অমিল
অভিনয় শেষ। গ্রিনরুমে এসে সমবেত হয়েছে। স্থান অল্প, লোক বেশি। অভিনয় ব্যাপারে এত পরিশ্রমের পরেও অজস্র কথার গতিতে মুখের রঙ তোলার বা পোশাক পরিচ্ছদ বদলানোর তাড়া নেই।
স্থান সল্পতা স্বত্ত্বেও ঘরের এক কোণে একটু নিরিবিলি আছে। মেয়েদের সেখানে আনাগোনা কম, কিন্তু ভারতী এসেই সে স্থানটুকু বেছে নিয়েছে। অত গোলমাল আর তার ভালো লাগে না। ভারতী তাই একটা লোহার চেয়ারে চিবুকে হাত রেখে বসে মজলিশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চুপ করে আছে।
কিন্তু কোনোরকমেই রেহাই পাবার উপায় নেই। রেখা কোত্থেকে এসে ধরল।
–ইস, ভাই তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান! এমন করে একলাটি বসে। আছিস কেন বল তো?
ভারতী হেসে বললে, এমনি!
তোর সবই, তো এমনি, সে যাক, একটু বসতে দে আগে, আমি আর দাঁড়াতে পারছিনে।
—জায়গা কোথায়?
–একটু সরলেই হবে— কোনোরকমে জায়গা করে রেখা তার পাশে বসল। রানির ভূমিকাভিনয়ে ছিল ভারতী। তাই জমকালো হয়ে সাজতে হয়েছিল। রানির পরিধানযোগ্য অনেক ধরা-চূড়া। কিন্তু একটি জিনিসও ভারতীর নিজের নয়, সব এই রেখার দেয়া। সে কোথায় পাবে? মেয়েরা তাকে একদিনের জন্যও একটা ভালো কাপড় পরতে দেখেনি। তারা জানে এর মূলে কী!
ভারতী বললো, তোর জিনিসগুলো–
রেখা আর বলতে দিল না, তার মুখে হাত চেপে বাধা দিয়ে বলল, ওসব কে এখন শুনতে চাইছে? একসময় দিলেই হবে।
-না, দামি জিনিস তো!
ইস আমি পারিনে। এখানে কি এমন কেউ নাই যে আমাকে এই nonsense talk থেকে রেহাই দিতে পারে। রেখা অভিনয়ভঙ্গিতে বলল।
ভারতী নীরবে হাসল।
ভারতীকে জড়িয়ে রেখা বললে, তোর মতো রূপও যদি আমার থাকত তবে দেখতিস।
কথাবার্তায় রেখার প্রকৃতিই ওই রকম, সবসময় কেবল সৌন্দর্যচর্চা। একটু পরে বলল, থিয়েটার কেমন হল?
দু-চার বছরেও এমন হয়নি।
খানিকটা পরে : অঞ্জন আসবে লিখেছে।
ভারতী বললো, শুধু এই? আর কী লিখেছে বল? লিখেছেঃ পাইনের মর্মর ভুলতে পারো কি? আমাকে তো অনেকগুলো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়, তাদের ভাষায় আমি এক অতিপরিচিত ভাষাই শুনতে পাই। আমার ভালো লাগে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তটিকে কী নামকরণ করব বলো, যখন মনে হয়, যা অতীত তা তো আর আলোক নয়, শুধু অন্ধকার? অন্যদিকে চেয়ে কতকটা স্বগতভাবে রেখা বলল,-এমন সরল স্বভাব, এমন হাসি!
ভারতী পরিহাসচ্ছলে বলল, কালো অঞ্জন মেখেছিস চোখে! কিন্তু আমার তো হিংসে হওয়ার কথা।
-তা হোক, তাতে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু আমার ভয়ানক, খিদে পেয়েছে।
রেখা আশ্চর্য হয়ে বলল, কেন, তুই খাসনি? চা?
-ওসব আমার ভালো লাগে না।
–তুই একটা অদ্ভুত প্রাণী। চল, এলাদির কাছে গিয়ে বলি।
ভারতী তার হাত ধরে বলল, দোহাই তোর, তুই এখান থেকে যাসনে। অত গোলমালে আমার মাথা ধরে গেছে। এখানে বেশ ভালো আছি, তুই বরং গল্প কর।
ভারতী খানিক থেমে বললে, এলে কিন্তু আমায় দেখাবি।
-আচ্ছা।
–তখন আমার দুঃসময়। তুই তো আমাকে ভুলেই যাবি।
–তা তুই ভাবতে পারিস, তোর মতো নেমকহারাম দুটি আছে? ভারতী আশ্চর্য হয়ে বলল, কী দোষটা করেছি শুনি?
-দোষ? কতদিন বললাম আমাদের বাসায় যেতে! বন্ধু বলে আমারই ঠেকা বেশি, না?
-না, কে বললে অমন কথা? কখনও নয়। ঠেকা আমারই বেশি। কিন্তু তোকে আমাদের বাসায় নিইনে কেন জানিস? সেখানে গেলে তুই শ্বাসরোধ যন্ত্রণায় মারা পড়বি।
রেখা গম্ভীর হয়ে বললে, তুই আমাকে ঠাট্টা করিস?
—মোটেই না। জ্বলন্ত সত্য কথা।
রেখা গম্ভীর হয়েই রইল। ভারতী তার হাতটি বুকের কাছে টেনে বলল, কাল এক মজার ব্যাপার ঘটেছিল। শেষরাতে হঠাৎ জেগে দেখি, ভয়ানক বৃষ্টি হচ্ছে। ঝরঝর একটানা শব্দ। কী যে ভালো লাগলো বলতে পারি না–
রেখা আর চুপ করে থাকতে পারল না। তাড়াতাড়ি বলল, একেবারে মিলে গেছে। আমিও জেগে উঠেছিলাম কিন্তু। তোরই মতো ভালো লেগেছিল আর মনে হয়েছিল, ভারতী এখন কী করছে কে জানে? এখন যদিও থাকত আমার পাশে, শেষ রাতটুকু অনেক কথা বলে কাটিয়ে দিতাম।
ভারতী আশ্চর্য হয়ে বলল, আমার ভাবনাও ছিল ঠিক তাই। আশ্চর্য তো!
রেখাদের বাসা আছে। তাই যাবার পথে নেমে পড়বার সময় তার টানাটানিতে ভারতী না গিয়ে থাকতে পারল না, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে রেখা বলল, এখন রাত আটটা বেজেছে আরও দু-ঘণ্টা দেরি করে গেলে বাসায় কিছু মনে করবে না, ভাববে ইসকুলের থিয়েটার শেষ হয়নি।
—তারপর যাবার উপায়?
–গাড়ি। আমিও যাব সঙ্গে।
তার শোবার ঘরে বসিয়ে রেখে সে বলল, বোস, একটু আসছি।
একটু পরে রেখা তার মাকে সাথে করে ফিরে এল। ভারতী উঠে দাঁড়াল। মা বললেন, চলো মা, কিছু খাবে।
-ওঃ, এই ষড়যন্ত্র করেছে রেখা! আমি খাব না।
রেখার মা হেসে বললেন, তাহলে ভুগতে হবে কিন্তু আমাকেই। ও তো কিছুতেই খাবে না। ভারতীকে খেতে হল।
খাওয়া-দাওয়ার পর আবার দুজনে এসে বসল ঘরে।
–একটা রাত থেকে যা ভারতী। বাসায় খবর পাঠিয়ে দি।
-না না, আমার কাজ আছে।
ঘরে রেডিও ছিল।
-শুনবি?
ভারতী হেসে মাথা কাত করল।
কিছুক্ষণ কেটে গেছে।
-এক্কেবারে বাজে। রেখা বললো, তার চেয়ে গল্প করা ভালো।
ভারতীর কিন্তু বেশ ভালো লেগেছিল, একমনে শুনেছিল, কচিৎ শোনার দুর্বলতার মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না।
রেখা বলল, খুব বেশি চালাক যারা, তাদের আমি দেখতে পারিনে। তারা মনে বাইরে এক নয়।
-মনে-বাইরে কেউ এক নয়। সে যাক, তোর কথা শুনে যাদের তুই দেখতে পারিস, সে বিষয়ে একটু আন্দাজ করতে পারছি বটে।
রেখা হেসে বলল, সত্যি, এমন সরল আমি আর কখনো দেখিনি।
–দু-একটা প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত শুনি আগে, তারপরে তো মতের মিল হবে।
–একদিন জুতো খুলে জলে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম। ফিরে আসবার সময় অঞ্জন পরিষ্কার রুমাল বার করে আমার পা মুছিয়ে দিল, তারপর জুতো পরলাম।
—আরে বাপরে, এ যে দেখছি—
—চেঁচিয়ে ওঠার কোনোই কারণ নেই, তারপর যা আছে শোন। আবার এমনও হয়েছে তিন-চারদিন আমার সমুখ দিয়ে অঞ্জন ওর বুড়ো ঠাকুরদার সাথে চলে গেছে, আমাকে দেখেও দেখেনি!
–তোর তখন কী অবস্থা?
–কান্না পেয়েছে। রেখা হেসে ফেলল। কিছুক্ষণ পরে দশটা বাজল।
ভারতী বললো, আমি যাই।
—এখনই?
–বলেছি না, দরকার আছে?
তারপর নীচে নেমে গাড়িতে গিয়ে উঠতে ভারতী বলল, সঙ্গে এসে আর কী করবি? অনর্থক তোকে কষ্ট দেয়া।
পরের দিন স্কুলের দালানে। রানির উপযোগী যত কিছু পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার রেখা দিয়েছিল, আজ সব সে এনেছে। কাল যখন ওদের বাসায় গিয়েছিল তখনই দেয়া যেত এবং একবার বলেছিল কিন্তু রেখা মোটেই কান দেয়নি।
ভারতী বলল, এই নাও বাপু!
–এত তাড়া কীসের? রেখা যেন অবজ্ঞায় বান্ডিলটায় হাত দিল।
এ দেখে ভারতী ধরে নিল যে অনেক আছে বলেই এ ধরনের ভাবভঙ্গি। সেখানে আর কেউ ছিল না।
–গয়নাগুলো পরে ওদের তাক লাগিয়ে দিই, কি বলিস?
—আচ্ছা। কিন্তু আমি যাই, এখনই আসব আবার।
ভারতী চলে গেল। রেখা বান্ডিলটা খুলল। কিন্তু কতক্ষণ পরে এসে যা দেখল তাতে ভারতী রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। রেখা উদবিগ্ন হয়ে কী খুঁজছে।
—কী হয়েছে?
–একটা হার পাচ্ছিনে।
–একটা ছাড়া আরও ছিল নাকি!
রেখা আশ্চর্য হয়ে বললে, ছিল নাকি মানে? আমার স্পষ্ট মনে আছে।
ভারতী শুষ্ক স্বরে বলল, আমার মনে হচ্ছে—
—আরে, না না, আমি কি মিথ্যে বলছি তোর কাছে?
ভারতী কী করবে ভেবে পেল না, একটু দেখবার আশায় বাইরে গেল। একটু পরে কতকগুলো মেয়ে এসে জুটল।
—কী হয়েছে রে?
রেখা সব বললে।
একটা মেয়ে মুচকি হেসে আস্তে আস্তে বলল, আমার ঠাকুরমা একটা কথা প্রায়ই বলেন, অভাবে স্বভাব নষ্ট। যদিও সকলের বেলায় তা নয়।
রেখা বলল, অন্য কিছু হলে আমার আফসোস হতো না, কিন্তু জিনিসটা বিলেতের গোল্ড স্মিথ কোম্পানির, দাদা এনেছিলেন। তাই দুঃখ হয়। কী যে করি এখন!
-কী আর করবে? আরও ভাব করো গে!
এমন সময় ঘরে এসে ঢুকতে ভারতী কিছুটা শুনে ভয়ে আর বিস্ময়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। এমন যে হবে সেটা কখনও ভাবতে পারেনি। তবু সে অনেকগুলো কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে গিয়ে বলল,
—বাসায় একবার খুঁজে দেখিস না ভাই
-এত ভুলো মন নয় আমার। আর এই তো প্রমীলাও তো দেখেছে। অন্য জিনিস হলে আমি কিছু বলতাম না, কিন্তু এ যে—আর এতই যদি টাকার দরকার ছিল, আমি কি চাইলে দিতে পারতাম না?
ভারতী একবার প্রতিবাদ করতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না।
কিন্তু পরের দিন এর চেয়েও বেশি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। রেখা এসে হাত ধরে বলল, তোরই কথা সত্যি হল, বাসায় সেটা পেয়েছি। কিন্তু তোকে অনেক কষ্ট দেয়া হল, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার মতো যেন ভারতী অনুভব করল। মুখে বলল, ব্যাপারটা খুব হাস্যকর বোধ হচ্ছে।
-হ্যাঁ, তুই আমাকে মাপ কর ভাই!
—ক্ষমা কাকে বলে তা আমাদের মতো লোকের জানবার কথা নয়, তার অর্থও ভালো করে বুঝিনে, আরও অনেক জিনিস না বোঝার মতো!
রেখা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল।
-কিন্তু এটা একাধিকবার প্রমাণিত হল যে, বড়োলোক এবং গরিবে এমনি খুব দরকারবোধে গম্ভীর আবহাওয়ার মধ্যে কথাবার্তা হয়তো চলতে পারে কিন্তু ভাব যাকে বলে, মানসিক ঘনিষ্ঠতা যার নাম, তা কখনও হতে পারে না।
-কেন?
—কেন, তার অনেক কারণ। প্রধান কারণ হল, একপক্ষ নিজের অবস্থা সম্বন্ধে একজন সম্রাটের চেয়েও বেশি সচেতন।
-কথাটা হয়তো সত্যি নয়।
—তুমি কিছুমাত্র দ্বিধা না করে আমাকে সকলের কাছে চোর বলে চালিয়ে দিলে কী মনে করে?
–ভুল হয়েছিল বলেই তো?
-এ একটা হাস্যকর কথা, ধনীদের সস্তা অজুহাত।
–বললামই তো, ভুল।
–আবার সেই কথা! ভারতী উষ্ণ হয়ে বলল, এই যে সকলে চোর বলেই জানল, আমার দারিদ্রের সুবিধা নিয়ে অনেক ধারণাই করল, তার কী হবে, কী কৈফিয়ৎ দেবে তুমি? আমাদের আত্মসম্মান নেই? না, সেটা তোমার ওই পেন্সিলকাটা জাপানি কলের চেয়ে সস্তা?
–এখন ব্যাপারটা যখন সত্যি নয়—
–সত্যি নয় কে বললে? এখন কারোর কাছে গিয়ে আমি যদি বলি, প্রাণের চেয়েও প্রিয় একটি মেয়ে আমার বন্ধু ছিল, এমন ভাব বোধহয় কোনোখানেই দেখা যায় না। কিন্তু একদিন একটা হার চুরি যাওয়ায় সেই মেয়েটিই আমাকে চোর বলতে একটু ভেবে দেখল না, অমনি আমার কথা বিশ্বাস করবে বল? আমাকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাববে।
ভারতী রাগে লাল হয়ে বলল, আমার সাথে তুমি কথা বোলো না। ঘৃণা জিনিসটা আমি খুবই ঘৃণা করতাম কিন্তু এখন একটু দরকার বোধ করছি।
সে আর কিছু না বলে জায়গা ছেড়ে চলে গেল।