1 of 2

অভিশপ্ত নীলকান্ত

অভিশপ্ত নীলকান্ত

প্রায় আট শতাব্দী আগেকার কথা। আমেরিকায় তখনও শ্বেতাঙ্গ সভ্যতার পত্তন হয়নি। আমেরিকার নামও তখন শ্বেতাঙ্গরা জানত না। বর্তমানে যে দেশ দক্ষিণ আমেরিকা নামে বিখ্যাত, তারই উত্তর-পশ্চিম দিকে এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল তখন ইনকাদের সাম্রাজ্য। ইনকা জাতের লোকেদের আজ ‘রেড ইন্ডিয়ান’ বা ‘লাল মানুষ’ বলে ডাকা হয়।

ইনকারা যে রীতিমতো সভ্য ছিল, তাদের স্থাপত্য প্রভৃতির ধ্বংসাবশেষ দেখলে সেটা বুঝতে বিলম্ব হয় না। কিন্তু মধ্যযুগের যুদ্ধলিপ্সু শ্বেতাঙ্গেরা তাদের সভ্যতা ও সাম্রাজ্যকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে।

পৃথিবীর সব রাজবংশেই কোহিনুরের মতো বিখ্যাত মণি বা হীরকের আদর আছে। ইনকারাও একটি বিশেষ হীরকের অধিকারী ছিল। সে একটি অতি মূল্যবান নীলকান্ত মণি। তার রং উজ্জ্বল নীল।

প্রায় আটশত বৎসর আগে ওই দুর্লভ হিরাখানি চুরি যায়। কেমন করে, কেউ তা জানে না।

ইনকাদের প্রধান পুরোহিত চোরের উদ্দেশে দিলেন অভিশাপ। একটা বা দুটো নয়, মোট নিরানব্বইটা অভিশাপ! প্রত্যেক অভিশাপের মূল কথা হচ্ছে, যার কাছে এই মণি থাকবে তার সর্বনাশ হবে।

পুরোহিতের অভিশাপ ব্যর্থ হয়নি। গত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে বহু ব্যক্তি এই অভিশপ্ত মণির মালিক হয়ে লাভ করেছে চরম দুর্গতি বা দুর্ভাগ্য— অর্থাৎ মৃত্যু।

সেকালকার করুণ ঘটনাগুলি লিপিবদ্ধ করবার জায়গা আমাদের নেই। আমরা একালের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করব।

১৮৯৯ সালে একজন নাবিক ব্রাজিলের পার্নামবুকো শহরে গিয়ে এক দোকানে ওই নীলকান্ত মণিখানি দেখতে পায় এবং কিনতে চায়।

দোকানদার বললে, ‘কিন্তু আমি জানানো উচিত মনে করছি যে এখানা হচ্ছে ইনকাদের বিখ্যাত অভিশপ্ত মণি!’

নাবিক বললে, ‘অভিশাপের নিকুচি করেছে! হিরাখানি আমি কিনব!’

হিরাখানা সে নিজের আংটির উপরে বসিয়ে নিলে। চারদিন পরে গলাকাটা অবস্থায় তার মৃতদেহ পাওয়া গেল এক জেটির ওপরে।

তারপরেই ওই হিরার আংটির মালিক হল আর এক নাবিক। তারও মরতে দেরি লাগল না। দেহ তার কুচি কুচি করে কাটা, কিন্তু হাতের আঙুলে সেই হিরার আংটি।

নাবিকের বউ শখ করে আংটিটা নিজের আঙুলে পরলে এবং ঠিক বিশ দিন পরেই একখানা পাঁচতলা বাড়ির উপর থেকে ঝাঁপ খেয়ে আত্মহত্যা করলে।

আংটিটার নতুন নাম হল ‘পার্নামবুকের প্রমাদ।’

তারপর আংটিটা যেখানে যায়, সেখানেই ডেকে আনে সর্বনাশকে। একে-একে মারা গেল পাঁচজন লোক। প্রত্যেক মৃত্যুই অপঘাত।

তারপর বেশ কিছুকাল ধরে এই সর্বনেশে হিরার আংটির আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সুতরাং ইতিমধ্যে সে আরও কারুর কারুর অপঘাত মৃত্যুর কারণ হয়েছিল কি না সে কথা জানা যায় না।

আমরা বলব তার পরের ঘটনা।

পৃথিবীর প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে।

চলচ্চিত্রের জন্য বিখ্যাত হলিউড শহর।

সেখানে হঠাৎ এক শ্রেণির চোরের আবির্ভাব হল। তারা দামি দামি মোটরের নানা অংশ খুলে চম্পট দেয়। থানায় থানায় অভিযোগের পর অভিযোগ আসে। পুলিশ রীতিমতো সজাগ।

ক্লার্ক হচ্ছেন একজন পুলিশ কর্মচারী। এক রাত্রে রাস্তায় টহল দিতে দিতে দেখতে পেলে, দু-খানা মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তার মধ্যে পিছনের গাড়িখানার চলন্ত ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

আরও কয়েক পা এগিয়েই ক্লাক বুঝতে পারলে, দু-জন লোক সামনের গাড়িখানার অংশ খুলে নেওয়ার কাজে ব্যাপৃত হয়ে আছে।

তৃতীয় এক ব্যক্তি একটু যে আড়ালে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে, ক্লার্ক তা দেখতে পেলে না। সে আরও এগিয়ে ভালো করে তদন্ত করতে এল।

অমনি ওরে বাসরে, ধ্রুম, ধ্রুম, ধ্রুম! উপরিউপরি রিভলভারের গুলিবৃষ্টি!

ক্লার্ক এক লাফে একটা দেওয়ালের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পৈতৃক প্রাণ রক্ষা করলে। পিছনের গাড়িখানা তিরবেগে ছুটে বেরিয়ে গেল।

ক্লার্ক ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে রিভলভার বাগিয়ে ধরে ছুটন্ত গাড়িখানার দিকে প্রেরণ করলে একটা উত্তপ্ত বুলেট।

গাড়িখানা থামল না বটে, কিন্তু শোনা গেল একটা একটানা আর্তনাদ।

বুলেট বিদ্ধ হয়েছে অন্তত একটা চোরের দেহ।

চারিদিকে খোঁজ খোঁজ রব উঠল। হাসপাতালে হাসপাতালে এবং ডাক্তারদের বাড়িতে বাড়িতে সন্ধান নেওয়া হল, কোনো আহত লোক চিকিৎসার জন্যে গিয়েছে কি না।

না, কেউ যায়নি।

তবে কি লোকটা মারা পড়ল? লাশটা কী কোথাও পুঁতে ফেলা বা ফেলে দেওয়া হয়েছে? তখন সেই তল্লাশ চলল।

দিনচারেক পরে একটা ড্রেনের ভিতর থেকে আবিষ্কৃত হল একখানা মোটর গাড়ির তলায় পাতা কম্বল এবং একটা সচ্ছিদ্র টুপি। দুটো জিনিসেই লেগে আছে রক্তের দাগ।

বোঝা গেল বুলেটের আঘাতেই টুপিটা ছ্যাঁদা হয়ে গেছে। মাথায় যখন বুলেট লেগেছে, লোকটা তখন আর বেঁচে নেই।

কিন্তু তার মৃতদেহ কোথায়?

দুর্ঘটনার পর কেটে গেল আট দিন।

ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াল কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুনোর মতো।

মেট্রো-গোল্ডউইন মেয়রের স্টুডিয়োর কাছে যে ছোটো নদী আছে, তারই তীরে মাটি খুঁড়ছিল দু-জন মজুর।

খুঁড়তে খুঁড়তে আচমকা বেরিয়ে পড়ল একটা মৃতদেহ! প্রায় গলিত অবস্থা, পোশাক-পরিচ্ছদ যেন রক্তে ছোপানো এবং লাশের মাথায় একটা বুলেটের ছিদ্র।

খবর পেয়ে পুলিশ ছুটে এল দলে দলে।

পুলিশের এক বড়ো কর্তা দেখে শুনে বললে, ‘নিশ্চয় ক্লার্কের গুলিতেই লোকটা মারা পড়েছে।’

কিন্তু তার পরেই আবিষ্কৃত হল আর এক ব্যাপার। মৃতদেহের বুকের উপরে আর একটা বুলেটে ছ্যাঁদা।

ক্লার্ক বলে, সে এক বারের বেশি রিভলভার ছোড়েনি। একটিমাত্র বুলেট, কিন্তু মাথায় এবং বুকে দু-দুটো ছ্যাঁদা! তাও কখনো হয়?

গোয়েন্দাদের চক্ষুস্থির!

যুবকের মৃতদেহ। মাথায় মাঝারি, পেশিবদ্ধ জোয়ান দেহ, সাজপোশাক দামি কিন্তু রুচিসম্মত। পোশাক তল্লাশ করে কিছুই পাওয়া গেল না, কেবল কামিজের হাতায় আছে দুটো বোতাম, তার উপরে খোদা তিনটে অক্ষর— এনএফডি।

পোশাকের উপরে দেখা গেল ওকল্যান্ডের এক দরজির নাম ও ঠিকানা।

আবার তিনদিন কেটে যায়।

ওকল্যান্ড থেকে খবর এল, মেরি ডাবেলিকের স্বামী হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছে। তার নাম নিকোলাস এফ ডাফোলিক।

মেরি এসে নিকোলাসের দেহ শনাক্ত করলে।

তার মুখে জানা গেল, নিকোলাস ভদ্র বংশের সন্তান এবং নিজেও অতি ভদ্র, অতি সজ্জন। সে নাম করা ব্যবসায়ী। সে অসৎ সঙ্গ পরিহার করে চলে। সে অজাতশত্রু।

মাস কয়েক আগে সে একটি দশ রতি হিরার মূল্যবান আংটি ক্রয় করেছে এবং তারপর থেকেই কেবল যেন সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। প্রায়ই বলত, ‘কে যেন সর্বদাই আড়াল থেকে আমার উপরে ওত পেতে আছে, কে যেন আমার সমস্ত গতিবিধি লক্ষ করেছে, কে যেন আমাকে গুরুতর বিপদে ফেলতে চায়!’

‘যেদিন নিকোলাসের সঙ্গে তোমার শেষ দেখা, সেদিনও কি তার হাতে ওই আংটিটা ছিল?’

‘ছিল বই কী!’

‘টাকাকড়ি?’

‘তার সঙ্গে সর্বদাই কয়েক শত টাকা থাকত।’

‘টাকা বা আংটি কিছুই আমরা পাইনি।’

‘শুনেছি ওই হিরার আংটিটা নাকি বড়োই অলক্ষুণে! কিন্তু শুনেও নিকোলাস আংটিটা হাত থেকে খুলে রাখতে রাজি হয়নি।’

‘তোমার স্বামীর বন্ধুদের কথা কিছু বলতে পারো?’

‘আমার স্বামীর বিশেষ বন্ধু বলতে একজনকেই বোঝায়। তাঁর নাম জ্যাক অ্যালেন। খুব ভদ্রলোক। ওকল্যান্ডেই থাকেন। এখনও তিনি আমাদের খোঁজখবর নেন।’

ওকল্যান্ড থেকে ঘটনাক্ষেত্র হচ্ছে চার-শো মাইল দূরে। তবু গোয়েন্দারা অ্যালেনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলে।

কিন্তু অ্যালেনের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কিছুই জানা গেল না।

গোয়েন্দারা ফাঁপড়ে পড়ে গেল। একটা আহত বা নিহত চোরের সন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া গেল ওকল্যান্ডের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর মৃতদেহ! তার উপরে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল একটা প্রাচীন ও অভিশপ্ত নীলকান্ত মণির রহস্য! কিছুই ধরবার ছোঁওয়ার জো নেই!

তারপরেই সব ঘটনার জট খুলে গেল অকস্মাৎ।

ওকল্যান্ডের এক জহুরির কাছে খবর পাওয়া গেল, সেখানে জনৈক ব্যক্তি একখণ্ড মূল্যবান হিরার দর যাচাই করতে গিয়েছিল। কিন্তু যাচাই করতে দিন কয় দেরি লাগবে শুনে সে হিরা নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি প্রস্থান করেছে।

‘তার চেহারা আর সাজপোশাক কীরকম?’

জহুরির বর্ণনা শুনে গোয়েন্দাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল হুবহু জ্যাক অ্যালেনের মূর্তি!

অ্যালেনকে থানায় ডেকে আনা হল। সে বললে, ‘আমি নির্দোষ ভদ্রলোক। আমি চোরও নই, খুনিও নই।’

গোয়েন্দারা তখন পুলিশের দপ্তর খুঁজে দেখতে লাগল, তার মধ্যে নির্দোষ ভদ্রলোক অ্যালেনের পূর্বজীবনের কাহিনি পাওয়া যায় কি না?

পাওয়া গেল। তার আসল নাম হচ্ছে ফরেস্ট সিসিল মিঙ্গল। ১৯০৯ সালে সে আমেরিকার অন্য এক শহরে একটি মহিলাকে হত্যা করে তাঁর এক গহনার বাক্স চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং দীর্ঘকাল জেল খাটে।

তখন ভেঙে গেল মিঙ্গল ওরফে অ্যালেনের সাধুতার ভড়ং। তারপর খুব সহজ হয়ে গেল গোয়েন্দাদের কাজ। অবশেষে মিঙ্গলকে স্বীকার করতে হল যে, অভিশপ্ত নীলকান্ত মণির লোভেই সে নিকোলাসকে হত্যা করেছে।

বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাবাসের হুকুম হল।

কিন্তু যাকে নিয়ে এই কাহিনির সূত্রপাত, সেই মোটর-চোরটা ক্লার্কের গুলি খেয়ে জখম হল কী মারা পড়ল, তার কোনো পাত্তা পাওয়া গেল না।

আর জানা গেল না সেই ভয়াবহ নীলকান্ত মণির পরিণাম! মিঙ্গল ধরা পড়বার আগে সেখানা কোথায় লুকিয়ে ফেলেছে, না আবার কারুর কারুর হাতের আংটিতে সংলগ্ন হয়ে সে নতুন নতুন সর্বনাশের আয়োজন করেছে?

কিন্তু তার অভিশাপ থেকে মিঙ্গলও শেষ পর্যন্ত মুক্তিলাভ করতে পারেনি।

কারাগারে একদিন আচম্বিতে ঘুম থেকে উঠে সে ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করতে লাগল, ‘ওই আংটি! ওই আংটি! ওই আংটি!’

তারপর কারাগারেই হঠাৎ তার মৃত্যু হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *