অরন্ধনের নিমন্ত্রণ
এক-একজন লোকের স্বভাব বড়ো খারাপ, বকুনি ভিন্ন তারা একদণ্ডও থাকতে পারে না, শ্রোতা পেলে বকে যাওয়াতেই তাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ। হীরেন ছিল এই ধরনের মানুষ। তার বকুনির জ্বালায় সকলে অতিষ্ঠ। আপিসে যারা তার সহকর্মী, শেষপর্যন্ত তাদের অনেকের স্নায়ুর রোগ দেখা দিলে, অনেকে চাকরি ছাড়বার মতলব ধরলে।
সব বিষয়ের প্রতিভার মতোই বকুনির প্রতিভাও পৈতৃক শক্তির আবশ্যক রাখে। হীরেনের বাবার বকুনিই ছিল একটা রোগ। শেষবয়সে তাঁকে ডাক্তারে বারণ করেছিল, তিনি বেশি কথা যেন না-বলেন। তাতে তিনি জবাব দিয়েছিলেন—তবে বেঁচে লাভটা কী ডাক্তারবাবু? যদি দু-একটা কথাই কারো সঙ্গে বলতে না পারলুম! কথা বলতে বলতেই হৃৎপিণ্ড দুর্বল হবার ফলে তিনি মারা যান—মার্টার টু দি কজ!
এ হেন বাপের ছেলে হীরেন। বাইশ বছরের যুবক—আপিসে কাজ করে— আবার রামকৃষ্ণ মঠেও যাতায়াত করে। বিবাহ করবার ইচ্ছা নেই। শুনেছিলাম সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। এতদিন হয়েও যেত, কিন্তু রামকৃষ্ণ আশ্রমের লোকেরা এ বিষয়ে তাকে বিশেষ উৎসাহ দেননি; হীরেন সন্ন্যাসী হয়ে দিনরাত মঠে থাকতে শুরু করলে একমাসের মধ্যেই মঠ জনশূন্য হয়ে পড়বে।
হীরেনের এক বৃদ্ধা পিসিমা থাকতেন দূর পাড়াগাঁয়ে। স্টেশন থেকে দশ-বারো ক্রোশ নেমে যেতে হয় এমন এক গ্রামে। পিসিমার আর কেউ নেই, হীরেন সেখানে পিসিমাকে একবার দেখতে গেল। বুড়ি অনেকদিন থেকেই দুঃখ করে চিঠিপত্র লিখছিল।
সে গ্রামের সবাই এতদিন জানত যে, তাদের কুমী অর্থাৎ কুমুদিনীর মতো বকুনিতে ওস্তাদ মেয়ে সে অঞ্চলে নেই। কুমীর বাবা গ্রাম্য পুরোহিত ছিলেন কিন্তু যেখানে যখন পুজো করতে যেতেন, আগডুম বাগডুম বকুনির জ্বালায় যজমান ভিটে ছেড়ে পালাবার জোগাড় করত, বিয়ের লগ্ন উত্তীর্ণ হবার উপক্রম হত।
কুমীর বাপের বকুনি-প্রতিভার একটা বড়ো দিক ছিল এই যে, তাঁর বকুনির জন্য কোনো বস্তুর প্রয়োজন হত না। যত তুচ্ছ বিষয়ই হোক না-কেন, তিনি তাই অবলম্বন করে বিশাল বকুনির ইমারত গড়ে তুলতে পারতেন। মনে যথেষ্ট উৎসাহ ও শক্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ বলবার ও ছবি গড়বার ক্ষমতা না-থাকলে মানুষে এমন বকতে পারে না বা শ্রোতাদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। তাঁর মৃত্যুর সময়ে গ্রামের সকলেই দুঃখ করে বলেছিল—আজ থেকে গাঁ নিঝুম হয়ে গেল।
দু-একজন বলেছিল—এবার আমসত্ব সাবধানে রৌদ্রে দিও, মুখুয্যেমশায় মারা গিয়েছেন, কাক-চিলের উৎপাত বাড়বে। অর্থাৎ তাদের মতে গাঁয়ে এতদিন কাক চিল বসতে পারত না মুখুয্যেমশায়ের বকুনির চোটে। নিন্দুক লোক কোন জায়গায় নেই?
কিন্তু হায়! নিন্দুকের আশা পূর্ণ হয়নি বা মুখুয্যেমশায়ের হিতাকাঙ্ক্ষীদের দুঃখ করবারও কারণ ঘটেনি। মুখুয্যেমশায় তাঁর প্রতিনিধি রেখে গিয়েছিলেন তাঁর আট বৎসরের মেয়ে কুমীকে। পিতার দুর্লভ বাক-প্রতিভার অধিকারিণী হয়েছিল মেয়ে। এমনকী তার বয়েস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই সন্দেহ করলেন যে, মেয়ে তার বাপকে ছাড়িয়ে না-যায়।
সেই কুমীর বয়েস এখন তেরো-চোদ্দো। সুশ্রী, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, কোঁকড়া কোঁকড়া একরাশ চুল মাথায়, বড়ো বড়ো চোখ, মিষ্টি গলার সুর, একহারা গড়ন, কথায় কথায় খিল খিল হাসি, মুখে বকুনির খই ফুটছে দিনরাত।
শুভক্ষণে দুজনের দেখা হল।
হীরেন সকালবেলা পিসিমার ঘরের দাওয়ায় বসে প্রাণায়াম অভ্যাস করবার চেষ্টা করছে, এমন সময়ে পিসিমা আপন মনে বললেন—দুধ কী আজ দিয়ে যাবে না? বেলা যে তেপহর হল—ছেলেটা যে না-খেয়ে শুকিয়ে বসে আছে, একটু চা করে দেব তার দুধ নেই—আগে জানলে রাত্রের বাসি দুধ রেখে দিতাম যে—
—রাতের বাসি দুধ রোজ রাখ কিনা—
বলতে বলতে একটি কিশোরী একঘটি দুধ হাতে বাড়ির পেয়ারা গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল।
পিসিমা বললেন—দুধের ঘটিটা রান্নাঘর থেকে বের করে নিয়ে আয় দিকি, এনে দুধটা ঢেলে দে—
কিশোরী চঞ্চল লঘুপদে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকল এবং দুধ ঢেলে যথাস্থানে রেখে এসে আমতলায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললে—শোনো ও পিসি, কাল কী হয়েছে। জানো?—হি–হি–
পিসিমা বললেন—কী?
এই কথার উত্তরে আমতলায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি হাত-পা নেড়ে একটা গল্প জুড়ে দিলে—কাল দুপুরে নাপিত-বাড়িতে ছাগল ঢুকে, নাপিত-বউ কাঁথা পেতেছিল, সে কাঁথা চিবিয়ে খেয়েছে, এইমাত্র ঘটনাংশ গল্পের। কিন্তু কী সে বলবার ভঙ্গি, কী সে কৌতুকপূর্ণ কলহাসির উচ্ছাস, কী সে হাত-পা নাড়ার ভঙ্গি, পিসিমার চায়ের জল গরম হল, চা ভিজোনো হল, হালুয়া তৈরি হল, পেয়ালায় ঢালা হল—তবুও সে গল্পের বিরাম নেই।
পিসিমা বললেন—ও কুমী মা, একটু ক্ষান্ত দাও, সকালবেলা আমার অনেক কাজকর্ম আছে—তোমার গল্প শুনতে গেলে সারাদুপুরটি যাবে—এই চা-টা আর খাবারটুকু তোর এক দাদা—ওই বড়োঘরের দাওয়ায় বসে আছে—দিয়ে আয় দিকি।…
কুমী বিস্ময়ের সুরে বললে—কে পিসি?
—তুই চিনিসনে, আমার বড়ো জ্যাঠতুতো ভায়ের ছেলে—কাল রাত্তিরে এসেছে—তবে চা তৈরি করবার আর এত তাড়া দিচ্ছি কী জন্যে? তুই কী কারো কথা শুনতে পাস, নিজের কথা নিয়েই বে-হাতি—
কুমী সলাজমুখে চা ও খাবার দাওয়ার ধারে রেখে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু হীরেন তাকে অত সহজে যেতে দিতে প্রস্তুত নয়। সে কুমীর নাপিতবাড়িতে ছাগলের কাঁথা চিবোনোর গল্প শুনেচে এবং মুগ্ধ, বিস্মিত, পুলকিত হয়েছে এইটুকু মেয়ের ক্ষমতায়।
সে বললে—খুকি তোমার নাম কী?
–কুমুদিনী—
হীরেন বললে—এই গাঁয়েই বাড়ি তোমার বুঝি? ওপাড়ায়? তা ছাগলের কথা কী বলছিলে? বেশ বলতে পারো–
কুমী লজ্জায় ছুটে পালাল।
কিন্তু কুমুদিনীকে আবার কী কাজে আসতে হল। হীরেনের সঙ্গে একটু একটু করে পরিচয় হয়ে গেল। দুজন দুজনের গুণের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ। দুজনেই ভাবে এমন শ্রোতা কখনো দেখিনি। তিন দিন পরে দেখা গেল পিসিমার দাওয়ার সামনে উঠোনে দাঁড়িয়ে কুমী এবং দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে হীরেন ঘণ্টাখানেক ধরে পরস্পরের কথা শুনচে, হীরেন অনর্গল বকে যাচ্চে, কুমী শুনছে—আর কুমী যখন অনর্গল বকচে তখন হীরেন মন দিয়ে শুনচে।
সেবার পাঁচ-ছ-দিন পর পিসিমার বাড়ি থেকে হীরেন চলে এল।
কুমী যাবার সময়ে দেখা করলে না বলে হীরেন খুব দুঃখিত হল, কিন্তু হীরেন চলে যাবার পরে কুমী দু-তিন দিন মনমরা হয়ে রইল, মুখে হাসি নেই, কথা নেই।
বুড়ি পিসিমার প্রতি হীরেনের টানটা যেন হঠাৎ বড়ো বেড়ে উঠল; যে হীরেন দু-বছর তিন বছরেও অনেক চিঠিপত্র লেখা সত্বেও এদিকে বড়ো একটা মাড়াত না, সে ঘন ঘন পিসিমাকে দেখতে আসতে শুরু করলে।
আজ বছর দুই আগের কথা, হীরেনকে পিসিমা বলেছিলেন—হীরু বাবা, যদি এলি তবে আমার একটা উপকার করে যা। আমার তো কেউ দেখবার লোক নেই তোরা ছাড়া। নরসুপুরের ধরণী কামারের কাছে একগাদা টাকা পাব জমার খাজনার দরুন। একবার গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে টাকাটার একটা ব্যবস্থা করে আয় না বাবা?
হীরেন এসেচে দু-দিন পিসিমার বাড়ি বেড়িয়ে আম খেয়ে ফুর্তি করতে। সে জষ্ঠি মাসের দুপুর রোদে খাজনার তাগাদা করে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরতে আসেনি। কাজেই নানা অজুহাত দেখিয়ে সে পরদিন সকালেই সরে পড়েছিল। এখন সেই হীরেন স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে একদিন বললে—পিসিমা, তোমার সেই নরসুপুরের প্রজার বাকি খাজনার কিছু হয়েছে? যদি না-হয়ে থাকে, তবে এইসময় না-হয় একবার নিজেই যাই। এখন আমার হাতে তেমন কাজকর্ম নেই, তাই ভাবছি তোমার কাজটা করেই দিয়ে যাই।–
ভাইপোর সুমতি হচ্ছে দেখে পিসিমা খুব খুশি।
হীরেন সকালে উঠে নরসুপুরে যায়, দুপুরের আগেই ফিরে এসে সেই যে বাড়ি ঢোকে, আর সারাদিন বাড়ি থেকে বার হয় না। কুমীকেও প্রায়ই দেখা যায় পিসিমার উঠোনে, নয় তো আমতলায়, নয়তো দাওয়ার পইঠাতে বসে হীরুদার সঙ্গে গল্প করতে। কাক-চিল পাড়ায় আর বসে না।
জ্যোৎস্না উঠেছে।
কুমী বললে—চললুম হীরুদা।
—এখনই যাবি কেন, বোস আর একটু—
উঠোনের একটা ধারে একটা নালা। হঠাৎ কুমী বললে—জ্যোৎস্না রাতে এলো চুলে লাফিয়ে নালা পার হলে ভূতে পায়—আমায় ভূতে পাবে দেখবে দাদা—হি হি-হি-হি–; তারপর সে লাফালাফি করে নালাটা বারকতক এপার-ওপার করছে, এমনসময় ওর মা ডাক দিলেন—ও পোড়ামুখী মেয়ে, এই ভরা সন্ধেবেলা তুমি ও করচ কী? তোমায় নিয়ে আমি যে কী করি? ধিঙ্গি মেয়ে, এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান যদি তোমার থাকে!—হীরু ভালো মানুষের মতো মুখখানি করে হারিকেন লণ্ঠনটা মুছে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
মায়ের পিছু পিছু কুমী চলে গেল, একটু অনিচ্ছার সঙ্গেই গেল, মুখে তার অপ্রতিভের হাসি। হীরেন মনমরা ভাবে লণ্ঠনের সামনে কী একখানা বই খুলে পড়তে বসবার চেষ্টা করল।
মাসের পর মাস যায়, বছরও ঘুরে গেল। নতুন বছরের প্রথমে হীরেনের চাকুরিটা গেল, অফিসের অবস্থা ভালো নয় বলে। এই এক বছরের মধ্যে হীরেন পিসিমার বাড়ি আরও অন্তত দশবার এল গেল এবং এই এক বছরের মধ্যে হীরেন বুঝেচে কুমীর মতো মেয়ে জগতে আর কোথাও নেই—বিধাতা একজন মাত্র কুমীকে সৃষ্টি করেছেন। কী বুদ্ধি, কী রূপ, কী কথাবার্তা বলবার ক্ষমতা, কী হাত নাড়ার ললিত ভঙ্গি, কী লঘুগতি চরণছন্দ।
প্রস্তাবটা কে উঠিয়েছিল জানিনে, বোধ হয় হীরুর পিসিমাই। কিন্তু কুমুদিনীর জ্যাঠামশাই সে প্রস্তাবে রাজি হননি—কারণ তাঁরা কুলীন, হীরেনরা বংশজ। কুলীন হয়ে বংশজের হাতে মেয়ে দেবেন তিনি, এ কথা ধারণা করাই তো অন্যায়।
হীরু শুনে চটে গিয়ে পিসিমাকে বললে—কে তোমাকে বলেছিল পিসিমা ডেকে অপমান ঘরে আনতে? আমি তোমার পায়ে ধরে সেধেছিলুম কুমীর সঙ্গে আমার বিয়ে দাও? সবাই জানে আমি বিয়ে করব না, আমি রামকৃষ্ণ আশ্রমে ঢুকব। সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে, এবার এই ইয়েটা মিটে গেলেই–
কুমীর কানে কথাটা গেল যে হীরু এই সব বলেচে। সে বললে—হীরুদাকে বিয়ে করতে আমি পায়ে ধরে সাধতে গিয়েছিলুম যে! বয়ে গেল—সন্ন্যাসী হবে তো আমার কী?
হীরু তল্পি বেঁধে পরদিনই পিসিমার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি চলে গেল।
হীরুর বাড়ির অবস্থা এমন কিছু ভালো নয়। এবার তার কাকা আর মা একসঙ্গে বলতে শুরু করলেন—সে যেন একটা চাকুরির সন্ধান দেখে। বেকার অবস্থায় বাড়ি বসে কতদিন আর এভাবে চলবে?
হীরুর কাকার এক বন্ধু জামালপুরে রেলওয়ে কারখানার বড়োবাবু, কাকার পত্র নিয়ে হীরু সেখানে গেল এবং মাস দুই তাঁর বাসায় বসে বসে খাওয়ার পরে কারখানার অফিসে ত্রিশ টাকা মাইনের একটা চাকুরি পেয়ে গেল।
লাল টালি-ছাওয়া ছোট্ট কোয়ার্টারটি হীরুর। বেশ ঘরদোর, বড়ো বড়ো জানালা। জানালা দিয়ে মারক পাহাড় দেখা যায়; কাজকর্মের অবসরে জানালা দিয়ে চাইলেই চোখে পড়ে টানেল দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন যাচ্চে-আসছে। শান্টিং ইঞ্জিনগুলো ঝক ঝক শব্দ করে পাহাড়ের নীচে সাইডিং লাইনের মুড়োয় গিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। কয়লার ধোঁয়ায় দিনরাত আকাশ-বাতাস সমাচ্ছন্ন।
একদিন রবিবারে ছুটির ফাঁকে—সে আর তার কাকার বন্ধু সেই বড়োবাবুর ছেলে মণি, মারক পাহাড়ের ধারে বেড়াতে গেল। মণি ছেলেটি বেশ, পাটনা ইউনিভার্সিটি থেকে বি-এস সি. দিয়েছে এবার, তার বাবার ইচ্ছে কাশী হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো। কিন্তু মণির তা ইচ্ছে নয়, সে কলকাতার সায়েন্স কলেজে অধ্যাপক রমণের কাছে ফিজিক্স পড়তে চায়। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে তার মনান্তর চলচে। হীরু জানত এসব কথা।
বৈকাল বেলাটি। জামালপুর টাউনের আওয়াজ ও ধোঁয়ার হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যে ওরা দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে অনেকটা চলে গিয়েছে, নীল অতসী ও বনতুলসীর জঙ্গল হয়ে আছে পাহাড়ের মাথায় সেই জায়গাটায়। ঘন ছায়া নেমে আসচে পূর্বদিকে শৈলসানুতে, একটি বন্যলতায় হলদে ক্যামেলিয়া ফুলের মতো ফুল ফুটেছে, খুব নীচে কুলিমেয়েরা পাহাড়তলির লম্বা লম্বা ঘাস কেটে আঁটি বাঁধছে—পূর্বদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় সমতল মাঠ, ভুট্টার খেত, খোলার বস্তি, কেবল দক্ষিণে, পূর্ব-পশ্চিমে টানা পাহাড়শ্রেণি ও শালবন থই থই করছে,
আর সকলের ওপরে উপুড় হয়ে পড়েছে—নিকট থেকে দূরে সুদূরে প্রসারিত মেঘমুক্ত সুনীল আকাশ।
একটা মহুয়াগাছের তলায় বসে মণি বাড়ি থেকে আনা স্যান্ডউইচ, ডিমসিদ্ধ, রুটি এবং জামালপুর বাজার থেকে কেনা জিলিপি একখানা খবরের কাগজের ওপর সাজালে—থার্মোফ্লাস্ক খুলে চা বার করে একটা কলাই-করা পেয়ালার ঢেলে বললে—এসো হীরুদা—
দেখলে, হীরু অন্যমনস্কভাবে মহুয়াগাছের গুঁড়িটায় ঠেস দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে।
—খাবে এসো, কী হল তোমার হীরুদা?
হীরু নিরুৎসাহ ভাবে খেতে লাগল। সারা বৈকালটি যতক্ষণ পাহাড়ের ওপর ছিল, কেমন যেন অন্যমনস্ক, উদাস—কী যেন একটা ভাবচে। মণি ভাবলে, পাহাড়ে বেড়ানোটাই মাটি হয়ে গেল হীরুদার জন্যে। পাহাড় থেকে নামবার পথে হীরু হঠাৎ বললে—মণি, একটি মেয়েকে বিয়ে করবে ভাই?
মণি হো হো করে হেসে উঠে বললে—কী ব্যাপার বলো তো হীরুদা? তোমার আজ হয়েছে কী?
—কিছু হয়নি, বলো না মণি? একটি গরিবের মেয়েকে বিয়ে করে দায় উদ্ধার করো না—তোমার মতো ছেলের
—কী, তোমার কোনো আপনার লোক? তোমার নিজের বোন নাকি?
–বোন না-হলেও বোনের মতোই। বেশ দেখতে মেয়েটি, সুশ্রী, বুদ্ধিমতী।
—আমার কথায় তো কিছু হবে না, তুমি বাবাকে কী মাকে বলো। একে তো লেখাপড়া নিয়েই বাবাকে চটিয়ে রেখেচি, আবার বিয়ে নিয়ে চটালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। বাবার মেজাজ বোঝো তো?
রাত্রে নিজের ছোট্ট বাসাটিতে হীরু কথাটা আবার ভাবলে। আজ পাহাড়ের ওপর উঠেই তার কেমনসব গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। কুমীর কথা তাহলে তো সে মোটেই ভোলেনি! নীল আকাশ, নির্জনতা, ফুটন্ত বন্য ক্যামেলিয়া ফুল, বনতুলসীর গন্ধ—সবসুদ্ধ মিলে একটা বেদনার মতো তার মনে এনে দিয়েচে কুমীর হাসিভরা ডাগর চোখ দুটির স্মৃতি, তার হাত নাড়ার ললিত ভঙ্গি, তার অনর্গল বকুনি—সে তো সন্ন্যাসী হয়ে যাবে রামকৃষ্ণ আশ্রমে সবাই জানে, মিথ্যেই পিসিমা কুমীর বাবাকে বিয়ের কথা গিয়েছিলেন বলতে। কিন্তু কুমীকে জীবনে সুখী করে দিয়ে যেতে হবে। এ তার একটা কর্তব্য।
সাহসে ভর করে মণির বাপের কাছে সে প্রস্তাবটা করলে। হীরুকে মণির বাপ মা স্নেহ করতেন; তাঁরা বললেন—মেয়ে যদি ভালো হয় তাঁদের কোনো আপত্তি নেই। তাঁরা চাকরি উপলক্ষ্যে পশ্চিমে থাকেন, এ অবস্থায় স্বঘরের মেয়ের সন্ধান পাওয়াও কঠিন বটে। যখন সন্ধান পাওয়া গিয়েছে ভালো মেয়ের—আর মণির বিয়ে যখন দিতেই হবে, তখন মেয়েটিকে দেখে আসতে দোষ কী?
কুমীর জ্যাঠাকে আগেই চিঠি লেখা হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা সমস্ত জিনিসটাকে অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অত বড়ো লোকের ছেলেকে জামাই করার মতো দুরাশা তাঁদের নেই। হীরুর যেমন কাণ্ড!
কিন্তু হীরু পুজোর ছুটিতে সত্যিই মণির এক জ্যাঠতুতো দাদাকে মেয়ে দেখাতে নিয়ে এল।
কুমী এসে হীরুর পায়ের ধুলো নিয়ে নমস্কার করলে।
হীরু বললে—ভালো আছিস কুমী?
—এতদিন কোথায় ছিলে হীরুদা?
—চাকরি করচি যে পশ্চিমে জামালপুরে। সাত-আট মাস পরে তো দেশে ফিরচি।
—ও কাকে সঙ্গে করে এনেচ? হীরু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেও আমার এক বন্ধুর দাদা
—তা এখানে এসেছে কেন?
—এসেচে গিয়ে ইয়ে—এমনি বেড়াতে এসেচেই ধর—তবে—ইয়ে—
—তোমার আর ঢোঁক গিলতে হবে না। আমি সব জানি, কেন ওসব চেষ্টা করছ হীরুদা?
হীরু বললে—যাও—অমন করে না ছিঃ, চুলটুল বেঁধে দিতে বল গিয়ে। ওঁরা খুব ভালো লোক, আর বড়ো লোক। জামালপুরে ওঁদের খাতির কী! আমি অনেক কষ্টে ওঁদের এখানে এনেচি। বড়ো ভালো হবে এ বিয়ে যদি ভগবানের ইচ্ছেয় হয়–
অনেক কষ্টে কুমীকে রাজি করিয়ে তার চুল বাঁধা হল, মেয়ে দেখানোও হল। দেখানোর সময় মেয়ের অজস্র গুণ ব্যাখ্যা করে গেল হীরু। কুমী কিন্তু পাঞ্জাব প্রদেশ কোন দিকে বলতে পারলে না, তাজমহল কে তৈরি করেছিল সে সম্বন্ধেও দেখা গেল সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। হাতের লেখা বেঁকে গেল। গান গাইতে জানে না বললে—যদিও সে ভালোই গাইতে জানে এবং তার গলার সুরও বেশ ভালো।
সঙ্গের ভদ্রলোকটি মেয়ে দেখা শেষ করেই ফিরতি নৌকোতে রেলস্টেশনে চলে গেলেন। রাত্রের ট্রেনেই তিনি খুলনায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি যাবেন। যাবার সময়ে বলে গেলেন—মতামত চিঠিতে জানাবেন। হীরু তাঁকে নৌকোতে তুলে দিয়ে ফিরে এসে কুমীকে বললে—কী করে বললে—গান গাইতে জানো না? ছিঃ, এ কী ছেলেমানুষি, ওরা শহরের মানুষ, গান শুনলে খুব খুশি হয়ে যেত। এমনি তো ঘরের কোণে খুব গান বেরোয় গলায়? আর এর বেলা
কুমী রাগ করে বললে—ঘরের কোণে গান গাইব না তো কী আসরে বসে গাইতে যাব? পারব না যার-তার সামনে গান গাইতে।
হীরুও রেগে বললে—তবে থাকো চিরকাল আইবুড়ো ধিঙ্গি হয়ে। আমার কী? কুমীর বাড়ির ও পাড়ার সবাই এজন্য কুমীকে ভৎসনা করলে। গান গাও-না-গাও, গান গাইতে জানি এ কথা বলার দোষ ছিল কী? ছিঃ, কাজটা ভালো হয়নি।
বলাবাহুল্য, ভদ্রলোকের কাছ থেকে কোনো পত্র এল না এবং হীরু পুজোর ছুটি অন্তে জামালপুরে গিয়ে শুনলে, মেয়ে তাঁদের পছন্দ হয়নি।
মাস পাঁচ-ছয় কেটে গেল। কী অদ্ভুত পাঁচ-ছ-মাস! কাজ করতে করতে জানালা দিয়ে যখনই উঁকি দিয়ে বাইরের দিকে চায়, তখনই সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, কুমীকে কতবার জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেচেহাত-পা নেড়ে উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে হেসে গড়িয়ে পড়ে কুমী গল্প করছে…নিমফুলের গন্ধভরা কত অলস চৈত্র-দুপুরের স্মৃতিতে মধুর হয়ে উঠেচে বর্তমান কর্মব্যস্ত দিনগুলি…
ইতিমধ্যে এক ছোকরা ডাক্তারের সঙ্গে তার খুব আলাপ হয়ে গেল। নতুন এম.বি. পাস করে জামালপুরে প্র্যাকটিস করতে এসেছে, বেশ সুন্দর চেহারা, বাড়ির অবস্থাও খুব ভালো, তার জ্যাঠামশাই এখানে বড়ো চাকরি করেন। কথায় কথায় হীরু জানতে পারলে ছোকরা এখনও বিয়ে করেনি এবং কুমীদের পালটি ঘর। অনেক বুঝিয়ে সে তার জ্যাঠামশাইকে মেয়ে দেখতে যেতে রাজি করালে। মেয়ে দেখাও হল—কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছুই হল না, তাঁদের কুটুম্ব পছন্দ হয়নি শোনা গেল। একে তো অজ পাড়াগাঁ, দ্বিতীয়ত তাঁরা ভেবেছিলেন পাড়াগাঁয়ের জমিদার কিংবা অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, অমন গরিব ঘরের মেয়ে তাঁদের চলবে না।
মাস তিনেক পরে হীরু আর এক বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে গিয়ে পিসিমার বাড়ি হাজির হল। কুমীদের বাড়ির সবাই বললে—হীরু বড় ভালো ছেলে, কুমীর জন্য চেষ্টা করছে প্রাণপণে। কিন্তু অত বড়ো বড়ো সম্বন্ধ এনে ও ভুল করচে, ওসব কী জোটে আমাদের কপালে? মেয়ে পছন্দ হলেই বা অত টাকা দিতে পারব। কোত্থেকে?
কুমীর সঙ্গে খিড়কি দোরের কাছে হীরুর দেখা। কুমী বললে—হীরুদা, তুমি কেন এসব পাগলামি করচ বলো তো? বিয়ে আমি করব না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি ওসব বন্ধ করো।
হীরু বলল—ছিঃ লক্ষ্মী দিদি, এমন করে না, এবার যে জায়গায় ঠিক করচি, তাঁরা খুব ভালো লোক, এবার নির্ঘাত লেগে যাবে—
কুমী লজ্জায় রাঙা হয়ে বললে—তুমি কী যে বলো হীরুদা! আমার রাত্রে ঘুম হচ্চে না, লাগবে কী না-লাগবে তাই ভেবে। মিছিমিছি আমার জন্য তোমাকে লোকে যা তা বলে—তা জানো? তুমি ক্ষান্ত দাও, তোমার পায়ে পড়ি হীরুদা—
হীরু এসব কথা কানে তুললে না। পাত্রপক্ষের লোক নিয়ে এসে হাজির করলে, কিন্তু কুমী কিছুতেই এবার তাদের সামনে আসতে রাজি হল না। সে দস্তুরমতো বেঁকে বসল।
হীরু বাড়ির মধ্যে গিয়ে বললে—পিসিমা, আপনারা দেরি করচেন কেন? কুমীর মা বললেন—এসে বোঝাও না মেয়েকে বাবা! আমরা তো হার মেনে গেলাম। ও চুলে চিরুনি ছোঁয়াতে দেবে না, উঠবেও না, বিছানায় পড়েই রয়েছে।
কুমী ঘর থেকে বললে—পড়ে থাকব না তো কী? বারে বারে সং সাজতে পারব না আমি, কারো খাতিরেই না। হীরুদাকে বলো না—সং সেজে বেরুক ওদের সামনে।
হীরু ঘরের মধ্যে ঢুকে কড়া সুরে বললে—কুমী ওঠ, কথা শোন—যা চুল বাঁধগে যা—
—আমি যাব না—
—যাবিনে, চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাব—ওঠ—দিন দিন ইয়ে হচ্চেন–না? ওঠ বলচি—
কুমী দ্বিরুক্তি না-করে বিছানা ছেড়ে দালানে চুল বাঁধতে বসে গেল, সাজানো গোজানোও বাদ গেল না, মেয়ে দেখানোও হল, কিন্তু ফল সমানই দাঁড়াল অর্থাৎ পাত্রপক্ষ বাড়ি গিয়ে চিঠি দেব বলে গেলেন।
জামালপুরের কাজে এসে যোগ দিলে হীরু। কিন্তু সে যেন সর্বদাই অন্যমনস্ক। কুমীর জন্যে এত চেষ্টা করেও কিছু দাঁড়াল না শেষপর্যন্ত! কী করা যায়? এদিকে কুমীদের বাড়িতেও তার পসার নষ্ট হয়েছে, তার আনা সম্বন্ধের ওপর সবাই আস্থা হারিয়েছে। হারাবারই কথা। এবার সেখানেও কথা তুলবার মুখ নেই তার। অত বড়ো বড়ো সম্বন্ধ নিয়ে যাওয়াই বোধ হয় ভুল হয়েছে। কুমীর ভালো ঘর জুটিয়ে দেবার ব্যাকুল আগ্রহে সে ভুলে গিয়েছিল যে, বড়োতে ছোটোতে কখনো খাপ খায় না।
লজ্জায় সে পিসিমার বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিল।
বছর দুই-তিন কেটে গেল।
হীরু চাকুরিতে খুব উন্নতি করে ফেলেচে তার সুন্দর চরিত্রের গুণে। চিফ ইঞ্জিনিয়ারের অফিসে বদলি হল দেড়শো টাকায় মার্চ মাস থেকে।
হীরু আর সেই হীরু নেই। এমনি হয়, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। প্রতি দিন, প্রতি মাস, প্রতি বৎসর, তিলে তিলে মানুষের দেহের ও মনের পরিবর্তন হচ্ছে—অবশেষে পরিবর্তন এমন গুরুতর হয়ে ওঠে যে, বহুকাল পরে আবার সাক্ষাৎ হলে আগের মানুষটিকে আর চেনাই যায় না। হীরু ধীরে ধীরে বদলেচে। অল্প অল্প করে সে কুমীকে ভুলেচে। রামকৃষ্ণ আশ্রমে যাবার বাসনাও তার নেই বর্তমানে। এর মূলে একটা কারণ আছে, সেটা এখানে বলি। জামালপুরে একজন বয়লার-ইনস্পেক্টার ছিলেন, তাঁর বাড়ি হুগলি জেলায়, রুড়কীর পাস ইঞ্জিনিয়ার, বেশ মোটা মাইনে পেতেন। কিন্তু অদৃষ্টের দোষে তাঁর ছ-টি মেয়ের বিয়ে দিতে তাঁকে সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে। এখনও একটি মেয়ে বাকি।
হীরুর সঙ্গে এই পরিবারের বেশ ঘনিষ্ঠতা জন্মেছিল। সুরমা হীরুর সামনে বার হয়, তাকে দাদা বলে ডাকে, কখনো-কখনো নিজের আঁকা ছবি দেখায়, গল্প করে, গান শোনায়।
একদিন হঠাৎ হীরুর মনে হল—সুরমার মুখখানা কী সুন্দর! আর চোখ দুটি —পরেই ভাবল—ছিঃ, এসব কী ভাবচি? ও ভাবতে নেই।
আর একদিন অমনি হঠাৎ মনে হল—কুমীর চেয়ে সুরমা দেখতে ভালো—কী গায়ের রং সুরমার! তখনই নিজের এ চিন্তায় ভীত ও সংকচিত হয়ে পড়ল। না, কী ভাবনা এসব, মন থেকে এসব জোর করে তাড়াতে হবে। কিন্তু জীবনকে প্রত্যাখ্যান করা অত সহজ হলে আজ গেরুয়াধারী স্বামীজিদের ভিড়ে পৃথিবীটা ভর্তি হয়ে যেত। হীরুর বয়েস কম, মন এখনও মরেনি, শুষ্ক, শীর্ণ, এক অতীত মনোভাবের কঙ্কালের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখতে তার নবীন ও সতেজ মন ঘোর আপত্তি জানালে। কুমীর সঙ্গে যা কিছু ছিল, সে অমূল তরু শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে গিয়েছে আলো-বাতাস ও পৃথিবীর স্পর্শ না-পেয়ে।
সুরমাকে বিয়ে করার কিছুদিন পরে সুরমার বাবা বয়লার ফাটার দুর্ঘটনায় মারা গেলেন; রেল-কোম্পানি হীরুর শাশুড়িকে বেশ মোটা টাকা দিলে এজন্যে; প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও যা পাওয়া গেল তাতে মেয়ের বিয়ের দেনা শোধ করেও হাতে ছ-সাত হাজার টাকা রইল। সুরমার মা ও একটি নাবালক ভাইয়ের দেখাশোনার ভার পড়েছিল হীরুর উপর, কাজেই টাকাটা সব এসে পড়ল হীরুর হাতে। হীরু সে টাকায় কয়লার ব্যাবসা আরম্ভ করল। চাকরি প্রথমে ছাড়েনি, কিন্তু শেষে রেল কারখানায় কয়লার কন্ট্রাক্ট নিয়ে একবার বেশ মোটা কিছু লাভ করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যাবসাতে ভালো ভাবেই নামল। সুরমাকে বিয়ে করার চার বছরের মধ্যে হীরু একজন বড়ো কন্টাক্টর হয়ে পড়ল। শাশুড়ির টাকা বাদ দিয়েও নিজের লাভের অংশ থেকে সে তখন ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা কারবারে ফেলেছে।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে হীরুর চালচলন বদলে গিয়েছে। রেলের কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে মুঙ্গেরে গঙ্গার ধারে বড়ো বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানেই সকলকে রেখেচে। রেলে জামালপুরে যাতায়াত করে রোজ, মোটর এখনও করেনি—তবে বলতে শুরু করেছে মোটর না-রাখলে আর চলে না; ব্যাবসা রাখতে গেলে ওটা নিতান্তই দরকার, বাবুগিরির জন্যে নয়। হঠাৎ এই সময় দেশ থেকে পিসিমার চিঠি এল, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না; বহুকাল হীরুকে দেখেননি তিনি, তাঁর বড়ো ইচ্ছে মুঙ্গেরে হীরুর কাছে কিছুদিন থাকেন ও দু-বেলা গঙ্গাস্নান করেন।
সুরমা বললে—আসতে যখন চাইচেন, নিয়ে এগো গে—আমিও তাঁকে কখনও দেখিনি—আমরা ছাড়া আর তাঁর আছেই বা কে? বুড়ো হয়েচেন—যে ক-দিন বাঁচেন এখানেই গঙ্গাতীরে থাকুন।
বাসায় আর এমন কেউ ছিল না, যাকে পাঠানো যায় পিসিমাকে আনতে, কাজেই হীরুই দেশে রওনা হল।
ভাদ্র মাস। দেশ এবার ভেসে গিয়েচে অতিবৃষ্টিতে। কোদলা নদীতে নৌকোয় করে আসবার সময় দেখলে জল উঠে দু-পাশের আউশ ধানের খেত ডুবিয়ে দিয়েছে। গোয়ালবাসির বিলে জল এত বেড়েছে যে, নৌকোর বুড়ো মাঝি বললে সে তার জ্ঞানে কখনো এমন দেখেনি, গোয়ালবাসি ও চিত্রাঙ্গপুর গ্রাম দু-খানা প্রায় ডুবে আছে।
অথচ এখন আকাশে মেঘ নেই, শরতের সুনীল আকাশের নীচে রৌদ্রভরা মাঠ, জল বাড়বার দরুন নৌকো চলল মাঠের মধ্য দিয়ে, বড়ো বাবলা বনের পাশ কাটিয়ে। ঘন সবুজ দীর্ঘ লতানে বেতঝোপ কড় কড় করে নৌকোর ছইয়ের গায়ে লাগচে, মাঠের মাঝে বন্যার জলের মধ্যে জেগে আছে ছোটো ছোটো ঘাস, তাতে ঘন ঝোপ।
পিসিমাদের গ্রামে নৌকো ভিড়তে দুপুর ঘুরে গেল। এখানে নদীর পাড় খুব উঁচু বলে কূল ছাপিয়ে জল ওঠেনি; দু-পাড়েই বন, একদিকে হ্রস্ব ছায়া পড়েছে জলে, অন্য পাড়ে খররৌদ্র। এই বনের গন্ধ…নদীজলের ছলছল শব্দ…বাঁশবনে সোনার সড়কির মতো নতুন বাঁশের কোঁড় বাঁশঝাড়ের মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে…এই শরৎ দুপুরের ছায়া…এইসব অতিপরিচিত দৃশ্য একটিমাত্র মুখ মনে করিয়ে দেয়…অনেকদিন আগের মুখ…হয়তো একটু অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, তবুও সেই মুখ ছাড়া আর কোনো মুখ মনে আসে না। নদীর ঘাটে নেমে, পথে চলতে চলতে সে মুখ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল মনের মধ্যে… এক ধরনের হাত-নাড়ার ভঙ্গি আর কী বকুনি, অজস্র বকুনি!…জগতে আর কেউ তেমন কথা বলতে পারে না। অনেক দূরের কোন অবাস্তব শূন্যে ঘুরচে সুরমা, তার আকর্ষণের বাইরে এ রাজ্য। এখানে গৃহাধিষ্ঠাত্রী দেবী আর একজন, তার একচ্ছত্র অধিকার এখানে—সুরমা কে? এখানকার বন, নদী, মাঠ, পাখি সুরমাকে চেনে না।
হীরু নিজেই অবাক হয়ে গেল নিজের মনের ভাবে।
পিসিমা যথারীতি কান্নাকাটি করলেন অনেকদিন পরে ওকে দেখে। আরও ঢের বেশি বুড়ি হয়ে গিয়েছেন, তবে এখনও অথর্ব হননি। বেশ চলতে-ফিরতে পারেন। হীরুর জন্যে ভাত চড়াতে যাচ্ছিলেন, হীরু বললে—তোমায় কষ্ট করতে হবে না পিসিমা, আমি চিঁড়ে খাব। ওবেলা বরং রেঁধো।
অনেকবার বলিবলি করেও কুমীর কথাটা সে কিছুতেই পিসিমাকে জিগ্যেস করতে পারলে না। একটু বিশ্রাম করে বেলা পড়লে সে হাটতলার মধু ডাক্তারের ডাক্তারখানায় গিয়ে বসল। মধু ডাক্তারের চুল-দাড়িতে পাক ধরেচে, একটি ছেলে সম্প্রতি মারা গিয়েছে—সেই গল্প করতে লাগল। গ্রামের মক্তবের সেই বুড়ো মৌলবি এখনও আছে; এখনও সেইরকম নিজের অঙ্কশাস্ত্রে পারদর্শিতার প্রসঙ্গে সাব-ইনস্পেক্টার মহিমবাবুর গল্প করে। মহিমবাবু ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে এ অঞ্চলে স্কুল সাব-ইনস্পেক্টরি করতেন। এখন বোধ হয় মরে ভূত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কোনবার মক্তব পরিদর্শন করতে এসে নিজেই শুভঙ্করীর সারাকালির একটা অঙ্ক দিয়ে নিজেই কষে বুঝিয়ে দিতে পারেননি, সে গল্প আজও এদেশে প্রচলিত আছে। এই মৌলবি সাহেবের মুখেই হীরু এ গল্প বহুবার শুনেচে।
সন্ধ্যা হবার পূর্বেই হীরু হাটতলা থেকে উঠল। মধু ডাক্তার বললেবোস হে হীরু, সন্ধেটা জ্বালি—তারপর দু-এক হাত খেলা যাক। এখন না-হয় বড়োই হয়েচ, পুরোনো দিনের কথা একেবারে ভুলে গেলে যে হে!
হীরু পথশ্রমের অজুহাত দেখিয়ে উঠে পড়ল। তার শরীর ভালো নয়, পুরোনো দিনের এইসব আবেষ্টনীর মধ্যে এসে পড়ে সে ভালো করেনি।
কুমী এখানে আছে কিনা, একথাটা মধু ডাক্তারকেও সে জিগ্যেস করবে ভেবেছিল। ওদের একই পাড়ায় বাড়ি। কুমী মধু ডাক্তারকে কাকা বলে ডাকে। কুমীদের সম্বন্ধে মাত্র সে এইটুকু শুনেছিল যে, কুমীর জ্যাঠামশাই বছর পাঁচেক হল মারা গিয়েছেন এবং জ্যাঠতুতো ভাইয়েরা ওদের পৃথক করে দিয়েছে।
অন্যমনস্কভাবে চলতে চলতে সে দেখলে কখন কুমীদের পাড়াতে, একেবারে কুমীদের বাড়ির সামনেই এসে পড়েছে। সেই জিউলি গাছটা, এই গাছটাতে একবার সাপ উঠে পাখির ছানা খাচ্ছিল, কুমী তাকে ছুটে গিয়ে খবর দিতে, সে এসে সাপ তাড়িয়ে দেবার জন্য ঢিল ছোড়াছুড়ি করে। এ পাড়ার গাছে-পালায়, ঘাসে-পাতায়, সন্ধ্যার ছায়ায়, শাঁকের ডাকে কুমী মাখানো। এইরকম সন্ধ্যায় কুমীদের বাড়ি বসে সে কত গল্প করেচে কুমীর সঙ্গে।
চুপ করে সে জিউলিতলায় খানিকটা দাঁড়িয়ে রইল।…
তার সামনের পথটা দিয়ে তেইশ-চব্বিশ বছরের একটি মেয়ে দুটো গোরুর দড়ি ধরে নিয়ে আসছে। কুমীদের বাড়ির কাছে বাঁশতলাটায় যখন এল, তখন হীরু চিনতে পারলে সে কুমী।
প্রথমটা সে যেন অবাক হয়ে গেল…আড়ষ্টের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সত্যিই কুমী? এমন অপ্রত্যাশিতভাবে একেবারে তার চোখের সামনে! কুমীই বটে, কিন্তু কত বড়ো হয়ে গিয়েছে সে।
হঠাৎ হীরু এগিয়ে গিয়ে বললে—কুমী কেমন আছ? চিনতে পারো? কুমী চমকে উঠল, অন্ধকারে বোধ হয় ভালো করে চিনতে পারলে না, বলল কে?
—আমি হীরু।
কুমী অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ তার মুখ দিয়ে কথা বার হল না। তারপর এসে পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে হীরুর মুখের দিকে চেয়ে বললে— কবে এলে হীরুদা? কোথায় ছিলে এতকাল? সেই জামালপুরে?
—আজই দুপুরে এসেছি।
আর কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বেরুল না। সে কেবল একদৃষ্টে কুমীর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কুমীর কপালে সিঁদর, হাতে শাঁখা, পরনে একখানা আধময়লা শাড়ি—যে কুমীকে সে দেখে গিয়েছিল ছ-সাত বছর আগে, এ সে কুমী নয়। সে কৌতূহলোচ্ছল কলহাস্যময়ী কিশোরীকে এর মধ্যে চেনা যায় না। এ যেন নিরানন্দের প্রতিমা, মুখশ্রী কিন্তু আগের মতোই সুন্দর। এতদিনেও মুখের চেহারা খুব বেশি বদলায়নি।
কুমী বললে—এসো আমাদের বাড়ি হীরুদা। কত কথা যে তোমার সঙ্গে আছে, এই ক-বছরের কত কথা জমানো রয়েছে, তোমায় বলব বলব করে কতদিন রইলাম, তুমি এ পথে আর এলেই না।
হয়েচে! সেই কুমী! ওর মুখে হাসি সেই পুরোনো দিনের মতোই আবার ফুটে উঠেছে; হীরু ভাবলে, আহা, ওর বকুনির শ্রোতা এতদিন পায়নি তাই ওর মুখখানা ম্লান।
–তুই আগে চল, কুমী।
—তুমি আগে চলো, হীরুদা।
চার-পাঁচ বছরের একটি ছেলে রোয়াকে বসে মুড়ি খাচ্ছিল। কুমীকে দেখে বললে—ওই মা এসেচে।
-–বসো হীরুদা, পিঁড়ি পেতে দিই। মা বাড়ি নেই, ওপাড়ায় গিয়েচে রায়বাড়ি, কাল ওদের লক্ষ্মীপুজোর রান্না বেঁধে দিতে। আমি ছেলেটাকে মুড়ি দিয়ে বসিয়ে রেখে গোরু আনতে গিয়েছিলুম দিঘিরপাড় থেকে। উঃ—কতকাল পরে দেখা হীরুদা! বোসো, বোসো! কী খাবে বলো তো, তুমি মুড়ি আর ছোলাভাজা খেতে ভালোবাসতে। বসো, সন্দেটা দেখিয়ে খোলা চড়িয়ে গরম গরম ভেজে দিই। ঘরে ছোলাও আছে, নারকোলও আছে। দাঁড়াও, আগে পিদিমটা জ্বালি।
সেই মাটির ঘর সেইরকমই আছে। সেই কুমী সন্ধ্যা-প্রদীপ দিচ্ছে পুরোনো দিনের মতো, যখন সে কত রাত পর্যন্ত ওদের বাড়ি বসে গল্প করত। তবুও কত কত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে! কত ব্যবধান এখন তার আর কুমীর মধ্যে।
কুমী প্রদীপ দেখিয়ে চাল ভাজতে বসল। একটু পরে ওকে খেতে দিয়ে সামনে বসল সেই পুরোনো দিনের মতোই গল্প করতে। সেই হাত-পা নাড়া, সেই বকুনি—সবই সেই। কত কথা বলে গেল। হীরু ওর দিকে চেয়ে থাকে, চোখ আর অন্য দিকে ফেরাতে পারে না। কুমীও তাই।
হীরু বললে—ইয়ে, কোথায় বিয়ে হল কুমী?
কুমী লজ্জায় চোখ নামিয়ে বললে—সামটা।
—তা বেশ।
তারপর কুমী বললে, ক-দিন থাকবে এখন হীরুদা?
—থাকবার জো নেই, কাজ ফেলে এসেছি, পিসিমাকে নিয়ে কালই যাব। পিসিমা চিঠি লিখেছিলেন বলেই তো তাঁকে নিতে এলাম।
—না, না হীরুদা, সে কী হয়? কাল ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীপুজো, কাল কোথায় যাবে? থাকো এখন দু-দিন। কতকাল পরে এলে। তুমিও তো বিয়ে করেচ, বউদিকে নিয়ে এলে না কেন? দেখতাম। ছেলে-মেয়ে কী?
—দুটি ছেলে একটি মেয়ে।
—বেশ, বেশ। আচ্ছা, আমার কথা মনে পড়ত হীরুদা?
মনে খুব পড়ত না, কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, এখন এমন মনে পড়চে যে সুরমা ও জামালপুর অস্পষ্ট হয়ে গিয়েচে। বড়োলোকের মেয়ে সুরমা তার মনের মতো সঙ্গিনী নয়, তার সঙ্গে সব দিক থেকে মেলে—খাপ খায় এই কুমীর। অথচ সুরমার জন্য দামি মাদ্রাজি শাড়ি কিনে নিয়ে যেতে হবে কলকাতা থেকে যাবার সময়—সুরমা বলেচে, যাচ্চ যখন দেশে, ফিরবার সময় কলকাতা থেকে পুজোর কাপড়-চোপড় কিনে এনো। এখানে ভালো জিনিস পাওয়া যায় না, দরও বেশি।
আর কুমীর পরনে হেঁড়া আধময়লা কাপড়।
না—দরিদ্র গৃহলক্ষ্মীকে বড়োলোকী উপহার দিয়ে সে তার অপমান করবে না। কুমী বকেই চলেছে। অনেক দিন পরে আজই ও আনন্দ পেয়েছে—নিরানন্দ অসচ্ছল সংসারের একঘেয়ে কর্মের মধ্যে বালিকাবয়সের শত আনন্দের স্মৃতি নিয়ে পুরোনো দিনগুলো হঠাৎ আজ সন্ধ্যায় কেমন করে ফিরেচে।
ঘণ্টা দুই পরে কুমীর মা এলেন। বললেন—এই যে, জুটেচ দুটিতে? আমি শুনলুম দিদির মুখে যে হীরু এসেচে। কাল লক্ষ্মীপুজো, তাই রায়েদের বাড়ি রান্না করে দিয়ে এলাম। তা ভালো আছিস বাবা হীরু? কুমী কত তোর কথা বলে। তোর কথা লেগেই আছে ওর মুখে; এই আজও দুপুরবেলা বলছিল, মা, হীরুদা নদীতে বন্যা দেখলে খুশি হত; এবার তো বন্যা এসেছে, হীরুদা যদি দেখত, খুব খুশি হত—না মা? তা, আমি তুই এসেছিস শুনেই দিদির ওখানে গিয়েছিলুম। বাড়ি নেই দেখে ভাবলাম সে ঠিক আমাদের ওখানে গিয়েছে। তা বোসো বাবা, চট করে পুকুর থেকে কাপড় কেচে গা ধুয়ে আসি। গামছাখানা দে তো কুমী। খোকার জন্য তরকারি এনেচি কাঁসিতে। ওকে ভাত দে। এই ওর বিয়ে দিয়েচি সামটায়— বুঝলে বাবা হীরু? জামাই দোকানে সামান্য মাইনের খাতা-পত্র লেখার কাজ করে। তাতে চলে না। তার ওপর দজ্জাল ভাই-বউ। খেতে পর্যন্ত দেয় না ভালো করে মেয়েটাকে। এই দেখোএখানে এসেচে আজ পাঁচ মাস, নিয়ে যাবার নামটি নেই, বউদিদির হুকুম হবে তবে বউ নিয়ে যেতে পারবে। আর এদিকে তো আমার এই অবস্থা, মেয়েটার পরনে নেই কাপড়, জামাই আসে-যায়, কাপড়ের কথা বলি, কানেও তোলে না। আমি যে কী করে চালাই? তা সবই অদৃষ্ট! নইলে–
কুমী ঝাঁজালো সুরে বললে—আ : যাও না, গা ধুয়ে এসো না—কী বকবক শুরু করলে—
অদৃষ্ট, হাঁ অদৃষ্টই। সে আজ কোথায়, আর কুমী কোথায় পড়ে কষ্ট পাচ্ছে।
পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই, জীবনে আনন্দ নেই, সাধ-আলহাদ নেই, কিছুই দেখলে না, কিছুই ভোগ করলে না, সবই অদৃষ্ট ছাড়া আর কী?
খানিক রাত্রে হীরু উঠল। কুমী প্রদীপ ধরে এগিয়ে দিলে পথ পর্যন্ত। বললে— আমাদের হ্যারিকেন লণ্ঠন নেই, একটা পাকাটি জ্বেলে দিই, নিয়ে যাও হীরুদা, বাঁশবনে বড় অন্ধকার।
সকালে কুমী পিসিমার বাড়ি এসে ডাক দিলে—কী হচ্চে, ও হীরুদা—
—এই যে কুমী, কামিয়ে নিলাম। এইবার নাইব।
কুমী ঘরের মধ্যে ঢুকে বললে—কেন, কীসের তাড়া নাইবার এত সকালে? তোমার কিন্তু আজ যাওয়া হবে না হীরুদা—বলে দিচ্চি। আজ ভাদ্রমাসের লক্ষ্মীপুজোর অরন্ধন, তোমায় নেমন্তন্ন করতে এলুম আমাদের বাড়ি। মা বললেন—যা গিয়ে বলে আয়।
হীরু আর প্রতিবাদ করতে পারলে না, কুমীর কাছে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নেই সে জানে। কুমী খানিকটা পরে বলল—আমার অনেক কাজ হীরুদা, আমি যাই। তুমি নেয়ে সকাল সকাল এসো।
হীরু বেলা দশটার মধ্যে ওদের বাড়ি গেল। আজ আর রান্নার হাঙ্গামা নেই। কুমী বললে—আজ কিন্তু পান্তা ভাত খেতে হবে জানো তো? আর কচুর শাক— আর একটা কী জিনিস বলো তো?…উঁহু… তুমি বলতে পারবে না।
কুমীর মা বললেন—কাল রাত্রে তুই চলে গেলে মেয়ে অত রাত্রে তোর জন্যে নারকেল কুমড়ো রাঁধতে বসল। বললে, হীরুদা বড়ো ভালোবাসে মা, কাল সকালে খেতে বলব, বেঁধে রাখি।
কুমী স্নান সেরে এসে একখানা ধোয়া শাড়ি পরেচে, বোধহয় এইখানাই তার একমাত্র ভালো কাপড়। সেই চঞ্চলা মুখরা বালিকা আর সে সত্যই নেই, আজ দিনের আলোয় কুমীকে দেখে ওর মনে হল—কুমীর চেহারা আরও সুন্দর হয়েছে, তবে ওর মুখে-চোখে একটা শান্ত মাতৃত্বের ভাব ফুটে উঠেচে, যেটা হীরু কখনো ওর মুখে দেখেনি। কুমী অনেক ধীর হয়েছে, অনেক সংযত হয়েচে। মাথায় সেইরকমের এক ঢাল চুল, মুখশ্রী এখনও সেইরকম লাবণ্যময়। তবুও যেন কুমীকে চেনা যায় না, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বালিকা কুমী অন্তর্হিত হয়েছে, এখন যে কুমীকে সে দেখচে তার অনেকখানিই যেন সে চেনে না।
কিন্তু খানিকটা বসবার পরে হীরুর এ ভ্রম ঘুচে গেল। বাইরের চেহারাটা যতই বদলে যাক না কেন, তার সামনে যে কুমী বার হয়ে এল, সে সেই কিশোরী কুমী। ওর যেটুকু পরিচিত তা ওর মধ্যে বার হয়ে এল—যেটুকু হীরুর অপরিচিত, তা নিজেকে গোপন রাখলে।
কী চমৎকার কুমীর মুখের হাসি। হীরুর মোহ নেই, আসক্তি নেই, আছে কেবল। একটা সুগভীর স্নেহ, মায়া, অনুকম্পা…এ এক অদ্ভুত মনের ভাব, কুমীকে সে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারে তাকে একটুক খুশি করবার জন্য।
কুমী কত কী বকচে বসে বসে…পুরোনো দিনের কথা তুলচে কেবল।
–মনে আছে হীরুদা, সেই একবার জেলেদের বাঁশতলায় আলেয়া জ্বলেছিল —সেও তো এই ভাদ্রমাসে…সেই চারুপাঠ মনে আছে?
হীরুর খুব মনে আছে। সবাই ভয়ে আড়ষ্ট, আলেয়া নাকি ভূত, যে দেখতে যায় তার অনিষ্ট হয়। হীরু সাহস করে এগিয়ে গিয়েছিল দেখতে, কুমীও পিছু পিছু গিয়েছিল।
হীরু বলেছিল—আসছিস কেন পোড়ারমুখী, ভূত ধরে খাবে যে—
কুমী ভেংচি কেটে বলেছিল—ইস! ভূতে ধরে ওঁকে খাবে না—আমাকেই খাবে। আলেয়া বুঝি ভূত? ও তো একরকম বাষ্প, আমি পড়িনি বুঝি চারুপাঠে? শুনবে বলব…অনেকের বিশ্বাস আছে আলেয়া একপ্রকার ভূতযোনি, বাস্তবিক ইহা তা নয়—
হীরু ধমক দিয়ে বলেছিল—রাখ তোর চারুপাঠ—আরম্ভ করে দিলেন এখন অন্ধকারের মধ্যে চারুপাঠ…বলে ভয়ে মরচি—
পরক্ষণেই কুমী খিলখিল করে হেসে উঠে বলেছিল—কী বললে হীরুদা, ভয়ে মরচ? হি হি হি হি—এত ভয় তোমার যদি এলে কেন? চারুপাঠ পড়লে ভয় থাকত না…চারুপাঠ তো আর পড়োনি?
সেইসব পুরোনো গল্প। আলেয়া…আলেয়াই বটে।
কুমীর যে খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে তা বোঝা গেল, যখন ও গ্রামের এক বিধবা গরিব মেয়ের কথা তুললে। আগে এসব কথা কুমী বলত না। এখন সে পরের দুঃখ বুঝতে শিখেচে। মুখুয্যে বাড়ির বড়ো পুরীপাল্লার মধ্যে হর মুখুজ্যের এক বিধবা নাতনি—নিতান্ত বালিকা—কী রকম কষ্ট পাচ্চে, পুকুরঘাটে কুমীর কাছে বসে নির্জনে মৃত স্বামীর রূপগুণের কত গল্প করে—এ কথা কুমী দরদ দিয়ে বলে গেল। সত্যিই মাতৃত্ব ওর মধ্যে জেগেছে, ওকে বদলে দিয়েছে অনেকখানি।
হঠাৎ কুমী বললে—অই দেখো হীরুদা, বকেই যাচ্চি। তোমায় যে খেতে দেব, সে-কথা মনে নেই।
তার পরে সে উঠে তাড়াতাড়ি হীরুকে ঠাঁই করে দিয়ে ভাত বেড়ে নিয়ে এল। হাসিমুখে বললে—জামালপুরের বাবুর আজ কিন্তু পান্তা ভাত খেতে হবে। রুচবে তো মুখে? নেবু কেটে দেব এখন অনেক করে, নারকোল-কুমড়ি আছে, কচুর শাক আছে।
এসব সত্যিই হীরু অনেকদিন খায়নি। যা যা সে খেতে ভালোবাসে, কুমী তার কিছুই বাদ দেয়নি। হীরু আশ্চর্য হয়ে গেল—এতকাল পরেও কুমী মনে রেখেছে এসব কথা।
খেতে বসে হীরু বললে—কুমী, ছেলেবেলা ভালো লাগে, না এখন ভালো লাগে?
—এ কথার উত্তর নেই হীরুদা। ছেলেবেলায় তোমরা সব ছিলে, সে একদিন ছিল। এখনও তা বলে খারাপ লাগে না—জীবনে নানারকম দেখা ভালো নয় কি?
—কুমী, একটা কথার উত্তর দে। তোর সংসারের টানাটানি খুব?
-কে বললে এ কথা? মা বলেছিল সেই তো কাল রাত্তিরে? ও বাজে কথা, জানো তো, মা যত বাজে বকে। বুড়ো হয়ে মার আরও জিব আলগা হয়ে গেছে।
–কুমী, আমার কাছে সত্যি কথা বলবিনে?
—ওই, তুমিও পাগলামি শুরু করলে। নাও, খেয়ে নাও—যত বাজে বকতে পারো—মা গো!…দাঁড়াও পায়েসটা আনি, কচুর শাক পড়ে রইল কেন অতখানি?…না সে হবে না—
—দ্যাখ কুমী, আমার কাছে বেশি চালাকি করিসনে। তোকে আর আমি জানিনে? কোদলার ঘাটে পায়ে খেজুরকাঁটা ফুটে গিয়েছিল, মুখে একটু রা করিসনি, জানতে দিসনি কাউকে–
—আবার?
হীরু চুপ করে গেল। এতখানি বলে সে ভালো করেনি, ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলেচে। কুমী যা ঢাকতে চায়, ও তা বার করে কুমীর আত্মসম্মানে ঘা দিতে চায় কেন? ছিঃ—
কুমী বললে—আবার কবে আসবে হীরুদা?
—সত্যি কথা যদি শুনতে চাস, আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না কিন্তু।
—আবার বাজে বকতে শুরু করেচ হীরুদা। তোমার যা কিছু সব সামনে, চোখের আড়াল হলে আর মনে থাকে না। আর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যত বাজে বকুনি
—তুমি তো জানো না একটুও বাজে বকতে? আমি ইচ্ছে করলে থাকতে পারিনে ভেবেছিস?
—হাঁ, থাকো না দেখি কাজকর্ম বন্ধ করে। বউদি এসে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যাবে না?
—আচ্ছা সে যাক, একটা কথার উত্তর তোকে দিতেই হবে। আমি যদি এখানে থাকি তুই খুশি হোস?
—উঃ, মা গো, মুখ বুজে খেয়ে নাও দিকি? কী বাজে বকতেই পারো!
হীরু দুঃখিতভাবে বললে—আমার এ কথাটারও উত্তর দিবিনে কুমী? তুই এত বদলে গিয়েছিস আমি এ ভাবতেই পারিনে। আচ্ছা, বেশ।
কুমী হেসে প্রায় লুটিয়ে পড়তে পড়তে বললে—তোমার কিন্তু একটুও বদলায়নি হীরুদা, সেইরকম ‘আচ্ছা, বেশ’ বলা, সেইরকম কথায় কথায় রাগ করা। আচ্ছা, কী বলব বলো দিকি? তুমি জানো না ও-কথার কী উত্তর আমি দিতে পারি? ভেবে দেখো তা হলে আমি বদলাইনি, বদলে গিয়েছ তুমি হীরুদা।
—আচ্ছা কুমী, এতটা না-বকে সামান্য দু-কথায় সাদা উত্তর একটা দে না কেন? বকুনিতে আমি কি তোর সঙ্গে পারব?
-না, তা তুমি পারবে কেন? বকতে তুমি একটুও জানো না। হ্যাঁ, হই।
–মন থেকে বলছিস?
—আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করচে হীরুদা, এতটা বদলে গিয়েছ তুমি? যাও—আমি তোমার কোনো কথার আর উত্তর দেব না, তুমি না-নিজের বুদ্ধির বড়ো অহংকার করতে?
—কুমা, রাগ করিসনে। অনেক কাজের মধ্যে থেকে আমার সূক্ষ্ম-বুদ্ধিটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যাক, বাঁচলুম কুমী।
—পায়েসটা খাও, তোমার পায়ে পড়ি। আর বকুনিটা কিছুক্ষণের জন্যে ক্ষান্ত রাখো। কিছু তোমার পেটে গেল না এই অনাছিষ্টি বকুনির জন্যে।
কুমী পরদিন এসে বিছানা-বাক্স গুছিয়ে দিলে। ঘাট পর্যন্ত এসে ওদের নৌকোতে উঠিয়ে দিলে। নৌকো ছেড়ে যখন অনেকটা গিয়েচে তখনও কুমী ডাঙায় দাঁড়িয়ে আছে।
দু-পাড়ের নদীচড়া নির্জন। দুপুরের রৌদ্র আজ বড়ো প্রখর, আকাশ অদ্ভুত ধরনের নীল, মেঘলেশহীন। বন্যার জলে পাড়ের ছোটো কালকাসুন্দি গাছের বন পর্যন্ত ডুবে গিয়েছে। কচুরিপানার বেগুনি ফুল চড়ার ধারে আটকে আছে। সেইসব বনজঙ্গলময় ডাঙার পাশ দিয়ে চলেচে ওদের নৌকো। ঝোপের তলার ছায়ায় ডাহুক চরচে। বন্যার জলে নিমগ্ন আখের খেতের আখগাছগুলো স্রোতের বেগে থরথর করে কাঁপছে।
ছইয়ের মধ্যে পিসিমা ঘুমিয়ে পড়েছেন। নিস্তব্ধ ভাদ্র অপরাহু। নৌকোয় তক্তার ওপর বসে বসে হীরু কত কী ভাবছিল। এ গ্রামে যদি সে থাকতে পারত! মধু ডাক্তারের মতো হাটতলায় ওষুধের ডিসপেনসারি খুলে? ডাক্তারিটা যদি শিখত সে!
পুজোর বাজারটা ফিরবার সময় করতে হবে কলকাতা থেকে…অন্তত দেড়শো টাকার বাজার। আসবার সময় খুব উৎসাহ করে সুরমার কাছ থেকে ফর্দ করে নিয়ে এসেচে…
একটা মানুষের মধ্যে মানুষ থাকে অনেকগুলো। জামালপুরের হীরু অন্য লোক, এ হীরু আলাদা। এ বসে বসে ভাবচে, কুমীদের রান্নাঘরে অরন্ধনের নেমন্তন্ন খেতে বসেছিল, সেই ছবিটা। অনবরত ওই একটা ছবিই।…
কুমী বলছে—আমার কথা মনে পড়ত হীরুদা?…
কুমী এখনও কী ঠিক তেমনি হাত-পা নেড়ে কথা বলে…ঠিক সেই ছেলেবেলাকার মতো!…আচ্ছা, আর কারো সঙ্গে কথা বলে অমন আনন্দ হয় না কেন? সুরমার সঙ্গেও তো রোজ কত কথা হয়…কই…
রেলের বাঁশির আওয়াজে হীরুর চমক ভাঙল। ওই স্টেশনের ঘাট দেখা দিয়েছে। সিগন্যাল নামানো, বোধ হয় ডাউন ট্রেনটা আসবার দেরি নেই…