অয়ন
কীপড়ছিস রে টুঁই? খাবার টেবলে বই খুলে বসে-থাকা টুঁইকে তার দিদি টুসি প্রশ্ন করল।
Whitman, Walt Whitman. কখনো পুরোনো হয় না আমার কাছে। ‘Leaves of Grass’।
কী?
All Truths wait in all things,
They neither hasten Their own delivery nor resist it.
They do not need the obsteric forceps of a Surgeon,
The insignificant is as big to me as any.
Logic and Sermons never Convince,
The damp of the night drives deeper into my Soul.
বা:।
টুসি বলল।
ক-টায় এলার্ম দিলি রে টুঁই?
ওদের মা দিতি বললেন।
চারটেতে।
তোর যা ঘুম। ভাঙলে হয়।
তুমি চিন্তা কোরো না তো মা। সারাপৃথিবী চড়কি মেরে বেড়াতে হচ্ছে। বম্বে থেকে যখন ভোরের ফ্লাইট ধরে এখানে আসি তখন কি কেউ তুলে দেয়? না তুমি থাকো সেখানে? বম্বে পৌঁছেই তো আমস্টারডাম যেতে হবে তিনদিনের জন্যে। আমি কি তোমার সেই ছোটো টুসিটি আছি?
থাকলেই খুশি হতাম। আমি তো বম্বেতে থাকি না, আমি জানব কী করে!
তারপর বললেন, চা খাবি কি সকালে?
না। না। এয়ারপোর্টে গিয়েই খাব।
রাতে খাবার টেবলে বসেই কথা হচ্ছিল। শ্রমণ চাটুজ্যের পরিবার যখন কলকাতাতে একসঙ্গে হয়, তখনও শুধুমাত্র খাবার টেবলেই দেখা হয় সকলের সঙ্গে সকলের। অন্য সময়ে প্রত্যেকেই যার যার ঘরে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সকলে বলতে, বড়ো মেয়ে টুসি, ছোটো মেয়ে টুঁই, তাদের মা দিতি এবং শ্রমণ।
শ্রমণ চারবছর হল অবসর নিয়েছেন চাকুরি থেকে। এখন এখানে-ওখানে লেখালেখি করেন। সময়ও কাটে। কিছু অর্থাগমও ঘটে। তাঁর বিষয় ছিল অর্থনীতি। কিন্তু বাংলাতে গল্প-উপন্যাসও লেখেন। চাকরি বলতে, অধ্যপনা করেননি বটে, তবে কাজটা ছিল অধ্যাপনা ঘেঁষাই।
দিদি, তুমি হোটেল থেকে ফ্ল্যাটে কবে শিফট করবে?
ঢাঁই জিজ্ঞেস করল টুসিকে, বড়ো চামচ দিয়ে ডালের পাত্র থেকে ডাল তুলতে তুলতে।
ডাল খেতে এতই ভালবাসে টুঁই যে, শ্রমণবাবুর ইচ্ছেতে যদি ও বিয়ে করত, তবে কোনো ডালকলের মালিকের সঙ্গেই ওর বিয়ে দিতেন উনি। কিন্তু বাবার, এমনকী মায়ের ইচ্ছেতেও বিয়ে করার যুগ কবেই চলে গেছে! নিজেদের ইচ্ছার অনেকই ডিমগুলি ফুটি-ফুটি করেও ফোটে না।
টুঁই ব্যাঙ্গালোর থেকে এম. এ. শেষ করে এসেছে এই ক-দিন হল। কিন্তু আবার ও চলে যাবে জুনের শেষে এম. ফিল-এর জন্যে। রিটন-টেস্ট দিয়ে এসেছে। তবে ফিরে গিয়েই VIVA আছে। যদি পায়, তাহলে আরও দু-বছর। তবে, পেয়ে হয়তো যাবে।
কেন? একথা কেন জিজ্ঞেস করছিস?
টুসি জিজ্ঞেস করল টুঁইকে।
যা একটি কেবলি তুমি! তাইতো আমি মাকে বলি! যে, এখনও নিজের জন্যে জামা কিনতে পারে না একটা, নিজে পছন্দ করে, সে আবার নিজের বর পছন্দ করবে। ঘর গোছাবে!
থাক। আর পছন্দ করেছে। তিরিশ বছর বয়স হতে চলল।
দিতি বললেন, আমার মা বলতেন—
‘‘অতি বড়ো বরণী না পায় বর
অতি বড়ো ঘরনী না পায় ঘর।’’
টুঁই বলল, দিদি, তুমি আমাকে যেমন আমার ইউনিভারসিটির ক্যাম্পাসে সেটল করিয়ে দিয়ে এসেছিলে ব্যাঙ্গালোরে, মনে আছে? বাক্স-প্যাঁটরা-কুঁজো-বালতি সুদ্ধু? তুমি ভুলতে পারো, কিন্তু আমি ভুলিনি। আমার বিবেক বলে কোনো বস্তু নেই নাকি?
তুমি যখন শিফট করবে, অবশ্যই জানাবে আমাকে। আমি নিশ্চয়ই যাব বম্বেতে তোমাকে হেল্প করতে। দিস ইজ মাই টার্ন। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ আর ‘দ্যা ওয়ার্লড’-এ লিখে যে টাকা পেয়েছি গত দু-বছরে তাতে ব্যাঙ্গালোর থেকে বম্বে যাওয়া-আসার প্লেন-এর টিকিট হয়ে যাবে। কিন্তু আগে না জানলে যদি টিকিট পেতে অসুবিধা হয়?
শ্রমণ ওদের কথা শুনছিলেন। বললেন, কল্যাণকে বলে দেব। টিকিটের কোনো প্রবলেম নেই।
কে কল্যাণ?
কল্যাণ মজুমদার। আই. এ. সি’র ইস্টার্ন জোন-এর কমার্শিয়াল ম্যানেজার ও। কল্যাণ ভালো লেখকও।
তাই? কিন্তু ইস্টার্ন জোন!
তুই টিকিট পেলেই তো হল।
শ্রমণ বললেন, মেয়েকে আশ্বস্ত করে।
শ্রমণ চ্যাটার্জির এই পরিবার মাতৃতান্ত্রিক। তাঁর ভূমিকাটা এখানে নিতান্তই গৌণ। তবে, মানে, আগেকার দিনে খাসিয়া বা মণিপুরী পুরুষদের জীবন যেমন ছিল, তেমন বাড়ি বসে যে আরাম করবেন, একটু নেশা-ভাঙ করবেন কিংবা ইচ্ছে হলে হরির নামও, তারও উপায় নেই কোনোই। উনি সংসারে আছেন। অথচ নেইও। শ্রমজীবী এখনও। অবসর নিয়েও, শ্রমণই! প্রব্রজ্যাতে যতি পড়েনি। দায়-দায়িত্ব অবশ্যই আছে, অনেকই আছে। কিন্তু তিনি পুরোনো দিনের যৌথ পরিবারের অতিসাধারণ সহায়-সম্বলহীন অব্যবহৃত আসবাবের সমগোত্রীয় অবসরপ্রাপ্ত অবিবাহিত আত্মীয় পুরুষেরই মতন। খাওয়া-দাওয়া সবই সময়েই জোটে কিন্তু জীবনটা একটা অর্নামেন্টাল সিংহাসনের মতনই হয়ে গেছে। সবাই দেখে যায়। বসে না কেউই। কারোই কাজে লাগে না সেই আসন। এই সংসার এবং এই সংসারের সভ্য অন্য সকলের জীবন তাঁর চতুর্দিকে সততই বেগে এবং সশব্দে আবর্তিত হয় কিন্তু তিনি নিজে সেই সব ক্রিয়াকান্ডের নিছক নীরব দর্শকমাত্র। অন্যদের সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের জীবনকে প্রতিমুহূর্তে প্রভাবিত করে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তেই তাঁর নিজের বিন্দুমাত্র ‘Say’ নেই। তিনি শালগ্রাম শিলার মতন বসে থাকেন। অথচ সবসময়েই হেঁটে যাচ্ছেন মনে মনে। দাঁড়িয়ে থাকা গাছেরা যেমন হাঁটে।
আজকাল বাড়ির বাইরে বড়ো একটা যান না। কারও সঙ্গেই মেশেন না। বইপত্র নিয়েই থাকেন। জীবনের অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে এসে চারিদিকে, নির্লজ্জ নগ্নস্বার্থ। আর ভন্ডামির দোর্দন্ড প্রতাপ দেখে দেখে সমাজ, সংসার, জীবিকা, বন্ধুতা, প্রেম এমনকী জীবন সম্বন্ধেও একধরনের গভীর অনীহা জন্মে গেছে তাঁর। হয়তো অসূয়াও। শ্রমণবাবু জানেন যে, এটা আদৌ ভালো নয়। কিন্তু উনি নিরুপায়।
আলোড়ন কি ওঠে না? কোনো আন্দোলনই কি অনুভূত হয় না?
হয়।
তবে, সবই ভেতরে ভেতরে। সমুদ্রের অতল জলের নীচে তো পাহাড়, বন, নদী, পথ, সাঁকো সবই থাকে। প্রচন্ড বেগে বয়ে যায় জলস্রোত জলেরই মধ্যের সেইসব কক্ষপথ দিয়ে। কিন্তু ওপরের জলস্তরে তো তার কোনোই প্রভাব পড়ে না।
টুঁই আবারও বলল, তুমি যবেই শিফট করো দিদি, আমাকে দিন সাতেকের নোটিস দিও কিন্তু। আমারও কিন্তু ফিরে যেতে হবে ব্যাঙ্গালোরে এ মাসের শেষেই। তার আগেই কোরো শিফট।
হুঁ।
তোর বাড়িটা কেমন রে? বাংলো?
টুসির মা দিতি জিজ্ঞেস করলেন বড়ো মেয়েকে।
কী যে বলো! বম্বেতে বাংলো? অবভিয়াসলি ফ্ল্যাট।
টুঁই বলল মাঝে পড়ে, যেন ও-ই শিফট করছে।
বম্বে-ব্যাঙ্গালোর-দিল্লি কি কলকাতা নাকি?
কত ডিপোজিট আর কত ভাড়া জানো? অঙ্ক শুনেই মাথা ঘোরে। বিরাট বিরাট পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এবং মাল্টি ন্যাশনালসরাই শুধু এইসব ক্রিয়াকান্ড করতে পারে।
টুসি বলল।
ছাদ আছে?
দিতি জিজ্ঞেস করলেন।
ফ্ল্যাট-বাড়িতে ছাদ থাকলেই বা কী? তুমি যেমন তোমাদের নর্থ ক্যালকাটার বাড়ির ছাদে তোমার যৌবনে মনের সুখে মুখে সর মেখে বা মাথায় টক দই বা ডিমের কুসুম মেখে বসে থাকতে তেমন তো আর থাকা যায় না! ফ্ল্যাট-বাড়ির ছাদে প্রাইভেসি কোথায়?
টুঁই বলল।
চাঁদের আলোতে বসে শরৎচন্দ্রের ‘‘পরিণীতা’’ বা বুদ্ধদেব বসুর ‘‘তিথিডোর’’ পড়া যায় না অথবা প্রেমপত্র লিখে ইটের টুকরো দিয়ে গোল্লা পাকিয়ে সে প্রেমপত্র ছুড়েও দিতে পারা যায় না পাশের বাড়ির ছাদে।
শ্রমণবাবু বললেন।
দিতি সঙ্গে সঙ্গে সর্পদ্রংস্ট্রার মতন বললেন, যার যা ভাবনা। গাঁইয়া আর কাকে বলে ওয়ান-ট্র্যাক মাইণ্ড।
তারপরই টুসিকে আবারও বললেন, ছাদ আছে কি না বল না?
আছে। ফ্ল্যাট যদিও কিন্তু বাড়িটা মাল্টিস্টোরিড অ্যাপার্টমেন্ট নয় মা। দোতলা বাড়ি। আমি দোতলাটাই নিচ্ছি। নিরিবিলি পাড়ায়। ছোটো ছোটো, কিন্তু তিনটে বেডরুম। আর ছাদটা খুবই সুন্দর। গাছ-গাছালি দেখা যায়। সবুজ পাখ-পাখালি।
তারপরই আদুরে গলাতে বলল, এখন তোমাকে বলি মা যে, ছাদটা আমারই এক্সক্লুসিভ।
তাই? তার মানে, প্রাইভেসি থাকবে। ওয়াও! সান-বেদিং করবে? দিদি? তুমি? সোৎসাহে টুঁই বলল।
দিতি বললেন, বাড়িটা সেফ পাড়াতে তো? দেখে, O.K. করে দিয়েছিস? একা থাকবি। ভয় করে।
হ্যাঁ। ডিপোজিটের চেকও দেওয়া হয়ে গেছে, এগ্রিমেন্টও সই হয়ে গেছে।
টুঁই আবার বলল, কদম গাছ আছে দিদি? আমাদের কলকাতার এই ভাড়াবাড়ির সামনের রাস্তায় যেমন আছে?
না। আর থাকলেই বা কী! সেখানে কোন কেষ্ট দাঁড়িয়ে থাকবে বাঁশি হাতে তোর জন্যে?
শ্রমণবাবুর মনে হল যে, বলেন, থাকলে কী! রাধাদের সময় কোথায় এখন? দৌড়! দৌড়! শুধুই দৌড়। দিতিদের প্রজন্মে তাঁদের হাতে যে অঢেল মন্থর সময় ছিল তা কি আর ওদের আছে? মন্দ-মন্দ বায়ু-বওয়া বকুল বা চাঁপা-গন্ধি উড়ু উড়ু সময়? আহা!
একটু স্যালাড, প্লেটে তুলে নিলেন শ্রমণবাবু। ভাবছিলেন, যখন টুসি আর টুঁই ওঁদের বয়সে এসে পৌঁছোবে, ষাটের কোঠায়, তখন টুঁই ও টুসির ছেলে-মেয়েরাও (যা দিনকাল! যদি, আদৌ তারা আসে) হয়তো বলবে, এই একই কথা। প্রত্যেক নারী ও পুরুষের ‘সময়ই’ তার নিজের ‘নিজস্ব’’। কারও সময়ের সঙ্গেই অন্য কারও সময়ই তুলনীয় নয়।
সময়ের রকম, আয়তন, ক্রমাগতই বদলে যায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
ফোনটা বাজছিল শ্রমণবাবুর ঘরে। প্রফুল্ল গিয়ে ধরল। তারপর এসে বলল, প্রাণময়বাবু ফোন করেছেন বাবু।
শ্রমণবাবু উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলেন।
বলো প্রাণময়, কী খবর?
প্রাণময়, শ্রমণবাবূর ইনকামট্যাক্সের উকিল। অ্যাডভোকেট। ছেলে খুবই ভালো। দোষ একটা। তার ধারণা, আয়কর এবং প্রাণ সমার্থক। আয়কর আইনই প্রাণময়ের প্রাণবায়ু।
উনি তো মানতে চাইছেন না দাদা?
বলছেন যে, রিভাইসড-রিটার্ন দিয়ে ট্যাক্স আরও বেশি ভরে দিলে, ছেড়ে দেবেন।
আরও ট্যক্স? কোন আইনে? এবং কোথা থেকে ছাড়বেন উনি আমাকে? খোঁয়াড়?
হ্যাঁ দাদা।
খোঁয়াড়?
না দাদা, জেল।
ভরে কি দিয়েছেন ইতিমধ্যেই?
না, না।
তোমার কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। সব-কটি পয়েন্টসই আগুন করেছিলে তো? যেগুলো লাস্ট মীটিং-এ তোমাকে বলে দিয়েছিলাম?
সব।
প্রাণময়, তুমি একটি ওয়ার্থলেস। কিছু মনে কোরো না। প্রাণময় হয়েও তোমার বড়োই প্রাণভয়। প্রয়োজনে, উকিলদের অত্যন্ত মুখর এবং দুর্বিনীতও হতে হয়। যে হাকিম যেমন ভাষা বোঝেন তাঁর সঙ্গে সেই ভাষাতেই কথা বলতে হয়। যদি কেউ আস্তে বললে না শোনেন তবে, তাঁকে জোরে বলতে হবে বই কী! তবে ঝগড়া বা অসম্মান করে নয়। আবার চিৎকার করে বললেই যে সব কথা বোঝানো যায়, তাও নয়। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে ওয়েভ-লেন্থ। তাঁর ওয়েভলেন্থ-এই তোমাকে কথা বলতে হবে। উনি এফ. এম-এ অবস্থান করলে তুমি যদি মীডিয়াম ওয়েভ-এ কথা বলো, উনি শুনতে পাবেন কী করে? ওঁর ওয়েভ লেন্থটা কী? সেটা আগে বোঝো। জানো।
হ্যাঁ দাদা। আমি জানি।
জানো! তা আমাকে কী করতে বলো? অসৎ মানুষের অত্যাচারও যেমন অত্যাচার, সৎ মানুষের অত্যাচারও অত্যাচার। সততার হাত ধরে অত্যাচার এলে তা মেনে নিতে হবে এমন শিক্ষা আমার পাঠশালাতে শেখায়নি।
কোন পাঠশালা দাদা?
জীবনের পাঠশালা।
কুড়িতারিখ দিন দিয়েছেন।
যা মনে করো, তুমি করো। তুমিই তো আমার উকিল।
কী করব দাদা?
প্রাণময়, তোমার যা খুশি করো। আমি কালই রাতে মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড়ের জঙ্গলের পটভূমিতে একটি উপন্যাস শুরু করে একেবারে তার ভেতরে সেঁধিয়ে গেছি।
পড়া শুরু করেছেন?
না না, লেখা। আমাকে বিরক্ত কোরো না এখন। উপন্যাসের যে অধ্যায়ে আছি, সেই অধ্যায়ে এখন গভীর রাত। কলকাতা থেকে সদ্য-যাওয়া বি. কম. পাস অ্যাকাউন্ট্যান্ট নায়ক প্রকৃতিহত হয়ে গেছে বাসন্তী চাঁদের রাতে। বাইরে ফুটফুটে ডাইনি-জ্যোৎস্নার মধ্যে প্রকান্ড এক মহীরূহ শিমূলগাছের মগডালে একটা বড়ো, কালো তীক্ষ্ণ-চঞ্চু পাখি বসে আছে। মারুতি পানকা তার নাম বলেছে ‘মোরাঙ্গী’।
মোরাঙ্গী?
হ্যাঁ।
মারুতি পানকা কে?
সে আমার উপন্যাসের এক চরিত্র। যখন পড়বে তখনই জানবে।
পুজো-সংখ্যাতে বেরোবে বুঝি?
হ্যাঁ।
কোন কাগজে?
জানি না। আগে রাজকন্যেকে ডাগর তো করে তুলি। তারপর তো পাত্রস্থ করার কথা উঠবে। স্বয়ংবর-সভা বসাব। কিন্তু প্রাণময়, তুমি সাহিত্য-টাহিত্য পড়া ছেড়ে দাও। ইনকামট্যাক্স আর সাহিত্য আদৌ কমপ্যাটিবল নয়। ইনকামট্যাক্সকে আইনস্টাইন থেকে হেমিংওয়ে সকলেই ভয় পেতেন। একে অন্যের পক্ষে, এরা বিষমই ক্ষতিকর। আর শোনো! শোনো! সেই পাখিটা এখুনি যেন একবার ডাকল। আমার বুকের মধ্যে। ‘‘কীরে! কীরে! কি কি কি?’’ এখন আমার মনোজগতে আদৌ কোনো গোলমাল ঘটিও না প্রাণময়। ঘটালে, পাখিটা হয়তো উড়ে যাবে। চাঁদ মরে যাবে। ডাইনি-জ্যোৎস্নার মধ্যে ছায়ার রুমালেরা ওড়াউড়ি করবে।
কী করব দাদা?
একটু চুপ করে থেকে শ্রমণবাবু বললেন, তুমি বরং একটা কাজ করো।
কী দাদা?
একটা অ্যাম্পলিফায়ার ভাড়া করে নিয়ে গিয়ে তাঁদের বলে এসো জনে জনে, সব ক্ষমতাবান ডি. সি. এ. বি, এ. বি. সি. ডি.-দের যে, ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের বাইরে, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বাইরে, প্রবল প্রতাপশালী মিডিয়ার অফিসের বাইরেও সুন্দর এবং মস্ত বড়ো একটা জগৎ আছে। যেখানে ফুল-গন্ধ বয়ে নিয়ে যায়, হাওয়া এখনও দৌড়াদৌড়ি করে, প্রথম ভোরে যেখানে পাখি ডাকে, প্রজাপতি ওড়ে, ডাইনির মতন বনজ্যোৎস্না, তার বুকের কাঁচুলির সবুজ অন্ধকারের ঘেরাটোপের মধ্যে আরণ্যক পৃথিবীর সব রহস্য এবং সুগন্ধ এখনও লুকিয়ে রাখে, যেখানে ‘মোরাঙ্গী’ পাখি উজলা রাতে বুকের মধ্যে চমকে দিয়ে চকিতে শিহরতোলা চিকুর-তোলা ডাক ডেকে ওঠে : ‘‘কীরে? কীরে? কি কি কি?’’
তারপরই বললেন, ফোন ছাড়ছি প্রাণময়, আমাকে বিরক্ত কোরো না।
ওরা খাওয়া শুরু করেছিল। শ্রমণবাবু চেয়ার টেনে বসলেন।
বাবা, তুমি কি এক টুকরো ছানা নেবে?
টুসি বলল, উনি টেবলে ফিরে গিয়ে বসতে।
না:।
তারপর বললেন, তুই আবার কবে আসবি রে কলকাতায়?
মাত্র তিনদিনের জন্যে এসেছিল মেয়েটা, কাল ভোরেই চলে যাবে। মনটা খারাপ লাগছে ওঁর। আসলে মনটা খারাপই হয়ে আছে আজ সকাল থেকেই, ব্রতীনের মৃত্যু সংবাদটা পাবার পর থেকেই। শ্রমণবাবুর সমসাময়িকরা সবাই সারিতে দাঁড়িয়ে গেছেন।
কেউ আগে যাবেন, কেউ পরে। জীবনটা যে কত ছোটো এবং এ জীবনটা নিয়ে করার মতন কিছুই যে করা হল না, এই কথা কেবলই মনে হচ্ছে ব্রতীনের মৃত্যু-সংবাদটা পাওয়ার পর থেকেই। বাল্যবন্ধু। মিহিজাম-এর আউটস্কার্টস-এ সেটল করেছিল রিটায়ার করার পর অনেক জমি নিয়ে। যে গাছগুলো লাগিয়েছিল তাদের ছায়ায় একটু বসে যাওয়ার সময় পেল না বেচারা। গাছ খুব ভালোবাসত ব্রতীন।
টুসি শ্রমণবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বলল, দেখি! এই মাসে কি আর হবে? তারপর শিফটিংও তো এই মাসেই করতে হবে। তা ছাড়া কলকাতাতে মীটিং ছিল বলেই তো আসা হল। নিজের খরচে আসার কি উপায় আছে বাবা? ইকনমি ক্লাসের ভাড়াই তো সাংঘাতিক। আর আজকাল কম্প্যুটার-এর জন্যে হঠাৎ করে ট্রেনের টিকিট পাওয়া তো অসম্ভবই। ট্রেনে আসতে সময়ও অনেক লাগে।
তোর নতুত অ্যারেঞ্জমেন্ট?
পেয়েছি বাবা। আজই পেলাম বিকেলে। অফিসে। তোমাকে দেখাতাম, খেয়ে উঠেই।
আমি দেখে আর কী করব? বল না। কত পাবি এখন বছরে?
সব কিছু নিয়ে, মানে রি-ইমবার্সমেন্ট-টেন্ট নিয়ে-টিয়ে, তিন মতন।
তিন লাখ?
হ্যাঁ। বছরে।
তারপর বললেন গাড়ি-টাড়ি?
হ্যাঁ। গাড়ি তো দেবেই। গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদির Bills-ও দেবে। চিকিৎসার খরচ। ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনোর খরচ। আজকালকার পে-স্কেল এর স্ট্যাণ্ডার্ডে এই এমল্যুমেন্টস কিছুই নয়।
ফু:। ওসব খরচ তো দেয়ই! কবে বিয়ে করবি, করবি কি না তারই ঠিক নেই, তার ছেলে-মেয়ে। গাছে কাঁটাল গোঁফে তেল।
টুসির মা দিতি চিড়বিড়িয়ে উঠে বললেন, আক্ষেপের সঙ্গে বিরক্তি মিশিয়ে।
শ্রমণবাবু স্বগতোক্তির মতন বললেন, মানে বারো দিয়ে ভাগ করলে মাসে পঁচিশ হাজার মতন! তোর মতন বয়সে…। সত্যি। খাওয়া-থাকা অবশ্য বাবার হোটেলেই হত। তোর তুলনাতে আমি গরিব ছিলাম বহু বহু বহুগুণ। অবশ্য তোর যোগ্যতাও আমার চেয়ে অনেকই বেশি।
ট্যাক্সেই তো সব চলে যাবে।
টুসি বলল।
তা ঠিক। এদেশে সকলেই ট্যাক্স দিলে, যারা দেয়, তাদের ওপর তো চাপ পড়ত না। যারা দেয়, তাদেরই গর্দান যায়। আর যারা দেয় না, তারাই বাহাদুর!
তারপর একটু চুপ করে থেকে শ্রমণবাবু বললেন, একথা ঠিক যে, যৌবনের অনেক শখই আমার পূরণ হয়নি। তোর মায়েরও। শখ আর স্বপ্নে মানুষে যে বয়সে, যে সময়ে, ভরপুর থাকে, ঠিক সেই সময়েই পুরণ হয়নি। আমাদের অভাব ছিল অনেকই। পরে, সামর্থ্য হয়তো এসেছিল কিন্তু সেই সময়টা তো, বয়সটা তো আর ফিরে আসেনি। কারও জীবনেই আসে না। তোর মায়ের তো প্রায় কোনো শখই পূরণ করতে পারিনি আমি। কিন্তু তবু আমাদের সেই সময়কার জীবনে তোদের জীবনের মতন এমন দৌড়াদৌড়ি ছিল না। এত টেনশান ছিল না মোটেই। অভাব ছিল অবশ্যই কিন্তু অভাবের বোধটা আজকের মানুষদের মতন অমন তীব্র ছিল না। আমাদের যা মাইনে ছিল, যেমন জীবনযাত্রা ছিল, তাতেই আমরা সুখী মনে করতাম নিজেদের।
ওই! আজকালকার পৃথিবীটাই ওরকম বাবা। আইদার উ্য রান অর উ্য ড্রপ ডেড।
বড়ো মেয়ে টুসি বলল। প্লেটে রাইতা তুলতে তুলতে।
টুঁই বলল, উই হ্যাভ নো চয়েস। নো চয়েস অ্যাট অল।
একটু কি যতি দিতে পারিস না? একটু থামা, একটু ভাবা, একটু একা থাকা, টু কারেক্ট ইওর বেয়ারিংস।…
শ্রমণবাবু বললেন। অতিসাধারণ বাবা, অসহায়ের মতন, তাঁর কৃতী সন্তানদের।
ভাবি প্রায়ই। ভাবি না যে, তা নয় বাবা।
টুসি বলল।
বলেই বলল, কিন্তু কী জানো? সেই ওয়ার্লড-চ্যাম্পিয়ন বক্সার জো লুই একবার বলেছিলেন না?
কী? কী বলেছিলেন?
‘‘উ্য ক্যান রান, বাট উ্য কান’ট হাইড।’’ পালাতে তো চাই-ই, কিন্তু পারি কোথায়?
চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে টুসি বলল, চারমাস ছুটি চেয়েছি ম্যানেজমেন্ট-এর কাছে।
তারপরই বলল, হ্যাঁ: বিশ্রাম তো দূরস্থান। বিয়ে করারই পর্যন্ত সময় পেলাম না। তাই জন্যেই…
বিয়ে? কারও সঙ্গে তেমন করে মেশবারই সুযোগ ও সময় পেল না দিদি!
টুঁই বলল।
দেবে? ছুটি? নতুন জায়গাতে জয়েন করার পর পরই কি চারমাস ছুটি দেবে? এত দায়-দায়িত্ব দিল তোকে!
না দিলে, চাকরিই ছেড়ে দেব।
এমন চাকরি! বলিস কী রে!
শ্রমণবাবু আতঙ্কিত হয়ে বললেন।
চাকরির অভাব নেই বাবা। সবই গিভ অ্যাণ্ড টেক-এর ব্যাপার। কোম্পানিও আমাকে দয়া করছে না আমিও কোম্পানিকে দয়া করছি না।
শ্রবণবাবু মনে মনে মেয়ের জন্য গর্বিত হলেন। এই তো চাই। এরকম সেলফ কনফিডেন্স! আত্মবিশ্বাসের চেয়ে বড়ো সম্পদ একজন মানুষের আর কী থাকতে পারে? আর ঈশ্বরবিশ্বাস। তবে উনি জানেন না, টুসির ঈশ্বরবিশ্বাস আদৌ আছে কি না! রিচুয়ালস-এ অবশ্য বিশ্বাস করে না ও। অষ্টমীর দিনে অঞ্জলি দিত আগে আগে। আজকাল তাও দেয় না। পুজোর মধ্যে, কলকাতাতে থাকলে, আজকাল ঘুমোয়ই শুধু পড়ে। একটা নতুন শাড়ি পর্যন্ত পরে না। এতই ক্লান্ত থাকে।
তারপর, ভাবলেন শ্রমণবাবু, সব রিচুয়ালসই তো সাধারণদেরই জন্যে। রিচুয়ালস-এ বিশ্বাস থাকার কোনো প্রয়োজনও তো নেই সকলের। ঈশ্বরবোধের সঙ্গে এইসব রিচুয়ালস-এর কোনো সম্পর্কও নেই। উনি নিজেও অঞ্জলি দেননি কখনো কলেজে ওঠার পর থেকে কিন্তু তা বলে তাঁর ন্যায়-অন্যায় শুভাশুভবোধকে বিসর্জন দেননি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তা বরং আরও গভীর হয়েছে। ঈশ্বরবোধের সঙ্গে ন্যায়-অন্যায়বোধও যে জড়িয়ে আছে। থাকে।
বিয়ে করা তো আর তোর হাজারিবাগের বড়ো দাদুর মতন শোনপুরের মেলাতে গিয়ে গাই-বলদ কেনা নয়, যে গেলি আর গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে এলি একটাকে, আর সেও হাম্বা! হাম্বা! করতে করতে তোর পেছন পেছন এলো!
বিরক্ত গলাতে দিতি বললেন।
উদ্ধত টুঁই মুখে বলল, দিদিকে সাপোর্ট করে, তোমাদের সময়ে জীবন তো এমন ছিল না মা! উই হ্যাভ টু স্ট্রাগল ফর আওয়ার এগজিসটেন্স! প্রতিপদেই যুদ্ধ।
শ্রমণবাবু মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু মনে পড়ে গেল যে, বাট্রাণ্ড রাসেলের লেখাতে পড়েছিলেন ছাত্রাবস্থাতে, তাঁর ‘Conquest of Happiness’ বইয়ে যে, “We do not struggle for existence. We struggle to outshine our neighbours”
কে জানে! বার্ট্রাণ্ড রাসেলের সময় আর আজকের টুসি আর টুঁইদের সময়ের মধ্যে বোধহয় বিস্তরই ব্যবধান হয়ে গেছে। এখন প্রশ্নটা হচ্ছে এই, “Existence”-এর ব্যাখ্যাটা বদলে গেছে কি না? ওঁদের সময়ে যতটুকুতে হেসেখেলে বাঁচা চলত আজকে তার চেয়ে অনেকই বেশি লাগে। এই বাড়তি যা, তার প্রয়োজন সত্যিই ছিল না বা তার অনেক কিছু না হলেও ‘‘চলত’’ কি না? এইটিই প্রশ্ন।
কিন্তু প্রশ্নটা বা করেন কাকে? আর উত্তর বা দেয় কে?
শান্ত টুসি তার বক্তব্যে ফিরে বলল, তা না মা! কারওকে ভালো লাগলে বিয়ের আগে মেলামেশা করতেও তো কিছু সময় লাগেই। কত ছেলেই তো বিয়ে করতে চাইল। তারা চাইলেও আমি যে মন স্থিরই করতে পারলাম না। তা ছাড়া তুমি কি ভাবো যে, বিয়েটা তাবৎ সুখ-শান্তির গ্যারান্টিড ক্যাপসুল? আমার যে-সব বন্ধু সময়েই মানে পঁচিশ ছাব্বিশের মধ্যেই বিয়ে করেছিল, প্রেসিডেন্সির, ইউনিভারসিটির, তারা কি সকলেই সুখী? তুমি তো চেনোও তাদের মধ্যে অনেককেই। কতজনের তো ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে এরই মধ্যে। তারাই কেউ কেউ বলে, যে, তারা আটারলি অসুখী ছিল। তাই এখন বিয়ের কথা ভাবতেও ভয় পাই। সত্যিই ভয় পাই।
ম্যারেজেস আর মেড ইন হেভেন। দুগগা বলে ঝুলে পড়তে হয়।
দিতি বললেন।
তারপর বললেন, আমাদের সময়ে অত ভাবাভাবির অবকাশই ছিল না।
তা ছাড়া তোদের মতন অত চয়েসও ছিল না আমাদের। নইলে, তোর বাবাকে আমি বিয়ে করি!
তোমাদের দিন আর আমাদের দিনে আকাশ-পাতাল তফাত মা। তবুও আমারও তাই মনে হয়।
টুঁই বলল।
কী মনে হয়?
অসকার ওয়াইল্ড তাঁর পিকচার অফ ডরিয়ান গ্রে’র মুখবন্ধে লিখেছিলেন না? সাহিত্যকর্ম ভালো অথবা খারাপই হয়। শ্লীলতা-অশ্লীলতা সাহিত্যর বেলাতে কোনো ব্যাপারই নয়, বিয়েটাও সেইরকমই। দেয়ার আর ব্যাড ম্যারেজেস অর গুড ম্যারেজেস। দেয়ার নাথিং ইন-বীটউইন। তোমাদের মতন ‘‘ইনডিফারেন্ট’’ ম্যারেজ ইজ নো ম্যারেজ অ্যাট অল।
তারপই আদুরে গলায় ছোটো মেয়ে টুঁই বলল মা-আ-আ! আমি কিন্তু Uttertly Butterly Delicious একটা বিয়ে করব দেখো।
দিতি কিছু বলার আগেই টুসি বলল, হুঁ। বিয়ে যেন চকোলেট-কেক! আমি ভাবছি, একটা বাচ্চা অ্যাডাপ্ট করব। বাচ্চা খুব ভালো লাগে আমার। জানো মা!
হ্যাঁ:। নিজেকে কে দেখে তারই ঠিক নেই, বাচ্চা অ্যাডাপ্ট করবে! আমি ছুঁড়ে ফেলে দেব।
নায়াগ্রা ফলস-এর মতন বিরক্তি ঝরল দিতির স্বরে।
দিতির জন্যে কষ্ট যে হয় না শ্রমণবাবুর তা নয়। জামাই, নাতি-নাতনি সব কিছুরই একটা বিশেষ সময় আছে। বিশেষ করে, মেয়েদের জীবনে। হয়তো পুরুষদের জীবনেও।
তাঁরও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, শীতের রোদে পিঠ দিয়ে বসে, নাতি বা নাতনিকে কোলে নিয়ে কাঁটালের বিচি ভাজার সঙ্গে আচারের তেল দিয়ে মেখে মুড়ি খান।
কিন্তু…এ জীবনে সব ইচ্ছে পূরিত হয় কারই বা? সময় পেরিয়ে গেলে, মন তো খারাপ হতেই পারে! কিন্তু করা কী যাবে! ওঁদের নিজেদের করণীয় নেই কিছুই। সন্তানদের জীবন তাদেরই। ‘কেরিয়ার’ ‘কমপিটিশন’, ‘সাকসেস’ এসবই আজকের দিনের মূলমন্ত্র। ওইসব জামাই, নাতি-নাতনির সুখের ভাবনা আজকাল তুচ্ছ তাই।
শ্রমণবাবু বললেন দিতিকে, অকর্মা অকর্মা কোরো না। তোমার ন-দাদার মতন নিজের জুতো পালিশ করলে আর আণ্ডারওয়্যারস কাচলেই তো ‘কর্মবীর’ হওয়া যায়। ওইরকম ‘‘কর্মবীর’’ হওয়ার অ্যামবিশান আমার কোনোদিনই ছিল না। আমার মেয়েদেরও হয়তো নেই।
তা নেই। কিন্তু তোমার মেয়ে নিজের ফ্লাটে গিয়ে খাবেটা কী? রুটি আর মাখন? এক কাপ চা-ও তো…একটা ওমলেট পর্যন্ত ভাজতে পারে না!
বিষয়ান্তরে গেলেন শ্রমণবাবু, কারণ, দিতির রাগ এবং ক্ষোভটাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার প্রয়োজন ছিল। বললেন, খাদ্য হিসেবে পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড়ও তো খারাপ নয়।
ওই তো! আমি এখন কথা বললেই তো লেগে যাবে তোমার সঙ্গে।
দিতি বললেন।
যাবেই তো! তুমি তো অন্য আকাশেই ওড়ো। আমিও আমার আকাশেই থাকি। আমরা পোলস অ্যাপার্ট।
টুঁই বলল, পোলস অ্যাপার্ট নয় বাবা, তুমি আর মা, তোমরা দুজনে চৌত্রিশ বছর এমন ঠোকাঠুকি করেই একসঙ্গে দিব্যি রয়ে গেলে। আর আজকাল তিনমাসে ছ-মাসে ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, রইলে কেন? হোয়াই? উ্য শুড হ্যাভ লাভড অ্যাণ্ড লিভড ইওর ওওন লাইভস। একটাইমাত্র জীবন। তোমরা এমন করে নষ্ট করলে?
হুঁ! ‘দিব্যি’ আদৌ থাকিনি। তবে থেকেছি যে, সেটা তো সত্যিই! অস্বীকার করি কী করে!
দিতি বললেন, ক্ষোভের সঙ্গে।
তারপরই হঠাৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, কিন্তু কেন রইলাম, তা কি জানিস? ভেবে দেখেছিস কি স্বার্থপর তোরা কখনো সেকথা?
না। কী সেটা?
টুঁই বলল।
তোদেরই জন্যে। শুধু তোদের দুজনের জন্যে। তোদের বড়ো করে তোলার জন্যে, মানুষ করে তোলার জন্যে।
একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমরা তোদের চেয়ে অনেকই কম স্বার্থপর ছিলাম।
স্বার্থপর! আমরা স্বার্থপর?
টুঁই আহত গলাতে বলল।
তারপর বলল, তুমি কী বলছ মা! নিজেদের পায়ের তলাতে একটু মাটি পেতে আজকের কমপিটিটিভ ওয়ার্লড-এ আমরা সব কিছু ছেড়ে, অন্ধের মতন, পাগলের মতন দৌড়োচ্ছি আর তুমি আমাদের বলছ স্বার্থপর?
হ্যাঁ বলছি। তোরা শুধু তোদের কথাই ভাবিস। শুধুই নিজেদের কথা। কিন্তু আমরা আমাদের সময়ে অনেক কিছুই খুশি মনে ছেড়ে দিয়েছি। অনেক সুখ, অনেক আনন্দ। আমরা গুরুজনদের জন্যেও করেছি, লঘুজনদের জন্যেও করেছি। নিজেদের কথা ভাবিনি কখনোই। সেটাই অন্যায় হয়েছে হয়তো। সবসময়েই তোমরা দুজনে বেড়ালছানার মতন ‘‘ম্যা ম্যা’’ করতে। ‘‘মা’’ ছাড়া তো গতিই ছিল না তোমাদের।
বলেই হঠাৎ বললেন, তোর বাবাও তোদের জন্যে কম করেননি।
শ্রমণবাবু চমকে ডঠলেন কথাটা শুনে। ভাবলেন, ভুল শুনলেন না তো!
তারপর মনে মনে বললেন, রামের সুমতি হতে এতদিন লাগল! তাও ভালো যে হয়েছে অবশেষে।
দিতি আবারও উদগীরণ করলেন, এখন শিং গজিয়েছে তো তোমাদের। বড়ো হয়েছ, স্বনির্ভর হয়েছ, বড়োলোক হয়েছ, এখন আর মাকে কী দরকার? তোমরা স্বার্থপর নয়তো কারা স্বার্থপর?
চিরদিন দিতি রেগে গেলে, মেয়েদের তুই না বলে তুমি বলেন।
দিতির চোখ জলে ভরে এলো।
হাউ আনরীজনেবল! হাউ আনফেয়ার!
টুঁই বলল, উষ্মার সঙ্গে দু-হাত দু-দিকে ছুঁড়ে।
আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড়ো বেশি হাত ছুঁড়ে কথা বলে। ওঁদের সময়ে অমন করাকে অসভ্যতা বলে গণ্য করা হত। পৃথিবীটা ত্রিশবছরে বড়োই বদলে গেল!
দিতি ভাবছিলেন।
শ্রমণবাবু বললেন, তাও তো তোমার একটা বড়ো ভূমিকা ছিল তোমার মেয়েদের কাছে। মেয়েরা একটা সময় পর্যন্ত মায়ের ওপরে সব ব্যাপারেই ডিপেণ্ড করত এবং সেটা তারা স্বীকারও করে। কিন্তু আমার কোনোই ভূমিকা তোমার অথবা তাদের জীবনে আদৌ যে ছিল এমন কথা, না-তুমি কোনোদিনও স্বীকার করেছ, না-মেয়েদের বুঝতে শিখিয়েছ। আমার এই আটারলি থ্যাঙ্কলেস, নন-এনটিটি অস্তিত্বটা তাই আমার নিজের কাছে একেবারে অর্থহীন তো বটেই, সময়ে সময়ে দুঃসহও ঠেকে। মাঝে মাঝেই মনে হয় এই সেবাদাস-এর আত্মহত্যা করে মরে যাওয়াই শ্রেয়।
তুমি তো সারাটা জীবন শুধু ‘‘আমি আমি’’ করেই গেলে। তুমি কি পুরুষ? তুমি তো মেয়েরও অধম!
‘‘সারাটা জীবন’’ ভুল বাংলা। ‘‘সারাজীবনটা’’ বলা উচিত ছিল।
ভাবতে ভাবতে, চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন শ্রমণবাবু। আবহাওয়া ক্রমশই দুর্যোগপূর্ণ হচ্ছে। নিজের ঘরের দিকে এগোবেন ঠিক করলেন।
টুসি বলল, বাবা, কাল তো আমি ভোর সাড়ে চারটে নাগাদই বেরিয়ে যাব। তোমার সঙ্গে আর তো দেখা হবে না! আচ্ছা! মানে এবারের মতন, টা টা।
অপরেশকে আসতে বলেছিস তো?
শ্রমণবাবু ড্রাইভারের কথা বলছিলেন। পুরোনো অ্যামবাসাডরটা পুরোনো জুতোরই মতন বিশ্বস্ত এখনও। তেমনই অপরেশ।
না। অপরেশ কেন আসতে যাবে? কোম্পানি থেকেই গাড়ি পাঠাবে।
টুসি বলল।
ওঃ।
এখন আর টুসির জন্যে শ্রমণবাবুর কিছুই করণীয় নেই। টুঁই-এর জন্যেও কিছু করণীয় থাকবে না আর দু-বছর পর থেকে। বম্বেতে বদলি হবার আগেও নিজের গাড়ি ও ড্রাইভার ছিল টুসির। দিনে দিনেই হালকা হয়ে যাচ্ছেন শ্রমণবাবু। ভারশূন্য।
ভারশূন্য হলে তো খুশি হওয়ারই কথা ছিল কিন্তু খুশি লাগে না কেন?
যেতে যেতেই শ্রমণবাবু বললেন ভোর চারটের আগেই আমি উঠে পড়ব টুসি। আমি তো রোজ সাড়ে তিনটের সময়েই উঠি। তোকেও উঠিয়ে দেব চারটেতে, যদি অ্যালার্ম না বাজে?
কী করো তুমি। এত ভোরে উঠে বাবা?
কী যে করেন, কেমন করে করেন, তা শ্রমণবাবুই জানেন। অফিস থেকে রিটায়ার করার পর সঞ্চয়ের ওপরে যতটুকু সুদ তাতে একেবারেই কুলোয় না। অথচ খরচও কমেনি কিছুই। বরং বেড়েই গেছে। মেয়ের কাছে তো সাহায্য চাইতে পারেন না. ঈশ্বর করুন, যেন কোনোদিনও চাইতে না হয়। তাঁর পৌরুষ-এ লাগবে। তিনি মানুষটি একটু অন্য ধাঁচের।
মায়ের জন্যে মেয়েরা কিছু করতে পারে। হয়তো করেও। জানেন না শ্রমণবাবু। কিন্তু তাঁর স্ত্রী দিতি তাঁকে তাঁর শত্রু বলেই মনে করে এসেছেন চিরদিনই। শ্রমণবাবুর এই সংসারে তাঁর আপনজন একজনও নেই যার সঙ্গে তিনি তাঁর সুখদুঃখের কথা এক মুহূর্তের জন্যেও আলোচনা করতে পারেন, তাঁর অসুবিধার কথা, তাঁর কষ্টের কথা, তাঁর ভবিষ্যতের কথা, যদি ভবিষ্যৎ বলে আদৌ কিছু থেকে থাকে।
টুঁই বলল, আমি জানি যে, বাবা রোজ অন্ধকার থাকতেই ওঠে।
কী করে জানলি? তোর ঘরে আলো যায় নাকি?
শ্রমণবাবু শুধোলেন, লজ্জিত হয়ে।
না, না, তোমার বাথরুমের ফ্লাশ টানার শব্দ শুনি। আর তারপরে উঃ। আঃ। মা:। মা গো। এই সব শব্দ, মেঝের ওপরে চেয়ার-টানার আওয়াজ।
তোর বাবার কথা! যত না কাজ করেছে জীবনে, তার চেয়ে অনেকই বেশি দেখিয়েছে। আওয়াজ করেছে। শুধুই Show off. চিরদিন! হি ইজ অ্যাজ নয়জী অ্যাজ আ হিপ্পোপটেমাস।
শ্রমণবাবু বললেন, শুধু নয়জীই কেন? বলো, অ্যাজ ফ্যাট অ্যাণ্ড আনকুথ অ্যাজ আ হিপ্পোপটেমাস অ্যাজ ওয়েল।
সুন্দরী, তম্বী দিতি বললেন, তাও বলা যায়।
শ্রমণবাবু ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে, নিজের ঘরে গিয়ে পৌঁছোলেন। জানালার সামনে দাঁড়ালেন। পুরোনো দিনের বাড়ি। বড়ো বড়ো ঘর। সস্তার দিনে ভাড়া নিয়েছিলেন। এই বাড়িটিই এক বিশেষ স্বস্তির কারণ ছিল এত অস্বস্তির মধ্যেও। এটাও যাবে। সময় হয়েছে। এই বাড়ি ছাড়তে হবে এবারে। পরম ‘ভদ্রলোক’ বাড়িওয়ালার দুই কৃতী ছেলে আহমেদাবাদ আর দিল্লি থেকে ফিরেছে। এবারে উনি তাদের বিয়ে দেবেন। আনন্দবাজারে প্রতিরবিবার পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখে। রবিবারের কাগজটা রাখতেই হয়। শুধু ওই জন্যেই। সম্বন্ধ করেই বিয়ে দেবেন উনি। ওঁরা শ্রমণবাবুর পরিবারের মতন অত আধুনিক নন। তাই জীবনও অনেক কম জটিল।
ছেলেদের বিয়ে হলে সত্যিই তখন ওঁদের জায়গার অকুলান হবে।
বাঁশদ্রোণীতে তিরিশ বছর আগে পাঁচ কাঠা জমি কিনে রেখেছিলেন। যদি বে-দখল না হয়ে গিয়ে থাকে, তবে সেখানেই ছোট্ট একটি ডেরা করবেন। কাল সকালেই সেখানে একবার যাবেন বলেও মনস্থ করেছেন।
পথটা নির্জন হয়ে এসেছে। গাড়ি-ঘোড়াও কম। বৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে সবে চান করে ওঠা পথ-পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটা সোডিয়াম-ভেপার ল্যাম্পের আলোতে সুন্দর স্বপ্নময় দেখাচ্ছে। পৃথিবীটাও। জীবনটাও যদি এমন স্বপ্নময় হত।
উনি ভাবছিলেন, কী করে সময় যায়। যৌবন যায়। জীবনও। জীবনটাও বড়োই ছোটো এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, ভীষণই আনপ্রেডিক্টেবল। ওঁদের দুই অবিবাহিত মেয়ের কেউই আর এখন ওঁদের সঙ্গে থাকে না। তবে কন্যারা তো চিরদিনেরই ‘পর’। চলে যাওয়ারই জন্যে। কিন্তু অনেকেই আজকাল বলেন, এখন মেয়েরাই নাকি ছেলে। ছেলেরা নাকি তাদের শাশুড়িদেরই ছেলে হয়ে গেছে। আজকাল আর ছেলেতে-মেয়েতে তফাতও নেই কোনো।
টুঁই আর টুসিকে নিয়েই খুশি ওঁরা। অথচ মাত্র তিরিশবছর আগেও বিয়ের পরে শ্রমণবাবুর পৈত্রিক নিবাসে তিনি ঠাকুমা, কাকারা, পিসতুতো বোন, খুড়তুতো বোন, নিজের ভাই-বোনদের সকলকে নিয়ে তাঁর মা-বাবার সঙ্গেই থাকতেন। অনেকই অসুবিধে ছিল। আবার সুবিধেও ছিল, অসুবিধের চেয়ে অনেকই বেশি। তিনমাসের শিশুকন্যা টুসিকে মায়ের কাছে রেখে উনি আর দিতি সাতদিনের জন্যে মধুপুরে গেছিলেন বেড়াতে। দল বেঁধে। সেসব সুন্দর দিনের কথা আজকাল ভাবাও যায় না। সুখস্মৃতি হয়ে গেছে। হয়ে রয়েছে। ফ্রেমে-বাঁধানো ছবি হয়ে গেছে সেইসব দিন বাবার বাড়ি।
খুবই গরিব, কিন্তু সেই সময়ের সর্বক্ষণ হাসি-খুশি আনন্দময় শ্বশুরবাড়ি। এখন শ্বশুরবাড়ির অধিকাংশরাই দারুণ বড়োলোক। কিন্তু ‘আনন্দ’ উধাও হয়ে গেছে। সময়, সবকিছুকেই বদলে দিয়েছে।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মনে পড়ে গেল শ্রমণবাবুর, টুসি তখন ক্লাস ফোর বা ফাইভ-এ পড়ে, ওকে নিয়ে পূর্ণ সিনেমাতে এক রবিবার সকালে ‘Guns of Navarone’ ছবিটা দেখতে গেছিলেন। ছবি দেখে যখন গাড়িতে উঠছেন, উনি ড্রাইভিং-সিট-এ, পাশে টুসি। টুসি বলল, দেখলে বাবা, যখন ওরা একটি মেশিনগান দিয়ে আহত বন্ধুকে ‘Pass’ এর মুখে রেখে গেল তখন ওই ভীতু মানুষটা মরবার সময়ে পৌঁছে প্রমাণ করে যাওয়ার সুযোগ পেল যে, সে ভীতু ছিল না। বইয়ে আছে, ‘At last he was at peace with him-self.’
শ্রমণবাবু অবাক হয়ে বলেছিলেন, বইটা তুই পড়েছিস নাকি?
হুঁ!
বইটা পড়েছে বলেই নয়, অতটুকু মেয়ে যে ওইভাবে পড়েছে এবং ওই একটি আপাততুচ্ছ ঘটনার গভীর তাৎপর্য বুঝতে পেরেছে জেনে সেদিন ওঁর বুক আনন্দে ভরে উঠেছিল। বুঝেছিলেন যে, ওঁর সন্তান ওঁর চেয়ে অনেকই বেশি বুদ্ধি ধরে। সন্তানের কাছে হেরে যাওয়ার যে কী আনন্দ সেদিনই প্রথম জেনে পুলকিত হয়েছিলেন শ্রমণবাবু।
আরেকবার, ওদের সকলকে নিয়ে পুজোর সময়ে শিলং-এ গেছিলেন বেড়াতে। ওঁর প্রিয় ‘পাইন উড’ হোটেলেই উঠেছিলেন। টুসির সঙ্গে বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে একটা ইংরেজি শব্দের প্রকৃত মানে নিয়ে ওঁর মতপার্থক্য ঘটল। উনি ওঁর বারোবছরের শিশুকন্যাকে আদিম পিতৃত্বর গায়ের জোরে ধমকে বলেছিলেন, ‘তুমি কি আমার চেয়ে বেশি জানো?’
Overbearing, জংলি, বাবার ব্যবহারে আহত হয়ে টুসি মুখ নামিয়ে নিয়েছিল। জলে চোখ ভরে গেছিল টুসির।
পরে জেনেছিলেন যে, উনি ভুল, টুসিই ঠিক। বারে বারেই হেরে গেছিলেন উনি মেয়ের কাছে। সেই হার, তাঁর কাছে যে কত বড়ো আনন্দ হয়েছিল তা তিনিই জানেন।
টুসিটা চিরদিনই চাপা। খুব আস্তে, প্রায় শোনা যায় না, এমন নীচু স্বরে কথা বলে। Delicate Darling! স্কুলের এক শিক্ষিকা ওকে ডাকতেন ‘Dainty Young Lady’ বলে। স্কুলের Head Girl ছিল ও।
টুঁইও পড়াশুনোতে বেশ ভালোই ছিল। ভীষণ রেগে গিয়ে বলত ও যে, স্কুলে সকলেই ওকে বলেন, ‘টুসির বোন না তুমি?’
ধুৎ, কেন? আমার কি নিজের নাম নেই? নিজের পরিচয় নেই?
টুসির মতন অত ডেলিকেট ছিল না টুঁই। তবে Tom-Boyish-ও ছিল না। আর নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবার খুবই জেদ ছিল ওর ওই বয়সেই। যে জেদ, জীবনে মানুষকে বড়ো হতে সাহায্য করে।
ভাবছিলেন শ্রমণবাবু।
ওদের মা দিতির জেদও বড়ো কম ছিল না। তাঁর গর্ব ছিল মেয়েদের তিনি ভালো করে মানুষ করবেন। মেয়েরাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। সম্ভবত মায়ের জেদই সংক্রামিত হয়েছিল দুই-মেয়েরই মধ্যে।
বোসদের প্রকান্ড লন-এর এক কোণের ওই মস্ত কদম গাছটার পাশেই একটি বাঁশঝাড় আছে। তাঁদের কোম্পানির সাপ্লায়ার চাঁইবাসার বাঁশ ব্যবসায়ী ভোগলু ঘোষ একদিন শ্রমণবাবুকে বলেছিলেন যে, বাঁশ-এর ফুলই হচ্ছে তার মরণের শমন। কারণ, ফুল ফুটলেই বাঁশ মরে যায়। পরের বছর আবার বাঁশের বীজ থেকে বাঁশ গজাতে শুরু করে। ‘চিরদিন’ কোনো মানুষ কিংবা গাছই থাকে না। তা বলে, জীবনপ্রবাহ বন্ধ হয় না। একে যায়, অন্যে আসে।
ইকনমিক্স-এর মাস্টার্স-ডিগ্রিধারী তাঁর মেয়ে টুঁইকে শ্রমণবাবু নিজের লেখা একটি ইংরেজি প্রবন্ধ দেখে দিতে বলেছিলেন। কোথাও পাঠাবেন এমন ইচ্ছাতেই লিখেছিলেন।
গতকাল সকালে টুঁই বলেছিল, চাপা বিরক্তির সঙ্গে, বাবা, ইওর ইংলিশ ইজ ভেরী ব্যাক-ডেটেড। তোমার ভাষাটাও বড়ো Halting। এগোতে পারছি না।
সত্যি কথা। একটু Brush-Up করে দে-না মা! আমি তো তোদের মতন ভালো স্কুলে পড়িনি। Schooling -টা সবচেয়ে ইমপর্ট্যান্ট। পরে কিছুতেই মেকআপ করা যায় না।
বলেছিলেন, শ্রমণবাবু লজ্জিত অপরাধীর গলাতে।
সময় এখনও হয়নি টুঁই-এর। অথচ ওর ফিরে যাওয়ার দিনও ঘনিয়ে এলো। এম. ফিল-এর জন্যে সবসময়েই পড়াশুনো করছে ও। সময় কোথায় ওর সময় নষ্ট করবার! বাংলা-মিডিয়াম স্কুলে-পড়া বাবার ইংরেজি ব্রাশ-আপ করে দেবার? ওকে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। দিদির মতনই সাকসেসফুল হতে হবে। পরীক্ষা শেষ করে এসেও তাই সবসময়ই পড়াশুনো করে ও।
বেচারি!
প্রকৃতির এই নিয়মের মধ্যে ভারী একটা যুক্ত আছে বলে মনে হল শ্রমণবাবুর। জীবন যখন অনন্তকাল ধরে একই শরীরে বা আধারে চলমান নয়, তখন একসময়ে তো তাকে থামতেই হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সময়টুকু কোন সময়?
কোন সময়টুকু সঠিক সময়?
মানে, ফিরে যাবার? খেলাধুলা সাঙ্গ করে?
ভাবছিলেন, উনি.
ড্রইং-কাম-ডাইনিং-রুম থেকে তাঁর স্ত্রী আর তাঁর রক্তজাত মেয়েদের গলার স্বর ভেসে আসছিল। সাজানো বাগান। সুন্দর, সুগন্ধি। মধ্যে উনিই কেবল বেমানান। বাঁশ গাছেরই মতন।
তবুও বেশ তো কাটিয়ে গেলেন জীবনটা! চাওয়া ছিল অনেকই, চাওয়া অনুপাতে পাওয়া হয়তো হয়নি, অধিকাংশ মানুষেরই হয় না, কিন্তু সেজন্যে তেমন গভীর কোনো ক্ষোভ নেই। যা পেয়েছেন, তাই বা কম কী! তাঁর সন্তানদের কাছে হেরে যাওয়ার গভীর আনন্দ তো পেয়েছেন। এই অস্থির সময়ে, দ্রুত পালটে যাওয়া মানসিকতা এবং মূল্যবোধের ঝোড়ো, প্রতিকূল হাওয়ার মধ্যে বেদুইন-এর মতন মুখ-কান ঢেকে বেঁচে তো এলেন এতগুলো বছর!
বাঁশ গাছে কি ফুল এসেছে? বোধহয়।
সাধারণ, অতিসাধারণ শ্রমণবাবুর যাবার সময় এসেছে।
কিন্তু তাঁর কৃতী সন্তানেরা থাকবে। শ্রমণ চ্যাটার্জির নিশান উড়বে তাদেরই উঠোনে। এমনি করেই যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই প্রত্যেক মানুষই একে একে ফিরে গেছেন উত্তরসূরীদের হাতে পতাকা তুলে দিয়ে। পাখিরই মতন উড়ে গেছেন বীজ ফেলে দিয়ে,
‘‘প্রলয় সৃজন না জানি এ কার যুক্তি।
ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া আসা।
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি।
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।’’
কী একটা কথাতে যেন টুঁই, ঝরনার মতন ঝরঝর করে হেসে উঠল খুব জোরে। আর তারই সঙ্গে টুসি এবং দিতিও।
হাসির হররা ধেয়ে এলো শ্রমণবাবুর ঘরের দিকে।
গভীর এক প্রশান্তিতে ভরে গেল তাঁর মন।
একেই কি বলে…?
আরও একবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন।
দেখলেন, সোডিয়াম-ভেপার ল্যাম্পের আলোতে বোসদের লন-এর বাঁশঝাড়টিকে সত্যিই ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। বৃষ্টি-শেষের হাওয়ার মধ্যে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। নিবিড় শান্তি এখন এই সুন্দর পৃথিবীতে। তাঁর দুই কন্যা এবং স্ত্রীর, আজ রাতের হাস্যমুখর আনন্দোচ্ছল গ্রূপ-ফোটোরই মতন এই মুহূর্তের ছবিটি, মনের ফ্রেমে বাঁধিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন শ্রমণবাবু। যে অচেনা দেশেই যান না কেন!
মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড়ের অচানকমারের জঙ্গলের ডাইনি-জ্যোৎস্নার রাতে মস্ত শিমূল গাছটার মগডাল থেকে সেই বড়ো কালো ঝুঁটিহীন শিকারি পাখিটা হঠাৎই ডেকে উঠল আবার। শ্রমণবাবুর বুকের মধ্যে। ডানা-ঝাপটে।
পাখিটা বলল, ‘‘কীরে! কীরে! কি কি কি?’’