অমানুষিক – ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

অমানুষিক – ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

প্রেম ও স্পিসিস

“তুই শিয়োর প্রীতম? আজকেই নামাবে?”

“হ্যাঁ রে বাবা। সারা সকাল কাউন্সেলিং করেছি। বারবার বুঝিয়েছি, নাউ অর নেভার। খুব নার্ভাস হয়ে আছে, তবে আজই নামিয়ে দেবে।”

“এত নার্ভাস হবার কী হল, বুঝি না বাবা। অমৃতাকে প্রোপোজ করতে এত কি লাগে? আমি যখন সহেলিকে প্রো…।”

“খবরদার বলছি অর্চি! ফের তুই তোর সহেলির গল্প শুরু করেছিস কী ছাতার বাড়ি খাবি!”

“ঠিক বলেছিস! বাবা বাবা! জিএফ যেন কারও থাকে না! সারাক্ষণ সহেলি নামের মালা জপ হচ্ছে।”

“ভালো হবে না বলছি পৃথা, তোর এখানে কী দরকার রে? যা না, ল্যাবে গিয়ে ডবলিউবিসি কাউন্ট কর্‌।”

“আমি কী করব তোকে বলতে হবে না। আচ্ছা প্রীতম, দেবোপম আজই নামাবে তো?”

“অনেক বুঝিয়েছি, খালি বলে, যদি অমৃতা না বলে? তাহলে কী হবে?”

“ন্যাকামোর হাইট!! তুই কী বললি?”

“বললাম, যদি না বলে তাহলে দিন পাঁচেক একটু ‘দেবদাস’ মুভির রিহার্সাল দিবি, তারপর আবার অন্য কারও পিছনে লাইন দিবি। শুনে এমন ভাব করল যেন আমি ওকে ওর বাড়ির লোকের সামনে খিস্তি দিয়েছি।”

“সব ছেলে তোদের মতো নয়, বুঝলি সবজান্তা? দেবোপম অমৃতাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে। অমৃতা ওকে রিফিউজ করলে বোকামি করবে।”

ভিতর থেকে আরও দুটো মেয়ে বেরিয়ে এল। একজন বলল, “অমৃতা ব্যাগ গোছাচ্ছে। দেবোপমকে রেডি হতে বল্‌।” মুহূর্তের মধ্যে প্রীতম ছিটকে চলে গেল করিডরের পাশে সিঁড়ির দিকে। ছতলা থেকে পাঁচতলায় নেমে একটা ক্লাসরুমে ঢুকে বলল, “রেডি! ও নামছে! কম্পিত পায়ে দেবোপম বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।”

স্থান : আশুতোষ কলেজের জুলজি ডিপার্টমেন্ট, কাল : বিকেল সাড়ে চারটে। পাত্রপাত্রী সব জুলজি ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা।

বিকেল সওয়া পাঁচটা। দোতলায় লাইব্রেরির সামনে দেবোপম আর প্রীতম। দেবোপমকে দেখলেই মনে হচ্ছে ‘ধুক করে নিবে গেল বুকভরা আশা’। প্রীতম নানাভাবে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু দেবোপম কিছুই শুনছে বলে মনে হয় না। প্রীতম ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রশ্ন করছে “আচ্ছা, ও ঠিক কী বলেছে বল্‌ তো?” কিন্তু দেবোপম ইনফাইনাইট লুপে পড়া প্রোগ্রামের মতো শুধু বলে চলেছে “সব শেষ হয়ে গেল। অমৃতা আর আমার সঙ্গে কথা বলবে না!” অবশেষে দেবোপমকে ছেড়ে দিয়ে বিরক্ত প্রীতম নিজের কাজে গেল আর দেবোপম কিছুক্ষণ উদ্‌ভ্রান্তের মতো করিডরে ঘুরে কলেজ থেকে বেরিয়ে রাসবিহারীর দিকে হাঁটা শুরু করল।

এ গল্পের শুরু মাস তিনেক আগে এক জুলাই মাসের দুপুরে, যে দিন প্রথম এই কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়। এসএম স্যারের ক্লাস। জুলজি অনার্সের প্রায় জনা ষাটেক ছাত্রছাত্রী বসে আছে। এসএম স্যারের পড়ানোর ধরনটা খুব চমৎকার। বিনা আয়াসে যেন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গল্প করছেন এইভাবে পড়া এগচ্ছে। উনি স্রেফ কথা বলার ঢঙে প্রশ্ন করছিলেন, “আচ্ছা, তাহলে জীবজগৎকে ক-টা প্রধান ভাগ ভাগে করা হয়? পাঁচটা, একে বলে পাঁচটা কিংডম। তার মধ্যে অ্যানিমাল হল একটা কিংডম। আর সেই ভাগটা নিয়েই জুলজির মাথাব্যথা। বেশ। এবারে এই অ্যানিমাল কিংডমটা কতকগুলো ফাইলামে ভাগ করা আছে। তার কতকগুলো নাম তোমরা জান…।” ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে হাত উঠল।

“ইয়েস, বল।”

“স্যার! সব ক-টার নামই জানি। প্রোটোজোয়া, পরিফেরা…”

“আগে বল মোট ক-টা?”

“তেরোটা স্যার।”

এসএম এক গাল হাসলেন। বললেন, “স্কুল ছেড়ে কলেজে এসেছ তো, এখন আর ওই তেরোটায় চলবে না। এই মুহূর্তে মোটামুটি একত্রিশটা ফাইলাম জানা আছে। আরও আবিষ্কার হতে পারে। তবে হ্যাঁ, ওই তেরোটা ফাইলামেই মোটামুটি ৯৯.৯৯৯% প্রাণী আছে।” এসএম স্যার লেকচারে ফিরে গেলেন।

“এখন এই ফাইলামগুলোকে সাব-ফাইলামে ভাগ করা হয়। সেগুলোকে ভাগ করা হয় ক্লাসে। যেমন ম্যামেলিয়া, মানে স্তন্যপায়ী জীব হল ভার্টিব্রেট ফাইলামের একটা ক্লাস। আবার ক্লাসকে ভাগ করা হয় অর্ডারে। যেমন বাঁদরজাতীয় সব প্রাণীর অর্ডার হল প্রাইমেট। এর তলায় আরও কয়েকরকম ভাগ আছে, তবে সেগুলো এতটা স্ট্রাকচার্ড নয় তাই সেগুলো বলছি না। তবে অর্ডারের তলায় জেনাস আর তার তলায় হল স্পিসিস। এই স্পিসিস হল সবচেয়ে তলার ভাগ। এখন আর সব ভাগ কমবেশি সাবজেকটিভ। মানে আমরা যদি কাকে প্রাইমেট বলি, তার সংজ্ঞা পালটাই তবে আরও কিছু প্রাণীকে প্রাইমেট বলা হতে পারে। কিন্তু স্পিসিসের ক্ষেত্রে তার উপায় নেই। কেন জান?”

এবারে গ্যালারির পিছন দিকের বেঞ্চে মেয়েদের মধ্যে থেকে একটি হাত উঠল।

“ইয়েস, বল।”

“স্যার, স্পিসিস ইজ এ জেনেটিক্যালি ক্লোজড গ্রুপ।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে এসএম স্যার হঠাৎ নাটকীয়ভাবে হাততালি দিয়ে উঠলেন। “পারফেক্ট। পারফেক্টলি কারেক্ট। একেবারে জুলজির ছাত্রীর সঠিক উত্তর। মে আই আস্ক ইয়োর নেম প্লিজ?” গোটা ক্লাসের মতোই দেবোপমের দৃষ্টিও গিয়ে পড়ল দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির উপর। আর তার ফলেই, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় “তার আঠেরো বছর বয়স্ক মুণ্ডটি ঘুরিয়া গেল।” দেবোপম ঠিক কী দেখল তা বলা শক্ত, কিন্তু হাঁ করে তাকিয়েই রইল। দেবোপম বুঝতে পারছিল, সে মাথা থেকে পা পর্যন্ত মেয়েটির প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। শুনল মেয়েটি বলছে, “অমৃতা সিনহা স্যার।”

“ভেরি ভেরি গুড অমৃতা। তুমি কি বাকি ক্লাসকে তোমার কথাটার মানে বুঝিয়ে বলবে? কারণ আমি শিয়োর ক্লাসের এক পার্সেন্ট স্টুডেন্টও তোমার কথার মানে বোঝেনি।”

দেবোপম স্পষ্ট দেখল, অমৃতার ফরসা গাল লাল হয়ে উঠছে। মাথা একটু নিচু করে বলল, “স্যার, আপনিই বলুন।”

“ভেরি ওয়েল। প্লিজ সিট ডাউন। অমৃতা যা বলল, তার মানে হল… ইয়েস, ইউ স্যার! আই অ্যাম টকিং টু ইউ। আমি কিন্তু এদিকে আছি!”

দেবোপমের পাশের ছেলেটি দেবোপমকে এক ঝাঁকুনি লাগায়। “স্যার তোকে বলছেন!!”

চটকা ভেঙে দেবোপম লক্ষ করে, সে এখনও অমৃতার দিকে তাকিয়ে আছে আর গোটা ক্লাস তার দিকে তাকিয়ে, আর এসএম হাসিমুখে দেবোপমের উদ্দেশে বলছেন “আই অ্যাম হিয়ার ইয়াং ম্যান!” মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া অস্বস্তি নিয়ে দেবোপম কোনওমতে বলল “সরি, স্যার।” ক্লাসে একটা ছোট হাস্যরোল উঠে থেমে গেল।

“স্পিসিস ইজ এ জেনেটিক্যালি ক্লোজড গ্রুপ। এর অর্থ, কোনও একটা স্পিসিসের মধ্যে যে কোনও মেল এবং ফিমেলের সংযোগে এক বা একাধিক সন্তানের জন্ম হলেও, ইন্টার-স্পিসিস জেনেটিক্যাল কন্ট্যাক্ট ইজ বাউন্ড টু ফেইল। ফলে জন্মের পদ্ধতিটি একেবারেই একটি স্পিসিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকী আফ্রিকান হাতি লক্সোডন্টা আফ্রিকানা আর ভারতীয় হাতি এলিফাস ম্যাক্সিমাসের ক্রস ব্রিডে কোনও ফল হবে না। কেন? না তারা আলাদা স্পিসিস। বোঝা গেল?”

“কিন্তু স্যার, টাইগন? বাঘ আর সিংহ তো আলাদা স্পিসিস। তাহলে টাইগনের জন্ম হল কীভাবে?” সামনের বেঞ্চ থেকে প্রশ্ন ভেসে আসে।

“ভেরি গুড কোয়েশ্চেন। এইখানেই একটা মজা আছে। একই জেনাসের মধ্যে দুই স্পিসিসের কখনও কখনও একটা ফ্রিঞ্জ রিজিয়ন থাকে। সে ক্ষেত্রে এদের মধ্যে বারবার আর্টিফিশিয়াল ক্রস ব্রিড ঘটানোর চেষ্টা করতে থাকলে হাজারে একটা হয়তো সফল হতে পারে। কিন্তু সেইসব প্রাণী অত্যন্ত দুর্বল হয়। সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এ ছাড়া এদের প্রজননক্ষমতা একেবারেই থাকে না। ফলে কখনওই কোনও ইন্টার-স্পিসিয়াল বংশধারা চালু হয় না।”

ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে এল। দেবোপমের মাথায় খালি অমৃতার ছবি ঘুরছে। মনে হল, একটা বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন করতে পারলে হয়তো অমৃতার নজর নিজের উপর নিয়ে আসা যাবে। দেবোপম হাত তুলে ফেলল।

“ইয়েস, বল!”

“স্যার আফ্রিকার হাতি আর ভারতীয় হাতির কোনও সন্তান হয় না। কিন্তু আফ্রিকার মানুষ আর ভারতের মানুষের তো…।” কথা কেড়ে নিয়ে এসএম বললেন, “আমরা তো একই স্পিসিস। হোমো স্যাপিয়েন্স। মজার কথা হল, আমাদের জেনাস হল হোমিনিড। কিন্তু এই জেনাসের একমাত্র স্যাপিয়েন্স স্পিসিসটাই আছে। আর যারা ছিল, যেমন পিথেক্যানথ্রোপস, নিয়ানডরথ্যাল, তারা কেউ নেই। বুঝলে? মানুষের জিন, সে এস্কিমোরই হোক বা জারোয়ারই হোক, এত বেশি একরকম যে মনে করা হয়, সমগ্র মানবজাতির একজনই মা। অর্থাৎ কোনও এক পার্টিকুলার হোমো স্যাপিয়েন্স দম্পতির সন্তান আমরা এখনকার সমস্ত মানবজাতি। একই স্পিসিসের মধ্যে জিনের যতটা তফাত হওয়া উচিত, মানুষের মধ্যে সেই তফাত প্রায় নব্বই শতাংশ কম।

ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টা পড়ল। সামনের বেঞ্চ থেকে প্রশ্ন এল, “স্যার মানুষের মতো অন্য স্পিসিসগুলোর কী হল? এসএম ক্লাস ছেড়ে যেতে যেতে বললেন, “হোমো স্যাপিয়েন্স সবাইকে খতম করেছে।” ঠেলাঠেলি করে ক্লাস থেকে বেরতে বেরতে দেবোপম দেখল, অমৃতা এক দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে।

রক্তদান ও হিমোফোবিয়া

দেবোপম সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়া ভালো ছাত্র। লম্বা, ফরসা, রোগা, ঈষৎ কটা চুলের দেবোপমকে পাতলা দাড়ি রাখার ফলে একেবারে যিশুখ্রিস্টের মতো দেখায়। খেলাধুলায় মন বা ভালোরকম খেলাধুলা করার সক্ষমতা ওর কোনও দিনই ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ভাবুক প্রকৃতির দেবোপম মন দিয়ে পড়াশোনা করত আর অবসর সময়ে নানারকম কল্পনা করে তার মধ্যেই হারিয়ে থাকত। ওর বাবার বেশ বড় একটা রেডিমেড গারমেন্টসের তিনতলা দোকান আছে, সেই সঙ্গে জামাকাপড় তৈরি এবং এক্সপোর্টের ব্যাবসা। দেবোপমের দাদা ম্যানেজমেন্ট পড়ে। পাশ করলেই বাবার ব্যাবসা দেখবে। দেবোপম যে নিজের প্রিয় সাবজেক্ট জুলজি পড়তে ঢুকেছে, সে ব্যাপারে বাড়ির কারও আপত্তি নেই। বাবা-মা-র আশা, দেশে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করে, বিদেশে গবেষণা ইত্যাদি করে যবে হোক চাকরিবাকরি করবে, কোনও তাড়া নেই। মেয়েদের সম্বন্ধে ওর চিন্তাভাবনা চিরকাল কবিতার বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হায়ার সেকেন্ডারি পড়ার সময় ওকে দেখে ক্লাসের এবং কোচিং-এর একাধিক মেয়ে মুগ্ধ হয়ে নানাভাবে আলাপ করার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেবোপম এমন সিটিয়ে থাকত যে, সেইসব কন্যাই আশা ত্যাগ করে হাওয়া হতে বাধ্য হয়েছিল। পুরো বয়ঃসন্ধির সময়টাই দেবোপম বাস্তবের নারীদের মুখোমুখি হবার চেয়ে কল্পনার নারীদের সঙ্গে মেলামেশা করাতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিল। কিন্তু অমৃতাকে দেখার পরেই ও প্রথম বুঝল যে, ওর কল্পনার চেয়েও বেশি মনের মতো কেউ থাকতে পারে। আগে থেকে ছোটখাটো টিকা না নিলে যেমন ভাইরাসের আক্রমণ ভয়ংকর হয়ে দেখা দেয়, ঠিক সেইরকম প্রেমের কোনও ছোটখাটো অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে এই ‘ফার্স্ট-সাইটিস’ রোগের ভাইরাসের আক্রমণে দেবোপম বিপর্যস্ত হয়ে গেল।

পরের ঘটনাটা ঘটল কলেজের ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের দিন। দেবোপম রক্ত দেওয়ার ব্যাপারে ভীষণ ভয় পেত। কিন্তু যদি অমৃতা রক্ত দিতে আসে তাহলে আবার একটা নজরে পড়ার ব্যাপার থাকতে পারে ভেবে দেবোপম বীরোচিত পদে ক্যাম্পে গিয়ে ঢুকল। ছুঁচ ফোটানোর সময়টা একটু কানের মধ্যে চিনচিন করলেও বাকিটা হাসিমুখে ও ভালোই ম্যানেজ দিল। হাতে মিষ্টি, ডিম, কলার প্যাকেট আর একটা কার্ড নিয়ে যখন দেবোপম বেরিয়ে আসছে, তখনই দেখল ওদের ক্লাসের মৃন্ময়ী অমৃতাকে এদিকে আনার চেষ্টা করছে। অমৃতা কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেবোপম কাছে যেতে মৃন্ময়ী যেন আরও মরাল সাপোর্ট পেয়ে গেল, বলল – “দেখ্‌, দেখ্‌, ওই যে রোগা পটকা দেবোপম, ও-ও তো ব্লাড দিল। কিচ্ছু হবে না! চলে আয়।” অমৃতার দু-চোখে মাখানো আতঙ্ক। ও খালি মাথা নাড়ছে আর বলছে “না, না। আমি ব্লাড দিতে পারব না। আমায় ছেড়ে দে।” দেবোপমের মাথার ভিতর থেকে কেউ প্রম্পট্‌ করল, ‘এই হল সময়’। দেবোপম হিরোর মতো এগিয়ে অমৃতাকে বলতে গেল, ‘আরে, কিছু না’, কিন্তু অমৃতার মুখ দেখে হঠাৎ ওর মনে হল এটা কোনও নারীসুলভ ন্যাকামি নয়, এর মূল অনেক গভীরে। ও গম্ভীর গলায় বলল, “ঠিক আছে। অসুবিধা থাকলে ব্লাড দেবে না। কিন্তু তোমার প্রবলেমটা কী জানতে পারি?” অমৃতা রুদ্ধশ্বাসে বলল, “আগে এখান থেকে চল। আমার অসুস্থ লাগছে।” দেবোপম সুযোগ বুঝে চট করে অমৃতার হাতটা ধরে ফেলল। তারপর ওরা তিনজন ক্যান্টিনে গিয়ে বসল। অমৃতা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। বলল “আমার একটা প্রবলেম আছে।”

“কী প্রবলেম?”

“আমার ছোটবেলা থেকেই রক্ত দেখলে, এমনকী রক্তারক্তির কথা বেশি ভাবলেও মাথা ঘুরতে থাকে। এমনকী আমি অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারি। ডাক্তার বলেছে এই রোগটার নাম হিমোফোবিয়া।” পাশে বসে মৃন্ময়ী ফিকফিক করে হাসছিল। দেবোপমের সমস্ত অন্তরাত্মা নিঃশব্দে মৃন্ময়ীকে বলছিল, ‘তুই এখান থেকে যা না।’ কিন্তু কথাটা তো আর মুখে বলা যায় না! মৃন্ময়ী ফিচেল হেসে বলল, “তুই ঢপ দিচ্ছিস অমৃতা। যার রক্তে ভয় আছে, সে কখনও জুলজি পড়তে আসে? তোকে তো ব্যাং, গিনিপিগ সবই কাটতে হবে। যতবার ডিসেকশন করবি, ততবার অজ্ঞান হবি?” অমৃতা একটু অসহিষ্ণুভাবেই বলল, “বিশ্বাস করা-না করা তোর ইচ্ছা। কিন্তু মানুষের রক্ত না হলে আমার কোনও প্রবলেম হয় না। আর হ্যাঁ, আমার নিজের হাত কেটে গেলেও আমার কোনও প্রবলেম নেই। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় অ্যাক্সিডেন্ট দেখলে।” মৃন্ময়ীর মুখ সুড়সুড় করছিল। দেবোপম এখানে না থাকলেই ও অমৃতাকে একটা প্রশ্ন করতই। দেবোপম মুখে একটু গাম্ভীর্য মাখিয়ে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, এই হিমোফোবিয়াটা কি শুধু ফোবিয়া, না এর কোনও প্যাথোলজিকাল সাইড আছে?” অমৃতা বলল, “জানি না। আসলে এটা খুব রেয়ার একটা সিনড্রোম।” এবারে অমৃতা উঠে পড়ল। বলল, “ভালো লাগছে না, বাড়ি চলে যাব।” দেবোপম বলল, “আজ কিন্তু এসএম-এর ক্লাস আছে। এসএম-এর ক্লাস তোমার ভালো লাগে না?” অমৃতা বলল, “হ্যাঁ, খুবই ভালো লাগে। কিন্তু আমার এখন অস্বস্তি লাগছে। বাড়ি গিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।” দেবোপম একটা রিস্ক নিয়ে বলল, “কীসে যাবে?”। অমৃতা বলল, “ওলা নিয়ে নেব।” দেবোপম একটা শেষ চেষ্টা দিয়ে বলল, “আমি পৌঁছে দেব? আমার গাড়ি আছে।” অমৃতার মুখটা হঠাৎ একটা হাল্কা হাসিতে ভরে গেল, বলল, “মেনি থ্যাঙ্কস, কিন্তু আমি একাই যেতে পারব, তোমার এসএম-এর ক্লাস মিস হয়ে যাবে।” দেবোপম নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে গিয়ে সোজাসুজি বলে ফেলল “হোক গিয়ে। চল তোমায় পৌঁছে দিই।” অমৃতা হাসিমুখ বজায়ে রেখেও বলল, “না। তার দরকার নেই।” এই প্রত্যাখ্যানে দেবোপমের মুখের সব আলো ঝুপ করে নিবে গেল। এতটাই সর্বহারার মতো দেখাতে লাগল তাকে, যে অমৃতাও একটু অনুতপ্ত হয়ে বলে ফেলল, “ঠিক আছে, আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দাও।”

ক্যান্টিন থেকে গেট বেশ খানিকটা পথ। এর মধ্যেই দেবোপমের জানা হয়ে গেল অমৃতা প্রচুর গল্পের বই পড়ে, ওরা দুজনেই দেখা গেল আইজ্যাক আজিমভের সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত। তবে অমৃতার সায়েন্স ফিকশনের দৌড় অনেকটা বেশি। ও স্তানিস্লো লেমের লেখার খুব ভক্ত, যে লেখকের নামও দেবোপম শোনেনি। অমৃতা খুব উৎসাহভরে দেবোপমকে লেম যে কত ভালো লেখক তা বোঝাতে শুরু করল এবং প্রতিশ্রুতি দিল, ওকে লেমের ‘ফেবলস ফর রোবোস’ পড়াবে। আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর অমৃতা আবিষ্কার করল, তার শারীরিক অসুস্থতা কমে গেছে এবং বাড়ি যাবার প্রয়োজন নেই। ওরা ফের পাঁচতলার দিকে রওনা দিল, কারণ এসএম স্যারের ক্লাস আড়াইটেয়। যেটা ওরা কেউই জানল না, সেটা হল, প্রায় পঁচিশজোড়া চোখ ওদের এই যাওয়া এবং ফিরে আসা খুব গভীরভাবে লক্ষ করেছে।

প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে দুর্ঘটনা

সব কলেজেই কিছু কিছু স্যার থাকেন, যাঁরা ছাত্রদের ভাষায় খোরাক। ইচ্ছামতো এঁদের পিছনে লাগা হয়। এঁরা সাধারণত সহজে মাথা গরম করে ফেলেন বা ভালো পড়াতে পারেন না কিংবা বাতিকগ্রস্ত—এইরকম হন আর কী। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের আরএস হলেন এরকমই একজন খোরাক। ইনি প্র্যাকটিক্যাল একেবারেই করাতে পারেন না, কিন্তু এঁর ধারণা ইনি অত্যন্ত দক্ষ এক্সপেরিমেন্ট-করিয়ে। তা ছাড়া কোনও অজ্ঞাত কারণে এঁকে ‘লিভ ইট’ বললে ইনি মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এই তথ্যটি ছাত্রপরম্পরায় চলে আসছে।

যেসব ছাত্রের জুলজিতে অনার্স থাকে, তাদের সাধারণত বটানি আর কেমিস্ট্রি পাস সাবজেক্ট হিসাবে থাকে। পাস সাবজেক্টে শুধু শতকরা তিরিশ পেলেই চলে। ফলে জুলজির ছাত্ররা মোটেও সিরিয়াসলি কেমিস্ট্রির ক্লাস করে না। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে উপস্থিত থাকে বটে, কিন্তু সেখানেও কাজের সঙ্গে বহুবিধ বাঁদরামি চলতে থাকে। সেশনের প্রথম দিকে সাধারণত পাসের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস শুরু হয় না। সেশন মাসখানেক গড়িয়ে গেলে তবেই ব্যাপারটা শুরু হয়। দেবোপম সে দিন কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যালে ঢুকে লক্ষ করল অমৃতা পিংক সালোয়ার কামিজের উপর সাদা অ্যাপ্রন চড়িয়েছে। দেবোপমের মনে প্রশ্ন জাগল পরিরা কি অ্যাপ্রন পরে? তারপর মনে হল, অ্যাপ্রন পরিহিতা অমৃতাকে যেন অনেক বেশি ভালো দেখাচ্ছে। আচ্ছা, বিশ্বসুন্দরীদের একটা অ্যাপ্রন পরা রাউন্ড থাকলে কেমন হত?

অমৃতার প্র্যাকটিক্যাল পার্টনার হল দিয়া মণ্ডল, ভয়ানক পড়াশোনা করা সিরিয়াস টাইপের মেয়ে। ওরা একটা চারকোল ব্লকের উপর স্যাম্পল নিয়ে বেসিক র‍্যাডিক্যাল বের করার চেষ্টা করছে। দেবোপমের পার্টনার অভিজিৎ জয়েন্ট অ্যাস্পিরেন্ট। কলেজে আসার থেকে বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করাই তার বেশি পছন্দ। আজও আসেনি। দেবোপম চারকোল ব্লকের গর্তে স্যাম্পল আর সোডিয়াম কার্বোনেটের মিশ্রণ রেখে ব্লো-পাইপ দিয়ে বুনসেন বার্নারের ফ্লেমটা ফোকাস করে চারকোল ব্লকে ফেলার চেষ্টা করতে শুরু করছিল, হঠাৎ কানের কাছে বিকট গর্জন! কে? কে আবার, আরএস স্যার!

“বলি, বেসিক র‍্যাডিক্যালের প্রিলিমিনারি টেস্টগুলো করেছ? না প্রথমেই চারকোল ব্লক নিয়ে পড়লে?”

“স্যার! প্রিলিমিনারি টেস্ট বলে তো কিছু নেই। যে কোনওটা দিয়েই তো শুরু করা যায়!”

“ফের মুখে মুখে তর্ক শুরু করেছ? প্রথমে ফ্লেম টেস্ট! দেখি কোথায় তোমার স্যাম্পল? তোমার প্ল্যাটিনাম ওয়্যার কই? এই যে প্রথমে ডাইলিউট এইচসিএলে প্ল্যাটিনাম ওয়্যার ভিজিয়ে তারপর স্যাম্পলে …”

“স্যার, পুরো স্যাম্পল যে এইচসিএলে ভেসে গেল!”

“হুঁ! যত ইনএফিশিয়েন্ট সব ছেলে!” বলে গজগজ করতে করতে আরএস অমৃতাদের দিকে রওনা হলেন। প্রথমেই দিয়াকে এক ধমক লাগালেন, “তুমি ব্লো-পাইপ ঠিকমতো ধরতে জান না? আগে ব্লো-পাইপ ধরতে শেখ। বলে ব্লো পাইপটা ঘুরিয়ে ধরে বললেন “এইবার ফুঁ দাও।” ব্লকটা স্যারের হাতেই ছিল। দিয়া ফুঁ দিতেই ব্লো-পাইপের হাওয়া বুনসেন ফ্লেমটিকে ফোকাস করে ফেলল স্যারের হাতে। ‘বাপ রে’ বলে বিকট চিৎকার করে আরএস ব্লকটক ফেলে দিয়ে বেসিনের জলে হাত ভেজাতে লাগলেন। সেই সঙ্গে তারস্বরে দিয়াকে বকতে শুরু করলেন, “তোমাকে ওইভাবে ফুঁ দিতে কে বলেছে?” দিয়া বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে বলল, “কেন, আপনিই তো আমায় ফুঁ দিতে বললেন।”

“আরে, তা-ই বলে তুমি আমার হাতে ফুঁ দেবে?”

“স্যার ব্লো-পাইপও আপনি ধরেছিলেন আর চারকোল ব্লকও আপনি ধরেছিলেন। আমি তো শুধু ফুঁ দিয়েছিলাম!”

দেবোপম দেখছিল স্যারের পিছনে দাঁড়িয়ে অমৃতা নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে। হাসির চোটে সমস্ত শরীরটা মাঝে মাঝে দুলে উঠছে। দেবোপমের সঙ্গে চোখাচোখি হতে অমৃতার হাসির দমক আরও বেড়ে গেল। মুগ্ধ দেবোপম আবার দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ত। কিন্তু কানে এল এসআর-এর চিৎকারঃ “কী! আবার মুখে মুখে তর্ক। কিছু বলি না বলে তোমাদের সাহস ক্রমশ বেড়ে চলেছে অ্যাঁ!!” বেসিন থেকে হাত তুলে এসআর বললেন, “প্র্যাকটিক্যালের কোনও সেন্স নেই। দেখিয়ে দিতে গেলে”, ঠিক সেই সময় পিছন থেকে আওয়াজ এলঃ “লিভ ইট স্যার।” বাস! অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল। বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে—“কে বললে?” বলে ব্যাঘ্রগর্জন করে পিছন ফিরতে গিয়েই সহসা দুর্ঘটনা! অমৃতা ছিল আরএস-এর ঠিক পিছনে। স্যারের আশি কেজি বপুর ধাক্কায় ঠিকরে গিয়ে টেবিলের কোণে পড়ল। সেখান থেকে সটান মেঝের উপর। দেবোপম হুড়মুড় করে এগিয়ে এসে দেখল অমৃতা অজ্ঞান হয়ে গেছে।

মুহূর্তের মধ্যে জল, জল কোথায়, ডাক্তার কোথায় ইত্যাদি আওয়াজে কেমিস্ট্রি ল্যাব মুখরিত হয়ে উঠল। আরএস কী সব বলতে বলতে সবেগে কেটে পড়লেন মনে হল। কেমিস্ট্রির হেড পারমিতা ম্যাডাম এসে উপস্থিত হলেন। আর এসেই সমস্ত বিশৃঙ্খল ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। একটি ছেলেকে ছোটালেন এনএসএস রুমে। সেখান থেকে কলেজের ডাক্তারবাবুর ফোন নম্বর নিয়ে আসতে। তারপর একটা অ্যামোনিয়াম হাইড্রক্সাইডের শিশি খুলে বোতলের তরল পদার্থ একটু ফিলটার পেপারে মাখিয়ে অমৃতার নাকের কাছে ধরলেন। অমৃতা একটু নড়েচড়ে চোখ খুলল। আর কয়েক সেকেন্ড চোখ পিটপিট করেই ধড়মড় করে উঠে বসল। পারমিতা ম্যাম সস্নেহে প্রশ্ন করলেন “কী ঠিক লাগছে? আহা আহা উঠ না। কী মুশকিল!” অমৃতা সরাসরি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার টাল খেয়ে গেল। কিন্তু দেবোপম রেডি হয়েই ছিল। খপ করে ধরে ফেলল, ফলে দ্বিতীয়বার পতন থেকে অমৃতা রক্ষা পেয়ে আস্তে আস্তে বসে পড়ল। পারমিতা ম্যাম প্রশ্ন করলেন, “কোথাও লেগেছে?” যন্ত্রণায় অমৃতার মুখ বেঁকে যাচ্ছিল। বলল, “কিছু না ম্যাডাম। পেটের এই পাশে একটু লেগেছে।”

“ঠিক আছে, একটু শুয়ে থাক, ডক্টর মিত্রকে ফোন করছি। উনি …” কথা শেষ হবার আগেই অমৃতা আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। “না ম্যাডাম! ডাক্তারের কোনও দরকার নেই।”

“আরে সে সব আমি বুঝব। তুমি এখানে বেঞ্চে বসো তো।”

কিন্তু উত্তেজনায় অমৃতার গলা চড়ে গেল। বলল, “না না ম্যাডাম আমি কোনও ডাক্তার দেখাব না। আমি বাড়ি চলে যাব।” পারমিতা ম্যাডাম খুব ঠান্ডা কিন্তু ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা, তিনি সামান্য বিরক্ত গলায় বললেন, “যা বলছি শোন। পেটে কোথায় লেগেছে সেটা ডঃ মিত্র একবার দেখে নিন, তারপর বাড়ি তো যাবেই।” কিন্তু অমৃতা প্রায় চেঁচিয়েই বলল “আমি আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ছাড়া কাউকে দেখাব না।” তারপর ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি ম্যাডাম প্লিজ কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আমরা কেবল ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকেই দেখাই।” তারপর টলমল করে বেরনোর চেষ্টা করতে গেল। পারমিতা ম্যাডাম একবার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, তারপর সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বোঝা গেল, উনি মারাত্মক চটেছেন। দেবোপম আর দিয়া দুদিক থেকে অমৃতাকে গিয়ে ধরল। তারপর দেবোপম বলল, “আমার গাড়িতে বাড়ি যেতে আশা করি কোনও আপত্তি নেই?” অমৃতা কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে বলল, “প্লিজ তাই কর, আমি দাঁড়াতে পারছি না।” আরও কয়েকজন মেয়ে এসে হাত লাগিয়ে অমৃতাকে একতলায় নামিয়ে দিল।

গাড়িতে যেতে যেতে দেবোপম বারবার প্রশ্ন করছিল, “কেমন লাগছে?” অমৃতা কষ্টে হেসে উত্তর দিচ্ছিল, “সব ঠিক আছে।” তারপর হালকা হাতে দেবোপমের হাত ধরে ভরসা দেবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু দেবোপমের মনে হচ্ছিল যে, অমৃতা আস্তে আস্তে আবার অজ্ঞান হবার দিকে যাচ্ছে। মুশকিলের ব্যাপার হল, অমৃতার বাড়ি হল রিজেন্ট পার্কের দিকে। সেদিকটা না চেনে দেবোপম, না চেনে তার ড্রাইভার। অমৃতা যদি আবার অজ্ঞান হয়ে যায় তো বাড়িটা কে চেনাবে? কিন্তু সেসব হবার আগেই রিজেন্ট পার্কের মোড় এসে গেল। গাড়ি গলির মধ্যে ঢোকান হল। একটু এগিয়ে বাঁ দিকে একটা পুরানো গেট দেখিয়ে অমৃতা বলল, “এই বাড়ি।”

রিজেন্ট পার্কের মতো ঘিঞ্জি জায়গায় এতবড় একটা কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়ি থাকতে পারে, দেবোপম আশাই করতে পারেনি। সামনে প্রায় দশ কাঠা বাগান হবে। বাগানটা যেন কীরকম। পরিষ্কার কিন্তু বড় বড় গাছে ভরতি। গাছের পিছনে বাড়িটা দেখাই যায় না। বাড়িটাও কীরকম রংচটা পোড়োমতন। কিন্তু সামনে গাড়িবারান্দা আছে। গাড়ি এসে দাঁড়াতেই চার-পাঁচজন লোক এসে পাশে দাঁড়াল। এদের তো দরোয়ান বা সিকিয়োরিটি ক্লাসের লোক বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা বলে বোঝাতেই ওদের একজন বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করে অমৃতাকে পাঁজাকোলা করে তুলে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। এমনভাবে নিয়ে গেল যেন অমৃতা একটা বাজারের ব্যাগের থেকেও হালকা। বাকিরা ওই লোকটার পিছন পিছন চলে গেল। দেবোপমকে কেউ একটা কথাও বলল না।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দেবোপম যখন ফিরে যাবে বলেই মনস্থ করেছে, তখনই এক বয়স্ক ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর দেবোপমকে দেখে বললেন, “ওহ্‌! আপনিই তো অমুকে নিয়ে এসেছেন। আসুন! আসুন! ভিতরে আসুন।” তারপর দেবোপমকে নিয়ে বাড়ির ভিতর যেতে যেতে বললেন “আমি অমৃতার বাবা। আসলে বাড়িতে একটা ছোট অনুষ্ঠান আছে। আত্মীয়স্বজন এসেছে। এর মধ্যে এই কাণ্ড! কিছু মনে করবেন না।” দেবোপম অমৃতার বাবাকে লক্ষ করছিল। পাজামা-ফতুয়া পরা, কিন্তু চেহারাটি ভারী সুগঠিত। ফরসা, লম্বা এবং কাটা কাটা নাক-চোখ। চেহারা দেখলে অমৃতার বাবা বোঝা যায়। দেবোপম নিজের পরিচয় দিল। বলল, “আমি অমৃতার ক্লাসমেট।” তারপর নিচু হয়ে প্রণাম করতে যেতেই ভদ্রলোক একেবারে হাঁ হাঁ করে আটকালেন। এরপর বাড়ির ভিতরে যাওয়া হল।

বসবার ঘরটা বেশ বড়। বিশেষ করে ছাতটা বড্ড উঁচু। ফলে ঘরের আলো কম মনে হচ্ছে। দেবোপমকে বসিয়ে অমৃতার বাবা ভিতরে কোথাও চলে গেলেন। একটু পরে চা হাতে যিনি এলেন, তিনি নিশ্চয়ই অমৃতার মা। দু-একটা ছোটখাটো কথা। অমৃতাকে পৌঁছে দেবার জন্য প্রচুর এবং বিগলিত ধন্যবাদ। দেবোপম এদের ভদ্রতায় অভিভূত হলেও ফর্ম্যালিটির বড্ড বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল। যেন দেবোপম মেয়ের ক্লাসমেট নয়, বরং মেয়ের মাস্টারমশাই। দেবোপমের আরও একটা ব্যাপারে অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন আড়াল থেকে অনেক জোড়া চোখ ওর দিকে কঠিন নজর রাখছে। অমৃতা কেমন আছে প্রশ্ন করায় ওর মা জবাব দিলেন, ওকে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান দেখেছেন এবং বলেছেন, সিরিয়াস কিছু হয়নি। দেবোপম ভেবে পেল না, এত অল্প সময়ের মধ্যে ডাক্তারকে ডাকলই বা কে আর ডাক্তার দেখলেনই বা কখন? না-করা প্রশ্নটা বুঝে নিয়েই যেন অমৃতার মা বললেন, “আজ বাড়িতে একটা গেট-টুগেদার আছে তো, ডাক্তারবাবুও নিমন্ত্রিত। তাই তক্ষুনি অমৃতাকে দেখা হয়ে গেছে।” দেবোপমের খুব ইচ্ছা করছিল যদি অমৃতা একবার আসে। কিন্তু সেরকম কোনও ঘটনা ঘটবে বলে মনে হচ্ছিল না। দেবোপমের এ-ও মনে হচ্ছিল যে, যেহেতু বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে ওকেও তাতে অংশ নিতে বলা হবে। এই মনে করে যখন ও বলল, “তাহলে কাকিমা আজ আমি আসি?” তখন অমৃতার মা-র মুখে একটা স্বস্তির ছায়া খেলে গেল। তিনি বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম। ঠিক আছে। আবার এস কিন্তু!”

দেবোপম বেরতে বেরতে সতৃষ্ণ নয়নে বাড়ির দিকে ফিরে তাকাচ্ছিল। নজরে পড়ল সেই যুবককে, যে অমৃতাকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেবোপমকে দেখছে। দৃষ্টিটা খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ বলে মনে হল না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেবোপমের মনে হল, আচ্ছা, আজ অমৃতাকে দেখতে বরপক্ষ আসেনি তো? তাই দেবোপম মোটেও স্বাগত অতিথি নয়, আর ওই যুবক হল অমৃতার বয়ফ্রেন্ড কাম বর? কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারে পড়া মেয়ের আজকাল কেউ বিয়ে দেয় নাকি? যাঃ! কিন্তু এটা তো হতেই পারে যে, হয়তো আজ বাড়িতে অন্য কোনও অনুষ্ঠান আর তাই অমৃতার বয়ফ্রেন্ড নিমন্ত্রিত! হঠাৎ দেবোপমের মনে হল, বাড়িতে গেট-টুগেদার থাকলে অমৃতা কলেজে গিয়েছিল কেন? তারপরে যে কজনকে গাড়ির চারপাশে দেখা গেল, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদও কিন্তু অনুষ্ঠানবাড়ি আসার মতো নয়। এই পরিবারকে ঘিরে নিশ্চয়ই কোনও একটা রহস্য আছে।

কিন্তু দেবোপমের আঠেরো বছরের মন বেশিক্ষণ রহস্য সন্ধানে থাকতে পারল না। তার খালি মনে হতে লাগল সেই সময়গুলোর কথা, যখন অমৃতা ওর হাত ধরে ওকে বলছিল সব ঠিক আছে। আহা রে, ওকে যদি অসুস্থ অমৃতার পাশে থাকতে দিত! যদি অমৃতার রক্তের প্রয়োজন হত, ওদের ব্লাড-গ্রুপ এক হত আর ও অকাতরে রক্ত দিতে পারত। গাড়ি ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনে দেবোপমের বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু দেবোপমের সেদিকে কোনও খেয়াল ছিল না। সে তখন দিবাস্বপ্নে বিভোর।

প্রত্যাখ্যান ও আঘাতপ্রাপ্তি

কোনও কিছু না ভেবেই দেবোপম রাসবিহারীর দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। মনের মধ্যে প্রবল ঝড় বইছে। আর সেই ঝড়ের মধ্যে কে যেন বারবার চিৎকার করে বলছে। “অসম্ভব। বোকার মতো কথা বলবি না।” দেবোপম নিজেকে এক হাজার ছশো তেইশবারের মতো বলল, “সব শেষ। অমৃতা আর আমার সঙ্গে কথা বলবে না। মনে হচ্ছে কী গাধা আমি, গাল বাড়িয়ে থাপ্পড় খেতে গেলাম। এখন প্রোপোজ না করে যদি আরও পরে বলতাম বা একেবারেই না বলে বন্ধুর মতোই থাকতাম তাহলে কখনও না কখনও অমৃতা আমার উপর দুর্বল হয়ে পড়তেও পারত। এখন গোটা কলেজ কাল জিজ্ঞাসা করবে, কী হয়েছিল। তারপর আমাকে দেখে ছেলেগুলো আওয়াজ দেবে, মেয়েগুলো হাসবে। উঃ!! আমি কী ভীষণ ছাগলামো করলাম! আমি গোরুর থেকেও গাধা। অমৃতা আর আমার সঙ্গে কথা বলবে না। আমার বেঁচে থেকে কী লাভ? এত মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেও দেবোপম লক্ষ করল, তার মনে অমৃতার প্রতি কোনও রাগ হচ্ছে না। সত্যিই তো, ও কি অমৃতার মতো স্বর্গের অপ্সরার উপযুক্ত! বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে গেলে যা হবার তা-ই হয়েছে। ঠিক হয়েছে! ঠিক হয়েছে!! দেবোপম বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় নিজের গালে দুটো চড় লাগিয়ে দিল।

আত্মধিক্কারে ডুবে যাওয়া দেবোপম একেবারেই খেয়াল করেনি যে, তার পাশে একটা অটো থামল। সেই অটো থেকে বেরিয়ে এল তার স্বপ্নের রানি। অমৃতা অটো থেকেই লক্ষ করেছিল যে, দেবোপম গ্রিক চার্চের সামনের ফুটপাথে অসংলগ্ন পদক্ষেপে হাঁটছে। নিজের গালে চড় মারার দৃশ্য দেখে অমৃতা আর থাকতে পারেনি। অটো থামিয়ে ভাড়া চুকিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল।

“এই পাগলা! এটা কী হচ্ছে শুনি?”

দেবোপম ভ্যাবলার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। অমৃতা সামনে দাঁড়িয়ে আছে! কী আশ্চর্য! আবার নিজে থেকে কথাও বলছে!!

“কোথায় যাচ্ছিস? তোর গাড়ি কই? কী হল? কথা বলছিস না কেন?”

দেবোপমের এতক্ষণের রুদ্ধ আবেগ চোখের জল হয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ল। অমৃতা কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা রুমাল বার করে খুব যত্নে দেবোপমের চোখের জল মোছাতে শুরু করল। নিজেও হয়তো ছোট্ট করে একটু চোখ মুছে নিল। তারপর বলল, “তুই আচ্ছা বোকা তো! কাঁদছিস?” দেবোপমের কান্নার চাপ আরও বেড়ে গেল। প্রায় নিজের মুখ টিপে ধরে ওর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা থেকে নিজেকে বিরত করতে হচ্ছিল। অমৃতা ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে রাসবিহারীর মোড়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল।

ওরা নীরবে রাসবিহারীর মোড় পার করে সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এর মোড় পর্যন্ত পৌঁছাল। তারপর মোড় নিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউ ধরে চলতে লাগল। বহুক্ষণের নীরবতা ভেঙে দেবোপম বলল, “তুই আমাকে অন্য কিছু বলবি?” অমৃতা বলল “তোকে কী বলি বল্‌ তো! তুই এত ছেলেমানুষ কেন? তুই আমার কতটুকু জানিস, যে একেবারে প্রোপোজ করে ফেললি? আমার কোনও বয়ফ্রেন্ড আছে কী না, জিজ্ঞাসা করেছিস?” দেবোপম সটান অমৃতার চোখের দিকে তাকাল। বলল, “আমি কিচ্ছু জানতে চাই না। আমি শুধু জানি, আমি তোকে ভালোবাসি। বাস!” অমৃতা বলল, “আর আমি যদি এরকম রিলেশন না চাই?” দেবোপমের গলা প্রায় বুজে আসছিল, তবু বলল, “তাতেও কিছু যাবে আসবে না।” অমৃতা একটু অবাক গলায় বলল “তুই কি আমাকে হরণ করে নিয়ে যাবি নাকি।” দেবোপম বলল, “তোর ইচ্ছে না থাকলে একশোবার না।” কথা বলতে বলতে ওরা লেকের সামনে চলে এসেছিল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। জায়গাটায় বিশেষ কোনও লোকজন নেই। খালি হেডলাইট জ্বেলে গাড়িগুলো ছোটাছুটি করছে।

অমৃতা বলল, “তাহলে তোর এই ভালোবাসার ভবিষ্যৎ কী?” দেবোপম বলল, “কী, কেন, কিচ্ছু আমি জানি না। তুই কী করবি, তাতেও আমার কিছু যাবে আসবে না। আমি তোকে ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। তুই যা চাস তা-ই কর্‌। আমি কোনওরকম ইন্টারফিয়ার করব না, কথা দিচ্ছি।” অমৃতা দেবোপমের দিকে ফিরে বলল, “তাহলে কান্নাকাটি বন্ধ করবি তো?” দেবোপম বলল, “তুই গালিবের নাম শুনেছিস?” এইবার অমৃতা হেসে ফেলল, বলল, “দিল হি তো হ্যায়, না সংগকে/দর্দসে…” কিন্তু অমৃতার কথা থামিয়ে পাশ থেকে শিসের শব্দ শোনা গেল। চকিতে ঘুরে দেবোপম দেখল দুটো ছেলে, খুব সম্ভব অবাঙালি, গলায় চেন, এক কানে দুল, বাইকে ঠেস দিয়ে লেকের রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে। তাদেরই একজন শিসটি দিয়েছে এবং এবারে অন্যজনের মন্তব্য শোনা গেল, “ওহো চিকনি, গালিব সুনা দে রে।” দেবোপমের এতক্ষণের হতাশা-ক্ষোভ সব রক্ত হয়ে চোখের সামনে ফুটতে আরম্ভ করল। অমৃতা বলল, “না, দেবোপম না…”। বলতে বলতেই দেবোপম সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হয়ে মন্তব্যকারীর কলার চেপে ধরল, আর তার পরমুহূর্তেই একটা বিরাট ধাক্কা খেয়ে ফুটপাথে লুটিয়ে পড়ল।

অন্য দিন হলে দেবোপম আর উঠতে পারত না। কিন্তু আজ তার উপরে নিশ্চয়ই কোনও মধ্যযুগীয় নাইটের আত্মা ভর করেছিল। কাজেই ও বীরবিক্রমে লাফ মেরে উঠে ধাক্কা-মারা ছেলেটার মুখে বিরাট এক ঘুসি বসিয়ে দিল। ছেলেটা পিছিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করল, তার ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে। ছেলে দুটো দেবোপমের প্যাংলা চেহারা দেখে ওকে সিরিয়াসলি নেয়নি। কিন্তু এবারে লড়াইটা সিরিয়াস চেহারা নিল। শিস-দেওয়া ছেলেটা পিছন থেকে দেবোপমকে জাপটে ধরল, যাতে ও আর নড়াচড়া না করতে পারে। এবারে ঘুসি-খাওয়া ছেলেটা নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে এগিয়ে এল। ক্রূর চোখে অন্যজনের হাতের বাঁধনে ছটফট করা দেবোপমকে দেখতে দেখতে নিখুঁত দক্ষতায় দেবোপমের চোয়ালে একটা আপারকাট লাগাল। তার পরের মুহূর্তেই তলপেটে প্রচণ্ড লাথি। প্রচণ্ড যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে করতে দেবোপম দেখল, হঠাৎ ওর আর ওর আক্রমণকারীর মাঝে নিঃশব্দে অমৃতা এসে দাঁড়িয়েছে। দেবোপমের মুখ ভরতি রক্ত। চোয়াল নড়ছে না, কাজেই ও কিছু বলার অবকাশ পেল না। ছেলেটি অমৃতার দুটো কাঁধ ধরবার চেষ্টা করছিল। অমৃতা খুব নির্বিকারভাবে ছেলেটার হাত চেপে ধরল। তারপরেই হঠাৎ হাড় ভাঙার মটমট শব্দ হল। ছেলেটা আর্ত চিৎকার করে বসে পড়ল। তারপর হাতের সাহায্য ছাড়া টলমল করে উঠে দাঁড়াল। দু-চোখে নিখাদ আতঙ্ক। অন্যজন দেবোপমকে ছেড়ে দিতেই, দেবোপম পড়ে গেল। এবারে ওই ছেলেটি অমৃতার দিকে এগতেই অন্যজন চিৎকার করে উঠল, “উসকে পাস মত জা! ডাইন হ্যায়।” ছেলেটি ঠিক কী হয়েছে বুঝতে না পেরে নার্ভাস হয়েই পকেট থেকে একটা ছুরি বার করে ফেলল। অমৃতা ওর দিকে একপা এগোতেই অন্য ছেলেটি আবার চেঁচিয়ে উঠল, “আরিয়ন, ভাগ যা। চুড়েল হ্যায়। জান লে লেগি।” দেবোপম অজ্ঞান হতে হতে দেখল, অমৃতা অন্য ছেলেটাকে দু-হাতে ধরে মাথার উপর তুলে প্রচণ্ড শক্তিতে ফুটপাথের উপর আছাড় লাগাল। অন্য ছেলেটা প্রাণভয়ে চিৎকার করছিল, “বাঁচাও বাঁচাও!” দেবোপমের আর কিছু মনে নেই।

প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে ধীরে ধীরে দেবোপম নিজেকে একটা বিছানার উপর আবিষ্কার করল। চোয়াল নাড়াবার কোনও উপায় নেই, কিছু একটা দিয়ে বাঁধা রয়েছে। একটা পরিষ্কার ঘর, টিউবলাইট আলোকিত, এসি চলছে। ঘাড় ঘোরানোর চেষ্টা করল দেবোপম। না, কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। হাতে কী একটা বাঁধা, ওঃ! এটা তো একটা চ্যানেল। মানে ও কোনও একটা হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে আছে, অমৃতা? ও কোথায়? ওর কোনও বিপদ হয়নি তো?

মুহূর্তের মধ্যে ওর মনে পড়ে গেল সেই দৃশ্যটা। অমৃতা, সেই পরির মতো চেহারার অমৃতা দু-হাতে একটা বলশালী ছেলেকে অবলীলায় মাথার উপর তুলে আছাড় মারছে। কী করে সম্ভব? অমৃতা নিশ্চয়ই মার্শাল আর্ট জানে। কিন্তু দেবোপমের অবচেতন মনের কোনও জায়গা থেকে একটা আওয়াজ এল, ‘এটা মার্শাল আর্টের কর্ম নয়।’ না অমৃতার নিশ্চয়ই কিছু হয়নি। দেবোপম একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পরমুহূর্তেই তার মনে হল, এই জীবনে আর কখনওই তাকে অমৃতার নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। দেবোপমের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসছিল। ও আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

এবারে ঘুম ভাঙার সময় দেবোপম সামনে এক হাসি হাসি চেহারার নার্সকে দেখতে পেল। নার্সটি হাসিমুখেই বলল, “জ্ঞান ফিরেছে। ভালো লাগছে?” দেবোপমের মুখ নাড়াবার উপায় ছিল না, মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাবার চেষ্টা করল। নার্স আবার বলল, “এখন দিন তিনেক মুখ নাড়ানো যাবে না। মা আর বাবা বাইরে আছেন। আসতে বলছি।”

মা বিছানার পাশে এসে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে দিল। বাবা পাশে দাঁড়িয়ে, মুখ গম্ভীর, কিন্তু চোখে রাজ্যের খুশি মাখানো। একটু পরে মাকে বললেন, “তোমার কান্না শেষ হল?” মা একটু কান্না-কান্না গলাতেই বললেন, “এ কী কাণ্ড তুই করলি বল্‌ তো। জীবনে কোনও দিন একটা পিঁপড়ের গায়ে হাত তুলিসনি আর সেই তুই গেলি গুন্ডাদের সঙ্গে মারামারি করতে?” বাবার ভারী গলা শোনা গেল, “তো কী করবে? ওর সামনে ওর… মানে একটা মেয়েকে অপমান করবে আর ও ছেড়ে দেবে? ঠিক করেছিস! আমি এতদিন ভাবতাম, দেবুটা কবে মানুষ হবে, ভগবান আমার কথা শুনেছেন। দু-দুটো গুন্ডাকে পিটিয়ে দিয়েছে, আফটার অল, ছেলে কার দেখতে হবে তো?” দেবোপমের মা একটু রেগেই বললেন, “তোমার মতো গুন্ডা হয়ে আর কাজ নেই। সেবারে তো …।” দেবোপম গল্পটা জানত, ওর দাদার জন্মেরও আগে, ওর বাবার তখন ছোট্ট রেডিমেড গারমেন্টসের একটা দোকান ছিল। দুই তোলাবাজের সঙ্গে মারামারি করে বাবা মাসখানেক হাসপাতালে ছিল। দেবোপম বলার চেষ্টা করল, ব্যাপারটা এরকম নয়, কিন্তু মুখ নাড়ার উপায় নেই। ওর বাবা আবার বললেন, “অমৃতার বাবা নার্সিং হোমে এসেছিলেন। আমাকে প্রচুর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেছেন। বলেছেন ওঁর মেয়ের সম্ভ্রমরক্ষার জন্য ওঁরা পুরো পরিবার আমাদের কেনা হয়ে থাকবেন। অসম্ভব বিনয়ী ভদ্রলোক।” দেবোপমের চোখ দেখে মা না-বলা কথা আন্দাজ করে নিলেন। বললেন, “অমৃতাও এসেছিল। কী মিষ্টি মেয়ে।” দেবোপমের হৃদয়ের গভীর থেকে একটা বিরাট স্বস্তির শ্বাস পড়ল। যাক বাবা-মা-কে আর কিছু বলতে হবে না। ওরা সব বুঝে ফেলেছে। ওরা অমৃতাকে পছন্দও করে ফেলেছে। তাহলে পুরো ফ্যামিলিই অমৃতার ব্যাপারে লড়ে যাবে। বাবা সব পারে, অমৃতার বাবাকে ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। তাহলে একা অমৃতা আর কতদূর না করতে পারবে? ইন ফ্যাক্ট না-ই যদি করবে তাহলে অমৃতাই বা গল্পটা এইভাবে সাজিয়েছে কেন? ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন। নার্স এবারে সবাইকে বার করে দিচ্ছিল। দেবোপম আবার চোখ বন্ধ করে অমৃতার কথা ভাবতে শুরু করল। ওর হাসি, দেবোপমের চোখের জল মুছিয়ে দেওয়া, ওর গালিবের শায়েরি বলা, অমৃতার কল্পমূর্তি দেবোপমের প্রায় বুকের কাছে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ পিছন থেকে যেন কে চেঁচিয়ে উঠল, “পাস মত জা! ডাইন হ্যায়।” দেবোপম আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

রক্তের সম্পর্ক

দিন পনেরো পরে দেবোপম আবার কলেজে এসেছে। কলেজের বন্ধুদের কাছে একটা বিরাট হিরোর সংবর্ধনা পেল দেবোপম। এই ক-দিনে দেবোপমের চিন্তাভাবনার জগৎটা একেবারে বদলে গেছে। প্রথমত ও বুঝেছে যে, সত্যিটা যা-ই হোক, সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না। এই ঘাড়ে এসে পড়া হিরোর ভাবমূর্তি তাকে সারাজীবন বয়ে চলতে হবে। এতে তার বিশেষ কোনও আপত্তি ছিল না, কিন্তু যে অমৃতা ওকে বাঁচানোর জন্য ছুরির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, সে কিন্তু দেবোপমকে অ্যাভয়েডই করছে। দেবোপম স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, ঘটনাপ্রবাহের রাশ ওর হাতেও নেই, অমৃতার হাতেও নেই। গোটা কলেজ এখন দেবোপম আর অমৃতার প্রেমকাহিনি নিয়ে মশগুল। কিন্তু এহ বাহ্য, দেবোপমের চিন্তাগুলো অনেক বেশি জটিল।

দেবোপম অমৃতাকে ভালোবাসে। এ বিষয়ে দেবোপমের মনে কোনও সন্দেহ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিচ্ছু নেই। অমৃতার যদি বয়ফ্রেন্ড থাকে, অমৃতা যদি ওকে দূরে সরিয়ে রাখে, অমৃতা যদি আর কাউকে বিয়ে করে, এমনকী অমৃতার সঙ্গে ওর সারাজীবন দেখা না-ও হয়, দেবোপম অমৃতার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু দেবোপমের মনের একটা অংশ খুব ভালোভাবে জানে, অমৃতাও ওকে ভালোবাসে। এ কোনও যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করার বিষয় নয়, মন দিয়ে অনুভব করা সত্য।

কিন্তু এটাও ঠিক যে, একটা বিরাট গোলমাল কোথাও আছে। সেই গোলমালের কারণেই অমৃতা দেবোপমকে প্রত্যাখ্যান করেছে বা এড়িয়ে চলছে। প্রথমত, অমৃতার ডাক্তার দেখানোয় আপত্তি। দ্বিতীয়ত, অমৃতার ওই অদ্ভুত বাড়ি এবং আত্মীয়স্বজন। তৃতীয়ত এবং প্রধানত সেই সন্ধ্যায় অমৃতার সেই অসুরদলনী মূর্তি। আর শেষ কথা হল, অমৃতা ও তার পরিবারের পুরো ঘটনাটা চেপে যাওয়া। দেবোপম মনের ভিতর থেকে বুঝতে পারছে যে, অমৃতার সঙ্গে জড়ালে জীবনে শুধু ঝড় নয়, বিধ্বংসী টর্নেডো উঠবে এবং খুব সম্ভব সেই টর্নেডো ওদের দুজনকে, এমনকী ওদের দুই পরিবারকেও শেষ করে দিতে সক্ষম। কিন্তু দেবোপম অসহায়। অমৃতাকে ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। নিয়তি যেদিকে নিয়ে যায়, সেইমতো চলা ছাড়া ওর অন্য কোনও উপায় নেই।

প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস চলছে। জুলজি অনার্সের একটা প্র্যাকটিক্যাল হল ব্লাড-গ্রুপ টেস্ট। এমনিতে খুব সোজা প্র্যাকটিক্যাল। একটা নিড্‌ল্‌ দিয়ে নিজের আঙুলের ডগায় একটা ছোট্ট ফুটো করে যে রক্তের ফোঁটাটা বেরচ্ছে, সেটাকে একটা স্লাইডের উপর টানতে হয়। এই স্লাইডটা কিন্তু স্পেশাল। এটার মধ্যে চারটে ভাগ করা আছে। A, B, AB, O—আসলে এই চারটে ভাগে চাররকম কেমিক্যাল দেওয়া থাকে। যে গ্রুপের রক্ত, সেই গ্রুপের যে ভাগটা নির্দিষ্ট আছে, সেটা ছানা কেটে যাবার মতো হয়ে যাবে। মাইক্রোস্কোপের নিচে ধরলে পরিষ্কার বোঝা যায়। আর-একটা স্লাইড হল পজিটিভ-নেগেটিভ দুই ভাগ করা স্লাইড। সেটাতেও একই ব্যাপার। যে অংশটা রিঅ্যাক্ট করবে, সেইমতো পজিটিভ বা নেগেটিভ গ্রুপ হবে।

কাজ এখনও শুরু হয়নি। জুলজির বিখ্যাত কল্যাণী ম্যাডাম, যাঁকে অন্য ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা ভয়ে ভয়ে মিলিটারি মাসি বলে, এখন ব্লাড-গ্রুপ নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন।

“মানুষের সঙ্গে মানুষের বিজ্ঞানভিত্তিক তফাত এই একটাই, যাকে বলে ব্লাড-গ্রুপ। এখনও পর্যন্ত একান্নরকম তফাত পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে প্রাথমিক তফাত হল এই চাররকম অ্যান্টিজেন গ্রুপ আর পজিটিভ, নেগেটিভ। শতকরা পঁচাশিজন হল পজিটিভ আর পনেরো শতাংশ হল নেগেটিভ। এদিকে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় এ গ্রুপ বেশি, এশিয়ায় বি গ্রুপ বেশি, আফ্রিকায় বি গ্রুপ আর ও গ্রুপ দুইই প্রধান আর ল্যাটিন আমেরিকায় ও গ্রুপ খুব বেশি। ও গ্রুপ অবশ্য কমবেশি সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে। এ-বি গ্রুপ খুব কমই দেখা যায়, যদিও দক্ষিণ চিনের সাগর-ঘেঁষা অংশের লোকের মধ্যে এ-বি গ্রুপের মানুষের সংখ্যা বেশি। পজিটিভ-নেগেটিভ কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়ে আছে।

বক্তৃতা শেষ করে ম্যাডাম সবার হাতে একটা চার ভাগে ভাগ করা স্লাইড তুলে দিতে থাকলেন। অমৃতা হঠাৎ দেবোপমের কাছে সরে এল। বলল, “আমার আঙুলে ছুঁচ ফোটাতে ভীষণ ভয় লাগছে। আমার স্লাইডটায় তুমি তোমার ব্লাডটাই টেনে দিয়ো। এই কাণ্ডটা মেয়েরা অনেকেই করে। আশপাশে সাহসী নারী-পুরুষের অভাব না থাকায় ম্যানেজ হয়ে যায়। দেবোপম নিজের আঙুলে ছুঁচ ফুটিয়ে প্রথমে নিজের স্লাইডে টেনে তারপর অমৃতার স্লাইডটা নিতে গেছে, কিন্তু নজর করেনি, কল্যাণী ম্যাডাম দেখতে পেয়ে গেছেন। নিজের রক্ত অমৃতার স্লাইডে লাগাবার আগেই ক্যাচ-কট-কট। খপ করে হাত থেকে স্লাইড ছিনিয়ে নিয়ে মিলিটারি গলায় গুরুগুরু রবে বললেন, “বন্ধুর উপকার হচ্ছে? অ্যাঁ! এই জন্যই সবার ব্লাড-গ্রুপ একই রকম আসে। বলতে বলতে ম্যাডাম খপ করে অমৃতার আঙুল পাকড়ে ধরে ছুঁচ ফুটিয়ে রক্ত স্লাইডে টেনে নিলেন। অভ্যস্ত হাতে এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটল যে, অমৃতা কোনওরকম বাধা দিতে পারল না। কিন্তু স্লাইডটা অমৃতাকে না দিয়ে ম্যাডাম যখন চলে যাচ্ছেন তখন অমৃতা বুঝতে পারল। বলল “ম্যাম, স্লাইডটা?” কল্যাণী ম্যাডাম বললেন, “আর-একটা স্লাইড নাও, এটা আমি রেখে দেব। এটা ভালো টানা হয়েছে। আমরা টেন পারসেন্ট স্যাম্পল রেখে দিই।” অমৃতা সরাসরি ম্যাডামের সামনে চলে এল, “না ম্যাডাম, আমার ব্লাড স্যাম্পল আমায় দিয়ে দিন। ওটা রাখবেন না।” কল্যাণী ম্যাডাম তাজ্জব হয়ে অমৃতার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন অন্য গ্রহের জীব দেখছেন। তারপর বললেন “কেন? রাখব না কেন? তোমার ব্লাড স্যাম্পল কোনও কনফিডেনশিয়াল ডকুমেন্ট নাকি?” অমৃতা তখনও রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে দেখে একটা মিলিটারি ধমক ছাড়লেন, “সর! এত সাহস কী করে হয়! পাগল নাকি তুমি!” দেবোপম ভয়ে কাঁটা হয়ে দেখছিল, অমৃতা কল্যাণী ম্যামকে আক্রমণ করে স্লাইডটা কেড়ে না নেয়। কিন্তু অমৃতা অত্যন্ত কনফিউজড হয়ে কল্যাণী ম্যাডামের পথ ছেড়ে দিল। তারপর ফিরে এল। দেবোপম বলল “কী হল তোর? শরীর খারাপ লাগছে?” অন্যমনস্কভাবে “না না” বলতে বলতে অমৃতা অন্য দিকে চলে গেল। এরপর কিছুক্ষণ বাদে আর অমৃতাকে দেখা গেল না। অমৃতা কাউকেই কখনও সেল ফোনের নম্বর দিত না। পারতপক্ষে সেল ফোন ব্যবহারও করত না। উদ্‌বিগ্ন দেবোপম যোগাযোগ করতে না পেরে চিন্তায় রয়ে গেল।

ওদিকে ল্যাবরেটরির ভিতরের ঘরে, কল্যাণী ম্যাম এসএম স্যারকে ডেকে এনেছেন। “আচ্ছা দেখুন তো এই ব্লাড স্যাম্পলটায় কী গন্ডগোল? এমনিতে তো এ গ্রুপ মনে হচ্ছে, কিন্তু বি গ্রুপটাতেও তো কীরকম একটা হেজ দেখা যাচ্ছে। এসএম বললেন “কোনও কন্টামিনেশন হয়নি তো!”

“না না! আমার নিজের হাতে টানা!” এসএম মাইক্রোস্কোপের উপর ঝুঁকে পড়ে বললেন, “কতকগুলো অ্যাবনর্ম্যালিটি আছে। কার স্যাম্পল?”

“ওই তো লম্বা ফরসা মেয়েটার, অমৃতা না কী যেন নাম।”

“ওকে একবার ডাকুন তো, আর একটা স্যাম্পল নেব।”

একটু পরে কল্যণী ম্যাডাম ফিরে এসে বললেন, “দেখতে পেলাম না। অন্যরা বলল, কোথায় গেছে, জানে না।”

“কাল এলেই মনে করাবেন তো। ভেরি ইন্টারেস্টিং!” এসএম আবার মাইক্রোস্কোপের উপর ঝুঁকে পড়লেন।

কিন্তু কাল অমৃতা এল না। তার পরের দিনও নয়। বস্তুত অমৃতা আর কলেজে এলই না।

মৃতপ্রায় অমৃতা

অমৃতা কলেজে আসছে না। দেবোপমের রাত কাটে তো দিন কাটে না। সারা সপ্তাহ অমৃতাকে না দেখে শেষে শনিবার দেবোপম স্থির করল, বাড়িটা যতই অদ্ভুত হোক, অমৃতাদের ওখানে একবার খবর নিতে যেতেই হবে। রিজেন্ট পার্কের বাড়িটা চিনতে দেবোপমের কোনও অসুবিধা হল না। কিন্তু ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আবার দুটি ছেলে গাড়ির দুপাশে এসে দাঁড়াল। দেবোপম নামতেই খুব ভদ্র কিন্তু দৃঢ়ভাবে রাস্তা আটকে প্রশ্ন করল, “কাকে চাই?”

“অমৃতা আছে?”

“আপনি কে?”

“আমি ওর কলেজের বন্ধু।”

“একটু দাঁড়ান।”

একজন বাড়ির ভিতরের দিকে রওনা হল। আর-একজন দেবোপমের পাশেই রইল। এমনভাবে, যাতে দেবোপম কোনওভাবেই ভিতরে ঢুকতে না পারে। দেবোপম ওকে প্রশ্ন করে, “আপনি অমৃতার কে হন?” কিন্তু ছেলেটি শুনতে না পাওয়ার ভান করে কোনও উত্তর দেয় না। ইতিমধ্যে অমৃতার বাবা এগিয়ে এসেছেন—“আসুন! আসুন।” দেবোপম চূড়ান্ত অবাক হয়ে গিয়ে বলল, “আমি অমৃতার বন্ধু! আমাকে আপনি বলছেন কেন?” ভদ্রলোক কোনও জবাব দিলেন না। ইতিমধ্যে ওরা বাইরের ঘরে গিয়ে বসেছে। দেবোপম প্রশ্ন করল, “অমৃতা কলেজে যাচ্ছে না কেন?” অমৃতার বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে আছেন। বললেন—“ও তো এখানে নেই, দিল্লি গেছে। ওর মাসি ওখানে থাকে।” দেবোপম আরও অবাক হয়ে বলল, “এখন মিডসেশনে ক্লাস কামাই করে মাসির বাড়ি গেছে কেন?” ভদ্রলোক চূড়ান্ত বিব্রত মুখে বললেন, “না মানে মাসির খুব শরীর খারাপ তো, তাই।” দেবোপম এবারে ডিটেকটিভসুলভ ভঙ্গিতে বলল, “তা আপনারা না গিয়ে শুধু ও গেল কেন?” অমৃতার বাবাকে দেখলে মনে হচ্ছিল, পালাতে পারলে বাঁচেন। বললেন, “মানে আমাদের কাজ আছে, আর অমৃতা মাসিকে খুব ভালোবাসে তো, মানে মাসিই ওকে মানুষ করেছে তো আর …।” দেবোপম বলল, “আমার ওর সঙ্গে খুব দরকার। ওর ফোন নম্বরটা পাওয়া যাবে?” অমৃতার বাবা কীরকম তোতলা হয়ে বললেন, “ফোন… মানে ওর ফোন নম্বর দেওয়ার … মানে …,” এমন সময় দরজার পাশ থেকে অমৃতার মা-র গলা পাওয়া গেল, “ভালো ছেলেটাকে এত মিথ্যে বলে পাপ বাড়াচ্ছ কেন? ওকে সবটা সত্যি বলে দেওয়াই ভালো।” অমৃতার বাবা আরও চুপসে গেলেন মনে হল। অমৃতার মা একটা সোফায় বসে দেবোপমকে বললেন, “এখানে বসো। তোমাকে সব খুলে বলছি। কিন্তু তুমি কথা দাও, আর কেউ যেন কিচ্ছু জানতে না পারে।” দেবোপম উদ্‌বেগে প্রায় ভদ্রমহিলার হাত ধরে ফেলে বলল, “কাকিমা আগে বলুন অমৃতা কেমন আছে?” অমৃতার মা বললেন, “আগে সব শোন। তারপরে যা বলার বলো।”

“অমৃতাকে দেখে তোমার খুব ভালো লেগেছে—এটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী তোমাকেও আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছিল। তোমার বাবা-মা-রও তুলনা নেই। তোমার কী ইচ্ছা, সেটা আমি জানি। সেটা পূর্ণ হলে আমরা সবাই ধন্য হতাম। কিন্তু…” অমৃতার মা-র গলা কেঁপে গেল।

“মা হয়ে নিজের সন্তানের কথা কী করে বলি, কিন্তু অমৃতা তোমার যোগ্য নয়। ছোটবেলা থেকেই ও অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল ধরনের মেয়ে। ওকে দেখে সেটা কিছুতেই বোঝা যেত না। ওকে অনেক সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছি। ওরা বলে ও নিম্ফোম্যানিয়াক ধরনের। বারো বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। কোনওরকম বাছবিচার ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও আমরা ওকে ঠিক করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত বছরখানেক আগে পাপের ফল ফলল। মাঝে মাঝেই ওর জ্বর হত। ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করে বললেন এইচআইভি পজিটিভ। মানে ওর এইডস হয়েছে। এখন প্রায় শেষ অবস্থা। দিল্লিতে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ভরতি আছে। যে কোনও দিন…” অমৃতার মা আর পারলেন না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে নিজের মুখ ঢাকলেন।

দেবোপমের কয়েক মুহূর্ত ব্ল্যাক আউট হয়ে গেল। কানের মধ্যে একটা অদ্ভুত চিনচিন শব্দ। তারপর আস্তে আস্তে ওর সংবিৎ ফিরতে লাগল। সামনে অমৃতার মা দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন। অমৃতার বাবা মা-র পাশে বসে পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। দেবোপম বহু কষ্টে নিজের গলার স্বর ফিরে পেয়ে প্রশ্ন করল, “সেই জন্যই কি ওর ডাক্তার দেখাতে এত আপত্তি ছিল?” বাবা বললেন “হ্যাঁ, তাই।” দেবোপম এবারে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে সক্ষম হল। বলল, “আর সেই জন্যই ওর রক্ত পরীক্ষায় বা ব্লাড ডোনেশনে আপত্তি ছিল?” অমৃতার বাবা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। দেবোপমের বুকের মধ্যে কীরকম একটা যন্ত্রণা হচ্ছিল। ও বলল, “আমি অমৃতার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।” অমৃতার মা কান্না-ভেজা সুরে বললেন, “না তা করো না। এতে তোমার যন্ত্রণা আরও বাড়বে। ভুলে যাবার চেষ্টা কর। তোমার মতো ভালো ছেলে যে ওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েনি—এটা তোমার বিরাট সৌভাগ্য। ওকে ভুলে যাও। আর ক-দিনই বা। তারপর তো আমাদেরও সেই একই চেষ্টা করতে হবে। অমৃতার মা আবার উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

দেবোপম কয়েক মিনিট চুপ করে রইল। সবকিছুই ঠিকঠাক বোঝা গেল? কোথাও একটা খচখচ করছে। হঠাৎ দেবোপমের একটা কথা মনে হল। বলল, “আচ্ছা এইডস হলে তো মানুষের শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে যায়?” অমৃতার মা বললেন, “ঠিক তা-ই। শেষের দিকে ওর চলতে-ফিরতেও কষ্ট হত।”

“তাহলে সে দিন ওই ছেলে দুটোকে ও ওভাবে মারল কী করে?”

অমৃতার বাবা অবাক হয়ে বললেন, “ছেলে দুটোকে কে মেরেছে?”

“কেন অমৃতা?”

“কে বলেছে?”

“আমি নিজের চোখে দেখলাম!”

অমৃতার বাবা দৃঢ় গলায় বললেন, “তুমি ভুল দেখেছ। আসলে অমৃতা যাতে আর কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করতে না পারে বা কোথাও অসুস্থ হয়ে না পড়ে, তাই আমরা দুজন সিকিয়োরিটি রেখেছি। ওই গেটের ছেলে দুটো। ওরা আগে আর্মিতে ছিল। ওদের আন-আর্মড ফাইটের ট্রেনিং নেওয়া আছে। ওরা সবসময়ে অমৃতাকে শ্যাডো করত। সে দিন ওদেরই একজন ছেলে দুটিকে মেরেছিল। পাছে ঝামেলা হয়, আর সব কথা জানাজানি হয়, তাই আমরা ওদের কথা অস্বীকার করে বলেছিলাম, তুমিই ওদের মেরেছ।”

“কিন্তু কাকু, আমি নিজের চোখে দেখলাম অমৃতা…”

“তুমি তখন অজ্ঞান হয়ে হ্যালুসিনেশন দেখছিলে। নয়তো অমৃতার মতো হালকা পাতলা মেয়ে কখনও দুটো অ্যান্টিসোশালকে মেরে ঠান্ডা করে দিতে পারে?”

দেবোপম চুপ করে গেল। সত্যিই তো। কিন্তু যা ওর অত স্পষ্ট মনে আছে, সেসব মায়া? হ্যালুসিনেশন? কে জানে বাবা। হয়তো তা-ই হবে। অমৃতার বাবা বললেন, “যাও বাবা, এবারে বাড়ি যাও। আমাদের কপাল খারাপ যে তোমাদের মতো পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারলাম না। কিন্তু ভগবান তোমাকে রক্ষা করেছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আমাদের ভুলে যেয়ো। আর ভবিষ্যতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করো না। তাতে তোমার যন্ত্রণাও বাড়বে, আমাদের যন্ত্রণাও বাড়বে। যাও বাবা।”

যন্ত্রচালিতের মতো অমৃতাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেবোপম গাড়িতে চড়ে বসে। অমৃতা দুশ্চরিত্রা! অমৃতা অসুস্থ! অমৃতা মরে যাবে! অসম্ভব! কিন্তু কী করে অসম্ভব? অমৃতার মা-বাবা কীভাবে নিজের মেয়ের সম্বন্ধে এ ধরনের মিথ্যে বলতে পারে? দেবোপমের মনের মধ্যে বিরাট ভাঙাগড়া হতে থাকল। দেবোপম ঠিক কী ভাবছিল তা কোনওভাবেই বলে বোঝানো সম্ভব নয়। দেবোপম নিজেও তা জানে না। কিন্তু গাড়ি যখন বাড়ি পৌঁছাল, দেবোপম স্থির সিদ্ধান্তে এসে গেছে। ও অমৃতাকে ছাড়তে পারবে না।

মন ও তার চিকিৎসা

অমৃতার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর মাস ছয়েক কেটে গেছে। বাড়ি ফিরে এসেই দেবোপম আবিষ্কার করেছিল যে, অমৃতার বাবা এর মধ্যেই ওর বাবাকে ফোন করে সব কথা জানিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে এ-ও বলে দিয়েছেন যে, এত কিছু জেনেও দেবোপমের এখনও অমৃতার প্রতি মোহ কেটেছে বলে মনে হচ্ছে না, ওর বাবা-মা যেন দেবোপমের দিকে ভালোভাবে নজর রাখেন। দেবোপমের মা ওকে বিভিন্নরকম দিব্যি দিয়ে রেখেছেন যেন ও অমৃতার খোঁজ না করে। আর এদিকে বাবা এবং দাদাও ওর গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখা শুরু করেছে।

দেবোপম অমৃতার খোঁজ আর করেনি। কারণ ওর মন বলছিল, এভাবে খুঁজলে পাওয়া যাবে না। কিন্তু কী ভাবে অমৃতার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে, সে বিষয়ে ও কিছুই ভেবে উঠতে পারেনি। মন ক্রমে ক্রমে হতাশায় ডুবে গেছে। পড়াশোনা তো গোল্লায় গেছেই, ওর কলেজেও যেতে ইচ্ছা করত না। ক্লাসে যখনই অমৃতার রোল নম্বরটা ডাকা হত ওর মনে হত, একটা ফাঁকা ঘরে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। ক্লাসের বন্ধুবান্ধবীরা প্রথম কয়েকদিন ওর কাছেই অমৃতার খোঁজ নিত। তারপর আর কারওরই কিছু মনে রইল না। দেবোপমের খালি কান্না পেত। এভাবে সপ্তাহ তিনেক যাবার পর একদিন দেবোপম কলেজ থেকে জ্বর গায়ে বাড়ি ফিরল। সন্ধ্যার মধ্যেই জ্বরের প্রকোপ পৌঁছাল একশো চারে। ডাক্তার প্রথমে বললেন ভাইরাল ফিভার, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই চেস্ট ইনফেকশন হয়ে অসুস্থতাটা একটা যাচ্ছেতাই চেহারা নিল। দিন চারেকের মাথায় দেবোপমকে হসপিটালে ভরতি করতে হল। যম ও ডক্টর মুখার্জির মধ্যে প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের কঠিন টাগ অব ওয়ার-এর শেষে একদিন বিজয়ী ডাক্তারবাবু বললেন, “আর চিন্তা নেই। পরশু ছেড়ে দেব।”

কিন্তু বাড়ি ফিরে দেবোপম আশ্চর্য হয়ে দেখল যে, বাড়িতে মা বিরাট শান্তি স্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা করেছেন। এবং শান্তি স্বস্ত্যয়ন শেষ হওয়ার ক-দিন পরে আবার এক বিখ্যাত তান্ত্রিককে ধরে এনেছেন তিনি। সে হতভাগা তিন দিন ধরে এক বৃহৎ-প্রেতবিতাড়ন যজ্ঞ চালিয়ে গেল। যজ্ঞের অবসানে অবশেষে গোটা তিনেক দশাসই তান্ত্রিক মাদুলি দেবোপমের কোমরে লটকানো হল। দেবোপম ভেবেই পাচ্ছিল না, এই ভণ্ডামিগুলো বাবা কী করে মেনে নিচ্ছে? কারণ বাবা জ্যোতিষী-তান্ত্রিক—এদের একদম সহ্য করতে পারত না। আর তার রোগের চিকিৎসা হয়েছে হাসপাতালে, এদিকে প্রেতরা কী এমন দোষ করে ফেলেছে যে, তাদের তাড়ানোর জন্য যজ্ঞ করতে হবে? মাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে মা এড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দেবোপম মাথার দিব্যিটিব্যি দিয়ে মায়ের অস্ত্রেই মাকে ঘায়েল করে ফেলল।

কিন্তু মা-র সব কথা শুনে দেবোপমের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। জানা গেল, একদিন দেবোপম কলেজে বেরনর পর অমৃতার বাবা ফোন করে জানান যে, আজ সকালে অমৃতা মারা গেছে। আর সেই দিনই দেবোপম প্রবল জ্বর নিয়ে কলেজ থেকে ফেরে। বাস! এরপর কি আর কোনও সন্দেহ থাকে যে বিদেহী অমৃতার আকর্ষণেই দেবোপমের পৃথিবী ছাড়ার উপক্রম হয়েছিল? তান্ত্রিক বাবা তো স্পষ্টই বলে দিয়েছেন যে বিদেহী অমৃতা বৃহৎ-প্রেতবিতাড়ন যজ্ঞের ফলে এই বাড়িতে বছরখানেকের জন্য ঢুকতে পারছে না বটে, কিন্তু বাড়ির বাইরে বেরলেই সবসময় দেবোপমের পাশে পাশে থাকছে। উনি সেটা নিজের চোখেই দেখেছেন। নেহাত যজ্ঞভস্মের মাদুলি পরা আছে বলে পেতনি অমৃতার কোনও জারিজুরি খাটছে না। কিন্তু মাদুলি খুললেই ব্যাস।

আগে হলে দেবোপম তদ্দণ্ডেই মাদুলি খুলে ছুড়ে ফেলে দিত। কিন্তু এই অসুখ থেকে উঠে ইস্তক ও কীরকম ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেছে। মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কোনও ব্যাপারেই সহজে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অমৃতা মারা গেছে শুনেও ওর সেরকম কোনও দুঃখবোধ হল না। কিন্তু আস্তে আস্তে এক গভীর বিষণ্ণতা ওকে চোরাবালির মতো গ্রাস করতে থাকে। বিছানায় সারাদিন শুয়ে থাকে দেবোপম। বিকেলে খেয়াল হয়, সারা দুপুর ধরে ও বাড়ির পাশের কাঁঠাল গাছটায় চড়াই পাখির নাচ দেখেছে, কিন্তু কিচ্ছু ভাবেনি। যদিও বা কিছু ভেবে থাকে, তার একবর্ণ মনে নেই। এতদিন বিশেষ কোনও স্বপ্ন দেখত না। কিন্তু এবারে রোজ রাত্রে অমৃতাকে নিয়ে নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু হল। তার মধ্যে একটা স্বপ্ন ও বারবার দেখতো। সেটা হল নদীর ধারে একটা লঞ্চঘাট। সেখান থেকে একটা লঞ্চে করে অমৃতা চলে যাচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও দেবোপম লঞ্চটা ধরতে না পেরে শেষে একটা লাফ মারে আর লঞ্চের ধার ফসকে অনন্ত নিচে পড়তে থাকে, পড়তেই থাকে। এই অবস্থায় ওর ঘুম ভেঙে যায়। বড্ড কষ্ট হয় তখন।

শরীর সারে শরীরের নিয়মে, কিন্তু মন সারে কই। দেবোপম কলেজে যায়। বন্ধুবান্ধবীদের কথা চারদিকে গুঞ্জনের মতো বেজে যায়, কিছু কানের পাশ দিয়েই বেরিয়ে যায়। কিছু কানে ঢুকলেও তার অর্থ বোধ হয় না। ক্লাস লেকচারগুলি চলতে থাকে। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে ভ্যাবলার মতো মাইক্রোস্কোপ দেখে ও। কোনও কিছুরই মানে খুঁজে পায় না। অমৃতার মুখটা ওর পরিষ্কার মনেও পড়ে না এখন। এইভাবেই প্রথম দু-মাস কেটে গেল। অবশষে একদিন দেবোপমকে নিয়ে যাওয়া হল সাইকিয়াট্রিস্ট উপাসনা রায়চৌধুরির চেম্বারে।

ডঃ রায়চৌধুরি বছর পঁয়ত্রিশ বছরের এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা। প্রথমেই তিনি ঘোষণা করলেন, দেবোপম যেন তাঁকে উপাসনাদিদি বলে সম্বোধন করে। অসুস্থ হবার পরে এই প্রথম কেউ দেবোপমের সঙ্গে স্বাভাবিক মানুষের মতো ব্যবহার করল। প্রথম দিন দেবোপম ওঁর সঙ্গে বিশেষ কোনও কথা বলেনি বটে, কিন্তু উনিও ‘তাহলে তোমার কিছু হয়নি’ জাতীয় কোনও কথা বলেননি। ফলে উপাসনাদিদিকে তার ততটা খারাপ লাগেনি। পরদিন দু-চারটে কথার পর দেবোপম উপাসনাদিদির কাছে হৃদয়ের বোঝা পুরোটাই হালকা করে দিল। যে কাজটা এতদিন কেউ করেনি, উনি সেটাই করলেন। অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে উনি দেবোপমের পুরো গল্পটা শুনলেন। তারপর বললেন, “কিছু মনে না করলে তোমাকে একটা অনুরোধ করব? তুমি গল্পটা আবার বল।” একই গল্প দ্বিতীয়বার বলতে দেবোপমের প্রথমে একটু বোকা বোকা লাগলেও ডঃ রায়-চৌধুরির সিরিয়াস ভাব দেখে ওর গল্পটা দ্বিতীয়বার বলতেও ভালোই লাগল। গল্প শেষ হবার পর উপাসনাদিদি একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “তোমার কী ধারণা, অমৃতার বাবা মেয়ের মৃত্যুর ব্যাপারে তোমাদের মিথ্যা কথা বলেছেন?” দেবোপম চুপ করে রইল। কী বলবে সে? আগে হলে হয়তো সে তা-ই বলত। কিন্তু এখন আর ওর মতামত বলে কিছু নেই। উপাসনাদিদি বললেন, “তার মানে আমি ঠিকই ধরেছি! তুমি বুদ্ধিমান ছেলে! অত্যন্ত বুদ্ধিমান!!” দেবোপম একটা ছোট চমক খেল। না-বলা কথার মধ্যে উপাসনাদিদি ওর বুদ্ধিমত্তা আন্দাজ করলেন কী করে?

ডঃ রায়চৌধুরি বলে চললেন, “তোমার গল্পটা সম্বন্ধে তুমি একেবারে নিশ্চিত। কারণ দুবারই তুমি হুবহু একই কথা বলেছ। কিন্তু বলার ভাষা বদলেছ। অর্থাৎ তুমি কোনও অবসেশনের বশবর্তী হয়ে গল্পটা বলছ না। অমৃতার বাবার বলা গল্পটার মধ্যে দুটো অসংগতি আছে। এক নম্বর যে মেয়ে নিম্ফোম্যানিয়াক, সে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তার ম্যানিয়া সারবে না। বরং সে আরও অ্যাগ্রেসিভ হয়ে উঠবে। গোটা সমাজে এইডস ছড়িয়ে প্রতিহিংসা নিতে চাইবে। এ ক্ষেত্রে তোমার মতো সুন্দর একটা ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করা অসম্ভব।”

“আর দু-নম্বর অসংগতি?” দেবোপম নিজের অজান্তেই কৌতূহলী হয়ে পড়ে।

“হ্যালুসিনেশনের একটা মজা আছে। হ্যালুসিনেশনে সাধারণত মানুষ যা ইচ্ছা করে তা-ই দেখে, স্বপ্নের মতো। তুমি অমৃতাকে প্রবল শক্তিরূপিণী দেখতেই পার। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডে ছেলেটি যে বলল, ‘পাস মতো জা। ডাইন হ্যায়।’ এটা তুমি কক্ষনো নিজের ভালোবাসার মেয়ে সম্বন্ধে হ্যালুসিনেট করবে না। বা ‘আরিয়ন ভাগ জা চুড়েল হ্যায়।’ এটাও না। তুমি চুড়েল মানে জান?

দেবোপম মাথা নেড়ে বলল, “ওই তো নন-বেঙ্গলিরা, ওই বলে মেয়েদের গালাগালি দেয়।”

“ওই তো। তুমি মানে জান না। চুড়েল মানে পেতনি। এবং প্রাণ নিয়ে নেয় এমন পেতনি। তুমি হ্যালুসিনেট করলে এই দুটো অংশ থাকত না।”

অকস্মাৎ দেবোপমের মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা রাসায়নিক পরিবর্তন হয়ে গেল। প্রবল আগ্রহ নিয়ে ও প্রশ্ন করল, “তাহলে আমি ঠিক দেখেছিলাম?”

“একশো শতাংশ।”

“তাহলে কি অমৃতার এইডস হয়নি?”

“এইডস রোগীর গায়ে অত জোর অসম্ভব!”

“তাহলে অমৃতার বাবা কেন মিথ্যা বলবেন?”

ডঃ রায়চৌধুরি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, “বহু কারণ থাকতে পারে। একটা সম্ভাব্য সলিউশন আমিই তোমায় বলছি। দেখ, কোনও অসংগতি পাও কি না। ধরা যাক, তোমাদের আশুতোষ কলেজে সন্ত্রাসবাদীদের একটা বড় ডেরা আছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তর তার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তাদের এক এজেন্ট অমৃতাকে ছাত্রী সাজিয়ে পাঠিয়েছে। মেয়েটি সিবিআই-এর অপারেশনাল এজেন্ট স্বাভাবিকভাবেই মার্শাল আর্টে সিদ্ধহস্তা। এবার সুন্দরী কন্যা! তার প্রেমে তো ছেলেরা পড়তেই পারে, বাড়ি ধাওয়া করতেই পারে। তাই বাবা-মা দুজনেই সাজানো, বাড়িটাও গোয়েন্দা দপ্তর ভাড়া করেছে। আর বাড়িতে বেশ কয়েকজন বাহুবলী তো থাকবেই। এখন এদিকে সবই ঠিক ছিল, কিন্তু মানুষের মন হল ঘোরতর আনপ্রেডিক্টেবল। তুমি অমৃতার প্রেমে পড়লে ক্ষতি ছিল না, কিন্তু অমৃতাও তোমার প্রেমে পড়ে গেল। এ অবস্থায় তো তদন্তের কাজ চলবে না, কাজেই অমৃতাকে সরিয়ে নেওয়া হল। আর তোমাকে আর তোমার বাবা-মাকে একটা বানানো গল্প শোনানো হল। এটা চলবে?”

দেবোপমের মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিউরে উঠল। সত্যিই তো। তাহলে অমৃতা বেঁচে আছে! অমৃতা ওকে ভালোবাসে! কী কাণ্ড!! আর ও কিনা এতদিন বোকার মতো মন খারাপ করে ছিল? কিন্তু একটা সমস্যা!

“কিন্তু তাহলে অমৃতার রক্ত দিতে আপত্তি ছিল কেন?”

উপাসনাদিদি একগাল হাসলেন, বললেন, “তা-ই হয় নাকি? গোয়েন্দা দপ্তরের এজেন্ট! তাকে কত সাবধানে থাকতে হয়! তোমাদের ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে যদি কেউ ব্লাড নেবার অছিলায় বিষাক্ত ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়?”

দেবোপমের চোখের উপর থেকে সব কুয়াশার আবরণ কেটে যাচ্ছিল। বলল, “তাহলে এবারে বলুন, আমি কি করব?”

“অমৃতাকে খুঁজে বের করবে! আবার কী?”

“কোথায় খুঁজবো?”

ডঃ রায়চৌধুরি হাসলেন। বললেন, “অমৃতা কি দামি দামি ড্রেস পরত?”

“দামি কি না জানি না, কিন্তু খুব সুন্দর সুন্দর ড্রেস পরত।”

“তাহলে তার খোঁজ পেতে গেলে শপিং মলে ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়ের দোকানে যেতে হবে। একদিন বা এক মাসের কাজ নয়। ওকে ছাড়া যদি তুমি না-ই থাকতে পার, তাহলে ধৈর্য ধরে খোঁজা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সেই সঙ্গে কলেজে যাও। পড়াশোনাও চালিয়ে যাও। তোমাকে ভালোবেসে থাকলেও একেবারে বাজে কেরিয়ারের একটা ছেলেকে বিয়ে করতে কি অমৃতার ভালো লাগবে?”

দেবোপমের মুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ফুটে উঠল। বললো “আপনার কী মনে হয়, আমি ওকে খুঁজে বার করতে পারব?”

“কঠিন কাজ। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তুমি পারবে।”

“উপাসনাদিদি! আমি কি আপনার সঙ্গে আবার দেখা করতে পারি?”

“নিশ্চয়ই পার, কিন্তু বাড়ির কাউকে জানাবে না, কেমন? দরকার হলে আমিও দু-একদিন তোমার সঙ্গে অভিযানে যেতে পারি। এবারে তুমি এস।” আমি তোমার বাবা-মা-র সঙ্গে আলাদা একটু কথা বলি! দেবোপম বাচ্চাদের মতো জিজ্ঞাসা করল, “কী বলবেন?”

“দেখ তোমায় যা বললাম, এসব তোমার বাবা-মাকে বললে তাঁরা আরও ঘাবড়ে যাবেন। তাই ওঁদের বলব, তুমি চিকিৎসায় ভালো রেসপন্ড করেছ। আর কয়েকটা সিটিং-এ তুমি ঠিক হয়ে যাবে। এটা তো আর বলতে পারব না যে, তুমি কখনওই মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলে না, তা-ই না?”

দেবোপম বেরিয়ে এল। বাবা আর মা ঘরে ঢোকার পর ডঃ রায়চৌধুরি বললেন, “আমার মনে হচ্ছে, ও ঠিক হয়ে যাবে। অমৃতার প্রতি ওর যে টানটা রয়েছে, সেটার জোরেই ও সুস্থ হবে। ওকে আমি একটা গল্প বলেছি, যার মূল কথাটা হল অমৃতা বেঁচে আছে। ও এখন আপনাদের লুকিয়ে সর্বত্র অমৃতাকে খুঁজবে। কোনও বাধা দেবেন না। ওর হাতখরচ বাড়িয়ে দিন। কোথায় গিয়েছিল—এই নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন করলেও বেশি কচলাবেন না। আর যতক্ষণ বাড়ি থাকে, ওর প্রতি আপনাদের কেয়ার, কনসার্ন, প্রকাশ করুন। পড়াশোনা নিয়ে কোনও চাপ দেবেন না। এইভাবে চলতে চলতেই ওর ডিপ্রেশন কেটে যাবে। তখন চিকিৎসার সেকেন্ড ফেজ শুরু হবে।”

দেবোপম বাবা-মা-র সঙ্গে বাড়ি ফিরে এল। মনে প্রবল উত্তেজনা। কাল থেকে অমৃতা-সন্ধান শুরু হবে।

কিন্তু তারপরে মাসের পর মাস কেটে গেল। সব ক-টা শপিং মলের সব ক-টা দোকানের সব কজন সেলসবয়/গার্লরাও পরিচিত হয়ে গেল, কিন্তু অমৃতার কোনও পাত্তাই নেই। এর মধ্যে বার তিনেক ডঃ রায়চৌধুরির সঙ্গেও শপিং মলে ঘুরে বেড়ানো হয়েছে। নানা গল্প হয়েছে। আস্তে আস্তে ওর মনে হচ্ছে যে, অমৃতাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু অমৃতাকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা সম্ভব হলেও হতে পারে। ইতিমধ্যে একটি ক্লাস টুয়েল্‌ভের মেয়েকে ও বায়োলজি পড়াচ্ছে। টিউশনিটা উপাসনাদিদিই ঠিক করে দিয়েছেন। বাবা-মা একটু আপত্তি করে মেনেও নিয়েছেন। পড়াশোনাতেও মন একটু একটু করে ফিরছে। এমন সময়ে একদিন সেই সাংঘাতিক কাণ্ডটা ঘটে গেল।

হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ

শনিবার বিকেল আড়াইটে নাগাদ দেবোপম সাউথ সিটি মল থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল, যদি কোনও অটো টালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিকে যায়। এই মল-অভিযানে দেবোপম কক্ষনো নিজের গাড়ি ব্যবহার করে না। হঠাৎ ওর নজরে এল রাস্তার উলটো দিকে যাদবপুরগামী একটা মিনিবাসের জানালায়! কে ও? অমৃতার মতো লাগছে না? গত তিন মাসে ওর মাঝে মাঝেই এরকম লাগত, কিন্তু ও প্রত্যেকবার মেয়েগুলিকে ফলো করে ভালোভাবে দেখে তবে নিশ্চিত হত যে মেয়েটি অমৃতা নয়। অতএব এবারও ও বিদ্যুৎবেগে রাস্তা পার হল। কিন্তু মিনিবাসের কাছে যাবার আগেই বাসটা ছেড়ে দিল। দৌড়ে ধরার মতো পরিস্থিতি নয়। দেবোপম এদিক-ওদিক দেখে একটা যাদবপুরগামী অটো ধরল। অমৃতার মিনিবাসটা হল যাদবপুর পূর্বাচলের। দেবোপমের জানা ছিল ওটা এইট-বি স্ট্যান্ড পর্যন্ত যায়। অটোটাও তা-ই যাচ্ছে। কিন্তু মাঝে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে অটোওয়ালার খুচরো নিয়ে তর্ক বেধে যাওয়ায় দেবোপম যখন এইট বি পৌঁছাল, ততক্ষণে মিনিবাস থেকে অমৃতা নেমে গেছে। কোন দিকে গেল!

এইট-বি-তে অমৃতার কী কাজ থাকতে পারে? অবশ্য যদি আদৌ মেয়েটা অমৃতা হয়। উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেবোপম সম্পূর্ণ কনফিউজ্‌ড্‌ হয়ে পড়ল। এইট-বি-র মোড়ে একজন সিবিআই এজেন্ট কী করতে পারে বা না পারে তা দেবোপম কী করে হিসাব করবে। দেবোপম আর-একটু এগিয়ে ইউনিভার্সিটি ছাড়াতেই বাঁ দিকে স্টেশনে যাবার রাস্তায় একটা রিকশায় অমৃতার লাইল্যাক রঙের কামিজের পিছন দিকটা দেখা গেল মনে হল। দেবোপম সরাসরি ছুট লাগাল। কিন্তু যাদবপুর স্টেশন রোড ধরে ছোটার মতন কঠিন অবস্ট্যাক্‌ল্‌ রেস আর হয় না। ফলে স্টেশনে অমৃতা ঢুকে যাবার আগে দেবোপম সেখানে পৌঁছতে পারল না।

কিন্তু যাদবপুর স্টেশন লোকে লোকারণ্য। এর মধ্যে লাইল্যাক কামিজ খুঁজে পাওয়া কি চারটিখানি কথা! এদিক-ওদিক দৌড়াতে দৌড়াতে দেবোপম সহসা আবিষ্কার করে ফেলল যে, লাইল্যাক কামিজ ওদিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। দেবোপম চিৎকার করে ওঠে, “অমৃতা! এই অমৃতা!” লাইল্যাক কামিজের কোনও হুঁস নাই। দেবোপম সটান লাইনে নেমে পড়ে। শিয়ালদার ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্মে আদ্দেক ঢুকে পড়েছে। প্ল্যাটফর্ম শুদ্ধ লোকের সমবেত “গেল! গেল!” ধ্বনির মধ্যেই দেবোপম ওদিকের প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়েছে। কয়েক ফুটের জন্য শিকার ফসকে এদিকের প্ল্যাটফর্মে শিয়ালদা লোকালটা তখনও ফোঁসফোঁস থামাতে পারেনি।

গোটা প্ল্যাটফর্মের মতো লাইল্যাক কামিজও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেবোপমের কাণ্ড দেখছিল। কিন্তু দেবোপম যখন সরাসরি তাকেই গিয়ে “অমৃতা, তুই ঠিক আছিস?” বলে সামনে দাঁড়াল, তখন সে বেচারির এক্সপ্রেশনটি দেখার মতো হল। রীতিমত আতঙ্কের সঙ্গে মেয়েটি বলল, “কে আপনি? আমি অমৃতা নই।”

অমৃতা না? দেবোপম পুঙ্খানুপুঙ্খকভাবে মেয়েটিকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল। একেবারেই একরকম। শুধু অমৃতার চুল ছিল পিঠের মাঝখান পর্যন্ত। সেটাকে ও হর্সটেল বানিয়ে রাখত। এ মেয়েটির ছোট স্টেপকাট চুল। মেয়েটি আবার বলল, “আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। আপনি ভুল করছেন।” এতক্ষণ দেবোপম লক্ষ করেনি মেয়েটির পাশে একটি লম্বা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। দেবোপম ছেলেটিকে স্পষ্ট চিনতে পারল। অমৃতার বডিগার্ড। ফের মেয়েটির চোখের দিকে সরাসরি তাকাল দেবোপম। তাকিয়েই রইল। মেয়েটি চোখ সরিয়ে নিল। হ্যাঁ, ও অমৃতাই। দেবোপমের নিজের অস্তিত্ব যেমন সত্যি, অমৃতার অস্তিত্বও তেমনই সত্যি। পাশের ছেলেটি এবারে এগিয়ে এল। বলল, “বেকার ঝামেলা করছেন দাদা। আপনাকে আমরা কেউই চিনি না। তা-ই তো?” শেষ প্রশ্নটা অমৃতাকে করা হল। অমৃতা মাথা নাড়ল, বলল, “না চিনি না।” দেবোপম ছেলেটিকে অগ্রাহ্য করে। অমৃতাকে বলল, “একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল্‌ অমৃতা, তুই আমাকে চিনিস না?” অমৃতা চোখের দিকে না তাকিয়েই বলল, “বলছি তো চিনি না।” এবারে এই প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছিল। দেবোপম ট্রেনটা দেখিয়ে অমৃতাকে বলল, “আমি কিন্তু এই ট্রেনের সামনেই লাফিয়ে পড়ছি।” মুহূর্তের মধ্যে অন্য ছেলেটি প্রায় রিফ্লেক্স অ্যাকশনে দেবোপমের কাঁধ চেপে ধরল। বাপ রে বাপ! কী অমানুষিক হাতের জোর! দেবোপম বিন্দুমাত্র নড়ার সুযোগ পেল না। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ার পর দেবোপম ছাড়া পেল।

ছেলেটি দেবোপমকে কড়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু অমৃতা ওকে থামিয়ে বলল, “কোনও লাভ নেই অর্ক। ও আমাকে এবং তোমাকে একদম চিনে ফেলেছে।” তারপর দেবোপমের দিকে তাকিয়ে বলল “তুই কী চাস? কিছুতেই আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবি না?” দেবোপম একদৃষ্টে অমৃতার দিকে চেয়ে রইল। অভিমানে ওর দু-চোখ জলে ভরে এসেছে। অমৃতা আবার বলল, “তুই আমাকে ভুলে যেতে পারিস না? দেবোপম বলল “এত মিথ্যা কথার পর, আমার কী একটা এক্সপ্ল্যানেশন প্রাপ্য নয়?” অমৃতা বলল, “সত্যিগুলো তোকে বলার মতো কথা নয়। তুই কেন এ ব্যাপারে জড়াবি? প্লিজ চলে যা, আর যোগাযোগ করিস না।” দেবোপম বলল “তুই কি সিবিআই বা সিআইডির কেউ?” অমৃতা প্রচণ্ড অবাক হয়ে গিয়ে বলল, “এসব কথা তোকে কে বলল?”

“যেই বলুক, কথাটা কি ঠিক নয়?”

“আগে আমার জানা দরকার কথাটা কে বলেছে? ইট’স ইম্পট্যান্ট!”

“উপাসনাদি, ডঃ উপাসনা রায়চৌধুরি, সাইকিয়াট্রিস্ট।” নামটা শুনে অমৃতা নিজের কপালে করাঘাত করল। গুমরে উঠে বলল, “ও মাই গড! জল তাহলে বহুদূর গড়িয়ে গেছে!” কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর অমৃতা বলল, “শোন। তুই আমাকে সাত দিন সময় দে। তারপর আমি তোর সঙ্গে যোগাযোগ করব। এই সাত দিন তুই আমার কোনও খোঁজ করবি না বা কাউকে আমার সম্বন্ধে কিছু বলবি না।”

দেবোপম বলল “আর যদি সাত দিনের পর যোগাযোগ না করিস?”

“করব, ভরসা রাখ্‌।”

“ঠিক আছে, তারপরে আমি আরও সাত দিন দেখব। এর মধ্যে কোনও ফোন না পেলে…” দেবোপম একটা নাটকীয় পজ দিল। অমৃতা খালি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। দেবোপম বলল, “কোনও না কোনও খবরের কাগজে আমার আত্মহত্যার খবর পাবি। চলি।” দেবোপম সম্পূর্ণ অ্যাবাউট টার্ন করে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল। একবারও যদি পিছন ফিরে তাকাত তাহলে দেখত, অমৃতা উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়েছে—“ভগবান! আর যে পারি না!!”

অজানা ইতিহাস

রাত প্রায় সাড়ে ন-টা। চারদিকে রেগুলার ঝিঁঝি ডাকছে। দেবোপম প্রায় আধ ঘণ্টা হল, এই রবীন্দ্র সরোবরের পাশে একটা বেঞ্চে বসে অমৃতার জন্য অপেক্ষা করছে। সেই দিন বিদায় নেবার পর দেবোপমের মন বলছিল, যতই দেরি হোক, অমৃতা ঠিক একটা খবর দেবেই। অবশেষে এগারো দিনের দিন অর্থাৎ আজ সন্ধ্যার সময় হঠাৎ অমৃতার ফোন। দেবোপম যেন ন-টা নাগাদ রবীন্দ্র সরোবরের মেন গেট দিয়ে ঢুকে, পুরানো পড়ে থাকা স্টিম রোলারের কাছের একটা বেঞ্চে বসে থাকে। কেউ যেন জানতে না পারে যে, দেবোপম ওখানে গেছে। অমৃতার দেরি হতে পারে, কিন্তু দেবোপম যেন অপেক্ষা করে থাকে।

আধ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। চারদিকের মশারা এই চমৎকার অযাচিত ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পটি পেয়ে মহা উল্লাসে গুনগুন করে দেবোপমের গুন গাইছে। দেবোপম আকাশ-পাতাল ভাবছে। কিন্তু প্রিয়া অভিসারে যে আনন্দটি মনে হবার কথা ছিল, তার বিন্দুবিসর্গও হচ্ছে না। একটা কালো অন্ধকার যেন দেবোপমকে ক্রমেই ঢেকে ফেলছে। কিন্তু ওই যেন কে আসছে? হ্যাঁ, একটি নারীমূর্তিই তো মনে হয়। দেবোপম ‘এই যে আমি’ বলবে ভাবছিল, কিন্তু তার আগেই অমৃতা এসে ওর পাশে বসে পড়ে বলল, “একটু দেরি হল। বেশি সময় নেই। তুই জিজ্ঞাসা করবি, আমি উত্তর দেব, না আমিই সব গুছিয়ে বলব?” দেবোপম বলল “আগে বল্‌ তুই কলেজ ছেড়ে দিলি কেন?”

“না দিলে আমার পরিচয় ডিসক্লোজ হয়ে যেত।”

“তোর পরিচয় কী?”

“সেটা বলার আগে তুই একটু সামলে নে। হঠাৎ ভয় পেয়ে যেতে পারিস।”

“নাঃ, ভয় পাবার কী আছে?”

“শোন্‌। আমরা না, মানুষ নই।”

দেবোপম মুখ বিকৃত করে বলল, “তবে কি ডাইনি, পিশাচ, কি বলে যেন চুড়েল? ”

“ওসব না। আমি বা আমরা, মানে আমার বাবা-মা, বা আমাদের বাড়িতে যাদের দেখেছিস, আমরা, কীভাবে বোঝাই, হোমো স্যাপিয়েন্স নয়।”

এই হোমো স্যাপিয়েন্স শব্দটায় দেবোপমের সারা শরীরে কাঁটা দিল। বলল, “তাহলে? তাহলে তুই কী? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না!”

“তাহলে কোনও প্রশ্ন না করে আমার কথা শোন্‌। আমি শর্টে প্রায় তিরিশ হাজার বছরের ইতিহাস বলব।”

অমৃতা যা বলে আর দেবোপমের সঙ্গে তার যা প্রশ্নোত্তর চলে তা থেকে যা জানা গেল, মোটামুটি তা এইরকম—

আজ থেকে আনুমানিক দু-লাখ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগের পাওয়া পাথর হয়ে যাওয়া হাড়গোড় ইত্যাদি দেখে নৃতত্ববিদরা ধারণা করেন যে, সেই সময়ে পুরাতন প্রস্তর যুগে মানুষের বিশেষত্ব আছে এরকম একাধিক প্রজাতি ছিল। যেমন, পিথেক্যান্থ্রপ্স, সিন্যানথ্রোপ্স, জাভাম্যান, পিকিংম্যান, নিয়ানডরথ্যাল, ক্রোমানিয়—এরকম আরও অনেকে। কিন্তু চল্লিশ হাজারের এদিকে কেবল হোমো স্যাপিয়েন্সের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপের পূর্ব দিক এবং এশিয়ার পশ্চিম দিকে থাকত নিয়ানডরথ্যালরা। ওই চল্লিশ হাজার বছর আগে পাওয়া নিয়ানডরথ্যাল কঙ্কালগুলির অনেকগুলির মাথাতেই অস্ত্র দিয়ে করা ফাটল দেখা যায়। অর্থাৎ এরা সব যুদ্ধে মারা গিয়েছিল। ধরা যায়, নব্য প্রস্তর যুগে এসে পড়েছিল কেবল হোমো স্যাপিয়েন্সরাই। আর তারাই তাদের উন্নততর অস্ত্রের সাহায্যে আজ থেকে চল্লিশ হাজার বছরের মতো আগে হোমিনিড জেনাসের অন্য স্পিসিসগুলিকে ধ্বংস করে ফেলে।

কিন্তু কোনও একটা স্পিসিসের, খুব সম্ভব নিয়ানডরথ্যালদের খুব অল্পসংখ্যক প্রাণী বেঁচে যায়। এদের মানুষ থেকে আলাদা করার জন্যই এখানে অমানুষ বলে উল্লেখ করা হবে।

পূর্ব ইউরোপে কার্পেথিয়া অঞ্চলে জেট্রিয়া (Xetria) বলে এক জায়গায় এই অমানুষদের বাস ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এদেরও বিবর্তন হতে থাকে। এরাও ক্রমে প্রস্তর যুগ পার হয়ে তাম্র যুগে না ঢুকে সরাসরি লৌহ যুগে ঢুকে পড়ে। এদের ছিল প্রচণ্ড গোষ্ঠীবদ্ধতা। এরা ছিল ফরসা, পেশিবহুল, লম্বা এবং গায়ের জোর মানুষের তুলনায় আড়াইগুণের মতো বেশি। যেখানে গড় মানুষ নিজের ওজনের সমান ওজন তুলতে পারে, সেখানে এরা এদের ওজনের আড়াইগুণ তুলতে পারত। কিন্তু বুড়ো আঙুল একটু কম বাঁকা থাকার দরুন এদের কোনও কিছু গ্রিপ করতে বা সূক্ষ্ম হাতের কাজ করতে অসুবিধা হত। এরা প্রধানতঃ পশুপালন আর পশু শিকার করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করত।

আশপাশের মানুষদের সঙ্গে এদের ছোটখাটো লড়াই লেগেই থাকত। কিন্তু জেট্রিয়া জায়গাটা দুর্গম বলে মানুষরা সুবিধা করতে পারত না। তখনকার দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী, কখনও কখনও মানুষরা এদের মেয়ে তুলে নিয়ে যেত, আবার কখনও এরাও মানুষের মেয়েদের তুলে আনত। কিন্তু সেইসব তুলে আনা মেয়ের পেটে সন্তান আসত না। ক্বচিৎ কদাচিৎ এলেও সেইসব সন্তান বেশি দিন বাঁচত না। এই ব্যাপারটা বহুদিন লক্ষ করার পর মানুষদের মধ্যে জেট্রিয়ান মেয়েদের সম্বন্ধে এক ধরনের ট্যাবু বা নিষেধাজ্ঞা কাজ করত।

হাজার আটেক বছর আগে মধ্য ইউরোপে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়তে থাকে। ক্রমে পশুচারণের উপযোগী ঘাসের অভাব হতে থাকে। একসময় জেট্রিয়ানরা বুঝতে পারে, যে এভাবে চললে গোটা জাতিটাই খাদ্যাভাবে মারা যাবে। জেট্রিয়ানরা ঠিক করে, এক ভাগ জেট্রিয়ায় থাকবে আর একদল সেখান থেকে দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত কম ঠান্ডা একটা জায়গায় এগিয়ে যাবে। আশপাশের মানুষের দলেরও একই সমস্যা থাকায় তারাও দক্ষিণ পূর্বে এগিয়ে যাবার প্ল্যান করে। এই সময়ে মানুষদের এক মোড়ল জেট্রিয়ানদের কাছে দূত পাঠায়। বলে, তোমরা আমাদের সঙ্গেই দক্ষিণে চল। আমরা এক হয়ে থাকব। তোমরা আমাদের এবং আমরা তোমাদের মেয়েদের দিকে নজর দেব না। তোমাদের গায়ের জোর বেশি, কিন্তু তোমরা অস্ত্র বানাতে পারো না, এবারে আমরা তোমাদের অস্ত্র বানিয়ে দেব, তোমরা আমাদের হয়ে লড়াই করবে। জেট্রিয়ানরা ভালো করে ভেবে দেখল যে, এর থেকে ভালো প্রস্তাব আর হতেই পারে না। কারণ চেনা বন-পাহাড়ের বাইরে আদিম লোহার অস্ত্র দিয়ে লড়াই করে কতদূর বেঁচে থাকা যাবে তার সন্দেহ আছে। কাজেই গোটা জাতটাই এদের সঙ্গে দক্ষিণে চলল।

ক্রমে ক্রমে আরও কয়েক হাজার বছর কেটে গেল। জেট্রিয়ানদের গায়ের জোর দেখে অন্যদের ধারণা হল, এদের গোষ্ঠীর বাইরে বিয়ে না করাটাই এদের শক্তির উৎস। ফলে অন্য গোষ্ঠীগুলোতেও যারা যোদ্ধার কাজ করত, তারা এরকম বিবাহবদ্ধ গোষ্ঠী তৈরি করতে শুরু করল। ততদিনে এদের নাম জেট্রিয়ান থেকে জেত্রীয় হয়ে ক্ষত্রিয় হয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে বর্ণশুদ্ধির এই বাতিকটা এই সব ক-টা পশুপালক গোষ্ঠীকে (যাদের আমরা এখন আর্য বলে জানি), এমন আচ্ছন্ন করল যে, তারা রীতিমত চার বর্ণ ভাগ করে সমাজ তৈরি করল। যা ছিল অমানুষ জেট্রিয়ানদের দুর্বলতা, সেটাকেই মানুষরা বিরাট একটা সামাজিক নিয়ম বানিয়ে ফেলল।

এইরকম সময় আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে আর্যদের নিজেদের মধ্যে এক বিরাট লড়াই হয়। জেট্রিয়ানরাও সেই ভ্রাতৃঘাতী লড়াইতে অংশ নিতে বাধ্য হয়। পরাজিত দল ইউরোপে ফিরে যায়, জয়ী দল ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। বেশির ভাগ জেট্রিয়ান ইউরোপ ফিরে যায়। একটা ছোট্ট দল ভারতে প্রবেশ করে। তারপর পাঞ্জাবে বসতি করে। এরা নিজেদের বলত জ্যোত-ক্ষত্রিয়। ভারতবর্ষের মতো জাতপাতের দেশে আলাদা একটা গ্রুপ হয়ে থাকতে তাদের বিশেষ অসুবিধা হয়নি। তাদেরই একটা ছোট্ট দল আওরঙ্গজেবের অত্যাচারে বাংলার দিকে পালিয়ে আসে। ওদিকে যারা ইউরোপের দিকে ফিরে গিয়েছিল, তারা অনেক অসুবিধা সহ্য করে শেষে অস্ট্রিয়ার এক ছোট জেলা ক্রান্তসবুর্গে গিয়ে বসতি করে। দিন চলে যায়। আঠেরোশো উনষাট সালে যখন ডারউইন তাঁর ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ বইটি বার করেন, তখন এই অমানুষরা ঠিকঠাক নিজেদের অবস্থানটা বুঝতে পারে। এই সময় ডঃ ব্রিয়ল নামে একজন অমানুষ বিজ্ঞানী, যিনি কিনা ডারউইনের শিষ্য ছিলেন, ইউরোপের বাকি অমানুষদের খুঁজে বার করেন। এবং তাদের মধ্যে একটা গুপ্ত সমিতি গঠন করেন। ঠিক হয়, অমানুষরা নিজেদের অস্তিত্বের কথা লুকিয়ে রাখবে। মানুষের কাছে নিজেদের চিকিৎসা করাবে না। সবসময় রক্ত পরীক্ষা থেকে দূরে থাকবে।

ডঃ ব্রিয়ল সেই সময়েই বুঝতে পেরেছিলেন যে, অমানুষদের জিনের বৈচিত্র ক্রমশ কমে আসছে। এক গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমাগত বিবাহ হতে থাকলে যা হয় আর কী। কাজেই তখন ঠিক হল, অমানুষদের মধ্যে বিবাহ আর পরিবার ব্যাপারটা শুধু দেখানোর জন্য থাকবে। প্রত্যেক নারী অমানুষ যতবার সম্ভব গর্ভ ধারণ করবে, কিন্তু প্রত্যেক সন্তানের পিতা হবে গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা লোক। এই পদ্ধতিতেই কিন্তু ১৯০০ সালের থেকে আমাদের সংখ্যা প্রায় দশগুণ বেড়ে গেছে।

ডঃ ব্রিয়ল অমানুষদের মধ্যে চলে আসা গল্পগুলো থেকে আন্দাজ করেন যে, এই অমানুষদের একটা দল ভারতবর্ষের কোথাও আছে। তিনি শেষ জীবনে ভারতবর্ষে চলে আসেন এবং এখানকার জ্যোত-ক্ষত্রিয়দের খুঁজে বার করেন। সেই থেকে আমাদের সঙ্গে ক্রান্তসবুর্গের পুরোপুরি যোগাযোগ আছে। আমরা সবাই ডঃ ব্রিয়লকে আমাদের প্রফেট মনে করি এবং কঠিনভাবে মেনে চলি। ডঃ ব্রিয়ল উনিশশো চোদ্দো সালে লোকান্তরিত হন।

এর মধ্যে আঠেরোশো উনআশি সালে আর-একটা ঘটনা ঘটে। এক সন্তানসম্ভবা অমানুষ মা অস্ট্রিয়া থেকে জার্মানি যাবার পথে ঘোড়ার গাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটে। শিশুটি সেই সময়েই জন্মায়, কিন্তু বাবা-মা দুজনেই মারা যায়। এই অমানুষ শিশুটি মানুষের ঘরেই লালিত-পালিত হয়। উনিশশো আট সালে ডঃ ব্রিয়ল এই শিশুটিকে খুঁজে পান। শিশুটি ডঃ ব্রিয়লের কাছে অমানুষদের ইতিহাস শুনে মানুষদের উপর প্রতিহিংসা নেবে বলে ঠিক করে। যদিও ডঃ ব্রিয়ল কিন্তু এই ধরনের প্রতিহিংসা থেকে আমাদের দূরে থাকতে বলেছেন।

এই শিশুটি বড় হয় এবং একটা রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধে সারা পৃথিবীকে জড়িয়ে ফেলে।

এই সময় দেবোপম অমৃতাকে প্রশ্ন করে “কে সেই শিশু?”

“অ্যাডল্‌ফ্‌ হিটলার।”

“তিনি তো জার্মানির শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়েছিলেন!”

“ওইখানেই তো মস্ত ধোঁকা। আচ্ছা বল, হিটলারের মতন অত বুদ্ধিমান সেনাপতি কোন আক্কেলে রাশিয়া আক্রমণ করেছিলেন? নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের কথা কি তাঁর জানা ছিল না? কেনই বা ইহুদিদের মেরে শেষ করছিলেন? আর অ্যাটম বোমা বানাতে পারে এমন বিজ্ঞানীদের কেন আমেরিকা পালাতে দিলেন?”

“কেন?”

“আসলে হিটলার চেয়েছিলেন, মানুষ জাতটা মারামারি করে মরুক। যত বেশি মরে, ততই ভালো। ইহুদিরা সেই সময়ের ইউরোপে মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছিল। তাই হিটলার আগে তাদের শেষ করতে চেয়েছিলেন। অ্যাটম বোমা বানাবার মতো পয়সা হিটলারের ছিল না। তাই আমেরিকাকেই অ্যাটম বোমা বানাবার ব্যবস্থা করে দিলেন।”

“যাঃ, এসব বানানো কথা।”

“ভেবে দেখ্‌। হিটলারের রক্তের বিশুদ্ধি নিয়ে পুরাণের মনুর মতো অবসেসড্‌ কেন? এটাও আমাদের থেকেই পাওয়া। এ ছাড়া হিটলার অন্তত দুজন মহিলার সংস্পর্শে এসেছিলেন—এক, গেলি রাউবেল, দুই, এভা ব্রাউন। কোনও সন্তানলাভ হয়নি। কেন?”

“এসব কি সত্যি না তোদের থিয়োরি!”

অমৃতা হাসল। বলল, “যুদ্ধের সময় হিটলার ইহুদি আর কমিউনিস্টদের মারার জন্য অনেকগুলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটার নাম ছিল ডাচাউ। এই ডাচাউয়ের পাশে একটা স্পেশাল আন্ডারগ্রাউন্ড ইউনিট ছিল। তাতে পাঁচতারা হোটেলের ফেসিলিটি ছিল। তাতেই এনে রাখা হয়েছিল ক্রান্তসবুর্গের যাবতীয় অমানুষকে। এমন ব্যবস্থা ছিল যে, যে কোনওরকম বোমাবর্ষণে এই ইউনিটটি অক্ষত থাকবে। যুদ্ধের শেষে আমরা বেরিয়ে ডাচাউতে ঢুকে পড়লাম। মিত্রশক্তি ভাবল আমরা হিটলারের বন্দি। আমাদের খাতির করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হল। যেটা ওরা কখনওই বুঝতে পারেনি, সেটা হল, ওই দলের মধ্যে হিটলার নিজেও ছিলেন। অবশ্যই চেহারা পালটে। কারণ হিটলারের যে চেহারা লোকে দেখে অভ্যস্ত ছিল, সেটা ছিল ছদ্মবেশ। হিটলার আত্মহত্যা করেনি। বরং বার্লিনের পতনের এক মাস আগে নিজের এক ডামিকে বাংকারে রেখে ডাচাউ পালিয়ে আসেন। হিটলার শেষ জীবনে ক্রান্তসবুর্গেই ছিলেন। শেষে লিভার ক্যানসারে মারা যান।”

অমৃতা বলা শেষ করে চুপ করে। বিভ্রান্ত দেবোপম কিছুই বুঝতে পারে না। বলে, “তোদের বাড়িতে যে ছেলেগুলো…”

“ওরা আমার মায়ের পেটের ভাই, যদিও প্রত্যেকের বাবা আলাদা।”

“তোরা অসুস্থ হলে কি করিস?”

“আমাদের মধ্যে ডাক্তার হবার প্রবণতা খুব বেশি। ইন ফ্যাক্ট, আমার বাবাই একজন ডাক্তার। আর প্রত্যেক অমানুষ কলোনির জন্য একটা করে নার্সিং হোম থাকে, এখানে যেমন পুরুলিয়ায় একটা আছে। চণ্ডীগড়ে আমাদের

একটা বড় হাসপাতাল আছে।”

দেবোপম খাপছাড়াভাবে প্রশ্ন করে, “তুই কাকে বিয়ে করবি তাহলে?”

অমৃতা বলে, “ভাইদের ছাড়া যে কোনও অমানুষকে। তারপর বিভিন্ন অমানুষ পুরুষের বাচ্চার জন্ম দেব। যতগুলি সম্ভব। অমৃতার গলাটা যেন কেমন শোনায়।”

দেবোপম বলে, “আচ্ছা ধর্‌, আমি যদি তোদের এই নিয়মটা মেনে নিই, অর্থাৎ তুই বিভিন্ন আমানুষের বাচ্চার মা হবি। সে ক্ষেত্রে কি তোরা আমাকে দলে নিবি? আমি শুধু তোর সঙ্গে থাকতে চাই। তোর সব ক-টা বাচ্চাকে আমি নিজের বলে মেনে নেব।”

স্তম্ভিত অমৃতা বলে, “তা-ই কি সম্ভব নাকি? প্রথমত, আমাদের কমিউনিটি একজন মানুষকে নিজেদের মধ্যে নিতে কখনওই রাজি হবে না। দ্বিতীয়ত, তুই কেন এত বড় একটা ত্যাগ স্বীকার করবি?”

“তাহলে যদি আমরা দুজনে পালিয়ে যাই? একটা মানুষ আর একটা অমানুষ যদি হারিয়েও যায়, পৃথিবীর তাতে খুব কি ক্ষতি হবে? আমাদের বাচ্চাকাচ্চা না-ই বা হল। আমরা দুজনে দুজনকে নিয়ে সুখী হতে পারব না?”

অমৃতা চুপ করে থাকে। দেবোপম বুঝতে পারে, ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। দেবোপম আবার বলে “তুই আমাকে ভালোবাসিস না অমৃতা?”

অমৃতা মর্মচ্ছেদী গলায় বলে, “বাসি। তাতেই তো আমার সর্বনাশটা হল।” দেবোপম বলে, “তাহলে, চল্‌ আমরা পালিয়ে যাই।”

দেবোপমের পিছন থেকে একটা রুক্ষ পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল -– “একটু দেরি হয়ে গেল।” অমৃতা স্প্রিং-এর মতো লাফ দিয়ে দেবোপমের পিছনে দাঁড়াল। “প্লিজ ওকে ছেড়ে দাও। ও কাউকে কিছু বলবে না।” এবারে উলটো দিক থেকে আর-একজনের গলা পাওয়া গেল। “অমৃতা তুমি সরে দাঁড়াও।” দেবোপম প্রায় চিৎকার করে বলল, “আপনারা কি চান?” দেবোপমের পিছনের লোকটা বলল, “তুমি অনেকটা জেনে ফেলেছ। তোমার আর বেঁচে থাকা চলবে না। আমরা আমাদের পুরো জাতটাকে বিপন্ন করে তুলতে পারি না।” দেবোপম থমকে গেল। বলল, “মানছি অতীতে আপনাদের উপর অনেক অবিচার হয়েছে, কিন্তু এখন কী আপনারা মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারেন না?” ওপাশ থেকে একটা ব্যঙ্গের হাসি ভেসে এল। —“আমাদের অস্তিত্ব জানার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পুরো জাতটাই জেনেটিক গবেষণার গিনিপিগ হয়ে যাবে। মানুষদের আমরা হাড়ে হাড়ে চিনি। মানুষরা মানুষদের সঙ্গেই মিলেমিশে থাকতে পারে না তো আমরা!” দেবোপম একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনারা অমৃতাকে কোনও শাস্তি দেবেন না তো?” ওদিক থেকে আর একজন বয়স্ক লোকের গলা ভেসে এল—“না। কারণ আমাদের জাতির মধ্যে মেয়েরা অত্যন্ত প্রেশাস।” দেবোপম বলল, “তাহলে অমৃতাকে ভালো করে ধরুন। আমাকে আক্রমণ করলে ও কিন্তু মাঝখানে এসে পড়ে চোট পেতে পারে।”

চারদিক থেকে চারজন অমানুষ এগিয়ে এল। আরও দুজন শক্ত হাতে অমৃতাকে চেপে ধরে আছে। বয়স্ক অমানুষটি দেবোপমের কাছে এসে বলল, “আমরা তোমার জন্য দুঃখিত ইয়াং ম্যান। তুমি আমাদের একজনকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে ছিলে। কিন্তু আমরা নিরুপায়।” একজনের হাতে ছুরি চকচক করে উঠল। আর-একজন পিছন থেকে দেবোপমের হাত চেপে ধরল। দেবোপমের চোখের সামনে আস্তে আস্তে নিজের ছোটবেলার কথা ভেসে আসতে শুরু করল। হঠাৎ পিছন থেকে সেই বয়স্ক অমানুষটির গলা পাওয়া গেল, “থাম।” দেবোপম তার সামনে বয়স্ক লোকটিকে অনুভব করে।

“তুমি সত্যিই সাহসী, ইয়াং ম্যান! তোমাকে ছেড়ে দিলে তুমি কাউকে কিছু বলবে না—এই শপথ করতে পার? ”

দেবোপম বলল আমি, “কাউকে কিছু বলব না—এটা শপথ করতে পারি। কিন্তু অমৃতার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করব না—এ কথা দিতে পারি না।”

“ওকে, তাহলে আগামী ছ-মাস তুমি অমৃতার থেকে দূরে থাকবে। আমরা তোমার উপর কড়া নজর রাখব। ছ-মাসের মধ্যে যদি তুমি কাউকে কিছু না বল, তাহলে আমরা তোমাদের কথা আবার ভেবে দেখব। আফটার অল, তুমিই একমাত্র মানুষ যে, আমাদের কাউকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছ।” বয়স্ক লোকটি অমৃতার দিকে তাকিয়ে বলল “ঠিক আছে অমৃতা!” অমৃতার মুখ দিয়ে কথা বেরচ্ছিল না। কোনওমতে বলল “হ্যাঁ বুর্গোমিস্টের।”

“তাহলে অমৃতাকে নিয়ে আমরা চলে যাচ্ছি। তুমি মিনিট পাঁচেক পর বেরিয়ে আসবে। কেমন?”

দেবোপম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল। এত কাণ্ডের পর ওর আর ভাবনার শক্তি অবশিষ্ট নেই। খালি একটা মজার কথা ওর মাথায় এল—‘জেট্রিয়ানের জামাই’, বেশ সুন্দর অনুপ্রাস। আস্তে আস্তে ও রবীন্দ্র সরোবর থেকে বেরিয়ে এল। এবারে বাড়ি ফেরা। তারপর বাবা-মাকে একটা ডিটেল জবাবদিহি করা। কী বলা যায়? কোথায় গিয়েছিল ও? দেবোপম খেয়াল করেনি যে, তিনজন ছেলে ওকে তিনদিক থেকে ঘিরে ধরছে। হাতে চকচকে ছুরি। অমানুষদের গোপন কথা গোপন রাখতেই হবে।

কথা রাখে না, কেউ কথা রাখে না।

এই কাহিনি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কোনও বাস্তব ঘটনা বা চরিত্রের সঙ্গে মিল পাওয়া গেলে তা আকস্মিক ধরতে হবে।

লেখক পরিচিতি – ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৬৬ সালে কলকাতায়। পদার্থবিদ্যার ছাত্র। ইন্সটিটিউট অফ রেডিও ফিজিক্স থেকে সৌরপদার্থবিদ্যায় গবেষণা করে ১৯৯৬ সালে Ph.D ডিগ্রি  আর ওই বছরই মৌলিক গবেষণার জন্য
URSI Young Scientist Award লাভ। বর্তমানে দীনবন্ধু অ্যান্ডুজ কলেজে অধ্যাপনারত। প্রথম কাহিনি প্রকাশ ২০১৬ সালের শারদীয়া তথ্যকেন্দ্র পত্রিকায়। ২০১৭ সালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প অনেকের প্রশংসা অর্জন করে। ফেসবুকের নানা গ্রুপের নিয়মিত লেখক। নেশায় সর্বভুক পাঠক। স্বভাবে অন্তর্মুখী ও অলস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *