অমানুষ – ৬

বাতাসে মাংসের খোসবু উঠছে। তার সঙ্গে মিলেছে মধু আর মৌচাকের দলার তীব্র গন্ধ। মদের গন্ধে সেটা আরও মাদকতাময় নেশা লাগানো হয়ে উঠেছে। মধু আর সারেঙ দুজনেই ছাদে উঠে গেছে। ওদিকে পেছনের সেই কাঠের খুপরির ভেতর রান্না করছে সুখানি ছেলেটা, লেখা এককোণে গুম হয়ে রয়েছে। 

লঞ্চটা চলছে। ধারে-পাশে কোথাও লোকালয়ের চিহ্ন নেই। অন্ধকার বন। 

লেখা চুপ করে বসে আছে। জোলো হাওয়া আসছে হু-হু করে। তার সারা মনে নীরবে রাগের কাঠিন্য। আর কয়েক ঘণ্টা সে এমনিভাবে বসেই কাটিয়ে দেবে। ওখানে পৌঁছে মহিমবাবুকে সবকথা বলবে সে। দরকার হলে ভুবনবাবুকেও জানাবে। 

বর্ষার সময় কাজ বন্ধ রেখে মধু ফিরছে নিজের সেই পরিত্যক্ত ঘরখানায়। কিছুদিন আবার জ্বালাবে সেই শান্তির জায়গাটাকে। এবার আর চুপ করে থাকবে না তারা। মধুকে সাজা দেবে। লেখাও সেই চেষ্টাই করবে। 

কতদূর এসেছে তারা জানে না, হঠাৎ মনে হয় লঞ্চের ইঞ্জিনের সেই একটানা গর্জনটা কেমন বাধা পাচ্ছে। থেকে থেকে ওর মন্থর গতি যেন রুদ্ধ হয়ে আসছে। ঢং-ঢং করে ঘণ্টি বাজছে।

সুখানিও রান্নাঘর থেকে বের হয়ে খোলের মধ্যে ইঞ্জিনের কাছে গিয়ে তেলকালি-মাখা পাটের ফেঁসো হাতে এটা-সেটা নাড়াচাড়া করছে। মাংকিরেঞ্চ দিয়ে ঠুকছে এদিকে-ওদিকে! ইঞ্জিনটা কেমন আর্তনাদ করছে। লঞ্চের গতিবেগ অনেক কমে গেছে। ওটা যেন চলতে পারছে না। কোঁকাচ্ছে। 

—কী হল রে? তেল-মবিল ঠিক আছে তো? 

ওপরের ফোকর দিয়ে সারেঙ উঁকি মারে। ওর গোল মুখখানায় হ্যারিকেনের আলো পড়েছে। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে চোখ দুটো জ্বলছে। কী ভেবে নেমে এসে ইঞ্জিনটাকে চালু করবার চেষ্টা করে সে। সগর্জনে কয়েকটা বন্দুকের গুলির মতো শব্দ ওঠে। ফট-ফটাস-দুম! 

কেঁপে ওঠে ইঞ্জিনটা, আবার থেমে যায়। দূর থেকে লেখা দেখে ইঞ্জিনের ভেতর থেকে কয়েকটা স্পার্ক ফস করে জ্বলে ওঠে। মধুও নেমে এসেছে, সে গর্জে ওঠে,—যাঃ শালা! কি হল র‍্যা? অ নসু! মেয়েছেলের মতো ফোঁস ফোঁস করে যে! 

সারেঙ আর সুখানি এদিক-ওদিক কী সব নাড়াচাড়া করছে। মধু হাসছে ওদের ব্যাপার দেখে হঠাৎ বলে মধু—অরে অ নসু! বাবা, ইঞ্জিনকে দু’টোক গিলিয়ে দিবি নাকি? দ্যাখ, এখুনি সচল হয়ে উঠবে। জোলো হাওয়ায় জমে গেছে বোধহয় বাপধন! 

ওর হাসি দেখে লেখার রাগ হয়। কিন্তু তার চেয়ে ভয়টাই ঠাণ্ডা অনুভূতির মতো ওর শিরায় শিরায় কী স্তব্ধতা আনে। লঞ্চ যদি সচল না হয় তার নিজের অবস্থাটা কী হবে বুঝছে সে। এই গাঙ আর ওই বনের ধারে তিন-তিনটে মাতাল হিংস্র জানোয়ারের মধ্যে এই লঞ্চেই পড়ে থাকতে হবে। 

সারেং নসু ঘেমে উঠেছে। মধুই এক মগ মদ ওর দিকে এগিয়ে দেয়—নে বাবা! খেয়ে-দেয়ে দ্যাখ যদি চলে, না চলে সে ও ভি আচ্ছা! ছিট নোঙর ফেলে ভোম মেরে বসে থাক। কাল দিন বেলাবেলি দেখবি বুড়োর কী হলো! শালা মহিম ব্যাটা কেপ্পনের জাসু। বুনো রদ্দি মাল দিয়ে কাজ চালাবে। লঞ্চ কোনদিন ভরাডুবি হবে দেখিস মাঝগাঙে! 

—লঞ্চ চলবে না? লেখা শুধোয়। 

লেখার সেই ভয়টা যেন রাগে পরিণত হচ্ছে। মনে হয় লোকগুলো ইচ্ছে করেই এইসব বাগড়ার সৃষ্টি করেছে, আর যত নষ্টের মূল ওই মধুসুদনই। লেখার ওই প্রশ্নেরও কেউ জবাব দেয় না। ওরা তিনজনে ইঞ্জিনটা ঠোকাঠুকি করছে। তারগুলো নাড়াচাড়া করে দেখছে। 

লেখা কী কুক্ষণে যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল জানে না। সে এগিয়ে আসে। জবাব না পেয়ে বেশ কঠিন স্বরে শুধোয় সে,—লঞ্চ চলছে না কেন? 

সারেঙ নসু গোল মতো দাড়ি-গোঁফ ঢাকা মুখটা তুলে হাসল। ওই হাসিতে যেন আরণ্যক হিংস্রতা-মেশানো। পুরু ঠোঁট দুটো ঝুলে পড়েছে, ফুলছে ওর নাকের পাটা। রেঞ্চ দিয়ে কী ঠুকে চলেছে আবার, লেখার কথার জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করে না সে-আদৌ। 

লেখা চড়া স্বরে বলে,—মদ খেয়ে এইসব করবে? লঞ্চ চালাতেই হবে। আজ রাতেই পৌঁছে দিতে হবে আমায় ধনেখালিতে। 

নসু জবাব দিল—স্পার্ক না হয় ডিস্ট্রিবিউটারে কোথাও গোলমাল হচ্ছে, কাল সকালে দেখতে হবে। এখন বোঝা যাবে না। 

—আজ রাতে চলবে না? লেখার কণ্ঠস্বর সপ্তমে ওঠে। 

সুখানি ওর চোয়াড়ে মুখটা তুলে তাকাল মাত্র। সারেং জবাব দেয়—না। বললাম তো! জোর করে চালাতে গেলে ডাইনামো জ্বলে যাবে। 

লেখা শাসনের স্বরে বলে—যেভাবে হোক আমাকে পৌঁছাতেই হবে আজ রাতে। 

মধু বলে ওঠে—হেঁটে যাও। না হয় সাঁতরেও যেতে পার। এতই যদি ভয়, তাহলে এই পথে রাত-বিরেতে বেরোলে কেন? তখন খেয়াল ছিল না বাদাবনে এসেছ, বিপদ এখানে পদে পদে। এসেছিলে কেন? 

লেখা ওর দিকে কঠিন চাহনিতে তাকাল। ওর মুখ থেকে মদের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ বের হচ্ছে। বলিষ্ঠ বিশাল দেহটা রোদে-জলে এই ক-মাসে যেন আরও কঠিন, আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। ওর চোখে ফুটে উঠেছে একটা জ্বালাকর তীব্র চাহনি। লেখা জবাব দেয়—তাই বলে কাজ থাকবে না? বেরোব না? 

মধু বলে—পথে সবাই যেন ওর মতো দেবতারাই থাকে! বাদাবনের বিপদ জানো না? বোঝো এখন ঠ্যালা! 

লঞ্চের ইঞ্জিনটা থেমে গেছে। ডাবের খোলের মতো ভাসছে সেই লঞ্চটা। কোনো গতি নেই। বোধহয় স্রোতের টানে ওই পারের জঙ্গলের দিকেই চলেছে। ওখানে নেমেছে রাতের থমথমে অন্ধকার, পুঞ্জ পুঞ্জ জোনাকি জ্বলছে। হিংস্র কোনো বাঘ হাঁক দিয়ে ফিরছে বৃষ্টি-ভেজা রাতে। ক্লান্ত সারেঙ চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে এবার এক মগ মদ ঢেলে তারিয়ে তারিয়ে গিলছে, আর তাকিয়ে রয়েছে লেখার দিকে। 

মধুসুদন চুপ করে আশপাশ তাকিয়ে দেখে শুধোয়,—কোথায় এসেছি রে? কোন জায়গা এটা? 

নসু বলল—বাঘনার কাছাকাছি মনে লয়। হোই বাঘনা নদীর মুখ দেখা যায়। শালা এইখানে রাতভোর পড়ে থাকতে হবে মধু ভাই! জায়গাটা ভালো লয়। লঞ্চও গেল তাল মাইরা। অরে অ ইয়াকুব! লোঙর ফেল দিকি! বাঁধ বাপধনরে। 

লেখা ওদের সঙ্গে আর কথা বলে না। বেশ বুঝেছে লঞ্চ যাবে না—কিংবা ওদের লঞ্চ নিয়ে যাবার বাসনা আদৌ নেই। সরে এসে ওই বস্তাগুলোর মধ্যে তার জায়গাতেই বসল সে। তীরে ভেড়ালে তবু কোথাও সে নেমে দাঁড়াতে পারত। লেখা তাই বলে—ধারে ভেড়াতে পার না? 

হাসছে এইবার সারেঙ। ওর কুঁতকুঁতে দু’চোখে সেই হাসিটা বিশ্রী হয়ে ফুটে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে—বড়ো শিয়ালের প্যাটে যাবার তাল? শোনতি পান না সমুন্ধিদের হাঁকাড়? 

স্তব্ধ রাতের অন্ধকারে বনের দিক থেকে ওই ডাকটা ভেসে আসছে। গুরু গুরু ডাক–শূন্য দিগন্তে, নদীর বিস্তারে সেই হিংস্র ডাকটা ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তোলে। 

হাসছে নসু সারেঙ। সান্ত্বনার সুরে বলে,—তবে, ইখানে গাঙ পার হয়ে সমুন্ধিরা লঞ্চে আসবে না। শালা, আমরাই তো বাদাবনে থাইকা বাঘ হয়ে গেছি। কি গো মধু ভাই? 

মধু একবার তাকাল লেখার দিকে। লেখা মুখ ফিরিয়ে নিল। 

লেখার মনের সেই রাগটা এখন পরিণত হয়েছে শুধু বুকজোড়া আতঙ্কে। মনে হয় লোক তিনটে ইচ্ছে করেই তাকে এইখানে আটকে রেখেছে। পালাবার কোনো পথ নেই। ওরা আজ এই আদিম-আরণ্যক পরিবেশে তার সর্বনাশ করবে। মধুকে সে চেনে। জানে তার সেই পাশব প্রকৃতির কথা। ধনেখালির অনেক মেয়ের জীবনে সে এনেছে চরম অপমান আর বিপর্যয়। লেখা তাকে এড়িয়ে চলেছিল এতদিন—ঘৃণা করেছে নিদারুণভাবে। আজ ওকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছে মধু। এসব তারই চক্রান্ত। 

সারেঙও লেখার দিকে তাকাচ্ছে। ওর লাল চোখ-দুটোয় কী সনাতন বুভুক্ষা। সুখানি—সেই লিকলিকে মানুষটার চোয়াড়ে গালের ওপরে দুটো-চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসছে। লেখার ভয় হয়, রাগ হয় ওদের দেখে। 

এমনি অনেক সর্বনাশ আর কান্নার খবর সে জানে। দেখেছিল ধনেখালির দাশেদের বিধবা বউটাকে। ওই মধুই নাকি তার সর্বনাশ করেছিল। মা হতে বাধ্য করেছিল, কিন্তু গাঙের তুফানে লাফ দিয়ে পড়ে চরম কলঙ্কের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল মেয়েটা। কী নির্লজ্জ ওই চাহনি! একপাল নেকড়ের মধ্যে এসে পড়েছে সে। ওরা তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেবে রাত-নির্জনে। বাঁচাবার কেউ নেই। ওই দানবদের হিংস্র উদ্দাম পাশব চেহারাগুলো আতঙ্কিত করে তাকে ছায়ামূর্তির মতো ওরা ঘুরছে। 

.

—কিছু খাবেন না? 

চমকে উঠল লেখা। দেখে একটা এনামেলের থালায় খানিকটা মাংস আর দু’খানা রুটি এনে দিয়েছে সুখানি। ওদের গায়ে নোনা গাঙের জলের সঙ্গে ঘামমেশা গন্ধ। লেখা কঠিন হবার চেষ্টা করে—না। খাব না। খিদে নেই। 

সারেঙ নসু বলে— সারারাত না খেয়ে থাকবেন? কাল পৌঁছাতে বেলা হয়ে যাবে কিন্তু!

লেখা ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় লোকগুলো তাকে সহজ করে নিতে চাইছে। যাতে ওদের সেই নারকীয় বীভৎসতায় সে প্রবল প্রতিবাদ না তুলতে পারে। ওদের চোখে-মুখে দেখছে সেই লালসার ছায়া। বন্য আদিম অন্ধকারে ওদের মনে হয় হিংস্র একপাল জানোয়ার। 

লেখার ভয় করে। শীত লাগছে তার। নিজের দেহের কোনো অঙ্গই ওদের সামনে অনাবৃত রাখতে ঘৃণাবোধ করে সে। মনে হয় ওরা সবকিছু বিষিয়ে দেবে তাদের চাহনির জ্বালায় আর বিষে। লেখা সর্বাঙ্গ ঢাকা দিয়ে বসে বেশ চড়াস্বরে জানায়—বললাম তো খিদে নেই। খাব না। 

সারেঙ চুপ করে গেল। মধু ওপাশ থেকে বলে—ও খেলে তোর পেট ভরবে কিসের নসু, যে একেবারে খোসামুদি করে গলে গেলি? নিয়ে আয় ওটাই। অ্যাই ইয়াকুব! দে এখানে! না খায় না খাবে। এত খোসামুদি কিসের র‍্যা? 

ওরা ওপাশে পাটাতনের ওপর বসে গিলছে সেই রুটি আর মাংস। তার সঙ্গে বাকি মদটাও ঢালছে মগে মগে। তিনটে জানোয়ার যেন কোনো শিকার ধরে গিলছে। তারপর কী আদিম হিংস্রতা নিয়ে লাফিয়ে পড়বে অন্য শিকারের ওপর। পর-পর তিনটে প্রাণী ধারালো নখ-দাঁত আর থাবার আঘাতে সেই শিকারের দেহটাকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেবে। 

লেখার কান্না আসে। অসহায় একটি নারী, আজ তার সবকিছু ওই দস্যুর দল লুঠ করে নেবে। তার মুখে মাখিয়ে দেবে দুঃসহ কলঙ্কের কালো দাগ, সারা জীবনের জন্য সেই দাগ আর মুছবে না। 

লেখার মনে হয় এর চেয়ে সে মরতেই পারবে। মৃত্যুকেই মেনে নেবে। সারাজীবন এই দুর্বিষহ গ্লানি আর নরকের যন্ত্রণা ভোগ করার থেকে লাফ দেবে ওই গাঙের জলে। অন্ধকারে তাকাল নদীর বিস্তারের দিকে। মাংসের হাড়-টুকরো ফেলেছে ওরা জলে। জলের বুকে একটা শব্দ ওঠে। সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া গাঙ ফসফরাসের আভায় জ্বলছে। লঞ্চের ধারে বড়ো বড়ো কয়েকটা কামট এসে জুটেছে। কোনো শিকারকেই ওরা বাদ দেয় না। ধারালো করাতের মতো দাঁত দিয়ে মানুষের দেহের মাংস কুরে নেয়। নিশ্চিত মৃত্যু ওদের মাঝে পড়লে। তবু লেখা সেই বেদনাদায়ক মৃত্যুকেই মেনে নেবে। ওদের অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করে সে। 

লোকগুলো খাওয়া-দাওয়া সেরে বাকি মদটুকু শেষ করছে। রাত্রি নামে। লেখার মনে হয় ওরা এইবার রাত গভীরে এগিয়ে আসবে একে একে। 

নিজেকে তবু বাঁচাবার চেষ্টা করবে সে। বস্তার নিচে একটা ছোটো লোহার রড পেয়ে সেটাকেই তুলে নেয় ওদের চোখের আড়ালে। সামনের দিকটা ছুঁচালো মতো, মনে হয় অন্তত একটাকেও সে শেষ করতে পারবে এই দিয়ে। 

লেখা কঠিন হয়ে ওঠে। তার সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সে প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়।

কী দুঃসহ মুহূর্তগুলো! এক-একটা মুহূর্তে তার সারা দেহের তন্ত্রীতে, শিরায় নিবিড় উত্তেজনা আনে। মনে হয় কাল সকালে ধনেখালির সকলেই শুনবে তার ওপর সেই চরম অত্যাচারের কথা। ওরা হয়তো হাসবে অনেকেই। কেউ কেউ রেগে উঠবে। 

তার আগেই লেখা নিজেকে শেষ করবে। সে ওই আলোচনাগুলো শুনতে যাবে না। সেই অপমান সহ্য—করে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই ভালো। 

লোকগুলো খেয়ে-দেয়ে মদের পাত্র প্রায় শেষ করে উঠল। টলছে ওরা, চোখ লাল হয়ে উঠছে। লেখাও তৈরি হয়েছে। কাছে এলেই এই লোহার ধারালো রড একটার বুকে সজোরে গেঁথে দিয়ে সে লাফ দেবে গাঙের জলে। 

আড়ামোড়া ভেঙে সারেঙ বলে মধুকে—বড্ড বেশি হয়ে গেছে মধু ভাই। শোবানি? অরে অ ইয়াকুব! শালা যে নেতিয়ে পড়ল ওস্তাদ! 

ইয়াকুব তখন ওপাশের খোলেই সেই খানা খাবার দস্তরখানের ওপরই নেতিয়ে পড়েছে। তার যেন সাড়া নেই। 

মধু সারেঙকে বলে—তুমি শোও গিয়ে। জায়গাটা ভালো নয় নসু, হুঁশিয়ার থেকো। আমি একটু জেগে থাকি। মরাভাটির পর জোয়ার না এলে – বাদাবনের ধারে রইছি ঘুমোতে ভরসা পাচ্ছি না। যদি সাঁতরে আসে বাঘ-টাঘ! 

নসুর এদিকে যেন ভয়-ডর নেই। ওরা এসবে অভ্যস্ত। বিরাট দেহটাকে বার দুয়েক আড়ামোড়া ছেড়ে একটু টান টান করে নিয়ে টলতে টলতে মই বেয়ে লঞ্চের ছাদে সেই খুপরিটাতে উঠে গেল। 

লেখার সারা শরীরে ঘাম দিচ্ছে ভয়ে। ঠাণ্ডা হাওয়াতেও সেই ঘামটা ঝরছে। ভয়ে তার মুখ-চোখ কঠিন হয়ে উঠেছে। মধুর চক্রান্ত এইবার বুঝতে পারে লেখা। 

লোকটাকে মধু ঠেসে মদ খাইয়ে বেঁহুশ করে দিয়েছে। কিন্তু নিজের কিছুই হয়নি। মদ খেয়ে খেয়ে সে পোক্ত হয়ে গেছে। 

এইবার লঞ্চে তারা জেগে আছে মাত্র দুজন। কোথাও মানুষের সাড়া নেই, শুধু আদিম- আরণ্যক জীবনের আতঙ্ক আর হিংস্রতা নেমেছে। লেখার মনে হয় ও এইবার এসে লাফ দিয়ে পড়বে, তার মুখ টিপে ধরবে বলিষ্ঠ দুটো কঠিন হতে দিয়ে। অন্ধকারে ওর চোখ-দুটো জ্বলছে কী হিংস্রতায়, ও যেন নিশ্বাস নিচ্ছে না, হাঁপাচ্ছে। পায়ের শব্দ ওঠে আবছা অন্ধকারে। 

লেখা কঠিন হয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। মধু এগিয়ে এলেই সে ওই ধারালো রডটা ওর বুকে না হয় পেটে আমূল বসিয়ে দেবে। তবু সেই অত্যাচারের গ্লানি সে সইবে না। 

মধুর বলিষ্ঠ দীর্ঘ দেহটা ছায়াকালো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে লঞ্চের ওমাথায়। চারিদিকে সন্ধানী দৃষ্টি মেলে কী দেখছে সে। বোধহয় চরম মুহূর্তের সন্ধান করছে। লেখা ক্লান্ত হলেই সে এগিয়ে আসবে। তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে, ওই বলিষ্ঠ দেহের নিবিড় বাঁধনে যেন সাপের বাঁধনের চেয়ে কঠিনতর করে পিষে ফেলবে তাকে। 

লঞ্চটা দুলছে, বোধহয় জোয়ার আসছে। 

রাত কত জানে না লেখা। মেঘের ফাঁক দিয়ে একফালি ভীরু চাঁদের আলো এসে পড়েছে লঞ্চের এপাশে। মনে হয়, ওই চাঁদও দেখতে চায় সেই সর্বনাশের বেদনা-করুণ দৃশ্য। 

অসহ্য উত্তেজনায়, নিষ্ফল রাগে আর দুঃসহ আতঙ্কে ওর সব শিরাতন্ত্রীগুলো যেন ছিঁড়ে পড়বে খান খান হয়ে। 

লেখার মুখে-চোখে সেই নির্মম যন্ত্রণা আর লাঞ্ছনার ছায়া মাখানো। মধুর বলিষ্ঠ দেহটা যেন তাকে পিষে ফেলেছে। কাঁদছে—আর্তনাদ করছে অসহায় একটি নারী। নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে সে আপ্রাণ। কিন্তু পারছে না। তার দু’চোখে নেমেছে অন্ধকার। 

হঠাৎ কার ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠল লেখা। ওপাশ থেকে মধুসূদনই তাকে ডাকছে—ওঠো। বেলা হয়ে গেছে। 

চমকে ধড়মড়িয়ে উঠল লেখা। রাত কখন কেটে গেছে। মেঘমুক্ত আকাশকোলে ফুটে উঠেছে দিনের প্রথম সোনালি আলো। বনভূমির সবুজ গাছগাছালির মাথায় পড়েছে সেই আলোর আভা। বৃষ্টি-ধোয়া গাছগুলো ঝক-ঝক করছে। উড়ছে গাঙ-চিলের দল। একঝাঁক শালিকপাখি বন থেকে কলরব করে গ্রাম-বসতের সন্ধানে বের হয়ে গেল। বাতাসে ওঠে সেই সুর—ওর মুখে-চোখে পড়েছে মিষ্টি আলোর আভা। 

লেখা দেখে বস্তার গাদাতেই শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। জোলো হাওয়ায় ঠাণ্ডা পড়েছে, তার গায়ে একটা চাদর চাপানো। 

অবাক হয় লেখা। শীতে বোধহয় কুঁকড়ে পড়েছিল, ওই চাদরখানা কে চাপা দিয়ে গেছে। মধুর গায়ের চাদরখানা দিয়ে তাকে আবৃত করে গেছে কখন রাতের অন্ধকারে। 

লেখা লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। ঘুমের ঘোরে তার অসংযত দেহের কিছুটা নিশ্চয় ওর নজরে পড়েছে। লজ্জা বোধ হয়। কাপড়-চোপড় সামলে নিতে থাকে। অবাক হয় লেখা—মধু ওখানে নেই। কোনদিকে সরে গেছে, তাকে এমনি অসংযত অবস্থায় দেখতে সে চায় না বোধহয়। 

মধু ফিরছে একটু পরে। ওকে বলে—চা খাবে তো? তাহলে হাত-মুখ ধুয়ে নাও।

নিজেই মধু ওর জন্য কলাই-করা গ্লাসে চা এনেছে। বলে সে আর কিছু নেই। কই রে বাবা নসু—লঞ্চ তোর চলবে? না চলে তো বল গাঙ সাঁতরে গিয়ে নৌকো ফৌকো দেখি। যত্তো সব ভ্যাজালের কারবার মহিমের! 

খোলের মধ্যে ইঞ্জিনটা ঠুকতে ঠুকতে নসু জবাব দেয়—হই যাবেনে। চিল্লাও ক্যান খামোখা? খোয়াড়ি ভেঙে নাও, লঞ্চ চালু করছি ইবার 

পাখি ডাকা আলো-ভরা জগৎ। মধুর দিকে তাকাল লেখা। মাটিমাখা কঠিন একটা মানুষ। কোথায় যেন সে নির্লিপ্ত আর উদাসীন। লেখার দিকে ফিরেও তাকাল না। 

মধু বলিষ্ঠ পদক্ষেপে লঞ্চের ছাদে গিয়ে উঠল। লঞ্চটা চলছে এইবার। অন্ধকার জগৎ থেকে ওরা আলোর দিকে চলেছে, অরণ্য থেকে চলেছে জনপদের দিকে। 

অশ্বিনী ডাক্তার সারারাত ঘুমোতে পারেননি। দুর্যোগ কমেছে, কিন্তু লেখার না ফেরার জন্য ভাবনা তাঁর যায়নি। কেবলই খোঁজ করেছেন। মহিমবাবুও এসেছে সকালেই। তার লঞ্চও ফেরেনি। ভুবনবাবুও খবর পেয়ে এসেছেন। আর একটু বেলা অবধি দেখে ওরা পুলিশের বোট নিয়েই বের হবে। কে জানে, বাদাবন এলাকা, কোনো বিপদ-আপদ হল কিনা দেখা দরকার। 

ভুবন দারোগা বলেন—ওকে একা ছাড়লেন কেন? 

মহিমবাবুও ভাবনায় পড়েছে—তাই তো, মুশকিল হল দেখছি! 

অশ্বিনীবাবু বলেন—আমি ওকে পাঠাতে চাইনি ভুবনবাবু, ও নিজে জোর করে গেল। বলে—একটা মানুষ এমনি মরবে, যাব না? 

মহিমবাবু এ অঞ্চলের ঘুণব্যক্তি। অনেক দেখেছে সে। বর্ষার পর এদিকের লাটে লাটে কলেরার মড়ক লাগে। তাদের দেখার কেউ নেই। ওরা বাঘের পেটে মরে, না খেয়ে মরে, রোগে মরে।

মহিমবাবু বলে,—তাই বলে নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াতে হবে? দেখা যাক আর একটু। এখনও সময় যায়নি। তারপর ভাঁটিতেই বেরোনো যাবে নৌকো নিয়ে। লঞ্চও ফিরল না কেন, তাই ভাবছি। 

.

লেখার কাছে এই সোনালি সকালটুকু কি মিষ্টি-স্বপ্ন আর আশ্বাস এনেছে। মনে হয়, এতদিন মিথ্যা একটা ঘৃণা আর অবজ্ঞা দিয়ে নিজের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। হঠাৎ মেঘমুক্ত সকালের এই সবুজ অরণ্য-সীমা, মুক্ত গাছের বুকে আলোর আশ্বাস দেখে সে নিজেকেও চিনেছে। 

আজকের এই হলুদ রোদ-ভরা সকালটুকু যেন তার বহু পরিশ্রম-অর্জিত ছুটির মতোই মনোরম। লঞ্চটা চলেছে মসৃণ গাঙের বুকে ঢেউ তুলে। ওপাশের রৌদ্রস্নাত বনভূমির তীরে দাঁড়িয়ে আছে দু-একটা হরিণ কালো চোখ মেলে, ওদের দেখেই লাফ দিয়ে সোনালি রেখায় মিলিয়ে গেল। গাঙ-চিলগুলো সাদা ডানা মেলে উড়ছে। 

শান্ত-সুন্দর একটি জগৎ। লেখার কাছে এই জগৎ, এই বনসীমা, ওই মুক্ত ধানখেতের সবুজ প্রশান্তি কী নতুন আশ্বাস আনে। এ যেন ধনেখালির সেই ছকবাঁধা জীবন থেকে মুক্তির আশ্বাস এনেছে তার কাছে। 

সামনে নদীর বাঁকের মাথায় মোল্লাখালির গঞ্জ দেখা যায়, টিনের শেড তোলা গুদাম, হাটতলা, দু-চারটে বাড়ি রোদে চিক-চিক করছে। জেলে-নৌকোগুলো দেখা যায়—লঞ্চের ঢেউয়ে তারা দুলছে। 

—সালাম গ মধুবাবু! ভালো আছেন? 

মধু ওদের চেনে। মধুও গলা তুলে জবাব দেয়—হ্যাঁরে! মাছ পেলি? 

লঞ্চটা এগিয়ে চলেছে মোল্লাখালির হাটতলার ঘাটের দিকে। 

.

ঘাটে লোকজন জুটে গেছে। হাটবার নয়, তবু ওরা জানে লঞ্চটা আসবে। এখানেও মহিম ঘোষালের কিছু মালপত্তর উঠছে। 

মধুও হাঁক-ডাক করছে। ও-ই যেন প্রধান ব্যক্তি। দীর্ঘ দেহটা দেখা যায়, রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। লেখা দূর থেকে মধুর ওই বলিষ্ঠ দেহের দিকে চেয়ে থাকে। 

মধু লোকজনদের মধ্যে একজন বয়স্কের হাতে একটা হরিণের কাঁচা চামড়া দিয়ে দেয়। বলে,

—নাও বড়কর্তা! ক’বারই বলেছিলে হরিণের চামড়ায় বসে তপস্যা করবে। করো শ্লা তপস্যা! দেখো যেন বনবাবুরা জানতে না পারে! 

বুড়ো লোকটা খুশি হয়েছে হরিণের চামড়া পেয়ে। তবু বলে—তোমাকে কিছু বলেনি তো বাবু? 

মধু গর্জে ওঠে,–সে শ্লা এখনও মায়ের গব্বে রয়েছে। 

নালিশ ফরিয়াদের ফয়সালাও করতে হয় তাকে। এদিকে কে শীর্ণমতো একটা লোক বলে,

—নিতু জানাও এসেছে। বাবু ওকে বলে দিন একটু, আর যেন জমি লিয়ে হাঙ্গামা না বাধায়! গরিব মানুষ। 

মালপত্তর ওঠা-নামা হচ্ছে। মধুর জালা, মোম, পাট, ধানের বস্তাগুলো তদারক করছিল একটা লোক। ফর্সা ধুতি হাফশার্ট পরা, হাতে একটা ছোটো খাতায় হিসেব রাখছিল। 

লেখাও দেখেছে লোকটা সরে পড়বার চেষ্টা করছে ভিড়ে। লঞ্চ থেকে হাঁক পাড়ে মধু ওকে দেখে 

—পালাবা না নিতু! খুব তো গোলাদার হয়েছ দেখছি! 

ওই লোকটার বিরুদ্ধেই নালিশ। ধরা পড়ে গিয়ে নিতু জানা আমতা আমতা করে—কী বলছেন বাবু, গোলদার আর হলাম ক্যামনে! আপনাদেরই খেয়ে-পরে মানুষ। 

মধু ফোঁস করে ওঠে—খুব তো বিনয় দেখছি! ওই রতির জমি আবার দখল করতে গিইছিলি কেন? ফৌজদারি করতে চাস? তালে বল সাত জেলের জিতু নস্করের মতো তোকেই সাত- হাত নাকখত দিইয়ে দিই এইখানেই। 

নিতু জানা চমকে ওঠে। মধু চৌধুরী তা পারে। জিতেন নস্করের মতো মারকুটে খুনেকে ও সেদিন জব্দ করে দিয়েছে সে। ওমর শেখের মতো ডাকাতকে পিটিয়ে ছাতু করে দিয়েছিল সেদিন হাটতলায়। 

লেখা দেখছে সমবেত মানুষগুলোর মুখে-চোখে কী আশ্বাস ফুটে উঠেছে। নিতু জানা ফণা নামিয়েছে। বলে—কি যে বলেন বাবু, ফৌজদারি করতে যাব কেন? বিশ্বাস করুন— 

মধু শাসায়—থাক! শেষ কথা বলে গেলাম, গরিবের ভাতে হাত দিতে যাবি তো শা’র হাত ভেঙে দোব। কল্লা মটকিয়ে গাঙের জলে ফেলে দোব। সেই হারামির বাচ্চা গোবিন্দ কোথায়? 

ভিড়ের মধ্যে গোবিন্দ নামক প্রাণীর সন্ধান করছে সকলে। লেখা দেখে, টিকটিকির মতো একটা লোক চুপিসারে ওপাশের টিনের চালার আড়াল দিয়ে সরে যাচ্ছে। হাসি আসে মধুর 

যেন ওরা একপাল শিয়াল, বাঘের হাঁকানিতে ওরা গর্ত খুঁজছে। মধু ধরে ফেলে গোবিন্দকে। লোকটার কাছা-কোঁচা খুলে গেছে। ওইখান থেকেই হাতজোড় করে সে অনুনয়- বিনয় করছে,

—দোহাই মধুবাবু, ওরা মিছে কথা বলছে। আজ্ঞা তিন নম্বর লাটে আমি যাইনি। মা কালীর দিব্যি গেলে বলছি! 

মধু গর্জন করে ওঠে—বেশ! ওরা মিছে কথা বলেছে? যাওনি সেখানে? 

গোবিন্দ যেন বলির পাঁঠার মতো কাঁপছে। মধু বলে-ন্যায্য যা পাবে তা নেবে। তা না দেয় মধু চৌধুরীকে বলো, চাষির পেটে পা দিয়ে ধান আদায় করে দোব। তবে যদি মস্তানি করতে গেছ—ওই জাবেদাখাতা বগলে করে গিয়ে এক মণ ধানকে তিন মণের দাবিতে লুট করো—শুনে রাখো, ফিরে আসতে হবে না। 

—অ্যাঁ! গোবিন্দ কাতরাচ্ছে। 

মধু শাসায়—হ্যাঁ! কথাটা মনে রেখো। 

লোকটাকে ওরা ভালোবাসে সেইজন্যই। মধুর এই পরিচয়টা লেখার কাছে অজানাই ছিল। বেলা হয়ে আসছে। 

হঠাৎ লেখার দিকে চোখ পড়তে যেন মধুর ফেরার কথাটা খেয়াল হয়। মধু হাঁক-ডাক শুরু করে,

—অ্যাই নসু! সে ইয়াকুব শ্লা কোথায় গেল? অ্যাই, ফিরতে হবে না? তোদের না হয় কাজ-কাম নেই! ওর তো স্কুল ডাক্তারখানা আছে। ডাক্তারবাবুও ভাবছেন। জলদি কর। 

নসু সাড়া দেয়,—যাই গ! আরে ইয়াকুব, বস্তা, মাল-ফাল তোলা হল? 

—হয়ে এয়েছে! খ্যানখ্যানে গলায় জবাব দেয় সে। 

মধু ইতিমধ্যে জানায়—এখুনি আসছি। তোরা তৈরি হ’। দেরি করিসনি আর।

সামনেই একটা মুড়ি তেলেভাজার দোকানে গিয়ে ওর মুড়ির ধামাটাই তুলে নেয় মধু,–দে, তেলেভাজা দে মণে! 

মধুকে টাকা বের করতে দেখে লোকটা বলে,—আবার ট্যাকা কেনে গ! 

মণে ওর কাছে কৃতজ্ঞ। মণের দুটো ভাইপোকে মধুসূদন মেটের কাজ দিয়েছে। মণীন্দ্র তাই সামান্য জলখাবার দিতে পারলে যেন কৃতার্থ হয়। মধু বলে—তোর কি বাপের তেলকল আছে র‍্যা, না টানা মালের কারবার করছিস, অ্যা! যে এত টাকা তোর? নে–ধর। 

গোটা তিনেক টাকা এগিয়ে দিয়ে বলে মধু—ধামাটা ফিরতি লঞ্চে ইয়াকুব দিয়ে যাবে।

লাফ দিয়ে লঞ্চে উঠে হাঁক পাড়ে সে—অ্যাই নসু! চালা— 

ঘন্টি বাজছে। পেছনের প্রপেলারের শব্দ ওঠে। নিস্তরঙ্গ জলের বুকে ঢেউ তুলে ঘাট ছেড়ে লঞ্চটা এগিয়ে চলে। ঘাটে তখনও লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে। 

শান্ত নদীতীর। দু’দিকে দু-একটা বসতি, ধানখেত আর সমানভাবে চলে গেছে ভেড়িগুলো। লেখা আনমনে চেয়ে থাকে। হঠাৎ মধুর ডাকে ফিরে তাকাল। এ যেন অন্য মানুষ। সেই তেজ, দাপট আর কাঠিন্য নেই। চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে। লেখা তাকাল ওর দিকে। মধু শালপাতার ঠোঙায় মুড়ি আর গরম তেলেভাজা এনেছে। বলে—কাল রাত থেকে কিছুই খাওনি। পৌঁছাতেও ঘন্টা খানেকের বেশি লাগবে। যদি কিছু খেতে, মানে, এছাড়া আর কিছু মেলে না এখানে। 

ওর কথার সুরে কুন্ঠার ভাব। লেখা ওকে দেখছে। অতীতের সেই শান্ত কিশোরের মুখচ্ছবিটা মনে পড়ে। কোথায় যেন মধু তেমনিই রয়ে গেছে। বাইরের পরিবর্তনটা ওর ক্ষণিকের। 

লেখা কী ভেবে হাসল একটু। হাত পেতে মুড়ির ঠোঙাটা চেয়ে নিল। একটু ছোঁয়াও লাগে। ওর কঠিন হাতে তার স্পর্শটুকু কেমন চমক আনে। লেখা সরে গেল ঠোঙাটা নিয়ে ওপাশে। শান্ত নদীর বুকে ঢেউয়ের আবর্ত তুলে লঞ্চটা চলেছে। মধু বলে—দেখিগে, নসু কী চালাচ্ছে, যেন গাধাবোট পেয়েছে ব্যাটা। 

লেখার দিকে না তাকিয়ে ওপরে উঠে গেল। 

এইবার লঞ্চটা জোরে চলছে। ইঞ্জিনের শব্দ ওঠে। আশপাশে ভেড়ির ধারে দু-চার ঘর লোকের বসতি দেখা যায়। চালে উঠেছে লাউকুমড়ার গাছ। গোরু চরছে। মাঝে মাঝে জেলেডিঙিগুলো মাছ ধরছে নদীতে। সিটি দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ। 

এপাশ থেকে দেখা যায় লঞ্চের স্টিয়ারিং ধরেছে মধুসূদন নিজে। তাই বোধহয় জীর্ণ লঞ্চটার গতি বেড়েছে। মরা ঘোড়াকে যেমন চাবকে নিয়ে যায় পোক্ত সওয়ারি, ও তেমন হাঁকিয়ে নিয়ে চলেছে লঞ্চটা। 

লেখা অনুভব করে খিদে পেয়েছে। গরম তেলেভাজাগুলো খাবে কিনা ভাবছিল। মনে হয় ফেলেই দেবে ওগুলোকে। কিন্তু পারে না। ওরা সকলেই খাচ্ছে, সেও খেতে থাকে, ভালোই লাগে। 

এই দিকহীন যাত্রা, শূন্য দিগন্ত আর নদীর বিস্তার, দূরে দূরে মানুষের ঘর, তাদের আনাগোনা—কোথায় রেইন্ট্রি গাছের ছায়া নেমেছে। এই জগতের দিকে চোখ মেলে দেখেনি লেখা। এখানে এত রূপ, এত সুর, এত আলো আছে, তা জানত না সে। 

দূর থেকে দেখা যায় ধনেখালির গঞ্জ। লম্বা শেডগুলো, থানার এরিয়াল মাস্ট, হাটতলার গাছগুলো—সব ছবির মতো ফুটে ওঠে। লঞ্চটা এগিয়ে চলেছে। 

.

মধুসূদন বোধহয় ঘরে ফেরার আনন্দটা জানান দিচ্ছে ওই সিটির শব্দে। শূন্য দিগন্তে, নদীর বিস্তারে সেই শব্দটা ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তোলে। দেখা যায় ঘাটে এসে দাঁড়িয়ে আছে অশ্বিনীবাবু, মহিমবাবু, দারোগা-সাহেব, আরও কারা। ওরা যেন সাগ্রহে এদের ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিল। 

ইয়াকুব সুখানি এতক্ষণ পিট পিট করে দেখছিল লেখাকে। কানে ওর একটা আধপোড়া বিড়ি গোঁজা। জলে জলেই ঘোরে—তাই মাথার চুলগুলো তেল-কালি মাখানো আর তেমনি লম্বা, কান অবধি ঢেকে গেছে। পরনে একটা নীল রঙের বিবর্ণ প্যান্ট। হাড়গুলো পুঁটিমাছের মতো জিল জিল করছে। সব গোনা যায়। লোকটা পাকানো দু’হাতের জোরে তক্তাটা জোরে নিচে নামিয়ে এগিয়ে আসে। লেখাকে বলে, 

—বাক্সটা আমিই নামিয়ে দিবানি। আপনি নেমে যান আগে। সাবধানে নামবেন। যা কাদা!

লেখা ওর দিকে তাকাল। মনে হয় লোকগুলোকে চিনতে পারেনি কাল। প্রকৃতির নিষ্ঠুর পরিবেশের থাপ্পড়গুলো ওদের সব শ্রী আর কমনীয়তাকে কাঠিন্যে পরিণত করেছে। কিন্তু অন্তরে কোথায় ওরা এখনও মানুষই রয়ে গেছে। কাল রাতের সেই সময়গুলোকে মনে করবার চেষ্টা করে লেখা। তার সব ভাবনা-চিন্তা কেমন জট পাকিয়ে যায়। নেমে গেল সে। ইয়াকুব, নসু সারেঙ ওকে সেলাম জানায়। 

অশ্বিনী ডাক্তার বোনকে পেয়ে নিশ্চিন্ত হন। লেখার মুখে-চোখে খুশির আভাস। রাতের সেই দুশ্চিন্তা আজ সব মুছে গেছে। লেখা বলে, 

—বুঝলে দাদা, ডেলিভারি কেসটা ‘সেফলি’ উতরে গেছে। তবে ভুগিয়েছে দারুণ।

ভুবনবাবু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। অবাক হয়েছেন তিনি ভাই-বোনের সঙ্গে মিশে ওরা কেমন যেন এই নিয়েই খুশি রয়ে গেছে। 

মহিমবাবু বলে—যাক, শেষরক্ষা হয়েছে তাহলে। ওহে নসু, লঞ্চ আজ রেস্ট নিক। তোমরাও জিরোও। কাল মাল চালান যাবে ঘেরে। অ্যাই!… আরে—আরে—! 

মহিমবাবু হকচকিয়ে ওঠে। ওরাও অবাক হয় সকলে। 

হঠাৎ একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দে ওরা চমকে ওঠে। লঞ্চের পাটাতন বেয়ে নয়—একেবারে ছাদ থেকে সটান ভিজে মাটিতে ওদের সামনে লাফ দিয়ে নেমেছে মধুসূদন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনের কাপড়টা হাঁটু অবধি তোলা। হাফশার্টটাও তেমনি মাটি-কাদা লাগা। মধু জড়িত কণ্ঠে বলে, 

—নমস্কার দারোগাবাবু! ডাক্তারবাবু! এই যে পেসিডেন সাহেব ভ্যালা লঞ্চ করে রেখেছ যা হোক মাইরি! ইঞ্জিন গড়বড়—ব্যস, তামাম রাত শ্লা পড়ে থাকতে হল বাঘনার জঙ্গলের ধারে। সব কি ফোকটিয়া গিরিধারি বাব্বাঃ! এন্তার লুটছ, লঞ্চে একটু মাল-পত্তর ভালো দাও। ওই যাঃ, শ্লা ভুলেই গেছলাম! 

ওরা সকলেই হতচকিয়ে গেছে মধুসূদনকে এই সঙ্গে ফিরতে দেখে। ওদের মুখে ফুটে ওঠে একটা কাঠিন্য। ভুবনবাবু দেখছেন মধুকে। মহিম ঘোষালের মুখে কালো ছায়াটা মিলিয়ে যাচ্ছে। নয়া আবাদ থেকে বোধহয় উঠেছে ফিরতি লঞ্চে। সারা রাত কাটাতে হয়েছে ওই লঞ্চেই। লেখাও ছিল সঙ্গে। ওরা চমকে ওঠে। ওই জানোয়ারের সঙ্গে একটি মেয়েছেলে আটকে ছিল লঞ্চে সারারাত। 

অশ্বিনী ডাক্তার চমকে ওঠেন। মহিমবাবু মুখ টিপে হাসছে। সে এসব বিষয়ে রসিক ব্যক্তি। মুখ ফুটে কিছু বলল না, খবরটা শুনল মাত্র সে। 

মধুসূদনের ওসব ভাববার অবকাশ নেই। সে হাঁক পাড়ছে গলা তুলে, 

—অ নসু, বাবা মালটা কি একাই গিলবি? দে বাবা! 

—এই যে! নসু সেই বিরাট লাউয়ের খোলটা এগিয়ে দিল। 

মধু সেটাকে তুলে নাড়াচাড়া করে বলে–রেখেছিস কিছু, না ছাপ করে দিয়েছিস? শ্লা বললাম তো, মাছ খায় সব পাখিতেই বদনাম শুধু মাছরাঙার। মহিমবাবু, খাঁটি চোলাই, বুঝলেন? বাদাবনের মধু আর চিঁড়ে পচিয়ে তৈরি। হবে আজ সন্ধ্যাবেলায়। চলি! দারোগাবাবু, কিছুদিন এখন ধনেখালিতে থাকব মাইরি, ডিসটার্ব করবেন না, প্লিজ! 

পদা আর যতিলাল নিচের আবাদ থেকে আগের দিন এসেছে। তারাও জানে কয়েকটা কাজ সেরে গুরু ফিরবে। তাই পথ তাকিয়ে ছিল ওরা। 

হঠাৎ অসময়ে লঞ্চটা ফিরতে দেখে ওরাও দুজনে এসে হাজির হয়। যতিলালের হাতে দুটো মুরগি, গুরুদেবের ভোগে লাগবে। দুজনেই একটু টলছে। তবু ওই অবস্থাতেই এসে হাজির হয় তারা। 

—এই যে গুরু! 

পেছনে হাটতলার পানের দোকানি গদাই, পারঘাটের ফটিক আরও ক-জন শাগরেদ রয়েছে। পদা এগিয়ে যেতেই মধু ওর পেছনে একটা সপাটে লাথি কষে গর্জায়। 

—ব্যাটা নচ্ছার, ছিলি কোথায়? 

হাসছে পদা। লাথির চোটে ছিটকে পড়েছিল, উঠে এসে হাসিমুখে বিছানা আর চামড়াগুলো নিয়ে বলে, 

—মাল গস্ত করতে গেইছিলাম গুরু। 

—ধর যতে, লাউয়ের খোলটা সাবধানে ধর! 

পদা খুশি হয়,—দব্য তা’লে এনেছ গুরু! যতে, হুঁশিয়ারি করে লিবি কিন্তু। তোর রক্তের চেয়েও দামি। 

এগিয়ে এসে মধুকে পেন্নাম করে ওই গদাই-ফটিকের দল, 

—শুনলাম নাকি আবাদ মাতিয়ে এসেছ গুরু। ধনেখালি তো শূন্য হয়ে গেছিল পেরায়।

যতিলাল লাউয়ের খোলটা মাথায় চাপিয়ে মুরগি দুটোকে সামলাতে সামলাতে বলে, আবার বেন্দাবন হয়ে উঠবে গ। 

লোকজন জুটে গেছে। ওরা এসেছে মধুকে অভ্যর্থনা করতে। মধুও লোকজনদের নিয়ে যাবার মুখে বলে—আসি স্যার! ক-দিন একটু রেস্ট নোব দারোগাবাবু। নমস্কার! ভক্তদের ঘাড়ে হাত দিয়ে গান গাইতে গাইতে চলেছে, 

দেখা হইল না রে সই 
নতুন বয়স কালে। 

বিচিত্র শোভাযাত্রার দিকে তাকিয়ে ভুবনবাবু হাসছেন। 

মহিম ঘোষালের মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে। ও বলে—আমরা রয়েছি, এতটুকু মান-সম্মানবোধ নেই! সামলান এইবার ওটাকে। 

ভুবনবাবু জবাব দিলেন না। মনে হয় মধু এতদিন ধরা-বাঁধার মধ্যে থেকে ছুটি পেয়েছে ক-দিন। তাই একটু শোরগোল সে করবেই। তবু ভুবনবাবু কোথায় ভরসা পান। মধু তাঁর কথা রেখেছে। 

শোভাযাত্রা করে ওরা তাদের ঘরে-ফেরা গুরুকে নিয়ে চলেছে। ভক্তদের ঘাড়ে ভর করে মধুসূদন গান গাইতে গাইতে চলেছে—দেখা হইল নারে সই, নতুন বয়স কালে। 

.

পেছনে চলেছে ওর গুণমুগ্ধ ধনেখালির তাবৎ হতভাগার দল। আজ দুপুর থেকেই বেশ খানাপিনা জুটবে। হাটতলায় পারঘাটে খবর হয়ে যায়। বাওয়ালিদের বউ-ঝিদের মধ্যেও সাড়া পড়ে। কেউ মনে মনে খুশি হয়। কেউ বা বলে, –বাদাবন থিকি জানোয়ারটা আবার ঘরে ফিরি এল। উটারে শিয়ালে লেয় না? 

মাতনও শুনেছে কথাটা। ওর মরদকে বোধহয় এই গাঙ খেয়েছে। ওর রক্তের মাতন তবু থামেনি। গহীন গাঙের মতো, তাতে তুফান দাবড়ে ওঠে বাওড় লাগলেই। মাতনের গা-গতরে তারই জোয়ার। হাসছে সে। অন্যান্য ভদ্রলোকের মতো মধুসূদন আঁধার রাতের পাপী নয়। তার বুকের পাটা আছে। সে মরদ। তাই বোধহয় ভালো লাগে মাতনের। ও বলে,

—ও-ই যে বাদাবনের বাঘ গো! হাঁকাড়ি শোনোনি? ধনেখালিতে অ্যাদ্দিন রাতের বেলায় শিয়াল-কুকুরগুলোন জ্বালাই মারছিল। এবার দেখবা বাঘের হাঁকাড়িতে উরা ঘর থিকা বেরুবে নাই আর। 

.

মহিম ঘোষাল আবার তার রাতের কারবারের কথা ভাবছে। নগদ পয়সা ওতে। তুফানের মরশুমে কিছু টানামাল আনার সুবিধে পাকিস্তান থেকে। এখন তেমন পাহারা নেই। পুলিশের লঞ্চও এই ভর তুফানে ওদিকে যাবে না। তাছাড়া মধুসূদন এসেছে। ওর সাহস দুর্বার। পাকা সারেঙকেও হার মানায় তুফানে পাড়ি জমাতে। লঞ্চ যেন ওর ইশারায় ঢেউগুলোকে ফাটিয়ে পথ করে নেয়। মহিমবাবু কথাটা ভেবে রেখেছে। এক খেপ মাল আনতে পারলে বেশ কয়েক হাজার টাকা মুনাফা থাকবে। 

রাত হয়ে গেছে। মধুসূদনকে ডাকতে পাঠিয়েছে সে। কোথায় পড়ে আছে কে জানে। হঠাৎ পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল মহিমবাবু। 

বড়ো নদীর ধারে খালের ভারানির মাথায় কাঠের বাংলোটা। নদীর জোলো হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। কাঠের মাচামতো করা। তার ওপর ওই ঘর। গরানের সরু রলা করা আর গোলপাতার ছাউনি দেওয়া। সারা মেঝেটা মাটি থেকে অনেক উঁচুতে। মেঝেতে লাগিয়েছে কেওড়ার তক্তা। ভারী পায়ের শব্দ ওঠে তাতে। 

মধুসূদন ঢুকল। চোখ-দুটো লাল। সিগ্রেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, 

—কী ব্যাপার পেসিডেন সাহেব? রাত দুপুরে একটু স্ফূর্তি-আত্তি করব তার জো নেই। বল দিকি হেঁচে-কেশে তোমার মতলবটা! 

—বস, বলছি! মহিমবাবু দেরাজ থেকে কলকাতার চালানি হোয়াইট হর্স-এর একটি বোতল বের করে সামনে রাখল। 

একটু অবাক হয় মধু। বলে—বেড়ে মাল তো দেখছি! সাদা ঘোড়া! চালাও পানসি—

থালায় মুরগির মাংসও এসে গেল। মধু একটা ঠ্যাং মুখে করে কামড়াতে কামড়াতে বলে –এ যে কল্পতরু হয়ে গেলে মাইরি! আমদানি তালে ভালোই হচ্ছে? 

কথাটা পাড়ে এইবার মহিমবাবু –যাও না, একখেপে দেখে এসো। ভালো মালপত্তর আছে। লবঙ্গ, ঘড়ি, কলম, টেরিলিন। শুধু ঘণ্টা কয়েকের ব্যাপার। 

হাসে মধুসূদন—জানো না পেসিডেন। ব্যাটা ভুবন দারোগা মহা ঘোড়েল। আমি এসেছি দুদিন। দেখছি ছায়ার মতো পেছনে লোক রেখেছে। তোমার দিকেও নজর আছে। ও টের পেয়ে গেছে তোমার কারবারের খপর। তাই বলছি, ওসব এখন থাক। যদি মাল-পত্তর কিছু থাকে বরং সরিয়ে ফেলো। 

মহিমবাবু একটু ঘাবড়ে যায়। তবু বলে—কী যে বলো! দু-একদিন দ্যাখো। তারপর যাবে। কথাটা এখনই আলোচনা করতে চায় না মহিম। ও সহজে টোপ এখন গিলবে না। তাই ওকে অন্য কথায় নিয়ে যায় সে। মহিমবাবু বলে—সেদিন রাতভর লঞ্চে ছিলে, মেয়েটা—ওই অশ্বিনীর বোন— কোথায় ছিল হে? 

মুরগির ঠ্যাং চুষছে মধু। অন্যমনস্কভাবে জবাব দেয়—কেন, লঞ্চেই। 

হাসছে মহিমবাবু। মধু চমকে ওঠে ওর এই অর্থপূর্ণ হাসিতে। মহিমের দু’চোখে কিসের ইঙ্গিত। মহিমবাবু হাসি থামিয়ে বলে—তাহলে ভালোই ছিলে, কি বল মধুসূদন? মেয়েটার বড়ো ডাঁট। বুঝলে, চোখেই দ্যাখে না। আর কি বলছিল হে মেয়েটা? 

মধু বুঝতে পারে ওর ইঙ্গিত। চমকে উঠেছে সে। সেই রাত্রে এমন কোনো ভাবনাই তার মনে আসেনি। ওই মহিম তাকে বোধহয় মানুষই মনে করে না। 

মদ খায়, মেয়েছেলের সন্ধানে ঘোরে—সত্যি, কিন্তু বিপদে পড়লে কাউকে সাহায্য না করে তার সর্বনাশ করাই যেন মধুর স্বভাব, এই কথাটাই ভেবে নিয়েছে মহিমবাবু। ও তাকে ভাবে বাদাবনের জানোয়ার, মানুষ বলে ভাববার মতো কোনো পরিচয়ই তার নেই। মহিমবাবুর কথাগুলো যেন মধুর-মুখে চাবুকের মতো বেজেছে। লাফ দিয়ে ওঠে সে–কি বলছ পেসিডেন? 

হাসছে মহিমবাবু—চটো কেন হে! তবু মেয়েটা লেখাপড়া জানে, একেবারে বুনো বাওয়ালির ঘরের নয়, তুমিও ভদ্দরলোকের ছেলে, না হয় একটু ইয়ে, মানে–একটু মাখামাখি, ধরো-

মধু সদর্পে ওর টেবিলেই একটা থাপ্পড় মারে। ওর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে অপমানে।

মহিম ঘোষাল ভেবে-চিন্তা পা ফেলে। আজ সে দেখেছে মধু আবার মাথা তুলছে। ওর সাহস আছে, শক্তি আছে, আর ও নীচ নয়। তাই একটা কাজ করেই সে সরকারি মহলে নাম কিনেছে। পরপর আরও কাজ তাকে দেবে ওরা, আর মহিমবাবুর অর্ডার ক্যানসেল হয়ে গেছে। 

তাছাড়া ওই লেখার ওপর তার একটা লোভ রয়ে গেছে। মধু সেদিকেও যেন নজর দিয়েছে। লেখার মুখ-চোখে সেদিন মহিমবাবু দেখেছে হাসির আভা। কোনো অভিযোগের কাঠিন্য নেই। অথচ লেখা মহিমবাবুর সব সাহায্য ফিরিয়ে দিয়েছে ঘৃণাভরে। 

ধূর্ত মহিম ঘোষাল তাই চেয়েছিল মধুকে ওই টানামালের কারবারে নামিয়ে হাতে-নাতে ধরাবার ব্যবস্থা করতে। স্মাগলিং-এর দায়ে শ্রীঘর ঘুরে আসত মধুসূদন। তা হয়নি। 

কথাটা এড়িয়ে গেছে মধু। তাই ওই লেখার সম্বন্ধেই মন্তব্যটা করেছিল। কিন্তু মধুকে দপ করে জ্বলে উঠতে দেখে মহিমবাবু বুঝতে পারে মধুর মনেও কোথায় অন্য একটা ধারণা রয়ে গেছে। 

তবু মহিমবাবু মধুর কঠিন মুখ-চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, –রাগলে নাকি? 

মধু নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে, —না। রাগব কেন? 

মহিমবাবু বলে—মেয়েটার আছেই বা কি? শুধু বড়ো বড়ো বাত। তাই বলছিলাম ওর ডাঁট ভেঙে ফেলেছ কিনা? 

মধু এসব কথা পছন্দ করে না। তাই বলে—ওসব কথা বলবে না পেসিডেন! সবই আমার নিয়েছ তুমি। জমি-জায়গা, পুকুর- ভেড়ি সব কিছুই গেছে। ভেবেছ মধু শ্লা বাদাবনের জানোয়ার হয়ে গেছে, না? তার বিবেক-বুদ্ধিরও লেশটুকুও নাই? নেহাত বিপদে পড়েছিল মেয়েটা সেই রাতে-তাকেও অপমান করব? 

মহিমবাবু হাসছে—তাই নাকি! তাহলে ভাবব লেখা এমনিই ছাড়া পেয়েছে? 

মধুর সর্বাঙ্গে জ্বলে ওঠে ওই অবিশ্বাসের হাসিতে। নিজের ওপর রাগ হয়। ওই মহিমের মতো অমানুষের কাছেও তার এতটুকু মর্যাদা নেই। এ কথাটা কত বড়ো বেদনার, সেটা আগে বুঝতে শেখেনি সে, পারেনি। তাই বলে মধু, – হেসো না পেসিডেন! মধু শ্লা জানোয়ার হয় জানোয়ারের সামনে। মানুষের সামনে নয়। 

হাতের গেলাস আর আধ-খাওয়া মাংসটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মহিমবাবু একটু ঘাবড়ে গেছে—মধুসূদন। আরে কিছু হলেই বা দোষ দোব নাকি তোমায়! 

মধু উঠে দাঁড়িয়ে লাথি মেরে চেয়ারটাকে সরিয়ে দিতে মহিম অবাক হয়ে দেখছে ওকে।

মহিম বলে, কি হল, খাওয়া ফেলে উঠলে যে? 

মধু কঠিন স্বরে বলে-তোমার এখানে মদ-মাংস খেতে আসিনি পেসিডেন। লেখার ব্যাপার নিয়ে ওসব কথা কোনোদিন বোলো না। ভালো হবে না। লম্বা লম্বা পা ফেলে মধু অন্ধকারে হনহন করে বের হয়ে গেল। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *