অমানুষ – ৭

রাত নেমেছে। মহিম ঘোষাল একাই বসে আছে। গাঙের বুকে ঢেউগুলো ফাটছে বর্ষার জোয়ারে। ফসফরাসের ঝকমকে আভাস জলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে, কে যেন মুঠো মুঠো। তারাফুল ছিটিয়ে দিয়েছে। 

মহিম ঘোষাল কোণঠাসা হয়ে আসছে। মধু আজ তাকে অপমান করে গেছে, শাসিয়ে গেছে প্রকারান্তরে। আর ওই লেখাও তাকে অগ্রাহ্য করে। এতদিন তবু অপেক্ষা করেছিল মহিম ঘোষাল এইবার চরম আঘাতই হানবে সে। ওর সেই রূপটাকে লেখা চেনেনি! 

—পিতে! 

মহিম ঘোষালের পার্শ্বচর পীতাম্বর বাইরেই ছিল প্রভুর প্রসাদের অপেক্ষায়। দেখেছে পীতাম্বর মহিমবাবুর মেজাজটা ভালো নেই। মধুও কী সব বড়ো বড়ো কথা শুনিয়ে গেছে। পিতু সবই শোনে-জানে। ও অন্ধকারের জীব। ওর হাতে বেশ কিছু লোকও রয়েছে, যাদের পুষে রেখেছে মহিম ঘোষাল। 

মহিমবাবু পিতুকে কাছে ডেকে কী বলছে। পিতে শুনছে কথাগুলো। মহিমবাবু ওর হাতে এক গ্লাস মদ তুলে দিয়েছে। পিতে ওতে চুমুক দিয়ে যেন জোর খুঁজে পায়। 

—পারবি তো? মহিম ঘোষাল শুধোয়। 

পিতে মাথা নাড়ে—নিশ্চয়ই! ও আপনি ভাববেন না। লোকজন নিয়ে যাব। সব ঠিক হয়ে যাবে তখুনিই 

—নে মাংস খা! 

পীতাম্বর মাংস চুষছে, যেন একটা লুব্ধ কুকুরের সামনে মহিম ঘোষাল দু-এক টুকরো মাংস ছুঁড়ে দিচ্ছে, সে খাচ্ছে আর লেজ নাড়ছে। 

.

কথাটা ধীরভাবে ভেবেছে লেখাও। অবাক হয়েছে। এতদিন মধুসূদন সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনেছিল সে। দেখেছে ওর সেই রুদ্রমূর্তি। মদ গিলে সারা গঞ্জে বাঁদরামি করে ফেরে। মেয়েরা ওর কাছে শুধু ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছু নয়। 

কিন্তু সেই রাত্রে দেখেছে লেখা ওই হিংস্র বন্য রূপটার আড়ালে একটা বলিষ্ঠ সৎ মানুষকে। সে মেকি নয়, তার স্বভাবের ক্লেদটাকে ভণ্ডামি আর ভালোমানুষির মুখোশ ঢেকে সাধু সেজে সমাজে ফেরে না এই মহিম ঘোষালের মতো। তার দোষগুলোও স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলে, গুণগুলোও। 

সেদিন দেখেছিল মোল্লাখালির হাটতলায় আবাদের মানুষের জন্য সে কী করতে পারে। গরিবের ওপর অত্যাচার হলে সে কঠিন একটি হিংস্র জীবে পরিণত হতে পারে। সাধারণ মানুষ তাই তাকে ভালোবাসে সারা মন নিয়ে। এ ক-দিনে তার জনপ্রিয়তা আর প্রতিষ্ঠার খবরও জেনেছে লেখা। 

তাই বোধহয় বিচিত্র লাগে ওই মধুসূদনকে। ও জানে না ওর অন্তরে কী সম্পদ আছে। তাই নিষ্ফল রাগ আর অভিমানে নিজেকে জ্বালিয়ে দিয়ে চলেছে সে। লেখা মধুকে নতুন করে চিনেছে। এখানে ফিরেও দু-একবার দেখা হয়েছে হাটের পথে, না হয় ভেড়ির ধারে লঞ্চঘাটে। 

মধুসূদন চোখ তুলেও তাকায়নি তার দিকে। সরে গেছে। এড়িয়ে গেছে তাকে। কথা বলতে চেয়েছিল লেখা, সেই রাতের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতেও ইচ্ছে করে তার। কিন্তু ওর কঠিন স্বভাবের আচরণের জন্যই সে এগোতে পারেনি। সরে এসেছে। মনে হয়েছে মধুসূদন ইচ্ছে করেই তাকে এড়িয়ে গেছে। 

.

মধুসূদন এসব ভাবেনি। এসব ভাববার অবকাশ তার নেই। প্রথমে ক-দিন মদ গিলেছে, এদিক-ওদিক ঘুরেছে। হঠাৎ মনে হয় আগেকার যে উন্মাদনা আসত নেশা করে—না হয় রাতের অন্ধকারে কোনো নারী-মাংসের স্বাদে, সেই উন্মাদনা আর আসে না। কেমন বিশ্রী ঠেকে মধুসূদনের। 

গদাই জানা ওর অনেককালের শাগরেদ। হাটতলায় পানের দোকান দেয় আর বোতলে লুকিয়ে চোলাই বিক্রি করে। গদাই বলে তোমার কি হল বল দিকি গুরু? বেজার মেরে থাকতিছ?

মধু ওর কথার জবাব দিল না। ওর মনে হয় সেই জীবনযাত্রার স্বাদ আজ কী অজানা কারণেই তার কাছে পানসে ঠেকে। মনে হয়েছে তার দাপট, প্রতিষ্ঠার দাম কেউ দেয়নি। ওরা তাকে জানোয়ারই ভাবে। ওই মহিমবাবুরই একা এই ধারণা নয়, সকলেরই ধারণা তার সম্বন্ধে ওই রকমই। মানুষের খাতা থেকে ওরা তাকে অনেক আগেই বাতিল করে দিয়েছে। 

গসাই বলে—একটা দোব? বিকেলে ভালো মাল এনেছি গুরু! 

হাটতলার কলরব শুরু হয়েছে। নৌকোগুলো আসছে। পারঘাটের মাচার ওপর বসে আছে মধুসূদন। লোকজন, ব্যাপারিরা অনেকেই চেনা। বেশ কিছুদিন পর ওকে দেখে ওরা ফের আলাপ করে –কি মধুবাবু, শুনলাম এখন ঠিকাদারি করতিছেন? তা ভালো, এইবার দেখব মহিমবাবুর মতো মানুষ হয়ে দাঁড়াবেন। 

ফোঁস করে ওঠে মধু—মহিমবাবু খুব বড়ো মনিষ্যি, না রে শা? 

