অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ

অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ

কলেজ থেকে ফিরে সন্ধ্যাহ্নিক করে সবে লাইব্রেরি ঘরের প্রিয় ইজিচেয়ারটিতে গা এলিয়েছেন ভাদুড়ি মশায়, এমন সময় বাইরে থেকে একটা হইহই কানে এল। চেঁচামেচির উৎস সন্ধানে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবেন, তখনই ঝড়ের মতো ঘরে এসে ঢুকলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হাজরা। তাঁর দুই হাতে বিশাল দুই হাঁড়ি মিষ্টি। হাঁড়ি দু’টো নির্দ্বিধায় বইয়ের টেবিলে রেখে জাঁদরেল গলায় বলে উঠলেন, সুখবর আছে নীরেন।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভাদুড়ি মশায়ের কলেজ বেলার বন্ধু। যদিও বন্ধুত্ব হওয়ার বিশেষ অবকাশ ছিল না কারণ ভাদুড়ি মশায় পড়তেন সংস্কৃত আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিষয় ছিল বটানি। তবু ভারী অদ্ভুত ভাবে এই দু’জনের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল এবং সে বন্ধুত্ব আজও এই মধ্য চল্লিশে এসেও অটুট। ভাদুড়ি মশায় বললেন, সে তো তোর উত্তেজনা দেখেই বুঝতে পারছি কিন্তু দয়া করে হাঁড়িগুলো আমার বইয়ের ওপর থেকে নামা।

কথাটায় পাত্তা না দিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ধপাস করে ভাদুড়ি মশায়ের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে পড়লেন এবং বললেন, প্রমোশন পেয়েছি। এ বার সোজা জলদাপাড়া।

একটুক্ষণ বন্ধুর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় ভাদুড়ি মশায় বললেন, ফের শাস্তিমূলক বদলি তাই তো?

আসলে এ প্রশ্ন করার কারণ আছে। আইএফএস দিয়ে ভারতীয় বনবিভাগের চাকরিতে ঢুকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিন্তু কোথাও তিনি বেশি দিন টিকতে পারেন না। তাই পনেরো বছরের চাকরি জীবনে দেশের প্রায় সব ক’টি অরণ্যই তাঁর ঘোরা হয়ে গেছে। এর জন্য দায়ী তাঁর বদমেজাজ এবং সততা। অবশ্য আজ থেকে বিশ বছর আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর ভাদুড়ি মশায়ের যে বন্ধুত্ব হয়েছিল, তার নেপথ্যে ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বদমেজাজ।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থাকতেন হিন্দু হস্টেলে। রাতে মেসের খাবার মিস হলে বা রাত জেগে পড়তে পড়তে খিদে পেলে হিন্দু হস্টেলের অনেক ছেলেই মেডিক্যাল কলেজের সামনে ঘুগনি, রুটি, মুড়ি, চা, বিস্কুট খেতে যেত। মেডিক্যাল কলেজের সামনে সারা রাতই খাবারের দোকান খোলা থাকে। তা সে দিন সন্ধেবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। ঘুম যখন ভাঙল তখন সাড়ে এগারোটা। মেসের খাবার ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই। অগত্যা ঘুমঘুম চোখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চললেন মেডিক্যাল কলেজের দিকে। খাবারের দোকানের সামনে যখন পৌঁছলেন তখন সেখানে তিনটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেগুলোকে দেখেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বুঝলেন, এরা হাড়কাটা গলির প্রসিদ্ধ মস্তান। তিনি এক পাশে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঘুগনি, রুটি নিয়ে ছেলেগুলো লোহার বেঞ্চে জাঁকিয়ে বসতে তিনি দোকানদারকে খাবারের অর্ডার দিলেন। দোকানদার জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে চেনে। সে বলল, আর একটু দেরি হলেই ঘুগনি পেতেন না। এই এক প্লেটই পড়ে আছে। একটু দাঁড়ান। আমি ডিম ভেজে ওপরে ছড়িয়ে দিচ্ছি।

খাবারের দাম মিটিয়ে লাইট পোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে সিগারেট টানতে লাগলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। সিগারেটের ধোঁয়ায় খিদে চাগাড় দিয়ে ওঠে। তখন খাবারের স্বাদ আরও খোলতাই হয়। মিনিট পাঁচেক পরেই দোকানদার খাবার বেড়ে ডাক দিল। ইতিমধ্যে এসে হাজির হয়েছে আরও একটা হাড়কাটার ছেলে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ খাবারের প্লেটটা নেওয়ার আগেই সে টপ করে প্লেটটা তুলে নিল। কান এঁটো করা হাসি দিয়ে বলল, হেবি খিদে লেগেছে মাইরি। এটা আমি খাচ্ছি।

চড়াং করে মাথাটা গরম হয়ে গেল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। তিনি বললেন, খাচ্ছি বললেই তো হল না। আমি এই খাবারের দাম দিয়ে দিয়েছি আর এটা আমার খাবার।

হাত বাড়িয়ে তিনি প্লেটটা নিতে চাইলেন কিন্তু ততক্ষণে বেঞ্চে বসে থাকা তিনটে ছেলে উঠে এসেছে। তাদেরই একজন বলল, খাবারে তোর নাম লেখা আছে না কি বে?

একটু থমকে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, কেন বেকার ঝামেলা করছ? তোমাদের সামনেই তো আমি অর্ডার দিলাম।

যে প্লেট কেড়ে নিয়েছে সে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। অর্ডার যখন তুই দিয়েছিস তখন খাবারটা তোরই কিন্তু খেতে পারলে খা, এই বলে সে ঘুগনির ওপর একটুখানি থুতু ফেলে দিল, আমার এঁটো খাবি তো খা।

হো হো করে হেসে উঠল চার জন। এই অসভ্যতা দেখে আর মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন ছেলেটার মুখে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বড়সড় চেহারা। ছেলেগুলো সবই রোগারোগা। ঘুষি খেয়ে ছেলেটা টাল সামলাতে পারল না। বাঁই করে এক পাক ঘুরে রাস্তার মধ্যে উল্টে পড়ল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানেন, সময় দিলেই ওরা পাল্টা মারবে তাই সেকেন্ডের ভগ্নাংশে হতচকিত হয়ে যাওয়া তিনটে ছেলের একটার কানের পাটায় ঠাটিয়ে এক চড় মারলেন তিনি। একটার পেটে বসিয়ে দিলেন সপাটে লাথি আর একটার ঘাড়ে বসিয়ে দিলেন বিশাল এক রদ্দা। তিনটে ছেলেই লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়। একা হাতে চারটে হাড়কাটার মস্তানের মহড়া নিয়েছেন ভেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন উত্তেজনায় ফুটছেন। কিন্তু তাঁর হিসেবে ভুল ছিল। ভদ্রঘরের ছেলে তিনি, যেটুকু যা মারপিট করেছেন সে নেহাতই খেলাচ্ছলে। তাই রাস্তার মারপিটের মেজাজটাই যে আলাদা সেটা তাঁর জানার কথা নয়। তিনি ভেবেছিলেন, ছেলেগুলো আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু তাঁকে অবাক করে একে একে চারটে ছেলেই উঠে দাঁড়াল। তার পর চোখের নিমেষে একটা ছেলে রাস্তা থেকে একটা আধলা ইট তুলে ছুঁড়ে মারল তাঁর দিকে। রিফ্লেক্সে মাথাটা বাঁচালেও সবটা বাঁচাতে পারলেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। আধলাটা তাঁর বাঁ কানটা প্রায় ছেঁচে নিয়ে বেরিয়ে গেল। মাথার ভিতরটা ঝনঝন করে উঠল। চোখে অন্ধকার দেখলেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে ধাতস্থ হতেই যা দেখলেন তাতে এক লাফে বেতালের মতো তাঁর ঘাড়ে চেপে বসল মৃত্যুভয়। বিস্ফারিত চোখে তিনি দেখলেন, চারটে ছেলের একটা বাঁহাতে আরও দু’টো আধলা তুলে নিয়েছে আর ডান হাতটা উঁচু করছে অন্য একটা আধলা ছুঁড়বে বলে। সামনে দাঁড়ানো তিন জনের দু’জনের হাতে লকলক করছে ধারাল ছুরি এবং আর এক জন উনুন থেকে টেনে বার করে নিয়েছে কয়লা খোঁচানো লোহার শিকটা। রুমালে পেঁচিয়ে এক প্রান্ত ধরে আছে সে। অন্য প্রান্ত আগুনরঙা লাল। বলতে বললেই আধলাটা ছুঁড়ে মারল ছেলেটা আর সেটা এসে সজোরে জমে গেল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বুকে। দম আটকে এল মুহূর্তে। ততক্ষণে তাঁর পেট লক্ষ্য করে ছুরি তুলেছে একটা ছেলে। তিনি বুঝতে পারছিলেন মৃত্যু অবধারিত কিন্তু বাঁচার আকুতিতে হঠাৎ করেই যেন জোর এসে গেল তাঁর গায়ে। সামনের ছেলেটাকে ধাক্কা মেরে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলেন উল্টো দিকে। কোনও মতে একবার হিন্দু হস্টেলের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়তে পারলে আর চিন্তা নেই। কিন্তু আজই যেন রাস্তা ফুরোতে চাইছে না। দরদর করে ঘামছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। কান থেকে বেরনো রক্তে ভিজে যাচ্ছে কাঁধের জামা। পেছনে ছুটে আসছে চারটে কালান্তক যম। একটা ইট মাথার পাশ দিয়ে সাঁ করে সামনের রাস্তায় আছড়ে পড়ল। পরেরটা যদিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হল না। সোজা এসে আছড়ে পড়ল কোমরে। তবু ছুটছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর তাদের অশ্রাব্য গালাগালের মধ্যে থেকে একটা কথাই তাঁর মাথায় গেঁথে যাচ্ছে। সেটা হল, জান নিয়ে ফিরতে পারবি না শালা।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনীশক্তি শেষ। চোখে ঝাপসা দেখছেন। বুঝতে পারছেন, আর কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা। তার পরেই আততায়ীরা ধরে ফেলবে তাঁকে। এই অবস্থাতেই মূল রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে প্যারীচরণ সরকার স্ট্রিটের দিকে বাঁক নিলেন তিনি আর নিতেই দেখলেন, উল্টো দিক থেকে একটা লম্বা মতো ছেলে হেঁটে আসছে। একটা মানুষ দেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাঁচার আকাঙ্ক্ষা যেন আরও বেড়ে গেল। তিনি সোজা ছেলেটার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। আর্তস্বরে বলে উঠলেন, বাঁচাও ভাই।

আর চলতে পারছিলেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। রাস্তার ওপরেই শুয়ে পড়লেন তিনি। এই ঘটনায় ঘাবড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। ছেলেটাও ঘাবড়ে গেল। কিন্তু সে বিস্ময় কাটার অবকাশ না দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল চারটে ছেলে। তাদের তিন জনের হাতে ছুরি আর লোহার শিক। তাদেরই এক জন বলল, চুপচাপ ফুটে যা। নয়তো তুইও খবর হয়ে যাবি।

হাল ছেড়ে দিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এক জন অচেনা মানুষের জন্য কোন পাগল এই মস্তানদের সাথে বিবাদ করবে? আর চাইলেও তো সে কিছু করতে পারবে না। তিনি অস্ফুটে লম্বা ছেলেটিকে বলে উঠলেন, তুমি যাও ভাই। চলে যাও।

কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটি। বলল, উঠে আসুন।

ছেলেটির বলার মধ্যে কী যে জাদু ছিল আচমকাই মনে বড্ড বল পেলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। ছেলেটির হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন।

ছেলেটি বলল, কোথায় যাবেন আপনি?

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, হিন্দু হস্টেল।

ছেলেটি বলল, ভয় নেই। আমি পৌঁছে দেব আপনাকে।

এই কথোপকথন রক্তপিপাসু ছেলেগুলোর ভাল লাগার কথা নয়। লাগলও না। তাদেরই এক জন লোহার শিক নিয়ে তেড়ে এল লম্বা ছেলেটির দিকে। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে সে যেন আচমকাই থমকে গেল! থমকে গেল বাকি তিন জনও! এ যেন অনেকটা সেই ছেলেবেলার খেলা। স্ট্যাচু বললেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। এক্কেবারে নড়াচড়া করা চলবে না। বিস্ফারিত চোখে ছেলেগুলোর এই রূপান্তর দেখছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। শক্ত করে তাঁর হাত ধরে ছেলেটি বলল, আমার কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটুন।

হাঁটতে হাঁটতে বারবার পেছন ফিরে দেখছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, কোন মন্ত্রবলে ছেলেগুলো অমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে! সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল তাঁর।

এসে পড়ল হিন্দু হস্টেলের গেট। লম্বা ছেলেটি বলল, আশা করি, এ বার আপনি যেতে পারবেন?

ধন্যবাদ দিতেও ভুলে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বিস্মিত গলায় বললেন, ছেলেগুলো নড়ছে না কেন? আপনি কি ওদের কিছু করেছেন?

মৃদু হাসল ছেলেটি। বলল, একে বলে হস্তপদ বন্ধন। সবই গুরুকৃপা। যান ঘরে যান। সাবধানে থাকবেন। এ ধরনের ছেলেদের সাথে অশান্তি না করাই ভাল।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে অবাক করে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল ছেলেটি। ঘোর কাটিয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন তিনি, শুনুন, আপনার পরিচয়?

ঘুরে তাকিয়েছিল ছেলেটি। বড় অন্তর্ভেদী দৃষ্টি তার চোখে। গম্ভীর গলায় বলেছিল, আমি নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সংস্কৃত বিভাগ।

তিন দিন পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে নীরেন্দ্রনাথকে খুঁজে বার করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং হাত দু’টো আঁকড়ে ধরে বলেছিলেন, আপনি আমায় জীবন দিয়েছেন ভাই। বলুন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?

স্মিত হেসে নীরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, আপনি তো বটানি? আপনাকে আমি ফুটবল খেলতে দেখেছি। সে দিন রাতে প্রথমটায় চিনতে পারিনি। পরে মনে পড়ল। আমরা সেম ব্যাচ। আপাতত আমায় তুই করে বলতে পারেন।

উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে নীরেন্দ্রনাথকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তার পর চোখ গোলগোল করে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ভাই, তুই কি তান্ত্রিক?

নীরেন্দ্রনাথ মাথা নেড়ে বলেছিলেন, উঁহু। আমি কৌতূহলী মাত্র।

তা আজ বন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে ঘনঘন মাথা নাড়লেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বললেন, না রে ব্যাটা। তুই যা ভাবছিস তা নয়। এই যে আমায় জলদাপাড়া পাঠাচ্ছে এর মধ্যে শাস্তি তো নেই-ই উল্টে পুরস্কার আছে।

ভাদুড়ি মশায় বললেন, কী রকম?

গুছিয়ে বসলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বললেন, বৌদি কোথায়? একটু চা হোক।

নিবেদিতা একটু বেরিয়েছে। ফিরুক। শুধু চা নয়, অনেক কিছুই হবে। ততক্ষণ তুই বল ব্যাপারটা কী?

ব্যাপারটা আসলে খুবই ঘোরাল। গত ছয়-সাত বছর ধরে জলদাপাড়া, চিলাপাতা, বক্সা এই সব জঙ্গলে প্রচুর পোচিং হচ্ছে। বক্সা বা চিলাপাতা কিছুটা কন্ট্রোল করা গেলেও জলদাপাড়া পুরোপুরি হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে। বনবিভাগের বড়কর্তাদের গোপন বৈঠকে যে তথ্য উঠে এসেছে তা হাড় হিম করে দেওয়া। যে ভাবে জলদাপাড়ায় গন্ডার মারা হচ্ছে এখনই যদি রাশ টানা না যায় আগামী পাঁচ বছরে জলদাপাড়ায় আর একটাও একশৃঙ্গ গন্ডার থাকবে না।

শিউরে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়, কী বলছিস জ্যোতি?

ঠিকই বলছি। গত তিন বছর ধরে বনবিভাগ জলদপাড়ার এই পোচিং কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছে কিন্তু অদ্ভুতভাবে বারেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। তিন বছরে অনেক জন অফিসারকে ওখানে বদলি করা হয়েছে কিন্তু কেউই ওখানে থাকতে চাইছে না। নানা অজুহাতে ফিরে আসছে। এ দিকে সরকার বাহাদুর বদ্ধপরিকর যে করে হোক চোরাশিকার আটকাতে হবে। তাই এই অধমের ডাক পড়েছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ইনস্পেক্টর জেনারেল থেকে ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল করে আমাকে ওখানে পোস্টিং দিয়েছে। অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল অব ফরেস্ট নমন শুক্লা নিজে আমার সাথে মিটিং করেছেন। বলেছেন, অ্যাট এনি কস্ট গন্ডার মারা আটকাতে হবে। আমিও বলেছি, আমি কাজটা করে দেখাব। এত দিন করাপশনের চক্করে কেউ আমায় কাজ করতে দেয়নি। এ বার নিজেরাই বুঝেছে। করাপশন হুড়কো দিয়ে দিয়েছে সব্বার পেছনে। আমিও তোকে বলছি নীরেন, আমি যদি ওপর মহলের হেল্প পাই আর যদি কেউ আমার পেছনে কাঠি না করে তা হলে আমি এই চোরাশিকারিদের বাপের নাম ভুলিয়ে দেব।

কথাগুলো শুনতে শুনতে চিন্তার ছাপ পড়েছিল ভাদুড়ি মশায়ের কপালে। তিনি বললেন, দেখ জ্যোতি, তোর কর্মকুশলতা এবং সততা নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই তুই এই চোরাশিকার আটকাতে পারবি কিন্তু এই যে বলছিস এত জন অফিসারকে ওখানে পাঠানো হয়েছে এবং সকলেই নানা অজুহাতে ফিরে এসেছেন, এটা কেন? এ ব্যাপারে কোনও খোঁজখবর নিয়েছিস?

মাছি তাড়ানোর মতো কথাটা উড়িয়ে দিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ধুর ধুর। এতে আবার খোঁজখবর নেওয়ার কী আছে? ওখানে গিয়ে দেখেছে পোচারদের সাথে এঁটে উঠতে পারবে না, আর এখন তো ওখানে যাদের পাঠানো হচ্ছে সবাই ডিরেক্টলি আন্ডার সারভেইলেন্স। ঘুষও খেতে পারবে না। তাই বেকার বেকার নাম খারাপ না করে ফিরে আসছে। বুঝেছিস?

গম্ভীর ভাবে নেতিবাচক মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়, না রে জ্যোতি। আমার মন বলছে, ব্যাপারটার মধ্যে কিছু গন্ডগোল আছে। তুই একটু ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে তবে যা।

এখন আর খোঁজখবর নেওয়ার উপায় নেই নীরেন। পোস্টিং ডেট দিয়ে দিয়েছে। যেতে তো হবেই। গিয়ে আমি খোঁজ নেব বরং।

কবে যাওয়া?

এই তো পরশুর পরের দিন।

এ সব কথার মাঝেই ছেলে সৌরীন্দ্রনাথকে নিয়ে ফিরে এলেন ভাদুড়ি মশায়ের স্ত্রী নিবেদিতা। ঘরে বানানো গোটা ছয়েক মোচার চপ আর দু’কাপ চা খেয়ে বিদায় নিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, বৌদি, আপনার যা রান্নার হাত দ্রৌপদীও লজ্জা পাবেন।

নিবেদিতা কিছু বলেন না। শুধু হাসেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে এই সার্টিফিকেট তিনি বহুবার পেয়েছেন। স্বামীর এই বিশালবপু অথচ বড় নরম মনের বন্ধুটিকে ভারী স্নেহ করেন তিনি।

সকালের দিকে দু’টি ছেলে পড়া বুঝতে আসে। তাদের আনন্দবর্ধনের ধ্বনিবাদ ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছিলেন ভাদুড়ি মশায়, কানে এল ফোনের ঝঙ্কার। কিছুক্ষণ পরেই লাইব্রেরি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন নিবেদিতা, তোমার ফোন।

কে?

জ্যোতি ঠাকুরপো।

উঠে গিয়ে ফোন ধরলেন ভাদুড়ি মশায়, বল।

একটু যেন গম্ভীর শোনাল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গলাটা। বললেন, তোর কথা মতো কাল বাড়ি ফিরে একটু খোঁজখবর করলাম বুঝলি? যাদের যাদের ওখানে পোস্টিং হয়েছিল বেশির ভাগই হিন্দি বেল্টের লোক। মালগুলো মহা খচ্চর হয় জানিস তো? কিচ্ছু বলতে চায় না। ভাবে কথা বললেই বুঝি চাকরি চলে যাবে।

আহ, আসল কথাটা বল না, মাঝপথে থামিয়ে দিলেন ভাদুড়ি মশায়।

হ্যাঁ, বলছি। বলছি। তা এই বদলির লিস্টে এক জনকে পেলাম বাঙালি। সুজয় পাল। আমাদের দু’ব্যাচ জুনিয়র। তা সুজয় একটা অদ্ভুত কথা বলল।

কী?

বলল, প্রতি তিন মাস অন্তর না কি জঙ্গলে অ্যাটাক হয় আর সে দিন কোনও গার্ড পাহারা দিতে চায় না। জোর করে ঠেলে পাঠালেও জঙ্গলের বাইরেই দল বেঁধে বসে থাকে। কিছুতেই কোর এরিয়ায় ঢোকে না। আর তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার, গন্ডারগুলোর না কি বডি পাওয়া যায় না!

মানে? বুঝলাম না। গন্ডার তো মারা হয় প্রধানত খড়্গর জন্য। তা হলে বাকি বডিটা…

কথা কেটে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, বললাম তো পাওয়া যায় না। পরে হিসেব করে দেখা যায় গন্ডার কমে গেছে কিন্তু যে দিন থেকে এই ব্যাপক হারে পোচিং শুরু হয়েছে সে দিন থেকে জঙ্গলে কোনও গন্ডারের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। এটা শুনে আমি শুক্লাজীর সাথেও কথা বললাম। ওনার বক্তব্য, বিরাট বড় একটা র‍্যাকেট কাজ করছে এর পেছনে। সম্ভবত ওরা ঘুমপাড়ানি গুলি করে পুরো গন্ডারগুলোকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং কোনও গোপন ডেরায় কাটাকাটি করছে। ইদানীং শুধু গন্ডারের খড়্গই না, চীনে গন্ডারের চামড়া বা বিভিন্ন অঙ্গেরও বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছে। তুই ভাবতে পারছিস কী ভয়ানক ব্যাপার চলছে ওখানে? আর এগুলো এতটাই কনফিডেনশিয়াল যে কিছুই বাইরে আসছে না।

ভুরু কুঁচকে চুপ করে থাকেন ভাদুড়ি মশায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, কী হল? চুপ মেরে গেলি কেন?

গলা ঝেড়ে ভাদুড়ি মশায় বললেন, ভাবছিলাম।

কী ভাবছিলি?

খুব সামান্য কয়েকটা কথা জ্যোতি। তুই বলছিস, তিন মাস অন্তর অ্যাটাক হয় এবং গন্ডারদের ঘুম পাড়িয়ে ধরে নিয়ে চলে যাওয়া হয়।

আমি বলছি না, শুক্লাজীর সন্দেহ।

যাই হোক, একটা কথা ভেবে দেখ সে ক্ষেত্রে তো অন্তত দশ বারোটা বড় লরির প্রয়োজন। এতগুলো গাড়ি যদি জঙ্গলে ঢোকে এবং জঙ্গল থেকে বেরোয় সেগুলো কি কারও চোখে পড়বে না? মানলাম, গার্ডেরা ভয়ে জঙ্গলে ঢোকে না। কিন্তু এমন একটা সেন্সিটিভ জায়গায় জঙ্গলের বাইরেও নিশ্চয়ই কড়া পাহারা আছে। সেখানে তো এই গাড়িগুলোর ধরা পড়ে যাওয়ার কথা। তাই না?

অদ্ভুত বোকার মতো কথা বলছিস নীরেন, ঝাঁঝিয়ে উঠলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, যাদের এত পাওয়ার যে গোটা গন্ডার তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে তাদের কাছে রাস্তার চেকপোস্ট কিনে নেওয়া কোনও ব্যাপার?

তুই বলতে চাইছিস, দুনিয়াশুদ্ধু সবাই অসৎ?

না, বলতে চাইছি, সকলেরই প্রাণের ভয় আছে।

আচ্ছা। তোরও প্রাণের ভয় আছে তা হলে?

আছে নীরেন, কিন্তু এটা আমার নিজেকে প্রমাণ করার লড়াই। আই হ্যাভ টু প্রূভ মাইসেলফ। যাই হোক, তোর এত নেগেটিভ কথা আমার ভাল্লাগছে না। আমি রাখলাম।

ফোন কেটে দিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিন্তু রিসিভার হাতে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। তাঁর ভাবনার জগতে কীসের যেন তোলপাড় হচ্ছে। পাশে এসে দাঁড়ালেন নিবেদিতা। নরম গলায় বললেন, কী হয়েছে গো? তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

স্ত্রীর ডাকে সাড় ফিরে পেয়ে ফোনের রিসিভারটা জায়গা মতো রাখলেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, কেন জানি না মনটা খুব কু ডাকছে নিবেদিতা। মনে হচ্ছে জ্যোতির খুব বিপদ। ও যদি অন্যদের মতো ভিতু বা অসৎ হত আমি চিন্তা করতাম না। কিন্তু ও যে গোঁয়ার। মনে হচ্ছে ওর এই গোঁয়ার্তুমি ওকে ভয়ানক সমস্যায় ফেলবে।

শিউরে উঠলেন নিবেদিতা, সে কী! তবে এখন উপায়?

একটু ভেবে ভাদুড়ি মশায় বললেন, কটা দিন তুমি সৌরীনকে নিয়ে একা থাকতে পারবে?

একটুও সময় নিলেন না নিবেদিতা। দৃঢ় গলায় বললেন, পারব। তুমি জ্যোতি ঠাকুরপোর সঙ্গে যাও।

কয়েক মুহূর্ত স্ত্রীর গভীর চোখ দু’টির দিকে তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। তার পর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, বহু পুণ্যবলে পুরুষ তোমার মতো জায়াপ্রাপ্ত হয়। তোমার কল্যাণ হোক। তোমার এই উদারতা ঋদ্ধ করুক আমাদের সন্তানকে।

ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেলের বাংলোটা ভারী সুন্দর। জঙ্গলের এক ধার ঘেঁষে কাঠ আর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাংলোর লাগোয়াই অফিস। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এসে হাঁকডাক করে লোক জড়ো করে ফেলেছেন। অধস্তন সমস্ত অফিসার থেকে শুরু করে যে অফিসের জিপ চালায় সেও আছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যম দেখে মনে হচ্ছে, তিনি আজই চোরাশিকারিদের ধরে ফেলবেন। ভিতরের ঘরে আধশোয়া হয়ে বই পড়তে পড়তে ভাদুড়ি মশায় বন্ধুর গলা পাচ্ছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন কিন্তু কোনও সন্তোষজনক উত্তর পাচ্ছেন না। বেশিরভাগেই হ্যাঁ-না করে কাটিয়ে যাচ্ছে আর তাতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গলার পর্দা চড়ছে ক্রমাগত।

বড্ড চেঁচায় জ্যোতিটা। শুরুতেই এত হইহই করলে তো কেউই ওর ওপর ভরসা পাবে না। ভাদুড়ি মশায়ের ইচ্ছে করছিল, গিয়ে মুখটা চেপে ধরেন। কিন্তু উপায় নেই। বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাইরে। বাংলোর পেছন দিকটায় সুন্দর করে সাজানো বাগান। সেখানে এসে দেখলেন, চরণদাস বাগানে জল দিচ্ছে। চরণদাস একাধারে এই বাংলোর মালি, রাঁধুনি এবং পাহারাদার। এই লোকটিকে ভারী ভাল লেগে গিয়েছে ভাদুড়ি মশায়ের। ষাটের কাছাকাছি বয়েস। কম কথা বলে কিন্তু কাজে অতিরিক্ত দক্ষ। মেদিনীপুরের লোক। গত চল্লিশ বছর ধরে এখানেই আছে। ভাদুড়ি মশায়রা এখানে পৌঁছনোর পরেই সে এত সুন্দর একটা ডাবের শরবৎ খাইয়েছে যে তখন থেকেই ভাদুড়ি মশায় চরণদাসে মজে আছেন। তাঁকে বাগানে এসে দাঁড়াতে দেখেই চটপট হাত ধুয়ে এগিয়ে এল চরণদাস, কিছু লাগবে স্যার?

মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, কাজ না থাকলে এসো গল্প করি।

হঠাৎই এ দিক ও দিক দেখে চাপা গলায় চরণদাস বলল, আপনাকে একটা কথা বলব স্যার?

চরণদাসের এই আকস্মিক পরিবর্তনে খানিক অবাক হলেন ভাদুড়ি মশায়। তবু কৌতূহলে ঘাড় নাড়লেন।

চাপা গলায় চরণদাস বলল, আপনার বন্ধুকে একটু রয়েসয়ে থাকতে বলুন স্যার। নয়তো খুব বিপদ। জানি ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললাম কিন্তু আপনাদের খুব ভাল লেগেছে আমার। তাই মনে হল সাবধান করে দিই।

হঠাৎ এ কথা বলছ কেন?

সে অনেক কথা স্যার। এখন চার দিকে অনেক লোকজন। আমি রাতে আপনার সাথে দেখা করব। ঘরের দরজাটা খোলা রাখবেন স্যার। যেমন দ্রুত এসেছিল, তেমন ভাবেই বাগানে ফিরে গেল চরণদাস।

ভারী চিন্তিত হয়ে পড়লেন ভাদুড়ি মশায়। মানুষ চিনতে তাঁর খুব ভুল হয় না। যেটুকু বুঝেছেন, চরণদাস বাজে কথা বলার লোক নয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ফোন পেয়ে মনটা যেমন কু ডেকে উঠেছিল, এখনও সেই একই অনুভূতি হল ভাদুড়ি মশায়ের। তাঁর মন বলল, এমন কিছু একটা রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে এই অরণ্যে যা ভেদ করতে গেলেই অতর্কিত মৃত্যুর মতো নেমে আসবে বিপদ। ভয়ানক বিপদ।

. . .

দরজাটা খোলাই রেখেছিলেন ভাদুড়ি মশায়। মৃদু শব্দ হতেই উঠে বসলেন। দরজাটা আলতো ফাঁক করে মুখ বাড়াল চরণদাস। ভাদুড়ি মশায় বললেন, এসো।

নাক ডাকার শব্দে ঘুম আসে না, এই অজুহাতে আগেই অন্য ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন ভাদুড়ি মশায়। কথাটা মিথ্যে নয়। পাশের ঘর থেকে অনবরত ভেসে আসছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাসিকাগর্জন। চরণদাস বলল, স্যার বাইরে আসুন। বাগানে গিয়ে কথা বলি।

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ভাদুড়ি মশায়। রাতের অরণ্য বড়ই মায়াবী। তার ওপর ভাঙা চাঁদ রয়েছে আকাশে। মৃদু একটা হাওয়া দিচ্ছে। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বাগানের কাঠের বেঞ্চে বসলেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, এ বার বলো চরণদাস। তাঁর কণ্ঠস্বরে উদ্বেগের আভাস।

চরণদাস বলল, স্যার, এই চোরাশিকারের সমস্যা কোনও দিন সমাধান হবে না। অনেক অফিসার এসেছেন, গেছেন। কেউ কিছু করতে পারেননি। আপনার বন্ধুও পারবেন না। উল্টে বেশি হইহই করলে বিপদে পড়বেন। এই পুরো এরিয়ার জঙ্গল যার হাতের মুঠোয় তার নাম সুখবিলাস ছেত্রী। সুখবিলাস আজকের লোক নয় স্যার। বিশ বছর আগে থেকেই ও টুকটাক পোচিং করত। ধরাও পড়েছে কয়েক বার। মাঝে ও অনেক দিনের জন্য কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেছিল। পাঁচ বছর আগে ফিরে আসে এবং নতুন করে চোরাশিকার শুরু করে। কিন্তু ওর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই কারণ কেউই তো আর বন্দুক হাতে জঙ্গলে ঢুকছে না, এ দিকে গোটা গোটা গণ্ডার গায়েব হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এটা কী করে সম্ভব চরণদাস? চিন্তিত গলায় বললেন ভাদুড়ি মশায়?

চরণদাসের মুখে একই সঙ্গে ভয় আর আশঙ্কার একটা মিশ্র অভিব্যক্তি খেলা করে গেল। গলা নামিয়ে সে বলল, স্যার, সুখবিলাস কালোজাদু জানে।

মানে? চমকে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়।

স্যার, তিন মাস অন্তর প্রতি ত্রয়োদশীর রাতে জঙ্গলে প্রেতের দল নেমে আসে। ওরাই গন্ডারদের মেরে ফেলে খড়্গ নিয়ে নেয়। সে জন্যই তো মৃত গন্ডারদের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না। ওই প্রেতের দল সুখবিলাসের পোষা। বলতে বলতেই যেন কেঁপে উঠল চরণদাস।

উত্তেজনায় বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালেন ভাদুড়ি মশায়, কী বলছ তুমি চরণদাস?

হ্যাঁ স্যার। তাই জন্যই তো গার্ডেরা অ্যাটাকের দিন কোর এরিয়ায় ঢোকে না। আমি দু’জন গার্ডের মুখ থেকেই এ কথা শুনেছি। কিন্তু বাইরের কাউকে এ কথা তারা বলবে না। আর দু’দিন পরেই তো ত্রয়োদশী। তিন মাস পার হয়ে গেছে। আবার প্রেতের দল নেমে আসবে জঙ্গলে। আমার মন বলছে, সুখবিলাস কালই আসবে আপনার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। নতুন অফিসার এলেই সে দেখা করতে আসে। আপনার বন্ধুর যা মাথা গরম, আমার ভয় হচ্ছে সুখবিলাস ওনার কোনও ক্ষতি না করে দেয়!

আচমকাই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ভাদুড়ি মশায়ের। ত্রয়োদশীর রাতে জঙ্গলে প্রেতের দল নেমে আসে এবং তারাই গন্ডার শিকার করে এ কথাটা মেনে নিতে একটু সময় লাগল তাঁর। বিপদের আশঙ্কা তিনি করেছিলেন কিন্তু বিপদ যে এ ভাবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে তা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি। এ বিপদ থেকে কী ভাবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং সর্বোপরি এই জঙ্গলকে উদ্ধার করবেন তা তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। চাপা গলায় চরণদাস বলে উঠল, স্যার আপনার বন্ধুকে বলবেন, সুখবিলাসের সাথে যেন ঝামেলা না করেন। ও যা বলছে মেনে নেওয়াই মঙ্গল।

উত্তর দিলেন না ভাদুড়ি মশায়। ধীরে ধীরে ভাঙা চাঁদখানি মেঘে ঢেকে গেল।

পরের দিন সকাল হতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে সবটা খুলে বললেন ভাদুড়ি মশায়। শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার পর আচমকাই সেক্রেটারিকে ফোন করে বললেন, বাই হাফ অ্যান আওয়ার আমাদের যত গার্ড আছে আমি সবার সঙ্গে কথা বলতে চাই। অ্যারেঞ্জ করো।

হাঁ হাঁ করে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়, কী পাগলের কাণ্ড করছিস জ্যোতি?

পাগলের কাণ্ড মানে? সরকারের থেকে টাকা নেবে আর ভূতের ভয়ে পাহারা দেবে না? ইয়ার্কি হচ্ছে? আজ সব কটাকে সাপসেন্ড করে দেব। গর্জন করে উঠলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

এক মুহূর্ত বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। তার পর গম্ভীর গলায় বললেন, তুই একটি হস্তিমূর্খ। তোকে যারা চাকরি দিয়েছে তাদের দেখা পেলে আমি কানে ধরে ওঠবোস করাতাম। তোর ম্যাচিওরিটি তো একটা দশ বছরের বাচ্চার থেকেও কম। তোকে না কি করেছে ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল!

ওপরে ওপরে তড়পালেও আসলে ভাদুড়ি মশায়কে খানিক সমঝেই চলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এমন ভর্ৎসনায় খানিক থতিয়ে গিয়ে বললেন, এ ভাবে বলছিস কেন?

তো আর কী ভাবে বলব? তুই কী ভেবেছিস, গার্ডেরা তোর সামনে স্বীকার করবে যে তারা ত্রয়োদশীর দিন কোর এরিয়ায় ঢোকে না? জ্যোতি এই সমস্যার শিকড় অনেকটা গভীরে। এ ভাবে চেঁচামেচি করে সমাধান হবে না। লোকজ বিশ্বাস এতটাই গভীর হয় যে তার ওপর সরকারি হুকুম কাজ করে না।

ফের তেতে উঠলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, তার মানে তুই ওই ভূতের গল্পে বিশ্বাস করছিস?

একটু চুপ করে থেকে ভাদুড়ি মশায় বললেন, বিশ্বাস করছি না, আবার অবিশ্বাসও করছি না। এ দুনিয়ায় সবই সম্ভব জ্যোতি। আর জঙ্গল থেকে গন্ডার যে স্রেফ উধাও হয়ে যায় এ কথাও তো মিথ্যে নয়।

না নয় কিন্তু তা বলে আমি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব আর ত্রয়োদশীর রাতে ভূতের দল এসে দশটা গন্ডার মেরে দিয়ে চলে যাবে?

আমাকে একটু সময় দে জ্যোতি। ভাবতে দে। এখনও তো আমরা সুখবিলাস লোকটাকে দেখিইনি। আগে তাকে দেখি। চরণদাস যা বলছে সেটার সত্যতা যাচাই করতেও তো সময় লাগবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তুই তো এখানে দু’দিনের জন্য আসিসনি। সময় নিয়ে সবটা জেনেবুঝে নে। তার পর মোডাস অপারেন্ডি ঠিক কর। এ ভাবে তাড়াহুড়ো করিস না।

দু’হাতে কপালের রগ ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তার পর মুখ তুলে অত্যন্ত জেদি গলায় বললেন, তুই যা বলছিস সব ঠিক নীরেন কিন্তু আমি নিজের কাছে প্রমিস করেছি, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর আর একটাও গন্ডারকে মরতে দেব না। তাই আগামীকাল ত্রয়োদশীতে সুখবিলাসের পোষা ভূতেরা হোক বা তার পোষা পোচাররা হোক, কাউকেই আমি গন্ডার শিকার করতে দেব না।

কী ভাবে আটকাবি তুই?

লোকাল গার্ডদের ওপর আমার ভরসা উঠে গেছে। আমি অন্য ব্যবস্থা করব।

দুপুর তিনটের মধ্যে চার কোম্পানি আধাসেনা এসে হাজির হল জলদাপাড়া রেঞ্জার অফিসে। তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। নির্দেশ দিলেন, আগামীকাল সন্ধে থেকে জঙ্গলের নিজস্ব গার্ডদের পাশাপাশি আধাসেনাও জঙ্গল পাহারা দেবে এবং সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই গুলি করবে।

মিটিং সেরে এসে ভারী তৃপ্ত দেখাল জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে। চা খেতে খেতে ভাদুড়ি মশায়কে বললেন, নীরেন, কালাশনিকভ নিয়ে জঙ্গল পাহারা দেবে আধাসেনা। ভূত, প্রেত, দত্যি, দানো যাই আসুক সুবিধে করতে পারবে না। জ্যোতি হাজরা থাকতে জলদাপাড়ায় আর একটাও গন্ডার মরবে না।

মৃদু হেসে বন্ধুর পিঠে হাত রাখলেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, তোর ইচ্ছেপূরণ হোক জ্যোতি। তুই বোস আমি একটু হেঁটে আসি আশপাশ থেকে।

. . .

সাড়ে ছ’টা বেজে যেতেও যখন ভাদুড়ি মশায় ফিরলেন না, ভারী চিন্তায় পড়ে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। নীরেন তো এমন দেরি করার লোক না। তা ছাড়া হঠকারিতা তার স্বভাবে নেই। সে তো জঙ্গলের গভীরে ঢুকবে না। তা হলে গেল কোথায় সে?

এমন সময় একটা সাদা খাম নিয়ে এল চরণদাস। কেউ একটু আগেই বাংলোর বারান্দায় ফেলে রেখে গেছে। খাম খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। একটা চিঠি। চিঠির বয়ান :

মাননীয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হাজরা,

আগামীকাল জঙ্গলে শিকার হবে বলে খুব ব্যস্ত। সে জন্য আপনার সঙ্গে দেখা করার সময় পেলাম না। তবে ঝামেলা মিটলেই আমি আসব।

শুনলাম, আপনি কাল জঙ্গলে আধাসেনা নামাচ্ছেন। আমার অনুরোধ ওটি করবেন না কারণ তাতে জীবনহানির আশঙ্কা আছে আর জানেনই তো, মানুষ মরলে অনেক বেশি হ্যাপা। অবশ্য আপনি যে কথা শোনার লোক নন সে আমি বুঝতে পেরেছি তাই আপনার বন্ধুকে আমার কাছে নিয়ে গেলাম। দু’দিন গরীবের সেবা নেবেন। আপনি যদি আধাসেনা না নামান তা হলে পরশু দিন ভোরেই আপনার বন্ধুকে আপনার বাংলোয় পৌঁছে দেব আর যদি নামান তা হলেও আপনার বন্ধুকে পৌঁছে দেব কিন্তু মাথাটা আমি আমার কাছে রেখে দেব।

খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন সুখবিলাস ছেত্রী ফাঁকা আওয়াজ দেয় না। আর আমার খোঁজ করে লাভ নেই। আপনি কেন, আমি না চাইলে আপনার বাবারাও আমার টিকির নাগাল পাবে না।

ইতি,

আপনার একান্ত অনুগত

সুখবিলাস ছেত্রী

ধপ করে বেতের চেয়ারে বসে পড়লেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বুঝতে পারলেন, শত্রুকে হালকা ভাবে নিয়েছিলেন আর সেই ছিদ্র দিয়েই শত্রু দংশন করেছে। যেমন তেমন কামড় নয়, একেবারে মরণ কামড়। কোনও উপায় নেই। নিজের প্রতিজ্ঞার সাথে আপোস করতেই হবে। আধাসেনা নামানো যাবে না। নীরেনের জীবন নিয়ে কোনও ঝুঁকি তিনি নিতে পারবেন না। কিন্তু অসহায় গন্ডারগুলোর আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে তাঁর চোখে জল এসে গেল।

হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা চলে এসেছিলেন ভাদুড়ি মশায়। এখান থেকে ফরেস্ট বাংলো চোখে পড়ে না। প্রাচীন সব বৃক্ষ দৃষ্টিরোধ করে। মুগ্ধ হয়ে একটা জায়ান্ট স্কুইরেলের কীর্তিকলাপ লক্ষ্য করছিলেন, এমন সময় চারটে লোক তাঁকে ঘিরে ধরল। তাদের প্রত্যেকের হাতেই বন্দুক। প্রথমটায় একটু ঘাবড়েই গেছিলেন ভাদুড়ি মশায় কিন্তু দ্রুত বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে প্রশ্ন করলেন, কে আপনারা? কী চাই?

দলের পান্ডাগোছের লোকটা খুবই বিনীত ভঙ্গিতে বলল, মাস্টারজী, সুখবিলাস ছেত্রী আমাদের পাঠিয়েছেন। আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।

থমকে গেলেন ভাদুড়ি মশায়। এরা তাঁকে মাস্টারজী বলে সম্বোধন করছে! তার মানে সব খবর নিয়েই এসেছে! জ্যোতিকে শায়েস্তা করার জন্যই যে এই অপহরণ তা বুঝতে ভাদুড়ি মশায়ের সময় লাগল না। তিনি বেরিয়ে আসাতে এদের সুবিধে হয়েছে। নয়তো গায়ের জোর দেখাত। এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হল, বাংলোয় ফিরে যান। চারটে লোককে থামিয়ে দেওয়া তাঁর কাছে কোনও ব্যাপার না, কিন্তু পরক্ষণেই তীব্র কৌতূহল সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য করল। তাঁর মনে হল, এদের সঙ্গে গেলেই সুখবিলাসের দর্শন পাওয়া যাবে এবং ত্রয়োদশীর রাতে জঙ্গলে প্রেত নামার ব্যাপারে কিছুটা হলেও জানতে পারা যাবে। বোঝা যাবে এ কথা কতটা সত্যি, কতটা মিথ! একটু চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় তিনি লোকগুলোকে বললেন, চলো।

গাছের আড়ালেই যে একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে ভাদুড়ি মশায় আগে বুঝতে পারেননি। তাঁকে তুলে নিয়ে জিপ রওনা দিল গভীর জঙ্গলের দিকে। জিপ চলতে শুরু করা মাত্র তাঁর চোখ বেঁধে দিল লোকগুলো। প্রায় মিনিট কুড়ি চলার পর জিপ থামল। চোখের বাঁধন খুলে লোকগুলো বলল, নামুন মাস্টারজী।

অবাক হয়ে ভাদুড়ি মশায় দেখলেন, গভীর জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা জায়গা গাছ কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দু’খানা মাটির ঘর তোলা হয়েছে। রয়েছে কুয়ো এবং তুলসীতলাও। ঠিক যেন একখানা গেরস্তবাড়ি। জিপের শব্দ পেতেই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল একটা লোক। পরনে মিলিটারিদের মতো প্যান্ট। গায়ে সুতির ফতুয়া। লোকটার মাথার চুলে পাক ধরেছে কিন্তু পাকানো দড়ির মতো চেহারা দেখে বয়েস আন্দাজ করার উপায় নেই। চোখ দু’টোয় রাজ্যের ধূর্ততা। লোকটা হাত জোড় করে এগিয়ে এল ভাদুড়ি মশায়ের দিকে। বলল, গোস্তাকি মাফ করবেন মাস্টারজী। বাধ্য হয়ে আপনাকে একটু তকলিফ দিতে হল। আসুন আসুন, গরিবখানায় পায়ের ধুলো দিন। অধমের নাম সুখবিলাস ছেত্রী। এটা আমার ফরেস্ট বাংলো। আজ আর কাল রাতটা আপনাকে একটু কষ্ট করে থাকতে হবে। আপনার বন্ধুকে আমি চিঠি দিয়েছি। তিনি যদি কাল আধাসেনা না নামান তা হলে পরশু ভোরেই আমার লোক আপনাকে ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে আসবে। আশা করি, আপনার মুখ চেয়ে তিনি আমার কথা শুনবেন। সুনীতি, এই সুনীতি।

সুখবিলাসের ডাকে একটি অল্পবয়স্ক মেয়ে বেরিয়ে এল। বেশ আঁটো চেহারা। মুখে চপল হাসি। তাকে দেখিয়ে সুখবিলাস বলল, আমার সাধনসঙ্গিনী, সুনীতি। এই দেড় দিন ওই আপনার খেয়াল রাখবে। সেবা করবে। ও সব রকম সেবাই খুব ভাল করে। লোনলি লাগলে হেজিটেট না করে বলবেন। বিশ্রি ভাবে হেসে উঠল সুখবিলাস।

সে হাসিতে তাল মেলাল মেয়েটি। হাসতে হাসতেই ভাদুড়ি মশায়ের বাহু স্পর্শ করে অত্যন্ত মদির গলায় বলল, এসো মাস্টারজী।

এক ঝলক মেয়েটির চোখের দিকে তাকালেন ভাদুড়ি মশায়। মানুষের চোখ পড়তে তাঁর ভুল হয় না। মেয়েটির এই যৌবনমদমত্ত চাহনির অন্তরালে যে এক ব্যাকুল প্রাণের বিজন রোদনা লুকিয়ে আছে তা বুঝতে দেরি হল না ভাদুড়ি মশায়ের। মেয়েটির মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন, চলো মা। আমায় হাত, পা ধোয়ার জল দাও।

ভাদুড়ি মশায়ের স্পর্শে থরথর করে কেঁপে উঠল মেয়েটি।

ঘণ্টাখানেক পরে ভাদুড়ি মশায়কে বিদায় জানিয়ে সুখবিলাস বেরিয়ে গেল। জানাল, আগামীকাল সকালে ফিরবে। ঘরের জানলা দিয়ে ভাদুড়ি মশায় দেখলেন, বাইরে দু’টো লোক বন্দুক নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। চুপ করে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে তিনি সমগ্র পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার চেষ্টা শুরু করলেন। সুখবিলাসের আচরণ দেখে কিছুতেই আঁচ করা যাচ্ছে না আগামীকাল সে কী করবে। ভাদুড়ি মশায় বুঝতে পারলেন, এই মুহূর্তে ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনও রাস্তা নেই।

সন্ধে নেমেছে অনেকক্ষণ। ঘরের মধ্যে দু’টো হ্যারিকেন জ্বলছে টিমটিম করে। একটা হ্যারিকেনের সলতে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন ভাদুড়ি মশায় এমন সময় দরজায় মৃদু শব্দ হল। ঘুরে তাকিয়ে তিনি দেখলেন, মাথা নীচু করে সুনীতি দাঁড়িয়ে আছে। মা বলে ডাকার পর থেকেই মেয়েটা কেমন যেন জড়োসড়ো হয়ে আছে। বোধহয় ওই অশ্লীল স্পর্শটার জন্য অপরাধবোধে ভুগছে। ভাদুড়ি মশায়ের মনে হল, এই মেয়েটির কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, একটি অল্পবয়সি মেয়ে অপরাধবোধে ভুগে দূরে দূরে থাকবে এ কোনও কাজের কথা না। পতিতা শব্দটিতেই ভারী আপত্তি ছিল গুরু রামদাস ঠাকুরের। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল ভাদুড়ি মশায়ের।

গুরু রামদাস ঠাকুর খুব ভাল কবিরাজি চিকিৎসা জানতেন। কয়েক ঘর যজমান ছিল যারা আজকালকার যুগেও ঠাকুর ছাড়া অন্য কারও ওষুধ খেত না। সে এক গ্রীষ্মকাল। ভাদুড়ি মশায় ঠাকুরের আশ্রমেই আছেন। এমন সময় চক্রবেড়িয়া থেকে খবর এল, গোবিন্দ ঘোষের ছোট নাতিকে সাপে কেটেছে। ঠাকুর চকবেড়ের ঘোষেদের মন্ত্রগুরু। খবরটা পেয়েই উৎকণ্ঠিত হয়ে হাঁক দিলেন, ওরে মোটর বার কর।

আশ্রমে একটা মোটরগাড়ি থাকত। শিষ্যরা চাঁদা তুলে কিনে দিয়েছিল। দূরের রোগী দেখতে যেতে হলে ঠাকুর ওই গাড়ি ব্যবহার করতেন। গাড়িতে উঠতে উঠতে ঠাকুর বললেন, নীরেন, তুই আমার সাথে চল। কথা কইতে কইতে যাওয়া যাবে।

সে রাতে ছেলেটিকে সুস্থ করে ফেরার পথে প্রবল বৃষ্টি নামল। পথ হারিয়ে ড্রাইভার হাজির হল এক বেশ্যাপল্লীতে। এমনিতেই বৃষ্টি বলে হয়তো সে রাতে লোকজন কম ছিল, তার ওপর মোটরগাড়ি দেখে মেয়েরা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আজ স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সে দিন ঘেন্নায় কুঁকড়ে গেছিলেন ভাদুড়ি মশায়। কিন্তু ঠাকুর নির্বিকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠাকুরের সাথে মেয়েদের দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল এবং ঠাকুর রান্না করতে বসলেন। খিচুড়ি রেঁধে নিজে হাতে খাইয়ে দিলেন মেয়েদের। ফেরার পথে মেয়েরা চোখে জলে ঠাকুরের পা ধুইয়ে দিল। গাড়িতে উঠে খুব সঙ্কোচে ভাদুড়ি মশায় বলেছিলেন, একটা কথা বলব ঠাকুর?

ভাদুড়ি মশায়ের দিকে তাকিয়ে ঠাকুর হেসেছিলেন। বলেছিলেন, তুই কী কইবি আমি জানি। শোন নীরেন, পতিতা শব্দটাই খুব খারাপ। এই সব মেয়েরা কীসের থেকে পতিত? কে ঠিক করেচে সে কথা? একটা কথা জানবি, দু’টো মানুষ যদি স্বেচ্ছায় যৌনাচার করে তাতে কারও বাপের কিছু বলার নেই। আর সবচে বড় কথা, সমাজ এদের জন্য বিকল্প রুজির ব্যবস্থা করতে পারেনি বলেই এরা এই পথে নেমেচে। সেই সমাজই আবার এদের পতিতা বলবে? ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল মারার গোঁসাই? নুড়ো জ্বাল দিনি অমন সমাজের মুখে।

স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন ভাদুড়ি মশায়। যৌনতা নিয়ে বড় পরিষ্কার ধারণা ছিল ঠাকুরের। আজ সুনীতিকে দেখে সে দিনের ঘটনাটা যেন ছবির মতো ভেসে উঠল চোখের সামনে। নরম গলায় তিনি ডাকলেন, এসো মা। ভেতরে এসো।

চায়ের কাপ আর মুড়ির বাটি নামিয়ে রেখে সুনীতি মৃদু গলায় বলল, খেয়ে নিন। রাতের খাবার হলে আমি দিয়ে যাব।

সুনীতি বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে। ভাদুড়ি মশায় ডাকলেন, শোনো।

দরজার কাছে থমকে দাঁড়াল সুনীতি। পেছন ফিরে বলল, বলুন।

মৃদু হেসে ভাদুড়ি মশায় বললেন, তখনের ঘটনার জন্য আমি কিছু মনে করিনি মা। তুমি এসো। এখানে বোসো। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

সুনীতি বসল না। কিন্তু ওখানে দাড়িয়েই কিছুক্ষণ পর কান্নাভেজা গলায় চাপা স্বরে বলে উঠল, আমাকে মাপ করবেন বাবা। আপনি যে সাত্ত্বিক মানুষ আমি বুঝতে পারিনি। আপনাকে নোংরা হাতে ছুঁয়েছি। আমার নরকবাস হবে।

উঠে দাঁড়িয়ে সুনীতির দিকে এগিয়ে গেলেন ভাদুড়ি মশায়। মাথায় হাত রেখে বললেন, মা গো, তুমি মলিন হাতে স্পর্শ করলেও সে মালিন্য আমায় ছুঁতে পারেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা কী জানো মা? যেটুকু খাদ ছিল, তোমার এই অনুশোচনার আগুনে পুড়ে তা ইতিমধ্যেই খাঁটি সোনা হয়েছে। আর কেঁদো না। কিন্তু তুমি কী করে বুঝলে বলো তো আমি সাত্ত্বিক মানুষ?

এই স্নেহবাক্যে ফুঁপিয়ে উঠল সুনীতি। বলল, আপনার কথা শুনে বাবা। আমার দাদুও আপনার মতোই ছিলেন।

ছিলেন বলছ কেন?

এক বার বাইরের দিকে দেখল সুনীতি। তার পর এগিয়ে গিয়ে সশব্দে বন্ধ করে দিল ঘরের দরজা জানালা। বাইরে পাহারাদার দু’জন একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের ঠোঁটে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি।

সুনীতির এই আচরণে চমকে গেলেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, সব বন্ধ করে দিলে কেন?

সুনীতি বলল, এ ছাড়া আপনার সাথে কথা বলার উপায় নেই বাবা। এরা নরকের জীব। নোংরা জিনিস ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। দরজা খোলা রেখে বেশিক্ষণ আপনার সাথে কথা বললেই সন্দেহ করত। দরজা বন্ধ করলে আর সন্দেহ করবে না। আমায় মাপ করবেন। ওদের চোখে আপনি খারাপ হলেন।

ওরা কী ভাবল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তুমি বলো মা। গম্ভীর গলায় বললেন ভাদুড়ি মশায়।

হাতের চেটো দিয়ে চোখের জল মুছে সুনীতি বলল, আমার উপায় নেই তাই আমি এখানে পড়ে আছি বাবা। শয়নে স্বপনে আমি শুধু একটা কথাই ভাবি, কী করে সুখবিলাসের ক্ষতি করা যায়। সুখবিলাস আমার দাদুকে খুন করেছে।

সে কী? আঁতকে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়।

সুনীতি বলল, হ্যাঁ বাবা। আমার দাদু ছিলেন মহাতান্ত্রিক। আমার মা বাবা নেই। দাদুর কাছেই মানুষ। দাদুই আমার বিয়ে দেন। আমায় কাছছাড়া করতে চাননি বলে আমি আর আমার বর দাদুর কাছেই থাকতাম। সুখবিলাস দাদুর শিষ্য হয় এবং সবটা শেখার পর দাদুকে খুন করে। অনেক দিন থেকেই আমার ওপর ওর কু’নজর ছিল। বর আর ছেলে সমেত ও আমায় এখানে নিয়ে চলে আসে। আমার বর ওর কাছেই কাজ করে আর আমার বাচ্চাকে ও বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। নাটক করে আমাকে সাধনসঙ্গিনী বলে। আসলে আমি ওর…, কথাটা শেষ করল না সুনীতি। তার পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমি দিনের পর দিন মুখ বুজে সব মেনে নিচ্ছি কারণ প্রতিবাদ করলেই ও আমার বর আর ছেলেকে মেরে ফেলবে। আর সত্যি বলতে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায়ও নেই। সুখবিলাস অসম্ভব শক্তিশালী। ওর ক্ষতি করার ক্ষমতা কারও নেই।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। ফের কেঁদে ফেলল সুনীতি। বলল, আপনাকে এ সব কথা কেন বললাম জানি না বাবা। কিন্তু বলতে খুব ইচ্ছে হল। অনেক দিন পর এমন যত্ন নিয়ে কেউ মাথায় হাত রাখল। এ বার আমি যাই বাবা। রান্না চাপাতে হবে। আপনাকে খেতে দেব।

এক মিনিট মা। একটা কথা বলো তো। দ্রুত বলে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়।

কী কথা বাবা?

একটু ভেবে ভাদুড়ি মশায় বললেন, আমি শুনেছি তিন মাস অন্তর ত্রয়োদশীর রাতে জঙ্গলে প্রেতের দল নেমে আসে? এটা কি ঠিক?

একটুও সময় নিল না সুনীতি। বলল, হ্যাঁ বাবা। সব তো দাদুর থেকে পাওয়া শিক্ষা। তিন মাস অন্তর ও ভূতডামর যজ্ঞ করে। পিশাচের দল উঠে আসে পাতাল থেকে। তারা ওর বশ। ও যা বলে তারা তাই শোনে। ওই পিশাচদের দিয়েই তো জঙ্গলটা উজাড় করে দিল। কবে যে এই অনাচার শেষ হবে কে জানে! দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুনীতি।

একটু চুপ করে থেকে ভাদুড়ি মশায় বললেন, আমার যা জানার জানা হয়ে গেছে মা। একটা জিনিস কি তুমি আমায় জোগাড় করে দিতে পারবে?

কী বাবা?

এ জঙ্গলে তো গাউর পাওয়া যায়। মানে সাদা বাংলায় যাকে বাইসন বলে। তুমি আমাকে একগুছি বাইসনের লোম জোগাড় করে দিতে পারবে?

ভারী অবাক হল সুনীতি। বলল, সে পারব বাবা। কিন্তু বাইসনের লোম দিয়ে আপনি কী করবেন?

মৃদু হাসলেন ভাদুড়ি মশায়, বিপদ যখন খুব বেশি করে ঘনিয়ে ওঠে তার মধ্যেই উঁকি দেন বিপত্তারণ। তাঁকে চিনে নিতে হয়। বাইসনের লোম দিয়ে তোমার সমস্যা প্রতিকারের চেষ্টা করব মা। আর চেষ্টা করব যাতে এ জঙ্গল উজাড় হওয়া থেকে বাঁচানো যায়।

সুনীতির মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে। এই মানুষটাকে সে মনে মনে বড় উঁচু জায়গায় বসিয়েছে কিন্তু মানুষটা এত জোরের সাথে এ সব কথা বলছে কেমন করে? সুখবিলাস যে ভয়ানক! এ মানুষটা কি সুখবিলাসের ক্ষমতা আঁচ করতে পারছে না? না কি এ মানুষটা সত্যিই সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে? বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে হাঁ করে ভাদুড়ি মশায়ের দিকে তাকিয়ে রইল সুনীতি।

ভাদুড়ি মশায়ের সে দিকে চোখ নেই। মনে মনে তিনি একটা অন্য অঙ্ক কষতে শুরু করেছেন। একটা গভীর বিশ্বাস, প্রাচীনতম অরণ্যের গোপনতম এক প্রবাদের কথা ভাবছেন তিনি। কিন্তু তিনি সংশয়াকুল। এই তন্ত্র আগে কখনও প্রয়োগ করেননি। কে কবে প্রবাদের সত্যতা যাচাই করে? কিন্তু এ বার সেটাই করতে হবে। অরণ্যের এই প্রাচীন প্রবাদ যদি সত্য হয় তবেই ঘটবে রোগমুক্তি। আরোগ্য।

ধুপধাপ শব্দে ভাদুড়ি মশায়ের ঘুম ভাঙল। সকাল হয়েছে। বাইরে এসে দেখলেন, লরিতে কাঠ বোঝাই করা হচ্ছে আর সেটার তদারক করছে সুখবিলাস। ভাদুড়ি মশায়কে দেখে সুখবিলাস দূর থেকে হাত জোড় করল। গলা উঁচু করে বলল, আজ ত্রয়োদশী। ত্রয়োদশীর দিন আমি একটা করে পুরনো গাছ কাটি মাস্টারজী। গুঁড়িটা বেচে দিই আর নরম ডালগুলো দিয়ে যজ্ঞ করি।

বিবমিষায় মুখটা বিকৃত হয়ে গেল গেল ভাদুড়ি মশায়ের। তবু নিজেকে সংযত করে তিনি বললেন, কীসের যজ্ঞ?

হাসতে হাসতে এগিয়ে এল সুখবিলাস। বলল, আমি পোচিংয়ের নতুন কায়দা শুরু করেছি মাস্টারজী। এতে কোনও লোক লাগে না, কিচ্ছু লাগে না। মাঝখান থেকে আরামসে আমার কাজ হয়ে যাচ্ছে। এটা একটা গোপন ব্যাপার আছে। আজ রাতে যজ্ঞ হবে। আপনি কিন্তু ঘর থেকে বেরবেন না।

বোকা সাজলেন ভাদুড়ি মশায়, লোকজন ছাড়া পোচিং কী ভাবে সম্ভব আর কী এমন যজ্ঞ যাতে বাইরে বেরনো যাবে না?

সরু চোখে কিছুক্ষণ ভাদুড়ি মশায়ের দিকে তাকিয়ে রইল সুখবিলাস। তার পর বলল, ভেতরের খবর বার করতে চাইছেন? কিন্তু কোনও লাভ হবে না। আপনাকে সব বলে দিলেও কেউ আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। শুনুন মাস্টারজী, আমি তন্ত্রসাধনা করি। আমি এমন অনেক কিছু করতে পারি যা আপনার গভমেন্ট অফিসারেরা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। ওরা অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে আটকানোর কিন্তু ওরা আমার চাকরবাকরেরও অধম। আমার যা শক্তি আছে সবকটাকে টিপে মেরে ফেলতে পারতাম কিন্তু আমি মানুষ মারতে চাই না। দু’চার মাস থাকতে থাকতে অফিসারেরা বুঝে যায় আমার সাথে লেগে লাভ নেই তাই ট্রান্সফার নিয়ে চলে যায়। আপনার বন্ধুও যাবে। তবে ওনার তেজ একটু বেশি তো, এমন বাণ মারব যে কেন্নোর মতো বুকে হেঁটে এসে আমার পায়ে ধরবে। আমি যে সে কেউ নই মাস্টারজী। আমি পিশাচসিদ্ধ, মহাতান্ত্রিক।

ভাদুড়ি মশায়ের ইচ্ছে হল চড় মেরে লোকটাকে মাটিতে ফেলে দেন তার পর ওকে দেখিয়ে দেন মহাতান্ত্রিক কাকে বলে। এমন ইতর প্রকৃতির মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলেন তিনি। এই মুহূর্তে কিছু করলে সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান হবে না। তার জন্য রাত অবধি অপেক্ষা করতে হবে। ভাদুড়ি মশায়কে চুপ করে থাকতে দেখে সুখবিলাস বলল, কী ভাবছেন মাস্টারজী?

মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়। মৃদু গলায় বললেন, কিছু না। দেখুন এ সব তন্ত্রমন্ত্রের তো আমরা কিছু জানি না। যা ভাল বোঝেন করুন। আমি দু’দিনের জন্য ঘুরতে এসেছি। চলে যাব। আমার কী? আমাকে কাল ভোরে পৌঁছে দিলেই হল।

হা হা করে হেসে উঠে সুখবিলাস বলল, ভয় নেই, ভয় নেই। আপনার বন্ধু পাঁয়তারা না কষলে আপনার কিচ্ছু হবে না। কাল ভোর ভোর আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আমার অনেক কাজ। আমি এক সাথে পাঁচটার বেশি গন্ডার মারি না। কারণ শিংগুলো বেচতেও তো সময় লাগে। সবই ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটের খদ্দের। কাল ভোরে আপনাকে গন্ডারের শিং দেখাব। যান আপনি রেস্ট নিন।

এ বার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না ভাদুড়ি মশায়। কঠিন গলায় বলে উঠলেন, যে হারে গন্ডার মারছেন তাতে তো আর কিছু দিন পরে একটাও গন্ডার থাকবে না। তখন কী করবেন? কাদের মেরে ব্যবসা করবেন?

দাঁত বার করে হাসল সুখবিলাস। বলল, ও আমার ভাবাই আছে মাস্টারজী। জলদাপাড়ার গন্ডার শেষ হলে আমি সুন্দরবন যাব। এ দেশে এত জন্তু জানোয়ার আছে যে শেষ করতে অনেক টাইম লাগবে। ওয়ার্ল্ডের এক নম্বর পোচার হব আমি। জলদাপাড়া দিয়ে তো হাত পাকাচ্ছি। আসল খেলা শুরু করব কিছু দিন পর।

বলতে বলতে চলে গেল সুখবিলাস। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। মনটা উসখুস করতে লাগল তাঁর। খালি মনে হতে লাগল, কখন রাত হবে আর এই পাষণ্ডটা শাস্তি পাবে?

সন্ধে হতে না হতেই একে একে সব পাহারাদারদের বিদায় করে দিল সুখবিলাস। উঠোনের মাঝখানে সাজিয়ে ফেলল যজ্ঞবেদী আর রক্তাম্বর পরে বসে পড়ল তার সামনে। সবটাই জানলার ফাঁক দিয়ে দেখছিলেন ভাদুড়ি মশায়। কারণ কিছুক্ষণ আগেই সুখবিলাসের নির্দেশে সুনীতি এসে বাইরে থেকে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। অবশ্য দরজা বন্ধ করার আগে সে ভাদুড়ি মশায়ের হাতে দিয়ে গেছে একগুছি বাইসনের লোম আর খুব নিচু গলায় ভাদুড়ি মশায় তাঁকে বলেছেন, একটা গ্লাসে করে কিছুটা জল রেখে দিতে। যে মুহূর্তে গ্লাসের জলে কাঁপন ধরবে সেই মুহূর্ত থেকে অন্তত একটি ঘণ্টা বাইরে বেরনো যাবে না। কাঁপা গলায় সুনীতি প্রশ্ন করেছিল, কেন বাবা? তখন কী হবে?

মাথা নেড়ে ভাদুড়ি মশায় বলেছেন, সে উত্তর আমি এখন তোমায় দিতে পারব না মা। কারণ আমি নিজেই জানি না, গ্লাসের জল শেষ পর্যন্ত কাঁপবে কি না! যদি কাঁপে তা হলে আমাদের সবার মঙ্গল।

দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যজ্ঞের আগুন। জংলা বাতাসে সেই আগুনের আভা সাপের মতো কিলবিল করতে লাগল সুখবিলাসের শরীর জুড়ে। বড় ভয়ানক দেখাচ্ছে তাকে। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে পড়তে সে এক মুঠো হাড়ের গুঁড়ো ছুঁড়ে দিল আগুনে। এক টানে আলাদা করে ফেলল একটা কালো পায়রার ধড় আর মাথা। সেই রক্ত টপ টপ করে পড়তে লাগল রাক্ষুসে আগুনের মধ্যে। এ পদ্ধতি ভাদুড়ি মশায়ের জানা। নিম্নশ্রেণির তান্ত্রিকদের বড় প্রিয় এই ধরনের কুৎসিত আচার। এতে বিপরীত শক্তি আয়ত্ত হয়। বশ হয় পিশাচ, হাঁকিনি, ডাকিনিদের মতো নিম্নমার্গের অথচ অতি শক্তিশালী প্রজাতিরা। চোয়াল শক্ত করে জানলার ফাঁক দিয়ে সুখবিলাসের কীর্তি দেখতে লাগলেন ভাদুড়ি মশায়। এক সময় তিনি অনুভব করলেন ধীরে ধীরে ভারী হচ্ছে চারপাশের বাতাস। বাতাসে ভাসছে মড়াপচা গন্ধ। ক্রমশ বাতাস এত গুমোট আর দুর্গন্ধময় হয়ে গেল যে শ্বাস নিতেও কষ্ট হতে লাগল। তখনই আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত ছড়িয়ে সুখবিলাস চিৎকার করে উঠল, আয়। আয়। আয়। আয়।

ধীরে ধীরে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল যজ্ঞের আগুন। অথচ তা প্রোজ্জ্বল, দীপ্তিময়। আচমকাই কাঁপতে শুরু করল সেই কালো আগুন এবং আগুনের ফুলকি ছিটকে পড়তে লাগল নানা দিকে। আগুনের ফুলকি মাটিতে স্পর্শ করা মাত্র মাটিতে সৃষ্টি হল গভীর গহ্বর আর তার মধ্যে থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসতে লাগল গলিত লাভার মতো সবজেটে কালো আধা তরল। উচ্চগ্রামে উঠল সুখবিলাসের মন্ত্রোচ্চারণ এবং ক্রমে সেই আধা তরলগুলি শরীর ধারণ করল। কঠিন চোখে ভাদুড়ি মশায় দেখলেন তাদের অবয়ব মানুষের মতোই কিন্তু প্রত্যেকের চারটি করে হাত এবং চারটি করে পা। বীভৎস ঘৃণ্য মুখে একটি মাত্র বিশাল চোখ আর তার ঠিক নীচ থেকে শুরু হয়েছে চোয়াল। তাতে হাঙরের মতো দাঁত। প্রত্যেকের বুকে ক্যাঙ্গারুর মতো থলি। ভাদুড়ি মশায় জানেন, চলতি কথায় এদের বলে মাকড়খাকি। অত্যন্ত হীন এবং ক্ষতিকারক প্রেত এরা। এতক্ষণে ভাদুড়ি মশায় বুঝতে পারলেন কেন মৃত গন্ডারগুলোর কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না।

সুখবিলাসের নির্দেশে প্রেতের দল অদ্ভুত হাড়হিম করা শব্দ করতে করতে আট হাত-পায়ে দ্রুত মিলিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে। এ ঘটনার সাক্ষী রইল ত্রয়োদশীর অসহায় চাঁদ।

যা দেখার দেখা হয়ে গেছে। ভাদুড়ি মশায় জলের ঘটি তুলে নিলেন। তার পর মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে জল ছিটিয়ে দিলেন ঘরের মেঝেয়। খুলে ফেললেন পরিধেয় সমস্ত বস্ত্র। বাসি কাপড়ে পুজো হবে না। ঘটির বাকি জল ঢেলে দিলেন নিজের মাথায়। তার পর নিরাবরণ দেহে ঋজু সন্ন্যাসীর মতো বজ্রাসনে বসলেন ঘরের মেঝেতে। টেবিলের ড্রয়ার থেকে বার করে আনলেন আগেই জোগাড় করা তিনটে পাতা সমেত একটি গাছের ডাল এবং বাইসনের লোম। ভাগ্যিস তাঁর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ কারণ এর পর তিনি যে ছড়াটা পড়বেন সেটা বহু বছর আগে তাঁকে বলেছিল মাধাই মুর্মু। এত বছরে এই ছড়া মনে করার দরকার পড়েনি। বাইসনের লোমগুলি মেঝেতে ছড়িয়ে গাছের পাতা দিয়ে হাওয়া করতে শুরু করলেন তিনি আর বিড়বিড় করে আওড়াতে শুরু করলেন লোকজ ছড়াটি। যা আসলে আদিমতম অরণ্যের প্রাচীনতম এক প্রবাদ। প্রগাঢ় বিশ্বাসে তিনি আওড়ে যেতে লাগলেন পঙক্তিগুলি। তাঁর বিশ্বাস অলৌকিক হবে। গুরু বলতেন, বিশ্বাসে পাহাড় টলে। এ ছড়া বলবার বিশেষ সুর আছে। সেও শিখিয়েছিল মাধাই মুর্মু। মানভূমের এক সাতবুড়ো রাখাল। সেই বিশেষ সুরে ভাদুড়ি মশায়ের নিজের কানেই যেন ঘোর লাগল।

একটু চোখ লেগে এসেছিল সুনীতির। একটা পেঁচার ডাকে সচেতন হতেই প্রথমে তার চোখ গেল টেবিলের ওপর রাখা জলের গ্লাসটার দিকে আর সে অবাক হয়ে দেখল, গ্লাসের জল কাঁপছে। কয়েক মুহূর্ত পর পর নির্দিষ্ট ছন্দে কেঁপে উঠছে গ্লাসের জল। যেন কারও পায়ের চাপে মাটিতে কাঁপন ধরছে। সুনীতির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল, এ কম্পন এমনি না, বিশাল পাহাড়ের মতো কিছু একটা এগিয়ে আসছে এ দিকেই।

এক লাথি মেরে একটা চেয়ার উল্টে দিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার পর টেবিল থেকে তুলে নিলেন লোডেড রিভলবারটা। শব্দ পেয়ে ছুটে এল চরণদাস। দরজায় দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, কী হয়েছে সাহেব?

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, আমি বেরোচ্ছি। তুমি দোর দিয়ে দাও।

হাঁ হয়ে গেল চরণদাস। এই নতুন অফিসারের মাথা কি একেবারে খারাপ? এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে আর এখন উনি বেরবেন! তার ওপর আজ ত্রয়োদশী। এ রাতে জঙ্গলে যাওয়া মানে তো… আর ভাবতে পারল না চরণদাস। মৃদু গলাতেই প্রতিবাদ করে উঠল, কী বলছেন সাহেব? এত রাতে বেরিয়ে কোথায় যাবেন?

রক্তচক্ষুতে তার দিকে তাকালেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বললেন, যেখানেই যাই, তোমার বাপের কী? বেশি কথা না বলে যা বললাম করো।

বুটের শব্দ তুলে বাংলোর গেট খুলে বেরিয়ে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। গেট ধরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চরণদাস। একে সাহেবের বন্ধুকে সুখবিলাসের লোকেরা তুলে নিয়ে গেছে, তার ওপর এই রাতে সাহেবও বেরিয়ে গেলেন! অমঙ্গলের আশঙ্কায় কাঁপন ধরল চরণদাসের পায়ে। এই মানুষ দু’টোকে তার বেশ ভাল লেগেছিল।

দ্রুত হাঁটছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। যদিও তাঁর বাঁ হাতে একটা টর্চ আছে কিন্তু সেটা তিনি জ্বালাচ্ছেন না। বহু বছর জঙ্গলে চাকরি করছেন। রাতের অন্ধকারেও জঙ্গলে পথ চলতে তাঁর অসুবিধে হয় না। তা ছাড়া আকাশে আজ চাঁদও আছে। ত্রয়োদশীর চাঁদ। মুখটা বিকৃত করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে একটা গালাগাল দিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। হতভাগা সুখবিলাস তাঁর দুর্বল জায়গায় আঘাত হেনে তাঁকে থেমে যেতে বাধ্য করল। তবে সুখবিলাসের কথা শুনে তিনি চুপ করে বসে থাকেননি। সুখবিলাসের খোঁজ করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একটা সূত্রও পেয়েছেন। ভালয় ভালয় নীরেন শুধু ফিরে আসুক তার পর তিনি এই সুখবিলাসের খবর নেবেন। চোরাশিকার করা জন্মের শোধ ঘুচিয়ে দেবেন। একটা শেকড়ে সামান্য হোঁচট খেয়ে তাঁর চিন্তার জালটা ছিঁড়ে গেল। চারপাশে তাকিয়ে বুঝলেন, কোর এরিয়ার কাছাকাছি চলে এসেছেন। শক্ত করে রিভলবারটা চেপে ধরলেন। কোনও বন্য জন্তুর উপস্থিতি টের পেলে আত্মরক্ষায় কাজে লাগবে।

এতটা পথ চলে এসেছেন তবু কোনও ফরেস্ট গার্ড দেখতে পাননি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। রাগে তাঁর কপালের রগ দু’টি দপদপ করতে লাগল। এদের অপদার্থতা প্রত্যক্ষ করতেই এত রাতে এতখানি ঝুঁকি নিয়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। কোর এরিয়ায় ঢুকে তিনি দেখতে চান কোন ভূত গন্ডার শিকার করে! তিনি ভেবেই রেখেছেন, যদি এমন কিছু দেখতে পান তা হলে সেই ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ করবেন তৎক্ষণাৎ। গুলি চালাতে তাঁর এতটুকু হাত কাঁপবে না। সত্যি সত্যি তিনি জানতে চান, কী রহস্য লুকিয়ে আছে এই ত্রয়োদশীর রাতে।

বেশ জোরেই পা চালাচ্ছিলেন তিনি, আচমকা একটা শব্দ পেয়ে থমকে গেলেন। একটু ঠাহর করতেই দেখলেন, ডান দিকে একটু দূরেই একটা অগভীর জলাশয়। জলাশয়ের ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চ্যাটালো পাথর। এ জলাশয় প্রাকৃতিক নয়। বনদপ্তর থেকেই জঙ্গলের ভেতর এমন কিছু জলাশয় খোঁড়া হয় আর চ্যাটালো পাথরগুলোয় নুন ঢেলে রাখা হয়। বন্য জন্তুরা এখানে জল খেতে আর নুন চাটতে আসে। এ সব জায়গায় জঙ্গল তুলনামূলক পাতলা। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। শব্দের উৎস সন্ধানে এ দিক, ও দিক তাকাতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখলেন, জঙ্গল থেকে দু’টি গন্ডার বেরিয়ে এল। একটি পুরুষ, একটি মাদি। কান নাড়াতে নাড়াতে দু’টিতে এগিয়ে চলল জলাশয়ের দিকে। যদিও গন্ডার মূলত একাই ঘুরে বেড়ায়, তবে এ দু’টি মনে হচ্ছে জোড়া। সদ্যই প্রেম হয়েছে এদের। এই নব্য যুগলটির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। মানুষ এদের মেরে ফেলে ভেবেই তাঁর কান গরম হয়ে উঠল। মানুষ হিসেবে যারপরনাই লজ্জা পেলেন তিনি এবং ফের সিদ্ধান্ত নিলেন, এই জঙ্গল থেকে চোরাশিকার বন্ধ না করে তিনি শান্তিতে শ্বাস নেবেন না। ওরা যাতে বিরক্ত না হয় তাই একটা গাছের আড়ালে সরে এলেন তিনি। ওই তো মুখ ডুবিয়ে জল খাচ্ছে দু’জন। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট পুরুষটির দীর্ঘ শৃঙ্গ। বড় সুন্দর দৃশ্য। আচমকাই তাল কেটে গেল একটা কানে তালা ধরিয়ে দেওয়া শব্দে। শব্দটা জোরে নয়। অনেকটা মশার ডানার বিনবিনানির মতো। কিন্তু বড্ড তীক্ষ্ন। মাথার মধ্যে গিয়ে আঘাত করে। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার আগেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যা দেখলেন তাতে তাঁর সমস্ত সত্তা অন্তর থেকে কেঁপে উঠল আতঙ্কে। এমন হাড় হিম করা ভয়াবহ দৃশ্য তিনি কখনও দেখবেন বলে কল্পনা করেননি। তিনি দেখলেন, আচমকাই জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ছ’টা অদ্ভুত জীব। তাদের অবয়ব মানুষের মতোই কিন্তু তারা নিঃসন্দেহে মানুষ নয়। মানুষ কখনও এমন ভয়াবহ দেখতে হতে পারে না। মানুষের আট খানা হাত-পা থাকে না। তারা বেরিয়ে আসতেই গন্ডার দু’টি চমকে গেল কিন্তু চোখের পলক ফেলার আগেই তারা তিন জনের দু’টি দলে ভাগ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল গন্ডার যুগলের ওপর। এক দল মেয়ে গন্ডারটাকে ঘিরে রইল আর এক দল বিশাল বিশাল কামড়ে মাংস তুলে নিতে শুরু করল পুরুষ গন্ডারটির দেহ থেকে। একটি জীব নিপুণ কামড়ে কেটে নিল তার খড়্গ এবং রেখে দিল পেটের থলিতে। গন্ডারটির আর্তনাদে করুণ হয়ে উঠল জঙ্গলের বাতাস। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তার মধ্যেই অদ্ভুত সেই ভয়াবহ জীবগুলি সমগ্র গন্ডারটিকে খেয়ে ফেলল। একটা হাড় তো দূর, দীর্ঘ খসখসে জিভ বার করে তারা মাটিতে পড়ে থাকা রক্তবিন্দুগুলিও চেটে নিল। জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের বুক থেকে স্রেফ গায়েব হয়ে গেল একটি গন্ডার!

টলে পড়ে যেতে যেতে একটা গাছের গায়ে ভর দিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এই মাত্র তিনি যা দেখলেন তা অবিশ্বাস্য। কিন্তু নিজের চোখকে অবিশ্বাসই বা করবেন কেমন করে? তা হলে চরণদাসের কথা ঠিক? এই ভাবে প্রেতের দল নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে জলদাপাড়া? এই অতিলৌকিক শক্তির সাথে কী ভাবে লড়বেন তিনি? তিনি বুঝতে পারছেন, কেন গন্ডারদের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না… চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। তাঁর মাথার ভিতরটা কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে গেল। কুৎসিত কদাকার জীবগুলি ততক্ষণে দ্বিতীয় গন্ডারটির দিকে নজর দিয়েছে। গন্ডারটি চিৎকার করছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বুঝতে পারছেন, গন্ডারটি কাঁদছে। প্রিয়তমের মৃত্যু দেখে কাঁদছে, মৃত্যুভয়ে কাঁদছে। এই কান্না আগুন জ্বালিয়ে দিল তাঁর শিরায় শিরায়। প্রেত হোক, পিশাচ হোক কিচ্ছু এসে যায় না। এই মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবেন তিনি। ভাবা মাত্রই তিরের মতো ছিটকে বেরিয়ে এলেন গাছের আড়াল থেকে আর একদম সামনে থাকা কদাকার জীবটিকে লক্ষ্য করে বন্দুক চালিয়ে দিলেন। বন্দুকে ছ’টা গুলি আছে। দেরি করলেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তাঁর লক্ষ্য অব্যর্থ। গুলির শব্দের সাথে সাথে তীব্র আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল ছ’টি পিশাচ। আকস্মিক মুক্তি পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল গন্ডারটি। তার পরেই ছুটে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে। প্রাচীন এই অভয়ারণ্যের মাঝে জলাশয়ের ধারে ত্রয়োদশীর চাঁদের নীচে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন একা এবং তাঁর সামনে মাটিতে পড়ে আছে ছ’টি অদ্ভুত দর্শন জীব। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হাঁফাচ্ছেন। রিভলবারের একটা একটা গুলিতেই যে এই আটহাতি জন্তুগুলো এমন নির্জীব হয়ে যেতে পারে তা ঠিক তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না।

কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। নিঃসীম নিস্তব্ধতা যেন গ্রাস করতে আসছে। ঠিক তখনই এক টুকরো মেঘ এসে চাঁদকে আড়াল করল আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন তাঁর ধারণাই ঠিক। ধীরে ধীরে নড়তে লাগল জন্তুগুলো আর এক সময় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আকাশের দিকে মুখ করে তীব্র সেই শব্দে কাঁপিয়ে দিল দিগ্বিদিক। ঘোলাটে হিংস্র বিশাল এক চোখে তারা তাকাল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দিকে। প্রতিহিংসায় ধকধক করছে মৃত্যুহিম সেই দৃষ্টি। ভয় পেলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। অনেক দিন পরে আবার টের পেলেন, মৃত্যুভয় জাঁকিয়ে বসছে মজ্জায় মজ্জায়। নিশ্চিত মৃত্যুর মতো বীভৎস মাকড়খাকি পিশাচের দল এগিয়ে আসতে লাগল। হাত থেকে বন্দুকটা ফেলে দিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তবে তিনি এমনি এমনি মরবেন না। মরতে হলে লড়াই করে মরবেন। এই মুহূর্তে তিনি উত্তেজিত। একটা গন্ডারকে বাঁচিয়েছেন এই পিশাচদের হাত থেকে। মাটি থেকে একটা শুকনো মজবুত ডাল তুলে নিলেন তিনি।

মৃত্যুর খুব মুখোমুখি হলে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পায়। নয়তো জ্যোতিরিন্দ্রনাথ গাছের ডাল নিয়ে মাকড়খাকিদের সাথে লড়াই করার কথা ভাবতেন না। একটা গোটা গন্ডারকে নিশ্চিহ্ন করতে যাদের কয়েক সেকেন্ড লাগে তাদের সাথে লড়াই করার সাধ্যি আর যারই থাক কোনও মানুষের নেই।

গাছের ডাল বাগিয়ে ধরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চিৎকার করতে লাগলেন, আয়। আয় দেখি তোদের কত ক্ষমতা।

সামান্য মানুষের এই স্পর্ধা সহ্য হল না নরকের কীটদের। বিকট শব্দ করে একটা মাকড়খাকি ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ওপর কিন্তু তাঁকে স্পর্শ করার আগেই প্রবল এক আঘাতে সেটি ছিটকে পড়ল দশ হাত দূরে। কানে তালা ধরানো শব্দে কাতরে উঠল। বাকিগুলোও চমকে উঠল এই অতর্কিত আক্রমণে। ঘোর কাটিয়ে ঘুরে তাকালেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর তাকাতেই দেখলেন, বিশাল এক বর্শা এসে সোজা গেঁথে গেল একটা পিশাচের বুকে। শিউরে উঠলেন তিনি। চাঁদের আলোয় যা দেখলেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। আজ পরপর এ সব কী দেখছেন? এমনিতেই এতক্ষণ এই আটহাতি প্রেতের দলকে দেখে, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে দুলতে তিনি মানসিক ভাবে ক্লান্ত। তার ওপর এখন যা দেখছেন তা আরও অবিশ্বাস্য। ভীতি উদ্রেককারী। আর ভয় তিনি একা পাননি, ভয় পেয়েছে কদাকার জীবগুলোও। বিজাতীয় শব্দ করে তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না তারা, জঙ্গলের মধ্যে থেকে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল চলমান পাহাড়টি। তার বিশাল কাঁধে ঢাকা পড়ে গেল ত্রয়োদশীর চাঁদ। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এতক্ষণ যা পাহাড় মনে হচ্ছিল, এই তুলনামূলক ফাঁকা জায়গায় তার অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চোখে। এক প্রবল পুরুষ! ধূসর কালো গাত্রবর্ণ। জঙ্গলের সবচেয়ে উঁচু বৃক্ষটির থেকেও মাথায় খানিক উঁচু! দশটা বিশাল বট গাছকে একত্র করলেও বুঝি তার বুকের ছাতির বেড় পাবে না। বিশাল দুই পাঞ্জার একটিতে ধরা ভীমাকায় এক বর্শা, অন্যটিতে গদার মতো করে ধরা একটি পূর্ণাঙ্গ শুকনো গাছ। পরনে মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি। পায়ের গোছে ও কবজিতে ধাতুর মাকড়ি। হাতে ও গলায় পাথরের মালা। সবটাই মানুষের মতো, শুধু এই প্রচণ্ড পুরুষের মাথাটা মোষের। বিশাল বাঁকানো দুই শিঙে ঝিকিয়ে উঠছে চাঁদের আলো। ক্রোধে দপদপ করে জ্বলছে ক্ষুদ্র মণি দু’টি। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখলেন, পালানোর সময় পেল না কদাকার পিশাচগুলো। দু’টো তো আগেই মাটি নিয়েছিল, এ বার প্রবল গর্জন করে সেই মহিষমানব তার বিশাল পা চাপিয়ে দিল বাকিদের ওপর। মানুষের পায়ের তলায় যেমন করে পোকার মৃত্যু ঘটে ঠিক সে ভাবে জঙ্গলের মাটিতে দলা পাকিয়ে গেল তাদের শরীর আর কয়েক মুহূর্ত পর মিলিয়ে গেল চিরতরে।

চাঁদের দিকে মুখ তুলে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল মহাকায় এই বিস্ময়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল জঙ্গলের ভিতর আর কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না। তার পর এগিয়ে চলল জলাভূমির দিকে এবং ধীরে ধীরে তার আকার ছোট হতে লাগল। অবাক হয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখলেন, জলাশয়ের এক প্রান্তে জড়ো হয়েছে পালে পালে বাইসন। তারা শব্দ করছে না। শুধু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এতগুলো বাইসন এখানে এসেছে অথচ কোনও শব্দ পাওয়া যায়নি! আর অবাক হলেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। আজ একের পর এক যা ঘটছে, তিনি অবাক হতেও ভুলে গেছেন। পাহাড়প্রমাণ সেই মহিষমানবের আকার ক্রমে ছোট হয়ে এল। এখন তার আকার সাধারণ মানুষের মতোই। শুধু তার শারীরিক গঠন যে কোনও ব্যয়ামবীরকে লজ্জায় ফেলে দেওয়ার মতো। চেহারার সাথে সাথে ছোট হয়েছে বর্শার আকার। পূর্ণাঙ্গ শুকনো গাছটি হয়েছে মোটা এক লাঠি। সে এগিয়ে গেল বাইসনের পালের দিকে। দলের মধ্যে থেকে সবচেয়ে বড় বাইসনটি এসে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। অবলীলায় তার পিঠে উঠে পড়ল মহিষমানব। তাকে নিয়ে নিঃশব্দে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল বাইসনের দল। এতগুলো বাইসন, অথচ কোনও শব্দ হল না!

চোখের সামনে কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝলেন না জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, তবে তাঁর মন বলতে লাগল, আর ভয় নেই। জঙ্গল এবং বন্যপ্রাণীরা এখন বিপন্মুক্ত। ওই মহিষমানব যেন তার সাথে করে সব ভয় নিয়ে চলে গেছে। অজান্তেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ওই মহাকায় পুরুষের উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকালেন।

ফরেস্ট বাংলোর ঘরে ভাদুড়ি মশায়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। ভোর হতে না হতেই সুনীতিকে নিয়ে ভাদুড়ি মশায় ফরেস্ট বাংলোতে ফিরে এসেছিলেন। সুনীতি রাস্তা চিনত। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল। পথনির্দেশ শুনে লোকজন নিয়ে সুখবিলাসের ডেরায় ছুটে গেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেছিল এক অদ্ভুত দৃশ্য। সবই ঠিক আছে শুধু সুখবিলাসকে মেরে কেউ তার দেহটা সবচেয়ে উঁচু গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে রেখে দিয়েছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা বলাবলি করছিল, অত উঁচুতে দেহটা গেল কী করে? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিন্তু অবাক হননি। ওই উঁচু ডালে যে অবলীলায় হাত পেতে পারে তাকে গতকাল রাতেই দেখেছেন তিনি। সব কাজ মিটিয়ে, বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়েই বাংলোতে ছুটে এসেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। কাল যা দেখেছেন নীরেনকে বলতেই হবে। মুখোমুখি বসে সে কথাই সবে বলতে শুরু করেছিলেন তিনি, তখনই ভাদুড়ি মশায় বলেছেন, আমি সব জানি, আর তাতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হাঁ হয়ে গেছেন। ভাদুড়ি মশায় ওই মহিষ মানবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে দিয়েছেন। একটু ধাতস্থ হয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, তুই এতসব কী করে জানলি নীরেন? কাল যখন ওই মহিষমানবকে সুখবিলাসকে মারছিল তুই কি দেখেছিলি?

মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়, উঁহু। উনি যখন আসেন তখন ঘরের বাইরে বেরনোর নিয়ম নেই। নেহাত তুই জঙ্গলের মধ্যে ছিলি তাই দেখতে পেয়েছিস।

চমকে উঠলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, উনি?

মৃদু হাসলেন ভাদুড়ি মশায়, উনি কে বল তো?

কে?, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চোখে প্রবল বিস্ময়।

উনি হলেন অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ।

মানে?

প্রবাদ বলে, জঙ্গল এবং বন্য প্রাণীরা যখন বিপদে পড়ে তখন তাদের উদ্ধার করতে আসেন জঙ্গলের রক্ষক, বুনো মহিষের দেবতা, টাঁড়বারো।

টাঁড়বারো? এ নামটা তো…

‘আরণ্যক’-এ পড়েছিস।

ঠিক ঠিক।

আমিও ওখানেই প্রথম পড়ি টাঁড়বারোর কথা। ভারী কৌতূহল হয়েছিল আমার। কিন্তু আমি কোথাও খুঁজে পাইনি এই দেবতার ব্যাপারে। অনেক পরে মানভূমের এক সাতবুড়ো রাখাল মাধাই মুর্মু আমায় বলে টাঁড়বারো আছেন এবং তাঁকে ঠিক করে ডাকতে পারলে তিনি আসেন। যে মুহূর্তে আমি বুঝতে পেরেছিলাম সুখবিলাসের প্রেত নামানোর ব্যাপারটা সত্যি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম টাঁড়বারোকে আহ্বান করব। আর চিন্তা নেই জ্যোতি, এ বার আর কেউ অলৌকিকের সাহায্যে চোরাশিকার করতে পারবে না।

একটু চুপ করে থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, তুই আহ্বান করেছিলি টাঁড়বারোকে?

হ্যাঁ।

কিন্তু কী ভাবে?

ওই যে বললাম, প্রবাদ আছে। অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। ‘চিরল চিরল তিনটি পাত/মোষের ঘাড়ের লোম/কারোর কাছে দ্যাবতা হুই/কারও কাছে যম/আজব ছড়ার আজব সুর ধইরতে যদি পারো/বিপদ মিটায় দিবে তোমার রাজা টাঁড়বারো…’, ভাদুড়ি মশায় শুধু ছড়াটি আওড়াচ্ছেন। সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন বিশেষ সুরটি। কারণ তিনি প্রমাণ পেয়েছেন, বিশেষ সুরে আজব ছড়াটি পড়তে পারলেই প্রবাদ সত্যি হয়। আবির্ভূত হন রাজা টাঁড়বারো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *