অমানুষ – ৯

আবার সেই ঘরছাড়া মানুষগুলো যে-যার ঘরে ফিরে গেছে। ভেড়িগুলোর হানামুখ ওরা বন্ধ করেছে। মাঠে মাঠে এসেছে সবুজ ধান-শিশুর দল; কোথায় ভেড়ির ওপর ঘুমন্ত কাশবন জেগে উঠেছে যৌবনের স্বপ্নে, সাদা ফুলে ভরে গেছে ওর সর্বাঙ্গ। বাতাসে কাঁপছে ওরা। মেঘমুক্ত নীল আকাশে উড়ে যায় সাদা মেঘের দল। সুন্দরবনের দিক থেকে শরতের খুশির হাওয়ায় ভেসে আসে মানুষের এই দুঃখ-জয়ের সংবাদ। 

কতদিন তার হিসেব রাখেনি মধু, কী দুর্বার পরিশ্রমের মধ্যে কেটে গেছে। লেখাকে দেখেছে, একটি সেবাপরায়ণা নারী নিজের সব ভুলে ওদের সেবায় ডুবেছিল। অপরিচিত হাজার মানুষের মনে ওর ছবি আঁকা হয়ে গেছে। 

ওরা সব গঞ্জ খালি করে যে-যার বসতে ফিরে গেছে। 

মধু বলে—যা শালারা! এ যেন পাখির বাসা। সাঁঝবেলায় জুটল, চ্যাঁচামেচি করল, তারপরই দিনের আলোয় ফুরুৎ? ধা! সব দিক-দিগন্তরে উড়ে গেল। অ্যাই পদা, মালপত্তর গোছগাছ করে, ধনেখালিতে ফিরতে হবে আজই রাতে। 

পদা বলে—তাই চল গুরু! কিন্তু আজ এট্টু, মানে— 

লেখা দাঁড়িয়ে ছিল। মধু পদাকে নিয়ে সরে গেল। লেখার সামনে ওএসব কথা তুলতে যেন সমীহ করে সে। লেখা হাসল মনে মনে। 

কোথায় এই কঠিন মানুষটার অতল মনের সেই সম্ভ্রম আর সম্মানবোধটুকুকে সে জাগিয়ে তুলেছে। মধু আজ এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান, কিন্তু এ সম্মান সে চায় না, সেই কঠিন একটা আবরণে নিজেকে ঢেকে রেখেছে। ওরা তাকে বড়ো বড়ো ভেড়ির ঠিকে গছাবার জন্য ব্যস্ত। মধু বলে, 

—যেটুকু পারব করব। তার বেশি নিলেই চুরি করতে হবে। চোর সাজাতে চান মধু চৌধুরীকে?

লেখা ওকে দেখেছে নতুন রূপে। 

রাতের অন্ধকারে লঞ্চটা ফিরছে। ঘরে ফিরছে ওরা। 

শান্ত-স্তব্ধ নদীর বিস্তারে পড়েছে চাঁদের আলো, ওপাশে আদিম অরণ্যভূমিতে স্বপ্ন নেমেছে। ঘুমঢাকা চারদিক। লঞ্চের ইঞ্জিনের গুরু গুরু শব্দ ওঠে। পেছনে জল কেটে চলেছে প্রপেলারটা। সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া জলে ওই চাঁদের আলোয় ঝকঝকে ফসফরাসের ঝিলিক জ্বলছে রুপোলি আভায়। 

দাঁড়িয়ে আছে মধু। ওর মনের অতলে একটা শূন্যতা জাগে। 

এতদিন কাজে ডুবেছিল, আজ সব কিছু ফুরিয়ে গেছে। মনে হয় ধনেখালির সেই অলস দিনগুলো আর সেই পরিবেশ তাকে কেমন মাতাল করে তুলবে। একা সে। কোথাও তার কোনো সঞ্চয় নেই, যা দিয়ে মনের সেই অসীম শূন্যতাকে পূর্ণ করে নেবে। 

হঠাৎ পাশে কাকে দেখে চমকে ওঠে—লেখা! 

লেখা জবাব দিল না, ওর দিকে তাকাল। ওর মুখে পড়েছে একফালি চাঁদের আলো। গহন স্তব্ধ বনভূমি। ওদিকে ঘুমন্ত মানুষের আবাদ, বিরাট অন্তহীন এই বিস্তারে ওরা দুজনে কোথায় হারিয়ে গেছে। 

অতীতের একটি রাতের কথা মনে পড়ে লেখার। 

এমনি করে লঞ্চ সেদিন ফিরছিল, রাতের অন্ধকারে লঞ্চ বন্ধ হয়ে পড়েছিল তার এইখানে। সেই অবিশ্বাস, আতঙ্ক আর ঘৃণার রাতে নতুন করে চিনেছিল লেখা ওই জানোয়ার বলে পরিচিত মানুষটাকে। 

আজ ভেঙে-চুরে তা থেকে অন্য একটি সম্পূর্ণ মানুষ বের হয়ে এসেছে। লেখার মনে কী পূর্ণতার সাড়া। ওর দিকে তাকাল সে। 

মধু অবাক হয়ে যায়। এ যেন জীবনের একটি সফল মুহূর্ত। এই মুহূর্তটুকু তার শূন্য -ব্যর্থ জীবনে পরম সার্থকতার আশ্বাস এনেছে। 

—লেখা! 

লেখা ওর দিকে তাকাল। ওর হাতখানা মধুর হাতে। সারা দেহ মনে কী সুর জাগে। হঠাৎ মধু চমকে ওঠে লেখার দিকে তাকিয়ে। কী যেন একটা অন্যায় করে ফেলেছে সে। মধু লেখার সঙ্গে এতদিন মিশেছে। কিন্তু নিজের মনের কী একটা নগ্ন লোভী সত্তাকে দেখে শিউরে উঠেছে। এটাকে সে প্রকাশ করতে চায় না। নিজেই নিজের এই স্বরূপ দেখে আজ শিউরে উঠেছে। সরে গেল সে। যেন চাবুক-খাওয়া জানোয়ারের মতো শিউরে উঠে পালাচ্ছে ভয়ে, একটা অন্য জীব। 

লেখা অবাক হয়—কী হল তোমার? 

মধুর জবাব দেবার সাধ্য নেই। সে এড়িয়ে যায়। সরে গেল ওখান থেকে লঞ্চের নিচের খোলে। 

ঢেউয়ের আঘাতে আর গতিবেগে লঞ্চটা দুলছে। পদা দাঁড়িয়ে আছে নীচে, ঘুম আসেনি ওর। একটা হ্যারিকেন দড়িতে বেঁধে নিচের ডেকে ঝুলিয়ে ইঞ্জিনটা চালু রেখে ইয়াকুব বসে বসে ঢুলছে। 

পদা জানে গুরু কোথায় আছে। কিছুদিন ধরে সে দেখে আসছে ব্যাপারটা। যতে ওপাশে চাদর মুড়ি দিয়ে নাক ডাকাচ্ছে। হঠাৎ তাড়া-খাওয়া জানোয়ারের মতো মধুকে নেমে আসতে দেখে তাকাল পদা। 

মধু হাঁপাচ্ছে। শুধোয় সে—কিছু আছে রে পদা? 

আজ মধু আবার মাতাল হতে চায়। নিজের এই স্বরূপটাকে যেন টুটি টিপে মারতে চায় সে। একে কোনো স্বীকৃতিই দিতে সে নারাজ। 

পদা অবাক হয়েছে। মধুর দিকে তাকাল সে। 

মধু ওর চোখাচোখি হতে চায় না। ফ্যাসফ্যাসে গলায় শুধোয় আবার –আছে? 

পদা জবাব দেয়—থাকবে কোত্থেকে? খেতে দিয়েছ সুস্থির হয়ে? নাই। 

মধু হাঁ-না কিছু বলল না। গাঙের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঢেউ ফাটছে, চাঁদের আলোয় ফসফরাসের আভা ওই জলের বুকে। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। পদা এগিয়ে এসে বলে—গুরু!

মধু জবাব দিল না। পদা দেখছে মধুর মনের সেই ঝড়টাকে। ও যেন সমর্থন করতে, অভয় দিতে চায় তাকে। 

—একটা কথা বলব মাইরি? 

মধুর তাতেও কোন উত্তর নেই। স্তব্ধ-গম্ভীর একটি মানুষ কী ভাবনার গভীরে তলিয়ে গেছে। হঠাৎ যেন কঠিন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে, যার সমাধানের কোন পথ তার জানা নেই।

পদা কাছে এসে বলে—গুরু মেয়েটা—ডাক্তারের বোন, ওই সুনীতি সুধা মাইরি তোমার ‘লভে’ পড়ে গেছে। একেবারে হাবুডুবু— 

কথাটা শেষ করতে পারে না, মধুর কানে ও কথাগুলোই গরম একটা অসহ্য-জ্বালা এনেছে। সে পেছনে ফিরেই পদার গালে সপাটে একটা চড় কষেছে। অতর্কিত ওই চড়ে পদা বস্তার ওপর টাউরি খেয়ে গিয়ে পড়ল। 

ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারে না সে। মধু গর্জাচ্ছে,–ফের যদি ওইসব কথা বলেছিস, জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব তোর! 

পদা উঠে বসে গালে হাত বোলাতে থাকে। কী অন্যায় করল সেটা বুঝতে পারে না সে।

মধু গুম হয়ে আবার রেলিংয়ে ভর দিয়ে ওই অন্ধকার পরিবেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওই অজানার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চায় সে। 

.

সকাল হয়ে গেছে। 

ওদের ডাকাডাকিতে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল মধু, রাতে কখন ওই পুরনো বস্তার ওপরই শুয়ে পড়েছিল। ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া লাগতে একটা বস্তাই ঢাকা দিয়েছে, আটার বস্তার সাদা গুঁড়োগুলোয় মুখ-মাথা ভর্তি হয়ে গেছে। হাসছে লেখা—কী হল? এত ঘুম! আমরা এসে গেছি, সামনেই ধনেখালির গঞ্জ। চা খাবে না? এখানে মানুষ শোয়? 

মধু মাথা-গা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে—আমি শ্লা আবার মানুষ, হ্যাঁ! ঠিক আছে! চা হবে নাকি একটু? পদা, যা নিয়ে আয়। 

লেখাকে ও যেন এড়িয়ে যাচ্ছে। লেখাও একটু অবাক হয়। সেই সহজ প্রাণখোলা মানুষটাও কেমন বদলে গেছে আবার। 

নামবার আগে লেখা দূর থেকে তাকিয়ে আছে গঞ্জের দিকে। ঘাটে অন্য একটা লঞ্চ বাঁধা রয়েছে, লোকজনের ভিড়ও জমেছে। বোধহয় ওদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে। 

লঞ্চটা এসে ঘাটে লাগল। চারিদিকে থমথমে স্তব্ধতা। 

ভুবনবাবু, মহিম ঘোষাল, হারু সা, ব্লক অফিসার অন্যান্য লোকজন জমেছে, সকলেরই মুখই থমথমে ভাব। 

মধুসূদন অবাক হয়। লঞ্চ থেকে নেমে এগিয়ে এসে ওদের দিকে চেয়ে বলে,— যাঃ বাবা! বলি সব কী বোবা মেরে গেলে নাকি! অ পিসিডেন, ভুবনবাবু! 

লেখা নেমে আসছে। 

ভুবনবাবু এগিয়ে আসেন মধুর দিকে। চুপি চুপি কী বলেন তিনি। শুনে মধু চমকে ওঠে, 

—অ্যা! সে কি কথা ভুবনবাবু? কবে হয়েছে? 

—কাল রাত্রে। 

মধুসূদন গুম মেরে যায়। লেখাও শুনেছে কথাটা। 

কাল রাতে অশ্বিনীবাবুর স্ট্রোক মতো হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। 

ভুবনবাবু বলেন—রেডিওগ্রাম করে এস ডি ও’র লঞ্চে সিভিল সার্জনকে এনেছি, তিনি দুজন ডাক্তারও এনেছেন সঙ্গে। চেষ্টার ত্রুটি করিনি মধু। 

লেখা অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে। ওর মুখে কি বিবর্ণতার ছায়া নামে। সে এগিয়ে গেল ওদের বাড়ির দিকে। মধু তাকিয়ে দেখছে ওই লেখাকে। 

মহিম ঘোষাল মনে মনে খুশি হয়েছে। আর অশ্বিনীবাবু বেঁচে উঠুক এটাও বোধহয় সে চায় না। তাই বলে, 

—চেষ্টা অবশ্য করতেই হবে। তবে মনে হয় ব্যর্থই হবে সবকিছু। আরও সব রোগের ওপর পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো। 

মধু ওর দিকে তাকাল। ওর চুলগুলো উশকোখুশকো, আটার চোকল লেগে আছে সর্বাঙ্গে, জামায়। মধু কথা বলে না, চুপ করে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট টানছে। 

ভুবনবাবু বলেন—সিভিল সার্জন কোনো আশা দিতে পারছেন না। 

মধু বলে ওঠে—আশা! তবু মনে হয় কী জানেন ভুবনবাবু! লেখার কেউ নেই ওই দাদা ছাড়া! 

হঠাৎ কার-আর্তকণ্ঠ স্বর শোনা যায়!… 

.

লেখা কাঁদছে। অশ্বিনীবাবুর আর জ্ঞান ফেরেনি। 

— দাদা! 

লেখা ওঁকে ডাকছে। কিন্তু কোনো শব্দ নেই, অসাড় দেহটা পড়ে আছে। সি এম ও তাকিয়ে আছেন লেখার দিকে। সহকারী ডাক্তার ওই অচেতন দেহটার মুখের ওপর থেকে অক্সিজেন ফানেলটা সরিয়ে নিলেন, একে দাদা চাদরটা ঢেকে দিল, যেন সব কিছুর ওপর অমনি অস্বচ্ছ যবনিকা নেমেছে। লেখা জানে তার অর্থ, অজানা কী ভয় আর দুঃখ অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে সে, 

— দাদা! দাদা! 

জানে সাড়া আর কোনোদিনই মিলবে না। দুই ভাই-বোনের মধ্যে আজ একজন হারিয়ে গেল। এই বিরাট পৃথিবীতে আজ লেখা একা, চারিদিকে শুধু যন্ত্রণাদায়ক নিঃস্বতা আর শূন্যতার হাহাকার! 

সেই আর্ত চিৎকার যেন মধুসূদনের মুখে তীব্র চাবুকের আঘাত করেছে। লেখার কান্নার শব্দ আকাশ-বাতাস ছড়িয়ে পড়ে। আর্তনাদ করে ওঠে মধু, 

—ভুবনবাবু! 

ভুবনবাবুও চমকে ওঠেন। মহিমবাবু বলে,–ও আমি জানতাম ভুবনবাবু! 

মধু গর্জন করে ওঠে,

—থামবে পেসিডেন! তুমি ঢের কিছু জানো দেখছি! 

মধুর ওই গর্জনে মহিমবাবু থেমে গেল। মধু সিগ্রেটটা ফেলে দিয়ে ওই গাঙের দিকে তাকিয়ে থাকে। সব কেমন তছনছ হয়ে গেল। 

মহিমবাবু তবু এগিয়ে গেল ডাক্তারের বাড়ির দিকে। ওরই যেন দায়।

—যাই দেখি! শেষ কাজের ব্যবস্থা করতে হবে তো! 

মধু দাঁড়িয়ে আছে ওই অকূল গাঙের ধারে। সব যেন শূন্যতার বেদনায় বিকৃত হয়ে গেছে। 

—গুরু! 

পদা ডাকছে ওকে। পদার দিকে তাকাল মধু। 

—ঘরে যাবে নাই? কী হল তোমার বল দিকি? 

—যাব। তুই যা। 

ওরাও গুরুর এই পরিবর্তনে কেমন ঘাবড়ে যায়। পদা কী শুধোতে যাবে, যতিলালের ইশারায় সরে গেল। 

দিনগুলো চলে যায় হালকা হাওয়ায় ভেসে-যাওয়া ঝরাপাতার মতো। সব কেমন শূন্য লাগে মধুর। তবু কাজকর্ম শুরু করতে হবে ধান উঠলেই। মাঠে সোনাধানের রং লেগেছে, গাঙের বুকে এসেছে স্তব্ধতা। 

লেখার সঙ্গে দেখা হয়েছে দু-একবার। গেছেও মধুসূদন ওর ওখানে। 

ডাক্তারখানাটা শূন্যপ্রায়। স্কুলটা নিয়ে কোনোরকমে সব ভুলে আছে লেখা। মধুকেই এখন ওর অনেক কাজ-কর্ম দেখে দিতে হয়। 

—ধানের কি হবে? জমি-জমার ব্যাপার ওসব তো জানি না! 

লেখা অসহায় সুরে মধুকে কথাগুলো জানায়। লেখা বলে,—এদিকে বছরের খোরাক-খরচা তো আছে। 

মধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে সে,—ওর জন্য তোমায় ভাবতে হবে না লেখা লেখা হাসল। মলিন-বিবর্ণ একটু হাসি। জবাব দেয় সে—ভাবব আর কত! সব কেমন অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। একা। 

মধু ওর দিকে তাকাল। লেখা বলে—এক-একসময় মনে হয়, ওই গাঙের জলেই ডুবে সব জ্বালা জুড়োই। এ ছাড়া আর পথ কি? 

মধু শুনছে ওর কথাগুলো। কোথায় ওরও বেদনাবোধ হয়। সরে এল সে। 

হঠাৎ সেদিন শহরে লেখার কী কাগজগুলো দাখিল করে ফিরছে মধু। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শীতের শুরু, কুয়াশার ঘন আবরণে সবকিছু যেন চাদর-জড়ানো, কোন্ বাহাত্তুরে কালের বুড়োর মতো চেহারা নিয়ে গঞ্জটা দাঁড়িয়ে আছে। 

মধু এগিয়ে যায়, লেখার হাতে রসিদ দিয়ে বাড়ি ফিরবে। 

হঠাৎ ওর ঘরের বারান্দায় উঠে থমকে দাঁড়াল। ভেতর থেকে লেখার কঠিন কন্ঠের চিৎকার শোনা যায়। 

—যান, বের হয়ে যান বলছি! 

কাকে ধমকাচ্ছে লেখা। মধু চুপ করে দাঁড়িয়েছে। ওদিক থেকে মহিম ঘোষালের কন্ঠস্বর শোনা যায়। হাসছে সে—চটছে কেন? যাচ্ছি, যাচ্ছি। তবে বললাম, কথাটা ভেবে দেখ! নিশ্চিন্তে থাকবে। একা-একা থাকো! 

লেখা চিৎকার করে-আপনাদের জন্য কি গাঙের জলে ডুবে মরব? দোহাই আপনাদের, দয়া করুন, এখানে আসবেন না। চলে যান আপনি! 

—যাচ্ছি! তবে তোমার ভালোর জন্যেই বললাম। 

লেখার কান্নার শব্দ শোনা যায়। মহিমবাবু বের হয়ে আসছে। হঠাৎ আবছা আলোয় দরজার সামনেই মধুকে দেখে থমকে দাঁড়াল। শহর থেকে ফিরছিল মধু, হাতে তরকারি-ফুলকপির সেই ব্যাগটা ফেলে দিয়ে ওর পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। আবছা আলো-আঁধারির মাঝে ওর দু’চোখ জ্বলছে। 

মহিম ঘোষালের মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠেছে ভয়ে 

—মানে….মানে…. 

মধু গর্জে ওঠে,—মানে বুঝিয়ো না পেসিডেন! তোমাকে শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি, এমুখো হবে না। ফের যদি দেখি শুনি এখানে জ্বালাতন করতে এসেছ, মধু চৌধুরী সেদিন তোমাকে গলা টিপে শেষ করে মাঝগাঙে রেখে আসবে। কুমির-কামটের ভোজে লেগে যাবে। 

মহিম ঘোষাল শিউরে ওঠে—সত্যি বলছি মধু, মানে….. 

—মধু চৌধুরী বাপের ব্যাটা। তোমার মতো নেড়ি কুত্তাকে মারতে তার এতটুকু সময় লাগবে না। বুঝলে? 

মহিম ঘোষাল ছাড়া পেয়ে চোঁ-চা দৌড় মারল। 

লেখার সেই কান্নায় ভেঙে পড়া চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে মধু। কী ভাবছে সে। পায়ে পায়ে সরে এল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সে। চারিদিকে কুয়াশার আবরণ, বাতাসে নদীর গর্জন ওঠে, সব শূন্যতার যন্ত্রণায়-ভরা। লেখা তাই কাঁদে। 

কী ভেবে মধু হনহন করে চলেছে। নিশুতি জনপদ। অন্ধকার পথ দিয়ে চলেছে মধু। বাড়িটার কাছে এসে থামল। 

বারান্দার ওপাশের ঘরটায় আলো জ্বেলে ভুবনবাবু কাজ করছেন। হঠাৎ অন্ধকারে মধুকে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখে ওর দিকে তাকালেন। উশকো-খুশকো চেহারা, চোখ-দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে। 

—ভুবনবাবু! মধু ওঁর দিকে এগিয়ে আসে। 

ভুবনবাবু অবাক হন—কী ব্যাপার মধু? এত রাত্রে? 

আপনার কাছে এসেছিলাম মাইরি! 

মধুর কোন দরকার থাকতে পারে, এখানে তা জানতেন না ভুবনবাবু। তাই ওর কথায় অবাক হন—কী ব্যাপার? 

—কোনোদিন কারও কাছে মধুসূদন চৌধুরী কিছুই চায়নি ভুবনবাবু। আজ এসেছি খুব বিপদে পড়ে। একদিন বলেছিলেন আপনি, সত্যি আমাকে ভালোবাসেন! 

ভুবনবাবু ওর দিকে তাকালেন,—হ্যাঁ! 

—তাহলে একটা কথা রাখতেই হবে। মধু ওঁর হাতটা ধরে ব্যাকুলভাবে। 

—কী ব্যাপার! 

—আপনি লেখাকে উদ্ধার করুন! ভালো মেয়ে, আপনার যোগ্য সে। আর জানেন তো, কেউ নেই যে ওকে আশ্রয় দেয়! 

ভুবনবাবু অবাক হন,—সেকি! তা কী করে সম্ভব! 

—কেন নয়? 

মধু ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। ভুবনবাবু মাথা নাড়ছেন,—না-না! 

—অ! তাহলে অ্যাদ্দিন মিছে কথাই বলেছেন আমাকে! মিছে কথা সব শ্লাই বলে। কিন্তু ভুবনবাবু, আপনিও মিছে গুল দিলেন সেদিন? ভালোবাসি, ভালো লাগে তোমাকে? ধ্যাত্তেরি— ভুবনবাবুও জানেন লেখার ব্যাপারটা। ওর জন্য তাঁরও বেদনাবোধ কম নেই। মধুকে বলেন তিনি, –তোমার সঙ্গে ওর চেনা-জানা, এতদিনের পরিচয়— 

মধু চেয়ার ছেড়ে খাড়া হয়ে ওঠে। ভুবনবাবুর কথাটা থামিয়ে দিয়ে বলে, 

—থাক থাক! দেখছি দারোগা না হয়ে, তিন বছর কোনো দারোগার ঘোড়ার ঘাস কাটাই উচিত ছিল তোমার! 

ভুবনবাবু হাসছেন। 

মধু বলে চলেছে—আমি শ্লা জানোয়ার, মদো-মাতাল ইতর কেলাসের লোক। আজ বিপদের সময় ওকে বিয়ে করলে, লেখা পরে ভাববে মধু চৌধুরী তাকেও জুল-জাল দিয়ে বিয়ে করেছে, ঠকিয়েছে। তাছাড়া এ যে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা ভুবনবাবু। লেখার মতো মেয়ে কোনোদিন আমাকে নিয়ে সুখী হতে পারে না—পারবে না! 

ভুবনবাবু ওর দিকে চেয়ে থাকেন। মধুর চোখ-দুটো ছলছল হয়ে ওঠে কী বেদনায়। চুপ করে ভাবছেন ভুবনবাবু। মধুসূদনকে লেখা ভালোবাসে তা জানেন তিনি। কিন্তু মধু আজ লেখার কথা ভেবেই সেই পরম পাওয়া থেকে বঞ্চিত করতে চায় নিজেকে। 

—মধু! 

ভুবনবাবুর কথায় মধু বলে ওঠে—সেদিন মধু চৌধুরীর মতো জানোয়ারকে মানুষ করার জন্য আদা-জল খেয়ে লেগেছিল, আর আজ মানুষকে—মানুষের স্বীকৃতি দিতে ধানাই-পানাই করছ! লেখা কেমন মেয়ে তা জানো তুমি! বলো, তুমিও বই-পড়া, জামা-প্যান্টুল পরা একটা ভণ্ড, শুধু বুকনি মারতে পারো? কাওয়ার্ড, ভীরু- 

ভুবনবাবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। মধুর ওই কথাগুলো নির্মম হলেও বোধহয় সত্যি। মধুই আজ তার মনের অতলের সেই কর্তব্যকে জাগিয়ে তুলেছে, হয়তো বেদনাভরা ভালোবাসাকেও 

ভুবনবাবু ওর হাত ধরে ওকে শান্ত করতে চান। স্থির চাহনিতে তাকিয়ে থাকেন ওর দিকে। মধু ওঁকে দেখছে। হঠাৎ মনে হয়, ভুবনবাবুর চোখে কী স্বীকৃতি আর মাধুর্য। মধু নতুন মানুষটাকে যেন চিনেছে। ওকে জড়িয়ে ধরে মধু বলে—ভুবনবাবু! তাহলে তুমিই সেদিন ব্যাটা মধুসূদনকে একলা চেনোনি, মধুসূদন চৌধুরীও তোমাকে চিনেছিল হে! না’লে, সেদিন ফস করে পিঠ পেতে দিইছিলাম অমনি চাবুক খেতে? আর কেউ হলে মধু চৌধুরীর অন্য মূর্তি দেখত সে। বুঝেছ—তোমাকেও চিনেছিলাম। তুমি খাঁটি মানুষ। 

মধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে তরুণ ভুবন বোস। দুটি কঠিন মানুষ, অন্তরের নিভৃত মাধুর্যের আবেশে বাঁধা পড়েছে। 

লেখাও প্রতিবাদ করতে পারেনি। মধুর ওই কথাগুলো সে-ও শুনেছিল। 

লেখা কথা বলতে অবকাশ পায়নি। মনে হয়েছিল মধু তাদেরই দলে, যারা জীবনে চায় না কিছুই, শুধু দিয়েই যায়। লেখার জীবনে এসেছে পূর্ণতার সাড়া। আজ তার ঘর, আশ্রয় সব হয়েছে। সুখী হয়েছে সে। 

ভুবনবাবুও জীবনের একটি প্রকৃত সঙ্গিনীকে পেয়েছেন লেখার মধ্যে। মধুর মনে হয় তার জীবনে এইটাই সবচেয়ে বড়ো কাজ, আর সেটাকে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে সে। 

শীতের গাঙ। মধু আবার চলেছে ভেড়িবাঁধার কাজে। ধনেখালির ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে লঞ্চটা। ভুবনবাবুর প্রমোশন হয়ে গেছে। তিনিও দু-চার দিনের মধ্যে আলিপুরে চলে যাচ্ছেন এই বাদা অঞ্চল থেকে। ধনেখালির বুক থেকে লেখাও চলে যাবে শহরে স্বামীর সঙ্গে তার নতুন সংসারে। লঞ্চে মালপত্তর তোলা হচ্ছে। ভুবনবাবু বলেন—আর ফিরে এসে দেখা হবে না মধু। শহরেই দেখা করতে যাবে। না গেলে লেখা কিন্তু খুব রাগ করবে। 

—যাব। নিশ্চয়ই যাব। মধু তাড়া দেয়—অরে অ যতে! ম্যাপ, তেরপল, মালপত্তর তুলেছিস?

-–হ্যাঁ গ! 

পদাও তৈরি। মধু তাকিয়ে দেখছে ধনেখালির গঞ্জকে। কেমন সব শূন্য হয়ে যাবে। লেখা-ভুবনবাবু দাঁড়িয়ে আছে। লেখাও থাকবে না এখানে। একটি স্মৃতিও মুছে যাবে জোয়ারের জলে। 

—চলি ভুবনবাবু! 

হঠাৎ লেখা এগিয়ে এসে ওকে প্রণাম করে, কী ভেবে ভুবনবাবুও মাথা নোয়াল। আঁতকে ওঠে মধুসুদন। জীবনে তাকে কেউ প্রণাম করেনি। তাই চিৎকার করে, 

—আরে, অ্যাই অ্যাই! জানোয়ারকে পেন্নাম করে নাকি! অ্যাই পদা, দ্যাখ, দ্যাখ, শ্লা; ভুবনবাবু, লেখা কিনা মধু চৌধুরীকে পেন্নাম করছে! অ্যা! বলি মাথা খারাপ হল নাকি হে তোমাদের? চলি— 

লাফ দিয়ে লঞ্চে উঠল সে। বলে ওঠে—নসো! চালা বাবা! 

লঞ্চটা জল কেটে কেটে চলেছে। ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে লেখা-ভুবনবাবু। ওদের কাছ থেকে, ধনেখালির ছায়াবন গঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি মানুষ। হঠাৎ বুকের ভেতরটা কী-যন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠে। মধু দেখছে ওদের, ঝাপসা হয়ে আসে চোখের দৃষ্টি। 

—গুরু! একটোক চলবে না? 

পদা ওর হাতে একটা বোতলই দিয়েছে। তাজা গন্ধ উঠছে। মধু মুখে ঢালতে গিয়ে কী ভেবে থামল, বোতলটাকে জলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। 

হঠাৎ আবিষ্কার করে মধু। তার দু’চোখ জলে ভরে গেছে—ধ্যাত্তেরি! 

মধুর কোথায় যেন সব হারিয়ে গেছে। তবু মনে হয় অনেক পেয়েছে সে। এ পাওয়ার পরিমাণ সে জানে না, নিজেকে ফিরে পেয়েছে সে। 

(সমাপ্ত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *