অমাবস্যা

অমাবস্যা

দার্জিলিং কিংবা সিমলার মতো একটি শৈল-নগর। উঁচু-নীচু রাস্তা, ছবির মতো বাড়ি। নগরের এক প্রান্তে খাড়া পাহাড়, তার কোলে গভীর খাদ।

একটি স্থান বন-জঙ্গলে ঢাকা, পাকা রাস্তা এখন পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। পাহাড়ের ফাঁকে একটা সমতল পাথর খাদের ওপর ঝুঁকে আছে। লোকে বলে বাঘের জিভ। পাঁচ-ছয় হাত চওড়া, দশ-বারো হাত লম্বা পাথরটা যেন খাদের ওপর সেতু বাঁধতে গিয়ে এক-পা এগিয়েই থেমে গেছে।

একদিন অপরাহ্নে এই কাহিনীর নায়িকা পূষ্পা একা এই বাঘের জিভের ওপর বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছিল। পিছনে রাস্তার ওপর তার ছোট্ট টু-সীটার গাড়িটা রয়েছে। পুষ্পা থেকে থেকে উৎসুক চোখে পিছু ফিরে তাকাচ্ছে, মনে হয় সে কারুর জন্যে অপেক্ষা করছে।

দূর থেকে একটি মোটরের গুঞ্জন শোনা গেল। একটি বড় গাছের গাড়ি পুষ্পার গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল। চালকের আসন থেকে অবতীর্ণ হলো এক কান্তিমান যুবক, নাম দীপনারায়ণ। তাকে দেশে পুষ্পার মুখে হাসি ফুটল। দীপনারায়ণ এসে পুষ্পার পাশে বসল। বেশ বোঝা যায় তারা পরস্পরের প্রতি আসক্ত।

পুষ্পা বলল, ‘কি করে জানলে আমি এখানে এসেছি?’

দীপ বলল, ‘একটি ছোট্ট পাখির মুখে শুনলাম।’

তারপর দু’জনে ফষ্টিনষ্টি হাসি-মস্করায় মগ্ন হয়ে গেল।

কিন্তু বেশীক্ষণের জন্যে নয়। মৃদু মোটরহর্নের শব্দে চকিত হয়ে দু’জনেই ঘাড় ফেরাল। দেখল, তৃতীয় মোটর এসে হাজির হয়েছে এবং রাজমোহন নামক যুবা তা থেকে নামছে। পুষ্পা ও দীপের মুখ ম্লান হয়ে গেল।

রাজমোহন দীপনারায়ণের সমবয়স্ক, সে-ও সুপুরুষ, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে কুটিলতা মেশানো আছে। সে কাছে এসে দাঁড়ালে পুষ্পা মুখে একটু হাসি এনে বলল, ‘তুমিও কি কাক-কোকিলের মুখে খবর পেয়েছিলে নাকি?’

রাজমোহন ভারী গলায় বলল, ‘না। তোমার বাড়িতে গিয়ে শুনলাম তুমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছ। আমার মন বলল তুমি এখানে এসেছ, তাই চলে এলাম।’

সে তাদের সামনে বসল, তার সন্দিগ্ধ চোখ দু’জনের মুখের ওপর যাতায়াত করতে লাগল।

কিন্তু আসর আর জমল না। কিছুক্ষণ ছাড়া ছাড়া কথাবার্তা চালাবার পর পুষ্পা উঠে পড়ল, বলল, ‘এবার আমায় বাড়ি ফিরতে হবে। পুলিস সুপারিন্টেন্ডেন্টের বোন হয়ে জন্মানো যে কী গুরুতর ব্যাপার তা তো তোমরা জান না, সন্ধ্যের আগে বাড়ি না ফিরলে সারা শহরের পুলিস আমাকে খুঁজতে বেরুবে।’ একটু হেসে নড্‌ করে পুষ্পা চলে গেল।

দু’জনে উঠে গিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছিল। পুষ্পার গাড়ি দূরে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর রাজমোহন দীপের দিকে ফিরে সহজ বন্ধুত্বের সুরে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে দীপ।’

রাস্তা এবং বাঘের জিভের সন্ধিস্থলে প্রকাণ্ড শিবলিঙ্গের মতো একটা পাথর খাড়া দাঁড়িয়ে ছিল, দীপ অলসভাবে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কি কথা?’

রাজমোহন বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি পুষ্পাকে বিয়ে করতে চাও। আমিও চাই তাকে বিয়ে করতে। এখন কথা হচ্ছে কে তাকে বিয়ে করবে।’

মৃদু কৌতুকের সুরে দীপ বলল, ‘বাছাবাছির ভারটা পুষ্পার ওপর ছেড়ে দিলে হয় না?’

রাজমোহন বলল, না, হয় না। আমি বেঁচে থাকতে তুমি পুষ্পাকে পাবে না, তুমি বেঁচে থাকতে আমি পুষ্পাকে পাব না। এর নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। দ্যাখো, তুমি বড়মানুষ, আমারও পয়সার অভাব নেই; আমাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি ভাল দেখায় না। চল আমার বাড়িতে, সেখানে কথা হবে।—ভাল কথা, ওই পাথরটার ওপর অমনভাবে হেলান দেওয়া ঠিক নয়, মনে হয় ওটা যেন একটু দুলছে।’

দীপ সোজা হয়ে দাঁড়াল। পাথরটা টলমল করতে লাগল, যেন একটু ঠেলা দিলেই বাঘের জিভের ওপর দিয়ে গড়িয়ে খাদে পড়বে।

দীপ বলল, ‘তোমার বাড়িতেই চল, কী তোমার প্রস্তাব শোনা যাক।’

রাজমোহনের বাড়িটি চমৎকার। সামনে বিস্তীর্ণ ফুলের বাগান। সেদিন রাজমোহনের বোন পুর্ণিমা বাগানে ফুল তুলে তোড়া বাঁধছিল, রাজমোহন ও দীপনারায়ণের মোটর আগে পিছে ফটক দিয়ে প্রবেশ করছে দেখে চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে রইল।

গাড়ি-বারান্দায় দু’টি গাড়ি থামল, দু’জনে গাড়ি থেকে নামল। রাজমোহন তার খাস চাকর সেওলালকে ডেকে বলল, ‘আমরা বসবার ঘরে যাচ্ছি, শরবত নিয়ে এস।’ সেওলালকে দেখেই চেনা যায় ধূর্ত প্রকৃতির লোক।

রাজমোহন দীপকে বসবার ঘরে নিয়ে গেল। বাগানের দিকের জানলা খুলে দিয়ে দু’জনে টেবিলের দু’পাশে বসল। সেওলাল দু’গ্লাস শরবত রেখে চলে যাবার পর রাজমোহন দেরাজ থেকে দুটো ওষুধের ট্যাবলেট বের করে বলল, ‘এ দুটো কিসের বড়ি বলতে পার?’

দীপ ঈষৎ বিস্ময়ে বড়ি নিরীক্ষণ করে বলল, ‘তা কি করে বলব? কুইনিন নাকি?’

রাজমোহন বলল, ‘একরকম দেখতে হলেও দুটো এক জাতের বড়ি নয়। একটি মারাত্মক বিষ, খেলেই মৃত্যু; অন্যটি সাধারণ বড়ি—অ্যাসপিরীন।’

দীপ শঙ্কা-ভরা চোখে চেয়ে বলল, ‘তোমার মতলবটা কি?’

রাজ হেসে বলল, ‘মতলব খুব সোজা। আমরা দু’জনেই তো পুষ্পাকে বিয়ে করতে পারিনে, একজনকে সরে দাঁড়াতে হবে। এস, আমরা এই বড়ি দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিই। কোনও হাঙ্গামা নেই, বেছে নিয়ে যে-যার শরবতের গ্লাসে ফেলে ঢক করে খেয়ে ফেলা। ব্যস, নিষ্পত্তি হয়ে গেল। তোমার কপালে যদি বিষের বড়ি ওঠে তাহলে এক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু, কোনও যন্ত্রণা নেই, কিছু টের পাবে না। আর আমার কপালেই যদি মৃত্যু থাকে, ঠেকাবে কে? পুষ্পা কার হবে এ নিয়ে আর তকরার থাকবে না। কেমন? এবার এস, নিজের বড়ি বেছে নাও।’

দীপ এতক্ষণ স্তম্ভিতভাবে চেয়ে ছিল, এখন বলে উঠল, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি।’

রাজ ব্যঙ্গ করে বলল, ‘তুমি দেখছি ভয় পেয়েছ বন্ধু! মৃত্যুকে এত ভয়!’

দীপ বলল, ‘মৃত্যুকে ভয় করি না। কিন্তু এ যে নিছক পাগলামি।’

রাজ বলল, ‘কেন, পাশ্চাত্য দেশে প্রণয়িনীর জন্যে ডুয়েল লড়ত, শোননি?’

শেষ পর্যন্ত মোহগ্রস্তের মতো দীপ রাজি হলো। একটি বড়ি রাজের হাত থেকে তুলে নিয়ে নিজের গ্লাসে ফেলল। রাজও অন্য বড়িটি নিজের গ্লাসে ফেলে বলল, ‘এস, চুমুক দেওয়া যাক, দেখি ভাগ্যলক্ষ্মী কার গলায় মালা দেন।’

বিলিতি কায়দায় তারা গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়েছে এমন সময় খোলা জানলা দিয়ে ফুলের তোড়া এসে পড়ল গ্লাসের ওপর, দুটো গ্লাসই টেবিলের ওপর পড়ে চূর্ণ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গরাদহীন জানলা দিয়ে ভয়ার্ত মুখে প্রবেশ করল পূর্ণিমা। রাজ কটমট করে তার পানে তাকিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার! আমরা শরবত খাচ্ছি—’

পূর্ণিমা কান্না-মেশানো চিৎকার করে বলল, ‘মিথ্যে কথা বলো না, আড়াল থেকে আমি সব শুনেছি। (দীপের প্রতি) দাদা পুষ্পার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছে, তুমিও কি তাই?’

লজ্জাহত স্বরে দীপ বলল, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ পূর্ণিমা। তোমার দাদার ছোঁয়াচ লেগে আমিও প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আর এখানে নয়, আমি চললাম!’ দীপ চলে গেল।

পুর্ণিমা কিছুক্ষণ রাজের ক্রুদ্ধ-বিফল মুখের পানে চেয়ে থেকে বলল, ‘দাদা, তোমার মতলবটা কি বলো দেখি?’

কোণ-ঠাসা বিড়ালের মতো রাজ ফোঁস করে উঠল, ‘মতলব আবার কি! আমি ওকে সরাতে চাই।’

‘খুন করতেও তোমার দ্বিধা নেই। কিন্তু তুমি জানলে কি করে যে দীপই বিষের বড়ি তুলে নেবে?’

রাজ হিংস্র হাসি হেসে বলল, ‘মেয়ে-বুদ্ধি আর কাকে বলে! গোড়ায় দুটো বড়িই বিষের বড়ি ছিল, তারপর আমার নিজের গ্লাসে বড়ি ফেলবার সময় হাত-সাফাই করলাম।’

‘হাত-সাফাই!’

‘হ্যাঁ। বিষ-বড়ির বদলে একটা নির্দোষ বড়ি গ্লাসে ফেললাম।’

‘উঃ! কী সাংঘাতিক মানুষ তুমি! তোমার শরীরে দয়া-মায়া বলে কিছু নেই?’

‘না। পুষ্পাকে আমি চাই, যে ভাবেই হোক ওকে আমার চাই।’ হঠাৎ থেমে গিয়ে রাজ চোখ ছোট করে পূর্ণিমার পানে চাইল—‘তুই—তুই দীপনারায়ণকে ভালবাসিস?’

পুর্ণিমা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল, চোখে আঁচল দিয়ে অস্পষ্টভাবে ঘাড় নাড়ল।

রাজ লাফিয়ে উঠে উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘তাহলে তুই তার মন ভোলাবার চেষ্টা করছিস না কেন? তুই দেখতে সুন্দরী, নাচ-গান জানিস; দীপের মন পেতে আর বেশী কী দরকার? দীপ যদি তোর প্রেমে পড়ে আমার রাস্তা সাফ, পুষ্পাকে বিয়ে করার আর কোনও বাধা থাকে না।’

পূর্ণিমা অসহায়ভাবে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ও যদি আমার পানে ফিরে না চায়, আমি কি করব?’

মুখে রাগ আর অসন্তোষ নিয়ে রাজ তার পানে চেয়ে রইল।

দীপ নিজের বাড়িতে ফিরে এল। রাজের বাড়ির মতোই সুন্দর বাগান-ঘেরা দোতলা বাড়ি। বাড়িতে সে একলা থাকে, সঙ্গীর মধ্যে ম্যানেজার বজ্‌রঙ্‌ আর বুড়ো চাকর কেশব।

দীপ নিজের বসবার ঘরে গিয়ে টেবিলের সামনে গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে লাগল। পুষ্পা—রাজ—পুষ্পা—তার মাথার মধ্যে চক্রাকারে ঘুরতে লাগল।

ম্যানেজার বজ্‌রঙ্‌ এসে টেবিলের পাশে দাঁড়াল, মৃদু সম্ভ্রমের সুরে কথা বলতে লাগল। সে অতি মিষ্টভাষী, কিন্তু মনে জিলিপির প্যাঁচ। ব্যবসায়ে দীপের অমনোযোগিতার সুযোগ নিয়ে সে নিজে বেশ গুছিয়ে নিচ্ছে। দীপকে ইদানীং প্রায়ই বাইরে যেতে হয়, তাই বজ্‌রঙ্‌ সময়মত ট্যাক্স ইত্যাদি দিতে পাচ্ছে না, এই ধরনের একটা অজুহাত দেখিয়ে সে ইতিমধ্যে দীপের কাছ থেকে মোক্তারনামা লিখিয়ে নিয়েছে; এখন সে দীপকে দিয়ে ব্যাঙ্কের একটি চিঠি সই করিয়ে নিল যাতে বজ্‌রঙ্‌ও দীপের পক্ষে ব্যাঙ্ক থেকে চেক্‌ কেটে টাকা তুলতে পারে। দীপ অন্যমনস্কভাবে চিঠি সই করে দিয়ে ভাবতে লাগল—পুলিসের বড়সাহেব বোধহয় অমত করবেন না—

বুড়ো চাকর কেশব কফির ট্রে নিয়ে এল। বিড় বিড় করে বজ্‌রঙের নামে অনেক অভিযোগ করল, বজ্‌রঙ্‌ নাকি মদ খায়। মদের টাকা আসে কোথা থেকে? নজর না রাখলে ঘরের ঢেঁকি কুমির হয়। ইত্যাদি। দীপ তার কথায় কান দিল না, কফির পেয়ালায় কালো কফি ঢেলে খেতে লাগল। কেশো বকতে বকতে চলে গেল।

পুলিসের বড়সাহেব রণবীর আর পুষ্পা তাদের বাংলোতে নৈশাহার শেষ করে কফি খাচ্ছে রণবীরের বয়স চল্লিশের নীচে; মিলিটারি ধরনের দীর্ঘ দৃঢ় শরীর। ড্রয়িংরুমে কফি খেতে খেতে ভাই-বোনে গল্প হচ্ছে।

রণবীর বলল, ‘আজ বিকেলে কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলি?’

পুষ্পা বলল, ‘বাঘের জিভের ওপর গিয়ে বসেছিলুম।’

রণবীর সকৌতুকে ভুরু তুলে প্রশ্ন করল, ‘একা?’

‘একাই গিয়েছিলুম। পরে আরো দু’জন এল।’

‘দু’জন? দীপনারায়ণ আর রাজমোহন। কেমন?’

‘হ্যাঁ। তুমি কি গুপ্তচর লাগিয়েছ নাকি?’

রণবীর হাসল, ‘না। ওদের মতলব বুঝতে দেরি হয় না। তোকে আর একলা থাকতে দিতে চায় না, নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলতে চায়। তা তোর কোন্‌টিকে পছন্দ?’

পুষ্পা সলজ্জ স্বরে বলল, ‘তোমার কাকে পছন্দ আগে বলো।’

রণবীর বলল, ‘দু’জনেই তো যোগ্য পাত্র মনে হয়। শিষ্ট, ভদ্র, পয়সাকড়ি আছে। তবে দীপ যেন একটু বেশী ভাল। (পুষ্পা মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল) ঠিক ধরেছি তাহলে? কিন্তু তোর যাকেই পছন্দ হোক, আমার অবস্থা সমান, তুই স্বামীর ঘরে চলে গেলে আমি একলা পড়ে যাব।’

‘দাদা!’ পুষ্পা উঠে গিয়ে রণবীরের পিছনে দাঁড়াল, তার কাঁধে দু’হাত রেখে বলল, তুমি এবার বিয়ে কর-না দাদা। আমার জন্যে কতদিন আইবুড়ো থাকবে? তোমার বোধ হয় ভয় যে, তুমি বিয়ে করলেই আমি তোমার বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দেব, তাই আমাকে বিদেয় না করা পর্যন্ত বিয়ে করছ না। সত্যি বলছি আমি তোমার বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া করব না।’

রণবীর পুষ্পার হাতের ওপর হাত রেখে হেসে উঠল, ‘দূর পাগলি! সে জন্যে নয়। আসলে নিজের জন্যে বৌ খোঁজা একটা ঝামেলা। তা তুই না হয় আমার ঘটকালি কর। তোর তো অনেক বান্ধবী আছে।’

পুষ্পা বলল, ‘তুমি তো আমার সব বান্ধবীকেই চেনো, বলো না কাকে তোমার পছন্দ।’

‘আমার আবার পছন্দ, যাহোক একটা হলেই হলো।’ ক্ষণেক চুপ করে থেকে হঠাৎ রণবীর বলল, ‘আচ্ছা, রাজমোহনের একটি বোন আছে না? কী নাম তার—’

‘পূর্ণিমা।’

‘কেমন মেয়ে বল দেখি? দেখতে তো ভালই। স্বভাব কেমন?’

‘ভারি নরম মিষ্টি স্বভাব, ঠিক যেমনটি তোমার দরকার।— তাহলে ঘটকালি করি?’

রণবীর হেসে বলল, ‘কর। কিন্তু আমি তো বুড়ো বর, রাজমোহন আমার হাতে কি বোনকে দেবে?’

পুষ্পা সগর্বে বলল, ‘দেবে না আবার, স্বর্গ হাতে পাবে।’

পরদিন বিকেলবেলা দীপ রণবীরের বাংলোতে গেল। বাগানের এক কোণে ঝোপঝাড়ের আড়ালে একটি দোলনা আছে, দীপ জানে সেটি পুষ্পার প্রিয় স্থান। সে সেইদিকে চলল।

কিন্তু রাজমোহন আগেই সেখানে হাজির হয়েছিল এবং বিলিতি কায়দায় পুষ্পার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করছিল। প্রস্তাবটা খুব অপ্রত্যাশিত নয়, তবু পুষ্পা ঘাবড়ে গিয়ে দোলনায় বসে শঙ্কিতভাবে এদিক ওদিক চাইছিল। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে রাজ আরো আবেগভাবে প্রস্তাব করছিল। এই সময় পুষ্পা দীপকে আসতে দেখে যেন অকূলে কূল পেল। সে আহ্বানসূচক হাত তুলল।

রাজ তখন দেখল দীপ আসছে, তখন সে রাগে অধর দংশন করল, তারপর মুখ অন্ধকার করে চলে গেল।

দীপ এসে কাছে দাঁড়াতেই পুষ্পা সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাব্বাঃ! আর একটু হলেই গিয়েছিলুম।’

সে দোলনার একপাশে সরে গিয়ে দীপের জন্যে জায়গা করে দিল; দীপ তার পাশে বসে উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ‘কী হয়েছে? রাজ চলে গেল দেখলাম—সে কি তোমাকে কিছু বলেছে নাকি?’

মুখে ছদ্ম গাম্ভীর্য এনে পুষ্পা বলল, ‘হুঁ। গুরুতর কথা বলেছে। এবার তুমি কি বলবে বলো।’

দীপ প্রশ্ন করল, ‘আমি কী বলব?’

নিরাশ মুখভঙ্গি করে পুস্পা বলল, ‘তোমার কিছু বলবার নেই?’

‘কিছু না তো। হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে।— তোমার দাদা কোথায়?’

‘বাড়িতেই আছেন, দপ্তরে কাজ করছে। দাদার সঙ্গে তোমার কী দরকার?’

‘তাঁর একমাত্র ছোট বোনকে আমি বিয়ে করব, তাই তাঁর অনুমতি চাইতে হবে।’

পুষ্পার মুখে নবারুণের রঙ ফুটল। সে দীপের পানে চকিত বিদ্যুৎবিলাসের মতো দৃষ্টি হেনে খাটো গলায় বলল, ‘তাই নাকি! আর একমাত্র ছোট বোন যদি বলে তোমাকে বিয়ে করবে না?’

‘তাহলে তাকে এমনি করে পক্ষিরাজ ঘোড়ার পিঠে তুলে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাব।’ দীপ সজোরে দোলনা দুলিয়ে দিল। হঠাৎ দোল খেয়ে পুষ্পা দীপের গলা আঁকড়ে ধরল, তারপর বুকের ওপর মাথা রাখল।

পরদিন সকালবেলা পূর্ণিমা নিজেদের বাগানে বিষগ্ন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, এমন সময় দীপ এল। হাসিখুশি মুখে বলল, ‘সুপ্রভাত, পূর্ণিমা।’

পূর্ণিমা বলল, ‘সুপ্রভাত। তোমাকে আজ খুব খুশি মনে হচ্ছে।’

দীপ হেসে বলল, ‘খুশির কারণ কাছে, যথাসময় জানতে পারবে। —রাজ কোথায়?’

পূর্ণিমা বলল, ‘বাড়িতেই আছে। কেমন যেন মন-মরা ভাব। কিছু দরকার আছে?’

‘না—এমন কিছু নয়—আমি দেখি—’ দীপ বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। পূর্ণিমা সন্দিগ্ধভাবে চেয়ে রইল, তারপর দূরে থেকে দীপের অনুসরণ করল।

দীপ রাজের বসবার ঘরে গিয়ে দেখল রাজ চিন্তামগ্নভাবে একলা বসে আছে। সে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘ভাই রাজ, তোমার শুভেচ্ছা চাইতে এসেছি, ভাগ্যদেবী আমার ওপর প্রসন্ন হয়েছেন।’

রাজ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল, ‘তার মানে পুষ্পা তোমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে?’

দীপ বলল, ‘হ্যাঁ। রণবীরও সম্মতি দিয়েছেন।—তুমি মনে ক্ষোভ রেখো না বন্ধু।’ সে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল।

রাজ মুখে তিক্ত হাসি নিয়ে করমর্দন করল, ‘না, ক্ষোভ কিসের। একজনকে তো পরাজয় স্বীকার করতেই হবে। তোমাকে আমার অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

পূর্ণিমা জানলার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনল, তারপর দীপ যখন চলে গেল তখন বুকের জ্বালা দমন করে ঘরে ঢুকল, রাজের দিকে বাঁকা বিদ্রুপভরা চোখে চেয়ে বলল, ‘তাহলে দীপ তোমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিল।’

রাজের মুখ হিংস্র হয়ে উঠল, সে চাপা তর্জনের সুরে বলল, ‘এখনি হয়েছে কী, এই তো সবে শুরু। যুদ্ধ যখন শেষ হবে তখন দেখিস।’

পূর্ণিমা বলল, ‘এখন আর তুমি কী করতে পার?’

রাজ বিকৃত হেসে বলল, ‘বিয়ে তো আর আজই হচ্ছে না। তার আগে অনেক কিছু ঘটতে পারে।’ ফস করে লাইটার জ্বেলে সে সিগারেট ধরাল।

পুষ্পার বিয়ের এনগেজমেন্ট উপলক্ষে রণবীর বেশ ঘটা করল। বাড়িতে নহবত বসল। বাগানের মাঝখানে রঙ্গমঞ্চ খাড়া হলো, সেখানে নাচ-গানের আসর বসবে। শহরের যত গণ্যমান্য লোক নিমন্ত্রিত হলো; রণবীর নিজে পুষ্পাকে নিয়ে রাজমোহনের বাড়িতে গেল, বিশেষ করে পূর্ণিমাকে নিমন্ত্রণ করল। বলল, ‘তুমি পুষ্পার বান্ধবী; শুনেছি নাচ-গান জান। আমরা প্রত্যাশা করব তুমি তোমার নাচ-গান দিয়ে নিমন্ত্রিতদের সমাদর করবে। আমি মনে করি তুমি আমারই বাড়ির একজন।’

রণবীরের অকপট আগ্রহ দেখে পূর্ণিমা ম্রিয়মাণভাবে সম্মত হলো। রাজমোহনও দেঁতো হাসি হেসে বলল, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়। আমিও যাব, এ তো আমাদের বাড়ির কাজ।’

নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যার পর বাগানের গাছে গাছে বিদ্যুতের রঙীন দীপালি জ্বলে উঠল; রঙ্গমঞ্চের সামনে চেয়ারের সারি, তাতে অতিথিরা বসল। তকমা-আঁটা ভূত্যেরা নিঃশব্দে আহার্য পানীয় আইসক্রিম পরিবেশন করতে লাগল। নহবতের মিষ্টি সুরের সঙ্গে মিশে আলো-ঝিলমিল দৃশ্যটি যেন স্বপ্নময় হয়ে উঠল।

রঙ্গমঞ্চে একজন বাজিকর এসে নানা রকম ইন্দ্রজাল দেখালেন। তারপর এলেন এক ওস্তাদ, কালোয়াতি গান শুনিয়ে সঙ্গীত-রসিকদের মুগ্ধ এবং বেরসিকদের বিরক্ত করলেন। সর্বশেষে এল পুর্ণিমা; দেবযানীর ভূমিকায় সে কচকে বিদায় দেওয়ার উপলক্ষে নৃত্য করবে। একক নৃত্য। পূর্ণিমা মঞ্চে এসে দাঁড়াল, তারপর বাদ্যের তালে তালে তার দেহ দুলতে লাগল; অদৃশ্য প্রণয়াস্পদকে সে বিদায় দিচ্ছে। তার নৃত্যে প্রিয়-বিদায়ের অন্তর্গূঢ় বেদনা মথিত হয়ে উঠল। নৃত্যের চরম মুহূর্তে সে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

রণবীর দর্শকদের মধ্যে প্রথম সারিতে বসেছিল, সে এক লাফে মঞ্চে উঠে পূর্ণিমাকে পরীক্ষা করে দেখল, তারপর দুই বাহুতে তুলে নিয়ে সটান বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল। দীপ ও রাজ তার সঙ্গে সঙ্গে গেল। রণবীর পূর্ণিমাকে একটা সোফায় শুইয়ে দিয়ে মুখে জলের ছিটে দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে পূর্ণিমা চোখ খুলল। রণবীর রাজকে বলল, ‘তোমরা সভায় যাও, আমি পূর্ণিমার কাছে আছি।’

রাজ ও দীপ নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল। খবর পেয়ে পুষ্পা ছুটে এল, ‘দাদা, কী হয়েছে পূর্ণিমার? আমি বাড়ির মধ্যে এসেছিলুম দু’-মিনিটের জন্যে—’

রণবীর বলল, ‘কিছু নয়, তুই চট করে একটু ব্রাণ্ডি নিয়ে আয় তো পুষ্পা।’ সে ইশারা করে চোখ টিপল।

পুষ্পা মুচকি হেসে বলল, ‘দেখি, ব্র্যান্ডির বোতল কোথায় আছে খুঁজে বার করতে হবে তো।’ পূর্ণিমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে সে চলে গেল।

বাইরে তখন মঞ্চের ওপর একটি গায়িকা মিহি সুরে গজল গাইছিলেন। রাজ ও দীপ একটু দূরে একটি বিদ্যুদ্দীপমণ্ডিত গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে গল্প করছিল।

রাজ বলল, ‘তুমি হাত-দেখায় বিশ্বাস কর? সেদিন বাঘের জিভের নীচে জঙ্গলের মধ্যে এক সাধুর সঙ্গে দেখা। লোকটার আশ্চর্য ক্ষমতা। আমার হাত দেখে বলেছিল আমার বোনের অসুখ হবে।’

দীপ সাগ্রহে বলল, ‘তাই নাকি! আর কী বলল?’

রাজ মলিন হেসে বলল, ‘আর বলল, প্রণয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমি হেরে যাব।’

‘সত্যি! আশ্চর্য সাধু। কোথায় থাকেন?’

‘নীচে ঝর্ণার কাছে একটা গুহার মত আছে, সেইখানে থাকেন। কেন বলো দেখি?’

‘পুষ্পাকে সুখী করতে পারব কিনা এই ভাবনা এখন মাথায় ঢুকেছে। তোমার সাধু যদি বলতে পারেন—’

‘পারবেন, পারবেন। তুমি একবার গিয়েই দেখ না।’

‘যাব। আমার অবশ্য কোনও কুসংস্কার নেই, কিন্তু—’

‘তা তো বটেই। আমারও কুসংস্কার নেই, কিন্তু—’

দু’জনে একসঙ্গে হেসে উঠল।

তারপর যথাসময় উৎসব শেষ হলো। পূর্ণিমাও সুস্থ হয়েছে, তাকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। তাকে নিয়ে রাজ বাড়ি ফিরে এল। রাজের মনও বেশ প্রফুল্ল। এত সহজে যে দীপ ফাঁদে পা দেবে তা সে আশা করেনি।

খাদের সঙ্কীর্ণ পথে ক্ষুদ্র হ্রদের কাছে পাহাড়ের গায়ে একটা খোঁদলের মতো তৈরি হয়েছে; তারই মুখের কাছে সাধুবাবা বসে আছেন। সামনে ধুনী জ্বলছে। বাবার মাথায় জটা, দাড়ি-গোঁফে মুখ আচ্ছন্ন। গঞ্জিকার প্রসাদে রক্তবর্ণ চক্ষু দু’টি ঘূর্ণিত হচ্ছে।

দীপকে দেখে বাবা চেরা গলায় বললেন, ‘আও বেটা। তোমার জন্যে বসে আছি। জানতাম তুমি আসবে।’

দীপ পুলকিত হয়ে বলল, ‘জানতেন! কী করে জানলেন বাবা?’

বাবা বললেন, ‘একটা ছোট্ট কাঠবেরালি আমাকে বলে গেল। বস, বস। কী জানতে চাও জানি। কিন্তু তুমি নিজের মুখেই বলো।’

বাবার পাশে উপবিষ্ট হয়ে দীপ তদ্‌গত কণ্ঠে বলল, ‘বাবা, একটি মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, শিগগির বিয়ে হবে। এখন আমার ভাবনা হয়েছে স্ত্রীকে আমি সুখী করতে পারব তো?’

বাবা কিছুক্ষণ শিবনেত্র হয়ে রইলেন। অর্ধস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন—‘ফড়িং ফড়িং ফড়িং।’ তারপর দীপের মুখের ওপর চোখ রেখে বললেন, ‘বাধা আছে, তোমার বিয়ে সুখের হবে না—’

‘অ্যাঁ, সে কি কথা বাবা! তবে আমি এখন কী করব?’

‘দৈব উপায় আছে, আমি বাতলে দিতে পারি। শুনবি?’

‘হ্যাঁ বাবা।’

‘শোন তবে। আজ অমাবস্যা। এই ধুনী থেকে ছাই দিচ্ছি, ভাল করে রাখ।’

বাবা এক মুঠি ছাই দীপকে দিলেন, সে রুমালের খুঁটে বেঁধে পকেটে রাখল—‘তারপর বাবা?’

বাবা ঊর্ধ্বদিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে বাঘের জিভ দেখছিস, খাদের ওপর বেরিয়ে আছে—আজ অমাবস্যার রাত দুপুরে ধুনীর ভস্ম নিয়ে ওই জিভের ওপর গিয়ে বসবি। ছাই মুখে মেখে ফেলবি, তারপর খাদের দিকে মুখ করে বসে চোখ বুজে জপ করবি—কিড়িং ফুঃ! কিড়িং ফুঃ! কিডিং ফুঃ! রাত বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত যদি জপ করতে পারিস তাহলে সব রিষ্টি কেটে যাবে, সংসার সুখের হবে।’

দীপ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ব্যস, আর কিছু করতে হবে না? শুধু কিড়িং ফু মন্ত্র জপ?’

‘হ্যাঁ—শুধু একটা কথা মনে রেখো। জপ করতে করতে যদি কোনও শব্দ কানে আসে, খবরদার, পিছু ফিরে তাকাবে না। তাহলেই সব ভ্রষ্ট হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা বাবা, তাকাব না।’

‘এবার তুমি এস। আমি এখন ধ্যানে বসব।’

বাবা ধ্যানস্থ হলেন। দীপ পকেট থেকে টাকা বার করে তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে আনন্দিত মনে চলে গেল। সে চোখের আড়াল হতেই ধ্যানস্থ বাবা টাকাটি খপ করে তুলে নিয়ে ট্যাঁকে খুঁজলেন, জটা এবং দাড়ি-গোঁফ খুলে ফেলে মাথা চুলকোতে লাগলেন। এখন তাঁর স্বরূপ প্রকাশিত হলো; তিনি আর কেউ নয়, রাজমোহনের ভৃত্য সেওলাল।

গুহার অন্ধকার থেকে রাজমোহন বেরিয়ে এল। সেওলাল বলল, ‘কেমন হুজুর, ঠিক কাজ হয়েছে কিনা?’

রাজ হেসে বলল, ‘ঠিক ঠিক কাজ হয়েছে। মাছ টোপ গিলেছে।’

সেওলাল সেলাম করে বলল, ‘তাহলে আমার ইনাম।’

রাজ পকেট থেকে দু’শো টাকার নোট বের করে সেওলালকে দিয়ে বলল, ‘এত টাকা নিয়ে কী করবি?’

‘কি আর করব, মজা লুটব। আমাকে দু’হপ্তার ছুটি দিন হুজুর।’

‘আচ্ছা যা, মজা লুটবে যা। আজ অমাবস্যা, পূর্ণিমার দিন পর্যন্ত ছুটি দিলাম।’

রাত্রি আন্দাজ সাড়ে দশটার সময় রণবীরের বাংলোতে নৈশাহার শেষ হয়েছিল। বাইরে অমাবস্যার অন্ধকার রাত্রি, ঘরের মধ্যে তিনটি প্রাণী; রণবীর, পুষ্পা ও পূর্ণিমা। পূর্ণিমা ও রাজমোহনের আজ এখানে নৈশভোজনের নিমন্ত্রণ ছিল; রাজ আসেনি, কেবল পূর্ণিমাকে পৌঁছে দিয়ে কাজের অজুহাত দেখিয়ে চলে গেছে। রাত্রি সাড়ে দশটার সময় পূর্ণিমাও উঠি-উঠি করছিল কিন্তু পুষ্পা ও রণবীর তাকে ছাড়ছিল না। পুষ্পা বলছিল, বাড়িতে গিয়ে শুধু ঘুমোনো। আর একটু বসো না ভাই, দাদা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন।’

রণবীর বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি তো হামেহাল হাজির। তার চেয়ে এস আর এক দফা আইসক্রিম খাওয়া যাক। কি বলো পূর্ণিমা?’

পূর্ণিমা হাসিমুখে রাজী হলো। এদের দুই ভাই-বোনের প্রীতি ও স্নেহের স্পর্শ পেয়ে পূর্ণিমার মন বেশ প্রফুল্ল হয়েছে।

রণবীর খানসামাকে ডেকে আইসক্রিম হুকুম করল। এমন সময় বাইরে মোটরের শব্দ হলো। কে এসেছে দেখবার জন্যে রণবীর উঠে দাঁড়িয়েছে, দীপ প্রবেশ করল। একটু হেসে বলল, ‘পুষ্পাকে একটা কথা বলতে এলাম।’

পুষ্পা তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, দীপ তাকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে খাটো গলায় বলল, ‘বিশেষ একটা গোপন কাজে আমি এখুনি এক জায়গায় যাচ্ছি, একটা নাগাদ ফিরে তোমার সঙ্গে দেখা করব। আমি যতক্ষণ না ফিরি তুমি আমার জন্যে জেগে থাকবে?’

পুষ্পা বলল, ‘থাকব। কিন্তু তুমি যাচ্ছ কোথায়?’

‘সে-কথা ফিরে এসে বলব’, দীপ একটু রহস্যময় হেসে সকলকে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেল।

তারপর এদের সভাও ভঙ্গ হলো। রণবীর পূর্ণিমাকে নিজের গাড়িতে তুলে তার বাড়ির ফটক পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এল।

পূর্ণিমা রণবীরকে বিদায় দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে যাবে, দেখল রাজমোহন বেরিয়ে আসছে। রাজের পরনে কালো পোশাক, পায়ে রবার-সোল জুতো। পূর্ণিমাকে দেখে সে একটু থমকে গেল। পূর্ণিমা বলল, ‘দাদা, এত রাত্রে তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

রাজ বলল, ‘হঠাৎ কাজ পড়ে গেল। কখন ফিরব বলা যায় না। আমার জন্যে জেগে থাকার দরকার নেই।’

রাজ বাইরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। পূর্ণিমা অবাক হয়ে খানিক চেয়ে রইল।

রণবীরের বাংলোতে পুষ্পা ভুরু কুঁচকে বসে ভাবছিল, রণবীর ফিরে এসে বলল, ‘কি ভাবছিস? দীপ কি বলে গেল?’

পুষ্পা দীপের কথা বলল। শুনে রণবীরের কপালে চিন্তার রেখা পড়ল। সে বলল, ‘তাহলে আমিও জাগি। আয়, ডব্‌ল্‌-হ্যান্ড ব্রিজ খেলা যাক, দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে।’

রাত্রি ঠিক বারোটার সময় দীপ বাঘের জিভের ওপর গিয়ে বসল, মুখে ছাই মেখে চোখ বুজে মন্ত্র জপ করতে লাগল। সামনে গভীর খাদ, পিছনে পাথরের চাঙড় স্তম্ভের মতো উঁচু হয়ে আছে। কোথাও শব্দ নেই, জনমানব নেই।

পিছনে একটি ছায়ামূর্তির আবির্ভাব হলো। অন্ধকারে কালো পোশাক পরা রাজমোহনকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে শিলাস্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে দীপকে দেখল, তারপর বাঘের জিভের দিকে লক্ষ্য করে পাথরটাকে ঠেলা দিতে লাগল। পাথর দুলতে আরম্ভ করল, রাজ ঠেলা দিয়ে চলল। শেষে পাথর আর স্বস্থানে থাকতে পারল না, কেন্দ্রচ্যুত হয়ে বাঘের জিভের দিকে গড়াতে শুরু করল।

পাথর গড়ানোর শব্দ কানে যেতেই সামান্য দ্বিধার পর দীপ পিছু ফিরে চাইল, দেখল পাথরটা গড়াতে গড়াতে প্রায় তার ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। সে চিৎকার করে একপাশে সরে গেল, কিন্তু তাল সামলাতে পারল না। পাথরটা যেমন সগর্জনে খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সে-ও তেমনি তাল সামলাতে না পেরে খাদে পড়ে গেল।

রাজ এতক্ষণ পিছনে ছিল, এখন ছুটে এসে বাঘের জিভের ওপর শুয়ে নীচে উঁকি মারল। দেখল, দীপ জিভের পাশে আটকে নেই। তার মুখে হিংস্র হাসি ফুটল। এবার আর ফস্কায়নি, তার পথের কাঁটা দূর হয়েছে।

রাত্রি একটা পর্যন্ত দীপ যখন ফিরল না তখন পুষ্পা আর রণবীর দু’জনেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তাস খেলা বন্ধ করে রণবীর বলল, ‘তাই তো, দীপ এখনো ফিরল না—’

পুষ্পা পাংশু মুখে বলল, ‘কিছু বুঝতে পারছি না। স্পষ্ট করে বলল না কোথায় যাচ্ছে। দাদা, আমার ভয় করছে।’

‘ভয় কিসের?’

‘কি জানি, মনে হচ্ছে ওর কোনও অনিষ্ট হয়েছে।’

রণবীর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চল, ওর বাড়িতে খবর নিই।’

রণবীর একটা বড় বৈদ্যুতিক টর্চ হাতে নিল, দু’জনে মোটরে চড়ে বেরুল।

প্রথমে তারা দীপের বাড়িতে গেল। চাকর কেশো ঘুমোচ্ছিল, সে মনিবের কোনও খবর জানে না। দীপ বাড়িতে নেই, রাত্রি দশটার সময় বেরিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি। কেশোকে নিয়ে তারা রাজমোহনের বাড়ি গেল।

সেখানে হাঁকাহাঁকির পর পূর্ণিমা এসে দোর খুলল; রাজ মটকা মেরে বিছানায় পড়ে রইল। দীপ এখানে নেই।

রণবীর শহরের আরো কয়েক জায়গায় খুঁজে শেষে উদ্বিগ্ন হয়ে থানায় গেল, সেখান থেকে দু’জন পুলিস নিয়ে বেরুল। নিশ্চয় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সারা শহর খুঁজে শেষে তারা বাঘের জিভে গিয়ে দেখল দীপের শূন্য মোটর পড়ে আছে। টর্চ জ্বেলে স্থানটা পরিদর্শন করে স্পষ্টই বোঝা গেল, দীপ বাঘের জিভ থেকে খাদে পড়েছে। তখন তারা ঘুর পথে খাদে নেমে দেখল দীপ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে; প্রচণ্ড আঘাতে তার মাথা ফেটে গেছে।

পুষ্পা কেঁদে উঠল। তারপর সকলে ধরাধরি করে দীপকে ওপরে আনল এবং রণবীরের বাংলোতে তুলল।

শহরের কয়েকজন বড় ডাক্তারকে ডাকা হলো। তাঁরা পরীক্ষা করে প্রাথমিক চিকিৎসা করলেন। তাঁদের মতে প্রাণের আশঙ্কা নেই, কিন্তু মস্তিষ্কে যে আঘাত লেগেছে তার গুরুত্ব কতখানি তা জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না।

পুষ্পা আর কেশো দীপের সেবার ভার দিল। সকাল হলো, কিন্তু দীপ অজ্ঞান হয়েই রইল। সারা দিন তার জ্ঞান হলো না। তখন রণবীর মহানগরে একজন ব্রেন-স্পেশালিস্টকে তার করল।

সেই রাত্রে ক্ষণেকের জন্যে দীপের একবার জ্ঞান হলো। সে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে ছিল, মুখের ওপর তীব্রশক্তি ইলেকট্রিক বালবের আলো পড়েছিল। তার খাটের দু’পাশে পুষ্পা আর কেশো একদৃষ্টে তার মুখের পানে চেয়ে বসে ছিল। দীপের চোখের পাতা নড়ে উঠল। তারপর সে আস্তে আস্তে চোখ খুলল। ডান দিক থেকে বাঁ দিকে তার চোখ যাতায়াত করল, মুখে একটা বিকট পৈশাচিক ভাব ফুটে উঠল। তারপর সে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ল।

পুষ্পা ভয়ে শিউরে উঠেছিল, কোনোমতে নিজের মুখের ওপর হাত রেখে চিৎকার রোধ করল। দীপের মুখে এমন ভয়ঙ্কর ভাবের ব্যঞ্জনা সে আগে কখনো দেখেনি।

মহানগর থেকে স্পেশালিস্ট ডাক্তার এসে দীপের চিকিৎসা শুরু করলেন। শহরে খুব উত্তেজনা, রণবীরের বাড়িতে এসে অনেকে দীপের খবর নিয়ে যাচ্ছে। দীপ বেঁচে আছে শুনে রাজমোহন প্রথমটা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল, ক্রমে সামলে নিয়েছে। এক মাঘে শীত পালায় না। সে পূর্ণিমাকে সঙ্গে নিয়ে দীপের খোঁজখবর নিতে আসে। পূর্ণিমার মনেও শান্তি নেই, সে সবই বুঝতে পেরেছে। একদিন সে রাজকে বলল, ‘দীপ যদি মারা যায় তাহলে আমি সব ফাঁস করে দেব।’

রাজ দেখল, ঘরের ঢেঁকি কুমির হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখন আর কোনও উপায় না দেখে সে একদিন পুর্ণিমাকে বাড়ির গুপ্ত তোষাখানায় নিয়ে গিয়ে সেখানে বন্ধ করে রাখল। এই তোষাখানায় বংশের দামী হীরা-জহরত সোনাদানা রাখা থাকে, বাইরের কেউ এ ঘরের খবর জানে না।

বিশেষজ্ঞের চিকিৎসায় দীপ হপ্তা দুয়ের মধ্যে সেরে উঠল। পুষ্পার শীর্ণ মুখে আবার হাসি ফুটছে।

দীপের সুস্থ হওয়ার ফলে রাজ খুবই ভয় পেয়েছিল; কিন্তু যখন সে শুনল যে সেদিনের কোনও ঘটনাই দীপের মনে নেই তখন সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তবু অত সহজে ফাঁড়া কাটে না। সেওলাল নানা ছুতোয় তার কাছে টাকা আদায় করার চেষ্টা করছে। ভয় দেখাচ্ছে, আরো টাকা না দিলে সে গুপ্ত কথা ফাঁস করে দেবে। তাকে আরো দু’শো টাকা দিয়ে রাজ সাময়িকভাবে অব্যাহতি পেয়েছে।

ওদিকে তোষাখানার চোর-কুঠুরিতে পূর্ণিমা বন্ধ আছে; দু’বেলা তাকে খাবার দিতে যেতে হয়। সে ঝগড়াঝাঁটি কান্নাকাটি করে।।

দীপ রণবীরের বাড়িতে আরো কিছুদিন থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কেশোকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেল। বাড়িতে আর এক বিপদ : বজ্‌রঙ্‌ পালিয়েছে, যাবার সময় ব্যাঙ্ক থেকে দীপের ত্রিশ হাজার টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছে। গুরুতর দুর্ঘটনার পালা শেষ না হতে হতেই এত টাকা লোকসান; দীপ মাথায় হাত দিয়ে বসল। পুলিসে টাকা চুরির খবর গেল; সারা শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ল।

দুর্ঘটনার পর আজ একমাস পূর্ণ হলো। আবার অমাবস্যা।

ধনী ব্যবসায়ী শেঠ আম্বালালের বাড়িতে সন্ধ্যের পর বিরাট পার্টি জমেছে। অন্যান্য গণ্য অতিথিদের মধ্যে রণবীর, পুষ্পা ও দীপও নিমন্ত্রিত। নাচ-গান গল্পগুজব চলছে।

এক কোণে চেয়ারে গোল হয়ে বসে কয়েকজন অতিথি নিজেদের মধ্যে অমাবস্যার বিধিনিষেধ নিয়ে আলোচনা করছেন। একজন বললেন, অমাবস্যার দিন বেগুন খেলে গোদ হয়। একে একে অন্যরাও নিজের নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ অভিমত প্রকাশ করল। বোঝা গেল অমাবস্যার দিন সব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়।

অমাবস্যার প্রসঙ্গ উঠতেই দীপের কেমন ভাবান্তর হলো। যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। পুষ্পার কাছে বিদায় নিয়ে সে একটু সকাল সকাল বাড়ি ফিরে এল।

রাত্রে নৈশাহার শেষ করে দশটার সময় যখন সে শুতে গেল তখন সে বেশ সুস্থ মানুষ, অস্বচ্ছন্দতাও কেটে গেছে। সে বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।

রাত বারোটার সময় তার ঘুম ভাঙল, বাড়ির একটা ঘরে টং টং করে ঘড়ি বাজছে। দীপ বিছানায় উঠে বসল, ধীরে ধীরে তার মুখের পরিবর্তন হতে লাগল; একটা পৈশাচিক ক্রুরতা তার মুখে ফুটে উঠল। হিংস্র শ্বাপদের মতো এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সে খাট থেকে নামল, তারপর নিঃশব্দে দোর খুলে নীচের তলায় নামতে লাগল।

সিঁড়ির ঠিক নীচের ধাপের সামনে কেশো মাদুর পেতে ঘুমোচ্ছিল, না জেনে তার ঘাড়ে দীপ পা দিতেই কেশো আঁকপাঁক করে জেগে উঠল, ‘এ কি দাদাবাবু, তুমি এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছ?’

দীপ কথা বলল না, জিঘাংসুভাবে দাঁত বার করল। কেশো ভয়ে পেছিয়ে এল। এ যেন দীপ নয়, কোনও একটা দুষ্ট উপদেবতা তার ওপর ভর করেছে। এই সুযোগে দীপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল এবং অমাবস্যার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

চোরের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পুলিসের চোখ এড়িয়ে দীপ শেষে শেঠ আম্বালালের বাড়িতে এসে পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ল। বাড়ির লোকজন সবাই ঘুমে অচেতন। দীপ এ-ঘর- ও-ঘর ঘুরে হাতের কাছে দামী জিনিস যা পেল তাই পকেটে পুরল। সব শেষে সে শেঠজির ঘরে ঢুকল। শেঠজি ঘুমোচ্ছিলেন, দীপ তাঁর বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে চাবি বার করবার চেষ্টা করতেই তিনি জেগে উঠে ‘চোর! চোর!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। দীপ ছায়ামূর্তির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল।

রাত প্রায় দুটোর সময় দীপ বাড়ি ফিরে এল। কেশো আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাকে সন্তর্পণে ডিঙিয়ে বাড়ির স্ট্র-রুমে গেল। এ ঘরে সারি সারি লোহার সিন্দুক, তাতে সাবেক কালের সোনা-রূপোর বাসন ও হীরা-জহরতের গয়না আছে। দীপ একটি পুরনো মজবুত সিন্দুকের তালা খুলে চোরাই মাল পকেট থেকে বার করে তাতে রাখল, সিন্দুক বন্ধ করে নিজের শোবার ঘরে গিয়ে বিছানায় শয়ন করল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালবেলা কেশো চা নিয়ে দীপের ঘুম ভাঙাতে এল। তার হাতে চায়ের পেয়ালা দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, ‘কাল রাত্রে তুমি কোথায় গেছলে?’

দীপ আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কখন?’

কেশো বলল, ‘দুপুর রাত্রে। আমাকে মাড়িয়ে খেপা হাতির মতো চলে গেলে।’

‘দূর পাগল! তোর মাথা খারাপ হয়েছে।’

‘তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। কাল রাত্তিরে তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তুমি সদ্য-মানুষ নও, তোমাকে দানোয় পেয়েছে। আশ্চর্য নয়। কাল তো অমাবস্যা ছিল। অমাবস্যার দুপুর রাত্রে ভূত প্রেত দৈত্য দানা সব মানুষের ঘাড়ে চাপবার জন্যে ঘুরে বেড়ায়।’

কাল রাত্রির কথা দীপের কিছুই মনে ছিল না, কিন্তু কেশোর মুখে অমাবস্যার কথা শুনে তার মনটা বিকল হয়ে গেল, সে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘অমাবস্যা!’

সেদিন বিকেলবেলা রাজমোহন একলা দীপের বাড়িতে বেড়াতে এল। বলল, ‘পূর্ণিমাকে পুষ্পা চায়ের নেমন্তন্ন করেছিল, তাকে পৌঁছে দিয়ে এলাম।’

দীপ কেশোকে চায়ের হুকুম দিল। দু’জনে চা খেতে খেতে গল্প করতে লাগল, তারপর এক সময় রাজ বলল, ‘শুনেছ নিশ্চয়, কাল রাত্রে শেঠ আম্বালালের বাড়িতে একটা দুঃসাহসিক চুরি হয়ে গেছে।’

দীপ বলল, ‘কই না, আমি তো কিছু শুনিনি।’

রাজ বলল, ‘আমিও জানতাম না। এইমাত্র রণবীরের মুখে শুনলাম।’

‘চোর ধরা পড়েছে?’

‘না, তবে শেঠজি চোরকে এক নজর দেখেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, চোরের চেহারা নাকি অনেকটা তোমার মতো।’

দীপ চমকে উঠল, ‘আমার মতো?’

রাজ হেসে বলল, ‘তোমার মতো। কিন্তু সত্যিই তো আর তুমি নও।’

দীপের মনটা আবার বিকল হয়ে গেল।

এক মাস কেটে গেল। শেঠ আম্বালালের বাড়িতে চুরির কোনও কিনারা হয়নি। আবার অমাবস্যা ফিরে এসেছে, কিন্তু দীপ আধুনিক ছেলে, তিনি-নক্ষত্রের খবর রাখে না। রাস্তার পাশে একটা ভিখারি বসে ভিক্ষে চাইছে, ‘আজ অমাবস্যার পুণ্য তিথি, দুটো পয়সা ভিক্ষে দাও বাবা।’

রাত্রে রণবীরের বাড়িতে দীপের ডিনারের নিমন্ত্রণ ছিল। ডিনার শেষ করে পুষ্পা বলল, ‘চল, তিনজনে সিনেমা দেখে আসি।’

রণবীর বলল, ‘আমার আলস্য হচ্ছে, তোমরা যাও।’

দীপ আর পুষ্পা দীপের মোটরে চড়ে বেরুল। শহরের ঘিঞ্জি পাড়ায় সিনেমা হাউস, এই একটি মাত্র হাউস। টিকিট কিনে দু’জনে বক্সে গিয়ে বসল। রাত্রি তখন ন’টা। দীপের মানসিক অবস্থার কোনও বিকার নেই, স্বাভাবিক মানুষ।

সিনেমা ভাঙল পৌনে বারোটার সময়। পুষ্পা আর দীপ গাড়িতে এসে বসল। দীপের মুখের ভাব একটু অন্য রকম। গাড়িতে স্টার্ট দিতে গিয়ে সে পুষ্পাকে বলল, ‘একটু বস, আমি আসছি।’ তার কণ্ঠস্বরে একটু কঠিনতার আভাস। চোখের দৃষ্টি দুঃস্বপ্নে আচ্ছন্ন।

গাড়ি থেকে নেমে সে পিছন দিকে চলে গেল। পুষ্পা একটু অবাক হলো; কিন্তু কোনও প্রশ্ন না করে গাড়িতে বসে রইল।

দশ মিনিট দীপের দেখা নেই। তারপর সে পিছন দিক থেকে এসে সামনের দিকে চলতে আরম্ভ করল, মোটরের দিকে তাকাল না। সে চলে যাচ্ছে দেখে পুষ্পা ব্যগ্রভাবে ডাকল, ‘ও কি, কোথায় যাচ্ছ? এই যে এখানে গাড়ি।’

দীপ ফিরে তাকাল না, হন হন করে এগিয়ে চলল। পুষ্পা তখন ড্রাইভারের সীটে সরে গিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিল, গাড়ি চালিয়ে দীপের পিছনে চলল। কিন্তু দীপের কাছ পর্যন্ত পৌঁছবার আগে দীপ পাশের একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল, যেখানে গাড়ি যায় না।

গলির মুখের কাছে গাড়ি থামিয়ে পুষ্পা হতভম্ব হয়ে বসে রইল। কী হয়েছে দীপের হঠাৎ? সে এমন ব্যবহার করছে কেন?

রাস্তা নির্জন হয়ে গিয়েছিল, একলা বসে বসে পুষ্পার ভয় করতে লাগল। এই সময় সামনে কিছু দূরে খটাখট জুতোর শব্দ এল, একজন পাহারাওয়ালা রোঁদে বেরিয়েছে। গাড়ির পাশে এসে সে গাড়ির মধ্যে টর্চের আলো ফেলল। পুষ্পাকে পুলিসের সকলেই চেনে। কনেস্টবল বলে উঠল, ‘এ কি, মিসিবাবা। আপনি এত রাত্রে এখানে কী করছেন!’

পুষ্পা বলল, ‘কিছু না। আচ্ছা, তুমি বলতে পার এই গলিটা কোথায় গিয়েছে?’

কনেস্টবল ইতস্তত করে বলল, ‘গলিটা ভাল নয় মিসিবাবা, খারাপ পাড়া। আপনি আর এখানে থাকবেন না, বাড়ি ফিরে যান।’

অশান্ত হৃদয়ে ভয় সংশয় সন্দেহ নিয়ে পুষ্পা গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।

গলির মধ্যে নিম্নশ্রেণীর পতিতার ঘর। ঘরের মধ্যে কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয় একটি যুবতী পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচছে এবং থেকে থেকে গানের একটি কলি গাইছে; সঙ্গে তবলা ও সারেঙ্গী বাজছে। বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় বাতাস আচ্ছন্ন। যারা আসরে বসে আছে তারা সকলেই গুণ্ডা-তস্কর জাতীয় লোক। তাদের মধ্যে সেওলালও উপস্থিত আছে। সে এখন আর রাজমোহনের চাকরি করে না, হাতের টাকা ফুরিয়ে গেলেই রাজমোহনের রুধির শোষণ করে।

দীপ গলি দিয়ে যাচ্ছিল, গান-বাজনার শব্দ শুনে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তার চেহারা দেখে মনে হয় সে-ও গুণ্ডা-তস্করদের সমগোত্রীয় লোক। সে দোর ঠেলে ঢুকতেই নর্তকী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, দর্শকেরা ঘাড় বেঁকিয়ে ভুকুটি করে দীপের পানে চাইল।

দীপের গলায় বিকৃত বেপরোয়া হাসি ফুটে উঠল। সে নর্তকীকে বলল, ‘থামলে কেন—নাচো নাচো।’

নর্তকী আবার নাচ আরম্ভ করল। দীপ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তার নাচ দেখতে লাগল।

ভিড়ের মধ্যে বসে সেওলাল চোখ কুঁচকে দীপের পানে তাকিয়ে দেখছিল। চেহারাটা ঠিক দীপেরই মত, তবু যেন ঠিক দীপ নয়। তাছাড়া দীপ বড়মানুষ, সে কি এরকম জায়গায় আসবে? সংশয়ে সেওলালের মন দোলা খেতে লাগল। কিন্তু ও যদি সত্যিই দীপনারায়ণ হয়, তাহলে—। টাকা রোজগারের আর একটা রাস্তা পেয়ে লোভে সেওলালের চক্ষু তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। পুষ্পার সঙ্গে দীপের আসন্ন বিয়ের খবর তার অজানা ছিল না।

নাচ-গান শেষ হলে দীপ মেয়েটার দিকে একটা দশ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘সাবাস!’

সেওলাল এই সময় উঠে এসে দীপকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি দীপনারায়ণ রায়?’

দীপের মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, সে দু’হাতে সেওলালের গলা চেপে ধরে পাগলের মতো ঝাঁকানি দিতে লাগল। হৈ-হৈ কাণ্ড বেধে গেল; ধস্তাধস্তি মারামারি চিৎকার—

পরদিন সকালে কেশো চা নিয়ে দীপের ঘরে গিয়ে দেখল, দীপ বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

বেলা আন্দাজ ন’টার সময় সেওলাল রাজমোহনের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিল এবং রাজকে গত রাত্রির কথা সবিস্তারে শোনাচ্ছিল। এই সময় রণবীর হাতে একটি ফুলের তোড়া নিয়ে পূর্ণিমার সঙ্গে দেখা করতে এল। সে পায়ে হেঁটে এসেছে, তাই তার আসার কথা রাজ জানতে পারল না।

বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে রণবীর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, জানলা দিয়ে রাজ আর সেওলালের কথা শোনা যাচ্ছে।

রাজ মনের রাগ চেপে সেওলালকে বলছে, ‘এবার কত টাকা চাও?’

সেওলাল বলল, ‘বেশী নয়, শ’ পাঁচেক।’

রাজ বলল, ‘অত টাকা এখন হাতে নেই। এই পঞ্চাশ টাকা নিয়ে বিদেয় হও। যথেষ্ট দোহন করেছ, আর পাবে না।’

সেওলাল বলল, ‘মাত্র পঞ্চাশ! এতে কী হবে। দীপনারায়ণবাবুকে পাথর গড়ানোর খবরটা দিলে অনেক বেশী বকশিশ পাব।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, পাঁচশো টাকাই দেব। কিন্তু আজ হবে না। কাল ব্যাঙ্ক থেকে টাকা বার করে দেব। কিন্তু তুমি আমার চাকরি ছেড়ে দিয়েও এখন বার বার আমার বাড়িতে এলে লোকে নানারকম সন্দেহ করবে। তার চেয়ে ঝর্ণার কাছে যে গুহা আছে, কাল সন্ধ্যেবেলা সেখানে দাঁড়িয়ে থেকো, আমি টাকা নিয়ে যাব। কেমন, রাজী?’

‘রাজী।’ সেওলাল পঞ্চাশ টাকা নিয়ে চলে গেল। রাজ কিছুক্ষণ আগুন-ভরা চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর দেরাজ খুলে একটা রিভলবার বার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল।

রণবীর বাইরে থেকে সব শুনেছিল এবং বুঝেছিল যে রাজ কোনও বে-আইনী অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত আছে। কিন্তু সে যেন কিছুই জানে না এমনিভাবে বলল, ‘কি হে, অনেক দিন তোমাদের খবর নেই তাই দেখতে এলাম। পূর্ণিমা কোথায়?’

রণবীরকে দেখে রাজ হকচকিয়ে গিয়েছিল, সামলে নিয়ে বলল, ‘পুর্ণিমার শরীর ভাল নয়, সে নিজের ঘরে শুয়ে আছে।’

‘তাই নাকি! কী হয়েছে?’

‘মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড়—এই সব।’

‘ও—তা আমি একবার তার সঙ্গে দেখা করতে পারি?’

‘মাফ করবেন রণবীরবাবু, আমাদের বাড়ির রেওয়াজ নয়। কুমারী মেয়ের শোবার ঘরে—’

‘আচ্ছা যাক’, রণবীরের সন্দেহ হলো রাজ মিছে কথা বলছে—‘তুমিই না হয় ফুলগুলো তাকে দিও, বোলো আমি এসেছিলাম।’

ফুল নিয়ে রাজ বলল, ‘আজ একজনের মুখে দীপ সম্বন্ধে একটা খবর শুনলাম। এত জঘন্য কথা যে বিশ্বাস হচ্ছে না।’

রণবীর ভ্রু তুলে প্রশ্ন করল, ‘দীপ সম্বন্ধে এমন কি কথা?’

রাজ তখন সেওলালের কাছে যা শুনেছিল, রণবীরকে বলল। শুনে রণবীরের মুখ গম্ভীর হলো, ‘আচ্ছা আমি খোঁজ নেব।’

রণবীর চলে যাবার পর রাজ ফুলের তোড়া নিয়ে ওপরে গেল, তোষাখানার তালা খুলে পূর্ণিমাকে বলল, ‘রণবীর তোমার জন্যে ফুলের তোড়া এনেছে। ব্যাপার কি? পুলিসের লোকের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা কিসের?’

পূর্ণিমা বলল, ‘আমি মনে মনে ঠিক করেছি ওকে বিয়ে করব। তোমার হাত থেকে আমি নিষ্কৃতি চাই।’

‘আমার নামে পুলিসের কাছে লাগাবে বলে নিষ্কৃতি চাও? পাবে না নিষ্কৃতি।’ তোড়াটা পুর্ণিমার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে রাজ চলে গেল

রণবীর চিন্তান্বিত মনে ফিরে এল। বাড়িতে পুষ্পা মুখ শুকিয়ে বসে ছিল। রণবীর তাকে প্রশ্ন করল, ‘কাল রাত্রে দীপকে তুই কোথায় নামিয়ে দিয়ে এসেছিলি?’

পুষ্পা দু’বার ঢোক গিলে বলল, ‘ও আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল।’

রণবীর বলল, ‘তাহলে দীপের গাড়িটা আমাদের কম্পাউণ্ডে রয়েছে কি করে?’

এ প্রশ্নের উত্তর নেই; পুষ্পা মুখ নীচু করে রইল। রণবীর বুঝল পুষ্পা কাল রাত্রের কথা লুকোচ্ছে। সে আর প্রশ্ন না করে অফিসে গিয়ে কাজে বসল।

কিছুক্ষণ পরে দীপ পুস্পার কাছে এল। তার মনে অপরাধের ছায়া নেই, কাল রাত্রির কথা সে সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। পুষ্পা কিন্তু তাকে দেখে শক্ত হয়ে বসল, শুকনো গলায় বলল, ‘কাল রাত্রে আমাকে গাড়িতে বসিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?’

‘কোথায় গিয়েছিলাম?’ দীপ চকিত হয়ে চাইল।

কিছুক্ষণ কথা-কাটাকাটির পর পুষ্পা অধীরভাবে বলে উঠল, ‘মিছে তর্ক করে লাভ নেই। তুমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পার। আমি বাধা দেবার কে। যাবার সময় নিজের গাড়িটা নিয়ে যেও।’

পুষ্পা উঠে চলে গেল। দীপ মর্মাহতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বাইরে এসে দেখল তার গাড়িটা কম্পাউন্ডের এক কোণে রয়েছে। তার ভারি ধোঁকা লাগল। কাল রাত্রে সে পুষ্পাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল…তারপর কী হয়েছিল আর কিছু তার মনে নেই।

রাজমোহন ও সেওলালের মধ্যে যে রহস্যময় কথাবার্তা রণবীর আড়াল থেকে শুনেছিল তাতে তার বুঝতে বাকি ছিল না যে, ওরা দুজনে প্রচ্ছন্নভাবে কোনও বে-আইনী কাজে লিপ্ত আছে। তাই পরদিন বিকেলবেলা সে পকেটে রিভলবার নিয়ে দু’জন সাব-ইন্সপেক্টরের সঙ্গে ঝর্ণার কাছে গুহার মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে রইল।

সন্ধ্যে হয়-হয় এমন সময় সেওলাল এসে ঝর্ণার ধারে একটা পাথরের ওপর উবু হয়ে বসল এবং বিড়ি টানতে টানতে প্ল্যান আঁটতে লাগল, এখন যে-টাকাটা পাবে সেটা কিভাবে খরচ করবে; পেছনে গুহার মধ্যে যে পুলিস লুকিয়ে আছে তা সে জানত পারল না।

ঝর্ণার জল যেখানে খাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে সেখানে ঝোপঝাড় জঙ্গল, দিনের বেলাও অন্ধকার। সেওলাল নিশ্চিন্ত মনে একটা বিড়ি শেষ করে আর একটা ধরাবার উদ্যোগ করছে এমন সময় রাজ ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে পা টিপে টিপে এগিয়ে এল। সেওলাল তাকে দেখতে পেল না। রাজ পকেট থেকে রিভলবার বার করে দশ হাত দূর থেকে সেওলালকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল। সেওলাল চিত হয়ে পড়ে গিয়ে গোঙাতে লাগল। সেওলাল মরেনি দেখে রাজ তার কাছে এসে আবার গুলি ছুঁড়তে উদ্যত হয়েছে এমন সময় গুহার মধ্যে দ্রুত পদশব্দ শুনে সে চকিতে পিছু ফিরে চাইল, তারপর তীরবেগে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

রণবীররা অবশ্য রাজকে দেখতে পেয়েছিল এবং চিনতে পেরেছিল। তারা সেওলালের কাছে এসে দেখল, সে গুরুতর আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, কিন্তু মরেনি। তারা তখন তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করে দিল এবং ডাক্তারকে বলে এল যে সেওলালের জ্ঞান হলেই যেন পুলিসে খবর দেওয়া হয়।

দীপের সঙ্গে পুষ্পার মনান্তর হবার পর দীপের মনের অবস্থা খুবই খারাপ। সে রাত্রে সত্যিই কী হয়েছিল তা সে স্মরণ করতে পারছে না, তাই তার মনে শান্তি নেই, সে সাহস করে পুস্পার কাছে যেতে পারছে না, পাছে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ে। পুষ্পার মনেও সুখ নেই, নানারকম সন্দেহে তার মন নিরন্তর দগ্ধ হচ্ছে। সে-ও দীপের কাছে যেতে পারছে না। গভীর মনঃপীড়ার মধ্যে দিয়ে তাদের দিন কাটছে।

কেশো দীপের মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু বার বার প্রশ্ন করেও দীপের কাছ থেকে সদুত্তর পায়নি। কেশোর ধারণা হয়েছিল অমাবস্যার রাত্রে দীপের ঘাড়ে ভূত চাপে। তাই এক মাস পরে যখন অমাবস্যা ফিরে এল তখন সে এক মতলব করল; রাত্রে দীপ নিজের ঘরে শুতে যাবার পর সে চুপি চুপি বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিল।

সে-রাত্রে দীপের ঘুম ভাঙল ঠিক বারোটার সময়। তার মুখে ক্রুর পাশবতা ফুটে উঠল। দোর খুলতে গিয়ে যখন দেখল দোর বন্ধ, তখন তার মুখের চেহারা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সে ছুটে গিয়ে খোলা জানলা দিয়ে তাকাল; দোতলা থেকে অন্ধকার বাগানে কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু একটা বোগেনভিলিয়ার লতা নীচে থেকে উঠে জানলাকে ঘিরে ধরেছে। দীপ জানলা দিয়ে বেরিয়ে লতা ধরে ধরে মাটিতে নেমে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কেশো দোরে তালা লাগিয়ে দোরের বাইরে মাদুর পেতে শুয়েছিল, ঘরের মধ্যে শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল। সে নিঃশব্দে তালা খুলে ঘরে ঢুকল; দেখল বিছানা শূন্য, পাখি উড়েছে।…

নিশাচর পাখি উড়ে গিয়ে শহরের এক নিকৃষ্ট জুয়ার আড্ডায় বসেছিল। খেলাড়িরা সবাই চোর বাটপাড় গুণ্ডা। খেলতে খেলতে ঝগড়া বেধে গেল, তারপর মারামারি। দীপ আলো নিভিয়ে দিল। অন্ধকারে হাতাহাতি চলতে লাগল…

জুয়ার আড্ডা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে দীপ রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে, তার গলার মধ্যে গভীর উপভোগের হাসি। যেতে যেতে সে থমকে দাঁড়াল। রাস্তার পাশে রণবীরের বাংলো। সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দীপ পিছনের একটা খোলা জানলা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। নাইট-ল্যাম্পের আলোতে বাড়ির ঘরগুলি চোরের মতো হাতড়ে বেড়াতে লাগল।

পুষ্পা নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। ড্রেসিং-রুমে খুটখাট শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠে ড্রেসিংরুমের দোরের কাছ থেকে উঁকি মেরে দেখল দীপ তার ড্রেসিং-টেবিল থেকে কয়েকটি ছোটখাটো গয়না—কানের দুল, সোনার রিস্টওয়াচ—নিয়ে নিজের পকেটে পুরছে। পুষ্পার গলা থেকে অজ্ঞাতসারেই একটা ভয়ার্ত শব্দ বেরিয়ে এল। দীপ তাই শুনে চোখ তুলে চাইল, তারপর বিদ্যুদ্বেগে জানলা খুলে বাইরে লাফিয়ে পড়ল।

রণবীরের ঘুম ভেঙেছিল। সে এসে দেখল পুষ্পা দোরের সামনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রশ্ন করল, ‘পুষ্পা, কি হয়েছে?’

পুষ্পা শীর্ণ কণ্ঠে বলল, ‘চোর। চোর এসেছিল।’

রণবীর বলল, ‘অ্যাঁ! কোথায় চোর?’

পুষ্পা জানলার দিকে আঙুল দেখাল, ‘ওই দিক দিয়ে পালিয়েছে।’

রণবীর জানলার কাছে গিয়ে বাইরে দেখল। চোর তখন পালিয়েছে। সে বলল, ‘আমার বাড়িতে চোর! এত দুঃসাহস কার? তুই চোরের মুখ দেখতে পেয়েছিলি?’

পুষ্পা বিবর্ণ মুখে মাথা নাড়ল, ‘না।’

তারপর রণবীর লোকজন ডেকে সারা বাড়ি বাগান তল্লাস করল, কিন্তু চোরকে ধরা গেল না।

পুষ্পা নিজের ঘরে গিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল, শুন্যদৃষ্টিতে দেয়ালের পানে তাকিয়ে ভাবতে লাগল—একি সত্যি? না তার চোখের ভুল?

ওদিকে দীপ নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকল, চোরাই মাল সিন্দুকে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঠং ঠং করে দুটো বাজল। দীপের মুখের চেহারা আবার স্বাভাবিক হলো, চোখ তুলে এল। তারপর সে ঘুমিয়ে পড়ল।

দুটো বেজে যাবার পর কেশো চুপি চুপি আবার দীপের ঘরে ঢুকল। দেখল, দীপ অকাতরে ঘুমোচ্ছে। সে চোখ মুছে আবার দেখল। না, চোখের ভুল নয়, সত্যিই দীপ ঘুমিয়ে আছে।

এক মাস কেটে গেছে, দীপ পুষ্পাকে দেখেনি; শেষে আর থাকতে না পেরে সে রণবীরের বাড়িতে গেল।

রণবীর বাড়িতে ছিল না, সেওলালের জ্ঞান ফিরেছে খবর পেয়ে সে হাসপাতালে গিয়েছিল। পুষ্পা একা বসবার ঘরে ছিল। দীপ মুখে সঙ্কোচভরা হাসি নিয়ে তার কাছে গিয়ে বসল। পুস্পার বুক ঢিব ঢিব করে উঠল, সে স্খলিত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কাল রাত্রি দেড়টার সময় তুমি কোথায় ছিলে?’

দীপ খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল; শেষে বলল, ‘এ প্রশ্ন কেন? আমি যথারীতি নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিলাম।’

‘এখানে আসনি?’

‘এখানে আসতে যাব কেন?—পুষ্পা, আমার সম্বন্ধে তোমার মনে কি কোনও সন্দেহ হয়েছে? কী সন্দেহ আমাকে বলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

পুষ্পা কেঁদে ফেলল। তারপর চোখে আঁচল দিয়ে ঘর থেকে উঠে চলে গেল।

দীপ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।

হাসপাতালে সেওলালের জ্ঞান হয়েছে; তার আঘাত গুরুতর হলেও প্রাণের আশঙ্কা নেই। সে রণবীরের কাছে জবানবন্দি দিয়েছে; সত্যি কথাই বলেছে। রণবীর ডাক্তারকে বলে গেছে যে পুলিসের হুকুম না পাওয়া পর্যন্ত সেওলালকে হাসপাতাল থেকে যেন ছাড়া না হয়।

হাসপাতাল থেকে রণবীর দীপের বাড়িতে গেল। সেখানে কেশো দীপকে জেরা করছে—‘কাল রাত্রে কোথায় গিয়েছিলে? আমি দোরে তালা দিয়েছিলুম তবু কি করে ঘর থেকে বেরুলে?’ দীপ জবাব দিতে পারছে না, কিন্তু তার মনেও নিজের সম্বন্ধে সন্দেহ জেগেছে। সত্যিই কি অলৌকিক ব্যাপার নাকি!

রণবীর আসতেই কেশো চলে গেল। রণবীর দীপের পাশে বসে সস্নেহ স্বরে বলল, ‘দীপ, তোমার নামে অনেক রকম কথা কানে আসছে। কী ব্যাপার বলো তো? শরীর খারাপ, না টাকার টানাটানি? আমার কাছে সঙ্কোচ করো না, সব কথা খুলে বলো।’

দীপ আস্তে আস্তে বলল, ‘রণবীরবাবু, আপনি পুষ্পার দাদা, আমার পরমাত্মীয়, আপনার কাছে আমার কিছুই গোপন নেই। বিশ্বাস করুন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমাকে সবাই সন্দেহ করছে; পুষ্পা সন্দেহ করছে, আপনি সন্দেহ করছেন, এমন কি আমার চাকর কেশো পর্যন্ত আমাকে সন্দেহ করছে। কিন্তু কিসের সন্দেহ? কি করেছি আমি?’

রণবীর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দীপের পানে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কোনও দিন দুপুর রাত্রে জুয়ার আড্ডায় গিয়েছিলে?’

দীপ চোখ কপালে তুলে বলে উঠল, ‘জুয়ার আড্ডায়! কখনো না। রণবীরবাবু আমার অনেক দোষ থাকতে পারে, কিন্তু আমি জুয়াড়ী নই।’

আরো কিছুক্ষণ প্রশ্নোত্তরের পর রণবীর বাড়ি ফিরে এল, পুষ্পাকে বলল, ‘দীপের কিছু একটা হয়েছে সন্দেহ হচ্ছে তার মস্তিষ্ক সুস্থ নয়। তার মাথায় যে চোট লেগেছিল তার জের এখনো কাটেনি। ব্রেন-স্পেশালিস্টকে আর একবার কল দেব ভাবছি।’

অমাবস্যা। দীপ নিজের ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। কেশো বাইরে থেকে দোরে তালা লাগিয়েছে। দীপের ঘুমন্ত মুখ শিশুর মুখের মতো সরল।

মধ্যরাত্রির ঘড়ি বাজল। দীপ ধীরে ধীরে চোখ খুলল, ধীরে ধীরে তার মুখে চোখে বিষাক্ত ক্রুরতা ফুটে উঠল। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে সে দরজা খুলতে গেল। কিন্তু দরজা খুলল না; কেশো দরজায় তালা লাগিয়েছে। দীপ তখন জানলা দিয়ে নেমে রাস্তায় নামল। আজ তার লক্ষ্য রাজমোহনের বাড়ি।

রাজের বাড়ির ফটকে পাহারাদার। দীপ পিছন দিকের পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢুকল। অন্ধকারে এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়াবার পর দীপ একটা ঘরে নাইট-ল্যাম্প জ্বলছে দেখে উকি মারল, দেখল রাজ নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে; সে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল। রাজের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে দেখল, তার বালিশের পাশে একগোছা চাবি রয়েছে। দীপ চাবির গোছা মুঠিতে ধরে তুলে নিল, রাজের ঘুম ভাঙল না। দীপ ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

সামনেই দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। দীপ ওপরে গিয়ে দেখল একটা দোরে তালা ঝুলছে। সে চাবির গোছা থেকে পর পর কয়েকটা চাবি তালায় লাগিয়ে দেখল, শেষে তালা খুলে গেল। দীপ কুটিল হেসে ঘরে ঢুকল।

ঘরে ঢুকেই কিন্তু সে চমকে উঠল। ঘরের চারিদিকে সারি সারি লোহার সিন্দুক, মাঝখানে মেঝেয় বিছানা পেতে পূর্ণিমা ঘুমোচ্ছে। দীপ সাবধানে পূর্ণিমাকে পাশ কাটিয়ে সিন্দুকের দিকে গেল, একটা সিন্দুকের তালা খুলতেই দেখল, ভিতরে হীরা-জহরতের গয়না রয়েছে। সে গয়নাগুলো নিয়ে নিজের পকেটে পুরতে লাগল।

একটা গয়না হাত ফসকে মেঝেয় পড়ল, ঝনাৎ করে শব্দ হলো। অমনি পূর্ণিমার ঘুম ভেঙে গেল। সে বিছানায় উঠে বসে চিৎকার করে উঠল—‘অ্যাঁ—কে? চোর চোর।’

দীপ ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। পুর্ণিমা তাকে চিনতে পারল, অমনি তার চিৎকার মধ্যপথে থেমে গেল। দীপ আর দাঁড়াল না, ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

নীচে রাজের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখল বালিশের পাশে চাবি নেই। এক লাফে খাট থেকে নেমে সে দোতলায় ছুটল।

সিঁড়ির মাঝখানে দু’জনের ঠোকাঠুকি। রাজ দীপকে আঁকড়ে ধরে চেঁচাতে লাগল, দু’জনে একসঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে নামতে আরম্ভ করল। তারপর দীপ এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাজের পেটে মারল এক লাথি। রাজ দু’-হাতে পেট ধরে গোঙাতে লাগল। দীপ ছুটে পালাল।

খানিক পরে রাজ সামলে নিয়ে দোতলায় গিয়ে দেখল তোষাখানার দোর খোলা, পূর্ণিমা অজ্ঞান হয়ে মেঝেয় পড়ে আছে। রাজ তার মুখে জলের ছিটে দিতেই তার জ্ঞান হলো, সে কেঁদে উঠল, ‘এ আমি কী দেখলাম! না না, হতেই পারে না।’

রাজের চোখ দপ করে উঠল, ‘তাহলে চোরকে তুই চিনেছিস! কে—কে লোকটা?’

পুর্ণিমা বলবার জন্যে ঠোঁট খুলে আবার বন্ধ করল। তার ভাবগতিক দেখে রাজের সন্দেহ বেড়ে গেল, সে ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ করে আছিস যে! শিগ্‌গির বল্‌।’

পূর্ণিমা বলল, ‘আমি—আমি জানি না।’

‘জানিস না!’ রাজ তার হাত ধরে মোচড় দিল, ‘বল্‌ শিগ্‌গির, নইলে হাত ভেঙে দেব।’

‘বলছি বলছি।’ পূর্ণিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘দীপ।’

‘দীপ! দীপনারায়ণ!’ রাজ লাফিয়ে উঠল, ‘দীপনারায়ণ আমার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল! ওর ম্যানেজার ওর সব টাকা নিয়ে ভেগেছে, সেই থেকে ও চুরি ব্যবসা ধরেছে। ব্যস্, আর যাবে কোথায়। ধরেছি এবার বাছাধনকে। দেখি, এবার কেমন করে পুষ্পাকে বিয়ে করে! জেলে পাঠাব, লাপসি খাওয়াব, তবে আমার নাম রাজমোহন।’

সে আস্ফালন করতে লাগল।

দীপ নিজের বাড়িতে এসে দেয়াল বেয়ে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকল, চোরাই মাল যথারীতি সিন্দুকে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাত্রি তখন দুটো।

কিছুক্ষণ পরে কেশো দোর খুলে ঘরে ঢুকল, দীপের বিছানার কাছে গিয়ে তার মুখ দেখল। কেশোর সন্দেহ এখন দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে, সে গায়ে নাড়া দিয়ে দীপের ঘুম ভাঙাল। দীপ বিছানায় উঠে বসল, ‘কি ব্যাপার? রাত্রি কত? বাড়িতে আগুন লেগেছে না চোর ঢুকেছে?’

কেশো বলল, ‘চোরই ঢুকেছে। কোথায় গিছলে তুমি?’

দীপ বলল, ‘কোথায় গিয়েছিলাম মানে? আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম।’

‘ঘুমোচ্ছিলে! তাহলে তোমার হাতে রক্তের দাগ এল কি করে?’

দীপ নিজের হাত চোখের কাছে এনে দেখল, সত্যিই রক্তের দাগ। সে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

কেশো বলল, ‘জানলা দিয়ে লতা ধরে ধরে তুমি নীচে নেমেছিলে। কেন নেমেছিলে? কোথায় গিছলে?’

দীপ নিজের রক্ত-মাখা হাতের দিকে তাকিয়ে যেন আপন মনেই বলে, ‘ঘুমের ঘোরে হয়তো নিজেই আঁচড়ে ফেলেছি—’

কেশো বলল, ‘লতার কাঁটায় হাত কেটেছে। এ-ঘরে এস দেখি, আমার নানারকম সন্দেহ হচ্ছে। সিন্দুকটা খুলে দেখ।’

পাশের ঘরে গিয়ে সিন্দুক খুলে দীপ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল, ‘এত সব দামী দামী জড়োয়া গয়না—অ্যাঁ, এ যে পুষ্পার কানের দুল। এসব আমার সিন্দুকে এল কোত্থেকে?’

কেশো বলল, ‘কোত্থেকে আবার, তুমি চুরি করে এনেছ। দুপুর রাত্রে তোমাকে ভূতে পায়, তুমি ঘর ছেড়ে বেরোও, তারপর চুরি ডাকাতি খুন, কী করে বেড়াও তুমি জানো। দু’ঘণ্টা পরে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়। তখন ভূতটা তোমাকে ছেড়ে পালায়।’

ধন্দ-লাগা মুখ নিয়ে দীপ ফিরে গিয়ে বিছানার পাশে বসল, বলল, ‘কেশো, এসব কি সত্যি?’

‘ভগবান জানেন, সব সত্যি!’

দীপ আত্মগতভাবে বলতে লাগল, ‘তাহলে আমি একটা চোর…জানি না আরো কত অপরাধ করেছি। শেঠ আম্বালালের বাড়ির চুরি, পুষ্পার গয়না চুরি, আরো যত চুরি হয়েছে, সবই আমার কাজ। আজ রাত্রে কোথায় গিয়েছিলাম। কেশো, এ আমার কী হলো?’

কেশো গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে চলে গেল। দীপ উঠে গিয়ে টেবিলের সামনে বসল, গালে হাত দিয়ে মোহাচ্ছন্নের মতো বসে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘পুষ্পাকে কোন্ মুখে বিয়ে করতে চাইব? চোরকে কে বিয়ে করবে?’

কিছুক্ষণ পরে মনকে দৃঢ় করে সে কাগজ-কলম নিয়ে পুষ্পাকে চিঠি লিখতে বসল।

দীপের চিঠি পেয়ে পুষ্পা অঝোরে কাঁদছে। রণবীর তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। সে বলছে, ‘কাঁদিসনে পুষ্পা, দীপ তো তোকে চিঠি লিখে বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছে, এ থেকেই বোঝা যায় তার মনে পাপ নেই। কিছু একটা হয়েছে, মানসিক ব্যাধি। ডাক্তার দেখানো দরকার। স্পেশালিস্টকে খবর পাঠিয়েছি, দু’এক দিনের মধ্যেই এসে পড়বেন।’

এই সময় গম্ভীর মুখে রাজমোহন প্রবেশ করল; দু’জনকে লৌকিক অভিনন্দন করে বলল, ‘মিস্টার রণবীর, আপনি আমাদের প্রধান পুলিস অফিসার, তাই থানায় না গিয়ে আপনার কাছেই একটা নালিশ জানাতে এসেছি।’

পুষ্পার মুখে শঙ্কার ছায়া পড়ল। রণবীর রাজকে প্রশ্ন করল, ‘কি রকম নালিশ?’

রাজ বলল, ‘কাল রাত্রে আমার বাড়িতে, চোর ঢুকেছিল, কিছু গয়না নিয়ে পালিয়েছে। পালাবার আগে আমি আর পূর্ণিমা তাকে চিনতে পেরেছি।’

‘চিনতে পেরেছ! কে লোকটা?’

রাজ একবার আড়চোখে পুষ্পার পানে চেয়ে বলল, ‘আপনাদের খুবই চেনা লোক—দীপনারায়ণ।’

পুষ্পা উঠে দাঁড়াল, ক্ষণেক নির্বাক থেকে তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল ‘এ হতে পারে না, মিথ্যে কথা!’

রণবীর উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ‘তোমরা বোধহয় ভুল করেছ রাজ। দীপ চুরি করবে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য।’

রাজ বলল, ‘শেঠ আম্বালালের বাড়িতে চুরি হয়েছিল মনে আছে? তিনিও দীপকে দেখেছিলেন, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেননি। এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই, ইদানীং শহরে যত চুরি হয়েছে সব দীপের কাজ। আমি এই গুরুতর অভিযোগের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে তার নামে অভিযোগ আনছি। আপনি লোকজন নিয়ে তার বাড়ি সার্চ করুন, আমার বিশ্বাস সব চোরাই মাল পাওয়া যাবে।’

রণবীর গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আমি পুলিস অফিসার, তুমি যখন অভিযোগ এনেছ তখন আমাকে অনুসরণ করতেই হবে। আমি এখনি থানায় যাচ্ছি, সেখানে তোমার নালিশ লিখে নিয়ে দীপের বাড়িতে যাব। এস আমার সঙ্গে।’

পুষ্পা বলল, ‘দাদা, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’

দীপ নিজের ড্রইংরুমে নিঝুম হয়ে বসে ছিল, কেশো ছুটে এসে খবর দিল, ‘পুলিস! একদল পুলিস এসেছে। সঙ্গে রণবীরবাবু, পুষ্পাদিদি আর রাজমোহন। কী করব, সদর বন্ধ করে দেব?’

ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপ বলল, ‘না, এখানে নিয়ে এস।’

‘কিন্তু—’, কেশো ইতস্তত করছে, এমন সময় রণবীর সদলবলে ঘরে ঢুকল। দলের পিছনে শঙ্কিত মুখে পুষ্পা।

রণবীর দীপের সামনে এসে আবেগহীন কণ্ঠে বলল, ‘তোমার বাড়ি খানাতল্লাস করার পরোয়ানা আছে, তোমার বাড়িতে নাকি চোরাই মাল আছে। (রাজকে দেখিয়ে) এই ভদ্রলোকের অভিযোগ, তুমি কাল রাত্রে এঁর বাড়িতে ঢুকে চুরি করেছ। তোমার কিছু বলার আছে?’

দীপ একে একে সকলের মুখের পানে চাইল, শুকনো গলায় বলল, ‘না, কিছু বলবার নেই। আপনার যা কর্তব্য আপনি করুন।’

রণবীর ইন্সপেক্টরকে খানাতল্লাসের হুকুম ছিল। দারোগা দলবল নিয়ে বাড়ির চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ড্রইংরুমে রইল কেবল দীপ, পুষ্পা আর রণবীর। কিছুক্ষণ কথাবার্তা নেই।

পুষ্পা এক পা এক পা করে দীপের চেয়ারের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল, ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘তুমি একবার বলো তুমি নির্দোষ, আমি তোমাকে বিশ্বাস করব।’

দীপ কিছুক্ষণ শক্ত হয়ে বসে রইল, উত্তর দিল না। তারপর হঠাৎ উঠে গিয়ে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল।

ওদিকে পুলিসের দল বাড়ির একতলা দোতলা খানাতল্লাস করে বেড়াচ্ছে, সঙ্গে রাজমোহন আর কেশো। রাজমোহনের মুখে উত্তেজিত আগ্রহ, কেশোর চোখে বিস্ফারিত আতঙ্ক। সব ঘর শেষ করে তারা দীপের শোবার ঘরে উপস্থিত হলো।

ড্রইংরুমে অখণ্ড নীরবতা। দোতলা থেকে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে তিনজনে ঘাড় তুলে চাইল। তারপর বিজয়ী সেনাপতির মতো আগে আগে রাজমোহন প্রবেশ করল, তার পিছনে অঞ্জলি-ভরা গয়না নিয়ে ইন্সপেক্টর।

রাজমোহন সগর্বে গয়নার দিকে আঙুল দেখিয়ে রণবীরকে বলল, ‘এই দেখুন চোরাই গয়না। সব ওর সিন্দুকের মধ্যে ছিল।’

ইন্সপেক্টর বলল, ‘কেবল রাজমোহনবাবুর বাড়ির জিনিস নয় স্যার, শেঠ আম্বালালের বাড়ির জিনিসও সিন্দুকে ছিল।’

রাজমোহন অট্টহাস্য করে উঠল, ‘চোর! দেখছেন কি, গ্রেপ্তার করুন। যেই ম্যানেজার টাকা নিয়ে পালাল অমনি চুরি ব্যবসা আরম্ভ করল। শুধু ভাত-কাপড় তো নয়, খারাপ পাড়ায় যাবার পয়সাও তো চাই।’

রণবীর কড়া সুরে বলল, ‘তুমি চুপ কর। দীপ, তুমি কিছু বলবে?’

দীপ একবার সকলের দিকে তাকাল; সবাই একদৃষ্টে তার পানে চেয়ে আছে, পুষ্পার চোখে নির্নিমেষ প্রতীক্ষা। দীপ একটা নিঃশ্বাস ফেলে উদাস কণ্ঠে বলল, ‘কিছু না। আমার যা বলবার আমি আদালতে বলব। আমাকে গ্রেপ্তার করুন।’

পুষ্পা ছুটে এসে তার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল। রণবীর তার হাত ধরে সরিয়ে এনে ইন্সপেক্টরের দিকে ঘাড় নাড়ল, অর্থাৎ গ্রেপ্তার কর।

দীপ জামিন চায়নি, হাজতে আছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তার মামলা এজলাসে উঠবে।

রণবীর ব্রেন-স্পেশালিস্ট ডাক্তারকে আনিয়েছে। রণবীরের বাড়িতে ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে, পুষ্পা চুপ করে বসে শুনছে। ডাক্তার বললেন, ‘মানুষের প্রকৃতির এমন হঠাৎ পরিবর্তনে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অনেক কারণেই এমন হতে পারে। সেই দুর্ঘটনায় ওঁর মাথায় আঘাত লেগেছিল; বাইরে থেকে ওঁকে সুস্থ বলে মনে হয়, কিন্তু মস্তিষ্কের আঘাতটা ভিতরে ভিতরে রয়েই গেছে। ওঁর দুর্ঘটনা ঘটেছিল রাত্রি বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে; তাই মাঝে মাঝে রাত্রি বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে ওঁর মস্তিষ্কে anti-social প্রবৃত্তি চাগাড় দিয়ে ওঠে। এটা কিছু নতুন ব্যাপার নয়, আমাদের মনোবিজ্ঞানে এর অনেক উদাহরণ আছে। মানুষের অবচেতন মনের মধ্যে তো সর্বদাই দেবাসুরের লড়াই চলছে।’

রণবীর বলল, ‘এ রোগের কি কোনও প্রতিকার নেই? তাহলে আপনাকে খুলেই বলি, আমার চিন্তার বিশেষ কারণ, ওর সঙ্গে আমার বোনের বিয়ে পাকা হয়ে আছে।’

ডাক্তার সহানুভূতি-ভরা চোখে পুষ্পার পানে চাইলেন, ‘দেখুন, কেসটা একটু নতুন ধরনের। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগার ফলে মস্তিষ্কের কোনও অংশ একটু স্থানচ্যুত হয়েছে, এর কোনও ওষুধ নেই। হয়তো কালক্রমে মস্তিষ্কের বিচ্যুত অংশ আবার স্বস্থানে ফিরে আসবে। কিংবা আবার যদি মাথায় ঠিক ওই রকম আঘাত লাগে তাহলেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে। এ ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখছি না।—আচ্ছা, মামলাটা কবে কোর্টে উঠবে বলুন তো?’

রণবীর বলল, ‘পরশু।’

ডাক্তার বললেন, ‘সে সময় আমার কোর্টে থাকা দরকার। (পুষ্পাকে) আপনি হতাশ হবেন না, মনে সাহস রাখুন। তারপর ভগবানের হাত।’

পূর্ণিমা এখনো তোষাখানায় বন্দী। রাজমোহন হাতে ওষুধের গেলাস নিয়ে তার কাছে গেল, বলল, ‘এই ওষুধটা খেয়ে নে। ডাক্তার দিয়েছে।’

পূর্ণিমা উদাসীনভাবে বলল, ‘কি এটা! বিষ নয় তো?’

রাজ বলল, ‘না না, টনিক। খেলে শরীর চাঙ্গা হবে, জড়তা কেটে যাবে।’

পূর্ণিমা বলল, ‘দাও, যা হয় হবে। মরণ হলে বাঁচি।’

ওষুধ খেয়ে সে শুয়ে পড়ল। রাজ নীচে নেমে এসে দেখল, রণবীর এসেছে। রণবীরের আচরণে ঘনিষ্ঠতার ভাব নেই। সে বলল, ‘দীপের মামলায় পূর্ণিমা সরকারী পক্ষের বড় সাক্ষী। তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

রাজ এর জন্যে তৈরি ছিল, বলল, ‘পুর্ণিমার সঙ্গে এখন তো দেখা হতে পারে না। সে বড় অসুস্থ, জ্ঞান নেই বললেই হয়।’

‘অসুস্থ! জ্ঞান নেই! আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।’

‘আমার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না? বেশ, আসুন, আমার সঙ্গে, নিজের চোখেই দেখুন।’

রাজ রণবীরকে নিয়ে পূর্ণিমার ঘরে এল। পূর্ণিমা ঘুমে অচৈতন্য। রণবীর তার নাড়ি দেখল, চোখের পাতা টেনে দেখল; রোগের কোনও লক্ষণ নেই, সন্দেহ হয় ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। সম্ভবত মর্ফিয়া।

রাজ বলল, ‘দেখলেন তো, এখন কি ওর পক্ষে মামলায় সাক্ষী দেওয়া সম্ভব? তাছাড়া পুর্ণিমার সাক্ষী দেবার দরকারই বা কি? আমি যা দেখেছি সে তো তার চেয়ে বেশী কিছু দেখেনি। আমার কথা কি যথেষ্ট নয়?’

রণবীর উত্তর দিল না, দু’জনে নীচে নেমে এল।

‘আচ্ছা চলি।’ রণবীর সদর দরজা পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল, বলল, ‘সেওলাল নামে তোমার একটা চাকর ছিল না? তাকে দেখছি না, সে কোথায়?’

আকস্মিক প্রশ্নের ধাক্কা সামলে নিয়ে রাজ বলল, ‘সেওলাল! হ্যাঁ, ছিল বটে। লোকটা চোর ছিল, আমার পকেট থেকে টাকাপয়সা সরাতো। একদিন ধরে ফেললাম। তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি।’

‘ও—তাই নাকি?’ রণবীর চলে গেল। যতক্ষণ তার গাড়ি দৃষ্টিবহির্ভূত না হলো ততক্ষণ রাজ চোখ কুঁচকে সেই দিকে চেয়ে রইল।

দীপের বিচার শুরু হয়েছে। আদালরে লোকের ভিড়। রণবীর, পুষ্পা, রাজমোহন সকলেই উপস্থিত। এক কোণে সেওলাল আধখানা মুখ ঢেকে বসে আছে। কাঠগড়ায় দীপ।

আদালতের সামনে একটা পুলিসের মোটরগাড়িতে দু’জন পুলিস অফিসার বসে ছিল। যেন কিসের অপেক্ষা করছে।

এজলাসে হাকিম এসে বসলেন। পেশকার মোকদ্দমা পেশ করল; পাবলিক প্রসিকিউটার উঠে বক্তৃতা শুরু করলেন—May it please your honour-রণবীর অলক্ষিতে এজলাস থেকে বেরিয়ে এসে প্রতীক্ষমান পুলিস-কারে উঠে বসল, কড়া সুরে বলল, ‘রাজমোহনের বাড়ি—’ গাড়ি বেরিয়ে গেল।

এজলাসে পাবলিক প্রসিকিউটার সরকারী বয়ান শেষ করলেন। হাকিম দীপের পানে চাইলেন; তিনি একটু অপ্রতিভ, কারণ দীপের সঙ্গে আগে থাকতেই তাঁর পরিচয় আছে; দু’জনে এক ক্লাবের মেম্বার। একটু দ্বিধা করে তিনি বললেন, ‘আপনার কৈফিয়ত? Guilty or not guilty?’

সকলের দৃষ্টি দীপের ওপর নিবদ্ধ হলো। দীপ একটু নীরব থেকে ধীরকণ্ঠে বলল, ‘ধর্মাবতার, আমি চুরি করেছি কিনা তা আমি নিজেই জানি না।’

হাকিম ভ্রু তুলে বললেন, ‘তার মানে? ভেবে-চিন্তে কথা বলুন। আপনি অপরাধী কি-না?’

দীপ বলল, ‘হুজুর, যখন চোরাই মাল আমার সিন্দুক থেকে পাওয়া গেছে তখন সম্ভবত আমি দোষী। কিন্তু আমিই যে চুরি করেছি একথা নিঃসংশয়ে বলতে পারি না।’

রাজমোহন ব্যঙ্গভরে হেসে উঠল। হাকিম তার পানে গভীর ভ্রুকুটি করে চাইলেন, তারপর দীপকে বললেন, ‘আপনার বক্তব্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আমার প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দিন—Guilty or not guilty?’

এই সময় এজলাসের দোর দিয়ে প্রবেশ করল পূর্ণিমা, সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘ধর্মাবতার, এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি।’

আদালতের মধ্যে একটা নতুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। পূর্ণিমাকে দেখে রাজমোহনের মুখ শুকিয়ে গেল। তারপর সেওলাল যখন মুখের ঢাকা খুলে পূর্ণিমার পাশে গিয়ে দাঁড়াল তখন রাজ মনে মনে প্রমাদ গুনলো। সে পিছন ফিরে দেখল, রণবীর যেন তার পালাবার রাস্তা বন্ধ করবার জন্যেই তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে এবং কঠিন হাসি হাসছে।

সেওলাল হাতজোড় করে হাকিমকে বলল, ‘হুজুর, আমারও কিছু বলবার আছে।’

অতঃপর ব্রেন-স্পেশালিস্ট ডাক্তার দীপের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘ইয়োর অনার, এই কেস সম্বন্ধে আমিও কিছু জানি, আপনাকে তা জানানো দরকার। আমি একজন ব্রেন-স্পেশালিস্ট ডাক্তার; কয়েক মাস আগে এই আসামী মাথায় আঘাত লেগে মরণাপন্ন হয়েছিলেন, তখন আমি এঁর চিকিৎসা করেছিলাম।’

আদালতে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। রাজমোহন দেখল, দীপের বিরুদ্ধে সে যে মোকদ্দমা গড়ে তুলেছিল তা ফেঁসে গেছে, সে নিজের ফাঁদে নিজে ধরা পড়েছে। সে পিছন ফিরে কোর্ট থেকে পালাবার চেষ্টা করল। কিন্তু রণবীর দুর্লঙঘ্য পাঁচিলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মরীয়া হয়ে সে পকেট থেকে রিভলবার বার করে চিৎকার করল, ‘ছেড়ে দাও, আমার পথ ছেড়ে দাও—’

রণবীর খপ করে রাজমোহনের বন্দুক-সুদ্ধ হাত চেপে ধরে বলল, ‘খবরদার, পালাবার চেষ্টা করো না। দীপনারায়ণ এবং সেওলালকে খুন করার চেষ্টার জন্যে আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করছি।

রিভলবারের জন্যে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি হলো; ধস্তাধস্তির মধ্যে একটা গুলি বেরিয়ে গিয়ে দীপনারায়ণের মাথায় লাগল। মাথার খুলি ফুটো হলো না বটে, কিন্তু খুলির ওপর একটা গভীর দাগ কেটে গুলিটা পিছলে বেরিয়ে গেল, দীপ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

আরো কয়েকজন পুলিসের লোক এসে রাজকে চেপে ধরল, রণবীর তার হাত থেকে রিভলবার ছিনিয়ে নিল।

পুষ্পা ছুটে গিয়ে দীপের রক্তাক্ত মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে কেঁদে উঠল—‘ডাক্তার! ডাক্তার!’

ততক্ষণে আদালত-ঘর থেকে দর্শকের দল সব পালিয়েছে।

দীপের শয়ন-কক্ষ। রাত্রি বারোটা বাজতে বেশী দেরি নেই। বিছানায় দীপ চোখ বুজে শুয়ে আছে, তার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ঘরের মধ্যে আছে রণবীর, পুষ্পা, পূর্ণিমা, কেশো। ব্রেন-স্পেশালিস্ট ডাক্তার খাটের ধারে দাঁড়িয়ে দীপের মুখের পানে চেয়ে আছেন। পুষ্পা খাটের পাশে বসে নির্নিমেষ চোখে দীপের মুখ দেখছে; তার মুখে আশা-আশঙ্কার চলচ্ছায়া।

ঘরের এক কোণে রণবীর আর পূর্ণিমা হাত-ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে এবং মাঝে মাঝে ফিসফিস করে কথা বলছে। কেশো অতৃপ্ত প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, একবার এর কাছে একবার ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।

রণবীর খাটো গলায় পূর্ণিমাকে বলল, ‘আজ রাত্রে তোমার বাড়ি গিয়ে কাজ নেই, তুমি বরং আমার বাংলোয় চল। তোমার বাড়িতে কেউ নেই, রাজমোহন হাজতে, এ সময় একলা তোমার নিজের বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।’

পূর্ণিমা বলল, ‘পুষ্পার এই বিপদ, আমি কোথাও যাব না। পুষ্পা দীপকে এত ভালবাসে আমি বুঝতে পারিনি।— তুমি আমার দাদার চরিত্র জানতে পেরেছ। তা সত্ত্বেও আমাকে চাও?’

রণবীর বলল, ‘তোমার দাদার চরিত্র এবং তোমার চরিত্র যে ঠিক বিপরীত তাও তো জানতে পেরেছি।’

‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারবে?’

‘বিশ্বাস না করতে পারলে তোমাকে বিয়ে করতে চাইব কেন?’

‘আমি এক সময় দীপকে ভালবাসতাম, কিন্তু ও আমাকে চায়নি। তারপর কী যে হলো, দীপের ওপর থেকে আমার মন সরে গেল, বুঝতে পারলাম দীপ পুস্পার, আর কারুর নয়।’

‘আমি জানি পূর্ণিমা।’

‘তোমাকে না জানিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না তাই জানালাম।’

রণবীর তাকে আর একটু কাছে টেনে নিল।

কেশো ডাক্তারের কাছে গিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তারবাবু, জ্ঞান হতে আর কত দেরি?’

ডাক্তার কেবল হাত তুলে তাকে আশ্বাস দিলেন। কেশো বিড় বিড় করে বলে চলল, ‘আজ আবার অমাবস্যা। আজকের দুপুর রাত্রে একটা ভূত ওর ঘাড়ে চাপে, তখন ও অন্য মানুষ হয়ে যায়—’

ডাক্তার আঙুল দেখিয়ে কেশোর দৃষ্টি দীপের মুখের দিকে আকর্ষণ করলেন।

দীপ এখনো অচৈতন্য, কিন্তু তার মুখের ওপর নানারকম ভাবের ব্যঞ্জনা একের পর এক খেলে যাচ্ছে। কখনো কপালে গভীর ভূকুটি মুছে গিয়ে একটা বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠছে। তারপর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে, ঠোঁট একটু একটু নড়ছে, যেন সে অজ্ঞান অবস্থায় স্বপ্নে কথা কইবার চেষ্টা করছে—

নীচের একটা ঘরে ঠং ঠং করে বারোটা বাজতে আরম্ভ করল। নিস্তব্ধ রাত্রে সেই গভীর আওয়াজে ঘরের সকলে যেন সচকিত হয়ে আরো গভীর আগ্রহে দীপের মুখের পানে চাইল।

ঘড়ির আওয়াজ থেমে যাবার পর দীপ আস্তে আস্তে চোখ খুলে চাইল। কিছুক্ষণ তার মুখ ভাবলেশহীন হয়ে রইল, তারপর কপালে ঈষৎ কুঞ্চন দেখা গেল।

ঘরের চারজন মানুষের শরীর শক্ত হয়ে উঠেছে, নিশ্বাস রোধ করে তারা তাকিয়ে আছে। কেবল কেশোর ঠোঁট একটু একটু নড়ছে, যেন সে ইষ্টনাম জপ করছে।

দীপের চোখ এদিক ওদিক ঘুরে পুস্পার মুখের ওপর স্থির হলো। খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে সে পুষ্পার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিল, কোমল কণ্ঠে বলল, ‘পুষ্পা, তুমি কবে আমায় বিয়ে করবে?’

পুষ্পা তার বুকের ওপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

ডাক্তার একটা নিশ্বাস ফেললেন।

‘যাক, আর ভয় নেই।’ তিনি কেশোর পেটে তর্জনীর খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘তোমার ভূত পালিয়েছে।’

মার্চ ১৯৭০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *