অরাজক দিল্লী (১৭৪৯-৮৮)

অরাজক দিল্লী (১৭৪৯-৮৮)

১.

যাঁহাদিগকে যথার্থই ‘দিল্লীর পাদিশাহ্’ নাম দেওয়া যাইতে পারে, তাঁহাদের মধ্যে মুহম্মদ শাহ্ শেষ জন। কিন্তু তাঁহার মৃত্যু-১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ-হইতে মুঘল-রাজধানীতে সিন্ধিয়া কর্তৃক দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হওয়া-১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ-পৰ্য্যন্ত, এই ৪০ বৎসরের মধ্যে ভারতের কোন প্রদেশই দিল্লীর প্রভুত্ব স্বীকার করিত না। সত্য বটে, এই সময়ে ‘পাদিশাহ্’ বলিয়া কেহ না কেহ ছিলেন, কিন্তু নিজের উপরই তাঁহার কোন কর্তৃত্ব ছিল না,-সাম্রাজ্যের উপর আধিপত্য বিস্তার করা তো দূরের কথা; এমন কি যখন এই নামমাত্র বাদশাহ দিল্লীতে বাস করিতেন, তখন রাজধানীটাও তাঁহার অধীন ছিল না;- ছিল তাঁহার রক্ষকের হাতে, অথবা এই রক্ষক-পদপ্রত্যাশী প্রতিদ্বন্দ্বীদিগের মধ্যে ভাগ হইয়া। আবার তাহারাও অখণ্ড প্রভূত্ব লাভের আশায় সৰ্ব্বদা বিবাদে লিপ্ত হইত। সত্য বলিতে কি, দিল্লী এবং তাহার চতুর্দ্দিকে এই সময়ে তখন অরাজকতাই রাজত্ব করিত। রাষ্ট্র বলিয়া একটা কিছুর অস্তিত্ব কেহই মানিত না; কারণ রাষ্ট্র বলিতে বুঝায়, সুনিয়ন্ত্রিত সুশাসিত রাজ্য- যে রাজ্যের প্রজারা রাজার হুকুম মান্য করিয়া চলে।

এই ৪০ বৎসরের ইতিহাস ভারতের বড়ই দুর্দ্দিনের ইতিহাস। এই সময় দেখা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী আমীর-উমারারা রাজ্যে সর্ব্বেসর্বা হইবার জন্য রক্তারক্তি করিতেছেন; সেনারা বাকী মাহিনার জন্য বিদ্রোহী হইয়া পথে দাঙ্গা বাধাইতেছে; অথবা বাজারে নানা জাতের সেনারা মারামারি করিতেছে। সম্রাট ভীরু ও দুর্ব্বল; তাঁহার প্রকৃত হিতৈষী বন্ধুরা যখন তাঁহাকে মুক্ত করিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছেন, তিনি তখন খোসামুদে ও আমোদ-আহ্লাদের সহচর, ঘুষখোর মন্ত্রীদের মন্ত্রণায় তাঁহাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দিতেছেন;– নীচ ও কাপুরুষোচিত ষড়যন্ত্রের আশ্রয় লইয়া, নষ্ট-ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের বৃথা চেষ্টা করিতেছেন; যেমন, পুরানো মন্ত্রীকে খারিজ করিয়া তাঁহার স্থানে নূতন মন্ত্রী নিয়োগ, অথবা বখ্শী (সেনা-বিভাগের কর্তা) কে উজীরের বিরুদ্ধে খাড়া করিতেছেন! দুর্দান্ত তৈমূরের বংশধরের পক্ষে, ইহা অপেক্ষা আর কি অবনতি হইতে পারে যে, নিজেকে মুক্ত করিবার জন্য পুরুষোচিত চেষ্টা বা বীরোচিত প্রাণদানের চিন্তাও তিনি মনে স্থান দিতে পারেন না? এই ৪০ বৎসরের দিল্লীর ইতিহাসে আছে কেবল,–মারাঠা ও আ্যান্, শিখ ও জাঠ, এমন কি গুজর ও পিণ্ডারিদের লুঠতরাজের বিরক্তিকর একঘেয়ে কাহিনী; দিল্লীবাসীর লুঠের ঘন ঘন আতঙ্ক, ধনী লোকের দেশ ছাড়িয়া পলায়ন, দোকান-পাঠ বন্ধ, এই গণ্ডগোল ও নগরবাসীর আশঙ্কার সুযোগে বদমাইস গুণ্ডা কর্তৃক শহরের অরক্ষিত বাড়ীগুলি লুঠপাট; দস্যু ও লুঠেরা সৈনিক কর্তৃক কৃষকদের সর্ব্বস্ব লুণ্ঠন, আর দিল্লীর চারিপাশের গ্রামগুলির ধ্বংসসাধন; ইহার ফলে রাজধানীতে দুর্ভিক্ষের দরে জিনিস-বিক্রয়; রাজদরবারের জঘন্য ষড়যন্ত্র, অযোগ্যতা, এবং নৈতিক অবনতি, আর তাহার চরম পরিণতি গোলাম কাদির কর্তৃক রাজপুরী-অবরোধ, রাজপরিবারভুক্ত স্ত্রীপুরুষের উপর অমানুষিক অত্যাচার, এবং বৃদ্ধ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলমের চক্ষু অন্ধ করিয়া দেওয়া। উৎপীড়িত কৃষকেরা যখন বুঝিল, এ রাজসরকারের অধীনে প্রাণ ও সম্পত্তি নিরাপদ নহে, তখন তাহারাও রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইল; কোন অপরিচিত লোক, এমন কি সরকারী সিপাই, দেখিলে তাহাদের প্রতি শত্রুর মত ব্যবহার করিত।

এই সময়কার দিল্লির বিস্তৃত ইতিহাস পাওয়া না গেলেও প্রধান প্রধান ঘটনাগুলি মোটামুটিভাবে নিম্নলিখিত গ্রন্থে পাওয়া যায়–

Francklin’s Hist. of Shah Alam
Keene’s Fall of the Mughal Empire
এবং Grant Duff’s Hist of the Mahrattas.

কিন্তু নব্যপ্রণালীর ঐতিহাসিক এগুলি লইয়া সন্তুষ্ট থাকিতে পারেন না; তিনি চাহেন সত্যের উৎসে পৌঁছিতে, সুতরাং তাঁহার চাই-মূল এবং সমসাময়িক সংবাদ। এইরূপ মালমশলার সন্ধান করিতে গিয়া আমরা দেখিতে পাই Francklin সাহেব তাঁহার Hist. of Shah Alam রচনাকালে এইগুলির সাহায্য লইয়াছিলেন:-

(১) মুন্না লাল রচিত শাহ্ আলমের প্রথম ১৩ বৎসরের ইতিহাস

(২) সৈয়দ রাজী-লিখিত শাহ্ আলমের শেষ ৯ বৎসরের ইতিহাস

(৩)ঘুলাম্ আলী খাঁর শাহ্ আলম-নামা।

কিন্তু এই তিনখানি গ্রন্থ আমাদের বিশেষ কোন কাজে লাগে না; প্ৰথম দুইখানিতে কেবল ঘটনার সারমর্ম্ম অতি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ হইয়াছে, আর শেষের খানির লেখক ঘটনাস্থল হইতে দূরে–লক্ষ্ণৌ সহরে বসিয়া, গ্রন্থ লিখেন। তাঁহার নিকট কোন সমসাময়িক ডাইরী বা লেখা, অথবা দিল্লী নগরী ও দরবার সংক্রান্ত সরকারী কাগজপত্র ছিল না।

ইব্রৎনামা একখানি বৃহৎ ইতিহাস; লেখক ফকীর খএর-উদ্দীন, সম্রাট শাহ্ আলমের পুত্রের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী; গ্রন্থে বর্ণিত অনেক ঘটনাই তিনি স্বচক্ষে দেখিয়াছেন। দিল্লী ও লক্ষ্ণৌ হইতে প্রেরিত, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিনিধি এবং পেশাদারী সংবাদ-দাতাদের অনেকগুলি ফার্সী সংবাদ-পত্র কলিকাতার Imperial Record Office-এ রক্ষিত আছে; এই পত্রগুলি হইতে উত্তর-ভারতের কোন কোন সময়ের ঘটনা জানিতে পারা যায়। পত্রগুলির সংক্ষিপ্তসার সহ তালিকা কেবল ১৭৭২ পৰ্য্যন্ত ছাপা হইয়াছে; কিন্তু ইহা হইতে ঘটনার একটা ধারাবাহিক বা বিস্তৃত বিবরণ পাইবার উপায় নাই। দিল্লীতে অবস্থিত মারাঠা-দূত পুনরায় তাঁহার প্রভুকে যেসব পত্র পাঠাইতেন, সেগুলি রাও বাহাদুর দত্তাত্রেয় বলবন্ত পারসনিস পুস্তকাকারে প্রকাশ করিয়াছেন। এই পুস্তকে কেবল ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী হইতে আরম্ভ করিয়া ৬১৬ খানি পত্ৰ মুদ্রিত হইয়াছে। পত্রগুলির লেখক তখন প্রভুত্বকারী-শক্তির প্রতিনিধি; সুতরাং হতভাগ্য দিল্লীবাসীর দিক দিয়া, ঘটনার উপর দৃষ্টিপাত করিবার অবস্থা তাঁহার ছিল না। ঠিক এইরূপ, রাজবাড়ের সাধনে গ্রন্থের তৃতীয় ও যষ্ঠ ভালুমে, এবং ‘নাগপুর-কর ভোঁসলে রাঁচি কাগজপত্রে (কাব্যেতিহাসে সংগ্রহের অংশবিশেষ) গ্রন্থে যে সব মারাঠী পত্র আছে, সেগুলির বর্ণিত বিষয় কেবল লড়াই, আর কূট রাজনীতি।

শাহ আলমের দরবারের এবং মহাজী সিন্ধিয়ার শিবিরের তিনমাস কালের দৈনিক সংবাদ-পত্র (৯ জুলাই হইতে ৮ অক্টোবর ১৭৮৭), একখানি ফার্সী পুঁথিতে পাওয়া যায়। সে যুগে বহু ফরাসী ভাগ্যান্বেষী সৈনিক দিল্লীর রাজনৈতিক-রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহারা, যেসব ঘটনার সংস্রবে আসিয়াছিলেন, তাহার কোন বিস্তৃত ইতিহাস লিখিয়া যান নাই। M.Alfred Martineau কর্তৃক সুসম্পাদিত, মঁসিয়ে জিঁয়া ল’র ‘আত্মচরিতে’ আছে– কেবল বাঙ্গলা, বিহার ও বুন্দেলখন্দের কথা; ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী পর্য্যন্ত ঘটনা বর্ণিত হইয়া পুস্তকখানি শেষ হইয়াছে। ডি বঁয়ের শেষ বাসস্থান-সুইজারলণ্ডের Chamberyতে তাঁহার Memoire (2nd edition 1830) প্রকাশিত হইয়াছে; এই ছোট বইখানি পড়িয়া আমাদের হতাশ হইতে হয়; কারণ যেরূপ খাঁটি সংবাদ আমরা চাই, ইহাতে তাহার একেবারে অভাব। সেই সময়ে উত্তর-ভরত-প্রবাসী আর কোন ফরাসী সেনাপতিই তাঁহার আত্মজীবন-কাহিনী রাখিয়া যান নাই- যদিও ফরাসী জাতি এই শ্রেণীর রচনায় শ্রেষ্ঠ।

২.

সুখের বিষয়, পাটনার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কাগজপত্রের মধ্যে একখানি অপূৰ্ব্ব ফার্সী পুঁথি পাওয়া গিয়াছে। এখানির নাম দেওয়া যাইতে পারে, “দিল্লীর অরাজকতার ক্রমানুক্রমিক বিবরণ।’ মীর কাসিমের পতন, এবং বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৩) অযোধ্যার নবাবের পরাজয়ের ফলে, বঙ্গ-বিহারে ইংরাজরা রীতিমত শান্তিস্থাপন করিলে বহুসম্ভ্রান্ত পরিবার দিল্লীর অরাজকতা হইতে আত্মরক্ষার আশায় বিহারে বাস করিবার জন্য পলাইয়া আসেন। বিহারে বাস করিবার মূলে তাঁহাদের অনেকটা সুবিধা ছিল; সেখানকার ভাষা, জলবায়ু, রীতি নীতি, সামাজিক আচার-ব্যবহার, সবই দিল্লীর মত–তার উপর বিহারের লোকের ধনপ্রাণ দিল্লীর তুলনায় অধিক নিরাপদ। এইরূপ একটি পরিবার দিল্লীর অরাজকতার দৈনন্দিন-কাহিনী (ডায়েরী) লিখিয়া রাখিয়াছিল। ইহাতে ঘটনাসমূহ সংক্ষেপে লিখিত হইয়াছে; ঘটনার তারিখ যথাক্রমে হিন্দু হিজিরা এবং পুরানো ফার্সী (বা ইলাহী) সনে দেওয়া। পুঁথিখানির অনেকগুলি পাতা হারাইয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু এখনও যাহা অবশিষ্ট আছে, তাহাতে ১৭৩৯ হইতে ১৭৯৯ পর্যন্ত, অর্থাৎ- নাদির শাহ্ দিল্লি-লুঠ হইতে, লর্ড লেকের অধীনে ইংরেজের দিল্লি-প্রবেশের প্রায় পূর্ব পর্য্যন্ত-ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। পুঁথিখানির বর্তমান অবস্থায় স্থানে স্থানে ফাঁক থাকিলেও ইহা অমূল্য, এবং বর্তমান যুগের বিচারকুশল ঐতিহাসিকের নিকট ইহার মূল্য খুব বেশি। এই পুঁথির বিষয়- দিল্লীর ঘটনাবলী ও গুজবের সমসাময়িক কালানুক্রমিক বিবরণ, ঘটনার অল্প পরেই একজন সহরবাসী কর্তৃক লিখিত; বর্ণনায় অলঙ্কার, বিকৃতি বা পরবর্তীকালের ঘটনা-বিন্যাসের কৃত্রিমতার নামগন্ধ নাই।

এই পুঁথিখানি পাঠ করিতে করিতে আমার মনে হইয়াছিল, ইহা দিনেমার আক্রমণ-যুগের ইংল্যান্ডের পুরাতন Anglo– Saxon Chronile-এর সমতুল্য। সরল সত্যবাদিতা, বাহুল্য-দোষ-বর্জিত সাদাসিদে ভাবে ঘটনার বিবৃতি, উচ্ছ্বাস বা সমালোচনার অভাব,- এইসব গুণে উভয় পুস্তকই সমান সম্মানের যোগ্য। ইঁহার একটু আভাস দিবার জন্য পুঁথিখানি হইতে জানিবার মতো দুই চারিটি স্থূল উদ্ধৃত করিয়া দিলাম।

৩.

এই গ্রন্থে আমরা প্রায়ই উল্লেখ দেখিতে পাই, সম্রাট বা আমীর-উমারারা আশপাশের লুঠেদের নিকট, অথবা অবরুদ্ধ-দুর্গের লোকেরা শত্রুর নিকট, টাকাকড়ি দিয়া নিষ্কৃতির জন্য প্রস্তাব করিয়া দূত পাঠাইতেছেন। এই দূত পাঠাইবার ফলে কখনোও কখনোও ঝগড়া না মিটিয়া, বরং বাড়িয়া গিয়া, শেষে হাতাহাতিতে পরিণত হইত।

গ্রামবাসীরা বাধা দেওয়ার ফলে শাহজাদা মিত্রাউল গ্রাম ভীষণভাবে লুঠ ও ধ্বংস করেন। ইব্রত্নামার গ্রন্থকার এই ঘটনা নিজের চোখে দেখিয়াছিলেন। তাঁহার গ্রন্থে ইহার হৃদয়বিদারক কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। দিল্লিনগরীর অবস্থাও তখন ভাল ছিল না। শাহজাহানের দিল্লী, অর্থাৎ প্রাচীর ঘেরা নগরীর বিশেষ কিছু অনিষ্ট না হইলেও, পুরাতন দিল্লী (শহর-ই-কুহ্া)তে, চারিপাশের গ্রামগুলির মতো অবাধে লুঠতরাজ চলিত। শাহজাহানের দিল্লীর প্রাকার এবং যমুনার বালুচড়া ‘(রেতী’) হইতে নাগরিকেরা মাঝে মাঝে দেখিত, পরপারে তাহাদের উপর প্রভুত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা যুদ্ধ করিতেছে। এই তামাসা দেখা সব সময়ে নিরাপদ ছিল না; কারণ কখনো কখনো ওপার হইতে গোলা আসিয়া নগর-প্রাচীরের মধ্যেও পড়িত।

তারপর এরূপ উল্লেখও দেখা যায়:- (লুকান ধনরত্নের লোভে) আজ এ আমীরের, কাল সে আমীরের প্রাসাদের মেঝে খোঁড়া হইল।

রাজসরকার এবং আমির-উমারাদের অধীন সৈন্যগণ অনেক ভিন্ন জাতির-যথা, উত্তর-ভারতীয় মুসলমান, রাজপুত, রুহেলা, বদখশী (অর্থাৎ মধ্য-এশিয়ার লোক), মুঘল (পারসিক অর্থে), এবং তেলিঙ্গা (অর্থাৎ ইউরোপীয় কৌশলে শিক্ষিত সিপাই)। সৈন্যদের এই জাতিগত পার্থক্য, সহরের শান্তি বা সম্পত্তি-সংরক্ষণের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হয় নাই।

১৩ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৪-বাকী মাহিনা আদায়ের চেষ্টায় যে-সব সৈন্যেরা কুসিয়া মসজিদে বসিয়াছিল, তাহারা হট্টগোল বাধাইল, লোকজনকে দুর্গে যাইতে বাধা দিতে লাগিল, যাহারা মসজিদে ঢুকিতেছিল, তাহাদের মাথার পাগড়ী কাড়িয়া লইতে লাগিল– এইরূপে তাহারা সরকারী পথে চলাফেরা বন্ধ করিয়া দিল। উজীর তাহাদের পাওনা আগামী শনিবার মিটাইয়া দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত হইলেন, তবে তাহারা থামিল।’

এপ্রিল, ১৭৫৪-’বদশীরা খেপিয়া উঠিয়া, পাওনা মাহিনা চুকাইয়া দিবার জন্য জুলুম করিতে লাগিল। তাহারা বন্দুক গাদিয়া, পুতে ধরাইয়া, সম্রাটকে বন্দী করিবার জন্য ছুটিল।… উজীর তাহাদের বাধা দিলেন, দুর্গ হইতেও তাহাদের উপর গোলাবর্ষণ হইতে লাগিল। উজীরের জয় হইল বটে, কিন্তু বিদ্রোহীরা খাস বাজার ও খারি বাওলী পুড়াইয়া ছারখার করিয়া দিল।’

জুন, ১৭৫৪–’গোলন্দাজ-সৈন্যেরা বাকী মাহিনার জন্য বিদ্রোহী হইয়া, দুর্গদ্বার বন্ধ করিয়া দিল। উজীর তাহাদের তাড়াইয়া দিলেন।’

আরও এক বৎসর–’উজীরের গোলন্দাজেরা বাকী মাহিনার জন্য হাঙ্গামা করিতে লাগিল। তাহারা লাহোরী দরওয়াজার কাছে সব দোকান-পসার লুঠ করিয়া জ্বালাইয়া দিল। পুনরায়, সৈন্যেরা মীর বখ্শী খান-ই-দৌরানের দেহ গোর দিতে বাধা দিল, আর বাকী মাহিনার জন্য জুলুম করিতে লাগিল।’

১৭৭৬-ভবানী সিংহ ও গঙ্গারামের পল্টনের তেলিঙ্গারা মজ্দ-উদ্-দৌলা (সম্রাটের প্রিয় মন্ত্রী)কে দিল্লী দরওয়াজার কাছে রাস্তায় ধরিয়া, রৌশন্-উদ্-দৌলার মসজিদে কয়েদ করিয়া রাখিল। সৈন্যদের বাকী মাহিনা চুকাইয়া দিবেন, প্রতিশ্রুতি দিয়া পরদিন রাত্রে মজদ্ মুক্তিলাভ করিলেন।’

১৭৮৭-’তেলিঙ্গারা বাকী মাহিনার জন্য বিদ্রোহ করিল। দেশমুখের শিবিরে দুইদিন যাবৎ হুলস্থুল ব্যাপার। সূর্য্য অস্ত যাইবার তিন ঘণ্টা পূৰ্ব্বে বন্দুক ও কামানের আওয়াজ শোনা গেল। দুই দলে একশত হতাহত হইল।’

১৭৫৩-’১৪ই মার্চ রাত্রে, ও ১৭ই মার্চ দিনের বেলা কেল্লার মধ্যে সোরগোল উঠিল।’ ৬ই মে। সফদর জঙ্গের প্ররোচনায়, জাঠেরা লাল-দরওয়াজার নিকটে পুরাতন সহরের লোকেদের বাড়ী লুঠ করিল।’ ১২ই জুন। ‘সদর জঙ্গ কর্ম্মচ্যুত হওয়ায় তাঁহার স্থলে ইতিজাম উদ্-দৌলা উজীর নিযুক্ত হইলেন। ইহার ফলে, দেড় প্রহরকাল গণ্ডগোল চলিয়াছিল। জাঠ ও অন্যান্য লোকে পুরাতন সহর লুঠ করিল…সদর জঙ্গ ও বখ্শী উল-মুল্কের মধ্যে বিরোধ বাধিয়া গেল; ফরিদাবাদ লুঠ হইল।’

৪ জুন ১৭৫৪-’গুজব উঠিল, উজীর সম্রাটকে সিংহাসনচ্যুত করিতেছেন। সোরগোল; ভয়ে পুরাতন দিল্লীর লোকেরা ঘর ছাড়িয়া পলাইল; তাহাদের সম্পত্তি লুঠ হইল।’

১৭৫৮-৫৯-’রুহেলারা যশবন্তপুরা ও আরও কয়েকটি মহল্লা লুঠ করিল মারাঠারা নিজাম্-উদ্দীন্ আলিয়া লুঠ করিল এবং টাকা আদায়ের মতলবে সহরবাসীদের আটক করিল।’

১৭৭০-’সেকেন্দ্রাবাদের নিকটস্থ গ্রামগুলি মারাঠারা জ্বালাইয়া দিল; ভয়ে গ্রামবাসীরা আগেই পলাইয়াছিল। মাঝরাত্রে গুজরেরা সারগাঞ্জ ও শাহদেরা পুড়াইয়া দিল।’

১৭৭৩-’শিখেরা মধ্যরাত্রি পর্য্যন্ত শাহদেরা লুঠ করিল, আর ৫০ জন ছেলেকে ধরিয়া লইয়া গেল। প্রভাত হইবার চারি ঘণ্টা পূর্ব্বে তাহারা চলিয়া গেল; তাহার পর ঠিক সেই রাত্রেই, গুজরেরা শাহদেরা লুঠ করিল।’

১৭৮২-’কোল হইতে শিখেরা আসিয়া বরারীতে ছাউনী করিল। তাহারা মালকাগঞ্জ ও সব্‌জী-মণ্ডী পুড়াইয়া দিল আর মুঘলপুরীর লোকজনকে হত্যা করিল। ভয়ে সহরবাসীরা দুর্গমধ্যে পলাইল।’

আর এক বৎসর-’ফরিদাবাদ পর্য্যন্ত কোন ঘরেই আলো জ্বলিল না। যাহারা পলাইতেছিল, জাঠেরা তাহাদের বাড়ীর জিনিষপত্র লুটিয়া লইল। ফরিদাবাদের কাছে দুই হাজার মৃতদেহ খোলা যায়গায় পড়িয়া রহিল, আর আব্দালীর পারসিক অনুচরেরা ধনরত্নের সন্ধানে ফরিদাবাদের সব বাড়ীর মেঝে খুঁড়িতে লাগিল।’

১৭৫৭–’ঘোড়া অথবা পাল্কী কিছুই না থাকায় সম্রাট রমজানের প্রার্থনার জন্য অন্দরমহল হইতে পায়ে হাঁটিয়া মসজিদে চলিলেন।’

১৭৬৫-শিখেদের লুঠ করিবার আশঙ্কা থাকায়, চারিদিকে ঘোষিত হইল যে, দিল্লী সহর ছাড়িয়া কেহ যেন কালিকা দেবীর মন্দিরে (কুতব মীনারের কাছে) তীর্থযাত্রা না করে।’

আর এক বৎসর- ‘চারিদিকে ঘোষণা করিয়া দেওয়া হইল যে, আহমদ্ শাহ্ আব্দালী যখন শহরে প্রবেশ করিবেন, তখন শোভাযাত্রা দেখিতে কেহ যেন ছাদে না যায়,– রাস্তায় অস্ত্র লইয়া বাহির না হয়,-আর দোকান-পাঠ যেন খোলা না থাকে।’…’আবদালীর অনুচরেরা বালুচরের উপর দাঁড়াইয়া যে-কেহ কূপে জল লইতে আসিত, তাহাদের সর্ব্বস্ব কাড়িয়া লইত… মুঘলেরা (অর্থাৎ আবদালীর পারসিক-সৈন্যেরা) কতকগুলি গলির ভিতর ঢুকিয়া লোকের ঘরবাড়ী আক্রমণ করিল, দরজা ভাঙ্গিয়া ঘরে ঢুকিয়া টাকাকড়ি লুঠ করিল। তাহাদের অত্যাচারে হাটবাজার বন্ধ করিতে হইয়াছিল।

কুঞ্জপুরায় আবদালীর সঙ্গে যখন মারাঠাদের লড়াই চলিতেছিল, সেই সময় দিল্লীবাসীরা শুনিল– ‘আবদালী আসিতেছেন।’ ‘এই গুজবে ভয় পাইয়া তাহারা দীর্ঘ এক বৎসর কাল মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল।… আফঘানেরা দিল্লী ত্যাগ করিল– সহরেও যেন সঙ্গে সঙ্গে নবজীবনলাভের আনন্দের সাড়া পড়িয়া গেল।

এখানে একটা জিনিষ লক্ষ্য করিবার আছে। যখন টাকায় ৮ সের গম, মুগ অপেক্ষা অপকৃষ্ট ডাল ১০ সের, আর দুই সের ঘি, তখন লোকেরা দুর্ভিক্ষ হইয়াছে বলিত!

৪.

Anglo-Saxon Chronicle-এর সহিত অপূর্ব্ব সামঞ্জস্যের জন্য আমি পুঁথিখানির নামকরণ করিয়াছি-দিল্লীর কালানুক্রমিক বিবরণ। কিন্তু উভয়ের মধ্যে একটা বিশেষ প্রভেদ আছে; দিনেমারদের আক্রমণকালে উৎপীড়িত ইংরাজদের তবু সান্ত্বনার কারণ ছিল যে, অত্যাচারীরা তাঁহাদের দেশবাসী নহে-বিদেশী; জাতি ধর্ম্ম ও ভাষায় তাঁহাদের হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন; এবং Alfred বংশীয় রাজাদের বীরত্ব, হিতৈষণা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার ফলে যে স্বাধীন সম্মিলিত ও বৃহত্তর ইংলণ্ড গড়িয়া উঠিয়াছিল, উৎপীড়িত ইংরাজদের বংশধরগণের পক্ষে তাহাই পরম সান্ত্বনার কারণ হইয়াছিল। কিন্তু অরাজকতার সময়ে দিল্লীবাসিগণের অদৃষ্টে যে সান্ত্বনা লাভেরও সৌভাগ্য ঘটে নাই।

ঐতিহাসিক যদি অতীত ঘটনা হইতে ভবিষ্যতের জন্য উপদেশ দিতে না পারেন– অতীত ঘটনার বিবরণ দিয়াই কৰ্ত্তব্য শেষ হইয়াছে ভাবিয়া থাকেন- তবে বলিতে হইবে যে তিনি কৰ্ত্তব্যভ্রষ্ট হইয়াছেন। দিল্লীর এই ৪০ বৎসরের অরাজকতার সময়ে যে সব বিপদ-আপদ ঘটিয়াছিল, তাহা হইতে আজ আমরা অনেক উপদেশ লাভ করিতে পারি। ভারতবর্ষ তখন ভিন্ন ভিন্ন খণ্ড-রাজ্যে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল;- কাহারও সহিত কাহারও কোন সম্বন্ধ বা সহানুভূতি ছিল না; পরন্তু একজন একটু ক্ষমতাশালী হইলেই প্রতিবেশী রাজ্য আক্রমণ করিত, নির্যাতিত করিত; অর্থাৎ সীমান্ত প্রদেশের অপর দিক হইতে বিদেশীরা যেমন আমাদের ভারতবর্ষ আক্রমণ ও অধিকার করিত, দেশের এক প্রদেশের লোক অপর প্রদেশের প্রতি সেই প্রকার আচরণই করিত। আমাদের যে সময়ের অধিনায়ক ও সদারগণের দূরদৃষ্টি বা মহত্তর দেশহিতৈষণা একেবারেই ছিল না; তাহারা কেবল নিজের পরিবার ও জাতির ভালর দিকেই নজর রাখিত। মধ্যযুগে জাম্মানীতে রোমরাজ্য যেমন একটা কিংবদন্তী বা নাম মাত্রে পরিণত হয়, সে সময়ের দিল্লীর কেন্দ্র-শক্তিরও অবস্থা সেই রকমই– হইয়াছিল একেবারে পঙ্গু বলিলেই হয়। বৈদেশিক-আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার জন্য তখন ভারতের কোন কেন্দ্রীভূত সৈন্য সামন্ত, বা আভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষার জন্য কোষাগার ছিল না। ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা এবং গোষ্ঠীগত স্বানুবৰ্ত্তিতা তখন ভারতবর্ষকে বিভক্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। তাহার অবশ্যম্ভাবী ফলে দেশ দুর্বল হইয়াছিল, এবং প্রথমে অরাজকতা, তাহার পর ৪০ বৎসরের অশান্তি। অবশেষে বৈদেশিক অধিকার। এই শেষোক্ত ঘটনায় জনসাধারণ বহুদিনের কষ্ট, যন্ত্রণা ও অশান্তি অব্যাহতি লাভ করিয়াছিল, এবং যদি আমরা ইতিহাসের ঘটনা-পরম্পরা মনোযোগ সহকারে পাঠ করিয়া বিভিন্ন রাজ্যের উত্থান-পতনের প্রকৃত কারণগুলি ভাবিয়া দেখি, তাহা হইলে এই বৈদেশিক অধিকার যথাসময়ে আমাদিগকে অধিকতর সম্পন্ন ও শক্তিশালী করিতে পারিবে।

শান্তিই সমস্ত ভাল কার্য্যের আরম্ভ। জাতীয় উন্নতি ও উৎকর্ষসাধন করিতে হইলে, অধ্যবসায়ের সহিত সুদীর্ঘকাল সুনির্দ্দিষ্ট পন্থার অনুসরণ করিতে হয়, এবং শক্তিমান, নিঃস্বার্থ ও পবিত্র হৃদয় মনীষীবৃন্দ যে পথে জাতিকে পরিচালিত করা কর্তব্য বিবেচনা করেন, সেই পথেই অগ্রসর হইতে হয়;- অরাজকতা ও অশান্তি এই কল্যাণময় পথের পরম শত্রু। আর সব কারণ ছাড়িয়া দিলেও শুধু বর্তমান জগতে বাঁচিয়া থাকিবার জন্য ভারতবাসীদিগকে দলবদ্ধভাবে দক্ষ, কৰ্ম্মঠ হইতে হইবে। জাতীয় মুক্তির এই পথ।*

[ভারতবর্ষ, বর্ষ-৮ খণ্ড-২, সংখ্যা-৫, বৈশাখ, ১৩২৮।

* Indian Records Commission-এর বোম্বাই অধিবেশনে পঠিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *