অমৃত কুম্ভের সন্ধানে – ৩

উঃ, কী ধুলো। ধুলোয় অন্ধ হয়ে গিয়েছে আমার চোখ। মুখ বিস্বাদে ভরে গিয়েছে, কিচকিচ করছে ধুলোয়।

জীবনযুদ্ধে প্রাণ তিক্ত হলাহলে পূর্ণ। পথে বেরিয়েছি নিতান্ত একান্তে নিজের হৃদয় একতারায় সুর তুলে। সেখানেও একটানা আনন্দ থাকবে কে বলেছে! সুরে যদি বেসুর না বাজে, তবে আর বাজিয়ে বেড়াবার কী প্রয়োজন ছিল। কিছুক্ষণ পরেই এলো রিকসাওয়ালা। ধুলোমাঠ থেকে ছুটে বেরিয়ে রাস্তায় উঠলো রিকসা। বাঁধের পথের দু’দিকে বিপণি সাজিয়ে বসেছে ব্যবসাদারেরা। একটি একটি আলো জ্বলে উঠেছে এখানে সেখানে। কোলাহল ক্রমে আরও বাড়ছে।

চোখ ভরে দেখবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এতক্ষণে ক্লান্তি এসে গ্রাস করছে। বুজে আসছে চোখ। বুঝেছি, গন্তব্য আগতপ্রায়। তবু মন বলছে আর কতদূর!

রিকসা থামল। শুনলাম, ‘বাবু, এই যে, বাঁধ।’

তাকিয়ে দেখি সামনেই পথ বন্ধ। বাঁধের উঁচুজমি আড়াআড়ি চলে গিয়েছে উত্তর-দক্ষিণের কোনাকুনি। যেতে হবে বাঁধের ওপরে।

রিকসাওয়ালাকে পয়সা দিয়ে বাঁধে উঠে এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম। অদূরেই গঙ্গা। উত্তর থেকে দক্ষিণে তীব্র স্রোত ছুটে চলেছে। বারো মাসের অন্ধকার গঙ্গার তীর আজ বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করছে। তারই আলোর ঝলক গঙ্গার পূর্বতীরের বাঁকা স্রোতে শাণিত বঙ্কিম অস্ত্রের মতো ঝিকমিকিয়ে উঠেছে।

ওপারের আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি তাঁবু-সমুদ্রের ঢেউ। সন্ধ্যার গাঢ় ধূসরতায় ঢেকে গিয়েছে পেছনের বিস্তৃত ভূমিখণ্ড। আর পূর্বে মাথা উঁচিয়ে উঠেছে উঁচু ভূমির বুকে গাছপালা ঘেরা গ্রাম। হয়তো ওখানেই আছে কোথাও সমুদ্রগুপ্তের উঁচু টিলার বুকে কাটানো কূপ।

আর বিশেষ কিছু চোখে পড়ছে না এখন। দক্ষিণে দেখতে পাচ্ছি ঘষা রুপোর পাতের মতো একটা চলন্ত জলের ধারা।

এই প্রয়াগ। (প্র=প্রকৃষ্ট, যাগযজ্ঞ)। যজ্ঞ অনুষ্ঠানের প্রকৃষ্ট স্থান হলো প্রয়াগ। পুরাণ শাস্ত্রের প্রজাপতি-ব্রহ্মার যজ্ঞবেদী, যজ্ঞের মধ্যবেদী এই প্রয়াগ। প্রজাপত্যের্যজ্ঞ আসীৎ প্রয়াগে। ভারতের আদিম যুগের ধর্মীয় ইতিহাসের লীলাক্ষেত্র। পৃথিবীর প্রথম যজ্ঞের ধূম সঞ্চারিত হয়েছে এখানকার মাথার উপরের আকাশে। প্রয়াগ সেই পূণ্যভূমি।

সিতাসিতে সরিতে যত্র সঙ্গতে
তত্রাহল্প তাসো দিবমুৎপতন্তি
যে বৈ তনুং বিসৃজন্তি ধীরাঃ
তে বৈ জনাসোহমৃতত্বং ভজন্তে।।

কিন্তু তা তো হলো। ঘরবাসী মানুষ পথে বেরিয়েছি। মাথা গুঁজব কোথায়! ঠাঁই নিশানা করে বেরুই নি, খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু এই মুক্ত আকাশের বুকে উত্তরঙ্গ তাঁবু-সমুদ্রের কোথায় ঠাঁই পাব, সে কথা তো একবারও ভাবি নি! মন বাউল হোক, হৃদয় হোক বৈরাগী, তবু ইতিমধ্যেই শীতে যে রকম কুঁকড়ে উঠছি, আচ্ছাদন না পেলে তো নিছক বাউলের মতোই মরতে হবে।

সব ছাড়তে পারি কিন্তু প্রাণ ছাড়তে পারি নে। তাড়াতাড়ি ঠাঁই খোঁজার জন্য নেমে গেলাম বাঁধের নিচে।

বাঁধের নিচে নেমে দেখলাম, জমকালো ব্যবস্থা। সে জমকালো ব্যবস্থা দেখবার মতো চোখ বা মন কোনোটাই এখন নেই। কালকে এ সময়ে প্রায় ঘর ছাড়ার উদ্যোগ করেছিলাম আজ এখনো মাথা গুঁজতে পারি নি কোথাও। চোখ আর মনের দোষ দিতে পারি নে।

সামনে লোক, পেছনে লোক, লোক ডাইনে বাঁয়ে। এখানে কারুর গতি একমুখী নয়। বহুমুখে চলেছে জনতার মিছিল। সকলেই চলেছে আশ্রয়ের সন্ধানে। আমি ঝোলাঝুলি নিয়ে একবার এদিকে ধাক্কা খেয়ে ওদিকে যাই, ওদিক থেকে এদিকে। বেশির ভাগই চলেছে গঙ্গার ওপারে।

ওপারে যাওয়ার জন্য রয়েছে অস্থায়ী সেতু। ভাসন্ত সেতু। আধুনিক যুদ্ধবিগ্রহের জন্যই এই সব সেতুর প্রয়োজন। পাশেই রয়েছে সামরিক বাহিনী এবং পি ডব্লিউ ডি-র ক্যাম্প। উর্দি পরা সৈনিকেরা দেখলাম পুলের উপর যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। সারি সারি আলোক মালা জ্বলে উঠেছে পুলের উপর। তীব্র স্রোতে তার প্রতিবিম্ব হারিয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে। মনে হলো, কাছাকাছি দু’টো মাত্র পুল রয়েছে।

কিন্তু ওপারে গিয়েই বা কী করব! যাব কোথায়! দেখতে পাচ্ছি, ওপারে হাল্কা কুয়াশার আড়ালে জ্বলছে অজস্র আলো, অজস্র ধূসর বর্ণের তাবু। মানুষ আসছে শত শত, যাচ্ছে হাজার হাজার। এপারে ওপারে মাইক নিনাদিত স্তোত্র, ভজন কীর্তন ও পুণ্যার্থীর কোলাহলে দিগন্ত মুখরিত। কিন্তু আমি যাই কোথায়!

মন পাগল হয়েছিল, কিন্তু এখন পাগল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় কী করে! সামনেই একটা বটতলায় দেখলাম, থরে থরে খাবার সাজানো রয়েছে। সর্বনাশ! সারা দিনটাতে যে চা-সিক্ত প্রাণ বাউল হয়েছিল, সে প্রাণ খাবার দেখেই মুহূর্তে ভোগের জন্য লালায়িত হয়ে উঠলো। সেই তেল-সিঁদুর আর ভবীর ব্যাপার। পোড়া পেট যে বাউল হয় না, বৈরাগ্যও মানে না। খাবার দেখা মাত্র চকিতে ক্ষুধার্ত চোখ পড়ে ফেললো, ‘খাঁটি ঘিউকে পুরী, দুধকে মালাই, লাড্ডু, প্যাড়া, সন্দেশ…।’ থাক থাকো, আর পড়ে লাভ নেই। ইতিমধ্যেই চোখের ভিতর দিয়ে সে মরমে পশেছে। এবার মরমের রস জিভ দিয়ে গড়াবার যোগাড় হয়েছে। তবে এই প্রয়াগ কা লাড্ডু এখন দিল্লি কা লাড্ডুর সমান। খেলে ভেদবমি হবার আশঙ্কা খুবই, না খেলেও জিভের জল তো কারুর হাতধরা নয়।

একদিকে ‘ইদ্ধে যাও,’ অন্যদিকে ‘উধার হটো,’ নানা প্রাদেশিক বুলি ও ধাক্কা খেতে খেতে সরে এসেছি অনেকখানি। সামনেই দেখলাম, একটা তাঁবুর গায়ে সাইনবোর্ড ঝুলছে, এনকোয়্যারি। দেখি, এনকোয়্যারিতে এনকোয়্যারি করে কিছু মেলে কিনা

আগে থাকতে শুনিনি কিছুই। ভেবেছিলাম, ভারতবর্ষের ধর্মীয় পীঠস্থান প্ৰয়াগ। পাণ্ডাদের জ্বালায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারবো না। আপনিই আশ্রয় যোগাড় হয়ে যাবে। কথায় বলে, ধরলে যম ছাড়তে পারে, পাণ্ডা ছাড়ে না। কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা না ছিল এমন নয়।

বছর কয়েক আগে একবার পুরী যেতে হয়েছিল। অসময়ে, মানে মরসুমের বাইরে। শুনেছি কোনো কোনো সময়ে, বনগাঁয়ের ইয়ে রাজা থেকে শুরু করে ভুতো-গদা-পুঁটীরা, স্বপ্ন-প্রিয় শুভ্রা বাহিনী, আওয়ারা গ্যাং, কলমবিদ্বেষী কেরানী, বাগ্মী অধ্যাপক ও জাদুকরী, কলমবাজ সাহিত্যিক বিদগ্ধজনেরা সকলেই পুরীর সমুদ্রসৈকতে মরসুমী ফুল হয়ে ফুটে থাকেন কিছুদিনের জন্য। মরসুমী ফুল হওয়ার সুযোগ পাইনি। মেঘভারাতুর আকাশ আর নিয়ত-ক্ষিপ্ত ভয়ংকর মূর্তি সমুদ্রের দারুণ ঝাপটায় আমার মতো অনামী ফুলের সব পাপড়িগুলি ঝরে গিয়েছিল।

যাক সে কথা। পুরী স্টেশনে দেখেছিলাম যাত্রীর দ্বিগুণ পাণ্ডাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমাদের উপর। যেন একরাশ মানুষের উপর ক্ষুধার্ত সিংহবাহিনী। কে কাকে সাপটে নেবে সেই চিন্তা। আমি একলা মানুষ কোনোরকমে যদিও বা পাণ্ডাব্যুহ ভেদ করে রিকসায় উঠেছিলাম, খানিকটা এগুতেই দেখি এক আধবুড়ো চলন্ত রিকসাতে উঠেই আমার পাশে বসেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার!’ সে একগাল হেসে তার নাম-ধাম পরিচয় দিলে। বুঝলাম, সে একটি পাণ্ডা। আরও বুঝতে হয়েছিল, বাঙলাদেশের অনেক নামী ও মানী পরিবারের পাণ্ডা। অতএব তার নিজস্ব মন্দিরেই আমার প্রথম প্রবেশ। কিন্তু কোনোরকমে যদিও বা তার এঁটো-কাঁটা ছড়ানো ভয়াবহ পিছল কুয়োতলা থেকে ফিরে এসেছিলাম, খেতে বসে কান্না পেয়েছিল।

হলুদ-গোলা ফ্যান হলো ডাল, আর কচুর তরকারি দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিলে আলুর তরকারি। কাছে বসে আতিথেয়তা করছিল পাণ্ডা আর হাতির মতো ফোলা দু’টি পা নিয়ে তার বউ। খেতে দিচ্ছিল একটি কলা বউ। ঘোমটার নিচে দেখা যাচ্ছিল তার দোলানো নোলক আর ছুঁচলো স্থূল ঠোঁট।

সে রকম হলে, পরিবেশ একটি বাঙালি গৃহস্থের দ্বিপ্রহরিক রান্নাঘরের সুখে দুঃখে ভরে উঠতে পারত। কিন্তু এখানে স্নেহ ও অনুরাগ-ভরা উপরোধ ও এক হাতা ঘণ্টো ধপাস করে পাশে ফেলে দেওয়ার ব্যাপার নয়। কচু দিয়ে আলুর দাম নেওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র।

শুনলাম দেড় টাকা এর দাম। দুবেলায় তিন টাকা হয় বটে, আট আনা ছাড় দেওয়া হবে। এ ছাড়া জগন্নাথের মন্দির দর্শন করবার দর্শনী তো আছেই।

মাথায় থাকুন জগন্নাথ ঠাকুর। জানি না, কচুকে আলু করতে পারেন কিনা তিনি। মাথায় দিই তাঁর লীলাভূমির ধুলো নিয়ে। দেড়খানি রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে গলায় জ্বলুনি নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম সমুদ্রতীরে। কপাল ভালো, আকাশে ছিল মেঘলা ভাঙা রোদ। দিগন্তহীন শান্ত সমুদ্র প্রাণভোলানো হাসির লহর তুলে সম্বোধন ও সংবর্ধনা জানিয়েছিল আমাকে। সেই ছিল আমার সান্ত্বনা, আমার কচুজ্বলুনি গলায় অমৃতের প্রলেপ, আমার জগন্নাথ দর্শন।

যাক। একেবারে গল্প ফেঁদে বসেছি। প্রয়াগ থেকে ছুটে গেছি সমুদ্রে। গল্প বলার নেশা ছাড়তে পারি নে। কথা হচ্ছিল পাণ্ডা নিয়ে। কিন্তু এখানে পাণ্ডার প্রাদুর্ভাব অন্তত আমার চোখে পড়লো না। পড়লে সদ্‌গতি হোক আর দুর্গতি হোক, গতি একটা হতো।’এনকোয়্যারি’ ক্যাম্পে ঢুকে দেখলাম, একজন পুলিশ অফিসার বসে কী লিখছেন আর সেপাই একজন রয়েছে দাঁড়িয়ে। বললাম, ‘দেখুন মশাই, আপনাকে একটা কথা—’

অফিসারটি লেখনী বন্ধ করে চকিতে একবার আমার আপাদমস্তক দেখেই আবার নিজের কাজে মন দিয়ে বললেন, ‘আপ ফোটো খিচনে মাংতা হ্যায় না? আই অ্যাম সরি, মেলাকা ফোটো খিচনা বিলকুল মানা হ্যায়।’

মেলা-কা ফোটো! সামনে আয়না নেই, তবু নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একবার। ধূলি-ধূসরিত জামা-কাপড়ের আসল রঙ চেনা দায়। তাহলে মাথা-মুখের অবস্থা কী হয়েছে, সেটা অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে। কাঁধে ওভারকোট, দু’হাতে ঝোলা। গলায় ক্যামেরাও ঝোলানো নেই, পোশাকটাও আর যা হোক ট্র্যাভেলারের মতো রম্য নয়। ফোটোর কথা কেন এলো ভেবে বিস্মিত হলাম। বুঝে নিলাম, মেলার ফোটো তোলা নিষিদ্ধ হয়েছে। বললাম, ‘ফোটোর কথা বলছি না, এখানে কোথায় আশ্রয় পেতে পারি, বলতে পারেন?

এবার অফিসারটি বিস্মিত হয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললেন, ‘কেন, আপনি যেখানে খুশি আশ্রয় নিতে পারেন। কোনো আশ্রমে কিংবা পাণ্ডাদের ক্যাম্পে। নয় তো আপনি নিজেই বেড়ার ছাউনি দিয়ে আশ্রয়, তৈরি করে নিতে পারেন। কোত্থেকে এসেছেন?’

বললাম, ‘কলকাতা। ‘

অফিসারটি এক মুহূর্ত ভেবে বললেন, ‘আপনি রামকৃষ্ণ আশ্রম কিংবা ভারত সেবাশ্রমের ক্যাম্পে খোঁজ করলে আপনার সুবিধা হতে পারে।’

কেন সুবিধে হতে পারে, সেটা উহ্য রেখেই তিনি আবার কাজে মনোযোগ দিলেন। কিন্তু আবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে হলো, ‘আচ্ছা বলতে পারেন, সেবাশ্রম সংঘটা কোথায়? কিংবা রামকৃষ্ণ আশ্রম?’  

মুখ না তুলেই তিনি বললেন, ‘একটা বাঁধের ওপারে, আর-একটা গঙ্গার ওপারে।’

বলে, তিনি অত্যন্ত দ্রুত গলায় সেপাইটিকে নির্দেশ দিতে লাগলেন। বুঝলাম, আমার এনকোয়্যারির পালা শেষ। এবার আমাকে বাঁধের ওপার অথবা গঙ্গার ওপার বেছে নিতে হবে। যে কোনো ওপার ছাড়া গতি নেই।

এতদুর চলে এসে মনে মনে হাঁপিয়ে মরছিলাম। ভেবেছিলাম, এসে পড়েছি। কিন্তু সে যে কতদূর এখনো, কে জানে!

বাইরে এসে দাঁড়াতেই, মনে হলো শিস দিয়ে উঠলো একটা চাবুক আর সর্বাঙ্গে কেটে বসলো তার আঘাত। একবার শিউরে উঠে সামলাতে না সামলাতে আর-একটা ঝাপটা। সর্বনাশ! শীতের প্রকোপ যে এত ভীষণ তা জানতাম না। তাড়াতাড়ি ঝোলা নামিয়ে ওভারকোট চাপালাম গায়ে।

সন্ধ্যার পরমুহূর্তের এই সময়টা অদ্ভুত হয়ে উঠেছে। ধুলো আর ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে চারদিক। আলো থাকা সত্ত্বেও আপাদমস্তক ঢাকা মানুষগুলি ছায়ামূর্তির রূপ ধরেছে। আধো অন্ধকার মঞ্চের এক গোপন রহস্য, দৃশ্য হয়ে উঠেছে সঙ্গমের উন্মুক্ত আকাশতলে। তারই মাঝে ছায়ামূর্তির খেলা।

এসবই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত মস্তিষ্কের আজগুবি স্বপ্ন কিনা বুঝতে পারছি না। কাছে এত ভিড় ঠেলাঠেলি, এত কল-কোলাহল, তবু মনে হচ্ছে সবই অনেক দূরে। যেন শীতের নিশীথে আমি দাঁড়িয়ে আছি এক গ্রামের সীমান্ত মাঠে। আমার কানে ভেসে আসছে সেই গ্রামের কোলাহল। অস্পষ্ট, অথচ কত স্পষ্ট। ঝাপসা, অথচ সবই দৃশ্যমান!

হঠাৎ আমার মন বেঁকে বসলো। থাকো, যাব না কোনো আশ্রমের সন্ধানে। একবারও নিজের মন খোঁজার চেষ্টা করলাম না। একটু ছলও খুঁজলাম না। কেবল মনে হলো, এইটুকু দেখবার জন্যই তো এসেছিলাম। এইটুকু আরও প্রাণভরে দেখবো। কী করে মনে এ ভাবের উদয় হয় জানি নে। এ কীসের হতাশা, কীসের গ্লানি বুঝি নে। এ কি নিজের মন থেকেই কোনো অভিমানের সৃষ্টি, না কি নিজেকে পীড়ন করার এক ভয়াবহ বিলাস-বাসনা সুপ্ত রয়েছে আমার মনের মাঝে, তাও আন্দাজ করতে পারি নে। দূরে ফেলে এসেছি জীবনধারণের সংগ্রাম। সেখানে প্রতি মুহূর্তে বাঁচার অভিযান। এখানে জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার তেমন কোনো নির্দয় ইচ্ছা নেই, তবুও ভাবলাম, পড়ে থাকবো এই বালুপ্রান্তরে। কেন আবার নিজের ভাবনায় অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করবো এখানেও! রাত কেটে যাবে, সম্ভবত কেটে যাবে এখানে থাকার অঙ্ককযা দিনগুলিও। যে মনকে ফাঁকা ভেবে এসেছি ছুটে,  তাকে ভরে নিয়ে যাব চলে। তবু আর টেনে নিয়ে যেতে পারি নে। দেহের চেয়ে মন ভারী। এর বাড়া ভারী সংসারে আর কী আছে!

আমি নয়, হঠাৎ চমকে উঠলো আমার কানের পর্দা। কী শুনলাম! কার গলা শুনলাম! চকিতে শিথিল দেহ ঝাড়াপাড়া দিয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি ভিড়ের দিকে ধুলোভরা দু’চোখ তুলে ধরলেম আকুল আগ্রহে।

দেখতে পেলাম না, কিন্তু আবার শুনতে পেলাম ফাটা বাঁশের চেরা গলা, ‘আর জ্বালাস নি আমাকে পেল্লাদ। এবার আমি গঙ্গায় ডুবে প্রাণটা দেব।’

জবাবে পেল্লাদের ক্ষুদ্ধ হেঁড়ে গলা শোনা গেল, ‘যা খুশি তাই করগে যা। আমি আমার পরিবারকে নিয়ে কাল চলে না যাই তো—’

‘খবরদার পেল্লাদ, দেবতার থানে দিব্যি কাটিস নে।’

‘কাটব। হাজারবার দিব্যি কাটবো। দেখি আমাকে কে কী করতে পারে!’

‘কাট, কাট তাহলে। দ্যাখ, আমিও গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে পারি কি না।’

কিন্তু পেল্লাদের সেই কথা, ‘কাটবই তো। তুই দে ঝাঁপ। শালা জন্মে অবদি পায়ে কোনোদিন ছুঁচ ফোটাইনি! আর তোর কিপটেগিরির জ্বালায় আমাকে তো নিতেই হলো, আমার পরিবারকেও কিনা ছুঁচ ফোটালে! এখন যদি একটা কিছু হয়?’

‘আর আমার এই বুড়ি হাড়ে বুঝি ছেড়ে দিয়েছে রে ড্যাকরা?’

এবার কার মোটা গলা শোনা গেল, ‘আঃ, তোমরা এবার থামো দিকিনি বাপু।’

উঃ, সেই নাটক! এখনো তার শেষ হয়নি। এর দেখছি বিরাম নেই, অঙ্ক নেই, বোধ হয় যবনিকাও পড়বে না। শুধু বহির্দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে মাত্ৰ।

কিন্তু আমার মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। আহা, ফাটা বাঁশের চেরা গলা ও প্রহ্লাদের হেঁড়ে গলা যে এমন মিষ্টি, তা কে জানতো! এ যে ডুবন্ত মানুষের খড়-কুটোর আশ্রয়। কেন পড়ে থাকবে এই বালুপ্রান্তরে! কীসের গ্লানি, কীসের হতাশা!

ওই তো! ওই তো দেখতে পাচ্ছি প্রহ্লাদ ভিড় ঠেলে চলেছে। তার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো শাল খুলে পড়েছে। এক হাতে ধরেছে দিদিমাকে, আর এক হাতে বউকে। বউকে তো নয়, প্রহ্লাদের ভাষায় পরিবার। বাব্বাঃ, হারিয়ে যাবার ভয়ে এক হাত ধরার কষাকষি, তার মধ্যেই গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়া ও দিব্যি কাটার ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা চলছে। তাহলে তাদের তিনজনকেই ইন্‌জেকশন নিতে হয়েছে। যাক, বাঁচা গেল। রুগীকে কোনো কোনো সময় ওই ভাবেই জোর করে ঔষধ দিতে হয়।

ভিড় ঠেলে তাদের কাছে গেলাম। প্রথমেই নজর পড়ল দিদিমার। আর যায় কোথায়? অমনি খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘থাক, আর দাঁত বের করে হাসতে হবে না।’

‘সত্যি! তাড়াতাড়ি দাঁত ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। কী করব! তাদের আগ বেড়ে ইনজেকশন নিয়েছি, অপরাধ তো আমারই।

প্রহ্লাদ বললো, ‘অ্যাই যে মোশাই, ব্যাটারা ছাড়লে না কিছুতেই। কুট করে দিলে ঢুকিয়ে।’ বলেই গলার স্বর পরিবর্তন করে বললো, ‘উঃ, কী ব্যথা! নির্ঘাত আমার জ্বর এসেছে।

অমনি দিদিমা বলে উঠলেন, ‘সেই অলক্ষুণে কথা! কক্ষনো তোর জ্বর আসেনি।’

‘আমি বলছি এসেছে। আমার যদি কিছু হয়-’

হঠাৎ একটা গোঙানি শুনে তাকিয়ে দেখি, বুড়ি দিদিমা উদ্‌গত চোখের জল চেপে বিড়বিড় করে বলছে, ‘ভগবান, ওর কথা যেন মিথ্যা হয়। আমি এতদূর থেকে ছুটে এসেছি আর আমার পেল্লাদের জ্বর করে দেবে

কী জানি প্রহ্লাদ টের পেয়েছে কিনা, সে কিন্তু গলার স্বর একটু নামিয়েছে। জ্বর আসেনি, প্রহ্লাদের ওটা মন-জ্বর। একবার যখন পেয়ে বসেছে, ও সারতে দেরি হবে। সে আমার উদ্দেশ করে বকবক করেই চললো। ‘মোশাই, এমন কিপটে বুড়ি, রোজ দু’আনা পয়সা দিতে আমার কালঘাম বার করে ছাড়ে। রোজ নয়, মাসে নয়, বছরে নয়, একবারের জন্য ছ’টা টাকা দিলে দিলে তো কাউকেই এ ভোগ পোয়াতে হতো না।’

কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রোজ দু আনাটা কীসের?’

হিক্কা তোলার মতো সরু গলায় হি হি করে হেসে উঠলো প্রহ্লাদ। পরমূহর্তেই আবার বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, ‘আর জিজ্ঞেস করবেন না মোশাই, মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওঃ, দু’টো দিন নিরম্বু উপোস যাচ্ছে! আগে জানলে কোন শালা আসত এখানে!’

কথাটা না বুঝে তার দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে একটু ঝুঁকে গলা নামিয়ে বললো, ‘বুঝলেন না? আপনি দেখছি নেহাত অকম্মা। আরে মশাই, বাবার পেসাদ! বুঝলেন, বাবার পেসাদ। যাকে বলে কলকে সেবা।’

‘মানে গাঁজা?’

প্রহ্লাদ জিভ কেটে বললো, ‘ছিঃ, ও কথা বলতে নেই।’

পাশ থেকে দিদিমার গলা শুনতে পেলাম ‘মরণ! ওর মুণ্ডু বলতে নেই। নেশাখোর যম, তীর্থ করতে এসেও আমার হাড় জ্বালিয়ে খাচ্ছে। বলি ও পাঁচ-বদ্যি, কোমর যে ভেঙে গেল বাবা, আর কদ্দূর?’

এতক্ষণে সামনের লোকটি মুখ ফেরালো। অর্থাৎ পাঁচ-বদ্যি। পাঁচ-বদ্যি কেন, অতবড় চেহারাটার নাম দশ-বদ্যি হলেও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু মুখটা দেখে শিউরে উঠলাম। মনে হলো, নিষ্ঠুর লগুড়াঘাতে কেউ ফুলিয়ে দিয়েছে লোকটার মুখ। মাথাটা সামনে পেছনে নোড়ার মতো লম্বা। কপালটা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সামনের দিকে, চোখের কোল দু’টো ঢুকে গিয়েছে ভেতরে। থ্যাবড়া নাক, মোটা ঠোঁট। নাম পাঁচ-বদ্যি। কেন, তা জানি নে। কিন্তু পরনে রয়েছে ফুলপ্যান্ট আর বুশ শার্ট। কোট চাদর কিছুই নেই। তবু এই শীতে সে একটুও কুঁজো হয়ে পড়ে নি। বললো, ‘এই পুলটা পারো হয়ে খানিকটা যেতে হবে।’ বলে, একবার আমার দিকে ফিরল। চোখ না দেখলেও বুঝলাম, আমার দিকেই তাকিয়ে দেখলো সে।

পুল পারো হতে গিয়ে দেখি বাধা। সেপাই ছুটে এসে বললো, ‘এ পুল দিয়ে ওপার থেকে আসা যায়। ওই দক্ষিণের পুল দিয়ে যেতে হবে।’

তাই গেলাম। ভিড় ঠেলাঠেলি করছে পুলের মুখে। যারা এসেছে রিকসায়, টাঙ্গায়, তাদের নামিয়ে দিচ্ছে সেপাইরা। পুলের উপর দিয়ে মানুষ নিয়ে যেতে পারবে না কোন যানবাহন। হেঁটে যেতে হবে। তাই নিয়ে লেগেছে চিৎকার আর গণ্ডগোল।

ভাসন্ত পুল। মানুষের পায়ের চাপে চাপা আর্তনাদে ক্যা ক্যাঁ করে উঠছে। দুলে দুলে উঠছে। বাধা পেয়ে ফুলে ফুলে উঠচে পুলের নিচের জল। চাপা গর্জন তুলে ছুটে চলেছে নিয়তবাহী গঙ্গা।

এখানে শুধুই চলা, শুধুই যাওয়া। যাওয়া-আসা নেই। আমরা সমুদ্রোপকূলের বাঙালিরা গঙ্গায় যাওয়া আসা দেখতে অভ্যস্ত। এ-বেলার জলে আমরা ওবেলা পলিমাটি দেখতে পাই। কিন্তু এখানে নিরবধি সূদুরের ডাক। অজানা ও অচেনার পথে নিরন্তর রোমাঞ্চকর অভিযান। সে অভিযানের প্রত্যাবর্তন নেই।

গঙ্গা পারো হয়ে এসে শীতের ডিগ্রি যেন আর একটু চড়ল। পুলের নিচেই সারি সারি প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে আছে কতকগুলি লোক। চেঁচাচ্ছে, ‘ঘিউ কা দীয়া। চার চার পয়সা। গঙ্গা মাঈকী সেবা করো বাবু।’

দেখলাম, অনেকগুলি জ্বলন্ত প্রদীপ গঙ্গাকিনারের নিস্তরঙ্গ জলে চলেছে ভেসে। ঘৃত-দীপ। জলের বুকে প্রতিবিম্ব পড়ে দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে তার সংখ্যা।

এই দীপ গঙ্গা কীভাবে গ্রহণ করছেন জানি না। চোখে দেখতে পাচ্ছি, ন্যাংটো, আধ-ন্যাংটো হা-ভাতে ছেলের দল ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলে। দু’হাতে সন্তর্পণে নিয়ে চলেছে হয়তো নিজেদের অন্ধকার ডেরায়। কেউ কেউ মেতে উঠেছে খেলায়। ঢেউ দিয়ে প্ৰদীপ সরিয়ে দিচ্ছে গঙ্গার দূর অকূলে।

মাতালের মতো চলেছি। ঠাণ্ডা বালুর মধ্যে গোড়ালিসুদ্ধ পা ডুবে যাচ্ছে। গাঁয়ের বাড়িঘরের আগ-দুয়ার দিয়ে চলার মতো চলেছি তাঁবুর এ-পাশে ও-পাশে। ধুনুচি জ্বালিয়ে এখানে সেখানে বালুর উপর বসে আছে সাধুর দল।

প্রহ্লাদ ডাকলো, ‘ডাক্তারমামা।’

জবাব দিল পাঁচ-বদ্যি, ‘বল্।’

‘আর কত দূর?’

‘এই এসে পড়েছি। ওই যে দক্ষিণপুবে দেখছিস অনেকগুলো আলো জ্বলছে, ওইটে আমাদের আশ্ৰম।

প্রহ্লাদ খুশি হয়ে বললো, ‘বাঃ, বেড়ে আশ্রমটি দেখছি। মাইকে গানও হচ্ছে নাকি ডাক্তারমামা?’ বুঝলাম, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো পাঁচ-বদ্যির আর এক নাম ডাক্তারমামা। যেরকম গম্ভীর দেখছি, ডাক্তার বলেই মনে হয়।

বললো, ‘হুঁ-হুঁ, এ যার তার কাজ নয়। দেখেশুনে এমন জায়গা করেছি, বুঝলে খুড়ি, মনে হবে নিজের ঘরে রয়েছি।’

খুড়ি হলো প্রহ্লাদের দিদিমা। বললো, ‘গুণের শরীর তোমার বাবা। তুমি না থাকলে আর আমার এ-যাত্রা আসা হত না। তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে বল?’ আপশোসের মধ্যে বোধ হয় প্রহ্লাদের প্রতি অভিযোগ প্রকাশ করলো দিদিমা।

কিন্তু তাতে প্রহ্লাদের কিছু যায় আসে বলে মনে হলো না।

বুড়ি হাঁপাচ্ছে অনেকক্ষণ থেকে। হাঁপাচ্ছে বোধ হয় প্রহ্লাদের পরিবারও। প্রহ্লাদের পরিবার কিন্তু জোর তেরো-চোদ্দর একটি বালিকা মাত্র। একে ক্লান্তি তায় শীত। বেচারির ঘোমটা খুলে গিয়েছে। প্রহ্লাদের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে চলেছে অন্ধের মতো টলতে টলতে।

পাঁচ-বদ্যি না ফিরেই জিজ্ঞেস করলো, ‘খুড়ি, ওই ছোঁড়াটা কে?’

ছোঁড়া? আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম। কই, কাউকে দেখতে পাচ্ছি না তো! দিদিমা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কী জানি, আমি তো জানিনে বাবা।’

আমাকেই বলছে নাকি? সর্বনাশ, প্রথমেই একেবারে ছোঁড়া! তা হলে যা আশ্রয় পাব, বুঝতেই পারছি।

পাঁচ-বদ্যি আমার দিকে ফিরে নীরস গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাওয়া হবে?’

বললাম, ‘কোথাও একটু আশ্রয়ের দরকার।’

ঠেলে-ওঠা কপালটা এগিয়ে নিয়ে এসে প্রায় ধমকে উঠলো, ‘তা আমাদের সঙ্গে কেন?’

অভ্যর্থনার বহর দেখে প্রায় থেমেই পড়লাম। বললাম, ‘থাকতে হবে তো! অন্তত আজকের রাতটার মতো—’

পাঁচ-বদ্যি তেমনি গলায় বলে উঠলো, ‘থাক, ও-সব চালাকি ঢের দেখেছি, এখন কেটে পড়।

নতুন জায়গা। নিয়মকানুন জানি নে। জানি নে এখানকার হালচাল। কিন্তু পাঁচ-বদ্যির ভাষায় কেটে পড়ে, নিজেকে খণ্ডিত করে যাব কোথায়!

একটু আশা নিয়ে তাকালাম প্রহ্লাদের দিকে। প্রহ্লাদ হেসে বললো, ‘দিব্যি আসছিলেন, বাধা পড়ে গেল। যান, কেটেই পড়ুন।’

এমনভাবে বললো, যেন কেটে পড়াটা তার কাছে কিছুই নয়। দিদিমার দিকে তাকালাম। দিদিমা আমার দিকে ফিরে অপ্রসন্ন গলায় বললো, ‘ঝাড়া হাত-পা নিয়ে তো ছুটে এসেছ, তা মাথা গোঁজবার ঠাই করতে পারো নি?’

সত্যি! ভগবানকে পাব বলে দিদিমার মতো পাগল হয়ে আসিনি। আসিনি পুণ্যসঞ্চয়ের কথা ভেবে। মাততে আসিনি তীর্থ নিয়ে। বৈষয়িক বুদ্ধি-বিবেচনা থাকা উচিত ছিল আমারই। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছে বিপরীত। কিছু বললে, উল্টো বিপত্তির লক্ষণ।

চেরা গলা মোলায়েম করে বললো দিদিমা, ‘পাঁচুগোপাল, বলছিলুম, দেশের ছেলে। তীর্থক্ষেত্রে কুকুর-বেড়ালকেও তাড়াতে নেই। ছেলেটাকে তাড়িয়ে দিবি?’

পাঁচু-বদ্যি বলে উঠলো, ‘ও-সব তুমি বুঝবে না খুড়ি। এর নাম কুম্ভমেলা, বুঝলে? মানুষ ঘুমিয়ে থাকলে মানুষসুদ্ধ চুরি যায়। রাত্রে যদি গ্যাঁড়াফাই করে ভাগে, তখন?’

কথাটা অপমানকর। কিন্তু প্রতিবাদ নিরর্থক। এদিকে এসে পড়েছি আশ্রমের কাছে। আশ্রম বলতে সুদীর্ঘ ঘেরাওয়ের মধ্যে দেবতার মঞ্চ, আর গোটা দশেক যাত্রীদের তাঁবু। মঞ্চের উপরে কয়েকজন গেরুয়াধারী গান করছেন মাইকের সামনে বসে। জটাজুটধারী ভস্ম-আচ্ছাদিত একজন সাধু বসে আছেন কাঠের সিংহাসনের উপর। কয়েকশো মেয়ে-পুরুষ বসে শুনছে গান।

ঢোকবার মুখে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে নমস্কার করলে দিদিমা। নমস্কার করে উঠে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। বললো, ‘পাঁচু, ছেলেটাকে নিয়ে নে। রাত করে যাবে কোথায়?’

‘যেখানে খুশি যাক, তোমার অত ভাবনা কীসের খুড়ি! এখানে ও থাকবে কোথায়?’

বলে সে এগিয়ে গেল। দিদিমা শণনুড়ি মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘এস, চলে এস। আমার যেন মরণ নেই, সব হয়েছে একতরো।’

পাঁচ-বদ্যির হুঙ্কারের কাছে এই চেরা-গলার আশ্বাস ও বিশ্বাস অনেক বেশি। কে ভেবেছিল, এলাহাবাদ স্টেশন-প্রাঙ্গণের সেই বুড়ি এমন মহীয়সী মূর্তিতে দেখা দেবে আমার কাছে! ইচ্ছে হলো তখুনি পায়ের ধুলো নিই। কিন্তু আবেগ বাগ মানাতে হলো।

কেন না এখন সংশয় দূর হয়নি।

এবার প্রহ্লাদও বলে উঠলো, ‘চলে আসুন না মোশাই, ডাক্তারমামা ওরকম বলেই থাকে। মাথা খারাপ কি না!’

জানি নে কার মাথা খারাপ। খানিকটা যেতেই পাঁচ-বদ্যি একজন সাধুকে নিয়ে এসে হাজির। মনে হলো বৈষ্ণব। নাকের উপর থেকে মাথা পর্যন্ত পুণ্ড্ররেখা টানা। ঘাড় অবধি চুল। পরনে গেরুয়া কাপড়। বোধ হয় এ আশ্রমের অধ্যক্ষ। আমাকে বললেন পরিষ্কার বাঙলায়। একলা পুরষের জন্য কোনো তাঁবু আমাদের নেই। আপনি সপরিবারে এলে আমরা ব্যবস্থা করতে পারতাম। এখানে সকলেই বউ-ঝি নিয়ে আছেন। আপনাকে তো আমরা থাকতে দিতে পারি নে।’

জানি নে কেমন কেমন করে বুড়ি-বুকে ঠাঁই পেয়ে গিয়েছিলাম। দিদিমা আশ্রমের মধ্যেই গলা চড়িয়ে বলে উঠলো, ‘পাঁচু, এ তোর বড় অন্যায় কিন্তু বাপু! ছেলেটা একলা কোথায় দেখলি তোরা? ও যদি কারুর বউ-ঝিকে উঁকি মেরে দেখতে চায়, তখন বলিস। এখন ও আমাদের তাঁবুতে আমাদের সঙ্গেই থাকবে। এতে যদি না হয়, তবে বলে দে, আমরাও পথ দেখি।’

পাঁচ-বদ্যির ভয়ংকর মুখটা অপ্রতিভ হয়ে উঠলো। সাধুও অবাক হয়েছিলেন। তারা দু’জন বিস্মিত হয়ে পরস্পর মুখ দেখাদেখি করলো। বিস্মিত আমিও কম হই নি। দিদিমা যে এতখানি এগুবে, তা আমিও জানতাম না।’

প্রহ্লাদ মাঝখান থেকে বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ বাবা, বলে দেও, তাহলে আমরাও কেটে পড়ি। দেখছ ছেলেটা আমাদের চেয়ে ভদ্রলোকের মতো দেখতে।’

সাধু বললেন দিদিমাকে, ‘না, আপনার সঙ্গে যদি থাকে, তবে আর আমাদের আপত্তি কী?’

তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি এদের সঙ্গে ব্যবস্থা করে নেবেন। আমি সাধারণ নিয়মের কথা বললাম মাত্ৰ।’

বলে তিনি চলে গেলেন। সকলেই চুপচাপ। পাঁচ-বদ্যি আমার দিকে একবার ক্রুদ্ধ চোখে দেখে দিদিমাকে বললো, ‘এসো, তোমাদের তাঁবু দেখিয়ে দিই।’

একটি তাঁবুর মাঝখান দিয়ে ভাগাভাগি করে এক-একটি পরিবারের আস্তানা করা হয়েছে। মাটির উপর বিছিয়ে দিয়েছে বিচুলি। ব্যবস্থা আছে ইলেকট্রিক আলোর। সত্যি, বাড়ির মতো ব্যবস্থাই বটে।

মনে মনে খুব সঙ্কুচিত হলেও দিদিমার সঙ্গে ঢুকে আগে ঝোলা-মুক্ত করলাম নিজেকে। তারপর ধপাস করে বসে পড়লাম বিচুলির গদিতে।

সকলেরই সেই অবস্থা। সকলেই বসে পড়েছে। কেবল পাঁচ-বদ্যি যাবার আগে বলে গেল, ‘ঘাট হয়েছে আমার তোমাদের আনা। আগে জানলে এ আপদ আমি আনতুম না। বাট, ইও ছোকরা—’

আমাকেই বলছে, তাকালাম তার দিকে। পাঁচ-বদ্যি একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করে বুক ঠুকে বললো, ‘মাই নেম ইজ ডক্টর পাঁচুগোপাল রায়। একটু এদিক ওদিক করবে তো, ঘাড়টি মটকে ছেড়ে দেব, মনে থাকে যেন। থাকো আজকের রাতটা, তারপরে তোমাকে কাল আমি দেখছি।’ বলে সে চলে গেল।

আমি বসেছিলাম একটি ভীত সন্ত্রস্ত বালকের মতো। সবই সময়ের ব্যাপার। পাঁচ-বদ্যিকে জবাব দেওয়ার সময় পাব একদিন। আপাতত আমি তার চোখের বিষ। সেই বিষ বুকে নিয়েছে দিদিমা।

তাকিয়ে দেখি, দিদিমা দিব্যি নাতবউ নিয়ে ঘর গোছাবার উদ্যোগ করছে। সে সব দেখার মন ছিল না। দিদিমাকে দেখে ভাবছিলাম একটা কথা। সেই কথা, রূপে তাকে চিনব না। ডুব দেব তার হৃদিসায়রে। রূপের পরে যে রূপ থাকে লুকিয়ে। মনের অন্ধকারে। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত দেহ। তবু চোখ ভরে জল এসে পড়ল। উঠতে চাইলাম। আড়ষ্ট হয়ে রইলো হাত-পা। বোধ হয় এই-ই দেখতে এসেছি। যা দেখতে এসেছি, তাই তো দেখছি নিজের অপমানের মধ্যে, অসহায়তার মধ্যে, আমার চোখের জলে।

একটু জলের জন্য হাঁপিয়ে উঠলাম। কোনোরকমে এলাম বাইরে বেরিয়ে। ঘুরে পেছন দিকে গিয়ে দেখি জলের কল রয়েছে। সেখানে ভিড় করেছে মেয়ে-পুরুষ। বাসন মাজছে, হাতপা ধুচ্ছে।

কে বলছে, ‘বিনু, তরকারিটা পোড়ারমুখী পুড়িয়ে ফেলেছিস।’ কে হেসে উঠলো খিলখিল করে বোধ হয় বিনুই। কে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘নেও নেও, বাসনকোসন নিয়ে সর বাপু, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না।’

পাশের তাবুতেই নারীকণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি, ‘অনিলের শ্বশুরের কথা বলছ তো? সে মিনসে নাকি মস্ত চাকরি করে। ওই গোমরেই তো অনিলের বউ অত বাপ সোহাগী!’ হঠাৎ আমার মনে হলো যেন বাঙলার কোনো মফস্বল শহরের এঁদো গলির বস্তি অঞ্চলে ঢুকে পড়েছি। সন্ধেবেলার বস্তি। চারদিকে কলকোলাহল, ঝগড়া, গান, ফুটকাটা, সাংসারিক প্যাচাল। তারই মাঝে জলের ছড়ছড়, বাসনের ধাতুর খনখন শব্দ।

ভুলে গেলাম তীর্থক্ষেত্র। দাঁড়িয়ে আছি বাঙলাদেশের কোনো এক পাড়ায়। মনটা তাজা হয়ে উঠলো। তাজা হয়ে উঠলো আরও জল দেখে। উঃ, যেন কতদিন গায়ে দিই নি। থাক শীত, তবু গায়ে জল না দিয়ে বাঁচব না।

আর থাক পাঁচ-বদ্যি। কে জানে, রূপে তাকে চিনলাম না। মনের মাঝের অন্ধকারে তার রূপ আরও কত ভয়ংকর, সেটুকু না দেখে গেলেও সে-দেখা আমার পূর্ণ হবে না।

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নিচু হয়ে আবার ঢুকলাম তাঁবুর মধ্যে।

তাঁবুতে এসে তাড়াতাড়ি ঝোলা হাতড়ে বের করলাম সাবান আর গামছা। আগে দেহটি আবর্জনামুক্ত করি, তারপরে অন্য কথা।

কিন্তু বেরুতে আর পারলাম না। দিদিমা বুড়ির চেরাবাঁশের গলা আচমকা তাঁবু কাঁপিয়ে খরখর করে উঠলো, ‘ওমাঃ! একি মেলেচ্ছ কাণ্ড গো বাবা!’

কাকে বলছে! ওরে বাবা, তাকিয়ে দেখি, শ্বেত-পিঙ্গল শণনুড়ি উঁচিয়ে বুড়ি কুঞ্চিত অগ্নিকটাক্ষ আমার দিকেই হানছে। শরীর আমার শুধু সিঁটিয়েই গেল না, আবার একটি কেলেঙ্কারির লজ্জায় ও ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কী হয়েছে?’

‘কী হয়েছে?’বলে দিদিমা আবার গলা চড়াল। অর্থাৎ যা আমি সবচেয়ে ভয় পাচ্ছিলাম। বললো, ‘প্যান্ট পরে ইঞ্জিসন না হয় নিয়ে এলে। নইলে যমে ছাড়বে না। কিন্তু দেবতার থানে সাবাং মাখতে যাচ্ছ কী বলে! তীর্থক্ষেত্ত তেল সাবাং-এ অপবিত্তর হয়, তাও জানো না বাছা?’

জানা ছিল না এত বড় কথা। প্রতিবাদও নিরর্থক। কে জানতো যে তেল সাবানে দেবতার মাহাত্মও ধুয়ে যেতে পারে!

কিন্তু মানুষ চেনার বড়াই আর এ জীবনে করবো না। কয়েক মুহূর্ত আগে যার পায়ে হাত দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য উন্মুখ হয়েছিলাম, এখন তার কাছ থেকে পালাতে পারলে বাঁচি। স্নেহ ভালবাসা, রাগ ও বিরাগ, এই উভয় ভাব প্রকাশের মধ্যে কি এদের ভাবেরও তারতম্য ঘটে না? অনেক মানুষেরই ঘটে না। সে উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। কিন্তু নিজে বড় একটা সে বিষয়ে ভুক্তভোগী নই। তাই মন বড় সহজেই দমে যায়।

ইচ্ছা থাকলেও এখান থেকে আর পালাবার উপায় নেই। এইটুকুই তো আমার পরম ভাগ্য যে, বুড়ির চেঁচানি শুনে ডাক্তার পাঁচুগোপাল রায় তার ভয়ংকর মূর্তি নিয়ে আসেনি ছুটে।

বিশ্রামের আরামে প্রহ্লাদের রসভরাট গলা গদগদ হয়ে উঠেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জানলি দিমা, ছেলেটা একেবারে ভদ্দরলোক।’

দিদিমা বললো, ‘তাই না বটে!’

সেইটাই অপরাধ। সাবান রেখে গামছা নিয়েই বেরিয়ে গেলাম। গায়ে জল লাগিয়ে আর ফিরে আসতে পরি নি। দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার যোগাড়। উঃ বড় ভুল করেছি। এ যে কম্প দিয়ে জ্বর আসার মতো। ম্যালেরিয়ার সর্বনাশা কাঁপুনির মতো হূৎপিণ্ড ছরকুটে যারে দেখছি। উত্তরপ্রদেশের শীত না ব্যক্ত করতে পারি, বাঙলাদেশের জল-হাওয়ায়, এই ম্যালেরিয়া-প্রুফ ক্ষীণ দেহের অভিজ্ঞতাটুকু জাহির করতে পারি খুব। মাসের পর মাস ঘড়ি না দেখে সময় বলে দিতে পারি জ্বর আসার ক্ষণটি লক্ষ করে। এ অভিজ্ঞতা কম নাকি! বেশ বড়-সড় একটি পিলেযুক্ত নিটোল পেট আর কাঠি-কাঠি হাত-পা নেড়ে, ভাসা-ভাসা টানা-টানা চোখে বাঙলার জল-আকাশের দিকে তাকিয়ে তবু আমরা দিব্যি কবিত্ব করি, ‘আয় লো আয় রাই বিনোদিনী, রসের হাটে কালো মানিক করবো বিকিকিনি।’হাড়কাঁপুনিকে বলি, ওদিকে থাক। দোষ ধরো না ভাই। পিলের গৌরব করছি নে। ওই রূপ দেখেও তো শুনেছি, ‘বাইরী বাঙালিনী নাকি, নিশি নিশি গুঞ্জরে।’

মধুর মধুর রসরাজ
মধুর বৃন্দাবন মাঝ।

থাক, রসিকতা আর পোষায় না। উত্তরপ্রদেশের হাওয়া পারে নি, জল যে একেবারে কাবু করে দিল। কোনোরকমে কাঁপতে কাঁপতে তাঁবুতে এসে মনটা একেবারে ভরে উঠলো। বাঃ! প্রহ্লাদের ক্যাটকেটে দিদিমা দেখছি টার্কি মুরগীর মতো বহুরূপিণী। আমার ধারণা ছিল, ওটা তরুণীদের একচেটিয়া। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো! দিব্যি দেখছি, আমার ঝোলা উজাড় করে বিচুলির উপর পাতা হয়েছে কম্বল। ঝোলা শিয়রে রেখে হয়েছে বালিশ। গায়ের কম্বলটিও ভাঁজ করা হয়েছে পায়ের দিকে। এবার শুয়ে পড়ার ওয়াস্তা।

যাক, আর কিছু চাই নে। দেখেই মন গরম হয়ে উঠেছে। শরীর গরম হতে আর কতক্ষণ! তাড়াতাড়ি গা-হাত-পা মুছে গায়ে দিলাম ওভারকোট। সেটি গায়ে নিয়েই বিচুলির ওপর কম্বল শয্যায় অঙ্গ পেতে টেনে নিলাম আর একটি কম্বল।

কিন্তু এতক্ষণ প্রহ্লাদ সপরিবারে, আর্থাৎ দিদিমা সহ আমার দিকে তাকিয়েছিল বিস্ফারিত চোখে। তারপরেই বুড়ির শ্লেষ্মা-জড়িত গলার হাসি তো নয়, হাসির হিক্কা। কিন্তু এও যে সম্ভব, তা জানতাম না। বুড়ি বললো, ‘বলি ও ভালো মানুষের ছেলে, সাবাং তো মাখতে যাচ্ছিলে, তোমার আবার এত ছুঁচিবাই কীসের বাপু?’

বললাম, ‘কিসের ছুঁচিবাই?’

‘এই যে গায়ে জল ঢেলে এলে। বারো জেতের ছোঁয়া নিয়ে আমরাও এসেছি, কিন্তু এই শীতে কি আমরা জল ঢালতে গেছি?’

এখন সত্য বলে বোঝানো নিরর্থক যে ছুঁচিবাই নয়, পরিষ্কার হওয়ার জন্যই জল ঢেলেছি। হয়তো বিশ্বাসই করবে না। তবু এমনি অবিশ্বাস ভালো। কিন্তু চেঁচামেচি যেন না হয়। কিছু না বলে শুধু হাসলাম। দিদিমা আবার বললো, ‘দেখো বাপু, শেষে নিমুনি বাধিয়ে বোসো না। ওসব ঝক্কি পোয়াতে পারবো না।’

কী দরকার পারবার! রাত পোহালে যাদের রেহাই দেব, তাদের ভাবনার প্রয়োজন নেই। ওদিকে খাবার বন্দোবস্তও হচ্ছে বলে মনে হয়। রান্না করা তো এখন আর সম্ভব নয়। চিঁড়েমুড়কি বেরুচ্ছে টিনের পাত্র থেকে। অস্বস্তি ঘিরে ধরল আমাকে। অন্তত খাওয়ার সময়টাও বাইরে থাকতে পারলে হতো। শুয়ে পড়েছি যে!

আবার দিদিমার গলা, ‘নেও দু’টো চিবিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়।’

এরা না জানুক, নিজে তো জানি, চিবোবার স্পৃহা এখন আমার একটুও নেই। গতকাল সকালে বিছানা ছেড়েছিলাম। পথের ধকল কাটিয়ে এবার গা পেতেছি। এই বিশ্রামের ভোগ এখন খাওয়ার চেয়ে বড় ভোগ। কিন্তু পরিস্থিতি আমার এ সত্য ভাষণের মর্যাদা দেবে না।

কথা না বাড়িয়ে, যতটা পারলাম, চিবিয়েই শুতে হলো। এখনো এ আশ্রমের মাইকে দেবমাহাত্ম্য অলোচিত হচ্ছে। সারা কুম্ভমেলা জুড়েই এখনো কলকোলাহল চলছে পুরোদমে। শুধু আমি রয়েছি যেন অনেক দূরে। শুনতে পাচ্ছি আশপাশের তাঁবুগুলিতে বিচিত্র গুঞ্জন। কিন্তু সবই অস্পষ্ট। এটুকু না থাকলে হয়তো গাঢ় ঘুমের আলিঙ্গনে অচেতন হয়ে পড়তাম। অমনি অর্ধচেতন অবস্থায় আমার কানে এলো এক ভাঙা-ভাঙা অর্ধস্ফুট একটি গলার গুঞ্জন—

শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন
যশোদা রাখিল নাম যাদু-বাছাধন।।

দিদিমার গলা। বোধ হয় তন্দ্রাচ্ছন্ন গলা। আমার কানের শিরাগুলি চকিত মুহূর্তে একেবারে জেগে উঠলো। তারপর কানের পর্দা থেকে একটা বিচিত্র শিহরণ আমার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত করে তুলল।

কৃষ্ণের শতনাম। কোনোদিন জীবনে মুখস্থ হয় নি। মহিমাও কিছু বুঝিনে ও নামের। কিন্তু ভাঙা জড়িত গলার এই বিচিত্র সুর, আমার শৈশবের নিদ্রাহীন চোখের উদ্ভট স্বপ্নের, আমার দুষ্টামির, আমার বিশ্বজোড়া কৌতূহলের সমাপ্তি এনে দিত। আমার শিশুরক্তের শিরায় শিরায় ঘুমের মায়া হয়ে থাকত লুকিয়ে। না-ছোঁয়া থাকলেও সর্বাঙ্গ ভরে থাকত, জড়িয়ে থাকত আমার মায়ের আলিঙ্গন, এমনি ছিল রাত্রের ঘুমে, ভোরের জাগরণে। যে সুরে ঘুম আসত, আবার সেই সুরেই একটু একটু করে খুলে যেত চোখের পাতা।

তারপর জীবনের স্রোতে আমি ভেসে গিয়েছি একটি বৃন্তহীন ফুলের মতো। যৌবন এসেছে অসহ্য বেদনা ও সংগ্রামের ডাক নিয়ে। পায়ের তলার মাটি বাঁচাতে কবে হারিয়ে গিয়েছে সেই সুর। মায়ের রূপ ধরেছে এই কঠিন পৃথিবী।

কিন্তু সেই হারানো সুর যে আমার এই দীর্ঘ জীবনের রক্ত-প্রবাহে অজান্তে অনুসরণ করছে, তা জানতাম না। সমস্ত কোলাহল স্তিমিত হয়ে এলো। গাঢ় নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লাম আমি। তখনো একটু একটু কানে আসছে—

কালোসোনা নাম রাখে রাধা বিনোদিনী
কুব্‌জা রাখিল নাম…

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। খসখস শব্দ হচ্ছে ঠিক কানের কাছেই। কত রাত হবে, কে জানে! শুয়েছিলাম বাইরের পর্দার সামনে। প্রথমটা চোখ মেলতে পারলাম না। পর্দার তলা দিয়ে তীক্ষ্ণ ছুঁচের মতো এসে বিঁধছে কনকনে হাওয়া। কাঁটা দিয়ে উঠছে গায়ের মধ্যে। মনে হলো সর্বাঙ্গ ভিজে গিয়েছে। রক্ত জমে গিয়েছে হাত পায়ের। বিচুলি-শয্যা বরফের মতো ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে। দূরাগত মেঘগর্জনের মতো গুড়গুড় করে উঠলো বুকের মধ্যে।

বোধ হয়, এই ভয়ানক শীতেই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে। মেলা নিস্তব্ধ। কোলাহল নেই। হঠাৎ দু-একটা সংক্ষিপ্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে দূর থেকে। আচমকা শোনা যাচ্ছে স্খলিত ঘণ্টাধ্বনি। আবার নীরবতা। কেবল কানের কাছে খসখস।

চোখ মেললাম। চোখ মেলেই চমকে উঠলাম। পর্দার কাছেই একজোড়া বুট। তাঁবুর মধ্যে আলো জ্বলছে। একটু একটু করে বুট বেয়ে বেয়ে দৃষ্টি তুললাম। বুটের উপরেই মোটা, খাকি প্যান্ট। হাঁটুর উপর থেকে ভারী কালো কম্বল।

সর্বনাশ! ফ্রাঙ্কেস্টাইন ছবির মনস্টার! পাঁচ বদ্যি! ভয়ংকর মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডক্টর পাঁচুগোপাল। টের পায় নি যে, আমি জেগে আছি। হাতের আড়ালে আমার চোখের কোলে ছায়া। দেখলাম, ডক্টর পাঁচুগোপাল ঠিক যেন রাত-প্রহরীর মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছে চারদিক। কী দেখছে কে জানে! কিন্তু একটা বুট যদি চাপিয়ে দেয় গলার উপর!

কয়েকটি রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত কাটল বুকের ধুকধুক তালে। তারপর কানে এলো চাপা চিৎকার, ‘শালা, নো জায়গা নট কিচ্ছু। চলো বাহার।’

পরমুহূর্তেই পর্দাটা তুলে বেরিয়ে গেল সে। আর-এক ঝলক কুচো বরফ কে ছুঁড়ে মারল আমার গায়ে। কোনোরকমে হজম করলাম ঠাণ্ডা চাবুকের কষাঘাত।

কিন্তু ডক্টর কেন এই শীতনিশীথে জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে! ‘নো জায়গা নট কিচ্ছু’র’ বাঙলা মানে তো তাই বোঝায়। বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা। ঘুম আর এলো না। অনেকক্ষণ পড়ে রইলাম। চব্বিশ ঘণ্টার ক্লান্তিতে এখনো চোখ জুড়ে আসারই কথা। কিন্তু আশ্চর্য! এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আর কিছুতেই আসছে না। অনেক সময় অতিরিক্ত ক্লান্তিতে দেহতন্ত্রী যেন টানটান হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে মনটিও। এই হঠাৎ ঘুম-ভাঙা মনেও আমার কোনো শৈথিল্য নেই। সেখানে অনেক তাড়া, অনেক কৌতূহল। মন যেন ছেঁড়া পালের টুকরো ফালির মতো থরথর করে কাঁপছে। হয়তো এর কোন অর্থ নেই, আশা নেই। তবু মন মানে না। মানে নি বলেই তো এসেছি ছুটে। হোক উদ্ভট, অদ্ভুত, অবাক কাণ্ড। তবু আর শুয়ে থাকতে পারি নে। উঠে পড়লাম। উঠে দেখি, প্রহ্লাদকে মাঝখানে রেখে একপাশে তার পরিবার আর-একপাশে দিদিমা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। এই ঘুম দেখে হঠাৎ বোঝার উপায় নেই, এরা এসেছে ঘর ছেড়ে দূরে। এসেছে তীর্থ করতে।

বাইরে বেরিয়ে এলাম ওভারকোটের বোতাম এঁটে। কিন্তু এসে কয়েক মুহূর্ত চলৎশক্তি রহিত হয়ে গেল। মনে হলো, মনের আশা মনে নিয়ে ঢুকে পড়ি তাঁবুর মধ্যে। শুনেছি, ইওরোপ শীতপ্রধান দেশ। সেখানকার শীতে জল জমে বরফ হয়। পথে ঘাটে উঠোনে ছাদে বরফ। লোকে পথে বেরুতে ভয় পায়। কিন্তু আমার বাঙালি হাড় যে উত্তরপ্রদেশের গঙ্গার পাড়েই জমে যাওয়ার দাখিল।

পকেটে ছিল মাফলার। বার করে জড়ালাম মাথায়। জুতো মোজা পরেই শুয়েছিলাম। সুতরাং দরকার থাকলেও শীত আটকাবার আর কোনো উপায় ছিল না।

আশ্রমের বাইরের আলোগুলি নেভানো। মঞ্চের পেছনেই অস্থায়ী মন্দির হয়েছে মাটির দাওয়ার উপরে, গোলপাতার বেড়া ও মন্দিরের ঝাঁপ বন্ধ। মঞ্চের উপরে ও নিচে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পুঁটলির মতো দেখাচ্ছে আপাদমস্তক মুড়ি-দেওয়া ঘুমন্ত কতকগুলি মানুষকে। মনে হলো না কেউ জেগে আছে।

আশ্রমের প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। শিশির ভেজা বালি খসখস করছে। চলার সঙ্গে সঙ্গে খসখস শব্দ করে। আটকে যাচ্ছে পা। রাশি রাশি ভেজা বালি জুতোর মধ্যে মোজাসুদ্ধ পা সিক্ত করে তুলছে। অন্ধকারে চিকচিক করে উঠছে বালির বুকে অভ্রকুচি।

পশ্চিমদিকে মুখ করে চলছিলাম। ওপারে অস্পষ্ট এলাহাবাদ দুর্গপ্রাকার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। দুর্গের মাথায় পতাকাটিও লক্ষ করা যায় একটা গাছের ফাঁক দিয়ে। নজরে পড়ে না শুধু সতর্ক প্রহরী।

সম্ভবত কিছুক্ষণ পূর্বেই চাদ ঢলে পড়েছে দুর্গের আড়ালে। তাই পশ্চিমের আকাশে কিঞ্চিৎ আলোর আভাস। কিংবা এলাহাবাদ শহরের আলোকমালার হালকা আভাস মাত্ৰ।

লক্ষ মানুষের মেলা এখন নিঃশব্দ। এই নিঃশব্দের মধ্যে মিশে গিয়েছে ঝিঁঝির ডাক, আমার পদশব্দের খসখসানি। নিয়ত ধাবিত গঙ্গার কলকল ধ্বনি এই নিঃশব্দ রাত্রির সঙ্গীত প্রবাহের মতো চলেছে ভেসে। যেন অদৃশ্যে বসে কোন এক নিঃশব্দের সঙ্গীতবিলাসী নিয়ত জলের বুকে ঢেলে চলেছে ধাতব বস্তু।

সন্ধ্যার সেই আলোর ছড়াছড়ি নেই। এখানে সেখানে দু-একটা আলো জ্বলছে। দিগন্ত জুড়ে তাঁবুগুলি দেখাচ্ছে যেন সমুদ্রসৈকতে নিশ্চল নীরব অসংখ্য পাখির মতো। যেন ধূসর বর্ণের পাখা মেলে বসে রয়েছে বাদুড়ের দল।

আবার সেই স্খলিত ঘণ্টাধ্বনি। কানের কাছেই শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ালাম। দেখলাম, কয়েক হাত দূরেই একটা হাতি বাঁধা রয়েছে। সুরের মাঝে ডুবে গিয়ে মানুষ যেমন করে দোলে, হাতিটা তেমনি দুলছে সামনে পেছনে। তারই তালে তালে বাজছে ঘণ্টা।

অদূরেই কিছু পোড়া কাঠ থেকে একটু একটু ধোঁয়া উঠছে। আগুন জ্বালা হয়েছিল, নিভে গিয়েছে। সেই অগ্নিকুণ্ডের গা ঘেঁষেই বালির উপর কয়েকজন শুয়ে আছে আপাদমস্তক ঢেকে। ভাবাও দুস্কর, এই ভয়াবহ শীতের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলে কেমন করে মানুষ শুয়ে আছে।

দূরে দূরে কোথাও দু-একটি প্রজ্বলিত আগুনের শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেই আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে আগুনের চেয়েও পুঞ্জীভূত ধোঁয়ারাশি।

আচমকা কান ফাটানো দুম-দুম ঝমঝম শব্দে চমকে উঠলাম। উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, গঙ্গার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে রেলওয়ে ব্রীজ। ট্রেন চলেছে তার উপর দিয়ে। মনে হলো, জমাট নৈঃশব্দ্য ভেঙে সেই ঝমঝম শব্দ ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। এখুনি জেগে উঠবে মানুষের মেলা।

কিন্তু ট্রেনের বিলীয়মান শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বালুচর একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। ট্রেন দেখবার জন্যই দাঁড়িয়েছিলাম। এই গাঢ় নিস্তব্ধতার মধ্যে একটি ভাঙা ভাঙা গলা শুনতে পেলাম। যেন কাকে কী বলছে। এই তাঁবু সমুদ্রের মধ্যেই কোথাও কেউ কথা বলছে। কিন্তু কোথায়? মানুষ তো দেখতে পাই নে।

একটু কৌতূহল হলো। কান পাতলাম। কথাগুলি হিন্দি ভাষায় বলছে। কী বলছে? আর একটু এগিয়ে আবার থমকালাম। কথা তো নয়, কে যেন কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘বহুত বহুত পাপ কিয়া ভগবান! হে ঈশ্বর, আমার অর্থ নাও, আমার সোনা নাও, আমার খাওয়া নাও, আমাকে বিবস্ত্র কর, আমার সব নিয়ে, আমাকে মৃত্যু দাও। আমার এই পাপের প্রাণ আমি তোমার পায়ে দিচ্ছি। গ্রহণ করে তুমি আমাকে মুক্তি দাও।’

আমার হাত-পা একেবারে নিশ্চল হয়ে গেল। অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে আমি কার পাপের স্বীকারোক্তি শুনছি! মৃত্যুকামনা শুনছি কার? আমি কোথায় এসেছি, যেখানে মানুষ অসংকোচে প্রকাশ করছে তার পাপ! নিবেদন করছে প্রাণ!

ভুলে গেলাম, আমি এক সভ্য দেশের সৃষ্টি ও কৃষ্টি ভরা নগরের নাগরিক। আমি যেন হাজার বছরের অতীতে এসেছি, ফিরে। কোন্ অদৃশ্য থেকে আমাকে দু’হাতে আলিঙ্গন করলো এই বালুচরের নিশি! নিশি পাওয়া অন্ধ ও বোবার মতো আমি চারিদিকে হাতড়ে ফিরতে লাগলাম।

ওই যে দূরের অগ্নিকুণ্ড ও ধোঁয়া, হয়তো ভরদ্বাজ মুনির যজ্ঞের কাঠ পুড়ছে ওইখানেই। দিনের পর দিন শত শত মানুষ প্রয়াগে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে প্রাণনাশ করছে! প্রাণনাশের এই ভয়াবহ মহাপুণ্যলীলা আজ ঘিরে ধরল আমাকে। অনেক মানুষ, অনেক মানুষের ছায়া চারিদিক থেকে ঘিরে আসছে আমাকে। ভারতের এক বিস্মৃত যুগের ছায়ারা ভিড় করছে আমার চারপাশে। ওভারকোট পরা একটি ক্ষীণ মানুষরূপী জীবের দিকে তারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, এ কোন্ দেশের মানুষ! গঙ্গাতীরে তাদের শত শত বছরের এই নির্জন বিচরণক্ষেত্রে রাত্রি নিশীথে এ কোন্ রক্তমাংসের জীব! অনেক পরিবর্তন তারা দিনের পর দিন লক্ষ করেছে। যে অক্ষয়বট গাছের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে ভগবানের কাছে তারা প্রাণ দান করেছে, তাদের সেই অক্ষয়বট অসঙ্কোচে কেটে দিয়েছেন আকবর বাদশা। গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমে দাঁড়িয়ে তারা দল বেঁধে সবাই সেই নিষ্ঠুর কাজ দেখেছে। তারপরও শত শত বছর ধরে তারা দেখে আসছে, মরজগতের লক্ষ লক্ষ নর-নারীকে, তাদের সেই অক্ষয়বটের স্মৃতিচিহ্নে মাথা ঠুকতে। দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে তারা। সে হাসি কেউ শুনতে পায় না। গঙ্গা ও যমুনার তলে চাপা পড়ে থাকে সেই হাসি। বিদ্রূপে বেঁকে উঠেছে তাদের চোখ, যখন দেখছে মরজগতের মানুষগুলি বেঁচে থাকতে কত ভালোবাসে। পাপকে গোপন করতে তাদের কত আয়াস। মুদ্রা নিক্ষেপ করে কত সহজে সে ঈশ্বরের কৃপালাভ করতে চাইছে। তারা দেখছে, তাদের অক্ষয়বটের পরিবর্তে একটা অন্য বটের ডাল দেখিয়ে পাণ্ডা পয়সা নিচ্ছে মানুষের কাছ থেকে।

তারা ফিসফিস করে কথা বলেছে আর হাওয়ার গায়ে ভেসে বেড়িয়েছে। কেউ জানে না, কিন্তু তারা জানে প্রয়াগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভারতের কী ইতিহাস লুকিয়ে আছে।

কিন্তু তাদের এই অবাধ মুক্ত বিচরণ সময়ে এ কোন্ জীব! গঙ্গার কোল থেকে একে একে তারা সকলে উঠে এসেছে। তারা কেউ হাজার বছরের, কেউ পাঁচশো বছরের, কেউ দুশো বছরের।

আমি কথা বলতে গেলাম। কিন্তু আমার কথা হারিয়ে গিয়েছে। তারা পরস্পরের গা টিপে হাসছে। আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমাকে। তারপর, তাদেরই সমবেত কণ্ঠের হাসির মতো আমার কানে এসে বাজল গঙ্গার কলকল ধ্বনি।

তাকিয়ে দেখলাম, আমার পায়ের কাছে জল। গঙ্গার তীরে এসে পড়েছি। দূর গঙ্গার বঙ্কিম স্রোতে হঠাৎ কারা হেসে উঠছে নিঃশব্দে। বাঁকা স্রোতের আলোর ঝিলিকে হেসে হেসে আবার সেই হাসি হারিয়ে যাচ্ছে স্রোতেরই বুকে। ছায়ারা সব গুপ্ত শত্রুর মতো চোখের সামনে অতলে ডুব দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

কে যেন গান করছে। নারীকণ্ঠের গান। নিশি-পাওয়া মন ভেসে গেল আর এক দিকে। বেহালার চাপা সুরের মতো মিষ্টি গলা অকস্মাৎ এক নতুন স্বপ্নজাল বিছিয়ে দিল বালুচরে।

না, গান তো নয়। সুর করে আবৃত্তি করছে,

চিরং নিবাসং ন সমীক্ষতে যো
ত্যুদারচিত্তঃ প্রদদাতি চ ক্রমাৎ।
কল্পিতার্থাংশ্চ দদাতি পুংসঃ
স তীর্থ রাজো জয়তি প্রয়াগঃ।

কণ্ঠ লক্ষ করে কয়েক পা অগ্রসর হয়েই থামলাম। দেখলাম, গঙ্গার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে একটি নারী। মনে হলো, শাড়ি পরে আছে। আলুলায়িত কেশরাশি ছড়িয়ে পড়েছে তার পিঠ জুড়ে। দূরের অস্থায়ী ভাসন্ত পুলের সামান্য আলোর রেশ এসে পড়েছে তার মুখে। সে আলো সামান্য। তার মুখাবয়বটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাতে। তার সু-উচ্চ নাক, কম্পিত ঠোঁট, নিস্পলক চোখের ঘনপল্লব।

কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখলাম, আপাদমস্তক আবৃত একজন পুরুষ এসে দাঁড়ালো তার পাশে। সেও কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আবৃত্তি করতে লাগলো প্রয়াগস্তোত্র।

আরও খানিকক্ষণ পরে আর একটি মেয়ে এলো, একটি বালকের হাত ধরে। আগে যাকে দেখেছিলাম, তার চেয়ে এর বয়স কম মনে হলো। পুষ্ট যৌবনের চিহ্ন তার সর্বাঙ্গে বঙ্কিম রেখায় উদ্ভাসিত। মুখে তার হাসির আভাস। বালকের সঙ্গে সেও আবৃত্তিতে যোগ দিল।

তাদের নিচু ও চাপা গলার মিশ্রিত আবৃত্তির সুর একাত্ম হয়ে গেল গঙ্গার কলকল ধ্বনিতে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে তারা সকলে চললো দক্ষিণে সঙ্গমের দিকে।

আমি সেই দিকেই এগুলাম। যত সময় যাচ্ছে, উত্তুরে হাওয়া তত যেন ক্ষেপে উঠছে। ওদের মিলিত গলা থেকে ঝাপটা মারছে আমার কানের পর্দায়।

মানুষের দেখা পেয়ে আমিও অনেকখানি যেন নিশিমুক্ত হয়ে উঠেছি আবার, চারিদিক পরিষ্কার হয়ে উঠেছে আমার কাছে।

হঠাৎ মনে হলো, কে যেন আমার পেছনে আসছে! তাকিয়ে দেখলাম। মনে হলো, একটা মূর্তি সরে গেল তাঁবুর অন্ধকার কোলে। হয়তো কোনো মানুষ বেরিয়েছে পথে। বেরুক। সামনে ফিরে আমি ওই চারজনের পিছে পিছে আবার চললাম।

এখনো কত রাত্রি অনুমান করতে পারি নে। কেল্লার পেছনের আকাশ ক্রমে গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। পূর্বাকাশের কোলে দূর ঝুসির পাহাড়ের মতো উঁচু ভূমির অস্পষ্ট রেখা ফুটছে ধীরে ধীরে। বিশাল নিকষ কালো পটে কোন এক অদৃশ্য শিল্পী যন্ত্র দিয়ে খুঁটিয়ে ফুটিয়ে তুলছে নতুন দৃশ্য।

মন্থর গতিতে আমার আগে আগে চলেছে তারা চারজন-দু’টি নারী, একটি বয়স্ক পুরুষ, বালক একটি। তারা মিলিত কণ্ঠে সুর করে আবৃত্তি করে চলেছে প্রয়াগমাহাত্ম্য। চাপা সুর, আবৃত্তিও মন্থর তাদের চলার মতো। সুস্পষ্ট সংস্কৃত উচ্চারণ। এই দারুণ শীতে একটুও বিকৃত শোনাচ্ছে না তাদের গলা।

আমি দূরে থেকে, চলেছি তাদের পেছনে পেছনে। কেন চলেছি, তার সঠিক অর্থ জানি নে। জানি কিঞ্চিৎ প্রয়াগের ইতিহাস। মাহাত্ম জানি নে তার অলৌকিক কীর্তির। আসা মাত্র গণ্ডুষে ভরা গঙ্গাজল নিয়ে দিই নি মাথায়। রাশি রাশি ধুলো ছড়িয়ে দিই নি নিজের গায়ে। তবুও চলেছি তাদের পেছনে পেছনে।

নিশির দলে নিশি পেয়েছে আমাকে। সুরে আমাকে ডাক দিয়েছে। ইতিহাস কথা বলছে। আমার কানে কানে। আমি মন্ত্র বুঝি নে প্রয়াগের। বুঝি নে পুজো।

শ্রাবণ মাসে বাঙলার গাঁয়ের গৃহস্থ মেয়ে-বউরা পুজো করে ‘ঢালা প্যালা’। পুজো করে মাটি ও বনপালার। তার অর্থ বুঝি, হে ধরিত্রী, তুমি উর্বর হও। তোমার প্রতিটি মাটির টুকরো ভরে উঠুক সবুজ শস্যে। আমার পুজো নিয়ে তুমি তৃপ্ত হও, তুমি সিক্ত হও, আমি জীবনভর তোমার সেবা করব।

এই আদিম সংস্কারের মধ্যে দেখি মানুষের বাঁচার অভিযান। নবান্ন উৎসবে শুনি জীবনের জয়গান। ফসলের গুণকীর্তন।

কিন্তু এই বালুচর! ভারতীয় প্রাচীন ইতিহাসের লীলাভূমি। ধর্মীয় ইতিহাসের স্মৃতিভূমি। কিন্তু কেউ এখানে ডুব দেয় না সেই স্মৃতিসাগরে। সন্ধান করে না জ্ঞানের জনপদ ও তার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এই বালুচরের গুণকীর্তন তাহলে কেন বুঝি নে? মানুষের রূপে মুগ্ধ হই। অলৌকিকের অনুভূতিই নেই মনে। কী করে বুঝব!

তবুও আমি মোহপাশে আবদ্ধ হয়েছি। মোহ নয়, মুগ্ধ প্রাণ নিয়ে চলেছি আমি। এই মৌন রাত্রি, আলো-আঁধারিতে ওই নারী ও পুরুষ, আর কী বিচিত্র তাদের মিলিত গলার হারমনি। এই সঙ্গীতে নেই যন্ত্রসঙ্গত। যন্ত্র হয়ে উঠেছে তাদের বিভিন্ন গলার সুর। এই সুরের অঙ্গে সুর মিলিয়েছে নিয়তবাহী গঙ্গা।

ক্রমে শেষ হয়ে এলো তাঁবুর সারি। যেন পিছনে ফেলে এলাম লোকালয়। এবার বালু আর বালু। বালুপ্রান্তর! জুতাসুদ্ধ পায়ের পাতা ডুবে যাচ্ছে গভীর বালুতে। মনে হলো, অনেক দূরে ফেলে এসেছি কুম্ভমেলা। হারিয়ে গিয়েছে বালুর উপর আঁকাবাঁকা পথের দিশা। বালুর নিচে কোথাও ভেজা মাটির ইশারা। জেগে উঠেছে টুকরো ঘাসবন। জলো ঘাস। আবার বলু।

হাওয়ায় নুয়ে পড়েছে ঘাসের মাথা। ক্রমে হাওয়া দুরন্ত হয়ে উঠেছে। পবন উন্মাদ হয়েছে। শিস দিয়ে চলেছে কানের কাছে। আর কানে ভেসে আসছে ওই সুর। সুর চড়ছে। বেহালার চাপা সুর হয়ে পড়েছে মুক্ত ও ব্যাপ্ত। তারে টান পড়েছে। উচ্চতর গ্রামে মিশেছে হাওয়ায়।

বয়স্ক পুরুষটির কম্বল উড়ছে ফরফর করে। মেয়ে দু’টির আলুলায়িত কেশপাশ শূন্যে আছাড় খাচ্ছে হাওয়ার দমকে।

হাওয়া নয়, নিষ্ঠুর চাবুক। আমার হাত আর পা ফেটে পড়তে চাইছে টনটনানিতে। শিউরে শিউরে উঠছে পায়ের মধ্যে।

একটু পরেই গতি মন্দ হলো সামনের চারজনের। সামনেই ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে বালুচর। ছিল প্রায় বিশ-ত্রিশ হাত দূরে। বুঝতে পারলাম না কতটা নিচু। নীচেও খানিকটা সমতল চর। তারপর দূর-আলোকের অস্পষ্ট রেখায় চকচক করছে জল।

তারা চারজন নেমে গেল নিচের সমতলে। আমি দূরেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারা চারজনও দাঁড়িয়েছে। এবার স্তিমিত হয়ে এসেছে গলার স্বর। যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি ও চাপা গুনগুনানি।

কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো দু’দল। চর বাঁদিকে বাঁক নিয়ে সরে গিয়েছে। কম্বলধারী চলে গেল সেই দিকে। বুঝতে পারলাম না, ওদিকটা আরও নিচু কিনা। কিন্তু তাকে আর দেখা গেল না। তারপরে একটি নারী গেল। সেও হারিয়ে গেল অন্ধকারে। বালকটিকে নিয়ে রইলো আর একজন নারী। কিন্তু আর দাঁড়ালো না। বালকটি এই ভয়াবহ শীতে জামাকাপড় খুলে এগিয়ে গেল জলের দিকে।

শিশু বালকের এই দুঃসহ পীড়নে হৃদয় বিস্মিত ব্যথায় চমকিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই, নতুন দৃশ্যে আমার সর্ব চেতনা আড়ষ্ট হয়ে গেল। দেখলাম, সেই মেয়েটিও বিবস্ত্রা হয়েছে। এত শীতেও কোনো তাড়া নেই। সবই মন্থরভাবে চলছে। বিবস্ত্রা হয়ে দাঁড়ালো কয়েক মুহূর্ত।

একেবারে স্পষ্ট নয়, কিন্তু অস্পষ্ট নয়। আমার সভ্যতাগর্বী মন থমকে গেল। নিজেকে আড়াল করার কিছু নেই এখানে। চোখের পাতা একবার চকিতে আনত হয়েও মনের পাতা উঠলো অবাধ্য হয়ে। কোনো পাপ তো করি নি। পালাব কেন।

কিন্তু সে-ও কি আমাকে দেখতে পায় নি! মুক্ত আকাশের তলে, দারুণ হিমেল হাওয়া মুখরিত চরে, মনে আমার অস্পষ্ট ভয় ঘিরে এলো।

শূন্যে-ওড়া কালনাগিনীর মতো তার উড়ন্ত দীর্ঘ কেশরাশি, তার বলিষ্ঠ দেহের সুস্পষ্ট রেখা, তার চাপা গুনগুনানি, সব মিলিয়ে পৃথিবীর চেহারা বদলে গেল আমার চোখের সামনে।

সে নেমে গেল জলের দিকে। চাপা পড়ে গেল গুনগুনানি। কিন্তু আমি তেমনি আড়ষ্ট, স্তম্ভিত। তাকিয়ে দেখি, চারদিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। আলো, এত আলো এলো কোথা থেকে! পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলাম। ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, পূর্বের প্রতিষ্ঠানপুরের আকাশের কোল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। দূর পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে দেখি, কালো অথচ তীব্র আলোকময়ী জলের স্রোতরেখা ছুটে আসছে আমার দিকে। আসতে আসতে আচমকা বাঁক নিয়ে চলে যাচ্ছে এই প্রাক্-ঊষা মুহূর্তে গঙ্গার অস্পষ্ট হিম-বিদ্ধ মুক্তাধবল তরঙ্গের গায়ে গায়ে। এই মুহূর্তে নীল যমুনার রঙ হয়েছে নিকষ কালো। তার দূর পশ্চিমে ঝাপসা রেলওয়ে সেতু। উত্তর কোলে জলের বুক থেকেই উঠেছে দুর্গের পাথুরে ইমারত। কী হাওয়া! প্রাণনাশী ঠাণ্ডা হাওয়ায় যমুনার উত্তর তীরের উঁচু গাছের মাথা দুলছে। যেন ঝাঁপ দিতে চাইছে যমুনায়! ব্যাকুল হাওয়ায় শনশন, যেন কোন অদৃশ্যচারিণীর ব্যাকুল গুনগুনানির মতো আসছে ভেসে। আর মুরারিকায় কালী যমুনার বাঁকা স্রোতে ঝলকিত বাঁকা হাসি। সে হাসি গোপনে হেসে ভেসে চলেছে দূরে। কিছুক্ষণ পরেই আবার গঙ্গার কোল থেকে ভেসে এলো সেই কণ্ঠের বাঁশির সুরঃ

দেবি সুরেশ্বরি ভগবতী গঙ্গে
ত্রিভুবনতারিণী তরল তরঙ্গে।

গঙ্গার অদৃশ্য কোল থেকে উঠে এলো সেই বালক! সে কাঁপছে থরথর করে। দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার ফাঁক দিয়ে এবার বিকৃত শোনাচ্ছে তার উচ্চারণ। শুকনো কাপড় থাবা মেরে তুলে নিল সে গায়ের উপর। বালকের পেছনেই উঠে এলো সে। সর্বচরাচরের মতো সে আরও সুস্পষ্ট। সম্মুখ তার পূর্বদিকে। ঊষার সিন্দুরকণা ছড়িয়ে পড়েছে তার সর্বাঙ্গে। ভেজা চুলের রাশি এলিয়ে পড়েছে তার ঘাড়ে দু’পাশ দিয়ে। তার শরীর অকম্পিত নয়, কাঁপুনি রয়েছে তার গলার স্বরে।

চোখ ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। নিলামও তাই। ধার্মিকের ভক্তি নেই। চোখে আছে কিঞ্চিৎ নিতান্ত মানুষিক মোহের অঞ্জন। এসেছি যেন বানের জলে ভেসে যাব বলে। ডুব দেব বলে। কিন্তু সত্তা তো পেছন ছাড়েনি। নিজেকে ভুলি কেমন করে!

