৮
বেরিয়ে এলাম। মেলা তো মেলা। আজ যেন বড় বেশি জাঁকজমক। লোকের আনাগোনাও বেশি। খানিকটা উত্তরে এসে একটি সাইনবোর্ডে চোখ পড়তে থামলাম। বড় তাঁবুর গায়ে সাইনবোর্ড। নর্থ ওয়েস্টার্ন রেস্টুরেন্ট। ব্র্যাকেটে, ভেজিটেরিয়ান। চারপাশে তার কাগজের ফুল আর মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। ঝকঝকে পোশাকে দাঁড়িয়ে রয়েছে বয়।
উঁকি মেরে দেখলাম, লোক নেই। ভেতরটা যেন অন্ধকার, ফাঁকা। ঢুকে তো পড়ি। চা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। ঢুকে দেখি, টেবিল-চেয়ার পাতা আছে ঠিক। সবই বালির উপরে। কোথাও কোথাও পাতা রয়েছে কাঠের পাটাতন।
বয় এসে দাঁড়ালো ছাপানো মেনু নিয়ে। এ আবার কী! বালুচরে শহুরে স্বর্গ রচনা হয়েছে।
মেনুর প্রয়োজন ছিল না। বললাম, ‘চা আর টোস্ট।’
পরমুহূর্তেই নজরে পড়লো, কোণের চেয়ারে একটি লোক বসে রয়েছে। সামনে টেবিল। টেবিলের উপর ফুলদানি, কাগজ কলম দোয়াতদান। ভদ্রলোক তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকেই। চোখ পড়তেই উপযাচক হয়ে হাত তুলে নমস্কার করলেন। আন্দাজে অনুমান করলাম, তিনি উত্তর-পশ্চিম রেস্তোরাঁর প্রোপ্রাইটর হবেন হয়তো! কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রতি-উত্তর দিলাম। দিতেই উঠে এলেন ভদ্রলোক। ইংরেজিতে বললেন, ‘অর্ডার দিয়েছেন?’
বললাম, ‘দিয়েছি।’
অপরিচিতের সঙ্গে আলাপে যারা দুরস্ত, গৌরচন্দ্রিকার প্রয়োজন হয় না তাদের। তাছাড়া, অপরিচিতের সঙ্গে আলাপে যারা আগ্রহান্বিত, আচমকা কোনো প্রশ্ন করতেও তাদের বাধে না। একটু হেসে বললেন ভদ্রলোক, ‘বাঙলা দেশ থেকে আসছেন নিশ্চয়ই?’ কথাটা ইংরেজিতেই বললেন। জবাব দিলাম, ‘কী করে বুঝলেন?’
পরিষ্কার বাঙলায় বললেন, ‘বয়কে যে ভাষায় হুকুম করেছিলেন, তাতেই বুঝলুম আপনি বাঙালি। আমাদের বাঙালি ভায়ারা ওরকম হিন্দি-ই বলেন কিনা! একটু হেসে আবার বললেন, ‘আপনাকে সেজন্য দোষ দিচ্ছি নে। শতকরা সব বাঙালিই তাই বলেন! শুনেই বুঝলুম আপনি বাঙালি।’
বুঝেও না বোঝার মতো করেই অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করতে হলো, ‘আপনিও নিশ্চয়ই বাঙালি?’
ভদ্রলোক একটু হেসে, বসে পড়লেন আমার পাশের চেয়ারে। ঠ্যাং দু’টো ছড়িয়ে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘কী মনে হয়?’
পালটা প্রশ্ন শুনে বিব্রতভাবে তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে। রীতিমতো চ্যালেঞ্জের হাসি তাঁর স্থূল ঠোঁট দু’টিতে। বোধ হয় সে অধিকারও ছিল তাঁর। কারুর মুখ থেকে পরিষ্কার বাঙলা শুনে যদি তাকে বাঙালি বলা যায়, তা হলে ইনিও বাঙালি নিঃসন্দেহে। কিন্তু চেহারার কোথাও সে ছাপ নেই।
লম্বায় প্রায় ছ-ফুট লোকটি। কপালটি রীতিমতো চওড়া। কপালের ঠিক মাঝখান থেকে, তীরের মতো ওলটানো ও কোঁকড়ানো চুলের অগ্রভাগ ঘাড়ের কাছে বাবরি পাকিয়ে উঠেছে। রঙটি ফর্সা, কিন্তু পোড়া তামাটে খানিকটা। সবচেয়ে দ্রষ্টব্য হলো তাঁর কপালে ও গালে গভীর রেখা। হাসিতে অমায়িক, রাগলে ওই মুখ ভয়ংকর নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে। পোশাকে, যাকে বলে ফেতো সাহেব। ময়লা জামা, তেলচিটে টাই আর লক্ষ করলে দেখা যায়, পোকা-খাওয়া ছিদ্র জর্জরিত কোট। সব মিলিয়ে বাঙালি বলা মুশকিল।
বলতে গেলাম, অবাঙালি। কিন্তু চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। ঠোঁটের হাসিটুকু ছিল না চোখে। ছোট গম্ভীর সেই চোখ জোড়াতে উঁকি দিয়ে রয়েছে যেন আর একটি মানুষ। এক ঘরছাড়া, দিকহারা, ঝোড়ো দিনের এক বাউন্ডুলে পথিক। বলে ফেললাম, ‘আপনি বাঙালি।’
ভদ্রলোক এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন হাসিতে, ‘রাইট ইউ আর মাই ব্রাদার। হাত দিন, হাত দিন। অবাঙালিরা আমাকে বাঙালি বলে চিনতে ভুল করে না। কিন্তু দেশি লোককে জিজ্ঞেস করলেই আমাকে অবাঙালি বলে বসে।’ বলে, হাত বাড়াবার অপেক্ষা না করেই ওঁর মস্ত থাবাটি দিয়ে টেনে নিলেন আমার একটি হাত। তারপর চিৎকার করে উঠলেন, ‘হোই রামাইয়া?’
নামের শেষে একটু বিসর্গজড়িত দ্রুত আকস্মিক ছেদ। অর্থাৎ রামাইয়াঃ। হাঁও নয়, হুঁও নয়, অদ্ভুত শব্দের জবাব এলো তাঁবুর ভেতর থেকে। ভদ্রলোক দ্রুত দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলে উঠলেন। তেমনি ভাষায় জবাব এলো ভেতর থেকে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ভদ্রলোকের দিকে।
সন্দেহ হলো। সত্যিই বাঙালি তো লোকটি! না কি স্রেফ ভেল্কি? এ আবার কী ভাষা বলছেন ভদ্রলোক!
বাহাদুরির ভঙ্গি নেই। চাপা উল্লসিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ভাষা বললুম, বলতে পারেন?’
বললাম, ‘না।’
‘তেলেগু ভাষা। আপনার চা দিতে দেরি হচ্ছে কেন, তাই জিজ্ঞেস করছিলুম। ও বললে, আপনার রুটি সেঁকছে।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই চা এসে পড়ল। ট্রের উপরে সাজানো সবই আলাদা আলাদা। এমনকি মাখনটুকুও। ভুলেই গিয়েছিলাম, ঢুকেছি এক সভ্যতাদুরস্ত রেস্তোরাঁয়। টি-পটের ঢাকনা খুলে দেখি, কাপ-তিনেক চা আছে। বয়কে বললাম, ‘আর একটি কাপ দাও।’
প্রোপ্রাইটর বললেন, ‘কেন?’
বললাম, ‘চা খান। ‘
‘না না না।’
অভদ্রতা প্রকাশ পেল কিনা জানি নে। তবু বললাম, ‘না কেন? এত চা কে খাবে? দু’জনের মতোই রয়েছে।’
ঠোঁট উলটে বললেন উনি, ‘ও মশাই বাঙালিদের পক্ষে। নইলে ওটুকু চা আবার একজন কি খাবে! বেশ, আপনাকে আমি সিঙ্গল কাপ দিতে বলছি।’
আমি ওঁর মতো বলে উঠলাম, ‘না না না। আমি আপনাকে আমার টেবিল-সঙ্গী হতে বলছি। আসুন না, চা খেতে খেতে গল্প করা যাক।’
‘ও! আমাকে খাইয়ে-ই পয়সা উশুল করবেন!
বলে হা হা করে হাসি। দরাজ গলায় হাসি। চকিতে ইশারা করলেন বয়কে। বয় কাপ এনে দিল। বললেন, ‘তাহলে আমি চা-টা পরিবেশন করি আর আপনি ততক্ষণ রুটি খেতে থাকুন।’
তাই হলো। চা তৈরি করতে করতেই বকবক করে চললেন উনি, ‘মশাই, খাবার কখনো খুঁতখুঁত করবেন না। ভারি খারাপ জিনিস। আগে আমার ওরকম ছিল। একবার কি হলো জানেন? তখন ছিলুম করাচীতে। পাকিস্তান হওয়ার আগে। শহর খুব ফিটফাট, রাজপথে একটা ভিখিরি দেখতে পাবেন না, এমনি কড়া আইন! ভিতরে যান, বারাকপুরের বস্তি অঞ্চলকে হার মানিয়ে দেবে, এত নোংরা। বিশেষ হাবসী পাড়ায়। যেমন নোংরা, তো দুর্দান্ত। মারামারি তাদের কথায় কথায়। বন্দরের এক হাবসী কুলি-সর্দার ইয়াকুব ছিল আমার বন্ধু। সে একবার নেমন্তন্ন করে বসলো তার ঘরে। খেতে গেলুম। আরে রাম রাম রাম। মশাই ক’দিনের বাসি হাতরুটি, সাদা সাদা পোকা দেখা যাচ্ছে। তেমনি দুর্গন্ধ। তার উপরে, মাংস বলে যা এলো, সে আর চেয়ে দেখা যায় না। কালো রঙ, বোধ হয় কোনো শাক-সবজী ছিল, আর কতগুলো নাড়ি-ভুঁড়ি। তার ওই নোংরা পাজামা দিয়ে রুটি ঘষে তুলে দিল আমার হাতে। কী করি! দ্বিরুক্তি করছি দেখে সে বিদ্রুপ করে বললো, ‘বাঙালি শুনেছি, কলাগাছের ছাল খেতে ভালোবাসে। মাংস রুটি পেয়ার করে না তারা।’ কথাটা বড় লাগল। বাঙালিকে খোঁচা? তাও এই অমৃত-সমান রুটি দিয়ে? ভাবলুম মরার বাড়া ভয় কি? খেয়ে ফেললুম। পেট ভরেই খেলুম। রাস্তায় এসে তুলে ফেললুম সব গলায় আঙুল দিয়ে। তারপর একদিন নেমন্তন্ন করলুম তাকে। ব্যবস্থাও করেছিলুম তেমনি। দু-দিনের পচা পান্তাভাত আর ঝোলা গুড়। খা, কত খাবি।’
