৪
দিদিমার হাতের রান্না মিষ্টি শুধু নয়। কুম্ভমেলায় এই বালুচরে, বাঁধাকপির পাতার সঙ্গে বড়ি দিয়ে যে এমন অবিস্মরণীয় নিরামিষ চচ্চড়ি জুটবে কপালে, তা কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি। রাত্রে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দিদিমা দেয় যত গঞ্জনা, তত নিরামিষ ব্যঞ্জনে ভরে ওঠে পাত। একেই বলে বোধ হয়, ভগবান যখন দেয়, ছপ্পড় ফুঁড়ে দেয়। এমন খাওয়া তীর্থক্ষেত্রে। রাজি আছি বারো মাস পড়ে থাকতে এখানে।
কিন্তু প্রহ্লাদ ফেরে নি এখনো। সে-ই দিদিমার ভাবনা। ব্রজবালারও।
আহারের পর বিশ্রাম। বিশ্রাম আর নয়। গত দু-রাত্রির সমস্ত ক্লান্তি আমাকে এই দিনের বেলা একেবারে গ্রাস করে ফেললো।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম, জানি নে। জেগে দেখি, অন্ধকার। ঠাওর করে দেখলাম, কেউ নেই। মেলার চারিদিকের গণ্ডগোলের সঙ্গে আশ্রমের গীত কানে এলো। পর্দা উঠিয়ে দেখি, আশ্রম প্রাঙ্গণে জনসমুদ্র। নারী, পুরুষ ও শিশুর মেলা। জ্বলে উঠেছে আলোর সারি। রঙে রঙে রঙের বান ডেকেছে চারিদিকে। হাসি, কথা ও গানে মুখরিত দিগন্ত।
মনে হয় কত কী না-জানি দেখতে পেলাম না। কত কী না-জানি হারালাম। তাড়াতাড়ি উঠে জামাকাপড় বদলালাম। রাত্রির সেই শীত আবার খুলছে তার মুঠো-করা থাবা। আস্তে আস্তে নেমে আসছে এই বালুচরের উপর তার ভয়ংকর আক্রমণ। এখন থেকেই দিচ্ছে হাড়ে কাঁপুনি।
তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে থমকে দাঁড়ালাম। আশ্রমের গেটের সামনে দেখলাম এক আলোর ঝলক। সে আলো শুধু আলো নয়, নারীর রূপের আলো। পৃথিবীতে এত রূপও যে ছিল, তা জানতাম না।
কানের কাছে শুনলাম, কে যেন বলছে ফিসফিস করে, ‘ওই যে, ওই রামজীদাসী আসছেন।’
‘রটি গেল সেই বার্তা’ কান থেকে কানে গেল ছড়িয়ে। এসেছে রামজীদাসী ব্রহ্মচারিণী। শুধু কানে কানে নয়, বুঝি ‘পশিল’ মরমে মরমে। যারা জানে আর জানে না যারা, সকলেরই চোখে অপার বিস্ময় ও কৌতূহল।
দাঁড়িয়েছিলাম, দাঁড়িয়েই রইলাম। পলক পড়লো না চোখের। মনে রইলো না সাড়া।
স্বপন বাধা টুটি
বাহিরে এলো ছুটি
অবাক আঁখি দু’টি
হেরি তারে।
অবকাশ রইলো না ভাববার, রূপ সে কেমন। মনের মাঝে শুধু আপানি গুনগুন করে উঠলো—
যেন মঞ্জুরী দীপশিখা।
নীল অম্বরে রাখে ধরি।
অন্তহীন গুনগুনানি বেজে চললো মনের তলে চাপা বীণার তারে। চোখের দৃষ্টি আটকে ছিল নীল আকাশের গায়ে। আদিম রহস্যসন্ধানী মন বারবার দেখতে চেয়েছে, কী আছে ওই নীল আকাশের ওপারে। ভাবলাম কল্পচারী মনে, ‘মাথার পরে খুলে গেছে আকাশের ওই সুনীল ঢাকনা’। চোখভরা শুধু মানুষের রূপ। মানুষ নয়, মানবী, নারী। এত রূপ! দেখি নি তো কোনদিন। একি ব্রহ্মচারিণী রূপ!
শুনেছি আর পড়েছি, নারীরূপের তীব্র ছটা জ্বালিয়েছে সোনার সিংহাসন। ছারেখারে দিয়েছে রাজ্য। ধসিয়ে দিয়েছে রাজধানী।
প্রাণ নাশ করেছে লক্ষ লক্ষ প্রজার। বিদেশে কেন যাই। নিজের দেশে পদ্মিনীর কথা মনে নেই?
সে রূপ কি এমনি? সে রূপ কি এর চেয়েও বেশি? কে জানে! মরু-জগতের রূপ-পাগল চোখ আমার। রূপ-ক্ষুধায় অম্লান আমার দু’চোখের দীপ্তশিখা! কোতোয়াল বলেছিল। হিমাচলের মেয়ে। ঠিক! এ তো সূর্যছটাদীপ্ত বরফশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার শৃঙ্গ।
রূপের বর্ণনা আর দেবনা খুঁটিয়ে। কৌতূহলটা প্রকাশ না করে পারবো না। এ কেমন ব্রহ্মচারিণী! প্রাচীন মলমলের মতো শুভ্র সূক্ষ্ম তার শাড়ি। চাপা রুপোলি তার পাড়। আধুনিকতার মতো কুঁচিয়ে আঁচল এলিয়ে দিয়েছে। সারা গায়ে নেই অলংকার। কিন্তু সুদীর্ঘ বেণী কালো সাপের মতো এলিয়ে পড়েছে তার পিঠ বেয়ে। বয়স? সে আনুমানের ক্ষমতা আছে কোন্ পুরুষের!
পদক্ষেপে নেই তার রূপসীর অহংকার। কিন্তু চোখে আছে সচেতন দৃষ্টি। রক্ত-রেখায়িত ঠোঁটে তার চাপা ও মুগ্ধ হাসি। আকর্ণবিস্তৃত কালো চোখে বিচিত্র আলো।
পেছনে তার অনেক নরনারী। একটি পুরুষ চলেছে পাশে পাশে। পোশাকে তার ভারী চাকচিক্য। মাথায় সাদা পাগড়ি। হাতে একখানি সরোদ।
রামজীদাসী গিয়ে বসলো মঞ্চের এক ধারে। বাহু প্রসারিত করে লুটিয়ে প্রণাম করলো মোহান্তকে। ভস্মাচ্ছাদিত জটাজুটধারী মোহান্তের পরনে কপনি। নেত্র রক্তবর্ণ। ফিরেও তাকালো না। শূন্যে তাকিয়ে হাত তুলে আশীর্বাদ করলো।
চাঁদ উঠেছে আকাশে। সুগোল নয়, কানা-ক্ষয়া থালার মতো। হাল্কা কুয়াশা পড়েছে ছড়িয়ে। যেন হাল্কা ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে মেলা। তার মাঝে বালুর বুকে অভ্রকুচির চাপা হাসির ঝিকিমিকি
সমস্ত মেলা জুড়ে মাইক ও জনতার হট্টগোল। আলোয় আলোময় চারিদিক। তাকিয়ে দেখি, যেন কোন্ আধুনিক নগরে আলোকিত কেন্দ্রে এসে পড়েছি। লাল নীল আলোকমালায় সাজানো হয়েছে কোথাও। আধুনিক বিপণির চমকিত আলোক-বিজ্ঞপ্তি। কোনো গাছে রঙিন আলোর ঝাড়। রঙিন হীরা ফলেছে সোনার গাছে। অজস্র ফুলের মতো রয়েছে ফুটে। গোধূলির আধো-আলোয় মাধবীবিতান। আর এই বালুচরের বুকে হাডসন ও অস্টিনের অভিজাত শহুরে হর্ন-নির্ঘোষ। নগর-কেন্দ্রকে মনে করিয়ে দিল বেশি করে। আমাদের সামনে বালু ঠেলে দাঁড়ালো এসে কয়েকটি গাড়ি। বাহারী পোশাক ও রঙের হাট নেমে এলো আশ্রমের মধ্যে।
কোনো এক মহিলা নেমে আসছিলেন চেন-বাঁধা কুকুর সমতে। হয়তো তাঁর আদরের পপি টমি গোছের একটি স্নেহের জীব। বাধা পড়ল। পাহারাদার সন্ন্যাসী আটকেছে তার পথ। আশ্রম-প্রাঙ্গণ অপবিত্র করবেন না মায়জী। কুকুরের প্রবেশ নিষেধ।
তাহলে? রঙ-রঞ্জিত ঠোঁটে বিরক্তির আভাস। তবে যেতে হবে। গাড়ির ভেতর পুরতে হলো আদরের জীবটিকে। সামান্য ফাঁক রেখে তুলে দিতে হলো দরজার কাচ। তারপর ঢুকলেন ভেতরে।
স্যুটপরা তরুণের দল করছে ভিড়। পকেটে দু’হাত, আর চোখে বিস্ময় ও কৌতূহল। চাপা হাসি আর গা টেপাটেপি।
ওদিকে গণ্ডগোল মহিলা চত্বরে। পাঞ্জাবী মহিলাদের রঙিন ওড়নার পালেই হাওয়া বেশি। বেশি কন্ঠের তেজ। দুই অবুঝ ভাষায় লেগেছে কলহ। বাঙালি ও পাঞ্জাবী।
কে বলছে, ‘ওমা, সরবো কোথায় গো আর? এ বেটি বলে কী?’
প্রতিবাদে গাঁক গাঁক করে উঠলো যে নারীকণ্ঠ, তার ভাষা বুঝি নে আমিও। লিখব কেমন করে! সম্ভবত যে স্থানটিতে বসেছে, সেটি কারুর পিতৃপুরুষের কেনা জায়গা নাকি, সেটাই কূট তর্কের বিষয়বস্তু। এর পরের প্রসঙ্গ নিশ্চয়ই, সারা কুম্ভমেলাটাই কারুর স্বামী বা পিতা কিনেছেন কিনা, সেই বিতর্ক।
শোনা গেল, ‘কী খাণ্ডার মেয়েমানুষ বাবা! আমাদের বাড়ির পাশে যে পাঞ্জাবী বউটা আছে, সে তো এমন ঝগড়ুটে নয়।
কথার মধ্যে কিঞ্চিৎ পশ্চাদপসরণের আভাস। তাকিয়ে দেখলাম, কলপাড়ের সেই বিপুলকায়িনী। বোঝা গেল, তার বাড়ির পাশের প্রবাসিনী পাঞ্জাবী বউয়ের তুলনায় সে কয়েক ডিগ্রি উচ্চে অবস্থান করে। অবশ্যই কলহে। কিন্তু পাঞ্জাবী তীর্থযাত্রিণী তার চেয়েও উচ্চে। বোধ হয় জীবনে একটি নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হলো। উত্তর প্রদেশের মহিলাকুলও কম যাচ্ছে না দেখা গেল।
মাইকে শোনা গেল, ‘জাগ্রত ভগবান এখানে অধিষ্ঠিত। মায়িজী, আপনারা দু’দিনের জন্য ভগবানের নাম করুন। সদা ভগবানের সেবা করুন। ঝগড়া করবেন না। ভগবান বিমুখ হবেন। রামজীদাসী ব্রত্নচারিণী আপনাদের ভগবান শ্রীরামের মহিমা শোনাবেন।’
কথাগুলো বলা হলো হিন্দিতে। উর্দু মিশ্রিত নয়, বরং খানিকটা বাঙলা মিশ্রিত যেন। বুঝতে অসুবিধা হলো না অধিকাংশেরই।
একটু স্তিমিত হলো কলহের কলকণ্ঠ। গুঞ্জন উঠলো তানপুরার তারে। দু’হাত জোড় করে বসেছে রামজীদাসী। নিমীলিত চোখ। জানি নে কী ছিল ওই মুখে। কিন্তু মনে হলো, ওই একখানি মুখ আলো করে রেখেছে সমস্ত মঞ্জু। আবার বলি, সে আলো রামজীদাসীর রূপ-শিখা।
এ রূপ শীতল জলরাশির মতো ঢলঢল নয়। শান্ত গভীর জলের বুকে ভাব-পাগলের অবগাহনের ডাক নেই তাতে। একটি অসহ্য দ্যুতি, একটি দুরন্ত দীপশিখা। কাঁপছে আর জ্বলছে ধিকিধিকি। দর্শক শ্রোতা আর পুণ্যার্থী নরনারী এই দীপশিখারই আলোয় আলোকিত। নিমেষহারা চোখ। মুগ্ধ মনের ছায়াচাপা মুখ
মন ভুলেছিল রূপে। কথাহারা মন কথা বললো এবার। সুদূর হিমাচলের, তার দূর গুহাকন্দরের রহস্যের মতো মনে হলো আমার এই ব্রহ্মচারিণীকে দেখে।
দূরে সরে গেলাম ভিড়ের কাছ থেকে। দূর থেকে দেখবো। একলা একলা দেখবো, মনে মনে দেখবো। ঘুরে গেলাম বেড়ার কাছে। ছিন্ন কম্বল আর কাপড় জড়ানো কতগুলি কালো মূর্তি গায়ে গায়ে জড়িয়ে বসেছে দূরের আধো আলোয়। বেড়ার গা ঘেঁষে বসেছে। এখানে মাথার উপর ঢাকনা নেই। দূরের আধো আলো আর কুয়াশা-চাপা চাঁদের আলো মিলে সৃষ্টি করেছে যেন একটি রহস্যঘন অন্ধকার। লক্ষ করে দেখলাম মূর্তিগুলি সব তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকেই। আরো লক্ষ করলাম, গুটি দুয়েক জ্বলন্ত গাঁজার কলকে, পাঁচুগোপালের ভাষায় সপ্তমী, ঘুরছে সকলের হাতে হাতে। গায়ে মুখে তাদের ভস্মমাখা। বুঝলাম, সকলেই সাধু।
কে একজন সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল হনহন করে। গায়ে ধাক্কা লাগল। তাকিয়ে দেখলাম, কোতোয়াল। ডাকলাম, ‘কোতোয়ালজী, সাধুজী!’
কোতোয়াল ফিরল। বললো, ‘কে? ও! আপনি এখানে কেন, সামনে যান।’
বললাম, ‘না, দূর থেকেই দেখি। দূর থেকেই ভালো দেখা যায়।’
কোতোয়াল একবার তাকিয়ে দেখলে মঞ্চের দিকে। দেখে মুখ ফেরাল। ফিরে রইলো এক মুহূর্ত। জানি নে ভুল দেখলাম কিনা। কিংবা চাঁদের এই কুহকী আলোরই এমনি কারসাজি। কোতোয়ালের সারা মুখে একটি বিচিত্র ভাবান্তর খেলে গেল। সে-ভাবান্তরে গভীর ও থমথমে হয়ে উঠলো তার মুখ। বললো, ‘তাই দেখুন। হয়তো দূর থেকেই ভালো দেখা যায়
আশ্চর্য! কোতোয়াল কথা বললো। কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকালো না। বললাম, ‘চললেন কোথায়?
কোতোয়াল এবার হাসলো। বললো, ‘সেই সর্বনাশী ঘুরছে আশেপাশে। দুবার সে চেষ্টা করেছে আশ্রমে ঢোকবার। ঢুকতে পারে নি। বেড়ার ধার দিয়ে গেছে ওই দিকে, পশ্চিমে। দেখি কোথায় গেল! বেড়া ভেঙে ঢুকলে আর রক্ষে নেই। কারোর সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
সর্বনাশী। সে আবার কে? কোতোয়ালের সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন সর্বনাশীর কথা বলছেন? কে সৰ্বনাশী?’
কোতোয়াল বললো, ‘জানেন না? খবর রাখেন না দেখছি। নারী চোরবাহিনীর সে সেরা মেয়ে। সে তো সব সময়েই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সাংঘাতিক মেয়েমানুষ। পুলিশে ধরে নিয়ে গেলেও যে কী করে বার বার ছাড়া পেয়ে যায়, সেটাই আশ্চর্য।’
খবর ঠিক রাখি নে বটে। তবে শুনেছিলাম ব্রজবালার মুখে। তাকিয়ে দেখলাম, বেড়ার বাইরে চলেছে শত শত নরনারী। চলেছে পুব থেকে পশ্চিমে। উত্তর থেকে দক্ষিণে। এর মধ্যে সেই নারী-চোর কী করেই বা বেড়া ভাঙবে, আর ঢুকবেই বা কী করে! সে তো জাদুকরী নয় যে অদৃশ্য হয়ে ঢুকবে।
বললাম, ‘এত লোকের মাঝে কী করে চুরি করবে সে?’
কোতোয়াল একটু বিচিত্র হেসে বললো, ‘লোকের মাঝেই তো চুরি করে সে। যত মানুষ, তত তার সুবিধে।’
পশ্চিমের বেড়ার ধারের কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালো কোতোয়াল। বালুচরের ভিড়টা এদিকে একটু হালকা। তাকিয়ে রইলো সেই ভিড়ের দিকে। তারপর আমাকে বললো, ‘ওই দেখুন, একটি মূর্তি ছুটছে। ছুটে চলেছে গঙ্গার দিকে। লক্ষ করেছেন? ‘
বলা মাত্রই দেখতে পেলাম না। লক্ষ করলাম কয়েক মুহূর্ত। তারপর দেখলাম, সত্যি, ভিড়ের মাঝে ডুব দিয়ে দিয়ে হঠাৎ জেগে উঠছে একটি মূর্তি। মেয়েমানুষ নিঃসন্দেহে। ছোটার বেগে আঁচল উড়ছে তার।
কোতোয়াল বললে, ‘ও যাদের চেনে, তাদের দেখলেই পালায়। তবে, ওর পালানোর কথা বলা যায় না। এই দেখছেন গঙ্গার দিকে ছুটছে। আবার হয়তো এখুনি দেখবেন, ঝুসির কোল আঁধার থেকে পা টিপে টিপে আসছে ক্যাম্পের দিকে। আর-জন্মে বোধহয় চিতাবাঘ ছিল।’
হবে হয়তো। চোর, তাও আবার নারী। ব্রজবালার মুখে যা শুনেছি, তাতে চোরটি যুবতী ও সুন্দরীও সম্ভবত। রহস্যের মধ্যে কিঞ্চিৎ রসিকতার কথাই স্বভাবত মনে আসে।
এমন সময় মাইকে কণ্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালাম। রামজীদাসী নিমীলিত চোখ খুলেছে। তানপুরার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে একটানা গেয়ে চলেছে শুধু, রাম রাম, রাম রাম, রাম রাম, রাম রাম। বারকয়েক রামজীদাসী একক কণ্ঠে রাম নাম গেয়ে গেল। কণ্ঠে কোথাও সঙ্গীত অধ্যবসায়ের কারুমিতি ঠেকলো না কানে। যেন গ্রাম্য বালিকার সরু চাপা কণ্ঠের সুর। একটু পরেই তার কণ্ঠে কণ্ঠ দিল কয়েকজন পুরুষ ও আরও দু’টি নারী। এরা আবার কারা? জিজ্ঞেস করবার জন্য ফিরে দেখলাম, কোতোয়াল নেই, আশ্চর্য তো! চোখে পড়লো, অদুরেই বেড়ায় বাঁশে হেলান দিয়ে একাকী দাড়িয়ে রয়েছে একজন। কোতোয়াল ভেবে কাছে গিয়ে উঁকি দিলাম।
লোকটি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মঞ্চের দিকে। লোক নয়, সাধু নিশ্চয়ই। ঝাপসা আলোয় মনে হলো ফর্সা মুখ। কুঞ্চিত ঘন দাড়ি সেই মুখে। এত শীতেও গায়ে শুধু মাত্র সুতি কাপড়ের গেরুয়া বস্ত্র একখানি। ঘাড় অবধি বেয়ে পড়েছে ঘন চুলের গোছা। জটাজুটের কোনো চিহ্ন নেই। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।
মঞ্চের দিকে শুধু দৃষ্টি নয়, বোধ হয় মনটিও পড়েছিল। আমি যে উঁকি দিলাম, প্রথমে নজরেই পড়লো না তার। কোতোয়াল নয় দেখে ফিরতে গেলাম।
হঠাৎ বোধ হয় সংবিত ফিরে পেল সে। পরিষ্কার হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবুজী, আপনি কী দেখলেন?’
সঙ্কুচিত হলাম। উঁকি দেওয়াটা ঠিক হয় নি বোধ হয়। বললাম, ‘আমি একজনকে খুঁজছিলাম। ভেবেছিলাম, আপনিই বুঝি সে।’
ভেবেছিলাম মিটে গেল কথা। কিন্তু সাধুটি হাসলো। হাসিতে তার চাপা উত্তেজনার আভাস। একটু যেন অপ্রকৃতিস্থ! একটু যেন রহস্য করেই বললো, ‘ভেবেছিলেন, আমি-ই সে! হাঃ হাঃ হাঃ—সে কোথায়! তাকে এখানে কোথায় পাবেন আপনি!’
আবার সেই কথা। সেই ভাব। সে আবার বলে উঠলো, ‘আপনি খুঁজছেন, বাবুজী, আমিও খুঁজছি। দুনিয়াভর তাকে খুঁজছি। জীবন কেটে গেল, তবু পাত্তা মিলল না।’
এ কথার কোনো জবাব নেই। কী জবাব দেওয়া উচিত, তাও জানিনে। অতএব সরে পড়াই ভালো।
কিন্তু সে আবার হেসে উঠে বললো, ‘কাকে খুঁজছিলেন বাবুজী?’
বললাম, ‘এ আশ্রমের কোতোয়ালজীকে।’
সাধু বললো, ‘রামানন্দজীকে? এই তো এখান দিয়ে চলে গেল সে।’
রামানন্দ! বললাম, ‘কে রামানন্দ?’
‘কেন, এ আশ্রমের কোতোয়ালজী।’
‘আপনি চেনেন?’
সাধু হাসলো। চাপা গলায় হা-হা করে হেসে বললো, ‘চিনিনে? অনেকদিন থেকে চিনি।’
‘আপনি কি আশ্রমের লোক?’
সাধু বললো, ‘না।’ বলে তাড়াতাড়ি বললো, ‘দেখুন, দেখুন রুক্মিণী নাচছে।
ফিরে তাকালাম। দেখলাম, রামজীদাসী কোমরে বেঁধেছে আঁচল। নেমে এসেছে মঞ্চ থেকে। মঞ্চোপরি মোহান্তর পাশে দেখলাম, যাত্রার দলের পোশাক পরে বসেছে তিনজন। তিনজনই বালক মনে হলো। দু’জনের ধনুকধারী পুরুষের বেশ। আর-একজনের রানীর বেশ বলেই মনে হলো।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার? এরা কারা?’
সাধু হাসলো। তার হাসির মধ্যে কোথায় একটা বিদ্রূপ ও কৌতুকের ছোঁয়া লেগে রয়েছে যেন। সে বললো, ‘ওরা রাম লক্ষণ আর সীতা। সাজিয়ে এনেছে একটি কীর্তন মণ্ডলেশ্বরের দল। রুক্মিণী এবার নাচবে। সে যে রামজীদাসী। মীরাবাঈয়ের কথা শুনেছ বাবুজী? কৃষ্ণদাসী, কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনী মীরাবাঈ। মহাপ্রেমিকা। কিষেণজীর নাম শুনলে প্রেমে অবশ হয়ে যেত রাজরানীর অঙ্গ। আর এই রামজীদাসী রামপ্রেমে পাগলিনী। সে যেখানে যায়, কীর্তন মণ্ডলেশ্বর সেখানেই রাম-সীতার মুক্তি নিয়ে হাজির থাকে। নইলে রামজীদাসী পাগলের মতো ঘুরবে, খুঁজবে, দেখবে। কোথায় সেই মোহন মূর্তি। নাম-গান করতে করতে প্রাণ তার অবশ হয়ে যায়। কখনো নাচে গায় হাসে কাঁদে।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘রুক্মিণী কাকে বলছেন আপনি?’
সাধু বললো, ‘কী বলবো তবে? মনিয়াবাঈ?’
‘মনিয়াবাঈ কে?’
‘রামজীদাসীর আর এক নাম ছিল। কিন্তু মনিয়াবাঈ মরে গেছে অনেকদিন।’ বড় কৌতূহল হলো। কুহেলিকাময় চাঁদের আলোয় সাধুর মুখে এক বিস্মৃত যুগের রহস্যকাহিনী যেন উঁকি মারছে। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করবার অবসর পেলাম না। বাজনা বেজে উঠলো। সরোদ আর তবলায় বেজে উঠলো নাচের বোল। রামজীদাসী ধরেছে গান।
কৌন বন্ পহুঁছে সখী দো পেয়ারা, দো পেয়ারা
যা’কে ভোজন মেওয়া মিঠাই তে করসে বনবল। করত্ আহারা।।
গানের সঙ্গে সঙ্গে নাচ। আশ্চর্য! এই নৃত্যভঙ্গিমা, পদ-সঞ্চালন, হাত ও আঙুলের মুদ্রা তো অশিক্ষিত অপটু নাচিয়ে মেয়ের নয়! এ শুধুমাত্র ভাবের ঘোরে ঘুরে ঘুরে নাচ নয়। প্রতিটি পদক্ষেপে তার নৃত্যকুশলী প্রতিভার অপূর্ব স্ফুরণ। হৃদয়তল ছন্দায়িত হয়ে উঠলো তার নাচের ছন্দে ছন্দে। ভুলে গেলাম, রয়েছি এক বালুচরের আশ্রমে। মনে হলো, কোনো নামকরা নৃত্যকুশলার নাচ দেখতে বসেছি কোথাও।
নাচের নাম জানি নে, তাই বলতে পারবো না। নাচের দোলায় দোলায় রামজীদাসীর রূপের ছটা বিচ্ছুরিত হলো দিকে দিকে। যে রূপ দেখেছি, সে রূপ ছিল ছাইচাপা। নাচের হাওয়ায় উড়ছে ছাই। আর-এক বিচিত্র রূপে রূপবতী হয়ে উঠেছে রামজীদাসী। আধুনিক ভঙ্গিতে পরা তার মলমলের শাড়ি। ভাঁজে তার রূপের শিহরণ। তার পিঠের বেণী চঞ্চল কালো নাগিনীর মতো হিস্ হিস্ করে উঠছে অস্থিরতায়।
যাকে আচোয়ান সরযূ গঙ্গাজল
তে কয়সে পিয়ত্ জঙ্গল জল খাড়া।।
তারপর করুণ কণ্ঠের মিনতি, ‘কহো কহো মেরী রাজা।’ গানের ভাষা দেহাতি মনে হয়। সব কথার অর্থ বুঝিনে। মনে হলো, বনবাসী রামকে জিজ্ঞেস করছে, ‘রাজার ছেলে তুমি। নিয়ত খেতে মেওয়া মিঠাই। কিন্তু বনে এসে তুমি কী করে বনফুল খেয়ে রয়েছো? নির্মল গঙ্গাজল তোমার পানীয়, কিন্তু হে রাম! জঙ্গলের জল তুমি কেমন করে পান করছ? চরণ তোমার নিত পল ‘পর, কেমন করে তুমি ঘুরছ বনে বনে পাহাড়ে পাহাড়ে। ওগো রাজা রাম! ঐ দুঃখ তুমি সয়েছ, আমার যে সয় না।’
একটা মাতন লাগিয়ে দিয়েছে রামজীদাসী। তাকিয়ে দেখি, সভাস্থ সকলের চোখেমুখে একটি ভক্তিরসের ছোঁয়া লেগেছে। রস করুণ, নিঃসন্দেহে। রামজীদাসীর রূপমুগ্ধ মানুষের হৃদয়ে কোনো চোরাপথ দিয়ে এসে পড়েছে একটি ভক্তিরসের শীর্ণধারা। জানি নে, প্লাবনের সৃষ্টি হবে কিনা!
‘আমার পার্শ্ববর্তী সাধু বলে উঠলো, ‘উলারা।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেটা কী?’
‘এই গানের নাম বাবুজী। এদেশের ঝি-বহুড়িরা পালা-পার্বণে এ গান গায়।’ দেখলাম, সাধুর চোখে মুখেও ওই গানের রসের তরঙ্গ লেগেছে।
তারপর শুধু নাচ। ‘সন্ন্যাসীর দিক থেকে চোখ ও কান দুই-ই চলে গেল রামজীদাসীর দিকে। তবু, সন্ন্যাসীকে ছাড়তে মন চাইছে না। একটা তীব্র ও চাপা কৌতূহল অদৃশ্য চুম্বকের মতো টেনে রেখেছে আমাকে। টেনে রেখেছে রুক্মিণী আর মনিয়াবাঈ। শুনতে পাচ্ছি, সন্ন্যাসী বিড়বিড় করছে আপন মনে। অস্পষ্ট কথা আর চাপা হাসি
তবু মন ভাসিয়ে নিয়ে গেল রামজীদাসী। রামজীদাসীর নাচ। নাচ আর বাজনা। সরোদ বাজছে যেন স্রোতস্বিনীর টানে, কিনারে কিনারে নুড়িমালার রিনিঠিনি। তার সঙ্গে তবলা-সঙ্গত। রামজীদাসীর পদক্ষেপের তালে তালে একজন হাতে নিয়ে ঝঙ্কার দিচ্ছে নূপুরের গোছা।
যন্ত্রসঙ্গীতের এই সুর যেন একটি ছবি। একটি নিখুঁত প্রাকৃতিক দৃশ্য। নিরন্তর তানপুরা-ধ্বনি যেন ছবির পিছনের বিস্তৃত অসীম নীল আকাশ। কোলে তার একটি রূপের দ্যুতি। রামজীদাসী।
ভাবের ঘোরে নাচ নয়। নাচে লেগেছে এবার ভাবের ঘোর। কথা ফুটেছে নাচের ছন্দে। সেই নিঃশব্দ কথা হাসি আনন্দের, বেদনা ও অভিমানের, কখনো নির্বাক ব্যথা ব্যক্ত হয়ে পড়েছে দেহ-ভঙ্গিতে। নিথর আড়ষ্ট বঙ্কিম দেহ। তারপরে অকস্মাৎ ব্যথার পাথর সরিয়ে নির্ঝরিণী ছলছল। সর্বাঙ্গ আনন্দে থরথর কম্পিত কিংবা কপট অভিমানে চটুল নারী চোখে হাত দিয়ে খেলে আঁখমিচোলি। আবার ভক্তি-উচ্ছ্বাসে মাটিতে লুটানো প্রণাম। রামকে নিয়ে রামজীদাসীর লীলা। নির্বাক বিস্ময়ে ছেলে তিনটি গোল গোল চোখে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। রাম, লক্ষ্মণ আর সীতা। বেচারিরা অন্যদিকে তাকাবার অবসরও পচ্ছে না একটু।
জানিনে, ভক্তি-উচ্ছ্বাসে কতখানি মেতে উঠেছে মণ্ডপের নরনারী। কিন্তু অভূতপূর্ব স্তব্ধতা বিরাজ করছে সর্বত্র। মোহমুগ্ধ নির্বাক সকলে। যেন তাদেরই নির্বাক হৃদয়ের তালে তালে নাচছে রামজীদাসী।
ভিড় হয়েছে প্রচণ্ড। গেটের সামনে আর বেড়ার ধারে ধারে গিজগিজ করছে কৌতূহলী দর্শকের ভিড়। সারা কুম্ভমেলাটাই ভেঙে পড়েছে যেন রামজীদাসীর নৃত্য-আসরে।
পাশ থেকে সন্ন্যাসী হেসে বললো, ‘একদিন যার নাচ দেখার জন্য লাখপতি ধর্না দিত বন্ধ দরজায়, আজ সে মেলার মাঝে নেচে নেচে ভগবানের সেবা করছে।’
লাখপতি ধর্না দিত! সন্ন্যাসীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই রামজীদাসীর নাচ দেখার জন্য।’
সন্ন্যাসী বক্র হেসে গম্ভীর গলায় বললো, ‘ছি বাবুজী, রামজীদাসী বলতে আছে! আমি বলছি লক্ষ্ণৌয়ের মনিয়াবাঈয়ের কথা। রূপে যার জুড়ি ছিল না দিল্লি-লক্ষ্ণৌয়ের বাঈজীকুলে। মনিয়াবাঈ। কেউ বলত রুক্মিণী। কার ফুলে মধু আছে, ভ্রমর ছাড়া কোন্ রসিক তার সংবাদ রাখে! কলকাতা থেকে, বোম্বাই থেকে রসিক ভ্রমরেরা আসত ছুটে, মনিয়াবাঈয়ের সন্ধানে। সংবাদ চাপা থাকত না তাদের কাছে। কেউ দেখা পেত, কেউ পেত না। সহজ কথা? এ কী। সেই লেড়কি, সেই আওরত, যে সড়ক-কি-কিনারে পেতেছে আপনা বেসাতি? হাসি যার ঠোঁটে লেগে থাকে, নাগরকে খুশি করা ছল-কথা যার মুখে ঝরে হরবখত্? নহি, নহি বাবুজী। সেই রকম বাঈজী ছিল না মনিয়াবাঈ। গানের কলি দিয়ে ভোলানো? আরে রাম রাম!’
বলতে বলতে কিছু ভাবান্তর ঘটল সন্ন্যাসীর মুখে। বক্র হাসিটি চাপা ব্যাথ’য় করুণ হয়ে ওঠে। যদি ঠিক দেখে থাকি, যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে দেখছি ঠিক। দেখলাম কোনো এক সুদূরের বুকে নিবন্ধ তার দৃষ্টি। যেন কোনো এক দূর মঞ্চে, কী এক খেলা খেলছে সে। তার চোখে খেলারই আলোছায়ার ঝিলিমিলি। তার কথাগুলি বুঝলাম। কিন্তু ব্যক্ত করতে পারবো না তার ভাষায়। ঠেট্ হিন্দি নয়। গ্রাম্য ভাষার মধ্যে গ্রাম্য অলংকার দিয়ে কবিতা আবৃত্তির মতো বললো সে। বললো, ‘বাবুজী জানো, অনেক খেলা ভগবান আমাদের দেখাচ্ছে। মনিয়াবাঈকে দিয়ে ভগবান আমাদের একটা খেলা দেখিয়েছে। মনিয়াবাঈ সোনার পালঙ্কে বসে মহারানীর আদর পেয়েছে, কিন্তু বুকের ভেতর তার আঁকা ছিল রঘুনন্দনের মূর্তি। রঘুনন্দন!’ যেন সে ডাক দিল রঘুনন্দনকে। জানি না কে সেই রঘুনন্দন। ব্যাকুল গলায়, জোড় হাতে বললো সন্ন্যাসী, ‘হে মহাপ্রাণ, সাধকগুরু আমার প্রণাম নাও।’ বলে সে চুপ করলো।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘রঘুনন্দন কে?’
বললো, ‘সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসী শুধু কপীন এঁটে জটা বাঁধবার জন্যে? চোখ পাকিয়ে খালি ব্যোম ব্যোম্? উঁহু বাবুজী, সন্ন্যাসী রঘুনন্দনের মধ্যে প্রেমাবতার বাসা নিয়েছিল। যে তার কথা শুনেছে, প্রাণ জুড়িয়েছে তার। মনে হতো, যুগযুগান্তরের কোনো সিদ্ধাচার্য নতুন রূপে এসে দাঁড়িয়েছে তোমার সামনে। সেই রঘুনন্দনের ছায়া পড়েছিল মনিয়াবাঈয়ের বুকে। পর-ছায়া নয়। রঘুনন্দনের সাচ্চা ছায়া। যত ছাড়ো, যত মারো, যত বুক চাপড়াও, সে ছায়া সরবে না। আগুনে ঝাঁপ দেবে? তোমার ছাইয়ের, তোমার আত্মার মধ্যে বিরাজ করবে সে। হা-হা-হা .. লক্ষ্ণৌয়ের রাজ ইমারত, বিজলী বাতি আর সোনার খাট! হীরে-জহরতে ভরা মনিয়াবাঈয়ের সর্বাঙ্গ। বাবুজী, লালসামত্ত পাগলেরা বাঈজীর খোলা গায়ে মদ ঢেলেছে। তার সুন্দর পা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পড়েছে সেই মদ। লোভী কুকুরের মতো কামাসক্ত মানুষ তাই চেটেছে। মানুষ নয়, জানোয়ার। জানোয়ারের উল্লাস। যৌবন যার ক্ষেত-জমিনের মাটির ঢ্যালা। আজকে পাথরের মতো শক্ত, কালকের বর্ষায় সে কাদা হয়ে গলে যাবে। আর এই জানোয়ারের মাঝে পাগলীর মতো খিলখিল করে হেসেছে নটী মনিয়াবাঈ। হেসেছে, নেচেছে, গান করেছে। তারপর জিন্-পাওয়া আওরতের মতো চিৎকার করেছে, লণ্ডভণ্ড করেছে ঘরদোর, ভেঙে দিয়েছে সভা। সেই ভৈরবী মূর্তি দেখে পালিয়েছে কামার্ত পশুরা। মনিয়াবাঈয়ের আর এক নাম ছিল পাগলী বাঈজী। রূপ ছিল তার পাপ। সেই পাপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল আলো। সেই আলো যখন জ্বলে উঠত পাপের ভারে, মনিয়া তখন পাগলী হতো। হবে না! আরে বাপরে! রঘুনন্দন এসে দাঁড়াত যে তার সামনে। তার দিব্যদৃষ্টির সামনে। তাকে বুকে নিত, আদর করত, সোহাগ করত। তারপর একদিন—’ বলতে বলতে সে থামল আচমকা। যেন কী কথা মনে পড়েছে হঠাৎ। চাপা উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো, ‘মগর, আখেরি নতিজা কেয়া মিলি? বাবুজী, দেখ, দেখ তো রামজীদাসীকে। হাত রাখো নিজের বুকে। রেখে বলো, কী দেখছ? কী ভাবছ? তোমার মনের মধ্যে এক ছোট্ট রঙদার চিড়িয়া পাখা ঝাপটা দিচ্ছে না? আরে, সরমাচ্ছো কেন বাবুজী? লজ্জা কী? ওই চিড়িয়া তোমার বাসনার সুন্দর মূর্তি। তোমারও নয়, সকলের। সকলের মনেই ওই বিহঙ্গ ছটফট করছে। করবে না? ওই রূপ! ওই বেশ। উর্বশীর জীবন্ত ছায়া। রামজীদাসী নামে, বুকের মধ্যে ধিকি ধিকি, ধুকু ধুকু। নিজের মন চেনে ক’জনা? গৃহী বাদ। সন্ন্যাসী? মন চেনে ক’জনা? বাসনা মরেছে ক’জনার? রামজীদাসী নয়, আগুনের পিছু ছুটছে সব। প্রকৃতি একটা শোধ নিচ্ছে এই রহস্যময়ীকে দিয়ে। ভগবানের মুখে চুনকালি মাখাতে চাইছে। শুনলে লোকে হাসবে, রাগ করবে। লোকে শুধু ওইটুকুই জানে। থাক, থাক ওসব কথা।
সন্ন্যাসী চুপ করলো। দাঁড়িয়েছিল একটা বাঁশ ধরে। সেটা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো এবার। গলায় তার রুদ্রাক্ষের মালা। রুদ্রাক্ষের কুণ্ডল কানে, বলিষ্ঠ হাতে বালা রুদ্রাক্ষের। কপালে অস্পষ্ট পুণ্ড্ররেখা।
সন্ন্যাসী থামল। কিন্তু আমার মন থামে নি। সে তার সবটুকু অনুভূতি দিয়ে কান খাড়া করে রইলো। দেখছি রামজীদাসী হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখ দেখতে পাচ্ছি নে। পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছি, রুপোলি পাড়ের বেষ্টনী ঘিরে রয়েছে তীব্র রেখাঙ্কিত দেহ। তাকে দু’ভাগ করে নেমে এসেছে সুদীর্ঘ কালো বেণী। আর কীর্তন মণ্ডলেশ্বরের গীতকারেরা সকলে মিলে ধরেছে গান।
রামজীদাসী আর মনিয়াবাঈ। মনিয়াবাঈ আর রঘুনন্দন। সব মিলিয়ে একটা অস্পষ্ট অথচ তীব্র রহস্যের দ্বারে দাঁড়িয়ে আছি উৎকর্ণ হয়ে। অতীত ভারতের এক রহস্যদ্বারের সামনে যেন দাঁড়িয়েছি আমি। যেন বিচিত্র রহস্যে ছেয়ে গিয়েছে সারা কুম্ভমেলা। মনিয়াবাঈ আর সন্ন্যাসী রঘুনন্দনের কাহিনী শোনবার জন্য আকুল মন।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘সন্ন্যাসীজী, তারপর?’
বুকের খুলে-যাওয়া আবরণ ঢাকা দিল সন্ন্যাসী। হঠাৎ যাওয়ার উদ্যোগ করলো। বললো, ‘পুরনো কথা বাবুজী। এ হলো সন্ন্যাসীদের গুপ্তকথা। আপনাদের শুনতে নেই। ভালোও লাগবে না।’
বলে, সে সত্যি পা বাড়াল। বললাম, ‘যদি বাধা না থাকে, তবে শুনতে চাই।’
সন্ন্যাসী তাকালো আমার দিকে। মন-সন্ধানের তীক্ষ্ণতা তার চোখে। বললো, ‘আপনার আশ্রমের কোতোয়ালের কাছ থেকে শুনে নেবেন বাবুজী। সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের কারুর অজানা নেই এই কথা
বলতে বলতে চলে যেতে চায়। মনে হলো, অনিচ্ছার ছল-হাসি তার মুখে। হয়তো শুনতে পাব না কিছু রামানন্দর কাছে। সন্ন্যাসীর কাছ ঘেঁষে এলাম, জানি নে সাধু-সন্ন্যাসীর মেজাজ। কখন কোন্ ভাবে বিভোর। বেশি বললে যদি আবার গণ্ডগোল ঘটে! তবু বললাম, ভয়ে ভয়ে, ‘অসুবিধে না হলে আপনিই বলুন।’
সন্ন্যাসী বাঁকা হেসে বললো, ‘কেন শুনতে চান? এ এক সন্ন্যাসীর প্রেমকাহিনী। আপনার গৃহী মন বিরূপ হবে।’
হয়তো হবে। তবে গৃহী বলে নয়। অমানুষিক কাহিনী হলে মানুষ দুঃখ পাবে বৈকি। তবুও মনে বড় কৌতূহল। সন্ন্যাসীর আবার প্রেম! সে কি কথা?
বললাম, ‘শুনতে বড় সাধ। সন্ন্যাসীর প্রেমকথা, এযুগে কখনো শুনিনি।’
সন্ন্যাসী আমার দিকে তাকিয়ে আবার হাসলো। হেসে চলতে আরম্ভ করলো আশ্রমের গেটের দিকে। বুঝলাম, নীরবে আহ্বান করছে সে আমাকে। আর একবার দেখলাম রামজীদাসীকে। সত্যি আগুনই বটে! সভাস্থ নরনারী সকলে অপলক বিস্মিত মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকেই।
গেটের কাছে এখনো ভিড়। ভিড় ঠেলে বাইরে এলাম। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। যেদিকে তাকাই সেদিকেই লোক। তবে গায়ে গায়ে নয়। সীমাহীন বালুপ্রান্তরের আলোকিত মেলায় ছড়ানো মানুষ।
সন্ন্যাসী চললো পুব-দক্ষিণ কোণ বরাবর। সঙ্গমের এক কোণে। যেখানে সরস্বতী আছে আত্মগোপন করে। ওদিকটায় আলো নেই। কিন্তু আকাশে চাঁদ রয়েছে। প্রবল শীত। তবু উত্তর প্রদেশের আকাশে এখনো যেন শরতের সমারোহ। সমারোহ শুধু মেঘেরই আনাগোনায়। কুয়াশার আবরণ ভেদ করে দেখা যায় না শরতের ঘোর নিলিমা। ঝুসির উঁচু বুকে অড়হরের ক্ষেত ঘন মেঘের মতো লেপটে রয়েছে অস্পষ্ট আলোকিত আকাশে। এদিকটায় বৈদ্যুতিক আলো নেই। কিন্তু মানুষের আনাগোনা কম নয়। অস্পষ্ট ছায়া মিছিল চলছে চারিদিকে।
যত এগুচ্ছি, বালি তত গভীর মনে হচ্ছে, পা ডুবে যাচ্ছে।
সন্ন্যাসী আমার দিকে ফিরে বললো, ‘সন্ন্যাসীর প্রেম-কথা কখনো শোনেন নি?’
তার কণ্ঠস্বরে অবাক হলাম। এক বিচিত্রভাবে ও সুধায়, কথা তার গম্ভীর ও তরল। খুশি ও আনন্দে ভরপুর। বললো, ‘সন্ন্যাসীর প্রেম তার ধ্যানে ও ধর্মে। ধর্মে আর কর্মে তার প্রেম বলে, ওগো দেব, প্রাণেশ্বরী, প্রেয়সী, সন্ন্যাসীনাং সদা সেব্যং পঞ্চতত্ত্ব বরাননে! তবে গোপনে। গৃহী-জগতের বাইরে। প্রেম থাকবে না কেন? তবে এই প্রেমে অনেক আড়ম্বর, অনেক আয়োজন। লোকচক্ষে বড় ভয়ের বিষয়! বসুন বাবুজী, আপনাকে সন্ন্যাসীদের একটি গুপ্ত ক্রিয়ার কথা বলি।’
বলে, সে শিশিরসিক্ত বালির উপরেই বসে পড়ল। আমিও সেখানে বসলাম। আধুনিক শহুরে মনে সাধু-সন্ন্যাসীদের সব উদ্ভট বলে জানি। তবু কৌতূহল ছাড়তে পারি নে।
সে বললো, ‘বাবুজী, সন্ন্যাসীর আছে কুলাচার। কুলাচার কী? আপনি বাঙালি। আপনাদের দেশে কুলাচারী বড় বেশি ছিল। আপনাদের ভক্ত চণ্ডীদাস, কবি-সাধক! শ্রীকৃয়ের প্রেমলীলা গেয়েছেন। তিনিও কিন্তু কুলাচারী। কুল তাঁর রজকী। রামী ধোপানী। ব্রাক্মণী, চণ্ডালী, নটী, ডোমী আর রজকী—এ হলো বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের নির্বাচন। ব্রাক্ষ্মণ তন্ত্রমতে নয়টি কুল। ওই পাঁচ, আর চারটি—বেশ্যা, কাপালী, নাপিতানী, গোপিনী। কোনো কোনো তন্ত্রমতে চৌষট্টি কুল আছে। যবনীও বাদ যায় না তাতে। এসব সাধনমার্গের গুহ্য পদ্ধতি। তবে, এ সবই তন্ত্রমতে। কিন্তু সন্ন্যাসীর তো তন্ত্র নেই। অনেকে কুলাচার-পদ্ধতিতে সাধন করে থাকে। আপনাকে সন্ন্যসীদের কথাই বলি।’ বলে সে আমার মুখের দিকে তাকাল। বোধ হয়, আমি কী ভাবছি, সেটুকু দেখবার জন্য। কিন্তু এসব বিত্তান্ত কম-বেশি শুনেছি। এতে আমার বিস্ময়ের কিছু ছিল না। আমি শুনতে চাইছিলাম, রঘুনন্দন ও রামজীদাসীর কাহিনী।
সে বললো, ‘সন্ন্যাসী আর অবধূতে বড় একটা তফাত নেই। এরা অনেকে জ্যোত্মার্গের সাধন করে। অনেক তার ক্রিয়াকাণ্ড। মূলে বালাসুন্দরী দেবীর আবির্ভাব হলো তার কামনা। ঘৃত কপূরের একটি প্রদীপকে তারা পূজা করে। প্রদীপের চারপাশে সাক্ষী থাকেন কালী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, হনুমান আর ভৈরব। এ পূজার উপাচার হলো প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, মতি ও চক্রী। বুঝতে পারলেন না? মদ, মাংস, অন্ন আর পুরি। এ হলো গুপ্ত শব্দ। এ ছাড়া সপ্তমী, ষষ্ঠী। গাঁজা আর তামাক। এ হলো জ্যোত্মার্গে প্রবেশের পন্থা। যে প্রবেশ করে, তাকে আর-একটি ব্রত করতে হয়। তাকে বলে চৈত্র মাসে নবরাত্র ব্রত। এই ব্রতের দিন সন্ন্যাসী চক্র করে আর গুপ্তস্থানে মিলিত হয় আওরতের সঙ্গে। এই মিলন হলো সন্ন্যাসীর গুপ্ত সাধনের সিঁড়ি। একে ছাড়া চলবে না। এর মধ্যে আছে অনেক যুক্তি, কূট বিষয়। আপনি সব বুঝবেন না বাবুজী।’
সন্ন্যাসীর জ্যোত্মার্গে প্রবেশ জানি নে। কিন্তু নানান কথা অনেকবার শুনেছি। শুনেছি, আর বারবারই মনের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে একটি প্রশ্ন, ‘এসব কেন, কেন?’ যত জিজ্ঞেস করছি, জবাবগুলি ততই অস্পষ্ট হয়ে এসেছে অনুভূতিতে। বুদ্ধিও অনুভূতির অগম্য। নানান্ জনের নানান্ মত। সাধকের সিদ্ধিলাভের বিচিত্র লীলা। নিতান্ত সামাজিক জীব আমরা। আমাদের বলে, তোমরা বুঝবে না। আর আমরা ভাবি, তবে বুঝব না। শেষ পর্যন্ত যা পাই, সে তো মানুষের আর সাধকের আত্মার তৃপ্তি। এখানেই এত ঘোর-প্যাঁচ। কিন্তু কই, বিকলাঙ্গ বলরামকে, তার কথাকে তো এত জটিল মনে হয়নি! সে যেন পরিচ্ছন্ন একটি সুন্দর মানুষ। তার সঙ্গিনী লক্ষ্মীদাসীও তেমনি সুন্দর।
প্রতিবাদ করলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘রঘুনন্দনের কী হল?’
সন্ন্যাসী বললো, ‘রঘুনন্দন আর রুক্মিণীর কথা বলবো বলেই এত কথা বললাম। এমনি বললাম বুঝি তোমাকে এসব? তবে এ বিশ্ব-সংসারে কিছুই গোপন নেই। তাই বললাম। বাবুজী, রামজীদাসীর রূপ দেখে মানুষের চোখ ভুলে যায়। পুরুষের চোখ কিনা! কিন্তু পুরুষের রূপ দেখেও যে মানুষের চোখ ভোলে, তার প্রমাণ ছিল রঘুনন্দন। এই এলাহাবাদেই এক ব্রাক্ষ্মণের ঘরের ছেলে। মানুষ নয়, সাক্ষাৎ শিব-স্বরূপ। শুধু রূপে নয়, গুণেও। সে চোখ তুলে তাকালে, গায়ে হাত দিলে, সারা দেহে কাঁটা দিয়ে উঠত মানুষের। মন্ত্র-তন্ত্র নয়, তার হৃদয়টি ছিল অমনি। তার চরিত্রের গুণে তার কাছে আসত মানুষ তোমার ঐ নিরঞ্জনী আখড়ার সাধুরা রঘুকে বিদ্রূপ করত, ঠাট্টা করত। বলত, সন্ন্যাসী-জীবন তোমার নয়। গোঁফদাড়ি কামিয়ে শাড়ি পরে নবদ্বীপে চলে যাও। তা বললে কি হয়? মহাজ্ঞানী রঘুনন্দন। তর্কে হার মেনে রগচটা সন্ন্যাসীরা খালি ত্রিশূল দিয়ে মাটি খোঁচাত।…এই রঘুনন্দনের সঙ্গে রুক্মিণীর দেখা হয়েছিল হরিদ্বারে। রঘু তখন জ্যোমার্গ সাধন করে নবরাত্র ব্রত উদ্যাপনের আয়োজন করছে।’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, কোনো এক অতীত যুগের কথা শুনছি। যে ভারতবর্ষকে দেখছি, এ যেন সে ভারতের কাহিনী নয়, কোনও এক হিন্দুযুগের। সন্ন্যাসীকে বাধা না দিয়ে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এসব কত বছর আগের কথা?’
সন্ন্যাসী বললো, ‘তা আজ প্রায় পনেরো-ষোলো বছর আগের কথা।‘
বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে রামজীদাসীর বয়স কত?’
হেসে বললো ‘সে, কত অনুমান করছেন বাবুজী?’
অনুমান? অনুমান করে নারীর বয়স বলার সাধ্য আমার ছিল না। তবু বললাম, ‘বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ।’
সন্ন্যাসী তেমনি হেসে বললো, ‘আরও কম বললে দোষ হত না। কিন্তু বাবুজী, আরও আট-দশ বছর বাড়িয়ে দিন।’
আরও আট-দশ বছর! চকিতে সেই রূপশিখা, মূর্তি ধরে দাঁড়ালো আলোর সামনে। আশ্চর্য!
শুধু দেহ নয়। মুখখানিতে কোথাও বয়সের দাগ পড়েনি। কম বললে সত্যি ক্ষতি ছিল না।
সন্ন্যাসী বললো, ‘মনে আছে, সে যেদিন এলো, আমাদের আশ্রমের শূন্য বাগানে যেন ফুল ফুটে উঠলো। সন্ন্যাসী বলে তো তার চোখ বন্ধ রাখতে পারি যায় না! হৃদয়ও মরে যায় না। সে এলো। সঙ্গে তার স্বামী। ঝোলা কাঁধে নিতান্ত গেঁয়ো মানুষ। চৈত্র মাস। হরিদ্বারে তখন এমনিতেই ভিড়! কেদারবদরির যাত্রীরা আসতে আরম্ভ করেছে। বরফ-গলা জলের ঢল নেমেছে এদিকে-ওদিকে। রুক্মিণীর স্বামী মোহান্তর অনুমতি নিয়ে খানা পাকাবার আয়োজন করলো আশ্রমে। তারা এসেছে আরও উত্তর থেকে। যাবে বদরিনারায়ণ দর্শনে। আশ্রমের পেছনেই একটি গুপ্তাবাস ছিল। একটি মস্ত গুহামুখ। সেইখানে নবরাত্র ব্রতের ভিড়। আশ্রমের অনেকে সেইখানেই ব্যস্ত। তা ছাড়া ভক্তও এসেছে অনেক। কয়েকজন এসেছে সস্ত্রীক। নবরাত্র ব্রত বড় গোপন বিষয়। তার আয়োজনও চলছিল গোপনে।’
বলে, এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ হেসে উঠলো সন্ন্যাসী। বললো, ‘বড় অদ্ভুত মানুষ ছিল রঘুনন্দন। গুপ্তাবাস থেকে বার বার বেরিয়ে আসে, আর মোহান্তর কাছে এসে খালি বসে। আমার সঙ্গে যতবার চোখাচোখি হয়েছে, ততবারই হেসেছে। অস্বীকার করবো না, সে-হাসি সন্ন্যাসীর শোভা পায় না। সে হাসি গৃহী জোয়ান ছেলের। গোপন প্রেমের। তবে, রঘুনন্দনের মুখে একটা চিন্তাও ছিল বাবুজী। মাঝে মাঝে কালো দেখাচ্ছিল তার আন্ধেরী মুখ। আমি ছিলাম কোতোয়াল। নবরাত্র ব্রতে নিমন্ত্রণ করতে যাব অন্যান্য আশ্রমের সহধর্মীদের। হঠাৎ রঘুনন্দন এসে বললো, কোতোয়ালী, আমি চক্রে থাকতে পারবো না রাত্রে। আমি তাজ্জব। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে। নিত্য-মন্ত্র পাঠ করে, নতুন বেশে সেজেছে সে। নেংটির চেয়ে হাঁটু অবধি গেরুয়া ধারণ তার পছন্দ ছিল। গলায় ধুতরার মালা। রুদ্রাক্ষের ফাঁকে ফাঁকে প্রবাল-গাঁথা হার। হাতে বদরিকা কঙ্কণ। আর প্রবালের মালা দিয়ে জড়ানো জটা। আগুনের মতো তার গায়ের রঙ। ভস্ম মাখা। বুকে, গলায় আর কপালে রক্তচন্দন। যেন সাক্ষাৎ শিব-স্বরূপ! মহাজ্ঞানী রঘুনন্দন। তার ঢিলেঢালা হাসি-খুশি চরিত্রের জন্য সে মোহান্ত হতে পারেনি। সন্ন্যাসীর আখড়া আছে। আবার মঠও আছে। সেখানে মোহান্ত কেউ কাউকে করে দিয়ে যায় না। সন্ন্যাসীরা সবাই মিলে যাকে মোহান্ত করে, সে-ই হতে পারে। কিন্তু মোহান্তর নিজের খুশিতে কাজ চলে না। সন্ন্যাসীদের সকলের মত নিয়ে তাকে কাজ চালাতে হয়। রঘুনন্দনের পক্ষে এসব সম্ভব ছিল না। কিন্তু ধর্মের ইতিহাস ও জ্ঞান পেয়েছিলাম আমরা তার কাছ থেকে। সে জানতো আর বুঝত সকলের চেয়ে বেশি। তার মুখে ওই কথা শুনে আমি ভয়ে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। শুধু বললাম, ‘কেন?’
সে বললো, ‘আমি কোনো উৎসহ পাচ্ছি না!’
আমি বললাম, ‘চক্রে বসলে উৎসাহ পাবে।’
সে বললো, ‘তা হয় না কোতোয়ালজী। হৃদয়ের আগল বন্ধ। ভগবান আমার সেবায় খুশি হবেন না। এমন সময়ে রুক্মিণী এসে দাঁড়ালো সামনে। আমাকে নয়, রঘুনন্দনকে নমস্কার করলো। রঘুনন্দন বললো, ‘নারায়ণো, বেঁচে থাকো। বলেছিলাম বাবুজী, রুক্মিণী এলে যেন আশ্রমে ফুল ফুটে উঠত। তার রূপ, তার কথা ও নির্মল হাসি সকলেরই বড় চোখে লেগেছিল। সে একটু চঞ্চল। ঝরনার মতো ছলছল তালে চলে। অল্প সময়ের মধ্যেই সকলের স্নেহ পেয়েছিল সে। রঘুনন্দনকে দেখে রুক্মিণী নির্বাক নিথর। চোখে তার আলোর শিখা। তার লজ্জা হলো না, জোড় হাতে দাঁড়িয়ে রইলো সে। শুধু বাতাসে উড়ছে তার খোলা চুল। বাবুজী, রঘুনন্দনের চোখেও দেখলাম তেমনি আলো। সন্ন্যাসীর মুগ্ধতা! সে তো ভালো কথা নয়, কিন্তু দু’জনেই কী সুন্দর! আমি জ্ঞানী নই, সাধনা নেই আমার। তবু আমার মনে হলো আমার সামনে স্বয়ং হরগৌরী রয়েছে দাড়িয়ে। আমার সময় চলে যায়। যেতে হবে অনেক দূরের আশ্রমে। আমি চলে গেলাম। আজ নবরাত্রের শেষ রাত্রি। জোমার্গে যান যেসব সন্ন্যাসী, তাঁদের অনেককেই সংবাদ দিতে হবে।
‘ফিরে যখন এলাম তখন সাঁঝ উতরে গেছে। আশ্রম নিঝুম। কিন্তু কাজকর্ম চলছে ঠিক। তখনো সন্ধ্যাপূজা শেষ হয়নি। মন্দিরে ছিল পাথরের শিবমূর্তি। কিন্তু আখড়া চলে বড় নিয়মে। এ সময়ে সন্ন্যাসীর কর্তব্য হলো মানসী পূজা। চোখ বুজে ভাবতে হয় গুরুর মূর্তি। কল্পনায় বসাতে হয় মন্দিরের বেদীতে। নিত্য গুরুদর্শনের ওই পন্থা। গুরুর পা ধোয়াবে, আস্নান করাবে, ধ্যান কল্পে লেপে দেবে তার সর্বাঙ্গে বিভূতি। পুজো করবে ফুল-চন্দন দিয়ে।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘সন্ন্যাসীরও গুরু থাকে?’
‘কী বললে বাবুজী? সন্ন্যাসীর গুরু থাকবে না? সন্ন্যাসীর কি একজন গুরু? তার যে গুরু অগনন। মূল গুরু, শিক্ষা গুরু, বিভূতি গুরু। সন্ন্যাসীর সাত গুরু। কেউ তাকে দেয় ডোরকৌপিন, কেউ দেয় বিভূতি। কেউ তার শিখা-মুক্তিদাতা গুরু। ষট্কর্মের দীক্ষাগুরু হলো আচার্য।
‘এসে দেখলাম, মোহান্ত স্বয়ং মানসীধ্যানে লিপ্ত। আমাকে বসতে হবে। দেরি হয়ে গেছে। এদিকে এক হাত-পা-মুখ ভরে গেছে ধুলোয়। আখড়ার কিছু সন্ন্যাসীর চোখে-মুখে একটি চাপা আনন্দ ও ব্যস্ততা। নবরাত্রে অংশগ্রহণে খবু উৎসুক তারা। কলিকাল কিনা! সন্ন্যাসী হয়েও সুখের মুখ দেখতে চায় সবাই। আসল সাধক আছে ক-জনা?
‘ভাবলাম, একবার রঘুনন্দনকে দেখে আসি। মন্দিরের পেছনে গিয়ে দেখলাম মহা আয়োজন। জনা-পাঁচেক আওরতকে দেখলাম, তারা সকলেই গেরুয়া ধারণ করেছে। জনা-বারো গৃহী সাধক এসেছে। তারাও পরেছে গেরুয়া কাপড়। সন্ন্যাসীর বেশে সেজেছে সবাই। সকলেই আমাকে নমস্কার করলো। আমি জবাব দিতে পারলাম না। এদের এসব আসর-অনুষ্ঠান আমার কোনোদিনই ভালো লাগে নি। আমাদের গুহ্য ষট্কর্মে কোনোদিনও কোনো বাইরের লোক ঢুকতে পায় না। কিন্তু জ্যোত্মার্গে বাইরের লোককে ঢোকবার অধিকার দিয়ে গেছে আগের সিদ্ধপুরুষেরা। কবে থেকে জানি নে, কিন্তু আমার জীবনে চিরকালই এই নিয়ম চলতে দেখেছি।
‘যে-পাথরের নিচের গুহাঘরে ছিল রঘুনন্দন সেখানটি একেবারে জনহীন। দূর থেকে দেখলাম, অন্ধকার। কাছে এসে ঘরে ঢোকবার মুখে থমকে দাঁড়ালাম। দু’টি মূর্তি কালো পাথরের গায়ে রয়েছে লেপ্টে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, রুক্মিণীর গায়ে গেরুয়া বসন। বাবুজী, রুক্মিণী যে এত সুন্দরী, আঁধার যে জ্যোতিতে ভরে ওঠে রূপে, সন্ন্যাসিনী বেশে তাকে দেখে তা বুঝলাম। আমার চোখের পলক পড়লো না কয়েক মুহূর্ত। রুক্মিণীর হাসিতে সংবিত ফিরে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কী চাও?’
রুক্মিণী জবাব দিল, ‘আমরা পূজা করব।’ আর বলবার দরকার ছিল না। বুঝে নিলাম, রুক্মিণীর সঙ্গে মুখে হোক, মনে মনে হোক, কোন বোঝাপড়া হয়েছে রঘুনন্দনের।
‘রঘুনন্দনের সঙ্গে দেখা করবার অবসর মিলল না। দেখলাম, দীপ জ্বলে উঠেছে ঘরের দু’ধারে দু’টি। একটি মহাদেবের। অপরটি মহাদেবী কালীর। অন্যান্য সন্ন্যাসী-সাধকেরা এসে পড়ল। সেই সঙ্গে ভৈরবীরূপী আওরতেরা। আরম্ভ হলো শিবশক্তি ভৈরবীর উপাসনা, তারপরে প্রসাদ খাওয়া। সে-প্রসাদ শুধু জ্যোত্মার্গের কুলাচারীরাই সন্ন্যাসী হয়েও গ্রহণ করতে পারে।
‘রুক্মিণী গিয়ে দাঁড়ালো রঘুনন্দনের কাছে। রঘুনন্দন তাকে প্রসাদ দিল। তারপর চক্রমধ্যে যা থাকে, তন্ত্রমতে সে-সবই আরম্ভ হলো।
‘পরে দু’দিন আর আমার সঙ্গে রঘুনন্দনের দেখা হয়নি। এমন কি রুক্মিণীকেও দেখতে পাই নি। রুক্মিণীর স্বামীকেও নয়। বাইরে থেকে বিশেষ কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু এ ব্যাপারের পর আশ্রমে কিছু কিছু অনিয়ম দেখা দেয়। ক্রিয়াকাণ্ডে গণ্ডগোল হয়। তৃতীয় দিনে দেখলাম, রঘুনন্দন গঙ্গা থেকে চান করে আসছে। কিন্তু এ সেই আগের রঘুনন্দন নয়। সেই মহাজ্ঞানী হাসি-মুখ সন্ন্যাসী নয়। তার সারা মুখে এক অদ্ভুত পাগলামি। চোখ আধবোজা, সামনাসামনি হলে বললাম, ‘ওঁ নমো নারায়ণ!’ সন্ন্যাসীর মতো জবাব না দিয়ে রঘুনন্দন আমার হাত ধরে বললো, মহাবীর ভাই! কথাটা বড় কানে ঠেকল। সাধারণ মানুষের মতো এমন গদগদ ভাবে কথা বলছে কেন রঘুনন্দন! বললাম, কী বলছ?
‘সে বললো, ভাই, নতুন জ্ঞান লাভ করেছি। অমনি আমারও বুকের মধ্যে আনন্দে ভরে উঠলো। জ্যোত্স্নাগচক্রে নিশ্চয়ই কিছু দর্শন ঘটেছে রঘুর। তাকে হাত ধরে আড়ালে নিয়ে গেলাম। যেমন করে ছোট ছেলে খাবার লুকিয়ে নিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলাম, কী জ্ঞান লাভ করলে?
‘রঘুনন্দন বললো, তা তো জানি নে। বলতে বলতে বাবুজী দেখলাম, তার চোখভরা জল। আর জলভরা মুখে হাসি। চোখের নজর সামনে নেই, পেছনে নেই। উদাসীন স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টি। হঠাৎ চমকে উঠে বললো, শুনেছ?
‘বললাম, কী?
‘বললো, শুনতে পাচ্ছ না?
‘কান পাতলাম। কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না।
‘রঘুনন্দন বললো, শুনতা নহি চিড়িয়া পুকারতি মিঠে বুলি?
‘হ্যাঁ, চারিদিকে গাছে গাছে অনেক পাখি ডাকছে। সে তো সব সময় শুনি।
‘সে বললো, ওই তো সেই আনন্দ, মহানন্দ। তুমি শোনো সব সময়? কই, আমি তো এতদিনে শুনতে পাইনি! দেখতে পাইনি ওই আসমান। এমনি পাগল বাতাস তো লাগেনি। আমার গায়ে। সহজ করে দেখিনি কোনোদিন কিছু। যা সহজ তাই তো সুন্দর। কিছু দেখলাম না, কিছু শুনলাম না, শুধু ছাই মেখে আখড়া নিয়ে পড়ে আছি। জ্ঞান নিয়ে বড়াই করেছি। জ্ঞান কাকে বলে? বুদ্ধিকে? না, ভুল মহাবীর ভাই। বুকের রস না হলে মাথায় ফুল ফোটে না। মাথার সেই ফুলের নাম হলো জ্ঞান। শিকড় তার হৃদয়ে। সে-হৃদয় আমার অন্ধ ছিল। সে অন্ধ চোখ মেলেছে। যখন প্রাণ মানে না, তখন পূজা আপনি করতে হয়। কিন্তু নিয়মের দাস হয়েছি আমরা। এ আর চলে না। মন্ত্র কী? মন্ত্র কি কেউ শেখায়! সে তো প্রাণ থেকে আপনি উঠে আসে। যে-সুরদাস পথে পথে গান গেয়ে বেড়ায়, ওই গানই তো তার মন্ত্র। অমনি সেবা না হলে সব মিথ্যে। আর অমনি সেবা কেমন করে হয়? যখন সহজ চোখে পড়ে বিশ্বরূপ। সেই বিশ্বরূপ তুমি, ভাই মহাবীর।
‘আমি চমকে উঠে বললাম, এসব কি বলছ রঘুনন্দন?
‘সে বললো, মিথ্যে বলি নি তো! তুমি, এই মাটি, এই বাতাস, জল, ওই গান-পাগল পাখি, ওই আকাশ। এর মধ্যেই সেই রূপ ফুটে রয়েছে, দেখতে পাইনি এতদিন।
‘বললাম, শিখাসূত্রত্যাগী সন্ন্যাসী তুমি, ষট্কর্ম শেষ করে পূর্ণ সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত, সপ্তগুরুর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কলিকালের আখড়াশ্রয়ী অবধূত, এসব কী বলছ?
‘রঘুননন্দন বললো, ঠিকই বলেছি ভাই। সপ্তগুরু কেন? গুরু আমার তুমি, এই প্রকৃতি, গুরু আমার রুক্মিণী, এই সংসার, সংসারের সব আদমি আর আওরত, যা অপরুপ, তাই গুরুর রূপ। এর শুরু কোথায় জানি নে। জানি নে বন্ধু, এর শেষ কোথায়। বলে, সে নিজে নিজে গান গেয়ে উঠলো। গানে গানে সে বললো, ওই যে গঙ্গা বয়ে চলেছে, কত রূপরাশি তার চোখে, সেই রূপ দেখে তুই নাচতে নাচতে চললি গঙ্গা। কিন্তু যেখানে তোর শেষ, সেখানে তোর শুরু। যার বুকে ঝাঁপ দিলি তুই, সে যে অসীম কূলকিনারাহীন। আমিও তেমনি ঘাটে ঘাটে ভেসে যাব, মন ভরাব রূপের হাটে হাটে। বাবুজী, রঘুনন্দনের এই রূপ যেন বাওরা সন্তের হাসি-কান্না ভরা বিচিত্র ও অপরূপ। ওই গান সে নিজের মন থেকে বানিয়ে গাইলে। আমার মনে হলো, যেন ঠিকই বলছে রঘুনন্দন। মনে হলো, ঝুটা আমার এই বিভূতি মাখা, জটা রাখা আর আখড়ায় থাকা। মনে হলো, এসব আমার চারপাশের নিগড়। ছুটে ভেঙে বেরিয়ে পড়ি। জানতাম, নিষ্ঠাবান বলতে যা বোঝায়, রঘুনন্দন ঠিক তা ছিল না কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে তার এই বিচিত্র পরিবর্তন কী করে হলো!
সে আবার বললো, সব দেখবে, তার আগে নিজেকে দেখতে হবে না? মনো ব্রহ্মেতি ব্যজানাং। এ কথা তোমাদের বলেছি মহাবীর ভাই, তাকিয়ে দেখি মনের আঁধার যে বড় ভারী। সে তিমিরে কিছুই চোখে পড়ে না। নমোমাহত্যং। কিন্তু কোন সাহসে নমস্কার করবো নিজেকে! খুঁজি, দেখি। এতদিন হরিদ্বারে আছি, তার গাছ-পাথরটুকুও দেখি নি কোনোদিন নিরালায় বসে। মানুষকে মনে করেছি, সব ব্যাটা টাকাখোর আর কামুক। ক্ষমা কর ক্ষমা কর। যে নিজেকে চেনে না, সে পরকে দেখবে কেমন করে!
সন্ন্যাসীর কথা অর্থাৎ মহাবীরের কথা শুনে আমি বিস্ময়ে হতবাক! সে কী! সন্ন্যাসী রঘুনন্দনের কথা তো দেখছি বাউলের গান হয়ে উঠেছে। এ যে সহজিয়া বাউলের কথা। যেন উঁকি দিচ্ছে বলরাম। রঘুনন্দনের এ সহজ কথা সহজ ভাব আমার মনকে নাড়া দিয়ে দিল। হৃদয়ের রস দিয়ে সে জ্ঞানের ফুল ফোটাতে চায় মস্তিষ্কে, রূপে পাগল হওয়া ছাড়া তার গতি কী!
চাঁদ উঠে এসেছে আরো খানিকটা। মাঝে মাঝে মেঘ উড়ে চলেছে চাঁদের মুখ চাপা দিয়ে। হিমালয় থেকে সমুদ্রে, উত্তর থেকে দক্ষিণে তার গতি। মেঘের ছায়া পড়েছে বালুচরে। আলো-ঝিকিমিক বালু-হাসি চাপা পড়ে যাচ্ছে যেন আচমকা কপট অভিমানে। কিন্তু কী শীত! আর এখনো কত ভিড়। কত কোলাহল।
মহাবীর আবার বললো, ‘বাবুজী, রঘুনন্দন চোখের আড়াল হলো। মনে এলো আমার কুসন্দেহ। ভুলে গেলাম তার প্রাণ ভোলানো কথা। মনে করলাম, রঘু-চরিত্রে দুর্বলতা ঢুকেছে। কেন? না, তার কথাগুলি যত মনে আসতে লাগলো সবই যেন ওই রূপবতী রুক্মিণীর কথা মনে করিয়ে দিল। ও তো কথা নয়, বুঝি কথা দিয়ে রুক্মিণীর রূপের আরতি। কপনি-আঁটা সন্ন্যাসী আওরতের সর্বনাশী মায়াজালে ধরা পড়ে মাথার ঠিক রাখতে পারছে না।
‘আশ্রমে এসে দেখি রুক্মিণীকে। গায়ে তার গেরুয়া নেই। পরেছে নিজের শাড়ি। তার রূপের ছটা আখড়ায় ঘরে-মন্দিরে। শুধু দেখতে পেলাম না তার স্বামীকে।
‘মোহান্ত ডেকে বললো, বদরিনাথ দর্শনে যাবে না তুমি?
‘রুক্মিণী হাসলো। সে কী হাসি! সারা দেহ ভরে তার এক বিচিত্র আনন্দ যেন ঝরে পড়ছে। রূপ তার দ্বিগুণ আলোয় উঠেছে ভরে। বললো, না বাবা! এখানে থেকেই তাকে সেবা করে যাব। তোমরা আমাকে আশ্রমে থাকতে দাও। আমি ভগবানের সেবা করব।
‘এরকম অনেক ছিল বাবুজী। ঘর ছেড়ে আসা অভাগিনী চিরজীবন আশ্রমের সেবা করে কাটিয়ে দিয়েছে। আশপাশের গাঁয়ের অনেক বউ-ঝি সারাদিন কাজ করে আশ্রমে। সন্ধ্যা হলে ফিরে যায় ঘরে। কিন্তু এই আগুন কোথায় রাখা হবে, সন্ন্যাসীর আখড়ায়? মোহান্ত জিজ্ঞেস করলো, তোমার স্বামী কোথায়?
‘বললো, তাকে দেখতে পাচ্ছি না বাবা।
‘সন্ন্যাসীদের মধ্যে কেউ বললেন, থাকুক। আপত্তি ছিল কারুর কারুরও। কিন্তু বাপারটার কোনো ফয়সালাই হলো না। সে থেকে গেল আশ্রমে।
‘মুখে কেউ কিছু বললো না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সকলেই কৌতূহলিত সন্দেহে ঘনীভূত হলো। সকলেই চোখে চোখে রাখে রঘুনন্দনকে। আমিও। সবাই ওৎ পেতে আছি, কবে একদিন ধরে ফেলব রঘুনন্দনের অপকীর্তি!
‘কিন্তু বাবুজী, রঘুনন্দন সে ধার দিয়েও গেল না। না, সে জটা মুড়োয়নি, ছাড়ে নি বিভূতি লেপন। কিন্তু সে-মানুষটি আর নেই। সকাল-সন্ধ্যায় পূজা-অৰ্চনায় মন নেই। তার পদে পদে গাফিলতি। সেজন্য কোন অনুশোচনা নেই। বাওরা সন্তের মতো দিবানিশি শুধু গান আত্মভোলা হাসি। ঘোরে এখানে সেখানে। সে ঘোরে বাইরে বাইরে। রুক্মিণী ঝাঁট দেয় আখড়ার উঠোন, লেপা-পোঁছা করে, জল তোলে, প্রসাদ পায়। কতদিন গেছি রঘুর পেছনে পেছনে। সে যেত নিরালায়। গান গাইত আপন মনে : আমার পাখায় যেদিন হাওয়া লাগবে, সেদিন ছুটে যাব তোমার খোঁজে। কখনো বসব তোমার গিরিশৃঙ্গে, ভাসা মেঘে ঠোঁট ঢুকিয়ে মেটাব আমার পিয়াস। তোমার এই ভুবনে কানে কানে শোনা তোমারই রূপগাথা।
‘গান শোনার জন্য ভিড় করতো লোক তার পিছে। তার মতো জ্ঞানী পুরুষের এই রূপ দেখে অবাক হলো অনেকে।
‘আমি খালি ভাবতাম, ওই গানের মালা কে পরিয়ে দিল তার গলায়! কে খুলে দিল এই গীত-নির্ঝরের উৎসমুখ। সন্ধ্যাবেলা মানসীপূজায় বসে, গুরুমূর্তি কল্পনা করতে গিয়ে, বার বার দেখি রঘুনন্দনকে। কানে শুধু তারই কথা—
ব্রহ্ম নামে একটি ফুল ফুটেছে
তার গন্ধ পাগল করেছে আমাকে।
সে ফুলের রূপে আগুন আছে।
তবু আমার চোখে জ্বলে নি!
শুধু আমার অন্ধ হৃদয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে বাতি।।
‘বাবুজী, রুক্মিণীর সঙ্গে যখন দেখা হত রঘুনন্দনের, তখন তারা নমস্কার করতো পরস্পরকে। কিন্তু রুক্মিণী চঞ্চল হয়ে উঠত। বুঝতে পারতাম, রঘুনন্দনের সঙ্গ কামনায় পাগলিনী হয়েছে সে। লোকলজ্জার ভয় ভুলে কোন কোন সময় ছুটে যেত রঘুর পেছনে। রঘু হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে ফিরে যেতে বললেই, ফিরে আসত সে।
‘বাবুজী, রঘুর প্রতি বিদ্বেষ আসত না কারুর। লজ্জার কথা, যাদের আসত, তারা সকলেই রুক্মিণীর প্রতি আসক্ত ছিল। গৃহী শিষ্যকুল আসত ঘন ঘন। নজর শুধু ওইদিকে। আখড়ারও অস্বাভাবিক অবস্থা।
‘হঠাৎ একদিন আখড়ার সকলেই শুনল, রঘু গাইছে, হে ব্রত্ন ও জ্ঞান, তোমার নাম রুক্মিণী। হে পৃথিবী, তোমার নাম রুক্মিণী। এই হিমাচল ও গঙ্গা, এই বিহঙ্গ ও গাছ, এই আকাশ ও মাঠ সকলেই রুক্মিণী নামে ও রূপে সুন্দরী। হে অবধূত-হংস, তুমি আসলে দেহস্থিত একটি নারী। তোমারও নাম রুক্মিণী। এবার আমি যাব তোমার সন্ধানে। সময় হয়ে গেছে আমার। ডাক পড়েছে।
‘বাবুজী, আরও তাজ্জব, নির্ভয়ে রুক্মিণী এসে ফুল, জল, চন্দন দিল রঘুর পায়ে। সকলে স্তম্ভিত। অনেকে রেগে উঠলো। মোহান্ত বললো, অন্যান্য আখড়ায় খবর দিতে হয়। আমাদের আছে অনেক আশ্রম, নির্বাণী, নিরাঞ্জনী, অটল, জুনা, আনন্দ। সকলের মতামত প্রয়োজন।
‘কিন্তু দরকার হলো না। সেই রাত্রি থেকে রঘু নিরুদ্দেশ। রুকমিণী রয়েছে। চকিত হরিণীর মতো কেবলি খুঁজছে। সে যাকে খুঁজছে, আমরা, বিশেষ আমি, খুঁজছি তন্ন তন্ন করে। সারা হরিদ্বারে পাত্তা মেলেনি তার! তাকে কে পাগল করলো বুঝলাম না, কিন্তু সে আমাকে পাগল করে কাঁদিয়ে চলে গেল।
‘দু’মাস ধরে এই ব্যাপার চলছিল। সকলের মনে যে অস্বস্তিটুকু ছিল রুক্মিণীর জন্য, দু’মাস পরে তার স্বামী এসে সেটুকু দূর করলো তার স্বামী এলো। একলা নয়। সঙ্গে আরও কয়েকজন লোক। ছি ছি ছি, আখড়ার বদনাম। সন্ন্যাসীরা জোর করে রেখে দিয়েছে নাকি তার বউকে! তাই সে কেড়ে নিতে এসেছে। যাদের নিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে দু’জন তলোয়ারধারী শিখও ছিল। লোকগুলি যে নিষ্ঠুর প্রকৃতির, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না।
‘কে রেখেছ? নিয়ে যাক রুক্মিণীকে। আমরাও তাই চাই। কিন্তু বেঁকে বসলো রুক্মিণী। সে যাবে না। তা বললে তো হয় না। এ ব্যাপারের পর আখড়া তাকে এমনিতেই সরিয়ে দেবে। বদনাম যা হওয়ার, তা তো হয়েছেই।
‘শেষে ওরা জোর করে নিয়ে গেল রুক্মিণীকে। বাবুজী, মিথ্যে বলবো না, আমার বুকে বেজেছিল। কেন বেজেছিল? তাহলে বলি, কে অস্বীকার করবে, সে ছিল আমাদের প্রিয়তম রঘুনন্দনের সাধন-প্রেয়সী? রঘু-রুক্মণী যে একাকার হয়েছিল। বাবুজী, কুলাচারে নারীর সঙ্গ-মধ্যে হৃদয় ও প্রেমের কিছু আছে কিনা জানি নে। থাকলেও বিশ্বাস করতে মন চায় না। ও শুধু সাধনমার্গের যান্ত্রিক ক্রিয়া।
‘কিন্তু রঘু আর রুক্মিণী! কুলাচারের চেয়েও প্রেম বড় হয়ে উঠেছে সেখানে। বাবুজী, হৃদয়ের রসহীন যে চারাগাছ উঠেছিল রঘুর মাথায়, রুক্মিণী তাতে ফুল ফুটিয়েছিল। রঘুর জ্ঞান ও হৃদয়ের মাঝামাঝি বন্ধ দরজার চাবি হয়ে এসেছিল রুক্মিণী। এর পর রঘুকে কে কী দিয়ে রাখবে বেঁধে!’
বলে, মহাবীর উঠে দাঁড়াল। কথা যে এইখানেই শেষ করবে, একেবারে বুঝতে পারি নি। বললাম, তারপর?
‘তারপর কী বাবুজী?’
‘রুক্মিণীর কী হল?’
মহাবীর জবাব দিল, ‘কী হলো, তা ঠিক বলতে পারি নে বাবুজী। তবে বছর না ঘুরতে দেখলাম, রুক্মিণী মানিয়াবাঈ হয়েছে।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করে?’
সে বললো, ‘তাও ঠিক জানিনে। যতদূর শুনেছি, তাতে মনে হয়েছে, রুক্মিনীর স্বামীর সঙ্গে যে লোকগুলো এসেছিল তাকে উদ্ধার করতে, তাদেরই কীর্তি এটি। রুক্মিণীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি তার স্বামী। তার সাঙ্গোপাঙ্গরা নিয়ে তুলেছিল একটা ডেরায়। শুনেছি, সেখানে ছিঁড়ে খাওয়া হয়েছিল তাকে। আর তার কাপুরুষ স্বামী পালিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে।
‘বাবুজী রুক্মিণীকে উদ্ধার করার কিছুই ছিল না। রঘুনন্দন তো আগেই চলে গিয়েছিল। তবু, বদনাম রটে গিয়েছিল আমাদের আশ্রমের নামেই। এমন কি, আমাদের বিভিন্ন আখড়ার দু’-একজন রঘুকে খুঁজে ধরে নিকেশ করে দেওয়ার প্রস্তাব পর্যন্ত করেছিল। সেটা যত না আখড়ার দুর্নামের জন্য তার চেয়েও বেশি বিরুদ্ধ ধর্মাচরণের জন্য। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তা হলে ঘটনা অনেক দূর গড়িয়ে পড়ত। আর রুক্মিণী! তার তো অপরাধের সীমা ছিল না। অখড়া থেকে তবু বা তার স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল। কিন্তু অতগুলো লোকের দ্বারা যে দিনের পর দিন ধর্ষিতা হয়েছে, তাকে কি কখনো ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। সে পালিয়ে বেঁচেছিল। তবে, এর জন্য সে আর ডাকেনি লোক-লস্কর, যায়নি পুলিশের কাছে। জানি নে, কে তাকে প্রতিষ্ঠা করে দিল লক্ষ্ণৌয়ের বাঈজী মহলে। কিন্তু তার সারা নামে শহর চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।’
একটু থামল মহাবীর। দাঁড়িয়েছিলাম দু’জনেই। সে দূরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখেছিলাম একদিন। খুবই কৌতূহল ছিল। সেবার লক্ষ্ণৌ গিয়েছিলুম। তখন দুনিয়াজোড়া যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। শহরের বাতিগুলো সব বোরখা পরেছিল। অন্ধকার। কানের পাশ দিয়ে একটা কথা শুনলাম, মনিয়াবাঈ আছে। চমকে উঠলো বুকের মধ্যে। কোথায়? ফিরে দেখলাম, সামনে রাজ-ইমারত। দোতলা কুঠি। উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে রুক্মিণী নয়, মনিয়াবাঈ। একটু আলো এসে পড়েছে ঘরের থেকে। দেখলাম, আঁধারে বিদ্যুৎশিখা স্থির। বাড়ির সামনে কয়েকটি মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দোতলার বারান্দায় ছায়ার মতো ঘুরছে কয়েকজন লোক। ব্যাপারটা কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুধু দেখলাম, ছায়াজগতে এক মূর্তিমতী রূপসী উর্বশী। সেখানে বা অন্য কোথাও বাজছিল সরোদের চাপা বাজনা। পুরুষ গলায় চাপা হাসি, কিন্তু মনে হলো, বাঈজী যেন অন্য জগতে রয়েছে। কীসের ঘোরে সে আচ্ছন্ন, কিন্তু সে শুধু তার বাঈজীসুলভ অভিনয়। তার রূপ-পাগলদের একটু নাচানো। সরে এলাম তাড়াতাড়ি। রঘুনন্দনের কথা মনে পড়েছিল। আমার রঘুনন্দন।’
থেমে আবার বললো, ‘তারপর রামজীদাসীকে দেখছি আজ কয়েক বছর। জানিনে এর কী দরকার ছিল। এতে করে ধর্ম কতখানি এগুলো, জানি নে। কেন সে ওই জীবন ছেড়ে এলো চলে! বাবুজী, মানুষের মন। রামজীদাসী আজ উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের এক রহস্যময়ী নারী। তার ধর্মপ্রচারে কতখানি কাজ হবে আমি বুঝিনে। সাধারণ মানুষ দুরের কথা, সাধু-সন্ন্যাসী মহলে তাকে নিয়ে রীতিমতো আলোচনা হয়। নিজের চোখে দেখে এলাম। সে যে আগুন। আগুনের শিখা। কোনদিন আবার কী প্রলয় উপস্থিত হবে কে জানে! আমার সেই ভয়।’
‘তবে যতদূর শুনি, সে এখন নাকি সব সময়েই নামের ঘোরে থাকে। অষ্টপ্রহর নামকীর্তনই তার কাজ। লোকে বলে, রঘুনন্দনের সঙ্গে নাকি তার দেখা হয়েছিল। সেই থেকে সে এ পথে এসেছে। আমি বিশ্বাস করতে পারি নি। এখনো করি না। রঘুনন্দন আর রামজীদাসী আকাশ-পাতাল তফাৎ। তাছাড়া আর একটি কথা শুনেছি।’
মহাবীর থামলো। বললাম, ‘কী?’ মহাবীর বললো, ‘গুজব বলেই মনে হয়। ওই যে দেখলেন সরোদ বাজাচ্ছে একটি লোক, ছিল সে একজন সরকারী কেরানী। ভালো সরোদের হাত। ওটি ওর সাধনার জিনিস। ভারি ওস্তাদ বাজিয়ে। কোন বাঈজী ওকে পেলে বর্তে যেত। লোকটি নাকি নিজের ইচ্ছেয় মনিয়াবাঈয়ের ওখানে যন্ত্র বাজাতে যেত। সে-ই নাকি মনিয়াকে এ পথে নিয়ে এসেছে। সকলেই তো কেটে পড়েছে আজ। শুধু ওই লোকটি ওই মিঠে যন্ত্রটি কাঁধে নিয়ে ছায়ার মতো ফিরছে রামজীদাসীর সঙ্গে সঙ্গে। শুনতে পাই, লোকটি নাকি খুব ভালো। একরকম মৌনব্রত বলা যায়। কথা বলে না কারুর সঙ্গে। এমন কি, রামজীদাসীর সঙ্গেও নাকি তাকে কেউ বড় একটা কথা বলতে দেখে না। এই সরোদের সুরই তার কথা। ওটি না বাজলে রামজীদাসীর রাম-ভজনের নাচ আসে না, পা ওঠে না।’
বলে, মহাবীর একটু হাসলো। বললো, ‘বাবুজী, অনেকেই জানে ওসব কথা, তাই বললাম। এবার আমি চলি।’
বললাম, ‘আপনার রঘুনন্দনের…’
আবার হাসলো সে। সে-হাসির অনেক অর্থ। বললো, ‘আমার রঘুনন্দন। ঝুটা বলেন নি। তবে আমার একলার নয়। আমাদের আখড়ার সুখের সংসারে সে ভাঙন ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বদনামের নয়, একটা নতুন ভাবের ঘোর এনে দিয়েছিল সে।’ বলতে বলতে দেখলাম, মহাবীরের মুখে একটি চাপা বেদনার হাল্কা অন্ধকার চেপে বসলো। চাপা গলায় বললো, ‘সে যে আমাকে পাখির গান শুনিয়ে গেল, সে যে আমাকে এক পাগল প্রেমের পথ দেখিয়ে গেল, সেই হলো আমার কাল। বাবুজী, আমি আর সন্ন্যাসী নই। ঘরে ফিরে যাওয়া মনস্থ করেছিলাম, পারিনি। সেই সহজ আর অসীমকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। ভাবি, সহজ আর অসীম, সে যে বুকের রসে মাথার ফুল ফোটানোর সাধনা। সে যে বড় যন্ত্রণার, বড় ব্যথার, মহা আনন্দের—কোনোটাই যে খুঁজে পাই নে।
‘বাবুজী, কুলাচারীর চক্রসাধনে হৃদয়ের স্থান কতটুকু আছে, জানি নে। কিন্তু এ জৈব-সাধনাই ধর্মান্তরিত করে গেল সন্ন্যাসীকে। ভেঙে দিয়ে গেল তার আচার-বিচার। তন্ত্রসাধনায় অভ্যস্ত হয় নি সে। তার জ্ঞানের সুধা হৃদয়ের রসে মিশে ভেসে গেল। যেমন হিমালয় থেকে নেমে ওই গঙ্গা চলেছে দুকূল ভাসিয়ে। প্রেম ও সহজের ওই তো পথ। রুক্মিণীর সঙ্গে রঘুনন্দনের প্রেম ছাড়া আর কী ছিল? কিছু না। নইলে আচারের নিগড় ভাঙত কী করে? তবু ভাবি, একদিনের তো দেখা রুক্মিণীর সঙ্গে। এত আলোড়ন আনল কী করে?’
‘কী জানি! প্রেমের কাজই নাকি অমনি। কখন কোনদিকে চলে, কে জানে! গতি তার নিমেষে সব ওলট-পালট করে দিয়ে যায়।’
বলে, হেসে উঠলো আবার। কপালে হাত ঠেকিয়ে বললো, ‘নমস্তে বাবুজী।’
বলে, আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে পুবদিকে চলে গেল। অদূরেই নয়নজুলির মতো একটি অল্প গভীর খাদ গিয়েছে উত্তর দক্ষিণে। আশেপাশে তখনো চলাচল করছে অনেক লোক। সেই বালি-খাদের আড়ালে, লোকারণ্যে হারিয়ে গেল মহাবীর।