অভিশপ্ত হাত – আনন্দ বাগচী
বিজন কার্টুন আঁকত না আমরা জানতুম। কিন্তু প্রিন্সিপাল সেকথা বোঝেননি। তিনি বিজনকে ভুল বুঝেছিলেন। আর তাই আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরুবার আগেই তাকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল।
বিজনকে এককথায় চেনাতে হলে তাকে থট পেইন্টার বলতে হয়। কিন্তু এই সহজ সংজ্ঞাটা অনেক পরে জেনেছি আমরা। তার জীবিতকালে তাকে চিনেছিলাম প্রতিভাবান বলে। অসাধারণ বলে।
অসাধারণ হলেও বিজন আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আমার আর পরেশের। আমরা ছিলাম আর্ট কলেজের সাধারণ স্তরের ছাত্র। বছর বছর যেমন দলে দলে ডিগ্রী নিয়ে বেরোয়। বর্ণ-পরিচয় এবং রেখার জ্ঞান আমাদের আর পাঁচটা ছাত্রছাত্রীর মতই হয়েছিল। আমরা যা দেখতাম তাই আঁকতে পারতাম। কিন্তু তার বেশি নয়। শিল্পের ব্যাকরণ আমরা আয়ত্ত করেছিলাম, রঙের সন্ধি আর সমাস আমাদের জানা ছিল এবং শরীরতত্ত্ব বা অ্যানাটমি ছিল নখদর্পণে। অর্থাৎ তুলিকলমের ডগায়। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।
আর বিজনের হাত ছিল অন্য ধাতুতে গড়া। সে চক্ষুষ্মান ছবি আঁকিয়ে ছিল না। তার তুলি ছিল তীক্ষ্ন এবং অসাধারণ, চোখের সাহায্য ছাড়াই ছবি ফোটাতে পারত। তার মানে এই নয় যে, সে চোখ বুজে ছবি আঁকত। তার মানে এই, মনে হত এক অন্ধ আবেগে ভেতর থেকে বিজনের ছবি আসছে। ডার্ক রুমে বসে আলোকচিত্রশিল্পী যেমন করে তার নিকষতম নেগেটিভ থেকে ছবি বার করে আনে।
কলেজ থেকে বেরিয়ে দেখলাম, নিছক শিল্পচর্চা করলে পেট ভরবে না। বাংলা দেশে ছবি আঁকিয়ে-কে কেউ বসিয়ে খাওয়াবে না। ফাইন আর্টস ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। তাই প্রকাশক আর সম্পাদকদের দরজায় দরজায় ঘোরাফেরা শুরু করলাম। গল্প উপন্যাসের ছবি আঁকার কাজ যদি পাওয়া যায়। কিছু কিছু ঘনিষ্ঠতাও হল। কোন কোন লেখক ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কাজ পছন্দও করতে লাগলেন। কিন্তু সে শুধু আমার আর পরেশের, বিজন বেচারী কোণঠাসা হয়ে পড়ল। আমরা সামান্য যা রোজগার করি বাসাভাড়া দিয়ে তাইতেই কোনমতে দিনগুজরান হয়। উড়োন চড়ুইয়ের দল। ইঁটের কোটরে বাসা, খাই হাত পুড়িয়ে। পিছুটান বলতে কিছু নেই। কোন কোন দিন পকেটে পাই পয়সাটাও তলানি পড়ে থাকে না। ধর্মতলা কলেজ স্ট্রীট পায়ে হেঁটে দুপুরগুলো কাটে, লন্ড্রির পয়সা নেই হয়তো, চারমিনার নিভিয়ে নিভিয়ে খাই, এককাপ সস্তা চায়ের জন্যে প্রায় চাতক হয়ে থাকি।
আবার হঠাৎ কাজ এসে যায় হাতে। সঙ্গে সঙ্গে আকবর বাদশা। তখন কে কাকে কেয়ার করে। নতুন তুলি কেনা হয়, রঙের টিউব। দু’চারদিন গোল্ডফ্লেকের ধোঁয়ায় মেজাজ প্রসন্ন থাকে। রেস্তোরাঁর কোণে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা হয়। একটা ছবির একজিবিশন ঝোলাতে পারলে কেমন হয়! যাতে থাকবে এই যুগের যন্ত্রণা আর স্বপ্ন। নতুন এক্সপেরিমেন্ট, নতুন কিছু কেরামতি। আর সেই আর্ট একজিবিশানে বিজন আমাদের অ্যাসেট। আজকের দিনের গোলা দর্শক তার ছবির মধ্যে রেখা রঙের গোলোকধাঁধার মধ্যে, খুঁটে খাবার দানা পাবে না নিশ্চয় এবং তার উদ্ভট চিন্তাকে পাগলামি ছাড়া অন্য কিছুও ভাববে না। কিন্তু কলারসিক, যোগ্য সমজদার লাখে কি আর দু-চারটে বেরোবে না! এদেশ বলেই আশঙ্কা, নইলে হত ইউরোপ কি আমেরিকা, বিজনের চিন্তার মূল্য নিশ্চয়ই মিলত।
কিন্তু একজিবিশান অনেক টাকার ধাক্কা। ফুটপাথের রেলিঙে ছবি ঝুলিয়ে কোন লাভ হবে না আমরা জানতুম। তাই স্বপ্নটা দেখা পর্যন্তই, কাজে কলমে এগোত না। কিন্তু তবু আমরা ধীরে ধীরে জীবন সংগ্রামে তলিয়ে যাচ্ছিলাম না। এক এক ধাপ করে উঠছিলাম।
বছর খানেক পত্রপত্রিকায় কাজ করলাম, কভার আঁকলাম, কিন্তু দেখলাম লেখকদের চেয়েও আমাদের অবস্থা অতি দীন। আমরা ছবির জন্য সামান্য পারিশ্রমিক পাই। আমাদের ছবির সংস্করণ বা মুদ্রণ ঘটে না। একবার ছাপা হলেই ফুরিয়ে যায়। না গেলেও দ্বিতীয়বার তার জন্যে আমরা টাকা পাই না। এবং নামও। এক কোণে একটি সংকেত অক্ষর ছাড়া আমাদের স্বাধিকার ঘোষণার কোন উপায় থাকে না।
ভেবে দেখলাম কমার্শিয়াল আর্টেই যখন জীবিকা বাঁধা রয়েছে, তখন আর নিজেদের মানসম্মান খুইয়ে পস্তাই কেন! একটা স্টুডিও গাড়তে হবে, একটা অফিস সেই সঙ্গে। তাছাড়া বিজনের কথাও ভাবতে হবে। ও এমনই খাপছাড়া যে ও কোনদিন এই সাধারণভাবে নিজের অন্নের সংস্থান করে নিতে পারবে না। সেদিকে ওর ভ্রূক্ষেপও নেই।
আমি আর পরেশ অনেক ঘোরাঘুরি করে দুটি ইউরোপীয়ান ফার্মে কাজ যোগাড় করে নিলাম। মাইনে ভাল, কাজও কম। সৌভাগ্য দেখা দিল এতদিন পরে। এইবার একটা কিছু করা যাবে। অন্তত স্টুডিও, অন্তত একটা অফিস। ভাবলাম আমরা। বিজ্ঞানের উৎসাহও কম নয়। কতদিন রঙ খরচ করার মত কাগজ কিনতে পারেনি বেচারা। ছবি আঁকার চর্চা প্রায় বন্ধের দাখিল। এইবার আর যাই হোক তুলিকলমে কিছু চিন্তা করতে পারবে ও, কিছু নতুন চিন্তা, সেই সঙ্গে আমাদের স্বাধীন ব্যবসাও চলবে কো-অপারেটিভ বেসিসে।
অনেক খুঁজে খুঁজে পার্ক স্ট্রীটে একটা ফ্ল্যাট বার করল পরেশ। এ বিষয়ে তার জুড়ি নেই। চারতলায় ঘরগুলো, তা হোক। প্রায় তিন দিক খোলা। নতুন ধাঁচের বাড়ি। ট্রাম হাতের কাছে, বাসও। আবার সেই সঙ্গে নিরিবিলিও। ভাড়াটা একটু বেশিই, তা হোক। এটা আমাদের কেবল পেশাঘর নয়, নেশার জায়গাও বটে। আর তাই এমনিই একটা ফ্ল্যাটের প্রয়োজন আমাদের ছিল, যেখানে বসে কাচের বিরাট জানলা দিয়ে সূর্যাস্তের সমারোহ দেখতে পাওয়া যাবে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পশ্চিমে যে সূর্য প্রতিদিন অফিস ছুটির পর অস্ত যায়; যে গোধূলি দেখা যায় আউটরাম ঘাটে।
আমাদের এই চিত্রপ্রতিষ্ঠানটির নাম দিয়েছিলাম ‘ক্লোজআপ’। নামটা অনেকদিন থেকেই মনের মধ্যে ছিল, এবার সাইনবোর্ডে আর লেটার হেডে বসল। আমাদের তিনজনের মধ্যে যে নিগৃঢ় অন্তরঙ্গতা, যে বন্ধুত্ব এবং যে আদর্শ আমাদের জীবনকে এত অর্থনৈতিক দুর্যোগের মধ্যেও উর্ধ্বমুখী করে রেখেছিল, তাকে সার্থকভাবে বোঝাতে গেলে এই নাম দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এবং সেই সঙ্গে আমরা পোরট্রেট-এবং অয়েল-পেন্টিং এবং ফ্রেস্কোর কাজ করতাম তার নিশানা দেওয়া ছিল। বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকার কাজই ছিল মুখ্যত প্রধান, সুতরাং ব্যবসায়িক স্বার্থকে ক্লোজআপে ধরে দেবার দায়িত্বও আমাদের তুলিকলম গ্রহণ করেছিল। যাই হোক, বিনা সমারোহে ক্লোজআপের প্রতিষ্ঠা হল।
বিজনের কাছে থাকে ফ্ল্যাটের চাবি। সে যথাসময়ে এসে স্টুডিও-অফিস খোলে। দুপুরটা পার করে দেয়, বিকেল নামে, আমরা অফিস থেকে আড্ডাখানায় ফিরে আসি। দিনের খবর নিই, গল্প করি, খাবার খাই। তারপর নতুন উদ্যমে স্টুডিওতে গিয়ে বসি। প্রথম প্রথম ফাঁকা; কোন কাজ কর্ম আসে না। নিজেরা বাইরে থেকে যা জুটিয়ে আনি, সেই সব স্কেচ-ড্রইং হয়, বাইরে থেকে কোন পার্টি এসে আমাদের ফ্ল্যাটে ওঠে না।
এক শনিবারের কথা স্পষ্ট মনে পড়ছে। অফিস থেকে সকাল সকাল স্টুডিওতে ফিরছি আমি আর পরেশ। চারতলায় উঠে দেখি অফিসঘরে দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন, কিন্তু বিজন নেই। স্টুডিও ঘরে গিয়ে দেখি তাজব কাণ্ড। এক বিরাট বপু ভদ্রলোক মুখে হাসি ফুটিয়ে বসে আছেন আর বিজন তাঁর ছবি আঁকছে।
ইজেলে গিয়ে উঁকি মারার ইচ্ছে প্রচুর হলেও আমরা ফিরে এলাম অফিসঘরে। বসে থাকা লোক দুটির সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, কোন একটা ছোটখাটো কোলিয়ারির ম্যানেজার এসেছেন নিজের অয়েলপেন্টিং করাতে। কাগজে আমাদের বিজ্ঞাপন দেখেই আসা। তাছাড়া এদিকেই কাজের প্রয়োজনে তাঁদের আসতে হচ্ছে কয়েক দিন ধরে।
আধঘণ্টাটাক পরে আমাদের শাঁসালো খদ্দেরটি, সদলবলে চলে যেতেই আমরা ছুটলাম বিজনের ইজেলের দিকে। বিজন তখন তার রঙমাখা পাঞ্জাবি, পায়জামা পরেই ইজিচেয়ারে বসে রেস্ট নিচ্ছিল। মুখটা গম্ভীর। ইজেলে একটা মানুষের কুয়াশা ধরা দিয়েছে। আবক্ষ হবি হবে বোঝা গেলেও, সবটা তখনো আঁকা পড়েনি। রঙ তখনও স্পষ্ট হয়নি, রেখাগুলো অর্থহীন কাঠামোর মত বিভ্রান্ত। কোথাও কোথাও ফ্যাকাশে রঙের ছোপ পড়েছে, যেগুলোকে শিল্পী টেনে নিয়ে যাবে, বিস্তার দেবে, রেখার মোড় ফেরাতে সাহায্য করবে। কোন কোন পুঞ্জীভূত অন্ধকার থেকে আলো আসবে। একটি মানুষের দেহের জন্ম হচ্ছে, হতে যাচ্ছে; তারই যন্ত্রণা ক্যানভাসের ওপরে তালগোল পাকিয়ে আছে, মেঘলা করে আছে সমস্ত পটভূমিকা।
কোলিয়ারির মালিকের চেহারার কোন ইঙ্গিত পেলাম না যদিও, নাক, মুখ, কান, চিবুকের স্থূলত্ব, কপালের ঢেউ সমস্ত কিছুই ছড়িয়ে আছে ইতস্তত, এই প্রথম দিনে তাই থাকে, ভ্রূণাক্ষরে এমনিই হয়ে থাকে খানিকটা, তবে এ যেন খানিকটা বাড়াবাড়ি।
বিজনের অন্যমনস্ক ঠোঁটের মধ্যে একটা গোল্ডফ্লেক গুঁজে দিয়ে আগুন ছুঁইয়ে দিয়ে বললাম, ‘রেঞ্জের মধ্যে তাহলে এসে গেল?’
ধোঁয়ার কুণ্ডলী হাতের বাতাসে সরিয়ে দিয়ে বিজন বলল, ‘ক্যারেক্টার এসে গেছে। লোকটা একটা আস্ত কোলাব্যাঙ।’
জানলা দিয়ে অনেক দূরে তাকিয়ে থাকল। পরেশ আমার মুখের দিকে তাকাল জিজ্ঞাসু চোখে। কিন্তু ব্যাপারটা আমিও সঠিক বুঝতে পারিনি তখনো। সাংসারিক প্রশ্ন করলাম বিজনকে, ‘টাকা পয়সার কথা কিছু বলেছিস, না শেষ পর্যন্ত ব্যাঙের আধূলি ভক্ষণ হবে?’
বিজন, তখনও যেন অন্য জগতের অধিবাসী। ধূসর গলায় বলল, ‘পাঁচশ টাকা, তিনশ আগাম দিয়ে গেছে, এই নে—’
পাঞ্জাবির পাশ পকেট থেকে তিনখানা নোট কাঁচা শালপাতার মত আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। টাকাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আমি চিন্তিত গলায় বললাম, ‘একটু সাবধানে ছবিটা আঁকিস, পাগলামো করিস না। খদ্দের…’
‘প্রভুর সমান!’ পরেশ রসিকতা করে জুড়ে দিল।
বিজন কোন কথা বলল না উত্তরে। অনেকক্ষণ পরে কেবল বলল—‘ছবি ভেতরের জিনিস।’
কিন্তু এই ভেতরের জিনিস আমাদের অনেক ভুগিয়েছিল। প্রথম দিনের সূচনা বহুদিনের জের টেনেছিল। ভদ্রলোকের অয়েলপেইন্টিং আঁকা হয়েছিল যথাসময়ে, কাজে কুঁড়েমি ছিল না বিজনের। ওর হাত খুব দ্রুত। তুলিকলমের ডগা ওর মনের মতই, একটুও কাঁপে না। তাই ছবি, সম্পূর্ণ হতে দেরি লাগেনি। ছবি আঁকা হল, ভাল প্যাকিংয়ে ডেলিভারি গেল, আমি পরেশ কিছুই জানি না, কিন্তু সপ্তাহখানেক পরে ফেরত এল, কদর্যভাষায় একখানা চিঠিও তার সঙ্গে, তখন সবকিছু আমাদের চোখে পড়ল।
ভদ্রলোকের দিক থেকে কোন দোষের কিছু দেখি না। কেউ নিজের অয়েলপেইন্টিং বাঁধাতে গিয়ে একটা কোলাব্যাঙের ছবি নিশ্চয়ই দেওয়ালে যত্ন করে টাঙাবে না। বিজন যে ভদ্রলোকের ছবি না এঁকে জলজ্যান্ত একটি ব্যাঙের ছবি এঁকেছিল তা নয়, একটি হুবহু মানুষের ছবির মধ্যে একটি ব্যাঙের মূর্তিকে মিশিয়ে দিয়েছিল আশ্চর্য কৌশলে। দুটো রূপ একসঙ্গে দেখা যেত না। মনে হত মানুষটার মধ্যে থেকে একটা অশরীরী আত্মা ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভদ্রলোকের সমস্ত ক্যারেক্টার অবয়বহীন হয়ে একটি অকৃত্রিম ব্যাঙে পরিণত হয়ে ওঠে।
পাঁচশ টাকা আবার ফেরত দিতে হয়েছিল মানে-মানে। কিন্তু ছবিটা নষ্ট করা হয়নি, আমাদের স্টুডিও গুদামে জমা হয়েছিল।
বিজনকে বললাম, এ তুই কি করলি?
বিজন ক্লান্ত বিষন্ন ভঙ্গিতে চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে বলল, আমার কিছু করার থাকে না রে, আমার অভিশপ্ত হাত—
কান্নার মত করুণ শুনিয়েছিল সেদিন বিজনের কথাগুলো, বিশেষ করে বিজনের গলার স্বর। তাতে আমরা কেউ কথা বলবার ভাষা খুঁজে পাইনি। শুধু পিঠে হাত রেখে বলেছিলাম, ঠিক আছে, কমার্শিয়াল রাস্তা তোর নয়। তোর যা মন চায় তুই আঁক, স্বাধীনভাবে আঁক।
বুঝেছিলাম বিজনের রক্তের মধ্যেই পাগলামির বীজ রয়েছে। ইনস্যানিটি প্রতিভার একটি লক্ষণ। সাধারণ হওয়া আর অসাধারণ হওয়ার মধ্যে যে সীমারেখা তা অপ্রকৃতিস্থতার। বিজনের মা রাঁচীর মেন্টাল হস্পিটালে মারা গেছেন। বিজনও মারা যাবে। এই অন্ধ, অন্তর্ভেদী রঙ আর রেখার স্রোতের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে ও মারা যাবে। উপায় নেই, নিয়তি কেন বাধ্যতে।
আর্ট কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। মিউজিয়ামের আশপাশ দিয়ে যখন হেঁটে বেড়িয়েছি, যখন চৌরঙ্গীর জনসমাগমের মধ্যে আমাদের চোখ তিনটে রঙের তুলির মত ঘুরে বেড়িয়েছে, সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। যখন আমাদের স্টাডির বিষয় ছিল ফুচকাওলা, বুটপালিশ ছোকরা, দেহাতি মেয়েপুরুষ, প্রেমিক-প্রেমিকা, বেওয়ারিশ কুকুর, ফেরিওলা, বাসের জানলায় বসা বাসবদত্তা। যখন আমরা প্রকৃতির ছবির সঙ্গে সঙ্গে, ল্যাণ্ডস্কেপের পাশাপাশি অগণিত মানুষের চলন্ত স্কেচ এঁকেছি। যখন জাহাজ ঘাটে, ডকে মেহনতি মানুষের মিছিল ফুটে উঠেছে।
প্রায়ই এমন হত, বিজন চাপা গলায় বলে উঠত, দ্যাখ দ্যাখ, একটা ক্যাঙারু আসছে। —কিংবা বলত,—বক দেখেছিস?
দেখতাম। বলাই বাহুল্য পশু বা পাখি নয়। মানুষ। তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত তাই মনে হত। দেখতাম, কখনো হুড খোলা ঝরঝরে মোটর, কখনো মুখ তোবড়ানো লরি হেডলাইট সুদ্ধু এক একটি যান্ত্রিক মূর্তি ফুটে উঠত মানুষের মুখে। অবাক হতাম। কখনো বা দ্রুত চলন্ত গাড়িগুলিকে সনাক্ত করে যেত বিজন এক-এক চরিত্রের মানুষের ভূমিকায়। কখনো বলত, ঝুনঝুনওয়ালা চলেছেন, এই যে প্রফেসার, হাতুড়ে বদ্যি চলেছে, আহা ইন্সিওরেন্সের দালাল ইত্যাদি।
ছেলেমানুষী বলে তখন উড়িয়ে দিতে পারতুম না বিজনের রানিং কমেন্টারী। আজ সেই কথাই মনে পড়ল। বিজন যেন সেদিনের মন্তব্যগুলোই কাগজে-কলমে ধরতে শুরু করেছে। ডুয়েল পার্সোনালিটির মতই মানুষের দৈহিক দুটি রূপ আছে। একটিতে তার জীবন, অন্যটিতে তার চরিত্র।
কিন্তু তখনও বুঝিনি বিজনের হাতের আঁকিবুকি জ্যোতিষীর মত মানুষের মনের গহনের পরিষ্কার মানচিত্র বলে দেয়। মানুষের চিন্তা, মানুষের অন্তস্থলের বাসনা তার তীক্ষ্নধী রেখায় অঙ্কের মত নির্ভুল প্রতিবিম্ব রচনা করে। ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মত তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি তখনও আমাদের খেয়াল হয়নি। কিন্তু না হলেও, বিজন থট্ পেইন্টার ছিল, সে বিষয়ে কোন ভুল নেই। জাতিস্মরের মতই সে জন্মগত প্রতিভা নিয়ে এসেছিল আমাদের মধ্যে, আমরা তার অতিলৌকিক ক্ষমতাকে ইনস্যানিটি বলে ভুল করেছি।
আমাদের ‘ক্লোজআপ’ শেষ পর্যন্ত কিন্তু দাঁড়িয়ে গেল। প্রথম দিকে দু’চারটি ধাক্কা যা এসেছিল, বিজনের জন্যই এসেছিল, সেগুলি সামলে নিতে আমাদের বিলম্ব হল না। তারপর কাজ আসতে লাগল, প্রায় হু-হু করেই আসতে লাগল। আমাদের অফিসে ফোন বসল, স্টেনো এল, বেয়ারা রামসদয় দরজায় মোতায়েন হল। বড় বড় কনসার্ন আমাদের দিয়ে বিজ্ঞাপনের লেআউট করাবার জন্যে টেলিফোনে ধর্না দিতে থাকে। আমি আর পরেশ দু’হাতে সামলে উঠতে পারি না। বিজনকে দিয়েও কিছু কিছু কাজ যে না করানো হয় তা নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ কোন দায়িত্ব তার কাঁধে চাপাতে ভরসা হয় না। কারণ আমাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম এখন এমন এক পর্যায়ে উঠেছে, যেখানে সবসময়ে সতর্ক সন্ত্রস্ত থাকতে হয়।
দিনের পর দিন এমনিভাবে চলছিল। স্কেল, কম্পাস, তুলি, প্যালেট, কলম টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে, রাশি রাশি স্কেচ পেপার আর ড্রইংয়ের মধ্যে ডুবে গিয়ে, ঢাকা ল্যাম্পের আলোয় চোখের দৃষ্টিকে তীক্ষ্ন করে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, হাত চলেছে ক্ষিপ্র গতিতে। ইজেলের সামনে বসে ক্যানভাসে পিন আঁটতে আঁটতে আমাদের খেয়াল থাকেনি বিজনের কথা। একবারও মনে হয়নি বিজন আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, ক্রমশ দূরে, অনেক দূরে। স্বাভাবিক জীবন থেকে অন্যদিকে, অন্য কোনখানে।
হয়তো আমাদের অজ্ঞানচেতন অবহেলায়, নয়তো বা নিজের অক্ষমতায় আত্মধিক্কারে বিজন আরও অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। ‘ক্লোজআপে’ এখন কেবল কাজ আর কাজ, পয়সা আর পয়সা। সেই সান্ধ্য আচ্ছা, সেই গোধূলি-আকাশ দেখার মেজাজ হারিয়ে গেছে কোনকালে। এখন কেবল বিজনেস-টক আর তারই সিক্রেট নিয়ে মাথা ঘামানো।
বিজন অফিসে নিয়মিত আসে না, দেখা ক্বচিৎ কদাচিত হয়। সিঁড়িতেই বেশির ভাগ সময়। উস্কোখুস্কো চুল বিজন চলেছে আধময়লা পোশাক, পাঞ্জাবির কোণায় রঙের ছিটে। পকেটে গোটাকতক তুলি, হাতে স্কেচের খাতা। ভাল করে কথাই হয় না। কখন খায়, কখন ঘুমোয়, কোথায় বেড়ায় খবর রাখা হয়ে ওঠে না।
কিন্তু খবর বাতাসে ভেসে আসে কখনো কখনো। যেমন বিজনের কথা ক্রমে ক্রমে শুনতে পেতে থাকলাম। এমন সব পাড়ায় বিজনকে দেখা গেছে যা খুব শোভন নয়, সম্মানের নয়। আর্টিস্টের কোন জাত নেই। কিন্তু তা বলে ছবি আঁকার নেশায় জীবনকে বিপন্ন করার কোন মানে হয় না।
নিশীথ নগরী কলকাতা। দুপুর রাত থেকে রাত শুরু হয় এমনও জায়গা আছে। এমন হোটেল পানশালা আছে যার খবর প্রয়োজনের লোক ছাড়া রাখে না। ছবি আঁকার মালমশলা খুঁজতে বিজন সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের জানা ছিল না।
পা টিপে টিপে যেখানে রাত্রি নামে। জীবন বাজী রেখে যেখানে চলে জুয়ার বেসাতি। বিদেশী চিত্রশিল্পীদের জীবন-কাহিনী আরব্য-উপন্যাসের মত। তুলির পাশাপাশি তাদের তরোয়াল খেলা করেছে। মদে আর রক্তে যারা রঙ গুলে ছবি এঁকেছে সেইসব বেদুইন চরিত্রের ছবি আঁকিয়ের দলে কি শেষ পর্যন্ত আমাদের কপর্দকশূন্য নিরীহ বিজন নিজের নাম লেখাল।
ন্যূড স্টাডিতে মন দিয়েছে বিজন। তার ছবির খসড়ার বিপুলায়তন অ্যালবামখানা খুলে সেদিন টের পেলাম। নারীমূর্তিগুলি কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে, কেউ নাচের মুদ্রায়। কিন্তু তাদের মুখ ঝাপসা। চেনার উপায় নেই। কালনাগিনীর ফণার ঝাপট যেন। ধারাল চাবুকের মত এক একটি রেখার আঁচড়। বিজনের হাত এত ক্ষিপ্র, বিজনের চোখ এত ধারাল, বিজনের বুকে এত জ্বালা, জানা ছিল না।
বিজনের হাতের রেখা বদল হয়েছে মানতেই হবে। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকলেও বিজন যন্ত্রণায় জ্বলছে, প্রতিঅঙ্গ দিয়ে জ্বলছে, টের পাওয়া যায়! আমি আর পরেশ খানিকটা শিউরে উঠলাম। এই যৌবন যন্ত্রণা আমাদের মধ্যে সুপ্ত ছিল একবয়সে, কিন্তু প্রকাশের পথ পাইনি। যখন চারমিনার নিভিয়ে নিভিয়ে খেতাম, যখন লন্ড্রীর বিল মেটাবার সাধ্য আমাদের থাকত না অনেক সময়েই।
বিজন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, ধ্বংসের দিকে প্রলয়ঙ্কর জলপ্রপাতের মত ছুটে চলেছে টের পেলাম। বেদনা বোধ করলাম মনে মনে।
তিনবন্ধুর একজন, যার ওপর আমাদের সবচেয়ে আশা-ভরসা ছিল, না, কমার্শিয়াল দিক থেকে নয়, বিশুদ্ধ শিল্পের দিক থেকেই। ভেবেছিলাম, বিজনের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ক্রমে চিত্রকলার মধ্যে একটি অভূতপূর্ব দার্শনিকতা এনে দেবে। কিন্তু কোথায় কি! রক্তমাংসের জগতে, হিংসা-হননের মধ্যে, ক্লেদপঙ্কিল সামাজিক অপভ্রংশের মধ্যে বিজন জেগে উঠেছে।
আমাদের থ্রি-ইউনিটি, ভেঙে গেল এতদিন পরে। কক্ষচ্যুত উল্কার মত ছিটকে গেল বিজন। ফ্ল্যাটের চাবি তার কাছেও আছে একটি। গভীর রাতে হয়তো আসে সেখানে; যখন আমরা উত্তর কলকাতার বাসায় ফিরে ঘুমের তলায় তলিয়ে যাই। শীতের রাতগুলো এমনি করে পার করে দিচ্ছিল বিজন। মধ্য কলকাতার দু’একটি রাস্তায় তার ছবির মোবাইল একজিবিশান হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। দেখিনি, খবর পেয়েছি। কিছু কিছু ছবি নাকি বিক্রিও হয়েছে।
সস্তায় স্কেচ বিক্রি করছে বিজন। কখনও শুনি অদ্ভুত ধরনের মেয়েদের সঙ্গে তাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে শহরের বিভিন্ন জায়গায়। রাত্রে শোবার সময়, ঘুমের আগে ওর কথা মনে পড়ত ভীষণভাবে, কিন্তু দিনের বেলায় অসংখ্য কাজের চাপে কোথায় হারিয়ে যেত বিজন। তাকে খোঁজবার কথা মনে থাকত না।
অপ্রত্যাশিতভাবে আমি বিজনকে ধরে ফেললাম একদিন, একেবারে কিম্বদন্তী সুদ্ধু। আমি বসেছিলাম পর্দা-ফেলা একটি রেস্তোরাঁ-কেবিনের মধ্যে। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, তাই একটু আগেই এসে বসেছিলাম! মেনু-কার্ড পড়ে সময় কাটাচ্ছিলাম এমন পাশের কেবিনে কথা শুরু হল। প্রথমটা কান দিইনি, তবু কানে এসেছিল! পরে উৎকর্ণ হয়ে সমস্ত কথাগুলিকে প্রায় গিলতে বাকী রেখেছিলাম।
‘তোমার ছবিটা ইদানীং বড় ট্রাবল্ দিচ্ছে।’
‘কোন্ ছবিটা?’
‘যেটা একজিবিশান থেকে কিনেছিলাম।’
অপরপক্ষ অনেকক্ষণ চুপচাপ, যেন ছবিখানাকে মনের মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল এতক্ষণ।
‘সেই পেঁচার ছবিটা?’
‘আহা, আর ক’খানা কিনেছি, বল তো—’
‘কেন, সেই ছবিটা আবার কি করল?’
নারীকণ্ঠ এবার একটু উত্তেজিত মনে হল। বলল, ‘প্যাঁচাটার জ্বালায় রাতে আমি ঘুমোতে পারিনে!’
বিজনকে এবার স্পষ্ট চিনলাম। তার গলা এবং বিষয়বস্তু এক হয়ে গেল, বলল, ‘সো সরি! ওটা একটা অভিশপ্ত ছবির নকলে এঁকেছিলাম। একটা ফরাসী ছবি, ভ্যামপেয়ারের আত্মাকে আমাদের দেশী কালপেঁচার শরীরে চালান করতে চেয়েছিলাম, পেরেছি মনে হচ্ছে।’
‘তোমার সৃষ্টির জন্যে তোমার আনন্দ হচ্ছে কিন্তু আমার অবস্থা অত্যন্ত কাহিল, কি কুক্ষণে যে ছবিটাকে পছন্দ করেছিলাম, উঃ, ভাবতেও গা-টা শিউরে ওঠে। আজ তিনদিন রাত্রে ঘুমোতে পারি নি, জানো?’
মনে হল, অপরপক্ষ নীরবে তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু চোখে। কারণ ভদ্রমহিলার গলা শোনা গেল আবার:
‘ছবিটাকে শোবার ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়েছিলাম। পেঁচাটাকে প্রথম থেকেই অত্যন্ত জীবন্ত মনে হয়েছিল কিন্তু রাত্রে যে সেটা কি পরিমাণ জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি কখনো। শোবার আগে রাত্রে জামাকাপড় পরতে পরতে হঠাৎ নজরে এল ছবিটা। মনে হল দেয়ালের গায়ে নিশাচর পাখিটা অদ্ভুত উপায়ে বসে আছে, দুটি চোখ আমার দিকে। এক্ষুনি উড়ে এসে আমার গায়ে বসবে। কেন যে এমন ধারণা হল জানি না। আমি ভয়ে যেমন তাকাতে পারছিলাম না, তেমনি চোখ ফিরিয়ে নেওয়াও আমার সাধ্যের মধ্যে ছিল না।’
‘কিন্তু পাখিটা তো আর সত্যিসত্যিই উড়ে আসেনি তোমার দিকে, তবে এত ভয় কেন, ছেলেমানুষী ভয়?’
‘একে তুমি ছেলেমানুষী ভয় বলে উড়িয়ে দিতে পার, কিন্তু আমি পারি না। আমার কাছে এ এত সত্য যে, এই যে আমরা দুজনে বসে আছি এ যেমন মিথ্যে নয়, তোমার নাম বিজন তালুকদার যেমন মিথ্যে নয়, তেমনি, এ আর প্রমাণ করতে হয় না।’
‘নার্ভাসনেস্ থেকে এসব ভয় রোগের জন্ম, কিন্তু তোমার নার্ভ এত খারাপ হল কেন বলতে পার?’
‘যা খুশি বল, প্রতিবাদ করব না। তবে এইটুকু অনুরোধ, আমার সবটুকু কাহিনী আগে শোন। কি জানি কেন মনে হচ্ছে একথা বলবার আর সময় পাব না আমি।’
‘কি ছেলেমানুষী হচ্ছে সুপর্ণা, চল এবার ওঠা যাক, নইলে ছবিটা শুরু হয়ে যাবে, ঠিক তিনটে-পনেরয় আরম্ভ—’
‘সিনেমায় যেতে আজ ভাল লাগছে না বিজন, টিকেট তুমি বিক্রি করে দাও। আমার মন আজকে অত্যন্ত অস্থির আছে।’
‘বেশ, কিন্তু তাহলেও তো এখন উঠতে হবে।’
‘আমার কথা তাহলে তুমি শুনতে চাও না, বিজন?’
‘কে বললে, চাই না? শুধু এখন নয়, এই বলেছি।’
‘তোমার পাখি তুমি ফিরিয়ে নাও বিজন, ও রাত্রে আমাকে ঘুমোতে দেয় না। আচমকা ওর ডাকে আমার ঘুম ভেঙে যায়, কি বিশ্রী আর কর্কশ ওর কণ্ঠস্বর যদি শুনতে।’
চেয়ার টেবিলের শব্দ হল, কয়েকগাছা চুড়ি আর শাড়ির একটা মিশ্র আওয়াজ। ওরা উঠে গেল। মেয়েটিকে দেখবার জন্যে মুখ বাড়ালাম, কিন্তু মুখ দেখতে পেলাম না। পিছন থেকে ফিগারটা নজরে পড়ল, লম্বা, ছিপছিপে। কলাপাতা-সবুজ শাড়ি, ম্যাচকরা জামা। আধখানা চাঁদের মত পিঠের ওপরের অংশটুকু অনাবৃত, নিটোলশুভ্র ঘাড়, সতেজ রজনীগন্ধার মত। বিজ্ঞানের পিছু পিছু বেরিয়ে গেল।
একটা নিশ্বাস ফেলে হাতঘড়ির দিকে তাকালাম, চায়ের কাপে দীর্ঘবিস্মৃত চুমুক দিলাম একটা, তারপর দ্বিতীয় দফা মেনুকার্ড পড়তে লাগলাম। বিজন কি এই মেয়েটির প্রেমে পড়েহে? কি জানি, ছবির অ্যালবামের আঁকিবুকির মধ্যে এই তরুণীটিকে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।
তোমার পাখি তুমি ফিরিয়ে নাও বিজন—মেয়েটির করুণ ভাঙা-ভাঙা কণ্ঠস্বর ঘুরে ঘুরে কানের মধ্যে বাজছে। মেয়েটির সমস্যা ভাবার চেষ্টা করলাম, যেটুকু ও বলে গেল। যদি সত্যি হয়, কিন্তু সত্যি হওয়া কি সম্ভব? বিদেশী রহস্য গল্পের মত, কিরকম একটা আধা ভূতুড়ে অবিশাস্য, গন্ধ রয়েছে এর মধ্যে। কুয়াশা আর বরফের দেশে যে প্রেততুল্য অনুভব বেঁচে থাকা সম্ভব, আমাদের বিষুবরেখার দেশে, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির কলকাতা শহরে সেই পশ্চিমী আরব্যরজনী সম্ভব কি? উঁচু গলায় একা একা হাসলাম। বেয়ারা ছুটে এসে পর্দা সরিয়ে বলল, ‘সাব?’
বললাম, ‘কুছ নেই; সব ঝুটা হ্যায়।’
পরের অংশটুকু ও চলে গেলে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট টিকল না। ভদ্রলোকের মুণ্ডুপাত করে উঠে পড়লাম। চায়ের দাম দিয়ে মেট্রোর দিকে পা চালালাম যদিই বিজনের দেখা পাওয়া যায়। কারণ তিনটে পনেরয় একমাত্র ওখানেই ছবি আরম্ভ হয়।
একগোছা নানা ছাঁদের তুলি একটা ফ্লাওয়ারভাসের মধ্যে বসানো ছিল। শিল্পীর ফুলদানি এটিই। শীতের সকালের প্রথম রোদের ছোঁয়ায় যখন তুলির ডগাগুলো নানা রঙের মরশুমী ফুলের মত জ্বলে ওঠে তখন আমি বিছানা থেকে উঠি। জীবিকায় সব খেয়েছে কিন্তু মেজাজটুকুকে অন্তত খেতে পারেনি।
আজও সেই দিকে তাকিয়ে ঘুম ভাঙল। এঘরে ঘড়ি নেই, ঘড়ি রাখিনি, ওয়ালক্লক, টাইমপিস, রিস্টওয়াচ; কিছুই না। চাকর বারবার এসে উঁকি দিয়ে যায়, তুলিতে রোদ লাগলে তবে প্রথম ক্ষেপ চা আসবে। আমি চায়ের প্রতীক্ষা করছিলাম এবং খবর কাগজের, কোনটাই এল না, শুধু খবর এল। ভিজিটিং কার্ড একখানা। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সত্যেন ঘোষাল এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। বিস্ময়ের কারণ বৈকি। যার সঙ্গে যাই থাক, পুলিশ আর ডাক্তারের সঙ্গে আমার কোনকালেই দহরম-মহরম ছিল না। তাছাড়া এই প্রাতঃস্মরণ নিশ্চয়ই কোন জরুরী প্রসঙ্গে। প্রায় ছুটতে ছুটতে নিচে এলাম, চোখে-মুখে জলস্পর্শ না করে।
সাদা ইউনিফর্ম পরা ভদ্রলোকটি তখন আমার বৈঠকখানা-ঘরের দেয়ালের ছবিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। আমাদের তিনজনের হাতের কাজই তিনদিকের দেওয়ালে টাঙানো ছিল। আমার পায়ের শব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি নমস্কার করলেন, ‘সকালে বিরক্ত করতে এলাম, কিছু মনে করবেন না।’
আমি বললাম, ‘আপনি শখ করে যে আমাকে বিরক্ত করতে আসেননি তা জানি, সুতরাং ভণিতার প্রয়োজন কি, কি ব্যাপারটা বলুন তো!’
ভেবেছিলাম ক্ষুন্ন হবেন, কিন্তু না, ভদ্রলোক হাসলেন আমার কথার উত্তরে। পরে আমাকে অবাক করে দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি ওরিয়েন্টাল সেমিনারীর সতু, থার্ড বেঞ্চের ফোর্থ বয়!’
‘সতু, তুই।’ আমি ওর হাতটা সাদরে জড়িয়ে ধরলাম, ‘চেহারার একি পরিবর্তন! সেই ডিগডিগে চেহারা কোথায় লুকিয়ে ফেললি রে! ওঃ, কতকাল তোর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তারপর কোথায় আছিস, কেমন আছিস? চল, চল ওপরে চল—’
‘পনের বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে পৃথিবীর, সত্যেন ঘোষালের সে তুলনায় সামান্যই। তবে অনেকদিন দেখা নেই তাই চিনতে পারিসনি।’
সতুকে ওপরে নিয়ে এলাম। একসঙ্গে চা খেতে খেতে অনেক গল্পই হল। দেখলাম, ও আমার অনেক খবরই রাখে…বিশেষ করে ক্লোজআপ সম্বন্ধে। পরেশ আর বিজনের কথাও জিগ্যেস করল কথা প্রসঙ্গে। জানালাম তারা আমার পার্টনার। থার্ড বেঞ্চের ফোর্থ বয় সম্বন্ধে তাদের কাছেও ইতিপূর্বে গল্প করেছি তা জানালাম। কারণ সতুর ওই নামকরণের পিছনে একটি কৌতুককর ইতিহাস ছিল।
চা শেষ হলে সতু বলল, ‘এবার আসল কথা বলি, আমার সঙ্গে চল একজায়গা থেকে ঘুরে আসবি। নিজের স্বার্থেই তোকে ডাকছি! একটা ইনভেস্টিগেশনে এসেছিলাম এই দিকেই। ব্যাপারটা অবশ্য খুবই স্যাড, তবু তুই গেলে খুশি হব, কারণ তুই একজন আর্টিস্ট।’
‘কারণ আমি আটির্স্ট! তার মানে?’
‘যথা সময়ে এবং যথাস্থানেই বুঝতে পারবি, এখন চল।’
পরেশের ঘুম না ভাঙিয়ে আমি একাই সত্যেন ঘোষালের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। কোন একটা রহস্যজনক কিছু ঘটেছে এ অনুমান করা আমার পক্ষে অসম্ভব হল না। কিন্তু আমার মনের মধ্যে কৌতূহল যতই তোলপাড় করুক, সতু একেবারে নির্বাক। ঘটনাস্থলে পৌঁছবার আগে কিছুতেই মুখ খুলল না।
ঘটনাস্থল বলতে গেলে আমাদের পাড়ার কাছেই। ছোটখাটো একটা তিনতলা বাড়ি। বাইরে থেকে খুব চাপা মনে হয়। তবু খবর চাপা ছিল না। দু-চারজন কৌতূহলী রবাহুতের ভিড় ওই সকালেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল পথের ওপর। দরজায় কনস্টেবল মোতায়েন থাকায় ভেতরে কেউ মাথা গলাতে পারেনি।
দরজার পাহারা আমাদের দেখে সসম্ভ্রমে সেলাম করে পথ ছেড়ে দিল।
ভেতরে একটি ছোটখাটো জনতা। প্রেস ফটোগ্রাফার রিপোর্টার থেকে শুরু করে ডাক্তার, পুলিশের ক্যামেরাম্যান, বাড়ির লোকজন অনেকেই ছিল। দোতলার ঘরের সামনের ভিড় ফাঁক হয়ে গেল আমাদের দেখে। আমি আর সতু ঘরের মধ্যে ঢুকলাম।
দরজার পাশে সাদা-পোশাকে পুলিশের একজন লোক ছিলেন। সতু তাকে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘এনিথিং মোর?’
ঘাড় নেড়ে ‘না’ জানাল লোকটি। ঘরের মধ্যে নজর দিলাম এতক্ষণ পরে। সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলাম।
ঘরখানা ছোট। তার অর্ধেক জুড়ে একখানা পালঙ্ক। সামনে দেয়াল ছুঁয়ে ড্রেসিং-টেবিল। পালঙ্কে ঠেসান দিয়ে একটি মেয়ে বসে আছে মাটির ওপর। মুখে আতঙ্কের চিহ্ন, চোখ দুটি বড় বড় হয়ে বেরিয়ে এসেছে। মুখখানা শঙ্খের মত সাদা। ঘাড়টা একটু কাত হয়ে পড়েছে। ড্রেসিং গ্লাসে ছায়া পড়েছে। একটা পা সামনের দিকে ছড়ানো, হাঁটুর ওপর পর্যন্ত কাপড় উঠে গেছে, অন্য পা মুড়ে বসা। চেহারার ধরন দেখেই বুঝলাম মেয়েটি মারা গেছে।
সতু আমাকে ডেডবডির কাছে ডাকল। এগিয়ে গেলাম। আহা, মেয়েটির চেহারা বড় সুন্দর, ছিপছিপে, লম্বা ফিগার। চুলের রাশ মুখের চারপাশে ছড়ান। শুতে যাবার আগের পোশাক পরা। পায়ের কাছে একখানা বাঁধানো পটের মত কি পড়ে আছে। ঝুঁকে পড়ে ছবিটা দেখেই চমকে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ চমক খেলে গেল। ‘তোমার পাখি তুমি ফিরিয়ে নাও বিজন।’
সতু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, ‘কি হল, এই পেঁচার ছবিটা তুমি চেনো নাকি?’
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘ভদ্রমহিলা কি মারা গেছেন?’
‘অনেকক্ষণ। ছবিটা কার আঁকা জান?’
আমি বললাম, ‘নাম সই নেই?’
‘না। অথচ ছবিটা একটু স্ট্রেঞ্জ। এবং এই মৃত্যুর সঙ্গে হয়তো জড়িত।’
‘কি করে বুঝলে?’
‘হার্টফেল করে মেয়েটি মারা গেছে। চোখে-মুখে উত্তেজনা ও ভয়ের চিহ্ন তো মুছে যায়নি দেখতেই পাচ্ছ। পাশে কাচ-ফাটা অবস্থায় ছবিখানা এই ভাবেই পড়েছিল। তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে এই ভয় পাওয়ার পিছনে ছবিটার কোন ভূমিকা ছিল। দেওয়ালের ছবি মাটিতেই বা পড়তে গেল কেন?’
‘শুধু এইটুকু দেখে তুমি এই সিদ্ধান্ত করছ?’
‘না। মৃতের চোখের দিকে তাকাও। দৃষ্টিটা কোন দিকে দেখ!’
‘দেওয়ালের দিকে, অনেকটা উঁচুতে।’
‘ওখানে কি কিছু দেখতে পাচ্ছ?’
‘কই, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। অবশ্য যদি এই ছোট পেরেকটার কথা তুমি ধর্তব্যের মধ্যে আনতে চাও—’
‘ঠিক তাই। ওই পেরেক এই মৃত্যুর দিকে আঙুল বাড়িয়ে রয়েছে।’
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি নে।’
‘একটু বুদ্ধি খরচ করলেই পারবে। পেরেকটা ভাল করে দেখ তো, ওটা সম্বন্ধে যা যা দেখছ এবং মনে হচ্ছে, বলে যাও।’
আমি কিছুক্ষণ তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম পেরেকটা, তারপর মেয়েটির চোখের দিকে, হাতের দিকে বার-দুই তাকালাম। তারপর একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘পেরেকটা দেয়ালে নন গাঁথা হয়েছে। পেরেকের আয়তন দেখে মনে হচ্ছে কোন ছবি-টবি টাঙাবার জন্যেই ওটিকে পোঁতা হয়েছিল। এবং সম্ভবত পেঁচার ছবিটি ওখানেই ছিল এবং সেই ছবির দিকে মেয়েটি তাকিয়ে ভয় পেয়েছিল। কারণ তোমার ভাষাতেই বলি, ছবিটা একটু স্ট্রেঞ্জ ধরনের। একটু বেশি মাত্রায় জীবন্ত। তাছাড়া চোখের মণিতে যে রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, এই রঙ রাত্রে জ্বলে, তাছাড়া চোখের মণির ইনার্ ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যে দেখলেই মনে হবে মণিটা ঘুরছে।’
‘এক্সেলেন্ট, এইজন্যই তোমাকে এনেছি হে! এবার ছবিটার ইতিহাস বল। ওটা কার আঁকা বলে মনে হয়? নিশ্চয়ই তোমার বা তোমাদের গ্রুপের কারো নয়?’
‘আমার নয় তা আমি জানি। তবে আমাদের গ্রুপের কারো হলেও হতে পারে। এ ধরনের রেখা আর রঙের ব্যবহার আমাদের মধ্যে একজনই করতে পারে, এবং করে থাকেও—এইটুকুমাত্র বলতে পারি।’
‘তাঁর নাম?’
‘বিজন তালুকদার।’ আমি ইচ্ছে করেই গত কালকার কাহিনী গোপন রাখলাম।
‘পার্টনার? মিস্টার তালুকদারকে এখন কোথায় পাওয়া যেতে পারে?’
‘হ্যাঁ, ক্লোজআপ-এর পার্টনার। কিন্তু তাকে কখন কোথায় পাওয়া যাবে আমার পক্ষে বলা শক্ত।’
‘কার কাছে গেলে তবে সঠিক হদিশ পাওয়া যেতে পারে?’
‘কেউই বলতে পারবে না। খেয়ালী মানুষ, সংসারে পিছুটান নেই। তুলি রঙ আর কাগজের মধ্যেই ও নিজের ফ্যামিলি খুঁজে পেয়েছে। ওর আঁকা ছবি নিয়েই ওর সংসার।’
‘স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান। ওঁর সঙ্গে তোমার কত দিনের পরিচয়? ব্যবসা সূত্রে?’
‘ছাত্রাবস্থা থেকেই! কিন্তু ওর সম্বন্ধে তুমি এত কথা জিজ্ঞেস করছ কেন বল তো? ও কিন্তু সত্যিই খুব ভাল মানুষ, আলাপ হলেই বুঝতে পারবে। এবং প্রতিভাবান—’
‘কিছু মনে করিস না,’ সতু আবার সহজ অন্তরঙ্গ সম্বোধনে ফিরে এল, ‘বিজনবাবুকে আমি সন্দেহ করছি না। কিন্তু এই মৃত্যুটা হৃদ্যন্ত্রঘটিত হলেও আমি এর মধ্যে একটু অস্বাভাবিকত্বের গন্ধ পাচ্ছি। আর তাই বিজনবাবুর খোঁজ করছি, যদি তাঁর মুখ থেকে কোন আলোর সন্ধান পাই। আচ্ছা, এই ছবিটায় বিজনবাবু নাম সই করতে ভুলে গেছেন কেন বলতে পারিস?’
‘বিজন তার কোন ছবিতেই নিজের নাম লেখে না। ও বলে, আর্টিস্টের নাম তার রঙ আর রেখাই বলে দেবে, তার চেয়ে দেখার ভঙ্গি। ভবিষ্যতে নামকরা গোয়েন্দা হতে পারবি, ধরনধারণ দেখে এই ভবিষ্যৎবাণী করলাম, মিলিয়ে নিস।’
সতু কৃতার্থের হাসি হাসল, ‘ফরেনে গিয়েছিলাম এই অপরাধ বিজ্ঞানটা হাতে-কলমে আয়ত্ত করতে—তা তোদের আশীর্বাদে দেখাই যাক না কি ফল ফলে—’
আমি বললাম, ‘রসিকতা করছিস না ঠাট্টা করছিস বুঝতে পারলুম না। তবে বিজনকে একটা জায়গায় বোধ হয় এখন পেলে পেতে পারিস। চল, আমি সঙ্গে যেতে পারি।’
সতু লাফিয়ে উঠল, ‘এখুনি এই মুহূর্তে! চল—’
সহকর্মীদের যথারীতি নির্দেশ দিয়ে সতু আমাকে নিয়ে উঠে পড়ল। ওর মোটর-বাইকে করে আমরা পার্ক স্ট্রীটে ক্লোজআপের উদ্দেশে রওনা হলাম। কিন্তু আমাদের ছোটাছুটিই সার হল, কাজআপের ফ্ল্যাট বন্ধ। বিজন সেখানে নেই। বোধ হয় গতরাত্রে শুতে আসেনি।
আমার কাছে চাবি ছিল অফিসের। সতুকে আমাদের স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে বসালাম। এইবার ধীরেসুস্থে ওর মুখে মেয়েটির ইতিহাস শুনলাম। মেয়েটির নাম সুপর্ণা সেন। চিত্রজগতের সাম্প্রতিক আবিষ্কার। অর্থাৎ প্রতিভাবান—ব্যাকরণ ভুল হল—চিত্রতারকা। ওর কোন ছবিই এখনো মুক্তি পায়নি, একসঙ্গে তিনটি ছবিতে কাজ করছিল সুপর্ণা! কোনটি অর্ধেক, কোনটি বার আনা, কোনটি ছ’ আনা মাত্র তোলা হয়েছে। সুতরাং জনাতিনেক প্রোডিউসারকেই সুপর্ণা একেবারে ডুবিয়ে দিয়ে গেল। নায়িকার অকালমৃত্যু অন্তত বাইরের দর্শক বুঝবে না কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে মাত্র মাস দুই আগেও ইন্সিওরেন্সের যে মেডিকেল রিপোর্ট লেখা হয়েছিল, তাতে সুপর্ণা সেনের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত বিবরণ লেখা হয়েছিল, অবশ্য ডাক্তারী ভাষায় যতখানি উচ্ছ্বাসের অবকাশ থাকা সম্ভব।
সুপর্ণা সেন চিত্রতারকা হলেও তার মধ্যে কালচারের চিহ্ন যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। সে লেখাপড়া জানত, অন্তত কলেজের পড়া আর শেষ হয়েছিল। কিন্তু তার প্রাইভেট স্টাডির নতুন করে শুরু হয়েছিল। সত্যেন ঘোষাল নানান রিপোর্ট থেকে এবং সেই প্রোডিউসারদের একজনের হাহাকার বাণী থেকে এই সব তথ্য সংগ্রহ করেছিল। এবং সেগুলি দ্বিতীয় দফা চা-পান করতে করতে আমাকে সমস্তই খুলে বলল।
সংসারে সুপর্ণার এক প্রৌঢ় বয়সী বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান মামা আর এক বিধবা পিসী ছাড়া কেউ ছিল না। এঁরা দুজনেই এই বাড়িতে বাস করতেন। মামা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, কোন খ্যাতনামা ওষুধের কোম্পানীর। রোজগার মোটামুটি ভালই। গান বাজনার দিকে, বিশেষ করে বাজনার দিকে ভদ্রলোকের খুব ঝোঁক। তিনি ভাল ভায়োলিন বাজান, সখের বাজিয়ে হিসেবে কলকাতায় অনেক পাড়াতেই তাঁর নাম আছে। পিসী স্কুল মিস্ট্রেস, কোন কিণ্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে মশগুল হয়ে থাকেন।
তিনজনের মধ্যে সম্পর্ক অতি মধুর ছিল। একসঙ্গে খাওয়া এবং গল্প করা তাঁদের অভ্যাস ছিল। পিসী এবং মামা দুজনেই সুপর্ণাকে নিজের মেয়ের মত ভালবাসতেন। আর সুপর্ণাকে যে দেখেছে সেই ভালবেসেছে (এমন কি বিজনও, আমি মনে মনে বললাম)। বাড়িটা সুপর্ণার বাবার। ব্যাঙ্কে কিছু গচ্ছিত অলঙ্কার এবং অর্থও রয়েছে, সুতরাং সে পরমুখাপেক্ষী ছিল না।
অভিনয়, গান, বাজনা, আবৃত্তি ইত্যাদির দিকে তার ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব দেখিয়ে অনেক পুরস্কার পেয়েছে স্কুল জীবন থেকেই। এছাড়া আর একটি গুণ ছিল তার, লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি আঁকত। সাহিত্যের প্রতি যেমন অনুরাগ ছিল, তেমনি চিত্রকলা সম্বন্ধেও। এই প্রসঙ্গেই অনেক গুণী এবং অপগুণীর সমাগম হত মাঝে মাঝে। অনেকসময় অনেক অসুবিধের মধ্যেও পড়তে হয়েছে তাকে এই গুণমুগ্ধতার জন্যে। সব শেষে একটি যুবক খুব আসা যাওয়া করত, সুপর্ণার মামার অভিমত অনুযায়ী একটু অদ্ভুত গোছের লোক। ছেলেটি চিত্রকর, প্রচলিত ধরনের চিত্রকর নয়। অনেকদিন মুখোমুখি দেখা হয়েছে তাঁর, কিন্তু ছেলেটির নাম জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। তবু এই ছেলেটিই যে বিজন তা অনুমান করতে আমাদের বিশেষ কষ্ট হল না।
বিজনের পরিবর্তন সম্বন্ধে আমি সতুকে কিছু-কিছু তথ্য দিলাম। তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সমস্ত কেসটাকে তুই কোন দিক থেকে দেখছিস বল তো? আর বিজনকেই বা এর সঙ্গে কি পরিমাণ জড়িত বলে মনে করছিস?’
সত্যেন পুলিশের ঈষৎ হোমরা-চোমরা হলেও তার গায়ে পুলিশের গন্ধ নেই। সে আমার বাল্যবন্ধু। থার্ড বেঞ্চের ফোর্থ বয়, তার গায়ে মেদমজ্জা লেগেছে সত্যি, চেহারায় জৌলুষ এসেছে, ওরিয়েন্টাল সেমিনারীর স্পর্শ এখনো লেগে আছে। তাই বন্ধুভাবেই সব বললাম, এমন কি সেদিনের রেস্টুরেন্ট-সংবাদও দিলাম।
অনেকক্ষণ চিন্তা করে সত্যেন বলল, ‘এটা সুইসাইড নয়, মার্ডার তাও বলা চলছে না। অথচ নার্ভাস ব্রেকডাউনের ফলে ন্যাচারাল কোর্সের হার্টফেল তাও নয়। প্রশ্ন হচ্ছে তবে এটা কি? পোস্টমর্টেমের আগে সেকথা বলা শক্ত, তবে ডাক্তারের পরীক্ষায় প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী আমি যে দুটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি তার একটি হচ্ছে কোনরকম মেন্টাল শকের ফলে সুপর্ণার মাথার একটু গোলমাল দেখা দিয়েছিল, সেই শকটি কি তা আমাদের আবিষ্কার করতে হবে। এবং এরই ফলে অদ্ভুত উদ্ভট চিন্তা মাথায় খেলা করত রাত্রিবেলায়। শিল্পের মধ্যে, বিশেষ করে ছবির মধ্যে তন্ময় হয়ে যাবার স্বভাব ওর বরাবরই ছিল। ফিল্মের কর্তাদেরও রির্পোট তাই। কোন কোন সেটে কাজ করবার সময় সুপর্ণা আত্মবিস্মৃত হয়ে যেত। একটা ভূতুড়ে ছবি ‘ছায়াময়ী’, যেটিতে সে মরবার আগের দিন সকালেও ইনডোর অ্যাপিয়ারেন্স দিয়ে এসেছে, সেখানকার স্টুডিও রিপোর্ট আমি টেলিফোনে পেয়ে গিয়েছি।’
একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে সাসপেন্সের মুখে এসে সত্যেন থামল। আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘হুঁ—’
সত্যেন বলল, ‘উহুঁ। সে-কাহিনী এখন নয়, সেটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণও নয়। সুতরাং অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে সুপর্ণার ক্ষেত্রে, এক, তাকে হত্যার চেষ্টা—ভয় দেখিয়ে অবশ্যই। দুই, কোন সুপারন্যাচারাল স্ট্রোক টু ডেথ। কিন্তু অলৌকিকে পুলিশ এবং আমি অবিশ্বাসী হতে বাধ্য। ফরমূলায় যাকে আনা যায় না, তাতে আমাদের ফেথ নৈব নৈব চ। তবু সেই সূত্রেই বিজনকে আমরা মনে করতে বাধ্য। কারণ তোর কথা অনুসারে এবং এতক্ষণ ওর স্কেচ ডায়েরি এবং অ্যালবাম দেখে মনে হল বিজন সত্যিই থট পেইন্টার। সে যে কেবল মনের ছবি আঁকে তাই নয়, মনের চিন্তাকেও সে ডেভেলাপ করতে জানে। তার হাতের রেখা এবং রঙ ফটোগ্রাফারের ডার্করুমের স্পেশাল সলিউশনের মত। নেগেটিভকে, অন্ধকার রহস্যকে, পজেটিভে, আলোর ভাষ্যে ফুটিয়ে তোলে। বিজন ইচ্ছে করলেই অনেকের মনের ভয়-ভীতি-ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে রঙিন করে দিতে পারে, উদ্দীপ্ত করে তুলতে পারে।’
‘কিন্তু সুপর্ণাকে হত্যা করে বিজনের লাভ কি?’
জিভ কেটে সত্যেন বলল, ‘বিজন সে চেষ্টা করেছে এ-কথাই আমরা ভাবছি না। যে সুপারন্যাচারাল স্ট্রোকের কথা বললাম, সেই প্রসঙ্গেই বিজনের ছবির কথা এল। একটা সোর্স তো চাই, তা অলৌকিক হলেও।’
‘তাহলে যে মার্ডারের কথা হল, সে বিষয়ে তুমি কাদের সন্দেহ কর?’
‘কাউকেই না। কেউ যদি ভয় দেখিয়ে থাকে, কে দেখিয়েছে আমরা জানি না। তবে সুপর্ণার মৃত্যুতে কাদের লাভ হয়, হতে পারে, আমরা একটু খতিয়ে দেখব বৈকি। বাইরের ব্যবসায়ী দৃষ্টিতে যতখানি দেখা যায়, সুপর্ণার মৃত্যুতে বিজনের লাভ নেই। অবশ্য এখনও জানি না, কোন ম্যারেজ রেজিষ্ট্রেশন তার সঙ্গে সুপর্ণার হয়েছিল কিনা। পিসীমা এবং মামা বাকী থাকেন। ইন্সিওরের টাকা এবং কনট্রাক্টের টাকা, বাড়ি, পৈতৃক ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স এগুলি অবশ্য তাঁদের দুজনের ওপরেই আইনত বর্তায়। কিন্তু তাঁরা নিঃসন্তান, এবং শেষবয়সী। তাঁদের কাছে এই অর্থ ঐশ্বর্যের যথাযথ কোন মূল্য নেই, লোভের কারণও নেই। কারণ প্রথমত তাঁরা মেয়ের মত ভালবাসতেন সুপর্ণাকে, দ্বিতীয়ত তাঁরা দীর্ঘকাল নিজেরা রোজগার করছেন। অভাব অনটন বা দেনা কিছুই তাঁদের নেই।’
‘সুতরাং’, আমি আর অন্যতর কোন মীমাংসা খুঁজে পেলাম না।
‘সুতরাং’ সত্যেন বলল, ‘অন্য কোনরকমের স্বার্থ সিদ্ধ হয়, এমন লোকেদের তালিকা আমাদের প্রয়োজন।’
‘অন্য কোন রকমের স্বার্থ?’ আমি অবাক হই।
‘প্রতিহিংসা চরিতার্থ হওয়া বা ওই ধরনের কোন কিছু আর কি! কোন পুরুষবন্ধুবান্ধব বা পানিপ্রার্থীর নামধামবিবরণ আমাদের জানা নেই। তাঁদের মধ্যে আর কোন বিশিষ্ট ভদ্রমহোদয় এ বিষয়ে অগ্রণী হতে পারেন। কিন্তু আমাদের তাকাতে হবে তার আগে ট্রেড-লাইনের দিকে। অর্থাৎ ফিল্ম কোম্পানীগুলির দিকে। সেখানে এই নবাগত চিত্রতারকা খসে গেলে কোথায় কি পরিমাণ আকর্ষণ বিকর্ষণ ঘটে। আমরা—
সিঁড়িতে একপ্রস্থ পায়ের শব্দ শোনা গেল। এবং সেই পদধ্বনিকে অনুসরণ করে যে উদ্ভ্রান্ত আগন্তকের আবির্ভাব ঘটল, তার চুল উস্কো-খুস্কো, বেশবাস আধময়লা, অবিন্যস্ত। মুখে কয়েক দিনের বাসি দাড়ি। চোখ দুটি রাত্রি জাগরণে পীড়িত, অবসন্ন।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘বিজন, তুমি এসময়ে!’
বিজন একমুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ভিতরে ঢুকে এল। কোন কথা বলল না। স্টুডিওর মধ্যে ঢুকে কি যেন খুঁজতে লাগল। আমি আর সত্যেন তার পিছন পিছন স্টুডিও ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম।
আঁকা ছবিগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে তখনও বিজন কি যেন খুঁজে চলেছে।
বললাম, ‘কি খুঁজছ বিজন, কি হয়েছে তোমার?’
‘একটা ছবি খুঁজছি’, বিজন বলল, ‘কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না।’
আমি এগিয়ে গেলাম, ‘পেঁচার ছবি নয় তো?’
উদ্যত ছুরির ফলার মত আচমকা বিজন অন্য মূর্তিতে ঘুরে দাঁড়াল। আমি কি বলব ভেবে পেলাম না। সত্যেন আমাকে বিভ্রান্ত অবস্থা থেকে মুক্তি দেবার জন্য প্রসঙ্গান্তরে এনে ফেলল।
‘মিস্টার তালুকদার, আমি আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্যে এখানে ছুটে এসেছি। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আত্মপরিচয় দিই—আমি আপনার বন্ধুর বাল্যবন্ধু, নাম সত্যেন ঘোষাল।’
বেশ রুক্ষ ভঙ্গিতেই বিজন জবাব দিল, ‘আসল পরিচয়টা গোপন রাখার প্রয়োজন কি, বলেই ফেলুন না আপনার পেশাটা। পুলিশের লোক কারও বন্ধু হয় না—তা বাল্যবন্ধু!’
সত্যেন সহিষ্ণু হাসি হেসে বলল, ‘থাক, থাক, হয়েছে আর লজ্জা দেবেন না, আত্মপ্রশংসা শুনতে অস্বস্তি লাগে। আমি ছবি সম্বন্ধে কিছু—’
বিজন অট্টহাসি হেসে উঠল, ‘কালোয়ারও কালোয়ত হয়, পুলিশের শখ চিত্রকলায়, শেষটুকুতে অবিশ্বাস নেই, কিন্তু চিত্র? চলচ্চিত্র ছাড়া আর কিছু দেখেছেন জীবনে?’
আমি মনে মনে অধৈর্য এবং অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছিলাম বিজনের অভদ্র ব্যবহারে, এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাম না।
বললাম, ‘অন্তত একখানা বিখ্যাত ছবি উনি দেখেছেন—’
ও অবাক হয়ে আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল।
আমি শেষটুকুও এবার ছাড়লুম, ‘একটি পেঁচার ছবি। যাক, তুমি নবাগত চিত্রতারকা সুপর্ণা দেবীকে চিনতে?’
আমার কথার এমন প্রতিক্রিয়া হবে ভাবিনি। বিজন প্রথমে একটু চমকে উঠল, তারপর একেবারে নিষ্প্রভ হয়ে গেল। ভেতরের দারুণ যন্ত্রণা যেন চাপতে চেষ্টা করছে, কিছুক্ষণ কথা কইতে পারল না। আমি ভাবলাম, এতখানি আঘাত ওকে না দিলেই হত।
বিজন অবশেষে বলল, ‘হ্যাঁ, চিনতাম।’ সত্যেনের দিকে ফিরে পরে বলল, ‘সুপর্ণা সেনকে আমি ভালবাসতাম, তবে চিত্রতারকা হিসেবে নয়। সুপর্ণা ছিল আমার ছবির অন্ধ ভক্ত, কোথাও কোন প্রদর্শনীতে আমার ছবি দেখলেই তার কেনা চাই। এই ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের পরিচয়। সুপর্ণা সত্যকার শিক্ষিতা ছিল, তার রুচিরসবোধ আমি সচরাচর মেয়েদের মধ্যে দেখিনি। কিন্তু তার চরিত্র কেমন ছিল, আমার সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল কিনা, দোহাই আপনাকে, এ ধরনের প্রশ্ন আর আমাকে করবেন না—আই অ্যাম ফেডআপ উইথ দিস সিলি কোশ্চেনস—’
দু’হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে পড়ল। মনে হল এতক্ষশ শক্ত হয়ে ছিল যে লোকটা, এইবার সে একেবারে ভেঙে গলে ঝরে পড়বে। বুঝতে পারলাম একটু আগেই সপুর্ণাদের বাড়িতে গিয়েছিল বিজন, এবং সেখানে নানাবিধ প্রশ্নের জবানবন্দি দিয়ে আসতে হয়েছে তাকে।
সত্যেন বিজনের কাঁধে হাত রাখল সোফার পাশে উঠে গিয়ে, ‘এত সফ্ট হলে পুরুষ মানুষের চলে, বিজনবাবু। বিশেষত আপনাদের আর্টিস্টদের। আপনারা হবেন অপারেশন টেবিলের ডাক্তারের মত অকম্পিত। অপরের সুখ দুঃখ ব্যথা বেদনা নিয়েই যদিও আপনাদের কারবার—’
বিজন কিছুক্ষণ কোন কথা বলল না, তারপর সহজ হয়ে সম্পূর্ণ অন্য গলায় বলল, ‘আপনি ঠিক বুঝবেন না আমার দুঃখটা, এই মৃত্যুর জন্যে আমিই প্রকারান্তরে দায়ী। আমি—মানে, আমার এই হাত—এই অভিশপ্ত হাত—’
শেষ দিকে আবার গলাটা কেঁপে গেল বিজনের।
‘আপনি কি বলছেন ঠিক বুঝতে পারছিনে। আপনি কেন দায়ী হতে যাবেন? মৃত্যুর রিপোর্টটা শুনেছেন নিশ্চয়ই। দরজা বন্ধ অবস্থায় প্রথম রাত্রেই সুপর্ণা দেবীর মৃত্যু হয়েছিল। এবং তাঁর মৃতদেহ প্রথম আবিষ্কার করেন তাঁর মামা। একটি টেলিফোন এসেছিল রাত সাড়ে এগারটায়, ফিল্মস্টুডিও থেকে। রাত তিনটের সময় একটা নতুন সেটের কাজ আরম্ভ হবার কথা—আড়াইটের মধ্যে গাড়ি পাঠাবেন ডাইরেকটার! সুপর্ণাকে ডেকে দিতে গিয়েই দুর্ঘটনা আবিষ্কৃত হল।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু কোন চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই কি বাড়ির কেউ শুনতে পায়নি?’
সত্যেন বলল, ‘বাড়ির নক্সা লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে যে পায়নি। এই যে—’ পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে দেখাল, পেন্সিলে আঁকা, সপুর্ণার ঘরের কাছাকাছি কারও ঘর নেই, কেবল লাইব্রেরী, বৈঠকখানা, বাথরুম, ড্রেসিংরুম ইত্যাদি রয়েছে। মোট কথা একটা সম্পূর্ণ তলাই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।’
ছবি সম্বন্ধে এর পরেই কথা উঠল। বিজন তার ছবি সম্বন্ধে নিজে যা বলল তা হচ্ছে, সে নিজেও তার রেখা এবং রঙের আশ্চর্য ক্ষমতা বুঝতে পেরেছে। এগুলো বুদ্ধি দিয়ে বোঝা বা বোঝন যায় না, এগুলি কেবলমাত্র অনুভবযোগ্য বিশ্বাসের ব্যাপার। একদিন বাঘের একটা মুখ আঁকছিল বিজন, স্টুডিওর মধ্যে একা একা। ছবিটা যখন সম্পূর্ণ করে এনেছে প্রায়, তখন হঠাৎ আঁতকে উঠেছিল বাঘের গায়ের গন্ধ পেয়ে। এছাড়া আরও ঘটনা ঘটেছে ছোটখাটো। কিন্তু সুপর্ণার কেনা পেঁচার ছবিটার ইতিহাস সকলকে হার মানিয়েছে। বিজনের ধারণা এই ছবিটাই সুপর্ণার মৃত্যুর জন্যে দায়ী। সুপর্ণা বারবার এই ছবির কথাই বলেছিল মৃত্যুর আগের সন্ধ্যায়। হাতের রেখায় মানুষের ত্রিকালের ছবি পড়ে, জ্যোতিষশাস্ত্রের এই গণনা যদি সত্যি হয়, তাহলে হাতের রেখায় আঁকা ছবিই বা ভবিষ্যতের কথা কিছু বলতে পারবে না কেন! যেমন গ্রহসূত্রে বাঁধা পাথর মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রিত করে, যেমন মন্ত্রতন্ত্রের কিছু কিছু সিদ্ধি আমাদের বিশ্বাসের বাইরে নয়, তেমনি বিজনের ছবি আঁকার হাত দৈবপ্রাপ্ত।
কিছুক্ষণ পরে সত্যেন বিদায় নিল। আমি আর বিজন মুখোমুখি বসে রইলাম কয়েক মিনিট। কারো মুখে কথা নেই। স্টুডিওর বেয়ারা এবং টাইপিস্ট এসে গেছে ইতিমধ্যে। মেসিনগানের গুলির মত লোহার অক্ষরগুলো কার্বোনের পিঠে গিয়ে বিঁধছে। সেই শব্দের মৌতাতের মধ্যে আমি বুঁদ হয়ে বসে রয়েছি। ভাবছি মানুষের ভাগ্যের কথা, নিয়তির কথা এবং আশ্চর্য, অভূতপূর্ব প্রতিভার কথা।
‘এই হাত আমাকে টানছে।’ অদ্ভুত গলায় কথা বলল বিজন। আমি চমকে তাকালাম।
‘কি আজেবাজে বকছ, একটু শান্ত হও, ওরকম উত্তেজিত হলে কি চলে?’
‘আমার কথা তোমরা এখন বুঝতে পারবে না, কিন্তু আমি ঠিকই বলছি—ঠিকই বলছি—’তুলিদানি থেকে একটা তুলি তুলে নিয়ে হাতের তালুর ওপর ভেঙে ফেলল বিজন।
পেঁচার ছবিটার দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম রাত্রে আমার শোবার ঘরে। ছবিটা চেয়ে এনেছিলাম সত্যেনের কাছ থেকে। ছবিটা সত্যিই রহস্যময়। ফাটা কাচের আবরণের মধ্যে থেকেও কি অস্বাভাবিক জীবন্ত চোখে পাখিটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে জোড়াসন হয়ে বসে আছি খাটের উপর। দেয়ালের পাখিটার দিকে চোখ রেখে। হান্টিং স্পটের দিকে শিকারী যেমন একদৃষ্টে তাকিয়ে জেগে বসে থাকে, কখন তার শিকার আসবে টোপ গিলতে। আমি জানি আজ রাত্রে কিছু পাব।
ধীরে ধীরে রাত নিঃঝুম হয়ে এল। পাড়া নিষুতি। পেটা-ঘণ্টায় বারটা বেজে গেল। ঘরের মধ্যে কেবল নিঃশব্দ অস্থিরতা। কেমন একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়েছে আমার চারপাশে, আমার দেহের ওপর, আমার মনের মধ্যে। অশরীরীর নিশ্বাসের মত। যেন প্ল্যানচেটে আত্মার প্রতীক্ষায় এতক্ষণ বসে ছিলাম। এইবার তারই উপস্থিতি যেন মনে মনে অনুভব করতে পারছি।
জোর করে আলো নিভিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অস্বস্তি আমার স্নায়ুর রাজ্য অধিকার করে বসে রয়েছে, তা থেকে নিষ্কৃতি নেই। রাত কত জানি না, সিলিংয়ের দিকে অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ঘুমের জন্য কৃচ্ছু সাধনা করছি, কিন্তু বোধ হয় আজ রাত্রে আমার কাছ ঘেঁষবে না। মাথার মধ্যে দপদপ করছে, দুচোখের মধ্যে উত্তাপ অনুভব করছি। হঠাৎ মনে হল ঘরের মধ্যে অত্যন্ত কর্কশ গলায় পেঁচা ডেকে উঠল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানার ওপর। একটু তন্দ্রার ভাব এসেছিল কিনা কে জানে। কান থেকে তখনো রেশ মেলায়নি ওই নিশাচর পাখির ডাকের। হঠাৎ আবার টেলিফোন চেঁচিয়ে উঠল, ঠিক পেঁচার ডাকের প্রতিধ্বনি করে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও যন্ত্রটাকে কানের কাছে টেনে নিতে হল। তারের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল আমার অতিপরিচিত একটি কণ্ঠস্বর। একটু উত্তেজিত।
বললাম, ‘হ্যাঁ, আমিই কথা বলছি, কিন্তু ব্যাপার কি সত্যেন?’
‘স্যাডেস্ট অ্যান্ড দ্য মোস্ট শকিং নিউজ, বিজন মারা গেছে।’
‘কে মারা গেছে। বিজন? তুমি কি এই শেষরাতে প্রলাপ বকছ।’
‘আমি চরম সত্য কথা বলছি, আজ এই মুহূর্তে, বিজনের ব্যাপারে এর চেয়ে সত্য কথা আর কিছুই হতে পারে না। আমাদের ডক্টর যা নোট দিয়েছেন তা হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা আগে বিজনের মৃত্যু হয়েছে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই মৃত্যু ঘটেছে, তবু শরীরের অবস্থা খুবই অস্বাভাবিক। মনে হচ্ছে—আচ্ছা, টেলিফোনে এসব কথা নয়, আমি গাড়ি নিয়ে তোর ওখানে যাচ্ছি, গেট রেডি।’
‘কিন্তু কোথায় বিজনের মৃতদেহ আবিষ্কার করলে, তা তো বললে না?’
‘স্বচক্ষেই সেটা দেখো। আমি আসছি—’
কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি পুলিশ-জীপ আমার বাড়ির দরজায় এসে থামল। আমি সেই চারটে রাতে প্রস্তুত হয়েই ছিলুম। সঙ্গে সঙ্গেই গিয়ে উঠলাম। পরেশ কলকাতার বাইরে গিয়েছিল, তাই তাকে আর খবরটা দেওয়া হল না।
জীপ ছুটল চৌরঙ্গীর দিকে। আমার সমস্ত মন এমন অবসন্ন যে, কোন কথা বলতে ভাল লাগছিল না। পাইপ দাঁতে চেপে সত্যেন বসেছিল আমার পাশে নির্বিকার মুখে। যেন বাসের সহযাত্রী। একসময় আমার পিঠে সমবেদনার ছোঁয়া লাগল। সত্যেন তার হাতের মৃদু চাপ দিয়ে সবই বোঝাল।
আমি বললাম, ‘একেবারে অবিশাস্য। এই কালও যার সঙ্গে এত কথা বলেছি, রাত না পোহাতেই তার মৃত্যু-সংবাদ—সহ্য করা যায় না।’
‘ভেরি শকিং—’
‘সুইসাইড মনে হল।’
‘কেন বল তো?’
‘কাল বিজন বলছিল: ‘এই হাত আমাকে টানছে, কথাটা এখনো কানে লেগে রয়েছে আমার, বারবার যেন ওর গলা শুনতে পাচ্ছি।’
‘বলা শক্ত। মার্ডার কি সুইসাইড কি সাডেন্ ডেথ্, আই মীন মেয়ার অ্যাক্সিডেন্ট বলা শক্ত। চল, নিজের চোখেই দেখবে।’
দেখলাম। চৌরঙ্গী পাড়ার একটি হোটেলের দোতলায়। স্যুট নম্বর কার নামে ছিল জানি না, তবে সেই স্যুটের একটি ঘরে বিজন ছাড়া আর কেউ ছিল না তার নজির দেখতে পেলাম। ঘরের দরজায় খাড়া পুলিশ পাহারা। ফটোগ্রাফাররা বিদায় হয়েছেন শুনলাম। ঘরখানা আসবাবপত্রহীন বলা যায়। দেয়ালে প্রকাণ্ড একখানা দামী বেলজিয়াম গ্লাস। একপাশে নিচু দেড় ফুট উঁচু চাইনীজ ডিজাইনের পালঙ্ক। নিভাঁজ বেড কভার পাতা।
মাঝখানে ইজেল। ছোট্ট একটা ডানলোপিলো দেওয়া টুল। বাঁদিকে বেশ উঁচু একটা লাইট স্ট্যান্ড, ফোকাস এসে পড়েছে ইজেলের ওপরে। হেঁট হয়ে টুলের ওপরে বসে আছে একটি লোক। পিছন থেকে তাকে জীবন্ত বলেই ভ্রম হয়। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় একটি নিস্পন্দ নিঃসাড় দেহ, আর স্পর্শ করলে, হিমশীতল, আড়ষ্ট, কঠিন।
সামনে গিয়ে দেখলাম, লোকটি আমাদের প্রতিভাবান সহকর্মী এবং বন্ধু বিজন ছাড়া আর কেউ নয়। ডান হাতের তিন আঙুলে একটি তুলি উঁচানো, চোখের দৃষ্টি বরফ দেওয়া মাছের চোখের মত খোলা। ইজেলের তলায় রঙের ট্রে। ইজেলের ক্যানভাসে কতকগুলো দ্রুতগতি রেখা ছড়ানো। একাধিক রঙে আউটলাইন এবং কর্নার কনসেপশনের ছোপ দেওয়া হয়েছে। প্রথমে এলোমেলো মেঘের আভাস মনে হয়। পরে একটি মেয়ের নগ্নমূর্তি, নাচের ভঙ্গিমায়। এবং আরও পরে ফণা তোলা একটি সাপের ছবি আত্মপ্রকাশ করে। ছবি দেখেই এমন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে, ডেথ-স্পটে দাঁড়িয়ে রয়েছি মনে ছিল না।
‘ছবিটা আঁকতে গিয়েই, বলতে গেলে আঁকতে আঁকতেই মারা গেছেন বিজন তালুকদার—কিন্তু তাঁর মডেল কোথায়?’
সত্যেনের জিজ্ঞাসায় আমি চমক ফিরে পেলাম। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। সিলিংয়ের বাতি জ্বলছে না। ঘরে দ্বিতীয় কোন আসবাবপত্র নেই। সামনের দিকে ব্যালকনির দরজা ভেতর থেকে কাচ বন্ধ। পাশে আর একটি দরজা দেখে উঁকি মারলাম। বাথরুম। ফিরে এসে বললাম, ‘মডেল এঘরে ছিল না। কোন ফটো কিংবা স্কেচ থেকে বিজন আঁকছিল।’
‘কি করে বুঝলে?’
‘ইজেলের দিকে যেরকম অ্যাঙ্গেল করে বিজন বসে আছে, আর একটিমাত্র আলোর ফোকাস যেভাবে পড়েছে, তাতে মডেলের উপস্থিতি সম্ভব ছিল না। তাছাড়া মাথা হেঁট করে রয়েছে অথচ হাতের তুলি উঁচোনো রয়েছে, এ থেকেই প্রমাণ হয়, তুলিতে রঙ নেবার পর তার কোলের ওপরে রাখা ফটোর দিকে নিশ্চয় তাকাচ্ছিল সে—’
‘বলছ?’ বলে খানিকক্ষণ কি ভাবল সত্যেন, তারপর ব্যালকনির দরজার কাছে একবার, আর একবার বাথরুমের কাছ থেকে কিসব দেখে ফিরে এল, ‘তাহলে ঘরের মধ্যে কেউ আসেনি বলছ; দরজা জানলা ভেতর থেকে অবশ্যই বন্ধ ছিল, ভেঙে ঢোকা হয়েছে।’
‘ঠিক তাই—’ আমি বললাম, ‘কিন্তু এই আকস্মিক মৃত্যুর কারণ কিছুই আমার মাথায়…’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, একটা বিষয় আমাদের এখানে ভেবে দেখার আছে। যে মেয়েটির ছবি আঁকা হচ্ছিল, অর্থাৎ যে ছবি বা ফটো দেখে, সেটি তাহলে কোথায়? এই ঘরের মধ্যে কোথাও তো তার চিহ্নও দেখতে পাওয়া যায়নি—’
সত্যিই আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি। সত্যেন বাথরুমের দিকে একবার এগিয়ে গেল। বাথরুমের দিকে সত্যেন বারবার কেন যাচ্ছে ভেবে পেলাম না। একটু পরে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। রুমালে জড়ানো কি একটা জিনিস তার হাতে।
‘কি ওটা, দেখি দেখি!’ থানার ও-সি ব্যগ্র কৌতূহল নিয়ে প্রবেশ করলেন।
‘একটি সামান্য প্লাগ’, সত্যেন বলল, ‘বাথরুমের প্লাগ-পয়েন্ট আধখোলা অবস্থায় ছিল, সঙ্গে একটু তারও আছে।’
‘তাতে কি হয়েছে?’ হা হা করে হেসে উঠলেন ও-সি।
আমি বিব্রত বোধ করলাম। সত্যি বলতে কি সত্যেনের এই গাঁজাখোরী গোয়েন্দাপনা আমার কাছেও ছেলেমানুষী মনে হচ্ছিল। প্লাগ-পয়েন্টে একটি প্লাগ পরানো থাকবে, এতে চঞ্চল হয়ে উঠবার কি আছে বুঝতে পারলুম না।
কথার জবাব না দিয়ে সত্যেন মৃদু হেসে দেয়ালের পাশ দিয়ে আইগ্লাস বুলোতে বুলোতে ব্যালকনির কাচের দরজাটার কাছে এগিয়ে গেল। তারপর খুব চিন্তিত হয়ে কি যেন দেখল সেখানে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে কি ভাবল। তারপর তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দরজার খিলটা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করল।
‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ সত্যেন চাপা গলায় আমাকে কাছে ডাকল। থানার ও-সিও আমার সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ালেন।
আমি খুব উৎসাহিত হয়ে বললাম, ‘কি, কোন সূত্রটুত্র পাওয়া গেল নাকি?’
সত্যেন বললে, ‘নিশ্চয়।’
‘কই, দেখি দেখি?’ ও-সির আর ত্বর সয় না।
‘এই যে, কাচের দরজার লোহার খিল।’
‘কাচের দরজার খিল, ব্যস। কিন্তু আপনার সূত্র কই?’
‘ওই। সূত্র বলেন সূত্র, লোহার খিল বলেন লোহার খিল।’
‘তুমি কি এই সময়ে মাথামুণ্ডহীন রসিকতা শুরু করলে!’
আমার কথার উত্তরে কাচের পাল্লা দুটো দেখিয়ে সত্যেন বলল, দেখ তো কোন দাগ দেখতে পাও কিনা কাচের গায়ে?’
দেখলাম সত্যিই কাচের পাল্লা দুটোর গায়ে একটি বিরাট পরিধি নিয়ে অর্ধবৃত্তাকার দাগ। কাচের দরজায় ধুলো জমেছিল, তার ওপর অস্পষ্ট ভাবে দাগটা পড়েছে।
বললাম, ‘কিন্তু এ তো লোহার খিলের ঘষা লেগে কাচের ওপর আঁচড় পড়েছে। এর মধ্যে তুমি রহস্য কোথায় পেলে?’
‘ভাল করে দেখ তো দাগটা খিলেরই কিনা। খিলের হলে ভেতর দিকে হবে দাগটা। নইলে—’
‘আশ্চর্য! দাগটা বাইরের পিঠে! কিন্তু—’ খিলটি খুলে নামাতে নামাতে আমি আমার বিস্ময় প্রকাশ করলাম, ‘কিন্তু ঠিক খিলের মাপেই দাগটা পড়েছে।’
‘তবেই বুঝতে পারছ এই ঘরে বিজনের মৃত্যুর সময়ে মানুষ ছিল।’
‘বুঝতে কিছুই পারছিনে। এই দাগের সঙ্গে, প্লাগের সঙ্গে মানুষের কি সম্পর্ক। আর মানুষ যদি এসেই থাকে, তাহলে সে বেরিয়ে গেল কোন্ পথ দিয়ে।’
‘বিজনকে হত্যা করে সে কৌশলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আর সেই কৌশলই আমাদের কাছে ধাঁধার সৃষ্টি করেছে। আমরা ভেবেছি এটা আত্মহত্যা।’
ও-সি এবার মুখ খুললেন, ‘হেঁয়ালি রেখে ব্যাপারটা খুলে বলুন তো মশাই। আপনাদের সাসপেন্স আমার হার্টের পক্ষে ক্ষতিকর হচ্ছে।’
‘ব্যাপারটা আসলে কঠিন কিছু নয়। হত্যাকারী বিজনের হালচাল সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল। সে জানত এই রাত্রে বিজন এই ঘরে বসে ছবি আঁকবে। তাই সে আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। বাথরুমে যে হিটারের জন্যে একটি প্লাগ পয়েন্ট আছে তার না-জানা ছিল না। সে একটি প্লাগ আর কয়েক গজ তার সঙ্গে করে এনেছিল। ঘরের মধ্যে আগে থেকেই লুকিয়েছিল হত্যাকারী, সময় বুঝে প্লাগ কানেকশন দিয়ে তারের প্রান্তটা নিয়ে বিজনের পিছন দিকে গিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর বিজনের ঘাড়ের কাছে সেটি ছুঁইয়ে দিতে যা বিলম্ব। এসি কারেন্ট নির্ভুল ভাবে বাকী কৰ্তব্যটুকু পালন করেছে। আকস্মিক ভাবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিজন মারা গেছে। হার্টের ক্রিয়া হয়েছিল সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। ডাক্তারী পরীক্ষার শেষ রিপোর্ট একটু আগে টেলিফোনে আমি পেয়েছি।’
‘কিন্তু হত্যাকারী এত পথ থাকতে ইলেকট্রিক শক্ দেওয়াই পছন্দ করল কেন, আর সে দরজা-জানলা বন্ধ অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলই বা কি উপায়ে?’
‘সবই বলছি ধীরে ধীরে। বৈদ্যুতিক পন্থা গ্রহণ করার কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি চিৎকার করার অবকাশ পাবে না। নিঃশব্দে অল্প সময়ের মধ্যে অতি সহজে কাজটা হাঁসিল হয়ে যাবে। তাছাড়া এই উপায়ে হত্যা করা তেমন নিষ্ঠুর কাজ বলে মনে হয়নি হত্যাকারীর কাছে। এবং সে ভেবেছিল এই হত্যা ডাক্তারী পরীক্ষায় ধরা পড়বে না। হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে—তা আরও প্রমাণ সিদ্ধ করার জন্য সে দরজা বন্ধ করে রেখে গেছে। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করেছে সে এক আশ্চর্য উপায়ে। একটা শক্তিশালী চুম্বককে সে কাজে লাগিয়েছে কাচের ও-পিঠ থেকে লোহার খিলটাকে যথাস্থানে স্থাপন করার কাজে। কাচের গায়ে চুম্বকটিকে টানা হয়েছিল থিলের আগার সমান্তরাল ভাবে। তারই দাগ পড়েছে কাচের পাল্লায়।’
আমরা দুজন সত্যেনের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সত্যেনের সূক্ষ্ম দৃষ্টির প্রশংসা না করে পারলাম না। যেমন আশ্চর্য এই হত্যা করার পদ্ধতি, তেমনি আশ্চর্য সেই রহস্যভেদ।
‘কিন্তু বিজনের কোন শত্রু ছিল বলে জানি না। তাকে হত্যা করে কারই বা কি লাভ হতে পারে ভেবে পাই না। এমন কিছু মূল্যবান জিনিস ছিল না যা কেড়ে নেবার জন্যেও কারও পক্ষে এই জঘন্য ধরনের কাজ সম্ভব।’
সত্যেন বলল, ‘এই ঘর থেকে স্পষ্টতই একটি জিনিস খোয়া গেছে, এবং সেটি বিজনের হত্যার পরেই, সেটা হচ্ছে ওই ছবির, অসম্পূর্ণ ছবির মডেল। সেই ফটোগ্রাফটি। এই হত্যাকাণ্ডটা যে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছু নয়, এই হত্যার কেন্দ্রে যে একটি নারী রয়েছে, একথা সুতরাং বলাই বাহুল্য।’ একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সত্যেন আবার শুরু করল, ‘আঁকা ছবির অসম্পূর্ণ হরফ থেকে স্পষ্ট অনুমান করা যায় না, তবু একটি মেয়ের কথা এই প্রসঙ্গে আমি মনে এনে পারছি না।’
অধৈর্য আবেগে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কে সেই মেয়ে?’
‘সুপর্ণা সেন। সামান্য কিছুকাল আগে, যাকে প্রায় কিছুক্ষণ বলে মনে হয়, যে মারা গেছে, সম্ভবত নিহত হয়েছে।’
‘সুপর্ণা সেন!’ আমি সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলাম, ‘সুপর্ণা সেনের ছবিই ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে বলছ—কই দেখি—উঁহু, এই ফিগার কি সুপর্ণা সেনের? মনে হয় না।’
‘আমি বলিনি এই ছবি সুপর্ণা সেনের। আমি বলেছি তার কথা স্বভাবতই মনে পড়ে। আমার আর একটু তদন্তের কাজ বাকী আছে—আমি বিকালে তোমার সঙ্গে দেখা করব।’
আমি যখন চৌরঙ্গী থেকে বিদায় নিলাম, তখন চারপাশ রোদে ঝলমল করছে। কিন্তু আমার চোখের সামনে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাড়ি ফিরলাম।
ক্লোজআপে বসেছিলাম আমি আর পরেশ। এমন সময় সত্যেনের আবির্ভাব। সঙ্গে সঙ্গে থানার ও-সি। যথাযোগ্য সমাদরে বসালাম ওদের। তারপর পরেশের সঙ্গে আগন্তুক দুজনের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, ‘কূল-কিনারা হল কিছু?’
সত্যেন গম্ভীর মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, সেইজন্যেই এসেছি। হত্যাকারী ধরা পড়েছে।’
আমি আর পরেশ দুজনেই আকস্মিক সংবাদে হকচকিয়ে গেলাম।
বললাম, ‘বল কি হে, এটা তাহলে সত্যি-সত্যিই মার্ডার! তোমার অনুমানই সত্যি হল। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করে কোথায় রেখেছো?’
সত্যেন বললে, ‘তাকে গ্রেপ্তার করতেই এসেছি।’
পকেট থেকে হাতকড়া বের করে থানার ও-সি এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে, ‘আসুন পরেশবাবু, নিষ্ঠুর কর্তব্যটুকু আগে সেরে ফেলা যাক, তারপর গল্পগুজব করা যাবে’খন।
আমি উত্তেজিত হয়ে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম, পরেশ ইঙ্গিতে নিষেধ করে হাত দুটো বাড়িয়ে দিল। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। সমস্ত কিছু যেন ওলট-পালট হয়ে গেল, বিজনকে হত্যা করবে পরেশ, স্বপ্নেও এমন অবাস্তব কল্পনা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেবল আমাদের নিবিড় বন্ধুত্বের জন্যেই একথা ভাবতে আমাদের কষ্ট হচ্ছিল তা নয়, বিজনের মত নিঃস্বচরিত্র শিল্পীকে হত্যা করে তার লাভই বা কি!
সত্যেন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি খুব দুঃখিত যে এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকতে হল আমাকে। কিন্তু অপ্রিয় সত্যের ভারবাহী আমরা, উপায় নেই।’
‘কিন্তু আমি যে এখনও পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারছি নে—এমন একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার—তাছাড়া আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিজনকে হত্যা করে পরেশের লাভই বা কি—তুমি নিশ্চয়ই এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ হাতে নিয়েই কথা বলছ—’
সত্যেন ম্লান হেসে বলল, ‘পরেশবাবুর সঙ্গে আমার কোন স্বার্থের সম্পর্ক ছিল না যে তাঁকে এমন একটা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত করতে যাব। প্রমাণ প্রয়োগ ছাড়া এক-পা আমরা এগোতে পারি না এ তো বলাই বাহুল্য। পরেশবাবুর ঘরে ঘোড়র ক্ষুরের আকৃতির একটি বিরাট চুম্বক আছে আমি আগেই লক্ষ্য করেছিলাম। এ ধরনের চুম্বক আগের দিনে দেখা যেত। সম্ভবত কোন ওল্ড কিউরিও শপ থেকে তিনি প্রথম যখন কিনেছিলেন, তখন দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীর চিহ্ন হিসেবেই কিনেছিলেন, কিন্তু পরে অন্য কাজে তিনি লাগালেন। ইলেকট্রিক শক দেবার আগে তিনি হোটেলের সেই ঘরের মধ্যেই ছিলেন, কিন্তু ঘরটির মধ্যে লুকিয়ে থাকার মত জায়গা ছিল না। বাথরুম আত্মগোপন করার নিরাপদ জায়গা নয়। সেই কারণে আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল, আততায়ী এমন কোন লোক যে বিজনবাবুর পরিচিত। কিন্তু বিজনবাবুকে যতদূর জানতাম, তাঁর পক্ষে দুটি লোককে ঘরের মধ্যে রেখে দরজা বন্ধ করে ছবি আঁকা সম্ভব ছিল, এক তাঁর মডেল, দ্বিতীয় ক্লোজআপের অন্য সহকর্মী। তোমার কথা শুনেই মডেলের সম্ভাবনা বাদ দিয়েছিলাম আমার ছক থেকে।’
সত্যেন তার পাইপটি ধরিয়ে নিল, তারপর আবার শুরু করল, ‘সুপর্ণা প্রসঙ্গেই আমি খবর পেয়েছিলাম, পরেশবাবুও তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া বিজনবাবুর যে দুটি ছবি সম্প্রতি আমেরিকায় চড়া দামে বিক্রি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে—সে ছবি দুটির চিত্রকর হিসেবে নাম আছে পরেশবাবুর। সুপর্ণা দেবীর ড্রয়ারে বিজনবাবুর সদ্য লিখিত একটি পত্রে তার উল্লেখ আমি পাই। তাছাড়া চৌরঙ্গীর হোটেলের স্যুটটি একদিনের জন্যে যে অপরিচিত নামা ভদ্রলোক ভাড়া নিয়েছিলেন, তাঁর স্বাক্ষর এবং পরেশবাবুর হস্তাক্ষর এক বলে প্রমাণিত হয়েছে। পরেশবাবুর গোপন সঞ্চয়স্থানে হানা দিয়ে আমি বিজনবাবুর আঁকা এক ডজন অন্তত ছবি পেয়েছি। চিত্রকলায় সামান্য জ্ঞান যেটুকু আছে তাতে বুঝতে পেরেছি, সেগুলি ভবিষ্যতে যুগান্তর আনবে। আমাদের সামনেই সেদিন বিজনবাবু তাঁর হারানো ছবি খুঁজছিলেন। তাছাড়া এই ফটোগ্রাফ নিশ্চয়ই চিনতে পার—’
একটা ন্যূড ছবি বের করল পকেট থেকে, না, সুপর্ণার ছবি নয়, ক্যানভাসের ভঙ্গির সঙ্গে হুবহু মিল খায় এমন একটি অপরিচিত নারীমূর্তির।
সত্যেন বলল, ‘এটিও পরেশবাবুর ডায়েরির মধ্যে পেয়েছি আজকে।’