমার তো কোনো অসুবিধে বা গোলমাল হয়নি।’ অর্জুন বলল।
‘না হলে খুব ভালো। কিন্তু হতে পারে আশঙ্কা করে, আমরা পুলিশকে খবর দিয়েছি। একজন বেয়ারা হঠাৎ দেখতে পায় আপনার ঘরের দরজা খোলা রয়েছে। কেউ তো দরজা খুলে রেখে বাইরে যায় না। আপনি ঘরের চাবি সঙ্গে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলেন; তাহলে দরজা খোলা কেন? পুলিশ এসে চেক করেছে কিন্তু ঘর লন্ডভন্ড করে যায়নি কেউ। কিন্তু কোনো কিছু চুরি গেলে একমাত্র আপনি জানতে পারবেন। তাই ওরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিল। যদি আপনার মনে হয় কিছু চুরি গিয়েছে তাহলে ওদের জানালে ব্যবস্থা নেবে।’ কথাগুলো বলে রিসেপশনিস্ট হাসল— ‘হোটেল হিমালয়ে আজ পর্যন্ত চুরি হয়নি। আশা করি, আপনার সব জিনিস ঠিকঠাক আছে।’
দ্রুত ঘরে চলে এল অর্জুন। ঘরের দরজা বন্ধ। সম্ভবত হোটেল থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলল সে। চারদিকে কোনো গোলমাল চোখে পড়ল না। তার সুটকেসও যেমন ছিল তেমনই রয়ে গিয়েছে। ওটা খুলে বুঝল, কেউ ভিতরে হাত দেয়নি। তাহলে দরজা খোলা ছিল কেন? কী করেই—বা খুলল। সে দরজাটা যে বন্ধ করেই বেরিয়েছিল তা স্পষ্ট মনে আছে।
বিছানা—বালিশ ঠিকঠাক রয়েছে, হঠাৎ মনে আসতেই সে খুঁজতে আরম্ভ করল। ডায়েরিটা, এলভিসের ডায়েরিটাকে দেখতে পাচ্ছে না সে। ওটা বালিশের পাশেই রাখা ছিল। আর সেই ডায়েরির মধ্যে ‘ফোটো ওয়র্ল্ড’ থেকে নিয়ে আসা এলভিসদের গ্রুপ ফোটোর কপি রাখা ছিল। সেটাও নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে মিস্টার লেনডুপের পাঠানো ছবিসুদ্ধ খামটা।
আরও একটু খুঁজে দেখল অর্জুন। আর কোনো সন্দেহ নেই যে এই ঘরের দরজা কেন খোলা হয়েছিল।
ঘরের ফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলতেই সে শুনল, ‘রিসেপশন থেকে বলছি স্যার। সব ঠিক আছে তো?’
হাসল অর্জুন— ‘সব ঠিক আছে। আমার কিছুই খোয়া যায়নি।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল সে।
ক্রমশ সরল হয়ে যাচ্ছে সমস্যা। তার কাছে এলভিসের ডায়েরি রয়েছে এটা মিস্টার লেনডুপ জানেন, বাইরের কারওর এটা জানার কথা নয়। ডায়েরিটা তার কাছে থাকুক এটা যে চায় না, সে কী করে খবরটা পেল? যাকে পাঠানো হয়েছিল সে কি শুধু ডায়েরির জন্যে এসেছিল না, ফোটো ওয়র্ল্ড—এর গ্রুপ ছবিটাও লক্ষ্যে ছিল? সে ছবিটা যে সংগ্রহ করেছিল, তা ওই দোকানের বৃদ্ধ মালিক কি কাউকে জানিয়েছিলেন? নাকি সেই দোকান থেকে তাকে অনুসরণ করে এই হোটেলে কেউ এসেছিল? কেন আসবে? সবশেষে হোটেলের ঘরের দরজার চাবি একটা ক্লায়েন্টের কাছে অন্যটা রিসেপশনে থাকে। তাহলে যে দরজা খুলেছিল সে চাবি কোথায় পেল? তা না হলে দরজা খুলল কী করে?
অর্জুন রিসিভার তুলল। অপারেটরকে বলল, ‘মিস্টার লেনডুপের ড্রাইভার জিগমেকে দয়া করে ফোন করে হোটেলে আসতে বলবেন?’
‘সিয়োর স্যার!’
‘আর একটা কথা, আপনাদের হোটেলের প্রতিটি ঘরে কি সাউন্ড রেকর্ড করার ব্যবস্থা আছে?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
একটু সময় নিয়ে অপারেটর বলল, ‘উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, স্যার।’
আধঘণ্টা পরে রিসেপশন থেকে জানানো হল, গাড়ি এসে গিয়েছে। তৈরি ছিল অর্জুন। স্যুটকেস নিয়ে নীচে নেমে চাবি ফেরত দিয়ে বলল, ‘মিস্টার লেনডুপের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে।’
‘ওকে স্যার।’
হোটেলের বাইরে গাড়ির সামনে জিগমে অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখে হাত নেড়ে হাসল সে। ঠিক তখনই পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে। গাড়ি থেকে নামলেন মিস্টার ওয়াংচু। সুটকেস জিগমের হাতে দিয়ে অর্জুন এগিয়ে গেল, ‘কী ব্যাপার? আপনি!’
‘শুনলাম, হোটেলে আপনার ঘর থেকে কিছুই চুরি যায়নি।’
অর্জুন হাসল, ‘এর মধ্যে খবর পেয়ে গেছেন?’
মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে আমরা সব খবর পেয়েছি। আপনি পুলিশের সঙ্গে সবসময় সহযোগিতা করেছেন। আমাদের বড়কর্তার ইন্ডিয়ান কাউন্টার পার্ট আপনার খুব প্রশংসা করেছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর হোটেলের বেয়ারা পদম খুন হয়েছিল। আবার আজ সকালে পদমের ঘর থেকে কার্ড নিয়ে ফোটোর দোকানে গিয়েছিলেন আপনি। কিন্তু সেখান থেকে আপনি চলে আসার পর ওই বৃদ্ধ খুন হয়েছেন।’
কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না অর্জুন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, আপনি দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পরেও বৃদ্ধ দোকানদার সুস্থ ছিলেন। দু’জন কাস্টমারের সঙ্গে কথাও বলেছেন। একটা ফোন করেছেন অর্থাৎ, ওঁর সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছি না।’
‘কীভাবে মারা গিয়েছেন উনি?’
‘কেউ খুব কাছ থেকে গুলি করেছিল। সম্ভবত সাইলেন্সার লাগানো ছিল বলে কেউ শব্দ শুনতে পায়নি।’ মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘হয়তো ব্যাপারটা একদম কাকতালীয় কিন্তু কয়েকঘণ্টার মধ্যে থিম্পুতে দুটো মানুষ খুন হয়ে গেল এবং সেই দুটো লোক খুন হল আপনার সঙ্গে কথা বলার পরে। এব্যাপারের পেছনে কি কোনো কারণ থাকতে পারে মিস্টার অর্জুন?’ মিস্টার ওয়াংচু জিজ্ঞাসা করলেন।
অর্জুন মানুষটির দিকে তাকাল। খুশি না হলে বা রেগে না গেলে পাহাড়ি মানুষের মনের কথা সহজে বোঝা যায় না। সে বলল, ‘পদমের কাছে এলভিস এবং তার তিনজন চিনে বন্ধুর ছবি ছিল। এলভিসের এখনকার চেহারা কেন, কোনো কালের চেহারাই আমি জানতাম না। অনুরোধ করায় আজ মিস্টার লেনডুপ ছেলের অল্প বয়সের ছবি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি পদমকে অনুরোধ করেছিলাম তার কাছে
যে—ছবিটা আছে সেটা দেখাতে। সে রাজি হয়েছিল। হয়তো সে কারণেই—’
‘আপনার সঙ্গে পদমের কথা বলার সময় আর কেউ ছিল?’
‘না। তবে এই হোটেলের ঘরে আপনি সামান্য শব্দ করলেই সেটা কোনো ঘরে রেকর্ডেড হয়ে যায়।’
‘আচ্ছা! সিসিটিভির কথা জানি, এটা তো শুনিনি। তাহলে সেই ছবির কপি বৃদ্ধের দোকান থেকে আনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু পেয়েছিলেন কি? বৃদ্ধ কি দিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। তবে রাফ কপি, আনকাট। সেটাই হয়তো ওঁর অপরাধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ছবিও হোটেলের ঘর থেকে চুরি হয়েছে।’
‘আচ্ছা! শুধু এই ছবিটাই চুরি হয়ে গেল?’
‘না। এলভিসের লেখা একটা ডায়েরি আমি মিস্টার লেনডুপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম। ছবির সঙ্গে সেটাও চুরি হয়ে গিয়েছে।’
মাথা নাড়লেন মিস্টার ওয়াংচু, ‘আপনি যে—কাজের দায়িত্ব নিয়ে থিম্পুতে এসেছিলেন, সেটা মনে হচ্ছে কিছুটা গুলিয়ে যাচ্ছে!’
‘হ্যাঁ। তা তো বটেই। আমাকে কেউ, খুব প্রভাবশালী কেউ, একদম পছন্দ করছেন না। তাই যাঁরা আমাকে সাহায্য করছেন, তাঁদের সরিয়ে দিচ্ছেন। বিনাদোষে কেন এঁদের খুন করা হল বুঝতে পারছি না।’ অর্জুন বলল।
‘খুনগুলো করা হয়েছে আপনাকে সতর্ক করার জন্যে। তাতে যদি আপনি সতর্ক না হন তাহলে শেষ আঘাতটা আপনার ওপর আসাই স্বাভাবিক। মিস্টার অর্জুন, আমার মনে হচ্ছে, আপনি অন্তত কয়েকদিনের জন্যে থিম্পুর বাইরে চলে যান। আপনার নিজের নিরাপত্তার জন্যেই যাওয়া উচিত।’ কথাগুলো বলে মিস্টার ওয়াংচু তাঁর গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ি চলে গেলে অর্জুন জিগমের গাড়িতে উঠল। জিগমে জিজ্ঞাসা করল, ‘পুলিশ সাহেব কি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছিল?’
অর্জুন হাসল, ‘উনি ভয় দেখাবেন কেন?’
জিগমে গাড়ি চালু করে বলল, ‘পুলিশের কাজ তো ওটাই।’
মিস্টার ওয়াংচুকে কতটা বিশ্বাস করা যায়? তাঁর শহরে দু’দুটো খুন হয়ে গেল অথচ তিনি যেন খুনিকে ধরতে খুব উৎসাহিত নন। বরং নির্লিপ্ত মনে হচ্ছে। অর্জুন থিম্পুর বাইরে চলে গেলে যেন স্বস্তি পাবেন ভদ্রলোক।
হোটেল হিমালয়ের ঘরে ঘরে শব্দ রেকর্ড করার ব্যবস্থা আছে জেনেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না ভদ্রলোক। সিসিটিভির প্রসঙ্গ তুলে ব্যাপারটাকে হালকা করলেন। যদি রেকর্ড করার প্রক্রিয়া কয়েক মাস ধরে চালু থাকে তাহলে এলভিস এবং তার চিনে বন্ধুরা যে—ঘরে থেকে কথা বলেছে, তাও রেকর্ডেড হয়ে আছে। অর্জুন চাইলে হোটেল ম্যানেজার অবশ্যই সহযোগিতা করত না কিন্তু মিস্টার ওয়াংচু তাঁর পদাধিকার বলে চাইলে সেটা অবশ্যই পেতেন। সেই কথাবার্তার রেকর্ড থেকে হয়তো এমন তথ্য পাওয়া যেত যা এলভিসের ব্যাপারে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যেত। মিস্টার ওয়াংচুকে ওই অনুরোধ করতে গিয়েও করেনি সে। লোকটা যদি সৎমানুষ হয় তাহলে প্রভাবশালীরা বিরক্ত হবে, বিপদে পড়বেন তিনি। আর যদি সৎ না হয় তাহলে অর্জুনের বিপদ বাড়বে।
জিগমে গাড়ি চালাচ্ছিল চুপচাপ। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি মিস্টার ওয়াংচুকে পছন্দ করো না, না?’
‘আমার পছন্দ—অপছন্দে কার কী যায় আসে!’ জিগমে উদাস।
‘মনে হচ্ছে আজ তোমার মুড ভালো নেই!’ অর্জুন বলল।
‘কী করে ভালো থাকবে? আমার দাদার শ্বশুরকে আজ খুন করা হয়েছে। লোকটার কোনো দোষ ছিল না। কারওর মনে হল ওকে খুন করা দরকার, তাই খুন হয়ে গেল? আজব দুনিয়া।’ চে�চিয়ে কথাগুলো বলল জিগমে।
‘তোমার দাদার শ্বশুরের কি ফোটোর দোকান ছিল?’
গাড়ি চালাতে চালাতে চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে অর্জুনকে দেখে নিয়ে জিগমে বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন!’
অর্জুন কথা বলল না। জিগমে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আপনি কি পুলিশে কাজ করেন?’
‘না। একদম না। একটু আগে মিস্টার ওয়াংচুর কাছে শুনছিলাম।’
‘ও, তাই বলুন।’
‘আচ্ছা জিগমে, থিম্পুতে চাইনিজ সিগারেট পাওয়া যায়?’
‘যায় স্যার।’
‘মিস্টার লেনডুপের ছেলে এলভিস কি সিগারেট খেত?’
‘ওই বয়সের বেশিরভাগ ছেলেই সিগারেট খায়। এখন একটু কমে এসেছে। তবে এলভিসকে কয়েকবার সিগারেট খেতে দেখেছি।’
‘ভুটানের রাজার পিসির বাংলোর গেটের সামনে একটা বাইসন দাঁড়িয়েছিল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বিদুৎগতিতে চলে গেল, পাশের জঙ্গলে। জিগমে বলল, ‘স্যার, আমাদের কপাল ভালো, না হলে ভরদুপুরে বাইসনের দেখা পেতাম না।’
‘বাইসনের সঙ্গে কপালের কী সম্পর্ক?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
‘হাজার বছর আগে একজন গরিব মানুষ অভাব সহ্য করতে না পেরে পাহাড়ি ঝরনার পাশে গিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। ঠিক সেই সময় ওই ঝরনার অন্য পারে একটা বাইসন এসে দাঁড়ায়। বাইসন তাকে বলে, বোকারাই আত্মহত্যা করে। তোমার প্রাণ তুমি তৈরি করোনি, তাই তাকে মারার অধিকার তোমার নেই। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আমাকে দেখার পর তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। গরিব লোকটা বাড়ি ফিরে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই সে বিশাল ধনী হয়ে গিয়েছিল।’
জিগমের কথা শুনে হেসে গাড়ি থেকে নামতেই অর্জুন শুনল মোবাইলে রিং হচ্ছে। ওটা জিগমের মোবাইল। জিগমে যন্ত্রটা বের করে কানে চেপে ‘হ্যালো’ বলেই সোজা হয়ে বসল। তার গলা দিয়ে চিৎকার ছিটকে বের হল! ভুটানি শব্দ উত্তেজিত হয়ে বলতে বলতে সে অর্জুনের দিকে তাকাল। তারপর যন্ত্রটা বন্ধ করে গাড়ি চালু করে জিগমে উত্তেজিত হয়ে বলতে বলতে সে অর্জুনের দিকে তাকাল। তারপর যন্ত্রটা বন্ধ করে গাড়ি চালু করে জিগমে উত্তেজিত গলায় বলল, ‘পারো থেকে ফোন এসেছিল। ওখানে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। বড় সাহেবের ড্রাইভার মারা গিয়েছে। সাহেব খুব উন্ডেড। সেন্সলেস। হাসপাতালের ডাক্তাররা বাঁচাবার চেষ্টা করছে, আমি পারো যাচ্ছি স্যার।’ গাড়ি ঘুরিয়ে দ্রুত চলে গেল জিগমে।
মুহূর্তে ছবি বদলে গেল। হোটেল হিমালয়ের অন্যতম অংশীদার মিস্টার লেনডুপকে খুন করতে কে চেয়েছে? ছেলের সন্ধান করতে যে—ভদ্রলোক তাকে অনুরোধ করেছেন কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ তার ওপর নজর রেখেছেন বলে অর্জুনের ধারণা কিন্তু কেন সেটা করেছেন তা বুঝতে পারছিল না বলেই অমল সোমের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছিল সে। ভদ্রলোক যে হোটেল হিমালয়ের অন্যতম অংশীদার তা কখনও অর্জুনকে জানাননি। অংশীদার বলেই হোটেলের সব খবর তিনি সহজে পেয়ে যেতেন। এরকম লোককে কে হত্যা করবে? তার কী উদ্দেশ্য?
শব্দ করতেই গেট খুলে দিল সেই কর্মচারী। অর্জুন এগোতেই দেখল অমল সোম ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন। ওঁর রুটিন অনুযায়ী এখন কারওর সঙ্গে কথা বলার সময় নয়। কথা বলবেন বিকেলের চায়ের সময়। অর্জুন অবাক হল।
অমল সোম বললেন, ‘তোমার কথাই ভাবছিলাম।’
‘কেন?’ অর্জুন তাকাল।
‘তুমি বোধহয় জানো না মিস্টার লেনডুপ এই মুহূর্তে হাসপাতালে। বোমা বিস্ফোরণে ভয়ংকরভাবে ইনজিওরড। ওঁর ড্রাইভার মারা গিয়েছে। গাড়িতে ওঠার সময় বিস্ফোরণ ঘটে।’ অমল সোম বললেন।
অর্জুন মাথা নাড়ল কিন্তু কোনো কথা বলল না।
‘একটু আগে পারো থেকে ফোন পেয়েছি। তখনই মনে হল তোমার কথা।’
‘কারা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তা জানতে পেরেছেন?’
‘না। শরীরে বোমা বেঁধে যে—ছেলেটি এসেছিল তাকে পুলিশ এখনও শনাক্ত করতে পারেনি, কারণ তার মুখ উড়ে গিয়েছে বিস্ফোরণের সময়ে। কিন্তু ছেলেটার পকেটে একটা চিনে সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া গিয়েছে।’ অমল সোম হাসলেন ‘জলপাইগুড়ির তিস্তার পাশে যে—বিস্ফোরণ হয়েছিল সেখানেও একটি মৃত ছেলের প্যান্টের পকেটে চিনে সিগারেট পাওয়া গিয়েছে। দুটো বিস্ফোরণের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকা অসম্ভব নয়।’ অমল সোম বললেন।
‘এখন আমারও একই কথা মনে হচ্ছে।’ অর্জুন বলল।
‘তোমাকে মিস্টার লেনডুপ ওঁর ছেলেকে খুঁজে বার করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। উনি এখন যে—অবস্থায় আছেন তাতে ব্যাপারটা আর গুরুত্বপূর্ণ রইল না। কিন্তু যারা ওকে মারতে চেয়েছে তারা তোমাকেও টার্গেট করতে পারে। আমার মনে হয়, তোমার এখনই জলপাইগুড়িতে ফিরে যাওয়া উচিত। ওরা যদি তোমার কাছে পৌঁছয় তাহলে তুমি জলপাইগুড়িতে থাকলেই ভালোভাবে মোকাবিলা করার সুযোগ পাবে।’ অমল সোম বললেন।
বাসে ফুন্টশোলিং পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। সেখান থেকে জলপাইগুড়ির বাস না পাওয়া গেলেও হাসিমারা পর্যন্ত ট্যাক্সি পেয়ে গেল। হাসিমারা থেকে ট্রেন ধরে শিলিগুড়িতে পৌঁছে জলপাইগুড়ির বাস পেতে অসুবিধে হল না।
বাসে বসেই জগুদাকে ফোন করল সে। ভারতে আসার পর থেকে অর্জুনের মোবাইল দিব্যি কাজ করছে। জগুদা বললেন, ‘এত রাত্রে, তুমি কোথায়?’
‘অনেক রাত হয়ে গেছে না? সরি জগুদা। ভুটান থেকে আসছি। আধঘণ্টার মধ্যে জলপাইগুড়িতে পৌঁছে যাব। নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল?’
‘আছে। আমি তো এখন থানায় আড্ডা মারছি বন্ধুর সঙ্গে।’
‘বাঃ। তাহলে ওখানেই কিছুক্ষণ থাকুন। আমি আসছি।’ অর্জুন বলল।
রিকশা নিয়ে যখন সে থানায় পৌঁছল, তখন এগারোটা বেজে গিয়েছে। তাকে দেখে জগুদা বললেন, ‘ঝড়োকাকের মতো দেখাচ্ছে যে!’
‘সেরকমই তো অবস্থা।’
‘এঁকে তো চেনো।’ বন্ধু পুলিশ অফিসারকে দেখালেন জগুদা।
‘নিশ্চয়ই। আচ্ছা, বোমা বিস্ফোরণে যারা মারা গিয়েছে, তাদের ডেডবডি কি দেখা যেতে পারে?’
‘অনুমতি নিতে হবে। ওরা এখন এনআইএ—র আওতায়। তবে ওদের ছবি দেখাতে পারি।’ ড্রয়ার খুলে খাম থেকে ছবিগুলো বের করে সামনে রাখলেন অফিসার। চারটে মৃতদেহ, দুটোর ঊর্ধ্বাঙ্গ নেই। বাকিরা ক্ষতবিক্ষত। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে সোজা হয়ে দাঁড়াল অর্জুন। একটি শরীরের বাঁ হাতের কনুইয়ের পাশে যে—জড়ুল ছিল তা ছবিতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওই ছেলেটির পকেটে কি চিনে সিগারেটের প্যাকেট ছিল?’
অফিসার মাথা নাড়লেন— ‘হ্যাঁ। আপনি কী করে জানলেন?’
‘এই ছেলেটির পরিচয় আপনাকে দিচ্ছি। সম্ভবত, এর নাম এলভিস লেনডুপ। থিম্পুর মিস্টার লেনডুপের ছেলে।’
কথাগুলো বলে অর্জুন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর মধ্যরাতের শহরের রাস্তায় রিকশায় উঠে বাড়ির দিকে এগোতে লাগল।