তবু, আমার নগরসভ্য চোখ দেখেছে অনেক ছবি। বিদেশী শিল্পীদের অসংখ্য ভেনাস, মনের মানসী, নগ্ন নাগরী। দেখেছে দেশি শিল্পীর আঁকা হৃদয়মাধুরী মেশানো নগ্ন-বিচিত্রার ছবি। তা ছাড়াও এ সভ্য চোখ বিষে আচ্ছন্ন দেশের দিগন্তজোড়া দেওয়ালের ছবি দেখে সেলুলয়েডের বুকে বীভৎস নগ্নতা দেখে।

কিন্তু এই নগ্নতা! ওই আকাশের মতো, এই চরের মতো, ওই গঙ্গা ও যমুনার মতো দ্বিধামুক্ত নগ্নতা। নগ্নতা পরিবেশ-অন্ধ। নগ্নতা কী ভয়ংকর অথচ কী অপরূপ!

বুঝি পথ ভুল করেছি! কিন্তু ভুল করে এসেছি কোন যুগে! ভারতের কোন্ বিগত শতাব্দীতে! বিষের ধোঁয়া নিয়ে এসেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েছিলাম সেই বিষের ফোঁটা কপালে নিয়ে। যখন থেকে দেখতে শিখেছি, দেখেছি বিষ ক্ষতে ভরা দেশ। নিরন্নর মিছিল, অবিশ্বাস, ভয়, নিষ্ঠুরতা আর হাহাকার।

তবু আরও দেখি দেখি করে ছুটে এলাম। কিন্তু কোন্ যুগের হাত ধরে এসে এ ছবি এলো আমার চোখের সামনে। এও দেশেরই রূপ। বাছ-বিচারের কী ধার ধারি! যা ভাবতে পারি নি, তাই দেখলাম। তাই তো দেখবো। ঘুরে-ফিরে এ নিজেকেই দেখা। না দেখলে চিনব কী করে? বিস্ময় আর সন্দেহ? তার নিরসন তো পরে।

এবার তারা মিলেছে আবার চারজন। বস্ত্রে আবৃত করেছে নিজেদের। গঙ্গাস্তোত্র শেষ করে নতুন সুরে আবৃত্তি ধরেছে :

প্রাতঃ স্মরামি ভবভীতিমহাতিশান্ত্যৈ
নারায়ণং গরুড়বাহনমজনাভম…

আবৃত্তি করতে করতে এগিয়ে আসছে তারা। নিশ্বাসের তালে তালে যেন ফুটছে দিনের আলো। পুরুষটিকে দেখেই ভড়কে গেলাম। এ যে একমাথা রুক্ষ চুল! আর বিরাট গুঁফো পুরুষ। চোখও বেশ লালবর্ণ। লজ্জা যে ছিল না মনে, তা নয়, কিন্তু এ যে ভয় ধরিয়ে দিল। ধমকালে যাব কোথায়! তা ছাড়া কুম্ভমেলা সম্পর্কে নানান কথা শুনে একটা শিউরোনি ছিল মনের মধ্যে।

কাছাকাছি এসে বয়স্ক পুরুষটি আমার দিকে বারকয়েক দেখলো। সন্দিগ্ধ ও সপ্রশ্ন দৃষ্টি। গলায় তার রুদ্রাক্ষের মালা লোমশ বুক ভরে ছড়িয়ে পড়েছে। ডানায় ও মণিবন্ধে রুদ্রাক্ষের মণিবন্ধনী। কানের ছিদ্রে পরানো রয়েছে রুদ্রাক্ষের কুণ্ডল।

তার পেছনে মেয়েদেরও তাই। মনে হলো, দু’জনেই যুবতী। তাদেরও রুদ্রাক্ষের অলংকার রয়েছে গায়ে। ছেলেটিরও তাই। কিন্তু দেখবার অবসর ছিল না।

আমার কাছে দাঁড়িয়ে যেন অবাক বিস্ময়ে ঘাড় বাঁকিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করলো পুরুষটি। অবিশ্বাস্য হাসি ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখের ভাঁজে ভাঁজে। সঙ্কোচের হাসি। মোটা গলায় জিজ্ঞেস করলো, একেবারে ঠেট হিন্দিতে, ‘আপনি কি সেপাই নন?’

আমি? কোন্ দুঃখে? তাই ভেবেছে বুঝি লোকটি? ওভারকোটটার গুণ আছে দেখছি। বললাম, ‘না তো!’

সে তার বড় বড় দাঁতগুলি বের করে বললো, ‘মহারাজ, আমি ভেবেছিলাম আপনি সেপাই। নমস্কার মহারাজ, নমস্কার। সন্ন্যাসীকে কিছু দান করুন।’

কী ভেবেছিলাম, কী হলো। এ যে দান চায়! কিন্তু নারী-শিশু পরিবৃত, এ আবার কোন রকমের সন্ন্যাসী, তা তো বুঝলাম না! বললাম, ‘তু-আপ-আপনি সন্ন্যাসী?

সে হা-হা করে হেসে উঠলো। বাবা! এ যে অট্টহাসি। মনে হয়, মেয়েরা ও শিশুটি মনে মনে মন্ত্ৰ আবৃত্তি করছে।

সে হেসে বললে, ‘জী মহারাজ, আমি সন্ন্যাসী। অবধূত আমি।’

অবধূত! কথাটি শুনেছি জীবনে কয়েকবার কিন্তু অর্থ জানি নে। তবু অবধূতের সঙ্গে এরা কারা? জিজ্ঞেস করলাম, ‘সন্ন্যাসীজী, অবধূত কাকে বলে বুঝলাম না তো।’

সন্ন্যাসী হেসে পিছন দিকে তাকাল। আমিও সেদিকেই দেখলাম। মেয়েদের মধ্যে যে বালকের হাত ধরে ছিল, সে মাথা নিচু করে হাসছিল। সলজ্জ মিষ্টি হাসি তার মুখে। কুণ্ঠাজনিত লজ্জা। তার বয়স আমার মনে হলো সতেরো-আঠারোর ঊর্ধ্বে নয়। আর একজন, সেও হাসছিল। তার লজ্জা নেই। সে তাকিয়ে ছিল অকুণ্ঠ হাসি নিয়ে। তার বয়স অনুমান করতে পারি নে। সে কিঞ্চিৎ খাটো, কিন্তু বলিষ্ঠ শরীর। একটু স্থূলতার লক্ষণও আছে। আর একজনের চেয়ে তার বয়স কিছু বেশিই মনে হয়। ছেলেটি নিতান্ত শিশু। বোধ হয় আট-নয় বছরের বেশি নয়। তার কাঁপুনি, তার মন্ত্র, বিস্ময়, সব মিলিয়ে সে একটি নিপীড়িত বেচারি মাত্র।

রুদ্রাক্ষ খুলে নিয়ে কাপড় পরিয়ে দিলে এরা যে গৃহস্থের বউ আর ছেলে হয়ে উঠবে এখনি। ওই হাসি-উচ্ছলিত মুখের উপরে ঘোমটা টেনে দিলে, এ মুখের পরিচয় যে বদলে। যাবে মুহূর্তে। সন্ন্যাসী বললো, ‘মহারাজ, আমার তো এখন সময় নেই। অবধূতের অনেক কথা। চলতে চলতে দু’কথায় কিছু বলতে পরি।’

কৌতূহল দুর্নিবার। পেট থেকে পড়েই শিশু অন্ধকারে চেয়ে দেখে অবাক চোখে দেখে দুর্বোধ মনের কৌতূহল নিয়ে, কুতকুতে চোখ বিস্ফারিত করে।

ছাড়ব কেন! শুনেই নিই, কী বলে। তাদের সঙ্গে আবার চললাম উত্তর দিকে।

ইতিমধ্যে মেলা জেগে উঠেছে। কলকোলাহল শুরু হচ্ছে আস্তে আস্তে। এর মধ্যেই কোনো কোনো আশ্রমের মাইকে গীতাপাঠ ও প্রাতঃস্তোত্র আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।

সন্ন্যাসী বললো, ‘এক কথায় অবধূত কাকে বলে জানেন? সন্ন্যাসীকেই অবধূত বলে। শৈব উদাসীনকেই বলে অবধূত। তার মধ্যে আছে রকমফের। সকলের তো একরকম নয়। কেউ হংসাবধূত, কেউ ব্রহ্মাবধৃত। কিন্তু ওসবে কিছু যায় আসে না। ওসবে বিলকুল ‘গণ্ডগোল আছে। আসলে দুই দল, মহারাজ। ভগবান মহাদেবের আপনি কটা রূপ দেখতে পান?’ বলে সে আমার দিকে সপ্রশ্ন হাসি নিয়ে তাকাল।

আমি? আমি তো কিছু জানি না। বললাম, ‘আপনিই বলুন।’

সন্ন্যাসী আবার আচমকা হা-হা করে হেসে উঠলো। বললো, ‘যখন তিনি ঘরে যান, তখন তিনি গৃহী। যখন তিনি বাইরে যান, তিনি উদাসীন। আমিও গৃহাবধূত। আমি ঘরে থাকতে পারি, আমি বাইরেও যেতে পারি। আমি কৌপীন আঁটতে পারি, ইচ্ছা করলে নাও আঁটতে পারি। যে-কোন আওরতকে আমি আমার সঙ্গিনী করতে পারি। আওরত মহাদেবী। মহারাজ, আমার মতো অবধূত সিদ্ধিলাভে শিবত্ব প্রাপ্ত হয়।’

হবে হয়তো। কিন্তু গৃহাবধূতের মতো এমন বিচিত্র কথা আর কখনো শুনি নি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরা আপনার কারা?’

সন্ন্যাসী কিঞ্চিৎ বয়স্কাকে দেখিয়ে বললো, ‘আমার অবধুতানী। আমার জেনানা। আর ওই আমার লেড়কি আর লেড়কা। ওদের দীক্ষা হয় নি। হবে।’

আমার মাথায় সব জগাখিচুড়ি পাকিয়ে গেল। দেখলাম, লেড়কি নিতান্ত গৃহস্থ লজ্জাবতী বালিকার মতো হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু বালক বেচারি বোধ হয় স্তোত্র ভুলে গেছে। সে আমাকেই দেখছে হাঁ করে। আর অবধূতানী যে একজন খাঁটি মা, তা বোঝা যাচ্ছে তার স্নেহমুগ্ধ চোখ দু’টি দেখে। কোথাও তো এদের সন্ন্যাসের ছাপ দেখি নে!

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার কি দান নিয়েই দিন চলে?’

সন্ন্যাসী বললো, ‘সাধুকে দান করবার লোক কোথায়, মহারাজ! আমার ঘর আছে। আছে কিছু ক্ষেতি-বাড়ি। তাইতেই দিন চলে যায়। এখন তীর্থ করতে এসেছি। ভিক্ষামাত্র সার।’

ক্ষেতি-বাড়ির কথা শুনে অবাক হলাম। বললাম, ‘কিন্তু এই ভোর রাত্রে তো কোন সাধুকে স্নান করতে দেখলান না!

সন্ন্যাসী আবার হেসে উঠলো, ‘দেখেন নি, কিন্তু অনেকেই করেছে। সব জিনিস কি দেখা যায়? শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী, এরই নাম মাঘব্রত, কল্পবাসীর অবশ্য কর্তব্য।’

‘বুঝলাম না।’

‘বুঝলেন না? মকর সংক্রান্তি থেকে গঙ্গাচরে বাস করতে হয়। থাকতে হয় উপোস করে। শুনতে হয় ধর্মের কথা। শোনাতে হয়, আপনা সাধন করতে হয়। আর ব্রাহ্মমুহূর্তে নগ্ন হয়ে নাইতে হয়। তবে পরম ব্রত্ম তুষ্ট হন।’

পরমব্রত্নকে তুষ্ট করবার জন্য এই ভয়াবহ শীতে স্নান! অবধূতানীর কথা বাদ দিই। কিন্তু ওই যুবতী আর বালক, ওরা কেমন করে দ্বিধামুক্ত ভাবে নগ্ন হয়ে স্নান করে! আবার আমি তাকাতে আরক্তিম হয়ে উঠলো অবধূতের মেয়ের মুখ। সে এক ভাবী অবধূতানী, কিন্তু গৃহকন্যার চারিত্রিক অলংকার ভরে রয়েছে তার আপাদমস্তকে। তার আলুলায়িত কেশের আড়াল দিয়ে ঢেকেছে সে তার মুখ ও বুক। সামনে যে তার পরপুরুষ!

আমার মনে হলো, সন্ন্যাসী অবধূত হোক, আর গৃহাবধূতই হোক, আমি দেখছি, সে পরম ধার্মিক সদাহাস্যময়, প্রেমিকা স্ত্রীর স্বামী, আদুরে ছেলেমেয়ের বাবা।

এখন আর আমার এগুনো সম্ভব নয়। আবার তাঁবুর সারি আরম্ভ হয়েছে। লোকালয়ে এসে পড়েছি। সামনেই তাঁবুর পায়খানা সারবন্দী। ফিনাইল আর ব্লিচিং পাউডারের হাল্কা গন্ধ লাগছে।

পকেটে হাত দিয়ে ব্যাগ বার করলাম। অবধূতানীর চোখে এবার কৃতজ্ঞতার চড়া হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠলো। বালকটি অপলক বিস্ময়ে দেখছিল আমার পয়সার ব্যাগ। আর কুমারী তার এলোচুলের আড়ালে আড়চোখে দেখছিল, আমি কী করি।

সন্ন্যসীকে পয়সা দিয়ে বললাম, ‘আমার ক্ষমতা কিছু নেই। এই সামান্য…’

সন্ন্যাসী তাড়াতাড়ি জিভ কেটে বিস্ফারিত চোখে বাধা দিল আমাকে, ‘খবরদার মহারাজ, ওকথাটি বলবেন না। আপনার যা কৃপা, সেই ভাগবানের কৃপা। এই কৃপা ভিক্ষা করে বেড়াব আমি সারাদিন। মহারাজ, আজকে নেয়ে উঠে আপনাকে দর্শন করেছি। একদিন সে এমনি করেই হয়তো আমার সামনে দিয়ে চলে গিয়েছে, কিংবা যাবে। কিন্তু আমি তো কোনোদিন জানাতেও চাইব না! কৃপাভিক্ষাই আমার ভিক্ষা।’

সন্ন্যাসীর হাসিমুখ গম্ভীর হয়ে উঠলো। লাল চোখ চিন্তামগ্ন। ঠিক চিন্তামগ্ন নয়, যেন পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে উঠলো।

বললাম, ‘চলি তাহলে।’

সন্ন্যাসী বললো, ‘মহারাজ, আপনি কোথায় যাবেন?’

আশ্রমের নাম বললাম। সে বললো, ‘তুলসীমার্গের পথ জানেন আপনি?’

তুলসীমার্গ? ভাবলাম, হয়তো মেলার বাইরে কোথাও। বললাম, ‘না তো।’

সে বললো, ‘দু নম্বর পুলের রাস্তা দিয়ে পুবে গেলে নির্বাণী আশ্রম। সেই পুবের রাস্তাই তুলসীমার্গের পথ। সেই পথে গেলে পাবেন ১০৮ শঙ্করাচার্যের আশ্রম। ওই আশ্রমের পেছনে আমার পাতার ঘর। সন্ধ্যাবেলা আপনি আসবেন সেখানে। কৃপা করে আসবেন।’

হঠাৎ কেন তার এই ব্যাকুলতা, বুঝতে পারলাম না। আমার মতো নিতান্ত ধর্মবিমুখ আর বস্তুবাদী মানুষের সঙ্গে তার কী কথা হবে! বললাম, ‘সময় পেলে যাব।’

‘আচ্ছা, মহারাজ, আপ-কা কৃপা।’

বলে তারা সদলবলে এগিয়ে গেল। অবধূতানী বিদায়-নমস্কার জানালো ঘাড় বাঁকিয়ে হেসে। বালকটি দাঁড়িয়েই ছিল আমার দিকে তাকিয়ে। দিদি টের পেয়ে, পেছন ফিরে নিঃশব্দে হেসে উঠলো। হাসিমুখে তাড়াতাড়ি এসে ভাইয়ের হাত ধরে নিয়ে চলে গেল।

বিদায় দিয়েও দাঁড়িয়ে ছিলাম। গৃহাবধূত। তার পিতৃত্ব, তার স্বামীত্ব, তার ঘর ও সংসার এই নিয়ে যদি তার সব সুন্দর হয়ে ওঠে, তবে উঠুক। আজ তার বাইরে তার প্রতি আমার শুভেচ্ছা আর কী থাকতে পারে।

তাঁবু-লাইনের এপাশ-ওপাশ দিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে গেল ওরা চারজন। হারাল না মন থাকে। মানুষী মোহের অঞ্জনটুকু একটি অপরূপ রঙের ছোপ লাগিয়ে রেখেছে মনের মধ্যে। সেই সঙ্গে কিছু বিস্ময়, একটু সংশয়।

ভাবলাম, কোটা সত্য! একদিকে অপরিসীম উদাসীনতা, আর একদিকে সীমাহীন লজ্জা। যেন নিরালায় লজ্জাবতী লতাটির মতো। ডাঁটোসাঁটো লতাটি, দিব্যি চিকন পাতা মেলে সর্বাঙ্গ উদাস করে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। ছোঁয়ামাত্র মুখ ঢেকে মিশে যায় মাটির বুকে। কিন্তু লতা নয়, মানবী যে! সে সন্ন্যাসী-বালা, ঘরে-বাইরে, জীবনে-মরণে নারী আমাদের সঙ্গিনী। নানা বেশে নানান্ সম্পর্কে পরস্পরের অসঙ্গতি চোখে লাগে। বৈচিত্র্যে কৌতূহলী হয়। দুঃখে জানাই সমবেদনা, সুখে দিই সঙ্গ। মনের চারপাশে খাড়া রয়েছে সমাজের প্রাচীর। তাই ভাবি। তাই ভাবলাম। ঘর ছেড়ে চলে এসেছি পথে। ‘কোনো বাঁধন রাখবো না গো’ গেয়ে গেয়ে পথে বেড়ালেও মন মাঝে মাঝে থমকায় বৈকি! সেটুকুনই তো বাঁচোয়া। নইলে আকাশ বাতাস সবই যে একাকার হয়ে যেত। ফুল জল পাতা পাখি—সবই ভিন্ন ভিন্ন বেশে ভিন্ন অনুভূতি জাগায়। গানে আর সুরে আনে বৈচিত্র্য। নইলে চোখ থেকেও কানা। মন থেকেও পাথর।

তাই ভাবি, যে মেয়ে লজ্জায় লজ্জাবতী, সে মেয়েই অকুণ্ঠ উদাসীনতায় প্রকৃতির মতো নগ্ন। কোনটা সত্য?

রূপ দেখে বোঝা যায় না। বোঝা যায় না হাত দিয়ে স্পর্শ করলে। মন দিয়ে ছুঁতে হবে। জানি নে কোথায় নির্বাণী আশ্রম, আর কোথায় তুলসীমার্গের পথ। বালুচরের কোন সীমানায় আছে অবধূতের পর্ণকুটির। তবু দেখার দেখা নয়, দেখার মত করে দেখতে চাই নইলে দেখা সাঙ্গ হয় না। সে হোক ভারতের গৌরব কিংবা হোক কলঙ্ক।

পূর্ব দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সোনালী রোদ। রোদ তো নয়, মৃতের প্রাণসঞ্জীবনী। শীতার্তের ব্যথিত আড়ষ্ট দেহে উ উত্তাপের আলিঙ্গন। কী মিষ্টি, কী সুন্দর, কত আরাম! দু’দিন যাক, আবার এই রোদকেই আড়াল করে গাল দেব মনে মনে। এই-ই নিয়ম।

রোদ উঠেছে। ঝুসির সুদীর্ঘ ছায়া পড়েছে বালুচরের বেলায়। তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে নরনারী। মাইলের পর মাইল জুড়ে গুনগুনানি উঠেছে, নিত্যনৈমিত্তিক কোলাহলে স্নানের জন্য চলেছে সবাই জলের দিকে। একদিকে মাইক-যন্ত্রের যান্ত্রিক চিৎকার মুখরিত হয়ে উঠেছে। আর আশেপাশে দেখছি স্নানার্থী অর্ধনগ্ন সাধুরা চলেছে স্তোত্র আওড়াতে আওড়াতে। কখনো কর্ণবিদারী শব্দ উঠছে, ‘জয় মহাদেও কি জয়’, ‘রাম রাম, সীতারাম’। দূর থেকে ভেসে আসছে অনেক কাড়া-নাকাড়ার আওয়াজ, তার সঙ্গে স্তিমিত শিঙাধ্বনি। জাগছে মেলা। আর দাঁড়াতে পারি নে। আবার তো ফিরে যেতে হবে সেই দিদিমা আর পেল্লাদদের তাঁবুতে। তার চেয়ে খুঁজে নিই আশ্রয়।

কিন্তু কোন দিকে যাই! কোন্ দিকে যাই ভেবে পিছন ফিরতেই দেখি, আপাদমস্তক কম্বলে ঢাকা পাঁচ-বদ্যি। আমার পিছনেই যেন গুপ্ত আততায়ী। কী সাংঘাতিক! পাঁচ-বদ্যি তো নয়, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বইয়ের সেই দৈত্য। কিন্তু কেন, কী করেছি, কারোর বাড়া ভাতে তো ছাই দিই নি! তবে এমন বাঘের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে রয়েছে কেন সে! না, বাঘের পেছনে ফেউ বলি কী করে! শিকারের পেছনে বাঘ। রাত না পোহাতে এ কি বিভ্রাট! মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবু কথা না বলাটা বিসদৃশ দেখায়। হেসেই বললাম, ‘ডাক্তারবাবু যে!’

ডাক্তার মুখিয়ে ছিল। বলামাত্র মাথা থেকে কম্বলটা খুলে ফেললো সে। পরিস্ফুট হয়ে উঠলো তার ভয়ংকর মুখটা। যেন কোমর বাঁধছে। কীসের যে এত রাগ, তা জানি নে। প্রায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ‘ডাক্তার নয়, ধন্বন্তরি। রোগের ওষুধ জানি।’

সে তো ভালো কথা। কিন্তু কী কথার কী জবাব! পৃথিবীতে একরকমের মানুষ আছে, ভালো বলে মন্দ বলো, তাদের মন পাওয়া দায়। এগুলে ভেড়ের ভেড়ের, পেছু নিব্বংশের বাটা! ছেলেবেলায় দেখেছি, পাড়ার মোড়ে থাকত একটা ছেলে। নাম বেচা। ছেলে নয়, প্রায় মিনসে। বেচা ছিল এমনই এক মানুষ। তার কিছুই করি নি কোনদিন। কিন্তু তার সামনে পড়লেই চোখ কুঁচকে তাকাত খপিসের মতো। আর প্রাণভরে কষাত গাঁট্টা ঘুষি চড়। একেবারে অকারণে। বাড়ি থেকে বেরুনো এক আতঙ্কের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাউকে বলতেও বাধতো। খালি মা কালীকে ডাকতাম, ‘হে মা কালী, হয় বেচাদের ও-বাড়ি থেকে উঠিয়ে অন্য পাড়ায় নিয়ে যাও, না-হয় ওর হাত দু’টো দাও ভেঙে।’

এই পাঁচ-বদ্যি যেন তেমনি। আমার ছেলেবেলার বেচা। কিন্তু সেই ছেলেবেলার রাজ্যে আমরাই ছিলাম আমাদের নবাব-বাদশা খলিফার দল। দুর্বল হলে বহু আজগুবি সন্ধিসূত্রে বশ্যতা স্বীকার করতেই হতো।

কিন্তু এখানেও কি সেই! ডানা মেলে উড়ে এলাম পায়রাটির মতো, ওদিকে বাজপাখি ঠোঁট শানাচ্ছে। তবু বললাম, ‘কোথায় চললেন?

ডাক্তার এক পর্দা গলা চড়াল, ‘যেখানেই চলি, তোমাকে চোখে চোখে রাখছি ঠিক। হ্যাঁ।’

আমিও একটু উম্মাতেই বললাম, ‘কেন বলুন তো?’

‘আমার খুশি।’ বলে, ডাক্তার বুক চাপড়াতেই গাদাখানেক ধুলো ঝরে পড়লো তার কম্বল থেকে। আর গলা কী—একেবারে বাজখাঁই! রাগও যেমন হলো, লজ্জাও হলো তেমনি। আশেপাশে লোক। সবাই কৌতূহলী হয়ে দেখছে হাঁ করে।

থামাতে গেলাম। কে শোনে! ডাক্তার ঠিক তেমনি গলায় বলে চললো, ‘মনে করেছে, আমি তোমাকে বেরুতে দেখি নি? রাত করে কেন ক্যাম্প থেকে বেরিয়েছ? কথা নেই, বার্তা নেই, বেরুলেই হলো?’

চেষ্টা করে গলা চড়াতে পারি নে। বললাম, ‘কেন, বেরুনো কি নিষেধ?

‘চোপ! চোপরাও! বলেছিলাম না, তোমাকে দেখে নেব। আই অ্যাম ডক্টর পাঁচুগোপাল রায়।’

তা ঠিকই, কিন্তু এ অপমানের কারণ কী? কারণ কী খ্যাপামির? দেখে নেওয়ার ব্যাপার হলে দেখতে হবে। তা কি এমন করে? স্বভাবতই কৌতূহলী লোক দু-একজন জমেছে আশেপাশে। মেলার ব্যাপার। কে রোধ করবে! হায় রে, এ কোন অমৃতকুম্ভের সন্ধানে ছুটে এলাম! বললাম, ‘ডাক্তার নয়, ধন্বন্তরিই। কী দেখবেন, দেখুন। অত চেঁচাচ্ছেন কেন?’

‘আলবাত চেঁচাব।’ বাঙলায় যাকে বলে তড়পানি, ডাক্তার সেরকম শুরু করলো। তারপর যা হয়। একজন সাধুবেশী মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করলো ডাক্তারকেই, ‘ক্যায়া হুয়া বাবা?’

যা বলো, সবই আগুনে ঘি। সাধুকে তেড়ে গেল, ‘যো হয় সো হুয়া, তুমকো কেয়া? তুম্ আপনা রাস্তা দেখো।’

সাধুর বৈরাগ্যের মিষ্টি হাসি চকিতে উধাও। বেচারা মুখ গোমড়া করে চুপ করে গেল। ডাক্তার আমার মুখের সামনে তর্জনী নেড়ে আবার বললো, ‘আবার আমাকে ঠাট্টা করা হচ্ছে ধন্বন্তরি বলে?

‘কেন আপনিই তো—’

কে শোনে! কোথায় আগুন লেগেছে না জানলে জল ঢালবে কোথায়! ডাক্তার প্রায় লাফিয়ে ওঠে আর কি! ‘জানো, আমি তোমার বাপের বয়সী?’

তাতে আর আশ্চর্যের কী! বললাম, ‘তা তো দেখছিই। তা আমাকে কেন? বাপের বয়সী আছেন, ঘরে গিয়ে নিজের ছেলেকে শাসন করুন।’

‘কেন, আমার কি ছেলেমেয়ে থাকতে নেই?’

কথার কী অদ্ভুত অসঙ্গতি! ডাক্তারের কোয়ালিটি ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। শেষটায় কি একটা বদ্ধ পাগলের হাতে পড়লাম? বললাম, ‘থাকবে না কেন? একশোটা থাকতে পারে।’

‘একশোটা?’

‘না হয় দুশোটাই?’

‘তার মানে, আমার কিছু নেই? আমাকে আঁটকুড়ো বললি তুই?’

একেবারে ‘তুই’! ট্রেনের ভিড়ে একবার মোষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম বিপদে পড়ে। এও প্রায় তেমনি বিপদ। উদ্ধার পেতে হলে পালটা রূপ ধরতে হবে। উপায় নেই। রুখে-মুখে চড়া গলায় ডাক্তারকে শেষবারের জন্য সাবধান করতে গেলাম।

কিন্তু কাকে বলবো! ডাক্তার ততক্ষণে কম্বলটি বগলদাবা করে হাঁটা ধরেছে। হাঁটছে খ্যাপা মোষের মতোই। পদাঘাতে বালু ছিটকে যাচ্ছে। খানিকটা গিয়ে আবার দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে সেখান থেকেই বললো, ‘আমি আঁটকুড়ো? আচ্ছা, দেখে নেব তোকে, দাঁড়া।’

বলে আবার চলতে আরম্ভ করলো। কোথা থেকে কী হয়ে গেল যেন! ঝড় বয়ে গেল একটা। ছিলাম সুস্থ, করে গেল উদ্ব্যস্ত। এতই আকস্মিক ব্যাপার, এমনিই অদ্ভুত যে, তার না বুঝলাম অর্থ, না কারণ। হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এ যে উন্মাদ!

কে জানতো! কে জানতো, পথে বেরিয়ে এমন মানুষের হাতে পড়বো। ভেবেছিলাম, দু’চোখ ভরে দেখবো। বাজবো আপন মনে, তাল দিয়ে যাব নিজেরই সুর। এ-যে তাল আর সুর, সব ছরকুটে যায়।

তবে হ্যাঁ, বেরিয়েছি, একটা কথা ভাবি নি তো! প্রকৃতির ঘরের কোন্ রূপসী আমার জন্য সাজিয়ে রাখবে শুধু নির্মেঘ আকাশ, ফোটা ফুল আর সুকণ্ঠী বিহঙ্গী! তার বিচিত্র দেহ জুড়ে নেই গুমসোনি গুমোট? ঝড়-ঝঞ্ঝা, দুর্যোগের ঘনঘটা? তবে? পথের দশাই এমনি।

কত রূপ! কিন্তু কই, কালকেও তো ডাক্তারকে এতখানি গণ্ডগোলে মানুষ মনে হয়নি। কিছুটা মনে হয়েছিল, কিন্তু একেবারে এত অসঙ্গত ঠেকে নি। আর, একি শুধু আমার কাছে? এই পাগলামি, খ্যাপামি, এ অসঙ্গতি?

অসঙ্গতি। মনে পড়লো, রাত্রে নিঃসাড়ে ডাক্তারের তাঁবুতে প্রবেশ। জায়গার অভাবে চলে যাওয়া। তারপরে এত কথা। তার শেষের কথাগুলি। শেষের কথাগুলিতে শুধু রাগ নয়। চোখ তার যন্ত্রণায় লাল হয়ে উঠেছিল যে! এই অসঙ্গতির মধ্যে কোথায় একটু সঙ্গতি রয়েছে। বেসুরের মধ্যে সুর। ডাক্তার চলে গেল না, যেন পালাল। পালাল যেন অসহায়ের মতো।

মন ফিরে গেল আমার। যা বলো, তাই বলো। লজ্জা-ঘেন্না-ভয়, তিন থাকতে নয়। উৎসুক হয়ে তাকালাম ডাক্তারের পথের দিকে। ওই যে দেখা যায় এখনো। মস্ত লম্বা মানুষ। ছোট হয়ে আসছে। চলেছে গঙ্গার ধার দিয়ে, উত্তরে। ভুল করেছি। ছেড়ে দেব না, ধরবো ডাক্তারকে।

কী আমার কপাল। পাশে জড়ো হয়েছে সব অবাঙালি মেয়ে-পুরুষ। গুলতানি করছে নিজেদের মধ্যে। আবিষ্কার করছে আমার আর ডাক্তারের সম্পর্ক। দুই বাঙালি আপনা-আপনি ঝগড়া বাধিয়েছে। হবে দুই ভাই, নয়তো বাপ-ব্যাটা। আপসে ঝগড়া মিটিয়ে নাও বাপু। কী বলো, আঁ?

ঠিকই, দাঁড়িয়েছি মঞ্চে, ভূমিকা নিতে হবে না? না নিলে দর্শক ছাড়ে? নিজেই কি ছাড়ি?

সেই ভালো। আপস করবো ডাক্তারের সঙ্গে। হাঁটা ধরলাম। মিলিয়ে যাচ্ছে ডাক্তারের চেহারা। ডাকলে শুনতে পাবে না। পা চালিয়ে দিলাম দ্রুত। আশ্রয় খুঁজবো পরে।

দোকানপাট খুলেছে। কত দোকান কত রকমের। দেখবার সময় নেই। পদে পদে বাধা, মানুষের দঙ্গল। মেয়েমানুষের হাত ধরে সব লাইনবন্দী হয়ে চলেছে। এঁকেবেঁকে যেতে হয়।

অনেকখানি এসেছি। ডাক্তার তেমনি চলেছে। একেবারে নাক বরাবর। ডাঁকলে শুনতে পাবে কিনা জানি নে। তবু একবার ডাক দিলাম, ‘ডাক্তারবাবু!’

ঠিক শুনেছে। থমকে দাঁড়াল ডাক্তার। বাজে-মাথা-মুড়নো তালগাছের মতো বিরাট চেহারা। হঠাৎ মনে হয়, অনেকদিনের পরিখাবাসী নিগ্রো সৈনিক। পেছন ফিরে একবার দেখলো আমার দিকে। দেখেও আবার চললো হনহন করে।

ডাকলাম, ‘শুনুন ডাক্তারবাবু।

আর নয়। ডাক্তার ততক্ষণে সেতুতে পা দিয়েছে। ওপারে চললো যে! চলুক, ভেবেছি যখন, ডাক্তারকে একবার ধরবই।

ওপারে, কেল্লার প্যারেড গ্রাউণ্ডে এসে ধরে ফেললাম ডাক্তারকে। প্যারেড গ্রাউণ্ড সঙ্গমের ত্রিকোণ ভূমি। এখন মেলার আসর। ডাক্তারকে ধরে ফেললাম একটা ভিড়ের কাছে। অনেক মেয়েপুরুষের ভিড়। কীসের ভিড় না দেখেই ডাক্তারকে ডাকলাম।

বোধ হয় ভিড়ের বাধাতেই দাঁড়াতে হলো ডাক্তারকে। দাঁড়িয়ে আড়চোখে তাকালো আমার দিকে। মুখে কোনো কথা নেই। গুঁতোবার আগে সিং কাত করে যেমন আড়চোখে তাকায় ষাঁড়, তেমনি ভাবখানা ডাক্তারের।

কিন্তু কী যে বলি! আশ্চর্য! এত যে ছুটে এলাম, এখন আর মুখে আমার রা ফোটে না। সত্যি, কী বলব?

সামনেই ভিড়। ভিড়ের কাছেই একটা মস্ত মোটরগাড়ি। গাড়িটাতে রেকর্ডে গান বাজছে সেই মাতাল মেয়ের। মাতলামির হিক্কা আর ‘হম্ পী-কে আয়ে।’ কী যেন হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে গাড়িটা থেকে। কী দিচ্ছে? চা! আরে আরে, তাকিয়ে দেখি, গাড়িটাতে লেখা রয়েছে, ‘অন্নপূর্ণা উইমেনস্ রেস্টুরেন্ট’।

চৌরঙ্গীর কাফেটেরিয়া। কোথা থেকে এসেছে? দিল্লি, না লক্ষ্ণৌ? সামনে যমুনা, আর এই চলন্ত কাফেটেরিয়া। দিব্যি ফোল্ডিং চেয়ার টেবিল পেতে আসর জমিয়ে তুলেছে এই বারো-মাসের বালুচরে। টেবিলে উয় চায়ের কাপে ধোঁয়া। শীতে আঁটোসাঁটো হয়ে সুড়ুত সুড়ুত করে চুমুক দিচ্ছে সুবেশিনী মেয়ে আর সুবেশ পুরুষের দল। ওদিকে কুপন আর ক্যাশ নিয়ে বসেছেন ক্যাশিয়ারবাবু। মোটা-সোটা টেকো মানুষ। শীতে হাত কাঁপছে থরথর করে।

একটু যে ভয় ছিল না তা নয়, তবু বললাম, ‘চা খাবেন ডাক্তারবাবু?’

ডাক্তারের মুখে কথা নেই। আড়চোখে যেমন আমাকে দেখছিল, তেমনি একবার দেখলো অন্নপূর্ণার গাড়ির দিকে। দেখলো চায়ের মজলিসের দিকে। তারপর গাড়ির শো-কেসের খাবারের দিকে তাকিয়ে রহলো একদৃষ্টে।

মৌনতা সম্মতির লক্ষণ কিনা জানি নে। কিন্তু কথা আর ফুটবে বলে মনে হলো না। যেন—যা বলার তা বলা হয়ে গেছে। আর মুখ খুলবে না।

বললাম, ‘দাঁড়ান একটু। আমি কুপন কেটে নিয়ে আসি।’

বলে, কুপন কেটে আগে দু’হাতে খাবারের ডিস নিয়ে এলাম। এসে দেখি ডাক্তার নেই। যেমন হতাশ হলাম, মনটাও খারাপ হলো তত। ডাক্তার একদৃষ্টে তাকিয়েছিল খাবারের দিকে। খাবার নিতে নিতেও তাই লক্ষ করেছি। এর মধ্যে সে কোথায় গেল! মজলিসের দিকে ফিরে দেখি, ডাক্তার দিব্যি চেয়ারে বসেছে! চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছে তার টেবিলের একমাত্র সঙ্গিনীর দিকে। পাঁচ-বদ্যির বসার ভঙ্গি ও চোখ দেখে বোধ হয়, চা আর নামছে না সে বেচারার গলা দিয়ে।

আমি তাড়াতাড়ি খাবারের ডিস দু’টো ডাক্তারের সামনে রেখে জল আর চা আনতে চলে গেলাম।

চা আনতে গিয়ে দেখি, মস্ত বড় কিউ পড়ে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে পড়লাম সারবন্দী লাইনের পিছনে। একটু অস্বস্তি লাগল। অস্বস্তি লাগলো এই ভেবে, ডাক্তার না আবার সরে পড়ে। কিন্তু লাইনে দাঁড়াতেও বড় আনন্দ হচ্ছে।

সত্যি, মেলা যেন নতুন রূপে জমে উঠেছে। মেতে উঠেছে সকলে। বোধ হয় একেই বলে মেলা। ইংরেজিতে যাকে বলে মুড, সেই মুড এসেছে সকলের মনে। মেলার মুড। অন্তত আমার চারপাশে যা দেখি, তা-ই।

অন্নপূর্ণার গাড়ির রেকর্ডে ‘হম পী-কে আয়ে’র মাতলামি শেষ হয়েছে। হঠাৎ বেজে উঠেছে সেই মান্ধাতা আমলের বাঙলা রেকর্ড। লম্ফর আলোর চেয়ে ধোঁয়া বেশি। রেকর্ডে আর গানের কথা শোনা যায় না। যন্ত্রসংগীতের অস্পষ্ট অথচ কর্ণবিদারী ধ্বনি শোনা যাচ্ছে কাঁসর-ঘণ্টার মতো। তারই ভেতর থেকে পিঁ পিঁ করে শোনা যাচ্ছে, ‘প্রাণের প্রভু রহে প্রাণে, রয় না বাহিরে।’

তা হোক। প্রয়োজন হচ্ছে একটা শব্দের। গান শুনছে ক-জনা? ওদিকে কাড়া-নাকাড়ার ধ্বনি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাঁধের উপর যাচ্ছে যত লোক, নেমে আসছে তার চেয়ে অনেক বেশি। যেন পিলপিল করে নেমে আসছে পিঁপড়ের সারি। আসছে লটবহর নিয়ে টাঙ্গা আর রিকসা, ঘোড়া আর গাধা, লরি আর বেঁটে চ্যাপ্টা প্রাইভেট কার। আর দিগন্তে শুধু মানুষ। নর আর নারী। রঙ আর রঙ। কথা আর কথা। গান আর গান। মাইকের কথা কতবারই বা বলবো।

চারিদিকে এত কোলাহল। কিন্তু ধন্য সেই আর্তস্বর, ‘হেই বাবু ভাইয়া পঞ লোক সকল, হেই ধৰ্মীবাবা।’…আশেপাশের সব গণ্ডগোল ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে সেই অদৃশ্য ভিখারির তীব্র চিৎকার। চিৎকার খাবার-ফেরিওয়ালাদের। আম্রদ। লে সস্তা আদ! পেয়ারার নাম আম্রদ। আদ আর পুরি। পুরি আর প্যাড়া। প্যাঁড়া আর মোম্‌ফালি। মোম্‌ফালি হলো চিনেবাদাম। দেখতে পাচ্ছি, ফেরিওয়ালাদের পেছনে লেগেছে পুলিশ। লাইসেন্সের ব্যাপার। হাজার হাজার টাকা জমা দিয়ে দোকান করেছে মহাজনেরা। পেছনে ফেরিওয়ালাদের অনধিকারপ্রবেশে বাধা পড়বেই, কিন্তু তাড়া দেবে কত! কত লাগবে পেছনে! পাঁচিল নেই, গেট নেই। মুক্ত সঙ্গমপ্রান্তর চারিদিকে করছে হা হা। ধাওয়া করবে কোথায়। যাবে এপার থেকে ওপারে। প্রান্তরের এপাশ থেকে ওপাশে। যেখানেই যাবে, মানুষ। মানুষ থাকলেই পেট। আর মেলার মানুষের পকেটের পয়সা। সে তো খাবার সন্ধানী পিঁপড়ের মতো। ফুটোর এপাশ ওপাশ নিয়ে বেরোয়।

যে কিউতে দাঁড়িয়েছি, সেখানে আর এক রূপ। কুম্ভমেলারই ভিন্ন রূপ। কিউ দিয়েছে মেয়েপুরুষ। চোখ-ঝলসে যাওয়া উলেন পোশাকের ছড়াছড়ি। মেয়ে-পোশাক আর পরুষের হাল-ফ্যাশানের আমেরিকান সুট ঝকঝকে আর চকচকে। খুবই দামী নিঃসন্দেহে। এই সাত সকালেই ঠোঁটে আর নখে রঙ মেখেছে। পরিপাটি অ্যালবার্ট ফ্যাশানের চুল।

ওরকম চুল দেখলেই আমার একটি কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে একটা মজুর-বস্তির কথা। বাপ শাসন করছে ছেলেকে। কারখানার মজুর দু’জনই। শাসন নয়, বোধ হয় বিদ্রুপই করছিল ছেলেকে। ছেলের পোশাকের বড় পরিপাটি। তাই বাপ বলছিল, ‘বড়বাজারের ফোকট্ কা পাতলুন, চোরাবাজার কা জুত্তা, ঔর চুল কো সিঙাড়া বনা কর কাহাঁকা লাটসাহিব কা ভাতিজা আইলনে তু?’

বড়বাজারের ফোকটের প্যান্ট আর চোরাবাজারের জুতোর একটা মানে বুঝি। কিন্তু চুলকে সিঙাড়া বানানো? সে আবার কি! পরে শুনেছিলাম ওই অ্যালবার্ট ফ্যাশান হল সিঙাড়া। হেসেছিলাম, কিন্তু সিঙাড়ার সঙ্গে অ্যালবার্টের এই আঙ্গিকগত সাদৃশ্য সত্যই লক্ষণীয়।

যাক সে কথা। পরিবেশটি নতুন রকম। ফ্যাশানটা স্বভাবতই আজকালকার স্টুডিও-ঘেঁষা গ্রেগরি পেক আর সুশান হেওয়ার্ড, দিলীপকুমার আর…। যাক, নাম বাড়িয়ে লাভ নেই। ফ্যানবৃন্দ আহত হতে পারেন। এ বিষয়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ অধ্যাপকের বক্তব্য বলার ইচ্ছা রইলো পরে। তা বলে আমার মতো ব্যতিক্রমও আছে বৈকি কিউতে। রাজস্থানী নাগরা আর গালপাট্টা, চৌদ্দ হাত শাড়ি আর তিন ইঞ্চি ডায়মেটারের নথ। তাদের হাসির আর অন্ত নেই। ‘টিকস্’ কেটে চা কিনতে হয়? আজব কাণ্ড! এটা জেনানা-লোকদের চায়েখানা? আরে রাম রাম কহো। এসে পড়, এসে পড়। চার পয়সা দিয়ে ‘টিকস্’ কাটাও আর লাইন দিয়ে পেয়লীভর চা পিয়ে নাও।

চা পাওয়ার ও খাওয়ার এ অভিনব পন্থা দেখবার জন্যই ভিড় করেছে কত মানুষ। পুরুষ আর মেয়েমানুষ। কৃষাণী ঘোমটা-খসা উদাসিনী। এ কি গো বিস্ময়! জেনানা তক লাইন দিয়ে চা খাচ্ছে! দিনে দিনে কতই হবে! তা ছাড়া বে-আব্রু মেয়েদের পোশাকই বা কি! পাকা মেমসাহেব বনে গিয়েছে সব।

খুব গা টেপাটেপি আর হাসাহাসির ধুম। এমন কি পুরুষদের মধ্যেও। আমার সামনেই হাল-ফ্যাশানের স্যুট-পরা এক যুবক। তার সামনে এক সুবেশিনী যুবতী। সম্ভবত স্ত্রী। ভেবেছিলাম, গান কেউ শোনে না, কিন্তু এরা দু’জনে কিউতে দাঁড়িয়ে সেই আলোচনাতেই মশগুল। তারা কান পেতে আবিষ্কার করছে, কী গান বাজছে রেকর্ডে। যুবতী বললো, ‘বোধ হয় ওড়িয়া গান।’ যুবক বললো, ‘আমার মনে হচ্ছে মাদ্রাজী।’

আর আমি বাঙলা গানের এ ভাষা আবিষ্কার শুনে হাঁ। যত অস্পষ্টই বাজুক, তা বলে, ‘প্রাণের প্রভু রহে প্রাণে’ একেবারে ওড়িয়া না-হয় মাদ্রাজী! কপাল আমার বাঙলা ভাষার। ধন্য আমার বাঙলা গানের শ্রোতা!

মেলা সরগরম! এই আবেষ্টনী, আর চেয়ার-টেবিলের ছড়াছড়ি রেকর্ডে কী বাজবে? ঘরছাড়া মানুষের গলায় গান আপনি গুনগুনিয়ে ওঠে। এ পরিবেশ দেখে ভুলে যেতে হয়। অবধূতের কথা। বিস্মৃতি আছে কুম্ভমেলার। শহুরে জীবনের এক নতুন পকেট যেন!

চা পেতেই ছুটে এলাম। ছি ছি, ডাক্তার এখনও মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে কটমট করে। তার টেবিলের এক সুন্দর-মুখ ভালো মানুষ সঙ্গিনী। অবাঙালিনী নিঃসন্দেহে। কোনো কোনো শিকারীর নজরেই বন্দী হয়ে পড়ে শিকার। মহিলাটির অবস্থা প্রায় সেইরকম।

আমি আসতেই বোধ হয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বেচারি। চোখে তার বাসি সুর্মার দাগ। নেহাৎ বাঙালিনীর মতো চোখ তুলে তাকাল। ভাবখানা, কী রকম মানুষ! একটা পাগলকে বসিয়ে রেখে গেছে এখানে?

অপরিচয়ের মধ্যেও মানুষ কথা বলে বৈকি। বলে নীরবে, চোখে চোখে। মহিলাটি একটি কটাক্ষ করে উঠে গেল। দেখলাম, পেয়ালায় চা রয়েছে এখনো। চুমুক দেবারও সুযোগ পায় নি।

সে উঠে যেতে ডাক্তারও যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। দলা করা কম্বলটা টেবিলে রেখে তাকালো মেয়েটির চলার পথের দিকে। তারপর আমার দিকে। খ্যাপামিটা এখনও একেবারে যায় নি মুখ থেকে। কোনো কথা না বলে দিব্যি পেয়ালা টেনে নিয়ে চুমুক দিল। খাবারটি খাবে না নাকি? কী জানি! যা মানুষ!

ভাবতে না ভাবতেই খাবারে হাত পড়লো ডাক্তারের। যত হাত পড়ে ততই ডাক্তারের ভয়ংকর মুখের নিষ্ঠুর রেখাগুলি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে! অবিশ্বাস্যরকম কোমল হয়ে উঠেছে ডাক্তারের মুখ। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মুখে মানবিক স্ফুরণ। নিজে খাব কী! ডাক্তারের মুখে কোন অদৃশ্য জাদুদণ্ডের স্পর্শ লেগেছে, তাই খুঁজছি। শুধু কোমল নয়, তৃপ্তিতে, সুখে নতুন সুষমায় ভরে উঠেছে ডাক্তারের মুখ!

লোকে বলে, বিশেষ করে গৃহিণীরা বলেন, ‘খাওয়া দেখেও সুখ।’ সে কোন্ খাওয়া? এমনি খাওয়া কি? বিস্ময়ের সঙ্গে খুশির আমেজ দেখা গেল আমার মনে। এ আবার কেমন খুশি, তা তো জানিনে। খেয়ে খুশি বরাবর। খাইয়ে খুশি ততো হই নি কখনো। কী বিচিত্র! আমার ছেলেবেলার বেচা এলো ফিরে। আমার যৌবনে এলো এই কুম্ভমেলার দিগন্তের হাটে পাঁচ-বদ্যির বেশে।

ছেলেবেলায় আমার পিঁপড়ের মতো খুঁটিয়ে বেড়ান সঞ্চয়। সেই সঞ্চয়ের ঐশ্বর্য একদিন ভয়ে দুঃখে আশায়-নিরাশায় দিয়ে দিয়েছিলাম বেচাকে। নোটনের ডালপুরি, লালমোহনের সন্দেশ, লজেন্স, বাখরকানি। কত কি! সেই থেকে সন্ধি স্থাপন হয়েছিল। বেচার খাওয়ায় সুখ পেয়েছিলাম, তা নয়। বরং সঞ্চয়ের শূন্য থলিটা দেখে, লুকিয়ে কেঁদেছিলাম। সন্ধি হয়েছিল চোখের জল দিয়ে। কিন্তু বেচার কথা তো ভুলি নি! ভুলি নি ওর অভিযোগ, ‘আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কেন তুই রোজ খাস?’ দেখিয়ে দেখিয়ে কোনোদিনই খাই নি। ওর দেখার মধ্যে ছিল আমার দেখানো।

দু’টো প্লেটই সাবাড় করেছে ডাক্তার। করে ডাক্তার একটু বা অপ্রস্তুত যেন। তাকাতে পারছে না আমার দিকে। চা-ও শেষ

দেখলাম, ডাক্তারের মোটা স্থূল ঠোঁটজোড়া ভিজে উঠেছে। এবড়ো-খেবড়ো মুখের চামড়া উঠেছে টান-টান হয়ে। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। সেলাই বহুল মোটা জামা আর তালি-মারা প্যান্ট। একটা রীতিমতো বলিষ্ঠ মানুষ। কিন্তু কী করুণ।

উঠে গেলাম ক্যাশিয়ারের কাছে। কুপন কিনে খাবার নিলাম। হিসাবের কড়ি পকেটে। টায়টিকে খরচের কড়ি। পথে বেরিয়েছি, এক পয়সা মা-বাপ। না থাকলে কেউ জিজ্ঞেস করবে না। দৈবজ্ঞ মরবে কাঁথা বয়ে।

তবুও। উপোস দেব একটি বেলা। ভাবছ, আবেগে হয়েছি অচৈতন্য। হবেও বা। কিন্তু মনের খুঁতখুঁত রাখব কোথায়! হৃদয়জোড়া বিষকুম্ভ। মনে অশান্তি দিয়ে তাকে আরও ভরে দিই কেন! অমৃতকুম্ভের খোঁজ পাই নে এখনো। ছাড়ি কেন আত্মতৃপ্তিটুকু! চোখের উপর ভেসে উঠছে খালি বলরামের মুখটি।

খাবার দেখে ডাক্তার আরও অপ্রস্তুত। অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকালো আমার দিকে। জানি, আমিই আবার রেগে গিয়েছি কিনা, সেটুকুই তার সংশয়।

বললাম, ‘খান।’

খাবারের দিকে দেখে ডাক্তার আবার তাকালো আমার দিকে। তারপর টেনে নিল একটা প্লেট। সে-প্লেটখানিও শূন্য হলো। দু প্লেট এনেছিলাম আবার।

বাকি প্লেটটি দেখিয়ে বললাম, ‘ওটাও খেয়ে ফেলুন।

এতক্ষণে মৌনব্রত ছাড়লো ডাক্তার। বললো, ‘তুমি?’

‘আমি চা খাব।’

ডাক্তার আমার দিকে তাকাল। সর্বনাশ! আবার খ্যাপামির লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। কিন্তু খেপল না। খেল না। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে বার করলে একটি ছোট কলকে। তেঁতুলবিছের মতো একটি চকচকে লাল গাঁজার কলকে। আবার এ-পকেট ও-পকেট করে বেরুল খানিকটা পাটের ফেঁসো আর নারকেলের ছোবড়া। কিন্তু আর কিছু নয়। বিরক্ত হয়ে সেগুলি পকেটে রেখে বললো, ‘বিড়ি-টিড়ি আছে?’

বিড়ি তো নেই। পকেট থেকে বার করে দিলাম সিগারেট। বুঝলাম, ওই বস্তুটি তেমন মনঃপুত নয়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘পেট ভরেছে আপনার?’

ডাক্তার বললো, ‘পেট আবার কখনো ভরে? না, ভরেছে কোনোদিন কারুর? কি করে ভরবে?’

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ডাক্তার বললো, কালকে যাও বা পেল্লাদের দিদিমা দিত দুটো খেতে, সে তো তুমি পেল্লাদ এসে ঘোচালে।’

বললাম, ‘আমি?’

‘তবে কে?’

‘কী রকম?’

ডাক্তার আবার প্রায় স্বমূর্তিতে দেখা দিল। বললো, ‘ওই যে, বুড়ির মন কেড়ে মেজাজ খারাপ করে দিলে। কিপটে বুড়ি। বুড়িগুলো সব কিপটে! ওরকম ষোলটা বুড়িকে গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছি দেশ থেকে। তখন বলে কত কথা! সব বেটি পাঁচুগোপালের ঘাড় বেয়ে সগে যাওয়ার তালে আছে। যাওয়াব’খন! ভেবেছে, প্রয়াগে এসে সব সগ ধরে ফেলেছে। আবার ফিরতে হবে না?’

বললাম, ‘আপনি নিয়ে এসেছেন নাকি? ‘

‘তবে? কে নিয়ে আসবে? পাঁচুগোপাল ছাড়া আর সব জানে কে? নিয়ে এসেছি, নিজের জানাশোনা আশ্রমে ক্যাম্প খুঁজে দিয়েছি।’

বলে, ডাক্তার আমাকেই যেন আসামী করে ধমকে উঠলো, ‘এমনি নিয়ে এসেছি, অ্যাঁ? এমনি নাকি বল? সবাই কন্টাক্‌ট করে এসেছে, দু-বেলা খেতে দেবে আর রাত্রে শুতে দেবে পালা করে। তা দু-বেলা ঠিকমতো খেতে দেওয়া দূরে থাকো, রাত্রে একটু শুতে পর্যন্ত দিচ্ছেনা।’

মনটা বিস্মিত ব্যথায় চমকে উঠলো। দু-বেলা দু’টো খাওয়া, আর একটু আশ্রয়ও যে ডাক্তারের কপালে নেই, এতটা তো অনুমান করতে পারি নি। মনে পড়ে গেল, কাল রাত্রে শীতার্ত ডাক্তারের ক্যাম্পে প্রবেশ।—সেই ‘নো জায়গা, নট কিচ্ছু।’ ডাক্তার! পেশা ও বিশেষণের কী বিড়ম্বনা! রহস্যাচ্ছন্ন ব্যাপার। এই পাঁচুগাপোল রায় ডাক্তার হলো কী করে?

ডাক্তার আপন মনে বলেই চললো, ‘এই বুড়িগুলোর একটাও সঙ্গে যাবে? একি গাড়ির টিকিট কেটে আর ভিড় ঠেলে মরতে যাওয়া, যে সগ্‌গে গিয়ে পৌছুবে! তিন সত্যি করে এলো সব, আর এখানে এসে আমাকে চিনতেই পারে না। দিব্যি নিজেরা খাচ্ছে, সাধুদর্শন করে বেড়াচ্ছে। ভগবান না, সঙ্ দেখতে এসেছে। দেখো তুমি, সবগুলো নরকে যাবে।’

কী করে দেখবো, তা তো জানি নে। ডাক্তারের অবস্থাটা খালি ভাববার চেষ্টা করছি। কিন্তু ডাক্তার থামে না——পেল্লাদের দিদিমার জন্য ক্যাম্পে বলে রেখেছি। এলাহাবাদ ইস্টিশান থেকে নিয়ে এলাম। পথে বললে, পাঁচু, আজ আমার কাছেই খাবি থাকবি। কিন্তু একবার ডাকলে! যখন নিজেরা খেলে? ক্যাম্পের বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলাম।’

লজ্জায় ও ব্যথায় এতটুকু হয়ে গেলাম। আমিও তখন খাচ্ছিলাম। আমিই কালকের রাত্রিটা ডাক্তারকে উপোসে রেখেছি। নিরাশ্রয় করেছি। তাই ডাক্তার ক্ষেপে উঠেছিল।

তাড়াতাড়ি বললাম, ‘সত্যি, কালকে রাত্রের ব্যাপারটা আমার খুব…’

‘তুমি?’ ডাক্তার আবার ধমকে উঠলো আমাকে। ‘তুমি কী করবে? ওসবে আমার আর বাজে নাকি? তাই ভেবেছ তুমি? আরে ছোঃ! অত সস্তা কলজে পাঁচ-বদ্যির নয়, বুঝেছ? দশ-দশটি বছর সাধু হয়ে সারা দেশ ঘুরেছি। সারাটা দেশ।’

বলে, হাতের বুড়ো আঙুল দু’টি দেখিয়ে বললো, ‘সব নখদর্পণে আছে, যতরকম সাধু আর যতরকম মানুষ। জিজ্ঞেস কর, বলে দেব।’

‘আপনি সাধু হয়েছিলেন?’

‘তবে?’

‘কেন?’

‘কেন আবার! বার করে নিয়ে গেল ঘর থেকে। ঘর-বার সমান করে দিল। জোর করে নিয়ে গেল টেনে।’

‘কে।’

‘কে আবার? যার নেওয়ার জ্বালা, প্রাণের জ্বালা।’

‘ছেড়ে দিলেন কেন?

‘ছাড়াছাড়ির কী আছে? কিছুই ধরি নি, তার ছাড়ব কী! কপনি এঁটেছিলাম, ফেলে দিয়েছি। আছি, যেমন ছিলাম তেমনি। জ্বালা টানে, জ্বালাই নিয়ে আসে। জ্বালা কখনো ছাড়ে?’

বলে, ডাক্তার সোজাসুজি তাকালো চোখের দিকে। তাকিয়ে দেখি ডাক্তারের চোখে মনি নেই। অন্ধকার দু’টি গর্ত শুধু। কোথায় হারিয়ে গিয়েছে চোখের মনি দুটি! অন্ধ গহ্বরে একটা দুর্বোধ্য যন্ত্রণার চমকানি। স্থূল ঠোঁট দুটো ছুঁচলো হয়ে উঠেছে। বিকৃত গলায় বললো, ‘বলো। জ্বালা কখনো ছাড়ে?’

জবাব চায় ডাক্তার। কী জবাব দেব! জ্বালা ছাড়ে কিনা জানি নে। কিন্তু ওই মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন করে বলি যে, ছাড়ে।

ডাক্তার আবার মুখ খুলল। তখনো কে জানতো, অজান্তে এক কুলুপ ছিদ্রে সুড়ুৎ করে ঘুরিয়ে দিয়েছি চাবি। ধাক্কা দিয়েছি বহুদিনের মরচে-পড়া বন্ধ দরজায়। ডাক্তার বললো, ‘কোথায় না গিয়েছি। অসময়ে একলা একলা বরফ ভেঙে ছুটে গেছি হিমালয়ের উপরে মানুষখেকো জন্তু পালিয়ে গেছে, তবু আমি থামি নি। ভীতু কাপুরুষ সাধু পুরুত দরজা খোলেনি মন্দিরের। মরণের ভয়ে, খেতে দেবার ভয়ে। বয়ে গেছে। জীবন-মরণ ক্ষুধা-তৃষ্ণা, সব জ্বালা জ্বলে-পুড়ে গেছে। আমাকে রুখবে কে? কিন্তু প্রাণ জুড়োল? জ্বালা জুড়োল?’

ডাকলাম, ‘ডাক্তারবাবু।

‘ডাক্তারবাবু?’আবার সেই ভয়ংকর মুখ। ‘আমাকে ঠাট্টা করা হচ্ছে? আমি ডাক্তারবাবু? জড়ি বুটি ছাড়ি, জড়ি বুটি। রাস্তায় ফেরি করি। দাদ কাউরের মলম তৈরি করে বেচি। নিয়ে দেখ, সারে কিনা। মাদুলি? তাও দিই। তা বলে ডাক্তার?’

সর্বনাশ! আবার সেই মূর্তি। এখন কি আর মনে আছে পাঁচ-বদ্যির, ডাক্তার পরিচয় সে নিজেই দিয়েছে! বলতে গেলে উলটো বিপত্তি হবে। যাক, বলে যাক। চায়ের আসর জমজমাট। বেশি গণ্ডগোল হলে ভিড় বাড়বে। আগেই টের পেয়েছিলাম, ডাক্তার নামের মধ্যে আছে পাঁচুগোপালের বিড়ম্বনা। বুঝলাম, নির্মম বিদ্রুপ মাত্র। খ্যাপার প্রতি শ্লেষ। পাঁচ-বদ্যি আর ডাক্তার পাঁচুগোপাল রায়। ওই নামে নিজেকেও বিদ্রুপ করে সে। করে যে, তাও বোধ করি নিজে সঠিক জানে না। কীসের জ্বালা, সেটুকু জানার বড় ইচ্ছা হলো।

ডাকলাম, ‘পাঁচুগোপালবাবু।’

ডাক্তার তাকাল। অবাক কাণ্ড! সে হাসছে নাকি? এও কি বিশ্বাসযোগ্য? বিকশিত তার বড় বড় দন্তরাজি। যদি হাসি হয়, তবে কী ভয়ংকর হাসি! বললো, মিষ্টি কথা বলা হচ্ছে? দিব্যি ওলটানো চুল, ঠাণ্ডা চোখ, ভালো মানুষের মতো দেখতে। ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানো না। খুব জানি তোমাদের মতো ছোঁড়াদের।’

আমাকেই বলছে। কিন্তু বাধা আর দিচ্ছি নে। তা হলেই ডাক্তারের ক্ষিপ্ততা দেখা দেবে। গলার স্বর নেমে এলো ডাক্তারের। বললো, ‘ওই যে একটি কেটে পড়লো টেবিল ছেড়ে। দিব্যি টানা-টানা চোখ, টিকলো নাক, সুন্দর মুখ। কেমন শান্ত মেয়েটি।’

বুঝতে দেরি হলো না, টেবিল-সঙ্গিনী সেই মহিলাটির কথা বলছে ডাক্তার। কিন্তু বেচারি সত্যি ভালো মানুষ। আমি তো তাই দেখেছিলাম। বললাম, ‘না, সে মহিলাটিকে তো―?’

‘সব করতে পারে।’ বাধা দিয়ে বলে উঠলো ডাক্তার, ‘ওসব ভয়ংকর, সাংঘাতিক। আমার চেয়ে বেশি জানো তুমি?’

তা হয়তো জানি নে। কিন্তু একটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন আছে তো।

ডাক্তার বললো, ‘বিশ্বাস হলো না বুঝি?’ বলে পকেট থেকে বার করলো একটা ময়লা কাগজ। এত ময়লা, কুঞিত চামড়ার মতো হয়ে গিয়েছে। অতি সন্তর্পণে সেই কাগজের ভাঁজ খুলতে চকচক করে উঠলো একটি ফটো। ফটোটি আমার সামনে মেলে ডাক্তার বললো, ‘দেখো তো কেমন?’

সুন্দর, সত্যি সুন্দর! টানা-টানা শান্ত চোখ। সু-উচ্চ নাক। কপালের উপর ঝাঁপিয়ে-পড়া চুলের গোছা। বয়স অনুমান করা শক্ত। তবে তরুণ বয়স, সন্দেহ নেই।

‘কেমন?’

বললাম, ‘সুন্দর।’

‘হুঁ হুঁ, বিষ! ভয়ানক বিষ, সুন্দর বিষ।’

মনে বড় কুণ্ঠা এলো, তবু জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে ইনি?’

শুনতে পেল না ডাক্তার। ভয়ানক বিষ, সুন্দর বিষের দিকেই সব ভুলে তাকিয়ে ছিল সে। গর্তে ঢোকা কালো চোখে তার বিগলিত দৃষ্টি। খাওয়ার সময় যেমন কোমল হয়ে উঠেছিল তার মুখ, এখন এই মুহূর্তে তার চেয়ে সুন্দর হয়ে উঠেছে সেই মুখের শ্রী।

পরমুহূর্তেই ফটোটা কাগজে মুড়ে পকেটে ঢুকিয়ে দিল। বললো, ‘কে, জিজ্ঞেস করেছিলে? আমার বউ ওকে জন্ম দিয়ে মরেছিল।’

‘আপনার মেয়ে?’

জবাব না-দিয়ে ডাক্তার মুখ ঘুরিয়ে নিল।

বুঝলাম, ‘আমার মেয়ে’ কথাটি উচ্চারণ করতে নারাজ সে!

সে বললো, ‘ওই যে ফটোটি দেখলে, বললে বিশ্বাস করবে না, ওই ফটোর মেয়ের চেয়েও তার মা ছিল আরও সুন্দর।’

চারিদিকে কথা, হাসি ও চিৎকার। হ্রেষাধ্বনি আর মোটরের গর্জন। সব মিলিয়ে একাকার। তার মধ্যে পাঁচুগোপালের চাপা মোটা গলা অদ্ভুত মিষ্টি শোনাল। যেন ক্লারিওনেটের খাদের সুরে বেজে চলেছে বিচিত্র রাগিণী।।

ডাক্তার বললো, ‘এই পাঁচুগোপাল, প্রাণগোপাল রায়ের ছেলে বসে আছে তোমার কাছে। চেয়ে দেখো, আমি কী কুৎসিত। চেহারা দেখে মানুষ আমার কাছে আসে না। তবু, সে আমাকে ভালোবাসত। এত ভালোবাসত যে, আমিই এক এক সময় ভাবনায় পড়ে যেতাম। আমার খেতে বসতে শুতে তারও ভাবনার অন্ত ছিল না। ওই মেয়ে জন্ম দিয়ে সে মরে গেল। ভালোবাসার কদর বুঝতে না বুঝতে সে চলে গেল। অন্ধ আর বোবার মতো আমি দিবানিশি হাতড়ে ফিরেছি, খুঁজেছি। মনে হতো, কেউ যড়যন্ত্র করে তাকে লুকিয়ে রেখেছে আমার কাছ থেকে। মানুষের খ্যাপামি কতদিন থাকে? ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি কাঁথায় শুয়ে কাঁদছে সে, আমারই মেয়ের বেশে। প্রথমে বড় রাগ ছিল মেয়েটার ওপর। পাড়ার মেয়েরাই দেখতো ওকে। তা ছাড়া কে বাঁচাবে! দিনে দিনে সেই মেয়ের চোখ ফুটল, নাক ফুটলো, হাসি ফুটলো। মায়ের মতোই। নাম হলো শিউলি। শেফালির মতোই সুন্দর, নরম আর মিষ্টি। নজর যখন দিলাম, আর চোখ ফেরাতে পারলাম না। কাজ করতাম কারখানায়। মন বসত না, কখন বাড়ি আসব, শিউলিকে বুকে নেব, সেই আমার ভাবনা। ওই মেয়েই আমার ধ্যান জ্ঞান, আমার প্রেম। ভালবাসা, আমার স্বর্গ, আমার ভগবান, আমার সব। আদেখলের ঘটি হলে যা হয়! কুঁড়েঘরে রাজকন্যের সাজপোশাক খাওয়া। সবাই হাসত আর ঠাট্টা করত।…বড় হলো, বুলি ফুটল। কী মিষ্টি কথা! প্রাণ ধরে ইস্কুলে দিলাম। দিনে দিনে বড় হলো। আমার ধুলোভরা রোদ-পড়া বাগানে ফুল ফুটল, ছায়া হলো, পাখি ডাকল। লুকিয়ে শুনতাম, মেয়েকে দেখে লোকে বলত পাঁচুগোপালের মেয়ে! কত আমার ভাবনা। অনেক লেখাপড়া শেখাব, গান শেখাব। কত কী!

বলে একটু থামল। আর আমি ভাবছিলাম এমন অভাবিত সুন্দর বিন্যাসও বেরোয় তার মুখ থেকে? গলার স্বরটা আরও নেমে এলো তার, ‘সতেরো বছর হলো। মেয়ের ভরা যৌবন। কিন্তু কী শান্ত! ঠিক তার মায়ের মতো। আমি ছিলাম তার বাপের চেয়েও বড়, তার একলার সঙ্গী, তার বন্ধু। বিয়ের কথা হলে কতদিন বুকে মুখ রেখে বলেছে, বাবা, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমি পারবো না।’

এই পর্যন্ত বলে আচমকা ব্রেক কষার মতো পাঁচুগোপালের কথা থামল। তাকিয়ে দেখি সারাটা মুখ কুঁচকে বিকৃত হয়ে একেবারে অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। যেমন আচমকা থেমেছিল তেমনি হঠাৎ বললো, ‘মিছে কথা। একেবারে শয়তান। সুন্দরের মধ্যে বিষ। চলে গেল। না বলে না জানিয়ে পালিয়ে গেল একটা ছেলের সঙ্গে। পাড়ারই ছেলে!’

এ পর্যন্ত বলতেই নাটকীয়ভাবে যবনিকা পড়ল। চলন্ত অন্নপূর্ণার আর্দালি টেবিল ওঠাতে এলো। লক্ষ করিনি, কখন আসর ভেঙে গিয়েছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে রেকর্ড। পথের রেস্তোরাঁ গিয়েছে উঠে। উঠে পড়লাম। পাঁচুগোপালের সঙ্গে চললাম পুলের দিকে। বেলা অনেক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে কথা মনে নেই। তাকিয়েছিলাম ডাক্তারের দিকে।

বোধ হয় তার কথা ফুরিয়েছিল। আর কিছু বলার দরকার ছিল না। কিভাবে পাঁচুগোপালের জীবন আজ এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, কেন সে সাধু হয়েছিল, তার কারণ ব্যাখ্যারও আর প্রয়োজন ছিল না। দরকার নেই আর বলার, কেন তার এত হাঁকাহাঁকি, কথার খেই হারানো, পাগলামি আর সুন্দর ছেলেমেয়ে দেখলেই একটা তিক্ত সন্দেহে ও যন্ত্রণায় জ্বলে ওঠা।

জ্বলার কথা তো নিজেই বলেছে সে। ঘরের বাইরে, অসীম সমুদ্র আর বিরাট হিমালয়, কোথাও তার জ্বলার নিরসন হয়নি। সব মিলে সে আজ অস্বাভাবিক, অবাস্তব রূপ ধরেছে। পুল পেরিয়ে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ালো সে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে দাগ পড়েছে। চ্যাটালো পাড়ে। কলকল শব্দ। পাঁচুগোপাল এসে দাঁড়াল।

বললাম, ‘পাঁচুগোপালবাবু, আপনার মেয়ে এখন কোথায়?’

বললো, ‘তা জানলে কি আর ভাবনা ছিল? ভাবি, এ কেমন যাওয়া! একটু কি খোঁজও দিতে নেই? দশ বছর বাইরে ঘুরে এসেও খোঁজ পাই নি।’

তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ। অজান্তে একটি নিশ্বাস পড়লো আমার। আর নয়। এবার আশ্রয়ের সন্ধান না করলে আর নয়।

খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশ পাথর।…

চলে যাওয়ার আগে সেই কথাটিই বার বার মনে পড়ছিল। জীবনভর এই খোঁজার পালা পাঁচুগোপালের শেষ হবে কিনা জানি নে।

খুব উত্তেজনার পর মানুষ যখন ঠাণ্ডা হয়ে যায়, অনেকক্ষণ কাঁদার পর শোকাতুর যেমন নীরব ও বিহ্বল হয়ে পড়ে, পাঁচুগোপাল তেমনি শান্ত হয়ে গিয়েছে।

মুখ ফিরিয়ে বিদায় নিতে গেলাম। পাঁচুগোপাল আচমকা প্রশ্ন করে বসলো, ‘কী করা হয়?’

কী যে করি, সে-জবাব দেওয়া মুশকিল। যা করি, সে কাজটি ভালো কি মন্দ দশজনের বিচার্য। কিন্তু বলতে গেলেই সঙ্কোচ হয়। বিশেষ পাঁচুগোপালের কাছে সাত-পাঁচ ভেবে তবু সত্যি কথাই বললাম।

বললাম, ‘লিখি।’

পাঁচুগোপাল অবাক হল! জিজ্ঞেস করলো, ‘কী লেখ? বই?’

পাঁচুগোপালের বিস্ময় দেখে একেবারে এতটুকু হয়ে গেলাম। কেন, বই লেখাটা কি পাপ? বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘কী বই লেখা হয়? এমনি সব জ্ঞান-ট্যানের বই, না গপ্পো-নভেল?

বুঝলাম, জ্ঞান-ধ্যানের বই বললেই বোধ হয় খুশি হয় সে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, পাঁচুগোপালের কাছ থেকে এরকম প্রশ্ন আশা করিনি।

বললাম, ‘হ্যাঁ, গপ্পো আর নভেলই লিখি।’

পাঁচুগোপাল বললো, ‘তা বুঝেছি! মাথার ওপর রোজগেরে বাপ আছে নিশ্চয়ই?’

‘কেন বলুন তো?’

‘তা নইলে চলে কী করে?’

হঠাৎ জবাব দিতে পারলাম না। চলে কিনা চলে, সে বিষয়ে নিজের মন্তব্য প্রকাশ করে লাভ কী! বললাম, ‘কেন, বাঙলাদেশের লেখকদের কি চলে না?’

পাঁচুগোপাল বললো, ‘কই, আমাদের কেষ্টকান্ত তো বাপের পয়সাতেই বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে খায় আর কাঁড়ি কাঁড়ি বই লেখে।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেষ্টকান্ত কে?’

‘আমাদের পাড়ার ছেলে।’

বললাম, ‘তা হবে। তবে, আমার বাবা মারা গেছেন।’

পাঁচুগোপাল আরও বিস্মিত হয়ে বললো, ‘তোমার মাথায় তো বাউড়ি কাটা চুলও নেই দেখছি।’

বললাম, ‘কেন? ‘

‘আমাদের কেষ্টকান্ত তাই বলে। বই লিখলে নাকি মাথায় বাউড়ি রাখতে হয়, চশমা পরতে হয়, উড়নি চাপাতে হয়।

পাঁচুগোপালের মুখের দিকে নজর করে দেখলাম। না, ঠাট্টা নয়, কথাগুলি সে সরল বিশ্বাসেই বলছে।

জানি নে, কে কেষ্টকান্ত। তাঁর রচিত সাহিত্য পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বললাম, ‘সকলের তো একরকম নয়। আপনাদের কেষ্টকান্ত হয়তো ওই রকমটি পছন্দ করেন।’ পাঁচুগোপাল একটা দীর্ঘ হুঁ দিল। মানে যার অনেক কিছুই হতে পারে। আবার বললো, ‘আর এ লাইনে কতদিন?’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন্ লাইনে?’

বললো, ‘এই তীর্থ ঘুরে বেড়ানো?’

বললাম, ‘এই প্রথম।

ঘাড় নেড়ে বললো পাঁচুগোপাল, ‘সেইজন্যেই। সেইজন্যেই রাত করে একলা বেরুনো হয়েছিল?’

‘বেরুলে কী হয়?’

‘কী আর হবে! ঘাড়টি মটকে বালুতে পুঁতে রেখে দেবে।

পুঁতে রেখে দেবে! অপরাধ? বললাম, ‘কে? কেন রাখবে?’

পাঁচুগোপাল দ্বিতীয়বার হাসলো। বললো, ‘যার দরকার সে-ই রাখবে। পকেটে নিশ্চয়ই কিছু রেস্তোও আছে?’

রেস্তো মানে পয়সা। তা কিছু তো আছেই। তা বলে সে-পয়সার জন্য একেবারে ঘাড় মটকানো!

পাঁচুগোপাল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলো। বললো, ‘মনে রেখো, এই কয়েক মাইলের মধ্যে সব জায়গায় ওৎ পেতে আছে ভয়ংকর সব মানুষ। অনেকে সাধু বেশেও আছে। সুযোগ পেলেই তারা কখনো ছাড়বে না। আর সাধুদের কাছে রাত্রে কখনো ভিড়ো না।’

বললাম, ‘কই, কাল রাত্রে তো সে রকম কিছু –

‘টের পাওনি। রোজ রাত্রেই কি আর এমনি হয়। তাছাড়া আমি ছিলাম কাল তোমার পেছনে পেছনে। আর-একটা কথা বলি। অনেক পেত্নী আছে এখানে, তারাও ছেড়ে কথা কইবে না।’

পেত্নী! পাঁচুগোপাল যে মনের মধ্যে রীতিমতো একটা ভয় ধরিয়ে দিল! বললাম, ‘পেত্নী! সেটা আবার কী?’

পাঁচুগোপাল মুখ বিকৃত করে বললো, ‘সেটা দেখলেই চোখ খুলে যাবে। আড়ে আড়ে চাইবে, ফিকফিক করে হাসবে, মনে হবে হাতছানি দিয়ে বুকের কাছে ডাকছে, বুঝেছ? খুব সাবধান।’

বলে, মুখ ফিরিয়ে বললো আপন মনে, ‘কত দেখলাম এরকম। এই গেলবারের হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় তিনজনকে এরকম খুন হতে দেখেছি। তারা সবাই তোমার মতো ভদ্দরঘরের ছেলে।

ভয়টা প্রায় চেপে বসলো মনে। বক্তব্য অনুযায়ী পাঁচুগোপাল এ বিষয়ে আমার চেয়ে অভিজ্ঞ নিঃসন্দেহে। তার কথা একেবারে উড়িয়ে দিতেও পারিনে। বললাম, ‘কিন্তু এই তীর্থক্ষেত্রে?’

সে বললো, ‘এইখানেই তো সহজ। তীর্থক্ষেত্তর বলে তো আর কারুর আসতে মানা নেই। দেখতে চাও? অনেক কিছু দেখতে পাবে। দেখিয়ে দেব তোমাকে। মাল-টাল টানা হয়?’

মাল? মানে মদ। বললাম, ‘না। কেন?’

‘সেসব বন্দোবস্তও আছে। এখানে সব পাবে। বে-আইনী চোলাই করা নদ এখানে খুব আসে।’

এতক্ষণে মনে হলো, পাঁচুগোপাল যে দিকটা ইঙ্গিত করতে চাইছে, সেদিকে আমার ভয় নেই। কিন্তু তার কথা শুনে আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইলাম।

এই দুস্তর বেলাভূমি। চারিদিকে গিজগিজ করছে সাধু-সন্ন্যাসী আর পুণ্যার্থী নরনারীর দল। এই উন্মুক্ত প্রান্তরের বুকে কোথায় থাকতে পারে সেই বেসাতির আস্তানা? জানি নে কোথায় থাকতে পারে! তবে থাকাটা অসম্ভব বলে বোধ হয় না। মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই।

যাবার আগে পাঁচুগোপালকেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা বলতে পারেন, এখানে বাঙালিদের আস্তানা আর কোথায় আছে?’

পাঁচুগোপাল বললো, ‘সব জায়গায় আছে, কেন?’

বললাম, ‘আমাকে একটা আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে তো!’

‘কেন? তুমি ওই ক্যাম্পে থাকবে না?’

বললাম, ‘কী করে থাকবো বলুন? বলেছিলাম, একটা রাতের জন্য থাকব, আজকে আমাকে নতুন জায়গা দেখে নিতে হবে।’

পাঁচুগোপাল বিস্মিত ব্যাকুল চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। বললো, ‘ও, এতক্ষণ ধরে মনে মনে এই সব মতলব ভাঁজা হচ্ছিল? চলে যাবে বলে বুঝি সব বলছিলে আমার সঙ্গে?’

হঠাৎ করুণ হয়ে উঠলো পাঁচুগোপালের মুখ। এখনো বুঝতে পারলাম না তাকে। বুঝতে পারলাম না মানুষটির সঠিক ধাত। এই একরকম, তার পরেই আর একরকম। কালকেই এই মানুষই আমাকে তাড়াবার জন্য কী না করেছে। সেকথা এখন মনে করিয়ে দিয়ে লাভ নেই। ভেবেছিলাম, পাঁচুগোপালের অপমানের শোধ তুলব। কিন্তু যার শোধ তুলব, তার শোধবোধ কোনোটারই বালাই নেই। সে চলে নিজের হৃদয়াবেগে। হৃদয়াবেগে চলার মানুষের সুখের চেয়ে দুঃখ বেশি। সে-দুঃখ কেউ কেউ রোধ করতে পারে না। কিন্তু নিজে সে সেই দুঃখের বিষয়ে সচেতন নয়। আসলে পাঁচুগোপাল আমাকে কাল অপমান করেনি। ওটাও তার হৃদয়াবেগেরই একটা ঘটনা মাত্র।

পাঁচুগোপাল বললো, বললো খুবই ঠাণ্ডা গলায়, ‘ওখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য কে তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে?’

বললাম, ‘দেয়নি। কিন্তু প্রহ্লাদবাবুদের ক্যাম্পটা তো আমার ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।’

পাঁচুগোপাল ঈষৎ চটল। বললো, ‘তোমার মাথা। যেখানে উঠেছ, কপালগুণে উঠে পড়েছ। একবার যখন বুড়ি তোমাকে ঠাঁই দিয়েছে, তখন আর ফেরাবে না। তাড়াতাড়ি গিয়ে বুড়ির হাতে খোরাকির পয়সা গুঁজে দাও তো! তোফা খাবে আর বেড়াবে। নইলে মরবে।’

বলে, আপন মনে বললো ফিসফিস করে, ‘এ লাইনে পয়লা হাতে-খড়ি কিনা, তাই এখনো সব ফালতু কথা নিয়ে—’

তবু ভাবছিলাম। শীতের বেলা। দেখতে দেখতে বেলা অনেকখানি বেড়ে উঠেছে। বেলা বাড়ছে আমার। মেলার কোনো বেলা নেই। মেলায় কলরব ও চিৎকার, যাওয়া-আসার শেষ নেই। ভাবছিলাম, প্রাণভরে দু’দিন ঘুরব। কত ঘোরা আমার এখনো বাকি। কত কিছু বাকি। কিন্তু ওই ক্যাম্পে থেকে আমার মনের সুখটুকু, শান্তিটুকু যাবে না তো!

কী ভেবে পাঁচুগোপাল দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো আমার দিকে। বললো, ‘দ্যাখ, একটা কথা বলব?’ গলায় আবার তার খ্যাপামির আভাস। বললাম, ‘বলুন।’

গলা আর একটু চড়িয়ে বললো, ‘তোমার মতো দেখতে ওরকম ছেলে ভালো হয় বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু তুমি যদি চলে যাও, তাহলে সত্যি বলছি, মনে বড় দুঃখু পাব। এই বলে দিলাম।’

বলে, যেমন দ্রুত ঘুরেছিল, তেমনি দ্রুত মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো সে। দাঁড়িয়ে বোধ হয় উৎকর্ণ হয়ে রহলো।

ব্যাপারটা বড়ই হাস্যকর। কিন্তু হাসতে গিয়ে পারলাম না হাসতে। হাসিটা ছুটে আসতে গিয়ে খচ করে আটকে রইলো বুকের মাঝে।

ওই ভঙ্গিতে তাকে এখন যে দেখবে, সে-ই হাসবে। তাই তো হয়। পাঁচুগোপাল তার দুঃখ দিয়ে পরকে হাসায়। ওটাই পাগলের বিড়ম্বনা। মানুষ জ্বলে-পুড়ে পাগল হয়। আমরা পাগল দেখে হাসি। বিশ্বের নিয়মটাই এমনি বিচিত্র।

সেই বিচিত্রের মতোই, পাঁচুগোপালের বিচিত্র মনের গতি কখন এক সময়ে আমার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বোধ হয় বন্ধুত্ব পেতেছে, পেতেছে মন। ভালোবেসেছে। হৃদয়াবেগের গতিই এমনি।

আসলে বোধ হয় আমাদের মতো ছেলেমেয়েদেরই সে ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি। কে জানতো, পাঁচুগোপালের মতো মানুষের সঙ্গে এখানে দেখা হবে। কে জানতো, গলা চড়িয়ে সে আবার বলবে, ‘তুমি চলে গেলে দুঃখ পাব।’ বলে ছেলেমানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে মুখ ঘুরিয়ে। যে অমনি করে বলে, তাকে ছেড়ে গেলে মনের মধ্যে অশান্তি হবে।

বললাম, ‘তাহলে চলুন, যাওয়া যাক।’

পাঁচুগোপাল মুখ ফেরাল না। আড়চোখে দেখলো। দেখে ধীরে ধীরে হাঁটা ধরল।

একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলাম। নিল না। বললো, ‘ওতে কিছু হয় না। দেও তো দু-আনা পয়সা দেও, একটু নেশা করি।’

বুঝলাম, গাঁজা কেনা হবে। কিন্তু এখানে কোথায় পাওয়া যাবে? দু-আনা পয়সা দিলাম

তাকে।

এদিক ওদিক দেখে, পাঁচুগোপাল একটি সাধুকে ডাকলো, ‘হোই বাবা। ‘

সাধু দাঁড়াল। ভিড়ের ঠেলাঠেলি। বেচারি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেয়া বেটা?’ পাঁচুগোপাল বললো, ‘থোড়া ইধার কৃপা কর বাবা।’

সাধু এলো। পাঁচুগোপাল পয়সা দু-আনা তাকে দিয়ে বললো, ‘থোড়া সপ্তমী কৃপা কর বাবা। অব শহর যানা বহুত মুশকিল।’

সাধু একবার সংশয়ান্বিত নজরে তাকালো আমার দিকে। আমি ভাবছিলাম, সপ্তমীটা আবার কী বস্তু!

সাধু জিজ্ঞেস করলো পাঁচুগোপালকে, ‘কৌনা জমাত?’

পাঁচুগোপাল জবাব দিল, ‘অব ঘর কি জমাত বাবা। চুঁড়তে হ্যায় গুরু। পহলি গুরুকে ছোড় দিয়া।’

সাধু জিভ দিয়ে করুণা ও আক্ষেপসূচক ধ্বনি করে বললো, ‘বিষ্ণু ব্রহচারীকে আশ্রমমে ভেট কর বাবা। গুরু মিল যায়েগা।’

বলে, পয়সা দু-আনা নিল। ঝুলি হাতড়ে বের করে দিল ছোট্ট একটি পুরিয়া। তারপর নমস্কার করে চলে গেল আবার।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সপ্তমীটা কী?’

পাঁচুগোপাল বললো, ‘মহাদেবের ধূমপান। যার নাম গাঁজা। অনেক সাধুদের মধ্যে গাঁজাকে ওই নামে ডাকা হয়।’

বলে পাঁচুগোপাল বিকৃত মুখে বললো, ‘হুঁ, এবার গুরু ধরবো ওর বিষ্ণু ব্রেষ্মচারীর আশ্রম! বলে, কত হাতি গেল তল, মশা বলে কত জল! ভাগ ভাগ।’

ব্যাপারটি সব বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করবো ভাবলাম। পাঁচুগোপাল তখন গাঁজা তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে।

প্রায় পনেরো মিনিট হেঁটে আবার সেই ক্যাম্পে এসে হাজি হলাম। রান্না খাওয়া, মাইকের ধর্মোপদেশ, সব মিলিয়ে আশ্রম একেবারে জমজমাট।

প্রহ্লাদ কোত্থেকে ছুটে এসে বললো, ‘ও বাবা, তোমরা বেড়ে ডুবে ডুবে জল খাও, শিবের বাবাও টের পায় না। আর আমি শালা মুখ চোকাচ্ছি তখন থেকে। খুব তুমি যা হোক ডাক্তার খুড়ো।’

প্রহ্লাদের কথাটা ঠিক অনুমান করতে পারলাম না। ডুবে ডুবে জল খাওয়ার মতো পাপ তো কিছু করিনি। যা করেছি, তা বিশ্ব-সংসারের মতে শিবের বাবাও জানেন বৈকি।

পাঁচুগোপাল ধমকে উঠলো, ‘মাকড়া। কোথাকার কাকে কী বলছিস! ছেলেটা আমাকে দু আনা দিল, তাই দিয়েই তো—’ বলে পাঁচুগোপাল মুঠো খুলে দেখিয়ে দিল পরমবস্তুটি।

প্রহ্লাদ আনন্দে পেল্লাদ হয়ে উঠলো। বললো, ‘মাইরি! ওর চলে না বুঝি? তাই বল। আমি যে এদিকে হেঁপ্পে মরছি খুড়ো তোমার জন্যে।

পাঁচুগোপাল হাত পেতে বললে, ‘কই, দেখি, আগে আসল চীজটি বার কর দিকিনি।’

বলতে না বলতে প্রহ্লাদ কয়েক আনা পয়সা তুলে দিল পাঁচুগোপালের হাতে। পয়সাগুলি পকেটে রেখে পাঁচুগোপাল বললে, ‘চলে আয় আমার সঙ্গে।

প্রহ্লাদের আনন্দ আর ধরে না। পাঁচুগোপালের পেছনে পেছনে চললো ঘাড় উঁচিয়ে। বুঝলাম, ওদের দু’জনেরই এখন অন্য কিছু ভাববার সময় নেই। আমি তো দূরের কথা। ফিরেও তাকালো না। ওতেই আনন্দ। মুঠোয় আছে প্রাণের সার। আর কিছু চাই নে।

কিম্ আশ্চর্য! নেশা নয়, পাঁচুগোপালের কথাই ভাবছি। ভাবতে গিয়ে হাসিও পেল। হাসি নয়, হাসির নামান্তর। নিজের কথা ভেবে কাউকে করুণা করতেও লজ্জা পাই। হাসিটা দুঃখের!

সবাই আমরা মনের মতো বস্তুটি খুঁজছি। মনে মনে খ্যাপা আমরা সবাই। আমাদের রকমারি বিচিত্র বেশ। পাঁচুগোপাল গাঁজা নিয়ে মাতামাতি করছে, যেন ওই ছাড়া আর কাম্য ধন নেই। কখন দেখবো, সব ফেলে চেঁচামেচি হাঁকডাক করে একই মাথায় করে তুলছে সারা কুম্ভমেলা। কিন্তু সবটাই উপরের জিনিস। মনটা কে দেখে!

হেসে ফিরতে গিয়ে দেখি কালকের সেই গেরুয়াধারী। পাঁচুগোপাল যাকে সঙ্গে করে এনেছিল। মন চমকালো। ফাঁড়া কেটেছে কিনা কে জানে! পাঁচুগোপাল তো ঠেকিয়ে দিয়ে গেল।

গেরুয়াধারী বললো, ‘হাসছেন যে?’

বললাম, ‘পাঁচুগোপালের কথা ভেবে।’

গেরুয়াধারী হেসে বললো, ‘আপনার সঙ্গে ওর আলাপ হয়ে গেছে নাকি?’

বললাম, ‘একরকম।’

গেরুয়াধারী হাসলো রহস্যের হাসি। বললো, ‘একরকম তো বটে। কী রকম সেটা বলুন।’

বলে, চোখাচোখি হতেই হেসে উঠলো সরবে। নিজেই বললো আবার, ‘থাক, আপনাকে বলতে হবে না। আন্দাজই করা যাচ্ছে। ও আমাদের কাশীর আশ্রমে এক নাগাড়ে তিন বছর ছিল এক সময়ে। তখন সাধু হয়েছিল। জ্বালিয়ে খেয়েছে আমাদের সবাইকে।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন বলুন তো?’

সন্ন্যাসী বিস্মিত হয়ে বললো, ‘ও তো পাগল। বদ্ধ পাগল। আমাদের মোহান্তকেই মারতে গেছল। কোনো কোনো সম্প্রদায়ের কিছু কিছু গুহ্য কর্তব্য করণীয় আছে তো! সেগুলো ও সহ্য করতে পারত না। সাধুদের উপরও ও খুব চটা জানেন তো?’

হবে হয়তো। কিন্তু সেরকম কোনো কথা শুনি নি তার মুখে। কোনো জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইলাম পাঁচগোপালের চলার পথের দিকে। সত্যি, বদ্ধ পাগলই বটে।

গেরুয়াধারী বলে উঠলো, ‘অবশ্য কালকে ওর কথাতেই আপনার কাছে আমাকে আসতে হয়েছিল। যাই হোক, ওগুলো আমাদের কর্তব্য তো!’

তাড়াতাড়ি বললাম, ‘তা তো বটেই।’

সে আবার বললো, ‘তা ছাড়া, আশ্রমে আপনাদের সুবিধা-অসুবিধার দিকে আমার নজর রাখাও কর্তব্য। অর্থাৎ duty। আমি একাধারে এ আশ্রমের হিসাবী, অথাৎ মুহুরী। আর একাধারে কোতোয়াল। বলতে পারেন ম্যানেজার।’

শুনে কৌতূহল হল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের আবার এসবও আছে নাকি?’

‘নেই?’ভ্রু তুলে বললো, ‘কী নেই বলুন! একটা প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে যা যা দরকার আমাদের সবই আছে। সব পাবেন এখানে। যা চাইবেন। অফিস চালাতে হলে অফিসার ম্যানেজার চাই, কেরানী চাই। সংসার চালাতে নিয়মের দরকার নেই? দরকার নেই নিষ্ঠার? আশ্রমেরও তেমনি নিয়ম আছে বৈকি। বিশেষ, বাইরে যখন আমরা জমায়েত হই। মোহান্তর নিচে আছে পূজারী, কুঠারী, কারবারী, হিসাবী, কোতোয়াল, ভাণ্ডারী, পাহারাদার, তুরীবাদক। কত কি! নইলে কি মনে করেছেন, এত বড় ব্যাপারটা আপনি আপনি হচ্ছে?

তা তো নয়-ই। কিন্তু এত সব জানতাম না। বাঙলাদেশের কোনো কোনো আশ্রমে আধুনিক নিয়মকানুনের ব্যবস্থার কথা শুনেছি। কারণ, ধর্মের গণ্ডি ছেড়ে সেখানে তাদের গতি সমাজের বুকে। কিন্তু সন্ন্যাসীর আবার এত নিয়ম কানুন কীসের! এ যে জমিদারী সেরেস্তা চালানোর ব্যাপার।

সন্ন্যাসী ব্যাখ্যা করে চললো কার কী কাজ। ভাণ্ডারী দেখবে ভাণ্ডার, পাহারাদার দেবে পাহারা। মনে হচ্ছে বুঝি, এখানে কোথায় কী ঘটছে কেউ জানে না। সব নখদর্পণে আছে। পাহারাদার নজর রেখেছে কড়া। একটু এদিক ওদিক হলে ধরবে এসে চেপে। খোয়া যাবার উপায় নেই কিছু। টাকাপয়সা? সব জমা আছে কারবারীর কছে। কারবারী হলো আশ্রমের ক্যাশিয়ার। টাকা দিচ্ছে নিচ্ছে, হিসাব রাখছে মুহুরী। একটি আধলা এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। মায় গাঁজা-সুখার হিসাবটি পর্যন্ত। হাতে নিয়ে ডললাম, হাঁক দিলাম আর কলকে ফুঁকলাম, তা নয়। যে যা পাচ্ছ, আগে জমা দাও। তারপর নিজের পাওনাটি নিয়ে ভোগ কর। তুমিও শিব, আমিও শিব। তাহলে আর কি! এসো সবাই মিলে ন্যাংটা হয়ে নাচি। উঁহু! সেটি চলবে না। আইন মেনে চলতে হবে সবাইকে। সন্ন্যাসী তো সকলেই। যে আইন দেখে আর আইন মানে। পূজারী রয়েছে। সময়মতো নিয়মমতো পুজো কর আগে। হ্যাঁ, অন্যায় অপরাধ আছে বৈকি! বিচার হয়। সবাই মিলে যে পঞ্চায়েত তৈরি হয়েছে, সেই পঞ্চায়েত বিচার করে। বিচারকর্তা মোহান্ত বলতে পারো। ওখানে বড় একটা কারুর হাত চলে না। বিচারে সাজা হয়। কতরকম সাজা আছে। জেল ফাঁসি দড়ি কেন? সন্ন্যাসীর সাজা তার চেয়েও কঠিন। কালে বুঝবে না। সাজা মানলে ভালো। নইলে বহিষ্কার! সন্ন্যাসী-জীবনের দফা গয়া। বেরিয়ে গেল তো সে মরে গেল। মৃতের সমান। তার কাজের দায় আর নিচ্ছে কে? অধিকার? সমানাধিকার? ওই কথাটা নিয়েই দেশে আজকাল বড় বাদানুবাদ, হ্যাঁ, তাই তো। যার যেমন, তার তেমন। গুণ বুঝে কদর। কাজ বুঝে দাম। আমি নারকেল গাছ। উঁচু হয়ে মাথা তুলেছি আকাশে। ফল দিই ডাব আর নারকেল। সে এক রস। ঝাপা-ঝোপা ছোট্ট আমগাছাটি দেয় আম। নিংড়ে খাও। সে আর এক রস। যারটি যেমন, তারটি তেমন বলবো। পেয়ারাকে জামরুল বলে খেলে তুমিই ঠকবে। কাজে কুঁড়ে, ভোজনে দেড়ে আর ছাই মেখে জটা নেড়ে সবার উপর তম্বি করে বেড়াবে, সেটি হচ্ছে না। তার কোন অধিকার নেই। সমান অসমান, কোনোটাই নয়।

বলে কী, এ তো দেখছি সংসারের কথা! সমাজের কথা। এই থেকেই আসে রাষ্ট্রের কথা। বললাম, ‘আপনাদের আবার এত নিয়ম কানুন কীসের! ওসব তো আমাদের। সাধারণ মানুষের।’

‘নিয়ম কানুন থাকবে না কেন? বিশ্বের নিয়ম কানুন আছে। দিন হয়, রাত্রি হয়, ঋতু বদলায় সবই সেই নিয়মের মধ্যে। মাস গেলে রোজগারটি করতে হলে, মুখে ভাত গুঁজে ছুটতে হয় না অফিসে? সকাল হলে ঝাঁপ খুলতে হয় না দোকানের? খালি অ্যালাকাড়ি বুঝি ভগবান পাওয়ার বেলায়? সেখানে আইন-কানুন নেই বুঝি? ওটা হলো ফোকোটিয়া, না? তা হবে না।’

‘কিন্তু আমরা তো জানি, সিদ্ধপুরুষেরা ভাবভোলা। সময়জ্ঞান রহিত। কখন কী করেন আর কখন কী বলেন, অন্য মানুষের তো বোঝার উপায় নেই।’

সন্ন্যাসী হাসল। হেসে বললো, ‘সিদ্ধপুরুষ? সে ক’জনা? এই যে দেখছেন, এত বড় কুম্ভমেলা আর দেশের তাবৎ সাধু সন্ন্যাসী যোগী, এর মধ্যে কার সিদ্ধিলাভ হয়েছে, কে বলতে পারে! যার হয়েছে তাকে কে চিনতে পারবে? সে যে কী বেশে, কী রূপে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে বলবে? তার নিয়ম নেই? তার নিয়মের যে চারা নেই। এই বাহ্যিক জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ কতটুকু? নিয়ম তার অন্য লোকে, অন্যখানে। সে-নিয়মের সুতোকাঠি কে দেখতে পাবে? তার যে চলতে নিয়ম, নিয়ম খেতে-বসতে।’

বলতে বলতে দিব্যি হাসি-মুখ সন্ন্যাসী গম্ভীর হয়ে উঠলো। চোখের দৃষ্টি তার স্বাভাবিক হয়েছে বলে মনে হলো না। হাত-জোড় করে আপন মনেই বলে চললো, যেখানেই থাকো, এখানে তাকে আসতে হবে। মাঘ মাসের প্রয়াগ ছেড়ে তার কোথাও যাবার উপায় নেই। কিন্তু কে চিনতে পারবে! যে মোহান্তের সঙ্গে বছরের পর বছর ঘুরে বেড়াচ্ছি, হয়তো উনিই সেই মানুষ। দত্তাত্রয়ের পাদুকা-পূজারী হয়তো ছদ্মবেশে ঘুরছে আমারই সঙ্গে সঙ্গে। কে জানে-–’

বলে, আমার দিকে চেয়ে এবার অদ্ভুত হেসে বললো, ‘এমন প্যান্ট পরে আর অলেস্টার গায়ে দিয়ে তিনি হয়তো দিব্যি ভদ্রলোক সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কি করে জানবো!’

আজ ভোরবেলা অবধূতের মুখেও যেন এমনিধারা কথাই শুনেছি। সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধক ভগবান কখন কোন্ বেশে তার সামনে দিয়ে চলে যাবে। খ্যাপা খুঁজে খুঁজে কখন পরশ পাথরটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যাবে নদীর জলে। এমনি একটি বিশ্বাস যেন এদের সকলের মনে রয়েছে। সেই বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে একটি বিচিত্র আবেগ ও ভক্তি। তাই, ওই কথা বলতে গেলেই ভক্তি ও বিশ্বাসের আবেগে সে হঠাৎ অন্য মানুষ হয়ে ওঠে। এখানে আমার বক্তব্য ও মন্তব্য, ও দুই-ই নিষ্প্রয়োজন।

সন্ন্যাসী নিজেই আমায় পরিষ্কার গলায় বললো, ‘যাক, ওসব কথা পরে এক সময় হবে। বিকেলে রামজীদাসী আসছেন। কোথাও যাবেন না যেন।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তিনি কে?’

‘সে কি, রামজীদাসীর কথা শোনেন নি? তিনি একজন সাধিকা। আমাদের মাইকে তো অনেকবার বলা হচ্ছে আজ সে কথা। তিনি প্রতিদিন এক-একটি আশ্রমে ঘুরে বেড়াবেন। খবর পাঠিয়েছেন, আজ এইখানে আসবেন। তিনি হিমাচল প্রদেশের মেয়ে। এলে বুঝতে পারবেন সব। আপনার আর দেরি করাব না, অনেক বেলা হলো।’

বলে, যাবার উদ্যোগ করে ফিরে দাঁড়ালো আবার। বললো, ‘আপনার তাঁবু চিনতে পারবেন তো?’

পারবো না কেন, তাঁবুর সারির দিকে ফিরে তাকালাম। সর্বনাশ! তাই তো, সবই একরকম দেখতে, আর একেবারে গায়ে গায়ে। বেরিয়েছিলাম রাত্রি থাকতে। কোনখান থেকে বেরিয়েছিলাম মনে থাকার কথা নয়। তা ছাড়া এমনিতে বোঝা মুশকিল। সেই রেল কলোনির ব্লকের মতো, না চিনে খালি পরের বাড়ি উঁকিঝুঁকি। নির্দোষকে শুনতে হয় কটুক্তি।

আমার বিভ্রান্তি দেখে গেরুয়াধারী হাসলো। গেরুয়াধারী নয়, কোতোয়ালই বলা যাক। বললো, ‘কেমন, ঠিক ধরেছি তো? অবশ্য দু-একদিন গেলে ঠিক চিনতে পারবেন। তবে প্রথম প্রথম বড় অসুবিধা হয় নিজেই বুঝি। তবে তার দরকার হবে না। ওই যে তাঁবুটা দেখছেন, একটি বুড়ি বসে আছে, তার ডানদিকের তাঁবুটা আপনাদের। দেখবেন, খড়িমাটি দিয়ে হিন্দিতে লেখা আছে বারো নম্বর।

হেসে বললাম, ‘সত্যি, আপনি না বললে ভারি বিপদে পড়তাম। কিন্তু একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব।’

‘করুন।’

‘আপনি কি বাঙালি?’

কোতোয়াল হাসলো। হাসিটি সব সময়েই একটু অর্থবোধক। বললো, ‘এটা কি খুব বড় কথা? তবে হ্যাঁ, আমি বাঙালি। জন্মেছিলাম বাঙলাদেশেই। দেখুন, মানুষের জিজ্ঞাসার অন্ত নেই, আর অন্ত নেই জবাবের। আমি হয়তো আপনাকে সব কথার জবাবই দিতে পারবো না।’

বলে, হেসে চলে গেল কোতোয়াল। অদ্ভুত ভদ্র তো লোকটি! প্রশ্ন না করার অভিপ্রায় জানিয়ে গেল হাসতে হাসতে।

ওদিকে মঞ্চের উপর মোহান্ত। তার পাশে বসে গায়ক ধরেছে গান। গলা মিলিয়েছে তানপুরার সঙ্গে। একটি করে গান হয়। গানের শেষে মোহান্ত উপদেশ দান করেন, ধর্মের কথা শোনান।

ভিড়ও হয়েছে কম নয়। অধিকাংশই এই আশ্রমের নরনারী নয়। যেখানে হোক ছুটে ছুটে এসে বসেছে সবাই। কোথাও বসে কিছুক্ষণ ধর্মের গীত ও বাণী শোনা নিয়ে কথা। এর মধ্যেই চলেছে দেখছি নানান গল্পগুজব। সামনেই দাঁড়িয়ে হেসে জটলা করছে জনা পাঁচ-ছয় পাঞ্জাবী মহিলা। পায়জামা, পাঞ্জাবি আর ওড়নার রঙ রূপে একগোছা ফুলের মতো রয়েছেন ফুটে। কীসের কথা, বুঝি নে। হাসিতে বাজছে শত নূপুরের রিনিঝিনি। তাই দেখে কয়েকজন মহিলা রয়েছেন চোখ বাঁকিয়ে। ভাবখানা, হাসতে হয় বাইরে গিয়ে হাসো, এখানে কেন?

কয়েক বিঘা জুড়ে আশ্রমের পরিধি। কতকগুলি অপোগণ্ড দিব্যি চালিয়েছে ছুটে ছুটে খেলা। ধরাধরি আর পাকড়াপাকড়ি। তাদের হঠাৎ-হাসির ঝলকে চমকে তুলছে আশ্রমের গুরুগম্ভীর জমায়েত ও পরিবেশ। এদিকে বাতাসে ভাসছে ঘিয়ের গন্ধ। তারই সঙ্গে সঙ্গে যেন বাঙলা রান্নার ফোড়নের পরিচিত গন্ধটিও নাকে এসে লাগছে।

তাঁবুর সামনে এসেও ভাবনা। আধাআধি বখরা। কোন্ দিকেরটি? বোধ হয় বাঁ দিকেরটিই। সামনে পর্দার মতো ক্যাম্বিসের ঢাকনা। তুলে দেখবো হয়তো অন্য লোক।

তুলে দেখলাম, সত্যি তাই। হাঁটু মুড়ে বসে একটি ছোট মেয়ে। বোধ হয় বাঙালি। ফ্রকের ওপর গাছকোমর করে বাঁধা রঙিন তাঁতের শাড়ি। ঘাড়ের কাছে ঝুলছে বাসি বিনুনি। কিছু একটা গালে পুরে, গাল ফুলিয়ে দিব্যি চিবুচ্ছে আর মাথা নেড়ে নেড়ে গুনগুন করছে। এক মুহূর্তের ব্যাপার। নজরটা তীক্ষ্ণ করলাম। সিঁথিতে সিঁদুর রয়েছে মনে হলো। আর মনে হওয়া! মনে হতে না হতেই মেয়েটি অস্ফুট চিৎকারে একেবারে লাফ দিয়ে উঠল। তড়িঘড়ি করে খুললো গাছকোমর। বাঁধা আঁচল খুলেই মাথার উপর টেনে একেবারে কলাবউ! কোল থেকে ছড়িয়ে পড়লো একরাশ টোপা টোপা বিলিতি কুল।

ছি ছি ছি, আমারই ভুল। বালিকা যে আমাদের পেল্লাদের পরিবার। লজ্জার চেয়ে হাসি পেল বেশি। তার চেয়ে বেশি বিস্ময়। এক ফোঁটা মেয়ের সর্বাঙ্গে এ লজ্জা এলো কেত্থেকে! অন্য দেশের মেয়ে কেন, আজ নিজের দেশের এমনি মেয়েরাই তো এ বয়সে বই-শ্লেট নিয়ে দিদিমনির দারস্থ হয়। অবশ্য পুতুলরূপী পুত্রকন্যাদের বিয়ের ভাবনায় এখন থেকেই ভাবী শাশুড়ী হওয়ার মক্‌শ করা হয়। দিব্যি মাথার উপর বউ দিয়ে, অর্থাৎ ঘোমটা টেনে বউ বউ খেলা হয়।

কিন্তু এ যে সত্যি বউ! মাথায় উঠলো কুল খাওয়া। পরপুরুষের সামনে এ যে রীতিমতো লজ্জাবতী বাঙালি বধূ। কালকেও দেখেছি। কিন্তু শাড়ির আড়ালে প্রহ্লাদের পরিবারটি এত ছোট, তা অনুমান করতে পারিনি। শত হলেও পরস্ত্রী। ইচ্ছে হলেও কী করে বলি, খুকি, কুল কটা খেয়ে নাও। খুকি বলা দূরের কথা, তুমি করে বলাটাই সমীচীন কিনা বুঝতে পারছি নে।

কিন্তু বেচারা এমন জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছু না বলাটাও ঠিক নয়। আহা, ছড়ানো টোপা কুলগুলোও বালিকার আঁচলহারা হয়ে বিষন্ন হয়ে উঠেছে।

না, অত আর অগ্রপশ্চাৎ ভাবা চলে না। বললাম, ‘কুল কটা কুড়িয়ে নাও।’

বলার অপেক্ষা মাত্র। অমনি ছোট্ট হাত বাড়িয়ে টুকটুক করে আঁচলজাত করলো কুলগুলি। করেও আবার দাঁড়িয়ে রইলো তেমনি।

বললাম, ‘এবার খাও। আমি ততক্ষণ জামা কাপড় ছাড়ি।’

বলে, ওভারকোটটা খুলতে গিয়ে দেখি, বালিকা ঘোমটার আড়াল থেকে দিব্যি পিটপিট করে দেখছে আমার দিকে। বোধ হয় যাচাই করা হচ্ছে আমাকে। চোখাচোখি হতেই আবার আড়াল হলো মুখ।

মনে মনে ভারি হাসি পেল। ওভারকোট ছেড়ে জামা খোলবার উদ্যোগ করছি। ভাবছি, প্রয়োজনীয় দু-একটি কথা জিজ্ঞেস করবো কিনা একে। ভাবতে ভাবতেই এক অভাবিত ব্যাপার।

প্রহ্লাদের পরিবার ফরফর করে বাইরের পর্দার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ ঘোমটার আড়াল থেকেই ঝাঁজমিশ্রিত বালিকা কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘কোথায় যাওয়া হয়েছিল। দিমা আসুক, দেখাবে’খনি।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে একেবারে অদৃশ্য। বিস্ময়ে আমি জিভটা কামড়ে ফেললাম কিনা সেটুকুও মনে নেই। এ যে বিনা মেঘে বজ্রপাত! জামা খোলার উদ্যোগ করে যেমন দাঁড়িয়েছিলাম, দাঁড়িয়ে রইলাম তেমনি। আমাকেই বললো তো! রীতিমতো শাসন! শাসন নয়, ঝগড়া ঘোষণা করে গেল। আর আমি কোথায় ভাবছি, ঘোমটা-ঢাকা এক লজ্জাবতী বালিকা মাত্র। কুলের শোকে কেঁদে না ফেলে। সে যে এমনিধারা মুখ ঝামটা দিতে পারে কে জানতো! বাইরে মাইকে ব্যাখ্যা হচ্ছে মাণ্ডুক্যোপনিষদ। আর আমি একলা এই তাঁবু কোটরে পাগলের মত হেসে উঠলাম। কুম্ভমেলায় এমনি এক বাঙালি গিন্নিও যে আছে, তা কি কেউ জানে।

একটু পরেই দেখি যে, আবার এসে হাজির। ঘোমটার আড়াল আছে ঠিক তেমনি। এসে ছোট্ট একটি তেলের শিশি রাখল আমার সামনে। রেখে বসল গিয়ে আবার নিজের জায়গায়। যেখানে বসেছিল আগে। বসার পর ঘোমটার আড়াল থেকে শাসানির সুর শোনা গেল, ‘তাড়াতাড়ি নেয়ে এসো। দিমা বলে দিয়েছে। নইলে দেখবে’খন।’

সত্যি আর দেখাদেখির দরকার নেই। কিন্তু তেল মাখব কী করে? তীর্থক্ষেত্রে তো তেল সাবান মাখা বারণ। বললাম, ‘তেল দিলে কে? দিদিমা?’

এক মুহূর্ত চুপ। তারপর একটু চাপা গলা শোনা গেল, ‘না। আমিই এনেছি। চটপট নাও। নইলে দিমা আমার মুণ্ডপাত করবে।’

লুকিয়ে তেল এনেছে! এতখানি দয়া সুবুদ্ধি তার হয়েছে! প্রহ্লাদের পরিবারটি দেখছি শুধ কাঁচা নয়, হৃদয়টি তার রীতিমতো কাঁচামিঠের স্বাদে অপূর্ব। এরপর বালিকা বলে অবজ্ঞা করব তেমন সাহস আমার নেই।

নির্দেশ মাত্র খালি গায়ে বসে গেলাম তেল মাখতে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিদিমা কী করছে?’

বালিকার মেজাজটি সব সময়েই যেন চড়ে আছে। বললো, ‘কী আবার করবে, রান্না করছে। তোমাদের মতো তো নয় যে, খালি টো-টো করে বেড়াবে।’

বলার পরই কটাস করে একটি শব্দ উঠলো ঘোমটার মধ্যে। বুঝলাম, একটি ডাঁশা কুলে কামড় পড়ল।

কিন্তু এত ভর্ৎসনা কেন? বকুনিটা প্ৰহ্লাদকে নয় তো? মুখ দেখতে পাচ্ছি নে। কিন্তু বুঝতে পারছি, বালা গিন্নির চোখে-মুখে কথা! জবাব দিতে গেলে এঁটে ওঠা দায় হবে। শত হলেও ওই দিমার নাতবউ তো!

কিন্তু সত্য কোনটি? ওই ঘোমটা, না খর কণ্ঠের ধমকানি? বোধ হয়, উভয়ই। তা হোক, তবু শাসন আর ধমকানির রূপ কী বিচিত্র উপভোগ্য! বিচিত্রের সন্ধানে ফিরি। ঘরের কানাচে চারাগাছের পাতায় পাতায় যে বড় বৈচিত্র্য, তা তাকিয়েও দেখি নে। দেখতে জানি নে, তাই দেখি নে।

একটু বা ভয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নামটি কী?’

অমনি কুল-পোরা মুখের ফোলা গাল নিমেষে দেখা দিল একবার। দেখা দিল দু’টি ডাগর চোখ। চোখে সেই বকুনির আভাস। ভাবখানা, বউ মানুষের আবার নামের দরকার কী?

তারপরেই ঘোমটার তল থেকে জবাব এলো, ‘কী আবার, ছিরিমোতি বেরজোবালা দেবী।’ অর্থাৎ শ্রীমতী ব্রজবালা দেবী। তাকে বালিকা, তবু ব্রজবালা বলে তো আর ডাকতে পারিনে তাকে! মনে মনে হেসে বললাম, ‘আচ্ছা, তোমাকে আমি না হয় বৌঠান বলেই ডাকব, কী বল?’

‘বৌঠান?’ বলে, বিস্মিত গলার অস্ফুট একটি শব্দ শোনা গেল। তারপরে হাসি। ফিকফিক করে হাসতে হাসতে একেবারে খিলখিল হাসিতে তাঁবু-কুটির চমকে উঠলো। বুঝলাম, কথাটি। ভারি খুশি করেছে তাকে। হাসতে হাসতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললো, ‘আচ্ছা, বোলো।’

ইতিমধ্যে ঘোমটা উঠে গিয়েছে মাথার মাঝখানে। পরমুহূর্তে আবার অন্য ভাব! বেশ খানিকটা ঝুঁকে, চাপা গলায় চোখ বড় বড় করে বললো, ‘এখানে একটা ভীষণ কিপটে বুড়ি আছে, জানো? ঠিক পয়সা চাইবে তোমার কাছে। সকলের কাছে খেতে চায়। সব্বাই বলেছে, বুড়িটার অনেক পয়সা আছে। তুমি দিও না যেন!

‘তাই নাকি?’ গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘কখনো দেব না।’

ঘোমটাটি এবার ঘাড়ে নেমেছে। কিন্তু সেদিকে ব্রজবালার খেয়াল নেই। বোধ হয়, এতক্ষণে সে একটি সঙ্গী পেয়েছে। কথা তার এখনো শেষ হয়নি। আবার তেমনি চাপা গলায় বললো, ‘জানো, একটা খুব সোন্দর বউ এসেছে এখানে। কী চোখ, কী মুখ! আমার চেয়েও মাথায় বড় বড় চুল। সেই বউটা না, কারুর সঙ্গে কথা বলে না কেন জানো?’

থতিয়ে গেলাম প্রশ্ন শুনে। ‘অ্যাঁ? তা তো জানিনে।’

আমাকে অপ্রতিভ দেখে ব্রজবালার ঠোঁট দু’টি করুণভাবে উলটে গেল। বললো, ‘জানো না তো? তার স্বামী নাকি দশ বচ্ছোর আগে সাধু হয়ে বেরিয়ে গেছে। সেইজন্যে দেওরের সঙ্গে এখেনে এসেছে। এখেনে দেশের সব সাধুটাধু আসে কিনা, তাই এসেছে। যদি খুঁজে পাওয়া যায় তাই।’

কে সেই নির্বাক সুন্দরী বউ, তাকে দেখি নি, জানিও নে কিছু। ‘তাই নাকি’ ছাড়া ব্রজবালাকে কী বলতে পারি! রীতিমতো সিরিয়াস হয়ে বললাম, ‘তাই নাকি?’

ব্রজর ছোট্ট মুখে কী বিচিত্র ব্যথিত বিস্ময়ের অভিব্যক্তি! বললো, ‘হ্যাঁ গো। আমি দেখেছি যে! আচ্ছা তোমাকে চুপিচুপি দেখিয়ে দেবখনি।’

চুপি চুপি সেই দেখাটা কতখানি বুদ্ধিমানের কাজ হবে জানি নে। আপাতত বলতে হলো, ‘আচ্ছা।’

কিন্তু ব্রজবালার কথা তখনো শেষ হয়নি। রামধনুর রঙের খেলা তার চোখে-মুখে এই একরকম। তারপরেই আর-একরকম। আচমকা তার মুখে ফুটল এক দিশেহারা ভয়ের চিহ্ন। বললো, ‘জানো, এখেনে বড় চোরের উপদ্দোরব।’

উপদ্দোরব নিশ্চয়ই উপদ্রব। ভাষাটাই একটা উপদ্রব বিশেষ। কিন্তু কী চুরি হলো ব্রজবালার? আমার ভাবনার ফাঁকে ব্রজ আবার হেসে কুটিপাটি। বললো, ‘জানো, আজ ভোর রাত্রে সবাই একটা চোরকে তাড়া করেছিল। মেয়েমানুষ চোর!’

মেয়েমানুষ চোর! কিম্ আশ্চর্যম্! এত গুঢ় সংবাদ ব্রজবালা কী করে সংগ্রহ করলো! এ হে রীতিমতো খবরের কাগজের রিপার্টোরের চেয়েও দুরূহ কাজ। জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেয়েমানুষ কী করে জানা গেল?’

ব্রজ কুলের বিচিটিকে এবার মুখ থেকে মুক্তি দিল। চোখ বড় করে বললো, ‘ওমা! সব্বাই বলছে। তা ছাড়া, সে যে আবার এসেছিল। দ্যাখো নি, পুবদিকের বেড়া অনেকটা ভেঙে ফেলেছে। সেখান দিয়ে সকালবেলা মাথা গলিয়েছিল। একজন দেখে ফেললো, তাই তো আবার পালিয়ে গেছে।’ তারপর গলাটি আরও চেপে বললো ব্রজবালা, ‘মেয়েমানুষটা নাকি খারাপ। ওকে ধরতে পারলে না—পুলিশে দিয়ে দেবে বলেছে, হ্যাঁ। ডবল সিরিয়াস হওয়া যায় কিনা জানি নে। আমি গলার স্বরটা অদ্ভুত রকম করে আবার বললাম, ‘তাই নাকি?’

ব্রজ তার ছোট্ট, সুন্দর মুখটি বেঁকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ গো’

পরমুহূর্তেই ব্রজবালার চোখ দু’টি চকিত আগুনের ঝিলিকে জ্বলে উঠলো। বললো, ‘হ্যাঁ গো! সেই মেয়ে চোরটাকে আমি নিজের চোখে দেখিচি। খু-উ-ব সোন্দর। ধবধবে গায়ের রঙ। একজন নয়, ওরকম অনেক আছে। দিমা বলেছে, ওরা নাকি ছেলেও চুরি করে।’

চোখ কপালে তুলে বলতে হোল আমাকে, ‘সর্বনাশ।’ তারপর বললাম, ‘একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, ‘যাকগে, যার ছেলে নেবে তার ছেলে নেবে। তোমার তো ছেলে নেই।

ওমা? ব্রজবালার ঠোঁট ফুলে উঠলো অমনি ওই টোপা কুলের মতো। পাকা বউটি মতো টেনে দিল ঘোমটা। কী ভাগ্যি, মুখ ঢাকা পড়েনি। দুশ্চিন্তাভরা ডাগর চোখ দুটি তুলে বললো, ‘তা বলে ভাবনা নেই বুঝি? তোমার দাদা বলছিল, ওকেও নাকি চুরি করে নিয়ে যেতে পারে।’

আমার দাদা! মানে পেল্লাদ? তা, ব্রজবালাকে যখন বৌঠান বলেছি, প্রহ্লাদ আমার দাদা বৈকি! কিন্তু কী অকপট হৃদয় ব্রজর! কী অকুণ্ঠ বিশ্বাস! কী অপরূপ তার ভঙ্গি! কে বলবে, এ এক নাবালিকা বধূ! ভারি হাসি পেল। সাহস হলো না হাসতে। তা হলে অনর্থ ঘটবে না!

সত্যিই, পেল্লাদ তো শুধু বর নয়, ও যে ছেলেও বটে! ব্রজর খেলাঘরের ছেলে, ব্রজর আঁচল-চাপা ছেলে, হৃদয়-জোড়া ছেলে, ব্রজর সংসারের একমাত্র ছেলে। হলোই বা সে লিকলিকে কালো গঞ্জিকাসেবী। ব্রজবালার ছোট্ট বুকে ভাবনার অন্ত কোথায়!

কী বিচিত্র সংসার! আর ধন্য প্রহ্লাদের রসজ্ঞান। সে তার এ নাবালিকা প্রিয়াকে কী বলে এমন এক অসহায় ভাবনায় ফেলেছে!

বললাম, ‘তোমার অত ভাবনা কীসের? আমি তো আছি!

বুক ফুলিয়ে বলি নি। খালি গায়ে তৈল মর্দনে বুকটা এমনিতেই টান হয়েছিল একটু। কিন্তু ব্ৰজ বৌঠান তাতে ভরসা পেল বলে মনে হলো না। এক মুহূর্ত দেখলো আমাকে ঘাড় কাত করে। চোখে চাপা সংশয়। তারপর একটি টোপা কুলে কামড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘বে করেছ?’

হঠাৎ বিয়ের কথা! বললাম, ‘কেন?’

ব্রজবালা বললো, ‘আইবুড়ো ছেলেদের ভয়-ই তো বেশি, জানো না?’

জানি নে আবার! কিন্তু ব্রজও যে সেটুকু জানে, তা আবার আমি জানতাম না। দেখি যত, অবাক মানি তত। ব্রজর যৌবনের সোনার কুঁড়ির পাপড়ি এখনো দল মেলেনি। বহু সংসারে আগে-পাছে চোরাবালি। তার রকমই বা কত! সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে, সন্তর্পণে পা টিপে টিপে চলেছে বাঙলার চিরকালের যে মেয়েটি, সে মেয়েটি কিন্তু এর মধ্যেই প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে ব্রজবালার মধ্যে। ফুলফলহীন লকলকে লাউ ডগাটির মতো। ভবিষ্যতের বিরাট সম্ভাবনা তার ওই চরিত্রের মধ্যে। সংসারের ফুল আর ফল চাপা আছে ওই চরিত্রের মধ্যে। চরিত্রই তো রূপ। ওই রূপ-ই তো চরিত্র। হাঁড়ি-কড়া-ঘর-পুরুষ ক্ষেত-খামার-মরাই-লক্ষ্মী, সব আগলে সামলে চলার সংগ্রামী প্রবৃত্তি। ওইটিই তো আদিম প্রবৃত্তি।

ব্ৰজ বালিকা! তা আমি জানি। তবু, সংসারের সব ভালোমন্দ বোঝার মধ্যে তার পাপ কোথায়? অকাল-পক্কতা? কিন্তু ওই দিয়ে তার সংসারের প্রথম পাঠ শুরু। দিদিমণির ক্লাসরুমে যে সে যেতে পারে নি, সেটা জাতির দুর্ভাগ্য। ব্রজর চেয়ে সরলা কে আছে! দিল্লি সেক্রেটারিয়েট থেকে ঘরামি পাড়ার পুরুষটি পর্যন্ত, ব্রজবালাদের না হলে যে সকল সংসারের ভিত-ই বালি আর বালি। ভিত গড়ার সেই বজ্র-আঁটুনি আঠাল মাটি কোথায়! ব্রজকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, ‘বিয়ের কথা বলছ? সে কাজটি আমি অনেক আগেই সেরে রেখে দিয়েছি। ওই মেয়ে-চোর আমার কিছু করতে পারবে না।’

বললো, ‘সত্যি বলছ?’

হেসে বললাম, ‘মিছে মনে হলো?’

ব্রজ গম্ভীর হয়ে বললো, ‘বলা যায় না। আজকালকার ছেলেরা তো এ বয়সে বে করে না। তোমাকে চোখে চোখে রাখা দরকার বাপু। কী জানি কী হয়! বলা তো যায় না!’ ব্রজর শঙ্কাব্যাকুল চোখের দিকে তাকিয়ে হাসি আর বাধা মানতে চায় না। মনে মনে বলি, বটে! সেই ভালো। এই মেলা জুড়ে খু-উ-ব সোন্দর চোর-মেয়েরা রয়েছে ছেলে ধরার ফাঁদ পেতে। তার মাঝে, ব্রজর চোখে চোখে থাকার চেয়ে নিশ্চিন্ততা আর কী থাকতে পারে!

তবু বললাম, ‘কেন, তোমরা বুঝি আজকালকার ছেলেমেয় নও?’

কোঁচড়ে তার অগুন্তি কুল। আর-একটাতে কামড় বসিয়ে গম্ভীর বালিকা বললো, ‘হলেই বা।’ তারপর মুখের কুলটি গালে আটকে রেখেই বললো চাপা গলায়, ‘তোমার দাদা তো ভালো মানুষ না। ব্যামোয় ভোগে তবু নেশা-ভাঙ করে। যদি আর কিছু করে, তাই দিমা আগে থাকতেই বে দিয়ে দিয়েছে। পুরুষ মানুষ তো!

পুরুষ মানুষ তো! ওই কলঙ্কটি আর আমাদের ঘুচল না। যেমন ওদিকে একটু মাথা বেড়ে উঠলো, দেখা দিল গোঁফের রেখা, আর অমনি আমরা উঠলাম মাথা ঝাড়া দিয়ে। দিবানিশি মন আনচান। গুমরে উঠছে বুকের মধ্যে, পরান যারে চায় তারে নাহি পায়। কোথা গেলে প্রাণসখী, দেখা দেও, এ পোড়া লয়নপথে। অচিরাৎ বাবা মা আর ঠাকমা দিমার দল বিস্মিত উৎকণ্ঠায় চমকিত। ওমা! ড্যাকরার যে মরণ ধরছে গো! ড্যাকরা, অর্থাৎ হাতে পায়ে বেড়ে ওঠা ডাগর ছেলেকে ওটি স্নেহের গাল। মরণ ধরেছে কীসের? না, মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। অমনি একটি ব্রজবালাকে এনে ঘুরিয়ে দিল সাত পাক। ওই-ই হলো মরণ। ব্যাস, ড্যাকরার সব জারিজুরি খতম। তখন ব্রজবালা একাই একশো।

কথাটা আর নিছক সত্য না হোক, সত্য আংশিক। যুগে যুগে পালটাচ্ছে রূপ। কিন্তু মেয়েদের বেলা? সে তর্ক করবো কার সঙ্গে? প্রহ্লাদ অত বড় একটি প্রমাণ। ব্রজর কাছে হারমানা ছাড়া উপায় কী! তবু বললাম, ‘তা, সে আর কিছু করে না তো?’

দপ করে জ্বলে উঠলো বালিকা ব্রজ। ওইটুকু মেয়ে। খসা ঘোমটা, দোলানো বেণী। ডাগর চোখে চমক কী! যেন ধব্ধকে আগুন! এক ফোঁটা নীল বিষের মতো নাকছাবিটিও জ্বলে উঠল ঝিকিমিকি। কুল মুখে তুলতে ভুলে গেল। বললো, ‘করুক না একবার, দেখি।’ ব্রজর মূর্তি কী! ভয় ধরে গেল আমারই। ওইটুকু মেয়ের এত আত্মসম্মানবোধ! অনাচারে এত ঘৃণা! স্বাধিকার-জ্ঞান এতখানি?

মনে আমার হাসি বিস্ময়, দুই-ই। বললাম, ‘যদি করে?’

‘যদি করে?’ ব্রজ তাকালো তেমনি করেই। অসহায় রাগে বেঁকে উঠলো ঠোঁট। যেন টঙ্কার-দেওয়া ধনুকের ছিলা। আবার বললো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে, ‘ইস্। করুক তো!’

আমিও যেন খেলাচ্ছলেই বললাম আবার, ‘তবু যদি করে?’

ব্রজর চোখে রক্ত ছুটে এলো। তার সারা মুখে চকিত আলোছায়ার ঝিলিমিলি। নিশ্বাস দ্রুত। গলার শিরা থেকে ঠোঁট কেঁপে উঠলো থরথর করে। আচমকা যেন ফণা মেলল ফণিনী। বললো, ‘তবে চলে যাব।’

অবাক হয়ে বললাম, ‘কোথায়?’

বলতে বলতেই দেখি, বালিকার দুই চোখে জলের ধারা। চাপা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললো, ‘যেখানে মন চায়, চোখ যায়, চলে যাব সেখানে। ঠিক, হ্যাঁ।’

আমি চকিত লজ্জায় ও ব্যথায় এতটুকু হয়ে গেলাম। ছি ছি ছি। মনে মনে হেসে ফেলছিলাম। বালিকা ভেবে তার ছোট্ট হৃদয়টুকুর সঙ্গে পেতেছিলাম খেলাপাতি। কিন্তু সে, খেলা যে বালিকার এতখানি বাজবে, তা কে জানতো! আবার বলি—

জনম অবধি হম রূপ নেহারলু
নয়ন না তিরপিত ভেল।

বাল্যবিবাহের স্বপক্ষে আমার যুক্তি নেই। কিন্তু যে দেহলতায় ফোটে নি ফুল, তার হৃদিসায়রে ফুটেছে ভালবাসার পদ্ম। কে অস্বীকার করবে, বালিকা ভালোবেসেছে। ওই প্রহ্লাদ প্রাণেশ্বর হয়েছে ব্রজর। তাই এত রাগ, এত ব্যথা, এত কান্না।

নিজেকে ধিক্কার দিয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘ওকি, তুমি কাঁদছ কেন? আমি এমনি বললাম। তাই কি কখনও হয়? অমন সুন্দর বউ।’

জলভরা চোখেই ব্রজ আমাকে দেখলো একবার চকিতে, তারপর মুখ ফিরিয়ে মুছল চোখের জল। আমি হেসে আবার বললাম, ‘এঃ, তুমি ভারি ছেলেমানুষ বৌঠান। তোমার মতো বউকে কেউ ঠকাতে পারে?’

অমনি হাওয়া এলো, মেঘ গেল। আকাশ নীল ঝকঝকে। ব্রজর আলোকিত মুখে মিটিমিটি হাসি। লজ্জা পেয়েছে একটু একটু।

মনটা তার অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, ‘তা কুম্ভমেলায় কেন এলে ছুটে?’

ব্রজ পরিষ্কার বললো, ‘ওর জন্য।’

ওর জন্য, অর্থাৎ প্রহ্লাদের জন্য। বললাম, ‘কেন?’

ব্রজ বললো, ‘দিমা বললে।’

‘কী বললে?’

ব্রজ একটু চুপ করে রইলো। হাত দুখানি এলিয়ে পড়েছে নিজের ছোট্ট কোলে। দু’টি ছোট ছোট শাঁখায় সোনালি প্যাঁচ, পাতলা নোয়া আর চুড়ি। আবার ঘোমটা দিয়েছে টেনে। টেনে দিতে বড় ভালো লাগে বোধ হয়। বললো, ‘কী আবার! বললে, এখেনে তিপুন্নিতে নাইতে হবে, আর…’

তিপুন্নি হলো ত্রিবেণী। বললাম, ‘আর?’

‘আর ওর যেন ব্যামো সেরে যায়। মতিগতি ভালো হয়। ওর যেন একশো বছর পরমায়ু হয়।’

কী গম্ভীর ব্রজবালা! কত গভীর তার কণ্ঠ, তার যত হাসি, তত রাগ। ততোধিক গাম্ভীর্য। ব্রজবালা বালিকা। আর সমাজ আমাদের অজস্র কুসংস্কারে ঠাসা। অভিলাষ ও অভিপ্রায় নিয়ে আমরা কখনো পড়ি বদ্ধ জলায়, যাই কখনো অন্ধকারে।

কিন্তু কোথায় বালিকা ব্রজবালা! দিদিমার কাছ থেকে জীবনের পাঠ নিয়ে যে কথা সে বললো তাতে দেখি সে বালিকা নয়, যুবতী নয়, বৃদ্ধা নয়, ব্রজবেশিনী সে এক মঙ্গলচারিণী নারী। সুখে, দুঃখে, কামনা ও বাসনায় অতি সাধারণ ও অসাধারণ মানুষী। তার সেই আদিম বাসনা। সেখানে তো কুসংস্কার নেই। কবিগুরুর শেষ জন্মদিবসের উক্তি মনে পড়ছে, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সে বিশ্বাস আমি কোনোদিন হারাইনি। সেই মানুষের এক বিচিত্র রূপ নিয়ে সামনে আমার ব্রজ।

ক্ষণিকের জন্য মন আমার আবগে আপ্লুত। রূপমুগ্ধ হৃদয় বোবা হয়ে গেল। মানুষ খোঁজার ছলে খুঁজি মন। সে-কথাটি মনে নেই। রূপসায়রে ডুবে দেখি, তলিয়ে গিয়েছি হৃদিকুম্ভে। ওইটি কি মন?

এসেছিলাম অমৃতের সন্ধানে। তাঁবু-খুপরিতে পেলাম ব্রজবালাকে। বালিকা বধূ। মুখে তার পাকা পাকা কথা। আমার মনে কুসংস্কার নেই। তবু, নব্য-সংস্কারবাদী আমার শহুরে মনের নতুন কাটা খালের জলে আর-এক জলের বন্যা এনে দিল সে। এই পরম বিস্ময় ও খুশিটুকু ঘরছাড়া মনের অনুভূতির থলিতে দিল সে ভরে। আমার পথের সঞ্চয় ও লাভের থলি।

হঠাৎ তাঁবুর পেছন থেকেই শোনা গেল চেরা বংশধ্বনি, ‘বেরজো, মুখপুড়ি গেলি কোথায়?’

বোঝা গেল, রান্নার স্থান তাঁবুর পেছনেই। একাধিক হাতা-খুন্তির ঘটং ঘটং শব্দ আসছে ভেসে। ব্রজ লাফ দিয়ে উঠলো। চেঁচিয়ে বললো, ‘কী বলছ?’

বলেই কুলে কামড়। বিলিতি কুল নামক বস্তুটি দেখছি তার ভারি প্রিয়।

জবাব এলো সেই কণ্ঠে, ‘তেলের শিশিটা কোথায় গেল?’

চমকে উঠে ভীত চাপা গলায় বললো, ‘ও মা গো!’ বলেই গালে হাত। আমারও অবস্থা তথৈবচ। সারা দেহ আমার তৈলাক্ত। যদি আসে তা হলে আর লুকোবার উপায় নেই।

ব্রজ ভীত, কিন্তু ঠোঁটের পাশে তার চাপা হাসির ঝিলিমিলি। চেঁচিয়ে বললো, ‘তেলের শিশি? আমি তো জানি নে দিমা।’

বলেই চাপা গলায় ব্রজর কী হাসি! আমাকে বললো, ‘শিগগির পালিয়ে যাও।’ তাড়াতাড়ি গামছা খুলে দিলাম গায়ে। ব্ৰজ ছোঁ মেরে তুলে নিল তেলের শিশি। তার ছোট্ট দেহের চেয়ে অনেক বড় শাড়ির তলায় তা নিমেষে হলো অন্তর্হিত। কোথায়, তা সে-ই জানে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে তার আবার একটু করুণা হলো বোধ হয়। সে বউ। নাত-বউ। তার হাসি-কান্না সব ছাড়িয়ে তবু সে বালিকা। খেলা তার যাবে কোথায়! আর আমার মতো দেবরের সঙ্গে সে পাতিয়েছে খেলা। ছাড়ে কখনো! কাছে এসে চুপি চুপি বললো। তাও বললো অনেক কষ্টে। মুখ ভরতি যে কুল। বললো, আমার পিছু পিছু এস চলে। জলের কলটা দেখেছ তো? ঢুকে পড়বে আর আমি চলে যাব, অ্যাঁ?’

তাই হোক। চললাম ব্রজবালার পশ্চাতে।

আশ্রম-প্রাঙ্গণ শূন্য। বেলা হয়েছে অনেক। এবেলার মতো অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। জলকলের ধারে এসে দেখি কল অদৃশ্য। একরাশ মহিলার ভিড়। চাকের বুকে মৌমাছির মতো। জলকল এখন নারীবাহিনীর এক্তিয়ারে। সুবোধ ছেলের মতো অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অন্যথায় ছুটতে হয় গঙ্গার ধারে।

ওদিকে দিদিমার গলা শোনা যাচ্ছে, ‘এই তো এখানেই ছিল শিশিটা। কী চোরের জায়গা বাপু! এরকম হলে তো গায়ের কাপড়ও চুরি করে নেবে কখন!’ নিজের মনেই মাথা নেড়ে বললাম, ‘তা কী করে সম্ভব। সে কাজটি তো একজনই পারত। গোপিনীদের বস্ত্র হরণ করা যার অভ্যাস ছিল।’

কিন্তু মনের রসিকতা রইলো মনে। কানে এলো, ‘তুই জানিস বেরজো?’

ব্রজ ধরা পড়লেই আমিও পড়বো। ব্রজ বললো তেমনি ভালো মানুষটির মতো, ‘না তো। আচ্ছা, আমি দেখছি খুঁজে।’

দিদিমা বললো, ‘আর কোথায় দেখবি! আমার বড়ি কটা আর ভাজা হবে না। কী সব্বোনেশে জায়গা বাপু। পাপীগুলাদের পাপের ভয় নেই গো! এই তীখক্ষেত্তোর জায়গা। জাগ্রত ঠাকুরের ঠাঁই। তবে আমিও বলি, যে নিয়েছে…’ সেই মুহূর্তেই শোনা গেল, ‘পেয়েছি দিমা’

‘কোথায় পেলি লো?’

‘এই উনুনের পেছনে।’

‘কই, আমি তো দেখতে পেলুম না।’

তা পারবে কী করে! ব্রজবালা যে জাদু জানে! সে খবর তো রাখে না দিদিমা। কমলের ধারের মহিলারাও ব্যাপারটা লক্ষ করছিল। একটি বিশালবপু বিধবা তখন থেকেই বিষয়টিতে ফুট কাটছিল। এবার আর একজনকে সাক্ষী মেনে ঠোঁট উলটে বললো, ‘মাগীর গলা আছে বাজখাঁই। ওদিকে চোখের মাথা খেয়ে বসে আছে। দেখলে তো, আশ্রমের তাবৎ বেটিদের চোর করে ছাড়লে বুড়ি!’

কিন্তু কেউ-ই সেই কথার জবাব দিল না। জল না হলে চলবে না। তাতেই ব্যস্ত সকলে। বোধ হয় বিষয়টি নিয়ে ঘোঁট হবে অবসর সময়ে।

কিন্তু বিশালবপুধারিণী ছাড়বার পাত্রী নয়। মুখের একটি বিচিত্র ভঙ্গি করে বললো, ‘আমাকে একবার বললে হতো! মুখ একেবারে থুড়ে দিতুম না!’

বলে, একবার অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকালো ভিড়ের দিকে। উদ্দেশ্য বোধ হয়, কথাগুলি তার কেউ শুনছে কিনা। অর্থাৎ গ্রাহ্য হলো কিনা।

হ্যাঁ, একজন তাকিয়েছে তার দিকে। একটি প্রৌঢ়া সধবা। তাকেই বললো, ‘আচ্ছা, তুমিই বলো তো ভাই..’

গণ্ডগোল। একেবারে গণ্ডগোল। সধবা বললো শান্ত কণ্ঠে, ‘কই, আপনাকে তো কিছু বলে নি। সত্যি, চোরের যা দৌরাত্ম! ওইটুকু তো বলবেই!’

আর যায় কোথায়! ক্ষেত্র পাওয়া গিয়েছে। বিশালবপুধারিণী গলা চড়াল, ‘কী রকম! তেলের শিশি রইলো ইয়ের গোড়ায়, আর আমাদের করবে শাপমন্যি! এ যে চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা গো!’

অবস্থা আয়ত্তের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। এখানে কোন মধুসূদনই সালিশি করতে সাহস পাবে না। গঙ্গাতেই যেতে হবে দেখছি।

এই সময় যুবতী কণ্ঠ, ‘কই, খনপিসি, তোমার ভাঁজা পড়েছে যে।’

‘পড়েছে? বাব্বা বাব্বা।’ বলেই বিশালবপু, অর্থাৎ খনপিসি সম্ভবত খনা ঠাকরুণ, হুড়হুড় করে ঢুকলো কলে। ধাক্কা খেল অনেকে। কিন্তু সবাই শুধু মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করেই ক্ষান্ত। বুঝলাম, খনপিসি আত্ম-পরিচয়ে ইতিমধ্যেই আশ্রমে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। সকলের চোখে-মুখে সেটাই পরিস্ফুট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *