অমলের পাখি
হঠাৎ দরজা খুলে অন্তু বললে, এই দেখ অমল, সেই পাখিটা ধরেছি!
অমল তখন একমনে বসে খাঁচা বানাচ্ছিল। অন্তুকে দেখে ওর মুখ দুঃখে সাদা হয়ে গেল। ফ্যাকাসে গলায় বললো, তুই ধরে ফেললি অন্তু! শুধু শুধু আমি এত কষ্ট করে খাঁচা বানালুম।
অন্তু মুঠো করে পাখিটার দুটো ডানা চেপে ধরেছে। আনন্দে ওর চোখ দুটো দু—টুকরো রোদ্দুরের মতো ঝকঝক করছে। আজ ওদের ইস্কুল ছুটি। গ্রামে কে যেন একজন মস্ত বড় মানুষ এসেছে সেই জন্য। সারা দুপুর বাগানে ঘুরে, এ—গাছ সে—গাছের মগডালে চড়ে অতিকষ্টে ধরেছে পাখিটাকে। অমল পাখিটা ধরবার চেষ্টা করেনি। আগে বসে বসে খাঁচা বানিয়েছে। যদিও পাখিটা অমলই প্রথম দেখেছিল।
এটা কি পাখি রে? অন্তু জিজ্ঞেস করল।
জানি না, অমল বললো।
আমাকে পাখিটা দিবি?
ইস! কত কষ্ট করে ধরেছি, আর…
অমল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল পাখিটার দিকে। দূর থেকে দেখে খুব ভালো লেগেছিল কিন্তু পাখিটা যে এত সুন্দর সে ভাবতেই পারেনি। দুধের মত সাদা রঙ, ঘুঘু পাখির চেয়ে একটু বড়, পায়রার চেয়ে একটু ছোট। টিয়া পাখির মতন দীর্ঘ বাঁকানো লাল ঠোঁট। পাখিটা যেন ভয় পেয়ে অবাক হয়ে গেছে। অমল এত সুন্দর পাখি আগে কখনও দেখেনি।
দে ভাই অন্তু পাখিটা আমাকে, অমল মিনতি করে বললো, তার বদলে তুই যা চাস দেব। আমার জলছবির খাতাটা নিবি, কিংবা এক ডজন কাচের গুলি, কিংবা রোদ্দুরের চশমাটা?
না, চাইনা, পাখি দেব না! অন্তু সোজা জবাব দিয়ে দিল।
কিন্তু তোর তো খাঁচা নেই। তুই কোথায় রাখবি?
যেখানে ইচ্ছে। আমি কি তোর মত, পাখি না ধরেই খাঁচা বানাবো?
আচ্ছা, পাখিটা একবার ধরতে দে।
অমল কাছে এসে পাখিটার গায়ে হাত দিল। অমনি পাখিটা ঝটপট করে উঠতেই অন্তুর হাত ছেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সেই সাদা পাখি আনন্দে একবার সারা ঘরটা ঘুরে জানলা দিয়ে টুপ করে বেরিয়ে গেল। প্রথমে দুজনেই চমকে গিয়েছিল, তারপরই অমল অন্তু ছুটে বাইরে এল ঘর থেকে। রান্নাঘরের চালে বসেছে। সেখান থেকে তেঁতুলগাছের মাথায়। তারপর ফুরফুর করে উড়ে আরও দূরে চলে গেল।
ছুট ছুট ছুট। ওরা দুজনে ছুটলো পাখির পিছু পিছু। পাখি উড়তে উড়তে এল ছোট খালটার পারে। তারপর কয়েকবার অদ্ভুত ডাক ডেকে চক্কর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চলে গেল খালের মাঝখানে। সেখানে একটা বজরা নৌকো ছিল। পাখিটা তার জানলা দিয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে গেল।
অমল আর অন্তু খালের পারে দাঁড়িয়ে রইল বজরাটার দিকে তাকিয়ে। বজরা নৌকো একরকম ছোটখাট বাড়ির মত; তার ঘর আছে, ছাদ—বারান্দা সব আছে। এ বজরাটা কার ওরা জানে না। গ্রামে নতুন এসেছে।
তোর জন্যই আমার পাখিটা উড়ে গেল!
পাখিটা তোর কি, আমার। আমিই তো আগে দেখেছি। তা ছাড়া আমি ওর জন্য খাঁচা বানিয়েছি। তুই কি করেছিস ওর জন্যে?
কষ্ট করে গাছে উঠে ধরল কে? তুই ধরতে পারতিস?
শেষের প্রশ্নে অমল একটু দমে গেল। ও গাছে উঠতে পারে না। গাছে ওঠা বারণ। গত বছর ওর খুব কঠিন অসুখ হয়েছিল। দুপুরবেলা চারিদিক নিঝুম। কোথাও জন—মানুষ নেই। বজরাটা নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে একটা মাছরাঙা পাখি ঝুপ ঝুপ করে জলে ডুব দিচ্ছে।
চল, ওই বজরাটায় যাবি? অন্তু বললো।
চল।
দুজনে জামা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। অন্তু খুব ভাল সাঁতার জানে, অমলও একেবারে খারাপ নয়। শান্ত জল ভেঙে ঝুপ ঝুপ করে ওরা এগুতে লাগল, ভারী সুন্দর দেখাল জলের মধ্যে ওদের কচি শরীর। নীল আকাশ সকৌতুকে ওদের দেখতে লাগলো।
বজরা নৌকোতে উঠে দুজনে চুপি চুপি জল নিঙড়ে নিল। একটু ভয়—ভয় করতে লাগল ওদের। কি করবে, কাকে ডাকবে এখন? এই সময় হঠাৎ একটা ঘরের দরজা খুলে গেল। একজন দীর্ঘ সৌম্য প্রায় বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে বললেন, এসো, এসো ভিতরে এসো, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
ভয় পেয়ে চমকে উঠল অন্তু আর অমল। অন্তু ফিসফিস করে বললো, রাজাবাবু, এ সেই রাজাবাবু! চলে আয়। তারপর ঝপাং করে লাফিয়ে পড়ল জলে। প্রাণপণে পাড়ে উঠে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল। অমল কি করবে ভেবে পেল না। অতবড় একজন লোকের সামনে হাত—পা ছুঁড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে ওর লজ্জা করল। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
সেই সৌম্য বৃদ্ধ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলেন অন্তুকে। তারপর অমলের দিকে ফিরে বললেন, এসো, ভিতরে এসো। হাত ধরে অমলকে নিয়ে এলেন ঘরের মধ্যে।
বৃদ্ধের মুখে সাদা দাড়ি, পা পর্যন্ত ঝোলানো একটা আলখাল্লা পরা। ঘরটা সুন্দর সাজানো। জানলার পাশে একটা ছোট টেবিল। সেখানে পিতলের প্রদীপদান, দোয়াত—কলম, একটা কাগজে কয়েক লাইন কি যেন লেখা। আর সব চেয়ে আশ্চর্য, ঘরের কোণে একটা বেতের চেয়ারের মাথায় সেই সাদা পাখিটা।
ওই তো সেই পাখিটা! হঠাৎ অমল বলে উঠল।
তুমি বুঝি ওটাকে ধরতে চেয়েছিলে? প্রসন্ন হেসে বৃদ্ধ বললেন।
হ্যাঁ।
কিন্তু ওকে তো ধরা যায় না। ও এমনিই উড়ে উড়ে বেড়ায়।
কিন্তু আমি যে ওর জন্যে একটা খাঁচা বানালুম।
তা বেশ করেছ। সে খাঁচায় পাখি রাখবার দরকার নেই। খাঁচার মধ্যে পাখিটাকে মনে মনে কল্পনা করে নিও। সে কল্পনার পাখি দেখবে কেমন সুন্দর গান করবে, ডাকবে। আসল পাখিগুলো উড়ে বেড়াক আকাশের বিশাল নীল মাঠে, কেমন?
অমল মাথা নাড়ল। সব কথা সে ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু তার ভাল লাগল।
তোমার নাম কি?
অমল।
বাঃ, ভারি সুন্দর নাম।
আপনি কে, আপনি কি রাজাবাবু? ও আপনার জন্যই কি আজ আমাদের ইস্কুল ছুটি?
না, আমি রাজাবাবু নই, আমি তোমাদেরই লোক।
আপনার নাম কি?
আমার নাম তোমার মত অত সুন্দর নয়। আমার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিস্ময়ে অমলের চোখ কপালে ওঠবার উপক্রম। আপনিই তো সেই! আপনার জন্যই তো বাবা দু—দিন ধরে জমিদারবাবু আসবেন, জমিদারবাবু আসবেন, বলে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
না অমল, আমি রাজাবাবু নই, আমি তোমাদেরই লোক। আমি তোমার বন্ধু।
আপনি ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে’ লিখেছেন? আর সেই ভূতের মতন চেহারা যেমন। সেই পঞ্চ নদীর তীরে, ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত—সব আপনার লেখা?
হ্যাঁ। তোমার ভাল লাগে?
আমি সব পড়েছি। আমার কাছে যা আছে। কিন্তু আর নেই, আর পড়তে পাই না। আর লেখেননি?
অনেক লিখেছি, অনেক, সে—সব বড় হয়ে পড়বে। আচ্ছা, তোমার জন্যে আর একটা নতুন লিখব।
এমন সময় বাইরে একটা গলার আওয়াজ শোনা গেল। কর্তাবাবা আছেন নাকি!
রবীন্দ্রনাথ বললেন, বসো অমল, দেখে আসি কে এসেছে। তিনি বাইরে এলেন।
বাইরে একজন লোক হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। নায়েবের ভাই লোচনদাস ঘোষ। সে রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করল। কি খবর লোচন?
আজ্ঞে, আমার ছেলেটা নাকি এখানে এসেছে। বড় দুরন্ত ছেলে, হয় তো আপনাকে বিরক্ত করছে। অমল তোমার ছেলে? ভারী সুশ্রী ছেলেটি।
বাবার গলা শুনে অমল বেরিয়ে এল বাইরে। এখন আর তার ভয় নেই। এই সময় সাদা পাখিটি ঝটপট করে জানলা দিয়ে বেরিয়ে কোন দিকে উড়ে গেল। অমল সেইদিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল।
যাও অমল, বাবার সঙ্গে যাও, আবার এলে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
কিন্তু আমার সেই নতুন বই?
সেই বই লেখা হলে তোমাকে চিঠি লিখব।
অমল চলে গেল। তারপর থেকে তার দিন কাটতে লাগল অন্যরকমভাবে। যাঁর নামে গ্রামের সকলের মাথা শ্রদ্ধায় নিচু হয়ে যায়, তিনি অমলের বন্ধু। তিনি অমলকে চিঠি লিখবেন, বলেছেন। অন্তু যখন খেলায় ফার্স্ট হয়, তখন অন্তুকে অমলের একটুও হিংসে হয় না। অন্তুর তো তার মতো কোনো বন্ধু নেই, অন্তুর জন্য তো কেউ বই লিখবে বলেনি।
তারপর নানান দেশ—বিদেশ ঘুরে অনেক লোকজন দেখে দু’বছর পরে রবীন্দ্রনাথ আবার এলেন শিলাইদহের সেই ছোট্ট গ্রামে। গ্রামের লোকজন সকলে এসে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে গেল। অমলের কথা তাঁর মনেই পড়ল না। হঠাৎ একদিন সকালবেলা তাঁর সেই বজরা নৌকোর গলুই—এ সেই সাদা পাখিটিকে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ল সেই ছেলেটির কথা। যে একটা খাঁচা বানিয়েছিল পাখিটার জন্য। ব্যস্ত হয়ে তিনি নায়েবকে ডেকে তার ভাইয়ের ছেলের খোঁজ করলেন। শুনলেন যে অমলের খুব অসুখ। দু’মাস ধরে ভুগছে। বাঁচে কি মরে ঠিক নেই। বিচলিত হয়ে তিনি বললেন, আমি অমলকে দেখতে যাব।
গ্রামের পথ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ হেঁটে চলেছেন। সঙ্গে বেশি লোকজন আনেননি। এক জায়গায় দেখলেন, একটি সুন্দর ছোট্ট মেয়ে শেফালি ফুল তুলছে। মেয়েটা লাল পাড়ের শাড়ি পড়েছে, ফর্সা রঙ, তাকেও একটা শেফালি ফুলের মতই দেখাচ্ছে।
তোমার নাম কি? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
আমার নাম সুধা। মেয়েটি বললো।
তুমি অমলকে চেনো?
হ্যাঁ। মেয়েটি সুর করে উত্তর দিল, তারপর একটু থেমে নিচের দিকে চেয়ে বললো, তার যে খুব অসুখ।
রবীন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি আবার চললেন। বাড়ির উত্তরের ঘরে অমল শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে ডাক্তার, কবিরাজ, আত্মীয়, অমলের বৃদ্ধ ঠাকুর্দা। কি শীর্ণ চেহারা হয়েছে অমলের, চেনাই যায় না প্রায়। তাঁকে দেখেই অমলের চোখ ছল ছল করে উঠলো। ক্ষীণ গলায় বললো, আপনি এসেছেন?
হ্যাঁ। অমল, আমি এসেছি। তোমার কোনো ভয় নেই। তারপর রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, কি বলবেন ভেবে পেলেন না। তাঁর মত কথার জাদুকরও কথা হারিয়ে ফেললেন। একটুক্ষণ চেয়ে বললেন, আমি খবর এনেছি তোমার সঙ্গে রাজার দেখা হবে।
রাজা?
হ্যাঁ, অমল। আমি তোমার বন্ধু, তোমার সঙ্গে এক মহান রাজার দেখা হবে, যাঁকে আমরা পর্যন্ত দেখতে পাইনি।
আমার চিঠি? আমাকে চিঠি লিখলেন না?
ওই দেখ, স্বয়ং রাজা তোমাকে চিঠি লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ আঙুল তুলে জানলার দিকে দেখালেন। অমল তাকিয়ে দেখল, সকলে দেখল, জানালা দিয়ে বর্শার মত রোদ্দুরের শিখা পড়েছে আর সেই জানলার শিকে সেই সাদা পাখিটা বসে আছে। কি আশ্চর্য পাখি, ঠিক এসে অমলের জানলায় বসেছে। ঘরের কোণে অমলের তৈরি খাঁচাটা এখনও আছে।
অমল একদৃষ্টে সেই পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বললো, আমার ঘুম পাচ্ছে!
রবীন্দ্রনাথ হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর হনহন করে বজরার দিকে ফিরে চললেন। যেন তিনি বিষম ব্যস্ত। তাঁর আর সময় নেই। তাঁকে এখুনি গিয়ে অমলের জন্য একটা বই লিখতে হবে।