তরকারির ব্যাপারি কলিমুদ্দির কাছে মহিমবাবু মস্ত লোকই। তবু কী বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে ভেবেই আমতা আমতা করে সে—না, না। আপনার সঙ্গে কার কথা! কয় না—মরা হাতি সওয়া লাখ! হাজার হোক জমিদারের পোলা, চৌধুরীবাড়ির নাম এ আবাদে কে না জানে? কও গদাই ভাই? 

কলিমুদ্দি কথা বলেই ফ্যাসাদে পড়েছিল। মধুর-মেজাজ যেন গোখরো সাপের মতো হয়ে আছে। এমনিতে ফুঁসছে। সে চুপ করে সরে গেল। 

মধু গজগজ করে, –জমিদারের পোলা। শ্লা হনুমানের বাচ্চা! জানোয়ার! বুঝলি পদা—মানুষ আর নেই। সব শ্লা ইয়ে। ধ্যাত্তেরি! দেখি, দু-ঢোঁক দে। 

একটা বোতল বের করে গলায় ঢেলে সেই জ্বালাটাকে ভোলবার চেষ্টা করে সে। একটু ভালো লাগে। মনে হয় দুনিয়ার সবাই ফিকিরবাজ। যেন একপাল জানোয়ার তার সামনে কিলবিল করছে। 

হঠাৎ কিসের চিৎকার আর কলরবে চমকে ওঠে মধুসূদন। মাঝে মাঝে আগুন লাগে এদিকে ছনের ঘর পুড়ে যায় বোধহয় আগুনই লেগেছে। হাটের কে বলে—আগুন লয় গো। মহিম ঘোষালের লোক স্কুলবাড়ি দখল লিতে গেছে। 

—মানে। 

মধুসূদনের নেশা চমকে ওঠে। স্কুল বলতে ওইটুকুই। মধুও জানে ওই গুদাম আর চালাগুলো এককালে তাদেরই ছিল। হাটের ব্যাপারিদের থাকার ব্যবস্থা হত ওখানে। ক্রমশ ওটার বেশ কিছুটা স্কুলে পরিণত হয়েছে। মধুর জমাবন্দি থেকে ওখনও খাজনা ওয়াশিল করা হয় ওই জায়গাগুলোর জন্য। তবু স্কুল বসে বলে মধুও আপত্তি করে না তাতে। 

ছোটো ছেলেমেয়েদের চিৎকার কানে আসে। টিনের চালায় লাঠি মারার দমাদ্দম শব্দ উঠছে। খবরটা সত্যিই, কারা যেন ওই স্কুলবাড়ির দখল নিতে গেছে। দু’চারজন মেয়েছেলেও চিৎকার করছে—ছেলেগুলানকে পিটিয়ে দিলে গ’। 

মধুর সারা দেহ-মন কঠিন হয়ে উঠেছে। জায়গাটা তারই। এখনও রেকর্ড-পড়চায় তেমনিই রয়েছে। হঠাৎ তার ওখানে কারা হানা দেবে ভাবতে পারেনি। লেখার কথা মনে পড়ে। বোধহয় সেও বিপদে পড়েছে। মদের বোতলটার বাকিটুকু গলায় ঢেলে উঠে দাঁড়াল মধু। জড়িত কণ্ঠে হুংকার ছাড়ে—যতে! 

যতিলাল ফুকফুক করে বিড়ি টানছিল। গুরুর ডাকে ওর দিকে তাকাল। মধু বলে – নিতে, পঞ্চা, ভোম্বলকে খবর দে, স্কুলের মাঠে আসুক। তুই ওদের নিয়ে আসবি; আর শোন—শুধু হাতে যাবি না। আমি এগোচ্ছি— 

যতিলালও মাঝে মাঝে এইসব চায়। গুরু যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিল। এই খবরে চাঙ্গা হয়ে ওঠে যতিলাল। সেও ছুটল। 

—পদা! 

পদা একটু কুঁড়ে ধাতের লোক। পদা এই ফাঁকে ওদিকে একদল মেয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করছিল।

সহসা তাকে রাগানো যায় না। একটু সময় লাগে ব্যাপারটা বুঝে রেগে উঠতে। কিন্তু একবার তাতলে সে অনায়াসেই খুন করে ফেলতে পারে। সে এতক্ষণে পারঘাটে কোন বাওয়ালি বউয়ের সঙ্গে রসিকতা করছিল। গুরুর ডাকে ব্যাজার মেরে বলে—কেনে গ’! দু’দিন জিরোতে এলে—আয়েশ কর, খ্যামোকাই— 

—অ্যাই! এদিকে আয়। শুনছিস না ওই চ্যাঁচামেচি! বলি—মধু বেঁচে থাকতে তার জায়গা বে-দখল হয়ে যাবে? এতবড়ো বুকের পাটা কোন ব্যাটার! 

পদা ওর দিকে তাকাল, ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে জানায় পদা—তা কি করে হয় গুরু? তা’লে তো দেখতে হয়! চল আজ্ঞা! দেখেই আসি সম্বন্ধীকে! 

পদা ফস করে গদাইয়ের বেড়ার একটা মজবুত গরান খুঁটি টেনে বের করে এগোল দুজনে। মহিম ঘোষাল শেষ চালই চেলেছে। আর ওরই জন্য সেই রাতে ওই পীতাম্বরকে মদ আর মাংস খাইয়েছিল, কিছু টাকাও দিয়েছিল। 

কাজ হাসিল হয়ে গেলে মহিমেরই ভালো। লেখার মতো মেয়ের ডাঁট ভেঙে যাবে। আর তারও দখলে আসবে গঞ্জের মধ্যের ওই তিন-চার বিঘে উঁচু জমিটা। ওইখানে তার গুদাম হবে ধান-চাল রাখার। একঢিলে দুই পাখি মারবে। 

তবে সামনে সে আসেনি এ ব্যাপারে। মহিম পিছনেই থাকে ওসব ক্ষেত্রে। পীতাম্বর লোকজন নিয়ে তৈরি হয়ে আসে সকাল বেলাতেই। স্কুল শুরু হয়েছে। প্রার্থনার ছেলেমেয়েরা ক্লাসে গেছে। ঘণ্টা বাজছে। হঠাৎ ওরাও দল বেঁধে এসে হাজির হয়। 

লেখাকে পীতাম্বর বলে, আজ্ঞে স্কুল উঠে যাবে এখান থেকে। 

লেখা, আরও দু-একজন শিক্ষিকা বের হয়ে এসেছে। তারাও লাঠি হাতে লোকগুলোকে চড়াও হতে দেখে অবাক হয়। 

—কেন? 

পিতু বলে—মহিমবাবুর জায়গাটার দখল নিতে হবে। 

পিতে কিছু বলবার আগেই ওর দলবল হামলা শুরু করে টিনের চালে, বেড়ার গায়ে ওরা লাঠি মারছে। ক্লাসঘর থেকে চেয়ার-টেবিল যা ছিল টেনে বের করে এদিক-ওদিক ছুড়ে ফেলে দিয়ে হুংকার ছাড়ছে। ভয় পেয়ে ছেলেমেয়েরাও বের হয়ে এসেছে। ওরা চিৎকার করছে। 

তখন ওরা পলকা টিনের বেড়া খুলে ফেলেছে দু-একটা ঘরের। লেখা বাধা দিতে যায়। কে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। টিনের কোণে লেগে ওর কপাল কেটে গেছে, শাড়িটাও ছিঁড়েছে। 

ওরা শাসায়—খবরদার, এগোলেই বিপদ হবে। এ জায়গা আমাদের! দখল নিচ্ছি। কলরব অশ্বিনী ডাক্তারও বের হয়ে এসেছেন। কিন্তু ওই যুদ্ধক্ষেত্রে এগোবার সাধ্য এবং সাহস তাঁর নেই। 

অসহায় দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে লোকজন। ওরা নিষ্ঠুর তাণ্ডব চালিয়ে লেখার এতদিনের পরিশ্রমে গড়ে তোলা ওর যথাসর্বস্ব ওই স্কুলটাকে আজ প্রচণ্ড আঘাতে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। 

লেখার দুচোখ দিয়ে জল নামে। ব্যথায়, অপমানে আর হতাশায় মুষড়ে পড়েছে একটি অসহায় নারী। ওরা বিজয় উল্লাসে হুংকার ছাড়ছে আর টিনের চালগুলো খুলে ফেলছে— ঝনঝন শব্দ ওঠে। 

—অ্যাই! শ্লা শুয়োরের বাচ্চারা-এখানে কি হচ্ছে? অ্যাঁ! অ্যাই পিতে, এখানে কি করতে এসেছিস? 

মধু ওদের দেখে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল পীতুর সামনে। 

ভিড় ঠেলে মধু চৌধুরীকে আসরে অবতীর্ণ হতে দেখে ওরা একটু চমকে যায়। মধু চৌধুরীকে ওরা চেনে। কাপড়টা মালকোচা মারা—গায়ে একটা গেঞ্জি। মধুও থমকে দাঁড়িয়েছে। লেখার কপালে, কাপড়ে রক্তের দাগ। ও বোধহয় কাঁদছিল একপাশে দাঁড়িয়ে। সামনে ওর স্কুলেরই জিনিসপত্তর, চেয়ার, ব্ল্যাকবোর্ড ভাঙা—ছড়ানো রয়েছে। মধুর মনে হয় ওই হতভাগার দল বোধহয় লেখার গায়েও হাত দিয়েছে। 

পীতাম্বরও আজ দলবল নিয়ে এসেছে। তাই গর্জে ওঠে—অ্যাই! মস্তানি দেখাতে এসেছ না? সরে যাও বলছি মধু! 

পিতের রাগটা ছিল মধুর ওপর অনেকদিন থেকেই। ওদের এককালের পাইক ওই পীতাম্বর আজ মধুবাবুকে সামনে দেখে হুংকার করে, দলের ওদের নির্দেশ দেয়—বিশে খবরদার থামবি না! কেউ এগোলে মাথা নিয়ে নিবি! ছেড়ে কথা বলবি না। 

মধু ফোঁস করে ওঠে—অ্যা মাথা নিবি তুই মধু চৌধুরীর। তোর পেটে লাথি মারলে এখনো মধু চৌধুরীর ভাত বের হবে, দেখবি? 

সেই মুহূর্তেই মধু তড়িৎগতিতে পীতাম্বরের পেটেই লাথি কষেছে তার কথার সত্যতা যাচাই করবার জন্যই। ভাত অবশ্য বের হয় না—পিতে আর্তনাদ করে দু-তিন হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে কাতরাচ্ছে, মেরে ফেললে— 

বিশেও ছুটে আসে লাঠি তুলে। তার আগেই মধুর শাগরেদ পদা তার কোমরে জমিয়েছে সেই গরানখুঁটির মোক্ষম একটা আঘাত। বিশেও ছিটকে পড়ে ছটফট করছে। 

মধু ততক্ষণে ওর হাতের লাঠি তুলে নিয়ে সামনের ক-জনকে পেটাতে থাকে। তারাও ভাবেনি, এভাবে চোট হয়ে যাবে পিতে আর বিশে। ওরাও পালাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু যতিলাল ইতিমধ্যে দলবল নিয়ে এসে ওদের ঘিরে ফেলেছে। শুধু চিৎকার আর আর্তনাদ উঠছে। মধু দাঁড়িয়ে মজা দেখছে আর সাবধান করে –যতে, কোমরে আর পায়ে মারবি, যেন রক্ত না পড়ে। ব্যাটার মুখটা নর্দমায় রগড়ে দে। ও-শালাকে দড়ি বেঁধে মাথাটা নিচু করে ঝুলিয়ে রাখ। অ্যাই পদা, ওটাকে আর মারিস না, খুনের দায়ে পড়বি। ছেড়ে দে, উঠতে গেলেই মাজায় মারবি। 

স্কুলের মাঠময় শুধু গড়াগড়ি দিচ্ছে বীরপুঙ্গবরা। পিতে কাতরাচ্ছে তখনও। 

মহিম ঘোষাল ঘটনাস্থলে না গেলেও নজর রেখেছিল। খুশি হয়েছিল ওদের কাণ্ড দেখে। দখল-জারি হয়ে যাবে এইবার। তখন হাজির হবে সে আসরে। লেখাকেও জানিয়ে দেবে কথা সে রেখেছে। ওই গুদাম চালাঘরগুলো তারই এবং সে-ই দখল নিয়েছে। 

হঠাৎ চাকা ঘুরে যেতে দেখে মহিমবাবু ভাবনায় পড়ে। ওখানে মধু চৌধুরী গেছে শুনেই মহিমও থানায় গিয়ে হাজির হয়। ও জানে তারপর কী ঘটবে। দু-একটা খুনও হয়ে যাবে। মহিমবাবুই বলে, – দেখুন গে মধুর কীর্তি! 

ভুবনবাবুও চিৎকারটা শুনেছেন। কিন্তু সঠিক জানেন না। তাই ওর দিকে তাকালেন। মহিম ঘোষাল বলে—স্কুলের জমির দখলদার ওই পীতাম্বর, ওকেই ধরে পিটছে মধু, তার দলবল নিয়ে। বললাম না, মধু এসেছে, আবার সেই কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। 

ভুবনবাবু অবাক হন—তাই নাকি! চলুন। 

মহিমবাবু বলে—কনস্টেবলদেরও নিয়ে চলুন স্যার, উইথ আর্মস। ফৌজদারি হয়ে গেছে, বোধহয় লাশ দাখিলও হয়ে গেছে দু’একটা। 

.

মধুসূদন গর্জাচ্ছে ওই লোকগুলোর সামনে—কোন শ্লা তোদের পাঠিয়েছিল? ওই মহিম ঘোষাল? অ্যাঁ, মধু চৌধুরীর সামনে তোরা আমারই জায়গা দখল করে নিবি লাঠির জোরে, আর মধু বানচোত বসে বসে দেখবে? এক একটাকে খুন করে ফেলব। 

ভুবনবাবুও শুনেছেন কথাটা। তিনিও জানতেন জায়গাটা চৌধুরীবাবুদেরই। আজ এই কাণ্ড দেখে অবাক হন। মধুরা ক-জনে পনেরো-বিশ জনকে শুইয়ে দিয়েছে। পিতে তখনও কাতরাচ্ছে।

অশ্বিনীবাবুও আসেন ওদের দেখে। তিনি বলেন-এ অন্যায়-অত্যাচার ভুবনবাবু। ওরা মেয়েদেরও অপমান করেছে। জোর করে ঘর-দোর ভেঙে দিয়েছে দেখুন। 

অশ্বিনীবাবুও আজ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাই শান্ত লোকটিও আজ প্রতিবাদ জানায়—একি অন্যায় ভুবনবাবু? এতকাল ধরে এখানে স্কুল হয়ে আসছে, বলা-কওয়া নেই হঠাৎ ওই পীতাম্বর লোকজন নিয়ে এসে চড়াও হল! জায়গাটা মধুসূদনের, সে আজ না থাকলে এতক্ষণে দেখতেন সব ওরা ধু-ধু মাঠ করে দিয়েছে। 

মধু ওপাশে তখন দাঁড়িয়ে আছে। মাঠে এদিক-ওদিক শুয়ে-বসে আছে আহত লোকগুলো। কেউ ওঠবার চেষ্টা করলেই শাসাচ্ছে মধু –যতে, ওটা মাথা তুলছে কেন রে? 

যতিলালও গরানখোঁটা তুলে শাসায়—খবরদার! মাথা তুলবি না ছাতু করে দোব।

লোকটাও চুপ করে যায় আর্তনাদ থামিয়ে 

মধু তখন মূল আসামি ওই পীতাম্বরকে নিয়ে পড়েছে। –কে ওদের পাঠিয়েছে দখল নিতে তা জানি দারোগাবাবু, তবু ও-শ্লা নিজের মুখে বলুক, না বললে—ওকে জ্যান্ত আর ফিরে যেতে দোব না। আমাকে অ্যারেস্ট করতে হয় স্যার, খুনের দায়েই করবেন। অ্যাই পিতে, বল! না’লে দোব তোর পেটে পা! ভুঁড়ি গেলে দোব। 

মধুও পেটে পা দিতে যাবে—পিতে আর্তনাদ করছে—মরে যাব, বাঁচান দারোগাবাবু। ওরে বাবা- 

মহিমবাবু ভয় পেয়ে যান। সব কথাই প্রকাশ হয়ে পড়বে। তাই বলে—ওসব কথা পরে হবে মধু।

মধু হাসছে—মাইরি! ঘাবড়ে গেলে যে পেসিডেনমশাই! অ্যা! তা’লে এসব ঘর-বাড়ি, চেয়ার-বেঞ্চির কি হবে? খুব তো ভাঙল এরা— 

মহিমবাবু বলে—ওসব আবার নতুন করে হবে। ঘরও তুলে দোব আমরা। পাঁচজনের স্কুল, ও-কাজ পড়ে থাকবে না। আমি কথা দিচ্ছি। 

মধু যাচিয়ে নেয়—ঠিক তো! পরে বেগড়বাই করলে চলবে না কিন্তু! আর পিতে, তোরা শোন, এখানেই স্কুল চলছে—স্কুলই হবে। ফের যদি কোনদিন ঝামেলা বাড়িয়েছিস, একটাকেও রাখব না। বুঝলি? 

লোকগুলো কাতরাচ্ছে। 

মধুর কাজ শেষ হয়েছে। গলাটাও শুকিয়ে গেছে। রোদে ঘেমে উঠেছে। তাই চ্যালাদের বলে, —চল! 

ওর মেজাজটা বিগড়ে গেছে।—ধ্যাত্তেরি! মেজাজি নেশাটা ব্যাটারা নষ্ট করে দিলে! কই রে—আছে মাল-টাল? অ্যাই গদাই। 

গদাই গলা নামিয়ে কী বলে। মধুসূদন হাসতে থাকে—বুঝলেন দারোগাবাবু, গদা কিন্তু একেবারে ‘লয়্যাল সিটিজেন’, চোলাই তৈরি করে বটে, তবে পয়সা নিয়ে বিক্রি করে না। কাক-পাখিতেও টের পায় না। শ্লা পাকা নেশাড়ে কী না—পিপে গিললেও টের পাবেন না।

সামনে ছেলের দলকে ভিড় করতে দেখে মধু গর্জে ওঠে—অ্যাই ছেলেরা, যা, স্কুলে যা। এখানে কি দেখছিস? 

ওর দাবড়ানিতে তারা হকচকিয়ে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যায়। 

মধু বলে—ব্যাটাদের এবারকার মতো ছেড়ে দ্যান দারোগাবাবু, ওদের যা প্যাণ্ডাই দিয়েছি, সামলাক গে শালারা। খামোখা নেশাটা মাটি করেদিল। চলরে পদা, সরেস মাল একটু দিবি চল। চলরে—অ্যাই পদা, যতে—চল। 

মধুসূদন চলে গেল কারও অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই। 

মহিমবাবু সব চাল ব্যর্থ হয়ে গেল। মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছে সে। লেখাও দেখছে ওদের। সে জানে এসবের মূলে কে। আজ তাকে ভালোমানুষ সেজে সহানুভূতি দেখাতে আসতে দেখে রেগে উঠেছে লেখা। 

লোকগুলো মারধোর খেয়ে ভেবেছিল থানা-পুলিশের হাঙ্গামায় পড়বে। কিন্তু মধুই তাদের রেহাই দিয়ে গেছে। ওরা চোরের মতো সরে গেল একে একে। মহিমবাবু এদিক-ওদিক দেখে বলে—চেয়ার-বেঞ্চি যা ভেঙেছে সেগুলো মেরামতের ব্যবস্থা আমিই করে দিচ্ছি। 

লেখা জবাব দেয়—থাক। তার দরকার হবে না। 

মহিমবাবুর দিকে সে তাকাল নিদারুণ ঘৃণা-ভরা চাহনিতে। তার কাছে আজ ওই মানুষগুলোর স্বরূপ পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। ঘৃণার বিষিয়ে উঠছে তার মন। 

মনে হয় একজনের সম্বন্ধে সে এতদিন ভুল ধারণাই করে এসেছিল। অবশ্য তার ভাবনার ওপর মধুসূদনের জীবনযাত্রা এতটুকু নির্ভর করে না। লেখাও এটা বেশ টের পেয়েছে। স্বভাবত অন্যায়কে ঘৃণা করে—তাই মধু এসেছিল এখানে। 

.

বিকেল নামছে। স্কুলের ছত্রভঙ্গ অবস্থা খানিকটা গোছগাছ করেছে লেখা আরও কয়েকজনের সাহায্যে। মহিমবাবুকে কড়া কথাই শুনিয়ে দিয়েছে আজ সে। আরও কিছু বলত—প্রকাশ করে দিত তার সেই লোভের কথা। কিন্তু পারেনি লেখা। তার নিজের সম্মানেই বেধেছে। তার তুলনায় মনে হয় মধুসূদন অন্য ধাতের মানুষ। কারও কাছে তার কোনো প্রত্যাশা নেই। লোকের সামনে তার পরিচয় ওই একটাই, সে মদ্যপ, জানোয়ার। এই পরিচয়ের জন্য তার এতটুকু লজ্জা নেই। লেখার মনে হয় এটা তার প্রকৃত পরিচয় নয়। জীবনের আসল রূপটাকে সে যেন মুখোশের আড়ালে ঢেকে রেখেছে। নিজেকে প্রকাশ করতে সে চাইল না। কোনদিনই। 

কিন্তু কেন তা জানে না লেখা। মনে হয় একটা বেদনাই ওর মনের গভীরে রয়ে গেছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। মধুসূদন চকিতের জন্য যেন অন্য মানুষে পরিণত হয়েছিল। আজকের ওই দখলের ব্যাপারে সে এতটা গুরুত্ব দিত না। নেহাৎ কৌতূহলবশেই ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ তার মাথায় রক্ত উঠে যায় ওদের ওই অত্যাচারের বহর দেখে। লেখার সেই অসহায় মিনতি-ভরা চাহনি তাকে শুধু বিভ্রান্তই করেনি, কেমন যেন উন্মাদ করে তুলেছিল। তাই এগিয়ে গিয়েছিল সে কঠিন হয়ে। মহিম ঘোষালের আড়ালের হাতটাকে মুচড়ে দিতে চেয়েছিল হঠাৎ। 

নিজের কাছেই এটা বিচিত্র বলে বোধহয়। জানে মধুসূদন, তাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে ওই লেখাই। সেই কারণেই নিজের এই দুর্বলতাটুকুকে সে তার সামনে প্রকাশ করতে চায়নি। মনের নেশায় সেই ক্ষণিকের দুর্বলতাটুকুকে ভুলতে চায়। 

—গুরু, আর খেও না মাইরি! পদা বাধা দেয়। 

মধুসূদন মদ গিলে চলেছে। মদে ওর আর নেশা হয় না। 

আগেকার সেই শান্ত মনের অতলে একটা ঝড় উঠেছে। মধুও জানে না এর কারণ। তবু মনে হয় একটু দুর্বলতা, হয়তো বা ভালোমানুষ হবার লোভ তার মনে জেগেছে। 

হাসি পায়। মধু চৌধুরীও সুনাম কিনতে চায়! ওই ভণ্ড লোভীগুলোর কাছে তার প্রশংসার কোনো মূল্যই সে দেয় না। মদ গিলে সব ভাবনাগুলোকে চাপা দিতে চায় সে। মনে হয় সে কেমন একা। 

বিশ্রী ঠেকে সব কিছু। ওই ভাবনাগুলোকে সে ভুলতে চায়। জবাব দেয়, মধু—কী মাল দিয়েছিল শা! মাল না জল র‍্যা? ধ্যাত্তেরি! 

অন্ধকারে ওই তারা-জ্বালা আঁধারে বাড়ির দিকে পা বাড়াল মধু। পা টলছে। জোলো হাওয়া বইছে। দু-একটা পাখি তখনও ডাকছে। শূন্য মাঠের বুকে সেই ডাক নিঃসঙ্গতা আনে। মনে হয়, পাখিটা তার মতোই একা, অন্ধকারে সে সাথি খুঁজে ফিরছে। বাসার সন্ধান করছে। কিন্তু ব্যর্থ সে সন্ধান। ওর সব হারিয়ে গেছে। 

চলেছে মধুসূদন, সারা দুনিয়াটা যেন টলমল করে কাঁপছে। 

ঝিকিমিকি তারা জ্বলছে। বর্ষার ধারা নেমেছে। শরৎ আসছে। মাঠের দিগন্তজ প্রসারী বুকে ধানখেত শনশন হাওয়া হাঁকে। হাটের কলরব এখন আর নেই। 

বাঁধের ধারে কার ছায়ামূর্তি দেখে দাঁড়াল মধু। ছায়ামূর্তিটা ওর পিছু পিছুই আসছিল। হাটতলায় মধুকে দেখেছে মাতন বউ। আজ তার কিছু টাকার দরকার। ওদের সংসারে এ অভাব-চিরন্তন। ঘরে ওদের খাবার থাকে না। মরদ নেই—নিজের গতর খাটিয়ে ওদের বেঁচে থাকতে হয়। এখন চাষ-আবাদও হয়ে গেছে। মাঠে মাঠে ধান। কাজও তাই কম। 

—বাবু! অ বাবু! 

মধু দাঁড়াল। –কে? শ্লা তুই কি আবার হিতোপদেশ দিবি নাকি বাবা? 

অন্ধকারে একটা নরম উত্তপ্ত দেহ ওর দেহে এসে ছুঁয়েছে। মধু চমকে ওঠে—কে? তুই! অ্যা! মধু কেমন যেন চমকে উঠেছে। 

তারার আলোয় দেখা যায় মেয়েটাকে। মাতন। 

ওর আদুড়-কালো গায়ে তারার আলো পড়েছে। কী একটা বুনো নেশার মতো মাদকতা জাগে মধুর দেহে। থমকে দাঁড়াল সে। 

মাতন অবাক হয়েছে। আগেকার মতো সেই উন্মাদনা যেন ওর দেহে নেই। ওই মানুষটার উদ্ধত বেপরোয়া ভাব আজ থেমে এসেছে। মাতন হাঁফাচ্ছে। বলে—গোটাকতক টাকা দাও বাবু। খাতি পাইনি। 

মেয়েটা ওর কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। মাতনের চোখে আগেকার সেই নেশা। মধু কী ভেবে পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দেয়—নে। 

মেয়েটা টাকাটা নিয়েও গেল না। দাঁড়িয়ে আছে। 

মধু কী ভাবছে। অবাক হয়েছে মাতন। সেই দুর্বার বুনো মরদের রক্তে যেন মাতন নেই।

মধু বলে, —পথ ছাড়। হাঁ-করে দাঁড়িয়ে রইলি যে, এ্যা? 

চমকে ওঠে মাতন, –বাবু। মেয়েটার চোখে কী নেশা। 

হাসছে মধু, জড়িত কণ্ঠে হাসির শব্দটা কেমন যেন বিশ্রী ঘ্যাঙানির মতো শোনায়। বিড় বিড় করে বলে—বললাম তো পথ ছাড়। দেয়ালি করবি তো এক লাথি মেরে ভেড়ি থেকে গাঙের জলে ফেলে দোব। বুঝলি, তুই লষ্টা মেয়েছেলে। বাবুরা বলে, তুই লষ্টা। হাঃ হাঃ হাঃ 

হাসছে লোকটা। ওই কথাগুলোকে আজ যেন নির্মমভাবে ব্যঙ্গ করছে মধুসুদন—খেতে দেবে না তোদের। তোর মরদটাকে বাদাবনের বাঘের পেটে না হয় গাঙে ফৌত হয়ে যেতে হবে। তোকেও শুনতে হবে—তুই লষ্টা মেয়েছেলে। তোরা সব্বাই। যেমন আম্মো জানোয়ার হয়ে গেছি ওদের চোখে। বুঝলি, শালারা ভাবে আমি জানোয়ার। জানোয়ারেরও অধম। আর তোরা? তোরা সবাই লষ্টা। এ ছাড়া আর কিসসু নই আমরা 

মাতন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কথাগুলো সত্যি। নিজের বুকভরা এই জ্বালার খবর মাতন জানত না। নিজের কথা ভাবে না সে। আজ ওই মধুবাবুর ব্যাপারে অবাক হয়েছে সে। টলতে টলতে চলে গেল ছায়ামূর্তিটা। মাতন তখন দাঁড়িয়ে দেখছে লোকটাকে। 

.

শরতের দিনগুলোয় আসে আতঙ্ক। তখন জোয়ারের সময় বাদাবনের রূপ বদলে যায়। দিক-ছোঁয়া সবুজ ধানের খেতে সবুজের শিহর জাগে। সারা বছরের অন্ন। কিন্তু নিষ্ঠুর প্রকৃতির মাতন জাগে এই সময়েই। 

ওরা ভয়ে-ত্রাসে দিন কাটায়। কোটালের জোয়ার আসে, কোথাও ভেড়ি বাঁধ ভাঙবেই। তারপর শুরু হয় তাণ্ডব। উন্মত্ত নোনা জল সেই বাঁধগুলোকে ফাটিয়ে দিয়ে কলোচ্ছ্বাসে ঢোকে মানুষের গড়া আবাদে। সবুজ ধানগাছগুলো ওই বিষাক্ত নোনা জলের ছোঁয়ায় হেজে যায়, জ্বলে যায়। মাটির সব উর্বরতা শেষ করে আবার বন-রাজ্যে পরিণত করতে চায় সেই বন্যা। গ্রাম-বসত ডুবিয়ে দিয়ে ছুটে যায় উন্মত্ত-জলস্রোত। অন্যদিকে ভেড়ি বাঁধতে বাঁধ ফাটিয়ে আবার কোন খাল ছাপিয়ে ওপাশের ভেড়িতে হানা মুখ করে সেখানের ঘর-বসত ধ্বংস করে। খাবার জলটুকু পর্যন্ত নষ্ট করে দেয় মিঠে-জলের পুকুর ভাসিয়ে দিয়ে। বিস্তীর্ণ এলাকায় পড়ে থাকে শুধু গোরু-বাছুর-ছাগল মানুষের পচা-মরা দেহগুলো। শিয়াল-শকুন নামে। 

আর চারিদিকে শুরু হয় মহামারি কলেরা। অসহায় নিরাশ্রয় সর্বহারা মানুষগুলো এমনি করেই মরে। ওদের কাছে মৃত্যুটাই সত্য। ওদের বাঁচাবার চেষ্টা অবশ্য হয়, কিন্তু সে চেষ্টা সামান্যই ফলবতী হয়। বিধাতার মারের হাত থেকে ওদের বাঁচাতে পারে না মানুষ। 

সুন্দরবন অঞ্চলের দুর্গম আবাদের এই সর্বনাশ ধ্বংসের খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ভুবনবাবুও থানা থেকে রেডিওগ্রামে খবর পাঠান মহকুমায়, সদরে, দু-একদিন ধরে যাতায়াতের পথও বন্ধ। কোটালের বান নয়, যেন সমুদ্রই মেতে উঠে কী হিংস্র পাশবিকতায় উন্মাদ হয়ে আবাদে হানা দিয়েছে। দুর্বার হয়ে ওঠে গাঙ 

নদীর নোনাজল তার তীব্র বুভুক্ষা নিয়ে বসতি, জনপদ, দিগন্ত-প্রসারী মাঠকে শেষ করে দিতে চায়। ধনেখালির আবাদে মানুষগুলো কী আতঙ্কে জেগে থাকে। 

দিন-রাত ভেড়ির ওপর নজর তাদের। মেয়েছেলে, মরদরাও বের হয়েছে ঝুড়ি কোদাল নিয়ে। মধুরও ঘুম নেই। কাদামাখা চেহারা—রাত্রি জাগরণের ফলে চোখ-দুটো লাল, চুলগুলো উশকো-খুশকো। দলবল নিয়ে সে ভেড়ি তদারক করে চলেছে। বাঁধটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে, নইলে জলের তোড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ধনেখালির এই বসত। মধু হাঁকডাক করে, – মাটি দে! অ্যাই নিতে মজা দেখতে এসেছিল শ্লা। ওরে পেসিডেনের গুদোম থেকে দু’ বস্তা চাল এনে চাপা, খিচুড়ি গিলবি আর পড়ে থাকবি ভেড়িতে। 

মহিমবাবুরও আজ প্রাণ-সংশয়। বাঁধ ভেঙে গেলে তারও সব যাবে। ধানকল যাবে আগে। তাই সে-ও বলে—তাই কর বাবা! 

ভুবনবাবু, অশ্বিনী ডাক্তার, ব্লক-অফিসাররাও আসেন। আজ ওঁরা যুঝছেন প্রাণপণে, আর এই যুদ্ধের সেনাপতি ছন্নছাড়া মানুষ—মধুসুদন। 

গলায় মদের বোতলটা ঢেলে, মুখ–মুছে মধু বলে—শ্লা গাঙ যে ফুঁপে উঠেছে মাইরি। ওরে এই যতে, জনাদশেক লোক নিয়ে গরান-সুঁতির ধারের ভেড়িতে যা। ওখানেই মাটি দিবি, আমি যাচ্ছি। 

মধু যেন চরকির মতো ঘুরছে। ধনেখালির গঞ্জে আজ সে অতন্দ্র-প্রহরী। 

হঠাৎ আর্তকলরব ওঠে। বৃষ্টি নেমেছে, সেই সঙ্গে মুখোট বাতাসে জোয়ারের জলে ফুলে ওঠা নদী এসে হানা দিয়েছে ভেড়িতে-ওপাশে কোথায় ভেড়িতে হানামুখ দিয়ে জোয়ারের লোনা জল ঢুকতে শুরু করেছে। এখুনিই ওই হানামুখ বেড়ে যাবে, বাঁধের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে মাতাল নদী এসে আছড়ে পড়বে এই বসতের ওপর। 

চিৎকার উঠছে। মধুও লোকজন নিয়ে দৌড়াল খাওয়া ফেলে। চিৎকার করে বলে—পদা, কলবাড়ির করোগেটের বেড়া খুলে ফেলে আট-দশখানা করোগেটের টিন নিয়ে আয়। শিগগির— 

ওরা দুমদাম করে টিনের বেড়া ভাঙছে। মাটি দিয়ে জলের তোড় আটকানো যাবে না। তাই টিন ফেলে রুখতে হবে, মাটি পড়বে তার ওপর। 

মহিম ঘোষালের কলবাড়ির বেড়া ভাঙছে তারা। সে-ও বাধা দিতে যায়—কি হচ্ছে ওসব?

মধু গর্জন করে ওঠে—মুখ-বুজে থাকে পেসিডেন, টিন আমার চাই। আবাদ, তোমার কলবাড়ি, বাংলো সব মুছে যাবে না হলে, খবরদার, কথা কইবে না! 

মহিম থেমে গেল, ও জানে এ সময় বাধা দিলে মধু চৌধুরী তাকে খুনই করে ফেলবে।

টিন দিয়ে আটকে ওই হানা মুখে ওরা মাটি ফেলছে। মধু কয়েকশো লোককে এনে হাজির করেছে। ঝপঝপ মাটি পড়ছে। 

—হুঁশিয়ার! 

যেন ক্লান্ত একদল সৈনিক প্রাণপণে সংগ্রাম করে চলেছে ওই দিগন্তজোড়া কোনো শত্রুর সঙ্গে।

.

লেখাও সেই সংগ্রামী মানুষটাকে দেখেছে, ওই ভিড়ের মধ্যেও সে স্বতন্ত্র একক একটি সত্তা। দুর্বার কঠিন একটি মানুষ। 

সেই দিনগুলো পার হয়ে গেছে, তবু আবাদের চারিদিকে থেকে হাহাকার আর সর্বনাশের খবর আসে। তিন নম্বর লাটের ভেড়ি তছনছ হয়ে গেছে। সেখানেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সব থেকে বেশি। 

তারপর শুরু হয় আবাদের অনেক লাটে মহামারি। খাবার নেই, জল পর্যন্ত নেই, ওষুধ নেই। 

.

ক-দিন ধরে চারিদিক থেকে আসছে বন্যা, ধ্বংস আর সর্বনাশের সংবাদ। হাটতলার জনতার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সেই কথাগুলো। হাটুরে পসারিদের ভিড় কমেছে। ওদের মুখে-চোখে ভয়-জড়ানো। 

আকাশে দেখা দিয়েছে কালো মেঘের দল। ওরা যেন ফিরে এসেছে আবার নতুন ফসল রোয়ার কাছে সাহায্য করতে নয়, সর্বনাশ করতে। মেঘ দেখলেই গাংও খেপে ওঠে। একটার পর একটা লাটের ভেড়ি ভাঙছে। ভেসে যাচ্ছে মানুষগুলো। তাদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে এই হাটতলায়, স্কুলের লম্বা চালায়, সরকারি ধানের শূন্য গুদামের শেডে। অনেকেই পালিয়ে গেছে শহরের দিকে। দেখবে সেখানে বাঁচা যায় কী না-ভিক্ষে করেও। অনেক এখনও উদ্ধারের পথ পায়নি, সেই ভেড়ির অবশিষ্ট অংশে কোনো উঁচু জায়গায়, বা কোনো ঘরের চালে বসে আছে। জল নামলেই বা কী করে সেখানে বাঁচবে, জানে না। 

ধনেখালি গঞ্জে এসে জমিয়েছে ওরা। আরও হাজার হাজার মানুষ নীচের আবাদে পড়ে আছে। জল চাই, খাবার চাই, ওষুধ চাই। ওদের বাঁচাতে হবে। 

সাহায্য অবশ্য আসছে। কিন্তু দুর্গম এইসব অঞ্চলে যাওয়া মুশকিল। এখন বদ্ধ জলায় কুমির-কামটের রাজত্ব, বাদাবনের বাঘের স্বচ্ছন্ন-বিহার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে সেইসব জনবসত। সরকারি লোকজন স্থানীয় লোকদের সাহায্য চাইছে। তাদের সাহায্যে ওরা এগিয়ে যাবে। তারাও কাজে না নামলে ওই ধ্বংস পর্ব থামানো যাবে না। 

ছোটো সেই গঞ্জে লোকগুলো যেন উপচে পড়েছে। মহামারি বুঝি শুরু হয়ে গেল। ইনজেকশন দিতে হবে— যেখানে কলেরার খবর আসছে এখনিই সেইসব আবাদে না গেলে আরও ছড়িয়ে পড়বে সেই রোগ চারিদিকে। জোয়ারের নদী, সেই জল শুধু নিচের দিকেই নামে না। ওপরের দিকেও ঠেলে আসে। সুতরাং বাঁচার পথ কারও থাকবে না। 

ভুবনবাবুরও দায়িত্ব আছে। এগিয়ে এসেছেন থানা হেলথ-অফিসার, মহকুমা থেকেও গেছেন কর্তারা। খোদ সদর অবধি হই-চই শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কাজের লোক মেলা ভার। এ-সব অঞ্চল তাদের জানা দরকার। এখানকার মানুষদের ধমকে, দাবড়ে, দরকার হলে শাসন করেও ইনজেকশন দেওয়াতে হবে। রোগের সম্বন্ধে সাবধান হতে বাধ্য করাবে তেমন লোকের দরকার।

অশ্বিনীবাবুরও অবসর নেই। এখানের গঞ্জের রোগীদের নিয়েই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন তিনি। 

শহর থেকে—মায় কলকাতা থেকে স্বেচ্ছাসেবক, মেডিক্যাল স্টুডেন্টরাও এসেছেন। ওষুধপত্তর কাপড়-চোপড়, খাবার-দাবারও আসছে। কিন্তু বাইরের ওই কর্মীরা এখানে পথ-ঘাটের হদিস চেনেন না, ওই মারমুখী গাঙ দেখে তাঁরাও ঘাবড়ে গেছেন। 

ডাক্তারখানার বারান্দায় ওঁরা সকলেই সমবেত হয়েছেন। আবাদ অঞ্চল থেকে লোকজন যে-সব খবর নিয়ে আসছে তা ভয়াবহ। ইতিমধ্যে মহামারি শুরু হয়ে গেছে। 

ভুবনবাবু বলেন—আপনাদের আরও নীচের আবাদে যেতে হবে। 

হাসেন ভুবনবাবু—ওই তো বাহন। না হয় লঞ্চে মালপত্তর আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।

ওঁদের অনেকেই বলেন—সুন্দরবনের ধার। পথ-ঘাটও চিনি না। লোকজন তেমন কেউ থাকলে সুবিধে হত। 

কথাটা সত্যি। ভাবনায় পড়েন ওঁরা। 

লেখাও কথাগুলো শুনেছে। নিজের চোখেও দেখেছে এখানের সর্বনাশের দৃশ্যগুলো। নিচের আবাদের মানুষগুলোকেও চেনে সে। তাদের দুঃখের সময় সে-ও কিছু করতে পারলে খুশি হবে। মনে মনে কঠিন হয়ে উঠেছে সে। লেখা বলে, –আমিও যাব বাদা অঞ্চলের আবাদে। 

ভুবনবাবু ওর দিকে তাকালেন। অশ্বিনীবাবু চমকে ওঠেন—তুই যাবি! 

—কেন? এর আগে তো গিয়েছি ওদিকে! 

অশ্বিনীবাবু বলেন—আজকের যাওয়া অনেক কষ্টের। জায়গা নেই, খাবার নেই, খাবার জল পর্যন্ত মাপা। তাছাড়া পরিশ্রম করতে হবে, ঘোরাঘুরিও করতে হবে। তুই কী করে পারবি ওসব লেখা তবু জেদ ধরে—এ সময় ওদের সেবা করবে পারব; মেয়েদেরও দেখতে পারব। মহিমবাবু বলে—তবু সঙ্গে কোনো লোকজন থাকা দরকার, যে বাদাবনের পথ-ঘাট, আবাদ, সেখানকার মানুষদের চেনে-জানে, দরকার হলে শাসন করতে পারবে তাদের। 

মহিমবাবু চেয়েছিলে ওঁরা তাকেই যেচে পাঠাবেন, না হয় যাবার জন্য অনুরোধ করবেন। ভুবনবাবুও কথাটা ভাবেন। ওদের মধ্যে কাজ করবার মতো সবদিক থেকে চৌকশ একজনের কথাই মনে পড়ে। গাঙ—ওই আবাদ তার খুব চেনা, মানুষগুলোও তাকে মানে। আর তার সেই ক্ষমতাও আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা—তাকে বিশ্বাস করা যায়। 

ভুবনবাবু বলেন,—একজন পারে এসব কাজ ঠিকমতো করতে। 

ওঁরা তাকালেন তাঁর দিকে মহিমবাবু নিজের দাম বাড়াবার জন্য তৈরি হচ্ছে। ভুবনবাবু বলেন—ওই মধুসূদন! 

চমকে ওঠেন অশ্বিনীবাবু, মহিম ঘোষাল, ব্লক অফিসার পর্যন্ত। 

—অ্যাঁ মধু! মোদো মধু যাবে রিলিফে? ওই বাদাবনে? ওকে বিশ্বাস করা যায়? 

ওঁরা সকলেই ভুবনবাবুকে যেন হেসে উড়িয়ে দেবেন। ভুবনবাবু তা জানেন। সেইজন্যই বলেন তিনি,

—হ্যাঁ, ওরই কথা বলছি। 

লেখা ভুবনবাবুর দিকে তাকাল। ওর মনেও ঠিক ওই নামটাই এসেছিল। মধুকে দেখেছে সে, তার কাজ করার ক্ষমতা আর সাহসের কথা সে জানে। বাদাবনের মানুষগুলোকেও ভালোবাসে সে। 

তাকে দিয়েই কাজ হবে। 

মহিমবাবু ভুবনবাবুর কথায় একটু হতাশ হয়। 

লেখার মুখে-চোখে ওই মধুর নামটাতেই যেন নীরব স্বীকৃতির ছাপ ফুটে ওঠে। লেখা আজ বিশ্বাস করতে পারে মধুকে। দেখেছে তার মধ্যে ঋজু-কঠিন একটি ব্যক্তিত্বকে। অন্যায় সে সমর্থন করে না। 

মহিমবাবু বলে –তা যখন বলছেন, দেখুন মধুকে! 

লেখাও সায় দেয় –ও রাজি হয় কিনা দেখুন! 

ভুবনবাবু তখুনিই কাকে একটা চিঠি লিখে পাঠালেন—বলবি আমরা রয়েছি এখানে। মধুবাবু যদি এখনি আসেন ভালো হয়। 

স্বেচ্ছাসেবকদের অধিকর্তা চঞ্চলবাবুও এতক্ষণ ধরে মধুর কথাই শুনছিলেন। মনে একটা কৌতূহলও জাগে। ওঁরা সকলেই তাই মধুসূদনের ওপরই ভরসা করে। চঞ্চলবাবু অপেক্ষা করছেন—সেই মহামান্য লোকটি বোধহয় এখুনি আসবে। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *