অমানুষ – ৪

ভাই-বোনের সংসারের সেই নীরব একটা ছন্দ ঠিকমতোই রয়ে গেছে। অশ্বিনীবাবু অবশ্য বোনের বিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। লেখাই রাজি হয়নি। তার মনের অতলে একটা স্বাতন্ত্র্য রয়ে গেছে। তাই বোধহয় অন্য কাউকে মেনে নিতে পারেনি। 

আরও বলেছিল লেখা—তোমাকে ফেলে যাব কোথায় দাদা? এই তো শরীর তোমার। বাত, ক্রনিক ব্রংকাইটিস সবই তো ধরিয়েছ। তোমার পেছনে কে থাকবে? 

অশ্বিনীবাবু তবু বলেছেন—তাই বলে নিজের জীবনটাকেই বরবাদ করবি? 

হাসে লেখা—বরবাদ কই? বেশ তো আছি! স্কুল, ডাক্তারখানা—সব কিছু নিয়ে বেশ আছি দাদা। এখান থেকে কোথাও আমি যেতে চাই না। 

লেখা তবু পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকে। ভোরবেলাতে বেশ কিছু সময় ওরই পেছনে যায়। কী পুজো তা জানেন না। অশ্বিনীবাবু, তবে দেখেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আরও অনেকের ছবি আছে। তাঁদের সামনে বসে চোখ-বুজে জপ-তপ করে লেখা। সে বলে, ওতে মনের জোর বাড়ে। 

লেখার জীবনে ওগুলোও যেন একটা অবলম্বন। সব নিয়ে সে দিনের সময়টুকু ভরিয়ে রেখেছে। 

রাত হয়ে গেছে। সারা বাড়ি নিঃঝুম। ভুবনবাবুরা ফিরে গেছেন। অশ্বিনীবাবুও খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছেন। লেখার সারাদিনের পর একটুকু অবকাশ মেলে। 

মধুর কথা মনে পড়ে। আগেকার দেখা, চেনা সেই কিশোরটি আজ আমূল বদলে গেছে কী প্রচণ্ড আঘাতে। 

লেখার কৈশোরের দিনগুলোও মনে পড়ে। এমনি কলকল্লোল-মুখর পরিবেশ, এমনি তারা-জ্বলা রাত্রি সব মিলিয়ে লেখার মনে সেই স্মৃতিগুলো ভিড় করে আসে। একটি ভালো লাগার স্মৃতি। লেখা আর মধু আগে তারাও স্বপ্ন দেখেছিল দুজনে। আজ সেই স্বপ্ন কোথায় নিঃশেষে হারিয়ে গেছে। 

.

রাতের অন্ধকারে ভুবনবাবু মধুসূদনকে নিয়ে থানায় ফিরেছেন। মধু বারান্দায় উঠে জামাটা খুলতে যাবে—ভুবনবাবু শুধোন—কী হবে? 

মধু বলে—চাবকাবেন না? ওটাই তো আপনার অনলি মেডিসিন। 

ভুবনবাবু ওর দিকে তাকালেন। মধু একটু অবাক হয়। ভুবনবাবু বলেন, 

—বসো, কথা আছে তোমার সঙ্গে। 

—কথা বলবেন? আমার সঙ্গে? ততক্ষণে ওপাশে প্লেটে মাংস-রুটি এসে গেছে। বলেন ভুবনবাবু, 

—খেয়ে নাও। আমি বাসা থেকে আসছি। 

ভুবনবাবু ভেতরে চলে গেলেন। মধুর সব ভাবনাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যায়। ভুবনবাবু যেন বিচিত্র একটি মানুষ। 

.

সারা বসতে নেমেছে রাত্রির জমাট অন্ধকার। কুয়াশার পুরু পর্দাটা ভারী হয়ে ওঠে। বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মত্ত-নদীর গর্জন। 

লেখা এই পরিবেশকে চেনে। মধুসূদন যেন এই বন্য আদিম রাত্রির আরণ্যক বিভীষিকাময় একটি জীব। ওরা তাকে বদলাতে চেষ্টা করছে। 

লেখার হাসি পায়। জানে মধুসূদন অমনিই থাকবে। 

ঠাণ্ডা পড়লে অশ্বিনী ডাক্তারের বাতের ব্যথাট চাগিয়ে ওঠে। তিনিও খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছেন। রাতের অন্ধকারে লেখার ঘুম আসে না। এমনি রাত-নির্জনে নিজের কথাগুলো মনে ভিড় করে আসে। একক, অবচেতন মনকে লেখা শুধু কাজ আর সেবার কাঠিন্য দিয়ে চেপে রেখেছে। 

আশপাশে দেখেছে সেই বঞ্চনা। তার মনে হয় ভুবন দারোগা জানে না মধুসূদনের সব কথা। নিজের অজ্ঞাতেই লেখার কঠিন মনে রাতের অন্ধকার ভুলে-যাওয়া ঘটনাগুলোকে সারবন্দি করে তার মনে এনেছে। সেগুলোকে মনে করতে চায় না সে। 

নিজের জীবন আজ ভিন্ন পথে নিয়ে চলেছে লেখা। ওই সমস্যা, প্রশ্নের কথা সে ভাবতে চায় না। ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া আসছে জানলার ফাঁক দিয়ে। লেখার ক্লান্ত দেহ-মন বিশ্ৰাম চায়। ঘুম নামে তার চোখের পাতায়–নিবিড় ঘুম।

.

ভুবনবাবু মধুর সম্বন্ধে ভেবেছেন। বোঝাতে চেষ্টা করেন তাকে—একটু ভালোভাবে থাকতে চেষ্টা করো। ঠিকদারিই করো। আমিও বলেছি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে। আমতলির ওদিকে বাঁধে কাজ হবে, নতুন আবাদে। এখানের জমিদার ছিলে–হোক না শরিকান সম্পত্তি। তবু তো জমিদার ছিলে! আর আজ যদি এমনি মাতলামি-গুণ্ডামি করে বেড়াও, লোকে কি বলবে? 

মধুসূদন কী ভাবছে। তার কাছে ভুবনবাবুর কথাগুলো একটু বিচিত্র ঠেকে। অনেক দারোগা দেখেছে সে। তারা এতদিন তার সঙ্গে যা ব্যবহার করেছে, সেটা অত্যন্ত বেদনাদায়কই। হুমকি দিয়ে শাসন করবার চেষ্টা করেছে। দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে তাকে। 

আগেকার একজন দারোগা তাকে ফৌজদারি কেসে জড়িয়ে মাসকয়েক জেলবাস করিয়েও ছেড়েছে। সেই যন্ত্রণাগুলোকে সে ভোলেনি। তার মনের অতলে আছে একটা কাঠিন্য, বাধা পেলে সে দুর্বার হয়ে ওঠে। 

তাই মধুসূদন ওদের সেই শাসনকে তুচ্ছ করেছে বারবার, আর তার এই দস্যিপনা বেড়ে গেছে। তার কাছে মনে হয়েছে মদটাই সবচেয়ে বড়ো জিনিস—আর মদ খেলেই তার মাথার পোকাগুলো নড়ে ওঠে। সারা রক্তে নেশা জাগে। সজীব মাংসের নেশা। এ-ছাড়া কোনো কাজেই সে লাগেনি। ওদের ঘৃণা কুড়িয়ে বেঁচে থাকাটা তার সত্যি ভালো লাগে না। মনের অতলে ঝড় ওঠে। সেই যন্ত্রণাটাকে ভোলবার জন্যই সে নেশা করে। এই দাপট দেখিয়ে ওদের সেই অবহেলাটাকে জয় করবার বৃথা চেষ্টাই করেছে। অবশ্য কিছুই এসে যায় না মধুসূদনের। সব কিছুকে অগ্রাহ্য করতে চায় মধুসূদন। 

ভুবনবাবু বলেন—কথাটা তাহলে ভেবে দেখো। 

.

রাত নেমেছে। 

মধুসূদনকে নিয়ে ব্যাপারটা অনেকদূরে গড়িয়েছে বলেই বোধহয়। পদা আর যতিলাল দুজনে হাট থেকে খবর পেয়েছে। গদাই পানওয়ালা জানায়, 

—তোদের গুরুকে এইবার বেন্দাবন দেখাচ্ছে ভুবন দারোগা। 

ওরাও ভাবনায় পড়ে। তাই এদিক-ওদিক ঘুরে গুরুর খোঁজ না পেয়ে এইখানেই এসেছে। পদা বলে, 

—গুরুর গায়ে হাত দিলে জান খেয়ে লিব মাইরি। আমরা কি মরে গেছি র‍্যা? 

চল তো— 

দুই মূর্তি অন্ধকারেই থানার দিকে এগিয়ে যায়। থানার কাছে গিয়ে থামল ওরা। যতিলাল অন্ধকারে উঁকি দিয়ে দেখতে থাকে। 

—কে! কে ওখানে? 

ভুবনবাবু অন্ধকারে ছায়ামূর্তি দুটোকে দেখে হাঁক পাড়েন। মধুও দেখেছে ওই দুটি প্রাণীকে। তাই বলে, 

—আমারই লোক ওরা। কই রে পদা 

ওরা দুজনে এগিয়ে আসে। জুল জুল করে তাকাচ্ছে নিরীহ গোবেচারি দুটি প্রাণী। 

ওদের দেখে মধু বলে—তা’হলে চলি দারোগাবাবু! 

ভুবনবাবু বলেন—ওই কথাই রইল। চিঠি দিয়ে দোব, কাল সকালেই চলে যাও বসিরহাটে। 

.

পদা, যতিলালও অবাক হয়। থানার বাইরে এসে ওরা শুধোয়, ভুবন দারোগা মাংস খাওয়াল, ব্যাপার কি গুরু? 

মধুর কাছে সব ভাবনাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যায়। ও বলে—তাই তো দেখলাম। বুঝলি পদা, ভাবছি কাজ-কম্মোর ধান্দাই দেখব এবার। সবাই বলছে দেখি একবার চেষ্টা করে। 

পদা বলে,–দ্যাখো, তবে শ্লা ধাতে টিকবে তো? 

—দেখতে হবে। কালই যাব ভাবছি। দেখি একবার! বুঝলি, ধনেখালিও একঘেয়ে লাগছে। সবাই বলে ভালো হ! ধ্যাত্তেরি, সুনীতিসুধা শুনে শুনে কান-পচে গেল। তাই ভাবছি চল বাদাবনের ধারে। দেখা যাক সেখানেই কী হওয়া যায়। 

.

ওরা তিনজনেই এসেছে শহরে। মধুসূদনের চেহারাটা ভদ্রই। এখনও এত অত্যাচারের পরও পোশাক পরলে তাকে বড়োঘরের ছেলে বলেই মনে হয়। 

ভুবনবাবুর চিঠিখানা নিয়ে ইরিগেশন অফিসে যেতে অফিসার ভদ্রলোক চেয়ারটা দেখিয়ে দেন, 

—বসুন! ভুবনবাবুর কাছে আপনার কথা সব শুনেছি। চা খান— 

মধু কিছু বলবার আগেই চা এসে যায়। মধুর ব্যাপারটা স্বতন্ত্র ঠেকে। তরুণ ইঞ্জিনিয়ার বলেন—আমরাও কাজ করতে চাই। শুনেছি আগে অনেক কিছুই চলত এখানে, আর তাঁর ফল ভোগ করত ওই গরিব চাষিরা। ভেড়ির চিহ্নই থাকত না তুফানের জলে। আজ তাই আমরাও কাজ চাই মধুবাবু। আপনিই পারবেন, এখানকার মানুষ। 

মধুসূদন অবাক হয়, 

—এসব কথা ঠিক সত্যি বলছেন তো স্যার? ওই আসল কাজের কথা! না পাঁয়তারা কষছেন মাইরি? 

ভদ্রলোক রাগলেন না, উলটে হো-হো করে হেসে ওঠেন। মধু অবাক হয়। দু-একজন ওভারসিয়ার, কনট্রাক্টারও আছেন। ভদ্রলোক ওঁদের কাজের নির্দেশ দিয়ে চলেছেন সামনের বিরাট ম্যাপে লাল-নীল পেন্সিলের দাগ এঁকে। মধু দেখে ভদ্রলোক ওসব এলাকা ঘুরেছেন। 

তিনি বলেন, 

—না, না। ঠিকই বলছি। পার্ট কাজ করুন, আমি দেখতে যাব, সেইটার বিল পেমেন্ট হয়ে যাবে। আবার কাজ করুন। আমরা কাজ চাই, সে কাজের লোক কই? 

মধু বলে—ঠিক আছে। কাজ করব। 

ও যেন বুকে বল-ভরসা পায়। ওর মনের মধ্যে একটা সতেজ ভাব জেগে ওঠে ও দেখিয়ে দেবে সে-ও কাজ করতে পারে। 

অফিসার ভদ্রলোক ওর কঠিন তেজদৃপ্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনে হয় এ পারবে ওই কাজ করতে। একজনও যদি ঠিকমতো কাজ করে, অন্য ঠিকাদারদের তাহলে সেইমতো কাজ করতে হবে। তাই বলেন—করুন! আমাদেরও সব সাহায্য নিশ্চয়ই পাবেন। বিনুবাবু, এঁকে আমতলির দিকে কাজটাই দেবার ব্যবস্থা করুন। কাগজপত্র সই-সাবুদ করে যান। আর কাজ শুরু করার প্রথম মাসেই পার্ট পেমেন্ট নেবেন। তবে বর্ষার আগেই— 

মধু বলে ওঠে—তা জানি স্যার! বাঁধ আপনার বর্ষার আগেই হয়ে যাবে, যদি আপনাদের ওই ওভারসিয়ারের দল বেগড়বাই না করে। আর ওদেরও বলে দেবেন, যেন মধু চৌধুরীর পেছনে না লাগে—ব্যস! কাজ বাজিয়ে নেবেন। এই বর্ষাতেই ওখানে চাষ-আবাদও শুরু হয়ে যাবে। বলে দেবেন ওদের। 

ভদ্রলোক তাকিয়ে দেখছেন মধুকে। মনে হয় কঠিন দুর্বার একটি মানুষ। বাদাবনের সব কাঠিন্য দিয়ে ও তৈরি, তাই ওই পরিবেশে ওর মতো লোকই কাজ করতে পারবে। ভদ্রলোক বলেন, 

—আপনি কথা দিলে তা রাখতে পারবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। 

মধুসূদন নিজেকে আজ নতুন করে চিনছে। সই-সাবুদ করে খুশি মনে বের হয়ে এল সে। তখন দুপুর হয়ে গেছে। 

বাইরে অপেক্ষা করছিল তার বিশ্বস্ত দুজন অনুচর। পদা আর যতিলাল, ওরা এতদিন মধুসূদনের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে দুস্তর গাঙ পাড়ি দিয়ে টানা-মালের কারবার করেছে। কঠিন সাহসী দুটো মানুষ। মধুকে দেখে ওরা এগিয়ে আসে—কি হল গুরু? 

মধু বলে—এবার আর অকাজ নয়, শালারা কাজ চাপিয়ে দিল ঘাড়ে। বলে, ঘুষ-ঘাষ লাগবে না আর, কাজ করুন। আমতলির নতুন আবাদের ভেড়ি পত্তন করতে হবে, টাকার জন্য ভাবনা নেই। 

—মাইরি! পদা লাফিয়ে ওঠে। 

ওরাও যেন কাজ করে ভালোভাবে বাঁচতে চেয়েছিল। টানা মালের কারবার করা এখন বিপদের হয়ে উঠেছে। সেদিন পুলিশের লঞ্চ থেকে গুলি খেতে খেতে বেঁচে এসেছে। শুধু পুলিশই নয়, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সও এখন কড়া হয়ে উঠেছে। যতিলাল মধুর পায়ের ওপর বসে পড়ে বলে—পায়ের ধুলো দাও, গুরু। এবার দেখিয়ে দোব কাজ কাকে বলে! তবে গুরু, ফেরার পথে একটু মাল-টালের ব্যবস্থা করো মাইরি। 

হাসে মধুসূদন—কাজ করবি, মাল খেলে যে কাজের ক্ষতি হবে বাবা। 

—কোন শ্লা বলে উ-কথা? যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না গুরু? মাল আর কাজ দুটোকে এক করে লুবো দেখবা। 

পদা আমতা আমতা করে, সাহস করে কথাটা বলতে পারেনি সে। তবে দু-এক ঢোঁক হলে তার আপত্তি নেই। তাই বলে, 

—তাছাড়া শুভ কাজের মুখপাতে ওটার দরকার যি গো! 

নখালির গঞ্জে হাওয়ায় খবরটা ভেসে ওঠে। মহিমবাবুর মুহুরিই খবরটা পৌঁছে দিয়েছে আগেকার লঞ্চে গিয়ে। পারঘাটার ওপরই খালের ধারে মহিমবাবুর গুদামের ওপাশে সাজানো বাংলোয় ওদের আড্ডা জমে মাঝে মাঝে। ছোট্ট ধনেখালির মধ্যে আড্ডা বসার জায়গা কম। তাই এখানেই জমা হয় ওরা বিকালের দিকে। 

বাঁধের ধারে রেইন্ট্রি গাছগুলোয় বিকেলের সোনা-হলুদ আলোর আভা পড়ে। 

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ওদের পাতাগুলো বুজে আসে যেন এক ব্যর্থ কান্নার রেশ নিয়ে, বাতাসে ছড়িয়ে থাকে তখনও শিরীষ ফুলের মিষ্টি-উদাস গন্ধ। 

মহিমবাবুর ওখানেই অশ্বিনী ডাক্তার, ব্লক অফিসার আরও দু-একজন এসে বসেছেন। বিকেল নামছে। আজ হাটের কলরব নেই। দু-চারজন লোক যাতায়াত করে। গাঙের ঘাটে নৌকোর ভিড় নেই। এক একটা মাছ ধরার নৌকো যাতায়াত করে মাত্র 

মহিমবাবুই বলে—মুহুরি ফিরে এসেছে বসিরহাট থেকে, সে-ই বলল কথাটা। মধুসূদন নাকি কাজ নিয়েছে, আমতলির ভেড়ির কাজ 

অশ্বিনী ডাক্তার চুপ করে কী ভাবছেন। মহিম ওই খবরে যে খুশি হয়নি তা তার কথাতেই বোঝা যায়। ব্লক অফিসার বলেন—নিলে বটে, তবে করবে কি? পারবে কাজ তুলতে? 

মহিমবাবুও জানে সে কথাটা। তবুও দেখাতে চায় যেন মধুর সেই-ই হিতাকাঙ্ক্ষী। মহিমবাবু বলে—তা পারবে হয়তো! 

ভুবনবাবুকে আসতে দেখে মহিমবাবুই জানায় কথাটা,—মধুকে তবে আপনিই সযুত করলেন কৌশলে। 

—কেন? 

মহিমবাবু খবরটা দেয়। ভুবনবাবু খুশি হন। তিনিও এইটা চেয়েছিলেন। তাই বলেন,—কাজ দিলে সে-কাজ ও করবেই মহিমবাবু। ওকে যতটুকু চিনেছি তাতে মনে হয়েছে, ও অনেস্ট আর বিশ্বাসী। কোথায় একটা ভুল আর জ্বালা ওর মনে রয়ে গেছে। সেইটা ভাঙতে পারলেই ওর মধ্যেকার আসল মানুষটা বের হয়ে আসবে। 

হাসে মহিমবাবু, 

—দেখা যাক; আপনার তো ওর সম্বন্ধে অনেক আশা। 

ভুবনবাবু বলেন, 

—সেটা অমূলক নয়। দেখবেন, হি উইল বি এ ম্যান। খাঁটি একটা মানুষ। ভুল ধারণা রয়ে গেছে ওর মনে, আমি সেটাকে বদলে দিতে চাই। সমাজের গলদগুলোও মিথ্যে নয়; ও হয়েছে তারই বলি। 

অশ্বিনী ডাক্তার ওঁর কথাগুলো শুনছেন। 

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। ভুবনবাবু বলেন—দেখবেন, ও বদলে যাবে। কাজের লোক হবে, ওর সেই ব্যক্তিত্ব আছে। হি ক্যান কম্যান্ড! 

ঘাটের ধারে লোকজন জমেছে। গাঙের বুকে ঢেউ তুলে সাদা লঞ্চটা ফিরছে বসিরহাটের দিক থেকে। সভ্যজগতের খবর নিয়ে আসছে ও। পাখিগুলো দিন শেষের পড়ন্ত বেলায় কলরব করে চলেছে। 

মহিমবাবু মনে মনে খুশি হয়েছে। তবু মধুসূদন এখান থেকে সরে যাবে। মহিমবাবুরও সাহস বাড়বে। তাকে বাধা দেবার কেউ থাকছে না। 

মহিমবাবু লেখার স্কুলের জন্য কিছু টাকা দিতে চায়, আর ওই টাকাটা সে দেবে লেখার জন্যই। কোথায় একটা চাপাপড়া দুর্বলতা জেগে ওঠে মহিমবাবুর মনে এতদিন সেই কাজটা করতে বেধেছিল ওই মধুসূদনের জন্যই। ও চলে গেলে সেই বাধা আর থাকবে না। মহিমবাবুই হবে এখানকার মুকুটহীন সম্রাট। লেখার দিকেও এগোতে পারবে সে। 

আর ভুবনবাবু খুশি হয়েছেন। তবু একটা সমস্যার সমাধান হবে। তাই বলেন তিনি—কাজ ও করবেই। আর দেখবেন, ভালোভাবে কাজ করবে ও। 

মহিমবাবু বলে—আপনার কথা কতদূর ফলে দেখি! 

লঞ্চটা থেমেছে ঘাটে। লোকজন নামছে। গদাইয়ের পানের দোকানের সামনে কাদের দেখে চমকে ওঠেন ভুবনবাবু 

তিনমূর্তি নেমেছে লঞ্চ থেকে। টলছে তিনজনে, যে কোনো মুহূর্তে ছিটকে পড়বে ভেড়ি থেকে গাঙের জলে। জড়িত কণ্ঠে গান গাইছে মধুসূদন, জামায় পানের পিকের লাল দাগ। হাত দিয়ে শূন্যপথে কী ধরবার বৃথা চেষ্টা করছে আর গান গাইছে—দেখা হইল না রে সই, নতুন 

বয়স কালে। 

মহিমবাবু বলে ওঠে—ওই যে ভুবনবাবু, আপনার কাজের লোকদের নমুনা দেখুন! ভুবনবাবু চমকে উঠেছেন ওদের দেখে। মধুসূদনও দেখেছে ওঁদের। তাই ওই অবস্থাতেই টলতে টলতে এইদিকে এগিয়ে আসে। অশ্বিনী ডাক্তার গজ গজ করেন—ননসেন্স! হতচ্ছাড়া কোথাকার! 

মহিমবাবু জোর গলায় জানায়,—ওই যে ভুবনবাবু, আপনার আইডিয়াল কাজের লোকদের হালখানা চিনে রাখুন। ওইটিই ওদের আসল পরিচয়। 

ভুবনবাবু অবাক হন। পদা আর যতিলাল টলতে টলতে এগিয়ে আসে ভেড়ির ওপর। তাদের দুটোকে ধরে মাঝখানে মধুসূদন, তারও তখন তুরীয় অবস্থা। এগিয়ে এসে দুটো হাত এক করবার চেষ্টা করে বলে—নমস্কার দারোগাবাবু, পেসিডেনমশাই। শালারা বলে কী না কাজ করতে হবে! অনেস্ট ওয়ার্ক। গছিয়ে দিলে মাইরি কাজটা। এখন যাও শালা বাদাবনের ধারে বসে গেড়ি বাঁধোগে। ঝুট ঝামেলা! বুঝলেন দারোগাবাবু, শ্লা মধুসূদনকে খুব ফেরে ফেলেছেন মাইরি। ভালো হওয়ার ঠ্যালা অনেক। অ্যাই পদা, টলবি না বানচোত। বুঝলেন ডাক্তারবাবু, পদা আর যতে শার পেটে দু-ঢোক পড়লেই ব্যস—আউট। আমি শ্লা কিলিন দু-বোতল ষাট ডিগ্রি কালিমাৰ্কা মেরে দেখুন, ঠিক আছে। পথটা কোনদিকে রে বাবা? সব যে খাল আর ডোবা, যাচ্চলে! ভুবনবাবু তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে অবাক হন। কাজের নমুনা যা দেখেছেন আজ, তাতে ঘাবড়ে গেছেন তিনি। 

মধু বলে—কিছু ভাববেন না। হবে ভেড়ি, ঠিক হয়ে যাবে। কালই চলে যাচ্ছি লোকজন নিয়ে। অ্যাই যতে, ঠিক হয়ে চল। কাল দেখা হবে স্যার। নমস্কার— 

ওরা চলে গেল। 

ভুবনবাবু বলেন—কী ব্যাপার হে? ভরাডুবি করে দেবে নাকি মদ গিলে! 

মহিমবাবু হাসছে। ও চেয়েছিল শুধু মধুকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে। মধু ঠিকেদারির কাজে নাম করুক, তা সে চায়নি। তাতে মহিমবাবুরই ক্ষতি হবে বেশি। ভালো কাজ দেখালে অন্য কাজগুলোও তার হাত-ছাড়া হয়ে যাবে। তাই মধুসূদনের এই ব্যাপারে সে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে। তবু আশ্বাস দেয় কৃত্রিম সহানুভূতির সঙ্গে—ও সব ঠিক হয়ে যাবে। নেশা কমালেই মধু কাজ করতে পারবে। 

মধুসূদন একা ফিরছে বাড়ির দিকে। তখনও মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে। পথে কয়েকটা কাজ সারতে দেরি হয়ে যায়। 

আজ মনে হয় ধনেখালির এই গঞ্জ, ওই হাটতলা, পারঘাটা সবই কেমন সুন্দর। সে এই জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে আছে। এই ধনেখালি থেকে বেশ কয়েক মাসের মতোই চলে যেতে হবে। তাই বোধহয় আজ এখানের সব কিছুই ভালো লাগে। 

ডাক্তারখানার পাশ দিয়ে চলেছে, খোলা জানলা থেকে একফালি আলো এসে পড়েছে রাস্তার ওপর, কাকে দেখে দাঁড়াল মধুসূদন। 

লেখা বাইরের দিকে এসেছিল। এই আবছা অন্ধকারে সে-ও মধূসূদনকে এখানে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনে যাবার পথ নেই, মধুসূদন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। 

লেখা অস্পষ্ট আলোয় ওর দিকে তাকাল। মুখ-চোখ ওর থমথমে, চোখদুটো সর্বদাই লালচে হয়ে থাকে মধুর, গায়ে নিশ্বাসে বিশ্রী টক-টক মোদো গন্ধ। সর্বদাই নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে লোকটা। তাই তাকে ঘৃণা করে লেখা। 

একদিন অতীতে এমনি জানোয়ার সে ছিল না। লেখা তখনও চিনত মধুসূদনকে। কাছারিবাড়ির তখন বোলবোলাও খুব। চারিদিকে তাদের নামডাক। সারবন্দি ধানের গোলা—তারই আড়ালে তারা লুকোচুরি খেলত! 

সেই কিশোর মধুসূদনকে চিনত লেখা। দুজনে কোনো কোনোদিন হাটতলার নিজের গাঙ দিয়ে নৌকো বেয়ে যেত। কালো নিথর গাঙের জলে সন্ধ্যা নামত, তারাগুলো দোল খেত সেই জলে। ভয় করত লেখার। 

—ফিরে চল মধু। ফিসফিসিয়ে উঠত সে। 

মধু হাসত—বড়ো গাঙে যাব। বুঝলি ছোটো গাঙ থেকে বড়ো গাঙ, তারপর বাদাবন পার হয়ে সাগরে যেতে ইচ্ছে করে। 

চমকে উঠত লেখা,—অ্যাই! কোনোদিন আর তা’লে আসব না তোর সঙ্গে। মধু লক্ষ্মীটি, ফিরে চল। দাদা বকবে— 

মধু সেদিন কিশোরী একটি মেয়ের কালো ডাগর চোখে সেই ভয়ের ছায়াটুকু দেখে মজা পেত। ব্যাকুল হয়ে উঠত লেখা। 

—মধু! 

কত দিন কত সন্ধ্যার স্মৃতি কিশোর-জীবনের দিনগুলোকে ভরিয়ে রেখেছে। সেই সুন্দর ছবিটাকে কে যেন আজ কালি ঢেলে ধেবড়ে বিকৃত করে দিয়েছে। আজকের দিনের ওর এই কদর্য রূপটাকে ঘৃণা করে লেখা। মধুসূদন যেন কী প্রচণ্ড আঘাত আর জ্বালায় ধীরে ধীরে এমনি জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। ওকে দেখে দাঁড়াল মধু। বলে—চিনতেই পারছ না মাইরি? 

লেখা জবাব দেয়,—চিনে দরকার নেই। রাত হয়েছে, বাড়ি যাও। নিজেকে যা করে তুলেছ, তাতে অপরে কেন, তুমি নিজেই নিজেকে আর চিনতে পারবে না। 

মধুসূদন ওর দিকে তাকাল। ওর সম্বন্ধে লোকের মনের এই ধারণাটার কথা উঠলেই রেগে ওঠে সে। লেখার কথায় রেগেছে, তবু রাগটাকে চেপে বলে, 

—চলে যাচ্ছি ধনেখালি থেকে। আবাদের নীচেকার বাদাবনে গিয়ে থাকব। 

লেখা জবাব দেয়,–সেইখানেই থেকো। বাদাবনেই থাকা মানায় তোমার। এখানে নয়।

মধুসূদন হয়তো ভেবেছিল ওর কাছে একটু সহানুভূতি, এতটুকু দরদ পাবে সে। তার অবচেতন মন এত নরকের মধ্যে থেকেও একজনের সম্বন্ধে অন্য ধারণা পোষণ করেছিল। কিন্তু লেখার কথায় একটু হতাশই হয়েছে সে। 

চটে ওঠে। দুনিয়ার কোথাও তার পাবার এতটুকু ঠাঁই নেই। জেনেশুনেও মধুসূদনের লোভী মন হয়তো ভুল করেই কিছু পেতে চেয়েছিল। ওর কথায় জবাব দেয় সে—এখানে দ্যাবতা-দেবীদের লীলাখেলা চলছে, চলুক। আমি শ্লা অসুর কিনা, থাকলে মজা মারার সুবিধে হচ্ছিল না, তাই বিদেয় কর বানচোতকে। ঠিক আছে, চালাও পানসি! শুধু দেখে যাই বাবা। 

মধুর নেশাটা চটে গিয়েছিল ঠাণ্ডা হাওয়ায় আর হঠাৎ মনের সেই স্বাভাবিক অবস্থায় এসে পড়েছে। তাতে দুঃখই বেড়েছে। ওসব কিছু সে ভুলতে চায়। তাই পকেট থেকে মদের ছোটো বোতলটা বার করে গলায় ঢালতে থাকে। 

—পথ ছাড়! লেখা ওকে কঠিন স্বরে ধমকায়। 

মধু বলে—পথ তো ছেড়েই দিয়েছি বাবা। পথের ধারে দাঁড়িয়ে একটু গলা ভেজাব, তাই সইবে না? তোমার সুনীতি-সুধার চেয়ে এই বিপিনবাবুর কারণ-সুধার ধার অনেক বেশি। একটু গিলে দেখবে? চিরকাল তো যৌবনে যোগিনী হয়েই রয়েছে; যমরাজকে গিয়ে কি জবাব দেবে, অ্যাঁ? চলি, আবার ‘অ্যাংরি’ হচ্ছো কিনা! 

মধু টলতে টলতে চলে গেল। জড়িত কণ্ঠে সে গাইছে : 

জীবন আমার বিফলে গেল 
কোনও কাজেই লাগল না গো… 
লেখা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। 

মধুসূদনের সেই বেসুরো গলার গান ভেসে আসে। লোকটাকে ঘৃণা তো করেই লেখা, বিজাতীয় ঘৃণা। তবু মনে হয় একদিন সত্যিই অনেক সুন্দর ছিল সে। সব কী এক বেদনার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। 

.

লেখা বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। জমি থেকে বেশ কয়েক ধাপ উঁচুতে কাঠের মাচামতো করা বারান্দা। সামনে মহিমবাবুকে অন্ধকার থেকে বের হয়ে এগিয়ে আসতে দেখে লেখা একটু অবাক হয়। লোকটাকে অনেকদিন থেকেই চেনে সে। আজ হঠাৎ ওকে এই সময় আসতে দেখে অবাক হয়েছে সে। 

দেখেছে ধাপে ধাপে কোনখান থেকে কোথায় এসে উঠেছে। লোভী—ধূর্ত মানুষটার চাহনিতে লোভ আর ক্ষুধা। লেখা ওকে এড়াবার জন্যই বলে—দাদা একটু আগে এসে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ছেন! কাল সকালে বরং আসবেন। 

মহিম ঘোষাল হাসল মাত্র। ওই হাসিটুকুতে ফুটে ওঠে মনের ভেতরের কদর্য লোভী রূপটা লেখার মনে হয় মধুসূদনকে তবু চেনা যায়, কিন্তু মহিমবাবু তার চেয়েও ভয়ানক, তার চেয়েও কৌশলী আর হিংস্র। 

মহিমবাবু বলে—তোমার কাছেই এসেছিলাম লেখা। মানে—তোমার সঙ্গেই কথা ছিল!

-–কেন? লেখা একটু অবাক হয়। ওর মুখে-চোখে কাঠিন্য ফুটে ওঠে। 

মহিমবাবু বলে—ডাক্তারখানা আর স্কুলের কথাটা ভেবে দেখলাম লেখা, যদি কিছু টাকা দেওয়া যায়—ভালোই চলবে। কথাটা বলব ভাবছিলাম। আমিও চাই—তুমি আমি দুজনে স্কুলটা গড়ে তুলি। 

লেখা জবাব দেয়—রাত হয়ে গেছে। এখন ওসব কথা আলোচনা করার সময় হবে না। পরে একদিন আসবেন, দাদার সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন ও বিষয়ে 

লেখা আর দাঁড়াল না। ওর মুখের ওপর কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে চলে গেল বারান্দা পার হয়ে ওপাশের ঘরে। ওর দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে আসে। 

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মহিম ঘোষাল হাসছে। ও জানে মধুসূদনও চলে যাচ্ছে এখান থেকে। মহিম ঘোষালের চারে ও মাছ আসবেই। আর কী করে খেলিয়ে তাকে তুলতে হবে—সেটা মহিমের জানা আছে। 

.

টর্চের একফালি আলো জ্বেলে মহিম ওর বাংলোর দিকে এগোল। বাদাবনের কাছাকাছি অঞ্চল, সাপখোপের ভয়ও আছে। সাবধানী মহিম ঘোষাল চলেছে ওই অন্ধকারে। বাতাসে ওঠে জোয়ার-মত্ত নদীর কলোচ্ছ্বাস। বন্য আদিম প্রকৃতি যেন ফুঁসছে, গজরাচ্ছে এই ঘুমন্ত জনবসতের আকাশে-বাতাসে। 

মধুসূদন স্কুলের দিক থেকে আসছে অন্ধকারে। কালই চলে যাচ্ছে, তাই কিছু জিনিসপত্তর গস্ত করে নৌকোয় তোলার ব্যবস্থা করে ফিরছে। হঠাৎ টর্চের আলো দেখে দাঁড়াল। মহিমবাবু ডাক্তারখানার দিক থেকে ফিরছে। আবছা আলোয় দেখা যায়, ও যেন লেখার সঙ্গে কী কথা বলতে গিয়েছিল। 

মধুর নেশা ছুটে গেছে। নেশা করলেও তার জ্ঞান হারায় না। তাই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওর কথাগুলো শুনছে সে। 

মহিমবাবুর এই নজর দোষের কথা সে জানত, কিন্তু ও এসেছে লেখার কাছে টাকার লোভ দেখাতে। 

লেখাও তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারেই হাসি আসে মধুর। বোদা মুখ করে মহিম ঘোষাল সরে আসছে। 

তার আগেই মধুসূদন বের হয়ে এসেছে পথের ওপর। অন্ধকারে মহিমকে দেখে দাঁড়াল সে।

—অ্যাই যে মহিমবাবু, এদিকে? 

মহিমবাবু চমকে উঠেছে ওর সামনে পড়ে। মধুর কথায় বলে—একটু কাজে এসেছিলাম।

—তা বেশ! মধু চৌধুরী রাত-বিরেতে ছোঁ-ছোঁ করে বেড়ায় সব শ্লা-ই জানে, আপনাদের মতো লোকের অবশ্যি সেসব দোষ নেই। কী বলেন? 

মহিম ওর সেই ভয়টাকে চেপে হাসবার চেষ্টা করে। ওসব কথা এড়াবার জন্যই বলে, – মন দিয়ে এইবার কাজ-কর্ম করো হে। ভালো চান্স পেয়েছ শুনলাম। 

মধু ওর দিকে চাইল। ঠাণ্ডায় কেমন গলাটা শুকিয়ে আসছে। শীতও লাগছে। 

মধু কঠিন চাপা স্বরে জানায়,—যাচ্ছি বটে, তবে তোমার উপরও নজর রাখার ব্যবস্থা করব মহিম। বেগড়বাই দেখলে- 

মহিম অন্ধকারে ঘাবড়ে গেছে। তাই হাসবার চেষ্টা করে—আরে কী যে বলো। চলো চলো, কতদিন থাকবে না—একটু আমার ওখান হয়ে যাবে। 

মহিম মধুকে চটাতে সাহস করে না। তবু ব্যাপারটা সহজ করার জন্য ওর সঙ্গে চলেছে। মহিমবাবু আর মধুসূদন ফিরছে বাড়ির দিকে। মধুসূদনের শূন্যপ্রায় বাড়িটায় ফিরে যেতে মন চায় না। রাত অনেক হয়ে গেছে। জলো-হাওয়ায় রাতের কুয়াশা মিশেছে। নদীর বুকে ঝাপসা ওই কুয়াশার আবরণ ঢেকে দিয়েছে সব কিছুকে। শিরীষ গাছের পাতা থেকে শিশির জমা জলকণা ওদের গায়ে পড়ছে, কন কন করে ওঠে। 

মধুসূদন বলে—খুব তো হিতোপদেশ দিলেন পেসিডেনমশাই, ঘরে মাল-টাল আছে? দ্যান না দু-ঢোক! এমন রংদার নেশাটা’ কোনদিকে ছুটে গেল! 

প্রেসিডেন্টবাবুকে এসব এক-আধটু রাখতে হয়। নিজে কালে-ভবিষ্যে এখন খায় মহিম। কিন্তু লোকজন তো আসে নানা রকমের, ওটা থাকেই। তাই মহিম ঘোষাল বলে—দিচ্ছি চলো। কিন্তু বাপু, হাটে-গঞ্জে ওই গুণ্ডামি বন্ধ কর। ভুবন দারোগাকে কথা দিইছি। তাছাড়া আজই ফৌজদারি কেসে জড়িয়ে তোমাকে চালান দিতে পারত। আমাদের কথায় ছেড়ে দিল। ভালো হও বাপু। কত বড়ো বংশের ছেলে তুমি! 

মধু বিরক্ত হয়ে ওঠে—তত্ত্ব-কথা ছাড় দিকি মাইরি! দুনিয়া যেন রাতারাতি ভালো মানুষের ভিড়ে-ভরে গেল দেখছি! মাল দেবে তো দাও, না-দাও চললাম মাতনের ওখানে। না হয় দেখি কাছাকাছি পাঁচির বাড়িতেই যদি মেলে কিছু। কথা দিয়েছি, ব্যস! দেখব ভালো লাগে ভালো হব, না লাগে যেমন আছি তেমনই থাকব। কারও বাড়া ভাতে ছাই তো দিইনি, অন্যায়ও করিনি। ভালো হও, ভালো হও! আরে বাবা, একি ডাল-ভাত যে গিলে ফেল্লাম কপ করে! বুঝেসুঝে, ভাবে-চিন্তে দেখতে হবে তো? 

.

মধুসূদনের অস্তিত্বটুকু ধনেখালির বুক থেকে মুছে গেছে। কয়েকমাস হল লোকটা বাদাবনের আবাদে গেছে ভেড়ি বাঁধার কাজ নিয়ে। খুশি হয়েছে এখানের অনেকে। 

মহিমবাবুর গোলায় আর বাওয়ালিদের মধ্যে মদ গিলে মারামারিও বাধে না। পারঘাটের ইজারাদার খুদু নস্কর আনমনে হুঁকো টানে, আর মাটির ভাঁড়ে পারানির পয়সা ফেলে। নিরুপদ্রবে দিন কাটছে সবাকার। 

বাওয়ালিদের বউ-ঝিরাও যেন বেঁচেছে। শান্তি পেয়েছে তারা। ওদের মরদরা ঘরে থাকে না। রাতের অন্ধকারে আসত সেই লোকটা মদ গিলে, ওর দু’চোখ লাল, পা-টলমল করে। জড়িত কণ্ঠে দরজায় ধাক্কা দিয়ে খিস্তি করত মধু। 

ওরা ভয়ে কাঁপত। তবু দরজা খুলতে হত। না হলে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে আগুন ও লাগিয়ে দিতে পারে লোকটা। এক-একটি আতঙ্কের রাত পার হত তারা। ওদের সবকিছু যেন ওই মাতাল লোকটা লুট করে নেবার জন্য বুনো জানোয়ারের মতো ঘুরত। 

ওরা শান্তি পেয়েছে। শান্তি নেমেছে এই ধনেখালির জনপদে, এখানকার মানুষের মনে।

কেউ কেউ মধুর জন্য দুঃখও করে। মাতন-বউ মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে মধুসূদনের কথা ভাবে। 

.

অশ্বিনী ডাক্তারও শান্তি পেয়েছেন। এখন মামুলি রোগী ছাড়া আর বিশেষ ঝামেলা নেই। লেখার স্কুল—তার হাসপাতালের কাজকর্মও চলছে। 

সন্ধ্যার পর থানার বারান্দায় আড্ডা জমে। ওঁরা অনেকেই আসেন। মহিমবাবু বলে – খুব চাল চেলেছেন কিন্তু দারোগাবাবু, ছোঁড়াটাকে এত সহজে এখান থেকে হটানো যাবে, তা ভাবিনি। 

ভুবনবাবুর মনে পড়ে মধুসূদনকে। খবরও পান। কাজ-কর্ম মন দিয়ে করাচ্ছে। কুলি, জন-মজুরের অভাব হয় না তার। নিজেই নৌকোয় করে এদিক-এদিক ঘুরে কাজ তদারক করছে। ওর স্বভাবটা যেন খানিকটা বদলেছে। 

ফরেস্ট অফিসার বলেন, 

মধুকে এখান থেকে আর ক-দিন পর সরাবেন স্যার? বর্ষার সময় তো ফিরে আসবে আবার। ততদিনে ও তো ধার-কাছের জঙ্গলের হরিণ আর রাখবে না। 

হাসেন ভুবনবাবু, 

—তা দু-একটা মারবে বইকি! তেমনি একটা বাঘও তো মেরেছে মশাই। নতুন বসতে লোকজন শুনেছি মধুকে ছাড়তে চায় না। 

—যেদিন চিনবে সেদিন আর চাইবে না। মহিমবাবু বলে। 

তবু মনে হয় ধনেখালির জীবনে একটা অঙ্গ-স্তব্ধ হয়ে গেছে। 

অশ্বিনী ডাক্তার বলেন, 

—বদলাতেও পারে। ভালো ঘরের ছেলে তো হাজার হোক। 

অশ্বিনী ডাক্তার মধুসূদনের আগেকার দিনগুলো দেখেছেন, তাই এখনও তিনি ওর সম্বন্ধে আশা রাখেন। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *