অমানুষ – ৩

বেলা হয়ে গেছে। রোগীদের ভিড় কমে এসেছে। অশ্বিনী ডাক্তার এ সময় ওকে ঢুকতে দেখে তাকালেন। একটু আগে পীতাম্বরও ওর হাতেই মার খেয়ে এসেছিল এখানে। এইবার মধুসূদনকে আসতে দেখে অশ্বিনী ডাক্তার একটু অবাক হয়েছেন, 

— তুমি! 

মধুসূদন বসল, অবশ্য অনুমতি না নিয়েই। 

অশ্বিনী ডাক্তার রেগেই ছিলেন পীতাম্বরকে ওভাবে মারতে দেখে। তাই বলেন, – আবার আজ পীতাম্বরকে মেরেছিলে কেন? নাম-মুখ ফাটিয়ে দিয়েছ! 

—শালা সাধু-মহাপুরুষ কিনা…. 

মধুসূদন কী যেন খিস্তি করতে গিয়ে লেখাকে দেখে থামল। নেহাত তাকে খাতির করেই খিস্তিটা আর প্রয়োগ করল না। সে বলে, 

—একটা দিকই দেখলেন স্যার? ব্যাটা পিতে কতখানি শয়তান তা তো জানেন না! অন্যায় করবে সে, আর সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দোষী হলাম আমি? ওরা যা ইচ্ছে তাই করবে! গরিবকে মারবে, তাই ওকে দিলাম ঘা-কয়েক। 

অশ্বিনীবাবু মধুকে দেখেছেন অনেকদিন থেকেই। বেয়াড়া ছেলেটাকে তিনি তবু ঘৃণা করতে পারেন না। ওর জন্য তাঁর মনে কোথায় একটা নীরব সমবেদনাই রয়েছে। দেখেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে মধু। মাঝে মাঝে ওর কাজগুলোকে সমর্থন না করলেও একেবারে মধুকে অবজ্ঞা করেন না অশ্বিনীবাবু। 

তাই আজ মধুকে ওইভাবে চাবুক খেয়ে আসতে দেখে তিনিও অবাক হন—এইভাবে মেরেছেন দারোগাবাবু? কি এমন কাজ করেছিলে? 

মধুসূদনের কাছে পাপ পুণ্যের কোনো সংজ্ঞা নেই, সে ওসব ঠিক বোঝে না। তাই পিঠের জামাটা তুলে সেই রক্তাক্ত ক্ষতটা দেখিয়ে বলে, পাপ-ফাপ জানি না ডাক্তারবাবু, পীতু-মহিমের শয়তানির প্রতিবাদ করার পাপের শাস্তি তো এই? ভুবন দারোগা ভগবান—ব্যস, শাস্তি দিয়েছেন। 

চমকে ওঠেন অশ্বিনীবাবু। লেখাও দেখছিল মধুসূদনকে। বলিষ্ঠ দুর্বার একটি যুবক। ভালোঘরের ছেলে। ওর আত্মীয়-স্বজনরা এখনও বাইরে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত। এককালে জমিদার ছিল এখানকার। কিন্তু মধুসূদন কেমন গোত্রছাড়া। 

লেখা ওকে মনে মনে ঘৃণা করে। তবু ওই মারের দাগটা দেখে শিউরে উঠেছে সে। পিঠে চাবুকের দাগ মাংস কেটে বসেছে, রক্ত পড়ছে। 

মধুসূদনের অবশ্য এসব তেমন বাজে না, রেগে উঠেছে সে এই আঘাতে নয়, অবিচারে। তাই জানায়, 

—দারোগাবাবু ভেবেছেন চরম শাস্তি দিয়েছেন আমাকে। মধু চৌধুরীর এসব গায়ে লাগে না ডাক্তারবাবু, তবে মনে থাকে। 

অশ্বিনী ডাক্তার ওই এই আঘাতে নিজেও কোথায় দুঃখ পেয়েছেন। বলেন তিনি, 

—একটু ওষুধ দিয়ে দিই। লেখা, একটু টিংচার আয়োডিন আর ডেটল দে, আর তুলো। লেখা মুখ-বুজে সেগুলো এনে দিল। মনে মনে যেন খুশি হয়েছে সে। দুষ্টু মানুষের সাজা দেবার সাহস ভুবনবাবুর আছে জেনে খুশি হয়েছে সে। বলে, 

—অন্যায় করলেই শাস্তি পেতে হবে। 

মধু গর্জে ওঠে, 

—যা করেছি সেটা অন্যায় নয়। আর এমন কাজ করার জন্য এতটুকু দুঃখও আমি পাইনি। বেশ করেছি। ভবিষ্যতে এমনি কাজ দরকার হলে আবার করব। থাক ডাক্তারবাবু ঘটা করে আর ওষুধ লাগিয়ে দরকার নেই। তবে জেনে রাখুন, আপনাদের মাপ-কাঠিতে ন্যায়-অন্যায় বিচার আমি করি না। নিজের চোখ দিয়েই আমি দেখি। বিচার করি। 

অশ্বিনীবাবু ওকে সরে দাঁড়াতে দেখে বলেন,–সেকি, ওষুধ লাগাবে না? ঘা-টা বিষিয়ে যেতে পারে যে! 

—যাক। কিছু হবে না আমার। এসব সহ্য-করা অভ্যাস আছে। মানুষ তো নই, জানোয়ার। বাদাবনের বাঘ গুলি খেয়েও বাঁচে, মধুও বাদাবনের জানোয়ার—এতে তার কিছুই হবে না। 

মধুসূদন কথাগুলো মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বের হয়ে এল। 

লেখা তখনও দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। অশ্বিনী ডাক্তার অবাক হয়ে ডানপিটে ছেলেটাকে দেখছেন। তিনি বলেন, 

—তোর এসব কথা বলার দরকার কি ছিল লেখা? 

লেখা জবাব দেয়,—ডাকাতকে ডাকাত বলব না? ওর ঢিট হওয়া দরকার। 

.

মধুসূদন চুপ করে গাঙের ধারে ভেড়িতে বসে আছে। বেলা গড়িয়ে গেছে। খিদে নেই। মনের নীরব জ্বালাটা কমে আসছে, থিতিয়ে আসছে ক্রমশ। বিকেলের আলো নামে শিরীষ গাছের ছায়া পার হয়ে খালের জলে। শান্ত-স্তব্ধ সেই হাটতলা আজ লোকজনের কলরব আর ভিড়ে ভরে গেছে। অন্যদিনের সেই স্তব্ধতা কোথায় হারিয়ে গেছে। খাল বেয়ে ছোটো-বড়ো নৌকো ডিঙি আসছে দূর-দূরান্তর থেকে লোকজন নিয়ে। 

এত লোকের ভিড়ে আজ মধুসূদন ঠিক শামিল হতে পারেনি। সে যেন এই কলরব-কোলাহলের জগৎ থেকে নির্বাসিত। নিজেরই ভালো লাগে না, তাই সরে এসেছে সে। মনের জ্বালাটাকে কমাবার জন্যই পর পর দু-বোতল তাজা মদ গলায় ঢেলেছে। তবুও মনে হয় আর একটু হলে ভালো হত। কী ভেবে একটু মাংসের সন্ধানে হাটের দিকে এগোল মধুসূদন। 

হাট তখন পুরোপুরি জমে উঠেছে। 

আজ এই জায়গাটার রূপ বদলে গেছে। দুপুর থেকে বড়ো বড়ো নৌকোয় করে দোকানিরা আসে। এই আবাদ অঞ্চলের কোন গঞ্জে কবে কোথায় হাট বসে, তাদের জানা। ওরা নৌকোয় মালপত্তর নিয়ে জলপথে এক হাট থেকে অন্য হাটে যাতায়াত করে। 

এককালে এই হাটে ছিল মধুসূদনের কর্তৃত্ব। নিজেও দেখেছে গঞ্জের এই জায়গায় তাদের কাছারি থেকে প্রথম হাটের পত্তন করা হয়। সেদিন এত দোকান-পাট ছিল না। দু’ দশজন ব্যাপারি আসত। তখন বাদাবন ছিল আরও কাছে। রাতের অন্ধকারে কখনো কখনো বন থেকে বের হয়ে আসত বাঘ দু-একটা। 

মধুসূদনই সেবার হাটতলায় গাছাল দিয়ে বসেছিল ওই চটকা গাছে। সেই রাত্রির কথা ভোলেনি। ঝিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে। খেপে উঠেছে ভাদরের গাঙ। ফুলে উঠেছে ওর জলরাশি। সবুজ ধানখেতগুলো অন্ধকারে ডুবে গেছে। দু-চারটে ছনের ঘরের বাসিন্দারা দরজা-কপাট বন্ধ করে ভয়ে ভয়ে রাত কাটাচ্ছে। 

মধুসূদন তখন সবে কৈশোরে পা-দিয়েছে। গোঁফের রেখাও উঠেছে। তখন থেকেই সে এমনি দুরন্ত আর দুঃসাহসী। বৃষ্টির মধ্যে দেখা যায়, আসছে বাঘটা। চঞ্চল ছন্দময় তার গতি, সারা গায়ে জোনাকি পোকাগুলো লেগেছে। বাঘটাকে অন্ধকারে দেখে মনে হয় একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। ওটা সাবধানি পা-ফেলে এগিয়ে আসছে। পারঘাটার টঙের চারিপাশে ঘুরছে বাঘটা। বাতাসে কিসের স্বাদ নিচ্ছে। 

গাছের নীচে সে দাঁড়াল বাঘটা। ওর দু’চোখ নীলাভ দীপ্তিতে জ্বলছে। ওপরের দিকে তাকাতেই মধুসূদন একমুহূর্তও দেরি করেনি। দুই চোখের মধ্যখানে গুলি চালিয়েছিল। একটি গুলিতেই লুটিয়ে পড়েছিল সেই মহারাজ। 

বন কেটে আবাদ পত্তন করেছিল ওরা। তারপর সব চলে গেল, জমিদারিও ফৌত হয়ে গেল। এখন দূরের দুর্গাতলি লাটে তার কিছু খাসজমি মাত্র আছে। এখানে টিকে আছে ওর কাছারি বাড়িটা। 

মধুসূদনকে ওরা ফাঁকি দিয়ে সব নিয়ে নিল। কারবার করার ইচ্ছে ছিল মধুর। ধান-চালের কারবারও করেছিল। কিন্তু ওই মহিম ঘোষালই সেই কারবারকে লাটে তুলেছিল। তার চেয়ে এক আনা বেশি দর দিয়ে ধান কিনেছিল মধু জেদের বশে। কিন্তু দর পড়ে গেল সেবার সরকারি কন্ট্রোলের চাপে, তার ধানও সিজ করে নিয়ে গেল। দাম যা পেল, তাতে মূলধনও উঠল না। 

—শ্লা—জোচ্চোরের দুনিয়া। 

হাটতলার কলরব কানে আসে। স্তব্ধ-আবাদের গঞ্জের রূপ আজ বদলে গেছে। কাকে দেখে দাঁড়াল মধু। 

অশ্বিনী ডাক্তারের বোন লেখা একটা চাকর নিয়ে হাটে আসছে, সে-ও ওকে দেখতে পেয়েছে।

লেখা দাঁড়িয়েছে মধুকে দেখে। 

মনে হয় ওবেলার সেই মারধোরের পর থেকেই ও বোধহয় বাড়িতেও ফেরেনি। পথে পথে না হয় পারঘাটার চালায় বসেছিল। জামা প্যান্টটা ময়লা, ধুলো-বালি লেগে আছে। মাথার চুলগুলো উশকো-খুশকো চোখ-দুটো লালচে। শুধু বোধহয় মদই গিলেছে ও। 

পিঠের সেই আঘাত আর যন্ত্রণা নিয়ে ও পথে পথেই তাড়াখাওয়া জানোয়ারের মতো ঘুরছে। লোকটার জন্য দুঃখও হয় লেখার। ও যেন কেমন হারিয়ে-যাওয়া মানুষ, বুকে কী জ্বালা নিয়ে ফিরছে। 

মধুও দেখেছে ওকে। 

মেয়েটাকে অনেকদিন থেকেই চেনে সে। কিন্তু তার মনে একটা কাঠিন্য রয়ে গেছে, সেই সহজ চেনার পথে ওইটাই প্রধান অন্তরায়। 

লেখা চলে গেল হাটের দিকে। 

মধুসূদন অবশ্য আশা করেনি লেখা তার সঙ্গে কথা বলবে। আজ ওর কথার জন্যই ওষুধও লাগায়নি পিঠের সেই ঘা-গুলোয়। চড়চড় করছে। 

মনে পড়ে সেই জ্বালাটা। মধু বোতলের শেষ তলানিটুকু গলায় ঢেলে খালি বোতলটা টান মেরে খালের জলে ফেলে দিয়ে প্যান্টটা টান করে নিয়ে হাটতলার দিকে এগোল। 

.

এককালে ওদেরই হাট ছিল এটা; আজ সেখানের সে কেউই নয়। চোরের মতো রাতের অন্ধকারে বের হতে হয় এখন মধুকে এখানে। সেই দাপট আর নেই। আজ অনেকেই ওকে দেখছে, মনে হয় মধুর, ওর সেই মারের কথা সবাই জেনেছে। ওরা বোধহয় ভাবে ভুবন দারোগা জব্দ করে দিয়েছে মধু চৌধুরীকে। 

ভুবন দারোগাকে এর জবাব দিতে হবে। ওকে জানিয়ে দেবে মধু, অন্যায় সে করে না; তাকে ভয় দেখিয়ে থামাতে পারবে না ভুবন দারোগা। মধু এখানকারই একজন, সে এখানকার কেউ-কেটা। স্বাধীন লোক সে, মাথা উঁচু করে চলবে। ভুবন দারোগার মতো কারো চাকর সে নয়। 

হাটে-ঢুকে সামনে একজনকে কয়েকটা মুরগি নিয়ে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে যায়। শুধোয় তাকে। 

—কত করে জোড়া রে? ওই দুটোর? 

মুরগি দুটো দেখতে থাকে নাড়াচাড়া করে মধু। 

লোকটা এ-হাটে বেশি আসেনি। ওর সঙ্গে বোধহয় ওর বউ হবে, সেই-ই বলে ওঠে,

—মুরগিগুলোকে ঘাঁটছ কেনে গ! জোড়া লাগবে ছয় টাকা। 

—ছ’টাকা! অবাক হয় মধু,—ধ্যাৎ! 

মুরগি দুটো তুলে নিয়ে সে পকেট থেকে চার টাকা বের করে দিয়ে বলে,

—নাও কর্তা। 

লোকটাও ফস করে নোটগুলো ফেলে দিয়ে ওর হাত থেকে মুরগি দুটো কেড়ে নিয়ে উপদেশ দেয়।

—আর মুরগি খাতি হবে না তোমায়। বুড়ো বক মারি খাও গে, পয়সা লাগবে না। মুরগি খাতি এলেন চার টাকায়, ট্যাকখালির জমিদার রে— 

মধু দপ করে জ্বলে ওঠে। সকাল থেকেই মেজাজটা ভালো নেই। ওই কথা শুনে মধুর সারা দেহের রক্ত মাথায় উঠে যায়, 

—কী বললে? মুখ সামলে কথা বলবে! 

—হ্যাঁ! ঢের দেখা আছে মর্দানি হে! ভারি মরদ তুমি! যাও, যাও বুড়ি ফোলা মারি খাও গে। মুরগি খাতি গেলি পয়সা লাগে। পয়সা নেই, আবার চোপা! 

—খবরদার! 

লোকটাও রুখে উঠেছে। মধু চকিতের মধ্যে ওর মুখেই বসিয়েছে একটা প্রচণ্ড ঘুষি। লোকটা ছিটকে পড়েছে ওপাশে। মেয়েটাও চিৎকার শুরু করেছে। লোকটা পড়ে গিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছে। বাদাবনের মানুষ ওরা, এমনিতেই কঠিন আর মারমুখী পরিবেশে বাস করে থাকে ওরাও মরিয়া হয়ে ওঠে। 

তাই ফস করে একটা ধারালো হাঁসুয়া বের করে এগিয়ে আসে মধুর দিকে। 

স্তব্ধ মুহূর্ত। ওর দু’চোখ জ্বলে উঠেছে শ্বাপদ হিংসায়। 

মধুও দেখেছে লোকটা খেপে উঠেছে। কোলাহল ওঠে। মধুর সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর কাঠিন্য নিয়ে লোকটা এগোচ্ছে। পালিয়ে যাবে না মধু; হঠাৎ অতর্কিতে ওই লোকটাকে লাথি মেরেছে সে, ছিটকে পড়েছে লোকটা। ওর হাত থেকে হাঁসুয়াটা কেড়ে নিয়ে ওর মুখেই একটা সজোরে লাথি মেরে মধু গর্জে ওঠে, 

—শয়তান কোথাকার! হাঁসুয়া বের করবি? জান খেয়ে নোব না! 

হাঁসুয়াটা ফেলে দিল টান মেরে খালের জলে। পকেট থেকে টাকা ক-টা বের করে ওর সামনে ছিটিকে দিয়ে বলে, 

—যা, দাঁত দুটো পড়ে গেছে। ওষুধ ডাক্তারি করাবি। মদ্দানি দেখাবি না মধু চৌধুরীর সামনে। বুঝলি! 

মধু বুকটান করে চলে গেল ওই ভিড়ের মধ্য দিয়ে হাটের বাইরের দিকে। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে। সকাল থেকে কেবল ঝামেলাই চলেছে। 

মধু সঙ্গে গেল। বুনো দেশের বুনো কানুন। দুজনের মধ্যে ঝগড়া কাজিয়া হবে—তারা দুজনেই ফয়সালা করবে। এর মধ্যে আর কেই মাথা গলাবে না। তাছাড়া লোকটা হাঁসুয়া তুলে অন্যায়ই করেছিল। খদ্দের যা হোক দাম বলবেই, তার মুখের ওপর পাইকের ওইসব কথা বলবে কেন? 

মধু অবশ্য দাঁড়ায়নি। লোকটাকে মারতে সে চায়নি। এসব করতে চায় না সে। কিন্তু কারও কোনো বাঁকা কথা শুনলে বা খারাপ কাজ করতে দেখলেই তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। 

মধু চলেছে হাটের ওপাশ দিয়ে। দু-চারজন ও দিকে তাকিয়ে থাকে। বলিষ্ঠ দীর্ঘ দেহটা তখনও রাগে ফুলে রয়েছে। 

—খুব তো মর্দানি দেখালে! অ্যাঁ? 

মধু দাঁড়াল। বুনো বাওয়ালির বউটা হাসছে ওকে দেখে। মেয়েটার সারা দেহে যেন গাঙের জোয়ার লেগেই আছে। ওতে মাতনই চলে দিনরাত, ওই রূপের গাঙে কোনোদিন ভাঁটা পড়ে না। 

বাওয়ালির জীবন এমনিই। ওরা বাদাবনে বাঘের মুখে যায় কাঠ-মহাজনের কাঠ কাঠতে। মারমুখী রাঙ আর ওই বনেই বাস করে নৌকোয়। বন-বাবুরা গাছের হাতুড়ি পিটিয়ে মার্কা দেবে বন্দুক পাহারায়। সেই গাছ কেটে কেটে নৌকো-বোঝাই করে বসতে ফিরতে দু-মাস কেটে যায়। 

দিনরাত কেবল সেই গাঙ আর বাঘের হাত থেকে বাঁচার ফিকিরই ভাবতে হয়। বাওয়ালিরা ভুলে যায় তাদের ঘরের কথা। রাত নামলে বাদাবন পরিণত হয় কোনো অশরীরীদের রাজ্যে। সেখানের আঁধারে ছায়ামূর্তির মতো ঘুরে ফেরে জিনপরির দল মানুষের সন্ধানে। ওদের পেলেই ওই জিনের দল তাদের শেষ করে দেবে। বনে মনে জ্বলছে হরিণের নীল চোখ, মাঝে মাঝে নদীর গর্জন কাঁপিয়ে কানে আসে বাঘের গুরুগম্ভীর ডাক। 

ওদের চারিদিকে মৃত্যু। এরই মধ্যে বাদাবনে নৌকো বসতে পড়ে থাকে বাওয়ালিরা। তাদের ঘর মিথ্যা, মিথ্যা তাদের বউয়ের স্বপ্ন। ওসব যেন হারানো জগৎ তাদের কাছে। বাওয়ালির বউ একাই নয়, আবাদের এমনি বসতে আছে অনেক বউ—যাদের স্বামী আছে নামে-মাত্র। তারা থাকে ওই বাদাবনে না হয় গাঙে—আবার কোনদিন কে হারিয়ে যায়, আর ফেরে না। সেই ফেরারি মানুষগুলোর জন্যে বউগুলো দুদিন কাঁদে—আউল হয়ে থাকে। তারপর নিজেদের বাঁচার তাগিদে আবার এই জীবনকে মেনে নেয়। ওদের চোখের জলে গাঙের জল লোনা হয়ে যায়, তবু মন মানে না। 

মাতন বউ দেখেছে আজকের ঘটনাটা। মধুকে সে চেনে, ওই লোকটা যেন গোখরো সাপের মতো ফণা তুলেই আছে। 

মধু ওর কথায় দাঁড়াল। 

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। হাটের কলরব একটু কমেছে। দূর থেকে দেখা যায় হাটের বাতিগুলো, খাল বয়ে নৌকা ডিঙি নিয়ে বসতে ফিরছে হাটুরের দল। জালা হাওয়ায় কেমন ঠাণ্ডা লাগছে, শিরশিরে ঠাণ্ডা। 

মধুর সকাল থেকেই মেজাজটা ভালো নেই। ভেবেছিল মুরগি কিনে নিয়ে গিয়ে একটু জমিয়ে বসবে, মদের বোতলটা কাছেই আছে। দু-ঢোক তাজা মদ গলায় নিয়েছে এই ফাঁকে। 

তারাগুলো জ্বলছে। খালের জলে পড়ছে তারই আভা। এদিকে জমাট অন্ধকার। বাদাবনের জীবনে এই অন্ধকারটাই ভয়াবহ নির্জনতা আনে। ওই বাতাসে ভেসে আসে আদিম জীবনের সেই নগ্ন পাশবিক প্রকৃতিটা। 

পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মধু ওদের বাড়ির কাছেই এসেছে। তার কাছারিবাড়ি ওই গ্রাম-বসত থেকে একটু দূরে। 

মাতনের দিকে তাকাল সে। মাতন হাসছে। 

—কী গো! কথা কতিছ না যি? কি হল? 

মধুর খিদে পেয়েছে। হঠাৎ মনে পড়ে তার সারাদিন খাওয়া হয়নি। 

মাতনের এখানে তার এমন অনেক রাত কেটেছে। মাতন কেন, এ চাকলার অনেক মেয়ের খবরই সে জানে। ওই মদটা পেটে পড়লেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। ওর রক্তে কী অসীম বুভুক্ষা আর জ্বালা জাগে। মনে হয়, সব কিছুকে গুঁড়িয়ে শেষ করে দেবে। মৌচাক নিঙড়ে মধু বের করার পর মোমগুলোকে যেমন করে বাওয়ালির দল ফেলে দেয়—তেমনি করে সবকিছু তার লুটে নিতে ইচ্ছে করে। বলিষ্ঠ দেহের পেশীতে জাগে সেই ঝড় 

মধু শুধোয়, 

—ভাত আছে তোর ঘরে? রেঁধেছিস আজ? 

মাতন হাসছে। জানে ওই লোকটাকে। মেয়েরা ওর জন্য পাগল। মাতন জানে এ চাকলার বাওয়ালিদের অনেক ঘরেই ওর যাতায়াত। লোকটাকে দেখলে নেশা লাগে। মনে হয় তাদের নিঃস্ব-শূন্য ব্যর্থ জীবনে ও আনে ক্ষণিকের জন্য কী নেশার সাড়া। 

মাতন বলে, 

—আছে বইকি! ভাত আর মাছ-চচ্চড়ি। 

মধু কথা না বলে সোজা ওর বেড়া-ঘেরা ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। কোনো নিমন্ত্রণের প্রয়োজন তার নেই। দাওয়ায় বসেছে মধু। লঙ্কার রঙে মাছের চচ্চড়িটা লাল হয়ে উঠেছে। মাছের অভাব নেই এখানে। খাল-বিল-গাঙে মেলে পারশে-ভাঙন-ভেটকি-পায়রাতেলি—আরও কত মাছ। 

মাতন ওকে যত্ন করে খেতে দেয়। ও সারাদিন কিছু খায়নি। 

মধুসূদন গোগ্রাসে গিলছে। মাতন তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর মুখের দৃষ্টিটা তার মনে সাড়া তোলে। কুপি জ্বলছে, ওর লালচে আলোর একটা রেখা পড়েছে মাতনের গায়ে, ওর নিটোল দেহে। এতটুকু কাপড়ে সেই জোয়ারের বেগবতী দেহকে যেন আটকানো যায় না। 

মধুর মনে সেই ঝড়টা এগিয়ে আসে। 

রাত নামে। আদিম রাত্রি, এখানে মানুষ নেই। লম্ফের শিষ-কাঁপা নাগিনীর ওই নিটোল দেহ, উন্নত বুক, সরু কোমর। কালো কুচকুচে দেহ মেয়েটার, কষ্টিপাথরের রং। মধুসূদনের বুক জ্বলছে—ওর রক্ত আদিম নেশাটাই তার সব কিছুকে ভুলিয়ে দিয়েছে। সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। 

হাসছে মেয়েটা, 

—ওই, হাঁ-করে দেখছ কি গো? মাইয়ামানুষেরে কি আগে দেখোনি? অ্যাঁ! 

মেয়েটার ওই হাসির অতলে কোথায় জমাট অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে সেই দুর্বার প্রকৃতির বুনো লোকটা। 

লেখাও সেদিন হাটে এসেছিল বাড়ির-ঝিকে সঙ্গে নিয়ে। রোজ জিনিসপত্তর মেলে না। তাই হাটের দিনে আসতে হয়। অশ্বিনীবাবু হাট করতে এলে এটা ভোলেন, ওটা ভোলেন, তাই লেখাকেই আসতে হয়। আজও তাই এসেছিল লেখা। মধুসূদনকে দেখে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। 

অবশ্য মধুসূদনের ওদিকে নজর নেই। লেখা দেখেছে লোকটাকে একটু আগে। পিঠে ওর চাবুকের দগদগে ঘায়ের কথা মনে পড়ে। তবু কোনোরকম ভ্রূক্ষেপ নেই ওর। 

সামনে একটা লোকের মুরগি তুলে নিয়ে দরাদরি করছে। তারপরই শুরু হয় ওই কাণ্ড। লেখা চমকে উঠেছে। ঠাণ্ডা মাথায় কেউ যে কাউকে এমনিভাবে আঘাত করতে পারে, তা জানা ছিল না তার। লোকটা হাঁসুয়া বের করতেই মধুসূদন তার ওপর বুনো বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আঘাত করতে থাকে। লোকটা অতর্কিত আঘাতে ছিটকে পড়েছে, ওর নাক-মুখ দিয়ে বের হচ্ছে তাজা রক্ত। 

তখনও ফুঁসছে মধুসূদন, 

–শেষ করে দোব তোকে! 

ও যেন খুনে। সকালেই আর একজনকে সে মারতে গিয়েছিল। লোকটাকে আহত হয়ে পড়ে যেতে দেখে লোকটার বউ-ও লাফিয়ে ওঠে। বুনো বাঘিনির মতো সে মধুসূদনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে কিল-চড় মারবার চেষ্টা করছে আর চিৎকার করছে তারস্বরে, 

—ওগো লোকটাকে মেরে ফেললে গো! 

ওর চিৎকারে হাটে লোক জমে যায়। কিন্তু মধুসূদনকে মারমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেউ বড়ো একটা এগোয় না তার সামনে। 

মধুসূদন ভিড় ঠেলে বের হয়ে চলে গেল সেখান থেকে। তখনও মদের নেশায় তার পা-টলছে, সোজা হয়ে চলবার সাধ্য তার নেই। 

লেখার যেন চেতনা ফিরছে। লোকটার বোধহয় খুবই লেগেছে। মধুর ওপর রাগ হয়। এত করেও ওকে বোঝাতে পারল না যে, এসব অন্যায়। কিসের ওপর দুরন্ত রাগে লোকটা দিনরাত ফুঁসছে। 

লোকজন জুটে গেছে। লেখাও এগিয়ে যায়। আহত লোকটা ততক্ষণে উঠে বসেছে। ওর নাকে-মুখে রক্তের দাগ। 

মেয়েটা চিৎকার করে, 

—এমনি করে বিনা দোষে মারবে? 

লেখার রাগ হয়। সে-ই বলে, 

—তাই করব। মগের মুলুক পেয়েছে ও! 

এমন সময় ভিড় ঠেলে পঞ্চায়েত প্রেসিডেন্ট মহিমবাবুকে আসতে দেখে ওরা পথ ছেড়ে দিল।

—কী হয়েছে রে! 

লেখাই জবাব দেয়, 

—মধুসূদনের আর একটা কীর্তি দেখে যান। ওকে আপনারা কিছুই বলবেন না, আর ও যা ইচ্ছে তাই করবে? 

মহিমবাবুও ভাবনায় পড়ে, 

—তাই তো দেখছি। জাহান্নামে গেছে ছোঁড়াটা। 

.

মহিমবাবুর হাটে নানা কারবার আছে। সঙ্গতিপন্ন জোতদার। তাছাড়া নৌকোয় মাল-চালানি কারবার করে বেশ দু-পয়সা কামিয়েছে। ধানকলও করেছে। এ এলাকার ধান চাল ওঠে তারই গোলায়, আর রাতের অন্ধকারে ওর লঞ্চ মাল-চালানোর নামে চোরাচালানির কাজও করে। 

সাতে-পাঁচে লোকটা ফুলে উঠেছে। 

এককালে মহিম ঘোষাল ছিল ওই কাছারি নায়েব। যেন বটবৃক্ষের ঝুড়ি। এখন সেই ঝুঁড়িগুলোই বটগাছে পরিণত হয়েছে আর মূল-কাণ্ডের কোনো অস্তিত্বই নেই। জমিদার বাড়ির ছেলে মধুসূদন আজ পথে পথে ঘোরে, এ চাকলার বনস্পতি হয়েছে ওই মহিম ঘোষাল। ঝুড়ি পরিণত হয়েছে কাণ্ডে। 

মহিমও সন্ধানী ব্যক্তি। এককালে অনেক সুনামই তার ছিল। মদ, মেয়েমানুষ আরও অনেক কিছু। এখন প্রেসিডেন্ট হয়ে সেটা একটু কমেছে। তাছাড়া বয়সও হয়েছে। বাকি যেটুকু সেই গুণপনা, তা অন্ধকারেই ঢাকা থাকে। 

অবশ্য বাদাবনে ওটা নিয়ে কেউ-ই মাথা ঘামায় না। এখানের জীবনে ওগুলো যেন স্বাভাবিক ঘটনাই। 

আজ লেখা মহিমবাবুকে হাটতলায় দেখে অভিযোগ করে, 

—মধুবাবু হাসল মাত্র। মধুকে সে ভালো করেই চেনে। মহিমবাবুর কাজ-কারবার চালাতে হয় নানা রকমের। জমিজমা নিয়ে, ধান কাটা নিয়ে ভাগ—চাষিদের সঙ্গে গোলমাল লেগেই থাকে। তাছাড়া মধুর, দু-চারজন শাগরেদকে সে চেনে, তাদের অসাধ্য কোনো কাজ নেই। 

দূর আবাদের ধারের গাঙে তারা রাতের অন্ধকারে ডিঙি নিয়ে ঘোরে। বাওয়ালিদের বা কোনো সওয়ারির নৌকো পেলে হড়বড়িয়ে উঠে লুটপাট করে নেয়। প্রতিবাদ করলে সড়কি চালাবে, না হয় মেরে গাঙের জলে ফেলে দেবে। ব্যস, ওদের শেষ করে দেবে কুমির না হয় কামটে। মধুর অনুচর তারাই। 

মহিমবাবু তাই মধুকে চটাতে সাহস করে না। কারণ আরও আছে। রাতের অন্ধকারে ওই রায়মঙ্গলের মাতাল বুকে পাড়ি দিয়ে টানা মাল আনার সাধ্যি মধু ছাড়া আর কারও নেই। 

আবার সেই বিদেশি ঘড়ি-পেন কর্পূর আরও নানা জিনিস মধুসূদনই হাত-ব্যাগে পুরে লঞ্চে চেপে কলকাতায় মহাজনের গদিতে পৌঁছে দিয়ে আসে নিরাপদে। ভদ্দরলোকের ঘরের ছেলে, জামা-কাপড় না হয় প্যান্টশার্ট পরলে ওকে চেনাই যাবে না বাদাবনের লোক বলে। ইংরিজিও শিখেছিল, বলতে-কইতে পারে। তাই মধুসূদন এই কাজটা করে চলেছে। দেখতে এমনিতে ভদ্র, কিন্তু খেপে উঠল সে বাদাবনের বাঘের চেয়েও দুর্বার আর হিংস্র হয়ে ওঠে। মহিমবাবু ওকে হাতে রাখতে চায়। 

সবদিক থেকে মধুসূদন তার কাছে অনেক দরকারি ব্যক্তি। তবু সে পঞ্চায়েত প্রেসিডেন্ট। তাই আইন রক্ষার ভার তার হাতেও রয়েছে। লেখার কথায় মহিমবাবু বলে, 

—সত্যিই। অন্যায় করেছে সে। 

লেখা বিরক্তিভরা স্বরে বলে, 

—দিন দিন লোকটা খেপে উঠেছে কোনো বাধা না পেয়ে। একবার একটা কেসে কিছুদিন শাস্তি পেয়ে জেল ঘুরে আসুক, তখন বুঝবে! এই দাপট কমবে তবেই। এটা করতে পারেন না? 

হাসে মহিমবাবু লেখার কঠিন মুখ-চোখে আরও কাঠিন্য ফুটে উঠেছে। 

মহিমবাবু মেয়েটাকে দেখছে। এককালে ওর রূপ-যৌবন ছিল। কিন্তু সেদিন অশ্বিনী ডাক্তার ওর বিয়ে দিতে পারেনি। তাছাড়া মেয়েটার এমনিতেই কেমন পুরুষ-পুরুষ ভাব। সেটা বোধহয় ওই বিয়ে না হওয়ারও কারণেই। তবু ওর দেহের বাঁধন আজও অটুট আছে। মুখে পড়েছে বয়সের ছাপ। ওর ব্যর্থ মন তাই বোধহয় সামান্যতেই জ্বলে ওঠে। যে মেয়ে জীবনে কোনোদিন ভোগ করল না, সে জেনেছে ওই ত্যাগ আর সংযমকেই সবচেয়ে বেশি করে, আরও কিছু করার নেই। তাই নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে কঠিন ত্যাগের বেড়ায় বন্ধ করে—ওই সেবাকেই পরম কর্তব্য মনে করে বেঁচে আছে। 

মহিম ঘোষাল দেখছে লেখাকে। 

তবু মেয়েটার ওই নিটোল স্বাস্থ্যের মধ্যে কোথায় একটা লাবণ্য আছে। সেটাই যেন মহিমের কাছে একটা আকর্ষণ। 

মহিম ঘোষালের লেখার দিকে নজর আছে, কিন্তু সেখানে এগোবার সাহস তার নেই। ওর লোভী মন তাই ভালোমানুষের মুখোশ পরেই ভান করে চলে। 

লোকটার দিকে তাকাল মহিমবাবু। 

মধুর প্রচণ্ড ঘুষি আর লাথির চোটে ওর দাঁত পড়ে গেছে। রক্ত পড়ছে। লোকটার বীরত্ব উবে গেছে, মুখ-টিপে ধরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে। 

লেখা বলে, 

—মধুকে আপনারা কিছু বলবেন না? 

মহিম ঘোষাল লেখাকে খুশি করতে চায়। তাই বলে, 

—নিশ্চয়ই, আজই ওকে চোরের মতো মেরেছে। তবু আবার ওই কাজ করেছে সে। লেখা বলে, 

—পুলিশে নিয়ে গিয়ে ডায়েরি করিয়ে ডাক্তারখানায় পাঠান ওকে। আর দেখবেন, এবার যেন মধু ছাড়া না পায়। 

মহিম ঘোষালও সায় দেয়, 

—নিশ্চয়ই, নিজে আমি ভুবনবাবুকে বলব। 

লেখা আজ চটে উঠেছে। 

ওরাও দলবেঁধে লোকটাকে নিয়ে থানার দিকে এগোল। লেখা যেন সামাজিক কর্তব্য করতে পেরেছে এইটা ভেবে মনে মনে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়! 

.

ভুবনবাবু বসেছিলেন। সন্ধ্যা নামছে। এখানে সন্ধ্যার একটা নিজস্ব রূপ আছে। ওদিকে হাটের কলরব উঠেছে। পানের দোকানে লাগিয়েছে চোঙাওয়াল গ্রামোফোন। বায়োস্কোপওয়ালার সেই বাক্সের গায়ে চোখ রেখে কোনো বাওয়ালি বোধহয় কলকাতার মনুমেন্ট, আগ্রার তাজমহল দেখার আনন্দ উপভোগ করছে এই আবাদের হাটতলায়। 

পাখিগুলো এখানে ছাতিম শিরীষ গাছে কলরব করছে। রাতের অন্ধকারে শিরীষের চিরল পাতায় যেন ঘুম নেমেছে। পাতাগুলো চোখ বন্ধ করেছে। বাতাসে উঠছে মৃদু ফুলের সুবাস। 

লোকটার সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়েছেন ভুবনবাবু। মধুসূদনের মধ্যে সেই বুনো ভাবটা পুরোপুরি রয়েছে। কাজকর্ম একটা দিলে হয়তো তাই নিয়েই ভুলে থাকবে। কিছুটা উৎপাত কমবে। ওর সাহস আছে। অনেকদিন অনেক দাগি বদমাইস দেখেছেন তিনি এই লাইনে। কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতায় মনে হয় মধুসূদন আলাদা ধাতের লোক। ওকে ঠিক সাধারণ আসামির পর্যায়ে ফেলতে পারেন না। মধুসূদনের কথা নিয়ে ভাবেন তিনি। ওর মনের জ্বালাটা কোথায় তা জানেন না ভুবনবাবু 

হঠাৎ অশ্বিনী ডাক্তারকে আসতে দেখে ওঁর দিকে চাইলেন ভুবনবাবু। অশ্বিনীবাবুকে বেশ উত্তেজিত দেখায়। সঙ্গে এসেছে প্রেসিডেন্ট মহিমবাবু। সে-ই বলে, 

—এর একটা বিহিত করতেই হবে। এসব জুলুম কতদিন চলবে? 

—কি ব্যাপার? 

মহিমবাবুর আগেই অশ্বিনীবাবু বলেন, 

—আবার সেই মধুসূদনের কাণ্ড। একেবারে একটা দাঁত ফেলে দিয়েছে লোকটার এক ঘুষিতে।

—হাটে গোলমাল শুনছিলাম। ভুবনবাবু কী ভাবছেন। শুধোন, 

—কোথায় গেল সে? 

অশ্বিনী ডাক্তার ওর খবর জানেন না। তাই বলেন, 

—তা তো জানি না! 

মহিমবাবু জানে ওর সন্ধান। সে-ই বলে, 

—যান, ভেড়ির ওধারে বুনো বাওয়ালির বাড়িতেই পাবেন বোধহয় ওকে। ওর আস্তানা তো যত্র-তত্র, এ কুঞ্জের এক কেষ্ট ওই হতভাগাই। 

একজন কনস্টেবল জানায়, 

—ওকে ছোটো খালের ধারে একটা বাড়িতে দেখলাম। 

ভুবনবাবু ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। 

হাটের কলরব থেমে আসছে, মানুষগুলো যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তখনও দু-একটা হ্যাজাক জ্বলছে কোনো গদিতে। 

অশ্বিনীবাবু মহিমবাবুর সঙ্গে আরও অনেক এসেছে। সেই আহত লোকটা কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়, আর ওর বউটা খ্যানখেনে গলায় চিৎকার করছে। 

ভুবনবাবু চুপ করে কী ভাবছেন। মধুর ব্যাপারে ভাবনায় পড়েছেন তিনি। বেশ জেনেছেন ওকে মেরে শাস্তি দিয়ে কায়দা করা যাবে না। কোথায় একটা কাঠিন্য তার রয়ে গেছে; তবু এই ঘটনার একটা মোকাবিলা করা দরকার। লোকটাও যা-তা বলেছিল, হাঁসুয়া বের করে কোপ দিতেও গিয়েছিল। বাধা না দিলে মধুকে কুপিয়ে বসত লোকটা। 

ভুবনবাবু কী ভেবে বলেন—ওকে কোথায় দেখেছ? 

মহিম ঘোষাল জানে ওর বর্তমানের আস্তানার কথা। তাই বলে—বললাম তো, দেখবেন, ওই বাওয়ালির ঘরেই রয়েছে সে। 

ভুবনবাবু নিমাইয়ের দিকে তাকালেন। সকালে নিমাই ওকে ধরে আনতে গিয়ে চুবুনি খেয়ে এসেছে। আর সে বীরদর্পে এগিয়ে আসে না। 

ভুবনবাবুই দুজন কনস্টেবলকে ডেকে বলেন, 

—চল, আমিও যাচ্ছি, তোমাদের সঙ্গে। মহিমবাবুও চলুন না, তার ডেরাটা দেখে আসি।

মহিম ঘোষাল এসব ঝামেলায় জড়াতে চায়নি। কিন্তু পেছোবারও উপায় নেই। তাই বলে,

—চলুন। ওকে হাতকড়ি পরিয়েই আনবেন স্যার। না হলে রাতের অন্ধকারে গাঙ সাঁতরে পালাবে ও। 

হাসলেন ভুবনবাবু চলুন, দেখা যাক। চলুন না ডাক্তারবাবু? 

ওঁরা বের হয়ে গেলেন থানা থেকে। ভারী বুটের শব্দ ওঠে। অন্ধকারে রাইফেলধারী কনস্টেবল দুজন আগে আগে চলেছে। 

ওঁরা চলেছেন বসত ছাড়িয়ে ভেড়ির ধার ধরে সেই মধুসূদনের সন্ধানে।

.

অন্ধকার নেমেছে। নিচু ঘরখানার চারিদিকে জমাট অন্ধকার। ওঁরা ভেড়ি থেকে নেমে দু-দিক থেকে ঘরখানাকে ঘিরে সাবধানে এগিয়ে যান। 

রাতের অন্ধকারে দরজা ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। টর্চের আলোয় আঁধার ঘর-ভরে ওঠে। মধু জড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে,—অ্যাই, কোন্, শ্লা রে? 

ভারী জুতোর শব্দ ওঠে। ঘরে মদের তীব্র গন্ধ-ছড়ানো। ওঁদের দেখে ধড়মড়িয়ে উঠল মধুসূদন। মেয়েটাও সরে গেল অন্ধকারে বাইরের দিকে। এক নজর দেখা যায় ওই অস্পষ্ট আলোয় মেয়েটার অর্ধনগ্ন-দেহটাকে। 

মধু ওঁদের দেখে চিনতে পারে। তার মুখে লজ্জার কোনো ছাপ নেই। বলে, 

—আপনি? দারোগাবাবু? 

মধু হাসছে। শুধোয় সে—এত রাতে আবার এখানে কেন স্যার? চলুন! 

পেছনে মহিমবাবুকে আর অশ্বিনী ডাক্তারবাবুকে দেখে বলে সে, 

—আই বাপ! পেসিডেনবাবু ডাক্তারবাবুও আছেন দেখছি! একেবারে দলবল নিয়ে এসেছেন? ব্যাপার তো অনেক দূর গড়িয়েছে তাহলে! 

অশ্বিনীবাবু দেখছেন মধুকে। ওর সম্বন্ধে অনেক কিছুই শুনেছেন তিনি। মদ, মেয়েমানুষ কোনো কিছুতেই তার অরুচি নেই। জুয়োও খেলে। ভদ্রলোকের ছেলেকে এমনিভাবে নষ্ট হতে দেখে দুঃখই পান। 

দু-একজন কৌতূহলী লোকও জুটেছিল। কোনো কোনো মেয়েও দেখেছে মধু আর মাতনের ওই ঘটনাগুলো। তারাও মুখ-টিপে হাসছে। 

অবশ্য মধুর এসবে যেন কোনো লজ্জা নেই। বোতলের শেষ তলানিটুকু গলায় ঢেলে মধু জামাটা গলিয়ে নিয়ে বে 

—চলুন। আপনারা মাইরি শান্তিতে থাকতে দেবেন না। 

দারোগাবাবু বলেন,—তুমি কাউকে শান্তিতে থাকতে দিয়েছ? আজ হাটতলায় ওসব গোলমাল বাধালে কেন? লোকটাকে এমনি করে মারে? কি এমন করেছিল সে? 

—ব্যাটা যে হাঁসুয়া তুলেছিল, কুপিয়ে গর্দান নামিয়ে দিত না মারলে! সাক্ষী চান? অনেক আছে। কই ডাক্তারবাবু, আপনার বোনও তো ছিল। তাকেই শুধোবেন। মাইরি বলছি, অন্যায় কাজ কিছুই করিনি। 

—বাজে কথা বলছ। দারোগাবাবু ওকে থামাবার চেষ্টা করেন। 

মধু বলে, 

—ঠিক আছে। হাসপাতালে যাচ্ছেন তো? সেখানেই শুধোবেন ডাক্তারবাবু বোনকে। আমি না হয় শ্লা লায়ার, কিন্তু ওঁর বোন তো ধৰ্ম্ম-টম্ম করেন, সিওরলি মিছে কথা বলবেন না! 

লেখাকে এইসব ঘৃণ্য ব্যাপারে জড়াতে চান না অশ্বিনীবাবু। আজ রাতে নিজের চোখে দেখেছেন ওই মধুসূদনকে মদ গিলে একটা বাজে-মেয়েদের ঘরে পড়ে থাকতে। ভদ্রসমাজের বদনামই করেছে ছেলেটা। বিরক্ত হন ডাক্তারবাবু ওর কথায়। 

অশ্বিনীবাবু বলেন—যাক ওসব কথা। 

হাসছে মধু,—ঘাবড়ে গেলেন মাইরি? অ্যা—সাক্ষী সাবুদও হতে দেবেন না? যাচ্চলে! 

.

ওঁরা ডাক্তারখানায় এসেছেন থানায় যাবার মুখে। 

লেখাও দেখেছে মধুর আজকের কাণ্ডটা। রাতের অন্ধকারে ওঁরা তাকে ধরে এনেছেন মাতাল অবস্থায় একটা বাজে-মেয়েছেলের ঘর থেকে। লেখার মনে একটা বিজাতীয় ঘৃণা জাগে। কঠিন হয়ে ওর মুখটা। লেখা চুপ করে দেখছে ওঁদের। 

হাসছে মধুসূদন,—কই স্যার, শুধোন লেখাকে। কই বলো, তুমি তো দেখেছিলে, ব্যাটা হাঁসুয়া তোলেনি হাটে? যা তা কথা বলবে, মারতে আসবে, সব সইতে হবে? বলো কি হয়েছিল হাটে? আমার কথা তো এঁরা শুনবেন না! 

লেখা জবাব দিল না। মুখ-চোখে তার ঘৃণার ছাপ। 

মধুর মুখে মদের তীব্র গন্ধ উঠছে। চোখ-দুটো লাল। টলছে লোকটা, ওকে দেখে লেখার মনে হয় যেন বাদাবনের একটা আহত বাঘকে ওঁরা বন্দি করে এনেছেন। 

মধু বলে—যা বাবা! আমি কি মানুষ নই, যে কথাও বলবে না? চলুন দারোগাবাবু চালান-ফালান দিতে হয় দেবেন। ওসব তো আর নতুন নয়। এই নিয়ে ক’বার হল যেন পেসিডেন মশায়? এক-দুই-তিন—সেবার টানা-মালের ব্যাপারে নিজে কেটে পড়ে ফাঁসালেন আমাকে। 

হিসেব করছে মধুসূদন। 

মহিমবাবু একটু ঘাবড়ে গিয়ে সামলে নিয়ে বলে—তাতেও তো এতটুকুও শোধরালে না! ভদ্দরলোকের ছেলে, লেখাপড়া সকলের হয় না, তবু যা হোক ছোট-খাটো কাজ-কম্মো নিয়ে থাকো। আরে বাবা, কতবার বললাম এসো ভেড়িবাঁধার ঠিকে করে দিই আবার। কাজ কিছু করো। 

—কাজ কম্মো কর! 

হাসছে মধুসূদন, 

—তা ওসব করলাম না, এই তো? বললাম যে, ঘুষ চাইবে ওই ওভারসিয়ার, পান খেতে চাইবে কানুনগো, আর মাংস খাওয়াতে হবে সদরের অফিসের বাবুদের। বলুন দারোগাবাবু, ওইসব দিয়ে-থুয়ে কি পয়সা থাকে যে, তাতে ভেড়ি বাঁধ হবে? সব নোনা জল ঠেলে ঢুকছে আবাদে তারই জন্যে। আমি শ্লা মাতাল, কিন্তু চোর নই। ও অন্যায় কাজও করতে পারব না। তাই এমনিই রয়ে গেলাম। নিজে একটু স্ফূর্তিটুর্তি করি, নেশা-ভাং করি। মেয়েছেলেগুলোকে ভালো লাগে, হাসি-মশকরা করি— 

লেখা ওর কথাগুলো শুনছিল। ওর মুখ-চোখ একেই একটু শুকনো, গালের হাড়-দুটো ঠেলে উঠেছে। কপালটা বেশ চওড়া, তবু গায়ের রংটা ফর্সা। ওর কথাবার্তায় ওর মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে। লোকটা বিচিত্র একটি জীব, আর কথাগুলোও তেমনি চাঁছাছোলা সত্যি। এসব অন্যায়ই নয় তার কাছে। মধুর নীতিবোধই যেন আলাদা। 

মধুসূদন একদিনেই এই পথে এসে এই বিচিত্র রূপের মানুষে পরিণত হয়নি। আজকের এই দুর্বার মানুষ ওর মনে জন্ম নিয়েছে তিলে তিলে। সারা মনে আজ জেগে উঠেছে কঠিন একটি সত্তা, যে আজকের সব কিছুকে ভেঙে ফেলতে চায়। মানতে চায় না কোনো কিছুই। কারণ, চারিদিকে দেখেছে পচা-পাঁক আর জঞ্জাল। 

রাতের অন্ধকার নেমেছে, বাতাসে ভেসে আসা জোয়ারমতো জলকল্লোলের গর্জন। কুয়াশার ফিকে ফিকে যবনিকার আড়ালে দু-একটা আলো জ্বলছে হাটতলার দিকে। সেই জনতার ভিড় কলরব আর নেই, কী আতঙ্কে যেন তারা সবাই সরে গেছে এখান থেকে। 

মধুসূদন ভুবনবাবুর দিকে তাকাল। 

ভুবনবাবু ওর অতীতের পরিচয় কিছুটা জেনেছেন। 

মধুসূদন ওঁর চাহনির সামনে নিজেকে কেমন অসহায় বোধ করে। তাছাড়া তার মনের মধ্যে জোর আনতে যে বস্তুটার প্রয়োজন হয় সেটা এখানে নেই। মধুসূদন যেন স্বীকারোক্তি করছে, তাকে চাপ দিয়ে কেউ এই স্বীকারোক্তি করায়নি। লেখার দিকে তাকাল। মনে হয়েছে লেখাও তাকে দেখছিল দু’চোখ মেলে। ওকে চাইতে দেখে লেখা চোখ ফিরিয়ে নিল। 

দিনের আলোয় যে মানুষটা ওই বিশাল দুর্বার প্রকৃতির মাঝে দুর্দম হয়ে ওঠে, রাতের অন্ধকারে আজ সে চুপসে গেছে। 

ভুবনবাবু বলেন—কাজ-কর্মের যদি ব্যবস্থা করে দিই তাহলে কেন করবে না? মধুসূদনের কাছে চারিপাশে ওই বুভুক্ষু মূর্তিটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। তাই বলে সে,

—কিন্তু ছিনে জোঁকের দলের সঙ্গে বিবাদ করে কাজ করা তো যাবে না! খামোখাই বিপদ 

কিনতে যাব কেন বলুন? ঘুষ-ফুষ কোনো শ্লাকে দিই না। 

মহিমবাবু এতক্ষণ ওকে পরামর্শ দিচ্ছিল। তাছাড়া মহিমবাবুর ওকে দরকার হয় সত্যি, কিন্তু মধুসূদনকে সে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর মতো স্পষ্টভাষী ছেলে-নেশা করলে তার মনের সব জ্বালা আর গোপন কথাগুলো বের হয়ে পড়ে, তাকে বিশ্বাস করা যায় না। 

আজ তারই লোক ওই পীতাম্বরকে যেভাবে মারতে গিয়েছিল তাতে মনে মনে ভয়ই পেয়েছে মহিমবাবু। কারণ, যে হাত পীতাম্বরের গায়ে উঠেছে সে হাত একদিন ওই বেপরোয়া মধুসূদন তার ওপরেই তুলবে। কারণ মহিম ঘোষাল পীতাম্বরের চেয়ে অনেক বেশি অপরাধী। 

মধুসূদনের আজ আরও অনেক কিছুই থাকার কথা। হাটতলার জমিগুলোর দাম অনেক বেশি। ওই হাটের বিস্তৃত অঞ্চল থেকে যা তোলা আদায় হয়, তার কিছুটা পেলে মধুসূদনের ভালোই চলে যেত। মহিম ঘোষাল ওদের এস্টেটে নায়েব থাকার সময় জমি-জায়গা, পুকুর- ভেড়ি তো বেনামা করে নিয়েছেই, ওই হাটতলার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছে। মধুসূদন তাও জানে। 

রাতের অন্ধকারে মধুসূদন চুপ করে কী ভাবছে। আকাশ-বাতাসে ওঠে মত্ত জলকল্লোলের গর্জন। গাঙের দিক থেকে ওই আদিম বীভৎস শব্দটা ভেসে আসে কী নিষ্ঠুরতা নিয়ে 

মধুসূদনের সামনে তার হিসেব-নিকেশের খাতাখানা কে যেন খুলে ধরেছে। তাতে শুধুই লাল-কালির আখরে ফাঁকির কথাই লেখা আছে। 

ওই মহিম ঘোষালই তাকে সব চেয়ে বেশি ঠকিয়েছে। তার জমি-জায়গা, পুকুরও নিয়েছে। তবু মধুসূদন বাঁচতে চেয়েছিল। 

লেখাও জানত সেদিনের কথাগুলো। 

.

মধুসূদন চেষ্টা করে ভেড়ি বাঁধের কাজের ঠিকা নিয়েছিল অনেক আশা করেই। ধান কেনার পারমিট নিয়েছিল। 

কিন্তু সেবার তার সব ধান ওই মহিম ঘোষালই ফাঁকি দিয়ে নিয়ে নিয়েছিল কম-দামে। বেশ কিছু লোকসান দিয়ে এসেছিল মধু। 

তবু ঠিকেদারি করবার চেষ্টা করেছিল। ওসব কাজ মহিমবাবুই করত, হাজার হাজার টাকার কাজ। ওই মহিমবাবু পারে ওই সব ছ্যাচড়ামো করতে। কিন্তু মধু পারেনি। ঘটা করে বাঁধ তৈরি করানোর পর যখন ওদের বিভিন্ন পাওনার দাবি আসতে লাগল তখন রেগে উঠেছিল মধু। 

ফলে তার বিলও পাস হয়নি। উলটে তাকে পুলিশ কেসে ফেলে কোর্টঘর করিয়ে ছেড়েছে। আজ তাই ওই কাজ করার নাম শুনে খেপে উঠেছে মধুসূদন,—কাজ! ওই কাজ করে ভালোমানুষ সাজা? 

হাসছে মধুসূদন। বলে সে—মহিম ঘোষালই পারে ওসব। বুঝলেন! অনেস্ট লোক ও। মহিম ঘোষালের মুখ-চোখ কঠিন হয়ে ওঠে। ও বুঝেছে, মধুসূদন এখানে থাকলে এইবার তাকে ও জব্দ করে দেবে। কারণ, ও মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই মহিমবাবুও ভাবনায় পড়ে। 

লেখাও এসব ব্যাপারে জানে কিছুটা। 

কিন্তু মধুসূদনের এই বেপরোয়া মনের জ্বালাটাকে সে স্বীকার করে না। ঘৃণা করে। মধুও তা জানে। তাই এক জায়গায় মধু যেন হেরে গেছে সব থেকে বেশি, আর সেই পরাজয়ই তাকে দুর্বার আর কঠিন করে তুলেছে। 

মধুসূদন বলে, 

—ভালোমানুষ হবার ঢের চেষ্টা করেছি দারোগাবাবু, শ্লা চোরের রাজ্যি। তাই আমোও ডাকাত সেজেছি। কাজ! ওইভাবে কাজ করা আমার দ্বারা হবে না। 

ওদের কথাবার্তার মধ্যে লেখা কখন বের হয়ে গিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করেছিল জানে না।

চা আসতে একটু অবাক হয় মধুসুদন। ভুবনবাবু বলেন—চা নাও। 

মধুসূদন হাসে—এসব চা খাই না স্যার। জানেন তো, ওতে ঠিক জমে না, নেশাটা চটে যায়।

লেখা দিতে এসেছিল। ও আর দাঁড়াল না। চায়ের কাপটা নিয়ে সরে গেল। ওর বিশ্রী লাগে ওই লোকটাকে। ওর কাছে নেশা আর অন্ধকার হিংস্রতা ছাড়া আর কিছুই বড়ো নয়। জীবনের অন্য কিছুর সন্ধান সে পায়নি। 

.

মহিমবাবু নিজের কথা ভাবছে। এখানে থাকলে মধুসূদন ধীরে ধীরে মাথা তুলবে। এতদিন সে প্রতিবাদ করেনি, কিন্তু শক্তি অর্জন করে মহিমবাবুকেই সে কঠিন আঘাত হানবে। তাই মহিমবাবুরও কৌশলে ওকে ওখান থেকে সরানোর দরকার। 

হঠাৎ দারোগাবাবুর কথায় মহিম নিশ্চিন্ত হয়। ভুবনবাবু মধুকে দেখেছেন—ভেবেছেন ওর সম্বন্ধে। তাই বলেন তিনি—বাঁধের ঠিকাদারি করবে? আমি নিজে জামিনদার হব তোমার। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমার বন্ধু। বাদা অঞ্চলে নতুন আবাদ হচ্ছে, সেখানেই কাজ কর। ঘুষ-ফুষ কেউ নেবে না, দিন বদলে গেছে। আমি বলে দোব—কাজ তুমি পাবে। 

মধুসূদন ওর দিকে তাকাল। ভুবনবাবুও দেখছেন ওকে। মধু কী ভাবছে। ভুবনবাবু বলেন।

মধুসূদন জবাব দিচ্ছে না। ভুবনবাবু ওকে খোঁচা মারবার ভঙ্গিতে বলেন,

—কাজ না করে যদি মস্তানি করে দিন কাটে, কাজ কে করতে চায়? কী বলো মধুসূদন?

লেখা একটু হাসল। 

মধুসূদন চমকে ওঠে। ওর সম্বন্ধে ওদের ধারণাটা এমনিই। মধুসূদন বলে, 

—বেশ। কাজ আমি করব। তবে ওই একটি শর্তে। দিন কাজ। কেউ যদি উলটোপালটা করেছে, কিন্তু খুনখারাপি হয়ে যাবে! 

ওর মুখে-চোখে একটা কাঠিন্য ফুটে উঠেছে। ভুবনবাবু হাসছেন। এমনিভাবে আঘাত করেই ওকে হয়তো বদলানো যাবে। 

মধু ভাবছে। নিজের কাজে এই ভাবনাটা কেমন বিচিত্র ঠেকে। সে জানে তার সামনে অন্য কোনো পথ নেই। বড়ো হবার চেষ্টা করেছে, সে, দু-চারবার শহরেও গেছে, যদি সেখানে থেকে কোনো কাজকর্ম করা যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে বুঝেছে বাদাবনের মানুষ সে, সভ্যজগতের তালে পা-ফেলতে পারেনি। আবার আঘাত খেয়ে ফিরে এসে নিজেকে ওই নেশা আর নারীর মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে স্তব্ধ জীবনে একটি উন্মাদনা আনতে চেয়েছে। 

তাতেও ঘৃণা এসেছে। দেখেছে ভদ্রসমাজের সকলেই তাকে ঘৃণা করে, এড়িয়ে চলে। লেখার মতো মেয়েও তাকে এড়িয়ে চলে, অবশ্য তার জন্য মধুসূদনের মনে কোনো ক্ষোভ নেই। আজও লেখা ওকে কাজ দেবার কথায় হেসে উঠেছিল, ও জানে—মধু একটা অপদার্থ জীব। 

মধু তাই শেষ চেষ্টা করে দেখবে। ধনেখালির পরিবেশও বিশ্রী লাগে তার কাছে। সরে যাবে সে সুযোগ পেলে। 

আজ ওদের কথাগুলো ভাবছে সে। একটা পথ পেতে চায়। এই জীবনে তার গ্লানি এসে গেছে। সে-ও দেখাতে চায়, কাজ দিলে ওদের চেয়ে ভালোভাবেই সে কাজ করতে পারে। 

মধু তাই মত দেয়,—বেশ! নেহাত ছাড়বেন না যখন, তখন চেষ্টাই করি। কি বলুন? তবে সুনীতি সুধা, মানে ওই উপদেশ—টুপদেশ দেবেন না মাইরি! 

রাত হয়ে গেছে। 

সন্ধ্যা থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধকল গেছে। অশ্বিনীবাবুর শরীরটা ভালো নেই। বাতের ব্যথাটা মাঝে মাঝে বেড়ে ওঠে। তাছাড়া রাতজাগা তাঁর সহ্য হয় না। 

তাই বলেন অশ্বিনীবাবু,—আপনারা তাহলে আসুন। আমি আর রাতে বের হব না। জানেন তো, ভোরবেলাতেই উঠতে হয়। তারপর বেলা হতে শুরু হবে রোগীদের ঝামেলা। 

রাতও হয়েছে। লেখা দাদার দিকে তাকাল। সে বলে—নাই বা বেরোলে আর রাত করে!

মধুসূদন বলে—সেই ভালো স্যার। আপনাদের তো আর বখেড়া নেই আমার মতো। তাছাড়া ভোরেই উঠতে হবে আপনাকে। 

ভুবনবাবু মধুর দিকে তাকালেন। লেখাও কথাগুলো শুনছে। 

মধু বলে—জানেন না স্যার, ভোর থেকেই তো বাড়িতে ঢপকেত্তন শুরু হবে। কি লেখা—এখনও অং বং, আর সেই স্তব কেত্তন-টেত্তন চলছে তো? 

লেখার মুখটা রাঙা হয়ে ওঠে রাগে। ভুবনবাবু বলে ওঠেন—থামো মধু মানীলোকের সম্বন্ধে এসব কথা না বললেই নয়? 

হাসছে মধুসূদন—ওই আমার স্বভাব স্যার। ঠিক আছে, এখন থেকে গুড বয় হবার চেষ্টা করব। তবে হ্যাঁ, এটা কিন্তু ‘অ্যালাউ’ করতে হবে! 

মধু পকেট থেকে বোতল বের করেছে। ভুবনবাবু প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্যই ওকে নিয়ে বের হয়ে এলেন। অশ্বিনীবাবুকে বলেন—ঠিক আছে। আমরা তাহলে চলি।—চলো মধু। 

মধু লেখার দিকে তাকাল, লেখা চোখ ফিরিয়ে নিল। খুব রেগেছে বোধহয়। 

অশ্বিনীবাবু বোনের দিকে তাকালেন। লেখা দরজাটা বন্ধ করে ও ঘরে চলে গেল। লেখা পড়াশোনার বইগুলো তুলছে। বলে সে—হাত-মুখ ধুয়ে নাও দাদা। দুধ গরম করতে দিয়েছি। খেয়ে নাও এইবার। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *