অরমিতা

অরমিতা

দুপুর যখনই বিকেলে গড়িয়ে যায়, বিশেষ করে বনেজঙ্গলে, তখনই চুয়ার মন বড়ো খারাপ লাগে। স্বল্পায়ু বিকেলও দেখতে দেখতে মরে যায়, উষ্ণতা মরে যায়; সোনা ঝরে যায়। ঘন গভীর বনের বুক থেকে ময়ূর আর বনমোরগের ডাক ভেসে আসে। বড়ো গাছেদের গা-জড়ানো অসংখ্য অদৃশ্য ঝিঁঝি, স্বল্পবিত্ত কন্যাপক্ষর বাড়ির সস্তা সানাইওয়ালার কর্কশ, তীব্র ফুঁ-এর মতো হঠাৎ বেজে ওঠে। একলা উড-ডাক বা একঝাঁক লেসার হর্নবিল গ্লাইডিং করে নিষ্কম্প ডানায় ভেসে যায় আলোর দেশ থেকে অন্ধকারের দেশে, তাদের ডানায় দিনের শেষ আলোকে মুছে নিয়ে।

সন্ধে আসে। ঝোপঝাড়ের গা থেকে একধরনের অসভ্য গন্ধ বেরোয়; যৌনতায় ভরা। অরণ্যের গভীরের বড়ো গাছপালার পাতা থেকে, অন্ধকারে, শীতের অদৃশ্য সৈন্যরা নি:শব্দে নেমে এসে ঘিরে ফেলে আগন্তুকদের।

দোলাটার ঠিক ওপরে একটা মস্ত ঝরে-পড়া একটা বড়ো শিমুল গাছের গুঁড়ির ওপর বসে ছিল চুয়া। দোলার দিকে চেয়ে। একটি ঝরনা বয়ে গেছে দোলাটাকে ছুঁয়ে। এখন পুজোয় সময়। বর্ষা এবার প্রলয়ংকরী রূপেই এসেছিল। প্রচন্ড আওয়াজে বয়ে চলেছে ঘোলা জল পাথরে পাথরে ধাক্কা দিয়ে, নিজেকে লালচে টুকরোয় গলিয়ে ভেঙে এলিয়ে দিয়ে।

ঝরনার দু-পাশে একটু মাঠের মতো! বড়ো বড়ো জংলি ঘাস তাতে। ঋষি বলে, ওগুলো নেপিয়ার ঘাস। জংলি জানোয়ারে তো খায়ই, ভালো সারও নাকি হয়। জলের কাছে, সোঁদা জায়গায় এরা জন্মায়, যেমন, আফ্রিকান ইয়ালো-ফিভার আকাসিয়া।

অনেক কিছু জানে ঋষি। আই এ এস পরীক্ষাতেও দারুণ নম্বর পেয়েছিল। ভাইভাভোসেতেও খুবই ভালো করেছিল। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেও যেতে পারত। কিন্তু না গিয়ে ফরেস্ট সার্ভিসে এসেছে। ও একজন কমিটেড ফরেস্ট অফিসার। যাঁরা বলেন যে, ভারতবর্ষের অনেক আমলারাই ওয়ার্থলেস, অসৎ; তাঁরা ঋষির মতো আমলা নিশ্চয়ই দেখেননি।

ঋষির মতো ফরেস্ট অফিসার আজ অনেকই দরকার এই দেশে।

চিফ কনসার্ভেটের অফ ফরেস্ট বলেছিলেন চুয়ার বাবাকে; যখন ঋষির সঙ্গে রাকার বিয়ে ঠিক হয়।

আশ্চর্য মেয়ে! সত্যি!

পেছন থেকে হঠাৎ-আসা, ঋষির গলার আওয়াজে চমকে উঠেছিল চুয়া।

তারপর নিরুত্তাপ গলায় বলেছিল, কেন?

কেন? কালকে গুণ্ডাহাতিটার এত গল্প শুনলে তাও বলছ কেন?

—ওঃ! গুণ্ডাহাতি খারাপ লোকদের মারে। আমার মতো ভালো লোককে মারবে কেন?

—বা:, জঙ্গলে কখনো অন্ধকারের পর এরকম নিরস্ত্র অবস্থায় থাকতে নেই। জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে যেসব গ্রাম তার বাসিন্দাদের দ্যাখো না? সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তর সঙ্গে তাদের ঘড়ি বাঁধা। রাতের জঙ্গল, শুধু জঙ্গলেরই।

—আমি যে এখানে আছি তা জানলে কী করে?

—আমি জানব কী করে? পাগলের মতো খুঁজছি। রাকা আজ তোমার জন্যে কড়াইশুঁটির চপ করেছে বন্ধুকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্যে। চায়ের সঙ্গে খাওয়াবে। আর তুমিই বেপাত্তা। দূরের হাটে লোক পাঠিয়ে জোগাড় করেছে কড়াইশুঁটি।

—লুকিয়ে থাকারও কি জো নেই? এই আশ্চর্য দৃশ্য, এই সানসেট-এর চেয়েও কি কড়াইশুঁটির চপ বেশি হল? উইথ অ্যাপলজি টু রাকাই, বলছি।

—লুকোনোর জায়গাও বেছেছিলে বাবা! ভাগ্যিস ফরেস্ট গার্ড, ঝি-রা তোমায় আসতে দেখেছিল এদিকে। নইলে মুশকিলেই ফেলতে। চলো চলো, ওঠো। হাতিটা নিয়ে ভয়ের কারণ আছে। গুণ্ডাহাতি জঙ্গলে সবচেয়ে ভয়ের।

ওরা যখন দোলার পাশের উঁচু জায়গাটা থেকে নেমে আসতে লাগল তখন আলো ছিল না। তবে অন্ধকারও না। এইরকম না-আলো না-অন্ধকার শুধু গ্রামে-গঞ্জে বনেজঙ্গলেই থাকে।

জিপের স্টিয়ারিং-এ বসতে যাচ্ছিল ঋষি।

চুয়া বলল, আমি চালাব।

আবদার করে।

জঙ্গলে জিপ চালাতে আমার খুব ভালো লাগে।

—বেশ! চালাও। তবে, পথের পাশের গাছে ধাক্কা লাগিয়ো না। প্রাণটা যাবে, তোমার প্রিয়সখী বিধবা হবে এবং আমার চাকরিটাও যাবে। প্রাণের চেয়েও চাকরি দামি আজকাল।

—আমার না জঙ্গল খুব ভালো লাগে। তোমার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই, ঋষি? এলিজিবল ব্যাচেলর? আলাপ করিয়ে দাও-না বাবা কয়েক-জনের সঙ্গে। দেখি, বিয়ে করার মতো ভালো কাউকে লাগে নাকি? তাহলে ফরেস্টেই থাকতে পারব বাকি জীবন।

সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে ঋষি বলল, নো প্রবলেম। আর পনেরোটা দিন থাকো। সেমিনার হবে ভুটানের বর্ডারে। হাতিরই ওপরে সেমিনার। শুধু ভারতবর্ষই নয়, এশিয়ার বহু দেশ থেকে অনেক হাতি-বিশেষজ্ঞ সব আসবেন। প্রমথেশ বড়ুয়ার ছোটোভাই প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়া অর্থাৎ লালজিও আসেন। চলো সেখানে স্বয়ংবর সভার বন্দোবস্ত করব।

গিয়ার চেঞ্জ করে একটা হেয়ারপিন বেণ্ড সামলাতে সামলাতে চুয়া বলল, আমি যাব কোন ক্যাপাসিটিতে?

—হুঁ। ক্যাপাসিটি নয়, বলো ক্যাপাকাইটি। তোমাকে সেমিনারে আমার বউ সাজিয়ে নিয়ে যাব।

—ইয়ার্কি! না?

—ইয়ার্কি কী? আমি তোমার প্রিয়সখীর স্বামী। আমার সঙ্গে সহবাস তো করছই না, দু-একটা চুমু-টুমু, তাও নয়; নিজেরই স্বার্থে একটু নেম-লেণ্ডও করতে রাজি নও! তাহলে দেব না ফরেস্ট অফিসার। ফরেস্ট অফিসারের অভাব কী? আমার বড়োসাহেবই তো ব্যাচেলার।

—সত্যি! এতক্ষণ তো বলোনি। তুমি একটি ওয়ার্থলেস।

বলেই বলল, ইস। কী আমার দেনেওয়ালা রে!

এবার দোতলা বাংলোটা দেখা যাচ্ছে।

অন্ধকারও হয়ে গেছে। ঝিঁঝিদের ডাক আরও জোর হয়েছে। এখুনি মশাদের পিনপিনানি শুরু হবে। উত্তরবঙ্গের জঙ্গল বড়ো স্যাঁতসেঁতে। শীতকালে এলে ভয়ও যেমন করে, মনও খারাপ হয়ে যায়। বর্ষাকালে এলে অবশ্য আরও খারাপ। তবু, চুয়া উত্তরবঙ্গেরই মেয়ে। তাই এই জঙ্গলকে ভালোওবাসে ও।

বড়ো বড়ো আকাশ-ছোঁয়া শাল গাছের মধ্যে দিয়ে সাদা ধুলোর পথটা চলে গেছে। বাইরে বারান্দায় হ্যাজাক জ্বলছে। অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিল চুয়া।

জিপের শব্দ শুনে বসবার ঘর থেকে বাইরে এল রাকা। জিনস পরেছে, হালকা নীলরঙা। পায়ে যোধপুরি বুট। ওপরে ফুল স্লিভস ক্রিমসনরঙা পুলওভার।

ইঞ্জিন বন্ধ করে নামল চুয়া। ঋষিও নামল। হ্যাজাকের আলো দোতলার রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে এসে রাকার মুখে পড়েছিল। প্লাক করা ভুরুতে পুরু করে আইব্রো পেনসিল ঘষেছে ও।

চোখ কুঁচকে ও ঋষির দিকে তাকাল, চুয়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।

বলল, কী করছিলে এতক্ষণ! ছিলে কোথায় তোমরা? গেছ সেই চারটেতে আর এলে সাড়ে পাঁচটাতে!

শেষের বাক্যটি বলল ঠাট্টার ঢঙে। কিন্তু ঠাট্টা বলে মনে হল না আদৌ।

নিজে মেয়ে বলে, রাকার কথার মানে চুয়া বুঝল।

ঋষি কাঁধ শ্রাগ করে বলল, ওয়েল! তোমার বান্ধবীকেই জিজ্ঞেস করো।

চুয়া বুদ্ধিমতী। অন্তত রাকার চেয়ে কম বুদ্ধিমতী নয়। মুখ তুলেই বলল, আগে কড়াইশুঁটির চপ। পরে কথা। চল ভেতরে। কাঞ্ছা, চা—আ—আ…।

ভেতরের দিকে এগোল বটে, কিন্তু এগোতে এগোতেই রাকা বলল, কড়াইশুঁটির চপ তো বানালাম সারাদুপুর ধরে। তোর তো দেখছি, তার চেয়েও মোর প্যালেটেবল…

চুয়া চকিতে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল রাকার দিকে।

চোখে চোখ রেখে বলল, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?

ভাগ্যিস ঋষি কথাটা শোনেনি। ও চলে গেছিল ওর ঘরে জামাকাপড় ছাড়তে। লজ্জায় কান ঝাঁঝাঁ করছিল চুয়ার।

রাকার দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইল ও। ছোটোবেলার বন্ধু ওরা। তবে ছোটোবেলাতেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। চুয়ার বাবা দিল্লি চলে যান বদলি হয়ে। মিরাণ্ডা হাউসে লেখাপড়া করে চুয়া। তারপর এখন চাকরি কলকাতায়। বিয়ের সময়ও আসতে পারেনি। অনেক বছর পর বন্ধুর খোঁজ পেয়ে পুজোর ছুটিটা কাটাবে বলে এসেছে।

চুয়া আবার বলল, কী রে? মাথা কি সত্যিই খারাপ হয়েছে তোর?

—হয়নি। কিন্তু হতে পারে।

গলা নামিয়ে বলল, তুই কী জানবি? তুই তো আর বিয়ে করিসনি। এখনও স্পিনস্টার। আ ওম্যান ক্যান শেয়ার এভরিথিং ইন হার লাইফ। বাট নট হার হাব্বি!

স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে ছিল চুয়া রাকার দিকে। রাকার স্বামীর ওপর ভাগ বসাবার কথা কীভাবে ওর মনে এল তা ওর বুদ্ধিরও বাইরে। মেয়েটা গ্রাম্যই রয়ে গেছে। ও নিজে যে দিল্লিতে পড়াশুনা করেছে এজন্যে ভালো লাগল চুয়ার। এ কী! এমন জানলে আসতই না এখানে। এসে অবধি লক্ষ করেছে যে, রাকা সন্দিগ্ধ। এমন ব্যবহার করলে লোককে আদর করে ডেকে আনা কেন?

রাকা বলল, বোস। চা-টা ভিজুক। আমি এগুলো গরম করে আনি আবার। আমার মায়ের রেসিপিতে বানিয়েছি। খেয়ে দ্যাখ।

চুয়া মধ্যের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, দোতলার চওড়া কাঠের বারান্দাতে ইজিচেয়ারে বসল। বাহাদুরকে বলল, হ্যাজাকটা ভেতরে নিয়ে যেতে।

—হাতি আছে কাছেই মেমসাহেব। এটা এখানে থাকা ভালো।

—একটুক্ষণের জন্যে নিয়ে যাও। বলল ও।

এখন কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদ ওঠে সেই শেষরাতে। একটা কোটরা হরিণ ডাকছে ব্বাক-ব্বাক-ব্বাক করে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে কাঠ চেরাই-এর মতো সেই শব্দটাও চেরাই হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারধারে। কখনো-বা ডাকটাকে দূরাগত বন্দুকের শব্দের মতো মনে হচ্ছে। ভয় লাগে চুয়ার এই ডাক শুনলে। জমাট বাঁধা অন্ধকার। গাছাপালারা এমন ঘনসন্নিবিষ্ট চাঁদোয়ার মতো ঝুঁকে আছে বাংলোটার ওপরে, যদিও দূরে দূরে তবু আকাশের তারাদের ভালো করে দেখা যায় না। মনটা খুবই খারাপ লাগছে চুয়ার। শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত মানুষের মধ্যে ক্ষুদ্রতা, ঈর্ষা, দৈন্য এবং কুটিলতা ওকে বড়ো পীড়া দেয়। চিরদিনই দিয়েছে। এসব দেখলে ওর বুকের মধ্যে কষ্ট হয় বড়ো। সেটা চুয়ার নিজের কারণে নয়। অন্য মানুষদের কারণে। এই ধরনের ছোটো মনের মানুষদের প্রতি ও একরকম অনুকম্পা বোধ করে। বড়ো ঘৃণাও বোধ করে সময় সময়। তারপরে একসময়ে অবশ্য ঘৃণাভরে ক্ষমাও করে দেয়। জেট ইঞ্জিন তার ভেতর থেকে বেগকে উৎসারিত করে পেছনে ঠেললে প্লেন উড়ে চলে তীব্র বেগে কিন্তু এই প্রচন্ড উৎসারের কষ্টটা সেই ইঞ্জিনকেই একা বইতে হয়। মনের মধ্যে আলোড়ন থাকেই। থেকেই যায়। গতি থাকলেই বিপরীত গতিও থাকেই। চুয়া যে সৎ, শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমতী একজন মানুষ! তার শিক্ষাটা বা বুদ্ধিটা বা সততাটা তো আজকালকার অনেক মানুষেরই মতো শুধু ভানমাত্রই নয়! কী করা যাবে! যে দুঃখ পাবার, তা পেতেই হয়।

ঋষি, পায়জামা পরে শাল গায়ে জড়িয়ে ওঘর থেকে বারান্দায় এল। সিগারেট ধরাল বারান্দার কোনার চেয়ারে বসে। দেখেনি ও, অন্ধকারে বসে-থাকা চুয়াকে। চুয়া ওর সিগারেটের আগুনটা দেখতে পাচ্ছিল। সিগারেটের আগুনটা নেচে নেচে নামছিল নিথর রাতের বনজ কালো স্তব্ধতায়।

চুয়া উঠে ভেতরে যাওয়ার জন্যে এগোল। ওর পায়ের শব্দে চমকে উঠল ঋষি।

—কে?

—আমি।

—তুমি? অন্ধকারে কী করছিলে?

—অন্ধকার দেখছিলাম।

চুয়া ভেতরে চলে গেল।

ঋষি ভাবছিল, চুয়া এসেছে সাত দিন। এই সাত দিনে ওর নিজের বড়োই কষ্ট গেছে। এখনও যাচ্ছে। প্রতিমুহূর্ত। চুয়া, অন্ধকারের মধ্যেও যে দেখার অনেক কিছু আছে, অন্ধকারের মধ্যেও দেখা যায় সেটা জানে। রাকা এখানে আছে দু-বছর। অথচ, এক সন্ধেতেও হ্যাজাকের ক্যাঁটক্যাঁটে আলো ছাড়া বারান্দাতে বসেনি। এমনকী চাঁদনি রাতেও না। কখনো জঙ্গলে বেড়াতে যায়নি। এক জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি বা মালবাজার অথবা বিভিন্ন ক্লাবে যাওয়া-আসার সময় ছাড়া। এইসব ক্লাবে যেতে একেবারেই ভালো লাগে না ঋষির। হয়তো, কোনো ক্লাবে যেতেই লাগে না। সেই একই মুখ, একই আলোচনা, বোকা বোকা রসিকতা; কিছু লোকের দুটো পেটে পড়লেই অশালীনতা, বাচালতা, আবার অন্য কিছু মানুষের সাংঘাতিক অবিচল সুস্থতাও। যাদের অনেক মদ খেয়েও কিছু হয় না সেইসব মানুষদের সম্বন্ধে ঋষির ভীতি আছে খুব। ওর ধারণা, সেই মানুষদের মধ্যে অনেকেই হয় ভয়বান, নয় ভূত।

ঋষিও গেল ভেতরে।

রাকা খুব শর্ট-টেম্পার্ড। মানুষটি খারাপ নয়। ও বড়োলোকের আদুরে, একমাত্র মেয়ে।

ওর ধারণা ও সর্বগুণসম্পন্না। অনেক মানুষেরই যেমন ধারণা থাকে নিজেদের সম্বন্ধে।

রাকা বলল, আর একটা নে চুয়া। কেমন হয়েছে?

দারুণ।

—তুমি আর নেবে না?

ঋষির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, রাকা।

দিচ্ছ কোথায় আর? সবই তো দু-বন্ধুতে মিলে শেষ করে দিলে।

—আহা! নাও-না।

চুয়া বলল, আমাকে আরও দুটো দিয়েছে রাকা। ঋষি, একটা নেবে আমার থেকে? যদিও বামুন নই আমি। ছোটোজাত।

ঋষি বলল, নো। থ্যাঙ্ক ইউ। আর পারব না। জাতের জন্যে কিছু নয়, কারণ মেয়েমাত্রই ছোটোজাত।

—কী! এত্তবড়ো সাহস!

চুয়া হেসে বলল।

আমি মেল-শভিনিস্ট। লাস্ট অফ দ্য মোহিকানস। আজকাল তো দেখি উলটোটা হওয়াটাই ফ্যাশানেবল। যাই-ইন ভোগ; যাই ফ্যাশানেবল আমি তাই না করতে ভালোবাসি; আমার বাবা-কাকাদের দেখেছি। আমি বিশ্বাস করি মেয়েরা ছোটো হলেই আসলে বড়ো হয়। ‘সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে।’ মেল শভিনিজম-এর অনেকই গুণ।

—এবার থামো। এনাফ ইজ এনাফ। কড়াইশুঁটির চপটার স্বাদ-ই নষ্ট হয়ে গেল মেল-শভিনিজম-এর ঠেলায়।

রাকা বলল।

চুয়া বলল, একটু টাবাস্কো সস ঢেলে দে তো ওর চপে, শভিনিজম এক্ষুনি গলে যাবে।

ঋষি হাসল, চাপা শব্দ করে।

চুয়া মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।

এই প্রাণখোলা হাসিকেই ভালোবেসে ফেলেছে চুয়া। এই মানুষটাকে অনবধানে ভালোবেসে ফেলেছে। তার স্বপ্নের স্বামীর মধ্যেও যা যা প্রত্যাশা করেছিল সবই ঋষির মধ্যে দেখেছে। অথচ, ঋষি ওর কেউই নয়। এটাই সত্যি। সত্যিকে মানতেই হয়। গল্প-উপন্যাসে অনেক আজগুবি ব্যাপার লেখেন সাহিত্যিকরা। জীবন, গল্প নয়।

—তোমার চায়ে আজ একটু বেশি চিনি দিই, ঋষি?

—কেন?

চমকে উঠে ঋষি বলল।

—কারণ, আজ সন্ধেতে তেতো ব্যাপারটা একটু বেশি হল তো।

চুয়া বলল।

ঋষি রাকার দিকে চকিতে একবার চেয়ে হাসল, চুয়ার চোখে চোখ রেখে।

রাকা রাগ ও হাসি মিশিয়ে বলল, দ্যাখ চুয়া। ভালো হচ্ছে না বলছি।

চুয়া চারদিক দেখে নিল, বাহাদুর বা কাঞ্ছা নেই যে, সে-সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে তারপর বলল, আচ্ছা রাকা, আমাদের দেরি দেখে তোর মনে ঠিক কী হয়েছিল বলবি? বেশ মজা হবে। লেটস অল বি ফ্র্যাঙ্ক। লেটস বি ট্রু টু আওয়ারসেলভস। আমরা যেন সকলেই একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেছি; যেন সকলেই…

রাকা বলল, না না, না।

শেষের ‘না’ টা বেশ চিৎকার করে বলল। ও বলল, না। স্টপ ইট, চুয়া।

স্টপ ইট প্লিজ!

—ওক্কে। ওক্কে। কিন্তু তুই কি পাগল হয়ে গেলি?

চুয়া বলল অবাক হয়ে। রাকার মুখ-চোখের ভাব দেখে যেন মনে হল ও অপ্রকৃতিস্থ।

—না, তা নয়। অন্য কথা বল।

রাতের মেনু কী আজ?

ঋষি বলল।

রাকা উত্তর দেওয়ার আগেই চুয়া বলল, আমরা সকলেই পাগল। কম আর বেশি। আমরা লুসিড ইন্টারভ্যালস-এ আছি।

এমন সময় নীচ থেকে বাহাদুরের গলা এবং বিট অফিস থেকে গার্ডদের সম্মিলিত চিৎকার ভেসে এল, ‘হাতি-হাতি-হাতি’। ‘আমাকে ধইর‌্যা ফেলাইল রে। ছাইন্যারে—এ—এ। বাঁচা।’’

কে যেন আর্তনাদ করে উঠল।

চারদিক থেকে ‘মারিল! মারিল! ধরিল! ধরিল!’ আওয়াজ আসতে লাগল।

রাকা সঙ্গে সঙ্গে হিস্টিরিয়ার রোগীদের মতো দু-হাতে দু-কান চেপে ইঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ, ইঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ বলে চিৎকার করতে করতে জিনস আর যোধপুরি পরে ব্যাঙের মতো লাফাতে লাগল।

রাকার দিকে একঝলক তাকিয়ে বুড়ো মেয়ের অসহ্য ন্যাকামিতে বিব্রত বোধ করল চুয়া। তারপর দৌড়ে গেল বারান্দায়, কোথায়? কোথায়? বলতে বলতে।

ঋষি দৌড়ে গেল তার ঘরে রাইফেল আনতে। রাইফেলটা নিয়ে এসে সে দাঁড়াল বারান্দার রেলিং-এ ঝুঁকে। বলল, টর্চটা ফ্যালো তো চুয়া। চুয়া তার পাশে দৌড়ে গেল, দোতলা বাংলোর নীচের কাঠের থামে কী যেন লাগল একটা নরম, কিন্তু জোরে।

ঋষি বলল, সরে এসো। হাতি! শুঁড়।

বলেই, আকাশের দিকে ব্যারেল করে গুলি করল।

মাজল থেকে গুলির শব্দে সঙ্গে-সঙ্গে একঝলক লাল আলো বেরোল গাঢ় অন্ধকারে। সঙ্গে সঙ্গে নীচ থেকে চিৎকার উঠল—আ—আ—আ—আ।

সেই হতভাগা মানুষটির নির্জন চিৎকারের সঙ্গে কোয়ার্টারের অনেক স্ত্রী-পুরুষের চিৎকার মিশে গেল। সব চিৎকার ছাপিয়ে ভেতর থেকে ন্যাকা রাকার চিৎকার ভেসে আসতে লাগল। ইঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ। ই-ই-ই-ই…

অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করল চুয়া, রাকার ওপর। এবং দুঃখিত হল ঋষির জন্যে।

হাতিটা আওয়াজ করল না কোনো। লোকটার পেট থেকে পা-টা তুলে নিয়ে মাথার ওপর রাখল। ‘পটাং’ করে শব্দ হল মাথাটা ফাটার।

শিউরে উঠল চুয়া।

হাতিটা, কালো পাথরের খোদাই করা একটা হাতিরই মতো, নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

চুয়া একেবারে ঋষির গা ঘেঁষে এসে বলল, মারো! মারো!! কানে মারো! পাশ ফিরে আছে। আলো ফেলেছি আমি। উত্তেজনায় ঋষির শক্ত বাহুতে ওর স্পন্দিত বুকের ছোঁয়া লাগল। এক মুহূর্তের জন্য। দু-জনেই শিউরে উঠল। ইলেকট্রিক শক লাগার মতো। এবং হাতিটাও। হাতিটা ঘুরে দাঁড়াল।

ঋষি আবার গুলি করল। এবার আকাশের দিকে নয়; নীচে মাটিতে। ওর পায়ের সামনে।

—এ কী! কানে মারো। চুয়া বলল। মারো মারো ঋষি। মানুষ মেরেছে হাতিটা।

—হাতি মারার পারমিশন নেই। এটা স্যাংচুয়ারি।

চাপা গলায়, অসহায়ের মতো বলল ঋষি।

না?

ফিসফিস করে চুয়া বলল, মানুষ মরে গেলেও?

—তবু মারা যাবে না।

—মানুষ মারার পারমিশন কে দিল?

ঋষি জবাব দিল না।

ম্যাগাজিন রাইফেলটার বোল্ট সরিয়ে আবার গুলি করল একটা ওপরে। এবার কী মনে হওয়াতে হাতিটা অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকারতর একটা স্তূপের মতো আস্তে সরে যেতে লাগল। পৃথিবীর সব সময় তার শুঁড়ে জড়িয়ে নিয়ে।

চুয়ার মনে হল, দোতলা বারান্দার সামনেটা হঠাৎ যেন আলোকিত হয়ে উঠল।

দেখা যেতে লাগল আবার। আসলে হাতিটা এতক্ষণ সবকিছু আড়াল করে ছিল।

হাতিটা চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর কোয়ার্টার থেকে আলো হাতে এক এক করে মানুষ এগিয়ে আসতে লাগল এদিকে।

ঋষি রাইফেলটা হাতে করে নেমে গেল নীচে, টর্চ ধরে অন্য হাতে। যাবার আগে চুয়াকে বলল, ভেতরে যাও। বীভৎস দৃশ্য। আলো আসার আগেই ঘরে যাও। রাকাকে দ্যাখো।

রাগ হল চুয়ার। মহত্ত্ব দেখাচ্ছে ঋষি। অন্য পুরুষ হলে, পুরুষের মতো পুরুষ হলে এমন বউকে চাবকাত।

ঘরের দিকে যেতেই রাকা আবার অমানুষিক চিৎকার করে উঠল, ইঁ! ইঁ! ইঁ! ইঁ!

চুয়াকে দেখেই পাগলের মতো চিৎকার করে বলল, ইউ—উ—উ—উ…দা উইচ। ডাইনি—ই—ই—ই! তোকে পুড়িয়ে মারব আমি। কোথায়? কোথায় কেরোসিন? কেরোসিন কোথায়? কাঞ্চি—ই—ই—ই—ই! বলেই, কিচেনের দিকে দৌড়ে গেল।

এবার ভয় পেয়ে গেল চুয়া। ডাকল, কাঞ্চি—ই—ই—ই….

দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল রাকাকে। চুয়া দৌড়ে গেল। কাছে যেতেই, চটাস করে প্রচন্ড এক চড় মারল রাকা চুয়াকে।

বলল, ইউ বিচ। আই উইল কিল ইউ।

বলেই, চুল ধরল চুয়ার।

চুয়ার দু-চোখে জলে ভরে এল। যন্ত্রণার চেয়েও বেশি অপমানে। মার খেতে খেতেও ও আর কাঞ্চি মিলে ওকে বেডরুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল জোর করে। এমন সময় ঋষি এসে ঢুকল ঘরে। কাঞ্চিকে বলল, দাবা, দাবা, জলদি দাবা লাও।

কাঞ্চি দৌড়ে কীসব ওষুধ নিয়ে এল। দুটো করে দু-রকম চারটে ট্যাবলেট একসঙ্গে মুখে পুরে দিল কাঞ্চি আর ঋষি জোর করে রাকার মুখ হাঁ করিয়ে এবং ওর হাত-পা চেপে রইল যতক্ষণ-না ঘুমিয়ে পড়ে রাকা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রাকা গভীর ঘুমে এলিয়ে পড়ল। চুয়া এসে ওর বুট আর মোজা খুলে দিল।

ঋষিকে জিজ্ঞেস করল নীচু গলায়; কাঞ্চিকে ডেকে, ওর জামাকাপড় খুলে কি নাইটি পরিয়ে দেব?

—না থাক। এই অবস্থায় গায়ে লেপ রাখে না ও। এই পরেই থাক। ঠাণ্ডা লাগবে তা না হলে। এর ওপরেই বরং লেপটা দিয়ে দাও। বলেই, একটু চুপ করে থেকে বলল, গলা নামিয়ে। আর, শোনো চুয়া। তুমি এঘরে থেকো না। কোনো কারণে ঘুম ভাঙলে তোমাকে দেখতে পেলে খুব মুশকিল করবে। আমি একটু নীচে যাচ্ছি। জিপ দিয়ে সদরে পাঠাতে হবে ডেডবডি। পোস্টমর্টেম করার জন্যে। লোকটার নাম হরেন কাঠাম। পাঁচটা ছেলে-মেয়ে। দুটো বউ। রোজগেরে একজন।

একটুক্ষণ ঘুমন্ত রাকার মুখে তাকিয়ে রইল ঋষি। তারপর চুয়ার চোখে চোখ রেখে বলল, জানো আমার দুঃখটাই পৃথিবীতে একমাত্র দুঃখ নয়। গভীরের চেয়েও গভীরতর দুঃখ আছে, এই-ই সান্ত্বনা।

ঘর থেকে চলে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে ঋষি বলল, তুমি বরং বারান্দাতে এসে বোসো। ডেডবডি সরিয়ে নিয়েছে। অন্ধকার দ্যাখো বসে বসে। দেখতে ভালোবাসো তুমি অন্ধকার।

চুয়া ঋষির সঙ্গেই বারান্দায় এল। ঋষি যখন নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে, ও বলল, শুধুই অন্ধকার নয়। আলোও দেখতে ভালোবাসি আমি ঋষি।

—আলো কোথায়? খুব অন্ধকার। আলো নেই।

বলল, ঋষি।

কাঞ্চিকে ডেকে দিয়ে চুয়া বারান্দায় এসে বসল। হাতে রাইফেল থাকা সত্ত্বেও, ঋষি হাতিটাকে মেরে কেন যে হরেন কাঠামকে বাঁচাল না তা ভেবে পাচ্ছিল না চুয়া। একটা মানুষের প্রাণের কোনো দাম নেই? একটা হাতির প্রাণের দাম তার চেয়ে বেশি? হোক না এ স্যাংচুয়ারি! তারপরই তার রাকার কথা মনে হল। রাকার যে মাথায় গোলমাল হয়েছে একথা আগে জানলে কখনো ও নিজেকে অপরাধী করতে এখানে আসত না। তা ছাড়া, এমন রোগীকে ঋষিই-বা জঙ্গলে ফেলে রেখেছে কেন? ঋষি কি কোনো মোদেসিয়া বা রাভা বা মেচ বা সাঁওতাল রক্ষিতা রেখেছে? কাঞ্চির সঙ্গেই কি কিছু? না:। মনে তো হয় না। কী জানি! কত কী ঘটে সংসারে। অসম্ভাব্য বলে কিছু আছে কি?

বারান্দায় কতক্ষণ বসেছিল কে জানে। রাত এখন অনেক। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু একটি কোয়ার্টার থেকে সম্মিলিত গলার কাঁপা কাঁপা কান্না ভেসে আসছে। এরা কারা? হরেন কাঠামের দুই বউ এবং পাঁচ ছেলে-মেয়েরা? বাড়ি কোথায় হরেন কাঠামের? কাঠামবাড়িতে কি? একবার ভরা বর্ষায় তিস্তার অন্য পারে দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলে কাঠামবাড়ির ফরেস্ট বাংলোর হাতিকে ভেসে যেতে দেখেছিল। কী লাভ আর বাড়ি কোথায় জেনে। সে ঠিকানা তো তামাদিই হয়ে গেছে। হরেন কাঠামের এখন অন্য ঠিকানা। অচেনা দেশে।

একটা চিতাবাঘ ডাকছে করাত চেরার মতো করে। ঋষিই একদিন চিনিয়েছে তাকে এসব ডাক-টাক। জঙ্গলকে ও স্থবির বলে জানত। এরমধ্যে যে কত এবং কত কতরকম প্রাণ! ঋষি কোথায়? নিশ্চয়ই সদরে গেছে। নিজেই গেছে কি জিপ চালিয়ে? ডেডবডি নিয়ে? সঙ্গে কে কে গেছে আর? হাতিটা? ঋষি কি চেনে জলপাইগুড়িতে অনেককে? চেনার কথা। পুলিশের ডি আই জি আছেন কমল মজুমদার ওখানে। তাঁকে চিঠি দিয়ে দিতে পারত একটা চুয়া। তার কাকার বন্ধু। যদি কোনো কাজে লাগেন। বীরেন সাহাও ছিলেন এখানে অনেক বছর আগে? তখন চুয়া ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। এখন তো কলকাতায়। শুনেছে এখন জয়েন্ট কমিশনার হয়ে গেছেন।

চাঁদ উঠল। আজ কোন তিথি, কে জানে। এখন কি শেষরাত? রাতের শেষে কী আছে? কাঞ্চি দু-বার এসেছিল, কিছু খাবে কি না জিজ্ঞেস করতে। কিছু খাবার মতো মানসিক অবস্থা তার একেবারেই নেই। দু-বার ও ঘরে গিয়ে রাকাকে দেখে এসেছে। ভীষণ-ই কষ্ট হচ্ছে চুয়ার। হরেন কাঠামের জন্যে। রাকার জন্যে। এবং ওর নিজের জন্যেও।

খুব কষ্ট।

অনেক বেলা এখন। ঘুম ভাঙতেই বুঝল যে, ইচ্ছে করেই ওকে তোলেনি কেউ। শরতের আলোয় চারদিক ঝকঝক করছে। এমন শারদ সকাল শুধু উত্তরবঙ্গের জঙ্গলেই আসে। ক্লোরোফিল। ক্লোরোফিল! নাইটির ওপর শাল জড়িয়ে বারান্দাতে বেরিয়েই দেখল, ঋষি বসে আছে। ও একটু লজ্জা পেল। কিন্তু দেখাল না তা। বসল।

চান করেছে। খাকি পোশাকও পরেছে ঋষি। রাতে নিশ্চয়ই ঘুমোয়নি। কিছু কি খেয়েছে? রাকা যখন সুস্থ থাকে, তখনও ঋষির খাওয়াদাওয়ার দিকে খুব-একটা নজর দেয় বলে মনে হয়নি চুয়ার। রাকা বিরাট বড়োলোকের মেয়ে। চা-বাগানের মালিক ওরা। বড়োলোকের সঙ্গে বড়োলোকের আর গরিবের সঙ্গে গরিবের বিয়ে হলেই বোধ হয় সহজে সুখী হয় কোনো দম্পতি। রাকার কষ্টর কথা খুব সম্ভব মানুষ হিসেবে এত ভালো হওয়া সত্ত্বেও ঋষি বোঝে না, আর রাকা বোঝে না, ঋষির কষ্ট।

—এসো! ঘুম হল ভালো?

হেসে বলল ঋষি।

কোনো অনুযোগ নেই, ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই গলায়।

—তুমি তো একটুও ঘুমোওনি রাতে।

—আমার কাজই তো ঘুমোনো। এখানে ঘুমোনো ছাড়া আর কী করি? কয়েক রাত না ঘুমোলে কিছুই হয় না। চা, মানে ব্রেকফাস্ট খেয়েছ?

—না। খাব। কাঞ্চি তৈরি করছে। বেড-টি তো দেয়নি আজ। আগে চা তো খাবে এক কাপ। কি চুয়া? দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি।

—এ কী! এ কী! ছি: ছি:। মেল-শভিনিস্টের এ কী অধঃপতন!

হেসে বলল চুয়া।

হাসতে পারল দেখে, ভালো লাগল। নিজের।

বলল, তুমি বোসো তো চুপ করে। তোমায় কিছু করতে হবে না। আমি দেখছি। রাকা কি চা খেয়েছে?

—না। এখনও ঘুমোচেছ। কাঞ্চিকে বলে গেছিলাম। শেষরাতে আবার ও ওষুধ দিয়েছে। ঘুমই ভাঙেনি। আরও অনেকক্ষণ ভাঙবে না।

ভেতর থেকে দু-কাপ চা বানিয়ে ট্রেতে করে নিয়ে এল চুয়া। টেবিলে নামিয়ে রাখল। ঋষির সামনে। তারপর ওর উলটোদিকে বসে বলল, নাও। তারপর বলল, এত সকালেই ধরাচূড়া পরে যে?

—বড়োসাহেব আসছেন। খুবসম্ভব, এই হাতিটাকে রোগ ডিক্লেয়ার করা হবে।

—তারপর? তুমি মারবে?

ঋষি হাসল।

বলল, রোগ-হাতি মারা সোজা কথা নয়। আমাদের চা-বাগানের পটাদা আছেন। পটা গুহ। তা ছাড়া মূর্তি নদীর পাড়ে মূর্তি ব্লকে গোরুমারার পাশে, বাবা আছেন ক্যাম্প করে।

—বাবা কে? কার বাবা?

—সকলেরই বাবা। লালজি। দরকার হলে কলকাতা থেকে ধৃতিকান্তবাবু বা চঞ্চল সরকারকেও তলব করা হবে। ভালো শিকারির অভাব নেই। ডিক্লারেশানটা আগে করা দরকার।

—একটা কথা বলবে?

চুয়া বলল।

—বলো!

—কিছু গোপন করবে না আমাকে?

—এই সাত দিনে আমাকে দেখে কি মনে হয়েছে তেমন? গোপন করাই কি স্বভাব আমার?

—না তা নয়। ব্যাপারটা এত ডেলিকেট।

—জানি। কী বলবে তুমি! তবে শোনো। বিয়ের তিন মাস পর থেকেই রাকার এরকম হয়।

—সেকী!

—হ্যাঁ।

—ডাক্তার?

—সব ডাক্তার শেষ। ওঁরা মেন্টাল হসপিটালে রাখতে চেয়েছিলেন।

—রাখলে না কেন?

—সেখানে উন্মাদেরাও থাকে। আমার মনে হয়েছিল, তাতে আরও খারাপ হবে।

—ওঁর বাড়ির লোকজন?

—বাড়ির লোকজন বিশেষ ইন্টারেস্ট নেন না। তুমি তো অনেক দিনই জলপাইগুড়ি ছাড়া। বোধ হয় জানো না যে, রাকার বাবাকে ওঁর ছোটোভাইয়েরা কিছুই দেননি। উনি থাকেন এখন শিলিগুড়িতে। হাকিমপাড়ায়। একটা ছোট্ট বাড়ি ভাড়া করে। একা। মা তো গেছেনই। বড়ো কষ্টে থাকেন। প্রতিমাসে আমি টাকা পাঠাই।

—তার একটা বিহিত করলে না তুমি!

—কীসের বিহিত? কিছু কিছু লোক এ পৃথিবীতে মন্দভাগ্য নিয়েই আসে চুয়া। রাকার বাবার যদি আজ অনেক টাকাও থাকত, রাকার দুঃখ কি সেই টাকার সুখ ঢেকে দিতে পারত? মা-মরা একমাত্র সন্তান।

—ডাক্তাররা কী বলছেন? বিয়ের পরই কেন এমন হল?

—তোমাকে বলছি। আর কাউকে বলিনি আগে। তুমিও বোলো না কাউকে।

একটু চুপ করে থেকে বলল, যেন খুবই কষ্ট করে বিয়ের তিন মাস পর্যন্ত আমরা দু-জনে কাছাকাছি আসিনি, মানে ইউ নো, হোয়াট আই মিন। ওরই আপত্তি ছিল। প্রথম যেদিন ব্যাপারটা…সেদিনই এরকম। পরে ডাক্তারদের কাছে শুনেছি যে, রাকার বাবাই ওঁদের বলেন, রাকার যখন তেরো বছর বয়স, তখন তিস্তার একজন চরুয়া বেদে ওকে রেপ করে। লোকটা সাড়ে ছ-ফিট লম্বা ছিল এবং দু-মন ওজন। ডাকাত। তার ভাইকে রাকার বাবা তিস্তার চরে শুয়োর শিকার করতে গিয়ে কী ব্যাপারে রেগে গিয়ে গুলি করে মেরে দেন। সেই রাগেই লোকটা এরকম করে। বিয়ের পর প্রথম ধরা পড়ে যে, ও চিরজীবনের মতো ফ্রিজড হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, আরও নানা ইমব্যালান্স-এর শিকার হয়েছে।

—কী অন্যায়!

—অন্যায়টা চড়ুয়া মুসলমানের নয়। রাকার বাবারই। উনি জেল খাটলে বা ফাঁসি গেলে রাকার ওপর বিচারের খড়্গটা পড়ত না। কিন্তু এ দেশে পয়সাওয়ালা লোকেদের জেল হয় না। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্রের আমল থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে।

—একটা কথা বলব?

চুয়া বলল।

—বলো।

—তোমাদের তো সম্বন্ধ করেই বিয়ে। তোমরা তো একে অন্যকে চিনতেও না। মাত্র তিন মাসের ব্যাপার। তুমি তাহলে ডিভোর্স চাইলে না কেন? এ কেমন সেলফমলেস্টেশান?

দুস…বলে হেসে উঠল ঋষি। দুটি হাত দু-দিকে ছড়িয়ে দিয়ে। বলল, পাগল! তা কি হয়? বেচারির কী দোষ। যাকে স্ত্রী বলে মেনেছি, যাকে জীবনে প্রথম চুমু খেয়েছি, নিরাবরণ করে যাকে দেখেছি, যে আমার জীবনের প্রথম ও শেষ নারী তাকে নিছক…যা:। তা হয় না। ভাবতেই পারি না আমি!

—সেকী! শারীরিক ব্যাপারটা থেকে তুমি চিরদিনই বঞ্চিত থাকবে? তোমার ছেলে-মেয়ে? কী জীবন…

—ছেলে-মেয়ের অভাব কী? জানো, কাল রাত থেকেই ভাবছি হরেন কাঠামের সব ক-টা ছেলে-মেয়ের ভার নেব আমি। খুব-একটা ভালো করে মানুষ করতে পারব না। তবু মোটা কাপড়, মোটা ভাত!

—আর তার দু-বউয়ের ভার? সেটাও নিচ্ছ তাহলে? বা: ভালোই! পারকুইজিট। আজকাল সহবাস মানেই তো আর প্রেগনেন্সি নয়।

হেসে ফেলল ঋষি। বলল, তুমি খুব খারাপ।

—আমি খারাপ তা আমি জানি। কিন্তু যতখানি ভালো তোমার মধ্যে; শুধু তোমার মধ্যেই-বা কেন, যেকোনো মানুষের মধ্যেই না-আঁটে, তুমি ততখানিই ভালো হবার চেষ্টা করছ। এই ভালোত্ব টিকবে না।

কাঞ্চি এসে বলল, নাস্তা লাগা দিয়া।

চুয়া বলল, তুমি খেয়ে নাও। আমি রাকার কাছে যাই।

—না না। তুমিও খেয়ে নাও। ওখানে যেয়ো না। ডাক্তারকে খবর দিয়েছি। উনি আজ এখানেই আসবেন।

—এই জঙ্গলে কি চিকিৎসা হয়?

—তা হয় না। কিন্তু মানুষ মানুষের মর্যাদা পায়। রাকাকে শহরে রাখলে, একটা এরকম অ্যাটাকের পর ও যখন সুস্থ হয়ে চলাফেরা করত, তখন শিক্ষিত ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলারা ওকে পাগলি বলে আড়াল থেকে টিটকিরি দিতেন। তাদের ছেলে-মেয়েরা ঢিল মারত ওকে, কুকুর লেলিয়ে দিত। বুঝলে চুয়া, এদেশে ‘শিক্ষা’ ব্যাপারটা বেছে বেছে কোশ্চেন মুখস্থ করে খাতায় উগরে দেওয়া বা টুকে ডিগ্রি পাওয়াতেই আটকে গেল। শিক্ষা কাকে যে বলে, তাই-ই আমরা শিখলাম না। ভাবলে, ভারি লজ্জা করে। এখানের সকলে, মানে আমার এই জঙ্গলের প্রতিবেশীরা ওর প্রতি সহানুভূতিশীল। এবার না-হয় তুমি আছ। অন্যান্য বার ওঁরাই রাকার সব ভার নেন। দ্যাখো, ও আজ বিকেলেই ঠিক হয়ে যাবে। ইদানীং এই অ্যাটাকগুলো অনেক কমেও গেছে। ন-মাসে ছ-মাসে হয়। এর আগে হয়েছিল ছ-মাস আগে। একজন ফরেস্ট গার্ডের মস্ত ভুটিয়া কুকুর আছে। সেই গার্ড ওই কোয়ার্টারে থাকে। সাংঘাতিক দেখতে। গার্ড নয়; কুকুরটা। সেই কুকুরটা বাংলোর হাতায় একদিন বাহাদুরের ছিপছিপে দুবলি-পাতলি লালচে কুকুরিটাকে….বাহাদুরের কুকুরি কেঁই কেঁই করে চ্যাঁচাতে থাকে…সেই আওয়াজ শুনে রাকা বারান্দাতে দৌড়ে আসে এবং ওই অবস্থায় দেখে কুকুর দুটিকে। দেখেই এইরকম—ইঁ! ইঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ করে চিৎকার করতে থাকে। বেচারি! যে অভিজ্ঞতা জীবনের প্লেজেন্টেস্ট অভিজ্ঞতা হতে পারত তাই-ই ওর কাছে বিভীষিকা হয়ে রয়েছে। সেই ঘটনার পর আবার এই হাতির জন্যে হল। যা বুঝছি, যেকোনো ভায়োলেন্ট ব্যাপার হলেই ও মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।

টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে চুয়া বলল, আমি আজ চলে যাব ঋষি।

চমকে উঠল ঋষি।

ওর মুখ দেখে মনে হল, ভীষণ ব্যথিতও হল ও।

ওর সব খুশি যেন নিভে গেল।

মুখ নীচু করে বলল, কেন চুয়া?

—কেন না? না কেন? তুমিই ভেবে দ্যাখো।

ঋষি চুপ করে থাকল।

—কী? কথা বলো?

গলাটা যেন ভারী শোনাল নিজেরই কানে চুয়ার।

—ঠিকই। থেকে কী করবে? কেনই-বা থাকবে? তোমাকে আটকে রাখার মতো কোনোরকম জোরই তো আমার নেই। রাখবই-বা কেন? যেতে ইচ্ছে হলে যাবে।

তারপর বলল, তোমাদের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে প্রতি শনি রবি ছুটি, না?

—হ্যাঁ। কেন বলো তো?

—প্রতি উইক-এণ্ডে আসতে পারো না তুমি চুয়া? কাঞ্চনজঙ্ঘাতে চলে এসো। আমি গিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে নিয়ে আসব। আবার রবিবার রাতে তুলে দিয়ে আসব।

—চাকরিটি যাবে।

হেসে বলল চুয়া। সকালের ট্রেন প্রায়ই দেরিতে পৌঁছোয়। আমাদের সাহেবি অফিস। সরকারি বা আধাসরকারি নয় যে, কাজের সময় খেলা আর স্লোগান দিয়েই মাইনে পাওয়া যায়। খেটে খেতে হয় আমাদের।

—আমি বুঝি খেটে খাই না? ঠাট্টা করছ? আমিও তো একজন সরকারি কর্মচারী।

—সরি! সরি! তুমি খাও। নিশ্চয়ই খেটে খাও। তোমার মতো অনেকেই তাই করেন। কিছু লোক না খাটলে তো পুরো ব্যাপারটা ধসে পড়ে যেত। তোমরা আছ বলেই আছে। তোমরা কিন্তু ব্যতিক্রম। আচ্ছা! ডাক্তার কখন আসবেন ঋষি? কথা ঘুরিয়ে বলল চুয়া।

—বিকেলে।

—তুমি আমাকে হাইওয়েতে বাস ধরিয়ে দেবে। রাতটা সিনক্লেয়ারস-এ থেকে কাল প্লেনে চলে যাব। আজ যদি ট্রেনের টিকিট পাই তবে তো ভালোই।

—তোমার টিকিট তো কাটাই আছে। পরশুর। পরশু গেলে হত না?

—না:। টিকিট থাক। আমি চলেই যাই।

—রাকাকে সুস্থ দেখে যাবে না?

—না:, তার আগেই গেলে ভালো। চিঠি লিখব ওকে। আমার সন্দেহ হচ্ছে কালকে আমার আর তোমার দেরি দেখেই ও…

—হতে পারে। কিন্তু তাতে তোমার অপরাধটা কী?

ঋষির চোখে চোখ রেখে চুয়া বলল।

—না, আমার অপরাধ নেই। আমার একার নয়, তোমারও নেই।

—আমার অনেকই অপরাধ। অপরাধ এই-ই যে, স্বার্থপর হতে পারিনি, আধুনিক হতে পারিনি। নিজেকে যতখানি ভালোবাসা উচিত ছিল; ততখানি ভালোবাসতে পারিনি।

—হুঁ। কিন্তু সময় তো যায়নি এখনও। যদি মনে করো যে ভুল করেছ, তাহলে এখনও শোধরাতে পারো।

চুয়া বলল।

এমন সময় একটা জিপের শব্দ শোনা গেল। বাইরে।

তাড়াতাড়ি কাঁটা-চামচ ছুড়ে ফেলেই ঋষি দৌড়ে নেমে গেল নীচে দুপদাপ শব্দ করে।

চুয়াও তাড়াতাড়ি ঘরে গেল। যেভাবে আছে এভাবে তো কোনো অপরিচিত লোকের সামনে বেরোনো যায় না। যদি ঋষির বড়োসাহেব ওপরে আসেন? জানলার পাশে, পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক কৌতূহলবশেই তাকাল ও। নীচে খুব রাশভারী সম্ভ্রান্ত চেহারার ভদ্রলোক বড়োসাহেব। জিপ থেকে নেমেই হ্যাণ্ডশেক করলেন ঋষির সঙ্গে। বললেন, রাকা কেমন আছে?

অপরাধীর মতো ও বলল, হাতিটা যখন ধরল হরেনকে, কাল রাতে; তখনই একটা অ্যাটাক হয়েছে। হঠাৎ।

—আই অ্যাম সরি। রিয়ালি আই অ্যাম সরি ঋষি! মিসফরচুন নেভার কামস এলোন। লুক আফটার হার। লাস্ট অ্যাটাক কবে হয়েছিল?

—ছ-মাস আগে।

—আই সি! তা ডাক্তারকে খবর দিয়েছ?

—হ্যাঁ। এসে যাবেন। শিলিগুড়ি থেকে আসছেন তো একটু সময় লাগবে।

—শোনো একটু পরেই হরেনের ডেডবডি নিয়ে আসছে ওরা। পোস্টমর্টেম করিয়ে দিয়েছি। হরেনের পরিবার এবং অন্য সবাইকেও বলে রাখো। এখানে কি গোলমাল চ্যাঁচামেচি ঠিক হবে? রাকার কেসটা অ্যাগ্রাভেটেড হবে না তো? তার চেয়ে আমি বলব সোজা কোনো নদীর পারে নিয়ে যাওয়াই ভালো হবে, এখানে সিন ক্রিয়েট না করে। রাকার কথা ভেবেই বলছি।

—হলে হবে স্যার। হরেন কাঠাম তো দু-বার মরবে না। তার পরিবারের লোকেদের রাইট আছে ওকে শেষবার কাছে পাবার; দেখবার।

—হুঁ। মে বি, ইউ আর রাইট!

বলেই বড়োসাহেব তাকালেন ঋষির মুখের দিকে।

চুয়া ভাবল, মানুষটা একটি অদ্ভুতচরিত্র। এতবেশি ভালো এবং আপ-রাইট সোজা যে, হাসি পায় মাঝে মাঝে। ইটস টু গুড টু বি…মানে ওর ভালোত্বটা।

—তাহলে কি রেকমেণ্ড করে দেব স্যার? ‘রোগ’ বলে ডিক্লেয়ার করার জন্যে? ওয়াইল্ড লাইফ ফাণ্ডের তাঁরা কিছু বলবেন না তো? যদিও এখানে সরাসরি কেউই নেই ওঁদের।

বড়োসাহেব পাইপ থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছাই ফেলতে ফেলতে বললেন, তাঁরা যদি বলেন তো বলবে। জঙ্গল বা জঙ্গলের প্রাণীদের তাঁদের চেয়ে আমরা কিছু কম ভালোবাসি না ঋষি। নিজের বিবেক যা বলবে, তাই-ই করবে। অলওয়েজ। বিবেককে যদি বোঝাতে পারো, তাহলে সহজেই অন্যদেরও পারবে।

পাইপে আগুন ধরিয়ে বললেন, তা ছাড়া এটা আমারই রেসপনসিবিলিটি। তুমি স্ট্রংলি রেকমেণ্ড করে দাও। আমি নিজে গিয়েই ডি. সি.-কে বলছি। উনিই অর্ডার পাস করবেন। এত লোকের প্রাণের ঝুঁকি নেওয়াটা অমানুষিক ব্যাপার হবে। কোনো গোলমাল হলে সোজা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ো। ঘাড় যথেষ্ট মোটা আমার। কোনো চিন্তা কোরো না। তুমি এখন এমনিতেই যথেষ্ট ঝামেলাতে আছ। এসব ব্যাপার আমার ওপর ছেড়ে দাও।

—স্যার, আপনি যাবার সময় রাকার এক বান্ধবীকে একটু নিয়ে যাবেন? কলকাতা থেকে এসেছেন। ছেলেবেলায় জলপাইগুড়ি ছিলেন উনি, সেই সুবাদে বন্ধুত্ব। আপনি ওঁকে জলপাইগুড়িতে নামিয়ে দিলেই হবে। শি উইল টেক আ ট্যাক্সি টু নিউজলপাইগুড়ি আর শিলিগুড়ি। বেচারি বেড়াতে এসে কী…

—বাই অল মিনস। নো প্রবলেম! তুমি অত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? আমার জিপ দিয়েই পাঠিয়ে দেব না-হয় শিলিগুড়িতে। নইলে নাড়ুবাবুকে বলে দিতে বলব বোসকে, বন্দোবস্ত সব ঠিক হয়ে যাবে। গাড়িতেই পৌঁছে দিয়ে আসবে।

বলে, উনি অফিসের দিকে এগোলেন ঋষির সঙ্গে।

চুয়া চান করতে গেল। বালতি করে গরম জল দিয়ে গেছিল কাঞ্চি। চান করতে করতে ও ভাবছিল, ঋষির বড়োসাহেব, বড়োসাহেব হবার যোগ্যতা রাখে। কোয়াইট ইন্টারেস্টিং। ঋষির মতো মিনমিনে নয়। আজ ট্রেনের টিকিট পেয়ে গেলে কাল সকালেই পৌঁছোবে, আর প্লেনে গেলে বিকেলে। উইক-এণ্ডটা মজা করে কাটাবে। মনটা বড়োই খারাপ হয়ে গেল এখানে এসে। ওর ছোটোবেলাটা অনেক দুঃখেই কেটেছে। তাই বড়ো হওয়ার পর থেকেই শুধুই আনন্দ করতে চায়। প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব অনেক দুঃখ থাকেই, তার ওপর পরের দুঃখে আর জড়াতে ভালো লাগে না।

চান করে উঠে জামাকাপড় পরে সবকিছু গুছিয়ে নিল। বেশিকিছু অবশ্য আনেনি। তবু, শীত পড়ে গেছে। তার ওপর জঙ্গলে আসা। একেবারেই কিছু না নিয়ে আসাও যায়নি।

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল।

দরজা খুলে দেখে, ঋষি।

—কী ব্যাপার! একেবারে তৈরি যে। ঋষি বলল। চলে যাবার আনন্দে ডগমগ করছ মনে হচ্ছে!

—যেতে যখন হবেই, মায়া বাড়িয়ে লাভই-বা কী?

হেসে বলল চুয়া।

মনটা খুব খারাপ লাগছে। রাকাটা এখনও ঘুমিয়েই রইল। যেতে ইচ্ছেও করছে না, অথচ থাকলেও বিপদ।

—হুঁ। থাকলে, সত্যিই বিপদ।

পরক্ষণেই ঋষি ছেলেমানুষের মতো বলল, চুয়া, তোমার ঘরে, তোমার কাছে একটু বসতে পারি?

চুয়ার মনটা হঠাৎ নরম হয়ে এল। চোখ যেন ভিজে উঠল। হঠাৎ পরক্ষণেই শক্ত করল নিজেকে। আধুনিক শিক্ষিত মানুষের সেন্টিমেন্টাল হওয়া মানায় না।

হেসে বলল, নিশ্চয়ই! আমার ঘর মানে কী? সবই তো তোমার! আমি তোমার ক্ষণিকের অতিথি!

ঋষি বলল, তোমাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?

—নিশ্চয়ই!

—তুমি কি মাঝে মাঝে আসবে? এখানে, এই জঙ্গলে?

—আসতে তো চাই। কিন্তু এলে তোমার অশান্তিই বাড়বে। কী লাভ? উপকারে তো আসবই না, অপকারে আসব।

—কার?

—দুজনেরই।

—কোনোই লাভ নেই বলছ?

—না:। ক্ষতি? হ্যাঁ, তোমার তো বটেই।

—কেন? আমার ক্ষতি কেন?

—নিজেকে জিজ্ঞেস করো ঋষি। তোমার বড়োসাহেব তোমাকে খুব একটা দামি কথা বলেছিলেন একটু আগে, শুনলাম— জানলা দিয়ে।

—কী? কী কথা?

—নিজের বিবেক যা বলবে, তাই-ই করবে। নিজের বিবেককেই যদি বোঝাতে পারো তাহলে অন্যদেরও পারবে। নিশ্চয়ই পারবে।

—হুঁ।

—নীচে আওয়াজ হল। ইঞ্জিনের।

—ওই বোধ হয় ডাক্তার সেন এলেন। বলল, ঋষি।

তারপর জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নীচে দেখে বলল, না:।—তোমার যাবার সময় হল চুয়া। ডাক্তার সেন নন, বড়োসাহেব। যাবেন এখন। কাজ হয়ে গেছে। ইস এই ঝামেলাতে আজ ওকে একটু চাও খাওয়ানো গেল না।

ঋষি! বলে, ডাকলেন উনি নীচ থেকে।

—আসছি স্যার।

চুয়া বলল, ঋষির মুখে তাকিয়ে। যাই, ঋষি!

—যাই বলে না।

ওর স্যুটকেসটা তুলে নিয়ে ঋষি বলল, বলো আসি। এবার এসো।

—দেখি! চুয়া বলল, চিন্তিত মুখে।

—তুমি নীচে যাও আমি রাকাকে একবার দেখে আসি। আদর করে যাই।

বাহাদুর আর কাঞ্চিকে বকশিশ দিয়ে আসি।

রাকা শুয়েছিল ঘরে। মুখের একপাশে রোদ এসে পড়েছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল চুয়া সেখানে। রাকার মুখে কেমন যেন এক শিশুসুলভ পবিত্রতা। রাকা যেন সেই তেরো বছরের মেয়ে হয়ে গেছে, যে চড়ুয়া বেদে ডাকাতের হাতে নিগৃহীত হয়েছিল।

রাকার গালে চুমু খাওয়ার সাহস হল না, যদি ঘুম ভেঙে যায়। চলে এল চুয়া। বকশিশ-টকশিশ দিয়ে নেমে আসতে লাগল। এইসব দোতালা পুরোনো বাংলোর কাঠের সিঁড়িগুলো দিয়ে নামলে ধপ ধপ শব্দ হয়। বিচ্ছিরি।

ওর চলে যাওয়াটা পুরোপুরি শব্দহীন হবে ভেবেছিল চুয়া।

স্যুটকেসটা পেছনে তুলে দিয়েছিল ঋষি। চুয়া যাবে বলে বোধ হয় ঋষির বড়োসাহেব নিজেই স্টিয়ারিং-এ বসেছেন, যাতে সামনের সিটে জায়গার অকুলান না হয়। ড্রাইভার পেছনে গেছে। বেশ ভদ্র তো ভদ্রলোক! ভদ্রলোকদের অবশ্য ভদ্রই হওয়ার কথা! ভদ্রলোক ব্যাচেলর। ঋষির কাছে শুনেছিল আগে।

—আসুন! আসুন! পাইপের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জিপ থেকে নেমে, নমস্কার করে ভদ্রলোক বললেন চুয়াকে।

চুয়ার নিজের সম্বন্ধে, নিজের চেহারা, নিজের ব্যক্তিত্ব, নিজের সপ্রতিভতা ইত্যাদি কোনো কিছু সম্বন্ধেই নিজের মনে কখনোই কোনো সন্দেহ ছিল না। মিষ্টি করে হেসে ও তাকাল ভদ্রলোকের দিকে। দু-হাত তুলে নমস্কার করল।

ফাইন, মনে মনে বলল চুয়া। রীতিমতো হ্যাণ্ডসাম অ্যাণ্ড আ ফরেস্ট অফিসার অ্যাজওয়েল।

কিন্তু উনি হাসতেই ওই হাসিটাই ভালো লাগল না। কেমন জান্তব ব্যাপার আছে হাসিটাতে। হায়না বা শেয়ালের মতো যেন।

ভদ্রলোক যেন প্রথম দর্শনেই একটু ধাক্কা খেলেন মনে হল। এরকম, ওর সঙ্গে আলাপ হলেই বেশি পুরুষেরই হয়। যেসব পুরুষ আকাট, বেরসিক। ঋষির মতো যারা, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। দেখা যাক, এই মলাট খুললে কী বেরোয়। ভাবল, ও।

চলি! চুয়া বলল আবার ঋষিকে।

চলি নয়; পিসিমাদের মতো বলল ঋষি, বলো, আসি। আবার এসো।

ধুঁয়ো উড়িয়ে অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিলেন বড়োসাহেব।

জিপ এগিয়ে চলল। পরিচিত রাস্তা। কদিন সকাল-বিকেল-দুপুর এ রাস্তায় অনেক ঘোরাঘুরি করেছে। কখনো একা, কখনো ঋষির সঙ্গে। ঋষি নিজে না যেতে পারলে ফরেস্ট গার্ড ঝিরাকে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে। মনখারাপ লাগছিল ওর। এই পথের জন্যে, এই ফেলে যাওয়া জঙ্গলের জন্যে, রাকার জন্যে, হরেন কাঠামের জন্যে; ঋষির জন্যে এবং নিজের জন্যেও। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কোয়ার্টারগুলো সব পেরিয়ে গভীর চওড়া কাঁচা রাস্তায় পড়ল জিপ। এবার জিপের গতি বাড়ালেন বড়োসাহেব। বড়োসাহেবের নামটা চুয়াকে আলাপ করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিল ঋষি। কিন্তু কিছু কিছু মানুষকে বাবা-মার দেওয়া নামের চেয়ে পদেই বেশি মানায়। বড়োসাহেবই থাকুন ইনি।

ভদ্রলোক যেন প্রথম দর্শনেই একটু ধাক্কা খেলেন মনে হল।

চুয়া ডান দিকে চেয়েছিল। গভীর জঙ্গলের একটা আলাদা গাম্ভীর্য আছে। তাকালেই ভয়মিশ্রিত একধরনের শ্রদ্ধা জাগে মনে। চনমনে সকালের চোখ-ধাঁধানো রোদ এসে পড়েছে ঘন কালচে-সবুজ শালবনের চন্দ্রাতপের ফাঁকফোকর দিয়ে। ডান দিকে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল চুয়া। হঠাৎ হুঁশ হতে বুঝল বড়োসাহেব তার দিকে চেয়ে আছেন, যদিও দু-হাত স্টিয়ারিং-এই।

পুরুষের চোখ, কখন যে তাদের কোথায় ছোঁয়; তা অন্যদিকে চেয়েও মেয়েরা তাদের ষষ্ঠবোধে বুঝতে পারে। লোকটার চাউনিটা দুষ্টু। পাজি আছে। তাও ভালো। ঋষির মতো গুডি-গুডি টাইপ এই বয়সে পৌঁছে আর ভালো লাগে না। নেকু-পুষু-মুনু ভালোবাসার একটা বয়স থাকে। সে বয়স চুয়া পেরিয়ে এসেছে অনেক আগেই। ঋষি যেন রবীন্দ্রনাথের গল্পের নায়কেরই মতো, অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অনুক্ষণ, পিসিমা তাকে ভালো বলবেন বলে। বাঙালি পুরুষদের এই মা-পিসিমারই যেন! ভাবছিল, চুয়া?

—কী ভাবছেন? মিস চৌধুরী?

—মিস নয়। এম. এস.। আজকাল মহিলারা মিস বা মিসেস কেউই ব্যবহার করেন না, তা বুঝি জানেন না?

পাজির সঙ্গে পেজোমি করল চুয়া।

—জানি। তবে জঙ্গলে কেউ এম.এস.টেম.-এস. জানেন না ভেবেছিলাম। দেখছি আপনি জঙ্গুলে নন।

—নিশ্চয়ই নয়। জঙ্গলে এসেছিলাম মাত্র। জঙ্গুলে আদৌ নই।

—জঙ্গল ভালো লাগে নিশ্চয়ই!

—সবসময় নয়। মাঝেমধ্যে। ভালোলাগার মতো মন থাকলে।

—নাইস টু নো দ্যাট।

হেসে বললেন উনি।

—কী ভাবছিলেন আপনি তা কিন্তু বললেন না, এম.এস. চৌধুরী।

—তেমন কিছুই নয়। ভাবছিলাম, এই ঋষির কথা। আশ্চর্য মানুষ! এরকম মহৎ মানুষ আজকাল দেখাই যায় না। তাই না?

বড়োসাহেব হঠাৎ হেসে উঠলেন। অল্প হাসি। সাহেবরা যাকে চাকল করা বলেন।

বললেন, ঋষি আমারও খুব প্রিয়। ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ডেডিকেটেড অফিসারস আই হ্যাভ। হিরের টুকরো ছেলে। মে বি, হি হ্যাজ আ লং ওয়ে টু গো ইন দা সার্ভিস। তবে ব্যক্তিগতজীবনে ঋষি, আমার মনে হয় টোটালি কনফিউজড।

—কেন? একথা বলছেন কেন?

—আপনাকে একটা কথা বলব মিস চৌধুরী; সরি, এম.এস. চৌধুরী। বাই দা ওয়ে, আপনি বিবাহিতা?

—আমি এম. এস.। জাস্ট এম.এস.। আপনারা পুরুষরা বড়ো আননেসেসারিলি ইনকুইজিটিভ হন।

ওঃ ফাইন! লজ্জা পেয়ে বড়োসাহেব বললেন, যা বলছিলাম। জানেন এম.এস. চৌধুরী, আমাদের চারধারেই মহত্ত্ব বলে যা যা আমরা প্রায়শই দেখি তার বেশিরভাগই মহত্ত্বর পোজমাত্র।

একটু আহত গলায় চুয়া বলল, তার মানে? কথাটা ঠিক বুঝলাম না।

ঋষির মহত্ত্ব সম্বন্ধে চুয়ার মনে অন্তত কোনোই সন্দেহ ছিল না। ঋষি সম্বন্ধে কোনো খারাপ কথা ও শুনতে রাজি নয়। ওর বড়োসাহেবের কাছ থেকেও নয়।

—মানে, যারা এই পোজ জেনেশুনে দেয় তারা ধূর্ত। এবং মহৎ তো তারা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু তারা এটুকু জানে অন্তত যে, তারা কী করছে। কিন্তু ঋষির মতো মানুষও আছে এখনও কিছু, যারা জীবনের ফ্রেমে মহত্ত্বের মোমেন্টারি পোজ মারতে এসে ফ্রিজ শট-এর মতোই আটকে গেছে চিরদিনের মতো। টোটালি কনফিউজড কিছু মানুষ। সেই মহত্ত্বের মিথ্যা বোধকে অভিশপ্ত মানুষেরই মতো বয়ে বেড়াচ্ছে, নিজে তার নীচে থেঁতলে গিয়ে। সবসময় বোধ হয় ভাবছে, পুরোনো দিনের শিভালরাস নাইটদের মতো, বঞ্চিত হয়ে, চাপা পড়ে; থেঁতলে মরাটাই বুঝি মহত্ত্বর পরাকাষ্ঠা!

—আপনার কি ঋষির ভালোত্বেও সন্দেহ?

মুখ ঘুরিয়ে চুয়া বলল, বড়োসাহেবকে।

—সার্টেনলি নট! হোয়াই শুড আই? তা ছাড়া হি ইজ সাফিসিয়েন্টলি গ্রোন আপ। আই পিটি হিম। দ্যাটস অল।

—আমি শুধু বলতে চাই যে, ঋষি সত্যিই জানে না যে; উই হ্যাভ জাস্ট ওয়ান লাইফ টু লিভ। জাস্ট ওয়ান। ওয়ান শুড বিট ইউ আপ। উইদাউট রিগ্রেটস। একটা জীবন ললিপপ-এর মতো চেটেপুটে খাওয়ার কথা। এ কী আত্মবঞ্চনা!

চুয়া চুপ করেই রইল। ওর মুখে রোদ এসে পড়েছিল। অলক উড়ছিল হাওয়াতে। কাচপোকা আর ফড়িং নাচছিল চাপ চাপ সবুজ ঘাসে—জঙ্গলের পাশে। খুব ভালো লাগছিল চুয়ার।

বড়োসাহেব বললেন, চলুন মিস, সরি এম.এস. চৌধুরী। আপনাকে আমিই নিয়ে যাই সিনক্লেয়ার্স-এ। শিলিগুড়িতে। আপনি কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। রাকার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব, ভাবাই যায় না।

তারপর পেছনে ড্রাইভারের দিকে একবার চেয়ে ড্রাইভার যাতে বুঝতে না পারে সেজন্যেই বোধ হয় ইংরেজিতে বললেন, উই উইল হ্যাভ সাম বিয়ার দেয়ার, অ্যাণ্ড লাঞ্চ। অ্যাণ্ড…অ্যাণ্ড দেন আই উইল লিভ দা রেস্ট ইন ইয়োর বিউ-ই-টি-ফুল হ্যাণ্ডস!

চুয়া মনে মনে বলল, ফাইন। এই সাত দিনে একেবারে হেজেমেজে গেছে ও। গুণ্ডা হাতির ভয়, হরেন কাঠামের বীভৎস মৃত্যু, রাকার বিকার, সন্দেহ, তারপর ওই অ্যাটাক। ভালোই হল। ফর আ চেঞ্জ! শি অলসো উইল বিট ইট আপ। আফটার অল, সহবাস মানেই তো আজকাল প্রেগন্যান্সি নয়! আর প্রেগন্যান্সি মানেই তো আর মা হওয়া নয়! পৃথিবীটা এখন কত সুন্দর ভয়হীন; স্ফূর্তির হয়ে গেছে।

মানুষটি খেলবে মনে হচ্ছে। খেলুক, খেলুক। কে খেলতে চায় আর কে চায় না; তা একটু নিজেও বোঝে আজকাল চুয়া। সুন্দরী মেয়েদের অনেকই বিপদ। খেলনা ভেবে সব পুরুষই খেলতে আসে। জ্বালা! খেলনারও যে পছন্দ-অপছন্দ আছে তা ভাবে না তারা।

শরীরী ব্যাপারে চুয়ার কোনো রক্ষণশীলতা নেই। বিয়ে হয়নি, বয়স হয়েছে। বয়স হয়েছে মানে বুড়ি হওয়া নয়, শরীরী ভালোবাসার শরিক হবার বয়স হয়েছে। তা ছাড়া ও স্বাবলম্বী। নিজের ফ্ল্যাটে থাকে, মানে কোম্পানির ফ্ল্যাট। একা। ওর স্বচ্ছলতা ওকে স্বাধীনতা দিয়েছে। মা-বাবাও গ্রাম্য নন। যথেষ্ট আধুনিক। পার্টি, পিকনিক অনেকই দেখেছে কিন্তু ভালোবাসার যোগ্য কোনো পুরুষই চোখে পড়েনি। শরীর আর মন একসঙ্গে চায়নি কাউকেই। তাই না-দেওয়া হয়েছে মন; না শরীর। শুধু বয়েই বেড়িয়েছে এতদিন।

খেলবে বড়োসাহেব? তাহলে খেলুক। নিরুচ্চারে চুয়া গেয়ে উঠল; ‘আজ খেলা ভাঙার খেলা, খেলবি আয়, আয়, আয়, আজ খেলা ভাঙার খেলা।’

দেখাই যাক মন-বিবর্জিত শরীর কেমন খেলা খেলে।

বড়োসাহেব বললেন, এম.এস. চৌধুরী, শুড উই? তাহলে আমরা কি যাচ্ছি শিলিগুড়ি, সিনক্লেয়ারস-এ? গেলে সামনের মোড়েই ঘুরে যেতে হবে কিন্তু।

চুয়া বড়োসাহেব মানুষটির চোখে তাকাল। সুন্দর, কিন্তু বেশি খাওয়াদাওয়া মদখাওয়া ফোলা ফোলা চোখদুটিতে শুধুই কাম। প্রেম নেই একটুও। একটুও না। চুয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে বড়োসাহেব পথের মোড়ে এসে জিপ দাঁড় করালেন। চুয়া হঠাৎই বলল, আমরা কত মাইল এসেছি? বাংলো থেকে অনেক দূর কি?

—কত মাইল ঠিক বলতে পারব না। তবে দূর একটু তো বটেই। কিন্তু কেন বলুন তো? হঠাৎ একথা!

—যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে যদি বাংলোয় ফিরিয়ে দিয়ে আসেন আপনি।

—কেন বলুন তো? হঠাৎ! আর ইউ অ্যানয়েড উইথ মি! ডিড আই মিসবিহেভ?

বড়োসাহেবের গলায় একটু ভয়ের ছোঁয়া লাগল। পেছনে ড্রাইভার বসে। সে আবার ইউনিয়নেরও পাণ্ডা। লাভের মধ্যে শূন্য, মাঝখানে ফালতু ঝামেলা। কোনো কারণ নেই অন্য। আসলে আমি আমার পার্সটা ফেলে এসেছি বাথরুমে। অনেক টাকা ছাড়াও আমার ‘ডাইনার্স’ ক্লাব-এর কার্ডটা আছে তার মধ্যে।

—সত্যি?

—সত্যি।

—আংশিক সত্যি। পার্টলি ট্রু? তাই না?

হয়তো! চুয়া মুখ ঘুরিয়ে বলল। তারপর বলল, সব সত্যই আংশিক। আজকাল ‘হোল ট্রুথ’ কথাটা বোধ হয় একটা কথাইমাত্র। কোনো মানে নেই কথাটার।

বড়োসাহেব বললেন, কাঁধ শ্রাগ করে, শিয়োর! নো প্রবলেম। এমনকী হাসলেনও একবার। বলেন, ইট ইজ নাইস মিটিং ইউ। নাথিং ইজ ওয়েসটেড ইন লাইফ।

চুয়া বুঝল, মানুষ নারীখাদক। নরখাদক বাঘেরই মতো অশেষ ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা আছে। এরকম লোক কলকাতাতে অনেক দেখেছে। মানে কলকাতার জঙ্গলে। বড়োসাহেব জিপ ঘুরিয়ে দাঁড় করালেন। বনেটটা স্পন্দিত হতে লাগল তার গর্ভে ইঞ্জিনের স্পন্দনে। পাইপটা ধরালেন। তারপর বললেন, স্ট্রেঞ্জ! ভেরি স্ট্রেঞ্জ ইনডিড…

—কী? চোখ তুলে শুধোল চুয়া।

—না:। এমনিই কত কী আশ্চর্য ঘটনা ঘটে, তাই ভাবছিলাম…

উত্তর দিল না চুয়া। মনে মনে বলল, বড়োসাহেব, তুমি অফিসে বড়োসাহেব হতে পারো, হতে পারো দন্ডমুন্ডের কর্তা; সর্বজ্ঞ। কিন্তু ঋষির জীবনে অফিসের বাইরেও একটা মস্ত জগৎ আছে। সকলেরই থাকে। সর্বজ্ঞদেরও অজানা থাকে অনেক কিছুই….

জিপটা চলছিল জোরেই। এবার রোদ ঘুরে গেছে। গালে ওর রোদ পড়ছে না। রোদ ঘুরছে ওর জীবনেও। আশ্চর্য! কেমন হঠাৎ বদল হয়ে যায় অয়নপথের। জিপটা টপ গিয়ারে চলছে এখন। জোরে হাওয়া লাগছে। শরতের হাওয়া। মিষ্টি। না খুব ঠাণ্ডা, না গরম। পথের পাশে আলো-ছায়া এক্কাদোক্কা খেলছে দ্রুত। সরে যাচ্ছে পেছনে প্রতি মুহূর্তে!

চুয়া ভাবছিল, ঋষির কাছ থেকে চলে আসার সময় একেবারে নি:শব্দেই আসবে ভেবেছিল। কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময়ে…

চুয়া স্টিয়ারিং ধরা বড়োসাহেবের হাতে হাত ছোঁওয়াল। বড়োসাহেব চমকে উঠে জিপ থামিয়ে দিলেন।

—কী হল? কী হয়েছে মিস, সরি এম.এস. চৌধুরী?

—কিছু না। জিপটা যখন বাংলোর কম্পাউণ্ডে ঢুকবে তখন হর্নটা খুব জোরে বাজাবেন। অনেকক্ষণ টিপে থাকবেন, প্লিজ।

পিঁ-পিঁ করে বেজে উঠে, ঋষির সমস্ত আকাশময়; চুয়া বলবে :

আমি এসেছি! এসেছি! আমি এসেছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *