অভ্রর গোয়েন্দাগিরি – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়
আমি তো তাজ্জব!
তাজ্জব মানে, ওইটুকুন একটা ছেলে যার বয়েস এখনও নয় পেরোয়নি, সে যে এমন একটা কাণ্ড করে বসতে পারে, ভাবতেই পারিনি। বড় হলে সে তো শার্লক হোমসকেও ছাড়িয়ে যাবে!
বলছি অভ্রদীপের কথা। আমার বড় ছেলে। ক্লাস ফোর-এ পড়ে। কিন্তু হলে কি হবে, ভীষণ বুদ্ধি ধরে আর ভীষণ সাহসী। ছেলেবেলায় সেই যে একবার মায়ের কথায় ‘ভূত বলে কিছু নেই’ ধারণা হয়েছিল, তারপর থেকে ভূতকেই সে ভয় দেখায়। অন্ধকারে যেখানেই যেতে বলা হোক, অভ্র যেতে পারে। মায়ের ফরমাশে রাত্রে ছাতের ওপর থেকে সে কাচা কাপড় তুলে আনে, মাঝ-রাতে লোড-শেডিংয়ের সময় বাথরুমে যেতে হলে তার আলোর দরকার হয় না, এমনকী কাউকে ডাকারও দরকার হয় না। মাঝেমধ্যে আমি হয়তো বাড়ি নেই, ওর মা গেছে দোকানটোকানে, সদর বন্ধ করে সে দিব্যি একা থাকে বাড়িতে। অবশ্য একা থাকে বলাটা ভুল। ওর যে ভাই শুভ্রদীপ, যার বয়েস সাড়ে-পাঁচ, সে থাকে। কিন্তু তার থাকা না-থাকা তো দুই-ই সমান। কারণ সুয্যি পাটে নামার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, তারপর একসময় কাত হয়ে পড়ে শতরঞ্জির ওপরেই। যদিও আঙুল ঠিক ছুঁয়ে থাকে বর্ণপরিচয়ের বর্ণে।
এহেন অভ্র হঠাৎ একদিন এক কাণ্ড করে বসল। অবশ্য কাণ্ডটা ঠিক ও করেনি, ও যেটা করেছে সেটা হল এই কাণ্ডটার মীমাংসা।
আমার ঘরে একটা সেকেলে জাপানি ঘড়ি আছে। সময়ের সংখ্যাগুলো রোমান অক্ষরে লেখা। ডায়ালটা হলদেটে হয়ে গেছে বটে, কিন্তু আজও সময় দিয়ে চলেছে ঠিক। বাজনাটাও টং-টং করে বাজে, শীতে কিংবা বর্ষায় ধরাধরা মনে হয় না। বছরে বছরে দেয়াল থেকে আমি সেটা নামাই, পার্টসগুলো খুলে কেরোসিনে ডুবিয়ে রাখি দু’দিন, তারপর মুছে ময়লা সাফ করে যেমন যেমন জোড় দেওয়া দরকার, দিয়ে, টাঙিয়ে দিই দেয়ালে। এর ফলে পুরনো হলেও সময়ের হেরফের করেনি কখনও ঘড়িটা, কিংবা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়নি।
কিন্তু একদিন ঠিক সেই ব্যাপারটাই ঘটল। অর্থাৎ ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেল। অফিস থেকে ফিরে হাত-পা-মুখ ধুয়ে দেয়ালের দিকে তাকাতেই দেখি, ঘড়ির পেন্ডুলাম দুলছে না, বড়-কাঁটাটা বারোর ঘরে আর ছোট-কাঁটাটা দুই আর তিনের মাঝামাঝি। অদ্ভুত লাগল। এমন তো হওয়ার কথা নয়। নিজে থেকে বন্ধ হলে হয় ছোট-কাঁটা ঠিক দুইয়ের ঘরে থাকবে, নয়তো বড়-কাঁটা ছয়ের ঘরে থাকবে। নিশ্চয় কেউ হাত দিয়ে কাঁটা সরিয়েছে! কিন্তু কে?
সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় খাবারের রেকাবি হাতে অভ্রর মা ঘরে ঢুকল। বিছানার সাদা চাদরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “দেখেছ তোমার বড়ছেলের কাণ্ড! আজই সবে সাদা চাদর পাতলাম, আর ও কিনা রাস্তার কাদা পায়ে উঠে ঘড়িতে দম দিতে গেছে! এক দণ্ড বেরুবার উপায় নেই কোথাও! দশ মিনিটের জন্যে বেরিয়েছি, এসে দেখি এই কাণ্ড। দিয়েছি আজ বেশটি করে পিটিয়ে।”
মুখ দেখে মনে হল এখনও রাগ যায়নি অভ্রর মায়ের। আবার না ঘা-কতক দিয়ে বসে! চোখ ফেরালাম বিছানায়। সত্যিই খাটের মাথার দিকে ধবধবে চাদরের ওপর এলোমেলো কতকগুলো কাদা পায়ের ছাপ। এবং সেগুলো অভ্রর পায়ের মাপেরই। কোণের দিকে টেবিলের ধারে অভ্রর দিকে তাকালাম। চোখদুটো ফোলা ফোলা। একটু আগের কান্নার জের বোধহয়। আমাকে দেখেই আবার ফুঁপিয়ে উঠল। বলল, “মা আমাকে মিছিমিছি মারল, বাবা। আমি বিছানায় উঠিনি, ঘড়িতেও হাত দিইনি।”
মুখখানা দেখে বড় মায়া হল। ছেলেবেলায় ঘড়িতে দম দেবার আকাঙ্ক্ষা শতকরা নিরানব্বইজন ছেলেমেয়েরই বোধহয় থাকে। আমারও ছিল। সুতরাং ওকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু বিছানার চাদর আর ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে রাগ দেখাতেই হল। চোখ পাকিয়ে বলে উঠলাম, “ফের মিছে কথা। লেখাপড়া শিখছ এই জন্যে?” বলে খাটের পায়ার কাছ থেকে হাতপাখাটা তুলতে যেতেই ওর মা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সেটা কেড়ে নিল আমার হাত থেকে। বলল, “আর মারতে হবে না— ও আর কোনওদিন করবে না—”
মুহূর্তেই রাগটা জল হয়ে গেল অভ্রর মায়ের। মনে মনে ঠিক এইটাই চাইছিলাম আমি।
দিন তিনেক পরে আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেই বিছানার চাদরে কাদা পা, যথারীতি ঘড়ির কাঁটা সরানো। এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই রাগ হয়ে গেল আমার। বিকেলের দিকে অভ্রর মাকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম ডাক্তারখানায়। বড়জোর ঘণ্টাখানেক, ফিরে এসে দেখি এই ব্যাপার। যাবার সময় ঘরে শেকল তুলে দিয়ে, সামনের বাড়ি থেকে অভ্ররই সমবয়সি আমার ভাগনে অরূপকে ডেকে নীচের ঘরে ক্যারাম বোর্ড খেলতে বসিয়ে বেরিয়েছিলাম। শুভ্র আমাদের সঙ্গেই ছিল। বেরুবার সময় পই পই করে অভ্রর মা আর আমি দু’জনেই বলে গেলাম, “দেখো বাবা, দুষ্টুমি কোরো না— আমরা যাব আর আসব। সদরে খিল দিয়ে রেখো— বেরিয়ে যেয়ে না যেন।” তা কে কার কথা শোনে।
এক ঘণ্টাও পার হয়নি, ফিরে এলাম আমরা। সদর দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। দেখি সামনের বেঞ্চটায় বসে বসে অভ্র একখানা গল্পের বই পড়ছে। জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, ক্যারাম খেলছিস না? অরূপ কোথায়?
“ভাইদাদা চলে গেছে।”
“কেন, ঝগড়াঝাটি করেছিস নাকি?”
“না। বললে ভাল লাগছে না।”
“ভাল লাগছে না বলে চলে গেল? তোকে একা ফেলে রেখে?”
অভ্রর মায়ের মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। দোতলায় উঠে, শেকল খুলে ঘরে ঢুকলাম আমরা। এবং যথারীতি ঘড়ির দিকে চোখ ফেলতেই যেন থ হয়ে গেলাম। অভ্রর মায়ের তো তখন রাগে-ক্ষোভে কেঁদে ফেলার জোগাড়। চিৎকার করে উঠল, “দেখেছ ছেলের কাণ্ড! ফের সেই কাদা পায়ে বিছানায় উঠেছে।”
“ঘড়ির কাঁটা সরিয়েছে তো!” সঙ্গে সঙ্গে আমিও বলে উঠলাম।
চেঁচিয়ে ডাকতে যাচ্ছিলাম অভ্রকে, কিন্তু ডাকতে হল না। পেছন ফিরতেই দেখি, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। অভ্রর মা তো দেখেই হাঁউমাউ করে তেড়ে গেল, “হতভাগা, আবার সেই একই কাজ করেছিস?”
আমিও এগোচ্ছিলাম, কিন্তু অভ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। মুখখানা কেমন অস্বাভাবিক ঠেকল। জিজ্ঞেস করলাম, “ঘড়িতে হাত দিয়েছিলি ফের?”
সঙ্গে সঙ্গে ওর মা’ও বলে উঠল, “আবার আমার বিছানা নোংরা করেছিস?”
দুটো প্রশ্নেরই জবাব একসঙ্গে দিল অভ্র, “আমি করিনি।”
“ফের মিছে কথা। তুই করিসনি তো তবে এ-কাজ কে করলে?” ঘড়ি আর বিছানার দিকে আঙুল তুলে দেখানো হল।
“ভাইদাদা।” অভ্রর গলায় যেন দৃঢ় প্রত্যয়ের সুর।
“ভাইদাদা? তুই দেখেছিস— নিজের চোখে দেখেছিস?”
সঙ্গে সঙ্গে আমারও মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “না দেখে একদম বাজে কথা বলবি না বলে দিচ্ছি! মেরে একেবারে পিঠের ছাল তুলে দেব—”
অভ্রর ভঙ্গি যেন বেপরোয়া। এক পা এগিয়ে এসে বলল, “শুধু শুধু আমায় বকছ কেন? আমি বলছি তো ভাইদাদা করেছে। বিশ্বাস না হয়, ডেকে জিজ্ঞেস করো। স্বীকার না করলে বাঁ হাতের আঙুলগুলো দেখো, দেখবে ভুষো মাখা!”
অভ্রর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। কী বলছে ও যা-তা! বিছানার চাদরে কাদা পায়ের ছাপ আর ঘড়ির কাঁটা সরানোর সঙ্গে বাঁ হাতের ভুষো কালির যোগ কোথায় ঠিক বুঝলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, “কী বলছিস তুই আবোল-তাবোল? ওর হাতে ভুষো কালি মাখা তো হলটা কী?”
“হল এই যে, আজ ও ধরা পড়ে গেল। সেদিনও এই কাজটা ও করেছিল। তোমরা মিছিমিছি আমাকে বকলে মারলে।”
“তার মানে?” আমরা আরও অবাক।
“তা হলে বলছি, শোনো।” ঘরের ভেতর এল অভ্র। “বাড়ির ভেতর থাকি আমি আর শুভ্র। শুভ্রর পা আমার থেকে ছোট, তা ছাড়া ঘড়ি পর্যন্ত ওর হাতও পৌঁছয় না। ওকে বাদ দিলে দোষটা আমার ওপরেই পড়ার কথা। পড়লও তাই। মারও খেলাম, বকুনিও খেলাম। কিন্তু সেইদিনই মনে মনে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, দোষীকে আমি হাতেনাতে ধরবই। ভাইদাদার পা আর আমার পা একই মাপের। আমি যদি এ-কাজ না করে থাকি তো করলে সেই করবে। কারণ আমাদের ঘরে একমাত্র সে-ই যাতায়াত করে। আজ তোমরা বেরিয়ে যাবার পর ক্যারাম খেলতে খেলতে জলতেষ্টা পেয়েছে বলে একবার ওপরে উঠে এলাম। আসার সময় রান্নাঘর থেকে লম্ফটা জ্বেলে আনলাম। দরজার কড়া দুটোয় লম্ফর শিখাটা ধরে ভুষো ধরালাম। জানতাম ঘরের শেকল খুলতে গেলে ভাইদাদাকে কড়াটায় বাঁ হাত লাগাতেই হবে। লাগালও তাই। খেলতে খেলতে খানিক পরে ভাইদাদাও জল খাবে বলে ওপরে উঠে এল। একটু পরে যখন নীচে গেল, আড়চোখে ওর বাঁ হাতের আঙুল লক্ষ করতেই দেখলাম ভুষোর দাগ। বুঝলাম দরজা খুলেছিল ও। জলের কুঁজো তো বাইরে দালানে থাকে, তার জন্যে দরজা খোলার দরকার কী? বুঝতে পারলাম ওর উদ্দেশ্যটা কী?”
জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না, “কিন্তু হঠাৎ রোজ রোজ এইরকম কাজ করার কারণটা কী?”
“কারণ আর কিছুই নয়, আমাকে মার খাওয়ানো। সেদিন ওদের টিম আমাদের টিমের কাছে হেরে গিয়েছিল যে!”
মনে মনে অভ্রর বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না। অরূপকে সঙ্গে সঙ্গেই ডাকা হল। প্রথমটা একটু থতমত খেল, কিন্তু পরক্ষণেই এক মুখ হেসে ফেলল দাঁত বার করে। সরল, নিষ্পাপ, কিন্তু দুষ্টুমিতে ভরা।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৮২
অলংকরণ: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়