বলে, ভদ্রলোক ঘাড় কাত করে তাকালেন আমার দিকে। গভীর বিস্ময়ে স্থানচ্যুত হলো তাঁর মুখের রেখা। বললেন, ‘মশাই, বেমালুম খেয়ে ফেললে! তারপর দিয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারি নে। মঞ্জুরি, কী বলবো আপনাকে, লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেলুম। আবার যাওয়ার সময় কী বলে গেল জানেন? বললে, বহুত বঢ়িয়া চীজ খিলায়া দোস্ত। বুঝুন ব্যাপারটা। তাই বলছি, বাইরে যখন বেরুবেন বাইরের মতন হয়ে বেরুবেন। অবিশ্যি চা আপনি কম খান তাতে কিছু নয়। কিন্তু বাঙালি বলে সব জায়গায় নিজের রীতিনীতির খুঁটি আঁকড়ে থাকব, তা করতে গেলে ফ্যাসাদে পড়ে যাবেন। তা হলেই গলায় আঙুল দিতে হবে। আরে মশাই, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াও তাই সয়। এ তো বাঙালিই বলে।’
পেটরোগা খুঁতখুঁতে বলে দুর্নাম আছে বাঙালির। আমি তার বাইরে নই। তিন কাপ চা একলা খেলে আমাকেও যে গলায় আঙুল দিতে হতো। বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ। তবু, আপাত মূল্য আছে এঁর কথার। প্রতিবাদ করতে পারলাম না। বিশেষ, এঁর বাঙালি-জেদ, আর হাবসীর পাত্তা-প্রীতির কথা শুনে। যে বাঙালিকে তিনি বিদ্রুপ করতে চান, সেই বাঙালি নামের জন্য সামান্য এক হাবশী কুলির পচা রুটি মাংস খেতেও পেছপা হননি।
কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই তিনি বলে উঠলেন আবার, ‘বিদেশে কোনো বিষয়ে পেছিয়েছেন তো, আপনি গেলেন। অমনি সবাই যো পেয়ে যাবে। ভেঁটে থাকতে হবে। যখন যেমন, তখন তেমন! লে আও তোমার কী খানা আছে। অত পটপট কীসের? সত্যি, অনেক অখাদ্য খেয়েছি। কিন্তু বমি কোনদিন কারনি আর। থাকগে যাক, ভায়ার নামটা কি শুনি?’ গায়েপড়া অন্তরঙ্গতার হাসি ছড়িয়ে পড়লো তাঁর চোখে-মুখে। সুর ছড়াল চায়ের টেবিলে। টাইপ আসর-জমানো লোকের মতো ‘ভায়া’ শব্দটি তাঁর মুখে একটুও বিচিত্র ঠেকালো না। নাম বললাম।
‘বেশ বেশ। তা এলাহাবাদে কি কোনো আত্মীয়স্বজন আছে?’
‘না।’
‘কোথায় উঠেছেন?’
আশ্রমের নাম বললাম।
আশ্রমের কথা শুনে আবার তাঁর মুখে একটু চাপা হাসির লক্ষণ দেখা গেল। যেন কতদিনের পরিচয় এমনি অন্তরঙ্গ সুরে, একটু রহস্য করে বললেন, ‘তা ভায়া, এ বয়সে এত বৈরাগ্য কেন?
বললাম, ‘বৈরাগ্য নয়। মন টানল, তাই চলে এলাম। দেখবো আর ঘুরব বলে বেরিয়ে পড়লাম।’
চা খেতে খেতে বললেন, ‘কোথায় ঘুরবেন, আর কী দেখবেন?’ মুখে তাঁর কৌতূহল ও বিস্ময়। যেন ঘোরবার দেখবার কিছুই নেই।
বললাম, ‘যা দেখি নি, যেখানে বেড়াইনি, সেই সবই দেখবো, সেখানেই বেড়াব।’ ভদ্রলোক তাঁবুর আধা অন্ধকার কোল থেকে কয়েক মুহূর্ত বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন বহু দূরে কী দেখছেন। চোখে তাঁর সেই আলোছায়ার খেলা। তারপর হঠাৎ বললেন, ‘দেখুন, আমি সত্যি মুখ্যু মানুষ। কী বলতে কী বলে ফেলব। অনেকদিন আগে একটা জাপানী কবিতার বাঙলা অনুবাদ পড়েছিলুম।
‘কি করি কোথা যাই,
কোথা গেলে শান্তি পাই?
ভাবিলাম বনে গিয়া,
জুড়াব তাপিত হিয়া।
শুনি সেথা অর্ধরাত্রে,
কাঁদে মৃগী কম্প্রগাত্রে।।’
বলে, তিনি চুপ করে গেলেন। মনে হচ্ছিল, একটা চাপা গভীর অথচ তীব্র আর্তনাদ শুনছি কাছে। তার মধ্যে অনুরণিত এক ঘোর অস্থিরতা। কিন্তু শান্ত। তারপর আচমকা চুপ করে গেলেন। যেন নিঃশব্দ রাত্রে এক পোড়ো বাড়ির দেউড়ি একবার ককিয়ে উঠে থেমে গেল। তারপর অসহ্য নিঝুমতা, অন্ধ নিঃশব্দ রাত্রির আড়ষ্টতা!
বাইরে কোলাহল। তাঁবুর আশেপাশে গণ্ডগোল চিৎকার। সে-কোলাহল ধ্বনি যেন ঝিঁঝির ঝিল্লিরব। বাইরে রৌদ্রালোকিত রূপালী বালুচর। আর কালো রঙের তাঁবুটার মধ্যে এখনো অন্ধকার লেপটে রয়েছে কোণে কোণে।
তাকিয়ে দেখি সামনে আমার নতুন মানুষ! তার বিশাল তামাটে মুখটা উঁচু-নীচু। যেন কোন্ দূর পাহাড়ের গড়িয়ে-পড়া এক পাথর। গভীর ফাটলের মতো মুখের রেখাগুলি তার গভীরতর। চোখ দু’টো পাথরের মূর্তির চোখের মতো নিষ্পলক, উদ্দীপ্ত অথচ অন্ধকার।। যেন এই শিলাখণ্ডের উপর দিয়ে বহু যুগ-যুগান্তরের রোদ বৃষ্টি ঝড় বয়ে গিয়েছে। পোড়া, ধোয়া, বিধ্বস্ত।
কী বলবো ভেবে পেলাম না। উনি এমনভাবে চুপ করলেন, সেটি যেন আর-একজনকে চুপ করিয়ে দেওয়ার মতো। আমার ঘরছাড়া অবারিত মন, আকুল আগ্রহে মেলে রয়েছে দু-চোখ। ডানা মেলে রয়েছে মুক্ত বিহঙ্গের মতো। উৎকর্ণ কান, মনের মাঝে উত্তুঙ্গ-মর্ম। মনোবীণার তারে অজানা সুরের ডাক। তাকে যেন দু-হাত মুঠি করে চেপে ধরলেন ভদ্রলোক। আড়াল করে দাঁড়ালেন আমার দিগবিদিক ছোটা পথের সামনে। কী বলব!
এত লোক, এত নারী আর পুরুষ, শিশু আর বৃদ্ধ এসেছে সারা দেশ থেকে। আমিও এসেছি। কে ডাক দিল জানি নে। কী বলে ডাকলো, কী সুরে বাজল সেই ডাকের সুর, তাও বুঝিনি। এ যেন সেই রাধার উক্তির মতোই—খেতে সাধ নেই, শুতে আনন্দ নেই। কোন অতৃপ্তি রেখেছিল চারপাশ থেকে ঘিরে, তাও খুঁজে দেখিনি। মন বললো, রইতে নারি, আর রইতে নারি ঘরে। মন ব্যাকুল হয়েছিল। তার ঝঙ্কার দিল আগ্রহের অঙ্গুলি। তাই বেরিয়ে পড়েছি। দেখবো, ঘুরব, আশা মেটাব। কিন্তু বিচিত্র বেশে এ কোন্ হরিণী সজাগ চোখে দাঁড়ালো আমার সামনে! নিজের মাঝে ছিল অতৃপ্তির কত গভীর উৎস, ভেবে দেখিনি। কিন্তু এ যে সমুদ্র! বুকে যার তীব্র গোঙানি, স্বাদ যার কটু ও লবণাক্ত।
কবিতা চীনে কি জাপানী জানি নে। হৃদয়ে যে-ভাষা জোগায়, সে কাব্যের কোন জাত নেই। সে কাব্য সকল মানুষের। মনে পড়লো, কবে একদিন পাড়ার মুদিখানায় বসে শুনেছিলাম এক পথচারী গায়কের গান—
‘কত ঘাটে ঘাটে বাঁধলাম নৌকা,
তোমার দেখা পেলাম না,
যারে শুধাই, এক জবাব পাই।
‘কার কথা কও, কোন্ জনা।’
শুধায় সবে, শুধাই আমি
শুধায় বনে বনে,
(হায়রে) বনও কাঁদে, কয় আমারে
‘তার দেখা পেলাম না’।।’
সেই একই হাহাকার। তবু কে বসে থাকবে নিশ্চেষ্ট হয়ে? ঠাঁই নেই, তবু বুকে হাত রেখে বসে থাকবো কোন্ সন্ধ্যাতারার দিকে চেয়ে? এক তারার পাশে আর এক তারা, তারপরে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি, অসংখ্য। চোখ মানে না। মন বাধা মানে না। বলরামের কথা মনে পড়ে গেল। আর আমার এই ঘরছাড়া চোখ দেখেছে শ্যামাকে। হাসিতে তার সেই মধ্যরাত্রির বিরহিণী হরিণীর কান্নাও বুঝি ছিল। শুনব বলে আসি নি। না এলে যে শুনতেও পেতাম না। কথা বলতে গেলাম। উনি বলে উঠলেন, ‘যেখানে যাবেন, এটি তো সঙ্গে যাবেই।’ বলে, তাঁর বুকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। তারপর বললেন, ‘এ কি কখনও ভরে?’
বললাম, ‘ভরে না বলেই তো!
অতবড় মানুষটা। হাসিতে কী করুণ ও নিরীহ। বললেন, ‘তবুও ভরতে হবে। কিন্তু ভায়া, ও তো কখনো ভরে না! এ সংসারে কার আছে ভরা ভাত, জানি নে। নিজেরটা তো দেখি, ফুটো পাত্র। যত ভরি, সে তত ঝরে। হিন্দিতে একটা গান আছে জানেন? যমুনা থেকে গাগরি ভরে ভরে বারবার জল নিয়ে এলি তুই ছোকরি, কিন্তু তাজ্জব! ছলকে ছকে বারবার তোর সব জল পড়ে যায়। তুই আবার ছুটিস যমুনার পানে। বলি, এ কি তোর ভরানো ঝরানো খেলা? যমুনার কালো জল কি দুরন্ত ছেলের মতো এতই দুষ্ট যে, সে কিছুতেই তোর কলসীতে থির হতে চায় না? বলে হেসে উঠলেন। একটা তীব্র কনকনে হাওয়া ঢুকলো তাঁবু দুলিয়ে। চকিত ফণার মতো দুলে উঠলো তাঁর তেলচিটে টাইয়ের অগ্রভাগ। বললেন, ‘জন্মে যা ভরে নি, মরণে কি সে ভরবে? তবু – ‘
বলে, এক মুহূর্ত থেমে নিজেই বললেন আবার, ‘তবু মন মানে না, কী বলেন? আগে বোঝাপড়া ওর সঙ্গে, তার পরে তো সব? আপনাদের সেই খ্রীষ্টান কবির কথা মনে আছে তো?’
‘আসার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়
তাই ভাবি মনে।
জীবনপ্রবাহ বহি কালসিন্ধু পানে ধায়
ফিরাব কেমনে?’
আমাদের খ্রীষ্টান কবি বটে! কিন্তু মুখস্থ দেখছি ওঁরই আছে বেশি। আচমকা একটি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বড় খারাপ নেশা ভাই। এই পথের নেশার চেয়ে খারাপ নেশা আর কিছু নেই। এ ডেকে নিয়ে এসে ছেড়ে দেয়, আর ডাকে না, পেছনে ফিরতেও দেয় না।
বলে, এক চুমুকে ঠাণ্ডা চায়ের কাপটি শূন্য করে দিলেন। আমার চায়ের পাট ফুরিয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু আটকা পড়েছি আপনা আপনি। যেচে আলাপ করতে এলেন উনি। কিন্তু ওঁর রূপ কী গুণ করলো আমাকে, যেচে বিদায়ের কথা পারলাম না বলতে। শুধু তাই নয়। ওঁর চোখের ওই দূরভিসারী দৃষ্টি, মুখময় ঝড়ের দাগ আর অসহায় হাসি মনের মধ্যে যুগপৎ অকারণ একটু ব্যথা ও কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার দেশ কোথায়?’
জিজ্ঞেস করতে আবার হেসে উঠলেন। এবার অট্টাহসি বলা চলে। বললেন, ‘চায়ের আসরটা তা হলে জমেছে ভালো, কী বলেন? দেশ তো ভাই আমার নেই। ঘরকে পর করেছি, পরকে ঘর। এখন সবই দেশ বলে মনে হয়। তবে জন্মেছিলুম বাঙলার এক গাঁয়ে। আঠারো বছর বয়সে সে-গ্রাম ছেড়ে এসেছি। তারপর দেশ থেকে দেশান্তর, যাকে বলে দেশান্তরী।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বাবা মা আত্মীয়স্বজন, তাঁরা কোথায়?’
‘বাবাকে ভাই কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মাকেও হারিয়েছি অল্প বয়সেই। আঠারো বছর পর্যন্ত পেলেছিল এক মাসি। মাসি মারা গেল। তার ছিল কিছু জমি-জমা। দেখলুম, আমার মতো অনেক বোনপো-ভাইপো রয়েছে মাসীর। তারা এসে দাবি করলো ঘরবাড়ি, জমি, গোরু-বাছুর। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি নে। বেঁচে গেলুম। ভেবেছিলাম, কাকে দেব? ভাগীদারের সংখ্যা দেখে চিন্তা ঘুচল। আর আঠারো বছর বয়স। সে যে অথৈ সমুদ্র। তার কূলকিনারা নেই!’
বলতে বলতে তাঁর সমস্ত মুখখানিতে স্বপ্ন নেমে এলো। জানি নে, এ শুধু তাঁর আসরজমানো কথা কিনা। কিন্তু তাঁকে যে কোনো নিশি পেয়েছে, সে-চিহ্ন ফুটে উঠেছে তাঁর মুখের গম্ভীর রেখায় রেখায়। বললেন, ‘ছোটকালে বাঁশঝাড় দেখিয়ে মা বলত, খবরদার, ওদিকে যাসনি। কিন্তু বড় বড় চোখে সারাদিন তাকিয়ে থাকতুম বাঁশবনের ঝুপসি ঝাড়ে। আপনি বাঙলাদেশের ছেলে। জানেন নিশ্চয়ই বাঁশঝাড়ের হাওয়ায় কী এক ‘আয় আয়’ ডাক শোনা যায় অষ্টপ্রহর। লোকে শুনলে হাসবে, আমার মুখে কাব্যি? কাব্যি নয়, এখনো কানে লেগে রয়েছে সেই ডাক। বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে দেখতুম ধুধু মাঠ। কে যেন আমাকে ডাকত ওই মাঠ থেকে। বিশ্বাস করুন। আমাকে ডাকত। লেখাপড়া করতে পারি নি। যেমনি পাখা গজাল, মানে একটু বয়স হলো, অমনি পালিয়ে গেলুম মাঠের উপর দিয়ে। আস্তে আস্তে ভয় ভেঙে গেল মাসি কাঁদত, মাসি আমাকে বেঁধে রেখেছিল। তারপর যেদিন মাসি ছেড়ে দিয়ে গেল সেই সেইদিন কে-ই বা তৈমুরলঙ আর কে-ই বা চেঙ্গিস খাঁ। বেরিয়ে পড়লাম দিগ্বিজয়ে। শুধু একজনের কাছে দাঁড়িয়েছিলুম গিয়ে। সে ছিল আমার সোনার বাঁধন। মাসি ছিল রক্তের, জানেন তো, মানুষের ব্যাপার! রক্তের চেয়ে দামী সোনা। তাকে ছাড়তে পারলে যেন সব ছাড়া গেল। সে কোনো কথাই বলে নি। শুনল, তাকাল, তারপর ঘাড় কাত করে জানালে যাও। চলে গেলুম। কেন যাচ্ছি, কীসের দিগ্বিজয়, কিছুই জানতুম না। তবু বেরিয়ে পড়লুম। সেই দিনটি ছিল আমার বড় আনন্দের দিন, আর আজ ভাবি, কী ভয়ংকর, কী সর্বনাশের দিন ছিল সেটি!’
আমি নিতান্ত বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
জিজ্ঞেস করতে করতেই তাকিয়ে অবাক হলাম। একি, এত অজস্র রেখা তাঁর মুখ ভরতি।
যেন একরাশ শুকনো দগ্ধ বর্ণের তৃণকুটার মুখ একটি। চোখে ব্যক্ত অব্যক্ত যন্ত্রণা। বললেন, ‘কেন? কেন নয়? কোন্ নিশি ডেকে নিয়ে এলো আমাকে, এখন মাথা খুঁড়ে মরছি। ফেরবার জায়গা নেই, এগুবার জায়গা নেই, কোথায় ঘুরে মরছি! কেন এসেছিলুম, কোথায় এসেছিলুম, সব ভুলে গেছি। ঘুরছি শুধু গোলক ধাঁধায়। শুনেছি অনেকে বেড়ায়, বেড়িয়ে লেখে ভ্রমণকাহিনী। আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি নে ওই বইগুলোকে। দু-চক্ষে নয়। ভ্রমণকাহিনী, সে আবার কী? দু-দিন বেড়ানো। তাহলে আমি কী? আমার এ কোন্ সর্বনেশে ভ্রমণ! শুকনো ঝরা পাতা উড়ছে পথে পথে। উঠছি পড়ছি, তারপর একদিন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাব কার পায়ের চাপে। কী যে চাইলুম, আর কী যে পেলুম! বড় ভয়ংকর নেশা ভাই, ভয়াবহ নেশা। ওই নিয়ে আবার লোকে বই লেখে?’
চুপ করলেন। মনে হলো, একটা তীব্র যন্ত্রণার সুর ঢেউ দিয়ে ফিরছে কানের কাছে। ভুলে গেলাম কুম্ভমেলার কথা। ভুলে গেলাম, কোথায় এসেছি। এ যে মাতালের ধিক্কারের কান্না। একদিন যা আকণ্ঠ পানে মাতাল করেছে, আজ তারই বিষক্রিয়া শুরু হয়েছে।
কিন্তু পথ কি মন্দ? ঘরছাড়া মানুষের সে যে তৃষ্ণার জল। যতক্ষণ সে জীবনস্বরূপ, ততক্ষণ সে আনন্দ অশ্রুভরা। সে ব্যথার ব্যথী। অগতির গতি। নিঃস্বর সঞ্জয়। পথ না হলে চলব কোথায়?
কিন্তু জানি নে, বুঝি নে, পথ কখন এমনি প্রতিশোধ নেয়! আর কী ভয়ংকর তার প্রতিশোধ। সেই প্রতিশোধেরই এক প্রতিমূর্তি যেন আমার সামনে।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার নামটি কিন্তু জানা হয়নি।’
বলতেই আবার হাসি। উচ্চহাসি হেসে বললেন, ‘নামটা ভাই বড় খারাপ আমার। এই বাউণ্ডুলে জীবনে সেটাও একটা ঠাট্টা। তাহলে আর একটু চা খেতে হয়।’
আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’ বলে, বয়কে ডাকবার আগেই উনি নিজেই সেই দক্ষিণী ভাষায় হুকুম করলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কখনো দেশে যান নি?’
বললেন, ‘বাঙলাদেশে? অনেকবার। তবে গাঁয়ে গেছি একবার।’
‘মাত্র?’
‘হ্যাঁ। যুদ্ধের পর গেছলুম, সারাটি দিন ঘুরলুম, কেউ চিনতে পারল না। গাঁয়ের হরে মুদি তেমনি বসেছিল দোকানে। শুধু গায়ের চামড়া তার ঝুলে পড়েছিল থলের মতো। কী বলবো ভাই, আমাকে দেখে বললে, কি মাংতা সাহেব? মনে মনে হাসলুম। বললুম, পৌয়া ভর চিঁড়ে দাও, দো পয়সা কী গুড়। সাহেবকে চিঁড়ে গুড় খাইয়ে তার ভারি আনন্দ। বললে, কার বাড়ি আসা হায়? বললুম, সোনার বাঁধন কি বাড়ি। সে বললে, ও সোনার বেনে? পশ্চিম পাড়ায় আছে বটে দু-ঘর। নাক কি বরাবর চলে যাইয়ে। হাসিও পেল। দুঃখও হলো। সত্যিই সোনার বাঁধনের বাড়ি নাক বরাবরই বটে। গেলুম। গিয়ে দেখলুম, ভাঙা বাড়ি আর ঘন জঙ্গল। সন্ধ্যার অন্ধকারে একটা ভূতুড়ে বাড়ি। বুঝলুম, কেউ নেই। হয়তো আমার সোনার বাঁধন অন্য কোনো দেশে আর কাউকে বেঁধেছে। তার চোখের দিকে তাকালে না বাঁধা পড়ে উপায় ছিল না। ফিরে গেলুম।’
আবার চুপচাপ। চা এলো। এবার দু’টি সিঙ্গল কাপ। বুঝলাম, সেই যে গেলেন, সেই যাওয়া আজও শেষ হয় নি।
বললেন, ‘যদ্দিন আছেন, আসবেন একটু-আধটু। একটু বকব প্রাণভরে, সে-মানুষও পাই নে।’
বললাম, ‘নামটা?’
হেসে বললেন, ‘ভোলেননি দেখছি। হাসবেন না যেন। নাম আমার রমণীমোহন মুখোপাধ্যায়।’ বলে কী হাসি! হাসি আর থামতে চায় না। বললেন, ‘কী আশ্চর্য বলুন তো, টো টো মোহন কিংবা বাউণ্ডুলে মোহন নাম রাখলেই ঠিক হতো।’
স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, চা খেতে ঢুকে এমনি এক রমণীমোহন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হবে। তাঁবুটার অন্ধকার তখনো কাটেনি ভাল করে। বাইরে বালুচরের আকাশ রুপোর পাতের মতো ঝকঝক করছে। আর বসে থাকতে পারি নে। পকেট থেকে পয়সা বার করতে গেলুম।
রমণীমোহন গল্পের নায়কের মতো বাধা দিলেন। বললেন, ‘পয়সাটা ভাই পাওনা থাক, কাল দিয়ে যাবেন।
বুঝলাম, আসবার জন্যই এই কথা। বললাম, ‘যদি না আসি?’
‘তা হলে একলা বসে বসে হাসব।’
অদ্ভুত কথা। দু’জনেই হেসে উঠলাম। বললাম, ‘কিন্তু ব্যবসা করতে বসেছেন। পয়সা না নিলে আসব কি করে?’
তাই তো ফন্দী। হেসে আবার বললেন, ‘দোকানটি আমার এক মাদ্রাজী বন্ধুর। আড়াই হাজার ঢাকা দিয়ে দোকান নিয়েছি। বুঝতেই পারছেন অবস্থা। সকাল থেকে আপনি একমাত্র খদ্দের। তবে সে সম্মান আপনাকে দেব না। আমার আত্মীয়তাটুকুই মেনে নিতে হবে আপনাকে। কী ভাগ্যি আপনি এসেছিলেন। প্রাণে একটু হাওয়া লাগল। আসবেন, আসবেন। রোজ পয়সা নেব, আজকের দিনটি পারবো না ভাই।’
বলতে বলতে উনি গম্ভীর হয়ে উঠলেন আবার। আমার মুখের হাসিটা আড়ষ্ট হয়ে রইলো। এই বিড়াট সুপুরুষ চেহারার মানুষটির ভেতরের সেই ক্লান্ত অসহায় প্রাণটি কখন যে মন দিয়ে কেড়েছে টের পাইনি। যাবার সময় ওঁর এই গাম্ভীর্য খচ করে উঠল বুকের মধ্যে।
একসঙ্গে বাইরে এলাম। রমণীমোহন বলে উঠলেন, ‘আঃ!’
দেখলাম, বুকটা ওঁর ঠেলে উঠেছে সামনের দিকে। মাথাটি উঁচু করে তুলে ধরেছেন দূরের আকাশের দিকে। দু-চোখে মুগ্ধতা। বুঝলাম, নেশা লাগছে। বিষ এখনো মাঝে মাঝে অমৃত হয়ে ওঠে। খোলা আকাশ দেখলেই মন ছুটে যেতে চায়। বোধ হয় ওইটুকুই এখনো প্রাণবায়ু হয়ে আছে।
বললাম, ‘চলি।’
সে-কথার জবাব না দিয়ে বললেন, ‘মানুষের ভিড় একটু বেড়েছে দেখছি। কাল পূর্ণিমা কিনা। স্নান রয়েছে।
পথের মানুষ। বাইরের কথা ভুলতে পারেন না কিছুতেই। বললাম আবার, ‘চলি।’
হাত ধরে বললেন, ‘আসুন।’
খানিকটা গিয়ে ফিরে দাঁড়ালাম। হাসি পেল, লজ্জাও হলো। তবু বললাম, ‘একটা কথা বলব?’
‘একটা কেন, একশোটা বলুন।’
বললাম, ‘কেন এসেছি বলছিলেন, না এলে আপনাকে দেখা হত না তো?’
বলতেই ওঁর ঠোঁট দু’টো বেঁকে উঠেই চকিতে ফেটে পড়লেন হাসিতে! হাসিটা তাকিয়ে দেখতে পারলাম না। ফিরে চললাম। শুনতে পেলাম, চিৎকার করে বলছেন, ‘তাহলে এ যাত্রা আপনার নিষ্ফল তীর্থযাত্রা! কুম্ভ আপনার শূন্যই থেকে যাবে। হা হা হা…।’
উত্তরে হাওয়ায় ভেসে এলো ওঁর হাসি। শূন্য কুম্ভ আমার ভরবে কিনা জানি নে। কিন্তু হৃদিকুম্ভ যে ভরে গিয়েছে মানুষ-রসের স্বাদে। যে মানুষ দেখে স্বাদ মেটে না, সেই অতৃপ্তি উনি বাড়িয়ে দিলেন হাজার গুণ। এ বৈচিত্র্যের শেষ নেই, রূপের সীমা নেই। এ নামেরও মৃত্যু নেই।
হঠাৎ বুকে আমার আনন্দের সীমা রইলো না। চারদিকে মানুষ। বিচিত্র রঙবাহার। কোলাহল, ব্যস্ততা, ব্যাকুলতা, ঊর্ধ্বশ্বাস মানুষ। সকলে চলেছে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে। মনের মধ্যে বেজে উঠলো সহস্র রাগিণী একই তারের ঝংকারে।
দ্রুত পা চালিয়ে দিলাম পূর্বদিকে। বালি শুকিয়ে ঝুরঝুর করছে। তেতে উঠেছে এর মধ্যেই। শীতে বড় আরাম লাগছে তাতে। পূর্বদিকে সমুদ্রগুপ্তের টিলার দিকে চললাম।
একলা চলছি নে। শত শত লক্ষ লক্ষ চলেছে। যেন আমারই সঙ্গে চলেছে সবাই। যেন চলেছে আমারই পায়ে পায়ে, আমারই হৃদস্পন্দনের তালে তালে, ছায়া ফেলে আমারই হৃদয়সরসী-নীরে। যেন সবারই ডাক পড়েছে আজ পূর্বদিগন্তে।
সত্যি, জনবন্যার ঢেউ বেড়ে উঠেছে অনেকখানি। একটি রাত্রের মধ্যেই সেই বন্যার গতি যেন চারিদিক থেকে পাক খেয়ে খেয়ে আবর্তিত হতে আরম্ভ করেছে। দূর থেকে হঠাৎ দেখলে তাই মনে হয়। কোন্ দিক থেকে আসছে মানুষ, যাচ্ছে কোন্ দিকে, কিছুই ঠাহর করা যায় না।
সামনে উঁচু-নিচু বালুচর। এদিকে তাঁবুর সংখ্যা ক্রমে কমে এসেছে। কমে আসতে আসতে শেষ হয়ে গিয়েছে একেবারে। শুধু সাদা বালু। তার উপর দিয়ে মানুষের বন্যা এ সকালের বেলায় যেন ঘন অরণ্যের সারি হয়ে উঠেছে। টাঙ্গা ছুটে চলেছে। ছুটে নয়, ঠেলে ঠেলে নিয়ে চলেছে। এরই উপর দিয়ে, মানুষের ভিড়ের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে প্রাইভেট মোটরকার। হাওয়ায় উড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বালি।
দেহ শীতার্ত। অথচ আকাশে আশ্চর্য মেঘ ও রোদের সমারোহ। সাদা মেঘের দল চলেছে নীল আকাশের আঙিনা জুড়ে। ছোট ছোট মেঘের টুকরোয় রোদের ছোঁয়া লাগায়, তার ধারে খেলছে রুপোলি ঝিলিমিলি।
ঝুসির গ্রাম থেকে নেমে আসছে উটবাহিনী। পিঠে তাদের কাঠের বোঝা। দূর থেকে দেখা সমুদ্রের ঢেডয়ের মতো দুলতে দুলতে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে আসছে গাধাবাহিনী। তাদের পিঠে শুধু কাঠ নয়। কাঠ, তরিতরকারি, ফল।
মানুষ পশু ও প্রকৃতির বিচিত্র সমারোহ। হাসি ও কলকোলাহল। অন্ধ সুরদাস চলেছে গান গাইতে গাইতে। তার ভাষা বুঝি নে। দরাজ গলায় তার ভৈরবী সুরের মধ্যে শুধু ছড়ার আহ্বান। শুধু ডাক। এই ভিড়, কোলাহলের মধ্যেও সে-সুরে কী বিচিত্র প্রসন্নতা। মুক্তি ও আনন্দের স্বাদে ভরপুর।
তাকিয়ে দেখি, শীত নেই অন্ধ সুরদাসের। খালি গা। ছিন্ন ময়লা উত্তরীয় বেঁধেছে কোমরে। রুক্ষু চুলের জটা উড়ছে বাতাসে। হাতের লাঠিখানি ঘুরে ফিরে চারিদিক দেখে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে থামছে গান। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, সুরদাস হাসছে থেকে থেকে। ডাইনে বাঁয়ে দেখছে, দেখছে আকাশের দিকে। যেন সে সত্যি দেখতে পাচ্ছে! হাসছে, আর তার মাতৃভাষায়, গেঁয়ো টানে থেকে থেকে জিজ্ঞেস করছে, ‘ওগো, শুনছো, ঠিক যাচ্ছি? পথ আমার ঠিক আছে তো?’
কেউ জবাব দেয়, কেউ দেয় না। কেউ বলে, অন্ধ কেন এ পথে? সে হাসে। হেসে হেসে আবার গলা ছেড়ে গেয়ে উঠছে গান।
আমি ভাবি, আমারই পায়ে পায়ে চলেছে মানুষ। অন্ধ সুরদাসের উল্লাস দেখে মনে হলো, সারা মেলা চলেছে ওরই পায়ে পায়ে। চলেছি যেন ওরই গানের সুরে সুরে।
চলেছি মনের বেগে, দেহের বেগে। তবু, আশ্চর্য! এ মন-পবনের নায়ে কোনো এক মেয়ে যেন ক্লান্ত সুরে গান গেয়ে চলেছে আমারই পাশে পাশে। সে যেন গুনগুন করছে—
যে ছিল আমার স্বপনচারিণী।
তারে বুঝিতে পারি নি।
দিন চলে গেছে খুঁজিতে….
ও! মনের দিকে তাকিয়ে দেখি, রমণীসমোহন মুখোপাধ্যায় চলেছেন আমার সঙ্গে সঙ্গে। রেখে এসেছি, ছেড়ে আসতে পারি নি দেখছি। পারা কি যায়? সেই শৈশবের কেষ্টযাত্রার নিমাইয়ের সন্ন্যাসযাত্রার কান্না মনে পড়ছে। স্বামী-সোহাগিনী বিষ্ণুপ্রিয়া নিদ্ৰা যাচ্ছে। নিমাইয়ের অঞ্চল তার ঘুমন্ত শিথিল মুঠিতে চাপা রয়েছে। নিমাই সাশুনয়নে ধরেছে গান—
মায়ার বাঁধন ছাড়া কি গো যায়?
যাই যাই মনে করি, যাইতে না পারি
মহামায়া আমার পিছনে ধায়।।
কে জানে, কাল যেতে পারবো কিনা রমণীমোহনের কাছে। কে জানে, কোনোদিন যেতে পারবো কি না! ঋণ? নিয়েছি, ভোগ করেছি মনোকষ্ট। কিন্তু সে-ঋণে তো বাঁধেনি আমাকে সে! সে যে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বাঁধলে, সে যে ধরে রাখলে আমাকে মুক্তি দিয়ে।
তার সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনী, সংক্ষিপ্ততর তার সোনার বাঁধনের কথা। যে কাহিনীর তরী ভাসছে রক্ত আর অশ্রুর নদীতে। জানি, এ চলার পথে হারিয়ে যাবেন উনি। হারিয়ে যাবেন হয়তো সূর্যাস্তের আগে। তবু বুঝলাম, মন-সৈকতে আঁকা রইলো যে রেখা, সে অদৃশ্যে ফিরবে আবার চলার পথে ক্লান্ত মেয়ের মতো। তাকে তো আটকাতে পারবো না।