1 of 2

অভিশপ্ত মূর্তি

অভিশপ্ত মূর্তি

রমেশের মতে গরম যখন চরম হইয়া উঠে এবং বিশুদ্ধ বাতাস না পাইয়া প্রাণপাখি ‘খাঁচা ছাড়ি-খাঁচা ছাড়ি’ করিতে থাকে, বিকালে তখন গড়ের মাঠের ‘কার্জন পার্কে’ গিয়া হাঁ করিয়া হাঁপ ছাড়াই বাঁচিবার পক্ষে সবচেয়ে প্রশস্ত এবং সহজ উপায়। অতএব, তারা কয় বন্ধুতে প্রত্যহ এই প্রশস্ত ও সহজ উপায় অবলম্বন করিত।

সেদিনও তারা ‘কার্জন পার্কে’ গিয়া জমিয়াছিল।

রমেশ ঘাসের ওপরে উড়ানি বিছাইয়া শুইয়াছিল, যোগেশ একটা মৌরির বিড়ি বারংবার নিবিয়া যাইতেছে দেখিয়া ক্রমেই চটিয়া উঠিতেছিল, সুরেশ একমনে একখানা বিলাতি ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়িতেছিল এবং উমেশ সকৌতুকে দূরের এক বেঞ্চের দিকে স্থিরচক্ষে তাকাইয়াছিল। সেই বেঞ্চখানার ওপরে দু-জোড়া সাহেব-মেম বসিয়াছিল। তার মধ্যে যে সাহেবটি তাকিয়ার মতো মোটা তাঁর মেমটি বাঁখারির মতো রোগা আর যে সাহেবটি বামনের মতো বেঁটে তাঁর মেমটি প্রায় জিরাফের মতো ঢ্যাঙা—এমন বিসদৃশ চার-চারটি চেহারা এক জায়গায় দেখিতে পাওয়ার সৌভাগ্য, বড়োই দুর্লভ!

হঠাৎ পিছন হইতে চেনা গলায় একজন বলিল, ‘আমি যে তোমাদের খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলুম!’

সবাই তাড়াতাড়ি ফিরিয়া দেখিল, পরেশ। অমনি একসঙ্গে প্রশ্ন হইল, ‘কীহে, তুমি না পুরী গিয়েছিলে?’ ‘কবে ফিরলে হে?’ ‘জায়গাটি কেমন লাগল?’ ‘আর কোথাও গিয়েছিলে নাকি?’

পরেশ আগে সকলকার মাঝখানে আসিয়া বসিল। তারপর কোঁচানো উড়ানিখানি খুলিয়া সাবধানে কোলের ওপর রাখিয়া বলিল, ‘ভাই, আমি চতুর্মুখ নই, সুতরাং একসঙ্গে তোমাদের চার-চারটি প্রশ্নের জবাব দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে একে-একে বলছি শোনো। হ্যাঁ, আমি পুরী গিয়েছিলুম। আজ সকালে ফিরেছি। জায়গাটা ভালো লাগল। দোষের মধ্যে আমাদের কালো রং সেখানকার জলহাওয়ায় ঘোরতর হয়ে ওঠে। পুরী থেকে আমি কনারকে গিয়েছিলুম—’

রমেশ চমকাইয়া বলিল, ‘অ্যাঁঃ কনারকে!’

‘ওকী, কনারকের নামে তুমি অমন চমকে উঠলে কেন?’

‘না না ও কিছু নয়, তুমি যা বলছিলে বলো!’

‘সে হবে না। আগে বলো তুমি চমকালে কেন?’

‘সে অনেক কথা!’

‘তা হোক—বলো!’

‘শুনলে তোমরা বিশ্বাস করবে না!’

‘যদি ভালো লাগে আর মাসিকপত্রের ছোটোগল্পের মতো চর্বি চর্বণ না হয়, তাহলে আমরা উনিশ বার জেল-ফেরতা দাগী চোরের কথাও বিশ্বাস করতে রাজি আছি!’

‘কিন্তু-কিন্তু’

‘কিন্তু তুমি বড়ো বেশি ল্যাজে খেলছ রমেশ!’

অগত্যা বাধ্য হইয়া রমেশ তার কথা শুরু করিল:

দুই

অনেক দিন আগেকার কথা, আমরা কয় বন্ধুতে কোনারক দেখতে গিয়েছিলুম। কোনারকের মন্দিরের কথা তোমরা অনেকেই জানো, সুতরাং আমি আর মন্দিরের কথা বলতে চেষ্টা করব না।

কোনারকের আশেপাশে মাঝে মাঝে দু-চারিখানি ছোটোখাটো গাঁ আছে; এ-সব গাঁয়ে লোকজন খুব কম। যারা থাকে তারা হচ্ছে চাষাভুষো ও গয়লা শ্রেণির।

কোনারক দেখতে যেদিন আমাদের আসবার কথা, সেইদিন বৈকালে আমরা অমনি একখানি গাঁয়ের ধার দিয়ে বেড়িয়ে ফিরছিলুম।

কৌতূহলী চোখে এদিকে-ওদিকে তাকাতে তাকাতে আসছি। হঠাৎ একটা গাছতলায় পুতুলের মতো কী-একটা নজরে ঠেকল। এগিয়ে গিয়ে দেখি, সত্যিই এক পাথরের মূর্তি। তার নীচের দিকটা বালিতে পুঁতে গিয়েছে।

মূর্তিটি রমণীর, গড়ন দেখে মনে হল কোনারকের সেকেলে শিল্পীদের কেউ এটিকে গড়েছে। কেননা তেমন রূপে-ভরা দেহ, হাসি-ভরা মুখ, ভাবে-ভরা চোখ বড় যে-সে কারিগরের কল্পনায় সম্ভব নয়। উড়িষ্যার প্রাচীন শিল্পের এটি একটি জ্বলন্ত নিদর্শন।

এহেন মূর্তি এখানে অযত্নে পড়ে আছে কেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাই ভাবছি। এমন সময় দেখি ‘আসুছন্তি ব্রজবাসী’ বলে গান গাইতে গাইতে, পাশ দিয়েই একজন গাঁয়ের লোক যাচ্ছে।

তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘হ্যাঁরে, এ পুতুলটা এখানে পড়ে আছে কেন?’

উড়িষ্যা ভাষায় সে যা বললে তার মর্ম বুঝলুম এই যে, গাঁয়ের মধুসূদন শ্রীচন্দনের বাড়িতে এ-মূর্তিটি আগে ছিল, কিন্তু সে মরে যাবার পর তার ছেলেরা এটাকে এখানে ফেলে দিয়ে গেছে।

‘ফেলে দিয়ে গেছে কেন রে?’

অত্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে লোকটি বললে, ‘কেন যে সে তা জানে না।’ তার মুখ দেখে মনে হল, সে যেন কী লুকোচ্ছে।

‘আচ্ছা, তুই এই পুতুলের গা থেকে বালিগুলো সরিয়ে ফেল দেখি! বখশিশ পাবি।’

লোকটা কেমন শিউরে উঠে তিন হাত পিছিয়ে গেল। তারপর দংশনোদ্যত সাপের দিকে লোকে যেমন করে তাকায় তেমনি ভীরু চোখে মূর্তির দিকে তাকিয়ে বললে, সে পারবে না।

খামোকা লোকটা আঁতকে উঠল কেন? মূর্তিটি যেন তার পাষাণ নয়ন তুলে করুণ হাসি হাসছে; আপনার নীরব ভাষায় যেন বলছে, ‘আমাকে উদ্ধার করো—এই আসন্ন সমাধি থেকে আমাকে উদ্ধার করো!’

লোভে আমার মনটা ভরে গেল। অপূর্ব শিল্পের এই উজ্জ্বল রত্নটিকে যদি কলকাতায় নিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমার বাড়ি আলো হয়ে উঠবে!

ফিরে দেখি পিছনে সে লোকটা আর নেই, হনহন করে সে গাঁয়ের দিকে চলে যাচ্ছে।

বন্ধুরাও আমাকে ফেলে অনেক দূরে এগিয়ে গেছেন। চেঁচিয়ে ডাকতে সবাই ফের ফিরে এলেন।

সকলে মিলে বালি সরিয়ে মূর্তিটাকে আবার টেনে তুললুম। সেটি একটি নর্তকীর নগ্নমূর্তি; এতক্ষণ আর আধখানা বালির ভিতরে ঢাকা ছিল বলে তার অপরূপ রূপ ভালো করে বুঝিনি, এখন তার সবটা পেয়ে আমাদের চোখে যেন তাক লেগে গেল। কী সুন্দর তার দাঁড়াবার ভঙ্গি! কী অপূর্ব তার হাত-পায়ের শ্রী ছাঁদ! আর পাথরের মূর্তি যে এতটা জীবন্ত হতে পারে, আমি তা জানতুম না। মনে হল, শিল্পী আর একটু চেষ্টা করলেই এর মৌনব্রত ভঙ্গ হয়ে যেত!

ভেবেছিলুম মূর্তিটিকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে গেলে, গাঁয়ের লোকে নিশ্চয়ই ওড়িয়া ভাষায় যৎপরোনাস্তি রুদ্ররস প্রকাশ করবে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, টু-শব্দটি পর্যন্ত করলে না।

তিন

সন্ধ্যার পর আমরা কোনারকের কালো দেউলের কালো ছায়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে সীমাহীন বালুকা সাগরের তীরে এসে দাঁড়ালুম।

আমরা চারখানা গোরুর গাড়ি ভাড়া করেছিলুম। অন্য তিনখানা গাড়িতে দু-জন করে লোক উঠল, কিন্তু আমার গাড়িতে সেই মূর্তিটি ছিল বলে আমি ছাড়া আর কারুর জায়গা হল না।

অস্পষ্ট চন্দ্রালোকে ঘুমন্ত সেই অনন্ত বালুপ্রান্তরকে চাকার শব্দে জাগ্রত করে, গোরুর গাড়িগুলো ঢিমিয়ে-ঢিমিয়ে চলতে লাগল। উপরে আকাশ, নীচে সেই ধূ-ধূ মরুভূমি। চারদিকে আর কিছুই নেই—না গ্রাম, না মানুষ, না গাছপালা।

সারাদিন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেহ-মন যেমন এলিয়ে পড়েছিল—আস্তে আস্তে গাড়ির ভিতরে দেহটাকে ছড়িয়ে দিলুম; আর আমার পাশেই নর্তকীর সেই পাষাণ মূর্তিটি স্তব্ধ মৃতদেহের মতো আড়ষ্ট হয়ে পড়ে রইল।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলুম—সেই পাষাণী নর্তকী যেন প্রাণ পেয়ে জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। টানা-টানা বিদ্যুৎভরা চোখ তুলে আমাকে দেখতে পেয়ে, কুন্দদন্তে অধর চেপে সে ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর সামনের দিকে ধীরে ধীরে তার দু-হাত বাড়িয়ে দিলে— আমাকে ধরবার জন্যে।

সেই জীবন্ত পাষাণীর স্পর্শ থেকে তাড়াতাড়ি যেমন সরে আসতে যাব অমনি চট করে ঘুম ভেঙে গেল।

চোখ কচলে উঠে বসে দেখি, পাথরের প্রতিমূর্তিটা গাড়ির ভিতরে পাতলা অন্ধকারে আবছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় সে মূর্তি যেন এক ঘুমন্ত মানুষের। বাইরে তো মড়ার মতো হলদে আধখানা চাঁদ একরাশ এলোমেলো কালো মেঘের উপরে স্তম্ভিত হয়ে আছে। গভীর রাত্রি অত্যন্ত স্তব্ধ; কেবল খুব দূর থেকে চিরজাগ্রত সমুদ্রের অশ্রান্ত হাহাকার বাতাসের ঠান্ডা দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে ভেসে ভেসে আসছে।

হঠাৎ আমার কানে একটা শব্দ গেল। গাড়ির ভিতরে কে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললে। প্রথমে ভাবলুম, আমার ভ্রম। কিন্তু তারপর ভালো করে শুনে বুঝলুম—না, ভ্রম নয়, ভিতর থেকে নিশ্চয় কারুর নিশ্বাস শোনা যাচ্ছে।

গাড়োয়ান ছোঁড়াটা তখন নেমে গাড়ির আগে আগে হেঁটে চলছিল।

প্রতিমূর্তিটার দিকে তাকিয়ে দেখলুম, সে তেমনি স্থিরভাবে পড়ে আছে।

ঝাঁ-করে মনে হল, কোনারকের সেই গেঁয়ো লোকটার রহস্যপূর্ণ আচরণ। বখশিশের লোভেও সে এই মূর্তিটার গায়ে হাত দিতে রাজি হয়নি! এ মূর্তিটাকে নিয়ে কিছু গোলমাল আছে নাকি? নইলে, দেখতে যাকে এত সুশ্রী, তাকে গাছতলায় অমন করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল কেন?

নিশ্বাস তখনও উঠছে-পড়ছে! শুধু তাই নয়, গাড়ির ভিতরে বিছানার তলায় খড় বিছানো ছিল; সেই খড়গুলো হঠাৎ খড় খড় করে উঠল—কে যেন এপাশ ফিরে শুল।

আমি ভূত মানি না। কিন্তু তবু কেন জানি না আমার বুকের কাছটা কেমন ছ্যাঁৎ-ছ্যাঁৎ করে উঠল! গাড়ির ভিতর পানে চাইতে আর ভরসা হল না। খালি মনে হতে লাগল—যেন কার দু-দুটো পাথুরে চোখের থমথমে চাহনি ধারালো ছুরির কনকনে ফলার মতো ক্রমাগত আমার পিঠের উপরে এসে বিঁধছে আর বিঁধছে! শেষটা এমনি অস্বস্তি বোধ হতে লাগল যে, আমি আর কিছুতেই সেখানে তিষ্ঠতে পারলুম না। এক লাফে সে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে অন্য এক গাড়িতে গিয়ে উঠলুম। সেখানে আমার দুই বন্ধু শুয়ে ঘুমোচ্ছিলেন; গুঁতোগুঁতি করে কোনো গতিকে বাকি রাতটা কাটিয়ে দিলুম।

ভোর হল। প্রান্তর তখনও শেষ হয়নি।

নিজের গাড়িতে ফিরে আসতেই দেখি—আমার বিছানার উপরে একটা কুকুরছানা, কুণ্ডলী পাকিয়ে দিব্যি আরামে শুয়ে নিদ্রাসুখ উপভোগ করছে।

কান ধরে সেটাকে তুলে বাইরে ফেলে দিলুম। ছানাটা কেঁউ কেঁউ করে উঠতেই গাড়োয়ান ছোঁড়া ছুটে এল। বললে, ‘বাবু, মেরো না, মেরো না, ও আমার কুকুর!’

‘তোর কুকুর!’

‘হ্যাঁ বাবু, ওর মা মরে গেছে; তাই ও আমার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতেই থাকে।’

বুঝলুম, গেল রাত্রে গাড়িতে কার নিশ্বাস শুনেছিলুম! কিন্তু তবু—

চার

কলকাতায় এসে নর্তকীর সেই প্রতিমূর্তিটিকে আমার বাইরের ঘরের একটি ছোটো টেবিলের উপরে দাঁড় করিয়ে দিলুম।

আমার স্ত্রী তাকে দেখবার জন্যে একদিন বাইরের ঘরে নেমে এলেন। অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভঙ্গিভরে ব্যঙ্গ করে তার দিকে চেয়ে বললে, ‘কালামুখীর দাঁড়াবার আর ঢং দ্যাখ না—দি ঠাস করে গালে এক চাপড়!’ রমা মূর্তির গালে সকৌতুকে একটি চড় বসিয়ে দিলে।

কিন্তু সেই সঙ্গেই সে আর্তনাদ করে দু-পা পিছিয়ে গেল! আমি অবাক হয়ে দেখলুম, তার মুখ একেবারে পাঙ্গাশ হয়ে গেছে!

‘কী হল রমা, অমন করে উঠলে কেন?’

‘আমার হাত ও কামড়ে দিয়েছে!’

‘কামড়ে দিয়েছে! ক্ষেপে গেলে নাকি?’

‘ওকে চড় মারতেই ও-যেন আমাকে কটাস করে কামড়ে দিলে! বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখ, হাত দিয়ে আমার রক্ত পড়ছে!’

তাই তো, রমার হাত দিয়ে সত্যিই রক্ত গড়াচ্ছে যে! হতভম্বের মতো মূর্তির দিকে চাইলুম; কিন্তু তখনি বুঝতে পারলুম আসল ব্যাপারটা কী! নর্তকীর নাকের ডগাটি শিল্পী অত্যন্ত সূক্ষ্ম করে ক্ষুদেছে! রমার হাত তার উপরে পড়াতেই আঁচড়ে গেছে আর কী!

কিন্তু রমা বিশ্বাস করলে না। আমার মুখে সে আগেই শুনেছিল, এ মূর্তিকে আমি কী করে কেমন অবস্থায় পেয়েছিলুম। সে বললে, ‘একে যখন লোকে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, তখন এ আপদকে ঘাড়ে করে বয়ে তোমার বাড়িতে আনবার কী দরকার ছিল?’

স্ত্রীলোকের কী কুসংস্কার! আমি হেসে বললুম, ‘যাও যাও, আর পাগলামি করতে হবে না—হাতে জল দাও গে যাও!’

ভয়ে-ভয়ে নর্তকীর দিকে তাকিয়ে রমা ঘর থেকে নীরবে বেরিয়ে গেল।

আমিও কিন্তু কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নর্তকীর দিকে চেয়ে রইলুম। রূপের গরবে ভরা হাসিমুখে, আমার দিকে দু-খানি নিটোল বাহু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন কার অভিশাপেই সে আজ নিশ্চল পাষাণে পরিণত হয়ে নিস্তব্ধ; নইলে ওই মুখের কলহাস্যরোলে এবং ওই চরণে রুনু-রুনু নূপুরনিক্কণে এখনি আমার ঘর পরিপূর্ণ হয়ে উঠত।

পাঁচ

বিনোদকে তোমরা সকলেই জানো বোধ হয়। এখন তার যে ভয়ানক দশা হয়েছে, তার জন্য দায়ী কে জানো?—নর্তকীর ওই প্রতিমূর্তিটা। বিনোদ যদি নর্তকীর প্রতিমা না দেখত, তাহলে ভালো আঁকিয়ে বলে দেশ-বিদেশে আজ তার নাম ছড়িয়ে পড়ত। সে একজন মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠত। বিনোদের শোচনীয় পরিণাম তোমাদের কারুর অজ্ঞাত নেই, কিন্তু তার আসল কারণ খালি আমিই জানি।

বিনোদ কলকাতায় থাকত না। কলকাতায় যখন আসত তখন আমার বাড়িতেই এসে উঠত। আমি ছিলুম তার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু।

সেবারে কলকাতায় এসে দেবদাসীর এই মূর্তিটা দেখে সে আনন্দে একেবারে বিভোর হয়ে পড়ল। উচ্ছ´সিত স্বরে বললে, ‘রমেশ, এ যে অমূল্য রত্ন! বন্ধু, তুমি লাখ টাকা পেলেও আজ আমি এত খুশি হতুম না।’ বিনোদ কাছে-দূরে আশপাশ সুমুখ ও পিছন থেকে নানারকমে ঘুরে-ফিরে প্রতিমূর্তিটা দেখলে। তারপর তার গায়ের পরে আপনার হাত রেখে আবার বললে, ‘এ সেই অতীতের বিশ্বকর্মার গভীর সাধনার ফল, এ যুগের সাধ্য কী এমন প্রতিমা গড়তে পারে! দেখ বন্ধু, এক পাষাণ-দেহে কী অপূর্ব সুষমা, হাত-পায়ের কী বিচিত্র ভঙ্গিমা! আমি যদি সম্রাট হতুম আর এ যদি মানুষ হত, এর একটি চাহনির জন্যে আমি সাম্রাজ্য বিকিয়ে দিতুম! হায়, এ হচ্ছে পাষাণী! একে ভালোবাসলেও প্রতিদানে আমি কিছুই পাব না! তবু দেখ, এ পাষাণও শিল্পীর হাতের মায়াস্পর্শ পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে, যেন এই কঠিন পাথরের আড়ালে আড়ালে প্রাণের লুকানো ধারা চুপি চুপি বয়ে যাচ্ছে—হাত দিলে যেন হাতে তার উত্তাপ পাওয়া যায়!’

এই বলে বিনোদ সেই প্রতিমার গায়ে হাত দিলে; কিন্তু পরমুহূর্তেই বিদ্যুতের হাতের মতো হাতখানা গুটিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

আচমকা তার এই ভাবান্তর দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘কীহে, ব্যাপার কী?’

বিনোদের খানিকক্ষণ বাক্যস্ফূর্তি হল না। তারপর একবার সেই মূর্তির দিকে, আর একবার আমার দিকে ফ্যালফেলে চোখে চেয়ে আমতা আমতা করে বললে, ‘কি সত্যি?’

‘কী সত্যি হে?’

‘দেখ রমেশ, এই মূর্তির গায়ে যেমনি হাত রাখলুম অমনি আমার কি মনে হল জানো? মনে হল ওর দেহের ভিতর থেকে হৃৎপিণ্ডটা দুপদুপিয়ে নেচে উঠল!’

আমি উচ্চস্বরে হেসে বললুম, ‘মূর্তিটা দেখে তোমার এত আনন্দ হয়েছে যে তুমি একেবারে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে বসে আছ!’

বিনোদ প্রতিমার গায়ে আবার হাত দিয়ে একটু হেসে বললে, ‘তাই বটে—আমারই ভ্রম। কই, এখন তো আর তা মনে হচ্ছে না। দেহ এখন স্তব্ধ, স্থির মৃত্যুর মতো শীতল!’ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললে, ‘হায়রে, পাষাণকে কি বাঁচানো যায়! তা যদি পারতুম, তাহলে আমরা, শিল্পীরা, আজ শত শত নিখুঁত আদর্শ মানুষ গড়ে সমস্ত সংসারকে সুন্দর করে তুলতুম!’

ছয়

আমার একটি বদ অভ্যাস আছে। রাত অন্তত দেড়টা-দুটো না বাজলে সহজে আমার ঘুম হয় না। প্রথম রাতটা আমি বই-টই পড়ে কাটিয়ে দি।

সে রাত্রে যখন পড়া সাঙ্গ করে উঠলুম, ঘড়িতে তখন দুটো বাজতে দশ মিনিট। আলো নিবিয়ে শুতে যাচ্ছি, এমন সময় বারান্দায় কার পায়ের শব্দ পেলুম।

এত রাত্রে জেগে কে? আশ্চর্য হয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি বিনোদ বেড়াচ্ছিল। বারান্দার এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত সে অস্থিরভাবে বেড়াচ্ছিল। সে রাত্রে গরমটা পড়েছিল কিছু অতিরিক্ত। ভাবলুম, গরমে বোধ হয় তার ঘুম ভেঙে গেছে, তাই সে বাইরে বাতাস পাবার জন্যে বেরিয়ে এসেছে। এই ঠিক করে তাকে আর না ডেকেই আমি শুয়ে পড়লুম।

পরদিন সকাল বেলায় বিনোদের সঙ্গে যখন দেখা হল, বললুম, ‘কীহে, কাল ভালো করে ঘুম হয়নি বুঝি?’

সে বিস্মিত স্বরে বললে, ‘তুমি জানলে কী করে?’

আমি বললুম, ‘কাল রাত দুটোর সময়ে তুমি যখন বারান্দায় এসেছিলে আমি তখন জেগেছিলুম।’

বিনোদ আমার কাছে সরে এসে খুব মৃদুস্বরে বললে, ‘ভাই, কাল এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছি। নর্তকীর মূর্তিটার একটা নকল তুলতে তুলতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কী স্বপ্ন দেখছিলুম জানো? দেখলুম, মূর্তিটা যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল। যদিও তার দেহ যেমন ছিল তেমন পাথরেরই ছিল। এক-পা এক-পা করে আমার কাছে এগিয়ে এসে হাসতে হাসতে সে বললে, ‘‘তোমার কথা আমি শুনেছি, তুমি আমাকে ভালোবাসতে চাও না?’’ আমি বললুম, ‘‘হ্যাঁ’’, ‘‘তাহলে আমিও তোমাকে ভালোবাসব, আর কখনো ছাড়ব না’’—এই বলে সে আমাকে প্রাণপণে আলিঙ্গন করলে! তার সেই শক্ত পাথরের হাতের চাপে আমার দম যেন আটকে আসতে লাগল। আমি জোর করে যেমন তার হাত ছাড়াতে যাব অমনি ঘুম ভেঙে গেল। তারপর কিছুতেই আর ঘুম আসে না। সেই বিদঘুটে স্বপ্নের কথা কোনোমতেই আর ভুলতে পারলুম না। সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মাথাটা এমনই গরম হয়ে উঠল যে শেষটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। কাল সারারাত অনিদ্রায় কেটেছে।’

কোনারকের প্রান্তরে আমি যে স্বপ্নটা দেখেছিলুম, সেটাও অনেকটা এই ধরনের। আমার বুক কী-এক বিপদ ভয়ে গুরগুর করে উঠল। তবে কি সত্যসত্যই এ মূর্তিটার ভিতরে অস্বাভাবিক কিছু আছে? একটু উত্তেজিত স্বরে বললুম, ‘বিনোদ, ও ঘরে আর তুমি শুয়ো না।’

আমার স্বরে চমকে উঠে বিনোদ বললে, ‘কেন বলো দেখি?’

নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, ‘তুমি ও মূর্তিটার কথা বড়ো বেশি ভাবছ। হয়তো আজও তুমি ওকে আবার স্বপ্নে দেখবে।’

বিনোদ হাসতে হাসতে বললে, ‘দেখলুমই-বা, তাতে হয়েছে কী!—স্বপ্ন তো সত্য নয়!’

তাকে আমি আর কখনো হাসতে দেখিনি। সেই হাসিই তার শেষ হাসি।

সাত

তারপর সেই ভয়ঙ্কর রাত্রি—সে রাত্রির কথা আমার জীবনে কখনো ভুলব না।

সে রাত্রেও আমি টেবিলের সামনে বসে একখানা বই পড়ছিলুম। রাত তখন একটার কাছাকাছি। চারিদিকে স্তব্ধতা যেন থমথম করছে।

কোথাও কিছু নেই। হঠাৎ একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক এক আর্তনাদ!—সে কী চিৎকার! চারিদিকের গভীর নীরবতার মধ্যে সে আর্তনাদ যেন আকুলভাবে ঝাঁপ দিয়ে কোথাও থই না-পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডুবে গেল।

এক লাফে আমি দাঁড়িয়ে উঠলুম।

আমার স্ত্রীও ধড়মড়িয়ে জেগে বিছানায় উঠে বসে সভয়ে বললে, ‘ও কী গো, ও কী!’

আবার আর্তনাদ! এবার তত জোরে নয়, কিন্তু অত্যন্ত যন্ত্রণা ভরা। এ যে বিনোদের স্বর!

আমি আর দাঁড়ালুম না, ঝড়ের মতো বেরিয়ে বাইরের ঘরের দিকে ছুটে গেলুম।

বাইরের ঘরের দরজা ঠেলতেই দড়াম করে খুলে গেল। ভিতরে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। মনে হল, সে অন্ধকার যেন হা করে আমাকে গিলতে আসছে! শুনলুম সেই অন্ধকারের মধ্যে থেকে অতিকষ্টে গেঁঙিয়ে-গেঁঙিয়ে বিনোদ বলছে ‘ছাড়-ছাড়—ওরে পিশাচী, ছেড়ে দে—ছেড়ে দে—ছে—’ আর কথা বেরুল না। কেউ যেন তাকে এত জোরে চেপে ধরলে, যে তার স্বর একেবারে বন্ধ হয়ে গেল!

তোমরা বুঝবে না, সে যে কী এক মহাভয়ে আমার সর্বাঙ্গ নেতিয়ে পড়ল। পারলে, তখনি আমি ছুটে পালাতে পারতুম। কিন্তু সে শক্তিও আমার ছিল না। ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মাটির উপরে আমি দু-হাতে ভর দিয়ে বসে পড়লুম। অন্ধকার ঘরের ভিতরে কেমন একটা অস্পষ্ট ঝটপটানি শব্দ হতে লাগল। কেউ যেন কারুর সঙ্গে জোঝাজুঝি করছে, কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টাতেও মুক্তিলাভ করতে পারছে না!…ক্রমে ক্রমে সেই ঝটপটানি শব্দটা থেমে গেল। তারপর, সব চুপচাপ। আর একটু তেমনভাবে থাকলেই আমি নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে যেতুম। কিন্তু বাড়ির যে যেখানে ছিল সবাই জেগে উঠে হইচই করতে করতে সে ঘরে ছুটে এল, আলো দেখে আমার আচ্ছন্ন ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে গেল।

আড়ষ্ট চোখে দেখলুম, নর্তকীর সেই প্রতিমূর্তিটা টেবিলের ওপর থেকে মাটিতে উপুড় হয়ে সটান পড়ে আছে, আর তারই তলায় বিনোদের দেহ নিথর হয়ে রয়েছে!

সবাই মিলে ধরাধরি করে পাথরের সেই ভারী মূর্তিটি বিনোদের ওপর থেকে তুলে ফেললুম। বিনোদের বুকে হাত দিয়ে দেখলুম, সে বেঁচে আছে।

তখনই ডাক্তার ডেকে আনা হল।

সেই মূর্তির চাপে বিনোদের দেহ আষ্টেপৃষ্ঠে থেঁতলে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে সে প্রাণে বাঁচল বটে, কিন্তু তার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেল। এখন তার কাছে গেলে সে ক্রমাগত বলতে থাকে, পাষাণীর স্পর্শে বুক তার পাষাণ হয়ে গেছে।

আট

রমেশ চুপ করিল। খানিকক্ষণ শ্রোতারা কেউ কোনো কথা কহিল না।

তারপর যোগেশ আপনার নিবন্ত বিড়িতে খুব একটা জোর টান মারিয়ে বলিল, ‘সে লক্ষ্মীছাড়া মূর্তিটার কী হল?’

রমেশ বলিল, ‘তাকে ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলে দিয়েছি।’

সুরেশ বলিল, ‘সেটা নিশ্চয়ই ভৌতিক মূর্তি, নইলে—’

রমেশ বাধা দিয়া বলিল, ‘না, আমি ভূত মানি না।’

‘তাহলে বিনোদের অমন দশা হল কেন?’

‘মূর্তিটা বোধ হয় কোনো গতিকে তার ঘাড়ের ওপর পড়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে ভৌতিক কী আছে?’

‘তবে সেটাকে ভাঙলে কেন?’

‘তারই জন্যে আমার বন্ধুর অমন অবস্থা হল, সেই রাগে…কিন্তু মূর্তিটাকে ভাঙবার সময়েও আর এক কাণ্ড ঘটে। চাকররা যখন হাতুড়ি দিয়ে মূর্তিটার ওপরে ঘা মারছিল, তখন হঠাৎ তার গা থেকে একখানা ভাঙা পাথর ঠিকরে একটা চাকরের কপালে গিয়ে এমনি জোরে লাগে যে, সে তখনি অজ্ঞান হয়ে ঘুরে পড়ে যায়।’

উমেশ কপালে চোখ তুলিয়া বলিল, ‘কী ভয়ানক! তবু তুমি বলতে চাও, এটা ভৌতিক ব্যাপার নয়?’

রমেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘না, আমি ভূত মানি না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *