অভিলাষী
জলধর মুখুজ্যে এসে বললেন, “তোমরা এখনও বসে আছ! ওদিকে যে বাসুকী ফণা নেড়েছেন।”
পশুপতি আর হাবুল সেন দাবা নিয়ে তন্ময়। সাধন একটা পুরনো রিডার্স ডাইজেস্ট নিয়ে আধশোয়া হয়ে চুরুট টানছিলেন।
মুখ তুলে সাধন বললেন, “তোমার যে কী ভাষা! যত্ত সব। হেঁয়ালি ছেড়ে কথা বলতে শিখলে না!”
জলধর তাঁর কাঁধে ঝোলানো ফ্লাস্ক নামিয়ে রেখে সোফায় বসলেন। পানের ডিবেটাও পকেট থেকে বার করে পাশে রাখলেন। বললেন, “কদম্ব মিত্তির এসেছে, সঙ্গে এবার অভিলাষী।”
কদম্ব মিত্তিরের নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে পশুপতিদের দাবার ঘোড়া চাল ভুলে গেল, নৌকো টলমল করে উঠল। সাধন অবাক হয়ে বললেন, “কদম্ব মিত্তির এসেছে! কে বলল?”
“আমি বলছি, আবার কে বলবে!” জলধর বললেন।
সাধন, পশুপতি, হাবুল—মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। পশুপতি বললেন, “আসার কথা ছিল, তবে সে তো বর্ষা পড়লে।”
“বর্ষা পড়া পর্যন্ত তর সইল না,” জলধর বললেন, “আগে আগে চলে এসেছেন। অভিলাষীর ইচ্ছে।” বলে জলধর মুচকি হাসলেন। পাকা গোঁফের পাশ দিয়ে হাসিটা থুতনিতে গড়িয়ে পড়ল যেন।
পশুপতি বললেন, “অভিলাষী মানে?”
জলধর বললেন, “মেয়েছেলে!”
কয়েক মুহূর্ত সবাই কেমন হতভম্ব। তারপর নাকচোখ কুঁচকে সাধন বললেন, “ছ্যা ছ্যা! বুড়ো বয়েসে তোমার মুখ যা হয়েছে। মেয়েছেলে টেয়েছেলে কী বলছ?”
জলধর দু দণ্ড সাধনের দিকে তাকিয়ে থেকে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করলেন। বললেন, “আমার মুখকে বিশ্বাস করতে হবে না। এটা পড়ছি। শোনো।” বলে জলধর চিরকুট পড়তে লাগলেন: “জলধরবাবু, গতকাল টুয়েন্টি ওয়ান আপ-এ আমি আসিয়া পৌছিয়াছি। ঘর বাড়ি নরক হইয়া ছিল। ফকির মস্ত ফাঁকিবাজ। সে যে কিছুই করে না বুঝিতে পারিলাম। যাহা হোক, সকালে ঘরদোর ভদ্রস্থ করা গিয়াছে। আপনি অন্যদের আমার খবর জানাইবেন ও সন্ধ্যায় আসিবেন। আপনাদের এক নতুন জিনিস দেখাইব। আমার সঙ্গে এক অভিলাষী আসিয়াছেন। এমন অদ্ভুত স্ত্রীলোক আপনারা দেখেন নাই। ইহার স্পিরিচুয়াল ক্ষমতা দেখিলে অবাক হইয়া যাইবেন। পারিলে আজ সন্ধ্যায় সকলে আসুন। বাগানের ফ্রেশ টি এবং জাহাজ হইতে খালাস করা জিনিসপত্র আনিয়াছি। অপেক্ষায় থাকি। ইতি কে. ডি.।।”
দাবার চাল ভুলে পশুপতিরা জলধরের চিঠিপড়া শুনছিলেন। জলধর চিঠি পড়া শেষ করে বললেন, “নাও শুনলে তো। আর কিছু বলার আছে?”
হাবুল বললেন, “রহস্য তো আরও ঘনীভূত হয়ে গেল, জলধরদা। স্ত্রীলোক, অভিলাষী, ক্ষমতা…ব্যাপারটা কি?”
“ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করতে হলে কদম্বকাননে যেতে হয়। চলো সবাই।”
সাধন ওয়াল-ক্লকের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সাতটা বাজতে চলেছে। কদম্ব মিত্তিরের বাড়ি মাইল খানেকের বেশি। হাবুল তার ছ্যাকড়া গাড়িটাও আনেনি, আনলে তবু চেষ্টা করা যেত; এখন আর এতটা পথ উজিয়ে যাওয়া যায় না। সে-বয়েস তাঁদের আর নেই, অন্তত তিনজনের, হাবুলকে বাদ দিলে অন্যরা সকলেই যাটের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছেন, হাবুলই ষাট ধরো-ধরো করছে।
সাধন বললেন, “এখন আর কেমন করে যাবে? সাতটা বাজতে চলল। রাস্তা তো কম নয়।…তোমাকেও বলি জলধর, তুমিই বা করছিলে কী! আগেভাগে খবর দিতে পারোনি?”
জলধর বললেন “কেমন করে দেব। এই চিঠিই আমি পেয়েছি বেশ বেলায়। ফকির দিয়ে গেল। যা গরম আর লু তখন তো আর গামছা মাথায় দিয়ে বাড়ি বাড়ি খবর দেওয়া যায় না। চারটে সাড়ে চারটে পর্যন্ত লু ছুটল। তেমনি হলকা। রোদ পড়তে গা হাত ধুয়ে মুছে বেরুব, গিন্নি ঘেমেনেয়ে বমি করে এক কাণ্ড বাঁধিয়ে তুলল।”
পশুপতি ভুরু কুঁচকে বললেন, “বমি? এই বয়েসে তোমার গিন্নির বমি হয় নাকি?”
জলধর খোঁচাটা হজম করলেন না, বললেন “হয় হয়, এখনও হয়; এ গিন্নি তো প্লাস্টিকের খেলনা নয় পশুপতি, হাড়ে-মজ্জায় মেদে বিরাশি কেজি। পিঁড়ি পেতে বসলে ঘর জুড়ে যায়।…যাক যে, গরমের দিন, টক-ডাল টক দই—এ সব খেয়েছিল খুব। অম্বলে উল্টে দিল। দু ডোজ ইপিকাক দিয়ে গিন্নিকে জুত করে দিয়ে আসছি।”
পশুপতি মুখ টিপে বললেন, “বউদির কি ইপিকাক সিম্পটম?”
“তুমি কি অন্য সিম্পটম দেখেছ?”
পশুপতি হো-হো করে হেসে উঠলেন। অনন্যরাও।
হাসি থামলে হাবুল বললেন, “আজ তা হলে যাওয়া হচ্ছে না?”
“না, আজ আর কেমন করে হবে?”
“তা হলে কাল খানিকটা বিকেল বিকেল যাওয়াই ভাল।”
সায় দিলেন সবাই।
জলধর বললেন, “আমি একটা খবর পাঠিয়ে দেব মিত্তির মশাইকে; সকালেই। বিকেলে সব যাচ্ছি।”
“হ্যাঁ”, পশুপতি বললেন, “যাচ্ছি সবাই। তবে আমি ভাবছি, কদম্ব মিত্তিরের অভিলাষীকে দর্শন করতে শুধু হাতে যাই কেমন করে? বাগানে বড় সাইজের পেঁপে পেকেছে কটা, নিয়ে যাব নাকি?”
জলধর বললেন, “নিয়ে যেতে পারো। তবে অভিলাষী দর্শনের পক্ষে পাকা বেলই ভাল হত।”
হাবুল অট্টহাস্য হেসে উঠলেন। সাধনও বাদ গেলেন না। পশুপতির মুখ দেখে মনে হল, জলধরের পালটা জবাবে তাঁর প্রসন্নতা বেড়েছে ছাড়া কমেনি। ছোট করে শুধু বললেন, “তোমার গাছ থেকে ধার দিও; আমার বাগানে বাপু বেলগাছ নেই।”
আবার খানিকটা হাসাহাসি হল।
আড্ডাটা বসেছিল সাধনের বাড়িতে, বসার ঘরে। এটা হল চার প্রবীণ বা বৃদ্ধের সাবেকি আড্ডাখানা। সন্ধের মুখে রোজই বসে। অসুখ বিসুখ না থাকলে চারজনেই হাজির থাকেন। অন্য দু একজনও আসেন মাঝেসাঝে—তবে তাঁরা নিয়মিত সদস্য নন, এঁরা চারজন নিয়মিত।
সাধনবাবুর বাড়িতে মানুষ বলতে তিনি এবং তাঁর জগন্নাথ। ভদ্রলোক বিপত্নীক। জগন্নাথের হাতেই খাওয়া-পরা, ঘরদোর সংসার। সন্তান বলতে একটি মেয়ে। মেয়ে-জামাই নিজেদের বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার ফেঁদে আছে ডালমিয়ানগরে। সাধন হলেন শিষ্টগোছের মানুষ। কথা খানিকটা সমঝে বলেন; ধর্মে টান এবং মাঝারি অর্শ-ব্যামো দুই-ই দেখা দিয়েছে স্ত্রীর অবর্তমানে। চোখ দুটি আজকাল অন্যমনস্ক ও উদাস হয়ে উঠছে দিন দিন। বয়স বাষট্টি। স্বাস্থ্য মাঝারি।
সাধনের খুব ঘনিষ্ঠ হলেন জলধর। দুজনে কেমন একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়তাও আছে। সম্পর্কে সাধন জলধরের শালা। জলধর তড়বড়ে মানুষ। চৌষট্টি বছর বয়েসেও বাইক চাপতে পারেন, লাল আটার রুটি আর ছোলা সেদ্ধ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারেন, তিন পোয়া দুধ এখনও রাত্রে তাঁর বরাদ্দ, গলার স্বর গমগম করে। স্বাস্থ্যটি দেখলে মনে হয় না, বয়েস তাঁকে তেমন কাবু করতে পেরেছে। গায়ের রং কালো। মাথায় বারো আনা টাক, চার আনা চুল—সবই সাদা। জলধরের সামান্য সন্ধ্যাপূজার ব্যবস্থা আছে। নিত্যই তিনি যে পেটমোটা ফ্লাস্কটি বয়ে আনেন—তার মধ্যে হরি শাহ-এর দোকানের দিশি মদ্য থাকে। একেবারে আনুপাতিক হারে জল মেশানো। এই বস্তুটি তিনি সাধনের বাড়িতে বসে খান। গল্প করেন। পান চিবোন। সিগারেট টানেন। এবং বলা বাহুল্য বৃদ্ধদের এই সান্ধ্য মজলিস সজীব করে রাখেন।
পশুপতি জলধরেরই সমবয়সী। মাস কয়েকের ছোট হতে পারেন। জলধর যখন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন পশুপতি তখন জিয়োলজিস্ট হিসেবে কাছাকাছি ঘোরাফেরা করেছেন। সেই সূত্রে প্রথম পরিচয়। সেই পরিচয় পরে বন্ধুত্বের পর্যায়ে দাঁড়ায়। পরস্পরের সাংসারিক কুশল বিনিময় এবং সুখ-দুঃখের পত্রালাপ চলত দূর থেকেও। অনেক পরে পশুপতি এসে বাসা বাঁধলেন এই ছোট শহরে, জলধরেরই কথায়। মানুষ হিসেবে শৌখিন, সদাশয় এবং সদাতৃপ্ত। চেহারাটি চমৎকার। বোঝা যায়—একসময়ে রূপবান পুরুষ ছিলেন। এখন আধিব্যাধি ভর করেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেয়াড়া হল, হাঁপানি। বর্ষা আর প্রথম শীতটায় পশুপতি কাবু হয়ে পড়েন। হাঁপানি ছাড়া অন্য ব্যাধিটা হল ডায়েবেটিস। তবে এটা মারাত্মক নয়। পশুপতির এক ছেলে কানপুরে, অন্য ছেলে পাটনায়। বাড়িতে পশুপতি আর তাঁর স্ত্রী। জলধরের ছেলেও পাটনায়। সেদিন থেকে পশুপতি অনেকটা নিশ্চিন্ত।
হাবুল সেন—সবার চেয়ে বয়েসে ছোট। ষাটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন। বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা, মাথার চুলগুলো সব সাদা। খানিকটা যেন চুল পাকিয়ে বুড়োর দলে ঢুকেছেন বলে মনে হয়। ব্যবসাদার মানুষ। শেড কনস্ট্রাকশান-এর কাজে নাম আছে। ছোট ভাই ব্যবসা দেখে, আর হাবুল সেন জোগাড়যন্তর করেন। হাবুলের স্ত্রী কলকাতার কাগজে কবিতা লেখেন। হাবুল বলেন, “হিস্টিরিয়া সেরে যাবার পর থেকে ওটা হয়েছে।”সন্তানাদি নেই।
চারজনের পরিচয়টুকু মোটামুটি দিয়ে রাখা গেল। এর পর যিনি—তিনি হলেন কদম্ব মিত্তির। তাঁকে নিয়েই জলধরের সন্ধেবেলার আড্ডাখানা আজ জমে উঠল।
জলধর হাঁক ছেড়ে জগন্নাথকে গ্লাস আনতে বললেন। তারপর পশুপতিকে জিজ্ঞেস করলেন, “অভিলাষী জিনিসটা কী—তুমি জান?”
পশুপতি মাথা নাড়লেন, জানেন না।
জলধর বললেন, “সংসারে কিছুই জানলে না। তোমাদের দিয়ে কোনো উপকারটিই হল না জগতের।” বলে জলধর অবজ্ঞার মুখভঙ্গি করলেন।
পশুপতি বললেন, “তুমিই বলো। জগৎ উদ্ধার করতে তুমিই অবতার রূপে এসেছ জলধরবাবু, তুমিই বলো।”
জলধর কোনো কথা বললেন না। স্কুলে মাস্টারমশাইয়রা যেমন ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে থাকেন প্রশ্ন শুধিয়ে সেইভাবে অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
সাধন বললেন, “আমি কখনো কথাটা শুনিনি। স্ত্রীলোক যখন স্পিরিচুয়াল তখন উঁচু দরের কিছু হবে।”
হাবুল বললেন, “কদম্বদা এর আগে একবার এক ফিরিঙ্গি বুড়ি এনেছিলেন মনে আছে? সে নাকি কদম্বদাকে রান্না শেখাত।”
এমন সময় জগন্নাথ কাচে গ্লাস দিতে এল।
পশুপতিরা এ-সময় চা-টা খান। জগন্নাথ ইশারায় কে কে চা খাবেন জেনে নিয়ে চলে গেল।
জলধর ফ্লাস্কের ঢাকনা খুলতে খুলতে বললেন, “কদম্ব এটিকে কি-শেখাতে এনেছে কে জানে!”
পশুপতি বললেন, “শেখার কি শেষ আছে জীবনে! তা যাক, তুমি বাপু মানেটা বলো তো?”
জলধর ফ্লাস্ক থেকে হরি শা ঢেলে নিলেন। গন্ধ ছুটল। আঙুল আলতো করে গ্লাসে ডুবিয়ে আঙুল তুলে নিলেন। বার তিনেক জল ছিটিয়ে দিলেন বাতাসে। উৎসর্গ করলেন। তারপর বললেন “মানে আর কী! কদম্ব মিত্তিরের ইয়ে, মানে ওই পোষা স্ত্রীলোক গোছের কিছু। ঠিক মানেটা হাবুলের বউ জানতে পারে, পদ্য লেখে বউমা।”
পশুপতি খোঁচা মেরে বললেন, “তোমার বিদ্যেতেও কুলল না। যাক বাঁচা গেল।”
দুই
পরের দিন সন্ধের আগে আগেই চারজন কদম্ব মিত্তিরের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। হাবুল সেন তাঁর গাড়িটা নিয়েছিলেন। চারজনের পক্ষে যথেষ্ট। এখনও টানতে পারে বিলিতি গাড়িটা।
কদম্ব বাইরেই পায়চারি করছিলেন। মালিকে বোঝাচ্ছিলেন—বর্ষার গোড়ায় বাগানে কোন কোন গাছ লাগাতে হবে। বন্ধুদের দেখে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন, “আসুন আসুন।”
জলধর বললেন, “কালকে আর হয়ে উঠল না। আজ সব জুটিয়ে আনলাম। কেমন আছেন?”
“চমৎকার। কেমন দেখছেন আপনারা?”
“ভালই। চেহারায় ফ্রেশনেস এসেছে।”
“আসবে না! যার হাতে পড়েছি।” কদম্ব খুশি খুশি মুখ করলেন।
জলধর আর পশুপতি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কদম্ব কার হাতে পড়েছেন বোঝা যাচ্ছে। অভিলাষীর। কিন্তু তিনি কে? কোথায় তিনি?
কদম্ব বললেন, “চলুন আমরা বসার ঘরেই বসি। বাইরে মশা।”
সাধন বললেন, “আপনার বাগানে গাছপালা বেঁচে আছে দেখছি। এবার যা গরম গেল। বিশ পঁচিশ বছরের মধ্যে এমন গরম দেখা যায়নি। মাঠঘাট খাঁখাঁ করছে মশাই, কুয়ায় জল শুকিয়ে গিয়েছে। লাস্ট উইকে দিন দুই বৃষ্টি নামল। কালবৈশাখীর পর। তাতেই যা অবস্থাটা সহ্যের মতন হয়েছে।”
কদম্ব বলল, “শুনলাম সব। আমার বাগানের বারো আনা ওই মালি সাবাড় করে দিয়েছে। এ যা দেখছেন এ হল চার আনা। দেখছেন না, আমার মতিবাগের বেলঝাড়ে ফুলের চিহ্নমাত্র নেই, দু-চারটে যা ফুটে আছে তাতে কোনো গন্ধই পাবেন না। বাগানের জন্যে আমার আলাদা কুয়ো, অবশ্য তাতে পাম্প নেই। বেটা এক বালতি জলও ঢালত না রোজ। সব কটা ফাঁকিবাজ। আসুন—।”
বাগান থেকে বারান্দা, বারান্দা দিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন সকলে। ততক্ষণে বাড়ির চাকর-বাকর খবর পেয়ে গেছে। ফকির এসে ঘরের আলো জ্বালিয়ে পাখা চালিয়ে দিল।
জলধর বললেন, “আপনার আসার কথা ছিল বর্ষা পড়লে, আগে আগেই চলে এলেন?”
‘বর্ষা পর্যন্ত ওয়েট করতে পারলাম না,” কদম্ব বললেন, “একটা জাহাজ ভিড়েছিল মশাই ডকে, দেড় মাস কালঘাম ছুটিয়ে দিল। এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট বিলকুল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। আমাদের কোম্পানির মেকানিকদের বারো চোদ্দো ঘণ্টা করে পরিশ্রম। আমারও দুশ্চিন্তা। যা গে, কাজটা শেষ হতে মনে হল, ফিলিং টায়ার্ড। চলে এলাম।” বলে কদম্ব পকেট থেকে সিগারেট কেস বার করলেন, লাইটার, তারপর সামান্য গলা নামিয়ে স্বর পাল্টে বললেন, “তা ছাড়া উনি—মানে ওঁর ঠিক কলকাতার ভ্যাপসা গরম সহ্য হচ্ছিল না। গলায় ঘামাচি বেরুতে লাগল।”
“ওঁর মানে, এই কি যেন—অভিলাষীর?” পশুপতি বললেন।
সিগারেট কেসের ওপর একটা সিগারেট ঠুকতে ঠুকতে কদম্ব বললেন, “হ্যাঁ।”
পশুপতি আড়চোখে জলধরকে দেখলেন একবার, তারপর কদম্বকেই জিজ্ঞেস করলেন, “এখানকার গরমে আরও কষ্ট হবে না?”
“না না,” মাথা নাড়লেন কদম্ব, “এখানকার গরম ড্রাই গরম, নট লাইক বেঙ্গল। উনি তো নেপাল আর বিহার বর্ডারের মানুষ। কড়া শীত, রুক্ষ গরম—দুটোতেই মানাতে পারেন।”
হবুল বলল, “নেপালের লোক নাকি?”
“মিক্সি টাইপের!” কদম্ব সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিলেন, “নেপালি, বিহারি, বাঙালি, তিনেরই ট্রেস পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে সি ইজ সামথিং ভেরি স্পেশ্যাল। এমন দেখা যায় না। রেয়ার। সাম স্ট্রেঞ্জ পাওয়ার রয়েছে। সাইকিক পাওয়ার।” কদম্ব প্রশংসার গলায় বললেন।
জলধররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।
“আপনারা একটু বসুন,” কদম্ব বললেন, “আমি আসছি।”
কদম্ব ঘর ছেড়ে চলে গেলে জলধর বললেন, “সাধন, এ যে দেখছি তে-আঁশলা। ভয়ংকর একটা কিছু হবে, কী বলো!”
সাধন কোনো জবাব দিলেন না। কদম্বর বসার ঘরের চারদিকে চোখ বোলাতে লাগলেন।
কদম্ব মিত্তির সম্পর্কে দু-চার কথা এখানে বলা দরকার। কদম্বর পোশাকি নাম কৃষ্ণধন মিত্র; ইংরেজিতে কে ডি এম; কদম্ব পুরোটা আর লেখেন না, শুধু কে ডি দিয়ে কাজ সারেন। কৃষ্ণধনের সঙ্গে কদম্বের কোনো সম্পর্ক নেই, তবু কেমন করে কদম্ব নামটা চলে গিয়েছিল বলা মুশকিল। কদম্ব দেখতে সুপুরুষ বা কুপুরুষ—কোনোটাই নয়। মাথায় সাধারণ, না লম্বা না বেঁটে; স্বাস্থ্য মাঝারি, গায়ের রং খুবই ফরসা, মাথার চুল কাঁচাপাকা এবং খানিকটা খোঁচা খোঁচা। কদম্বর চুল ছাঁটার ধরনটা হল নেভি কাট। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমায় তাঁকে অভিজাতই দেখায়, সাজপোশাকে তাঁর বিত্তও বোঝা যায়। কদম্ব এখনও ষাটে পৌঁছননি—, তবে আর দু-চার মাস, ষাটে পৌছলেই কদম্ব কর্মজীবন থেকে ইস্তফা দিয়ে পাকাপাকিভাবে এখানে এসে বসবেন। মনে মনে এটা ছকে নিয়েই কদম্ব বছর চার পাঁচ আগে থাকতেই এই বাড়ির কাজে হাত দেন। অনেকটা জমি, ফলফুলের বাগান এবং নিরিবিলি বসবাস—এই তিন দিকেই তাঁর নজর ছিল। মোটামুটি সবই জুটেছে। টাকা থাকলে কী না জোটে। অর্থ এবং উদ্যম কদম্ব দুইই আছে।
কদম্বরা হলেন কলকাতার বনেদি পরিবার। শাখাপ্রশাখায় কদম্ব পরিবার নানা দিকে ছড়ানো, তবে কদম্ব নিজে বরাবরই খানিকটা একাকী। পিতৃদত্ত ব্যবসা ছাড়া তিনি অন্য কিছু নেননি পরিবারের, এমন কি ভবানীপুরে যে বাড়িতে থাকেন সেটাও একরকম তাঁর স্বোপার্জিত অর্থে রূপান্তর করা হয়েছে। কদম্ব হলেন ব্যাচেলার। বত্রিশ বছর বয়েসে একবার, আর চল্লিশে আর-একবার তাঁর বিয়েতে মন গিয়েছিল—কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনকে বশ করে ফেলেন। কদম্বর কলকাতার বন্ধুরা বলেন, প্রথমবার কদম্ব পাত্রীর পূর্ব প্রণয়োপাখ্যানের ইতিবৃত্ত জানতে পেরে সরে আসেন, আর দ্বিতীয়বার স্পষ্টই বুঝতে পারেন, পাত্রী তিন দাঁতের এক নকল সেট পরেন। কদম্ব এর পর আর বিয়ের দিকে ঝোঁকেননি। না ঝুঁকলেও ঘরোয়া ব্যাপারে তাঁর বেশ মন রয়েছে। যেমন ঘরদোর সাজিয়ে ফিটফাট রাখায় কদম্বর বিশেষ নজর, খাওয়া-দাওয়ায় হরেকরকম শখ, বন্ধুবান্ধবদের ডেকে ডেকে নানান ধরনের খানা তৈরি করিয়ে খাওয়াতেও ভালবাসেন, তাঁর বাড়িতে বন্ধুদের আড্ডা গল্পগুজবেরও ঢালাও ব্যবস্থা থাকে।
সোজা কথায়, কদম্ব ব্যাচেলার হলেও গৃহবিবাগী নন, তাঁর গাল তোবড়ায়নি, চোখ হলুদ হয়নি, কৌমার্যের দাঁত ভোঁতা করে তিনি দিব্যি ঘাটে এসে পা দিচ্ছেন।
মানুষটি চেহারায় তেমন চোখ জুড়োনো হয়ত নয়, কিন্তু ব্যবহারে সুজন। অহমিকা না থাক আভিজাত্য রয়েছে। সকলের সঙ্গে মেশেন না, গলাগলিও করেন না। কিন্তু পছন্দ করে যাঁদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাঁদের সঙ্গে আলাপে-বিলাপে কোনো আড়াল বিশেষ রাখেন না।
জলধররা হলেন কদম্বর এইরকম পছন্দের বন্ধু। এর মধ্যে জলধরই এক নম্বর ফেভারিট।
পশুপতি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
কদম্ব ঘরে এলেন। এসে বললেন, “উনি আসছেন। সামান্য দেরি হবে। তার আগে আপনারা চা-টা খান।”
তিন
চায়ের সঙ্গে কলকাতার মিষ্টি আর ডিমের সিঙাড়া খেতে খেতে জলধর বললেন, “মিত্তিরমশাই, একটা ব্যাপারে আমাদের খটকা লেগেছে!”
কদম্ব বললেন, “কি ব্যাপার?”
জলধর পশুপতিদের দেখে নিয়ে বললেন, “এরা আমায় জিজ্ঞেস করছিল, অভিলাষী বস্তুটি কী?…আমি বললাম, স্ত্রীলোক বলে শুনেছি। তা এতে এঁদের মন ভরেনি। আপনিই বুঝিয়ে দিন এঁদের।”
কদম্ব চায়ের কাপ নামিয়ে রাখছিলেন; বললেন, “ও-একটা সেক্ট, মানে গ্রুপ। ভেরি স্মল। আপনাদের যেমন বড় বড় গ্রুপ আছে—বাউল বোস্টম সাধু সন্নেসী—ওই রকম, তবে খুব ছোট। বারসমাজি শুনেছেন, বিচারি, ছুটিয়া—এসব শুনেছেন কখনো? শোনেননি। এ-সবই আছে। তবে আগে যা ছিল তার শ্যাডো মাত্র পড়ে আছে। এরা সবাই এক একটা ছোটখাটো রিলিজিয়াস সেক্ট, বা বলুন গ্রুপ। আজকাল এদের দেখাই যায় না, রেয়ার। লোকের আর বিশ্বাস কোথায় যে বিচারি হবে, ছুটিয়া হবে। চাল ডাল সব মিলেমিশে একাকার।” বলে কদম্ব চোখের চশমাটা খুলে কোলের ওপর রাখলেন। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “অভিলাষীরাও ওই ক্লাসের। দেখাই যায় না আজকাল। দু চারটে পড়ে আছে।”
পশুপতি যেন বুঝতে পেরেছেন এমনভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “কী করে এরা?”
“সাধনা। চৈতন্যের সাধনা। সুপার পাওয়ার, দি আদার ওয়ার্ড—এই সবের খোঁজ রাখে।”
“মানে, ধর্ম…”
“ধর্ম তো বটেই, তবে ওই মন্দিরে গিয়ে ঘণ্টা নাড়া নয়। এরা হল ভেতরে সাধক, পার্টলি তান্ত্রিক।”
“তান্ত্রিক?” হাবুল আঁতকে উঠল। “ওরে বাব্বা, সে তো ভয়ংকর ব্যাপার। শ্মশান, অমাবস্যা, মা কালী, শব…মড়ার মাথার খুলি…”
কদম্ব চশমাটা আবার পরে নিলেন। নিয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন আস্তে আস্তে। হাবুলের দিকে এমন করে তাকালেন যেন ছেলেমানুষের কথায় কোনো মজা পেয়েছেন। বললেন, “না না, ওরকম ভয়ের নয়’ব্যাপারটা। তন্ত্র শুনলেই তোমাদের শ্মশান আর মাথার খুলি মনে হয়। নাথিং টু ডু উইথ দ্যাট।…আমি বোঝাবার জন্যে তন্ত্র বলিনি, আন্দাজ করার জন্যে বললুম। তন্ত্র আর তান্ত্রিক রাইটস একটা বিশাল ব্যাপার শুনেছি। আবার তান্ত্রিক গ্রুপের মধ্যেও ওরিজিন্যাল, ডুপ্লিকেট, চোরাই কতরকম কী!”
জলধর বললেন, “হ্যাঁ চোলাইও ঢুকেছে মিত্তিরসাম্বে। দু-একটা আমারও দেখা আছে বলছি। ফেগুসরাইয়ে এক তান্ত্রিক দেখেছিলাম—ছাগলের ঠ্যাং, এক কলসি চোলাই আর পিপের মতন এক ভৈরবী নিয়ে সাধনা করত। বেটা একদিন কলেরা হজম করতে গিয়ে মরে গেল।”
জলধরের কথায় সবাই হেসে উঠলেন।
কদম্ব বললেন, “ওসবের ধারে কাছে ইনি নন,” বলে আবার একটা সিগারেট ধরালেন। “ইনি অন্য ক্লাস। আমি মশাই মুখ্যু মানুষ, না পড়েছি গীতা না বাইবেল। আমার মাথায় ধম্মটম্ম ঢোকে না। তবে অভিলাষীর সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি—তাতে বুঝতে পারি—ওঁদের কথা হল, এই দেহটাই হল গাছের ডালপালা; গুঁড়ি হল ইন্দ্রিয়, শেকড় হল ভেতরের প্রাণ; আর দেহ অ্যান্ড প্রাণ এই দুইয়ের মধ্যে একটা পেণ্ডুলাম ঝুলছে—তার নাম মন। মনকে একেবারে না এদিক না ওদিক করতে হবে, মানে—মানে একেবারে স্থির। সুখ দুঃখ আরাম কষ্ট কিছুই অনুভব করবে না। ওই নিস্পন্দ স্থির অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে দেখা দেবে থার্ড কনসাসনেস, মানে আর একটা নতুন চেতনা। সেটাই হল পরম চৈতন্য, মানুষের ভেতরের পাওয়া…।”
জলধর বললেন, “ব্যাপারটা গুলিয়ে গেল মিত্তিরসাহেব। থিয়োরি অফ রিলেটিভিটির মতন। কঠিন ব্যাপার। তা কী রকম পাওয়ার বলেছেন?”
পশুপতি বললেন, “হাঁদার মতন কথা হল জলধর। পাওয়ার ইজ পাওয়ার। এ তোমার হর্স পাওয়ার নয়।”
জলধর ঠোক্কর মেরে বললেন, “নাইদার হর্স, নর ইওর চশমার পাওয়ার। ও-সব ছেলেমি বিদ্যে জানা আছে। আমাকে পাওয়ার শেখাচ্ছ!”
কদম্ব বললেন, “এই সব পাওয়ার হল একটা অন্যরকম পাওয়ার। ভেতরের পাওয়ার, সাইকিক, সাধনা করে করে পাওয়া যাচ্ছে। আসলে আমি অভিলাষীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝেছি—নরম্যাল অবস্থায় মনের যে ফাংশান থাকে সেটা রিয়েলিটির ফাংশান, কিন্তু মন যখন ওই সুপার লেভেলে চলে যায় তখন তার কাছে ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান নেই—সব একাকার। মনের তখন সুপার ফাংশান। তার দেখার রে বেড়ে যায়।
সাধন বলেন, “শাস্ত্রে একেই বলেছে, মার্গ…”
জলধর দাবড়ে উঠে বললেন, “চুপ করো, শাস্ত্র কি বলেছে পরে বুঝিয়ো; এখন মিত্তিরমশাইয়ের কাছে ব্যাপারটা জানতে দাও।” জলধর কদম্ব মিত্তিরকে কখনও বলেন মিত্তিরমশাই কখনও মিত্তিরসাহেব, যখন যেটা মুখে আসে।
হাবুল বললেন, “আজকাল সুপার জেট, সুপার পাওয়ার, সুপার কনসাসনেস—সবই সুপার, তাই না পশুপতিদা?”
“ধরেছ ঠিক”, পশুপতি বললেন, “নতুন জগতটা পুরনো জগতকে আরও ছাড়িয়ে যাচ্ছে তো—তাই সুপার।”
কদম্ব সিগারেটের টুকরো ছাইদানে গুঁজতে গুঁজতে বললেন, “আমি ঘোর নাস্তিক। ঈশ্বর, যম, স্বর্গ, নরক—মায় পাপপুণ্য কোনোটাই বিশ্বাস করিনি। কিন্তু মশাই, এবার ঠকে গেলাম। অভিলাষী আমায় চমকে দিলেন। সত্যি বলছি, যেদিন ওঁকে আমি দেখলাম, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ইলেকট্রিক ফিলিং। গঙ্গার ঘাটে বসেছিলেন, মনে হল আমার জন্যেই এসে বসে আছেন। সঙ্গে লোক নেই, একটা পুঁটলিও নেই আশেপাশে। বললাম, থাকো কোথায়, যাবে কোথায়? অভিলাষী হেসে আঙুল দিয়ে আমায় দেখিয়ে দিলেন। বুঝলাম—আমার ঘরেই যাবেন। ব্যাস, সোজা বাড়ি নিয়ে এলাম।”
কদম্বর কথা শেষ হবার মুখে ফকির এসে বলল, “মা এসেছেন।”
চার
ফকির দরজার পরদা সরিয়ে সরে দাঁড়াল, অভিলাষী ঘরে এলেন।
জলধররা উঠে দাঁড়িয়ে অভিলাষীকে অভ্যর্থনা করবেন কিনা ভাবছিলেন—তার আগেই অভিলাষী যেন ভাব বিভোর অবস্থায় মৃদু মৃদু হাসি বিতরণ করে কোনার দিকে রাখা সোফার কাছে এগিয়ে গেলেন।
কদম্ব জলধরকে বললেন, “থাক থাক আপনাদের আর উঠতে হবে না। বসে বসেই আলাপ করুন।”
পশুপতির মনে হল, অভিলাষী প্রবীণা নয়, বৃদ্ধা নয়, পড়ন্ত যুবতী। গমনে গজেন্দ্রানী ভাব আছে এখনও।
অভিলাষী সোফায় বসলেন।
জলধররা অভিলাষীকে দেখছিলেন। অভিলাষী শাড়ি পড়েননি, আলখাল্লা ধরনের এক পোশাক পরেছেন। কোমরের তলা থেকে পোশাকটা যতটা ঢিলেঢালা কোমরের ওপর দিকটা তত নয়। কোমরের কাছে ফেট্টি বাঁধা। বুক কোমর মাপে মাপে আলগা। পোশাকের রংটা ঘন কমলা, বোধ হয় সিল্কেরই কাপড়, জেল্লা দিচ্ছিল। অভিলাষীর মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। কপাল কান দুইই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কানে কোনো গয়না নেই। ওঁর মুখের গড়নটি অনেকটা গোল ধরনের। বড় বড় চোখ, চাপা নাক, মোটা ঠোঁট। থুতনিতে তিল রয়েছে। রং ফরসা, কেমন লালচে লালচে দেখাচ্ছিল। সিঁদুরে গাল। চোখ দুটিও সমান লালচে এবং আবেশ জড়ানো। চোখের পাতায় সুর্মার ছোঁয়া।
কদম্ব আলাপ করিয়ে দিলেন।
জলধরের সঙ্গে আলাপ করাতেই তিনি বললেন, “আপনার কথাই শুনছিলাম এতক্ষণ। দর্শন পেলাম এবার। আমাদের সৌভাগ্য।”
সাধন নমস্কার জানিয়ে বললেন, “বড় খুশি হয়েছি। আপনাদের মতন সাধক সাধিকার সাক্ষাৎ পাওয়া ভাগ্য।”
পশুপতি কদম্বকে বললেন, “আমাদের বাংলা কথা উনি বুঝবেন তো?”
কদম্ব বললেন, “বুঝবে না কেন! ওর বাংলাটাই ভাল আসে, হিন্দির চেয়ে। দু একটা ইংরিজিও জানা আছে।”
হাবুল বললেন, “মুখটা বাঙালির মতন, তাই না?”
অভিলাষী প্রায় মুদিত নয়নে হাসলেন।
কদম্ব বললেন, “বাঙালি অরিজিন। নামও তত বাঙালি।” বলে কিছু বলতে গিয়ে কদম্ব জিব কাটলেন, যেন ভুল করে নামটা বলতে যাচ্ছিলেন, আটকে নিলেন। হেসে বললেন, “অভিলাষীর গেরস্থ নাম পাঁচজনের সামনে বলতে নেই। আমার আবার ও-সব মনে থাকে না।”
অভিলাষী মাথা নাড়লেন, হাসি মুখেই। কদম্বকে নিষেধ করলেন। ইশারায়।
জলধর বললেন, “দেশ বাড়ি কোথায় ওঁর?”
কদম্ব বললেন, “আগে বলেছি না—নেপাল বিহার বর্ডার। জায়গাটার নাম বললে কেউ বুঝবে না। যোগাবানীর কাছেই। তাই না?”
অভিলাষী সামান্য মাথা হেলালেন।
পশুপতি বললেন, “কবে থেকে সাধন-ভজন শুরু হয়েছে? মানে ঘর সংসার ছেড়ে এই স্পিরিচুয়াল লাইফ?
কদম্ব বললেন, “মন্দ কি! দশ পনেরো বছর তো হবেই। তাই না?” বলে অভিলাষীর দিকে তাকালেন একবার, তারপর যেন হিসেব পাকা করে নিয়ে পশুপতিকে বললেন, “পনেরো। ফিফটিন। তার আগে একটা ইনক্যুবেশান পিরিয়ড গেছে আগে—”
“কী পিরিয়ড?”
“ইনক্যুবেশান পিরিয়ড; মানে ডিমে তা দেবার সময়। ডিম ফোটার আগে তা দিতে হয় না! স্পিরিচুয়াল ব্যাপারেও একটা তা দেবার পিরিয়ড আছে। পাঁচ সাত দশ বছর লেগে যায় কারও কারও।”
সাধন মাথা নাড়লেন। “ঠিক। ঠিক কথা।”
“এর বেলায় বছর বাইশ থেকে শুরু হয়েছিল।”
অভিলাষী সামান্য মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
“বাইশ থেকে সাঁইত্রিশ কি আটত্রিশ এক্কেবারে আদাজল খেয়ে অভিলাষীর ক্রিয়াকর্মে, সাধন-ভজনে কেটেছে,” কদম্ব বললেন, “তারপর আজ বছর ছয় সাত—নিজের মতন করে আছে—মানে অ্যাজ সি লাইকস।”
জলধর আর পশুপতি মনে মনে হিসেবটা কষে ফেললেন। অভিলাষীর তা হলে বয়েস দাঁড়াচ্ছে বিয়াল্লিশ। চল্লিশের ওপর ওপর পয়তাল্লিশের নীচে। গড়ন পেটন থেকে মেয়েদের বয়েস যতটা আঁচ করা সম্ভব—ততটা আঁচ করলে অভিলাষীকে এই রকমই মনে হয়। তবে আসরে নামার আগে সাজঘর ঘুরে আসায় বয়েস আরও কম কম মনে হয়।
জলধরের নজর পাকা। তিনি অভিলাষীর খুঁটিনাটি আরও কিছু দেখে নিচ্ছিলেন। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। জলধরের মনে হল, মালার ঝুলে টান পড়েছে। তা পড়ক। দেখতে ভালই লাগে। গলায় রুদ্রাক্ষ, হাতে গালার বালা, বাঁ হাতে আংটি, চুনি বসানো। মনে হল, আঙুলের নখ চকচক করছে।
হাবুল বললেন, “আমি একবার বিন্ধাচল বেড়াতে গিয়ে এক যোগিনী দেখেছিলাম—আমার বউ যোগিনীর বড় ভক্ত হয়ে উঠেছিল। তা সত্যি বলতে কি মিত্তিরদার, সেই যোগিনীর লুক আমার ভাল লাগেনি। কেমন এক পাগলি টাইপের। মাথার জটা পেছনে হাঁটু ছড়িয়ে গেছে। তবে সেই যোগিনীর ক্ষমতা দেখেছিলাম—এক টুকরো রুটি ছুঁড়তেই দু শো ইঁদুর কোনখান থেকে বেরিয়ে এল কে জানে! আশ্চর্য!”
জলধর বললেন, “কী সাইজের ইঁদুর? ধেড়ে না লেঙটি?”
“তা মনে নেই। বড় ছোট সব ছিল।”
“তুমি কি ধাতে ছিলে, হাবুল? ভাঙা, গাঁজা খাওনি তো?”
হাবুল প্রবলভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন।
হাবুলের মাথা নাড়া দেখে পশুপতিরা হেসে উঠলেন।
এমন সময় বাইরে দমকা বাতাস উঠল। ঝড়ের মতন। কোনো ঘরের দরজা জানলা আছড়ে পড়ে বন্ধ হল, গাছপালায় শব্দ উঠল, একটা হুলো বেড়াল বাইরে কোথাও গজরাতে লাগল। সামান্য পরে সব শান্ত। দমকা বাতাস যেটুকু পড়ে থাকল তা কানে পড়ার মতন নয়।
সাধন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই অভিলাষী ইশারায় কদম্বকে কিছু বোঝাতে চাইলেন।
কদম্ব ঠিক বুঝতে পারলেন না। উঠে কাছে গেলেন অভিলাষীর। কিছু বললেন অভিলাষী, জড়ানো গলায়, ইঙ্গিতে। কদম্ব ফিরে এলেন নিজের জায়গায়।
“সাধনবাবু, আপনি একটু কাছে গিয়ে বসুন। কিছু বলার আছে ওর।”
সাধন বিগলিত বোধ করলেন। এত লোক থাকতে তাঁরই ডাক আগে পড়েছে। নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে অভিলাষীর কাছাকাছি একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
অভিলাষী চোখ বন্ধ করে মৃদু মৃদু দুলছিলেন। সামান্য পরে চোখ খুলে তাকিয়ে সাধনকে দেখলেন। বললেন, “দুনিয়া বড় ফাঁকা লাগে, দাদাজি?”
সাধন চমকে উঠলেন। অভিলাষীর গলার স্বর সামান্য ভাঙা ভাঙা, মোটা, জড়ানো। তা হলেও কী নরম ভঙ্গি। হাঁ করে অভিলাষীকে দেখতে লাগলেন। দু-গাল টকটক করছে। ফিকে গন্ধ চারপাশে।
সাধন বললেন, “তা লাগে! একা থাকি সংসারে। স্ত্রী আজ চার বছর নেই।”
“বিজলীবালা?”
সাধন চমকে উঠলেন। গা কেঁপে গেল। চক্ষু আর পড়ে না। হ্যাঁ। আপনি জানলেন কেমন করে?”
অভিলাষীর সেই আঙুরদানার মতন টসটসে হাসি ঠোঁটে। চোখের পাতা আরও একটু বড় করে বললেন, “রাখী পূর্ণিমায় ছেড়ে গিয়েছিলেন!”
সাধনের বুক গুমরে উঠল। অভিলাষী একেবারে ঠিক বলেছেন। রাখী পূর্ণিমাতেই বিজলী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। চার বছর হয়ে গেল। কিন্তু অভিলাষী এত কথা বলছেন কেমন করে! আশ্চর্য!
সাধনের বুক টনটন করে উঠছিল। বিজলী বেঁচে থাকতে দামি শালের মতন যত্ন করে রেখেছিল তাঁকে। দুবারের বেশি তিনবার হাঁচলে—নাকের ওষুধ, পায়ের মোজা বার করে দিত। এখন আর কে কার!
অভিলাষী বললেন, “দুঃখ করবেন না। উনি ভাল আছেন।”
সাধন বললেন, “দুঃখ করব না। আমার তিরিশ বত্তিরিশ বছরের বউ! আপনি বলছেন কেমন করে অভিলাষী! সুখদুঃখের জীবন ভেঙে দিয়ে চলে গেল। কোথায় রেখে গেল আমাকে!”
“কেউ যায় কেউ থাকে দাদাজি!…আপনি দুখ করবেন না। উধার তো ওঁর পুনরজনম হয়ে গেল!”
“পুনরজনম। ফির জনম নিয়েছেন। এখন তো ওঁর পুরা এগারা মাস বয়েস। পুরা এগারা। তিন বছর আত্মা হয়ে ঘুমেছেন ফিরেছেন। আবার জনম নিয়েছেন।
জলধর বললেন, “এগারো মাসের বাচ্চা! আরে রামো, সে তো তা হলে কাঁথায় শুয়ে আছে পেনি পরে। দুধ তুলছে। হাতে চুষিকাঠি। সাধন, ভাবতে পারছ ব্যাপারটা! ছ্যা-হ্যা!”
সাধন চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা অনুমান করার চেষ্টা করছিলেন। সেই বিজলী, যার তিন গজ কাপড় লাগত সেমিজ করতে সে এখন ইয়ে হয়ে পেনিফ্রক পরে কাঁথায় শুয়ে আছে!
সাধনের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। পুনর্জন্ম তো ডেনজারাস জিনিস। সাধন যদি সামনের দু-এক বছরের মধ্যে মারা যান—এবং চট করে জন্মান আবার, তবুও বিজলী বয়েসে বড় থেকে যাবে। তার মানে আর কোনোদিন বউ হবে না, হবে দিদি। যা কচু, এ-জন্মের বউ আসছে জন্মে…।
অভিলাষী বললেন, “আপনি কিছু ভাববেন না দাদাজি! বাচ্চি ভাল আছে, সুখে আছে।”
সাধন আর কী বলবেন? বুক ভেঙে মস্ত এক দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। এরকম তো কথা ছিল না। বিজলী বলত, কর্তা তোমার আমার বন্ধন জন্ম জন্মান্তরের, পালাবে কোথায়, যেখানেই যাও কাছা ধরে টেনে আনব।’ কই কথা তো খাটল না। এবার তুমি কী করবে বিজু! তুমি আর আমায় ধরতে পারবে না।
চোখ ছলছল করে উঠল সাধনের। একেই বলে কপাল! আমি থাকলাম এখানে পড়ে, তোমার ঘরবাড়ি আগলে, তোমার মেয়ে জামাই নাতিনাতনীর কেয়ার টেকারের মতন হয়ে, আর তুমি স্বার্থপরের মতন পালিয়ে গিয়ে আবার একদফা জন্ম নিয়ে কাঁথায় শুয়ে পা ছুঁড়ছ। নিকুচি করেছে জন্মান্তরের!
সাধন চোখের জল মুছতে রুমাল হাতড়াচ্ছিলেন।
এমন সময় অভিলাষীর গলা শোনা গেল। এবার একটু জোরালো হয়েছে।
“পায়ে ছ’টা আঙলি কার আছে?” অভিলাষী বললেন।
জলধর থ’ মেরে গেলেন। নিজের পায়ের দিকে তাকালেন। ধুতিতে ঢাকা। বললেন, “আমার।”
“ডান পায়ে?”
“হ্যাঁ।”
“পিঠে ঘা আছে? কারুয়া ঘা।”
“কার্বাঙ্কোল হয়েছিল। গত বছর।”
“রাতমে ঘুম হয়?”
“তোফা। এক আধদিন পেটে গ্যাস হলে ঘুম গড়বড় করে।”
“চিন্তাউন্তা নেই?”
“কিসের চিন্তা! আমার হল আপনি আর কোপনি। তা অভিলাষীজি, সাধনের পরিবারের কথা হল—এবার আমার ইয়ের কোন দশা হবে বলুন তো?” জলধর যেন ঠাট্টার মতন করে বললেন, যদিও তাঁর কোথায় সামান্য খটকা লাগছিল। জলধরের ডান পায়ে কড়ে আঙুল দুটো, আর পিঠে এক কার্বাঙ্কল হয়ে গত বছর গরমের সময় বেজায় ভুগেছিল। অভিলাষী এসব কথা জানল কেমন করে?
অভিলাষী চোখ বুজে বসে থাকতে থাকতে একবার নাকের বাঁ দিক টিপলেন, তারপর ডান দিক। দেওয়ালের ছবির আড়াল থেকে টিকটিকি ডেকে উঠল।
অভিলাষী বললেন, “চুহা, কাউয়া, বিললি—তিন জানোয়ার তু পাললি। চুহা তো আপনি জানেন জলধরজি, ইঁদুর। কাউয়া—কাক। ইঁদুর কাক আর বিললি তিন জানোয়ার সব ঘরমে থাকে আগর না থাকে তো আগ লাগে। আপনার ঘরে চুহা নেই?”
জলধর খানিকটা থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন, বললেন, “ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর আছে। গিন্নির পায়ে একবার কামড়ে দিয়েছিল। ইনজেকশান দিতে হয়েছিল, অভিলাষীজি।”
“কাউয়া নেই?”
“কাউয়া কি কেউ পোষে। কাক আর ইঁদুর সব বাড়িতেই আছে।”
অভিলাষী একটু যেন হাসলেন, “ঠিক বলেছেন। এবার একটা কথা বুঝে নিন। মানুষমে তিন ইন্দ্রিয় জাদা জাদা কাম করে। চুহা হল কাম, কাউয়া হল ক্রোধ, আর বিললি হল লালচ।”
পশুপতি মুগ্ধ হয়ে বলল, “ব্রিলিয়ান্ট। অভিলাষী দারুণ বলেছেন। জলধরের তিন ইন্দ্রিয়ই তেজি…।”
জলধর ধমকে উঠতে যাচ্ছিলেন তার আগেই অভিলাষী বললেন, “জোর হলে আরও তিন জনম।”
“তিন জন্ম?”।
“আগাড়ি জনম আর চুহাগিরি করবেন না!”
জলধর চট করে একবার পশুপতির দিকে তাকিয়ে নিলেন। “এ-জন্মেই করলাম তো আগাড়ি জনম!”
অভিলাষী বললেন, “ঝুট বলছেন।”
“ঝুট! কোন শালা আমার নামে বলে—!”
নিরীহ মুখ করে পশুপতি বললেন, “কোনো শালাই বলবে না। জলধরের ও-সব ফালতু দোষ নেই অভিলাষীজি। লোকে যে বলে, জলধর মধু কবিরাজের বিধবা শালীর সঙ্গে…”
“অ্যাই, হচ্ছে কি?”
“কথাটা শেষ করতে দাও না,” পশুপতি বললেন, তারপর অভিলাষীর দিকে তাকালেন। “শুনুন অভিলাষীজি! মধু কবিরাজের বিধবা শালী এখানে বেড়াতে এসে ছ’ আট মাস ছিল। গানের লাইনের লোক তো, গজল গাইত। বেনারসি না এলাহাবাদি বিবি। আমাদের জলধর কবিরাজের বাড়ি গিয়ে গানের সঙ্গে ঠেকা দিত তবলায়। জলধর ভাল তবলচি!…আমি মিথ্যে বলছি না অভিলাষীজি, মিত্তির সাহেব সাক্ষী।”
অভিলাষী মুচকি হেসে বললেন, “জলধরজি বড়া কলাচার।”
জলধর ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “তবলার কথা থাক। আপনি বলুন তো, কে থাকছে কে যাচ্ছে! আমি আগে, না গিন্নি আগে?”
“ভগবান জানেন।”
“ভগবান জানেন তো আপনি কী জানেন?”
“আমি আঁখ বন্ধ করে এক তামাশা দেখছি, জলধরজি! দূরমে রামলীলা হচ্ছে। সীতাজি কাঁদছেন, হনুমানজি হায় হায় করছেন।”
জলধরের বুক কেঁপে উঠল। বলে কি অভিলাষী! তবে কি তাঁর দশাও সাধনের মতন হবে?
জলধর বললেন, “শুনুন অভিলাষীজি! আমি সাফসুফ বলে দিচ্ছি—আই অ্যাম নট সাধন! চিরটাকাল আমি সামনে সামনে এসেছি—গিন্নি আমার পেছন পেছন। ফাইন্যাল রাউন্ডেও অমি আগে যাব। বুঝলেন।”
সাধন বললেন, “যাওয়া কি তোমার হাতে?”
জলধর বললেন, “দেখা যাবে। এখন পাঁচ সাত বছর যাচ্ছি না। পরের কথা পরে।…তা মিত্তিরমশাই আমাদের তো রাত হয়ে যাচ্ছে, এখন শুরু করলে—!” বলে ইশারায় পানভোজনের কথা বুঝিয়ে দিলেন।
খেয়াল হল কদম্বর। বললেন, “তাই তো সাতটা বেজে গেল। ফকিরকে ডাকি।’
হাবুল বললেন, “আমরা যে বাদ পড়ে গেলাম, কদম্বদা।”
“হবে হবে, অভিলাষী তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আবার একদিন হবে। ওর শরীর ভাল যাচ্ছে না। একদিনে বেশি স্ট্রেন উচিত নয়।”
হাবুল অভিলাষীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। “ঠিক আছে, তাই হবে। আমাদের একটু মনে রাখবেন অভিলাষী দিদি।”
অভিলাষী মাথা হেলিয়ে হাসলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাচ্ছিলেন অভিলাষী, সামান্য দুলছেন। পায়ে খড়ম-জুতো। ঠুক টুক আওয়াজ উঠছিল। পশুপতির পাশ দিয়ে যাবার সময় অভিলাষী আড়চোখে কেমন করে যেন ইশারা করলেন। অন্য কেউ নজর করল না। পশুপতি হাত জোড় করে বলল, “আপনি ভগবতী। কাল পরশুই আবার আসব।”
পাঁচ
ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা।
হাবুল আর সাধন সামনে। পেছনের সিটে পশুপতি আর জলধর। জলধর যেভাবে গাড়ির মধ্যে গড়িয়ে রয়েছেন তাতে বোঝা যায় তিনি বাস্তবিকই এখন জলে পূর্ণ হয়ে রয়েছেন। তাঁর চোখ বোজা। মাঝে মাঝে নাক ডাকছিল।
পশুপতি হুঁশে আছেন—তবে এলিয়ে আছেন।
সাধন সামান্য মুখে দিয়েছেন তাতেই নেশা ধরে গিয়েছে। মাঝে মাঝেই তাঁর শোক উথলে উঠছে।
হাবুল যতটুকু নেশা করেছিল তাতেই আনাড়ির মতন গাড়ি চালাচ্ছিল। ভাগ্যিস মেঠো জমি আশেপাশে, নয়ত গাড়ি ডোবায় গিয়ে পড়ত।
সবাই চুপচাপ। হাবুল নিজেকে সজাগ রাখার জন্যে জোরে জোরে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছিল।
হঠাৎ হাবুল বলল, “জলধরদা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
কোনো সাড়া নেই।
পশুপতি আড়ষ্ট জিবে বললেন, “একেবারে কাদা। কাছা খুলে খেয়েছে। ওকেই আগে নামিয়ে দিও হাবুল। চ্যাংদোলা করে নামাতে হবে।”
হঠাৎ জলধর বসা গলায় বললেন, “আমি ঘুমোইনি।”
“ঘুমোওনি! নাক ডাকছ যে!”
“জেগে জেগেও নাক ডাকা যায়। আমি ভাবছিলাম।” জলধরের কথাগুলো অস্পষ্ট, জড়ানো।
“কী ভাবছিলে?”
“অভিলাষীকে ভাবছিলাম। মুখটা আমার বড় চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি।”
পশুপতি বললেন, “দেখেছ?”
জলধর কোনো জবাব দিলেন না।
আরও খানিকটা এগিয়ে আসার পর সাধন আবার যখন ফুপিয়ে কেঁদে উঠছেন হঠাৎ যেন জলধর কিছু আবিষ্কার করলেন। বললেন, “পশুপতি, এই অভিলাষী আর মধু কবিরাজের সেই বিধবা শালীটা এক নয়? সে বেটি হাওয়া হয়ে গেল—হঠাৎ। কদম্ব তখন এখানে এসেছিল। কদম্ব যাবার হপ্তা খানেক পরে ও-বেটি পালাল। তাই না?”
পশুপতি বললেন, “তুমি কোন বিধবার কথা বলছ? যার গানের সঙ্গে তবলায় ঠেকা দিতে যেতে। বাঁজা বিধবা।”
সিটের গর্ত থেকে উঠতে উঠতে জলধর বললেন, “মেয়েছেলে কেমন ভোল পালটেছে দেখেছ! ছিল কলসী, হয়ে গেল অভিলাষী। চেনাই যায় না। তাই বলি অভিলাষী এত হাঁড়ির কথা বার করছে কেমন করে? কদম্ব মিত্তির এমন পাকা ধড়িবাজ তা জানতাম না। যাক ভালই করেছে। বুড়ো বয়েসে একটা অবলম্বন তো দরকার। কি বলো?”
পশুপতি কিছু বলার আগেই হাবুলের গাড়ি গড়িয়ে গড়িয়ে মাঠে নেমে গেল।