অভিলাষ
রাঁচি-রোড স্টেশনের কাছেই ‘মারার’-এ ইফিকো লিমিটেডের চমৎকার গেস্টহাউস। ‘শান্তিপুঞ্জ’ ট্রেন হয়ে যাওয়াতে যাতায়াতেরও কোনো অসুবিধাই নেই। জেনারেল ম্যানেজার বাসু সাহেবের যত্নআত্তিরও খুঁত নেই কোনো। তবে স্নিগ্ধদের সঙ্গে অমিয় আছে বলেই এই খাতির-প্রতিপত্তি। অমিয় ইফিকো কোম্পানির একজন ডিরেক্টর। নইলে ওদের নিজস্ব দাম আর কতটুকু?
স্নিগ্ধ আর ভূতনাথ (ওরফে ভুতো) চানটান করে, সুটকেস প্যাক করে সকালের চা-জলখাবার খেয়ে নিয়েই বারান্দাতে এসে বসেছিল। সামনে টেরাসিং করা চমৎকার লন। অমিয়ও এল ঘর থেকে। একেবারে তৈরি হয়েই। ত্রিবেণীজি ড্রাইভারও গাড়ি নিয়ে তৈরি। এখন হাজারিবাগের দিকে রওয়ানা হয়ে যেতে পারে।
ঠিক এমন সময়ে মোটরসাইকেলের ভটভটানি আওয়াজ শুনে ওরা তিন-জনেই চোখ তুলে তাকাল। দেখল ইফতিকার আহমদ, ওদের বহুপুরোনো বন্ধু, একজন অপরিচিত ভদ্রলোকের বাইকের পেছন থেকে নামল।
নেমেই বলল, সালাম ওয়ালেকুম।
ওয়ালেকুম, আসসালাম।
অমিয় বলল, কাঁহাসে আ পঁউছা হিঁয়া আচানক?
—রামগড় থেকেই আসছি। তোরা বড়োসাহেব। তোদের রাহান-সাহান-এর খবর তো সারা এলাকাই রাখে। আজই সকালে এরফান চাচার ডেথ হয়ে গেল। তাই ভাবলাম একবার ঢুঁ মেরে যাই। তোদের গাড়িতেই বসে পড়ব।
—কী হয়েছিল এরফান চাচার? স্নিগ্ধ শুধোল।
—ক্যা নেহি হুয়া থা ওহি পুছ। ডায়াবেটিস, হাই-ব্লাডপ্রেসারভি। ইমরান ভাইয়াকা টেলিফোন আ পঁহুঁছা অউর ম্যায় তুরন্ত দৌড়কে আয়া হিঁয়া। হামে লেবি তো?
—মজাক উড়াস না। তোর মালপত্র কোথায়?
ভূতনাথ শুধোল।
—এই তো।
বলেই কাঁধের ব্যাগটি দেখাল। বলল, এরফান চাচাকে গোর দেওয়া হবে। গোছগাছ করার সময়ই পেলাম না। হাসিনা নিয়ে আসবে সঙ্গে, পরে।
—পরিণত বয়সেই গেলেন। হাবিব চাচার মতো অকালে তো যাননি এরফান চাচা।
অমিয় স্বগতোক্তি করল।
—তা ঠিক।
—নে ওঠ, যাব এবার আমরা। ওই যে, বাসু সাহেবের সাদা অ্যাম্বাসাডার আসছে।
ডা. বাসু আসতেই, অমিয় ইফতিকারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। বলল, আমাদের ছেলেবেলার বন্ধু, হাজারিবাগের। ঠিকাদারি করে রামগড়ে। মিলিটারির ঠিকাদার।
নমস্কার-আদাব বিনিময়ের পরেই ওরা বেরিয়ে পড়ল।
বাসু সাহেবের গাড়িও কারখানার দিকে চলে গেল।
গাড়ি ছেড়ে দিল হাজারিবাগের দিকে। পেছনে পড়ে রইল ‘মারার’।
হু-হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। কাচ সব তুলে দিয়েও গরম জওহরকোটের বোতাম আঁটতে লাগল স্নিগ্ধ। তার ওপরে গরম শাল জড়ানো। হাজারিবাগি শীত তো নয়; হাজারিবাঘি শীত!
জানলা দিয়ে দু-পাশের দ্রুত অপস্রিয়মাণ দৃশ্যের দিকে চেয়ে ছেলেবেলার নানা কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর। নানা স্মৃতি। এরফান চাচা, হাবিব চাচা, চাচিরা, মুনাব্বর, মকবুল, মোবাসসার, ওয়াজ্জু ইত্যাদি খেলার সাথিদের কথা। ওয়াজ্জু হজ করতে গেছিল হাবিব চাচার সঙ্গে ছেলেবেলাতেই। স্নিগ্ধও বায়না ধরেছিল সেও যাবে বলে। সে কী কান্না তার!
মা শেষে অনেক করে বুঝিয়ে বলেছিলেন যে, ‘কাফির’দের সেখানে যাওয়া মানা।
—শাকলু কেমন করছে রে ব্যাবসাতে?
—অমিয় শুধোল।
ইফতিকার বলল, বহতই আচ্ছা। এরফান চাচার পাঁচ ছেলেই খুবই ভালো করছে। আখখু, শাকলু, একরাম, প্রত্যেকেই। রাজ্জুও।
—আর হাবিব চাচার ছেলেরা?
—তারা সব ক-টা লাফাঙ্গা হয়েছে। আট-আটটি ছেলেই।
—আর মেয়েরা?
স্নিগ্ধ শুধোল।
—ক-মেয়ে ছিল যেন? ছয় মেয়ে নয়?
ইফতিকার বলল, হ্যাঁ। ছয় মেয়েই। তবে মেয়েরা আর কী করবে? শাদি হয়ে গেলে আমাদের ঘরের পর্দানসীন মেয়েদের পক্ষে যা করা সম্ভব, ঘর-গেরস্থালি, বাচ্চাদের দেখাশোনা, তাই করছে।
—পর্দা এখনও ওঠাতে পারলি না? তোরা নিজেরা তো লেখাপড়া করলি, ভালো চাকরি করছিস, ব্যাবসা করছিস, পুরো দুনিয়ার ফায়দা ওঠাচ্ছিস স্বার্থপরের মতো আর মেয়েদের বেলাতেই যত্ত….
স্নিগ্ধ বলল।
—পর্দা যে জেনানার নেই সে জেনানা তো জেনানাই নয়! দরজাতে পর্দা টাঙিয়েও আলোর মধ্যে বাস করা যায় ইচ্ছা করলেই। বুঝেছিস ইডিয়ট।
—বা: বা:। ভারি ভালো বলেছিস তো কথাটা ইফতিকার।
আমির বলল। তুই দেখছি অকলদার হয়ে উঠেছিস।
—চিরদিনই ছিলাম। তোদেরই অকল ছিল না বোঝবার মতো।
অমিয়, সেন বাড়ির জামাই বলেই বহুদিন থেকেই চেনে ইফতিকারদের পুরো পরিবারকে।
স্নিগ্ধ চুপ করে রইল।
ভাবছিল, ইফতিকারটা ঠিক সেইরকমই ফাজিল আর ছেলেমানুষই রয়ে গেল।
ডিবে থেকে মঘি পান আর খুশবুদার জর্দা মুখে ফেলে ইফতিকার বলল, ‘শামা হর রঙ্গ সে জ্বলতি হ্যায় সহর হোনে তক।’
—বহত খুব।
ভুতো বলল।
স্নিগ্ধ বলল, যার চাচা মরেছে শেষরাতে তার কবিত্ব এখনও একটুও বন্ধ হল না? তুই ঠিক তেমনই আছিস।
ইফতিকার হাসতে হাসতে বলল, ‘ইয়ে কঁহা-কি দোস্তি হ্যায় কেহ বনে হ্যায় দোস্ত নাসেহ?’
অর্থাৎ এ কী ধরনের দোস্তি যে শালা দোস্তও উপদেশ দিতে থাকে।
তারপর বলল, ইডিয়ট। এই প্রবহমান জগতে নিজে স্থির থেকে সব কিছু অনুধাবন করাটাই প্রকৃত অকলদারের কাজ। একথাটা যে না বুঝল, তার তোর মতো ইংরেজি বিশারদ হয়ে লাভটা কী?
—এই ‘অনুধাবন’ শব্দটা তুই-ই আমাকে শিখিয়েছিলি। মনে আছে? কানহারি পাহাড়ের চুড়োয় বসে এক দুপুরে?
স্নিগ্ধ ভাবছিল, সত্যিই। একটুও বদলায়নি ইফতিকারটা। আর ও যেন হুবহু বসানো মকবুল চাচা। চলা-ফেরা, হাত-নাড়া, কথায় কথায় শের আওড়ানো। খানা-পিনাতে তেমনই শৌখিন! বেশ, জিন্দা-দিল আদম।
এই কথা ভাবতে ভাবতে ইফতিকার বলল, এই ইডিয়ট। ক-দিন আছিস তুই হাজারিবাগে?
অমিয় ঠাট্টা করে বলল, তুই যে-কদিন ধরে রাখতে পারবি। এখন তো আর গোপাল সেন নেই। তোরাই এখন চুম্বকের কাজ করবি।
—তাহলে দ্যাখই-না আমার ক্ষমতার দৌড়। তোদের একদিন জবরদস্ত খানা খাওয়াব রে। সেই প্রথম জওয়ানির দিনগুলোর কথা মনে পড়িয়ে দেবে। কমসে কম দো-চার বাখরখানি রোটি, থোরাসা পায়া; জারাসা লাব্বা।
স্নিগ্ধ বলল, উমদা বিরিয়ানি, কমসে কম, থোরিসি তক্কর, পিরিচভর চৌরি ঔর দস্তরখান ইয়া রেবাবি ভর চাঁব।
—কমসে কম।
ভুতো বলল।
অমিয় বলল, তাহলে গুলহার আর বটি কাবাব কী দোষ করল?
—আর ফিরনি?
স্নিগ্ধ বলল।
—ফিরনি তো থাকবেই ঔর কমসে কম, থোরা-থোরা আণ্ডেকা রোশান হালুয়া। তোর জারা বিলকুল উতার যায়েগা। ইয়াদ হ্যায় না, আম্মি ক্যায়সি বনাতি থি।
—জরুর!
বলল, স্নিগ্ধ।
ওর চোখ দু-টি পুরোনো কথা মনে পড়াতে নরম হয়ে এল।
—আর হামদর্দ দাওয়া-খানেকি পাচনল? দো-চার বটি; কমসে কম।
—জরুর!
ইফতিকার বলল, বুড়ো বয়সে কেউ জন্নত-এ গেলে তাতে ‘গম্মির’ কী আছে? অবশ্য চাচা আমার জন্নতেই যে যাবে, দোজখ-এ যাবে না, এমন গ্যারান্টি আমি অন্তত দিতে পারব না।
অন্যরা হেসে উঠল।
স্নিগ্ধ বলল, বদতমিজ ভাতিজা।
ভুতো বলল। খাওয়াবি কোথায়? এই ‘গম্মির’’ মধ্যে?
—খাওয়া কি আর আমাদের নিজেদের বাড়িতে খাওয়াব?
—তবে? তোর শ্বশুরাল-এ?
—আমার শ্বশুরাল তো আগ্রাতে ইয়ার। ভুলেই মেরে দিলি। সেখানে কী খেতে চাইলে কী খাওয়ায় তার ঠিক কী? খাওয়াব হাজারিবাগেই। সালমার বাড়িতে। মনে আছে সালমাকে?
অমিয় বলল, নাজনিন-এর বন্ধু তো?
—জি হাঁ। সুরতহারাম। আমারও বন্ধু।
নাজনিন এর নাম উচ্চারিত হতেই স্নিগ্ধর বুকটা ধক করে উঠল। অনেক বছর ধরে ধামাচাপা দেওয়া একটি দুধ-সাদা কবুতর যেন ধামা সরিয়ে নেওয়ামাত্র এখুনি ‘ভড়ভড়’ শব্দ করে উঠল। মিনিয়েচার, সাদা হেলিকপ্টারের মতন। মস্তিষ্কের মধ্যে অনেক বছর ধরে চেপে রাখা ইটের নীচের ফ্যাকাশে হয়ে-যাওয়া ঘাস যেন আলোর দিকে পান্ডুর ফ্যাকাশে শিরা বের-হওয়া আঙুলগুলি বাড়িয়ে দিল।
স্বগতোক্তির মতোই বিড়বিড় করে স্নিগ্ধ বলল, নাজনিন কোথায় থাকে?
—ক্যা রে ইয়ার? নাজনিন-এর নাম করতেই দেখছি তোর বুকের মধ্যে জোড়া তবলার লহর আর ছনাছন ঘুঙুরের বোল উঠল। ইয়া আল্লা!
বলেই বলল, সীতাগড়া পাহাড়ের কাছাকাছি।
—সীতাগড়া পাহাড়ের কাছে?
—জি।
—ওর ছেলে-মেয়ে কী?
—এক ছেলে। এক মেয়ে।
—কী করে, নাজনিন?
করবে কী? নাজনিন তো বেগম সাহেবা। ওর বিয়ে হয়েছে-না এক নবাবজাদার সঙ্গে? ভয়ে আর লজ্জায় তো তুই ওর শাদিতে এলিই না। ডরপোক ইডিয়ট।
—কোথাকার নবাব উনি? ভুতো শুধোল।
—ওই পাটনার কাছেই কোথাকার যেন! কে খোঁজ রাখে। তখতই নেই, তার নবাব! তবে নবাবি খানদান-এর গুণ আছে মানুষটির। পয়সা চলে গিয়ে থাকতে পারে, স্বভাবটা নবাবেরই রয়ে গেছে। খুব বিদ্বান মানুষ। আরবি, ফারসি এমনকী সংস্কৃততেও পন্ডিত।
—এখন কী করেন? মানে, জীবিকা হিসেবে?
—করেন না কিছুই। সামান্য জমিদারির আয় এখনও আছে। কিন্তু খরচ অনেক। হিরে দানা, আসবাব, বন্দুক এসব বেচে-বেচেই চালান। বলেন, সঙ্গে তো যাবে না কিছুই। এইসব জিনিস-এর দাম কী? টাকার দামই-বা কী? তা তো কাগজ! কে কীভাবে ব্যবহার করে, তার ওপরেই দাম।
ইফতিকার জানলার কাচ নামিয়ে পানের পিক ফেলে বলল, ঔর বোল ইডিয়ট। ঔর ক্যা পুছনা মুঝসে?
ভুতো বলল, উস্তাদ। উনকো বাঁতে ছোড়ো। তুমহারা বারেমে বোলো।
ভুতো আর ইফতিকার একসঙ্গে হলেই সব অবস্থাতেই কথার ফোয়ারা উঠবেই উঠবে। মনে মনে এই খাতরা মেনে নিয়ে স্নিগ্ধ বাঁ-দিকের জানলা দিয়ে পথের বাঁ-পাশে চেয়ে বসে রইল।
ঘণ্টা দেড়েক লাগবে হাজারিবাগে পৌঁছোতে। গাড়িটা যতই হাজারিবাগের দিকে এগোতে লাগল ততই নানা পুরোনো কথা, স্মৃতি, সব দ্রুত ফিরে আসতে লাগল। ডিগবাজি খেতে খেতে দূরের আকাশ থেকে নানারকম পায়রারা যেমন শিস দেওয়া মালিকের ছোট্ট হাতে ফিরে আসে। ওর মনে হল যেন অগণ্য রঙে ছিদ্রিত হয়ে নীল আকাশটার সমস্তটুকুই সীমায়িত হতে হতে নেমে আসছে ওর মাথার ওপরে। আর স্মৃতিও তো কিছু কম নয়! সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলের দিনগুলো, সেন্ট কলম্বাস কলেজের দিনগুলো, হাজারিবাগের হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নানা মানুষ, চারদিকের শিকারভূমি, শীতের ভোর, বর্ষার দুপুর, বৈশাখের সকালগুলিকে কোনো জবরদস্ত ধুনুরি যেন নরম মসৃণ তুলোর মতো অবিরাম ধুনতে লাগল স্নিগ্ধর মাথার ওপরে ‘তুনুর-তুনুর’ শব্দ করে এক খাস-গন্ধী আতর-মাখা বালাপোশ বানাবে বলে।
মনে পড়ে গেল নাজনিনের কথাও। প্রথম যৌবনের সেই গর্হিত, ভয়ার্ত, আতঙ্কিত এবং অশেষ উত্তেজনাময় নিটোল ক-টি বছরের কথা। স্মৃতি সেই বিশেষ কুঠুরিটিতে আলো-ভরা এই শীতের কোলে হঠাৎ প্রবেশ করেই হিমেল আঁধারে তার বুক ছেয়ে এল।
অমিয়র সঙ্গে এবারে হাজারিবাগে আসছিল স্নিগ্ধ, গোপাল, নাজিমসাসেব কাড়ুয়া, আসোয়া, শামিম, ইজাহার, এমানুয়েল এবং চলে-যাওয়া আরও অনেকের স্মৃতি বুকে নিয়ে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ আগেই চলে গেছেন। গোপাল সেন গেল পুজোর আগে, কলকাতায়। তার স্মৃতিই সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল। এই মানসিক অনুষঙ্গে হঠাৎ ইফতিকার আহমদ ঢুকে পড়ে যে তার পরিবারের ইয়াদগারিতে ভরে দেবে ওদের সবাইকে, সর্বার্থে ঘুম পাড়ানো, ভুলে-যাওয়া নাজনিনকে যে জিয়নকাঠি দিয়ে আবার জাগিয়ে দেবে স্নিগ্ধর মনের শিশমহলে তা ওর কল্পনারও বাইরে ছিল।
চলে-যাওয়া যত বন্ধুদের স্মৃতি রোমন্থন করতেই শুধু এসেছিল সে। থেকে-যাওয়া অতিজীবন্ত এক প্রিয় বান্ধবীর সামনে গিয়েও যে দাঁড়াতে হবে হাজারিবাগে এলে, সেকথা আদৌ ভাবেনি।
নাজনিন কী ক্ষমা করবে স্নিগ্ধকে? স্নিগ্ধ নিশ্চিত ছিল যে, নাজনিন পাটনার এক রহিস আদমির বিবি হয়ে ছেলে-মেয়ে বৃদ্ধ স্বামী নিয়ে লক্ষ লক্ষ বিবাহিতা সুখী রমণীর মতোই সংসার ‘প্রতিপালন’ করছে। অর্থাৎ যে-জীবনে অপত্য আছে, টায়-টায় দেওয়া-নেওয়ার, ভাঁড়ার থেকে প্রতিসকালে মেপে-জুপে রসদ বের করার ঠিকঠাক দাম্পত্যও আছে, কিন্তু যে-জীবনে কোনো অবকাশ নেই, যতি নেই, সেখানে ‘প্রেম’ বন্ধ দেরাজের মধ্যে, বহুদিন আগে দু-জনেরই অলক্ষ্যে নেংটি ইঁদুরের মতো কবে পচে গেছে, সেরকমই কোনো নন-ডেসক্রিপ্ট জীবন। বিশ-পঁচিশ বছর বিবাহিত জীবনের অন্য দশজন সংসারীরই মতন।
এই ‘প্রতিপালন’ শব্দটাতেই অবশ্য নাজনিনের প্রবল আপত্তি ছিল চিরদিনই। মাথা উঁচু করে, গলার শিরা ফুলিয়ে ও বলত, সংসার কি বকরি-মোরগা যে, ‘প্রতিপালন’ করতে হবে। সংসার হচ্ছে কাঁঠালিচাঁপা গাছ। তাকে পেয়ার-ধিয়ান দিয়ে বড়ো করে, উজ্জ্বল সবুজ ক্লোরোফিল চকচক পাতায় পাতায় ভরিয়ে দিয়ে, তীব্রগন্ধী ফুলে ফুলে বাকায়দা ছেয়ে তোলারই, আর এক নাম সংসার করা। বড়ো সোহাগভরে বলত নাজনিন, এসো, তুমি আমার জীবনে প্রবেশ করো স্নিগ্ধ। আমি ফুলওয়ারি। খুদাহবন্দ-এর দোয়াতে তুমি আমার বাগানের হরগিজ মালিক হয়ে থাকো। কত গান গাইব আমরা, কত ফুল তুলব, কত খানা খাব আর মনের মতো খেলনা গড়ব। স্রিফ একটি বা দু-টি। দু-জনে মিলে। ছেলে হলে, তাকে মশহুর সরোদিয়া করে তুলব হিন্দুস্থানের। আর মেয়ে হলে আমার জরায়ুর সব ‘তাপ’ দিয়ে, তোমার পৌরুষের সব ‘জোশ’ দিয়ে তাকে গড়ে তুলব এক নাজুক, হামদর্দি, মরমিয়া, দরদিয়া, আওরত করে। যে আওরত আমাদের কন্যা, হিন্দুস্তাঁর-গুলিস্তাঁর লা-জয়াব বুলবুলি হবে। হাজারও বাহাদুর মর্দ তার পাণিপ্রার্থী হবে।
স্নিগ্ধ জানলার কাচটা একটু নামাল।
স্মৃতি কখনো কখনো দম বন্ধ করে দেয়।
স্নিগ্ধর চোখে-মুখে টাটকা হিমেল হাওয়া থাপ্পড় মারতে লাগল। ও ভাবছিল, সব বন থেকেই ফেরার পথ থাকে। পিচের পথ, মাটির পথ; পাকদন্ডী, কিন্তু মনের তেমন তেমন অব্যবহৃত অলিগলি দিয়ে স্মৃতির বনে একবার প্রবেশ করে গেলে সেখান থেকে বেরুবার পথ আর থাকে না।
নাজনিন-এর জবানিতে বলতে গেলে বলতে হয়, সব বেইমানি, সব বেওয়াফাই, সব মাঙ্গনি, সব গম্মি, সব সদমা, ওর ঈশ্বরের আর নাজনিনের আল্লা রসুলের দোয়াতে হিরেমতির ফুল হয়ে গাছে গাছে ফুটে থাকে; আঁকাবাঁকা, বন্য, চিত্রার্পিত নদীর চর সেখানে নম্র-মসৃণতায় শাহি-পালঙ্ক হয়ে হাতছানি দেয়, প্রতিগাছের প্রতিটি পাতাতে পাতাতে রুপোর পানদান ঝুলে থাকে, জরির জর্দা, জীবনের সব ‘অন্দরি-বাহিরি দরওয়াজা’ একই মেহালের দিকে নিয়ে যায় সেখানে পথভ্রষ্ট পথিককে।
যে মেহালের নাম ‘ইশক-মেহাল’।
দুই
ইফিকোর ত্রিবেণীজি ড্রাইভারের গাড়ি পাগমল-এ হজরত মিয়াদের বাড়ির সামনে গিয়ে যখন পৌঁছোল তখন জানাজার জন্য মুরদার খাটিয়া নামানো হয়ে গেছে। বড়া মসজিদের ইমামসাহেবকে গাড়ি করে আশাদুল্লা নাকি আনতে গেছে। উনি এলে জানাজা শেষে গোর হবে।
গোরস্থানটি হাজারিবাগ-সীমারিয়া রোডের ওপরেই। শহর ছাড়িয়ে একটু গেলেই। ছেলেবেলায় এই পথ দিয়েই স্নিগ্ধ গোপালের সঙ্গে সাইকেল রিকশা করে বনাদাগ অবধি গিয়ে সাইকেল রিকশা ছেড়ে দিয়ে হেঁটে মাইলখানেক গিয়ে ‘ক্কোসমা’তে পৌঁছোত। মোর-তিতির-কালিতিতির-খরহা শিকার করতে।
গোরস্থানের পরেই শ্মশ্মান।
ইমামসাহেব এসে নামাজ পড়ে দিতেই কফন উঠিয়ে নিয়ে সকলে নি:শব্দে চলল গোরস্থানের দিকে।
অমিয়কে বলে স্নিগ্ধ ইফতিকারের সঙ্গে হেঁটে গেল জানাজার লোকেদের পেছন পেছন নিজের রুমালে মাথা ঢেকে। অমিয় এবং ভুতো তাদের সকলকেই চেনে-জানে কিন্তু স্নিগ্ধর মতো এত দীর্ঘদিনের পরিচয় নেই ওদের ইফতিকারদের পুরো পরিবারের সঙ্গে। শৈশব থেকে যৌবনের প্রথমভাগ তো কাটেনি ওদের কারওই এই হাজারিবাগের মাটিতে!
অমিয়রা চলে গেল গাড়ি নিয়ে। গোপালদের বাড়ি বন্ধ আছে। যদিও মুনিরাম আর ধরম আছে, তবুও অনেকই কাজ থাকে। আগে পৌঁছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করাবে ওরা।
গোরস্থানে পৌঁছে ধীরে ধীরে কফন নামানো হল গোরে। বসির তার আব্বাজানের শেষকৃত্য করবে। মাপমতো মাটি কেটে কবরের ভেতরেও কাঠ বসিয়ে একটি বাক্সর মতো করে সেই বাক্সর মধ্যেই নামানো হল এরফান চাচাকে। বসিরভাই দু-হাতে আঁজলাতে মাটি নিয়ে এগিয়ে গেল কররের দিকে, তারপর তিনবার অঞ্জলি ভরে মাটি নিয়ে কবরের ওপরে দিয়ে বলল, ‘‘মিনহ খালেক নকুম—ওফিহা নইদোকুম—অমিনহা নোখরে জুখুম তারাতন উখরা।’
এর আগে বহুবার গোরস্থানে এসেছে স্নিগ্ধ। নাজনিনের আব্বা ও আম্মির গোর দেওয়ার সময়েও এসেছে। ইফতিকার-এর আব্বার গোর দেওয়ার সময় এসেছে।
কথাগুলির অর্থ জানে ও।
‘তোমাকে এই মাটি থেকেই পয়দা করা হয়েছিল, এই মাটিতেই তোমাকে সঁপে দিলাম, সেই আখরতের দিনে, বিচারের সময় এই মাটি থেকেই তোমাকে আবার তোলা হবে।’
তারপর সবাই মিলে গোরস্থানে ভালো করে মাটি দিয়ে এরফান চাচার গোর ঢেকে শবদেহ দফন করল। ধূপের আর ফুলের গন্ধে ভরে রইল গোরস্থান।
ইফতিকারদের পরিবারের জন্যে একটি বিশেষ এলাকা চিহ্নিত আছে এই গোরস্থানে।
গোরস্থানের গেটের কাছে, সেখানে পাকিস্তানি পতাকার রঙের মতো গাঢ় সবুজ ও গাঢ় লাল কাফানের মতো ছিল, সেইখানে পৌঁছোতেই ভিড়ের মধ্যে একটি কিশোর, স্নিগ্ধর পাঞ্জাবির কোণ ধরে আকর্ষণ করল।
ও দাঁড়িয়ে পড়ল। ভিড় আগে এগিয়ে গেল। ইফতিকারও হাতের ইশারা করে এগিয়ে গেল। ও ওদের রিস্তেদারদের সঙ্গেই ফিরে যাবে। গাড়িতেও কথা হয়ে গেছিল যে, কাল-পরশু গোপালদের বাড়ি ‘পূর্বাচল’-এ এসে দেখা করবে বিকেলে। অমিয় বাড়ি পৌঁছে বদিবাবুর বাড়ি দীপুকে ফোন করে দেবে বলেছিল। দীপু গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যাবে গোরস্থানেই। স্নিগ্ধকে তুলে আনতে।
গোরস্থানে পৌঁছে ধীরে ধীরে কফন নামানো হল গোরে।…
স্নিগ্ধ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল ছেলেটির দিকে।
—তুমি কে?
—আমি, আমি।
—তুমি কোন বাবু?
—আমি বাবু নই।
—তুমি তবে কী?
—আমি মিয়া।
—তোমার বাবার নাম কী?
—নবাব তাজউদ্দিন খাঁ।
—তুমি আমার পাঞ্জাবি ধরে টানলে কেন?
—দরকার ছিল বলে।
—দরকার? আমার সঙ্গে? কী দরকার?
—খত আছে তোমার নামে। তোমার নাম কী বলো আগে।
—আমার নাম স্নিগ্ধ বোস।
—তোমারই খত।
—কে দিয়েছে?
—আম্মি।
—তোমার আম্মির নাম কী?
—নাজনিন বেগম।
স্নিগ্ধ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল ছেলেটির দিকে। বয়স দশটশ হবে। উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। নবাব বংশের ছাপ আছে তাতে। কিন্তু নাজনিন-এর কোনো চিহ্ন নেই। তা ছাড়া তার সিন্থেটিক রবারের ধূলিমলিন চটি, আস্তিন-ছেঁড়া পাঞ্জাবি, মলিন কুর্তা, তেলহীন রুক্ষ মাথা ও মুখ দেখে ও যে সত্যিই নাজনিনের ছেলে তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হল স্নিগ্ধর।
—তোমরা ক-ভাই বোন?
—দুই।
—তুমি বড়ো?
—না। দিদি আছে।
—কত বড়ো?
—উনিশ বছরের।
—নাম কী দিদির?
—ফিরদৌসি।
—বা:। মুখ থেকে আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল স্নিগ্ধর।
—আর তোমার নাম?
ছেলেটি হাসল। হাসতেই তার চোখে নাজনিন-এর চোখের একটু আভাস ঝলকে উঠল, গোরস্থানের গাছতলার ঝিরঝিরি ছায়ায় চামর-বুলোনো উষ্ণ রোদের মধ্যে।
—কী নাম বলো-না?
—ভালো নাম আছে একটা। কিন্তু মা ডাকে ‘সাহিল’ বলে।
স্নিগ্ধ তার খোঁচা খোঁচা খাড়া খাড়া চুলের দিকে চেয়ে হাসল।
‘সাহিল’ অর্থাৎ ‘শজারু’। নাজনিনের সেন্স অফ হিউমার ঠিক সেইরকমই আছে।
—‘সাহিল’ তো মা বলেন, আর আব্বা কী বলে ডাকেন?
—আব্বা ডাকে না।
—ডাকেন না? তার মানে?
—নাম ধরে ডাকে না। কখনো কিছু ফরমাশ করার থাকলে বলেন, ‘অ্যাই। কোই হ্যায়?’ এইরকম। কখনো বলেন, অ্যাই নবাবজাদা! আবার কখনো খুব রেগে গেলে, হারামজাদা।
—তাই? স্নিগ্ধ আবারও হাসল।
—তা তুমি যাবে কীসে করে? কোথায় যাবে এখন?
স্নিগ্ধ বলে, আমি যাব ওখনিতে। বদিবাবুর বাড়ি, আর তুমি?
—আমরা তো থাকি সীতাগড়া পাহাড়ের দিকে।
—সে তো অনেক দূর।
—দূরই তো! এখন আমি বটমবাজারে যাব। ফুফার বাড়ি খাওয়াদাওয়া করে বাসে করে চলে যাব বিকেলে।
—তা বটমবাজারেই-বা যাবে কী করে? আরে তোমার নামটাই যে বললে না। তোমার আম্মি না-হয় সাহিল বলে ডাকেন, আমি তা ডাকতে পারব না।
—তাই-ই ডেকো। তুমি তো আম্মির বন্ধু।
বলেই সে হাসল। একেবারে দেবদুর্লভ হাসি।
—তাই?
স্নিগ্ধর মুখও হাসিতে ভরে গেল। কিশোরদের হাসি বড়ো ছোঁয়াচে।
দূর থেকে দেখা গেল বদিবাবুর ছেলে দীপু রায় আসছে তার হুড খোলা জিপ গাড়ি নিয়ে, পথের লাল ধুলো আর পাতা-পুতা খড়কুটো উড়িয়ে।
স্নিগ্ধ বলল, চলো সাহিল। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব বটমবাজারে।
—ঔর খতকা জওয়াব ক্যা হোগা? আম্মি জওয়াব সাথহিমে লেতে আনে বোলিন থি।
—পতা তো হ্যায় না খতমে?
স্নিগ্ধ শুধোল।
—হামে ক্যা মালুম? খত হাম পড়েথে থোরি! দোস্ত কি পতা ভি আপকি পাস নেহি হ্যায়? ক্যায়সে দোস্ত হ্যায় আপ?
স্নিগ্ধর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সত্যিই তো ঠিকানা যে নেই! অথচ থাকা উচিত অবশ্যই ছিল। অনেক বদলে গেছে স্নিগ্ধ, কিন্তু সাহিলকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পারছে যে, নাজনিন বদলায়নি। ঠিক আগের মতোই আছে।
কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে যেমন ছিল।
—তুমিই বলো ঠিকানাটা।
—ঠিকানা লাগবে না। সীতাগড়া রোডে নেমেই নবাব তাজউদ্দিনের নাম বলবেন, লোকে বলে দেবে। আমার নামও বলতে পারেন।
—কী নাম? সাহিল?
জি হাঁ। বলেই, সাহিল হেসে ফেলল।
আবার নাজনিনের চোখ নাচল ওর দু-চোখে। খড়খড়ে খড়ি-ওঠা অযত্ন লালিত কিশোরের রুক্ষ মুখ হঠাৎই আদ্রতায় ভরে গেল।
ভারি ভালো লাগছিল স্নিগ্ধর সাহিলের দিকে চেয়ে। ওর নিজের মেয়েটিও এই বয়সিই। ছেলের বয়স সতেরো। এবার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভরতি হল সে। সায়ান্স স্ট্রিম-এ।
হঠাৎ সাহিল বলল, আমার ভালো নাম সালামত।
দীপু বলল, চলো দাদা। অমিয়দা এখুনি ফোন করেছিলেন।
—চলো। স্নিগ্ধ বলল।
তারপর বলল, এ ছেলেটিকে বটমবাজারে নামিয়ে দিয়ে যেতে হবে।
দীপু বলল, নিশ্চয়ই।
তারপর বলল, তোমাদের পিতিজ-এ কবে নিয়ে যাচ্ছ দীপু?
—আমি তো তৈরিই। তোমার বাংলোও বুক করে রেখেছি। মোহনে নদীর ধারে। ইটখোরি আর পিতিজের মধ্যে। যেমন বলেছিলে। আমাদের পিতিজ-এর বাড়িতেও থাকতে পারো। মোটে ছয় কিলোমিটারের তফাত। তবে একটা হাতি বড়ো ঝামেলা করছে। যেদিন যাবে দেখাব তোমাকে, আমার বাউণ্ডারি ওয়াল ভেঙে ঢুকে এসে নারকেল গাছ খেয়ে গেছে।
—নারকেল গাছ! পিতিজ-এ?
—হ্যাঁ গো। পুঁতেছিলাম গোটা কুড়ি। বড়োও হয়েছিল। ফলও দিত সামনের বছর।
—ডেলিকেসি সাজিয়ে রাখবে, তা খাবে না কেন?
—অমিয়দা বলেছিল, সেও যাবে।
—তাই? তবে তো ওর সুবিধাটাও দেখতে হয়।
—কবে যাবে বলছে? দু-তিন দিন পর।
—ভালোই তো। তাহলে কদিন হাজারিবাগেই না-হয় থেকে যাব। এতদিন পরে এলাম।
—যেমন তোমার ইচ্ছা। আমাদের বাড়ি যাবে তো!
—এখনই চলো। ভাবছি বিকেলে ‘পূর্বাচল’-এই চলে যাব। অমিয় আছে তো! আমি না-গেলে বাঙালটা খেয়ে সুখ পাবে না। আমাতে-ওতে জমে ভালো। গতবার টিফিন ক্যারিয়ারে করে মাছ দিত মুনিরাম। এমনি কোনো বাটিতেই ওই কোয়ান্টিটি আঁটত না। চমনলাল তো ফওত হয়ে গেছে। গোপালই নেই, নাজিম সাহেব নেই, হাজারিবাগই আর সেই হাজারিবাগ নেই।
দীপু বলল, আমরা তো আছি।
তারপর বলল, বিকেলে তিতির মারতে যাবে নাকি দাদা?
—শিকার আমি ছেড়ে দিয়েছি দীপু। কুড়ি-বাইশ বছর হয়ে গেছে।
—হা:। তিতির আবার শিকার নাকি?
—কুড়ি-বাইশ বছর বন্দুক রাইফেলেই হাত দিইনি। পিস্তলটা কখনো কখনো দোকান থেকে আনিয়ে ছুড়ি, ক্লাবে গিয়ে। হাত ঠিক রাখার জন্যে।
বলেই বলল, ‘সব কিছুরই একটা কোথাও করতে হয় রে শেষ।’
গান থামিয়ে ‘তাই তো কানে থাকে গানের রেশ।’
পেছনের সিট থেকে মেয়েলি কন্ঠে কিশোর সাহিল বলে উঠল :
‘জীবন অস্তে যায় চলি তার রংটি থাকে লেগে
প্রিয়জনের মনের কোণে শরৎ-সন্ধ্যা মেখে।’
চমকে পেছনে চাইল স্নিগ্ধ।
দীপু বলল কেয়াবাত! কেয়াবাত! কামাল কর দিয়া তুনে ছঁওড়া পুত্তান।
—কোথা থেকে শিখলে এ তুমি?
স্নিগ্ধ শুধোল।
আম্মি শিখিয়েছেন।
ওর মা কি বাঙালি?
দীপু শুধোল।
‘হ্যাঁ’ও হয় ‘না’ও হয়, এমনিভাবে মাথা নাড়ল স্নিগ্ধ।
বটমবাজারে সাহিলকে নামিয়ে দিয়ে দীপুদের ওখনির বাড়িতে পৌঁছোতেই মাসিমা, দীপুর স্ত্রী শুক্লা এবং ওর জায়েরা আপ্যায়ন করে বসালেন ওকে। বদিবাবু ডাক্তারের কাছে গেছিলেন। ফাইটিং-ফিট মানুষটির স্বাস্থ্য ইদানীং একটু বেগড়বাই করছে।
দীপু বলল, হাত-মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও।
একবার বলতেই স্নিগ্ধ উঠে ওর সঙ্গে বাথরুমে গেল। গিয়ে দরজা বন্ধ করে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে চিঠিটা খুলল নাজনিনের। সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে ইংরেজিতেই লিখেছে। যেমন আগে লিখত। যে-চিঠির কয়েকটা কলকাতাতে দীপার হাতে পড়াতে বিষমই বিপত্তি ঘটেছিল। তারপরই ও নাজনিনের স্মৃতিকে নিজেহাতে কবর দিতে বাধ্য হয়েছিল। আজ বোধ হয় আখরতের দিন এসেছে। তাকে কবর থেকে তুলতে হবে।
লিখেছে,
ডিয়ার স্নিগ্ধ,
ইটস ভেরি মিন অন ইয়োর পার্ট নট টু হ্যাভ ইনফর্মড মি বিফোর। সালমা কেম টু নো ফ্রম ইফটিকার দ্যাট ইউ আর কামিং টু হাজারিবাগ। হুম, আর ইউ অ্যাফ্রেইড অফ? মি? আই ক্যান্ট এনি মোর ডেস্ট্রয় ইয়োর পিস। ইউ ক্যান্ট ডেস্ট্রয় মাইন ইদার।
ইটস টু লেট ইন দ্য ডে।
প্লিজ ডু ড্রপ ইন টু মিট অ্যান ওল্ড ফ্রেণ্ড, হার হাজব্যাণ্ড অ্যাণ্ড ফ্যামিলি।
—ইয়োরস এভার, নাজনিন।
চাবুকের মতো বাজল চিঠিটি স্নিগ্ধর বুকে। বুকের মধ্যে তোলপাড় করে উঠল অনেক বছরের পাথরচাপা সুখ-দুঃখ। আসার আগে সন্দিগ্ধ গলাতে তীক্ষ্ণচোখে দীপা শুধিয়েছিল, মারার থেকে হাজারিবাগ কত দূর?
স্নিগ্ধ বলেছিল, হাজারিবাগ থেকে মারার যত দূর, মারার থেকে হাজারিবাগও ঠিক তত দূর।
—ঠাট্টা নয়। যাচ্ছ তো হাজারিবাগেই। সেই যবনীকে তো আজও ভুলতে পারোনি তুমি। যাচ্ছ, তা তো বললেই হয়। এত ছলনা কেন?
—পেরেছি পেরেছি। না ভুলতে পারলে কি মানুষে বাঁচে? তুমিও কি ভোলোনি সীতাংশুকে? ভুলতে হয়তো চাওনি। বাধ্য হয়েই ভুলেছ।
—অন্য প্রসঙ্গ এনো না এরমধ্যে। তুমিও ভুলতে বাধ্য হয়েই ভুলেছ। সব মানুষেই বাধ্য হয়েই ভোলে। তারপর নিজের কাছে, অন্যের কাছে বাহাদুরি করে বলে, ভুলেছি, ভুলেছি। অত সহজ নয় ভোলাটা!
—ভাগ্যিস!
স্নিগ্ধ বলেছিল। ভাগ্যিস স্মৃতি থাকে। যার স্মৃতি নেই, ভুলতে না পারার মতো কিছুমাত্রই নেই; সে যে বড়ো হতভাগা মানুষ। তোমার কি তা মনে হয় না?
—আমার কী মনে হয়, না হয়, তা আমাকেই ভাবতে দাও। তুমি নিজের চরকাতে তেল দাও।
সত্যি! হাজারিবাগে যে যাবে তা কিন্তু ভেবেও আসেনি। ইফিকোর ‘মারার’—এর গেস্টহাউসে ক-টি দিন বই পড়ে আর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবে বলেই এসেছিল, অথচ দীপু ফোন করল, অমিয়ও জোর করল। এবং আশ্চর্য! ঠিক বেরোবার মুহূর্তে কোথা থেকে ইফতিকারও এসে জুটল। এটা ওর নিয়তি। এইবার হাজারিবাগে আসা।
ওরই নিজের আখরতের দিনও এসে গেছে বোধ হয়।
তিন
আজ গুরু নানকের জন্মদিন। পূর্ণিমা। ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। বরহি রোডে গোপাল সেনদের বাড়ি ‘পূর্বাচল’-এর পশ্চিমমুখো বারান্দায় অমিয় আর ভুতোর সঙ্গে বসেছিল স্নিগ্ধ। ভুতো মজার মজার গল্প করছিল। পুরোনো দিনের সব গল্প। হান্টারগঞ্জের পাহাড়ে জিপের তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় সারারাত দুর্ভোগের গল্প। কাড়ুয়া আর নাজিমসাহেবের পাগলা হাতি মারতে যাওয়ার যুগ্ম অঘটন এবং চেষ্টা। অমিয়র মাছ খাওয়া। গোপালের নানা গল্প।
রিফর্মেটরির দিকে চলে-যাওয়া রাস্তাটা অথবা লেকটাও এখন আর দেখা যায় না। দু-পাশেই টাঁড় ছিল আগে। কিন্তু এখন বনবিভাগের সোশ্যাল ফরেস্ট্রির গাছ লাগানোর দৌলতে গভীর বন। অথচ সবই হয় ইউক্যালিপ্টাস নয় অ্যাকাশিয়া। সেসব গাছে ফুল ফল হয় না, পোকা হয় না; তাই পাখি বসে না। কাঠবিড়ালি আসে না। পাখি বসে না, তাই সাপ আসে না। সাপ আসে না, তাই ময়ূর আসে না। জঙ্গলের নীচের আণ্ডারগ্রোথেও শুধু পুটুস; ল্যানটানা। তিতির বটের মুরগি কিছুই নেই। খরগোশ নেই। এমনকী শিয়ালও নেই। হরিণ নেই, চিতা নেই, চিল নেই। কিছুই নেই। প্রেতপুরীর মতো সার সার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে সোশ্যাল ফরেস্ট্রির অরণ্য। অরণ্য, চরিত্রহীন।
তবে চাঁদ সব বনকেই সমান স্নেহ করে। তার কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। ঝকঝক করছে শিশির-ভেজা বন, পূর্বাচলের আর হক সাহেবের বাড়ির প্রাচীন সব দুধলি ইউক্যালিপ্টাসের মসৃণ ভুরুতে আর সেগুনের বড়ো বড়ো পাতার কানে কানে চাঁদ নি:শব্দে চুমু খায়। স্মৃতিভ্রংশ হয়ে বসে থাকে ওরা তিন-জন। মনে হয় গোপাল সেন বসে আছে মাঝের চেয়ারটিতে। মাঝে মাঝে গলাখাঁকারি দিচ্ছে। যেমন দিত।
চেয়ার-টেবিল ঠিকই থেকে যায় শুধু মানুষই থাকে না।
—সময় হল? তিন দিন পর?
অমিয় বলল, চিমটি কেটে।
—আরে কত কাজ! কত্ত ঝামেলা।
—তোর বিবিকে নিয়ে এলি না কেন? স্নিগ্ধ শুধোল।
‘মারার’-এ বিবি লিবারেটেড। এখানে এসে পর্দার মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। তোদের সংস্কৃতে যাকে বলে, ‘পুনর্মূষিকঃ ভবঃ’। বুঝলি না, আমিই দেখতে পাচ্ছি না তাকে, তা তোদের কাছে নিয়ে আসব কী?
বলেই স্নিগ্ধকে বলল, ইডিয়ট! তোর যেতে হবে একটু আমার সঙ্গে।
—কোথায়?
জাহান্নম-এ।
ভুতো বলল, স্নিগ্ধদা জিন্নতের প্যাসেঞ্জার। জাহান্নম-এ যেতে যাবে কোন দুঃখে?
—না, ইয়ার্কি নয়। এখুনি ওঠ। তবে যেতে হবে বহুদূর। এই জিপটা কার?
অমিয় বলল, দীপুর।
—নিয়ে যেতে পারি? তেল ভরে নেব।
দীপু ট্যাঙ্ক ফুল করেই দিয়ে গেছে।
—তবে দীপুবাবুকে ফুল পাঠিয়ে দেব। বদবুদার তেলের চেয়ে খুশবুদার ফুল অনেকই মূল্যবান। আশা করি দীপু বুঝবে। ও না-বুঝলে শুক্লাবউদি বুঝবে। ফুলের সমঝদার মেয়েরা। তোরা সব সুরতহারামের ঝাড়, ছঁওড়া পুত্তান! ফুলের ইত্বশ্বরের, ইশক এর কী বুঝিস? আমরা উঠলাম।
—রাতে কি খাবে না স্নিগ্ধ?
—এখানে খাবে না। তা ছাড়া ফিরতে রাতও হবে। ইডিয়টই আমাকে পাগমল-এ নামিয়ে দিয়ে, জিপ নিয়ে চলে আসবে। তবে তোদের সকলের কাল রাতে দাওয়াত আছে। আমি নিজে আসব নিয়ে যেতে। সন্ধে সাতটাতে বেরোতে হবে। ফিরব এগারোটাতে। সালমা অনেক বন্দোবস্ত করেছে। কেউ ‘না’ কোরো না। বুঝেছ। সালমারা এখন কানরি হিল রোডে বাড়ি বানিয়েছে। কাছেই। তবে তোমরা হয়তো রাতে চিনতে পারবে না। তাই আমি এসে নিয়ে যাব।
ভুতো বলল, আমি না থাকলে জিপ খারাপ হলে ঠিক করবে কে? জিপ নিয়ে তো যাচ্ছ। কোন মডেলের জিপ জানো কি? নাইনটিন ফর্টি।
ভুতোর হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করে ইফতিকার বলল, চল ওঠ ইডিয়ট।
বলেই, জিপের চাবি চেয়ে নিয়ে জিপে গিয়ে বসেই আর্তনাদ করে উঠল। ওই ঠাণ্ডাতে খোলা জিপ বাইরে পড়ে ছিল। স্নিগ্ধরও বসামাত্র মনে হল আধগলা বরফের চাঁই-এর ওপরেই বসেছে যেন। ইফতিকার জিপ স্টার্ট করে সার্কিট হাউসের দিকে মুখ ঘোরাল জিপের। ডানদিকে শব-এর ওপরে বিছানো সাদা চাদরের মতো শুয়ে রয়েছে বরহি রোড ফুটফুটে জ্যোৎস্নাতে।
জিপটি গতি পেতেই ইফতিকার বলল, তুই ইডিয়ট তা জানতাম, তবে তুই যে এমন অসভ্য অভব্য তা জানতাম না। তোকে চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও তুই উত্তর দিসনি নাজনিনকে? তিন দিনের মধ্যে একবার যাবার সময় করতেও পারলি না? ছেলেটা চিঠি নিয়ে এল নিজেহাতে কোথা থেকে কোথায় গোরস্থানে। না:, তুই নেহাতই অমানুষ। তমদ্দুন, এতলাখ বা তমিজ. বলতে কিছুমাত্র নেই তোর। তুই একটি কামিন। চুহার মতো দিল তোর। হারামজাদা।
স্নিগ্ধ চুপ করে রইল। তারপর বলল, একটু আস্তে চালা। দীপু বলেছে, জিপের টাইরড একটু কমজোরি আছে। সেকেণ্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের জিপ তো!
—ঠিক আছে। তুই আমাকে জিপ চালাতে শেখাস না।
—এ কী! এ কোনদিকে মোড় নিলি? এ তো হারহাদ-এর রাস্তা।
—হ্যাঁ, নাজনিন তোর জন্যে হারহাদেই অপেক্ষা করছে। তোর প্রিয় জায়গা। কত পূর্ণিমার রাতেই তো দেখা হয়েছে ওর সঙ্গে সেখানে। আমারই কল্যাণে। কত ঝক্কি নিয়েছি তোর জন্যে একদিন! নিমকহারাম! তাই আজকের পূর্ণিমাতেই ও অপেক্ষা করছে তোর জন্যে। নাজনিনের মনে হয়েছে, যেকোনো কারণেই হোক, তুই ওর স্বামী বা ছেলে-মেয়ের সঙ্গে আলাপ করতে চাস না। তুই তেমনই স্বার্থপর আছিস। তুই কেবল ওকেই চেয়েছিলি। ওকে মানে, ওর শরীরকে। ভালোবাসার তুই কিছুই বুঝিস না। এই বয়সে পৌঁছেও যদি ভালোবাসা কাকে বলে তা না-বুঝিস তবে কবে আর বুঝবি? যৌবনে সব মানুষেরই কাছে প্রেম আর শরীর সমার্থক। কিন্তু এই অবেলাতেও?
—চুপ কর ইফতিকার। তুই বুঝিস না কিছুই, কিন্তু বড়ো বেশি কথা বলিস।
একজন মুসলমান মেয়ের পক্ষে একজন বেগমসাহেবার পক্ষে একা একা একজন বিবাহিত হিন্দু পুরুষের সঙ্গে দেখা করা এমন রাতে অমন নির্জন বন-বাংলোয় আজকেও কতখানি বিপজ্জনক তা কি তুই বুঝিস?
—বুঝি। ভালোবাসা ব্যাপারটা তো বিপজ্জনক। খতরনাক।
ইফতিকার আর কোনো কথা বলল না। লোকালয় পেরিয়ে গিয়ে ছাড়োয়া ড্যামের কাছে গিয়ে পড়তেই মনে হল জিপটা গন্ডগোল করতে লাগল। ভূতনাথের ইল-উইশের জন্যেও হতে পারে। গতি আস্তে করতে বাধ্য হল ইফতিকার। স্নিগ্ধ বাঁ-দিকে চেয়ে দেখল কোন মন্ত্রবলে যেন ছাড়োয়ার জল শ্যাওলা-সবুজ হয়ে গেছে। তাতে পূর্ণিমার চাঁদের আলো পড়ে এক আশ্চর্য অপার্থিব সৌন্দর্য পেয়েছে ছাড়োয়া।
ইফতিকার বলল, ভীষণ ঠাণ্ডা হারহাদ-এ বিজলিবাতিও নেই। অবশ্য হাজারিবাগ শহরেও রাত ন-টা অবধি থাকে না। ভোল্টেজ যা, তাতে মনে হয় যেন পিদিম জ্বলছে। তোর জন্যে নাজনিন কাঙরি নিয়ে গেছে। নিজেহাতে রান্না করে নিয়ে গেছে। আতরদান নিয়ে গেছে। ধূপদান। ফুল। তার বিয়ের ঘাঘরা নিয়ে গেছে। তোর সাহস হয়নি ওকে বিয়ে করার সেদিন। আজ ও তোকে বিয়ে করে জীবনের শেষ সাধ মেটাবে মরণের আগে। ও তোকে কতখানি ভালোবাসে তা তুই কল্পনাও করতে পারিস না। তুই সাচমুচ একটা ইডিয়ট।
স্নিগ্ধ রেগে উঠে বলল, বাজে কথা বলিস না। মুসলমান না হলে যে ওকে বিয়ে করতে পারতাম না। নাজনিন তো বলেছিল আমাকে মুসলমান হয়ে যেতে। ওই আমাকে ভালোবাসে শুধু? আমি কি ওকে বাসিনি? তবে? কেন বাজে কথা বার বার বলিস? দিতিস তোরা হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে?
—না। তা দিতাম না।
ইফতিকার বলল।
—তবে? তবে আর কথা কেন?
—তুই ওকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতিস?
—আবার বাজে কথা। দাঙ্গা বেঁধে যেত না? মুসলমানের সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে নিয়ে হিন্দুর ছেলে পালিয়ে গেলে? কী হত ভেবেছিস একবারও? তা ছাড়া মায়েরও তো খুবই পছন্দ ছিল নাজনিনকে। পালিয়ে যেতাম কোন দুঃখে? বিয়ে তো সামাজিক অনুষ্ঠান, সুন্দর অনুষ্ঠান। বাগি হয়ে গিয়ে বিয়ে করলে যা পেতাম তার তুলনায় যা হারাতাম তা অনেকই বেশি। জানিস সবই তবু যত পুরোনো কথা। বাজে কথা।
ছাড়োয়ার পরে রাস্তাটা যেখানে জঙ্গলের মধ্যে উঁচু ডাঙা দিয়ে গেছে, যেখানে গাছগাছালি একটু দূর দূর, যেখানে চাঁদ ছলছল করছে পথে, সেইখানে পৌঁছে ইফতিকার জিপটা পথের বাঁ-দিকে দাঁড় করাল।
—এ কী! এসব দিকে যে, আজকাল আকছার ডাকাতি-ছিনতাই হয় শুনেছি। সঙ্গে বন্দুক-টন্দুক কিছু নেই।
স্নিগ্ধ আতঙ্কিত গলায় বলল।
—হা: হা: হা: করে দানবীয় হাসি হেসে উঠল ইফতিকার। বলল, ডাকাইত কী নেবে রে তোর কাছ থেকে ইডিয়ট? কী আছে তোর? যার বুকের মধ্যে একটা দিল পর্যন্ত নেই তাকে ডাকাইতরা ছোঁয়ও না! তুই একটা কামিনা।
স্নিগ্ধর ভয় হল ইফতিকার ওকে খুন করে ছাড়োয়ার জলে ফেলে দেবে বোধ হয়। ইফতিকারের হাবভাব মোটেই প্রকৃতিস্থ নয়। মুখ দিয়ে গন্ধও বেরোচ্ছে। বোধ হয় মদ খেয়ে এসেছে। ও নিজেই হয়তো নাজনিনের প্রেমিক। স্নিগ্ধকে যে নাজনিন আজও এতখানি ভালোবাসে তা হয়তো ও সহ্য করতে পারছে না। প্রেম মানুষকে দেবতা বানায়; নয়তো দৈত্য।
—তোর সঙ্গে আজ সুহাগ-রাত কাটাবে নাজনিন। তোর সন্তান নেবে গর্ভতে। বাকি জীবনে ও আর তোর মুখও দেখতে চাইবে না। তুই আর পালাতে পারবি না কোনোদিনও ওর কাছ থেকে। সমস্ত জীবনের মতো তুই বাঁধা থাকবি ওর মসৃণ, উষ্ণ, জরায়ুর মধ্যে।
স্নিগ্ধর ওপরে হাজারিবাগ, এই পূর্ণিমার চাঁদ, ইফতিকার এবং অদৃশ্য নাজনিন এক গভীর প্রভাব ফেলতে আরম্ভ করেছিল। ওর মস্তিষ্কে, শরীরে, নানারকম মিশ্রক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছিল।
পঁচিশ বছর আগের এমনই একরাতে কানারি হিল রোডের মল্লিকদের ‘‘জিব্রলটার’’ বাড়ির গা-ঘেঁষে মহুয়াতলিতে—নাজনিনের বিজাতীয় আতরগন্ধী স্তনসন্ধির ও পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ-ভরা ঠোঁটের পরশ তার শরীরের স্মৃতিতে জাগরূক হল। তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুরণন ওঠাল সেই স্মৃতি। একটি সাদা সালোয়ার আর ফিকে বেগুনি কামিজ পরে এসেছিল নাজনিন। অনভ্যস্ত সব গন্ধে প্রথমে স্নিগ্ধর মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঘা দিয়ে তাকে বিরক্ত করেছিল। পরমুহূর্তেই ও বুঝেছিল যে, জীবনের সব ক্ষেত্রেই, বিরক্তিই হয়তো পরমতম আসক্তিকে হাত ধরে নিয়ে আসে। মনে শরীরে।
স্নিগ্ধ হঠাৎ বলল, চল। দাঁড়ালি কেন এখানে?
হা: হা: হা: করে ইফতিকার আবার দানবের মতো হাসতে লাগল।
তারপর স্বগতোক্তি করল, হায়! হায়! বেচ্চারি নাজনিন যদি জানত যে, পঁয়তাল্লিশ বছরের প্রৌঢ় স্নিগ্ধ শুধু তার উনিশ বছরের শরীরটাকেই ফিরে পেতে চায়। ‘মন’ বলে সেই মানুষটার কোনো পদার্থই নেই? হায়! হায়!
এমন সময় উলটোদিক থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে এগিয়ে আসছে। আগে এইসব অঞ্চলে এবং প্রায় সব অঞ্চলেই গভীর জঙ্গল ছিল। এখন বড়োগাছ আর নেই বললেই চলে। তাই দূর থেকেই হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছিল পথ আঁকাবাঁকা হওয়া সত্ত্বেও। এ পথে রাতে প্রায় কেউই যাতায়াত করে না। আগেও করত না, এক শিকারিরা ছাড়া। কাছে আসতেই বোঝা গেল যে, একটি সাদারঙা মারুতি ওমনি। গাড়িটির হেডলাইট ন্যাড়া জিপে আলোর বন্যা বইয়ে দিল। জিপের প্রায় মুখোমুখি এসেই ভ্যানটা দাঁড়িয়ে পড়ল ব্রেক কষে। এবং ভ্যানের দরজা খুলে যে নামল….আলোর বন্যার মধ্যে।
স্নিগ্ধর শরীরটা জিপের ঠাণ্ডা সিটের ওপরে শক্ত হয়ে গেল। নাজনিন। পঁচিশ বছর আগের সেই সাদা সালোয়ার আর ফিকে বেগুনি কামিজ। সেই তন্বী, শ্যামা, শিখরদশনা, উন্নতস্তনা, তীব্রগন্ধী নারী, স্নিগ্ধর প্রথম এবং শেষ প্রেমিকা। স্নিগ্ধ যেন প্রেতগ্রস্ত হয়ে গেল। ভয়ও যে পায়নি, এমনও নয়। তবু সিট ছেড়ে নেমে গেল পথের ধুলোয়।
শিশির ধুলো লেপটে রয়েছে। ঠাণ্ডায় হাত-পা হিম। ও এগিয়ে যেতে লাগল পায়ে পায়ে। হেডলাইটের আলোর বন্যার মধ্যে কেন্দ্রবিন্দুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল নাজনিন। ঠিক তেমনি গ্রীবা হেলনের ভঙ্গি। তেমনই এলানো বেণী। স্নিগ্ধ এগিয়ে গিয়ে নাজনিনের পশমিনা শালে ঢাকা দুটি কাঁধে নরম করে নিজের দু-হাত রাখল। অর্ধস্ফুট গলায় বলল, নাজনিন, নাজনিন!
নাজনিন খিলখিল করে হেসে উঠল। বেণী দুলিয়ে, ফুলেল তেল আর আতরের গন্ধ উড়িয়ে বলল, মামুজান, আমি ফিরদৌসি।
চমকে উঠল স্নিগ্ধ। কী বলবে, ভেবে পেল না।
ফিরদৌসি বলল, আম্মি-আব্বা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন হারহাদ-এ। মুমানিজানকে আনলেন না কেন? কলকাতা থেকে সঙ্গে করে? আলাপ হত আমাদের সঙ্গে। আম্মির কাছে কত যে গল্প শুনেছি আপনার।
সাদা হয়ে গেল স্নিগ্ধর মুখ। পরক্ষণেই এক অতীন্দ্রিয় আনন্দে দেদীপ্যমান হয়ে জ্বলতে লাগল।
হেসে, একটু ভেবে বলল, মুমানিজান এবারে আসেননি। পরের বারে নিয়ে আসব নিশ্চয়ই।
মুখে বলল বটে কিন্তু মনে মনে জানে যে, সেই সদা-সন্দিগ্ধ তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত শহুরে হিন্দু নারী নাজনিনের হৃদয়ের ঐশ্বর্যর দাম কোনোদিনই দেবে না।
—চলুন। চলুন। খানা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কখন এসেছি আমরা!
স্নিগ্ধ তার স্নিগ্ধতা ফিরে পেয়ে বলল, তোমার ইফতিকার মামুজানকেই জিজ্ঞেস করো দেরি হল কেন? সে তো গেল আমাকে আনতে এই একটু আগেই। তা ছাড়া সে তো আমাকে রিকশা করেই নিয়ে আসতে চাইছিল। কাল ভোর নাগাদ পৌঁছোতাম। ভাগ্যিস দীপুবাবুর জিপটা ছিল!
আমরা তাই তো নিতে আসছিলাম আপনাকে। ‘পূর্বাচল’-এই যেতাম।
এমন সময়ে মারুতি ওমনির ভেতরের অন্ধকার থেকে নামল সালামত।
হেসে বলল, মামুজান! আমিও এসেছি। সাহিল! আপনাকে নিতে।
স্নিগ্ধ হেসে বলল, সাহিল, তোমার মা বলেন বলুন! তুমি আমার সালামত।
—চলুন গাড়িতে উঠুন।
ফিরদৌসি বলল।
—না। তোমরা আগে আগে চলো বেটা। আমরা পেছনে পেছনে যাচ্ছি। তোমার ইফতিকারমামু তা নইলে একা হয়ে যাবেন। তোমরা এই জঙ্গুলে পথে রাতেরবেলায় একা এসেছ?
—না, না, ওই তো সামনে বসে আছে আবদুলভাই।
বড়ো বড়ো গোঁফঅলা পালোয়ানের মতো এক মিয়াজান হাতে বন্দুক নিয়ে নেমে কুর্নিশ করে বলল, আদাব মালিক।
—মালিকই বটে! স্নিগ্ধ বলল নিজেকে। কার মালিক? কীসের মালিক?
ওদের মারুতি ভ্যান আগে আগে চলেছে। টেইল-লাইট দুটোর লাল নাচতে-নাচতে কাঁপতে কাঁপতে চলেছে কুয়াশা আর ধুলোর আস্তরণের মধ্যে মধ্যে।
স্নিগ্ধ বলল, একটা পান খাওয়া তো ইফতিকার।
ইফতিকার বলল, তোর জন্যে ভাড়া করেছে এই ভ্যান। তিনশো টাকা ভাড়া ও পেট্রোল। তুই কত দামি! দেখেছিস?
কথাটার খোঁচা গায়ে মাখল না স্নিগ্ধ। সেই মুহূর্তে ও বড়ো সুখে ছিল। নাজনিনের এবং ওরও খোয়াইশ, তাদের অভিলাষ, আজ পূর্ণ হবে এই আনন্দসন্ধ্যায়।
পানের বাটা বের করে ইফতিকার পান এবং জর্দা দিল খুশবুদার। নিজেও নিল। তারপর চাপ দিল অ্যাক্সিলারেটরে।
জ্যোৎস্নায় চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে। একটি লক্ষ্মীপেঁচা উড়ে গেল ডান পাশ থেকে বাঁ পাশে। একজোড়া কপারস্মিথ পাখি ডাকছে রাস্তার এপাশ আর ওপাশ থেকে। দূরের শিশিরসিক্ত নীলাভ কুয়াশাচ্ছন্ন নিভৃত বনমধ্যের প্রান্তরে টিটি পাখি ডাকছে টিটির-টি, টি-টি-টি-টি….ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে। ভারি ভালো লাগছে স্নিগ্ধর। সেই মুহূর্তে বড়ো কৃতজ্ঞ বোধ করছিল সে ইফতিকারের কাছে।
-চলুন গাড়িতে উঠুন। ফিরদৌসি বলল।
স্নিগ্ধ ভাবছিল, এই তো পরমপ্রত্যাশার ছিল! মানুষের ভালোবাসা, তার শরীর অথবা মনেরও ভালোবাসা একই জায়গায় কোনো একটি ক্ষণে কখনোই বোধ হয় থিতু হয়ে থাকে না! মানুষ তো আর মোরগা-বকরি নয়! যতই দিন যেতে থাকে ততই তার ভালোবাসার রং-চং চেহারা-ছবি পালটে যায়। ভালোবাসার জনের স্বামী, তার সন্তান, তার প্রিয়জন, তার পোষা বেড়াল, তার কাকাতুয়া সবকিছু মিলিয়ে সেই বিশেষ জনের প্রতি সেই বিশেষ বোধ আশ্চর্য এক ব্যাপ্তি পায়। একদিন যে শরীরকে যে মনকে ভালোবেসেছিল, তার অনেক অনেক দিন পরে অন্যদিনে তার সমস্ত পরিবার তার সমস্ত অনুষঙ্গকেও ভালোবাসতে শেখে। একজনকে একরকম করে না-পাওয়ার দুঃখকে, বহুজনকে অন্যরকম করে পাওয়ার সুখ দিয়ে তর্পণ করে, তার নিজস্বতাকে পরম্পরায় অর্পণ করে সুধন্য হয় মানুষ। মানুষ বলেই পারে।
শুধু মানুষ বলেই পারে!
ইফতিকার পানের পিক ফেলার জন্যে জিপটাকে দাঁড় করাল।
তারপর দু-জনেই পিক ফেলল।
এত সুখী জীবনে আর কোনোদিনও হয়নি স্নিগ্ধ। এত উষ্ণতা, এত নির্মল আনন্দ; এত শান্তি কোনোদিনও বোধ করেনি এ জীবনে। এমনকী যেদিন নাজনিনকে ‘জিব্রালটরের’ পাশের মহুয়াতলিতে চুমু খেয়েছিল, সেদিনও নয়।
ইফতিকার বলল, কিছু বলবি, ইডিয়ট?
—না:।
স্নিগ্ধ বলল।
I am very happy reading the above story (and also many other stories & novels written by my most favorite writer, Buddhadeb Guha. Thank you guys from the bottom of my heart for giving me the chance towards getting this heavenly pleasure. I love you all.