দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

অরণ্যে রোদন

অরণ্যে রোদন

মাঝ রাতে অচেনা গলার ভেউভেউ কান্নায় গৃহস্বামীর ঘুম ছুটে গেল। মশারির ভেতর থেকে প্রশ্ন করলেন, কে বটে?

আজ্ঞে, আমি চোর।

অ্যাঁ, সে কি রে? চোর? চোর আবার কাঁদে নাকি? এখন তো একমাত্র চোরদেরই হাসির যুগ।

আজ্ঞে, সে এঘরের বাইরে। এমন জানলে কে ঢুকত, স্যার, এঘরে! ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।

তুই কোথা থেকে কথা বলছিস এখন?

আজ্ঞে, কোথায় আছি বুঝতে পারলে তো নিজেই বেরিয়ে যেতুম মাল হাপিস করে। ঘণ্টাখানেক ধরে চেষ্টা করছি, সব জড়িয়ে মরিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছি।

যে ঘরে এই নাটক হচ্ছে, সেই ঘরের একটু বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন। আয়তন তেরো বাই বারো, একপাশে দেওয়ালের সঙ্গে সাঁট হয়ে আছে বিশাল এক বোম্বাই খাট। বিবাহের প্রাপ্তিযোগ। ঢোকার দরজার ডানপাশে জাইগানটিক এক স্টিল ক্যাবিনেট। খাটের একটা পাশের সঙ্গে চেপে বসে আছে। এমন ভাবে চেপে আছে যেন খাট আর ক্যাবিনেট ‘শিয়ামিজ টুইন’। কোনও দিন সরাসরির প্রয়োজন হলে সার্জেন ডেকে অপারেট করে সেপারেট করতে হবে। ঠিক তার উলটো দিকে খাটের পাশ চেপে বুক চিতিয়ে পড়ে আছে ড্রেসিং টেবল। তার আয়নাটি আবার ত্রিফোল্ড, ঘরের খাঁচায় ডানা মেলে উড়তে চাইছে। তার সামনে খোঁদল করা একটি বসার আসন। ঘরে এপাশ ওপাশ করতে গেলেই ল্যাং মারে ড্রেসিং টেবলের বাঁ- পাশে একটি দেওয়াল আলমারি, তার পাশ থেকে ঘুরে গেছে এক সেট সোফা। কর্নার টেবিল দুটি যেন ভিড়ের বাসের যাত্রী। মেঝেতে ঠ্যাং ঠেকাতে পারেনি সোফার হাতলে ভর রেখে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছ হয়ে আছে, খাটের পায়ার দিকে যেটুকু জায়গা ছিল সেখানে ধুম্বো একটি টিভি, তার মুখ দেখলেই মনে হয়, অনবরত বলে চলেছে প্রাণ যায় পাঁচু।

এইবার খাটের তলায় কি আছে দেখা যাক। যৌথ পরিবার ভাঙতে-ভাঙতে এই পরিবারটি কোনও রকমে মাথা গোঁজার মতো এই বাসস্থানটি সংগ্রহ করেছে। এক বছরের ভাড়া অগ্রিম দিতে হয়েছে। বাড়িওয়ালা সেই টাকায় ঘরের বাইরে একটি রান্নাঘর বানিয়ে দিয়েছেন। সে এক আজব জিনিস। বসে রান্নার কথা স্বপ্নেও ভাবা যাবে না। পাঠশালে পণ্ডিতমশাই অবাধ্য ছাত্রকে মাঝেমধ্যে শাস্তি দিয়ে বলতেন, চেয়ার হয়ে থাক দেড় ঘণ্টা। সেই চেয়ার হয়ে থাকার কায়দায় পুচকে তোলা উনুনে সংসারের পিণ্ডি চটকাও। থোড়বড়ি খাড়া, খাড়াবড়ি থোড়। তরকারির রং দেখতে গিয়ে সামনে ঝোঁকার সময় পেছনের দেওয়ালের কথা ভুলে গেলে মুখ থুবড়ে উনুনে পড়তে হবে।

পেতলের বাসনের মধ্যে অতি অবশ্যই থাকবে গোটাদুয়েক পেতলের ঘড়া আর থাকবে সে যুগের মানুষের খাওয়ার আয়তন অনুসারে গড়ের মাঠের মাপের কানা-উঁচু কয়েকটি থালা। সে যুগের মানুষ খুব পান খেতেন, সুতরাং একটা পানের ডাবর থাকবে, থাকবে গোটাকতক গোল ডিবে, খাঁজে-খাঁজে আটকে সেই গোদা ডিবে বন্ধ করার এক দিশি কায়দায় অনেক পানবিলাসী কেতরে পড়তেন। খুললে বন্ধ হয় না। বন্ধ হলে খোলে না। অনেক সাবেক বাড়িতে এখনও পেতলের ঘড়ার বা কলসিতে জল রাখা হয়। কেলে কিসকিন্দে সেই সব পানের ডিবে চাপার কাজ করে। সুগৃহিণীরা নিয়ম করে পুরোনো তেঁতুল দিয়ে ঘড়া মাজিয়ে ঝকঝকে করে রাখেন। আর উদাসীবাবার আখড়ায় সেই সোনায় চাঁদ চেহারা থাকে না, কলঙ্ক লেগে ভূত হয়ে বসে থাকে। পাওয়ার মধ্যে আর থাকে গোটাকতক গম্বুজ গেলাস। জল ভরলে ওজন যা দাঁড়ায় ভীমভবানী ছাড়া কারুর তোলার ক্ষমতা থাকে না। এই সব মাল গিয়ে ঢোকে খাটের তলায়। সেলাইয়ের হাত মেশিন। প্যাকিং বাক্স, প্যাটরা, ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটলি, খালি বোতল। মশামারা তেলের টিন, স্প্রেয়ার। খাটের তলা এক সাংঘাতিক জায়গা, যেখানে ঢুকে রোদন মানে অরণ্য রোদন, অ্যানটার্কটিক এক্সপিডিসানের চেয়েও কঠিন ব্যাপার। জনৈক ভদ্রলোকের পুত্র হামা দিয়ে খাটের তলায় ঢুকেছিল। দেড়দিন তার কোনও সন্ধান মেলেনি। এদিকে জনাতিনেক নিরীহ প্রাণী ছেলেধরা সন্দেহে কচুকাটা হয়ে গেল। শেষে ফোঁস করে জলের ধারা বেরিয়ে আসতে কার যেন সন্দেহ হল ভাঙা সিন্দুক তো হিসি করতে পারে না, নবকুমার নিশ্চয় ওইখানেই আস্তানা নিয়েছে। বেবিফুডের আতঙ্কে শুরুহল এক্সপিডিসান। দেখা গেল দশ বছরের ঝুলে বালগোপাল দোলায় চাপার মতো আটকে বসে আছে, খাদ্যদ্রব্যেরও অভাব ছিল না। ঘরে বসে এ-যাবৎ মতো মুড়ি, চানাচুর, বিস্কুট খাওয়া হয়েছিল, সেই সব ছড়ানো-ছেটানো টুকরো-টাকরা বাড়ির কর্তব্যপরায়ণ কাজের লোকটি ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে, ঝেঁটিয়ে-ঝেঁটিয়ে খাটের তলায় ডাম্প করেছিলেন। নয়া জমানার হিরো সেই ফুড ডাম্পকে কাজে লাগিয়েছে। শিশুতে আর মুরগিতে সামান্য ইতর বিশেষ, পিকিং আর ইটিং হ্যাবিট।

গৃহস্বামী মশারির ভেতর উঠে বসে বললেন, দাঁড়াও, কী করা যায়, দেখি!

ঘর অন্ধকার, মেঝেতে আড়াআড়ি আরও দুটি বিছানা পড়েছে, দুটো মশারি। হাই টেনসান লাইনের মতো মশারি খাটাবার দড়ি দেয়ালের দিকে যেখানেই হুক বা পেরেক পেয়েছে, সেইদিকে ছুটেছে। এ দড়ির ওপর দিয়ে সে দড়ি। সে দড়ির ওপর দিয়ে এ দড়ি।

এর নাম মর্ডান লিভিং। বেশির ভাগ জামাকাপড় লন্ড্রিতেই পড়ে থাকে। বাড়িতে স্থানাভাব, আশেপাশে এমন কোনও গাছ নেই, যেখানে ডালে ডালে ঝুলিয়ে রাখা যায়। ছেলের বিয়ে, মেয়ের বিয়ে কমিউনিটি হাউসে ঘর ভাড়া নিয়ে দিতে হয়, নিমন্ত্রিতরা ভুল করে, উদোর জায়গায় বুধোর এলাকায় পাতা পাড়েন, খেয়ে উঠে বলেন, কই, তোমার কাকাকে তো দেখছি না।

আজ্ঞে, আমার কাকা তো কোনও কালে ছিল না!

আরে ছিল ছিল, কাজের বাড়ি তো! ভুলে গেছ।

গৃহস্বামী বলেন, ভুলেও এ-বাড়িতে আর এসো না।

পাগল হয়েছেন? এখন দয়া করে বাইরে যাওয়ার পথটা বাতলে দেন।

গৃহস্বামীর উত্তর—তা যদি জানতাম, এতদিন মরা মাকড়ের মতো পড়ে থাকি?

এর নাম অরণ্যে রোদন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *