অযাত্রা

অযাত্রা

রামবাবু আপিস যাইবার জন্য বাড়ি হইতে বহির্গত হইতেছেন। বেলা আন্দাজ ন’টা।

‘দুর্গা দুর্গা দুর্গা দুর্গা দুর্গা—’

দ্রুত মৃদুকণ্ঠে দুর্গানাম আবৃত্তি করিতে করিতে রামবাবু চৌকাঠ পার হইলেন। সঙ্গে সঙ্গে চাদরের খুঁটে টান পড়িল। ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলেন দরজার হুড়কায় চাদর আটকাইয়া গিয়াছে।

বিমর্ষভাবে রামবাবু ফিরিয়া আসিয়া ঘরে বসিলেন। গৃহিণী বলিলেন, ‘বাধা পড়ল তো?’

‘হুঁ’— মন খারাপ করিয়া রামবাবু দেয়ালে লম্বিত মা কালীর পটের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

প্রত্যহই এইরূপ ঘটিয়া থাকে। তাঁহার আপিস যাওয়া একটা পর্ব বলিলেই হয়। ঠিক যে সময়টিতে তিনি চৌকাঠ পার হইবেন সে সময়ে বাড়ির ভিতর কাহারও কথা কহিবার হুকুম নাই—কথা কহিলেই উহা পিছু ডাকা হইয়া পড়িবে। কলিকাতা শহর যখন শত উপায়ে অসহায় রামবাবুর প্রাণবধ করিবার জন্য উদ্যত হইয়া আছে এবং আপিসের বড় সাহেব যখন প্রতি সপ্তাহে কেরানি কমাইতেছে— এরূপ বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্য ‘পিছু-ডাক’ শুনিয়াও যে নাস্তিক ঘরের বাহির হইতে পারে তাহার অদৃষ্টে দুঃখ আছে— একথা কে অস্বীকার করিবে?

রামবাবু কালীমূর্তির উপর হইতে চক্ষু সরাইয়া ঘড়ির উপর স্থাপন করিলেন। সওয়া ন’টা। আপিসে পৌঁছিতে মোটামুটি পঁচিশ মিনিট সময় লাগে, সুতরাং চৌকাঠ যদি নির্বিঘ্নে পার হওয়া যায় তাহা হইলে দশটার মধ্যে আপিসে পৌঁছিবার কোনই বাধা নাই।

‘কালী কালী কালী কালী কালী—’

বিঘ্নকারী কোনও উপদেবতাকে ফাঁকি দিবার জন্যই যেন রামবাবু সুড়ৎ করিয়া দ্বার লঙ্ঘন করিয়া গেলেন। কিন্তু ফুটপাথে নামিয়াই তাঁহাকে দাঁড়াইয়া পড়িতে হইল। একটি গেঞ্জি-পরা লোক— বোধ হয় কোনও মেসের ম্যানেজার— তরি-তরকারি কিনিয়া হন্‌হন্‌ করিয়া যাইতেছিল, তাহার সহিত রামবাবুর চোখাচোখি হইয়া গেল।

ক্ষণকাল তিনি স্তম্ভিতবৎ দাঁড়াইয়া রহিলেন। লোকটি ততক্ষণ তাঁহাকে অতিক্রম করিয়া গিয়াছিল, তিনি চমকিয়া ডাকিলেন, ‘ওহে, শোনো।’

লোকটি ক্রুদ্ধভাবে ফিরিল, দাঁত খিঁচাইয়া বলিল, ‘কী চাই?’

রামবাবু তাহার দিকে এক-পা অগ্রসর হইয়া গেলেন; তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাহার গণ্ডের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘তুমি দাড়ি কামিয়েছ; না মাকুন্দ?’

‘তোর তাতে কিরে শালা?’— অগ্নিশর্মা ম্যানেজার আর একবার দাঁত খিঁচাইয়া হন্‌হন্‌ করিয়া চলিয়া গেল।

খনার বচন অগ্রাহ্য করিবার যো নাই। খনা বলিয়াছেন—

‘যদি দেখ মাকুন্দ চোপা

এক পা’ও যেও না বাপা।’

ঐ গেঞ্জি-পরা লোকটার মসৃণ গণ্ডস্থল দেখিয়া রামবাবুর সন্দেহ হইয়াছিল যে সে মাকুন্দ। তা— মাকুন্দ হোক্ বা না হোক্, ইহার পর যাত্রা না বদলাইয়া আপিস যাওয়া চলে না। রামবাবু ফিরিলেন। গৃহিণী মুখে একটা শব্দ করিয়া বলিলেন, ‘আবার বাধা পড়ল?’

রামবাবু উত্তর দিলেন না, ভর্ৎসনাপূর্ণ নেত্রে একবার মা কালীর পটের দিকে তাকাইলেন। মা কালী পূর্ববৎ জিভ বাহির করিয়া হাসিতে লাগিলেন।

কন্যা পুঁটুকে রামবাবু বলিলেন, ‘এক গেলাস জল দাও তো, মা।’

জল পানে যাত্রা বদল হয়। গেলাস নিঃশেষ করিয়া রামবাবু আবার দেয়ালের দিকে তাকাইলেন। মা কালীর পাশে একটি মহাদেবের ছবি টাঙানো ছিল, তদগত ভাবে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন।

ইদানীং বাধাবিঘ্নের সংখ্যা এত বাড়িয়া গিয়াছে যে প্রথম বার যাত্রা করিয়া আপিসে পৌঁছানো রামবাবুর আর ঘটিয়া উঠে না। তিনি তাই বেলা নয়টা হইতে পাঁয়তাড়া ভাঁজিতে আরম্ভ করেন, কিন্তু তবু দেরি হইয়া যায়। ইতিপূর্বে কয়েকবার সাহেবের ধমক খাইয়াছেন। কিন্তু দৈব যেখানে পদে পদে বাধা দিতেছে সেখানে বিলম্ব না হইয়া উপায় কি?

সাহেবের কথা মনে পড়িতেই রামবাবুর সমাধি ভাঙিয়া গেল; তিনি আড়চক্ষে ঘড়ির পানে চাহিলেন। সাড়ে ন’টা বাজিতে আর বিলম্ব নাই। কোনও মতে নির্বিঘ্নে দ্বার অতিক্রম করিতে পারিলে এখনও যথা সময়ে আপিস পৌঁছানো যাইতে পারে।

‘শিব শিব শিব শিব শিব—’

বলা যায় না, আবার মাকুন্দ দেখিয়া ফেলিতে পারেন— তাই রামবাবু চক্ষু বুজিয়া সবেগে দ্বার দিয়া নির্গত হইলেন।

তারপরেই— তুমুল ব্যাপার।

একটি অতিক্রান্তযৌবনা স্থূলাঙ্গী ঝি’র সহিত রামবাবুর সংঘর্ষ হইয়া গেল। হুলস্থুল কাণ্ড! রামবাবু, ঝি, আলু, পটল, হাঁসের ডিম ফুটপাথে গড়াগড়ি যাইতে লাগিল। ক্ষণেক পরে ঝি উঠিয়া কোমরে হাত দিয়া তারস্বরে যে ভাষা প্রয়োগ করিতে লাগিল তাহাতে রামবাবু দ্রুত উঠিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং সশব্দে হুড়কা লাগাইয়া দিলেন।

কাপড় চোপড় ছাড়িয়া তেত্রিশ কোটি দেবতার নাম জপ করিতে করিতে রামবাবু যখন আপিসে পৌঁছিলেন তখন বেলা পৌনে এগারোটা। পৌঁছিয়াই শুনিলেন বড় সাহেব তলব করিয়াছেন।

অষ্টমীর পাঁঠার মতো কাঁপিতে কাঁপিতে রামবাবু সাহেবের ঘরে গেলেন। সাহেব সংক্ষেপে বলিলেন, ‘বার বার তোমাকে ওয়ার্নিং দিয়েছি, তবু তুমি সময়ে আসিতে পারো না। তোমার আর আসিবার প্রয়োজন নাই।’

রক্ষাকবচের ভারে ডুবিয়া মরার মতো বিড়ম্বনা আর নাই। রামবাবু হোঁচট খাইতে খাইতে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

আজ যে এই রকম একটা কিছু ঘটিবে তাহা তিনি জানিতেন। পিছুটান, মাকুন্দ, কলিশন— এতগুলা দুর্দৈব কখনও ব্যর্থ হয়। তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া কাতর চোখ দুটি আকাশের পানে তুলিলেন।

একটা নূতন বাড়ি তৈয়ার হইতেছিল— লম্বা বাঁশের আগায় একটা ভাঙা ঝুড়ি ও ঝাঁটা বাঁধা ছিল, তাহাই রামবাবুর চোখে পড়িল।

তাঁহার মনে হইল অদৃষ্ট অন্তরীক্ষে থাকিয়া তাঁহাকে ঝাঁটা দেখাইতেছে।

৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *