অমিতার কথা

অমিতার কথা

বইটা শেষ করে এক পাশে নামিয়ে রাখল অমিতা।

বুকের মধ্যে দারুণ মোচড়াচ্ছে, গলার কাছে কী যেন আটকে আছে, এইবার চোখ ফেটে জল আসবে। কিন্তু কাঁদতে চায় না অমিতা, বই পড়ে কান্নার কোনো মানে হয়! তবু সে সামলাতে পারল না, আঁচল চাপা দিল চোখে।

নিস্তব্ধ দুপুর, ছাপ্পান্ন বছর বয়েসি এক মহিলা, উপন্যাসের পাতার কাল্পনিক নায়ক-নায়িকার সমব্যথী হয়ে কাঁদছে। কেউ দেখার নেই।

দুঃখের বই নয়, যাকে বলে সাধারণ বিয়োগান্ত কাহিনি, তাও নয়, ওসব পড়লে অমিতার কান্না আসে না। উপন্যাসের মধ্যে মৃত্যু বা বিচ্ছেদ তো থাকেই, ঠিকমতন লেখা হলে তাতে অল্প ব্যথার অনুভূতি হয় এবং যদি তা হয় জীবনের সার্থক রূপ, তাতে যে রসের সৃষ্টি হয়, তা আসলে আনন্দই দেয়। সাহিত্যপাঠ তো সেই জন্যই।

কিন্তু অমিতা ভুল বোঝাবুঝি একেবারে সহ্য করতে পারে না। জীবনটা এত ছোটো, তবু কত সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য নষ্ট হয়ে যায় কত সুন্দর সম্পর্ক। লেখক অনিমেষ রায়চৌধুরি এই রকম একটা ভুল বোঝাবুঝির কাহিনিই লিখেছেন বড়ো নিস্পৃহভাবে। লেখকরা এমন নিষ্ঠুর হন কেন?

একটা বাড়ির কথা প্রায়ই মনে পড়ে অমিতার। এই ধরনের বই পড়লে সেই বাড়িটার দু-ধরনের রূপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যাদবপুরের দিকে রাস্তার ধারে ছোটোখাটো একটা পুকুর, সেখানে তৈরি হচ্ছিল একটা বাড়ি। তখন অমিতাকে প্রায়ই যেতে হত যাদবপুরে তার দেওরের বাড়িতে, যাওয়া-আসার পথে চোখে পড়ত, সাধারণ বাক্স-ধরনের বাড়ি নয়, বোঝাই যায় বেশ শখের বাড়ি, নানান ধরনের বারান্দা, বাইরের দিকে দু-তিনখানা সিঁড়ি। এক সময় বাড়িটা সম্পূর্ণ হল, চোখ জুড়ানো রং হল, বাসের যাত্রীরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। অমিতার দেওর দিল্লিতে বদলি হবার পর আর ওদিকে যেতে হয়নি। বছরখানেক পর এক রবিবার সকালে পিকনিক ছিল সোনারপুরে, গাড়িতে যেতে হঠাৎ সেই সুশ্রী বাড়িটার কথা মনে পড়ায় জানালা দিয়ে দেখতে গিয়ে আঁতকে উঠেছিল অমিতা! বাড়িটা সেখানে নেই। একটা নতুন বাড়ির জায়গায় রয়েছে একটা পোড়ো বাড়ি। তবে কি জায়গাটা ভুল হল? না, এই তো সেই পুকুর, আর এক পাশে স্টেট ব্যাংক। একই বাড়ি, আগে ছিল ভোরের আকাশ-নীল, এখন রান্নার হাঁড়ির মতো কালো, এমনভাবে পুড়েছে যে কায়দার সিঁড়ি ও বারান্দাগুলো অদৃশ্য।

অমিতা পাশ ফিরে তার স্বামীর বাহু চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বলেছিল, ওই দ্যাখো, বাড়িটা পুড়ল কী করে?

সুবিমল সহসা উত্তেজিত হয় না। তার ধারণা, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই অকারণে বাজে কথা বলতে ভালোবাসে, বিশেষত স্ত্রীজাতি সম্পূর্ণ যুক্তিহীন জীবনযাপন করে।

সে মৃদু হাস্যে বলল, আমি সবজান্তা নই। কোন বাড়ি কেন পোড়ে তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাবই বা কেন?

সুবিমলের কাছে সব সময় এ রকমই উত্তর পায়, তবু অমিতার মনে থাকে না, সে তার ব্যাকুলতা বা তীব্র অনুভূতি ভাগ করে নিতে চায় স্বামীর সঙ্গে।

সারাদিন ওই বাড়িটার কথাই মন জুড়ে ছিল অমিতার, পিকনিকে মন বসাতে পারেনি। স্বামীর অফিসের সহকর্মীদের পিকনিক, তেমন উপভোগ্যও হয় না, কোনোবার এমনিই আসতে হয়।

অমন স্বপ্ন দিয়ে গড়া বাড়িটা এক বছরের মধ্যে কেন পুড়ে বীভৎস হয়ে গেল? বাড়ি তো নয়, একটা সংসার। কত সংসার ওরকম নষ্ট হয়ে যায় ভুল বোঝাবুঝিতে ইলেকট্রিকের আগুন, গ্যাস স্টোভ ফেটে যাওয়া, বা অন্য কোনো দুর্ঘটনার কথা অমিতার মনে আসে না। সে যেন দেখতে পায় এক অচেনা স্বামী-স্ত্রীকে, তাদের জন্য তার খুব কষ্ট হয়।

অনিমেষ রায়চৌধুরীর উপন্যাসটা অমিতা আবার তুলে নিল, শেষ কয়েকটা পাতা তার আর একবার পড়তে ইচ্ছে করছে।

যে বই পড়ে কষ্ট হয়, চোখে জল আসে, সেই বইও মানুষ আবার পড়তে চায় কেন?

অশোক আর ঊর্মিলা এই কাহিনির নায়ক-নায়িকা, শেষ পরিচ্ছেদে তারা তীব্র অভিমানে পরস্পরকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, অথচ ভালোবাসা ক্ষয়ে যায়নি, মানুষ হিসেবেও দুজনেই অসৎ নয়। লেখক তো ইচ্ছে করলেই ওদের ভুল ভেঙে দিতে পারতেন। একটা-দুটো বাক্যই যথেষ্ট ছিল। অমিতা যদি কোনোক্রমে এই কাহিনির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারত, তা হলে সে বলে দিত, ওরে ঊর্মিলা, ভুল বুঝছিস কেন, অশোক তোকে সত্যিকারের ভালোবাসে, বাকি সব ঘটনা তুচ্ছ!

বইটা নামিয়ে পাশে রেখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অমিতা। দু-চোখ দিয়ে নেমে আসছে কান্নার ধারা। এই সময় দরজার সামনে এসে দাঁড়াল এক যুবা। পঁচিশ-ছাবিবশ বছর বয়েস, সুঠাম স্বাস্থ্য, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গালে অল্প অল্প দাড়ি, জিনস ও হলুদ গেঞ্জি পরা, ঠিক যেন আধুনিকতার ছাঁচে তৈরি।

যুবকটির ভুরু কুঁচকে গেল, সে বলল, এ কী, কী হয়েছে?

হাসি ফুটে উঠল অমিতার মুখে, বেশ ঝলমলে হাসি, চোখে জল থাকলেও মানুষ হাসতে পারে, তখন মুখখানা অপরূপ দেখায়।

সে বলল, এ কী, জোজো, তুই হঠাৎ চলে এলি যে?

জোজো অর্থাৎ নিপুণ বলল, তুমি কাঁদছ কেন, কোনো খারাপ খবর এসেছে?

না, না, সেসব কিছু না। তুই আজ ফিরে এলি কী করে?

কেন, তাতে তোমার আপত্তি আছে? ছেলে বাড়ি ফিরে এলে মা খুশি হয় না?

সে কথা হচ্ছে না, তুই চলে এলি…দুর্গাপুরে তোর জরুরি কাজ ছিল—

মনে করো, সাডেনলি আই ফেলট হোমসিক…ওখানে এত বাজে রান্না, আই মিসড ইয়োর আলুপোস্ত।

এই দুপুরবেলা…কোন ট্রেন?

কথা বলতে বলতে বাচ্চা মেয়ের মতন, কোনো অপরাধ করে ধরা না পড়ার জন্য আস্তে আস্তে বইটাকে পেছন দিকে সরাবার চেষ্টা করল অমিতা। নিপুণ ঠিক দেখে ফেলেছে। কাছে এসে বলল, বাংলা বই…এই জন্য চোখের জল…বেঙ্গলি বুকস আর লাইক অনিয়ানস।

বাজে কথা বলিস না। তোরা তো কিছু পড়িস না—

তোমাকে আগেও বাংলা বই পড়ে কাঁদতে দেখেছি।

শেকসপিয়রের ওথেলো পড়িসনি? তোর কষ্ট হয়নি?

হু রিডস শেকসপিয়র দিজ ডেইজ? মা, আই অ্যাম স্টারভিং!

খেয়ে আসিসনি? এক্ষুনি খাবার গরম করে দিচ্ছি। চান করবি না?

ছোটো দোতলা বাড়ি, সুবিমলের বাবার আমলের। এক সময় বাড়ি ভরতি লোক ছিল, এখন স্বামী-স্ত্রী দুটি মাত্র প্রাণী। নিপুণ প্রায়ই থাকে না, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে জার্মানিতে। সেই জন্য কাজের লোক বেশি রাখা হয়নি। একটি ঠিকে মেয়ে দু-বেলা রান্না করে দিয়ে যায়, আর অনেক দিনের পুরোনো লোক রামরতন সরকারি অফিসে চাকরি করে, রাত্তিরে থাকে এখানে। বাড়ি পাহারা দেবার ভার তার ওপর।

দুপুরবেলা একতলাটা একেবারে ফাঁকা থাকে। তাতে একটাই অসুবিধে, হঠাৎ কেউ এলে অমিতাকে নীচে এসে দরজা খুলতে হয়। বাবা আর ছেলের কাছে চাবি থাকে, অন্য কেউ বেল বাজালে অমিতা দোতলার বারান্দায় এসে দেখে নেয়। ফেরিওয়ালা বা অচেনা কারোকে দেখলে খোলেই না।

রান্নাঘর একতলায়। ফ্রিজে কিছু-না-কিছু খাবার থাকেই। নিপুণ ভাত খেতে চায় না, পাউরুটি আছে। খানিকটা মাংসও আছে, নিপুণ এর বেশি খাবে না। ফ্রিজে দু-বোতল বিয়ারও আছে ঠান্ডা হয়ে, যদি ওর ইচ্ছে হয় তো নেবে। মাইক্রোওয়েভে মাংসটা গরম করতে দিয়ে অমিতা গোটাচারেক টোস্ট সেঁকে নিল।

স্নান করেনি নিপুণ, এর মধ্যে কমপিউটার নিয়ে বসে গেছে। ইন্টারনেটের প্রবল নেশা। এক একদিন কমপিউটারের সামনে বসে সারারাত কাটিয়ে দেয়। একটা ইঁদুর দেখিয়ে দেয় সারা পৃথিবী।

মাংসের বাটিতে টোস্ট চুবিয়ে খেতে খেতে নিপুণ বলল, প্রথমে তোমার চোখে জল দেখে আমার মনে হল, দিম্মার বুঝি কিছু হয়েছে—

অমিতার মা থাকেন পাটনায়, আশি বছর বয়সে আছাড় খেয়ে পা ভেঙেছিল। শয্যাশায়ী হলেও এতে অবশ্য মৃত্যুভয় নেই।

হাউ ইজ শি?

দিম্মা একই রকম আছে। রাত্তিরে ফোন করব।

সাডেনলি আই রিয়ালাইজড, তোমার চোখে জল থাকলে মুখটা অন্য রকম হয়ে যায়। মেয়েদের সবচেয়ে পিওর দেখায়, যখন তারা কাঁদে।

সেইজন্যই বুঝি পুরুষজাতটা এতকাল ধরে মেয়েদের কাঁদাচ্ছে।

আই ডোনট রিপ্রেজেন্ট পুরুষজাত টু ইউ! আই অ্যাম ইয়োর ডিয়ার লিটল সান।

অন্য মেয়েদের কাঁদাসনি যেন। সুপর্ণার কী খবর রে? অনেকদিন আসে না।

ওসব কথা বলার এখন সময় নেই। গেট লস্ট। আমার অনেক কাজ আছে। রাত্তিরে আলুপোস্ত রান্না কোরো।

অমিতা চলে এল নিজের ঘরে। ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। একেবারে স্থির হয়ে।

বিয়ের পর এই বাড়িতেই কেটে গেল তিরিশ বছর। সে গৃহকর্ত্রী, কোণের ঘরটায় বসে আছে তার একমাত্র ছেলে, তার স্বামী ফিরে আসবে সন্ধের সময়, কয়েক মুহূর্তের জন্য এই সব বোধই কেমন যেন হালকা হয়ে গেল, যেন অস্পষ্ট জলরঙে আঁকা। এর তুলনায় অশোক আর ঊর্মিলা নামে দুজন নারী-পুরুষ অনেক বেশি বাস্তব। অন্য রাস্তায়, অন্য একটা বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে অশোক আর ঊর্মিলা।

সুবিমল বলেছিল, সারাদিন তুমি একা থাক, মেয়েটার বিয়ে হলে গেল, জোজো তো বাড়িতে থাকবেই না। তুমি সময় কাটাবে কী করে? লেখাপড়া শিখেছ, কিছু একটা কাজ নাও, স্কুলে-টুলে পড়াবার দরকার নেই, একটা ছোটোখাটো ব্যাবসা করে দিতে পারি।

অমিতা রাজি হয়নি। ব্যাবসা সম্পর্কে তার ভয় আছে। একবার জয়ন্তী আর শ্রীলেখার সঙ্গে মিলে শখ করে শাড়ির ব্যাবসা শুরু করেছিল। মাঝপথে বন্ধ হয়ে অনেক টাকা দণ্ড গেছে। তার স্বামীরই তো টাকা।

তা ছাড়া ব্যাবসা-ট্যাবসা লোকে করে টাকা উপার্জনের জন্য। টাকা দিয়ে কী হবে? কোনো অভাব তো নেই। যারা টাকার অভাবে সংসার চালাতে পারে না, তারা ওসব করুক।

সময় কাটাবার জন্য বই পড়া যায়, গান শোনা যায়, মাঝে মাঝে থিয়েটার দেখা…এসব তো মানুষেরই জন্য। ছোটোবেলা থেকেই বই অমিতার প্রিয় সঙ্গী। বিয়ের পর কাছাকাছি সময়ের মধ্যে মেয়ে আর ছেলে জন্মাল, তাদের মানুষ করে তোলা, সুবিমল সব সময় ব্যস্ত, তাই মেয়ে আর ছেলের স্কুল কলেজের দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়েছে, নিজে বই পড়ার সময় পায়নি। এখন তো সে ঝাড়া হাত-পা। মাঝখানের বছরগুলির না-পড়া বইগুলি সে পড়ে নিতে পারে।

নতুন করে বই পড়া শুরু করে অমিতা। একসময় বুঝতে পারল, বই পড়ারও সঙ্গী লাগে, একা একা হয় না।

অল্প বয়েসে ভালো কিছু একটা পড়লেই বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে হত। ভালো কোনো খাবার ভাগ করে নেবার মতন। বন্ধুদের মধ্যে কাড়াকাড়ি হত এক একখানা বই নিয়ে। রাত জেগে কোনো একটা বই শেষ করেই তক্ষুনি ফোন করতে ইচ্ছে হত কোনো বন্ধুকে। মায়ের কাছে এজন্য অমিতা বকুনি খেয়েছে কতবার!

ছেলেবন্ধুরা সবাই হারিয়ে গেছে। শুধু একজন, অসিত, বিয়ের পরও সম্পর্ক রাখতে চেয়েছিল। দুপুরবেলা ফোন করত, অমিতাই কাটিয়ে দিয়েছে তাকে। বান্ধবীদের মধ্যে জয়ন্তী আর শ্রীলেখার সঙ্গেই যোগাযোগ আছে এখনও, কিন্তু ওদের সংসারযন্ত্র বোধহয় বেশি ঘোরালো-প্যাঁচালো, বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছে ওরা। কয়েকবার সদ্য পড়া কোনো বই সম্পর্কে জয়ন্তীর সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছে, একটু পরেই জয়ন্তী অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। আর শ্রীলেখা চাল মেরে বলে, আমি ভাই আজকাল গল্প-উপন্যাস পড়ি না, যা সব রদ্দি লেখা হচ্ছে, মাঝে মাঝে শুধু কবিতা পড়ি। অমিতা জানে, এ কথাটাও সত্যি নয়, শ্রীলেখার মুখে একটাও কবিতার লাইন সে কখনও শোনেনি।

নিপুণ যখন ছোট্ট ছিল, অতি দুরন্ত, তাকে ঘুম পাড়াবার সময় গল্প বলতে হত। তারপর এমনই তার গল্পের নেশা হয়ে গেল যে সবসময় জ্বালাতন করত, গল্প বলো, মা, গল্প বলো। তখন কত গল্প বানাতে হয়েছে অমিতাকে। একটু বড়ো হতেই সে গল্পের নেশা কোথায় মিলিয়ে গেল। এখন বাংলা দূরের কথা, ইংরেজি গল্পের বইও পড়ে না।

কোলের কাছে শুইয়ে বাচ্চা-নিপুণকে ঘুম পাড়াবার জন্য থাবড়াতে থাবড়াতে গল্প বলার কথা এখনও হঠাৎ মনে পড়ে। সেই ছেলে এখন মাকে বলে গেট লস্ট। অবশ্য ইয়ার্কি করেই বলে।

ছেলে আর মেয়ে দুজনকেই পড়ানো হয়েছে মিশনারি স্কুলে। সেটাই তো এখনকার রীতি। এই ধরনের পরিবারের সব ছেলেমেয়েরাই তো ওই সব স্কুলে পড়ে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে যে মাতৃভাষা যত্ন করে শেখানো হয় না, দেশের সরকারেরও তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, তা তো অমিতা জানত না। বুঝতে বুঝতে এতটাই সময় কেটে গেল যে, তখন আর কিছু করার উপায় নেই। ক্লাস সেভেন-এইটের ছেলেমেয়েকে স্কুল ছাড়িয়ে অন্য স্কুলে ভরতি করার প্রশ্নই ওঠে না। অমিতা সে-রকম প্রস্তাব দিলে তাকে সবাই পাগল বলত। ছেলেবেলায় সে-রকম ক্ষীণ ইচ্ছে হয়েছিল অমিতার, কিন্তু তখন নিপুণকে মিশনারি স্কুল ছাড়িয়ে বাংলা স্কুলে পড়ালে সে কি এমন কমপিউটার এক্সপার্ট হতে পারত? এই বয়েসেই বিভিন্ন কোম্পানি তাকে ডাকাডাকি করে। নিপুণ চাকরি নেবে না, কনসালটেন্ট হিসেবে তার ভালো উপার্জন।

মেয়ে বাসবীর বিয়ের সময় কয়েকখানি বই উপহার পেয়েছিল। আজকাল বিয়েতে বই দেওয়ার রেওয়াজ উঠেই গেছে। বিশাল আয়োজন হয়েছিল সেই বিয়ের, কেউ বাদ থাকেনি, বোধহয় গরিব আত্মীয়স্বজনরা দিয়েছে ওই বইগুলো। বিয়ের পরই জার্মানি যাওয়া, অত উপহারসামগ্রীর অনেক কিছুই রেখে যেতে হবে। অমিতা বলেছিল, বইগুলো নিয়ে যাবি না খুকি? বাংলা যে একেবারে ভুলেই যাবি। তবু সময় পেলে একটু-আধটু পড়বি, লোকে তো সেইজন্যই দিয়েছে।

বাসবী খানিকটা অভিমানের সুরে বলেছিল, আমাকে কি ভালো করে বাংলা শিখিয়েছ তোমরা? স্কুলে এলেবেলে বাংলা, অন্য কত পড়ার চাপ, তোমরা সব সময় বলতে ফার্স্ট হ, ফার্স্ট হতে হবে! বাংলা পড়ব কখন? কলেজে বাংলা সাবজেক্টই ছিল না। অভ্যেস নেই, এখন বাংলা বই দু-তিন পাতার বেশি পড়তে গেলে হাঁপিয়ে যাই, অনেক কথার মানে বুঝতে পারি না। ডিকশনারি দেখে দেখে গল্পের বই পড়া যায়? তা ছাড়া বইয়ের কত ওজন হয় জান না?

বাসবীর স্বামী অভিরূপ দিল্লির ছেলে, অতি ভালো ও ভদ্র, সে বাংলায় বেশ কথা বলতে পারে, কিন্তু এক বর্ণও পড়তে পারে না। অক্ষরজ্ঞানই হয়নি। সুতরাং, প্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দিয়ে গুচ্ছের বাংলা বই জার্মানিতে নিয়ে যাবে কেন?

ঝনঝন করে টেলিফোনে বেজে উঠল।

টেলিফোনের সঙ্গে ফ্যাক্স মেশিন জোড়া আছে, ধরতে দেরি করলে সেই মেশিন চালু হয়ে যায়। অমিতা দৌড়ে গেল।

হ্যালো, কে, অমিতা? আমায় চিনতে পারছ?

ঠিক ধরতে পারছি না।

আগে গলা শুনেই চিনতে পারতে।

আপনার কী দরকার বলুন।

আমি অসিত!

ও, অসিত। কী খবর? তুমি তো বাইরে ছিলে…কোথা থেকে বলছ?

কলকাতা থেকে। গত সপ্তাহে এসেছি। এখন কিছুদিন থাকব। তুমি ভালো আছ? অবশ্য জয়ন্তীর কাছ থেকে তোমার খবর মাঝে মাঝে পাই, একদিন তোমার সঙ্গে দেখা হতে পারে?

তোমার স্ত্রী, কী যেন নাম? কেয়া, সে আসেনি।

হ্যাঁ এসেছে, ছেলেমেয়েরাও।

তোমার স্ত্রী-ছেলেমেদেদের নিয়ে একদিন বাড়িতে এসো।

কেয়ার শরীরটা ঠিক ভালো নেই, আমি একা যদি কোনোদিন, তোমার বাড়িতে না হোক, অন্য কোথাও, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে…

কেয়ার শরীর ভালো হোক, তারপর ওকে নিয়ে একদিন বাড়িতেই এসো।

ফোন রেখে দিল অমিতা। অসিত, অতীতের প্রেত। বিয়ের আগে প্রায় রোজই দেখা হত, অসিতের মধ্যে প্রেম প্রেম ভাব ছিল, হাত জড়িয়ে ধরত প্রায়ই, কিন্তু অমিতা কখনও প্রশ্রয় দেয়নি। মানুষ হিসেবে অসিতকে সে কখনও ঠিক পছন্দ করতে পারেনি, চরিত্রে গভীরতা নেই, সব কথাই যেন কথার কথা। অমিতার সামনে যেসব স্তুতিবাক্য উচ্চারণ করত, ঠিক সেই কথাগুলোই আবার আড়ালে বলত জয়ন্তীকে। এই নিয়ে জয়ন্তী আর অমিতা যে কত হাসাহাসি করেছে, তা অসিত জানে না।

জয়ন্তীর সঙ্গে যে অসিতের এখনও যোগাযোগ আছে, তাও অবশ্য জানত না অমিতা। জয়ন্তী আগে সব কথা বলত তাকে, এখন গোপন করে যায়। করুক! সেই অসিত তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। একা। কোনও প্রশ্ন ওঠে না।

বিয়ে হয়েছে সম্বন্ধ করে সুবিমলের সঙ্গে, অমিতা মানিয়ে নিয়েছে। সুবিমলের সঙ্গে তার ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ সে দেয়নি কখনও। আসেনি কোনো তৃতীয় ব্যক্তি। একবারই একটা উপক্রম ঘটেছিল, তাও অমিতার অজ্ঞাতসারে। বিয়ের সময় ভরতি বাড়ি, অমিতার দেওর চন্দনের একগাদা বন্ধুবান্ধব আড্ডা দিতে আসত প্রায়ই। চন্দনের এক বন্ধু রজত গান গাইত বেশ ভালো, এখন গায়ক হিসেবে মাঝারি ধরনের খ্যাতিও হয়েছে। সেই রজত খুবই বউদি বউদি করত, অমিতাকে দিয়ে গান গাওয়াবার চেষ্টা করত, অনেকটা ন্যাওটা ধরনের হয়ে গিয়েছিল। ওই রজতকে যে সুবিমল পছন্দ করে না, তা বেশ কিছুদিন বুঝতে পারেনি অমিতা। সুবিমল অনেকটা উদাসীন ধরনের, আড্ডা দিতে ভালোবাসে না, বাড়িতে কী হচ্ছে, কারা আসছে, তা নিয়ে যেন মাথা ঘামাবারও সময় নেই। একদিন শুধু রজতের প্রসঙ্গে সুবিমল বলেছিল, ওই রাস্কেলটা আবার এসেছে, যাও, তোমাকে গান শোনাবার জন্য ডাকছে! ওই একটি শব্দ শুনেই সজাগ হয়ে গিয়েছিল অমিতা, সঙ্গে সঙ্গে রজতকে বাদ দিয়ে দিয়েছে নিজের জীবন থেকে।

তৃতীয় ব্যক্তি! না, রক্তমাংসের কেউ নেই।

কলেজ জীবনে প্রথমে ‘ওথেলো’ পড়ে খুব কষ্ট হয়েছিল অমিতার। তারপর অরসন ওয়েলসের ফিলম, সেটা দেখেও সে চোখের জল সামলাতে পারেনি। সেও তো ভুল বোঝাবুঝির কাহিনি। ওথেলো আর ডেসডিমোনা, দুজনেই সরল নিষ্পাপ, ভালোবাসায় স্বাদ ছিল না, শুধু ভুল বোঝাবুঝির জন্য দুজনেরই জীবন নষ্ট হয়ে গেল। ওই কাহিনিতে অবশ্য একটা খলচরিত্র ছিল, ইয়াগো, সে-ই নানান কুচক্র আর দুজনের মধ্যে চরম অবিশ্বাস এনে দিয়েছে।

একালে আর ওইরকম খলচরিত্র বা তৃতীয় ব্যক্তির দরকার হয় না। মানুষ এমনই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে যে, অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতেই চায় না কিছুতে। ইয়াগোর বদলে স্থান নিয়েছে ইগো। সেই ইগোই যখন তখন সংঘর্ষ বাধায়।

সুবিমলের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়নি অমিতার। কিন্তু কোনো বোঝাবুঝিই কি হয়েছে? এতগুলো বছর একসঙ্গে কেটে গেল, তবু কতটুকু চেনে পরস্পরকে? অমিতার মনের খবর কিছুই রাখে না সুবিমল। অমিতাও কি সুবিমলকে বোঝবার চেষ্টা করেছে? নিজের ব্যাবসা নিয়ে সদা ব্যস্ত সুবিমল, ব্যাবসাই তার ধ্যান-জ্ঞান, তাতে অনেক রকম ওঠা-পড়া থাকে, কখনো কখনো নিশ্চয়ই সে দারুণ মানসিক যন্ত্রণায় থাকে, কিন্তু অমিতা তার ভাগ নিতে পারে না।

বইয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই সুবিমলের, সকালে অন্য পত্রিকায় সামান্য চোখ বুলিয়ে মন দিয়ে পড়ে বিজনেস জার্নাল। তবে, অমিতার বই পড়ায় কখনও বাধা দেয়নি সে। শুধু একদিন তার একটা মন্তব্যে অমিতা যেন আঁতে ঘা খেয়েছিল। রাত্তিরবেলা বই হাতে অমিতাকে দেখে সুবিমল বলেছিল, আজ আবার ওটা কী পড়ছ, কবিতা নাকি? অ্যাঁ?

কথার সুরে এমনই অবজ্ঞার ভাব ছিল যে, তা একেবারেই পছন্দ করেনি অমিতা।

আহতভাবে সে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন, কবিতা পড়াটা কি দোষের?

সুবিমল বলেছিল, ওসব তো কলেজের ছোকরা-ছুকরিরা পড়ে। তোমার বয়েস হয়ে গেছে, টের পাও না? এখনও ওইসব ন্যাকা ন্যাকা কথা ভালো লাগে?

মুখে মুখে তর্ক করা স্বভাব নয় অমিতার। চুপ করে গিয়ে সে মনে মনে গুমরেছিল। বয়েস হয়ে গেলে কবিতা পড়তে নেই? তাহলে বয়েস হয়ে গেলেও কবিরা কবিতা লেখে কেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে আশি বছর বয়েস পর্যন্ত কবিতা লিখে গেলেন, সবই কি অল্পবয়সিদের জন্য? সবই ন্যাকা ন্যাকা কথা?

প্রথম প্রথম অবশ্য সুবিমলকে দলে টানার চেষ্টা করেছে অমিতা। কবিতা শুনে বুঝবে না, কিন্তু গল্প শুনে তো ভালো লাগতে পারে। রাত্তিরে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ার পর অমিতা বলছিল, তুমি তো বই টই পড় না। আজ একটা উপন্যাস পড়ে আমার খুব ভালো লাগল, এত সুন্দর লেখা, তুমি গল্পটা শুনবে?

মেজাজ বেশ প্রসন্ন ছিল সুবিমলের। সে বলেছিল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, শোনাও না গল্প।

তিন থেকে চার মিনিট, তার পরেই নাক ডাকতে শুরু করে তার। অমিতা আদর করে ঠেলা দিয়ে বলে, এই, এই, তার পর শোনো। সুবিমল জড়ানো গলায় বলে, বাকিটা কাল শুনব প্লিজ…

বাড়ি ফিরে প্রতিদিন ঠিক তিন পেগ হুইস্কি পান করার অভ্যাস সুবিমলের। সেই জন্য খাওয়ার পর শোওয়া মাত্র ঘুম। এক বিছানায় পাশাপাশি দুজন। ইদানীং শরীরের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। স্বামী-স্ত্রী মানে একসঙ্গে থাকা, ছেলেমেয়ের মা-বাবা হওয়া তো ঠিকঠাক হয়েই গেছে, সামাজিকতা করার জন্য স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়, অফিসের পার্টিতে সকলেই স্ত্রী আনে, আর বাড়িতে ঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়া…। ন-মাসে ছ-মাসে হঠাৎ যেন মনে পড়ে, শরীর বলে একটা ব্যাপার আছে। ষাট পেরিয়ে গেলেও যে পৌরুষ একেবারে ক্ষয়ে যায়নি, এটা প্রমাণ করার জন্যই যেন সুবিমল দাপাদাপি শুরু করে বিছানায়, আত্মসমর্পণে একটুও কুণ্ঠা প্রকাশ করে না অমিতা , তবু কিছুই যেন আগেকার মতন ঠিক সুরে বাজে না। রতিকর্মটি সেরে ঘুমিয়ে পড়ে সুবিমল, তার স্ত্রীর তৃপ্তি হল কি না, কিছু অসমাপ্ত রইল কি না, সে প্রশ্নই মাথায় আসে না তার।

সুবিমলের তুলনায় অমিতার ঘুম অনেক কম। আলো জ্বেলে বই পড়লে স্বামীর ঘুমের ব্যাঘাত হবে, তাই প্রায়ই রাতে সে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে চলে যায় পাশের ঘরে, বই খুলে বসে। দিনের বেলা অর্ধেক পড়া বই শেষ করার জন্য এক এক রাতে ছটফট করে সে। সব সময় নতুন বই পাবে কোথায়, তাই পুরোনো ক্লাসিক বইগুলিও পড়ে বারবার। শুধু বাংলা নয়, কলেজ জীবন থেকেই সে ইংরেজি সাহিত্য ভালোবাসে, ইংরেজি গোয়েন্দা গল্পও তার প্রিয়, আগাথা ক্রিস্টি মোট আশিখানা বই লিখেছেন, সবই তার পড়া। বেলজিয়ান লেখক জর্জ সিমেনোর বইগুলির ইংরেজি অনুবাদ তার খুব পছন্দ।

বই পড়া শেষ করে বিছানায় ফিরে এসেও কোনো কোনোদিন তার ঘুম আসে না। ছটফট করে। হঠাৎ হঠাৎ এক একজন পুরুষমানুষের কথা মনে পড়ে। হ্যাঁ, স্বামীর পাশে শুয়েও যে সে পরপুরুষের কথা চিন্তা করে, এটা সত্যি। সেইসব পুরুষদের কারো নাম হ্যামলেট, কারো নাম গোরা, কারো নাম শশী, হাল আমলের কয়েকটি নামও আছে। রক্তমাংসের জীবন্ত পুরুষের কথাও যে চিন্তা করে না তা নয়। কয়েক মাস ধরে অনিমেষ রায়চৌধুরী তার রাত্রির শয্যাসঙ্গী, লেখকরা এখন আর অলীক নয়, বই ও পত্রপত্রিকায় প্রায়ই তাদের ছবি ছাপা হয়, টিভিতে দেখা যায়, চেহারা চেনা যায়। অমিতা যে এই লেখকটির খুব ভক্ত তা নয়, তবে পরপর কয়েকটি বই পড়ে প্রায়ই ওঁর সঙ্গে মনে মনে কথা বলে। চাঁচাছোলা ভাষায় ইনি যেভাবে মানুষের জীবনের কথা লিখে যান, তাতে যেন অন্য রকম একটা জীবনদর্শন ফুটে ওঠে। প্রেমের কাহিনিই বেশি লেখেন ইনি, কিন্তু সেই প্রেমে চিরন্তনতা নেই, এটা কিছুতেই মানতে পারে না অমিতা। খানিকটা তির্যকভাবে এই লেখক যেন বলতে চান, হোক না দুবছর বা পাঁচ বছর, তার মধ্যেই ভালোবাসা সার্থক করে নাও। মানুষের জীবনকে ইনি ছোটো করে আনেন। একজন মানুষ আশি বছর বাঁচলেও তার আসল আয়ু যেন বড়ো জোর দশ বছর।

লেখকের সঙ্গে তো ইচ্ছে করলে দেখা করাও যায়। বইমেলায় অনেক লেখককে সই দিতে দেখেছে অমিতা। অনিমেষ রায়চৌধুরিকেও একদিন দেখেছিল নন্দন চত্বরে। ঠিকানা বা টেলিফোন নম্বর জোগাড় করা শক্ত কিছু নয়। কিন্তু পাঠক পাঠিকারা ফোন করলে কি লেখকরা বিরক্ত হন? বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে চাইলে কি দরজা বন্ধ করে দেন মুখের ওপরে? খ্যাতির সঙ্গে কি দাম্ভিক হয়ে যান এঁরা? অবশ্য এঁদের সময়ের দাম আছে, সবাই যদি বাড়িতে গিয়ে জ্বালাতন করে…

সংকোচ কাটিয়ে একদিন ফোন করেছিল অমিতা। অনিমেষ রায়চৌধুরি নিজেই ধরেছিলেন। অমিতার ধারণা ছিল, বিখ্যাত বা ব্যস্ত লোকদের সেক্রেটারি থাকে, তারা আগে ফোন ধরে জিজ্ঞেস করে, কে কথা বলছেন, কী চাই ইত্যাদি। প্রথমেই লেখকের গলা শুনে অমিতা একটু ঘাবড়ে গেল, সে বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি একজন সাধারণ পাঠিকা, কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল— কিন্তু তাকে মাঝপথে থামিয়ে লেখকটি খানিকটা কৌতুকের সুরে বললেন, কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না তো? এরকম তো হয়ই, প্রথম আলাপেই কি গড়গড় করে সব কথা বলা যায়? আমারও তো এরকম হয়, অচেনা কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে পারি না। আপনার নাম কী।

লেখকটির সাবলীল ভঙ্গিতে অনেকটা জড়তা কেটে গেল অমিতার। এরপর কিছুক্ষণ টুকটাক কথা হল। অমিতা জিজ্ঞেস করল, আমি কি একদিন আপনার বাড়ি গিয়ে দেখা করতে পারি? অনিমেষ রায়চৌধুরি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, আসতে পারেন, যে-কোনো রবিবার সকালে। অমিতা তবু জিজ্ঞেস করল, আপনার অসুবিধে হবে না? মানে আপনার যদি সময় নষ্ট হয়…। লেখক বললেন, না, না, রবিবার আমি লিখি না, চলে আসবেন, কোনো অসুবিধে নেই। আমার বাড়ি চেনেন?

সুবিমল ট্যুরে গেছে ছেলেও দুর্গাপুরে, সেই রকম এক রবিবার সকালে অমিতা যাবার জন্য তৈরি হল। স্বামীকে বা ছেলেকে কিছু বলেনি, জানলে ওরা হাসাহাসি, ঠাট্টা-ইয়ার্কি করত নিশ্চিত। বাংলা বাইয়ের লেখক ওদের কাছে অকিঞ্চিৎকর প্রাণী! না জানানোটা কি দোষের? লেখকের বাড়িতে বউ-ছেলেমেয়ে আছে, রবিবার সকালে দেখা করতে যাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কোনো বড়ো মানুষের কাছে প্রথমবার গেলে কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে যাওয়া উচিত। কী নেবে! একটা শার্ট পিস কিংবা পাঞ্জাবি? সেটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? কলম? ওঁদের নিশ্চয়ই অনেক কলম থাকে। শেষ পর্যন্ত পাড়ার দোকান থেকে এক বাক্স সন্দেশ নিয়ে গেল অমিতা।

মাঝপথে এসে অমিতার মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিল। টেলিফোনে আলাপ শুধু গলার আওয়াজ শুনেছেন, লোকটি ভেবে বসেননি তো যে অমিতা একটি তরুণী? ওঁরা তো কমবয়সিদেরই পছন্দ করেন। ওঁদের নায়িকারা সবাই তরুণী। এক প্রৌঢ়াকে দেখে নিরাশ হবেন না তো? হলে তো হবেন, কী আর করা যাবে। পাঠিকাদের সবাইকে সুন্দরী আর তরুণী হতে হবে নাকি? লেখক নিজেই কি কন্দর্পকান্তি? বয়েসও তো কম হল না।

অমিতার অবশ্য এ কথাও মনে হল, এই বয়েসেও তার শরীরের গড়ন অন্য অনেকের চেয়ে ভালো। সাজলে গুজলে এখনও…। জোজোটা মাঝে মাঝে ইয়ার্কি করে বলে মা, ইউ আর গেটিং ইয়ংগার এভরি ডে!

বেল দেবার পর দরজা খুললেন লেখক স্বয়ং। অমিতা আস্তে আস্তে নিজের নাম জানিয়ে বলল, আমি টেলিফোন করেছিলাম, আপনি আসতে বলেছিলেন…

অনিমেষ রায়চৌধুরি আন্তরিক ভদ্রতার সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ আমার মনে আছে, আসুন, আসুন!

মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে বললেন, এসব আবার কেন আনলেন? কে খাবে?

রেখে দিলেন টেবিলের ওপরে।

চেহারায় তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই এই লেখকের, মধ্য বয়েস পেরিয়ে যাচ্ছেন বোঝা যায়। সাজপোশাকের কোনও চেষ্টাও নেই, পাজামার ওপর একটা শার্ট। শার্টের বদলে অন্তত একটা পাঞ্জাবি পরা উচিত ছিল, দাড়ি কামানো হয়নি, কাঁচা-পাকা চুলে চিরুনিও পড়েনি মনে হয়।

পাজামার ওপর শার্ট পরা পছন্দ করেন না অমিতা, কিন্তু মানুষটি যে বিখ্যাত-বিখ্যাত ভাব করে নেই, সেটা তার ভালো লাগল।

বসবার ঘরে এসে সে অবশ্য দমে গেল। বিভিন্ন বয়েসের পাঁচজন নারী-পুরুষ বসে আছে সেখানে। লেখকটি তার সঙ্গে নিরিবিলিতে একলা দেখা করবেন, সেরকম তো কথা দেননি, তবু নিরাশ হয়ে গেল অমিতা। এত লোকের মধ্যে সে কী করে কথা বলবে? আড়ষ্টভাবে বসে পড়ল এককোণে। অন্যদের কথা শুনে সে বুঝতে পারছে, তারা কেউ তরুণ লেখক, কেউ এসেছে সভাসমিতিতে আমন্ত্রণ জানাতে, কেউ প্রকাশক। সকলের সঙ্গেই কথা বলছেন লেখক সরল সাদাসিধে ভাষা, সভা-সমিতির আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানও করছেন নম্রভাবে। একজন কিছু টাকা দিল, তিনি অবহেলার সঙ্গে রেখে দিলেন বুকপকেটে।

এর মধ্যে সকলের জন্য চা এল। লেখকের স্ত্রী একবার একটুক্ষণের জন্য এসে দাঁড়ালেন, দেখলেই বোঝা যায় বিদুষী মহিলা, চেহারাও সুশ্রী, তবে কিছুটা ব্যস্ত ব্যস্ত ভাব। সকালবেলা বাড়িতে এত লোক এলে তো গৃহকর্ত্রীকে ব্যস্ত থাকতেই হয়, মাঝে মাঝেই টেলিফোন বাজছে।

দু-তিনজন লোক উঠে গেল, আরও দু-তিনজন এল। অমিতা ভাবতে লাগল, একজন সাধারণ মানুষ আর একজন লেখকের মধ্যে তফাত কী? কিছুই তফাত নেই, এখানে এসে মনে হচ্ছে। অথচ এই লেখকই তাঁর বইগুলিতে যেন এক অন্য পরিচয়ে উপস্থিত। ধারালো ভাষা, মানুষের মনের গভীরে উঁকি মারার ক্ষমতা, মানুষে মানুষে সম্পর্কের জটিলতার উন্মোচন, জীবন ও মৃত্যুর নতুন ব্যাখ্যা, এইসব যেভাবে পাঠক-পাঠিকার মন আন্দোলিত করে, তার কিছুই এখন টের পাওয়া যাচ্ছে না। অমিতা এই সিদ্ধান্ত নিল যে, লেখকদের সামনাসামনি এসে তাঁদের লেখা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই।

তাহলে আর এখানে এসে লাভ কী? অল্পবয়সি মেয়েরা লেখকের প্রতি ভক্তিতে গদগদ হতে পারে। প্রেমেও পড়ে যেতে পারে, কিন্তু অমিতার তো সে অবস্থা নয়।

শুধু একটা ব্যাপার অমিতা লক্ষ করল, সকলের সঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছেন লেখক, তবু একটু যেন আলগা আলগা ভাব। যেন ভেতরে ভেতরে মানুষটা উদাসীন। অমিতা যে কিছু না বলে চুপ করে বসে আছে, সেজন্যও কোনও প্রশ্ন করলেন না। শুধু দু-একবার অমিতার সঙ্গে চোখাচোখি হতে তাঁর চোখে যেন একটু কৌতুকের ঝিলিক ফুটে উঠল। যেন তিনি অমিতার অস্বস্তিটা উপভোগ করছেন।

ঘন্টাখানেক পরে উঠে পড়ল অমিতা। লেখক তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে মৃদু কণ্ঠে বললেন, আবার আসবেন।

অমিতা ঠিকই করে ফেলেছে, আর আসবে না। একটা কোনও আকর্ষণীয় লেখা পড়লে কারও সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করতে খুব ইচ্ছে করে! কিন্তু আর যার সঙ্গেই হোক, লেখকের সঙ্গে আলোচনা করা যায় না সে-বিষয়ে। ওখানে একজন লোক ওই লেখকের একটা গল্প নিয়ে টিভি সিরিয়াল বানাবে বলে দু-একটি চরিত্র নিয়ে কথা বলছিল। গল্পটা অমিতার পড়া, বেশ মনে দাগ কেটেছিল, কিন্তু স্বয়ং লেখক লাজুক হেসে বললেন, অনেকদিন আগে লেখা তো, গল্পটা আমার ভালো মনে নেই!

অমিতার এই ক্ষুদ্র ও ব্যর্থ অ্যাডভেঞ্চারটার কথা বাড়ির কেউ জানল না। অমিতা ভাবল, ওই লেখকটিকে সামনাসামনি গিয়ে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখার পরও কি তাঁর লেখা পড়তে ভালো লাগবে? পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ওঁর একটা নতুন বই কিনে আনল অমিতা। কিছুটা পড়ার পর লেখকের কথা আর মনে রইল না, কাহিনির চরিত্রগুলি তার কাছে জীবন্ত ও বাস্তব, বিশেষত প্রধান মহিলা চরিত্রটি যেন অমিতারই মনের কথা বলে যাচ্ছে, অমিতা তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গল্পের পুরুষটির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পারে।

অনেকদিন পর সুপর্ণা এসেছে, জোজো বাড়িতে নেই, অমিতার সঙ্গেই গল্প করে গেল কিছুক্ষণ। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা, জিনস ও টি শার্ট পরা। আজকাল একে বলে ইউনিসেক্স পোশাক। এতে অমিতার কোনো আপত্তি নেই। শাড়ি-ব্লাউজ পরতে সময়ও লাগে বেশি, ট্রামে বাসে ঘোরাঘুরি করারও অসুবিধে। অমিতার ঠাকুমা-দিদিমারা ব্লাউজের বদলে শেমিজ পরতেন। তারও আগে মহিলারা শাড়ির নীচে শায়া-শেমিজ কিছুই পরতেন না। মেয়েদের পোশাক অনবরত বদলায়। দিল্লিতে বয়স্কা মহিলারাও শালোয়ার-কামিজ পরে।

একটা ইংরেজি কাগজে কাজ করে সুপর্ণা। ওর সঙ্গে ইংরেজি বই নিয়ে কথা হয়। বাংলা বেশ ভালো বলে সুপর্ণা। কিন্তু বাংলা বই পড়ে না। সুপর্ণা বেন ওকরি-র লেখা ‘দা ফ্যামিশড রোড’ নামে একটা উপন্যাস নিয়ে কথা বলেছিল, অমিতার মাথার মধ্যে সদ্য শেষ করা বাংলা উপন্যাসটা গজগজ করছে, সে প্রায় মরিয়া হয়ে সুপর্ণার সঙ্গেই ওই উপন্যাসটার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইল। বইটা নিয়ে এসে সে বলল, তুমি অনিমেষ রায়চৌধুরির লেখা পড়েছ?

বইটা হাতেও নিল না, একবার মাত্র চোখ বুলিয়ে সে বলল, না আন্টি, বাংলা বই আমার পড়া হয়ে ওঠে না।

অমিতা জিজ্ঞেস করল, কেন পড়ো না? তুমি তো ভালোই বাংলা জানো। ইংরেজি কাগজে কাজ করলে বুঝি বাংলা পড়তে নেই!

সুপর্ণা হেসে বলল, সে রকম কোনো নিয়ম নেই। আমার কলিগরা তো কেউ কেউ পড়ে, আমি পড়ি না। মানে, বাংলা লেখার ঠিক কোনো স্ট্যান্ডার্ড নেই।

অমিতা এবার খানিকটা উগ্রভাবে বলল, কী করে জানলে? যদি তুমি না পড়ো? আচ্ছা, এখানকার লেখার কথা না হয় বাদ দিচ্ছি, তুমি সুকুমার রায়ের কবিতা পড়েছ? একটাও মুখস্থ বলতে পার? সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোঁড়াই চরিতমানস’-এর নাম শুনেছ? সেই লেখার চেয়ে ‘দা ফ্যামিশড রোড’-কে কেউ বেশি ভালো বললে আমি মনে করি সে পাগল!

সুপর্ণা কৌতুকের সঙ্গে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল অমিতার দিকে। তারপর দু-কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, হতে পারে। আমি ট্রাই করে দেখব। কী নাম বললেন বইটার?

এতখানি উত্তেজিত হওয়া অমিতাকে মানায় না। সে লজ্জা পেয়ে গেল। প্রসঙ্গ বদলে অনেক ভালো ভালো কথা বলল সুপর্ণার সঙ্গে। জোর করে নতুন গুড়ের সন্দেশ খাওয়াল।

সুপর্ণা হয়তো তার পুত্রবধূ হবে। খুব ভালো মানাবে। ওরা দুজনেই বাংলা পড়বে না। অমিতার নাতি-নাতনিরাও বাংলা পড়বে না কেউ। ওরা বাংলা থেকে হারিয়ে যাবে। সেটা কী বাংলার ক্ষতি না ওদের ক্ষতি? বাংলা হারিয়ে তার বদলে কী পাবে ওরা? সে যাই হোক, যে কটা দিন ওদের সঙ্গে থাকবে অমিতা, সেই সময়টায় সে তার ভালো লাগার অনুভূতি বিনিময় করতে পারবে না এদের সঙ্গে। দুঃখ সেটাই এবং সে দুঃখ তার নিজস্ব।

আজ একটু বেশি রাত করে ফিরেছে সুবিমল। খাওয়ার আগে হুইস্কি নিয়ে বসেও সে অফিসের কাগজপত্র দেখে। আজ আচমকা অমিতাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি অসিত দাশগুপ্ত নামে কারুকে চেনো?

অমিতা বলল, অসিত, হ্যাঁ, আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়ত।

কাগজ থেকে চোখ না তুলে সুবিমল বলল, খুব ভাবটাব ছিল তোমার সঙ্গে?

না, সে রকম কিছু নয়। এমনি কফি হাউসে আড্ডা দিতাম।

কদিন ধরে আসছে আমার অফিসে। তোমার কথা বলছে, এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে, যেন তোমার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিয়েটিয়ে করতে চেয়েছিল নাকি তোমাকে?

যাঃ, কী যে বলো! চাইলেই বা কে পাত্তা দিত ওকে? সেরকম কিছুই হয়নি।

অনেকদিন বম্বেতে ছিল। এখন কলকাতায় চলে এসেছে, তা জানো?

জানি। এর মধ্যে টেলিফোন করেছিল একদিন।

এখন একটা অর্ডার সাপ্লাই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, আমাদের অফিসের কনট্রাক্ট চায়। তোমার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে এসেছে আমার কাছে। তুমি কী বলো?

আমি কী বলব?

খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি। ওর অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। বম্বেতে কিছু একটা গোলমাল করে এসেছে। একটু শেডি ক্যারেক্টার। আমাদের অফিসের কাজটা না পেলে ও খুবই মুশকিলে পড়বে। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।

তোমার অফিসের ব্যাপারে আমি কোনোদিন মতামত দিয়েছি?

তোমার সঙ্গে ভাব ছিল, এখনও যদি কোনো দুর্বলতা থাকে?

দুর্বলতা আবার কী?

তোমাকে এর মধ্যে ফোন করেছিল, আমায় বলনি তো?

বলিনি, মানে এরকম কতই তো ফোন আসে, সব কি তোমায় বলি? নাকি তোমার শোনবার সময় আছে?

ফোন করেছিল, তার মানে এখনও তোমার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সেটাও কি আমার জানবার কথা নয়?

কিচ্ছু সম্পর্ক নেই। তবু কেউ যদি নিজে থেকে ফোন করে—

তুমি বললে আমি ওকে কাজটা দিতে পারি। আমার পার্টনার তাতে আপত্তি করবে না। যদিও কিছুটা বেনিয়ম করতে হবে।

তা করবে কেন? তুমি যা ভালো বুঝবে, আমি কিছুই বলব না।

এবারে কাগজ থেকে চোখ তুলে অমিতার দিকে কয়েক মুহূর্ত বিচিত্রভাবে চেয়ে থেকে সুবিমল বলল, জোর দিয়ে না-ও বলতে পারছ না! ওলড ক্লেম।

অমিতা আহতভাবে বলল, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?

উঠে দাঁড়িয়ে সুবিমল খানিকটা ঝাঁজালো গলায় বলল, খাবারের ব্যবস্থা করো। অফিসে এসে একজন আমার স্ত্রীর নাম করে…আই ডিটেস্ট ইট!

তারপর আর কোনো কথাই শুনল না সুবিমল। বিছানায় শুয়ে একটাও কথা বলল না, ঠিক চার মিনিট পরে শুরু হল নাক ডাকা।

ঠায় চোখ মেলে জেগে রইল অমিতা। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। এ কী হল? এইভাবেই ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়। কোন অতীত থেকে উঠে এসেছে অসিত, তার প্রতি অমিতার বিন্দুমাত্র দুর্বলতা নেই, তবু কিছু একটা সন্দেহ করছে তার স্বামী। অমিতাও ঠিক মতন বোঝাতে পারেনি, তার ভাষা ঠিক হয়নি, প্রথম থেকেই হাসতে হাসতে উড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল। অসিত ফোন করেছিল, তার উত্তরে অমিতা কী বলেছিল, তা তো জানে না সুবিমল, জানলেও কি ভুল বুঝত? অমিতা উত্তরটা সুবিমলকে বলেনি, হঠাৎ তার মনে লেগেছিল, তার কাছে কোনো ফোন এলে তার জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে?

এতদিন পরে কি সুবিমলের ঈর্ষা হয়েছে? এটা হাসিরও ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো রকম শারীরিক সম্পর্ক নেই, সারা দিনে কথাই বা কটা হয়, তার মধ্যেও ঈর্ষা? তাও অসিতের মতো তুচ্ছ একজনকে নিয়ে?

সকালবেলাতেও সুবিমল গম্ভীর। অমিতা কোনো দোষ করেনি বলেই তার মনের মধ্যে অভিমান জমছে, সেও সহজ হতে পারছে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হলে শেষ পর্যন্ত একজনকে ক্ষমা চাইতে হয়। ঝগড়া তো হয়নি, ক্ষমা চাইবে কে? সুবিমলের উৎকট গাম্ভীর্য দেখে মনে হয়, শুধু অসিতের প্রসঙ্গই নয়, আরও যেন কিছু ব্যাপার আছে। সেই আরও কিছুকে আড়াল করার জন্যই যেন কাল হঠাৎ অসিতের কথা তুলল সুবিমল। আর কী হতে পারে? সে কথা বলছে না কেন সুবিমল?

দুপুরবেলা অফিস থেকে সুবিমলের সেক্রেটারি ফোন করে জানিয়ে দিল, বিশেষ কাজে সন্ধের ফ্লাইটেই সাহেবকে দিল্লি যেতে হবে। বাড়ি ফেরার সময় হবে না, একটু পরে ড্রাইভার এসে জামাকাপড়ের সুটকেসটা নিয়ে যাবে।

হঠাৎ হঠাৎ দিল্লি-মুম্বাই যাওয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু সুবিমল সেটা নিজে জানাতে পারল না অমিতাকে? সে এতই ব্যস্ত? কিংবা সে অমিতার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে না?

অমিতার চোখ জ্বালা করে এল। এসব কী হচ্ছে? ক্রমশ ফাটল বাড়বে? কোন কাঁটা ঢুকেছে সুবিমলের মনের মধ্যে? সুবিমল যে এতবার বাইরে যায়, সবই কি অফিসের কাজে? অমিতার মনে মাঝে মাঝে এ প্রশ্ন জাগে, কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারে না।

জোজো বাড়িতে নেই, অমিতা একা, এক সময় সে একেবারে অধীর হয়ে পড়ল। ফোন করল স্বামীর অফিসে। সেক্রেটারি জানাল, সাহেব নেই, তাঁকে যেতে হয়েছে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। কিন্তু এক্ষুনি যে একবার সুবিমলের সঙ্গে তার দেখা করা দরকার। কী করে তা হবে?

ঝোঁকের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরল অমিতা। স্বামীর অফিসে সে কোনোদিন যায়নি, একটা অনুচ্চারিত নিষেধও যেন আছে। অমিতা যাদবপুরের দিকে চলে এল, সেই পোড়ো বাড়িটার কাছে এসে ছেড়ে দিল ট্যাক্সি।

একটা বাজ-পড়া মরা গাছের মতন দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। এটা ভেঙে ফেলে আবার কেউ একটা নতুন বাড়ি বানাতেও চায় না? এ রকম অবস্থাতেই থাকবে?

এই বাড়িটা ছিল অশোক আর ঊর্মিলার। ভুল বোঝাবুঝি আর প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে ওরা দূরে সরে গেছে। অহং-এর সংঘর্ষে পুড়ে গেছে এই সংসার। অথচ ভালোবাসা ছিল। কোথায় গেল সেই ভালোবাসা?

অশোক আর ঊর্মিলা, তোমরা কোথায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *