অমল ধবল পালে
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে বর্ষাশেষে প্রথম শারদপ্রাতে আমি এই মহানগরীতে অনুপ্রবেশ করেছিলাম।
এর আগে অবশ্য আরও দুয়েকবার নেহাত বেড়ানোর জন্যে এবং একবার মাসতুতো বোনের বিয়েতে মা-বাবার সঙ্গে কলকাতায় এসেছি। কিন্তু সেই শারদপ্রাতে সবুজ পাসপোর্ট, সবুজ পাঞ্জাবি, এই শহরে আমার পুরোপুরি আসা।
কলেজে ভর্তি হতে এসেছিলাম। তারপর খেলাচ্ছলে, সুখে-দুঃখে, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিছু বোঝার আগে প্রায় চার দশক পূর্ণ হতে চলেছে।
সে বছর পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক পর্ষদের প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল বেরতে একটু দেরি হয়েছিল। রেজাল্ট বেরনোর পরের দিনই বোধহয় আমাকে রওনা হতে হয়েছিল। তার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এর পরে আর যাত্রাশুভ’ ছিল না, সেটাই ছিল শ্রাবণ মাসের শেষ দিন, তারপরই ভাদ্র মাস, যাত্রা নাস্তি। সুতরাং আমাকে তড়িঘড়ি রওনা হতে হল, বিকেলে রেজাল্ট এল, পরদিন সকালেই কলকাতা যাত্রা।
কত কী ভুলে গেছি এই সামান্য জীবনে।
কত মুখ, কত নাম, কত ঠিকানা। অনেক ভালবাসাভরা স্মৃতি, অনেক বেদনাভরা দুঃখ। কত কিছু আবছা, অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
কিন্তু সেই চলে আসার দিনটিকে ভুলিনি।
সেটা ছিল একত্রিশে না বত্রিশে শ্রাবণ। আগের দিন আকাশ ঝকঝকে ছিল। বাড়ির মধ্যে উঠোনের পাশে গোলবারান্দায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত বাড়ির সকলের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। পরদিন কলকাতায় চলে আসার উত্তেজনায় ঘুম আসছিল না চোখে।
মেঘ মুছে যাওয়া বর্ষণশেষের আকাশে হাজার হাজার তারা ঝিকমিক করে জ্বলছে। পায়ের কাছে, সিঁড়ির নীচে, অনেকদিন আগের ভুঁইচাঁপা ফুলগুলো, যাদের সবাই ভুলে গিয়েছিল, হঠাৎ সেদিনই সন্ধ্যায় মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। উলটোদিকে হারান মিস্ত্রির বাড়িতে একটা বোকা শিউলিগাছ একটু আগেই ফুল ফোটানো শুরু করেছে। তার সঙ্গে বোকামি করছে আমাদের ভাঙা বাগানের বুড়ো কামিনীফুলের গাছটা, ঠিক চৈত্র মাসের মতো হঠাৎ ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে।
পরেরদিন সকালে বাড়ির থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে বেরিয়ে চার মাইল দূরে নদীর ঘাট থেকে স্টিমারে উঠে বিকেল বিকেল সিরাজগঞ্জ রেলস্টেশন, সেখানের থেকে সন্ধ্যাবেলা সুরমা মেল পরদিন ভোরবেলায় সরাসরি শেয়ালদা, মোক্ষনগরী কলকাতা।
সুন্দর সকালবেলায় অশ্রুসজলা জননী, চেনা বাড়িঘর, লোকজন, গাছপালা প্রাণপ্রিয় জন্মের শহর ছেড়ে টমটমগাড়িতে কলকাতা অভিমুখে রওনা হলাম। কিন্তু নদীর ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আকাশ অন্ধকার করে তুমুল বৃষ্টি এল, জলের তোড়ে ঝাপসা হয়ে গেল চারপাশের দৃশ্য।
কোনওরকমে ভিজতে ভিজতে বাক্সবিছানা নিয়ে স্টিমারে গিয়ে উঠলাম। রীতিমতো দুর্যোগ কিন্তু ঝোড়ো হাওয়া নেই তাই রক্ষা, স্টিমার ঠিক সময়েই ছাড়ল এবং পৌছাল। সারা দুপর নদীতে কখনও ঝিরঝির করে, কখনও জোরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ল।
সিরাজগঞ্জ ঘাটেও সমান বৃষ্টি। সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টির বেগ প্রবলতর হল। তার মধ্যেই রওনা হল সুরমা মেল। ছোট ছোট সব স্টেশন সিরাজগঞ্জ টাউন, রায়পুর, সলপ বৃষ্টির মধ্যে ঢেকে রেখে ঈশ্বরদি জংশন, পদ্মার ওপরে সারা ব্রিজ, পোড়াদহ পার হয়ে এলাম; তখনও অঝোরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। এরই মধ্যে শুল্কপ্রহরা, ছাড়পত্র সীমান্ত পেরোলাম।
এরপর শেষ রাতের দিকে সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি আমার রাত পোহাল শারদপ্রাতে, রোদে ঝলমল করছে চারিধার, ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশে স্বচ্ছ সাদা মেঘ। অন্ধকার মেঘ বৃষ্টির কোথাও চিহ্ন পর্যন্ত নেই, জলবৃষ্টির পৃথিবী ছেড়ে নীল দিগন্তের দিকে জোর ছুটছে সুরমা মেল।
এক এক করে ক্রমশ ছিটকিয়ে চলে যাচ্ছে পলতা, শ্যামনগর, শহরতলির স্টেশন আর কিছুক্ষণের মধ্যে কলকাতা। পহেলা ভাদ্র, শরৎকালের প্রথম প্রভাতে নীল আকাশের নীচে রৌদ্রকরোজ্জ্বল মহানগরীতে এসে প্রবেশ করলাম।
এখনও যখন কোনও কোনও দিন বর্ষা শেষ হওয়ার মুখে হঠাৎ মেঘ কেটে নীল রংয়ের আকাশ ঝলমল করে ওঠে ঝকমকে রোদুরে ভরে যায় আমাদের এই নগরীর রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, আমার মনে পড়ে যায় একদা এমনই এক শুভপ্রভাতে এই শহরে আমি চিরদিনের জন্য প্রবাসী হয়েছিলাম।
শিশুশিক্ষার বইতে ঋতু পরিচয়ে লেখা আছে, ‘ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল’। যদিও ভাদ্র মাসের অনেকটাই, কোনও কোনও বছর প্রায় পুরোটাই, বর্ষাকালের মধ্যে পড়ে, এমনকী আশ্বিন মাসেও বর্ষা থেকে যায়, বিজয়া দশমীর দিন ঝড়জল তো প্রায় বাঁধা ব্যাপার, কবিও লিখেছেন মেঘে ঢাকা দারুণ দুর্দিনের আকূল আশ্বিনের কথা।
‘শরৎ’ কথাটির সরাসরি কোনও প্রতিশব্দ নেই ইংরেজিতে, Autumn হল হেমন্ত ঋতু, বিলিতি অভিধানের ভাষায় গ্রীষ্ম ও শীতের মধ্যবর্তী সময়। কিন্তু গ্রীষ্ম ও শীতের মধ্যে আমাদের রয়েছে দীর্ঘ বর্ষাকাল। তবে ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময় অনেকেই শরৎকাল বোঝাতে Early Autumn বা আগ হেমন্ত কথাটি ব্যবহার করেন।
এই পর্যন্ত লেখার পরে অভিধান দেখতে গিয়ে খটকা লাগছে। আমরা ছোটবেলায় বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত বারো মাসে যে ষড়ঋতুর কথা জেনেছিলাম সেই হিসেবে শরৎকাল হল ভাদ্র-আশ্বিন সুবলচন্দ্র মিত্র সংকলিত সরল বাঙ্গালা অভিধানে দেখছি যে শরৎকাল হল আশ্বিন-কার্তিক মাস। কিন্তু কার্তিক তো হেমন্ত ঋতুর প্রথম মাস সে কী করে শরতের সঙ্গে জুড়ে গেল?
রাজশেখর বসুও আমাকে বিশেষ সাহায্য করতে পারছেন না। তাঁর চলন্তিকায় দেখছি ওই একই কথা। শরৎ মানে আশ্বিন-কার্তিক, তবে তিনি একটু রফা করেছেন, ব্র্যাকেটে লিখেছেন মতান্তরে ভাদ্র-আশ্বিন। এ বিষয়ে অবশ্য আশুতোষ দেবের অনেক পুরনো ‘সরল অভিধান’ আমার পক্ষে রয়েছে। সেখানে শরৎ বলতে পরিষ্কার বলা আছে ভাদ্র-আশ্বিন মাস।
কলকাতায় এসে আমি উঠেছিলাম একেবারে শহরের খোদ মধ্যখানে এসপ্লানেডের ডেকার্স লেনে আমার ছোট মাসিমার কাছে। সেটা ছিল সরকারি কোয়ার্টার, সেই বাড়িতে তিনঘর বাঙালী ছাড়া পুরো এলাকায় ধারে-কাছে কোনও বাঙালি ছিল না। তখনও সব ইংরেজ চলে যায়নি, তা ছাড়া প্রায় সবাই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, কিছু দক্ষিণ ভারতীয় খ্রিস্টান। পাশেই চিনেপাড়া। ইতস্তত এদিক ওদিক সন্দেহজনক এলাকা।
ওপাড়ায় দুর্গাপুজোর কথা তখন ভাবাই যেত না। কাছাকাছির মধ্যে দুর্গাপুজো বউবাজারে আর তালতলায়। অবশ্য সুরেন ব্যানার্জি রোডে নিউ মার্কেটের ওপাশে রানি রাসমণির বাড়ির প্রাচীন পুজোও ছিল, কিন্তু তখন আমরা তার খবর রাখতাম না।
তখন খবরের কাগজে প্রাচীন বা বিশিষ্ট পূজো নিয়ে এত লেখা, ছবি, আলোচনার আয়োজন ছিল না। লোকমুখে শুনেই সবাই ঠাকুর দেখতে বেরত, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে দমকলের প্রতিমা, শ্যামবাজার বা ভবানীপুরের ক্লাবের ঠাকুর।
অবশ্য কলকাতায় শরৎকালে ঠাকর দর্শনের খুব একটা সুযোগ আমার হয়নি। তার কারণ তখনও বাড়ির লোকেরা সবাই দেশে। প্রত্যেকবারই পুজোর সময় ষষ্ঠীর দিন শেয়ালদা থেকে রেলে করে বাড়ি ফিরে যেতাম। শেয়ালদা স্টেশন চত্বরে তখন ঢাকের আওয়াজ গমগম করছে, সীমান্তের ওপার থেকে পুজোর চুয়াডাঙা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া থেকে ঢাকিরা এসেছে কলকাতার পুজোয় চারদিনের মেয়াদে। এ তাদের বাৎসরিক বৃত্তি, সারা বছর ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে শুধু এই চারদিন মহানগরীর জন্যে।
শুনেছি এই এতদিন পরে, এখনও ঢাকিরা ওপার থেকে প্রায় একইভাবে শেয়ালদায় এসে পৌঁছায় পুজোর আগে, তবে আমি দেখিনি। ষষ্টীর সকালে এখন আর শেয়ালদায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বাড়ি যাওয়া অনেকদিন বন্ধ হয়েছে।
কলকাতায় থাকতে এসে আমার প্রথম যে শারদীয় অভিজ্ঞতা হল সে হল মহালয়ার পুণ্যপ্রভাতে। শেষ রাতে ঘুম জড়ানো চোখে বিছানায় বসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর পঙ্কজ মল্লিকের মহালয়ার দেবীবন্দনা।
আমরা যে সুদূর তেরো নদীর পারের ছোট মফস্বল শহরে বড় হয়েছিলাম সেখানে বেতারযন্ত্র তখনও যথেষ্ট জনপ্রিয় নয়, ঘরে ঘরে রেডিয়ো পৌঁছোয়নি। বিশেষ করে আমাদের বাড়িতে ও-জিনিসটা ছিল না, পাড়াতেও বোধহয় নয়। সুতরাং কলকাতায় আসার আগে মহালয়ার ভোরের দেবীবন্দনার কোনও ধারণাই আমার ছিল না। শাস্ত্র, স্তোত্র, সংগীতের এমন ভাবগম্ভীর সমারোহ, উদাত্ত কণ্ঠের আবৃত্তি, শেষরাতের আধো অন্ধকারে সুরের মায়াজাল এক মফস্বল বালকের মুগ্ধ ও শিহরিত হওয়ার পক্ষে এর বেশি কিছু প্রয়োজন ছিল না।
শরৎকাল বলতে পঞ্জিকায় বা ক্যালেন্ডারে যাই বোঝাক, অভিধানের মানে যাই হোক এই শহরে শরৎকালের শুরু ওই মহালয়ার সকালে।
আমাদের ডেকার্স লেনের পাড়ায় চারদিকে যেমন কোনও বারোয়ারি পুজো ছিল না সেইজন্যে চাঁদার উৎপাতও ছিল না। তখন অবশ্য চাঁদা পুরোটা উৎপাত ছিল না। চোখ রাঙানি ছিল না, চাঁদা আদায়ের বেশির ভাগটাই ছিল আদর-আবদার। কিন্তু পুজো না থাকায় আমাদের এলাকায় সেই আদর-আবদারও ছিল না।
চাঁদা নয়। শিউলি ফুলও নয়।
ওই কাঠকট্টর পাড়ায় কোনও বাড়িতে উঠোন ছিল না। গলির মধ্যে একটাও গাছ ছিল না। কোনও জাতেরই গাছ নয়। ডেকার্স লেনের বাড়ির জানালায় বা বারান্দায় কিংবা গলির পথে মেম যুবতীর পাউডার পমেটম বা এসেন্সের উগ্র সুবাস হয়তো কখনও নাকে পেয়েছি কিন্তু কচিৎ এক ঝলক শিউলি ফুলের গন্ধ কখনও বাতাসে আসেনি।
আর কাশফুল? শরৎকালের অন্য অনুষঙ্গ?
কাশফুলের প্রশ্নই আসে না। কলকাতায় কাশফুল ফুটল তো এই সেদিন। পাতাল রেলের মাটি কাটার পর হঠাৎই একদিন এক শারদীয় পুণ্যক্ষণে চৌরঙ্গির সীমানায় ময়দান জুড়ে ফুটে উঠল রাশি রাশি কাশফুল। কাগজে কাগজে ছবি বেরল নীল আকাশের সাদা মেঘের নীচে কলকাতার ময়দানের হাওয়ায় আন্দোলিত ক্ষুদ্র কাশগুচ্ছের।
আমি কলকাতায় এসে শরৎকালের শিশির, শিউলিফুল বা কাশের গুচ্ছের দেখা পাইনি। প্রথম দিনের প্রবেশ কালে ঝলমলে রোদ্দুরের যে অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম সেটুকুই যা ছিল শারদীয়।
কিন্তু মহালয়ার দিন শেষ রাতের বেতার তরঙ্গাঘাতে নাগরিক শরৎকালের সঙ্গে পরিচয় হল। এর আগেই অবশ্য পুজোর বাজার কেনাকাটা শুরু হয়ে গিয়েছে। হকার্স কর্নার ব্যাপারটা তেমন চালু হয়নি। কেবল কলেজ স্ট্রিটে গোলদিঘির চারপাশে আর বোধহয় ধর্মতলায়। জুতোজামা, শাড়ির বাজার কলেজ স্ট্রিটে, বড়বাজারে। গড়িয়াহাটের রমণীশাসিত বাজার ভাল করে আরম্ভ হয়নি। শুধু দুয়েকটি বড় দোকান মোড়ের কাছাকাছি।
কলকাতার বিখ্যাত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো যথা কমলালয়, ওয়াছেল মোল্লা, হল অ্যান্ড অ্যান্ডারসন তখনও জমজমাট। এত না হলেও কাগজে বিজ্ঞাপন বেরচ্ছে পুজোর কেনাকাটার। লাল সালুতে ‘সেল, সেল’ কিংবা সিনেমায় বিজ্ঞাপনের স্লাইড পুজোর বাজারের খবর বহন করছে।
আস্তে আস্তে টের পাওয়া যাচ্ছে শরৎকাল। মফস্বল থেকে, দিল্লি, পাটনা, বোম্বাই থেকে প্রবাসী বাঙালিরা ঘরে আসছে বছরকার দিনে। রাস্তাঘাটে সপরিবারে তাদের দেখলেই চেনা যাচ্ছে।
মহালয়ার দিন সকালের দেবীবন্দনায় যে নাগরিক শরৎকালের শুরু সেই দিন আরও কিছু বড় ব্যাপার ছিল।
গঙ্গায় তর্পণের স্নান কিংবা কালীঘাট অথবা দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে প্রণাম করার মতো ধর্মীয় ব্যাপার ছাড়াও মহালয়ার দিনটি লক্ষণীয় ছিল আরও দুটো কারণে।
প্রথম হল বিভিন্ন পত্রিকার শারদীয় সাহিত্যসম্ভার, যার ডাক নাম হল পুজো সংখ্যা। সেই সময়েই এগুলো জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে। কাগজগুলো যথাসম্ভব মহালয়ার দিনই বের হত। শারদীয় দেশ তখনও পুরোপুরি গল্প আর কবিতার। কিছুকাল পরে একটি করে উপন্যাসও থাকত। বড় উপন্যাস থাকত আনন্দবাজারে। বেরত মোটা কাগজে, বোর্ড বাঁধাই ছোটদের পূজাবার্ষিকী। তবে এত বেশি শারদীয় সংখ্যা তখন ছিল না। তখনও সিনেমার কাগজ সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করেনি। তবে অন্য ধরনের কিছু সাপ্তাহিক ও মাসিক ছিল, ছিল বুদ্ধদেব বসুর কবিতা কিংবা হুমায়ুন কবিরের চতুরঙ্গের মতো অভিজাত লিটল ম্যাগাজিন।
মহালয়ার দিন সকালে ধর্মতলার কৃষ্ণচূড়া গাছতলায় পত্রিকার স্টলে দুরুদুরু বক্ষে গিয়ে দাঁড়াতাম। সে এক রোমাঞ্চকর শারদীয় স্মৃতি।
আমি তখন উলটোপালটা দিস্তা দিস্তা কবিতা লিখে ছোট বড়, খ্যাত অখ্যাত সমস্ত পত্রিকায় পাঠিয়ে যাচ্ছি; সমস্ত সাধারণ ও বিশেষ সংখ্যায়, শারদীয়া সংখ্যায় অবশ্যই।
আস্তে আস্তে কাঁপা হাতে পত্রিকার পৃষ্ঠা খুলে সূচিপত্রে নিজের নাম খুঁজতাম। হঠাৎ কখনও হয়তো দু’-চার পঙ্ক্তি ছাপা হয়েছে। হয়তো বা পাদপূরণের জন্যেই। আনন্দে বিহ্বল হয়ে যাওয়ার বয়েস সেটা, খুশি মনে কার্জন পার্কের দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করতাম বর্ষাশেষের গাছের পাতা, মাঠের ঘাস অনেক বেশি সবুজ। গাছের পিছনে আকাশের নীলে সমুদ্রের চঞ্চলতা, অমল ধবল পাল তুলে সেখানে সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। পকেটের পয়সা দিয়ে আমার লেখা ছাপা হওয়া কাগজটি তখনই কিনে ফেলতাম। কমপ্লিমেনটারি কপি কবে পাওয়া যাবে কে জানে! ততদিন অপেক্ষা করার অবসর কোথায়।
মহালয়ার দিনের দ্বিতীয় বড় আকর্ষণ ছিল সারারাতের থিয়েটার। উত্তর কলকাতায় হাতিবাগানে তখন শ্রীরঙ্গম, রঙমহল, স্টার ইত্যাদি তিন-চারটি থিয়েটার হল পুজোর বাজারে জমজমাট বন্দোবস্ত করত।
এক রাতে তিনটি কি চারটি পালা। শেষরাতে আকাশ ফর্সা হয়ে কাকডাকা পর্যন্ত অভিনয় চলত। থিয়েটার দেখা শেষ করে লোকেরা ফার্স্ট ট্রামে করে বাড়ি ফিরত। তখন রাস্তা জল দিয়ে ধোয়া হচ্ছে। গ্যাসের আলো নেবাতে কর্পোরেশনের লোকেরা পথে বেরিয়ে পড়েছে।
আমি অবশ্য কোনওদিন সারারাত জেগে থিয়েটার দেখিনি। সারারাত জাগার ক্ষমতা দিয়ে ঈশ্বর আমাকে পৃথিবীতে পাঠাননি। জীবনে একদিনও আমি সারারাত জাগতে পারিনি। তবে এক মহালয়ার রাতে মফস্বলের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ‘হোল নাইট’ থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ছে রাত দশটা না সাড়ে দশটায় প্রথম পালা, বোধহয় সেটার নাম ছিল ‘গঙ্গাবতরণ’। শেষ হওয়ার আগেই সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরে উঠে হলের সামনের বারান্দায় একটা লম্বা হেলান দেওয়া কাঠের বেঞ্চি ছিল সেটিতে গিয়ে শুয়ে পড়ি।
ওই থিয়েটার হলের প্রাঙ্গণের মধ্যেই কিংবা আশেপাশে কোথাও সেদিন সারারাত ধরে টুপটুপ করে শিউলি ফুল ঝরে পড়েছিল, আমি ঘুম আর তন্দ্রা জড়ানো হাওয়ার সেই ফুলের সুবাস পেয়েছি।
ভোরবেলা আমার সঙ্গের লোকেরা আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে তুলল সেই কাঠের বেঞ্চি থেকে। দু’হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে কোনও রকমে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে সকলের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে দেখি বারান্দার একদিকে ওপাশের দেয়ালের সামনে একটা ছোট শিউলি গাছ থেকে অনেক ফুল উঠোনে ঝরে পড়ে রয়েছে। আমি রুমালে কয়েকটা শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিলাম। বোধহয় সেই শেষবার। তারপর আর কখনও শিউলিফুল কুড়িয়েছি বলে মনে পড়ে না।
ভোরবেলায় ট্রামে হাতিবাগান থেকে এসপ্লানেড আসতে আসতে দেখলাম কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট আর ওয়েলিংটনের রাস্তায় এধার ওধারে বাঁশ দিয়ে পুজোমণ্ডপের ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে। এখনকার মতো এত নয়, তবুও যথেষ্ট। আমার পক্ষে যথেষ্ট।
কলকাতায় আসার পর প্রথম কয়েক বছর এসপ্লানেড় অঞ্চলে থাকার জন্যেই কোনও পাড়ার বা বারোয়ারি পুজোয় আমি জড়িয়ে পড়িনি। তার অন্য একটা কারণ অবশ্য এই যে আসল পুজোর সময় তো আমার থাকা হচ্ছে না। ষষ্ঠীর বোধন থেকে বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত থাকতে না পারলে পুজোর ব্যাপারে জড়িয়ে লাভ নেই।
তবে ডেকার্স লেনের পাড়া ছেড়ে আসার ঠিক শেষ বছরে ঠিক ওখানে না হলেও রাস্তার ওপারে গভর্নমেন্ট প্লেসে দুর্গাপুজো শুরু হয়। বারোয়ারি পাড়ার পুজো। সে বছর কী একটা অশান্তির জন্যে দেশে যাওয়া হয়নি। সেই পুজোতে আমি ছোটখাটো কিছু কিছু কর্তব্য পাড়াবাসী হিসেবে পালন করেছিলাম। খুব সম্ভব ডেকার্স লেনের মাদ্রাজ হ্যান্ডলুমের একটা ছোট আধ পাতা বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম সেই পুজোর সুভেনিরে।
সত্যি সত্যি পাড়ার পুজোয় জড়িয়ে পড়ি অনেকদিন পর দক্ষিণ কলকাতায় পণ্ডিতিয়ায় এসে। পুজোর প্রথম মিটিং থেকে শেষ মিটিং, চাঁদা তোলার রসিদ বই ছাপা থেকে হিসেব মেটানো পর্যন্ত সব কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছিলাম। শুনেছি সে পুজোর পৃষ্ঠপোষক কিংবা উপদেষ্টামণ্ডলীর তালিকায় একেবারে প্রথম সারিতে এখনও আমার নাম ছাপা হয়।
এই পুজোর মণ্ডপটি ছিল আমাদের একতলায় ফ্ল্যাটের সামনের তিন কোনাচে বসার ঘরের মুখোমুখি। জানলায় দাঁড়ালেই সামনাসামনি প্রতিমা দেখতে পেতাম।
আমাদের প্রিয় সারমেয়ী, তার নাম ছিল চিলি, একবার ঠিক ষষ্ঠীর দিন সকালে চিলির চারটে বাচ্চা হল। দুটো ছেলে, দুটো মেয়ে।
পঞ্চমীর গভীর রাতে মণ্ডপে প্রতিমা এসেছে। ঘুমের মধ্যে হইচই, বাজনা শুনে বুঝতে পেরেছি। সকালবেলা বাড়ির মধ্যের উঠোনের ধারে পরিত্যক্ত পুরনো রান্নাঘরে চিলির কোলে দুই ছেলে, দুই মেয়ে। আর তখনই জানলা দিয়ে দেখছি ষষ্ঠীর সকাল আলো করে মণ্ডপ জুড়ে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে নিয়ে দুর্গাঠাকরুন এসেছে।
একটা অধার্মিক, অশাস্ত্রীয় কাজ করে ফেললাম। আশাকরি ধর্মপ্রাণ কেউ অপরাধ নেবেন না। চিলির পুরুষ বাচ্চা দুটোর নাম রাখলাম কার্তিক, গণেশ, আর মহিলা বাচ্চা দুটোর নাম হল লক্ষী সরস্বতী। সেই গণেশ এখনও প্রবল প্রতাপে আমাদের বাড়িতে রয়েছে। তার কম্বুকণ্ঠের গর্জনে পুরো পাড়া কাপে।
আর বেশি কথা নয়।
কলকাতার আকাশে আবার পেঁজা তুলোর মতো, বিশ্বস্ত সাদা ভেড়ার মতো হালকা মেঘেরা ফিরে এসেছে, আকাশে সেই সাবেকি নীল আভা, ময়দানের এদিক ওদিকে দু’-চারটি কাশফুল ফুটে ওঠার চেষ্টা করছে, শহরতলির গৃহস্থ বাড়ির আনাচে-কানাচে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর ঝরে পড়ছে পুরনো দিনের শিউলি ফুল।
রঙিন বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে দৈনিক কাগজের ক্রোড়পত্র। রাস্তায়, ফুটপাথে, দোকানে উপছে পড়ছে ভিড়। ছুটির ঘন্টা বাজছে, কলকাতা থেকে বাইরে ছুটছে মানুষ। বাইরে থেকে কলকাতায় ছুটছে আরও মানুষ।
একটা তুচ্ছ গল্প বলে শেষ করি।
সেই পণ্ডিতিয়া পাড়ার দুর্গাপুজোয় যেখানে অনেক বছর বারোয়ারি উৎসবে জড়িত ছিলাম, সেখানে গত বছরও একবার গিয়েছিলাম। পুরনো পাড়ার একটা অন্তরের টান থাকে। তা ছাড়া, পুরনো পরিচিত দু’-চারজন এখনও আছেন। আমার সঙ্গে তাঁদের কারও কারও এখনও যোগাযোগ আছে। আমি যাওয়ায় তাঁরা খুশিই হলেন।
ভালই হচ্ছে পুজো। বেশ ধূমধাম করেই। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করছিলাম, হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে এসে আমার পাঞ্জাবির ঝুল ধরে টানতে লাগল, আর বলতে লাগল, ‘এই যে তারাপদবাবু, তারাপদবাবু।’
আমি বাচ্চাটিকে চিনতে না পেরে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এ ছেলেটি কোন বাড়ির?’
কেউ কিছু বলার আগে বাচ্চাটিই জবাব দিল, ‘আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না, আমি আপনার চলে যাওয়ার পরে হয়েছি।’
বাচ্চাটির কথা শুনে মজা পেলাম।
সেই সাদা মেঘ, সেই নীল আকাশ, প্রতিমার মুখে সেই একই আদল।
এরই মধ্যে অবল ধবল পালে সময়ের তরী বয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ফিরে আসছে সেই পুরনো শরৎকাল। নতুন কালের শিশু জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে। আমাদের বয়েস বাড়ছে।