অরক্ষণীয়া – ০৩

তিন

ছোটভাই অনাথনাথকে বাধ্য হইয়া প্রাঙ্গণের প্রাচীরে একটা দ্বার ফুটাইতে হইল। অগ্রজের শ্রাদ্ধ-শান্তি হইয়া গেলে পনর-ষোল দিন পরে একদিন তিনি অফিসে যাইবার মুখে চৌকাঠের উপর দাঁড়াইয়া পান চিবাইতে চিবাইতে বলিলেন, আর না বললে ত নয় বোঠান, বুঝতে ত সবই পার—খেতে তোমাকে একবেলা একমুঠো দিতে আমি কাতর নই—তা দাদা আমার সঙ্গে যতই কেন না কুব্যবহার করে যান। কিন্তু এতবড় মেয়ের বিয়ের ভার ত আমি আর সত্যি সত্যি নিতে পারিনে। শুনতেই আমার দেড়-শ টাকা মাইনে, কিন্তু কাচ্চা-বাচ্চা ত কম নয়? তা ছাড়া আমার নিজের মেয়েটাও বার বছরে পড়ল, দেখতে পাচ্চ ত। তাই, আমি বলি কি, মেয়ে নিয়ে এ সময়ে তোমার একবার হরিপালে যাওয়া উচিত।

দুর্গামণি রান্নাঘরের একটা খুঁটি আশ্রয় করিয়া কোনমতে দাঁড়াইয়া ছিলেন; সভয়ে সসঙ্কোচে কহিলেন, দাদার অবস্থা তুমি ত জান ঠাকুরপো। কিচ্ছু নেই তাঁর। এতবড় বিপদের কথা শুনে একবার দেখা পর্যন্ত দিতে এলেন না। তা ছাড়া, না নিয়ে গেলেই বা যাই কি করে?

বড়বৌ স্বর্ণমঞ্জরী দেবরের পার্শ্বে প্রাচীরের আড়ালেই দাঁড়াইয়া ছিলেন, একটুখানি গলা বাড়াইয়া কহিলেন, দাদার অবস্থা ভাল নয় জানি, কিন্তু তোমার দেওরটিই কোন্‌ লাটসাহেব মেজবৌ? আর ঐ শুনতেই দেড়-শ! কিন্তু যা করে আমি সংসার চালাই, তা আমি ত জানি! আর তাও বলি—অত বড় ধুম্‌সো মেয়ে তোমার ঘাড়ে––কে তোমাকে যেচে ঠাঁই দিতে যাবে বল দিকি? কিন্তু তা বলে মান-অভিমান করে বসে থাকলে ত চলে না!

দুর্গামণি ধীরে ধীরে বলিলেন, না দিদি, আমার আবার মান-অভিমান কি!

স্বর্ণ দেওরকে বাঁ হাত দিয়া পিছনে ঠেলিয়া, নিজে অগ্রসর হইয়া আসিয়া কহিলেন, তোমাকে মন্দ কথা ত আমি বলিনি মেজবৌ, যে অমন করে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলি বললে? তা, রাগই কর, আর ঝালই কর বাপু––তোমার ঐ ডানাকাটা পরীর বিয়ে দিতে আমরা পারব না| মেয়ে ত ঐ ছোটবৌটাও পেটে ধরেচে। কেউ একবার বাছাদের মুখপানে চেয়ে দেখলে আবার নাকি সে চোখ ফিরিয়ে চলে যাবে! তা সত্যি কথা বলব মেজবৌ––যেমন তোমার মেয়ের ছিরি, তেমনি গিয়ে হরিপালে পোড়ে-হোড়ে থেকে যা-হোক একটা চাষা-ভূষো ধরে দাও গে––ন্যাটা চুকে যাক। শুনেচি নাকি––সেখানকার লোক সুচ্ছিরি-কুচ্ছিরি দেখে না––মেয়ে হলেই হ’ল।

দুর্গামণি চুপ করিয়া রহিলেন। যে বিষের জ্বালায় একদিন তাঁহারা পৃথক হইয়াছিলেন, সেই বিষদন্ত পুনরায় উদ্যত দেখিয়া তিনি ভয়ে কাঠ হইয়া গেলেন। স্বর্ণ কহিলেন, যার যেমন! তোমাকে কেউ ত নিন্দে করতে পারবে না। হাঁ, পারে বটে বলতে আমাকে। তিনটে পাশের কম যদি জামাই ঘরে আনি, দেশসুদ্ধ একটা ঢিঢি পড়ে যাবে। সবাই বলবে—এটা করলে কি! এতবড় একটা জ্যাঠাই ঘরে থাকতে কিনা দুর্গাপ্রতিমে জলে ভাসিয়ে দিলে! সত্যি কিনা বল ঠাকুরপো? বলিয়া স্বর্ণ অনাথের প্রতি কটাক্ষ করিলেন।

তা বৈ কি! বলিয়া অনাথ তাহার মহামান্য বড়ভাজের মর্যাদা রাখিয়া অফিসের বেলা হওয়ার অছিলায় প্রস্থান করিল।

স্বর্ণ বলিলেন, তোমার ভাইকে ধরে-করে যা হোক একটা ধরে-পাক্‌ড়ে দাও গে। তাতে তোমার লজ্জা নেই মেজবৌ, কেউ নিন্দে করতে পারবে না। তিরিশটি টাকা ত সবে মাইনে ছিল, কেই বা তাকে জানত, আর কেই বা চিনত। এঁদের ভাই বলেই যা লোকে জানে। আমি বলি কি––কাল দিনটে ভাল আছে, কালই চলে যাও।

দুর্গামণি মনে মনে একবার অতুলের কথা ভাবিলেন, কিন্তু, ইহার সাক্ষাতে কোন কথা কহিলেন না। কারণ এই বড়জায়ের সম্বন্ধেই অতুলের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ। স্বর্ণ অতুলের মায়ের মামাত বোন।

সেদিন কেমন করিয়া জ্ঞানদা অতুলের পায়ের উপর পড়িয়া কাঁদাকাটা করিয়াছিল, মা তাহা দেখিয়াছিলেন বটে, কিন্তু অতবড় বিপদ মাথার উপর লইয়া ইহার বিশেষ কোন অর্থ ভাবিয়া দেখেন নাই। কিন্তু দুঃখীর ঘরে ত একান্ত-মনে শোক করিবারও অবসর নাই! তাই স্বামীর মৃত্যুর পরের দিন হইতেই এই কথাটা চিন্তা করিতেছিলেন। ঘরে গিয়া দেখিলেন, মেয়ে চুপ করিয়া মেঝের উপর বসিয়া আছে। ধীরে ধীরে তাহার কাছে বসিয়া কহিলেন, দিদি যা বললেন শুনেচিস ত?

মেয়ে ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিল। তার পরে যে তিনি কি বলিবেন ভাবিয়া পাইলেন না।

কিন্তু মেয়ে নিজেই তাহার সুবিধা করিয়া দিল। কহিল, কখ্‌খনো ত বাপের বাড়ি যাওনি মা, এ সময় একবার কেন চল না?

মা বলিলেন, মা বেঁচে নেই, দাদা কোনদিন খোঁজ নিলেন না। এতবড় বিপদ শুনেও একটা চিঠি পর্যন্ত লিখলেন না। কেমন করে তাঁদের কাছে সেধে যাই, বল্‌ দেখি মা?

মেয়ে কহিল, দুঃখীর খোঁজ কেউ সেধে কখনো নেয় না মা। তাঁরা নেননি—এঁরাও ত নেন না। এঁরা বরং যেতেই বলচেন। আমাদের মান-অভিমান বাবার সঙ্গেই চলে গেছে, মা। চল, আমরা সেখানে গিয়েই থাকি গে।

মায়ের চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। মেয়ে সস্নেহে মুছাইয়া দিয়া কহিল, আমি জানি, শুধু আমার জন্যেই তুমি কোথাও যেতে চাও না। নইলে, জ্যাঠাইমার কথা শুনে একটা দিনও তুমি এখানে থাকতে না। আমার জন্যে তোমাকে এতটুকু ভাবতে হবে না মা, চল, দিন-কতকের জন্যে আমরা আর কোথাও যাই। এখানে থাকলে তুমি মরে যাবে।

মা আর থাকিতে পারিলেন না, মেয়েকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া হু হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। মেয়ে বাধা দিল না, শান্ত করিবার চেষ্টা করিল না; শুধু নীরবে জননীর বুকের উপর মুখ রাখিয়া বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ পরে দুর্গামণি নিজেই কতকটা শান্ত হইয়া চোখ মুছিয়া বলিলেন, তোকে সত্যি বলচি জ্ঞানদা, তুই না থাকলে আমি যেখানে দু’চক্ষু যায় সেইদিনই চলে যেতাম যেদিন তিনিও জন্মের মত চলে গেলেন। শুধু তোর জন্যেই পারিনি।

তা আমি জানি মা।

আচ্ছা, একটা কথা আমাকে সত্যি করে বল দেখি, বাছা, সেদিন কেন অতুল ও-কথা বললে? না জ্ঞানদা, অমন করে মুখ ঢেকে থাকিস নে মা, লজ্জা করবার সময় এ নয়। আমি জানি, মিছে কথা বলবার ছেলে সে নয়। তবে, সেই বা কেন তাঁর মরণকালে অমন ভরসা দিলে আর তুই বা কেন তার পায়ে পড়ে অমন করে কাঁদলি?

জ্ঞানদা মায়ের বুকের মধ্য হইতে অস্ফুটে কহিল, সে আমি জানিনে, মা।

দুর্গামণি জোর করিয়া মেয়ের মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া একবার দেখিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সে জোর করিয়া আঁকড়িয়া ধরিয়া রহিল। বিফলকাম হইয়া তিনি পুনরায় কহিলেন, তোমার বাবা বেঁচে থাকতে আমার কখনো কিছু মনে হয়নি বটে, কিন্তু সেইদিন থেকে ভেবে ভেবে এখন যেন অনেক কথাই বুঝতে পারি। অতুলের মুখের কতদিনের কত ছোটখাট কথাই না আজ আমার মনে হচ্চে। বলিতে বলিতেই তিনি অকস্মাৎ ব্যগ্র হইয়া কন্যার দুটি হাত নিজের হাতের মধ্যে লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সত্যি বল মা, আমি যা মনে করেচি, তা মিথ্যে নয়! আমি এ ক’দিন শুধু স্বপন দেখিনি?

জ্ঞানদা তেমনি মুখ ঢাকিয়া মৃদুস্বরে বলিল, কি জানি মা, তাঁর ধর্ম তাঁর কাছে।

দুর্গামণি আনন্দের আবেগে কাঁদিয়া কহিলেন, আমাকে সংশয়ে ফেলে রেখে আর বিঁধিস নে মা, একবার মুখ ফুটে বল্‌—আমি তোর বাপের জন্যে একটিবার প্রাণ খুলে কাঁদি। আমার এ কান্না আজ তিনি শুনতে পাবেন।

মেয়ে চুপি চুপি কহিল, কাঁদো না মা—আমি ত তোমাকে কাঁদতে বারণ করিনে। বাবাকে জানাতে বলেছিলাম—তিনি নিজেই ত জানিয়েচেন। এখন তাঁর ধর্ম তাঁর কাছে।

দুর্গামণি এবার আর বাধা মানিলেন না। জোর করিয়া মেয়ের আরক্ত অশ্রুসিক্ত মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া, তাহাকে অজস্র চুম্বন করিয়া, পুনরায় বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া, নীরবে বহুক্ষণ ধরিয়া অশ্রুপাত করিলেন। পরে চোখ মুছিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, তাই বটে মা, তাই বটে! অতুল আমার দীর্ঘজীবী হোক—তার ধর্ম তার কাছেই বটে। কিন্তু এ কথাটা আমাদের কারু একদিনের তরে মনে পড়েনি মা, তুই নিজেই যে তাকে মরা বাঁচিয়েছিলি। সে বছর, লোকে বললে—বেরিবেরি রোগ। তা সে যে রোগই হোক—ফুলে ফেটে, ঘা হয়ে,—আগে তার মা, তার পরে অতুল। অতুলের তো কোন আশাই ছিল না। পচা গন্ধে, ভয়ে, কেউ যখন তাদের ওদিক মাড়াত না, তখন এতটুকু মেয়ে হয়ে তুই যমের সঙ্গে দিবারাত্রি লড়াই করে তাকে ফিরিয়ে এনেছিলি। সে ধর্ম সে কি না রেখে পারে? সাবিত্রীর মত যাকে যমের হাত থেকে তুই ফিরিয়ে এনেছিলি, তাকে কি ভগবান আর কারু হাতে তুলে দিতে পারেন? এ ধর্ম যদি না থাকে, তবে চন্দ্র-সূর্য এখনও উঠচে কেন?

একটুখানি মৌন থাকিয়া পুনরায় পুলকিত-চিত্তে বলিতে লাগিলেন, এখন যেখানে আমাকে বলিস সেইখানেই যাব। কিন্তু তুই ত তার মত না নিয়ে যেতে পারিস নে বাছা। তাই বটে! তাই বটে! তাই বাবা আমার ফিরে এসেই, সকাল হতে না হতে দু’গাছি চুড়ি দেবার ছল করে মাকে আমার দেখতে এসেছিল। ওগো, আর একটা বছর কেন তুমি বেঁচে থেকে চোখে দেখে গেলে না! বলিয়া তিনি উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন বস্ত্রাঞ্চল দিয়া রোধ করিলেন।

বলি মেজবৌ?

দুর্গামণি তাড়াতাড়ি মেয়েকে বুক হইতে ঠেলিয়া দিয়া, চোখটা মুছিয়া লইয়া সাড়া দিলেন, কেন দিদি?

বড়বৌ একবার ঘরের ভিতর দৃষ্টিপাত করিয়া কঠিন-স্বরে বলিলেন, তোমাদের না হয় শোকের শরীরে ক্ষিদে-তেষ্টা নেই; কিন্তু বাড়ির আর সবাই ত উপোস করে থাকতে পারে না। বেরিয়ে একবার বেলার দিকে চেয়ে দেখ দেখি।

দুর্গামণি শশব্যস্তে ঘরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বেলার দিকে চাহিয়া লজ্জিতমুখে মেয়ের নাম করিয়া কি একটুখানি জবাবদিহি করিতেই, স্বর্ণমঞ্জরী তীক্ষ্ণভাবে বলিলেন, বেশ ত। হেঁসেলটা চুকিয়ে দিয়ে মেয়েকে কাছে বসিয়ে সারাদিন বোঝাও না— আমি কথাটিও কব না। কিন্তু আমার ছেলে-মেয়েগুলো যে পিত্তি পড়ে মারা যায়। না বাপু, এমনধারা সব অনাছিষ্টি কাণ্ড আমি সইতে পারব না। বলিয়া নিঃসন্তান বড়বৌ ছোটবধূর সন্তানদের প্রতি মাতৃস্নেহের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়া উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা না করিয়াই চলিয়া গেলেন।

অনাথের সংসার পুনরায় প্রবেশ করা অবধি দুর্গাকেই রান্নাঘরের সমস্ত ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। তাহাতে বড়বৌ এবং ছোটবৌ উভয়েই সমস্তদিনব্যাপী ছুটি পাইয়া, একজন পাড়া বেড়াইয়া এবং খরচপত্র অত্যন্ত বেশী হইতেছে বলিয়া কোন্দল করিয়া, এবং আর একজন ঘুমাইয়া, নভেল পড়িয়া, গল্প করিয়া দিন কাটাইতেছিলেন।

অনাথ সাড়ে-আটটার ডেলি প্যাসেঞ্জার। ভোরে উঠিয়া যথাসময়ে তাঁহার আহার্য প্রস্তুত করিয়া দেওয়া, এ-বাটীতে একটা নিদারুণ অশান্তির ব্যাপার ছিল। এই লইয়া বড় এবং ছোট জায়ে প্রায়ই কথা-কাটাকাটি এবং মন-কষাকষি চলিত। এ কয়দিন এই হাঙ্গামা হইতে নিস্তার পাইয়া, উভয়ের মধ্যে অনেক দিনের পর আবার একটা ভালবাসার গ্রন্থিবন্ধনের সূচনা হইতেছিল। কিন্তু আজ সকালে হঠাৎ সেই বাঁধনটা আর একবার ছিঁড়িয়া যাইবার উপক্রম হইল। তাহার কারণ এই যে, বেলা সাতটা বাজে, এবং ঝি আসিয়া সদ্যনিদ্রোত্থিত ছোটবধূকে জানাইল যে, কয়লার উনানের আঁচ উঠিয়া গিয়াছে, একটু তৎপর হইয়া রান্না চাপাইয়া দেওয়া আবশ্যক।

ছোটবৌ বিরক্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন, মেজদি কি করচে? বেলা সাতটা বাজে—আজ বুঝি তার সে হুঁশ নেই?

ঝি কহিল, হুঁশ কেন থাকবে না গা? ভোরে উঠে মায়ে-ঝিয়ে জিনিসপত্র গোছগাছ বাঁধাছাঁদা করচে—এই আটটার গাড়িতে হরিপাল না কোথায় যাবে যে!

ছোটবৌর কালকার কথা মনে পড়িল। কিন্তু কিছুমাত্র প্রসন্ন না হইয়া চেঁচাইয়া কহিল, যাবে বললেই যাবে নাকি? বাবুর হুকুম নিয়েচে? দিদিকে জানিয়েচে?

ঝি কহিল, বাবুর কথা জানিনে ছোটবৌমা, কিন্তু বড়মা ত নিজেই তাদের আজ যেতে বলেছিল।

তবে, তাকেই বল গে সাড়ে-আটটার ভাত দিতে—আমি জানিনে, বলিয়া ছোটবৌ ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হইয়া খানিকটা গুলগুঁড়ানো ঠোঁটের ভেতর পুরিয়া গামছাটা কাঁধে ফেলিয়া খিড়কির দিকে হনহন করিয়া চলিয়া গেল।

ঝি বলিল, থাকলে ত বলব! তিনি গেছে গঙ্গাচ্চান করতে—বলিয়া সে নিজের কাজে চলিয়া গেল।

ছোটবৌকে ফিরিতে হইল, কারণ অফিসের সাহেব তাহার রাগের মর্যাদা বুঝিবে না। হয় যা-হোক দুটা সিদ্ধ করিয়া দিতেই হইবে, না হয় স্বামীকে ঠিক সময়ে অভুক্তই যাইতে হইবে। দুটার একটা অপরিহার্য। ছোটবৌ ফিরিয়া আসিয়া দুর্গামণির দরজার সম্মুখে দাঁড়াইয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, যাবেই ত। কিন্তু এমন খোলোমি করে না গেলেই কি হত না মেজদি?

এই অভাবনীয় আক্রমণে দুর্গামণি অবাক হইয়া গেলেন।

ছোটবৌ কহিল, আমরা কেউ জানিনে, তোমরা সকালেই যাবে। তিনি গেছেন গঙ্গা নাইতে। আমি ত এই উঠচি। টাইমের ভাত কি করে দিই বল দেখি?

প্রাতঃপেন্নাম হই মাসিমারা, বলিয়া অতুল বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।

ছোটবৌ ফিরিয়া আসিয়া কহিল, তুমি হঠাৎ যে অতুল?

অতুল কলিকাতার মেসে থাকে। সেখানে চিঠি পাইয়া ছুটাছুটি করিয়া এইমাত্র আসিয়া জুটিয়াছে—এখনও বাড়ি যায় নাই। কহিল, মেজমাসিমা হরিপালে গঙ্গাযাত্রা করবেন, আর শেষ দেখাটা একবার দেখতে আসব না? হরিপাল! অর্থাৎ ম্যালেরিয়ার ডিপো! তা এই আশ্বিনের শুরুতেই এমন সুবুদ্ধিটা তোমাকে কে দিলে বল দেখি, মেজমাসিমা? বাঃ—বাঁধাছাঁদা একেবারে কমপ্লিট যে! বলিয়া সে সহাস্যে ঘরের মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেই একপ্রান্ত হইতে একজোড়া জলেভরা আরক্ত চক্ষু্র টেলিগ্রাফ পাইয়া স্তব্ধ হইয়া থামিল।

ছোটবৌ প্রশ্ন করিল, তুমি কি করে খবর পেলে অতুল?

আমি? বাঃ—, বলিয়া অতুল তাহার কৈফিয়ত শেষ করিল।

অকস্মাৎ প্রাঙ্গণের কোন একটা অনির্দিষ্ট স্থান হইতে স্বর্ণমঞ্জরীর কণ্ঠস্বর শব্দভেদী বাণের মত আসিয়া প্রত্যেকের কানে বিঁধিল। অর্থাৎ তিনি গঙ্গাস্নানে শান্ত-শুচি হইয়া বাটীতে পা দিয়াই ঝির মুখে কয়লার উনুনের খবর পাইয়াছিলেন। সুতরাং মেজজায়ের সদ্য-বৈধব্যের যথার্থ হেতুটা মুক্তকণ্ঠে বলিতে বলিতে আসিতেছিলেন—চারপো পূর্ণ না হলে কি ভগবান কারু এমন সর্বনাশ করেন? করেন না। এ তাঁর ধর্মের সংসার—এখানে অধর্ম হবার জো নেই। সোজা চলিয়া আসিয়া ঘরের চৌকাঠের ভিতরে একটা পা দিয়া কহিলেন, মতলবটা ত তোমার এই, মেজবৌ—না খেয়ে উপোস করে ছোটকর্তা অফিসে যাক, সন্ধ্যাবেলা পিত্তি পরে জ্বর হয়ে বাড়ি আসুক। তারপর নিজের যেমন হয়েছে তেমনি সর্বনাশ আরো একজনের হোক।

দুর্গামণি মনে মনে শিহরিয়া কহিলেন, এ কপাল যার পুড়েচে দিদি, সে অতিবড় শত্রুর জন্যেও অমন কামনা করে না। কিন্তু কি করেচি তোমার যে, এত কটু কথা আমাকে উঠতে বসতে শোনাচ্চ?

স্বর্ণ হাত নাড়িয়া মুখ অতি বিকৃত করিয়া কহিলেন, কচি খুকী যে! আমাকে বলতে হবে—কি করেচ? সাড়ে-সাতটা বাজে—টাইমের ভাত রাঁধবে কে?

অতুল এতক্ষণ অবাক হইয়া শুনিতেছিল। তাহার বড়মাসিকে সে ভাল করিয়াই চিনিত; এইজন্য কথাবার্তাও বড় একটা কহিত না। কিন্তু এখন আর সহ্য করিতে না পারিয়া নিজেই প্রশ্নের জবাব দিয়া বসিল। কহিল সত্যি কথা বললে তুমিই রাগ করবে মাসিমা; কিন্তু কপাল নেহাত না পুড়লে, আর কেউ তোমাদের ভাত খেতে আসে না, সে-কথা তোমরাও জান, পাড়ার আর পাঁচজনেও জানে। কিন্তু আজ যাবার দিনটায় হতভাগিনীদের একটুখানি মাপ করলে তোমাদের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না, মাসিমা।

হঠাৎ অতুলের কথার ঝাঁজে দুই জায়েরই বিস্ময়ের অবধি রহিল না। মিনিট-খানেক কাহারও মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তার পরে স্বর্ণ কহিলেন, কোলকাতা থেকে তুই কি আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করতে এসে হাজির হয়েচিস নাকি রে?

ছোটবৌ বলিল, ঝগড়া করতে আসবে কেন দিদি? ওর মেজমাসিকে আমরা হরিপালে গঙ্গাযাত্রা করাচ্চি, ও তাই যে শেষ দেখাটা দেখতে এসেচে।

ও, তাই বটে?

ছোটবৌ কহিল, তাই দিদি, তাই। তাই তখন থেকে ভাবচি, আমরা বাড়ির লোক জানলাম না, তোমার বোনপোটি কলকাতায় বসে জানলে কি করে? তা হলে লোকে যা বলে তা মিথ্যে নয় দেখচি।

স্বর্ণ ক্রোধে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হইয়া চেঁচাইয়া বিদ্রূপ করিয়া একটা কাণ্ড করিয়া তুলিলেন। বলিতে লাগিলেন, বেশ ত বাছা, এতই যদি দরদ জন্মে থাকে, তোমার শাশুড়িমাসিকে গঙ্গাযাত্রা করাবে কেন, ঘরেই নিয়ে যাও না। গাঁ-সুদ্ধ লোক বাহবা করবে এখন।

তাঁহার বিষের জ্বালায় অতুলেরও মাথা বেঠিক হইয়া গেল। সেও বলিয়া বসিল, বেশ ত মাসিমা, তোমরা আপনার লোক, কথাটা যদি দু’দিন আগেই জেনে থাক, ভালই ত। উনি আমার ঘরে গেলে, আমি মাথার করে নিয়ে যেতে রাজি আছি। তোমাদের গাঁয়ের লোকগুলো তাতে বাহবা দেবে, কি ছি ছি করবে, আমি ভ্রূক্ষেপও করিনে।

কথাটা বলিয়া ফেলিয়া অতুল নিজেও যেমনি লজ্জায় আড়ষ্ট হইয়া উঠিল, তাহার গুরুজনেরাও তেমনি অসহ্য বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। এ যেন অকস্মাৎ কোথা একটা প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ু ছুটিয়া আসিয়া লজ্জা-শরম আড়াল-আবডাল সমস্তই চক্ষের পলকে ভাঙ্গিয়া মুচড়াইয়া উড়াইয়া লইয়া মস্ত একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে সবাইকে দাঁড় করাইয়া দিয়া গেল। কাহারও কাছে কাহারও আর গোপন করিবার, রাখিবার-ঢাকিবার জায়গা রহিল না।

অতুল নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। যদু বাগদী গরুর গাড়ি আনিয়া কহিল, মা, সময় হয়েচে, জিনিসপত্তর কি দেবে দাও। এখন থেকে না বেরুলে ইস্টিশনে গাড়ি ধরতে পারা যাবে না। বলিয়া সে ঘরে ঢুকিয়া নির্দেশমত সুমুখের টিনের তোরঙ্গের উপর বিছানাটা তুলিয়া নিয়া ঘাড়ে করিয়া বাহির হইয়া গেল। বড়বৌ ছোটবৌ দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন। দুর্গামণি ‘দুর্গা দুর্গা’ বলিয়া ঘরে তালা দিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া নিঃশব্দে গাড়িতে গিয়া উঠিলেন। মেয়েটা মূর্ছিতের মত মায়ের কোলের উপর চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *