অম্বর তদন্ত – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
মধ্যরাতে হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। এরকম মাঝে মাঝেই হয়। আমি তখন অকারণেই একটু পায়চারি করি। বাথরুমে যাই। আবার শুয়ে পড়ি। আজও ঘুম ভাঙতেই উঠে পড়লাম। দেওয়াল-ঘড়িতে রাত এখন একটা। রাখহরি একপাশে ক্যাম্পখাটে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মাত্র কয়েকমাস হল আমার কাছে এসেছে ও। সারাদিনে কত কাজই না করে। আমার এই মৌড়িগ্রামের চার কাঠার চৌহদ্দির মধ্যে ছোট্ট বাড়িটাকে কী সুন্দর ঝকঝকে তকতকে করে। রেখেছে। ওরই পরিচর্যায় বাগানের গাঁদা গাছগুলি ফুলে ফুলে ভরে আছে। আমার মতো লোকের বাড়িতে এইরকমই একজনের দরকার ছিল, পেয়েছি। এখন ওকে পেয়ে আমার অবসর সময়ও বেশ ভালই কাটে।
আমি উঠে আলো জ্বেলে বাথরুমে যাচ্ছি, এমন সময় ডোরবেলটা বেজে উঠল। থমকে দাঁড়িয়ে সাড়া নিলাম, “কে?”
“দরজাটা একবার খুলবেন?”
“কে আপনি?”
“আপনার সাহায্যপ্রার্থী।”
বালিশের তলা থেকে অটোম্যাটিকটা বার করে বললাম, “এক মিনিট।” তারপর এক টানে দরজাটা খুলতেই দেখলাম এক সুদর্শন ভদ্রলোক ক্রাচে ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, “আপনিই অম্বর চ্যাটার্জি?”
“সব জেনেই এসেছেন দেখছি। কী ব্যাপার বলুন তো?”
“বলব বলেই এসেছি আপনার কাছে। আমার বড় বিপদ।”
“আসুন, ভেতরে আসুন।”
ভদ্রলোক ভেতরে এলেন। তারপর একটা চেয়ার টেনে বসতে যেতেই আমি তাঁকে সোফাটা দেখিয়ে দিলাম। সোফায় বসেই বললেন, “জানি এইরকম সময় আমার আসাটা ঠিক হয়নি। আমি বালাশোর থেকে আসছি। আমার নাম সোমেশ্বর সামন্ত। ধৌলি এক্সপ্রেসটা রাত সাড়ে ন’টায় হাওড়ায় ঢোকবার কথা। তার জায়গায় রাত বারোটা হয়ে গেল। ভাবলাম, হাওড়া স্টেশনে রাত্রিটা কাটিয়ে ভরে আপনার কাছে আসব। কিন্তু…।”
“কিন্তু কী…?”
“কিন্তু এরই মধ্যে এমন একটা ব্যাপার হয়ে গেল যে, এখনই না এসে পারলাম না। এক গেলাস জল খাওয়াবেন?”
রাখহরি জল দিয়ে চা কিংবা কফির জন্য স্টোভ ধরাল।
সোমেশ্বর বললেন, “চাঁদিপুরের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? আমি সেখানকার ছোটখাটো একটা লজের মালিক। কিছুদিন আগে আমার লজে একটি খুন হয়। ঘটনাটা এইরকম, এক নবদম্পতি কয়েকদিনের জন্য আমার লজের একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। হঠাৎ একদিন দুটি ছেলে এসে পাশের ঘরটি ভাড়া নিল। প্রথম দিনটা কাটল ভালয় ভালয়। দ্বিতীয় দিন সন্ধেবেলা দম্পতি এসে অভিযোগ করলেন, ছেলে দুটির আচার-আচরণ নাকি ভাল নয়, এবং ওঁদের খুব উত্ত্যক্ত করছে। এই না শুনেই আমি ছেলে দুটিকে আমার লজ ছেড়ে অন্য লজে চলে যেতে বলব বলে যেই না ওপরে গেলাম, অমনি দেখি ঘরের দরজায় তালা দেওয়া। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম ওদের জন্য। কিন্তু না, ওরা আর ফিরল না। সম্ভবত ভয় পেয়েই পালিয়েছে। পরদিন পুলিশ ডেকে দরজা খুলেই অবাক। দেখি সেই ছেলে দুটির একজন মৃত অবস্থায় ঘরের মেঝেয় পড়ে আছে। অপরজন উধাও।”।
“সে কী! ওদের নাম-ঠিকানা আপনার খাতায় লেখা ছিল না?”
“ছিল। পুলিশকে যখন সেই ঠিকানা দেব বলে নীচে এলাম তখন দেখলাম খাতাটাই নেই। এই ঘটনায় ওখানে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। নবদম্পতিও সেই ফাঁকে কখন যেন সুট করে কেটে পড়লেন।”
“পুলিশ বাধা দিল না?”
“না। আসলে ওঁরা ভয় পেয়েই পালিয়েছেন।”
“এমনও তো হতে পারে ওঁদেরই যোগসাজশে খুনটা হওয়ার পর ওঁরা আপনার কাছে অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন?”
“তা হলে ওর বন্ধুটা পালাবে কেন?”
“সাজানো নাটকও তো হতে পারে? তা যাক, আপনার লজে স্টাফ ক’জন?”
“স্টাফ বলতে কিছু নেই। আমি ছাড়া চরনিয়া নামে আমার এক বিশ্বাসী কর্মচারী আছে। বহুদিনের পুরনো লোক।”
“আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে?”
“আমি ব্যাচেলার লোক। কেউ নেই আমার।”
“আপনার পা গেছে কতদিন?”
“বেশ কয়েক বছর হল। একটা মোটর দুর্ঘটনায় পা-টাকে খুইয়েছি।”
রাখহরি তখন কফি নিয়ে এসেছে আমাদের জন্য। বলল, “আগে এটা খেয়ে নিন। তারপর কথা বলবেন।”
আমরা তিনজনেই কফির পেয়ালায় চুমুক দিলাম।
আমি বললাম, “আমার খবর আপনি কার কাছ থেকে পেলেন?”
“মেজর কে. কে. ঘোষকে আপনার মনে আছে?”
“আরে! উনি আমার বিশেষ পরিচিত।”
“ওঁর মুখেই আপনার কথা শুনেছি এবং উনিই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। যদি সম্ভব হয় তা হলে বন্ধুর মতো আপনি একটু আমার পাশে এসে দাঁড়ান। আমাকে সাহায্য করুন।”
“বলুন তো আপনার প্রবলেমটা কী?”
“আমার এক পুরনো শত্রু এখন আমাকে উৎখাত করবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। মোটা টাকা অফার করছে লজটি তাকে বেচে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনও কিছুর বিনিময়েই ওই কাজ আমি করব না। শুধু তাই নয়, ইদানীং প্রায়ই দেখছি একটা উড়ো চিঠিতে কেউ বা কারা যেন আমার প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। কী জ্বালা বলুন তো? আপনি কি পারবেন ওই শয়তানগুলোকে শায়েস্তা করতে?”
“পারবই এমন কথা বলতে পারি না। তবে চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?”
“শুনে সুখী হলাম। এখন আমার এই অসময়ে আসার কারণটা বলি শুনুন। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, কেউ জানে না। চরনিয়াকে বলে এসেছি ভুবনেশ্বর যাচ্ছি বলে। আমি ভেবেছিলাম ধৌলিতে রাত সাড়ে ন’টায় নেমে আপনার সঙ্গে দেখা করব, তারপর ভোরের ট্রেনে আবার ফিরে যাব বালাশোরে। তা রাত বারোটা হয়ে গেল বলে স্টেশনে পায়চারি করছি এমন সময় লেট লতিফ ইস্পাত এক্সপ্রেস এসে ঢুকল। তারপরই এক চাঞ্চল্যকর ব্যাপার। ইস্পাত এক্সপ্রেসের ভেতর থেকে একটি দাবিদারহীন ট্রাঙ্ক নামাতেই দেখা গেল তার ভেতর এক তরুণীর মৃতদেহ। দেখেই শিউরে উঠলাম। পরিচিত মুখ। সেই তরুণী, যিনি আমার লজে খুনের ঘটনার দিন ছিলেন। সঙ্গে সেদিন স্বামী ছিল। আজ উনি একা। সেই দৃশ্য দেখেই আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছি।”
সোমেশ্বরের বিবরণ শুনে আমার কপাল ঘেমে উঠল। রীতিমতো রহস্যময় ব্যাপার। বললাম, “চলুন। এখুনি আমাদের যেতে হবে।”
“এখন কোথায় যাবেন? ট্রেন তো সেই ভোরবেলায়?”
“ভোরের আর দেরি কত? এখনই তো দুটো বাজে। এখনও গেলে হয়তো তরুণীর লাশটাকে দেখতে পাব।”
“চলুন তবে।”
রাখহরির হাতে ঘরের দায়িত্ব দিয়ে সোমেশ্বরকে নিয়ে সোজা চলে এলাম হাওড়া স্টেশনে। ওখানে আমার এক পরিচিত পুলিশ অফিসারের সাহায্য নিয়ে বেশ ভাল করে দেখলাম তরুণীকে। বললাম, “এ তো রীতা পারিয়াল।”
সোমেশ্বর বললেন, “আপনি চেনেন মেয়েটিকে?”
“আলাপ না থাকলেও বিলক্ষণ চিনি। চমৎকার অভিনয় করে মেয়েটি। কখনও শখের থিয়েটারে। কখনও সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রে। অনেকেই চেনে।”
আমি তখনই লোকাল থানায় আমার বন্ধু অফিসারকে ফোন করে জানালাম ব্যাপারটা। উনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন। তারপর ডেডবডি দেখে বললেন, “হ্যাঁ, এ তো সেই মেয়েটিই। আমাদের পুলিশ ক্লাবেও অভিনয় করেছিল একবার। ওর বাড়িও আমি চিনি। চলুন তো যাই।”
পুলিশের জিপেই আমরা শালকিয়ার একটি বাড়িতে এসে দরজায় ধাক্কা দিলাম। যিনি এসে দরজা খুললেন তাঁকে দেখেই তো আমাদের চক্ষুস্থির। দেখলাম, স্বয়ং রীতা পারিয়াল আতঙ্কিত মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। বললেন, “ব্যাপার কী ভাই! আপনারা?”
বললাম, “কিছুমনে করবেন। না। এমন একজন তরুণীর মৃতদেহ আজ আমরা দেখেছি, যার সঙ্গে আপনার চেহারার হুবহু মিল আছে। তাই ছুটে এলাম খোঁজখবর নেব বলে। ঈশ্বরের ইচ্ছায় আপনি ভাল থাকুন, এই কামনা করি।”
“আপনারা যে আমাকে বোনের মতো স্নেহ করেন সেজন্য ধন্যবাদ।”
আমরা যখন তাঁর ঘুম ভাঙানোর জন্য ক্ষমা চেয়ে লজ্জিত হয়ে ফিরে আসছি তখন হঠাৎ কী মনে হতেই আবার ফিরে গিয়ে বললাম, “আচ্ছা, আপনার কোনও অ্যালবাম আছে? যা থেকে আপনার দু’-একটা ছবি আমরা পেতে পারি?”
“নিশ্চয়ই পারেন।” রীতা আমাদের বসিয়ে রেখে তাঁর অ্যালবামটা দিতেই আমরা ছবির জন্য পাতা ওলটাতে লাগলাম। বেশিরভাগই অভিনয়ের ছবি। হঠাৎ একটি ছবি দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন সোমেশ্বর, “ওই। ওই তো সেই ভদ্রলোক। এঁর ছবি এখানে কী করে এল?”
রীতা বললেন, “আপনি কার কথা বলছেন?”
“আপনি কি এঁকে চেনেন?”
“কেন চিনব না? ইনি অশোক রায়। আমাদের ইউনিটের একজন ছিলেন। বিরাট বিজনেসম্যান। এখন অবশ্য লাইন ছেড়ে দিয়েছেন।”
সোমেশ্বর বললেন, “যিনি খুন হয়েছেন তিনি এঁরই স্ত্রী। আচ্ছা, একটু মনে করে দেখুন তো আপনার মতো দেখতে আপনার আর কোনও আত্মীয়া আছেন কি না?”
“আমার কেউ নেই। মা ছিলেন। বছর দুই আগে গত হয়েছেন।”
আমার মনে হল উনি কী যেন চেপে যাচ্ছেন। তাই বললাম, “ঠিক আছে। আজ আর আপনাকে বেশি বিরক্ত করব না। আপাতত অ্যালবামটাই আমরা নিয়ে যাচ্ছি। কয়েকদিনের মধ্যেই অবশ্য ফেরত পেয়ে যাবেন। আজ আমরা আসি। সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ।”
আমি বাইরে এসে পুলিশ অফিসার বন্ধুটিকে বললাম রীতার দিকে একটু নজর দিতে। যাতে কোনওরকমেই এখান থেকে ও পালিয়ে না যায়। তারপর আমাকে সাহায্যের জন্য ওঁকে কী কী করতে হবে তা একটু আড়ালে গিয়ে জানিয়ে দিলাম। সোমেশ্বর টিকিট কেটে আনলেন। আমরা দু’জনে মুখোমুখি দুটি জানলার ধার দেখে বসলাম ধৌলি এক্সপ্রেসে। পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটে ট্রেন ছাড়ল।
ধৌলি এক্সপ্রেস বালাশোরে পৌঁছল সকাল সাড়ে ন’টায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সোমেশ্বর তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে ফোন নম্বরটা দিতে ভুললেন না অবশ্য। আমিও একটা অটো নিয়ে চলে এলাম চাঁদিপুর। সেখানে সোমেশ্বর সামন্তর লজ খুঁজে বার করতে আমার একটুও অসুবিধে হল না। চরনিয়া লজের দায়িত্বেই ছিল। আমি গিয়ে তাকে বললাম, “তোমাদের এই লজের মালিক আমার ছেলেবেলার বন্ধু। তাই এখানে এসেছি তার সঙ্গে গল্প করে কয়েকদিনের ছুটি কাটাতে। কোথায় তিনি?”
চরনিয়া বলল, “বাবু তো এখানে নেই। ভুবনেশ্বর গেছেন। একটু বেলায় ফিরবেন। কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না। তাই ডিপোজিটের টাকা আপনাকে অগ্রিম দিতে হবে। এরপর বাবু এসে যা ব্যবস্থা করবার করবেন।”
আমি ওর হাতে একশো টাকার একটা নোট তুলে দিলাম। শুধু তাই নয়, সারাদিন ধরে নানাভাবে আলাপ জমাতে লাগলাম ওর সঙ্গে। কিছুদিন আগে যে খুনের ঘটনা ঘটেছিল, সে-ব্যাপারেও জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। ওকে আমি এমনভাবে হাত করে নিলাম যে, আমার উদ্দেশ্যটা বুঝতেই পারল না ও। সারাটা দিন গেল। সন্ধের সময় বললাম, “কই হে! তোমার বাবু তো এলেন না?”
চরনিয়ার মুখ শুকিয়ে গেল। বলল, “কী জানি? এমন তো কখনও হয় না। ওঁর পিছনে কী যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে…।”
এমন সময় হঠাৎ ওকে অবাক করে সোমেশ্বরকে লেখা সেই প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া একটা চিঠি বার করে বললাম, “কী ব্যাপার বলো তো? আমার ঘরের ভেতর থেকে এই চিঠিটা পেলাম। এসব কী?”
চরনিয়া কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাল আমার দিকে। বলল, “ঘরের ভেতর থেকে পেলেন?”
“হ্যাঁ। এইমাত্র।”
“ওটা আমাকে দিন।”
চিঠিটা আমি দিয়েই দিলাম ওর হাতে। তারপর পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ওকে দিয়ে বললাম, “শোনো, আমাদের দু’জনের খাবারের ব্যবস্থা করো। আর একটু চায়ের ব্যবস্থা করো দিকিনি, গল্প করতে করতে খাই দু’জনে।”
চরনিয়া চলে গেল। তারপর যখন রাতের খাবার আর চা নিয়ে ওপরের ঘরে এল আমি তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অ্যালবামটা দেখছি। চরনিয়া সেদিকে তাকিয়ে বলল, “এসব ছবি আপনার কাছে কী করে এল বাবু?”
“কেন? তুমি কি চেনো এদের? দ্যাখো তো, এর ভেতরে কাউকে তুমি চিনতে পারো কি না?”
আমি দেখলাম কেমন যেন ভয়ে ভয়ে একটি নাট্যমঞ্চের স্ক্রিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলের ছবির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে ও। সেদিকে তাকিয়ে দু’ চোখের পাতা পড়ছে না।
বললাম, “চেনো নাকি ওকে?”
চরনিয়ার মুখ সাদা হয়ে গেল। বলল, “চিনি। গোরাবাবু। আপনি যে ঘরে আছেন এই ঘরেই ও খুন হয়েছিল।”
এবার আমি ওকে রীতার ছবিটা দেখালাম, “এঁকে চিনতে পারো?”
“পারি।”
“এই ভদ্রলোককে?”
“এঁদের দু’জনকেই চিনি৷ কিন্তু এসব ছবি আপনার কাছে কী করে এল? তা ছাড়া ওই চিঠিটাও তো এ-ঘরে পড়ে থাকবার নয়। সত্যি করে বলুন তো, আপনি কে?”
“তোমার বাবুর বন্ধু।”
চরনিয়া কোনওরকমে চা খেয়ে ওর খাবার নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমি অনেকক্ষণ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখলাম। তারপর একসময় খেয়েদেয়ে ডিম লাইটটা জ্বেলে রেখে চুপিসারে বাইরে এসে বাড়িটার দিকে চেয়ে সেই ঝাউবনের ছায়া-অন্ধকারে চুপচাপ বসে রইলাম। মাথার ওপর তারার আকাশ। শুধু সমুদ্রের ভয়ংকর গর্জন ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না এখানে। প্রায় ঘণ্টাদুয়েক বসে থাকার পর একসময় দেখলাম একজন দীর্ঘ উন্নত বলিষ্ঠ চেহারার লোক সেই লজের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আমি বেড়ালের মতো সন্তর্পণে পিছু নিলাম তার। লোকটি কোনও দিকে না তাকিয়ে নির্ভয়ে এগিয়ে চরনিয়ার দরজায় টোকা দিল। চরনিয়া দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই বলল, “ওই লোকটা কে রে! অনবরত ওকে নিয়ে ঘুরছিস, কী ব্যাপার?”
“উনি তো বলছেন, উনি নাকি বাবুর বন্ধু। তবে খুবই সন্দেহজনক। ওঁর কাছে একটা অ্যালবাম রয়েছে দেখলাম। তাতে খুকুদিদিমণির ছবি। সেই যে ছেলে দুটিকে খুন করা হল তাদেরও একজনের ছবি। আমার কিন্তু খুব ভয় করছে। আমি আর এসবের ভেতরে নেই। তা ছাড়া সেদিন যে চিঠিটা আপনি বাবুকে দিয়েছিলেন সেই চিঠিটাও দেখছি ওঁর হাতে। উনি বললেন, আজই নাকি ওই ঘর থেকে পেয়েছেন। কিন্তু আজ তো বাবু নেই। আপনিও কোনও চিঠি দেননি। তা হলে?”
লোকটি একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “মনে হচ্ছে এ নিশ্চয়ই পুলিশের লোক। খুব সাবধান। বেঁফাস কথা একদম বলবি না।”
“না। কিন্তু বাবু এখনও ফিরলেন না কেন?”
“কী করে জানব? তবে লোকটার দিকে নজর রাখিস। ভোরবেলা নিশ্চয়ই সি- বিচে বেড়াতে যাবে? তুই সঙ্গে থাকবি। পারলে রাত্রি তিনটে নাগাদ ডেকে তুলবি ওকে। তারপর যা করবার আমিই করব।”
“আপনি কি শেষকালে পুলিশ মার্ডার করবেন?”
“প্রয়োজনে করতে হবে বইকী। আমার কথামতো না চললে তোরও পরিণাম ওই হবে।”
লোকটা চলে গেল। আমিও ওকে যেতে দিলাম। তারপর আবার ঝাউবনে এসে একটা দেশলাই জ্বালতেই দু’জন সাদা পোশাকের পুলিশ এগিয়ে এল আমার দিকে। বললাম, “রাত্রিশেষে একটু সজাগ থেকো তোমরা। একটা কিছু ঘটতে পারে। কতজন আছ, তোমরা?”
“আপাতত দশজন আছি।”
“এতেই হবে।”
আমি চরনিয়ার ঘরের দিকে এগোলাম। তারপর টকটক করে দরজায় টোকা দিতেই বেরিয়ে এল চরনিয়া, “আবার কী!” বলে আমাকে দেখেই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, “এ কী! আপনি?”
“হ্যাঁ। ঘুম আসছে না। তাই চলে এলাম তোমার কাছে। চলো-না একটু সমুদ্রের ধার থেকে ঘুরে আসি?”
“এখন আমি যেতে পারব না বাবু, ঘুম পাচ্ছে।”
“তা হলে আমার ঘরেই এসো। গল্প করি।”
“না, ঘুম পাচ্ছে।”
“আসতে বলছি এসো।”
চরনিয়া ভয় পেয়ে বলল, “আপনি কে বাবু?”
“তোমার বাবুর বন্ধু।”
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“এই লজটা কিনতে। কিনতে ঠিক নয়, এখন আমি এটা কিনেই ফেলেছি। তোমার বাবু ভুবনেশ্বরে গেছেন এটি আমাকে বিক্রি করবেন বলে। এতক্ষণে হয়তো রেজিস্ট্রিও হয়ে গেছে।”
“তার মানে আপনি এখন এই লজের মালিক? কত টাকায় কিনলেন?”
“আড়াই লাখে কিনেছি।”
“কিন্তু বাবু তো চার লাখ টাকাতেও এই লজ শ্যাম বিশোয়ালকে দিতে চাননি।”
“সেটা ওঁর ব্যাপার।”
“যদি কিনে থাকেন তা হলে আপনি ভুল করেছেন বাবু। শ্যাম আপনাকে কিছুতেই এখানে থাকতে দেবে না। হয়তো আপনিও খুন হবেন।”
“সে কী! আমার অপরাধ?”
“ওর মুখের গ্রাস আপনি কেড়ে নিয়েছেন।”
আমি ভয় পাওয়ার ভান করে বললাম, “দোহাই চরনিয়া। সব কথা তুমি আমাকে খুলে বলো। তোমার বাবু আমাকে কিছুই না জানিয়ে বেচে দিয়েছেন। দরকার নেই আমার লজ কিনে। তোমার শ্যাম বিশোয়াল যদি আমাকে চার লাখ টাকা দেয় তো এই লজ আমি ওকেই দিয়ে দেব। তবুও তো দেড় লাখ টাকা প্রফিট হবে আমার।”
চরনিয়া বলল, “সেটা যদি আপনি করেন তা হলে বুদ্ধিমানের কাজ করবেন।”
“এসো তা হলে আমার ঘরে। তোমার মুখে সব শুনি। একটু আলোচনাও করি। তবে তুমি যখন এতই উপকার করলে আমার, তখন বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা দালালি হিসেবে তোমাকেও দেব আমি। কিন্তু আগাগোড়া কীসব ব্যাপার আমাকে খুলে বলো দিকিনি?”
চরনিয়া টাকার লোভে ভাল-মন্দ বিচার না করেই উঠে এল আমার ঘরে। তারপর বলল, “পঁচিশ হাজার টাকা যদি আপনি আমাকে দেন তা হলে আমি আর এ-দেশেই থাকব না। সম্বলপুরে আমার পৈতৃক ভিটেয় চলে যাব। তবে একটা কথা, আপনি যেন ভোরবেলা ভুলেও বেরোবেন না ঘর থেকে। শ্যাম বিশোয়াল আপনাকে মারবার জন্য ওত পেতে বসে আছে। ওর ধারণা আপনি পুলিশের লোক। আমিও কিন্তু তাই ভেবেছিলাম।”
“বলো কী! তা বারণ যখন করছ তখন বেরোব না। এখন খুলে বলো তো সব শুনি, কীভাবে কী হল?”
চরনিয়া এলেও আমি বড় আলো জ্বাললাম না। ডিম লাইটই জ্বলতে লাগল। ও বলতে শুরু করলে আমিও একমনে সব শুনতে লাগলাম। ও বলল, “এই শাম বিশোয়াল হল একজন কুখ্যাত ব্যক্তি। যত রকমের খারাপ কাজ সবই ও করে থাকে। এখন ওর মাথায় চেপেছে সিনেমার প্রোডিউসার হওয়ার। কয়েকটি ওড়িয়া ছবিতে অংশও নিয়েছে। ওর ইচ্ছে সমুদ্রের ধারে বাবুর এই বাড়িটা কেনে এবং এখানে ওর কাজকর্ম করে। আসলে এই বাড়ি এবং এখানকার লোকেশন তো শুটিং স্পট হিসেবে আইডিয়াল। বাবু কিন্তু ওর প্রস্তাবে একদম সায় দেন না। শ্যামও টাকার পর টাকা অফার করতে থাকে। বাবুও তাকে প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন।”
“কারণটা কী?”
“প্রথমত, জায়গাটা বাবুরও পছন্দসই। দ্বিতীয়ত, শ্যামের সঙ্গে শত্রুতা। বাবুও তো একসময় খুব একটা ভালমানুষ ছিলেন না। জানি আমি সবই। ওয়াগন ব্রেকারদের লিডার ছিলেন। শেষমেশ একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে মালগাড়ির চাকায় একটা পা-ই খোয়াতে হল।”
“ওঁর পা তা হলে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে বাদ যায়নি।”
“না। সেই দুর্ঘটনার পর বাবু সেইসব পাপের টাকা নিয়ে এখানে লজ করে ভালমানুষটি সেজে বসে আছেন।”
“কিন্তু এর সঙ্গে ওই দুটি ছেলের খুন হওয়ার কারণটা কী? আমি অবশ্য জানতাম একটি ছেলে।”
“সবাই তাই জানে। কিন্তু আমি জানি সে রাতে খুন হয়েছিল দুটো। গোরাবাবু আর কালাবাবু। আসলে ওই যে খুকুদিদিমণির ছবি দেখালেন তখন, ওঁরা হলেন যমজ বোন। ওঁরা দু’বোনে ছোটবেলায় চমৎকার লব-কুশের অভিনয় করত। আমি আগে কটকের জ্ঞানমঞ্চে দরোয়ানের কাজ করতাম তো। তা সেই জ্ঞানমঞ্চ উঠে গেলে এখানে এই বাবুর কাছে এসেছি।”
“তারপর বলো।”
“এইবার মেয়ে দুটি বড় হলে খুকুদিদিমণিরই কদর হল এখানে সবচেয়ে বেশি। মেয়ে হিসেবেও খুকুদিদিমণি অত্যন্ত ঠান্ডা প্রকৃতির। তা রীতাদিদির খুব অভিমান হল তাই নিয়ে। উনি কলকাতা চলে গেলেন। এ ছাড়া অন্য কোনও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারও ছিল বোধহয়। তাই দু’বোনের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে গেল। ওদের বাবা-মা দু’মেয়ের কাছে দু’ প্রান্তে থাকতেন। তাঁরাও কেউ বেঁচে নেই আর।”
“তোমার বাবু এঁদের চিনতেন?”
“বোধহয় চিনতেন না। না হলে খুকুদিদিমণি যখন বিয়ের পর আমাদের লজে কয়েকদিনের জন্য এলেন তখন কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম। কিন্তু আমি চিনেছিলাম। বাবুর সঙ্গে অবশ্য ওঁর বিষয়ে কোনও আলোচনা হয়নি আমার। সে যাই হোক। খুকুদিদিমণি ইদানীং বেশ কিছুকাল অভিনয় জগৎ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। চাঁদিপুরের মাটিতে পা দিতেই শ্যামের চোখে পড়ে যান উনি। শ্যাম বারবার ওঁকে অনুরোধ করে তার নতুন ছবিতে কাজ করবার। খুকুদিদিমণি বা ওঁর স্বামী কেউই রাজি হন না। শ্যাম তখন গোরা ও কালাকে ওঁদের পিছনে লাগিয়ে দেয়। ওরা এসে এই লজেই ওঠে। এবং অনেক করে বোঝাতে থাকে দু’জনকে।”
“গোরা কালা কে?”
“ওরাও ওই জ্ঞানমঞ্চে কাজ করত। স্ক্রিন টানত ওরা। দিদিমণিও ওখানে অভিনয় করতেন। রামায়ণে সীতা, কৃষ্ণলীলায় রাধা হতেন। তা ওদের গায়ের রং ফর্সা আর কালো ছিল বলে ওইরকম নাম। ওরা দু’জনেই অনেক বুঝিয়েও যখন হার মেনে গেল, শ্যাম তখন খুকুদিদিমণিকে খুন করবার মতলব দিল ওদের। এই নিয়েই মতান্তর। ওরা বলল, যাকে আমরা চিরকাল দিদির মতো শ্রদ্ধা করেছি তার গায়ে হাত দেব? দরকার হলে তোমাকেই খতম করে দেব আমরা। তারই পরিণাম হল এই। গোরাকে মুখে চট চাপা দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মারল শ্যাম। আর কালাকে ছুরি মারল ওর দলের লোকেরা। কালার লাশ ঝাউবনের বালিতে পোঁতা আছে। শ্যামের নজর এড়িয়ে এই কথাটা খুকুদিদিমণিকে বলেই ওদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলাম আমি।”
“খুব ভাল কাজ করেছ। কিন্তু তোমার শ্যাম বিশোয়াল যেভাবে খুনের পর খুন করে তাতে তোমার বাবুকে এতদিন বাঁচিয়ে রাখল কী করে?”
“আসলে বাবুকে খুন করলে সবাই তো আগে ওঁকেই ধরবে। তা ছাড়া সে-কাজ করলে এই বাড়িটা কিনবে কার কাছ থেকে?”
“শ্যামের ব্যাপারে বাবুকে কখনও কিছু বলেছ তুমি?”
“না। বাবু মাথা গরম করে কখনও যদি বলে দেন শ্যামকে তা হলে আমি খুন হয়ে যেতাম। তবে এটা ঠিক, এ-বাড়ি একান্ত না পেলে বাবুকে খুন ও করতই। তাই তো বাবু ফিরছেন না দেখে ভয় হচ্ছিল আমার।”
“এবার তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি কি জানো তোমার ওই খুকুদিদিমণিকেও খুন করা হয়েছে?”
শিউরে উঠল চরনিয়া, “সত্যি বলছেন? এ তা হলে ওই শয়তানেরই কাজ। শ্যাম বিশোয়াল ছাড়া এ-কাজ আর কেউ করেনি।”
আমি এবার একটু কঠিন গলায় বললাম, “এতক্ষণ তুমি আমাকে যা যা বললে তা আদালতে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে?”
“পারব। কেননা আমি বুঝতে পেরেছি আমি নিজের জালেই নিজে জড়িয়ে গেছি। আপনি নিশ্চয়ই পুলিশের লোক। আর আমাকে ধোঁকা দিতে পারবেন না। তবে জেনে রাখুন, আদালতের চৌকাঠ পর্যন্ত ওরা আমাকে পৌঁছতে দেবে না।” বলে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই একটা গুলি এসে লাগল ওর বুকে।
মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় জানলাটা খুলে রেখে কী ভুলই না করেছিলাম। এরপর সিঁড়িতে দুড়দাড় শব্দ। আমি বড় আলোটা জ্বেলে দরজা খুলে বাইরে এসেই দেখি আততায়ী ধরা পড়েছে সাদা পোশাকের পুলিশের হাতে।
চরনিয়ার মরদেহ পুলিশের লোকেরা সরিয়ে নিয়ে গেল। শুধু শ্যাম নয় পালাতে গিয়ে ধরা পড়ল ওর দলের আরও দু’জন। সে রাতটা যে কীভাবে কাটল তা বলে বোঝানো যাবে না।
পরদিন সকালে ফোন করলাম সোমেশ্বরকে। উনি এলেন। আমার বক্তব্য লিখে ফেললাম পুলিশকে দেওয়ার জন্য। শ্যাম বিশোয়ালও চাপের মুখে সব কথাই স্বীকার করল। এমনকী প্রতিশোধ নেবার জন্য ওই তরুণী-হত্যার কথাও অস্বীকার করল না। খবর পাঠালাম রীতা পারিয়ালের কাছে। আর তীব্র ভর্ৎসনা করলাম সোমেশ্বরকে। বললাম, “নেহাত মেজর ঘোষের নাম করেছিলেন তাই। না হলে মিথ্যে পরিচয় দেওয়া বার করে দিতাম আপনার। আপনার মতো একজন ওয়াগন ব্রেকারের খুন হওয়াটাই দরকার ছিল। আপনার সংস্পর্শে না থাকলে চরনিয়াটাও মরত না।”
সোমেশ্বর মাথা হেঁট করলেন। আমি কোনও কথা না বলে নীচে নেমে এলাম। আমার কাজ শেষ। এবার পুলিশের কাজ পুলিশ করুক।
১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯১
অলংকরণ: দেবাশিস দেব