অমর বাঙালি
পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। সামনে সিঁথি। তেল-চুকচুকে জামাই-জামাই চেহারা। বকবক করে বকতে ভালোবাসে। বেশির ভাগ কথাই বোকা-বোকা। একটা হামবড়াই ভাব। স্বজাতির নিন্দায় পটু। অন্যের ভালো দেখলে নিজের আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। বিপদে পড়লে ভাই ভাই, বিপদ কেটে গেলে, তুমি কে ভাই। বাঙালিকে খুব সহজেই চেনা যায়। বাঙালির চোখেমুখে একটা ভেতো আলস্যের ভাব লেগে থাকে। সর্দিপ্রবণ। পেটপাতলা, মুখ হালসা, স্ত্রীর ন্যাওটা, এক কথায় বাঙালিকে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। ওগো হ্যাঁগো, শুনছ, থেকে থেকে ছেলেকে শাসন, ছেলের ডাকনামে অবশ্যই একটা বৈশিষ্ট্য থাকবে, যেমন, ডাম্বেল, বারবেল, কিমা, বাপ্পা, ভোম্বা, লেংটি, বুড়ো, টোকোন, ছোকন, লক্কা, নটে, নটাই। যাবতীয় অদ্ভুত শব্দে পুত্র কন্যাকে ডেকে বাঙালির স্বর্গীয় আনন্দ। প্রকাশ্য স্থানে, রাস্তায়, দোকানে, স্টেশানে, ট্রেনের কামরায়, বিয়ে বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে এই ভাব, এই ধুম ঝগড়া, বাঙালির খোকা প্রকৃতির বিশিষ্ট পরিচয়। বেগ আর আবেগ দুটোই প্রবল। প্রকাশ্য স্থানে প্রাকৃতিক কর্মে লজ্জা নেই, লজ্জা নেই পরিবারের সঙ্গে চুলোচুলি অথবা সোহাগে।
কিন্তু! এর মধ্যে একটা বড় কিন্তু আছে। বাঙালির মন। তার একটা তুলনাহীন বৈশিষ্ট্য আছে। বাঙালি বাইরে নেই। সে বাঙালির মৃত্যু হয়েছে। বাঙালি আছে ভেতরে। মনে বাঙালি, বিশ্বাসে, সংস্কারে বাঙালি।
পোশাকে-আশাকে, ভাষায়, আচরণে বাঙালি নিজেকে প্রকাশ করতে লজ্জা পায়; কারণ, বাঙালি আজ সব চেয়ে ঘৃণিত জাতি। যত মোম্বাই নিজের টেরিটারিতে। সীমানার বাইরে আর কোনও ইজ্জত নেই—ভাগ শালা বাঙালি। অনেক স্টেটে হাতি-খেদার মতো বাঙালি-খেদা আন্দোলন শুরু হয়েছে। এর অনেক কারণ আছে। বাঙালি অনুরকরণপ্রিয়, কর্তাভজা ক্লাসের প্রাণি। ইংরেজরা এই ‘ল্যাকি’দের ভালোই কাজে লাগিয়েছিল। নে, বুটের ফিতে বাঁধ, আর সেরোস্তায় বোস, মুৎসুদ্দি, বেনিয়ান, হুঁকাবরদার, মোসায়েব, চামচা, টিকটিকি, সব বাঙালি। একটু নেকনজর, সামান্য মহাপ্রসাদ, অল্প-স্বল্প খেতাব, প্রমোশান, বাঙালির সে কী নৃত্য। দত্ত হয়ে গেল দুতা বা ডুটা, মিত্র হয়ে গেল মিটার, বোস হয়ে গেল ভোঁস, দাস হয়ে ডস। হরি হয়ে গেল হ্যারি। শিক্ষিত বাঙালির ধারণাই হল, বাঙালি অতি নিকৃষ্ট জাতি। বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়াটা পাপ। ভাষা ভোলো, জাত ভোলো, আচার-আচরণ ভোলো। সাহেব হয়ে যাও। বাঙালিকে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বহু ভাবে, বহুদিক থেকে নিরীক্ষণ করেছিলেন। বলেছেন—’পিলে রোগী দেখেছি, কালাপেড়ে কাপড় পরেছে, অমনি নিধুবাবুর টপ্পা গাইছে। কেউ বুট পরেছে অমনি মুখে ইংরাজি কথা বেরুচ্ছে’। আর একটু বিস্তারিত বলছেন—’এক-একটি উপাধি হয়, আর জীবের স্বভাব বদলে যায়। যে কালাপেড়ে কাপড় পরে আছে, অমনি দেখবে, তার ‘নিধুর টপ্পার’ তান এসে জোটে, আর তাস খেলা, বেড়াতে যাওয়ার সময় হাতে ছড়ি এইসব এসে জোটে। রোগা লোকও যদি বুট জুতা পরে সে অমনি শিস দিতে আরম্ভ করে, সিঁড়ি উঠবার সময় সাহেবদের মতো লাফিয়ে উঠতে থাকে।’ এই উপাধিই হয়েছিল বাঙালির মহাকাল। সায়েবেদের সঙ্গে স্কন্ধ ঘর্ষণ। ইংরেজিটা চটজলদি শিখে ফেলা। শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তিতে—হ্যাট, গ্যাট, ম্যাট। তোষামোদ। চাটুকারিতা। কেউ হলেন রায়বাহাদুর, কেউ হলেন দেওয়ান, কেউ হলেন নাইট। বাঙালির কানে এল—হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টু ডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টু-মরো। বাঙালির লাঙুল স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত ফুলে একেবারে চামরের মতো হয়ে রইল। বাঙালিই হল সব। যেমন, লিকার, তেমনি ফ্লেভার। বাঙালির মেধা, বাঙালির জ্ঞান, বাঙালির শিল্প, বাঙালির ব্যাবসা, বাঙালির বক্তৃতা, সংস্কৃতি, স্বদেশ-চেতনা, অ্যাডমিনস্ট্রেশন, একেবারে মার কাটারি ব্যাপার। শিক্ষিত বাঙালি, এক নম্বর মাল। সে কী অহঙ্কার। সে কী দুর্ব্যবহার! মানুষকে মানুষ বলেই মনে করে না। এক বাঙালি আর-এক বাঙালিকে সহ্য করতে পারে না। আমি। আমিই সব। দ্বিজেন্দ্রলাল হালচাল দেখে মারলেন খোঁচা—’আমরা বিলাত ফের্তা ক’ভাই / আমরা সাহেব সেজেছি সবাই / তাই কি করি নাচার, স্বদেশী আচার / করিয়াছি সব জবাই / আমরা বাংলা গিয়েছি ভুলি / আমরা শিখেছি বিলিতি বুলি / আমরা চাকরকে ডাকি ‘বেয়ারা’ —আর / মুটেদের ডাকি ‘কুলি / রাম, কালীচরণ, হরিচরণ / নাম, এসব সেকেলে ধরন / তাই নিজেদের সব ডে রে ও মিটার /করিয়াছি নামকরণ।’
সেই বাঙালি সায়েবরা চলে যাওয়ার পর হয়ে গেল মুরুব্বিহারা অসহায়। জীবনের সর্বক্ষেত্রে চাঁট খেতে খেতে, সরতে সরতে এখন ‘কুমড়োকাটা বঠঠাকুর।’ সে কী? শ্রীরামকৃষ্ণের দিকে হাত বাড়াই। রসিকপ্রবরের ঝুলিতে আমাদের আত্মদর্শন ছিল। তিনি বলছেন—’এক-একজন বাড়িতে পুরুষ থাকে, —মেয়েছেলেদের নিয়ে রাতদিন থাকে আর বাহিরের ঘরে বসে ভুডুর ভুডুর করে তামাক খায়। নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকে। তবে বাড়ির ভিতরে কখনও গিয়ে কুমড়ো কেটে দেয়। মেয়েদের কুমড়ো কাটতে নাই, তাই ছেলেদের দিয়ে তারা বলে পাঠায়, বঠঠাকুরকে ডেকে আন। তিনি কুমড়োটা দুখানা করে দেয়, এই পর্যন্ত পুরুষের ব্যবহার। তাই নাম হয়েছে কুমড়োকাটা বঠঠাকুর।’
ভারতবর্ষে বাঙালি এখন কুমড়োকাটা বঠঠাকুর। অন্য প্রদেশে কোনও সম্মান নেই। ঘৃণার নাম বাঙালি, কারণ সব অর্থে অপদার্থ। নিজের রাজ্যে বাঙালির এখন দুটো ক্লাস, বক্তা আর শ্রোতা, বন্ধুগণ, বলে একবার শুরু করলে আর রক্ষা নেই। ডিঙি মেরে মেরে বক্তৃতা। সে কী ফোর্স। এদিকে পেছনের কাপড় খুলে নিয়ে গেল অন্য স্টেট। নামের প্যাড আর ভিজিটিং কার্ড ছাড়া বাঙালির কিছু রইল না। শেয়াল পণ্ডিতের কুমিরছানা দেখানোর মতো কয়েকজন মহাপুরুষকে বারেবারে দেখাতে দেখাতে আর কোনও কাজ হচ্ছে না। কোনও শ্রদ্ধাই আর পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কাজের বাঙালি, প্রতিষ্ঠিত বাঙালি, প্রাণের দায়ে অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে বহুরূপী সাজতে বাধ্য হচ্ছেন। বাঙালি বলে যেন চিনে না ফেলে, তাহলে আর করে খেতে হবে না। অপদার্থ, আত্মম্ভর, পেছনে লাগা, কুচুটে বাঙালিকে কেউ চায় না। সব অচল করে দেবে। মেরে ফাঁক করে দেবে। প্রমাণ, তার নিজের রাজ্য। কী অপূর্ব ব্যবস্থা। সব এলোমেলো। সম্পূর্ণ অচল। সম্প্রতি নতুন এক ভিরকুটি এসে জুটেছে—পদযাত্রা, মানবশৃঙ্খল, মহামিছিল আর বন্ধ। বাঙালি। তুমি কাজের কাঝ কী করো ভাই? পদযাত্রা করি। আর কী করো ভাই? ঝাণ্ডা মেরে কারখানা বন্ধ করে, নর্দমার ধারে চৌকি পেড়ে বছরের পর বছর তাস পিটি। আর কী করো ভাই? বারোয়ারি পুজো করি।
অতিশয় করুণ অবস্থা। বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলার মতো আর কিছু নেই। যা প্রায় সব জাতেরই আছে। আমি জার্মান, আমি ফরাসি, জাপানি আমি, আমি ইংরেজ। আমি কিন্তু বাঙালি নই। নিজেকে আমি লুকোবার চেষ্টা করি। কারণ বাঙালি শব্দটা এখন গালাগালি। পয়সাওয়ালা অবাঙালি শিল্পপতি বলবেন—আরে ব্যাটা বাঙালি। বাঙালি এখন সার্ভেন্ট ক্লাস। বাঙালি নিজের অবস্থা বোঝে। বাঙালি তো নির্বোধ নয়। আর বোঝে বলেই, ক্রোধ আর হতাশায় আত্মঘাতী। নিজেরাই নিজেদের কোতল করছে যদুবংশের মতো। পরস্পর পরস্পরের কাছা ধরে টানছে। কাকের মতো ঠোকরাচ্ছে। নিজেরা এগোতে পারছি না, বলে, অন্যকেও এগোতে দেব না। একটা মারকুটে নরঘাতী ভাবমূর্তি তৈরি করে সকলকে ভয় দেখাচ্ছি।
অথচ বাঙালি মন ঠিক ওই রকম নয়। বাঙালির বাঙালিয়ানা হল তার মন। বহু বছরের সংসারে তৈরি হয়েছে বাঙালি মন। ধর্মের প্রভাব পড়েছে। বৌদ্ধধর্ম, চৈতন্যধর্ম, আউল বাউল সহজিয়া। একদিকে শক্তি, আর-একদিকে বৈষ্ণব বাঙালির মনে বসে আছে। বাঙালি মনকে নাড়া দিয়ে গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির মন ও মননকে পরিচ্ছন্ন করেছেন। ইন্টেলেকচ্যুায়াল করেছেন। বাঙালির মন স্বভাবতই উদার। বাঙালি বন্ধুবৎসল, অতিথিবৎসল। খেয়ে ও খাইয়ে আনন্দ পায়। বাঙালি বুদ্ধিমানের ভাব করে, কিন্তু আসলে অতিশয় বোকা। বোকা না হলে প্রেমিক হয় না। বোকা না হলে খেয়ে আর খাইয়ে ফতুর হবে কেন? বোকা না হলে এ রাজ্যে গুরুবাদ এমন জাঁকালো হত না। মোড়ে মোড়ে জ্যোতিষীদের এত রমরম হত না। বাঙালির মনে এক ধরনের লোভ-মিশ্রিত বিশ্বাস আছে, যার ফলে বাঙালির মতো কেউ এত ঠকে না। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে—সারা ভারতে একমাত্র বাঙালিই ঠকতে আর ঠকাতে ওস্তাদ। বহুকাল আগে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বাঙালি চরিত্রের এই দিকটি ধরে ফেলেছিলেন—ডমরুধর দুর্গাপুজো করেছেন। দেবী সন্তুষ্ট হয়ে দর্শন দিয়ে বলেছেন—’বর প্রার্থনা করো।’ ডমরু বর চাইছেন—’মা! সুন্দরবনে আমার আবাদের মৃগনাভি হরিণের চাষ করিবার নিমিত্ত স্বদেশি কোম্পানি খুলিব মনে করিতেছি। ভেড়ার পালের ন্যায় বাঙ্গালার লোক যেন টাকা প্রদান করে, আমি এই বর প্রার্থনা করি।’
দেবী বলিলেন—’কৈলাস পর্বতের নিকট তুষারবৃত হিমাচলে কস্তুরী হরিণ বাস করে। সুন্দরবনে সে হরিণ জীবিত থাকিবে কেন?’ আমি বলিলাম—’যে কাজ সম্ভব, যে কাজে লাভ হইতে পারে, সে কাজে বাঙালি বড় হস্তক্ষেপ করে না। উদ্ভট বিষয়েই বাঙালি টাকা প্রদান করে।’
ত্রৈলোক্যবাবু আর এক জায়গায় লিখছেন—একটি তুখোড় বাঙালি যুবক ডমরুধরকে ব্যাবসার প্রস্তাব দিচ্ছে। তার এক হাতে এক রাশ এঁটেল মাটি আর এক হাতে চার-পাঁচখানা ধবধবে চিক্কণ কাগজ। ব্যাপারটা কী? ছেলেটি বললে—’এঁটেল মাটি হইতে আমি এই কাগজ প্রস্তুত করিয়াছি। এক টাকার এঁটেল মাটি হইতে দশ টাকার কাগজ হইবে। নয় টাকা লাভ থাকিবে।’ ডমরুধর বলছেন—’ভাবিলাম যে এ কাজ হালাগুলো বাঙালির উপযুক্ত বটে। দেশে ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল। সকলে বলিতে লাগিল যে, আর আমাদের ভাবনা নেই। যখন এঁটেল মাটি হইতে কাগজ প্রস্তুত হইবে, তখন বালি হইতে কাপড় হইবে।’
এই হল বাঙালি মন। সন্দেহপ্রবণ, যুক্তিবাদী কিন্তু উদ্ভটরসে, অবাস্তব প্রস্তাবে, অলৌকিকে বিশ্বাসী। ঠকবে, সর্বশান্ত হবে, তবু এগিয়ে যাবে। ত্রৈলোক্যনাথের ওই ছেলেটি ব্যাগ থেকে পরপর চারটি শিশি বের করল—একটা ম্যালেরিয়া জ্বরের আরক, একটা অজীর্ণ রোগের ওষুধ, একটা বহুমূত্র রোগের ব্রহ্মাস্ত্র, আর একটা মুখে মাখলে রং ফরসা হয়। বাঙালি চিরকালের ক্রেডুলাস জাত। টাকে চুল বেরোবে না জেনেও কাঁড়ি টাকা ঢালবে। ভাইটালাইজারে। কালো কখনও ফরসা হবে না জেনেও মুখে মলম ঘষবে। টাকা ডবল হয় না জেনেও জোচ্চোরের পাল্লায় পড়বে। তবু বাঙালির মধুর সত্তা, বাঙালি মনের মায়া, বাঙালি চেষ্টা করেও চাপা দিতে পারবে না। রাতবিরেতে বাঙালির বাড়িতে অতিথি এলে, গোটা পরিবার জেগে ওঠে আদর আপ্যায়ন করার জন্যে। যেকোনও সময়ে বাঙালির বাড়িতে গেলে, কিছু-না কিছু খাওয়াবার চেষ্টা হবেই। বাঙালিয়ানার একটা মস্ত বড় উপাদান হল এই আতিথেয়তা। বাঙালি অনেক সময় মানুষকে হতবাক করে দিতে পারে। সাংঘাতিক বিলিতি পোশাক, চোস্ত ইংরেজি, ঠোঁটে পাইপ, ঘ্যাম একজিকিউটিভ, চেনার উপায় নেই, বাঙালি না অবাঙালি। এটা তাঁর বাইরের রূপ। বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর একটা রূপান্তর হবে। অভাবনীয়। ধড়াচূড়া খুলে তিনি বসে পড়লেন হয়তো ঠাকুরঘরে। সম্পূর্ণ ধ্যানস্থ। অথবা বৃদ্ধ মায়ের পাশটিতে গিয়ে বসলেন বাধ্য শিশুর মতো। বৃদ্ধা হয়তো খোকার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। একটু আদরও করতে পারেন। বাঙালিয়ানার একটা বড় দিক হল, মা-বাবার চোখে বাঙালির বয়স বাড়ে না। সে চির-খোকা। আমি এমন দৃশ্যও দেখেছি, পিতার বয়স নব্বই ছেলের বয়স ষাট। পিতা তিরস্কার করছেন, ঠিক যেমনটি করতেন সন্তানের শৈশবে। বাঙালি বাইরে যে রকমই হোক, বাড়িতে সে বাঙালি। আচারে, আচরণে, কথায়, আড্ডায়। সে জজ সায়েবই হোক, কী মেজর জেনারেল। একটা ধুতি আর গেঞ্জি হবে পোশাক। পায়ে একটা চটি। এই ব্যাপারে বাঙালির আদর্শ—আশুতোষ, বিদ্যাসাগর। বাড়িতে জিন্স-পরা বাঙালিবাবু দেখতে পাওয়া কঠিন। বাঙালিয়ানার আর একটি দিক হল, জলের ব্যবহার। এমন জলপ্রীতি অন্য জাতির মধ্যে নেই। এঁটো কাঁটার বাছ-বিচার, আঁশ, নিরামিষ নিয়ে তুলকালাম একমাত্র বাঙালি পরিবারেই প্রবল। চেষ্টা করেও বাঙালি তার আদি বিশ্বাস ছাড়তে পারবে না। কারণ বিশ্বাস চলে গেছে সংস্কারে। সেই কারণেই বাঙালির দুটি দিক—তার বাইরের দিক—যে দিকে আছে বারফট্টাই, নাস্তিকতা, আমেরিকানিজম, আচার-আচরণের বাড়াবাড়ি, অসভ্যতা, অবুঝের মতো কথা, অনুকরণপ্রিয়তা। সেখানে বাঙালি হল নাচুনে বাঙালি। আর একটা দিক হল— ভেতরের দিক। শান্ত, সমাহিত, সুর ভালো লাগে, ভালো লাগে রং রেখা ছবি, ভালো লাগে কবিতা, প্রাকৃতিক দৃশ্য পাহাড়, সমুদ্র। সেখানে বাঙালি শুনতে পায় বিবেকের ঘুণপোকা কাটছে, বাঙালির শান্তি জীবন-কুটির। স্ত্রীকে নিয়ে স্বতন্ত্র ফ্ল্যাটে গিয়েও বাঙালি সন্তান রাত জাগে বিবেকের দংশনে—আমার পিতা! আমার মাতা! বাঙালিয়ানার অপর দিক হল—বাঙালি পারিবারিক জীব।