অয়োময়
বেদনা ও আনন্দময় অভিজ্ঞতার গল্প
নিউমার্কেটে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সৈয়দ শাসুল হকের সঙ্গে দেখা। তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, কী লিখছেন?
আমি বললাম, ‘অয়োময়’ লিখছি।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, সাহিত্য কিছু লিখছেন না?
এই দিয়েই ‘অয়োময়’ প্রসঙ্গ শুরু করি। তবে শুরুর আগে বলে নিই, সৈয়দ হকের এই কথায় আমি আহত হয়েছি। টিভির জন্যে নাটক লিখলে সাহিত্য হবে না, মঞ্চের জন্যে লিখলে সাহিত্য হবে, এই অদ্ভুত ধারণা তিনি কোথায় পেলেন কে বলবে। যে ‘অয়োময়’ আমি টিভিতে দিচ্ছি মঞ্চে তা দিয়ে দিলেই সাহিত্য হয়ে যাবে? আমি কেমিস্ট্রির ছাত্র, এইসব ব্যাপার বুঝি না, তার মতামত মেনে নিয়েই (!) আজকের লেখা শুরু করি।
অয়োময়ের আগে আরও দুটি অসাহিত্য’ টিভির জন্যে লিখেছিলাম–এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি। বহুব্রীহি শেষ করার পর একটা বড় কাগজে লেখলাম–এই জীবনে আর ধারাবাহিক নাটক লিখব না। আমার বড় কন্যা সেই লেখা ফ্রিজের গায়ে আটকে দিল। ঠান্ডা পানির জন্যে যতবার ফ্রিজের দরজা খুলি ততবার লেখাটার দিকে চোখ পড়ে। একসময় মনে হলো সেলফ হিপনোসিস প্রক্রিয়া কাজ করছে–মাথা থেকে ধারাবাহিক নাটকের ভূত নেমে গেছে। ফ্রিজের গা থেকে লেখা তুলে ফেলা হলো। আমি অন্য লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বছর দুই কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ লক্ষ করলাম মাথার গভীর গোপনে এক ধরনের যন্ত্রণা বোধ করছি। যন্ত্রণার কারণ ঠিক বুঝতে পারছি না। স্ত্রী এবং তিন কন্যাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলাম। গারো পাহাড় দেখতে যাব, পথে ময়মনসিংহ শহরে থাকলাম। বিকেলে দেখতে গেলাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। মুক্তাগাছার জমিদারের বসতবাড়ি। কলেজের শিক্ষকরা খুব আগ্রহ নিয়ে সব ঘুরে দেখালেন। রাজবাড়ির চারদিকে বিচিত্র সব গাছ। তারা এইসব গাছপালা খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে চেনাতে লাগলেন।
এটা এলাচি গাছ, এটা লবঙ্গ গাছ, এটা দারুচিনি গাছ।
মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল–এলাচি, লবঙ্গ, দারুচিনি।
তারা নিয়ে গেলেন পুকুর ঘাটে। কী সুন্দর ডিমের মতো পুকুর। শ্বেত পাথরের কী চমৎকার বাঁধানো ঘাট! পানিতে পা ডুবিয়ে ঘাটে বসেছি। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিল্পকলার শিক্ষক জমিদার সম্পর্কে মজার মজার গল্প বলছেন, মুগ্ধ হয়ে শুনছি—
বুঝলেন হুমায়ুন সাহেব, এই জমিদারের তিন স্ত্রী ছিলেন। তাদের একজন বিষ খাইয়ে স্বামীকে হত্যার চেষ্টা করেন। জমিদার সাহেব অনেক চেষ্টা করেন বের করতে–তিনজনের ভেতর কে বিষ দিয়েছে। বের করতে পারেন না। তিনি স্ত্রীদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। নতুন ধরনের শাস্তি। তিন স্ত্রীকে সামনে নিয়ে তিনি বসলেন। একটা বিড়ালকে বিষ খাইয়ে তাদের সামনে রাখলেন। তারা দেখলেন কী করে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বিড়াল মারা যায়। জমিদার স্ত্রীদের চোখের দিকে। তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। এই ঘটনা মাসে একবার করে ঘটতে লাগল।
গল্প শুনে আমি মুগ্ধ। চট করে মাথায় এল–আচ্ছা এদের নিয়ে একটা লেখা লিখলে কেমন হয়? কিন্তু এদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। কেমন ছিল তাদের জীবনচর্যা। পুরোপুরি কল্পনাকে আশ্রয় করে এখোনো কি ঠিক হবে? গবেষণা করব, এত সময় কোথায়?
কখনো যা করি না তা-ই করলাম, ঠিক করলাম কিছু খাটাখাটনি করব, তথ্য জোগাড় করব। ভাটি অঞ্চলের জমিদারদের জীবিত বংশধরদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম–তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। এদের মধ্যে আছেন গচিয়া চৌধুরী বাড়ির সালেহ উদ্দিন চৌধুরী এবং বাজিতপুর জমিদার বাড়ির বংশধর হারুনুর রশীদ। খসড়া লেখা তৈরি হলো—পরিকল্পনা উপন্যাস লেখার। ধারাবাহিক নাটকের চিন্তা তখনো মাথায় আসে নি।
নওয়াজীশ আলী খান
এক দুপুরে টিভি থেকে টেলিফোন করলেন নওয়াজীশ আলী খান। মহা আনন্দিত। আনন্দের কারণ হচ্ছে, তাঁকে টিভি থেকে সরিয়ে নিমকো বা এই জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে নির্বাসিত করা হয়েছিল, তিনি আবার টিভিতে ফিরে এসেছেন। তিনি বললেন, হুমায়ূন ভাই, আসুন চা খেয়ে যান। অনেক দিন আপনার পাগলামি কথাবার্তা শুনি না। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে আমার পাগলামি কথাবার্তা শোনাবার জন্যে রওনা হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, একটা ধারাবাহিক নাটক করলে কেমন হয়?
আমি বললাম, উত্তম হয়। কিন্তু আমি তো ভাই প্রতিজ্ঞা করেছি, আর ধারাবাহিক নাটকে যাব না।
প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবেন না?
জি-না।
প্রতিজ্ঞা করা হয় ভাঙার জনো, এটা জানেন?
জানি।
তাহলে আসুন শুরু করা যাক।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আপনার উপন্যাসকে ভিত্তি করে একটা ধারাবাহিক নাটক করি–বড় উপন্যাস আছে?
না, তবে যে-কোনো উপন্যাসকেই আমি টেনে রাবারের মতো লম্বা করতে পারব।
তাহলে একটা নাম দিন, এবং সিনপসিস দিন–আজই টিভি গাইডে যাবে।
আমি নাম দিলাম, ‘আমিন ডাক্তার’। একটা সিনপসিসও লিখে দিলাম–সেই সিনপসিস এমন যে, পড়ে কেউ কিছুই বুঝবে না। বাসায় ফিরেই ধারাবাহিক নাটকের প্রথম পর্বটি লিখে ফেললাম। লেখা শেষ হলো রাত তিনটার দিকে। গুলতেকিনকে পড়তে দিলাম। সে পড়ে বলল, নাটকের নাম আমিন ডাক্তার, কিন্তু গল্প তো দেখা যাচ্ছে জনৈক ছোট মীর্জাকে নিয়ে। আমি বললাম, শুরুতে আমিন ডাক্তার অপ্রধান চরিত্রে থাকলেও শেষটায় ঝলসে উঠবেন। গুলতেকিন বলল, নাটক ভালো হয়েছে, তবে নামটা পছন্দ হচ্ছে না। আমি বললাম, যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলবে না। সে বলল, পৃথিবীর সবকিছু তুমি বোঝ আর কেউ কিছু বোঝে না এটা মনে করারও কোনো কারণ দেখি না। দুজন দুপাশে ফিরে ঘুমুতে গেলাম।
প্রথম পাণ্ডুলিপি পাঠ
আমার জীবন বন্ধুহীন। মাঝে মাঝে অল্প কিছু সময়ের জন্য দু’একজন বন্ধু-বান্ধব জোটে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ এক বছরের বেশি কখনো থাকে না। আমার তেমনি এক বন্ধু কবি ওবায়দুল ইসলাম আগ্রহ প্রকাশ করলেন যে, প্রথম পাণ্ডুলিপি তার বাসায় পাঠ হবে। সেই উপলক্ষে অনেককে নিমন্ত্রণ করা হলো। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আছেন–আবুল খায়ের, আসাদুজ্জামান নূর, ড. এবং মিসেস এনামুল হক, সপরিবারে আবুল হায়াত। আসরের মধ্যমণি হিসেবে আছেন নওয়াজীশ আলী খান। খাবারদাবারের বিপুল আয়োজন। পাণ্ডুলিপি পকেটে নিয়ে সন্ধ্যার পর সেই বাসায় উপস্থিত হলাম। অতিথিরা সবাই এসে গেছেন, কিন্তু তাদের সবার মুখই শুকনো। কথা বলছেন নিচু গলায়। খবর যা শুনলাম তা ভয়াবহ। ওবায়দুল ইসলাম সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র খেলতে গিয়ে বা চোখে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। চোখে দেখতে পাচ্ছে না বলে বলছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তার বলেছেন, চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিছুমাত্র নড়াচড়া না করে দু’সপ্তাহ একভাবে শুয়ে থাকতে হবে। ভাগ্য ভালো হলে রক্ত শরীর শুষে নেবে। ভাগ্য খারাপ হলে…
ছেলেটি শুয়ে আছে। নড়াচড়া করছে না। এই অবস্থায় খাওয়াদাওয়া করা বা পাণ্ডুলিপি পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি বললাম, আজ বাদ থাক, অন্য একদিন পড়া যাবে। নওয়াজীশ আলী খান বললেন, বাদ দিন, বাদ দিন।
গৃহকর্তা এবং গৃহকত্রী রাজি হলেন না। তাঁদের বাড়ির সবাই অভিনয়কলায় বিশেষ পারদর্শী। সবাই এমন ভাব করতে লাগলেন যেন কিছুই হয়নি। চোখে আঘাত পেয়ে দেখতে না-পাওয়া যেন নিত্যদিনের ব্যাপার। তাদের কারণেই খাওয়াদাওয়া হলো, পাণ্ডুলিপি পাঠ হলো। তর্ক-বিতর্ক, মন্তব্য, রসিকতা চলতে লাগল। একসময় বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলাম, মরার মতো পড়ে থাকা বাচ্চাছেলেটির কথা কারোরই মনে নেই। প্রথম দিনের আলোচনায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আমিন ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করবেন জনাব আবুল খায়ের। নাটকটির নাম বদল করা হবে।
অভিনেতা–অভিনেত্রী নির্বাচন
নাটকের পাত্র-পাত্রী নির্বাচন সবসময় প্রযোজকই করে থাকেন। নওয়াজীশ আলী খান বললেন, নির্বাচনের ব্যাপারটি আপনাকে নিয়ে করতে চাই। এই নাটকে চরিত্র অনেক বেশি। চরিত্রের মেজাজও বিচিত্র। আপনি সঙ্গে থাকলে ভালো হবে।
আমি সঙ্গে রইলাম। দেখা গেল, আমি সঙ্গে থাকায় সমস্যা কমল না, বাড়ল। পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রী যাকেই নিতে চাই তিনিই না করেন। মদিনার স্বামী হিসেবে মামুনুর রশীদকে নেওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। তিনি দ্রভাবে বললেন–না। মীর্জার ছোট বউ হিসেবে খুব শখ ছিল সুবর্ণাকে নেওয়ার। তিনি বললেন–না। তার না বলার কারণ হচ্ছে, তিনি অন্য একটি ধারাবাহিক নাটক ‘গ্রন্থিকগণ কহে’-তে কথা দিয়ে রেখেছেন। ডলি জহুরকেও বলা হলো। তিনি বললেন, মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের একটি সিরিজে ভাঁকে কাজ করতে হবে। শান্তা ইসলামকে মদিনার চরিত্রে ভাবা হয়েছিল, তার চরিত্র পছন্দ হলো না। বললেন–বিদেশ যাবেন, কাজেই করতে পারবেন না।
আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু জনাব আবুল হায়াত সাহেবকে যখন কাশেমের চরিত্র করতে বলা হলো তখন তার ফর্সা মুখ কালো হয়ে গেল। চরিত্র পছন্দ নয়। তাকে বাসায় গিয়ে নানান কথাবার্তায় ভোলাতে হলো।
ফেরদৌসী মজুমদারকে মা চরিত্রে ভাবা হলো। আমি নিজে এক দুপুরে তাকে পরপর তিনটি পর্ব পড়ে শোনালাম। তিনি শুকনো গলায় বললেন, এর মধ্যে অভিনয় করার কী আছে? যে-কেউ এই চরিত্র করতে পারে।
সাবিহা চরিত্রে মধ্যম মানের একজন অভিনেত্রীকে ডাকা হয়েছিল (ডালিয়া)। তিনিও শুকনো মুখে জানালেন, চরিত্রে অভিনয়ের কিছু নেই।
শেষ পর্যন্ত চরিত্র ঠিক হলো।
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম শুনে সবাই বলল–ডুবেছে, এইবার হুমায়ুন। আহমেদ ডুবেছে। বিশ বাঁও পানির নিচে পড়ে যাবে। তাদের এ-জাতীয় চিন্তার কারণ হচ্ছে–মীর্জা চরিত্র করছেন আসাদুজ্জামান নূর। যিনি সবসময় হালকা আমোদী ধরনের চরিত্র করেন। মীর্জা চরিত্রের কাঠিন্য আনা তাঁর কর্ম নয়।
দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র করছেন সারা যাকের। টিভি দর্শকরা যাকে আগে কখনো পছন্দ করেননি।
আরেকটি প্রধান চরিত্র করছেন আমজাদ হোসেন। সবার ধারণা হলো, তিনি উচ্চগ্রামের অভিনয় করে নাটকে ‘আউলা’ ভাব নিয়ে আসবেন।
হায়াত সাহেবকে নিয়েও ভয়–মাঝি চরিত্রে তাকে মানাবে না।
মুস্তাফিজুর রহমান আমাকে বললেন, মিসকষ্ট হয়েছে। মিসকাস্টের জন্যে সমস্যায় পড়বেন। এখনো সময় আছে নূরের জায়গায় আলী যাকেরকে নিন। বিশাল দেহ আছে, মানিয়ে যাবে।
আমি বললাম, জমিদারকে কুস্তি করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই দেখা যাক না।
নৌকা ভাসানোর ব্যবস্থা হলো। ছটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হলো এবং পাঠ করা হলো। একেকদিন একেকজনের বাসায়। যে বাড়িতে পাঠ করা হবে সেই বাড়ির দায়িত্ব হচ্ছে চমৎকার ডিনারের ব্যবস্থা করা। আমি পাণ্ডুলিপি নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে খেয়ে বেড়াতে লাগলাম। সে বড় সুখের সময়।
ইতিমধ্যে নাম বদল হয়েছে। এখন আর আমিন ডাক্তার নাম নয়। এখন নাম হলো ‘অয়োময়’।
এই অদ্ভুত নাম কোথায় পেলাম। দেশ পত্রিকায় একবার একটা কবিতা পড়েছিলাম। কবির নাম অয়োময় চট্টোপাধ্যায়। অয়োময় নামটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। গাঁথুনি থেকে খুলে নিয়ে খানিকটা হালকা করলাম।
কারা কারা অভিনয় করবেন মোটামুটি ঠিক হয়ে গেল। সবাই পূর্বপরিচিত। তাঁদের সঙ্গে আগে কাজ করেছি। নতুনের মধ্যে আছেন মোজাম্মেল হোসেন। একদিন নওয়াজীশ আলী খানের অফিসে গিয়ে দেখি বিশালদেহী এক ভদ্রলোক বসে আছেন। নওয়াজীশ ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন–ইনি অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন। তাকে মীর্জার লাঠিয়াল চরিত্রে ভাবছি।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। অধ্যাপক মানুষ, সামান্য লাঠিয়াল চরিত্র করবেন? চরিত্রও তো তেমন কিছু না। আমি বললাম, ভাই আপনি কাশতে পারেন? তিনি তৎক্ষণাৎ খুক খুক করে দেখিয়ে দিলেন—’ফলেন পরিচয়তে’।
অয়োময়ের অল্প কিছু ব্যাপার দর্শকরা খুব আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করেছেন—হানিফের কাশি তার একটি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা হয় কাশার জন্য।
শিল্পীরা অনুষ্ঠানে গান গায়, নাচেন, কবিতা আবৃত্তি করেন হানিফ সাহেব কাশেন। সেদিন শুনলাম এক ক্যাসেট কোম্পানি হানিফ সাহেবের কাশির একটা ক্যাসেট বের করতে চান। এই বিচিত্র দেশে সবই সম্ভব।
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মদিনা চরিত্রে। আমি নওয়াজীশ ভাইকে বলে দিয়েছিলাম–পাগলের থাকবে অল্পবয়স্কা রূপবতী এক বালিকা বধূ। যে মেয়েকে নেওয়া হলো তার নাম মনে পড়ছে না–সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী। চরিত্রের জন্যে মানানসই। একদিন রিহার্সেল দিয়ে সে পিছিয়ে পড়ল। জানাল–নাটক করবে না। শান্তাকে ভাবা হলো। তিনিও পিছিয়ে পড়লেন। দেখা গেল এই চরিত্র কারোরই পছন্দ নয়। একটা সমস্যায় পড়া গেল।
আহমেদ ছফা তখন এক মহিলাকে পাঠালেন যদি তাকে কোনো সুযোগ দেওয়া যায়। তার সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা হলো, তিনি পারবেন। আমি তাকে নিয়ে টিভি ভবনে গেলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, হুমায়ূন ভাই, যেহেতু আপনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন আমার একটি চরিত্র পাওয়া অবশ্যই উচিত, কিন্তু আমার সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল। আমি জানি এই নাটকে অভিনয় করতে পারব না।
মহিলা রিহার্সেলে অংশগ্রহণ করলেন। কন্ট্রাক্ট ফরমে সই করলেন। আমি তাকে হাসিমুখে বললাম, দেখলেন তো আপনার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল নয়।
তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, তাই তো দেখছি, কিন্তু আমি জানি আমার দ্বারা হবে না। বিশ্বাস করুন, আমার সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ভদ্রমহিলার কথাই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো। তাকে নেওয়া হলো না। কেন নেওয়া হলো না তা তাঁকে বলা উচিত ছিল। বলিনি। আজ এই লেখার মাধ্যমে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং স্বীকার করছি, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আসলেই ভালো।
মদিনা চরিত্রে শেষ পর্যন্ত এলেন–তারানা। আমি সবসময় তার অভিনয়ের ভক্ত। ‘বহুব্রীহি’ নাটকে তাকে নেওয়ার খুব আগ্রহ ছিল। তিনি রাজি হননি। এইবার রাজি হলেন।
অয়োময় হবে না
সব যখন ঠিকঠাক তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের পক্ষ থেকে নওয়াজীশ আলী খান আমাকে জানালেন, অয়োময় করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম কারণ কী?
তিনি করুণ গলায় বললেন, কারণ খুব সহজ। টিভির অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এই নাটক যা দাবি করছে টিভিতে পক্ষে তা মেটানো সম্ভব নয়। হাতি, ঘোড়া, ছিপ নৌকা, হাওড়ে দিনরাত শুটিং–অসম্ভব। এই একটি ধারাবাহিকের জন্যে টিভির পক্ষে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়। কাজেই বাতিল।
আমি মন খারাপ করে বাসায় বসে রইলাম। আমাকে আরেকটি সহজ নাটক লিখে দেওয়ার জন্য মুস্তাফিজুর রহমান অনুরোধ করলেন। আমি বালকদের মতো অভিমানী গলায় বললাম, না।
আমি যখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে নাটক হবে না, তখন একদিন নওয়াজীশ আলী খান বললেন, সুসংবাদ। টিভি এই নাটকের জন্যে কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে রাজি হয়েছে, তবে আপনাকেও আপনার পরিকল্পনার খানিকটা কাটছাঁট করতে হবে। রাজি থাকলে চলুন নৌকা ভাসিয়ে দেই।
আমি বললাম, রাজি। খুশি মনে বাসায় ফিরে এসেছি। গুলতেকিনকে বললাম, আয়োময় শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে। সে ফ্যাকাশে ভঙ্গিতে হাসল। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বলল, আচ্ছা আমি যদি তোমাকে কোনো অনুরোধ করি তুমি রাখবে?
আমি বললাম, অবশ্যই রাখব। কী চাও তুমি?
নাটকটি তুমি এক বছর পিছিয়ে দাও।
সে-কি! কেন?
আমি বেবি এক্সপেক্ট করছি। এই অবস্থায় টেনশন নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব। আমি তোমার নাড়ি-নক্ষত্র চিনি। নাটক শুরু হওয়ামাত্র তুমি জগৎ-সংসার ভুলে যাবে। সব সামলাতে হবে আমাকে। আমার পক্ষে তা সম্ভব না। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, একটা বছর পিছিয়ে দাও।
আমি বললাম, তা তো সম্ভব না। পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে, খেলা শুরু হয়েছে। তুমি কোনো চিন্তা করবে না। তোমাকে কোনো টেনশন নিতে হবে না–সব টেনশন আমি নেব।
গুলতেকিনের কথা না-শোনার জন্য পরবর্তী সময়ে আমাকে চরম মূল্য দিতে হলো। সেই গল্প একটু পরেই বলব।
অয়োময়ের গান
গান লিখব কখনো ভাবি নি। আমার সবসময় মনে হয়েছে, গীতিকার হওয়ার প্রথম শর্ত সুর, রাগ-রাগিণীর উপর দখল। সেই দখল আমার একেবারেই নেই। কাজেই গান লেখার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু গান তো লাগবেই। ভাটি অঞ্চলের মানুষ ছ’ মাস বসে থাকে। সেই সময়ের বড় অংশ তারা গান-বাজনা করে কাটায়। অয়োময় ভাটি অঞ্চলের গল্প। গান ছাড়া চলবে না। প্রথমে ভেবেছিলাম সেই অঞ্চলের প্রচলিত গীত ব্যবহার করব। সংগ্রহ করা গেল না। শেষটায় বিরক্ত হয়ে নিজেই লিখতে বসলাম। সুর দেওয়ার জন্য ওমর ফারুককে দেওয়া হলো। তিনি চোখ কপালে তুলে বললেন, আপনার লেখা?
আমি চাপা অহংকার নিয়ে বললাম, জি।
ওমর ফারুক বিরক্ত গলায় বললেন, গান লেখার তো আপনি কিছুই জানেন না। মিল কোথায়? সঞ্চারী কোথায়?
সঞ্চারী কোথায় আমি জানি না। কিন্তু মিল তো আছে।
এই মিলে চলবে না।
আমি নরম স্বরে বললাম, কী করে গান লিখতে হয় আপনি শিখিয়ে দিন। আমি দ্রুত শিখতে পারি।
ওমর ফারুক সাহেব শিখিয়ে দিলেন। তাঁর মতো করে গান লিখে দিলাম। তিনি সুর দিয়ে আমাকে শোনালেন। আমি অবিকল তাঁর মতো চোখ কপালে তুলে বললাম, কী সুর দিয়েছেন? শুনতে জঘন্য লাগছে।
কী বললেন, শুনতে জঘন্য লাগছে?
জি।
এই রকম কথা বলতে পারলেন?
আমি মনে কথা রাখতে পারি না। যা মনে আসে বলে ফেলি।
হুমায়ুন সাহেব, আপনার সঙ্গে আমি কাজ করব না। স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
উনি এক দরজা দিয়ে বের হচ্ছেন, আমি অন্য দরজা দিয়ে। নওয়াজীশ ভাই দুজনকে ধরে এনে মিটমাট করার চেষ্টা করলেন।
ওমর ফারুক সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, হুমায়ুন সাহেব, গানগুলি প্রচার হোক, তখন আপনি বলবেন–ওমর ফারুক দি গ্রেট।
গান প্রচার হলো। এ দেশের মানুষ গানগুলো ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। আমি বলতে বাধ্য হলাম–ওমর ফারুক দি গ্রেট।
অয়োময়ের সবকটি গান আমার লেখা নয়। একটি লিখেছেন সালেহ চৌধুরী আল্লাহ সবুর করলাম সার। অন্য একটি ওবায়দুল ইসলাম—আসমান ভাইঙা জোছনা পড়ে।
অয়োময়ের গানগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গান হচ্ছে আমার মরণ চাঁদনী পহর রাইতে যেন হয়। আসলেই আমি চাঁদনী পহর রাতের ফকফকা জ্যোৎস্নায় মরতে চাই। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তেও অসহ্য সুন্দর পৃথিবীকে দেখে যেতে চাই। লেখাটা মনে হয় অন্যদিকে মোড় নিয়ে নিচ্ছে, আগের জায়গায় ফিরে যাই।
যাত্রা শুরু
আউটডোরের কাজ হবে ময়মনসিংহে। ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদী, আমিন ডাক্তার নৌকায় করে ভাটি অঞ্চলে যাচ্ছেন– সারা দিন নৌকা চলেছে। একসময় রাত নামল। আকাশে চাঁদ উঠল। বদরুল গান শুরু করল—
‘আসমানে উইঠাছে চান্দি
আমি বসিয়া কান্দি
ভব সমুদ্র একা একা ক্যামনে হব পার?’
দৃশ্যটি ধারণ করতে ক্যামেরাম্যান নজরুল সাহেব হিমশিম খেয়ে গেলেন। নদীতে প্রবল স্রোত। নৌকা টালমাটাল করছে। নেমেছে বৃষ্টি। ময়মনসিংহের বিখ্যাত বৃষ্টি, একবার শুরু হলে থামার নাম করে না।
রাত তখন একটা। গানের দৃশ্যের চিত্রায়ন শুরু হয়েছে। আমি উৎসাহদাতা হিসেবে অন্য একটি নৌকায় আমাদের আর্ট ডাইরেক্টরের সঙ্গে বসে আছি। হঠাৎ প্রবল স্রোতে নৌকা এগিয়ে চলল। মূল দলের সঙ্গে বিছিন্ন হয়ে আমরা ভেসে যেতে লাগলাম। ঘোর অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না–দূর থেকে ভেসে আসছে বদরুলের। গলা (সুবীর নন্দী)–’ভব সমুদ্র একা একা ক্যামনে হব পার।’
আমার জীবনের আনন্দময় মুহূর্তের একটি। আবেগে চোখে পানি এসে গেল। কয়েক ফোঁটা চোখের জল রেখে এলাম ব্রহ্মপুত্র নদীতে।
শুটিং শেষ হলো রাত দুটার দিকে। উৎসাহের কারও কোনো কমতি নেই। ভোর হওয়ামাত্র আবার বের হয়ে পড়লোম। রাজবাড়িতে সেট পড়েছে। পুকুরঘাটে বড় বউ এবং এলাচি বেগম। সারা দিন কাজ হলো। সবার মনে প্রবল উৎসাহ। যে-করেই হোক একটা ভালো জিনিস করতে হবে। যে-কোনো মূল্যে করতে হবে। আশপাশের সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
কত সুখস্মৃতি
‘অয়োময়’ নিয়ে চমৎকার সব স্মৃতি আছে। কয়েকটা বলি।
মীর্জা সাহেব খবর পেলেন তার সন্তান হবে। মনের আনন্দে তিনি সব পাখি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্যামেরা তার মুখের ওপর ধরা। তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। তিনি পাখির খাঁচায় হাত ঢুকাচ্ছেন, আর পাখিরা তাকে প্রাণপণ শক্তিতে ঠোকরাচ্ছে। হাত রক্তাক্ত। মীর্জা সাহেব ব্যথায় চিৎকার করতে পারছেন না–আবার পাখি জোগাড় করা সমস্যা। ছবি নেওয়া শেষ হলো। তিনি বক্তাক্ত হাত চেপে ধরে চেঁচাতে লাগলেন–বাবা রে, মা রে, গেলাম রে!
নাপিত নিবারণকে পাগল তাড়া করছে–নিবারণ ছুটছে। একসময় সে বুকে হাত দিয়ে বসে গেল। নওয়াজীশ আলী খান ছুটে গেলেন। নির্ঘাৎ হার্ট অ্যাটাক। নিবারণরূপী এ.বি সিদ্দিক ছটফট করছেন, তাঁকে হাওয়া করা হচ্ছে, মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। আমি একটু দূরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি। নওয়াজীশ ভাইয়ের মুখ ছাইবর্ণ। মোবারক উচ্চস্বরে কলেমা শাহাদৎ পড়ছে।
দারোগা সাহেব ঘোড়ায় করে এসেছেন। কাশেমকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবেন। ঘোড়ার পেছনে একদল গ্রামবাসী। গ্রামবাসীর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যে এক যুবক এগিয়ে এল, সে রীতিমতো পাংক। মাথা কামানো–মাঝখানে এক চিলতে চুল। নওয়াজীশ আলী খানের মেজাজ গেল বিগড়ে। তিনি তাকে নেবেন না। ছেলে অভিনয় করবেই। শেষ পর্যন্ত রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে তুমি আসো ঘোড়ার পেছনে পেছনে। ছেলে দু পা এগুতেই ঘোড়া প্রচণ্ড লাথি দিয়ে ছেলেকে শুইয়ে দিল। আমরা বললাম–সাবাস ঘোড়া। পাংকবিহীন দৃশ্য ধারণ করা হলো।
দুঃখময় স্মৃতি
আমার সব ধারাবাহিক নাটকে যা হয়–একদল মানুষ ক্ষেপে যান। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমাকে নারীবিদ্বেষী হিসেবে দেখানো হলো। কঠিন সব চিঠি ছাপা হলো। একটি লিখলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈকা অধ্যাপিকা। একটি সংলাপে মীর্জার মা’র চরিত্রে রূপদানকারী মিসেস দিলারা জামানও আপত্তি করলেন। সংলাপটি হচ্ছে, ঢোল, পশু ও নারী–এদের সব সময় মারের উপর রাখতে হয়।
সংলাপটি দেওয়ার উদ্দেশ্য সমাজে এই সময়ের নারীর অবস্থান বোঝানো। আজ এই কথা কেউ বলবে না, কিন্তু তখন বলত। ময়মনসিংহের একটি প্রবচন হচ্ছে, ‘জরু ও গরুকে মারের উপর রাখতে হয়’। তারও আগে যদি যাই তাহলে দেখি রামায়ণেও এই উক্তি আছে। তুলসী দাসের রামচরিত মানসে লেখা—
‘ঢোল, গবার, শুদ্র, পশু, নারী–এদের মারের উপর রাখতে হয়।’
আমি এ-জাতীয় সংলাপ ব্যবহার করছি বলেই এটা আমার মনের কথা তা মনে করার কোনো কারণ নেই।‘ বহুব্রীহি’তে এমদাদ খোন্দকার বলতেন, “মেয়েছেলের পড়াশোনার কোনোই দরকার নাই–তারা থাকবে রান্নাঘরে”। এটা এমদাদ খোন্দকারের কথা। আমার না। অথচ শিক্ষিত লোকজন ভেবে বসলেন, প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষ নিয়ে আমি ‘অয়োময়’ লিখছি। কী অসম্ভব কথা!
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এক অংশ তিন তালাকের একটি দৃশ্যেও খুব আহত হলেন। আমি দেখিয়েছিলাম রাগের মাথায় তিনবার ‘তালাক’ বললেই তালাক হয় না। তাঁরা বললেন–হয়। অথচ আমি খুব ভালোমতো জেনেশুনেই নাটকে এই দৃশ্য ব্যবহার করেছি। মুসলিম পারিবারিক আইনেও বলা আছে–পরপর তিনবার তালাক বললেই তালাক হবে না। এই আইন বড় বড় আলেমদের সাহায্যে হাদিস কোরআন ঘেঁটে তৈরি করা। আমার বিপক্ষে কঠিন কঠিন সব চিঠি একের পর এক ছাপা হতে লাগল। হায়, একজন কেউ আমার পক্ষে একটি কথা বললেন না।
শেষ কথা
রচনাটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। এখন শেষ করা উচিত। সুন্দর কিছু কথা বলে শেষ করলে ভালো হতো। অন্য ধরনের কিছু কথা দিয়ে শেষ করি–
নাটকের চতুর্থ পর্ব প্রচারের পর আমার স্ত্রী একটি অসম্ভব রূপবান ছেলের জন্ম। দিলেন। ছেলেটি দু’দিন বেঁচে রইল, তৃতীয় দিনের দিন মারা গেল। শোক ও দুঃখে পাথর হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে নিয়ে ঘরে ফিরেছি। বাচ্চারা চিৎকার করে কাঁদছে। আমার মা’কে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আর আমি কী করছি–মাথা নিচু করে লিখে যাচ্ছি অয়োময়ের নবম, দশম পর্ব। আমি দু’দিন পর আমেরিকা চলে যাব। আমাকে পাণ্ডুলিপি দিয়ে যেতে হবে। নাটক যেন বন্ধ না হয়–’Show must go on.’
লিখতে লিখতে হঠাৎ কী মনে হলো। বিছানায় শুয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকালাম। দেখি সে জলভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে, এই পাষাণ হৃদয় মানুষটির সঙ্গে আমার বিয়ে হলো?
আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। মাথায় হাত রাখলাম না। সান্ত্বনার কথাও কিছু বললাম না। আমার হাতে সময় নেই। আমার কাজ শেষ করতে হবে
‘I have promises
to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep.’
একদিন আমার সব কাজ শেষ হবে। চাঁদনী পহর রাতে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হব। তখন এ জীবনে সঞ্চিত সমস্ত ব্যথার কথা ভেবে চিৎকার করে কাঁদব। আজ আমার কাঁদার অবসর নেই। have promises to keep.