অমলা – বিমল কর
আমাদের বন্ধু নীলুর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেলেই কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে। ঘাটশিলায় গিয়ে মিহির হাত ভেঙেছিল, যশিডিতে যেবারে গেলাম, সেবারে শরৎ টাঙ্গা থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় বেশ চোট পেয়েছিল। আর একবার তো আমরা রাঁচির রাস্তায় বাস উলটে মরে যেতে যেতে বেঁচে গিয়েছি। অবশ্য এসব ঘটনার জন্য নীলুকে পুরোপুরি দায়ী করা উচিত নয়। তার এইমাত্র অপরাধ, সে ঘাটশিলায় সুবর্ণরেখার পেছল পাথরে পা দিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাবার পথটা আমাদের দেখিয়েছিল। কিংবা যশিডিতে যে টাঙ্গাটা চাকা ভেঙে রাস্তার মধ্যে কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে, সে টাঙ্গাটা নীলুই ভাড়া করেছিল। রাঁচির বাস সম্পর্কেও একই কথা, নীলুই আমাদের সন্ধের বাস ধরার জন্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এইসব ঘটনাকে আমরা নীলুর সঙ্গে একটা যোগসূত্র জড়িয়ে দিলেও সেটা নিতান্তই পরিহাস। যে ঘটনা স্বাভাবিক দুর্ঘটনা হিসেবে ঘটতে পারত, তার সঙ্গে নীলুকে জড়ানো অনুচিত। তবু আমরা ঠাট্টা করেই বলতাম, নীলু একটা অপয়া। নীলু এসব কথায় কান করত না, রাগও করত না।
সেবার ঘটনাটা অন্যরকম ঘটেছিল, এর জন্যে নীলু কতটা দায়ী বা কতটা দায়ী নয়, তাও আমি জানি না। কিন্তু যা ঘটেছিল, তার আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত নীলুর ভূমিকাই ছিল মুখ্য।
ক্রিসমাসের দিন চার—পাঁচ ছুটির মুখে নীলু এসে বলল, ‘চল কাছাকাছি একটা জায়গা থেকে ঘুরে আসি।’ মিহির আর শরৎ ভাবছিল, শীতের দিনে হরিহরদের গালুডি থেকে বেড়িয়ে আসবে। শরৎ বলল, ‘কাছাকাছি জায়গাটা কোথায়?’ নীলু বলল, ‘ভেরি নীয়ার। সীতারামপুর থেকে মাত্র কয়েকটা স্টেশন।’ আমি বললাম, ‘সেখানে কী আছে?’ নীলু বলল, ‘সাঙ্ঘাতিক লোনলি; এন্তার ফাঁকা মাঠ, শীতের ঠান্ডায়, হিমে জমে বরফ হয়ে থাকে! ফার্স্ট ক্লাস মুরগি…আর শুনেছি, টেরিফিক চমচম পাওয়া যায়। শরৎ ফাঁকা মাঠের ভক্ত, কাব্যে তার মতি আছে। মিহির মুরগি রাঁধে চমৎকার। কিন্তু এসব কথা নয়, দু—চার দিনের জন্যে শীতের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে আসায়, আমরা সকলেই উৎসাহী ছিলাম। অতএব যথাসময়ে যাত্রা করা গেল।
রেলের টাইমটেবিলে এই স্টেশনের নামটি আছে কিনা আমি জানি না। হয়তো আছে, কিন্তু তার নাম আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমরা ট্রেন থেকে নেমেছিলুম সন্ধের পর। ফাঁকা স্টেশনে দু—একটা বাতি টিমটিম করে জ্বললেও হালকা জ্যোৎস্না। এবং ঘন কুয়াশার মধ্যে স্টেশনের সাইনবোর্ড আমাদের চোখে পড়েনি। জায়গাটি আশ্চর্যরকম নিরিবিলি, মনে হয় যেন জগৎ—সংসারের স্থূল স্পর্শ থেকে একপ্রান্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। ছায়ার মতো একটি দুটি রেল কোয়ার্টার, টিলার মতো উঁচু জায়গায় ছোটো স্টেশন ঘর, বাইরে দু—চারটে খাপরা ছাওয়া দোকান, টিমটিমে লণ্ঠনের আলো। গাড়ি—ঘোড়ার কোনো চিহ্ন কোথাও ছিল না। নিজেদের বিছানা, সুটকেশ নিজেরাই বয়ে প্রায় সিকি মাইলটাক পথ এগিয়ে আমরা যে বাড়িটায় ঢুকলাম, সে বাড়িতে মানুষ ছিল। মোটামুটি আমাদের পক্ষে চলনসই বাড়ি। মাথার ওপর টালি, মাঝারি মাপের একখানি ঘর, সামনে বারান্দা, অল্প উঠোন; বাড়ির বাইরে কুয়াতলা। যে মানুষটি আমাদের অভ্যর্থনা করল তার বয়স হয়েছে, এ বাড়িরই রক্ষক, অর্থাৎ মালি বলা যায়। বাড়ির ব্যবস্থা নীলুই করেছিল আগে।
নীলু জনতা স্টোভ ধরিয়ে চায়ের জল চড়িয়ে দিল। ঘরটা মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল, গোটা দুই পুরোনো তক্তপোশ, তক্তপোশ জুড়ে আমাদের বিছানা পাতা হয়ে গেল। মোম আর লণ্ঠনের আলোয় হাতমুখ ধুয়ে আমরা যখন কম্বল পায়ে চাপিয়ে বসলাম, তখন মোটামুটি আরামই লাগছিল। চা আর সিগারেট খেতে খেতে শরৎ বলল, ‘রিয়েলি ইট ইজ উইন্টার।’ মিহির বলল, ‘মস্ত ভুল হয়ে গেল, একটা হুইস্কি আনা উচিত ছিল।’ আমি বললাম, ‘কম্বলে শীত কাটলে হয়।’ নীলু চায়ের পর টিফিন কেরিয়ারে বয়ে আনা খাবারগুলো একে একে গরম করে নিল। তারপর গল্পগুজবে আরও খানিকটা রাত হলে আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। বাইরের বারান্দায় বালতি ভরা জল ছিল, মুখ ধুতে গিয়ে মিহির যখন কুলকুচো করছে আর শরৎ তার হাতের টর্চের আলোটা এপাশ ওপাশ দোলাচ্ছে, তখনই হঠাৎ তার নজরে পড়ল বারান্দার এক কোণে একটা টিনের সাইনবোর্ড। টর্চের আলোটা সাইনবোর্ডে পড়তেই শরৎ তার হাত আর নড়াতে পারল না। একইভাবে আলো ফেলে রেখে হঠাৎ সে বলল, ‘আরে!’
তার ‘আরে’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ভালো করে তাকালাম, তাকিয়ে দেখি সাইনবোর্ডে একটি মেয়ের মুখ। স্পষ্ট করে তার চোখ মুখ দেখা যাচ্ছিল না। না দেখা যাবার কারণ রঙের বিবর্ণতা ততটা নয়, যতটা মেয়েটির মুখের ভঙ্গির জন্যে। মুখটা একপাশে হেলানো, একটিমাত্র চোখ নাক এবং এলানো চুলের গুচ্ছ চোখে পড়ছিল। একপাশে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘অমলা স্টোর্স’। সাইনবোর্ডটা দেখতে দেখতে আমি বললাম, ‘আশ্চর্য!’
নীলু ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, মিহিরের মুখ ধোওয়া শেষ। মিহির বলল, ‘কী আশ্চর্য?’ আমি বললাম, ‘ওদিকে দেখ।’
মিহির সাইনবোর্ডটার দিকে তাকাল, শরৎ তখনও সমানে টর্চের আলো সেদিকপানে ধরে রেখেছে। মিহির কেমন যেন চমকে উঠে বলল, ‘মাই গড!’
নীলু আমাদের ঘাড়ের পাশে এসে গিয়েছিল, বলল, ‘কী রে?’ বলে সে নিজেই সাইনবোর্ডটার দিকে তাকাল। তাকিয়ে আছে তো আছেই। আচমকা সে বলল, ‘স্ট্রেঞ্জ!’
এই যে আমরা চার বন্ধু অমলা স্টোর্সের সাইনবোর্ডের আঁকা অর্ধবিবর্ণ মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে যে যার মতো অবাক আর বিহ্বল হয়ে গেলাম, তার নিশ্চয় কোনো কারণ ছিল। কিন্তু কারণটা কী তখন বোধহয় কেউই স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারছিলাম না। কেন যেন আমরা খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে মুখ ধুয়ে নিলাম।
মিহির বলল, ‘সেই বুড়োটা কোথায় গেল?’
নীলু বলল, ‘ওর বাড়িতে গিয়েছে। কাছেই বাড়ি।’
আমরা হাত—মুখ মুছতে মুছতে ঘরে চলে এলাম। শরৎ দরজা বন্ধ করে দিল।
মিহির বিছানার ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে দিল। আমরা চার বন্ধু পর পর সিগারেট ধরিয়ে নিলাম।
সিগারেটে মস্ত টান দিয়ে শরৎ শেষে বলল, ‘এখানে ওই সাইনবোর্ড কী করে এল?’
নীলু বলল, ‘মানে? নিশ্চয় কেউ এনে রেখেছে!’
শরৎ বলল, ‘এরকম ঘটনা আমি জীবনে দেখিনি। অবাক কাণ্ড মাইরি।’
মিহির বলল, ‘আমিও থ মেরে গিয়েছি।’
আমি বললাম, ‘কি করে এমন হয়, আমার মাথায় ঢুকছে না।’
নীলু মুঠো পাকিয়ে সিগারেট টানছিল, ছাদের দিকে মাথা তুলে বিড়বিড় করে বলল, ‘এ শালা যেন ভূতের কারবার।’
আমরা চারজনেই অবাক হয়ে গিয়েছি অমলা স্টোর্সের বিজ্ঞাপনের মেয়েটিকে দেখে, কিন্তু কেন হয়েছি তা আরও কিছুক্ষণ কেউ প্রকাশ করতে পারলাম না।
তক্তপোশের ওপর ঢালাও জোড়া বিছানায় চার বন্ধু চুপচাপ বসে প্রথম সিগারেটটা শেষ করে ফেললাম। ঘরের মধ্যে এক কোণে লণ্ঠনটা জ্বলছে মিটমিট করে। ঘরের মধ্যেই শীত এত প্রবল যে বাইরে বোধহয় পশু—পাখিও নেই। কোথাও কোনো শব্দ আমরা শুনছিলাম না। একটা কুকুর পর্যন্ত কোথাও ডাকছে না।
শরৎ তার কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সাধুবাবার মতন করে বসল। বলল, ‘ভাই, ওই যে বাইরে অমলা স্টোর্সের সাইনবোর্ডে মেয়েটার মুখ দেখলাম ওই মুখ আমি আগে দেখেছি। এগজ্যাক্টলি দ্যাট ফেস।’
মিহির বলল, ‘আরে, ওই মেয়ের মুখ আমারও চেনা।’
আমি আর নীলু একই কথা বললাম।
আমরা চার বন্ধু একই মেয়েকে চিনি এটা কিছু অসম্ভব নয়। এরকম পাঁচ—সাত জনের নাম করে দেওয়া যায়, যেমন কলেজে নীলিমাকে, যদিও নীলিমা আমার আর শরতের সঙ্গে পড়লেও মিহিরদের সঙ্গে পড়ত না। মিহির আর নীলু আলাদা কলেজে পড়ত। আমাদের কলেজে আড্ডা মারতে এসে নীলিমাকে দেখেছে। ইউনিভার্সিটিতে হাসির বেলায়ও সেইরকম। সে মিহিরদের হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ছিল, কিন্তু আমরা তাকে দেখেছি। নিরুপমা বউদি, মিহিরদের পাড়ার সেই স্কুল—টিচার আভা মৈত্র—এইরকম কত মেয়ে আছে যারা আমাদের পরিচিত। কিন্তু সে পরিচয় সমষ্টিগতভাবে, একক নয়। অমলা স্টোর্সের মেয়েটির বেলায় আমাদের তেমন কোনো ঘটনা মনে পড়ছিল না। মেয়েটিকে আমরা যেন চিনি—কিন্তু একা একা, কোনোদিন একসঙ্গে দুজনেও তাকে দেখিনি।
নীলু শরৎকে বলল, ‘তুই ওকে কোথায় দেখেছিস?’
শরৎ বলল, ‘ভাই, আমি চুঁচড়োয় একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম, বেশি দিনের কথা নয়, গত বর্ষায়, বোধ হয় শ্রাবণ মাসে। আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রী। সেখানে প্রথম মেয়েটিকে দেখি। কন্যাপক্ষের মেয়ে, মানে পাত্রীর দিদি, বোধ হয় মাসতুতো দিদি—টিদি হবে। সত্যি বলতে কী, বিয়েবাড়িতে যত মেয়ে ছিল তার মধ্যে এই মেয়েটি নজর টানে সবার আগে। কেন নজর টানে, সেকথা আমায় জিজ্ঞেস কোরো না। আমি তোমাদের বোঝাতে পারব না। ওর অসম্ভব একটা চার্ম ছিল। লম্বা, শ্যামলা, ছিপছিপে চেহারা, শ্যামলা রং যে অত সুন্দর দেখায় আমি জীবনে দেখিনি। শরীরের গড়ন নিখুঁত, যেমন চোখ—মুখ তেমনি হাত—পা। স্পেশালি চোখ, লোকে বলে পাখির পালকের মতন টানা—টানা চোখ নাকি হয়, আমি সেই প্রথম দেখলাম, সত্যিই পাখির পালকের মতন চোখ, মণি দুটো কালো কুচকুচ করছে, দাঁত কী অদ্ভুত সাদা আর ঝকঝকে। একটাই শুধু অবাক কাণ্ড, বিয়েবাড়িতে মেয়েটি তার মাথার চুল একেবারেই এলো রেখেছিল, খোঁপা নয়, বিনুনি নয়, একটা রিবন পর্যন্ত তার মাথায় ছিল না। এমন চমৎকার চুল মেয়েদের দেখাও যায় না আজকাল। যেমন ঘন, তেমনি কালো, সামান্য কোঁকড়ানো, আর কম করে কোমর ছাড়ানো চুল। আমাদের ধারণা হয়েছিল, মেয়েটি তার মাথার চুল দেখাবার জন্যে এইভাবে রয়েছে। বিয়েবাড়িতে মেয়েরা অন্য পাঁচ ভাবে মাথার চুল দেখায়, কিন্তু এভাবে নয়। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলিও করেছি। মেয়েদের বাড়ির তরফেও কেউ কেউ দেখলাম, একই কারণে অখুশি। কিন্তু আমাদের খুঁতখুঁতুনিতে কী আসে যায়। মেয়েটির চুলও তার চার্ম। বলতে নেই, আমি এমনই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে বিয়ে—ফিয়ে ভুলে সারাক্ষণ ওকে দেখেছি, যতক্ষণ পেরেছি। আলাপের চেষ্টা করার একটা সুযোগও জুটেছিল। দু—চারটে কথা বলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেছি, মেয়েটি শুধু হেসেছে। আমি শালা, টু টেল ইউ ফ্র্যাংকলি, প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে এমন করে নাড়া দিয়েছিল মেয়েটি কী বলব।… পরের দিন আবার কলকাতা থেকে ছুটলাম, নিজে যেচেই বলতে পারিস, বর—বউ আনতে চুঁচড়োয়। গিয়ে দেখি—মেয়েটি নেই, ভোরবেলায় তার বাড়ি ফিরে গেছে। মন—টন খারাপ হয়ে গেল, যাঃ শালা, যেজন্যে যাওয়া সেটাই বরবাদ। তারপর আমি মেয়েটি সম্পর্কে অনেক খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেছি। শুনেছি, ওরা বর্ধমানের লোক। এর বেশি কোনো খবর পাইনি। আমার ভাই এবং ভাইয়ের বউ আমায় আর কিছু বলতে পারেনি বা বলেনি। আজ এতদিন পরে একেবারে অবিকল সেই মেয়েটির মুখ আমি ওই ছবির মধ্যে দেখলাম। হয়তো চোখের ভুল। কাল সকালে একবার দেখব। তবে, আমি ও মুখ ভুলে যাব, এমন আমার মনে হয় না। এখানে কী করে, কার হাতে ওই মুখের ছবি ফুটে উঠল বুঝতে পারছি না। দোকানের সাইনবোর্ডে অমন সুন্দর মেয়ের মুখ কেউ আঁকে নাকি? ছি ছি।’
শরৎ যখন কথা বলছিল, মিহির খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, সে যেন কিছু প্রতিবাদ করে বলতে চায়। শরৎ তার কথা শেষ করা মাত্র মিহির ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তা কী করে হবে? আমি যে ওকে নিজের চোখে চোরবাগানে দেখেছি।’
‘চোরবাগানে?’ আমি শুধোলাম।
‘আলবাৎ চোরবাগানে। চোরবাগানে আমার মেজদিরা থাকে। মানে মেজদির শ্বশুরবাড়ি চোরবাগানে। ভাই—সে এক কাহিনি। আমার মেজদির এক ভাসুর বরাবরই পাগলা গোছের, মাথায় ছিট—ফিট আছে। কিন্তু খুব পণ্ডিত লোক। এনশেন্ট হিস্ট্রির নামকরা ছাত্র ছিলেন এককালে, কলেজে পড়িয়েছেনও কিছুকাল। খ্যাপা টাইপের লোক, চাকরি—বাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। বিয়ে—থা করেননি। আমরা তাঁকে বিলাসদা বলেই ডাকতাম। নাম ছিল বিলাস। একদিন এক কাণ্ড হল। আমাদের বাড়িতে খবর এল, বিলাসদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিলাসদা বাচ্চা নন, ছেলেমানুষ নন, পলিটিক্যাল পার্টির লোক নন যে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাবা বললে, একবার মেজদির বাড়ি যা, গিয়ে দেখ কী ব্যাপার। মেজদির চোরবাগানের বাড়িতে গিয়ে দেখি, একটা হুলুস্থূলু কাণ্ড চলছে। বিলাসদা দিন দুয়েক আগে দুপুরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ওরকম তো রোজ যান—কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। রাত পর্যন্ত বিলাসদা ফিরছেন না দেখে বাড়ির লোক বেশ চিন্তিত হয়ে ওঠে। খোঁজখবর নিতে শুরু করে। খ্যাপা লোক, কোথায় গেছেন কী করছেন বোঝাও মুশকিল। সে—রাতটা কাটার পর সকাল থেকে ছুটোছুটি লেগে গেল। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, বন্ধুবান্ধবের ডেরা, হাসপাতাল, পুলিশ—কোথাও কোনো ট্রেস নেই। লোকটা তবে গেল কোথায়? কলকাতা ছেড়ে বিলাসদা পালিয়ে গেলেন নাকি? কোথায় গেলেন? এইরকম একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় আমি মেজদির বাড়ি গিয়েছিলাম সকালে। যাওয়াই সার, কোনো কাজে এলাম না। মেজদি বলল, তুই বিকেলে একবার আসিস। আবার বিকেলে গেলাম, গিয়ে দেখি বাড়িতে কান্নার রোল উঠেছে। বিলাসদার রাস্তার মধ্যে সেরিব্র্যাল অ্যাটাক হয়। রাস্তাতেই পড়ে যান। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর, এমারজেন্সির বাইরে ফেলে রাখা হয়েছিল। পরে বেডে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো একটা দিন কমপ্লিট অজ্ঞান ছিলেন, তারপর মারা যান। বিলাসদার কাছে এমন কিছু ছিল না—তাঁকে ট্রেস করা যায়। অনেক কাঠ—খড় পুড়িয়ে ট্রেস করা গেল যখন, তখন শুনলাম মর্গ থেকে ডেডবডি আনতে হবে। সেই বডি আনতে লোক গেছে।… বুঝতেই পারো, আমি কী অবস্থায় পড়েছি তখন। বিলাসদা মারা যাবার খবর পেয়ে বাড়িতে অনেক লোক এসে গেছে, আসছে একে একে, তার মধ্যে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছাড়াও বিলাসদার পুরোনো ছাত্রছাত্রীরাও ছিল। কান্নাকাটি, কেউ খাট আনছে, কারা যেন ঝুড়ি ঝুড়ি ফুল কিনে আনল। ঠিক এই সময় আমি একটি মেয়েকে দেখলাম। মেয়ে দেখার অভ্যেস আমার চিরকালের। কিন্তু ভাই, সত্যি বলছি, এরকম মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। আশ্চর্য দেখতে, তার পুরো চেহারার মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যা বুঝিয়ে বলা যায় না। ছিপছিপে চেহারা, মাথায় লম্বা চুল, সুন্দর কোমর, ঘাড়—পিঠে নিখুঁত। মুখখানিও ভারি মিষ্টি, মোলায়েম, অথচ অভিজাত। সাদা খোলের একটা শাড়ি, কালো পাড়, গায়ের জামাও সাদা। মাথার চুল একেবারে এলো। বিষণ্ণ, শান্ত, উদাস চোখ মেলে সে বারকয়েক বারান্দায় আর বাইরে এল গেল। আমি যতক্ষণ পারি তাকে দেখতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল, ও যেন চোখের আড়ালে না যায়। বাড়িতে এত লোকজন যে কে কার আত্মীয়, কার কী পরিচয়, ওই দুঃখের অবস্থায় কাউকে জিজ্ঞেস করার কথা নয়। তবু আমি একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল, জানি না। আমি গিয়েছি বিলাসদার শ্মশানযাত্রায় শোকযাত্রী হতে, অথচ একটি মেয়েকে দেখে সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে তাকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম। বিলাসদার দেহ এল। বাড়িতে নামানো হল। কান্নাকাটি, ফুল, অগুরু—কত কী হল—আমি শুধু মেয়েটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আর দেখছি। তারপর যখন বিলাসদাকে নিয়ে আমরা বেরোচ্ছি সন্ধেবেলা, হরিবোল শুরু হয়েছে, মুখ ফিরিয়ে দেখি—সেই মেয়েটি। নিবিড়, বিষণ্ণ, উদাস চোখে চেয়ে আছে। শোক আর বেদনায় সেই সন্ধ্যাটি যেন তার মুখশ্রীতে নিবিড় হয়ে থাকল।…তারপর আর তাকে দেখিনি। এতকার পরে আজ এখানে আবার তার ছবি দেখলাম। আমি জানি না, আমার কোনো ভুল হচ্ছে কিনা—তবে সেই মেয়েটিকে আমার ভোলার কথা নয়। অমলা স্টোর্সের সাইনবোর্ডের ছবিটা আর ওই মেয়ের মুখ হুবহু এক।…আমি বুঝতে পারছি না, কেমন করে এটা হল? তা ছাড়া ওই মুখ অমলা স্টোর্সের সাইনবোর্ডেই বা এল কী করে? কে আঁকল? বলতে বলতে মিহির চুপ করে গেল।
মিহিরের কথা ফুরোলে আমরা চুপচাপ। নীলু নতুন একটা সিগারেটের প্যাকেট খুলল। আমরা চারজনে সিগারেট ধরালাম। শীত যেন হাত—পা গায়ে বসে যাচ্ছে। কপাল ব্যথা করছিল।
আমি বললাম, ‘অমলা স্টোর্সের ওই মেয়েটির মুখ দেখে আমার একজনের কথা মনে পড়ছে। তার নাম অমলা কিংবা কমলাও হতে পারে—ঠিক বলতে পারব না। পারব না, কেননা তাকে যারা ডাকছিল, তারা আমার থেকে এতটা তফাতে ছিল যে আমি নামটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম না। ব্যাপারটা বেশিদিন আগে ঘটেনি। এবার পুজোর সময় মা আর মাসিমা তীর্থ করতে, বা বলো বেড়াতে, ওই স্পেশাল গাড়িতে যাচ্ছিল। টাকাপয়সা জমা দিয়ে যথারীতি সিট বুক হয়েছে। যাত্রার দিন আমি গেছি হাওড়া স্টেশনে মা আর মাসিমাকে তুলে দিতে। সে ভাই এক এলাহি কাণ্ড। মানুষে এত বেড়ায় আমার জানা ছিল না। বুড়ো—বুড়ি, বউ, বিধবা, যুবতী কোনোদিকেই কমতি নেই। যারা যাবে—তারা তো যাবেই—যারা যাচ্ছে, তাদের আত্মীয়স্বজনে প্ল্যাটফর্মটা গিজগিজ করছে। মা আর মাসিমাকে তুলে দিয়ে আমি নীচে নেমে একটু হাওয়া খাচ্ছি, দেখি ওই মেয়ে। সংসারের এক—একটা ঘটনা ঘটে ঠিক যেন বজ্রপাত, কখন ঘটে গেল, কী করে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল, স্তম্ভিত হলাম—বোঝাই যায় না। এটাও ঠিক তেমনি। একেবারে আচমকা দেখলাম সেই মেয়েটি আর দুজনের সঙ্গে বিছানাপত্র, সুটকেশ, এনে গাড়িতে চড়ছে। অসামান্য চেহারা ভাই। যাকে আমরা ডানাকাটা পরি, উর্বশী বা ওইরকম কিছু বলি, মোটেও তা নয়। একেবারে অন্যরকম, দেখামাত্র চোখে যেন বিদ্যুতের ঝিলিক লেগে যায়। এমন সুশ্রী, সংযত, শালীন চেহারা। ভগবান মেয়েটিকে কোথাও যেন চড়া রঙে আঁকতে চাননি, একেবারে নরম তুলিতে নরম রঙে। নিখুঁত গড়ন, কোথাও কোনো অমিল নেই, অসংগতি নেই। যেমন হাত—পা, তেমনি কোমর, বুক, গলা। মুখটি যেন শরতে ফুটে ওঠা জ্যোৎস্নার মতন, এমন মসৃণ, স্নিগ্ধ, চোখ জুড়োনো। আমি হাঁ করে মেয়েটিকে দেখতে লাগলাম। সে গাড়িতে উঠল, তার জায়গা খুঁজে নিল, জিনিসপত্র রাখল, তার দুই সঙ্গিনী তাকে অমলা কিংবা কমলা বলে ডেকে ডেকে কথা বলতে লাগল। আর হু—হু করে সময় বয়ে যেতে লাগল। আমি তখন চোখে কী দেখছি আর দেখছি না খেয়াল নেই, বুকের মধ্যে কীসের একটা তোলপাড় চলছে, মাথা ঝিমঝিম করছিল। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, মেয়েটির চুল ছিল এলানো। কেন, কীজন্যে আমি জানি না। এই চুলের জন্যে তাকে কেমন একটা যোগিনী—যোগিনী দেখাচ্ছিল, সাম সর্ট অফ রিলিজিয়াস পিউরিটি ওয়াজ দেয়াল।…তারপর গাড়িটা কখন ছেড়ে দিল। দেখলাম, সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হাসছে, আস্তে আস্তে হাত নাড়ল। আমিও একবার হাত নেড়ে দিলাম। গাড়ি ওকে নিয়ে চলে গেল। আমি বেহুঁশ হয়ে বাড়ি ফিরলাম।…সত্যি ভাই, কোনোদিন ভাবিনি—আর ওকে দেখব। কিন্তু আজ হল কী? এই একটা পাণ্ডববর্জিত জায়গায়—এইরকম একটা বাড়িতে কোথাকার একটা দোকানের সাইনবোর্ডে তারই অবিকল মুখ দেখলাম। আশ্চর্য! আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। তবু অবিশ্বাস করতে পারছি না।’ আমি আমার কথা শেষ করলাম।
এবার নীলুর পালা। আমরা চারজনেই মাথা গায়ে কম্বল জড়িয়ে আছি। কনকন করছে ঠান্ডা। বিছানাটা এলোমেলো হয়ে গেছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘর ভরা! লণ্ঠনের আলোটাকে কুয়াশার আড়াল দেওয়া আলোর মতন দেখাচ্ছে।
নীলু বলল, ‘আমি ভাই মেয়েটিকে দেখেছি একেবারে অন্যভাবে। একদিন দুপুরবেলায় অফিসে আমার এক বন্ধুর ফোন পেলাম। বলল, শিগগির আয়, আমার খুব বিপদ। ফোন পেয়ে ভবানীপুর ছুটলাম। গিয়ে দেখি পুষ্প—আমার বন্ধুর নাম পুষ্প—পাগলের মতন মাথা খুঁড়ছে। লোকজন জমে গেছে চারপাশে। পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স। পুষ্পর বউ বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ব্যাপারটা বুঝে দেখ, কোথা থেকে কী! সুইসাইড কেস, কাজেই পুষ্পর বউকে পোস্টমর্টেমের জন্যে নিয়ে চলে গেল, আর পুলিশরা পড়ল পুষ্পকে নিয়ে।…পরের দিন বিকেলে আমরা পুষ্পর স্ত্রীর ডেডবডি পেলাম। হিন্দু মহাসভার গাড়ি করে নিয়ে গেলাম কেওড়াতলা। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। আমাদের পর আরেকটা ডেডবডি এল। খাটে শোওয়ানো, মুখ খোলা, ফুল—টুল সামান্য রয়েছে। কী বলব ভাই, এমন মেয়ে আমি দেখিনি। মনেই হয় না—সে মারা গেছে। যেন চোখ বুজে ঘুমিয়ে আছে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মজার কোনো স্বপ্ন দেখছে। ঠিক ফুলের মতন মুখ, কী অপরূপ চোখ, ঠোঁট, নাক। মাথার চুলগুলো কাঁধের দু—পাশে ছড়ানো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। ভুল করে জ্যান্ত লোককে পোড়াতে আনেনি তো? কিন্তু তাই কি হয়? পুষ্পর বউকে ততক্ষণে চুল্লিতে নিয়ে যাচ্ছে, পুষ্প হাউমাউ করে কাঁদছিল।…আমি শুধু মেয়েটিকে দেখছি। দেখছি আর ভাবছি, ও কি সত্যিই মৃত না জীবিত? জীবিত না মৃত? ভাবতে ভাবতে দেখি, মেয়েটি যেন তার ঠোঁটের কোণে পাতলা একটু হাসল। কেন হাসল, বুঝতে পারার আগেই চুল্লিতে তার ডাক পড়ল। হ্যাঁ—আমি তো তাই বলব, চুল্লিতে তার ডাক পড়ল।…অমন একটা মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার আগে আমি শ্মশান ছেড়ে পালিয়ে এলাম।…জীবনে আমরা কত মুখ ভুলে যাই, কোনো কোনো মুখ আমৃত্যু ভুলি না। এই মুখ হল সেই মুখ, আমি ভুলিনি, ভুলতে পারিনি।…কিন্তু অবাক হয়ে ভাবছি, সেই মুখ এখানে এল কী করে? স্ট্রেঞ্জ!’
নীলু চুপ করল।
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, বিয়েবাড়িতে যে মুখের দেখা শরৎ পেয়েছিল, সেই মুখ কোথা দিয়ে কোথায় এসে শেষ হল। হায়, হায়।
আমরা বসেই থাকলাম, চুপচাপ, চার বন্ধু, মাথা—গা কম্বলে জড়িয়ে লণ্ঠনটা টিমটিম করে জ্বলতে লাগল।
হঠাৎ শরৎ বলল, ‘বাইরে বড়ো শীত, আমার কেন যেন ইচ্ছে করছে—অমলাকে ঘরে এনে রাখি।’
‘মানে, ওই অমলা স্টোর্সের সাইনবোর্ডটাকে?’
শরৎ মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। তবে সাইনবোর্ড—ফোর্ড বোলো না। ও অমলা।’
নীলু বলল, ‘আনলেই হয়। এমন কি কঠিন কাজ?’
আমরা চার বন্ধু টর্চ আর লণ্ঠন নিয়ে দরজা খুলে অমলাকে আনতে গেলাম বারান্দায়।
সমস্ত চরাচর জুড়ে জ্যোৎস্না নেমেছে, কী গভীর কুয়াশা, হিম ঝরছে নিঃশব্দ বৃষ্টির মতন।
শরৎ টর্চ ফেলল। ফেলেই বলল, ‘আরে!’
আমরা বারান্দার শেষপ্রান্তের দিকে তাকালাম।
অমলা স্টোর্সের সাইনবোর্ডটা কোথাও নেই।