এক
জাফর সাহেব বাসায় ঢুকেই জুলায়খাকে একটা ছেলের সঙ্গে ব্যাটমিন্টন খেলতে দেখে খুব অবাক হলেন। ভাবলেন, ছেলেটা কে হতে পারে? তার আত্মীয়স্বজনরা তো এ বাসায় আসে না। আসবার মতো মুখও তাদের নেই। তা ছাড়া দারোয়ানকে কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে, যে কেউ যত ঘনিষ্ট আত্মীয়ের পরিচয় দিক না কেন, তার হুকুম ছাড়া কাউকেই বাসায় ঢুকতে দেবে না।
ড্রাইভার কড়িডোরে গাড়ি পার্ক করার পর গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ তাদের খেলা দেখলেন। দু’জনেই বেশ পটু খেলোয়াড়। নিজের মেয়ের সম্পর্কে তিনি জানেন; কিন্তু ছেলেটার পটুতা দেখে আর একবার অবাক হলেন। পা-পা। করে এগিয়ে এসে তাদের খেলা দেখতে লাগলেন। তিনি নিজেও এই খেলায় খুব পটু। সময় পেলেই মেয়ের সঙ্গে খেলেন। মেয়েকে নিজেই শিখিয়েছেন।
জাফর সাহেব একজন বড় ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক কাজে জাপান গিয়েছিলেন। পনের দিন পরে ফিরছেন। ক’টার প্লেনে ফিরছেন সে কথা ফোন করে জানিয়েছেন। স্ত্রী হামিদা বেগম সময়মতো ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে পাঠিয়েছিলেন। এখন দোতলার বারান্দার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে ওদের খেলা দেখছিলেন। গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে নিচে নেমে এসে দেখলেন, স্বামী ওদের খেলা দেখছে।
জুলায়খা ও ডালিম খেলায় মত্ত। তাই তারা জাফর সাহেবের আগমন টের পায় নি। ডালিমের লাস্ট সর্টটা জুলায়খা মারতে পারল না। কর্কটা কুড়োতে গিয়ে দেখতে পেয়ে হর্ষোফুল্ল কণ্ঠে বলল, আব্বু তুমি? কখন ফিরলে? তারপর হাতের ব্যাটটা ফেলে দিয়ে জড়িয়ে ধরল।
জাফর সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, এই তো ফিরছি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটা কে?
আমার ফ্রেন্ড। তারপর ডালিমকে বলল, এদিকে এস, আব্বুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
ডালিম এগিয়ে এসে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে জাফর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বাসা কোথায়?
ততক্ষণে হামিদা বেগম সেখানে এসে গেছেন। ডালিম কিছু বলার আগে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ওর কথা পরে শোন। ভিতরে চল, ড্রেস চেঞ্জ করে চা খাওয়ার সময় সবকিছু শুনবে। তারপর ওদেরকে বললেন, তোমরাও এস।
নাস্তা খেয়ে চা খাওয়ার সময় জাফর সাহেব ডালিমকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?
মুহাম্মদ ইউসুফ, ডাকনাম ডালিম।
ডাকনাম কী বললে?
ডালিম।
ডালিম একটা ফলের নাম। আল্লাহপাকের সৃষ্টির সেরা মানুষের নাম কোনো ফলের নাম হতে পারে না। যিনি তোমার এই ডাকনাম রেখেছেন, তিনি ভুল করেছেন। একজন নবীর নাম যে ইউসুফ ছিল, তা কী তুমি জান?
জ্বি জানি।
তা হলে তুমিই বল, কোনো নবীর নামে যার নাম, তার ডাকনাম কী ডালিম রাখা উচিত। তা ছাড়া মুসলমান ছেলে-মেয়ের নাম কোনো নদ-নদী, ফল-ফুল, পার্থিব বস্তু অথবা বিজাতীয়দের নাম রাখা মোটেই উচিত নয়। কারণ এটা মস্তবড় বেয়াদবি। শোন খোকা, আজ বাসায় গিয়ে তোমার মা-বাবাকে আমার কথাগুলো বলে বলবে, ডাকনাম অন্য কিছু রাখতে অথবা ইউসুফ নামে যেন ডাকেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, নামের অর্থ জান?
জ্বি, সুদর্শন।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। হযরত ইউসুফ (আঃ) অত্যন্ত সুদর্শন ছিলেন। তুমিও দেখতে সুদর্শন। সে দিক থেকে তোমার নাম ঠিক রেখেছেন; কিন্তু ডাকনাম কেন যে ডালিম রাখলেন, তা বুঝতে পারছি না। তোমার বাবার নাম কী?
মুহাম্মদ ইয়াকুব।
তোমার বাবার নামও দেখছি একজন নবীর নাম। যিনি হযরত ইউসুফ (আঃ) এর পিতা ছিলেন। তোমরা ভাইবোন কয়জন?
দু’ভাই ও দু’বোন।
তাদের নাম বলতে শুনি?
সবার বড় বোন খাদিজা। তারপর আমি। আমার পরে এক ভাই। তার নাম বনি ইয়ামিন এবং সবার ছোট বোন সালমা।
তোমাদের সবার নাম খুব ভালো। নামগুলো কে রেখেছেন বলতে পার?
দাদাজী।
উনি বেঁচে আছেন?
জ্বি না, বনি ইয়ামিনের আক্বীকা করার পরের দিন মারা গেছেন। দাদিআম্মা বেঁচে আছেন।
মনে হচ্ছে তোমার দাদাজী খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। আচ্ছা, দাদিকে তুমি দাদিআম্মা কেন বললে বলতে পার?
জ্বি পারি। ছোটবেলা থেকে আমরা দাদিকে দাদিআম্মা, নানিকে নানিআম্মা, ফুফুকে ফুফুআম্মা ও খালাকে খালাআম্মা বলে ডাকি। কিছুদিন আগে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার বন্ধুরা শুধু দাদি, নানি, ফুফু ও খালা বলে, আমরা কেন ঐসবের সাথে আম্মা বলি? আম্মা বললেন, শরীয়তে যাদের সঙ্গে বিয়ে হারাম, তাদেরকে সম্পর্কের শেষে মা বা আম্মা যোগ করে ডাকতে হয়।
জাফর সাহেব বুঝতে পারলেন, ছেলেটা খুব ধার্মিক পরিবারের। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা কি করেন?
ইসলামী ব্যাংকে অফিসার র্যাংকে আছেন।
বাসা কোথায়?
পুরানা পল্টন।
ওখানে কী ভাড়া বাসায় থাক?
জ্বি না, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আব্বা বাড়ি করেছেন।
দেশের বাড়ি কোথায়?
চৌদ্দগ্রাম। গ্রামের নাম জয়ন্তীনগর।
কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস এইটে।
রোল নাম্বার?
এক।
জুলায়খার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হল কি করে?
ইউসুফ বলার আগে হামিদা বেগম স্বামীকে বললেন, তুমি কী বল তো? এতটুকু দুধের বাচ্চাকে সেই কখন থেকে উঁকিলী জেরা করছ। তারপর ইউসুফকে বললেন, তুমি আজ যাও, কাল এস।
জাফর সাহেবের লম্বা চওড়া শরীর দেখে ইউসুফ আগেই ভয় পেয়েছিল। তারপর এতক্ষণ তার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ঘেমে উঠেছিল। হামিদা বেগমের কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। একবার জুলায়খা ও তার দাদির দিকে তাকিয়ে চলে গেল।
ইউসুফ চলে যাওয়ার পর হামিদা বেগম বললেন, তুমি জাপান যাওয়ার পর ছেলেটা রবিউল স্যারের সঙ্গে দু’দিন এসেছিল। একদিন জুলায়খা বলল, “তোমরা তো আমাকে বাইরের কোনো ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলতে দাও না। স্যারের কাছে শুনেছি, ছেলেটা খুব ভালো। তার বাবাও বাইরের ছেলেদের সঙ্গে তাকে খেলতে দেন না। ওর সঙ্গে আমি খেলব। তুমি স্যারকে বলে ব্যবস্থা করে দাও।” বললাম, তোর আব্বা ফিরে এলে, তাকে বলিস। বলল, আব্ব কবে ফিরবে না ফিরবে তার ঠিক নেই, তুমি ব্যবস্থা কর। তারপর শাশুড়ীর দিকে তাকালেন।
আসিয়া বিবি বললেন, জুলায়খা মনমরা হয়ে সারা বিকেল ঘুরে বেড়ায়। তাই রবিউল স্যারের কাছে ইউসুফের সবকিছু জেনে আমিই তাকে আসতে বলি। এই বয়সে ছেলেমেয়েদের একটু আধটু খেলাধূলা …।
দাদিকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে জুলায়খা আব্বাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে খেলি বলে তুমি কী রাগ করেছ?
জাফর সাহেব মেয়েকে আদর করে বললেন, না করি নি। তবে তোকেও এ বছর রোল নাম্বার এক করতে হবে। শুনলি না, ইউসুফের রোল নাম্বার এক?
জুলায়খার রোল নাম্বার দশ। তবে এ বছর প্রথম ষান্মাসিক পরীক্ষায় ষষ্ঠ হয়েছে। বলল, দ্বিতীয় ষান্মাসিক পরীক্ষায় এক করতে না পারলেও বাৎসরিক পরীক্ষায় পারব।
জাফর সাহেব বললেন, তোমাকে না বলেছিলাম, ভবিষ্যতের কোনো কথা বলার আগে অথবা শেষে “ইনশাআল্লাহ” বলবে?
ভুল হয়ে গেছে। এরপর থেকে আর এরকম ভুল করব না ইনশাআল্লাহ। জাফর সাহেব হাসিমুখে বললেন, জাস্ট লাইক এ গুড গার্ল।
.
পরের দিন বিকেলে ইউসুফ খেলতে এলে জুলায়খা বলল, তুমি আমাকে সাহায্য করবে?
ইউসুফ হেসে ফেলে বলল, তোমাদের তো কোনো কিছুর অভাব নেই, তবু সাহায্য চাইছ, কথাটা বুঝতে পারছি না।
জুলায়খাও হেসে ফেলে বলল, আব্বু-আম্মুর কোনো কিছুর অভাব না থাকলেও আমার আছে। তুমি সাহায্য করবে কি না বল?
ঠিক আছে, বল।
কাল আবু তোমার রোল নাম্বার এক জেনে আমাকে বললেন, “তোকেও ঐ ছেলেটার মতো রোল নাম্বার এক করতে হবে।
তুমি কোন ক্লাসে পড়? তোমার রোল নাম্বার কত?
ক্লাস সিক্সে। রোল নাম্বার দশ। তবে এবছর প্রথম ষান্মাসিক পরীক্ষায় ষষ্ঠ হয়েছি। তুমি যদি আমাকে সাহায্য কর, তা হলে দ্বিতীয় ষান্মাসিক পরীক্ষায় না। হলেও বার্ষিক পরীক্ষায় নিশ্চয় এক করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
ইউসুফ অল্পক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমাকেওতো অনেক পড়াশোনা করতে হয়, তোমাকে কখন পড়াব? আমি যে স্যারের কাছে পড়ি, তুমিওতো সেই স্যারের কাছে পড়। একটু বেশি পরিশ্রম করলে রোল নাম্বার এক করতে পারবে। দরকার মনে করলে আরো একজন স্যার রাখার জন্য তোমার বাবাকে বল।
তার মানে তুমি আমাকে সাহায্য করবে না? এই কথা বলে জুলায়খা মুখ ভার করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার চোখ দিয়েপানি টপ টপ করে পড়তে লাগল।
তাই দেখে ইউসুফ বলল, তুমি আমার কথা বুঝতে পারনি। তোমাকে সাহায্য করব না, একথা বলি নি। কখন সাহায্য করব বোঝাতে চেয়েছি।
জুলায়খা চোখ মুছে মুখ তুলে ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর ছুটে ভিতরে চলে গেল। একটু পরে দাদির হাত ধরে ফিরে এল।
আসিয়া বিবি ইউসুফকে বললেন, তুমি ওকে পড়াশোনায় সাহায্য করবে বলেছ?
জ্বি বলেছি; কিন্তু এই সময়টা ছাড়া আমাকেও পড়াশোনা করতে হয়। আপনিই বলুন, কখন ওকে সাহায্য করব।
তুমি কোন স্কুলে পড়?
মতিঝিল মডেল হাই স্কুলে।
প্রতিদিন এখানে খেলতে আস, সে কথা তোমার মা বাবা জানেন?
শুধু আম্মা জানেন।
তোমাদের ফোন আছে?
জ্বি না।
গাড়ি?
জ্বি না।
ঠিক আছে, কাল স্কুলে যাওয়ার সময় তোমার আম্মাকে বলবে, ছুটির পর তুমি এখানে আসবে, সন্ধ্যের আগে বাসায় ফিরবে। আর শোন, স্কুল ছুটির পর গেটে থাকবে, আমাদের গাড়ি তোমাকে নিয়ে আসতে যাবে। আসার পর নাস্তা খেয়ে এক-আধ ঘন্টা ওকে পড়াবে। তারপর তোমরা খেলাধূলা করবে, কেমন?
ইউসুফ কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, আজ বাসায় গিয়ে আম্মাকে আপনার কথা বলব। আম্মা যদি আপত্তি না করেন, তা হলে কাল এসে জানাব।
আসিয়া বিবি আনন্দিত হয়ে বললেন, ঠিক আছে, তাই জানিও।