অমরত্বের আপেল ফল
অন্য আরেক সময়ে তিনজন দেবতা জতুনহাইমের প্রান্তে পাহাড়ি অঞ্চল পরিভ্রমণ করছিল। এবার তারা তিনজন ছিল থর লোকি আর হোনির (হোনির একজন প্রাচীন দেবতা, তিনি মানুষকে যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছেন।) ঐ পাহাড়ি অঞ্চলে খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিল, আর দেবতারা খুবই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল।
তারা দূরে একটা শব্দ শুনতে পেল, একটা গরুর হাম্বা ডাক, শুনে তাদের ঠোঁটে হাসি ফুটল, ক্ষুধার্ত দেবতারা এই ভেবে খুশি হলো, তারা আজ রাতে ভালো খাবার পাবে। তারা সবুজ উপত্যকায় নেমে এলো, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এলাকা, যেখানে বিশাল ওক আর উঁচু পাইন গাছেরা তৃণভূমি আর পানির ধারার চতুর্দিক ঘিরে রেখেছে। তারা একপাল গরু চরে বেড়াতে দেখল, যারা উপত্যকার ঘাস আর পানি খেয়ে বড় আর মোটাতাজা হয়েছে।
তারা একটা গর্ত খুঁড়ল আর সেখানে আগুন জ্বালাল। একটা ষাঁড় জবাই করে আগুনের কয়লার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল আর আগুনের তাপে খাবার সিদ্ধ হওয়ার অপেক্ষায় থাকল।
তারা কয়লার ভিতর থেকে ষাঁড়টি বের করল, কিন্তু মাংস তখনো কাঁচা আর রক্তাক্ত দেখতে পেল।
আবার তারা আগুন জ্বালাল। আবার তারা অপেক্ষা করল। আবারো দেখা গেল, আগুনের তাপে মাংস এমনকি উত্তপ্তও হয়নি।
“তোমরা একটা কিছু শুনতে পাচ্ছ?”
“কী?” জানতে চাইল হোনির। “আমি কিছুই শুনতে পাইনি।”
“আমি শুনেছি,” বলল লোকি। “ভালো করে শোনো।”
তারা মনোযোগ দিয়ে শুনল আর পরিষ্কার শুনতে পেল। কেউ একজন তাদের নিয়ে হাসছে।
তিন দেবতা তাদের চারপাশে তাকাল কিন্তু বিশাল উপত্যকায় কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না, শুধু তারা তিনজন আর একপাল গরুকে তারা দেখতে পেল।
লোকি কী ভেবে উপরে তাকাল।
সবচেয়ে বড় গাছটির সবচেয়ে মগডালে একটা ঈগল বসে ছিল। একটা বিরাট ঈগল, এত বড় ঈগল তারা আগে কখনো দেখেনি, আর ঈগলটা তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল।
“তুমি কি জানো কেন আগুন আমাদের খাবার সিদ্ধ করতে পারছে না?” জানতে চাইল থর।
“আমি হয়তো জানি,” জবাব দিল ঈগল। “হুম, মনে হচ্ছে তোমরা খুবই ক্ষুধার্ত। তোমরা কেন তোমাদের খাবার কাঁচা খাচ্ছ না? ঈগলরা তো তাই করে। আমরা আমাদের চঞ্চু দিয়ে মাংস ছিঁড়ে খাই। কিন্তু তোমাদের তো চঞ্চ নেই, তাই না?”
“আমরা ক্ষুধার্ত,” বলল হোনির। “তুমি কি আমাদের খাবার রান্নায় সহায়তা করতে পারো?”
“আমার মনে হয়,” বলল ঈগল, “তোমাদের আগুনে জাদু করা আছে, যাতে তোমাদের আগুনের সব শক্তি আর তাপ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমরা যদি তোমাদের খাবার থেকে কিছু মাংস আমাকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দাও, আমি তোমাদের আগুনের শক্তি ফিরিয়ে দিতে পারি।”
“আমরা কথা দিচ্ছি,” বলল লোকি। “আমাদের খাবার রান্না হলে তুমি তোমার অংশ পেয়ে যাবে।”
ঈগল তৃণভূমির ওপর দিয়ে উড়ে গেল, তার পাখার ঝাপটায় দমকা হাওয়া উঠল, হাওয়ার বেগ এত প্রবল যে, গর্তের কয়লা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল, দেবতারা বাতাসের ঝাপটা থেকে বাঁচতে একে অপরকে ধরে রাখল। ঈগল এক চক্কর ঘুরে আবার বৃক্ষের মগডালে গিয়ে বসল।
এবার তারা আশান্বিত মনে আগুনে মাংস রাখল আর অপেক্ষা করল। সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল, যখন উত্তরে সূর্য কমই অস্ত যায়, দিন অনেক বড় হয়, তাই সময়টা ছিল গভীর রাত কিন্তু তারা যখন গর্ত খুলে খাবার বের করল, তখনো দিনের আলো ছিল। তারা দেখল, মাংস নরম হয়ে এসেছে, চমৎকার সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে, খাবার তাদের ছুরি আর দাঁত ব্যবহারের জন্য একেবারে তৈরি
গর্ত থেকে যখন রান্না হওয়া ষাঁড়টি বের করা হলো, ঈগলটি গাছের ওপর থেকে উড়ে এলো আর ষাঁড়ের পিছনের দুই পা আর পিঠের এক অংশে লম্বা নখর দিয়ে থাবা বসাল আর বিশাল চঞ্চু দিয়ে মাংস ছেঁড়ার উপক্রম করল। নিজেদের খাবারের একটা বড় অংশ ঈগলের পেটে যাবে, এটা ভেবে লোকি রেগে গেল আর ঈগলটাকে তাড়িয়ে খাবার রক্ষার জন্য তার বর্শা দিয়ে আঘাত করল।
ঈগল খাবার ঠোঁট থেকে ফেলে দিল আর এত জোরে ডানা ঝাপটাল যে, বাতাসের ধাক্কায় দেবতারা প্রায় উড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। লোকি তার সাফল্য উদযাপন করার সময় পেল না কারণ, সে দেখল বর্শাটি ঈগলের পাশে আটকে গেছে আর ঈগলটি উড়ে যেতে যেতে তাকেও শূন্যে তুলে ফেলেছে।
লোকি তার বর্শাটি ছেড়ে দিল কিন্তু তার হাত বর্শার হাতলে আটকে গিয়েছিল, সে ছুটতে পারল না।
ঈগল নিচু হয়ে উড়ে গেল আর লোকির পা নুড়ি-পাথর, পাহাড়ের ধার আর গাছে ঘষা খেতে লাগল। লোকি জাদুমন্ত্রের উপস্থিতি টের পেল, আর বুঝল এটা খুবই শক্তিশালী জাদু।
‘থাম,” চিৎকার করল লোকি, “দয়া করে থাম। তুমি আমার হাত ছিঁড়ে ফেলবে। আমার জুতো ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি তো আমাকে মেরেই ফেলবে।” ঈগল পাহাড়ের পাশ হতে উড়ে গেল আর উঁচুতে চক্কর কাটতে লাগল। “আমি সম্ভবত তোমাকে মেরেই ফেলব,” বলল ঈগল।
“আমাকে নিচে নামিয়ে দাও, তুমি যা বলো, আমি তাই করব,” বাতাসে খাবি খেল লোকি, “শুধু আমাকে নিচে নামিয়ে দাও।”
“আমি ইডুনকে চাই,” বলল ঈগল। আমি তার আপেলগুলো চাই। অমরত্বের আপেল।”
লোকি বাতাসের ভেসে থাকল। তার কাছ থেকে মাটি অনেক দূরের পথ।
ইডুন কাব্যের দেবতা ব্রাগিকে বিয়ে করেছিল, সে খুব মিষ্টভাষী, ভদ্র আর দয়ালু ছিল। তার সাথে এশ কাঠের একটা বাক্স থাকত, যেটার ভিতরে থাকত কিছু সোনালি আপেল। যখন দেবতারা অনুভব করত বয়স তাদের স্পর্শ করেছে, তাদের চুল সাদা করে দিচ্ছে আর তাদের হাড়ে গেঁটে বাত হয়েছে, তারা ইডুনের কাছে যেত। ইডুন তার বাক্স খুলত আর তাদের একটি আপেল খেতে দিত। তারা যখন আপেলটি খেত, তাদের যৌবন আর শক্তিমত্তা আবার ফিরে আসত। ইডুনের আপেল না থাকলে দেবতারা আর অমর দেবতা থাকত না।
“তুমি কিছু বলছো না,” বলল ঈগল, “আমি তোমাকে আরো কিছু পাথর আর পাহাড়ের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাব। এবার আমি তোমাকে গভীর নদীর ওপর দিয়েও টেনে নিয়ে যেতে পারি।”
“আমি তোমাকে আপেলগুলো এনে দেব” বলল লোকি। “আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমাকে শুধু নিচে নামিয়ে দাও।”
ঈগল কিছুই বলল না, কিন্তু ডানার এক ঝাপটায় সে সবুজ তৃণভূমিতে নেমে এলো, যেখান থেকে আগুনের ধোঁয়া উঠছিল। ঈগল হুশ করে আগুনের ওপর দিয়ে উড়ে গেল আর লোকি নিজেকে সবুজ ঘাসে পড়ে থাকতে দেখতে পেল। একটা চিল-চিৎকার করে ঈগল পাখা ঝাপটে দূরে উড়ে গেল, দূর থেকে তাকে দেখতে একটা ছোট বিন্দুর মতো লাগছিল।
“আমি ভাবছি, এটা কী ঘটল,” বলল থর।
“আমিও তাই ভাবছি, কী যে সব ঘটে গেল!” জবাব দিল লোকি।
“আমরা তোমার জন্য কিছু খাবার রেখেছি,” বলল হোনির।
লোকির ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তার সহযাত্রীরা ভাবল বাতাসে ঈগলের সাথে যুদ্ধ করে বুঝি তার ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গেছে।
তারা এসগার্ডে ফিরে চলল, ফিরতি পথে তেমন কোনো চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল না। পরদিন ইডুন এসগার্ডে হেঁটে বেড়াচ্ছিল, দেবতাদের সাথে কুশল বিনিময় করছিল আর তাদের চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখছিল, তাদের কাউকে বয়স্ক দেখাচ্ছে কি না। সে লোকিকে পাশ কাটিয়ে গেল। সাধারণত লোকি ইডুনকে পাত্তা দিত না, কিন্তু আজ লোকি ইডুনকে দেখে হাসল আর কুশল জানতে চাইল I
“ইডুন! তোমাকে দেখে খুশি হলাম। আমার মনে হচ্ছে, আমার বয়স বেড়ে গেছে,” বলল লোকি। “তোমার একটা আপেল আমার খাওয়া দরকার।”
“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না, তোমার বয়স কিছুমাত্র বেড়েছে,” বলল ইডুন।
“আমি বয়স লুকিয়ে রাখি,” বলল লোকি, “কিন্তু আমার কোমরে অনেক ব্যথা। আমার মনে হচ্ছে, আমি বুড়ো হয়ে গেছি।”
ইডুন তার এশ কাঠের বাক্সটি খুলে লোকিকে একটা সোনালি আপেল দিল।
লোকি আগ্রহের সাথে সবটা আপেল খেলো, এমনকি খোসা আর বীজও বাদ দিল না, কিন্তু খাওয়া শেষ করেই মুখ বাঁকাল।
“ওহ ইডুন”, বলল সে, “আমি ভেবেছিলাম, তোমার কাছে আরো ভালো আপেল আছে।”
“তুমি তো অদ্ভুত কথা বলছো,” বলল ইডুন। তার আপেল নিয়ে এমন কথা এর আগে কেউ কখনো বলেনি। দেবতারা সাধারনত আপেলটার স্বাদ কতটা চমৎকার ছিল আর আপেলটা খেয়ে নিজেকে কেমন যুবক মনে হচ্ছে, এ ধরনের কথা বলে থাকে। “লোকি, এগুলো দেবতাদের আপেল। অমরত্বের আপেল।”
লোকির ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না।
“তা ঠিক” বলল সে। “কিন্তু আমি বনে কিছু আপেল দেখেছি, যেগুলো সব দিক থেকে তোমার আপেলের চেয়ে ভালো। তোমার আপেলের চেয়ে দেখতে সুন্দর, ঘ্রান ভালো, স্বাদেও চমৎকার। আমার মনে হয়, সেগুলোও অমরত্বের আপেল। হয়তো সেগুলো তোমার আপেলগুলোর চেয়ে ভালো অমরত্ব দেবে।”
লোকি ইডুনের চেহারায় অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তি খেলে যেতে দেখল।
“আমার আপেলগুলোই অমরত্বের আপেল, এই আপেল আর কোথাও নেই,” বলল ইডুন।
লোকি কাঁধ ঝাঁকাল। “আমি যা দেখেছি, তোমাকে তাই বললাম,” বলল সে।
ইডুন লোকির পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। “সেই আপেলগুলো কোথায় পাওয়া যাবে?” জানতে চাইল সে।
“ঐদিকে। জায়গাটা কোথায় সঠিক বলতে পারব না, কিন্তু আমি তোমাকে বনের ভেতর দিয়ে তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারব। খুব বেশি দূরে না।”
ইডুন যেতে রাজি হলো।
“কিন্তু যখন আমরা আপেল গাছটি দেখব,” বলল লোকি, তোমার এই এশ কাঠের বাক্সের আপেলের সাথে গাছের আপেলের কীভাবে তুলনা করব? মানে, আমি হয়তো বলতে পারি, বনের গাছের আপেলগুলো তোমার আপেলের চেয়ে ভালো। তুমি হয়তো বলবে, অবশ্যই না, আমার আপেলগুলোই ভালো, আমরা কীভাবে বুঝব?”
“কোনো চিন্তা নেই,” বলল ইডুন, “আমি আমার আপেলগুলো সাথে নেব। আমরা দুই আপেল পাশাপাশি রেখে তুলনা করব।”
ওহ,” বলল লোকি, “খুবই চমৎকার আইডিয়া। ঠিক আছে তাহলে। চল যাই।”
লোকি ইডুনকে বনের ভিতর দিয়ে নিয়ে চলল। ইডুন তার অমরত্বের আপেল ভরা বাক্স শক্ত করে ধরে ছিল।
আধঘণ্টা হাঁটার পর ইডুন বলল, “লোকি, আমার এখন মনে হচ্ছে, এরকম আপেলও নেই, আপেল গাছও না।”
“তোমার কথা শুনে কষ্ট পেলাম,” বলল লোকি। “ওই যে পাহাড় দেখছো, ওটার চূড়ায়ই আপেল গাছটি আছে।”
তারা পাহাড়ের চূড়ায় উঠল। “এখানে কোনো আপেল গাছ নেই,” বলল ইডুন। “শুধু একটা লম্বা পাইন গাছ আছে, আর গাছের মাথায় একটা ঈগল বসা।”
“এটা কি একটা ঈগল?” জানতে চাইল লোকি। “এটা তো অনেক বড়।”
ঈগলটা যখন তাদের কথা শুনল, সে তার ডানা ঝাপটাল আর উড়ে পাইন গাছের মগডাল থেকে নিচে নেমে এলো।
“আমি আসলে ঈগল নই”, বলল বিশাল ঈগল, “আমি দানব থিয়াজি, ঈগলের বেশে আছি। এখন আমি সুন্দরী ইডুনকে নিয়ে যাব। তুমি আমার মেয়ে স্কাডির সখী হবে। একসময় হয়তো তুমি আমার স্ত্রীও হতে পার। কিন্তু যাই ঘটুক না কেন, এসগার্ডের দেবতাদের সময় আর অমরত্ব, দুটাই শেষ হয়ে গেছে। এই আমি বলছি। দানব থিয়ালজি বলছি।”
ঈগল তার এক পায়ের থাবায় ইডুন আর অন্য থাবায় এশ কাঠের বাক্সটি নিয়ে উড়ে চলে গেল।
“তাহলে জানা গেল ঈগলটি কে ছিল,” লোকি নিজেকেই বলল, “আমি জানতাম, এটা শুধুমাত্র একটা ঈগল নয়, অন্য কেউ!”
লোকি এসগার্ডে ফিরে এলো আর আশা করল, ইডুন আর তার আপেলগুলো যে গায়েব হয়ে গেছে, এটা কেউ খেয়াল করবে না, আর যদি খেয়াল করেও, সে যে ইডুনকে বনে নিয়ে গেছে, এটা কেউ টের পাবে না।
“তোমাকে সর্বশেষ ইডুনের সাথে দেখা গেছে,” ডান হাতের মুঠি পাকিয়ে বলল থর।
“একদমই সত্যি নয়,” বলল লোকি। “কেন তুমি এসব কথা বলছো?”
“কারণ তুমি অন্যদের মতো এত বুড়ো হওনি,” জবাবে বলল থর।
“আমারও বয়স বেড়েছে, কিন্তু আমি ভাগ্যবান,” বলল লোকি, “আমি বয়সের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছি।”
থর মৃদু গর্জন করল, তাকে মোটেই লোকির কথায় সন্তুষ্ট মনে হলো না। তার লাল দাড়ি পুরোই সাদা হয়ে গেছে, মাঝেমধ্যে কয়েকটা কমলা দাড়ি দেখা যাচ্ছে, যেন এককালের জ্বলন্ত লাল আগুন সাদা ছাইয়ে পরিণত হয়েছে।
“তাকে আবার আঘাত করো,” বলল ফ্রেয়া। তার লম্বা চুলগুলো এখন ধূসর হয়ে গেছে আর মুখে গভীর বলিরেখা দেখা যাচ্ছে। তাকে এখনো সুন্দরী দেখাচ্ছে, কিন্তু সেটা বয়সের সৌন্দর্য, যুবতী কন্যার সৌন্দর্য নয়। “ সে জানে, ইডুন কোথায় আছে, সে এটাও জানে ইডুনের আপেলগুলো কোথায় আছে।” উজ্জ্বল কণ্ঠহারটা তার গলায় এখনো ঝুলছে, কিন্তু সেটাকেও ধূসর আর পুরোনো দেখাচ্ছে।
সকল দেবতাদের পিতা, ওডিন, তার গেঁটে বাতে দুর্বল হয়ে যাওয়া হাত তুলল। আগে তার যে বজ্রকণ্ঠে চতুর্দিক প্রকম্পিত হতো, সেটাও আজ ভাঙা আর নির্জীব শোনাল। “লোকিকে আঘাত করো না, থর,” বৃদ্ধ গলায় বলল ওডিন।
“দেখেছ তোমরা, আমি জানতাম, আপনি অন্তত বুঝদার লোকের মতো আচরণ করবেন, মহামান্য বিশ্বপিতা,” বলল লোকি। “আমি এসবের কিছুই জানি না। ইডুন কেন আমার সাথে কোথাও যাবে? সে তো আমাকে পছন্দই করে না।”
“তাকে আঘাত করো না,” পুনরায় বলে উঠল ওডিন, নিজের ধূসর হয়ে আসা একচোখে লোকিকে ভালো করে দেখল। “তাকে শাস্তি দেয়া শুরু করার আগে আমি তাকে অক্ষত দেখতে চাই। তারা আগুন প্রস্তুত করছে, অস্ত্রে ধার দিচ্ছে আর পাথর সংগ্রহ করছে। আমরা হয়তো বুড়ো হয়েছি কিন্তু আমরা এখনো শাস্তি দিতে পারি, এমনকি হত্যাও করতে পারি, যদিও ইডুনের আপেল খেয়ে যেমন জোয়ান আমরা ছিলাম, এখন আর তেমনটা নেই।”
পোড়া কয়লার গন্ধ লোকির নাকে পৌঁছাল।
“যদি….” বলল লোকি। “যদি আমি বের করতে পারি ইডুনের কী হয়েছে, আর যদি কোনোভাবে আমি ইডুন আর তার আপেলগুলোকে নিরাপদে এসগার্ডে ফেরত আনতে পারি, আপনি কি শাস্তি আর মৃত্যুদণ্ড থেকে আমাকে রেহাই দেওয়ার কথা বিবেচনা করবেন?”
“এটা তোমার বাঁচার একমাত্র রাস্তা,” বৃদ্ধ আর ভাঙা গলায় বলল ওডিন, ওডিনের গলা এতই ভাঙা আর বৃদ্ধ শোনাচ্ছিল যে লোকি ভাবল এটা কি বৃদ্ধের গলা বাকি বৃদ্ধার গলার মতো শোনাচ্ছে? “ইডুনকে এসগার্ডে ফেরত আনো। একই সাথে অমরত্বের আপেলগুলোও।”
লোকি মাথা ঝোঁকাল। “শেকলগুলো খুলে দাও,” সে তাদের বলল। “আমি কাজটা করব। এজন্য আমার ফ্রেয়ার ঈগল-পালকের আলখেল্লাটা দরকার।”
“আমার আলখেল্লা?” জানতে চাইল ফ্রেয়া।
“হ্যাঁ, তোমার আলখেল্লাটাই আমার চাই।”
ফ্রেয়া অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে হেঁটে গেল আর তার ঈগলের পালকের আলখেল্লা নিয়ে ফিরে এলো। লোকির শেকল খুলে দেওয়া হলো আর সে আলখেল্লা নিতে গেল।
“তুমি ভেবনা যে তুমি আলখেল্লা পরে উড়ে যাবে আর ফিরে আসবে না,” বলল থর, সে তার সাদা দাড়িতে হাত বুলাল, “আমি হয়তো বুড়ো হয়েছি,” বলল সে, “কিন্তু তুমি যদি ফিরে না আসো, আমি যত বুড়োই হই না কেন, তোমাকে আমি খুঁজে বের করে আনব, যেখানেই তুমি লুকাও, তোমার রেহাই নেই, আমার এই হাতুড়ি তোমার মৃত্যুর কারণ হবে। আমি এখনো থর আছি। আমি এখনো শক্তিশালী!”
“তুমি এখনো চূড়ান্ত বিরক্তিকরই আছ,” বলল লোকি। “কথায় সময় ব্যয় না করে তোমার শক্তিকে কাজে লাগাও। এসগার্ডের প্রাচীরের বাইরে একটা অনেক বড় কাঠের স্তূপ তৈরি করো। এর জন্য তোমাকে অনেক অনেক গাছ কাটতে হবে আর সেগুলোকে ছোট ছোট টুকরো করতে হবে। দেওয়ালের ধার ঘেঁষে আমার একটা লম্বা আর উঁচু কাঠের স্তূপ চাই, সুতরাং এখনই কাজ শুরু করো।”
লোকি ঈগল পালকের আলখেল্লাটি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল আর ঈগলে রূপান্তরিত হলো, ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ে গেল। সে উত্তর দিকে রওনা হলো, তুষার দানবদের রাজ্যের উদ্দেশে।
লোকি অনবরত উড়তে উড়তে দানব রাজ্যের গভীরে দানব থিয়াজির দুর্গে পৌঁছে গেল। আর দুর্গের চূড়ায় গিয়ে বসল, নিচের সবকিছু তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।
সে থিয়াজিকে দেখতে পেল, থিয়াজি এখন দানবের রূপে ছিল। লোকি দেখল থিয়াজি তার দুর্গ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা নৌকার কাছে গেল, নৌকাটা একটা বৃহৎ তিমির চেয়েও বড়। থিয়াজি নৌকাটাকে টেনে উত্তর সাগরের ঠান্ডা জলে টেনে নামাল আর বিশাল বিশাল দাঁড় বেয়ে সমুদ্রের গভীরে নিয়ে চলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকাটি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
ঈগলের বেশে থাকা লোকি দুর্গের পাশ দিয়ে উড়ে উড়ে প্রতিটি জানালা দিয়ে ভিতরে দেখতে লাগল। সবচেয়ে ভিতরের একটি কক্ষে সে ইডুনকে দেখতে পেল। সে দেখল ইডুন বসে বসে কাঁদছে। লোকি উড়ে গিয়ে জানালার শিকে বসল।
“কান্না থামাও,” বলল লোকি, “এই যে দেখ, আমি লোকি, তোমাকে রক্ষা করতে এসে গেছি।”
ইডুন তার কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে যাওয়া চোখে ফিরে তাকাল। “তোমার কারণেই আমার আজ এই দুর্দশা,” বলল ইডুন।
“কথা অনেকটা সত্য বলেছ। কিন্তু সেটা অনেক আগের কথা। ওটা ছিল আরেক লোকি। আজকের লোকি তোমাকে বাঁচাতে এসেছে, তোমাকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে এসেছে।”
“কীভাবে?” জানতে চাইল ইডুন।
“তোমার সাথে কি আপেলগুলো আছে?”
“আমি একজন এসির দেবী,” বলল ইডুন, “আপেলগুলো সবসময় আমার সাথেই থাকে”, সে লোকিকে আপেলের বাক্সটা দেখাল।
“তাহলে তো কাজ আরো সহজ হয়ে গেল,” বলল লোকি, “চোখ বন্ধ করো।”
ইডুন চোখ বন্ধ করল আর লোকি তাকে একটা খোসাসুদ্ধ হ্যাজেলনাটে রূপান্তর করে নিল। লোকি হ্যাজেলনাটের দানাটাকে থাবায় পুরে নিয়ে জানালার শিক গলে উড়ে গেল আর এসগার্ডের দিকে রওনা হয়ে গেল।
থিয়াজি সেদিন একটা মাছও ধরতে পারল না। একটা মাছও তার বড়শির টোপ গিলল না। সে সিদ্ধান্ত নিল বেকার সময় নষ্ট না করে-দুর্গে ফিরে গিয়ে ইডুনের সাথে সময় কাটানো যাক। ইডুনকে গিয়ে সে বলবে যে ইডুন আর তার আপেলগুলো ছাড়া এসগার্ডের দেবতাদের কী অবস্থা হয়েছে। তারা কেমন বুড়িয়ে থুথুরে হয়ে গেছে, তাদের চামড়া কেমন কুঁচকে গেছে। সে তার নৌকার দাঁড় বেয়ে দুর্গে ফিরে এলো আর সোজা ইডুনের কক্ষে গেল।
কক্ষে কেউ ছিল না।
থিয়াজি মাটিতে একটা ঈগলের পালক দেখতে পেল আর মুহূর্তেই বুঝতে পারল কী ঘটেছে, কে কীভাবে ইডুনকে নিয়ে গেছে।
থিয়াজি একটা বিশাল আর শক্তিশালী ঈগলের বেশে আকাশে উড়ে চলল, সে দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে ডানা ঝাপটিয়ে এসগার্ডের দিকে চলল।
মাটি তার নিচ দিয়ে সাঁইসাঁই করে চলে যেতে লাগল, সে বাতাসের বেগে ধাবিত হলো, এত দ্রুত উড়ল যে, তার পাশ দিয়ে বাতাস তীক্ষ্ণ শব্দ করে বেরিয়ে যেতে লাগল।
থিয়াজি উড়তে উড়তে দানবদের রাজ্য পেরিয়ে দেবতাদের রাজ্যে প্রবেশ করল। থিয়াজি যখন একটা ইগলকে তার সামনে উড়তে দেখল, সে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে আরো জোরে উড়তে শুরু করল।
এসগার্ডের দেবতারা এই চিল-চিৎকার আর বাতাসে ডানার ঝাপটার শব্দ শুনল আর প্রাচীরের ওপর গেল কী ঘটছে দেখার জন্য। তারা দেখল একটা ছোট ঈগল তাদের দিকে উড়ে আসছে আর তার ঠিক পিছনেই একটা বিশাল ঈগল উড়ে আসছে।
“এখন?” জানতে চাইল থর।
“হ্যাঁ, এখনই,” জবাব দিল ফ্রেয়া।
থর কাঠের স্তূপে আগুন দিল। এক মুহূর্ত পরই মাথার ওপর দিয়ে ছোট ঈগলটি উড়ে গিয়ে দুর্গের ওপর পৌঁছাল আর তখনি আগুন জ্বলে উঠল। একটা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো আগুনের শিখা আকাশের দিকে উঠে গেল। বিশাল ঈগলটির ডানায় আগুন ধরে গেল আর সে একটা জ্বলন্ত কুণ্ডলীর মতো আকাশ থেকে মাটিতে খসে পড়ল, তার পড়ার আঘাতে এসগার্ডের দুর্গ আর প্রাচীর কেঁপে উঠল।
আগুনে পুড়ে যাওয়া ভয়ার্ত ঈগলটি এমনকি এসগার্ডের বুড়ো দেবতাদের জন্যও ভয়ের কারণ হতে পারল না, সে তার ঈগলের বেশ থেকে দানবের বেশে রূপান্তরের পূর্বেই থরের হাতুড়ির এক আঘাতেই সে ধরাশায়ী হলো।
ইডুন তার স্বামীর কাছে ফিরতে পেরে খুবই আনন্দিত হলো। আর দেবতারা অমরত্বের আপেল খেয়ে তাদের যৌবন আবার ফেরত পেল।