অভিমানিনী মৃন্ময়ী – অষ্টম পর্ব

অভিমানিনী মৃন্ময়ী—অষ্টম পর্ব

জাহাজ আজ কদিন ধরে নীলাম্বুরাশিতে। উপকূল থেকে দু-তিন ক্রোশ দূর দিয়ে চলেছে দক্ষিণ-পশ্চিমে। এখন পাল খাটানো হয়েছে–যদিও বাতাসের গতিমুখ দক্ষিণ দিক থেকেই। দক্ষ নাবিকেরা জানে পাল কতটা বেঁকিয়ে, হাল কতটা হেলিয়ে জাহাজের গতিমুখ দিগ্‌দর্শন-যন্ত্রের নির্দেশ মোতাবেক দক্ষিণ-পশ্চিমে রাখা সম্ভবপর। তাছাড়া জাহাজের তলদেশে সমুদ্রতলের কিছু উপরে দুই সারিতে বারো-দুকুনে চব্বিশ জন দাঁড়ি একসঙ্গে দাঁড় টানে। অনুমান, পক্ষকাল পার হওয়ার পূর্বেই মহানদীর মোহনায় উপনীত হওয়া যাবে। সেখানে পৌঁছাতে পারলে বড়-সারেঙের বিশ্রাম; কারণ নদীর মোহনা থেকে মহানদী বেয়ে কটক বন্দর পর্যন্ত জাহাজ চলানোর দায়িত্ব স্থানীয় উৎকলী গাঙ-সারেঙের।

জাহাজ এখন প্রচণ্ড দুলছে। অনেকেই রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

দেয়াল ধরে ধরে টলতে টলতে দুর্গা গাঙ্গুলী উপরের ‘ডেক’-এ রূপেন্দ্রের বিশ্রামকক্ষে এসে হাজির। রূপেন্দ্র আর নগেন্দ্র ওপরের ডেকে পাশাপাশি দুটি ছোট ছোট কামরায় থাকেন। জাহাজীরা বলে ‘কেবিন’

রূপেন্দ্র শুয়ে ছিলেন উঠে বসলেন। বললেন, বসুন, গাঙ্গুলীখুড়ো, এই টলটলায়মান অবস্থায় আপনি হঠাৎ?

দুর্গা কোনওক্রমে আসন গ্রহণ করে বলেন, বাধ্য হয়ে এয়েছি বাবাজী। তোমার খুড়িমা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পেটে কিছু থাকচে না, ক্রমাগত বমি হয়ে যাচ্ছে।..

রূপেন্দ্র বলেন, সকলের একই অবস্থা, খুড়ো। এর কোনও চিকিৎসা নেই। সহ্য করতে হবে। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই ঘুমের ওষুধটা নিয়ে যান। জল দিয়ে খাইয়ে দেবেন। হয়তো ঘুমুতে পারলে একটু ভালো লাগবে।

—তুমি নিজে গিয়ে একবার দেখবে না, বাবা?

—আজ্ঞে না! বললাম তো। জাহাজসুদ্ধ সকলেরই এক অবস্থা।

—তা বটে। আর একটা কথা বলি রূপেন, কিছু মনে কর না—সেদিন কি তুমি আমার ওপর রুষ্ট হয়েছিলে?

—কোন দিন?

—যেদিন ছোটবউ তোমারে দ্যাখ-না-দ্যাখ বেমক্কা পেন্নাম করে বসল আর আমি সবার সমুখে বলে দিলাম, ও তোমার খুড়িমা?

রূপেন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, আপনি সত্যি করে বলুন তো গাঙ্গুলীখুড়ো—আপনি কি সজ্ঞানে মিথ্যা বলেননি? ইচ্ছে করেই আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাননি? যাতে আমি ধরে নিই মীনু মারা গেছে?

দুর্গা গাঙ্গুলী জবাব দিলেন না। নতনেত্রে নীরবে বসে রইলেন।

রূপেন্দ্র পুনরায় বলেন, কেন খুড়ো? হঠাৎ মিছে কথা বলতে গেলেন কেন?

এবারও গাঙ্গুলী নতনয়নে নীরব রইলেন।

রূপেন্দ্র পুনরায় বলেন, আমি যখন তীর্থভ্রমণে বার হই, তখন ও গর্ভবতী ছিল—

—’ও’ মানে? তোমার খুড়িমা?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি মৃন্ময়ীর কথাই বলছি—মীনু

মীনু—আপনার চতুর্থ পক্ষের ধর্মপত্নী তার কী হয়েছিল? পুত্র না কন্যা?

—না বাবা, রুপেন, পুত্র-সন্তানই হতো তার। হল না। কার পাপে জানি না, মৃত সন্তান প্রসব করেছিল ছোটবউ।

—ও!

দুজনেই কিছুটা চুপচাপ

রূপেন্দ্র পুনরায় বলেন, আপনি কিন্তু আমার ও-প্রশ্নটার জবাব এখনও দেননি গাঙ্গুলীখুড়ো। কেন আপনি আমাকে ওই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী করতে চেয়েছিলেন? আজই বা আমাকে কী বলবার জন্য এসেছেন, বলুন তো? মীনু তো জাহাজে একা অসুস্থ হয়নি . সবাই হয়েছে, এমনকি আপনি-আমিও। তাহলে সেই ছুতোয় এত কষ্টস্বীকার করে আমার কাছে কেন এসেছেন? কী বলতে এসেছেন এই নির্জনে?

গাঙ্গুলী অধোবদনে কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর মুখ তুলে বললেন, তুমি প্রখর বুদ্ধিমান! আমি জানি। হ্যাঁ, বাবা তোমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা আলোচনা করতেই এয়েছি। খোলাখুলি বলবো?

—বলুন, আমি খোলাখুলি জানতেই তো চাইছি। সঙ্কোচ কিসের?

—দেখ বাবা, ঘি আর আগুন কাছাকাছি রাখতে নেই। তোমার খুড়িমার বয়স সতেরো, তোমার এক কুড়ি ছয়। আর আমার তিন কুড়ি পুরেচে অনেকদিন। আমরা তিনজনেই এক গাঁয়ের বাসিন্দা। জানতে তো আমার কিছু বাকি নেই। মৃন্ময়ীর বাপ পীতু—পীতাম্বর মুকুজ্জে–তোমার পাশের বাড়ির বাসিন্দা। তুমিও জান, আমিও জানি—তোমার খুড়িমা দেড়- দুবছর বয়সে বিনি-ঘুন্সিতে তোমাদের দাওয়ায় হামা দিয়ে ফিরেচে। তুমি তারে কাঁধে করে ঠাকুর দেকিয়ে বেড়িয়েচ। তোমাদের দুজনেরই দুজনের প্রতি ইয়ে ছিল, তাও আমার অজানা নয়…

রূপেন্দ্র বাধা দিয়ে বললেন, তাহলে, আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো, কেন আপনি পীতুকাকার কাছে এই বিয়ের প্রস্তাব তুলেছিলেন? যখন আমি গাঁয়ের বাইরে ত্রিবেণীতে পড়াশোনা করছি? আপনি তো ‘পুত্রার্থে’ ভার্যা চেয়েছিলেন, তাই না? বিনা বরপণে? সেক্ষেত্রে অসংখ্য কন্যাদায়গ্রস্তের অরক্ষণীয়া তো আপনার জানা ছিল। আপনি তো নিজেই বলছেন যে জানতেন, আমাদের দুজনের প্রতি দুজনের ইয়ে’ ছিল….

–কী করব বল? পীতু মুকুজ্জে যেরকমভাবে আমার হাতে-পায়ে ধরলে—ওকে কথা দিয়ে..

–‘ও’ মানে? আপনার বাবা?

–আমার বাবা?

–বাঃ! আপনার স্ত্রী যদি আমার ‘খুড়িমা’ হন, তাহলে আমার খুড়িমার বাবা আপনার ‘বাধাই তো হবেন? শ্বশুরমশাইকে আপনি কি পীতু মুকুজ্জে বলে ডাকেন নাকি?

–পিতু আমার চেয়ে বয়সে ছোট! আমাকে বরাবর ‘দাদা’ ডেকে এয়েছে।

—তাতে কী হল? খুড়িমাও তো বয়সে আমার চেয়ে ছোট! জন্ম থেকে আমাকেও বরাবর ‘দাদা’ ডেকে এসেছে।

—তুমি কি আমার গায়ে পা তুলে ঝগড়া করতে এয়েছ?

—আমি তো আসিনি, খুড়ো। আপনিই আমার কাছে এসেছেন, কী যেন একটা জরুরি কথা বলতে। খোলাখুলি কথা বলতে আপনি ভালবাসেন বললেন, তাই বলছি!

দুর্গা গাঙ্গুলী অনেকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, আমি তোমার কাছে একটি সাহায্য চাইতে এয়েচি রুপেন। গাঁ-সম্পর্কে আমি তোমার খুড়ো হই। তুমি কি আমারে এ- বিপদে সাহায্য করবে?

—বিপদটা কী, এবং সাহায্যটা কী জাতীয় না জেনে কী করে বলব?

—তা’হলে কতা দাও, সাহায্য না করলেও তুমি কতাটা গোপন রাখবে।

—বেশ তো, বলুন না?

—তুমি বুদ্ধিমান। নিশ্চয় আন্দাজ করেচ কেন এই বয়সে আমি সস্ত্রীক জগন্নাথক্ষেত্রে তীর্থে যাচ্ছি।

ভ্রুকুঞ্চন হল রূপেন্দ্রের। বললেন, পুণ্যার্জন ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য আছে নাকি? তাহলে স্বীকার করব আমি আন্দাজ করিনি। ভাবিইনি।

আমি একটি পুত্রসন্তান চাই, বাবা রুপেন। সেকতা তোমায় অনেকদিন আগেই বলেছিলাম। তুমি ব্যবস্থাদিও দিয়েছিলে। সেই বুক দেখার যন্তরটা দিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল বটে, কিন্তু পরে আমি তোমার বাড়িতে সস্ত্রীক গিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলি….

—সেসব পুরনো কাসুন্দি আর নাই ঘাঁটলেন, খুড়ো। আমাকে সরাসরি বলুন, আমার কাছে কী সাহায্য চাইছেন?

—সন্তান উৎপাদনের ক্ষ্যামতা এই দেড় বছরে আমি একেবারে হারিয়ে ফেলেছি রুপেন। তোমার খুড়িমা দিনমানে আমার সেবা যত্ন করে। কিন্তু রাত হলেই সে এক্কেরে বাঘিনী। আমারে কাছে ঘেঁষতেই দেয় না। তুমি কবরেজ, নিশ্চয় বুঝতে পারছো আমার অবস্থা! তুমি জান, চার-চারবার বে করেছি, কিন্তু আজও পিণ্ডদানের কোনও ব্যবস্থা করে উঠতে পারিনি। এই আমার শেষ চেষ্টা…

রূপেন্দ্র সোজা হয়ে উঠে বসেন : কী আপনার শেষ চেষ্টা?

—গুরুদেবের একটি আশ্রম আছে জগন্নাথধামে। তিনি আমার জন্য পুত্যেষ্টি যজ্ঞের ব্যবস্থা করবেন। তাঁর প্রণামী আমি আগাম মিটিয়ে দিয়েচি। কিন্তু আমি বুড়ো মানুষ, বিদেশ- বিভুঁইয়ে যদি আতান্তরিতে পড়ি—তাই বলছিলাম, গাঁয়ের মানুষ হিসেবে তুমি কি আমারে টুক্‌ সাহায্য করবে?

রূপেন্দ্র কুঞ্চিতভ্রূভঙ্গে বলেন, পুত্রেষ্টি-যজ্ঞ! জগন্নাথক্ষেত্রে? মীনু জানে?

—বাঃ, সে জানবে না? নিশ্চয়! তাকে জানিয়েই তো সব ব্যবস্থা হয়েছে!

—জাহাজের আর কে কে জানে?

—না, বাবা! আর কেউ জানে না। পুরীধামে আমরা পৌঁছালেই গুরুদেবের নির্দিষ্ট পাণ্ডাজী আমাদের দুজনকে তাঁর পৃথক যাত্রী-আবাসে নিয়ে যাবেন। যজ্ঞ-টজ্ঞ সব কিছু সেখানেই গোপনে সারা হবে।

রূপেন্দ্র নতনয়নে কী যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, মীনুকে জানিয়ে ব্যবস্থা করেছেন বললেন, কিন্তু যজ্ঞের অন্তরালে যে নেপথ্য ব্যবস্থা সেটা কি আপনি মীনুকে বুঝিয়ে বলেছেন? সে ব্যাপারটা কি ও জানে? বুঝেছে?

দুর্গা গাঙ্গুলী বিহ্বলভাবে বললেন, তুমি কী বলছো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, বাবা। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?

রূপেন্দ্র কঠিনস্বরে বলেন, বলবো। তার পূর্বে আপনি কি দয়া করে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন, কোন্ বিকল্পটা আমি ধরে নেব? আপনি নিজেই কিছু না বুঝে-শুনে মূর্খের মতো গুরুদেবের কাছে অগ্রিম প্রণামী দিয়ে মাথা মুড়িয়েছেন; নাকি সব জেনে-বুঝে আজ আমার কাছে ন্যাকা সাজছেন?

গাঙ্গুলী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন।

—‘বিনিয়োগ প্রথা’ শব্দটা শুনেছেন? ‘ক্ষেত্রজ পুত্র’ শব্দটা? যূপকাষ্ঠে ফেলে ছাগশিশুকে যেমন বলি দেওয়া হয়, সে-ভাবে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের ভড়ঙের আড়ালে একটি সীমান্তনীকে হাত-পা বেঁধে বলি দেওয়া হয়, তা জানেন না বলতে চান?

গাঙ্গুলী এবার অধোবদনে কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা-ভাবনা করলেন। বললেন, তোমার কাছে লুকিয়ে কী লাভ রুপেন? তুমি বিচক্ষণ! কবিরাজ! সবই তো আন্দাজ করেচ! কিন্তু এছাড়া ‘পুন্নাম’ নরক থেকে এ বৃদ্ধের উদ্ধারলাভের আর কী পথ আছে বল?

—না, নেই। আপনার সংস্কারবশে আপনি যেভাবে ‘পুন্নাম নরক’-এর কথা কল্পনায় এঁকে রেখেছেন, তা থেকে আপনার উদ্ধারের পথ নেই। কিন্তু আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো–যাঁরা আজন্ম ব্রহ্মচারী, যেমন আদি শঙ্করাচার্য তাঁরা কি ‘পুন্নাম’ নরকে যমদূতের ডাণ্ডা খাচ্ছেন?

—তাঁরা যে ঋষি, সন্ন্যাসী! আমি যে গৃহী, বাবা?

—আপনিও সন্ন্যাস নিন না! আমি ব্যবস্থা করে দেব। সন্ন্যাস নেবার বয়সও তো হয়েছে। আপনার খড়ম-জোড়া মীনুকে দিয়ে যান। ও চেষ্টা করে দেখুক—মা-বিষ্ণুপ্রিয়ার মতো একান্ত সাধনায় সে জগন্নাথের কৃপা পায় কি না পায়?

নিদন্ত হাসি হাসলেন দুর্গা গাঙ্গুলী। সে হাসি বিষণ্ন। বললেন বিষয়-বিষ যে আমার মজ্জায়-মজ্জায় আজও জড়িয়ে আছে, রুপেন! আমি যে ওটা পারব না!

—বুঝলাম। কিন্তু পুত্রেষ্টি-যজ্ঞে আপনার যে পুত্রসন্তান লাভ হবেই একথা কেন ধরে নিচ্ছেন?

—গুরুদেব যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন! কন্যাসন্তানের বদলে পুত্রসন্তান উৎপাদনের জন্য তিনি যে আগাম দু-গুনো পেন্নামী নিয়েছেন, বাবা।

—আপনার গুরুদেবের কোনও অধিকার নেই যজমানকে ও জাতীয় প্রতিশ্রুতি দেবার আপনার স্ত্রী বন্ধ্যা নয় এটা প্রমাণিত ফলে গুরুদেব আপনাকে এ-প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন যে, পুত্রেষ্টি-যজ্ঞের মাধ্যমে সে পুনর্বার সন্তানবতী হবে। একরাত্রির উৎপীড়নে না হলে, বারে বারে তার উপর বলাৎকার করে, যতক্ষণ না হতভাগিনী গর্ভবতী হয়। কিন্তু ‘পুত্র’-সন্তান দানের ক্ষমতা তাঁর নেই। কন্যা-সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশভাগ।

দুর্গা গাঙ্গুলী যেন চিরতার রস খেয়েছেন। মুখটা বিকৃত করে বলেন, এত খরচপাতি করে, এত কাঠখড় পুড়িয়ে, আবার মেয়ে? তা’হলে গুরুদেব কেন বললেন : নিশ্চিত পুত্রসন্তান?

রূঢ়স্বরে রূপেন্দ্র বলেন, আপনার গুরুদেব সম্বন্ধে কোনও মন্তব্য করা আমার পক্ষে শোভন নয়, তবে এইভাবে অনেক ভণ্ড লোক গুরুবাদী সাধারণ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায় এটা প্রত্যক্ষ সত্য! এদের বিরুদ্ধেই আমার সংগ্রাম। দুর্ভাগ্যবশত সমাজ আমার সঙ্গে সহযোগিতা করছে না। কিন্তু আপনি কৌশলে আমার প্রশ্নের জবাবটা বরাবর এড়িয়ে যাচ্ছেন, খুড়ো।

—কী প্রশ্ন, বাবা?

—এই ‘নেপথ্য’-ব্যবস্থাটা

বিনিয়োগ-প্রথার কথাটা কি মীনু জানে? পাণ্ডাজীর নিয়োজিত যে পুরুষটার শয্যাসঙ্গিনী হতে তাকে আপনি বাধ্য করছেন, তাকে কি সে দেখেছে? সে কি তাকে অনুমোদন করেছে? পছন্দ করেছে?

খুড়ো মাথা নেড়ে বললেন, না, আমিই তারে দেখিনি এখনো পয্যন্ত! তবে গুরুদেব বলেছেন, কুচ্ছিৎ নয়, এই তোমারই বয়সী।

আমার প্রথম প্রশ্নটার জবাব দিন : মীনু কি জানে যে, আপনার পুত্রকামনায় তাকে ধর্মের ভড়ঙে আসলে পরপুরুষভজনা করতে হবে?

জেরার মুখে কোণঠাসা আসামীর মতো হঠাৎ আত্মসমর্পণ করে বসেন দুর্গা গাঙ্গুলী! ঝুঁকে পড়ে•রূপেন্দ্রের দুটি হাত ধরে বলে ওঠেন, না, বাবা! যজ্ঞের আসল ব্যাপারটা সে জানে না, তারে বলা হয়নি। আমার ঠিক সাহস হচ্ছে না…মানে, তুমি এটুকু উগ্নার করে দেবে, বাবা? তোমারে সে খুব শ্রদ্ধা করে…

—শ্রদ্ধা, না ‘ইয়ে’?

—তা যদি বল তো তাতেও আমি রাজি। কাকপক্ষীতে টের পাবে না। যজ্ঞ-টজ্ঞ কিছুরই দরকার নেই! তুমিই এ-দায়িত্ব নাও! পুরীতে পৌঁছে একটি ঘর ভাড়া নেব। তোমরা দুটিতে থাকবে! ও আমার কাছে বাঘিনী, তোমার কাছে মোহিনী হয়ে যাবে। তোমার দুটি হাত ধরছি, আমাকে পুত্রসন্তান দাও বাবা রূপেন

জাহাজ তখন প্রচণ্ড দুলছে। না কি এই প্রস্তাবে ওঁর মাথার মধ্যেই টলে উঠল? তবু রূপেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন। দ্বারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, বেরিয়ে যান!

—তুমি, তুমি… আমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছ, রুপেন!

—সেজন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন। আপনি অনাহত ফিরে যাচ্ছেন! এই মুহূর্তে আমার দৃষ্টির বাইরে না গেলে…

—কিন্তু জাহাজ যে প্রচণ্ড দুলছে, বাবা। আমি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছি না।

—তাহলে চার-হাতে পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যান! আপনার প্রস্তাবের সঙ্গে সেই গমনভঙ্গিমাটা সঙ্গতিপূর্ণ হবে। যান!

দেয়াল ধরে ধরে দুর্গা গাঙ্গুলী কোনক্রমে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। রূপেন্দ্রনাথ সংলগ্ন স্নানকক্ষে গিয়ে মুখে-মাথায় জলের ঝাপটা দিলেন। টলতে টলতে আবার এসে বসলেন আসনে।

উপায় নেই। কেউ রূপেন্দ্রনাথকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। ‘বিনিয়োগ প্রথা’, ‘ক্ষেত্রজ পুত্র’ সমাজে স্বীকৃত। স্মার্তপণ্ডিতদের পরিচালিত এই কূপমণ্ডুক সমাজব্যবস্থায় ‘ভৃত্য’ আর ‘ভার্যা’র সমান মর্যাদা। দুটিই এক ধাতুতে গড়া—√ভৃ+য—অর্থাৎ ভরণীয়! যাকে খাওয়া-পরা দিয়ে কাজ করাতে হয়। ভৃত্য শব্দের দুটি অর্থ—এক : দাস; দুই : ভার্যা। ভৃত্য সংসারের ভিতরে করে নানান জাতির কাজ, চাষের খেতে করে শস্য উৎপাদন। ভার্যাও করে সংসারের ভিতরে নানান জাতের কাজ, শয্যায় করে সন্তান উৎপাদন। তাই মনু বলেছেন : ভার্যা ভৃত্যই! “অবশ্যভরণীয়পুত্রদারাদিবর্গ”। মনু আরও বলেছেন : ভৃত্যকে দান করবে ব্যবহৃত পোশাক, যা জীর্ণ হয়ে এসেছে এবং ভার্যাকে দেবে “ভুক্তেবাচ্ছিষ্টংবধৈব দদাৎ”!

দুর্গা গাঙ্গুলীও নিশ্চয় তা দিয়ে থাকেন–ভুক্তাবশিষ্ট!

ভৃত্যকে যদি পরের সেবায় নিয়োগ করা যায়, ভার্যাকে কেন যাবে না? সমাজ দুর্গা গাঙ্গুলীর পক্ষে। ‘একবগ্গা’ ঠাকুরের বিপক্ষে।

তার মানে রূপেন্দ্র যদি মৃন্ময়ীকে বাঁচাবার জন্য সহযাত্রীদের সাহায্য চান, কেউ এগিয়ে আসবে না। ক্ষেত্রজ পুত্র দাবি করার অধিকার আছে স্বামীর। এতে আছে তার সামাজিক অধিকার–স্ত্রী তার মালিকের নির্দেশমতো বিবস্ত্রা হয়ে অজানা-অচেনা পুরুষের বিছানায় গিয়ে শুতে বাধ্য। অবশ্য ওদিকে ততক্ষণ যজ্ঞ হতে থাকবে। পুত্রেষ্টি যজ্ঞ! কাঁসরঘণ্টায় যেমন বলির পশুর মৃত্যুযন্ত্রণার আর্তি ঢাকা পড়ে যায়, তেমনি যজ্ঞের কোলাহলে শোনা যাবে না নির্যাতিতা হতভাগীর জান্তব আর্তনাদ! এ বলাৎকার শুধু আইনসম্মত নয়, ধর্মসঙ্গত।

মহান হিন্দুধর্ম!

কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে খরজিহ্ব যাত্রীদলের কাছে সেটা একটা মজাদার কেচ্ছা হয়ে উঠবে মাত্র। তামাক টানতে টানতে পুরুষেরা আড়চোখে মেয়েটিকে দেখিয়ে রসিকতা করবে : ঐ মেয়েটিই সেই বলির পশু, তাই না? তা গাঙ্গুলীবুড়ো খরচ পত্তর করে মরছে কেন? আমাকে বলেই তো বিকড়িতে তার কায্যোদ্ধার করে দিতাম! মাগীর গতর তো কানায়-কানায়। পান-জর্দায় রাঙা মহিলাদেরও রক্তিম জিহ্বা পার্শ্ববর্তিনীর কর্ণমূলে কিছু অশ্লীল রসিকতা করবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠবে মাত্র!

আশ্চর্য মতিগতি সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয়ী সমাজের!

ঠিক যেন এই বিংশ শতাব্দীর শেষপাদ!

যাত্রীদল কটক থেকে পদব্রজে একাম্রকাননে এসে পৌঁছেছে।

জাহাজটি মহানদীর বন্দরে এসে ভিড়েছিল পূর্ণ-জোয়ারকালে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যাত্রীদের নামিয়ে অর্ণবপোত আবার কাটজুড়ির মাঝগাঙে ফিরে গেছে। জোয়ার-ভাঁটা মেনে জাহাজকে বন্দরের পাটাতনে ভেড়াতে হয়। নাহলে সমুদ্রগামী বড় জাহাজের তলদেশ বালির চড়ায় আটকে যায়। কটক একটি অতি প্রাচীন বন্দর। কেশরীবংশীয় নৃপতি মকরকেশরী প্রতিষ্ঠিত। মহানদীর এক শাখা কাটজুড়ি-গঙ্গার এ-বন্দরে সেকালে অনেক অর্ণবপোত নোঙর করতো। হাঁটাপথে শ্রীক্ষেত্র এখান থেকে চার-পাঁচ দিনের পথ। অধিকাংশ যাত্রীই যাকে পায়ে হেঁটে। সামান্য কিছু ধনবান যাত্রীর জন্য পালকি বা চৌদোলার আয়োজন। গো-গাড়িও ভাড়া পাওয়া যায়। ছয়-ছয়জন একত্রে গো-গাড়ি ভাড়া করতে পারেন যাতায়াতের কড়ারে। এক পক্ষকাল তীর্থবাস করতে পারেন যাত্রীরা। সে-ক্ষেত্রে যাতায়াতের পথে গো-শকট চালকের খাদ্যের ব্যবস্থা যাত্রীদের করতে হয়। অবশ্য পুরীতে যে পক্ষকাল থাকবেন, তখন চালককে খোরাকি দিতে হয় না। যদি না অবশ্য যাত্রীরা স্থানীয় তীর্থগুলি গোযানেই দেখে নিতে চান। এটাই ছিল সেকালীন ব্যবস্থা।

নগেন্দ্র দত্ত একটি সুদৃশ্য চৌদোলায় রওনা হয়ে গেলেন। তিনি রূপেন্দ্রনাথের জন্যও একটি পালকির বন্দোবস্ত নিজ ব্যয়ে করে দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু রূপেন্দ্র কিছুতেই স্বীকৃত হলেন না! তিনি সংখ্যাগুরু পদযাত্রীদের দলে রয়ে গেলেন। দুর্গা গাঙ্গুলী সস্ত্রীক কিসে রওনা হলেন বোঝা গেল না। সম্ভবত গোয়ানে, অথবা, কে জানে, হয়তো জোড়া পালকিতে। রূপেন্দ্র টের পাননি। বস্তুত, সেই যেদিন মৃন্ময়ী ওঁকে সর্বসমক্ষে হঠাৎ প্রণাম করতে গিয়েছিল তার পর থেকে মীনুকে উনি আর দেখতে পাননি। গাঙ্গুলীমশাই তাকে বরাবর আড়াল করে রেখেছেন। সেই যেদিন রূপেন্দ্র বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে চতুষ্পদভঙ্গিতে খুড়োকে ওঁর ঘর থেকে ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে।

এখন সূর্যের তেজ কম। তবু যাত্রীরা অতি প্রত্যূষে ডেরা-ডাণ্ডা গুটিয়ে নিয়ে রওনা দেয়। তখনো নির্মেঘ আকাশে তারা দেখা যায়। সূর্যোদয়ের আগেই না-হোক তিন-চার ক্রোশ পথ পাড়ি দেওয়া যায়। তারপর একটু বিশ্রাম। পথের ধারে দোকানে প্রাতরাশ। যাত্রীদের জন্য অতি প্রত্যূষে পথপার্শ্বের বিপণীতে কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। খাজা, জিবেগজা, জিলাবি ইত্যাদি মিষ্টান্ন। গোধূমচূর্ণের নানারকম ঘৃতপক্ক মুখরোচক—ইদানীং তার চল হয়েছে, নাম : লোচিকা!

কিন্তু সে-সব লোভনীয় খাদ্যদ্রব্যাদি অর্থবান তীর্থযাত্রীদের জন্য। সাধারণ যাত্রীর ঝোলাতে থাকে চিপিটক আর ইক্ষুগুড়। ফেনি আর মঠ।

একপ্রহর বেলায় একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা। সূর্য যখন মধ্যগগনে, তখন মধ্যাহ্ন- বিশ্রাম। মন্দির কাছে-পিঠে থাকলে ভোগ পাওয়া যায় কড়ির বিনিময়ে। তাতেই ক্ষুন্নিবৃত্তি। তারপর দু-দণ্ডের বিশ্রাম। আবার অপরাহ্ণে সূর্যের তেজ একটু কমে এলে পদযাত্রা। শুক্লপক্ষ হলে রাতের প্রথম প্রহরের সমাপ্তিসূচক শিবাধ্বনি পর্যন্ত। জগন্নাথ সড়কের ধারে ধারে প্রতাপরুদ্রদেবের নির্মিত যাত্রীশালা। যারা দানীদের ‘পথকর’ প্রদান করে আদায়কারীর পাঞ্জাছাপ সংগ্রহ করেছে তাদের বিনামূল্যে সেখানে রাত্রিবাসের আয়োজন। অন্যান্যদের আশ্রয় কড়ির বিনিময়ে অথবা গাছতলায়। প্রতিটি যাত্রীনিবাসে আছে সংলগ্ন জলাশয় দীর্ঘিকা অথবা পাকা ইঁদারা।

ওঁরা সদলবলে একাম্রকাননে এসে পৌঁছলেন পড়ন্ত বেলায়। কে কোন্ যাত্রীনিবাসে আশ্রয় নিয়েছে, কে খোঁজ নেয়? ধনবান দু-দশজন যাত্রীকে কটকেই পাকড়াও করেছে পুরীর পাণ্ডা বা তার ছড়িদার। নাম-গোত্র জেনে নিয়ে তারা খেড়ো-খাতা ঘেঁটে বার করেছে কে কার যজমান। নগেন্দ্র দত্তের পাণ্ডাজীর পুত্র স্বয়ং তাঁকে গ্রেপ্তার করেছেন কটকের জাহাজঘাটায় : স্বনামধন্য পাণ্ডাজী : “জনার্দন মহাপাত্র ‘তিনিপুত্র’ মনমোহন মহাপাত্র”। মহাপাত্রজীর লাল খেরো খাতায় নগেন্দ্রনাথের পিতৃপুরুষের পরিচয় উদ্ধার করা গেছে।

কটক থেকে জগন্নাথক্ষেত্র যাবার পথে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত তীর্থ মন্দিরনগরী একাম্রকানন। একাত্র-পুরাণের পঞ্চবিংশতি থেকে দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদে একটি দেব-দানবের যুদ্ধের বর্ণনা করা হয়েছে। পুরাণকার বলছেন, গঙ্গাবতী নদীর তীরে এক আম্রকাননে দেবতারা শিবপূজার নিমিত্ত যজ্ঞ আরম্ভ করামাত্র দৈত্যরাজ হিরণ্যাক্ষ সসৈন্যে এসে যজ্ঞনাশ করে। দেবরাজ ইন্দ্র পরাভূত হয়ে পলায়ন করেন এবং মহাদেবের শরণ নেন। অতঃপর দেবাদিদেব ত্রিশূলহস্তে স্বয়ং রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন, হিরণ্যাক্ষকে সসৈন্য পরাজিত করেন–দৈত্য- সেনাপতি কালনেমী নিহত হয় এবং হিরণ্যাক্ষের সৈন্য সন্নিকটকস্থ সারি সারি পর্বতগুহায় আশ্রয় নেয়।

এ নিছকই গল্পকথা। কিন্তু কয়েকটি বিশেষ শব্দের দিকে আমাদের নজর পড়ে। প্রথমত, ‘গঙ্গাবতী নদী’; এই শৈবমন্দির নগরীর পাশ দিয়ে যে নদীটি আজও প্রবহমান, তার নাম গঙ্গাবতী বা গাঙ্গোয়া। দ্বিতীয়ত, সারি সারি পার্বত্যগুহার উল্লেখ। মন্দিরনগরী ত্রিভুবনেশ্বরের অনতিদূরে পাশাপাশি দুটি পর্বতে অগণিত বৌদ্ধ ও জৈনগুহা—উদয়গিরি ও খণ্ডগিরি। আর নিকটেই আছে দুটি গ্রাম। তাদের নাম ‘যগমারা’ ও ‘যগসারা’। বলা হয়, প্রথমটিতে হিরণ্যাক্ষ দেবতাদের পরাভূত করে যজ্ঞনাশ করে এবং দ্বিতীয় গ্রামের কাছাকাছি মাঠে মহাদেব দৈত্যদলকে পরাভূত করেন এবং দেবতারা শিবপূজা সম্পন্ন করেন।

ওই একাম্র-পুরাণের ত্রয়োদশ অধ্যায়েই শিব ও ব্রহ্মার একটি কথোপকথন লক্ষ্য করার মতো। পিতামহ ব্রহ্মা মহাদেবকে বলছেন যে, মর্ত্যে যেখানে দেবাদিদেব কালনেমীকে বধ করেছিলেন, সেই পুণ্যতীর্থে ব্রহ্মা স্বয়ং একটি শৈবমন্দির নির্মাণে ইচ্ছুক। প্রত্যুত্তরে মহাদেব বলছেন, হে পিতামহ বিভূতেশ্বর, এই সামান্য কাজ আপনাকে শোভা পায় না। কলিযুগের একপাদ অতিক্রান্ত হলে আমার মস্তকস্থিত ‘শশাঙ্ক’ ভূতলে অবতীর্ণ হবেন একটি সাম্রাজ্য স্থাপন করবেন এবং ওই একাম্রকাননের সন্নিকটে ত্রিভুবনেশ্বরে আমার জন্য একটি অক্ষয় মন্দির নির্মাণ করবেন।

অনুমান করার যথেষ্ট হেতু আছে, ভুবনেশ্বরের মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন গৌড়রাজ শশাঙ্কই। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম পাদে ভারতবর্ষে একই সঙ্গে আবির্ভূত হয়েছিলেন কয়েকজন ক্ষমতাশালী নৃপতি—কান্যকুব্জের হর্ষবর্ধন, প্রাগজ্যোতিষপুরের ভাস্করবর্মা, চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশী এবং গৌড়রাজ শশাঙ্ক। পরাক্রমশালী নৃপতির মধ্যে একমাত্র শশাঙ্কের প্রতিই ইতিহাস সুবিচার করেনি। তার একটি বিশেষ হেতু আছে। এ-যুগের ইতিহাসের মূল দুটি উপাদান। একটি বাণভট্টের হর্ষচরিত, অপরটি এক বিদেশীর দিনপঞ্জিকা : চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙ। যেহেতু শশাঙ্ক শৈব—বৌদ্ধদের, তথা হর্ষের, বিপক্ষ শিবিরে, তাই তাঁকে প্রায় নর-রাক্ষসের আকৃতিতে চিত্রিত করা হয়েছে।

কিন্তু শশাঙ্ক সম্বন্ধে হিন্দু পুরাণশাস্ত্র ভিন্ন কথা বলে। একাম্র-পুরাণ মতে, সম্রাট শশাঙ্ক কলিঙ্গ বিজয় করে ত্রিভুবনেশ্বরে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন—তিনিই কলিঙ্গে শিবপূজার প্রথম ভগীরথ। স্বর্ণাদ্রিমহোদয়, একাম্ৰ-চন্দ্রিকা এবং কপিলসংহিতায় স্পষ্টাক্ষরে বলা হয়েছে যে, ত্রিভুবনেশ্বরে লিঙ্গরাজের মূর্তির ওপর একটি অপূর্ব মন্দির গঠন করাই হচ্ছে কলিঙ্গে সম্রাট শশাঙ্কের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। বলাবাহুল্য, শশাঙ্ক কোনও শিবলিঙ্গ বা শিবের মূর্তি নির্মাণ করেননি। একটি স্বয়ম্ভূ-শিলাকেই শিবের প্রতীকরূপে কল্পনা করা হয়েছে। এভাবে অনাদিকালের ভূগর্ভ-ভেদ-করা প্রস্তরখণ্ডকে বহু মন্দিরেই শিবের প্রতীকরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন কাশীর কেদারেশ্বরে এবং হিমালয়ের কেদারতীর্থেও। হাতের কাছে আমাদের তারকেশ্বরও একটি উদাহরণ। আমরা বর্তমানে ভুবনেশ্বরে যে বিশাল মন্দিরটি দেখি, সেটি শশাঙ্ক-নির্মিত দেউল নয়। শশাঙ্ক-নির্মিত দেবদেউল মহাকালের স্থুল হস্তাবলেপনে ভূতলশায়ী হয়ছিল। পরবর্তী রাজন্যবর্গ একই স্থলে বৃহত্তর মন্দিরটি নির্মাণ করান। কিন্তু শশাঙ্ক-প্রতিষ্ঠিত বিন্দু সরোবরটি আজও বর্তমান, যদিও পরবর্তী উৎকলরাজগণের অর্থানুকূল্যে তার আকার ও আয়তন সমূহ বৃদ্ধিলাভ করেছে।

শ্রোতৃবর্গের প্রথম সারিতে বসেছিলেন বৃদ্ধা বামুনদিদি। তিনি রূপেন্দ্রনাথকে বাধা দিয়ে ‘বলে ওঠেন, আজ তোমার বক্তিমে বড় রসকষহীন হয়ে যাচ্ছে কথকঠাকুর। দেবতাদের

মহিমার গল্পের ঝুলি কি তোমার ফুইরে গেল নাকি গো?

কথা হচ্ছিল মন্দির-চাতালেই।

রূপেন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন, না দিদা, ভুবনেশ্বরের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে কোনও গল্প আমার জানা নেই। তবে কাল সন্ধ্যাবেলা আপনাদের সেরকম একটা জমাট গপ্পো শোনাব– সাক্ষীগোপালে। তবে ঠাকুরদেবতার গল্প শুনতে চাইলেন যখন, তখন একটা প্রশ্ন করি। ঐ বিরাট কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তিটি লক্ষ্য করে দেখুন। কোনও অসঙ্গতি নজরে পড়ছে?

সকলেই চোখ তুলে দেখল। সিংহপৃষ্ঠ সমারূঢ়া এক পার্বতীমূর্তি। চতুর্হস্তা; কিন্তু চারটি হাতই ভেঙে গেছে। মাথায় প্রকাণ্ড মুকুট। মায়ের বামদিকে একটি প্রস্ফুটিত পদ্ম। পদতলেও তাই।

সকলেই লক্ষ্য করতে থাকে। নগেন দত্ত বলেন, এটি কি লক্ষ্মীমূর্তি?

রূপেন্দ্র বলেন, না। এটি পার্বতী। এঁর নাম ‘নিশা-পার্বতী’। এবার বলুন, কিছু অসঙ্গতি আপনাদের নজরে পড়েছে?

একজন প্রৌঢ়া বললেন; মায়ের বাঁ পায়ে একটা গয়না আছে, ডানপায়ে নেই। এমনটা তো হয় না। মায়ের ‘সাজ ঠিক হয়নি বাপু!

রূপেন্দ্রনাথ অত্যন্ত খুশি হয়ে বলেন, দারুণ নজর করেছেন, মা! ঐটিই এ মূর্তির অসঙ্গতি। আর ঐ এক পায়ের মল দেখেই সনাক্ত করা যায় যে, এটি সাধারণ পার্বতী মূর্তি নয় : ইনি নিশা-পার্বতী!

—নিশা-পার্বতী! এ নাম তো শুনিনি?

—শুনুন তাহলে। দিদা গপ্পো শুনতে চেয়েছিলেন; তাই এ প্রসঙ্গ তুলেছি। একবার মহাদেব নাকি ধ্যানে বসেন। অতি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পরেও তাঁর ধ্যানভঙ্গ হয় না। তখন দেবকুল সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। অথচ শিবের ধ্যান ভঙ্গ করার হিম্মৎ কারও নেই। অনঙ্গদেবের ভস্ম হয়ে যাবার পরের ঘটনা এটি। তাই ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভা কোন নৃত্যপটিয়সীই ও দুঃসাহস দেখাতে রাজি হয় না। তখন পার্বতী স্বয়ং সে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। অন্যান্য দেবতাদের বললেন দৃষ্টিপথের বাহিরে চলে যেতে। অরণ্য নির্জন হলে গভীর পূর্ণিমারাত্রে তিনি ধ্যানস্থ মহাদেবের সম্মুখে নৃত্যারম্ভ করেন। পার্বতী নাচছেন! শিবের ধ্যান ভাঙে! চোখ চেয়েই নৃত্যরতা পার্বতীকে দেখে মহাদেব খুশিয়াল হয়ে ওঠেন! তৃতীয় নয়নের অগ্নি নয়, অপর দুটি নয়নেই ফুটে ওঠে প্রেমের প্রতিচ্ছবি! নিশাকালে নৃত্যরতা এই মূর্তির নাম : নিশা-পার্বতী! ভাস্কর্যে এর উদাহরণ খুবই সুদুর্লভ। শিল্পী প্রচলিত অলঙ্কার শাস্ত্রকে (উভয় অর্থেই) অস্বীকার করে মায়ের একটি পায়ে একটি মাত্র নূপুর পরিয়েছেন। বোঝাতে– হে দর্শক! ভ্রমাত্মক সিদ্ধান্ত নিও না! নৃত্যরতা হওয়া সত্ত্বেও ইনি নর্তকী নন–ভবভাবিনী, ভবতারিণী!

আসর ভেঙে গেল। বুড়ি গিয়ে নিশা-পার্বতী মূর্তির চরণস্পর্শ করে প্রণাম করলেন। বললেন, আমাদের কথকঠাকুরটি সব জানেন!

সন্ধ্যারতি শেষ হয়ে গেছে। এখন যাত্রীরা মন্দিরপ্রাঙ্গণ ফাঁকা করে দেবে, মন্দিরের দ্বারপালেরা লগুড়হস্তে ঘুরে ঘুরে মন্দিরের বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্রামরত যাত্রী-যাত্রিণীদের সবিনয়ে মন্দির খালি করে দেবার অনুরোধ জানাচ্ছে : সিং-দরজা বন্ধ হই যিবে, সে-পাকে চল।

রূপেন্দ্রের নজর হয়েছিল আজ শ্রোতৃবৃন্দের ভিতর দুর্গা গাঙ্গুলীকে আদৌ দেখতে পাওয়া যায়নি। তাঁর সহধর্মিণী, বলাবাহুল্য, না-পাত্তা। দলে দলে সকলে নির্গমনদ্বারের দিকে চলেছে। নগেন দত্ত রূপেন্দ্রর বাহুমূল ধরে একটু জনান্তিকে সরে আসেন। ওঁর কর্ণমূলে বলেন, আমাদের পাণ্ডাজী জানালেন, আজ শুক্লা দশমী—রাত্রের দ্বিতীয় প্রহরে নাটমন্দিরে রুদ্রাণীর নৃত্য পরিবেশিত হবে। আমি আসব; আপনি কি দেখতে চান?

রূপেন্দ্র বলেন, রুদ্রাণী কে?

—এ-মন্দিরের দেবদাসীদের প্রাধানা—‘অলঙ্কারা’। শৈবমন্দিরে প্রধানা দেবদাসীকে বলা হয় ‘রুদ্রগণিকা’, সম্বোধনে : রুদ্রাণি! বৈষ্ণব মন্দিরে যেমন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে, প্রধানা অলঙ্কারার নাম : ‘গোপিকা’!

রূপেন্দ্র হেসে বলেন, আপনি তো ও বিষয়ে অনেক খবর রাখেন দেখছি!

নগেন্দ্র বলেন, আপনিও তো তীর্থমাহাত্ম্য আর মন্দিরতত্ত্ব নিয়ে…

বাধা দিয়ে রূপেন্দ্র বলেন, বুঝেছি! যাদৃশী ভাবনাৰ্যস্য…

—তার মানে?

—তার মানে ‘রুদ্রাণী’-নৃত্য দেখবার বাসনা আমার নাই। আপনি বরং একাই আসবেন…কিংবা…:

—কিংবা?

রূপেন্দ্র আন্দাজে একটি শব্দভেদী বাণ ছাড়লেন, দুর্গা গাঙ্গুলীমশাইকে নিয়ে। তিনি এ-বিষয়ে আগ্রহী। ভাল কথা, আজ কদিন তাঁকে দেখছি না তো?’

শব্দভেদী বাণটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। নগেন্দ্র বললেন, কী জানি কোথায় গেছে! আর থাকলেও সেই বুড়োটাকে এই দেবদাসী-নৃত্যের আসরে আমি নিয়ে আসতাম না।

ওঁরা পায়ে পায়ে মন্দিরের বাহিরে চলে আসেন। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের বাহিরে নগেন্দ্রের চৌদোলা প্রতীক্ষায় ছিল। একজন ওঁর শুঁড়তোলা নাগরা চটিজোড়া হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। নগেন্দ্র পাণ্ডাজীর বিশেষ অতিথি। রূপেন্দ্র তাঁর আতিথ্য স্বীকার করতে রাজি হননি। তিনি জনতা দলের সঙ্গে রাত্রিবাস করেন সাধারণ যাত্রিশালায়।

যাত্রিশালায় এক-এক কোণে এক-এক দল। ক্লান্ত পদযাত্রীরা পাশাপাশি কাঁথা বিছিয়েছে। ঝোপে-ঝাড়ে জোনাক জ্বলছে। সন্ধ্যা থেকেই নির্মেঘ আকাশে চাঁদের আলো। রূপেন্দ্রনাথ ধ্যানে বসেছিলেন। বামুনদিদি ইতিমধ্যে দু-দুবার ঘুরে গেছেন। তৃতীয়বার এসে দেখেন রূপেন্দ্র শয়নের আয়োজন করছেন। বামুনদিদি এগিয়ে এসে বললেন : ও কী গো! শুয়ে পড়লে যে ঠাকুর! রাতের সেবা করলে না?

রূপেন্দ্র হেসে বললেন, পরমবৈষ্ণব বৃন্দাবন দাস ঠাকুর তাঁর চৈতন্যভাগবতে কী লিখেছেন জানেন না? “প্রভু যারে যেদিন বা না লিখেন আহার/রাজপুত্র হউ তভো উপবাস তার!!”

—ঠিকই তো নিখেচেন বেন্দাবন দাস ঠাকুর। কিন্তু তুমি কেমন করে জানলে যে, প্রভু তোমার ললাটে আজ উপুস নিখে রেখেচেন? ওঠ দিকিন, এই মালপোটুক সেবা কর। তোমার নাম করি দোকান থেকে নে এয়েচি।

রূপেন্দ্র উঠে বসলেন। বামুনদিদির করঙ্গে জল ছিল। তাতে হাত ধুয়ে শালপাতার ঠোঙায়-আনা মালপোয়াটুক মুখে দিলেন। বললেন, দিদার সব দিকে নজর!

—থাকবেনি? কথকঠাকুর নিত্যিদিন সাঁঝের বেলায় ঠাকুর-দ্যাবতার কতা শোনায়– পাব্বনি নেয় না–এটুকুও নজর রাখতে হবেনি? তবে আজ দাদাভাই, আমি এয়েচি একটা সমিস্যে নিয়ে। তোমারে একটা উগ্গার করতে হবে, দাদা।

—বলুন? কী করতে হবে?

—শুনেচ তো, কাল আমাদের যাত্রানাস্তি। এখানেই সবাই ঠাকুর-ঠুকুর দেখে বেড়াবে– অনন্তবাসুদেব মন্দির, মহিষমর্দিনী মূর্তি, বিন্দু সরোবরে ছান করবে। আসলে কী জান, দাদা? আমাদের দলে বিশ-পঁচিশটা আবাগী—মানে, বেধবা! কাল একাদশী তো? নিরুস্ব উপুস! তাই একটা দিন সবাইকে রুখে দেওয়া। এই আর কী! নাইলে আবাগীগুলো পারবে কেনে?

এ-তথ্যটা জানা ছিল না। মনে মনে খুশিই হলেন রূপেন্দ্র। এখানে কয়েকটি মন্দিরের কারুকার্যের সুখ্যাতি শুনেছেন–মুক্তেশ্বর, ব্রহ্মেশ্বর, রাজারানী মন্দির–অদুরে আছে ধৌলীপর্বতের পাদদেশে সম্রাট অশোকের শিলালেখ, আর উদয়গিরি-খণ্ডগিরিতে জৈন গুহামন্দির। যাত্রীদল এসব বিষয়ে আদৌ আগ্রহী নয়। কিন্তু জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের শিষ্যটি এসব স্বচক্ষে দেখে নিতে চান। খোদাই করা ব্রাহ্মী লিপ্যক্ষর ইতিপূর্বে কখনো দেখেননি রূপেন্দ্র।

মিষ্টান্ন আহারান্তে হাত ধুয়ে জানতে চান, এবার বলুন দিদা, কী আপনার ‘সমিস্যে’ আর আমাকে কী ‘উগ্গার’ করতে হবে?

–আজকাল আর সারা রাত উপুস করতে পারি না। সাড়ে তিন-কুড়ি পাড়ি দিয়েছি তো! তাই সুয্যি ডুবলে ইষ্টদেবকে জল-টল দে’ এক বামুনরে সেবা করি। তাঁর অনুমতি নিয়ে বাতাসাটুক মুখে দে’ জল খাই! তা দাদা, তুমি কাল আমার সেবা নিয়ে আমারে অনুমতি দেবা?

—এ আর শক্ত কথা কী? সুয্যি ডোবার আগেই আপনাকে অনুমতি দিতে পারি–তার আগেই যদি আমার পেট ভরে যায়।

বৃদ্ধা হেসে বললেন, না, না, অতটা উগ্গার করতে হবেনি!

হঠাৎ কী মনে হয়। রূপেন্দ্র বৃদ্ধার কাছে ঘনিয়ে এসে বলেন, এবার আপনি আমার একটা উগ্গার করবেন, ঠাম্মা? কথাটা কিন্তু খুব গোপন! এটা আবার আমার এক গোপন ‘সমিস্যে’!

বৃদ্ধা গম্ভীর হলেন। রসিকতায় যোগ দিলেন না। বললেন, বল্?

—কথাটা পাঁচকান হবে না তো?

–রাসুবামনি তেমন কানপাতলা নয়, বলদিনি কী তোর সমিস্যে?

রূপেন্দ্র নামোল্লেখ না করে বুঝিয়ে বলেন যে, যাত্রীদলের ব্যক্তিবিশেষের–সে পুরুষ কি স্ত্রী, তাও বলেন না–একটা প্রচণ্ড বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। জীবন-মৃত্যুর ‘সমিস্যে’! কিন্তু বিশেষ প্রতিবন্ধকতায় তিনি ওই ব্যক্তিবিশেষকে তার বিপদের কথাটা জানাতে পারছেন না।

—কেনে? তারে আর দেখতে পাচ্ছিস না বলে?

—হ্যাঁ, এ-ক’দিন তাকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু দেখা পেলেও গোপন কথাটা তাকে বলবার সুযোগ পাব না!

বৃদ্ধা দম ধরে অনেকক্ষণ কী ভাবলেন! তারপর বললেন, বিপদটা কী জাতের?

—তাও আমি তোমাকে বলতে পারব না, ঠাম্মা! আমি সত্যবদ্ধ! কথাটা পাঁচকান করব না। কথা দিয়ে রেখেছি!

—বেশ তো! পাঁচকান না করিস, দু-কান করতি তো বাধা নেই?

—’দু-কান করা’ মানে?

—যার বিপদ, তারে কানে কানে বলা!

রূপেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলেন, আঃ! তোমাকে কেমন করে বোঝাই? তাকে কানে কানে বলার সুযোগ যে আমি পাচ্ছি না, পাব না।

—সে সমিস্যের মওড়া আমি নেবনে। আমি তোরে সুযোগ পাইয়ে দোব! তুই আমারে কিছু না বলে, তারই কানে-কানে তার বিপদের কতাটা বলে দিস্! বুঝলি?

রূপেন্দ্র কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে বলেন, আমি কার কথা বলছি বল তো, ঠাম্মা?

—ওমা আমি কোতায় যাব! তোর ওই পাড়াতুতো ছুট বুনটা তো? তোর সাথে বে-র সম্বন্ধ হবার আগেই যারে ওই ঘাটের মড়া ছোঁ-মারি তৃতীয় পক্ষ করি ফেলিছেল! তাই তো? নাকি চতুখ?

রূপেন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বৃদ্ধার কথায়। বলেন, তুমি কেমন করে আন্দাজ করলে, ঠাম্মা?

—এ তো জন্মান্ধও একন বুঝে ফেলবে রে! আমার তো শুধু বাঁ-চোখটায় ছানি। তা সে আবাগীর বিপদটা কিসের?…ও, না, না, সে তো তুই আমারে ববি না। পাঁচকান হই যাবে! তা বেশ, তারেই বলিস। কানে-কানে। সাক্ষীগোপালে কিংবা জগন্নাথধামে।

রূপেন্দ্র জানতে চান, কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?

বৃদ্ধার চটজলদি জবাব : ফুস্-মন্তরে! সে তোরে ভাবতে হবেনি। কায়দাটা তারে শিখায়ে দেবনে। ও বলবে ওর পেটে শূলব্যথা উটেচে! আমরা পাঁচজনে তড়িঘড়ি তোরে ডাকি পাঠাব। জানিস তো–কোবরেজে যখন সোমত্ত বউরে পরীক্ষে করে, তখন সোয়ামিরে সেখানে ঢেঁড়িয়ে থাকতি নেই। আমি পাহারা দেব নে—বুড়োডারে তাইড়ে। তাইক্যে থাকব। কতায় বলে : পরইস্তিরি! নইলে ধম্মে সইবে না। তবে আমি দু’কান বন্ধ করি থাকব অনে। কতাটা চারকান হতি দোব না।

রূপেন্দ্র বলেন, তোমার তো দারুণ বুদ্ধি, ঠাম্মা! কেমন করে ফন্দিটা মাথায় এল?

বৃদ্ধা বললেন, ওমা আমি কোতায় যাব! জানিস না রাসুবামনির ভারি বুদ্ধি! এই দ্যাখ না—বুড়োকত্তা বিশ বিঘে ব্রহ্মোত্তর লাখেরাজ আর বাস্তুভিটে রাখি গেল! মাত্তর বিশটি বছরে সব উইড়ে-পুইড়ে দে’ আমি তুলসীর মালা নে’ পতে নেমেছি! কেউ ঠেকাতি পারল?

রূপেন্দ্র বিস্মিত হয়ে বলেন, তার মানে? দাদুর সম্পত্তি কোথায় গেল?

—ভকিল-মোক্তারের গব্বরে। আমার তিন-তিনটি জোয়ান বেটা আর তাদের তিন- দুকনে ছয়টা জাঁহাবাজ বউ! মহা ধূমধাম করি কাজীর কাছে হকিয়ত করছে আজও। আমার কী? আমি দেখতে পাচ্ছি? দিব্যি শান্তিতে আচি! পতে-পতে জয় গৌর, জয় নিতেই গেয়ে বেড়াচ্ছি! বিষয়-বিষে আমারে কেউ বিষিয়ে দিতি পেরেচে?

আশ্চর্য মানুষ তো!

জগন্নাথধামে পৌঁছে যাত্রাদল গোটা শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। কটক বন্দর থেকে কবে জাহাজ ছাড়বে তা সকলেরই জানা। নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে পৌঁছাতে পারলেই হল। নগেন দত্ত এবার আর ছাড়েননি। রূপেন্দ্রও আপত্তি করেননি। কারণ এবার পাণ্ডাজী যে যাত্রীনিবাসে ওঁদের থাকতে দিয়েছে, সেটি একেবারে সমুদ্রতটের উপরে। স্বর্গদ্বারের কাছাকাছি। ছাদে বসে নীলাম্বুরাশির অবিরাম উচ্ছ্বাস প্রত্যক্ষ করা যায়।

সেখানেই গাঙ্গুলীখুড়োকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এল ওঁর পাণ্ডাজীর ছড়িদার। ওঁরা আশ্রয় নিয়েছেন মন্দিরের কাছাকাছি একটি যাত্রীনিবাসে। গাঙ্গুলী রোগিণীর উপসর্গের বর্ণনা কে বললেন, এ কী আতান্তরিতে পড়লাম বল তো, বাবা! তুমি একবার চল, গিয়ে দেখবে

রূপেন্দ্র এই জাতীয় উপসর্গের আশঙ্কাই করছিলেন। কিন্তু অসুখের আক্রমণটা নিতান্ত ঘটনাচক্রে কাকতালীয়ভাবে সত্য হতে পারে! এজন্য ঔষধের পুঁটলিটাও সঙ্গে নিলেন। নগেন দত্ত জিজ্ঞাসা করেন, দোকান থেকে অখাদ্য-কুখাদ্য কিছু খেয়েছিল কি?

‘গাঙ্গুলী বিহ্বলভাবে জবাবে বলেন, ও যা খেয়েছে, আম্মো তাই খেইচি। অখাদ্য-কুখাদ্য কিছু হলে দু’জনারই তো হবার কতা!

—তা বটে।

রূপেন্দ্র বলেন, চলুন তাহলে— আর দেরি করব না। রোগিণীর কাছে পাহারায় আছে কে? জল-টল খেতে চাইলে—

–আছে বাবা, আছে, আমাদের দলেরই কয়েকজন।

কোবরেজমশাই আসামাত্র মহড়া নিতে এগিয়ে এলেন রাসুদিদি। বলেন, তুমি ভালো করি দেখ তো দাদাভাই–এ-আবাগীর পেটে কী ঢুকিচে! বমি হয় না, দাস্ত হয় না–অতচ তলপেটে শূলবেদনা!

রূপেন্দ্র দীর্ঘসময় রোগিণীর নাড়ির গতি লক্ষ্য করলেন। জিব দেখলেন, চোখের পাতা টেনে-টেনে দেখলেন। তারপর ঝোলা থেকে বার করলেন একটা বিচিত্র যন্ত্র। সেটা দেখেই এত যন্ত্রণার মধ্যেও রোগিণী ফিক্ করে হেসে ফেলল। মুখের ওপর আঁচলটা চাপা দিল।

রূপেন্দ্র দুর্গা গাঙ্গুলীর দিকে ফিরে বললেন, বুকটা একবার দেখবো? আপত্তি নেই তো?

দুর্গাখুড়ো মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন।

রাসুবামনি অবাক বিস্ময়ে বলে ওঠেন, ওমা আমি কোতায় যাব! জিব দেখলে, চোখ দেখলে, নাড়ি দেখলে তাও তোমার আশ মিটলনি? সোমত্ত মেয়ের বুক দেখবে কি গো!

দুর্গা বলে, ও কিছ নয়, দিদি। কোবরেজ এমন দেখে থাকে। দেখ।

রূপেন্দ্র বললেন, আপনারা সবাই ঘরের বাইরে যান। না, বামুনদি, আপনি শুধু থাকবেন।

দুর্গা গাঙ্গুলী নিজেই উৎসাহী হয়ে বাকি দর্শকদের ঘর থেকে বার করে দিলেন। বুক দেখার এ-যন্ত্রটা তাঁর পরিচিত। ওই যন্ত্রটা নিয়েই বছর দুয়েক আগে একটা ভুল বোঝাবুঝিতে রূপেন্দ্রর সঙ্গে ওঁর মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। সেবার মৃন্ময়ীও ওঁকে ভুল বুঝেছিল।

যে-কালের কথা, তখনও ‘স্টেথোস্কোপ’ যন্ত্রটা আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু তার একটি আদিম রূপের ব্যবহার ছিল আরব-পারস্যে। মুঘল যুগে হাকিম-উল-মুলুকদের মাধ্যমে সেই বিচিত্ৰ যন্ত্রটা পৌঁছেছে হিন্দুস্থানেও। দু-মুখো ক্ল্যারিওনেট জাতীয় একটা যন্ত্র। তার দু’প্রান্তে দুটি ভেকচর্ম। একপ্রান্ত রোগীর বক্ষস্থলে স্থাপন করলে অপরপ্রান্তে চিকিৎসকের কর্ণমূলে হৃদস্পন্দনের শব্দ শোনা যায়। চিকিৎসক তাতে অনুমান করতে পারেন হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা। রূপেন্দ্রনাথের পুলিন্দায় তেমনি একটা যন্ত্র বরাবর থাকে। প্রথমবার—মৃন্ময়ী তখন সদ্যবিবাহিতা—দুর্গা গাঙ্গুলীর বাড়িতে তিনি যখন বলেছিলেন, ‘এবার বুকটা একবার দেখবো’, তখন বজ্রাহত হয়ে গিয়েছিল মৃন্ময়ী। সেবারও গৃহস্বামীকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে একান্তে রোগিণীকে পরীক্ষা করছিলেন এবং সেবারও ওঁর নিয়মানুসারে কক্ষে উপস্থিত ছিল শোভারানী—মীনুর বড় সতীনের মেয়ে, অনূঢ়া হলেও বয়সে সে মীনুর বড়।

শোভারানী ইতিপূর্বে ‘কবিরাজ’ জীবটিকে কখনও দেখেনি। চিকিৎসা-পদ্ধতি কী-জাতীয় হয়, তার ধারণা ছিল না। কবিরাজ জিব দেখলেন, নাড়ি দেখলেন, এবার বুক দেখতে চাইছেন…

নিজ বুদ্ধি-বিবেচনা মতো সে বলে উঠেছিল, এটাই নিয়ম, ছোটমা! আমি পিছন থেকে কাঁচুলির বাঁধন খুলে দিচ্ছি। লজ্জা করবেন না। উনি এবার আপনার বুক দুটো দেখবেন।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন রূপেন্দ্রনাথ। কী সর্বনাশ! ওঁর উচ্চারিত ‘বুক’ শব্দটা সহসা দ্বিবচনে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ায় মুহূর্তমধ্যে বুঝে ফেললেন—ওদের কী মর্মান্তিক ভ্রান্তি হয়েছে! কিন্তু তিনি কিছু প্রতিবাদ করার পূর্বেই গৃহদ্বার উন্মোচিত হয়ে গেল। বোঝা গেল, গৃহস্বামী দৃষ্টিসীমারই বাহিরে ছিলেন, শ্রুতিসীমার নয়। ঘরের ভিতরে এসে শোভারানীকে বললেন, তুই ভিতরে যা!

শোভারানী তার বিমাতার পৃষ্ঠদেশে কঞ্চলিকার ফাঁসটা সবেমাত্র টেনে খুলেছে। বক্ষাবরণ অপসারিত করেননি তখনও। নিদারুণ আতঙ্কে, লজ্জায় আরক্তিম-আননে মৃন্ময়ী যেন বাধা দিতেও ভুলে গেছে।

বৃদ্ধ দৃঢ়স্বরে বলে উঠেছিলেন, তোমার রুগী দেখা শেষ হয়ে গেছে, রূপেন্দ্র। এসো আমার সঙ্গে, এ-ঘরে এসো। ওর চিকিচ্ছে তোমারে করতে হবেনি!

সেদিন ওই ক্রুদ্ধ বৃদ্ধকে রূপেন্দ্রনাথ বোঝাতে পারেননি–তিনি কী বলতে চান। দীর্ঘদিন পরে দুর্গাচরণ নিজের ভুলটা বুঝতে পারেন, যখন সর্বসমক্ষে ওই রূপেন্দ্রনাথই জমিদারগিন্নিকে বলেছিলেন—ওই একই কথা : আপনার বুকটা একবার দেখব, জ্যাঠাইমা।

বৃদ্ধাও সর্বসমক্ষে অনায়াসে বলেছিলেন, দ্যাখ!

যন্ত্র দিয়ে বুক দেখা যে চর্মচক্ষে নয়, শ্রুতিপথে, তাতে অশ্লীলতা যে কিছু নেই–‘বুক’ যে হৃপিণ্ডকে বোঝাচ্ছে · এসব কথা সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন।

ঘর খালি হল।

রাসুদিদি সবাইকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দ্বার ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলেন। নিজে বসলেন ঘরের দূরতম প্রান্তে। ভূমিশয্যাতেই। হাতে ছিল জপের মালা। টপকাতে শুরু করলেন।

রূপেন্দ্র কিছু বলার আগেই মৃন্ময়ী শয্যা থেকে নেমে পড়ল। বললে, দাঁড়াও, সবার আগে প্রণামটা সেরে নিই। সেদিন…

রূপেন্দ্র বাধা দিলেন না। প্রণাম সেরে মীনু প্রথমেই জানতে চাইল, বৌঠান কোথায়, রুপোদা?

এই প্রথম একজন পরিচিত ব্যক্তি সেই হতভাগিনীটার কথা জানতে চেয়েছে। রূপেন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেল–এই মীনুই একদিন তাঁর কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিল কুসুমমঞ্জরীকে বাঁচাতে—বিবাহ করে বাঁচাতে! মৃন্ময়ী ততদিনে ওঁর খুড়িমা। রূপেন্দ্রনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তার সব জ্বালা এতদিনে জুড়িয়েছে রে, মীনু

মৃন্ময়ী স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে রইল একমুহূর্ত। তারপর বললে, আমিও তাই আশঙ্কা করেছি। তাতেই তোমার এই বাউণ্ডুলের মতো হাল

রূপেন্দ্র বাধা দিয়ে বললেন, আমার কথা থাক রে। আমি তোকে একটা খুব জরুরি কথা জানাতে এসেছি। তোর একটা বিপদের কথা। দারুণ বিপদ…

মৃন্ময়ী একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওঁকে থামিয়ে দেয়। নিম্নস্বরে বলে, জানি!

—জানিস! কিন্তু কতটুকু জানিস? তোকে কতটা বুঝতে দিয়েছে খুড়ো?

মৃন্ময়ীর ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল। কিন্তু শব্দ বের হল না কোনও।

রূপেন্দ্র ঝুঁকে পড়ে বলেন, তুই কি এটুকু বুঝতে পেরেছিস, মীনু যে, যজ্ঞ-টজ্ঞ সব ফক্কিকারি? আসলে তোকে একটা অন্ধকার ঘরে…

প্রচণ্ডভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়ায়। বলে, তুমি আমাকে কী ভাবো রুপোদা? কচি খুকি? বাঁচেনি–কিন্তু আমি তো একছেলের মা! তা তো মান?

—তার মানে তুই সব জানিস? সব জেনে-বুঝে…

ঝর-ঝর করে কেঁদে ফেলল মৃন্ময়ী! বসে পড়ল আবার।

মাঝপথেই থেমে গেলেন রূপেন্দ্র। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তাঁর। বললেন, তাও তো বটে! কী করতে পারিস্ তুই? এটাই তো এই অবক্ষয়ী সমাজের ব্যবস্থা!

মৃন্ময়ী কী একটা কথা বলতে গেল। পারল না। মুখের ভিতর আঁচলের অনেকটা ঢুকিয়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

তোমরাই বল! ও-কথা কি বলা যায়? কী বলবে? কী করে বলবে? বললে তো বলতে হতো–না, রুপোদা! আমি কিছুই করতে পারি না। কিন্তু তুমি পারতে! তুমি এখনো পার! অন্ধকার ঘরে একটা নারীমাংসলোলুপ নরপিশাচের হাত থেকে একমাত্র তুমিই আমাকে এখনো বাঁচাতে পার। তুমি পার না? তুমি রাজি না হবার পরেই না বুড়োটা আমাকে সব কথা খুলে বলেছে! জাহাজেই সেই বুড়োটা টলতে টলতে তোমার ঘরে গেছিল না? আমাকে উদ্ধার করার প্রস্তাব নিয়ে?

একথা হতভাগী কেমন করে বলবে? এ প্রত্যাখ্যান যে তার নারীত্বের চরম অপমান! বোধকরি সেই অচেনা নারীমাংসলোলুপটার নিষ্পেষণে ভূতলশায়ী হওয়ার চেয়ে বড় জাতের আঘাত!

দুজনেই চুপচাপ। মুখোমুখি। দূর থেকে বামুনদিদি লক্ষ্য করল। ওখান থেকেই চিৎকার করে প্রশ্ন করে, কী দেখচ বলদিনি? পেটটা কি ফুলেছে?

রূপেন্দ্র বসেছিলেন বিছানায়। মীনু ভূতলে। দুজনেই বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে দেখেন। বৃদ্ধা নিঃশব্দে নিজের ওষ্ঠাধরে তর্জনী স্পর্শ করে আবার জপে বসল।

রূপেন্দ্র বললেন, সবই যদি জান, তাহলে আমাকে ডেকে পাঠালে কেন?

মীনু তার ডাগর দুটি চোখ মেলে তাকালো তার রুপোদার দিকে। বললে, তোমার কাছে একটা জিনিস ভিক্ষা চাইব বলে। দেবে? কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন তোমাকে বিরক্ত করব না, আর কোনদিন তোমার কাছে কিছু চাইব না–

—অমন করে বলছিস কেন রে? বল্ না কী চাস? আমার ক্ষমতায় কুলালে যা চাস্ নিশ্চয় দেব!

‘কর্ণকুন্তীসংবাদ’ রচনার দুশো বছর আগেকার ঘটনা। না হলে এখানে হয়তো রূপেন্দ্রনাথ বলে বসতেন, ‘আপন পৌরুষ ছাড়া, ধর্ম ছাড়া, আর/যাহা আজ্ঞা কর দিব…’

মীনু বললে, না, রুপোদা, তা তোমার অদেয় নয়। এর আগেও তা তোমার কাছে চুপিচুপি একজন চেয়েছিল আর লুকিয়ে তা পেয়েওছিল!

কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে রূপেন্দ্র জানতে চান : কে সে?

—আন্দাজ করতে পারছ না? বৌঠান! মঞ্জরী, বৌঠান!

হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শূন্যে দৃষ্টিপাত করে গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, ভুলে যেও না মীনু, সে আমার ধর্মপত্নী ছিল!

প্রথমটা ও অবাক হয়ে যায়। বুঝে উঠতে পারে না, তার রুপোদার কথার মর্মার্থ। তারপর তিল তিল করে তা ওর বুদ্ধিতে ধরা দেয়। মৃন্ময়ীও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। দু- হাতে মুখ ঢেকে মাথা নাড়তে নাড়তে আর্তনাদ করতে থাকে : ছি! ছি! ছি! আর কত অপমান করবে আমাকে, রুপোদা? আমি অমৃত চাইনি! ভিখারির মতো পরপুরুষের প্রেমভিক্ষা করতেও আসিনি। আমি চেয়েছিলাম : বিষ! তীব্র কালকূট। কেন, বৌঠান তা চায়নি? বৌঠান তা পায়নি? তখন তো সে তোমার ধর্মপত্নী ছিল না?

রূপেন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেল অতীত কথা। কুমারী অবস্থায় কুসুমমঞ্জরী তার চিকিৎসকের কাছে একই জিনিস চেয়েছিল—তার ধর্মরক্ষার প্রয়োজনে। রূপেন্দ্রনাথ সেবার তাকে তা দিয়েছিলেন। কিন্তু সে বিষ কুসুমকে পান করতে হয়নি, তার আগেই রূপেন্দ্র তার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। সেসব কথা অন্যত্র বলেছি। তোমরা হয় তো জান, নয় তো জান না। থাক ওসব অবান্তর কথা

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল রূপেন্দ্রের। বললেন, তার মানে তুই ওই কুপ্রথায় স্বীকৃত হসনি?

—ও নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে রুপোদা! বল। দেবে! যা চাইলাম? মীনু তো তোমার কাছে আর কোনদিন কিছু চাইতে আসবে না! দেবে?

হঠাৎ মনস্থির করলেন। আত্মহত্যা মহাপাপ! রুগী প্রার্থনা করলেও শারীরিক যন্ত্রণা উপশমের জন্য ভেষগাচার্য তাকে বিষ দিতে পারেন না। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে স্পষ্ট নিষেধ আছে। কিন্তু রূপেন্দ্রনাথ তা মানেন না। নিজের বিবেকের বকযন্ত্রে সব শাস্ত্রবাক্য চোলাই করে নেন। তাই সিদ্ধান্তে এলেন : আত্মহত্যা যদি মহাপাপ তবে ধর্মরক্ষার্থে ভারতীয় নারীর জহরব্রত পালনেও শাশ্বত অধিকার। এ তো শারীরিক যন্ত্রণা নয়, এ যে বলাৎকারের যন্ত্রণা! বলতে গেলেন, তাই তোকে দিয়ে যাব রে, মীনু! নারীমাংসলোলুপ পিশাচটা অন্ধকারে তোর অঙ্গস্পর্শ করার আগেই তুই মুক্তি পাবি।

বলা হল না। তার আগেই রুদ্ধদ্বারে মীনুর আতঙ্কগ্রস্ত পরম গুরু করাঘাত করলেন : কী গো? তোমাদের হল?

বামুনদিদি দোর খুলে দিয়ে বললেন, এসো বাবা। হয়েছে। কোবরেজমশাই ওষুধ দিয়েছেন। ভয়ের কিছু নেই। এসো, দ্যাকো!

রূপেন্দ্রনাথ শুনেছিলেন জগন্নাথধামের অনতিদূরে, বস্তুত একদিন-পথ দূরত্বে, সমুদ্রতীরে একটি জীর্ণ সূর্যমন্দির আছে–এককালে তার নাম ছিল অর্কতীর্থ। এখন তা বিগ্রহহীন, পরিত্যক্ত। কিন্তু একজন আরবি-ফার্সি জানা মৌলবি ওঁকে জানিয়েছিলেন আকবর বাদশার সভাসদ মহাপণ্ডিত আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে ওই মন্দিরটির বিশালত্ব এবং গঠন-সৌকর্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। পুরী মন্দিরে রক্ষিত ‘মাদলাপঞ্জী ‘ অনুসারে জানা যায় খুর্দার রাজা নরসিংহদেব ওই মন্দির দর্শন করতে যান 1628 খৃষ্টাব্দে। সেসময় উড়িষ্যার সুবেদার ছিলেন বাখর খাঁ, যিনি দিল্লীশ্বর শাহজাহাঁর প্রতিনিধি হিসাবে উড়িষ্যাশাসন করতেন। মাদলাপঞ্জী মতে, খুর্দার রাজা কোণার্ক মন্দিরে সূর্যমূর্তির বিগ্রহটি দেখতে পাননি। কারণ, তার পূর্বেই যবন আক্রমণের ভয়ে ওই মূর্তিটি অপসারিত হয়েছিল। তবে খুর্দার রাজার পরিদর্শনকালে মূল মন্দিরটি অটুট ছিল, শুধু ধাতব ধ্বজাটি ছিল না। যবনেরা সেটা সোনার মনে করে সম্ভবত অপহরণ করেছিল।

যবন আক্রমণের সময়কালটা আকবরের শাসনকালে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষপাদে। গৌড়-বাঙলার আফগান নবাব সুলেমান করনানি অতর্কিতে উড়িষ্যা আক্রমণ করে। নবাবের সেনাপতি ধর্মান্ধ কালাপাহাড় এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে বারে বারে যে দুর্ভাগ্যকে ঘনিয়ে উঠতে দেখেছি প্রাক-স্বাধীনতা যুগে রাজনীতির ক্ষেত্রে, বর্তমানে ভোটের রণাঙ্গনে আজও যা দেখছি—উড়িষ্যার ক্ষেত্রে সেবারও তাই হল। ওই চরম দুঃসময়ে উড়িষ্যারাজ মুকুন্দদেবের অমাত্যরা সুযোগ বুঝে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। মুকুন্দদেবের একক ক্ষমতায় কালাপাহাড়কে প্রতিহত করা সম্ভবপর হল না। মুকুন্দদেব নিরুপায় হয়ে কোণার্ক তীর্থের বিগ্রহটি নিরাপদ স্থানে অপসারিত করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। সে যুদ্ধে বুকের রক্ত দিয়ে মুকুন্দদেব তাঁর বিশ্বাসঘাতক অমাত্যদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে গেলেন। আর কালাপাহাড়ের অপকীর্তি মহাকালের বুকে চিরস্থায়ী ক্ষতচিহ্ন হয়ে রইল উড়িষ্যার নানান দেবদেউলে। ওই মুকুন্দদেবই উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন রাজা।

খুর্দারাজের কোণার্কদর্শনের ঠিক দুশো বছর পরে পাচ্ছি ওই মন্দির সম্বন্ধে কালানুসারে পরবর্তী একটি বিবরণ—এ. স্টারলিঙ-এর। সেটি 1825 খৃষ্টাব্দের। তখন জগমোহনটি অটুট থাকলেও মূল রেখদেউলটি ছিল ভগ্নাবস্থায়। স্টারলিঙের বিবরণে দেখছি লেখা আছে : ‘রেখদেউলটি তখনও কোনক্রমে দাঁড়িয়ে ছিল। উচ্চতায় প্রায় একশ পঁচিশ ফুট। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন পালতোলা একটি জাহাজ।” জেমস ফার্গুসন মন্দিরটি দেখেন তার বারো বছর পরে, 1837 খৃষ্টাব্দে। তাঁর একটি স্কেচের অনুলিপি ছাপানো বইতে পাওয়া যায়।

আমাদের কাহিনী অনুসারে রূপেন্দ্রনাথ পুরীতে এসেছেন 1743 খৃষ্টাব্দে। অর্থাৎ খুর্দারাজার পরিদর্শনের পরবর্তীকালে এবং স্টার্লিং-এর প্রত্নতত্ত্বের গবেষণার পূর্ববর্তীকালে।। মূল মন্দিরটি তখনও অটুট, যদিও বিগ্রহ নেই। আমরা এখন জগমোহন ঘিরে পাদপীঠে যে কারুকার্য দেখি, চব্বিশটি প্রকাণ্ড অর্ধোৎকীর্ণ রথচক্র, তা তখন দেখা যেত না। খুর্দার রাজা বা স্টারলিঙ তা দেখেননি। সেসব সময়ে তা ছিল বালির গর্ভে ঢাকা। সেসময় ওখানে কোনও লোকালয় ছিল না আদৌ।

রূপেন্দ্রনাথের বাসনা ওই কোণার্ক-মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া। কিন্তু যাত্রীদলের ভিতর কেউই রাজি হল না। নিত্যপূজা হয় না, দেববিগ্রহ নেই, এমনকি জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই—সেখানে কে যাবে? কিন্তু ‘একবগ্গা-ঠাকুর’ অত সহজে নিবৃত্ত হবার মানুষ নন। সন্ধান নিয়ে জানলেন, সমস্ত রাত্রি সমুদ্রোপকূলের বালুকাবেলার পথ ধরে গো-গাড়ি চালালে পরদিন প্রভাতে কোণাকতীর্থে পৌঁছানো যায়। আহার্য-পানীয় এবং গোরুর খাদ্য সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। পরদিন সন্ধ্যাবেলায় রওনা হলে সারা রাত্রে ফিরে আসা যায়। দু-একজন গো-শকট মালিকের সন্ধান পাওয়া গেল যারা জীবনে দু-একবার এমন নাছোড়বান্দা যাত্রীকে ওই সূর্যমন্দির দেখিয়ে এনেছে। চোর-ডাকাতের উপদ্রব নেই—কারণ যাত্রীদের কাছে একদিনের খাদ্যপানীয় ছাড়া কিছু লুটের মাল থাকেই না। নগেন দত্তকেও রাজি করানো গেল না। তিনি সারাদিন পুরীধামের তীর্থ দেখে বেড়ান এবং সন্ধ্যায় দেবদাসীনৃত্য।

শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা হল। না, গো-শকট নয়, উনি যাবেন অশ্বারোহণে। একটি ভাল জাতের আরবীয় অশ্বের ব্যবস্থা করে দিলেন পাণ্ডাজী, আর ওই সঙ্গে নটুঙ্গীদলের কাছ থেকে ভাড়া করে আনলেন একটা বিচিত্র পোশাক। বললেন, আপনি এই পোশাক পরে যান ঠাকুরমশাই–দূর থেকে মনে হবে উড়িষ্যারাজের কোনও সৈন্যাধ্যক্ষ। চোর-ডাকাত ত্রিসীমানায় ভিড়বে না। আর নিরস্ত্র যাবেন না। এটা নিন।

মাজায় বেঁধে দিলেন একটা তরবারি।

স্থির হল পরদিন প্রত্যুষে উনি যাত্রা করবেন। একলাই। সঙ্গে থাকবে একদিনের মতো আহার্য-পানীয়। সন্ধ্যায় প্রত্যাবর্তন করবেন।

কিন্তু এ পরিকল্পনাও বাতিল করতে হল শেষ পর্যন্ত। বাধা দিলেন দুর্গাখুড়ো স্বয়ং, তুমি যদি আপত্তি না কর, বাবা, তাইলে আমরাও তোমার সঙ্গে যেতে চাই। গো-গাড়িতে। আমরা দুজন।

সবাই বিস্মিত হল। একবগ্গা না হয় আধাপাগল, কিন্তু দুর্গা গাঙ্গুলী কেন কোণার্ক যেতে চাইছেন? সেখানে না আছে পূজা-পাঠনের ব্যবস্থা, না কোন ঠাকুর-দেবতা। গাঙ্গুলীমশায়ের যুক্তি অন্যরকম : মন্দির ভেঙে গেলেই কি দেবতার মহিমা ক্ষুণ্ন হয়? ওঁর পাণ্ডাজী বলেছেন ওই অর্কতীর্থে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব নাকি রোগমুক্ত হয়েছিলেন। চন্দ্রভাগা নদী যেখানে সমুদ্রে বিলীন হয়েছে, সেই কুম্ভরাশির মধ্যবর্তী অগ্নিকোণ দ্বাপরযুগে ছিল মহাতীর্থ। স্বয়ং শাম্ব ওই কোণার্ক মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। বিগ্রহ আছে কি নেই, এটা বড় কথা নয়। ওঁর মনোগত বাসনা সেই চক্রতীর্থে সস্ত্রীক তিনটে ডুব দেওয়া। কোন যাত্রী যেতে রাজি হচ্ছে না বলে উনি এতদিন নীরব ছিলেন। এখন, যখন শুনলেন কবিরাজমশাই স্বয়ং কোণার্কতীর্থে যাচ্ছেন, তখন উনি ভরসা করে এগিয়ে এসেছেন।

রূপেন্দ্র গো-যানে যেতে স্বীকৃত হলেন না। তবে একই সঙ্গে অশ্বারোহণে যেতে আপত্তি করলেন না। গো-গাড়ির সঙ্গে অশ্বারোহী একই তালে যেতে পারে না। তবে পথে যখন বিপদ কিছু নেই, তখন আগে-পিছে গেলে ক্ষতি নেই। বড় পাণ্ডা আরও সংবাদ দিলেন যে, কোণার্ক সম্পূর্ণ জনহীন নয়। তিন-চার ঘর মানুষ ওখানে বাস করে। খুর্দারাজার নিষ্কর প্রজা তারা। সপ্তাহান্তে পিপলির হাটে তারা বাজার করতে আসে। খুর্দার রাজা তাদের নিয়োগ করেছেন, যাতে আশপাশের গৃহনির্মাণেচ্ছুরা ওই ভাঙা মন্দিরের পাথর তুলে নিয়ে না যায়। বড় পাণ্ডা তাদের দলপতি মহানন্দ দাসপাত্রকে একটা হাতচিঠি লিখে দিলেন, যাতে ওই তিনজন যাত্রীর ঠিকমতো দেখভাল করা হয়। অবশ্য দাসপাত্র এবং তার তিনঘরের আত্মীয়-স্বজনেরা সবাই নিরক্ষর। চিঠি পড়তে পারবে না। তা হোক, অন্তত পাঞ্জাছাপটা চিনবে।

শুক্লা চতুর্দশীর সন্ধ্যারাত্রে গো-যানে যাত্রা করলেন সস্ত্রীক দুর্গা গাঙ্গুলী। মধ্যরাতে শুক্লা চতুর্দশীর নিশাপতি এখন প্রায় মধ্যগগনে–খ-মধ্যর কাছাকাছি। আকাশ নির্মেঘ, তবু বাঁধভাঙা চাঁদের উপচে-পড়া জ্যোৎস্নায় নক্ষত্রকুলরমণীরা আজ নিষ্প্রভ। ফাল্গুনের মাঝামাঝি। সূর্য এখন কুম্ভরাশিস্থ। আগামীকাল পূর্ণিমা। তাহলে এই মধ্যরাত্রে সূর্যদেব কু-বিন্দুর কাছে- পিঠে। হিসাবমতে এখন পূর্বগগনে বৃশ্চিকরাশির উদয় হবার কথা। হ্যাঁ তাই—রূপেন্দ্রনাথের লক্ষ্য হল রক্তাম্বরা জ্যেষ্ঠা পূর্বসমুদ্রে অবগাহন সেরে সবে উদিত হয়েছেন। গণিত-জ্যোতিষে রূপেন্দ্রনাথের কিশোরকাল থেকেই আগ্রহ। পিতৃদেবের কাছে এবং গুরু তর্কপঞ্চাননের সাহায্যে রাশিচক্রের গতিছন্দ এবং জ্যোতিষ্কদের মধ্যে উজ্জ্বল অনেক নক্ষত্র ভালই চিনতে পারেন। অশ্বের গতি সংবরণ করে ঊর্ধ্বগগনে পুব থেকে পশ্চিমে একবার তাকিয়ে দেখলেন। বৃশ্চিকরাশির প্রশ্নবোধক চিহ্নের পূর্ববর্তী তুলা রাশির নক্ষত্র-চতুষ্টয় পূর্ণচন্দ্রিমার প্রভাবে আজ অপ্রকাশ। কন্যারাশির চিত্রা একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছে সমুদ্রতীরের ওই একক অশ্বারোহীকে সিংহরাশির মঘা চন্দ্রসন্নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও অদৃশ্য নয়; পশ্চিমাকাশে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে সনাক্ত করা যায়-কি-না যায়। রক্তবসনা রোহিণী এখনো অস্তমিত হননি। চিত্রার অদূরে জ্বলজ্বল করছে স্বাতী। উত্তরাকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল ব্যতিরেকে সনাক্ত করা যায় স্বর্গীয় বীণায় অভিজিৎকে; এবং হংসবালাকার শীর্ষে কী-নাম-যেন উজ্জ্বল সাদা নক্ষত্রটিকে। এছাড়া চন্দ্রের অনতিদূরে স্বজ্ঞানপ্রভায় ভাস্বর দেবগুরু বৃহস্পতি। বাদবাকি শতসহস্র কৌতূহলী নক্ষত্ৰললনা যারা–অমাবস্যার রাত্রে তারকাপুরীর অসংখ্য বাতায়নপথে উঁকিঝুঁকি দেয় আজ তারা পূর্ণচন্দ্রের মায়ায় সুসুপ্ত

জগন্নাথধামের অধিকাংশ ভদ্রাসনেই নেমে এসেছে মধ্যরাত্রির গাঢ় তন্দ্রিমা। তবু শহরের এ-প্রান্তে ও-প্রান্তে এই মধ্যরাত্রেও আলোর আভাস। আগামীকাল দোলপূর্ণিমা। বৈষ্ণবদের শ্রেষ্ঠ পুণ্যাহ। নন্দলালার রঙিন উৎসব—আবীর-ফাগ-রঙদোলের হোরি। আবার অন্যদিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের পরমগুরু শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবের জন্মতিথি। দুই শত সাতান্ন বৎসর পূর্বে এমনই এক দোলপূর্ণিমার পুণ্য-রাত্রে শচীমাতার গৃহে অবতীর্ণ হয়েছিলেন গোরাচাঁদ। ফলে বেশ কিছু গৃহাভ্যন্তরে এই মধ্যরাত্রেও কর্মব্যস্ততা। মিঠাই-এর দোকানে রাত্রি জাগরণক্লান্ত ভিয়েনের আয়োজন।

অর্ধদণ্ডের মধ্যেই এইসব আলোকোজ্জ্বল ব্যস্ততার এলাকা অতিক্রম করে এলেন অশ্বারোহী। এখন বিশ্বচরাচরে তিনি নিতান্ত একা। দু-একটি নিশাচর পক্ষী এখনো বালুকাবেলায় শিকার-অন্বেষণে ব্যস্ত। অশ্বের আস্কন্দিত গতিশব্দে তারা জোড়া-পায়ে দূরে সরে সরে যায়। পদতলে আদিগন্ত বেলাভূমি। সমুদ্র আর মহাকাশ হারিয়েছে তাদের পৃথক সত্তা। রূপেন্দ্রনাথের দক্ষিণে ভরা কোটালের অতন্দ্র জলোচ্ছ্বাস আর বামে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত নিশুতি প্রকৃতি।

সন্ধ্যারাত্রে গো-শকটে গাঙ্গুলীখুড়োকে সস্ত্রীক রওনা করে দিয়েছেন। মীনু একদিনের সংসার পাতার নানান সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে গেছে—চাল, ডাল, আনাজপাতিও নিয়ে চলেছে। রসিকতা করে রূপেন্দ্রনাথকে বলেছিল, কাল আমার পুন্নিমের বেরতো, ঠাকুরমশাই আমাদের গাছতলায়-পাতা সংসারেই দুটি অন্নসেবা করে আমাদের গো-জন্ম উদ্ধার করবেন। রূপেন্দ্রনাথও হাসতে হাসতে বলেছিলেন, উপায় কী? না হলে দোলপূর্ণিমার দিন ‘উপুস’ করতে হবে। বড়জোর কাঁচা ফলার। তার চেয়ে তোমার ‘বকনা-জন্ম’ উদ্ধার করাই ভাল।

কালীক-হিসাবে তিনি দুই প্রহরকাল পশ্চাবৎবর্তী। উনি আশা করে ছিলেন—অর্ধরাত্রির ব্যবধান থাকলে গো-যান ও অশ্বারোহী একই সময়ে লক্ষ্যস্থলে উপনীত হবে। বাস্তবে হিসাবটি মেলেনি। দু-তিন ক্রোশ দূর থেকে কোণার্ক মন্দিরের চূড়াটি চন্দ্রালোকে দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু সারা পথে গো-শকটটি দৃষ্টিগোচর হয়নি। বালুবেলার উপর মাঝে-মাঝেই একজোড়া সমান্তরাল চাকার দাগ অবশ্য নজরে পড়েছে। তাতে বুঝেছেন, গো-শকট ওঁর পূর্ববর্তী। পল্লীবালা মীনুর ভাগ্যের মতো টলতে টলতে গোযানের বক্রচিহ্ন কোন্ অলক্ষ্য দিগন্তের দিকে চলেছে। অর্কতীর্থে যখন উপনীত হলেন, তখনও সূর্যোদয় হতে অর্ধদণ্ড বাকি। পুব আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। দেবারিগুরু শুক্রাচার্য সমুদ্রতলের কাছাকাছি। পাখির কাকলি জেগেছে বনে-বনান্তরে। মন্দিরের অদূরে প্রকাণ্ড এক অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে মীনু কিলিঞ্চক বিছিয়ে তার সাময়িক সংসার পাতছে। ওঁকে দূর থেকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো।

অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে রূপেন্দ্রনাথ একটি ছদ্ম অভিবাদন করলেন।

মীনু বললে, তোমাকে কী দারুণ দেখাচ্ছে সোনাদা! যেন সত্যিকারের রাজপুত্তুর। মাথায় উষ্ণীষ, মাজায় তরোয়াল, পক্ষিরাজ ঘোড়ায় চড়ে চলেছ কোন রাক্ষসপুরীতে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে!

রূপেন্দ্র বললেন, আর কুঁচবরন রাজকন্যা তার মেঘবরন চুল এলিয়ে কোথায় বীণা বাজাবেন, তা নয় তিন-পাথরের উনানে কাঠিকুঠি গুঁজে ফুঁ পাড়ছেন! খুড়ামশাইকে দেখছি না যে?

মীনু চোখ বড় বড় করে বললে, কে? রাক্ষসরাজ? কালরাত্রে তাঁর জ্বর এসেছে! গো- গাড়িতেই শুয়ে আছেন। নামেননি।

গরু দুটিকে খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে সামনে-পিছনে ঠেকো দিয়ে গাড়োয়ান গো- যানটি ভূমির সমান্তরালে রেখেছে। উপরে টাপর তোলা। রূপেন্দ্রনাথ পরীক্ষা করলেন দুর্গা গাঙ্গুলীকে। না, এখন জ্বর কমে গেছে। তবে নাড়ির গতি ভাল নয়। সর্বাঙ্গে বেদনা।

গাঙ্গুলী বললেন, ও কিছু নয়, পুন্নিমে তো! এসময় বাতের ব্যথাটা চাগায়। তার ওপর কাল সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সারাটা পথ ‘হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ’ কেত্তন গাইতে গাইতে এয়েছি যে, গো-গাড়ির ভিতরে।

রূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঔষধের পুলিন্দাটা নিত্যসঙ্গী। কী একটা শিকড় বার করে খল- নুড়িতে বেটে মধু সহযোগে খাইয়ে দিলেন। বললেন, অন্নগ্রহণ আজ আর না-ই করলেন। দেখি, কাঁচা ফলার কী পাওয়া যায়।

গাঙ্গুলী বললেন, সেসব ব্যবস্থা তোমার খুড়িমা জগন্নাথধাম থেকেই করে এনেছেন। ফলমূল-মিষ্টান্ন সবই সঙ্গে মজুত আছে। এখন মুশকিল হচ্ছে, চন্দ্রভাগা নদীর মোহনাটা কোতায়? এ ব্যাটা গাড়োয়ান তো কিছুই জানে না দেখচি! অক্কতীথ্যের নামই শোনেনি গদ্ধভটা!

রূপেন্দ্রনাথ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সে-সংবাদ সংগ্রহ করলেন। জীর্ণ দেবদেউলের পশ্চাতে, কিছুদূরে দু’-তিন ঘর মানুষের বাস। একটু এগিয়ে যেতেই একটি ঘর থেকে বার হয়ে এলেন নগ্নগাত্র এক প্রৌঢ়। উপবীতধারী ব্রাহ্মণকে দেখে দণ্ডবৎ হলেন। তাঁর পিছন পিছন বার হয়ে এসেছিল দুটি শিশু। বড়টি ওঁর কন্যা বছর দশ-বারো; ছোটটি পুত্র, বছর ছয়-সাত। তারা ধমক খেল, যেহেতু দণ্ডবৎ হতে ভুলেছে তারা। হ্যাঁ, ইনিই দাসপাত্র। কন্যার নাম সুভদ্রা, আজ্ঞে। লেড়াটি মান’ এ অধম দাসর পুত্র, বলাই আইজ্ঞা!

বড়পাণ্ডার পাঞ্জা-ছাপ দেখেই চিনলেন। চিঠিখানা পড়ে শোনানোর প্রয়োজন হল না। গো-যান এবং অশ্বারোহী দেখেই বাকিটা দাসপাত্র আন্দাজ করে নিয়েছেন : অতিথি সৎকারে উনি পরাঙ্মুখ নন।

তাঁর কাছে সংবাদ পাওয়া গেল : চন্দ্রভাগা নদীটি কোর্ণাক মন্দিরের বিগ্রহের মতো অন্তর্হিত। গর্ভমন্দিরের শূন্য সিংহাসন যেমন প্রমাণ দেয়, এককালে এ-মন্দিরে মূর্তি ছিল–সূর্যদেব, পূষণ, হরিদশ্ব, যাই হোক তেমনি চন্দ্রভাগার মরা খাত দেখে অনুমান করা যায় কোথায় সেকালে ছিল অর্কতীর্থ। স্বচ্ছতোয়া চন্দ্রভাগার খাত নিত্য জোয়ার-ভাঁটায় স্তরের পর স্তর বালিতে সম্পূর্ণ বুজে গেছে। এখন সেখানে গোড়ালি ডোবে-কি-ডোবে না। স্নান করার প্রশ্নই ওঠে না। দাসপাত্র আরও জানালেন, এখানে সমুদ্রস্নান নিরাপদ নয়; তবে সিকি ক্রোশ উত্তরে খুর্দারাজের প্রতিষ্ঠিত পদ্মদিঘিতে এখনো জলের অভাব হয়নি। অবগাহন স্নানে অসুবিধা নাই।

গাঙ্গুলী বললেন, আমার তো মাতা খারাপ হয়নি যে, এই জ্বর গায়ে চষাক্ষেত ঠেঙিয়ে দিঘিতে ছান করতে যাব।

দাসপাত্র তার বিচিত্র উৎকলী ভাষায় যা বলল, তার অর্থগ্রহণ হল না গাঙ্গুলীর; কিন্তু রূপেন্দ্রের কানদুটি লাল হয়ে উঠেছে। আর মীনু কী জানি কী করে বুঝে ফেলেছে—হাসির দমকে ওর পেট ফেটে যাবার জোগাড়। গাঙ্গুলী বলেন, সব কতায় শ্যালের মতো অমন খ্যাকখ্যাক করে হাস কেন বল দিকিনি?

রূপেন্দ্রনাথের দিকে ফিরে প্রশ্ন করেন, কী বলচে ও?

রূপেন্দ্রনাথ ঠিকমতে অম্বয় ব্যাখ্যা করলেন না। দাসপাত্রর বক্তব্যের সারাংশটুকু শুধু দাখিল করলেন: ও বলছে, কর্তামশাই যদি স্নান করতে না চান তাহলে বলভদ্র তাঁর কাছে বসে পাহারা দিতে পারবে; আমাদের দুজনকে সুভদ্রা পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে দিঘিতে।

বৃদ্ধ বলেন, অ! তা এতে হেসে গড়িয়ে পড়ার কী হল?

মীনুর সঙ্গে রূপেন্দ্রনাথের দৃষ্টি-বিনিময় হল। কিন্তু কেউই হাসলেন না। দাসপাত্র একটু অপ্রস্তুত। বেচারি বুঝে উঠতে পারেনি যে, মীনু ওই বৃদ্ধের চতুর্থ পক্ষ। সে ভেবেছিল ব্যাটা-ব্যাটাবউ নিয়ে বৃদ্ধ তীর্থভ্রমণে এসেছেন। তাই সে বলতে চেয়েছিল পিতৃদেবকে বালকের জিম্মায় রেখে রূপেন্দ্র সস্ত্রীক পদ্মদিঘিতে অবগাহন করে আসতে পারেন।

মীনুর নির্দেশমতো রূপেন্দ্র বললেন, আমরা এখানে অন্নপাক করে মধ্যাহ্ন-আহার করব। আর সুভদ্রা আর বলভদ্র আমাদের সঙ্গেই মধ্যাহ্ন-আহার সারবে।

দাসপাত্র সানন্দে স্বীকৃত; সিটা তো মহাপ্রভুর আশীবার্দ, আইজ্ঞে! ব্রাহ্মণের প্রসাদ!

বিগ্রহ নাই। তাতে কী হল? কোণার্ক মন্দির-ভাস্কর্যের খ্যাতি যে আগৌড় প্রসারিত। গাঙ্গুলীখুড়োর অত আদিখ্যেতা নেই: বিগ্রহহীন মন্দিরে মূর্তি দেখে বেড়ানো। অগত্যা রূপেন্দ্রনাথ মীনুকে নিয়ে মন্দির-ভাস্কর্য দেখতে এগিয়ে গেলেন। দাসপাত্র দু’জনের হাতে দুটি লাঠি ধরিয়ে দিল। ভাঙা পাথরের স্তূপে সাপের আধিক্য। পৌষ-মাঘ তারা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল। এই ফাল্গুনে সদ্য দীর্ঘ নিদ্রান্তে তারা গর্তের বাহিরে আসে। নাগ খোঁজে নাগিনীকে। বসন্তকাল যে মিলনের ঋতু।

দাসপাত্রের ভ্রান্তি এখনো অপনোদিত হয়নি। বিশেষ হেতুতে তাই সে নিজেও সঙ্গে গেল না মূর্তিগুলো দেখিয়ে দিতে পুত্রকন্যাকেও যেতে দিল না। মন্দিরের বাহিরে কী জাতির মূর্তি আছে, সে-কথা তার অজানা নয়।

আগেই বলেছি, আমাদের কাহিনীর কালে কোণার্ক মন্দিরের পোতা পর্যন্ত প্রোথিত ছিল বালির গর্ভে। রথচক্রগুলি তাই অদৃশ্য। পরিকল্পনাকার যে সূর্যরথের পরিকল্পনা করেছিলেন তা তখন বোঝার উপায় ছিল না। কিন্তু বর্তমানকালে জগমোহনের পূর্বদিকে যে প্রকাণ্ড নবরত্নের ‘স্ল্যাব’টা দেখা যায় এখন যার নিত্যপূজা হয়—তা তখনো ভেঙে পড়েনি। সেটি ছিল জগমোহনের প্রবেশদ্বারের উপর স্বস্থানে।

মন্দিরের কাছাকাছি এসেই কী একটা নজরে পড়ায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মৃন্ময়ী। রূপেন্দ্রও একটু ভেবে নিয়ে বললেন, চল, আমরা বরং ওদিকটা দেখি—

‘ওদিক’ বলতে কোন দিক? মন্দিরের চতুর্দিকেই তো একই জাতের মূর্তি। অতি বিশাল অসংখ্য নরনারীর নগ্নশৃঙ্গারদৃশ্য অতি-অন্তরঙ্গ রতিরঙ্গের মিলন-দৃশ্য! এমনকি বিকৃতকামের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড যুগল-মূর্তি।

মৃন্ময়ী চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না। বললে, যাক রুপোদা, আমার সখ মিটেছে! চল ফিরে যাই! ভাল লাগছে না।

—চল! উপর-পোতালের দেবদাসীদের মূর্তিগুলি কিন্তু অপূর্ব!

—তা হোক, গা ঘিনঘিন করছে! চল ফিরে যাই।

—চল।

দুজনে পায়ে পায়ে ফিরে আসতে থাকেন। মৃন্ময়ী গম্ভীরভাবে বলে, এতক্ষণ বুঝতে পারছি, কেন সুভদ্রা আর বলাইকে উনি আসতে দিলেন না—

—কেন?

—–বাঃ! ওই অশ্লীল মূর্তিগুলো কি ভাইবোনের একত্রে দেখা উচিত?

—উচিত কি না সে প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু একথা তো নিশ্চয় যে, ওদের বাড়ি যখন এত কাছে, তখন ওই প্রকাণ্ড মন্দিরের যাবতীয় মূর্তি ওরা ভাইবোনে বারে বারে দেখেছে! দেখেনি? একসঙ্গেও দেখেছে!

—হ্যাঁ, তা দেখেছে নিশ্চয়। কিন্তু কী বুঝেছে ওরা?

রূপেন্দ্রনাথ জবাব দিলেন না। পায়ে পায়ে দুজনে গাঙ্গুলীমশাই যে-বটবৃক্ষের নিচে বিশ্রাম করছেন সেদিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। মৃন্ময়ী পুনরায় বলে, আর সেই জন্য দাসপাত্রমশাই আমাদের মন্দির দেখাতে নিজে এলেন না—

—’সেই জন্যেই’ মানে?

মীনু আড়চোখে তার রুপোদার দিকে একবার দেখে নিয়ে বলে: আহা! বোঝ না যেন….—ও হ্যাঁ! উনি তো আমাদের স্বামী-স্ত্রী ভেবে বসে আছেন!

হঠাৎ থমকে থেমে পড়ে মৃন্ময়ী। বলে, একটা কথা বল তো রুপোদা, আমার বদলে যদি সত্যিই তোমার সঙ্গে আজ কুসুম-বৌঠান থাকত, তাহলে তোমরা দুজন বোধহয় ঘুরে ঘুরে ওই মূর্তিগুলো দেখতে, তাই নয়?

রূপেন্দ্রনাথ হেসে প্রশ্নটা উড়িয়ে দিতে চান, কী হলে কী হত, সে গবেষণা থাক!

হঠাৎ দৃঢ়মুষ্টিতে মৃন্ময়ী ওঁর একখানা হাত চেপে ধরে। বলে, না। থাকবে না! সত্যি করে বল তো তোমার মনোগত ইচ্ছেটা কী? তুমি ওই মূর্তিগুলো দেখতে চাও, তাই না?–তা যাও না, দেখে এসো! আমি বরং একাই ফিরে যাই!

রূপেন্দ্র বললেন, হাতটা ছাড়, মীনু! দূর থেকে দাসপাত্রমশাই দেখলে তাঁর ভ্রান্ত ধারণাটা…

মীনু তৎক্ষণাৎ ওঁর হাতটা ছেড়ে দেয়।

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, দেখ মীনু, এখানে তো জনমানব নেই। আর এটাও অনস্বীকার্য যে, মূর্তিগুলো অতি অনবদ্য ভাস্কর্য। তা আমার সঙ্গে একসঙ্গে দেখতে যদি তোমার সঙ্কোচ হয়, তাহলে আমি বরং এখানে অপেক্ষা করছি। তুমি একচক্কর দেখে এস। তুমি ঘুরে এলে আমি যাব। একসঙ্গে না হয় নাই দেখলাম!

—না! তুমি যাও, তোমার যখন অতই ইচ্ছে তখন দেখে এসোগে! আমি এখানে অপেক্ষা করছি। যাব না। আমি যাব না। আমার লজ্জা করবে!

—কার কাছে? নির্জনে নগ্নস্নান করতে কারও তো কখনো লজ্জা করে না।

—কেমন করে জানলে? তুমি নিজে কখনো করেছো?

—কী? নির্জনে নগ্নস্নান? নিশ্চয়! কেন তুমি করনি?

মীনু আবার আড়চোখে ওঁকে একবার তাকিয়ে দেখল। বলল, তুমি কৌশলে আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছিলে। বল না, আজ আমার বদলে যদি কুসুমবৌঠান তোমার সঙ্গে থাকত, তাহলে তোমরা যুগলে ওই মূর্তিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে। তাই নয়?

রূপেন্দ্রনাথ সত্যকে এবার আর অস্বীকার করতে পারলেন না। বললেন, হ্যাঁ, দেখতাম। সে রাজি হলে! জানি না, ঐ মূর্তিগুলির যৌনতার ঊর্ধ্বে যে শিল্পসৌকর্য তার নাগাল সে পেত কি না। হয় তো সেও তোমার মতো এর মধ্যে শুধু নরনারীর অন্তরঙ্গতাটুকুই দেখতে পেত। কোণার্ক মন্দিরের ভাস্কর্য অনবদ্য!

মীনু অধোবদনে কী যেন ভাবল একমুহূর্তের জন্য। তারপর বললে, সে নিশ্চয় রাজি হতো! সে তো তোমার স্ত্রী। তোমার কাছে তার আবার লজ্জা কী?

রূপেন্দ্র বললেন, এটা যুক্তি গ্রাহ্য নয়। ‘লজ্জা’ একটা অদ্ভুত মনোবৃত্তি! তুমি তো একা- একাও ওগুলি ঘুরে দেখতে রাজি হলে না–আমি বলা সত্ত্বেও যে, কোণার্ক মন্দিরের ভাস্কর্য গোটা হিন্দুস্থানের মধ্যে অতি অনবদ্য এক দ্রষ্টব্য! কেন রাজি হলে না মীনু? যেহেতু, তুমি নিরাসক্ত হতে পারছ না, তোমার অবচেতনের একান্তে ওই বোধটা জাগ্রত রয়েছে যে, তোমার রুপোদা জানতে পারছে যে, তুমি এগুলি দেখছো! অথচ তুমি যদি কুসুমমঞ্জরী হতে, তাহলে সানন্দে আমার সঙ্গে মন্দির পরিক্রমা করতে…না, না, বাধা দিও না মীনু…আমার কিন্তু বক্তব্যটা শেষ হয়নি—তুমি আমার ‘খুড়িমা’ হলে তোমার লজ্জা করা সঙ্গত ভাইবোনের সম্পর্কটা যদি সত্য হতো, তাহলে…ভেবে দেখ, ওই বলভদ্র আর সুভদ্রা ভেব না ওরা কিছু বোঝে না—

কথাটা তাঁর শেষ হল না, অন্তরীক্ষ থেকে দৈববাণী হল যেন, সব দেখিলেন, আইজ্ঞা? অম্লানবদনে মিথ্যা কথা বলে যবনিকাপাত ঘটালেন রূপেন্দ্র, হ্যাঁ, দেখে এলাম। এবার স্নানের আয়োজন করা যাক। রোদের তাপ বাড়ছে…

—আইজ্ঞা! সুভদ্রা সে-পাকে আছে। আপনকারদের পদ্মদিঘি লই যিবে!

১০

পদ্মদিঘিতে শুধু জলই নয়, পদ্মও এখনো আছে। পাথর-বাঁধানো প্রাচীন ঘাট জীর্ণ এবং বিপদজনক। বাঁশ ও কঞ্চি দিয়ে বানানো আর একটি ঘাটের কাছে সুভদ্রা ওদের পৌঁছে দিল। তার ভাই বলাই বৃদ্ধের কাছে পাহারায় আছে। পদ্মদিঘির চারধারে ঘন বন-জঙ্গল। স্নানের ঘাট সম্পূর্ণ নির্জন। কিন্তু ঘাট একটাই—পুরুষ-স্ত্রীর পৃথক ঘাট নেই। মৃন্ময়ী সুভদ্রার দিকে ফিরে বলে, তুই ছান করতে এলি আর একটা শুকনো কাপড় নিয়ে এলি না? কী বোকা রে তুই?

সুভদ্রা নতনয়নে নীরব রইল।

রূপেন্দ্র এই জনহীন জলাশয়ের পদ্মফুলগুলিকে দেখছিলেন। দর্শকের অভাবে তারা সৌন্দর্য বিকাশের পথে কোনও বাধা মানেনি। কোণার্কশিল্পী—যাঁরা ওই অনবদ্য ভাস্কর্যগুলি গড়েছিলেন—তাঁরা নিশ্চয় দর্শকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন—কিন্তু এই পদ্মবনের অযুত-নিযুত পদ্ম গড়েছেন যে প্রকৃতি তিনি দর্শক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন। হঠাৎ রূপেন্দ্র বলে বসেন, এবারও ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছো, মৃন্ময়ী। এটা ওই কিশোরীর নির্বুদ্ধিতাজনিত হেতুতে নয় জগন্নাথধামে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে ওকে তোমার একটি ব্যবহৃত বস্ত্র দান করে যেও…

—মানে?

—মানে, লোকসমাজে পরিধানের উপযুক্ত ওর দ্বিতীয় আচ্ছাদন নাই! সচরাচর এই নির্জনে ও নগ্নস্নান করে থাকে, যা আজ সম্ভবপর নয়। সিক্তবসনেই ওকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

সুভদ্রা কিছুই বুঝতে পারে না। যাতে না পারে তাই রূপেন্দ্র অত্যন্ত দ্রুত উচ্চারণে বিশুদ্ধ বঙ্গভাষে মৃন্ময়ীকে বক্তব্যটা জানিয়েছেন। মৃন্ময়ী বলে, বুঝলাম। ওর না হয় দারিদ্র্যজড়িত বিড়ম্বনা ঠাকুরমশায়ের ক্ষেত্রে হেতুটা কী? মহাশয় কেন একবস্ত্রে এসেছেন?

—আমি অশ্বারোহণে এসেছি। ওজন কমাতে চেয়েছি। একবেলা সিক্তবস্ত্রে থাকলে আমার অসুখ করবে না।

—হয়েছে মশাই, হয়েছে! একজন তো জ্বরে কাৎ হয়েছেন, আর একজনও হোন! আমার মাথায় এই বিদেশ-ভূঁইয়ে আকাশ ভেঙে পড়ুক!

—তার মানে আমাকে স্নান করতে বারণ করছ?,

—আজ্ঞে না, মশাই। আপনি একটু আড়ালে যান। সুভদ্রা তিন ডুব দিয়ে এক ছুট্টে বাড়ি চলে যাবে। আর আমি স্নান সেরে ওই ঝোপের আড়ালে গিয়ে ভিজে শাড়ি পালটাবো। তারপর ওই ভিজে শাড়িটা জলকাচা করে দেব, তাই পরে আপনি ছান করবেন!

—আমি তোমার শাড়ি পরবো?

—কেন? জাত যাবে তাইলে?

—না, যাবে না। তোমার কাছে আমার অথবা আমার কাছে তোমার আবার সঙ্কোচ কিসের? এই তো সেদিন দুর্গাখুড়ো বলছিলেন, ‘তোমার খুড়িমা তো বিনা-ঘুনসি-যুগে তোমাদের দাওয়ায় হামা দিয়ে ফিরেছেন।

—’বিনা-ঘুনসি-যুগে’ মানে?

—মানে নিতান্ত শৈশবে। যখন পরিধেয় বস্ত্র তো ছাড়, তোমার মাজায় ঘুসি বাঁধার কথাও কারও মনে পড়েনি!

মীনু দু-হাতে মুখ ঢাকে–কী অসভ্য তোমরা!

—তাহলে আড়ালে যাই? তা আড়ালেই যদি যেতে হয় তাহলে তুমিই বা শুধু শুধু শাড়িটা ভিজাবে কেন? এখানে তো ত্রিসীমানায় লোকজন নেই।

মৃন্ময়ী অবাক হয়ে বললে, তার মানে?

—মানেটা বোঝা কি এতই শক্ত? আমি ‘বিনাঘুসি-স্নানের’ কথা বলছি!

মৃন্ময়ী ছোট একটা পাথর ছুঁড়ে মারল রুপোদাকে লক্ষ্য করে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল।

রূপেন্দ্র বললেন, ফসকে গেল তো? চলি!

মৃন্ময়ী বললে, না। একটু দাঁড়াও রুপোদা!

—আবার দাঁড়াব? কেন?

—স্নানের আগে তোমার পায়ে একটু আবীর দেব। আজ দোলপূর্ণিমা।

ওর পেটকোঁচড়ে যে আবীরের পুঁটলি ছিল, এতক্ষণ তা নজরে পড়েনি। মৃন্ময়ী তা থেকে একটু আবীর নিয়ে রূপেন্দ্রের পায়ে দিল, সুভদ্রার মুখে মাখিয়ে দিল। রূপেন্দ্র বললেন, আমাকে একটু আবীর ধার দেবে মীনু? তাহলে আমিও সুভদ্রার কপালে টিপ পরিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করতাম।

মৃন্ময়ী তার কোঁচড় থেকে পুলিন্দাটা বার করে দিল। রূপেন্দ্র ওই কিশোরীর কপালে- গালে আবীর মাখিয়ে দিলেন। সুভদ্রা দুজনকে প্রণাম করল। রূপেন্দ্র মৃন্ময়ীর দিকে ফিরে বললেন, মনে আছে মীনু—তুমি যখন ওই সুভদ্রার বয়সী, তখন এক দোলপূর্ণিমায় আমি তোমার মুখে আবীর দিতে চেয়েছিলাম। তুমি দৃঢ় আপত্তি করে দু-হাতে মুখ ঢেকে বলেছিলে : না!

বিনা আবীরেও মৃন্ময়ীর গাল দুটি লাল হয়ে উঠল। বলল, বল তো রুপোদা, সে সময় কে বেশি বোকা ছিল? তুমি না আমি?

—দুজনই সমান নির্বোধ ছিলাম। তাই আমি তোমার আপত্তিটা মেনে নিয়ে বলেছিলাম: ‘বোকা মেয়ে! এত ভয়!’ নির্জনে পেয়েও তোমার কপালে শুধু একটি টিপ পরিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম! গালে-মুখে মাখাতে সাহস হয়নি।

—আজ বুঝি তার শোধ নিতে চাও? সুভদ্রার সামনেই?

রূপেন্দ্র জবাব দিলেন না। দু-হাতে আবার নিয়ে মাখিয়ে দিলেন মীনুর মুখে-মাথায়- গালে-গলায়!

মীনু থরথর করে কেঁপে উঠল। আর খিলখিল করে হেসে উঠল সুভদ্রা। পরমুহূর্তেই পদ্মপুকুরের অতলতলে ঝাঁপিয়ে পড়ল মীনু।

১১

অপরাহ্ণের দিকে দুর্গা গাঙ্গুলীর জ্বরটা ছেড়ে গেল; কিন্তু তিনি কিছুতেই সে-রাত্রে জগন্নাথধামে প্রত্যাবর্তনে স্বীকৃত হলেন না। সর্বাঙ্গে নাকি প্রচণ্ড বেদনা। পূর্ণিমা না ছাড়লে বাতের ব্যথাটাও কমবে না।

বুদ্ধি যোগালো দাসপাত্র।

তার এক ভাইপো নাকি পৃথগন্ন হয়ে বাস করে পাশের বাড়িটাতেই। শ্যালিকার বিবাহ- উপলক্ষে সে দিনতিনেক হল সপরিবারে পিপলি গেছে। বাড়িটা খালি। বাড়ি বলতে অবশ্য মাঝারি মাপের একটা উলুখড়ের ঘর আর সংলগ্ন একচালা। ঘরে প্রায় ঘর-জোড়া তক্তাপোষ। তার উপর শীতলপাটি বিছানো। দাসপাত্রের ভ্রাতুষ্পুত্র ওই তক্তাপোষে সপরিবারে শয়ন করে ছেলে-মেয়েসহ সস্ত্রীক। ওঁদের তিনজনের স্থানাভাব হবার কথা নয়। রূপেন্দ্র আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই দুর্গাখুড়ো বলে ওঠেন—অ্যাই হল পাকা মাতার বুদ্ধি! কতায় বলে ‘হলে সুজন, তেঁতুল পাতায় নজন’! ঠিগাছে! তাই ব্যবস্থা কর!

দাসপাত্রের ঘরণী মৃন্ময়ীকে জনান্তিকে ডেকে নিয়ে তার বিচিত্র ভাষায় যা বললে তার মর্মার্থ: তীর্থের পথে শয়নের কোন বাধা কি যাত্রীনিবাসে বা ‘চটি’তে মানা চলে? শুধু দেখতে হবে কে কারে কোল-পাঁজরে নিয়ে শুলো। ব্যস্! হাসতে হাসতে প্রৌঢ়া বললেন, ‘আপনার কর্তাটিরে কহিবে কি গোটে রাতির জন্য সুভদ্রাদেই হই যিবে।’—অর্থাৎ দেবী সুভদ্রা যেমন একপাশে বলরাম অপরপার্শ্বে জগন্নাথদেবকে নিয়ে নিত্যশোভমানা, মৃন্ময়ীর কর্তাও যেন তেমনি একরাত্রের জন্য একপাশে পিতা, অপর কোলপাঁজরে পত্নীকে নিয়ে শয্যাগ্রহণ করেন: এতে দোষ নেই!

মৃন্ময়ী প্রথমটা বুঝে উঠতে পারেনি, পরক্ষণেই তার কানদুটি লাল হয়ে ওঠে। বুঝতে পারে কীভাবে কর্তার ভ্রান্তি গৃহিণীতে সংক্রামিত হয়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। ভুলটা ওরা ভেঙে দেয়নি

না মৃন্ময়ী নিজে, না রূপেন্দ্রনাথ। প্রয়োজনও বোধ করেনি। একটা রাত যে থাকতে হতে পারে, এটা তো আগে আন্দাজ করেনি। এখন এত বিলম্বে, কী করা উচিত মৃন্ময়ী বুঝে উঠতে পারে না।

১২

এ-বেলায় তিনজনেরই পূর্ণিমার পারণ–কাঁচা ফলার। মৃন্ময়ী অবশ্য পূর্ণিমায় দু- বেলাতেই অন্নসেবায় অভ্যস্ত; কিন্তু আজ অবস্থা বিপাকে সেও কলাটা-শশাটা দিয়ে মিষ্টান্ন—সহযোগে পিত্তিরক্ষা করল। সূর্যাস্ত হবার তর সইছে না আজ পূর্ণচন্দ্রের। কোণার্ক মন্দিরের বিমান আর জগমোহনের ফাঁকে—ওই যেখানে বিশাল ঝাম্পান-সিংহটা মারাত্মকভাবে ঝুঁকে আছে, পড়তে পড়তে পড়ছে না, সেই খাঁজে উঠল রুপোর থালাখানা। ঝাঁকে ঝাঁকে জ্বলছে অগুনতি জোনাকি। সমস্ত প্রকৃতি জ্যোৎস্নামদিরায় যেন মোহগ্রস্ত।

দাসপাত্র বাইরের দাওয়ায় একবালতি জল আর একটি পিতলের গাড়ু রেখে গেলেন। একটি লাঠিও। পরামর্শ দিলেন, রাত্রে যদি কোনও দরকারে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে বেশিদূরে যাওয়া ঠিক হবে না। আর প্রতি পদক্ষেপে লাঠি ঠুকে-ঠুকে যাওয়াটা জরুরি। না, ‘বড় শেয়ালের’ উপদ্রব নেই—বনবিড়াল বা গুলবাঘারা মানুষকে ডরায়–তবে ভাঙা পাথরের স্তূপে বাস করেন ‘তেনারা’–সেই যাঁদের নাম ‘রেতের বেলা’ করা মানা।

কুলুঙ্গিতে একটি পিতলের প্রদীপে যথেষ্ট রেড়ির তেল ঢেলে জ্বেলে দিলেন। রূপেন্দ্র বলেছিলেন, কোনও প্রয়োজন নেই—চাঁদের আলোই তো আছে। তা আছে, জানলা দিয়ে একমুঠো জ্যোৎস্না এসে পড়েছে শীতলপাটিতে। কিন্তু

বৃদ্ধ বললেন, না, বাতিটা জ্বলুক। নতুন জায়গা। রাতে ঠোক্কর খাওয়ার ভয় আছে। তাঁকে রাতে বার দুই-তিন বাইরে যেতে হয়।

দাসপাত্র-গৃহিণীর মতো শয়নের ব্যবস্থা অবশ্য করা হয়নি। দুর্গা গাঙ্গুলী মধ্যমণি। গো-গাড়িতে আসার সময় মৃন্ময়ী দুটি কার্পাস-উপাধান এনেছে। সে দুটি ওঁদের দুজনকে দিয়ে নিজে একটা পুঁটলি মাথায় দিয়ে একপ্রান্তে শুয়েছে। দুর্গা একটি খেদোক্তি করলেন, বৃথাই গা-গতরে ব্যথা হল, টাকাগুলান জলে গেল! ‘অক্কতীথ্যে’ না কোন ঠাকুর-দেবতা, না হল ‘তীথ্যস্তান’!

রূপেন্দ্র বললেন, মন্দির-ভাস্কর্য কিন্তু অনবদ্য।

দুর্গা একটা বিম্ভণমিশ্রিত প্রশ্ন করলেন, তোমরা দুটিতে ঘুরে-ঘুরে তাই দেখলে বুঝি সকালে?

—না! খুড়িমা আর দেখলেন কোথায়? উবড়ো- খাবড়া পাথুরে জমিতে হাঁটতে ওঁর পায়ে লাগছিল। আমি একাই দেখলাম, দুপুরে

মৃন্ময়ী অবাক হল। মানুষটা নিপাট সাত্ত্বিক! কিন্তু আজকাল মিছে কথা আটকায় না ওর জিবে। আশ্চর্য!

‘দুর্গা শ্রীহরি’ বলে পাশ ফিরলেন মধ্যমণি। ধর্মপত্নীমুখো হলেন এতক্ষণে। মৃন্ময়ী সারা গায়ে আঁচলটা টেনেটুনে তাঁর দিকে পিছন করে পাশ ফিরল।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শোনা গেল বৃদ্ধের নাসিকাধ্বনি। রূপেন্দ্রের নিশ্বাসও সমতালে শোনা যেতে থাকে। দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না মৃন্ময়ীর। তার বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে সারা দিনের অভিজ্ঞতা। মুখে আবীর মাখা, স্নানান্তে বস্ত্র পরিবর্তন, চুরি করে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা—শাড়ি পরে নগ্নগাত্রে রূপেন্দ্রের স্নানদৃশ্য!—আচ্ছা, সে যখন স্নান করছিল, তখন উনিও কী…? নাঃ! তা হতেই পারে না। কিন্তু দুপুরে একা একা ওই বিশ্রি পাথরের মূর্তিগুলো তো ঘুরে-ঘুরে দেখেছেন! তখন তো বিবেকে বাধেনি? …মনে পড়ে গেল, একঝলক-দেখা দণ্ডায়মান দুটি নরনারীর অন্তরঙ্গ সঙ্গমদৃশ্য! এক-সন্তানের জননী মৃন্ময়ীর এ-বিষয়ে কোনও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই। দাম্পত্যজীবনের অন্তরঙ্গ পর্যায় বলতে ও বোঝে নীরন্ধ্র অন্ধকারে এক বৃদ্ধের কামেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করা। নায়িকাও যে সক্রিয় হতে পারে, হয়, এটা ওর ধারণার বাইরে। …মনে হচ্ছে, ভুল করেছে ফিরে এসে। নিশ্চয় শুধু চোখের দেখায় দোষের কিছু ছিল না থাকলে, রুপোদা একা-একা তা ঘুরে-ঘুরে দেখতো না।

নিঃশব্দে মৃন্ময়ী উঠে বসে। স্বামীকে ডিঙিয়ে ও-পাশের ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখে। নগ্নগাত্রে চিৎ হয়ে আছেন রূপেন্দ্র। একমুঠো চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে, বুকে। নিশ্বাসের তালে তালে উপবীতশোভিত কবাটবক্ষটা উঠছে-নামছে! একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল ধনু; ওর মনে পড়ে গেল কুসুমবৌঠানের কথা! আচ্ছা কুসুমমঞ্জরীরও কি এমন ঘুম-না- আসা চাঁদনী রাতে ওই মানুষটাকে এমন করে লুকিয়ে দেখত? শুধুই দেখত? তারপর কি ইচ্ছে হলে পাথরের মূর্তির ওই নায়িকার মতো…

দুর্গা গাঙ্গুলী কাশলেন।

তৎক্ষণাৎ শুয়ে পড়ল মৃন্ময়ী। দুর্গা উঠলেন। বসলেন। ইতি-উতি কী যেন খুঁজছেন তিনি। মৃন্ময়ী মৃদুভাষে প্রশ্ন করে: কিছু খুঁজছেন?

এই এক বিড়ম্বনা! ও-পাশে রূপেন্দ্র ঘুমোচ্ছে বলে নয়, গাঙ্গুলীর এই চতুর্থপক্ষ তাঁর সন্তানকে জঠরে ধারণ করতে পারল, কিন্তু আজও ‘আপনি’ ছেড়ে ‘তুমি’র নৈকট্যে আসতে পারল না।

বৃদ্ধ বললেন, না খুঁজছি না কিছু। কোন দিক দিয়ে নামব তাই ভাবছি।

মৃন্ময়ী জবাব দেবার আগেই রূপেন্দ্রনাথ একলাফে নেমে পড়েন চৌকি থেকে। বলেন, আসুন, এদিক দিয়ে। বাইরে যাবেন বুঝি?

—হ্যাঁ, লাঠিগাছখান দাও দিনি। তোমরা ভিতর থেকে দোরটা বন্ধ করে দাও বরং।

–কেন? আপনার কি ফিরতে দেরি হবে?

–না না, দেরি হবে কেন? এমন কিছু বেশি দেরি হবে না।

—তাহলে দরজা বন্ধ করার কী দরকার? আমি জেগেই বসে আছি। আপনি ঘুরে আসুন।

বৃদ্ধ বিরক্ত হলেন, আঃ! সব কতায় তক্কো কর কেন বলতো? দোর খালি পেলেই তেনারা লতিয়ে লতিয়ে চৌকাট ডিঙিয়ে ঘরে ঢোকেন। ঐ রেতে যাঁদের নাম করতে নেই। দোর বন্ধ করে দাও। আমি ফিরে এসে টোকা দিলে খুলে দিও বরং

বৃদ্ধ যাবার সময় দোরটা টেনে ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন। রূপেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। দরজা বন্ধ করতে এগিয়ে গেলেন না। ফিরে এসে তক্তাপোষে বসলেনও না ফের। দরজার পাশে খাড়া দাঁড়িয়ে রইলেন। মৃন্ময়ী বসে আছে। শোয়নি। প্রদীপটা জ্বলছে! রূপেন্দ্রনাথের ছায়া পড়েছে বিপরীত দেওয়ালে। মধ্যগগনে উন্নীত চাঁদের একমুঠো চৌকো নকশাটা, জানলার ফোকর দিয়ে চুরি করে ঘরে ঢুকে যেটা এতক্ষণ চৌকির ওপর লুটোপুটি খাচ্ছিল—সেটা নেমে পড়েছে বিছানা থেকে। যেন রূপেন্দ্রকে অনুসরণ করে। মৃন্ময়ী বললে, দাঁড়িয়ে কেন? বস, রুপোদা।

—না, ঠিক আছে।—দাঁড়িয়েই জবাব দিলেন রূপেন্দ্র।

ভ্রূকুঞ্চন হল মৃন্ময়ীর। পরক্ষণেই বললে, ও! সে-কথাটা আমার খেয়াল হয়নি। ঠিক আছে, আমিই না হয় দাঁড়িয়ে থাকছি। বস, তুমি! কিন্তু নির্জন ঘরে এক বিছানায় তো আমরা আগেও বসেছি, রুপোদা? বসিনি?

হঠাৎ হেসে ওঠেন রূপেন্দ্র: দূর পাগলি! না, না, সেসব কিছু নয়। বস্ তুই। এই তো আমি বছি!

যথেষ্ট দূরত্ব রেখে দুজনে চৌকির দু’প্রান্তে বসলেন। মধ্যবর্তী অন্তর্হিত বৃদ্ধের উপস্থিতি সম্বন্ধে দুজনেই সচেতন।

রূপেন্দ্র বালিশে ঠেশান দিয়ে আধশোয়া, মৃন্ময়ী কিন্তু বসে আছে। হঠাৎ বললে, দুপুরে মন্দির দেখতে আবার যখন গেলে, তখন আমাকে ডাকলে না কেন?

—বাঃ! তুই তো দেখবি না বললি?

—মানুষের মন কি বদলায় না? তুমিও তো এককালে বলতে সারা জীবনে বিয়েই করবে না…

রূপেন্দ্র তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা বদলে দিলেন, ঠিক আছে বাপু! তুই যদি চাস, কাল সকালে আমরা আবার মন্দির ঘুরে দেখতে পারি।

—তোমার খুড়োমশাই কি জানেন, মন্দিরে কী জাতের মূর্তি আছে?

—বোধহয় না। কেন?

মৃন্ময়ী ‘কেন’র জবাব দিল না। জানতে চাইল, তোমার খারাপ লাগেনি, রুপোদা? গা ঘিনঘিন করেনি?

—না তো! গা ঘিনঘিন করবে কেন? মূর্তিগুলো তো অনবদ্য!

—চূড়ান্ত ‘অশ্লীল’ নয়?

—অন্তত আমার কাছে নয়। ‘শ্লীল-অশ্লীল’ শব্দগুলো আপেক্ষিক। যুগে-যুগে তার সংজ্ঞা বদলায়!

—বুঝলাম না।

—স্বাভাবিক। যেহেতু ‘শিল্প’ সম্বন্ধে তোর কোনও প্রাথমিক জ্ঞান নেই। কিন্তু খুড়ো এখনো ফিরছেন না কেন? একটু এগিয়ে দেখব?

মৃন্ময়ী জবাব দিল না। রূপেন্দ্র নিজেই উঠে গেলেন। দোর খুলে বাইরে বের হলেন। পূর্ণিমার আলোয় বহু দূর পর্যন্ত পরিষ্কার নজর যাচ্ছে। ত্রিসীমানায় বৃদ্ধকে দেখা গেল না। রূপেন্দ্র দাওয়া থেকে নেমে পড়লেন। এদিক-ওদিক রীতিমতো সন্ধান করে অনেকক্ষণ পরে ফিরে এলেন। মৃন্ময়ী একই ভঙ্গিতে বসে আছে, হাঁটুর ওপর চিবুকটা রেখে। রূপেন্দ্র বললেন, আশ্চর্য, খুড়োকে ত্রিসীমানায় কোথাও দেখতে পেলাম না।

মৃন্ময়ীর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বললে, এখন কী করবে?

—তাই তো ভাবছি!

—ওঁর কোনও বিপদ হয়েছে বলে কি তোমার মনে হচ্ছে, রুপোদা?

—বিপদ! না, বিপদ কী হতে পারে? নরখাদক বাঘ এ-তল্লাটে নেই, তা দাসপাত্র আগেই বলেছেন। খুড়োর কাছে কানাকড়ি নেই। তিনি যুবতী নারীও নন যে কেউ অপহরণ করবে। তাছাড়া তেমন কিছু ঘটলে তো খুড়ো চিৎকার করতেন!

—তাহলে?

—’তাহলে’ মানে?

—ওঁর এই ব্যবহারের একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকবে তো!

হঠাৎ এই সমস্যার সমাধানটা পরিষ্কার হয়ে গেল ওঁর কাছে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ওঁর। গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি কি এটা জানতে, মৃন্ময়ী?

তৎক্ষণাৎ চৌকি থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল মীনু। ওঁর পায়ের কাছে বসে পড়ে দুটি পা জড়িয়ে ধরে বললে, বিশ্বাস কর রুপোদা, আমি…আমি কিছুই আন্দাজ করিনি। উনি এই ষড়যন্ত্রের কথা মনে রেখেই এখানে ভাঙা-মন্দির দেখতে এসেছেন। আমাদের দুজনকে এভাবে একঘরে বন্দি করার ফন্দি এঁটে! কিন্তু এই বিশ্রী ষড়যন্ত্রের কথাটা আমি কিছুই জানতাম না।

—তাহলে, আমার আগে তুমি ব্যাপারটা এমন চট করে আন্দাজ করলে কেমন করে? তুমি আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমতী বলে?

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মীনু। বললে, না, না, না! অমন করে বল না, রুপোদা! আমরা দুটিতে ষড়যন্ত্র করে এই দুর্ঘটনাটা ঘটাইনি। তোমার আগে আমি ওটা বুঝতে পেরেছি, তার দুটো কারণ। প্রথমত, ওই ফন্দিবাজ বুড়োটাকে তুমি ঠিক চেন না, আমি হাড়ে হাড়ে চিনি! দ্বিতীয়ত, আমি একটা কথা জানি, যা তুমি জান না—

—সেটা কী?

—তোমার খুড়োকে আমি শাসিয়ে রেখেছি—ওই যজ্ঞ-টজ্ঞ করার আগে আমি গলায় দড়ি দেব! তোমার খুড়ো বুঝতে পেরেছে…ওভাবে হবে না। বিশ্বাস কর…

রূপেন্দ্র বোধকরি বিশ্বাস করলেন। বললেন, আঃ! পা ছাড়! যা চৌকিতে উঠে বস্। আর ববিই বা কেন? অনেকটা রাত বাকি। শুয়ে পড়।

—আর তুমি?

—আমিও শোব। চৌকির এদিকে। অহেতুক রাত জাগবো কেন?

—আমাকে নিয়ে এভাবে এক বিছানায় শুতে তোমার আপত্তি হবে না?

জবাব না দিয়ে রূপেন্দ্র এগিয়ে গেলেন দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করতে।

—ও কি করছো, রুপোদা? দরজা কি ভেতর থেকে বন্ধ থাকবে?

—থাকবে না? যে লোকটা আমাদের এ-ঘরে থাকতে দিয়েছে, তার কী দোষ? তার সব কিছু চুরি হয়ে যাবে না, দোর খোলা থাকলে?

মৃন্ময়ী জবাব দিল না। দুজনেই উঠে বসলেন তক্তাপোষে। দুজনে শুয়েও পড়লেন—যথেষ্ট দূরত্ব রেখে।

১৩

দুজনেই জেগে। এবং দুজনেই জানেন যে, দুজনেই জেগে।

—রুপোদা?

—বল্?

—তুমি বলতে পারবে ঠিক কতক্ষণ ধরে তুমি আমাকে ‘তুমি’র বদলে ‘তুই’ বলছো?

—না। খেয়াল নেই। একথা কেন?

—তুমি আমাকে ‘তুই-তুমি-আপনি’ তিনরকম সম্বোধনই করেছ। জীবনের এক-একটা পর্যায়ে। তোমার কিছুই খেয়াল নেই, না?

—না! বল শুনি। ঘুম যখন হবেই না।

—সত্যি তোমার মনে পড়ে না, ঠিক কবে ‘তুই’ ছেড়ে আমাকে ‘তুমি’ বলতে শুরু করেছিলে?

—বলছি তো, মনে নেই। বল্‌ না!

—সেও ঠিক এমনি এক দোলপূর্ণিমাতে। হঠাৎ ‘তুই’ ছেড়ে আমাকে ‘তুমি’ বলতে শুরু করেছিলে? বলেছিলে, ‘বোকা মেয়ে! রঙ মাখতে তোমার এত ভয়?’

—আশ্চর্য! তোর মনে আছে ঠিক কবে তোকে প্রথম ‘তুমি’ বলেছিলাম?

—থাকবে না? সেই প্রথম যে তোমার চোখে আমি ‘খুকি’ ছেড়ে একটি পুরোপুরি ‘মেয়ে’ হয়ে গেলাম! যাক সে-কথা, কিন্তু আজ ঠিক কোন মুহূর্ত থেকে আমি ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ হয়ে গেছি বলতো?

—জানি না। তুই-ই বল?

—ঠিক যখন বুঝতে পারলে, আমি এ-ষড়যন্ত্রের অংশীদার নই; আর বুঝতে পারলে আমাকে এই ঘরে অরক্ষিত একা রেখে তুমি চলেও যেতে পারবে না। আমাদের দুজনকেই এই চৌকিতে শুয়ে বাকি রাতটা কাটাতে হবে। তাই না? নিজের মনকে তুমি ঠিক তখনই বোঝাতে চাইলে যে, আমি পরস্ত্রী নই, আমি যুবতী নই, আমি তোমার সেই ছোট্ট মীনু বল? ঠিক বলিনি?

—তুই চিরটাকালই পাগলি রয়ে গেলি, মীনু। নে, এবার ঘুমাবার চেষ্টা করা যাক!

হঠাৎ উঠে বসল মৃন্ময়ী। বলল, না! এমন একটা অবাক রাত আমার জীবনে দ্বিতীয়বার আসবে না। আমি ঘুমাব না, সোনাদা!

—সোনাদা?

—হ্যাঁ, তোমার মনে নেই? ছোটবেলায় তোমার ওপর খুশি হলে আমি তোমাকে ‘রুপোদা’র বদলে ‘সোনাদা’ ডাকতাম!’

রূপেন্দ্র হাসলেন। বললেন, হ্যাঁ রে, মনে আছে! কিন্তু আজকে হঠাৎ আমার উপর খুশি হয়ে ওঠার কারণটা কী?

—তুমি যে মেনে নিলে, আমার একমাত্র পরিচয় এটাই নয় যে, আমি তোমার খুড়িমা, আমি পরস্ত্রী! আমি আজও সেই পড়শি-মেয়েটাই আছি, তোমার চোখে সেই মীনুই!

রূপেন জবাব দিলেন না। কথা বাড়ালেই কথা বেড়ে যায়।

—তোমারও ইতিমধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু, সোনাদা।

—নাকি? কেমন?

—আগে তুমি কিছুতেই মিছে কথা বলতে পারতে না। এখন কিন্তু অনায়াসে বল। এই তো একটু আগে তোমার খুড়োকে বললে, পাথুরে জমিতে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল বলে আমি তোমার সঙ্গে মন্দির ঘুরে দেখিনি।

রূপেন্দ্র বললেন, দ্যাখ, মীনু, মিছে কথা আমি আগেও বলতাম না, এখনো বলি না। তবে ‘সত্য’ বস্তুটার সংজ্ঞা ক্রমে ক্রমে বদলে যাচ্ছে আমার ধারণায়। আগে মনে হতো, যা বাস্তবে ঘটেছে সেটাই সত্য, এখন মনে হয় : শিব ও সুন্দরের সঙ্গে যা সম্পৃক্ত শুধু সেটাই সত্য। বাস্তবে তা ঘটুক-না-ঘটুক!

—বুঝলাম না।

—স্বাভাবিক। এ-সব কথা বুঝবার মতো শিক্ষার সুযোগ তো তোরা পাস না।

—আচ্ছা, বৌঠানকেও কি তুমি এভাবে কথায়-কথায় ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতে? রূপেন্দ্রনাথ লজ্জা পেলেন। বললেন, আমি দুঃখিত! তুই এ-কথায় আঘাত পাবি তা ভাবিনি। আমি কিন্তু সাধারণভাবে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম। অর্থাৎ স্ত্রীশিক্ষার অভাবে হিন্দুসমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে চিন্তারাজ্যে একটা প্রাচীর গড়ে উঠেছে!

–এবারও আমার বলার কথা : ‘বুঝলাম না’; কিন্তু তা আমি বলবো না—কারণ তুমি তাতে বিরক্ত হবে। বরং তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা সোনাদা, আমার অনুরোধে তুমি খুড়োকে একটা মিছে কতা বলতে পারো? আমার ভালোর জন্যে?

—ভূমিকা না করে সোজাসুজি বল না : কী কথা?

—না, সামান্য একটু ভূমিকা আমাকে করতেই হবে। কথাটা ‘কী’ তা বলার আগে আমি বলে নিতে চাই : আমি মরতে চাই না, সোনাদা! জীবনে যা চেয়েছিলাম, তা পেলাম না। কোনদিন পাবও না। অর্থের অভাব আমার নেই; কিন্তু অর্থ তো চাইনি আমি, যখন ছেলেবেলায় শিবপুজো করতাম, পুন্নি পুকুর করতাম? হ্যাঁ, জীবনে আমি সুখী নই; কিন্তু তাই বলে বাঁচবার ইচ্ছে আমার শেষ হয়ে যায়নি।

—ঠিক কী বলতে চাইছিস্, মীনু?

—কাল তুমি তোমার খুড়োকে একটা মিছে কথা বলবে?

—’মিছে কথা’! কী কথা?

—বলবে : যজ্ঞ-টজ্ঞর দরকার নেই। ওসব ব্যবস্থা ওকে করতে হবে না।

—আমার কথা সে শুনবে কেন? ও-কথা তো আমি খুড়োকে আগেও বলেছি!

দপদপ করে প্রদীপটা নিবে গেল। তাই দু-হাতে মৃন্ময়ীকে আর মুখটা ঢাকতে হল না। তার দু-চোখ ছাপিয়ে যে অশ্রুর বন্যা নেমেছে তা ওর সোনাদা দেখতে পাচ্ছে না। অতিমৃদু স্বরে মৃন্ময়ী বললে, এবার শুনবে। যদি তুমি মিছে করে বলতে পার–আজ রাতের পর আর ওসবের দরকার নেই, বলবে… আমি, …আমি, …কীভাবে বোঝাবো তোমাকে? বলবে আমি…আজ রাতেই আবার ‘মা’ হয়ে গেছি!

রূপেন্দ্রনাথ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে বসলেন। প্রদীপ নিভে গেলেও এতক্ষণে চাঁদের আবছা আলোয় চোখটা সয়ে এসেছে। মীনুকে দেখা যাচ্ছে না ভালো করে, কিন্তু তার অবস্থানটার অভাস পাওয়া যায়। মেয়েটা উবুড় হয়ে শুয়েছে, দু হাতে মুখ ঢেকে। রূপেন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন, মীনু কী নিদারুণ পরিস্থিতিতে পড়েছে! একথা কি মুখ-ফুটে বলার? একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তাঁর। বললেন, তুমি জান না, মীনু, বিজ্ঞানসম্মতভাবে ও-কথা বলা যায় না।

—বিজ্ঞানসম্মতভাবে কী কথা বলা যায় না!

—ঐ যা তুমি বললে, নরনারীর এক রাত্রেই মিলনেই মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে যাবে।—তোমার খুড়ো তা জানে না। ও ঝাড়-ফুঁক-কবচ-মাদুলি সব বিশ্বাস করে। তোমার মতো ধন্বন্তরির মুখের কথাই সে বেদবাক্য বলে মেনে নেবে।

রূপেন্দ্রনাথ একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ধর, নিল! কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তো তুই ধরা পড়ে যাবি?

—যাব। কিন্তু ততদিনে আমরা সোঞাই পৌঁছে যাব। সেখানে আমি এতটা অসহায় নই। আমার জা আছে, শোভারানী আছে, দেওর আছে। সেখানে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ও যা-খুশি তাই করতে পারবে না।

কথাটা যুক্তিযুক্ত। রূপেন্দ্রনাথ বললেন, ঠিক আছে রে, মীনু। তোকে কোনদিনও হাতে করে কিছু দিতে পারিনি। আজ তোর মুখ চেয়ে এই মিছে কথাটাই না-হয় বলব আমি। তাছাড়া, আমার মতে এই মিথ্যা ঘোষণার সঙ্গে ‘শিব’ এবং ‘সুন্দর’ সম্পৃক্ত তাই এ ‘সত্য’! তোর হাতে যে বিষ তুলে দিতে হল না, এতেই আমি সুখী! কিন্তু আর কথা নয়। এবার ঘুমাবার চেষ্টা কর বরং।

আবার দুজনে শুয়ে পড়লেন। চৌকির দু-প্রান্তে। মাঝখনে অনেকটা জায়গা খালি পড়ে থাকল। রূপেন্দ্র জানতেও পারলেন না অদূরে নিঃশব্দ অশ্রুর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে একটি অনিদ্রিতা যুবতী। অনিদ্রিতা এবং অনাদৃতা।

১৪

রাত তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। চাঁদ অস্ত গেছে, অথবা পশ্চিম দিগন্তে মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে। এদিকে ফর্সা হতে শুরু করেছে পুবের আকাশ। সূর্য আসন্ন। এখনও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে শুকতারা। গাছ-গাছালিতে পাখ-পাখালির কলকাকলি শুরু হয়ে গেছে—কিন্তু তা সুষুপ্ত রূপেন্দ্রনাথের শ্রুতিতে প্রবেশ করলেও মস্তিষ্কে কোন অনুরণন জাগাচ্ছে না। শেষরাতের একটা গা-সিরসির মিঠে হাওয়া বইছে।

রূপেন্দ্রনাথ সুষুপ্তি থেকে সুপ্তির রাজ্যে নিজ্ঞান থেকে সংজ্ঞান স্তরে উন্নীত হয়ে এখন ‘স্বপ্নদর্শন’ চেতনার তলে রয়েছেন। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখছেন তিনি : কুসুমমঞ্জরী এসেছে ওঁর কাছে। বিছানায় ঠিক ওঁর পাশেই শুয়ে আছে। কোল ঘেঁষে।

প্রায় প্রতিরাত্রেই ইদানীং কুসুমমঞ্জরীকে স্বপ্ন দেখেন। বোধকরি সজ্ঞান চিল্লয় তার কথাই বেশি করে স্মৃতিচারণ করেন বলে। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে কুসুমমঞ্জরী দেখা দেয় একটা কালো অবগুণ্ঠনে মুখখানি ঢেকে। বোধকরি ওটা মৃত্যুলোকের কৃষ্ণ-চীনাংশুক যবনিকা! রূপেন্দ্রনাথ প্রতি রাত্রেই তাকে অনুরোধ করেন অবগুণ্ঠন উম্মোচিত করতে, কিন্তু মঞ্জরী তা করে না, অথবা করতে পারে না। রূপেন্দ্র সেই স্বপ্নে-দেখা মঞ্জুরীকে দু-হাত বাড়িয়ে ধরতে যান আর সে ক্রমেই দূরে সরে যায়। স্বপ্নমঞ্জরী প্রতিদিনই কী-একটা কথা বলতে চায়, যা বলতে পারে না, বলা হয় না তার আগেই ওঁর ঘুমটা ভেঙে যায়।

আজও-তাই হল। কুসুমমঞ্জরী এসেছে। কিন্তু এ কী! আজ আর নেই কোনও অবগুণ্ঠন, কৃষ্ণ যবনিকার রহস্যান্তরাল। শুধু তাই নয় চিরব্রীড়াবনতা মঞ্জরী, আজ উদ্দাম—তার বক্ষাবরণ অন্তর্হিত। তার কামনা-বাসনা যেন যুগল সমুদ্রোচ্ছ্বাসের মতো উদবেলিত! আশ্চর্য! কী অপরিসীম রূপেন্দ্রনাথ দুই হাত বাড়িয়ে ওকে বুকে টেনে নিতে গেলেন আশ্চর্য! চির লাজনম্রা কুসুমমঞ্জরী দূরে সরে গেল না। বরং ঝাঁপিয়ে পড়ল ওঁর কবাটবক্ষে–কোণার্ক-জগমোহনের উপর-জঙ্ঘায় খোদিতা বিপরীতরত্যাতুরা রমণীর মতো!

রূপেন্দ্র ওর কর্ণমূলে বললেন, ধরা দিলে শেষ পর্যন্ত?

ওর সর্বাবয়ব তখন রতিরঙ্গে থরথর করে কাঁপছে। বোধকরি ওর অবচেতনে প্রত্যাখ্যাতা হবার একটা আশঙ্কা ছিলই—সেটা অপসৃত হতেই ও উদ্দাম হয়ে উঠল। রূপেন্দ্রর প্রশ্নের জবাবে কী একটা কথা বলতে গেল, বলা হল না তার পূর্বেই রূপেন্দ্রর ওষ্ঠাধর নিবিড় নিষ্পেষণে নীরব করে দিল মেয়েটিকে। পরিরিঙ্গু কণ্ঠলীনার বাক্যস্ফূর্তির ক্ষমতা রইল না আর।

ক্ষণ-পল-দণ্ড নিয়ে তা মাপা যায় না–দীর্ঘ-দীর্ঘ সময় আযৌবনের চুম্বনতৃষ্ণা মিটিয়ে যেন ক্ষান্ত হল রত্যাতুরা। নিশ্বাস নিতে আলিঙ্গনমুক্তা হল। আর তৎক্ষণাৎ স্বপ্নস্তর ত্যাগ করে জাগর-বাস্তবে প্রত্যাবর্তন করলেন রূপেন্দ্রনাথ। অনুভব করলেন, তাঁর বুকের ওপর উবুড় হয়ে যে মেয়েটি শুয়ে আছে, নিজ দেহভারে যার স্তনযুগল ওঁর রোমশবক্ষে নিষ্পেষিত, সে কুসুমমঞ্জরী নয়! বালার্কসূর্যের আলোয় তাকে চিনতে পারলেন। স্বপ্নভঙ্গের তীব্র ক্ষোভে উঠে বসলেন, ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে। মৃন্ময়ী পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল ওঁর বুকে—দুই দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে ফেললেন ওর দুই বাহুমূল। যেন প্রতিবর্তী-প্রেরণায়। শুধু বললেন : ছিঃ!

বজ্রাহতা হয়ে গেল মৃন্ময়ী। এর মানে কী? ওর চোখে বলির পশুর দৃষ্টি! কাঁঠালপাতা খাওয়াতে খাওয়াতে আর আদর-সোহাগ করতে করতে হঠাৎ যখন ঘাতক খড়গখানা হাতে তুলে নেয়, তখন বোধকরি এমনই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছাগশিশু। জানতে চায় : হঠাৎ কী হল?

হতভাগিনী মৃন্ময়ী, বেচারি বোঝেনি যে, এতক্ষণ যে মেয়েটি রূপেন্দ্রর আদর-সোহাগ উপভোগ করছিল সে এক স্বপ্ননায়িকা যার ভূমিকায় অজান্তে আযৌবন-উপেক্ষিতা মীনু অভিনয় করেছে কয়েকটি খণ্ডমুহূর্ত

রূপেন্দ্র চৌকি থেকে নেমে পড়েছেন। পোশাক পরিধান করতে শুরু করেছেন। মাথায় চড়ালেন উষ্ণীষ, মাজায় বেঁধে নিলেন তরবারি। এখনো পর্যন্ত দুজনেই নির্বাক। মীনু ইতিমধ্যে তার আঁচল দিয়ে সারা দেহ ঢেকে নিয়েছে। অপরিসীম লজ্জায় চরম অপমান আর সহ্যাতীত বেদনায় যেন পাথর হয়ে বসে আছে। রূপেন্দ্রনাথ দ্বারের অর্গল উম্মোচনের উপক্রম করতেই কোনক্রমে বলল, কোথায় যাচ্ছো?

ঘুরে দাঁড়ালেন রূপেন্দ্রনাথ। এই প্রথম সংযম হারালেন উনি। বললেন, কাল তুমি গা ঘিনঘিন করার কথা বলেছিলে, না মীনু? আমি যাচ্ছি পদ্মদিঘিতে একটা ডুব দিয়ে আসতে। নির্জলা মিথ্যাভাষণ। কিন্তু কেন? রূপেন্দ্র পণ্ডিত, রূপেন্দ্র জ্ঞানী! তাহলে তিনি কেন এটুকু বুঝলেন না যে, স্বপ্নজগতে তিনি যে আনন্দলাভ করেছেন সেজন্য তাঁর আত্মধিক্কার নিষ্প্রয়োজন আর আত্মধিক্কার দেওয়ার প্রয়োজনে ওই হতভাগিনীর কাটা ঘায়ে লবণ- নিক্ষেপ অহৈতুকী ধর্ষকামিতার বিকার!

রূপেন্দ্রনাথ দ্বার খুলে বেরিয়ে এলেন। সকাল হয়ে গেছে। দেখলেন, অশ্বত্থবৃক্ষতলে দুর্গাখুড়ো মুখপ্রক্ষালন করছেন। তাঁর সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় হল। কিন্তু কেউ কোন সম্ভাষণ করলেন না। রূপেন্দ্রর অশ্বটি রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় অপেক্ষা করছিল।

বিনা সম্ভাষণে রূপেন্দ্র অশ্বারোহণে যাত্রা করলেন–জগন্নাথধামের দিকে।

সূর্য তখনো ওঠেনি। পূর্বগগনে জেগে আছেন শুধু তামসাচারী দেবারিকুলের গুরু শুক্রাচার্য!

রূপেন্দ্র চলেছেন তাঁর বিপরীতে দক্ষিণ-পশ্চিমাভিমুখে।

১৫

কাহিনীটি দীর্ঘ–অতি দীর্ঘ! সব কথা গুছিয়ে বলার না আছে সময়, না পরিবেশ। বস্তুত আমি—এ-কাহিনীর লেখক–এখনো অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি—কীটদষ্ট পুরাতন গ্রন্থের পাতায় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যযুগকে। রূপমঞ্জরীর সন্ধানে আমার হালও সেই : ‘খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশ-পাথর!’

তোমরা অবশ্য ও-কথা বলতে পার : বাপু হে, লেখক! এতক্ষণ ধরে ধানাই-পানাই করলে–রূপেন্দ্রনাথের কথা বলেছো, কুসুমমঞ্জরীর কথাও, কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম নারী-বিদ্রোহিণী রূপমঞ্জরীর কোনও আভাসও তো এ-পর্যন্ত দিতে পারোনি। সে কোথায়?

তা বটে! এবার সংক্ষেপে শেষ করে সে-কথাই বলি :

যতদূর জানতে পেরেছি, রূপেন্দ্রনাথের সঙ্গে জগন্নাথধামের গোবর্ধনমঠে সমকালীন শঙ্করাচার্যের সাক্ষাৎকারটি আদৌ ফলপ্রসূ হয়নি। শঙ্করাচার্য জানতে চেয়েছিলেন : ক্যা মাংতা হায় রে, বেটা?

রূপেন্দ্রনাথ বিশুদ্ধ সংস্কৃতে প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিলেন যে, তিনি গৌড়মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত বর্ধমানভুক্তির এক ভেষগাচার্য। গোবর্ধনমঠে এসেছেন পূর্বাঞ্চলের ধর্মগুরুর নিকট কিছু সামাজিক অনুশাসন সম্বন্ধে অবহিত হতে। স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে, বাল্যবিবাহনিরোধ বিষয়ে সহমরণপ্রথা-বর্জন বিষয়ে।

ধর্মগুরুর ভস্মাচ্ছাদিত ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হয়েছিল। তিনি এবার সংস্কৃত ভাষায় জানতে চাইলেন : প্রশ্নকর্তা দশনামী কোন্ সম্প্রদায়ভুক্ত!

রূপেন্দ্র জানিয়েছিলেন, তিনি সন্ন্যাসী নন, গৃহী। তিনি মন্ত্রদীক্ষাও গ্রহণ করেননি, সৎগুরুর সন্ধান পাননি বলে।

শঙ্করাচার্য পরামর্শ দিয়েছিলেন, সর্বপ্রথমে সৎগুরুর সন্ধান কর, দীক্ষা গ্রহণ কর, জপ- তপ-সাধন কর্ না হলে মুক্তি পাবি না।

অন্তরের বিরক্তি চেপে এবার রূপেন্দ্র বলেন, আমি মুক্তির সন্ধানে আসিনি, আচার্যদেব! আমি জানতে এসেছি : স্ত্রীশিক্ষা, বাল্যবিবাহ এবং সহমরণপ্রথা সম্বন্ধে আপনার কী সামাজিক অনুশাসন?

শঙ্করাচার্য ওঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন : না, ব্রাহ্মণকন্যার আট বছর পর্যন্ত সারস্বত-সাধনায় বাধা নাই। অবশ্য অন্যান্য সম্প্রদায়ের বালিকাদের অক্ষর-পরিচয় নিষ্প্রয়োজন—তারা বার- ব্রত-পূজাবিধি শিখবে। ওই অষ্টম বর্ষ পর্যন্ত। কারণ : অষ্টমবর্ষেতু ভবেৎ গৌরী। তারপর বালিকাদের ধ্যানজ্ঞাননিদিধ্যাসন শুধুমাত্র তাদের পরমপতিদেবতা! বিধবা? তার সন্মার্গ : সহমরণ! অন্যথায় দীক্ষাগ্রহণ, গুরুচরণারবিন্দ-আশ্রিত নিষ্ঠাময়ীর জীবন!

চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে রূপেন্দ্রনাথ নিষ্ক্রান্ত হলেন গোবর্ধনমঠ থেকে। এখানে হল না। হবে না। সংস্কারমুক্ত মহাজ্ঞানীর সন্ধান কোথায় পাবেন? দ্বারকা? রামেশ্বরম্? হিমালয়? নাকি ষড়গোস্বামী-অনুসারী উত্তরসূরীর পদরজধন্য বৃন্দাবনধাম?

নিতান্ত ঘটনাচক্রে এই সময় পথিপার্শ্বে এক ত্রিকালদর্শী সন্ন্যাসীর সঙ্গে ওঁর সাক্ষাৎ হয়ে যায়। পাকদণ্ডী পথে রূপেন্দ্র হনহন করে এগিয়ে চলেছেন। গাছের ছায়ায় শুয়েছিলেন অতিবৃদ্ধ সন্ন্যাসী। সাদা বাঙলায় ডাক দিয়ে বললেন, বাবা! একটু এদিকে আসবি?

রূপেন্দ্র থমকে থেমে পড়ে বলেছিলেন, আমি কপর্দকশূন্য, সন্ন্যাসীঠাকুর।

দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একগাল হেসে বৃদ্ধ বলেছিলেন : তোর কাছে কপর্দক তো ভিক্ষা করিনি, একবগ্গা-বেটা!

রূপেন্দ্রনাথ স্তম্ভিত। এগিয়ে এসে বলেন : আপনি আমাকে চেনেন? এর আগে কখনো দেখেছেন?

—না রে বেটা! তবে এটুকু জানি, তুই একবগ্গা-কোবরেজ, আর জানি গোবর্ধনমঠের গোয়ালে পাঁচনবাড়ির ঠ্যাঙানি খেয়ে কেন্দ্রাপসারী পথে নিরুদ্দেশে ছুটে চলেছিস!

—’কেন্দ্রাপসারী’ বললেন ঠাকুর?

—ভুল বললাম নাকি রে? বলবিদ্যায় কেন্দ্রের অভিমুখের আকর্ষণকে তো কেন্দ্রাভিকর্ষী বলে! তার মানে কেন্দ্র থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়াকে…তবে পড়াশুনা তো বহুদিন করি না সব ভুলে গেছি রে, বেটা…

রূপেন্দ্র ওঁর পদপ্রান্তে বসে পড়ে বলেন, ডাকছিলেন কেন, বলুন?

—ধুনির আগুনটা নিবে গেছে। চকমকি ঠুকতে পারি না। হাতে জোর নেই। আগুনটা জ্বেলে দিবি?

—দেব, নিশ্চয় দেব।

ধুনি জ্বেলে দিলেন, টিকেয় আগুন দিয়ে বড় ছিলিমটা ধরিয়ে দিলেন। সন্ন্যাসীর প্রাণপণ বাধা সত্ত্বেও তাঁকে মকরধ্বজ জাতীয় কী-একটা ওষুধ খাইয়ে দিলেন। তারপর বললেন, এবার বলুন, কী করে জানলেন আমার নাম, আর আমি যে গোবর্ধনমঠে ব্যর্থকাম হয়েছি।

ওই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীই দিলেন পথের সন্ধান। স্বীকার করলেন, সাধনার প্রথম স্তরে কিছু কিছু ‘বিভূতিলাভ’ করে উনি ভুল করে বসে আছেন। ছলনাময়ীর লীলা! মানুষজনকে দেখলেই বুঝতে পারেন, সে কালো না ভালো! তার ‘সামান্য পরিচয়’!

রূপেন্দ্রনাথ বলেন, আমি কী খুঁজে বেড়াচ্ছি তা জানেন?

—না রে, বেটা, তবে এটুকু জানি : তোর নিজের মুক্তির পথ নয়!

রূপেন্দ্র তখন সব কথা খুলে বলেন। কী তাঁর জীবনের লক্ষ্য।

সন্ন্যাসী বললেন, তোর সমস্যার সমাধানের কথা আমি বলতে পারব না বাপু! কিন্তু যে পারবে তার হক-হদিস বাতাতে পারি। না দ্বারকা, রামেশ্বরম্, যোশীমঠ নয়, বৃন্দাবনধামও নয়। তুই সোজা কাশীধামে গিয়ে বাবা বিশ্বনাথের চরণজোড়া জড়িয়ে ধর!

রূপেন্দ্র সহাস্যে বললেন, সন্ন্যাসী ঠাকুর! বাবা বিশ্বনাথ লিঙ্গমূর্তি! তাঁর চরণজোড়া আমি পাব কোথায়, যে জড়িয়ে ধরবো?

—পাবি রে, বেটা পাবি! অচল বিশ্বাস রাখ! তাহলেই অচল বিশ্বনাথ নয়, সচল বিশ্বনাথের সাক্ষাৎ পাবি! কাশতে নয়, ব্যাসকাশীতে। তাঁরই চরণজোড়া জড়িয়ে ধরিস। সেই ন্যাংটাবাবা যদি না পারে, তাহলে ভূ-ভারতে আর কেউ পারবে না। যাঃ।

সন্ন্যাসী নিদ্রাভিভূত হলেন!

রূপেন্দ্র এটাকে দৈবনির্দেশ হিসাবে গ্রহণ করে চললেন উত্তরমুখো—শেরশাহী বাদশাহী সড়ক ধরে : কাশীধাম।

১৬

সচল বিশ্বনাথ! তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়া কি অতই সহজ!

কখন কোথায় থাকেন টেরই পাওয়া যায় না। এই শোনা গেল বাবা আছেন দশাশ্বমেধ ঘাটে। দৌড়ালো শত শত দর্শনার্থীর দল। গিয়ে শুনল, বাবা ভাসতে ভাসতে চলে গেছেন কেদারঘাটে। অসি থেকে বরুণা তিনি ক্রমাগত সন্তরণে অতিক্রম করেন ঘাট দিয়ে পায়ে- হেঁটে নয়। তিনি যে দিগম্বর। সমস্ত রাত্রি হয়তো আকণ্ঠ গঙ্গাজলে নিমজ্জিত হয়ে বসে আছেন–কী শীত, কী গ্রীষ্ম। তারপর যেই গঙ্গার ঘাটে প্রথম স্নানার্থীর আবির্ভাব ঘটে অমনি বাবা সাঁতরে চলে যান ব্যাসকাশীতে। জনশ্রুতি—তিনি দাক্ষিণাত্যের সন্ন্যাসী। কাশীধামে যখন প্রথম আসেন, তখনো বেণীমাধবের ধ্বজাটা মাথা খাড়া করে ওঠেনি। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুই তো হয়েছে ছত্রিশ বছর আগে, 1707 খৃষ্টাব্দে। জনশ্রুতি এই সন্ন্যাসী নাকি প্রায় আড়াই শত বৎসরকাল ওই কাশীধামের বিপরীতে ব্যাসকাশীতে লীলাময় হয়েছিলেন।

নানান ঘাটে ঠেকতে ঠেকতে আমাদের কাহিনীর নায়ক একদিন এসে পৌঁছালেন কাশীধামে। জেব-এ নেই পারানির কড়ি। সন্তরণে অতিক্রম করলেন গঙ্গা। ও-পাড়ে জনমানবশূন্য বালিয়াড়ি। দূর থেকে তাঁর দর্শন পাওয়া গেল। বসে আছেন পদ্মাসনে, জনহীন প্রান্তরে, বালির ওপর। চোখ দুটি নিমীলিত। ধ্যানস্থ। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। তবে ওঁর মধ্যদেশ এতই স্ফীত যে, মেদের মৈনাকে তাঁর না, ভুল হল, তাঁর নয়, দর্শনার্থীর লজ্জানিবারণ হয়ে থাকে। বিশালকায় পুরুষ। মুণ্ডিত মস্তক। দাড়ি-গোঁফের বালাই নেই এই সন্ন্যাসীর।

একজন কাশীবাসী পরামানিকের কীর্তি এটি।

জপ-তপ, পূজা-উজা সে কিছুই করে না। বিশ্বনাথদর্শন বা গঙ্গাস্নানের প্রয়োজন হয় না তার। সগর্বে বলে, ‘কোন শালা যমদূত মরার পর আমাকে ছুঁতে পারবে না।’ কারণ তার সাধনমার্গ বড় বিচিত্র। সপ্তাহে দুদিন—‘বুধ ঔর এতোয়ার’ সে ঝড়-ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতের বাধা মানে না। ব্যাসকাশীতে চলে আসে নৌকা বেয়ে। ধ্যানস্থ বাবাকে ক্ষৌরি করে দিয়ে যায়। বাবা টেরও পান না।

ভক্তরা যা ফলমূল-মিষ্টান্ন নিবেদন করে যায়, তা পড়ে থাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কাক- গাঙশালিক আর শৃগাল নির্দ্বিধায় তাতে উদরপূর্তি করে যায়। বাবা অচল বিশ্বনাথই জানেন ধ্যানভঙ্গ হলে সচল বিশ্বনাথ সেই বায়স ও শিবাকুলের উচ্ছিষ্টে উদরপূর্তি করেন কি না।

ধ্যানমগ্ন ত্রৈলঙ্গস্বামীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন রূপেন্দ্র। বাবা টেরও পেলেন না। এখন নিরন্তর অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ততক্ষণে চৈতালী রৌদ্র প্রখর হতে শুরু করেছে। হ্যাঁ, চৈতালী রৌদ্র। পুরো তের মাস সময় লেগেছে কপর্দকহীন অবস্থায় পুরী থেকে কাশীধাম আসতে। এমন কত চৈতালী দিনে উদয়ভানু অস্তাচলে উপনীত হয়ে দেখেছেন সমস্ত দুপুরের ‘লু’-এর ঝড়ে বাবার সর্বাঙ্গ প্রায় ঢেকে যেতে বসেছে; অথচ তাঁর ধ্যানভঙ্গ হয়নি।

নিতান্ত সৌভাগ্য বলতে হবে। বাবার ধ্যানভঙ্গ হল।

অতলান্ত একজোড়া চোখ মেলে বাবা বললেন, ক্যা মাংতা হায় রে, বেটা?

আগন্তুক করজোড়ে বললেন, আশীর্বাদ, প্রভু!

রুখে উঠলেন দুর্বাসা : ক্যিঁউ? ভ্রষ্টাচারীকো ক্যিঁউ আশীর্বাদ করুঁ?

রূপেন্দ্র স্তম্ভিত। জ্ঞানত জীবনে কখনো কোন পাপ করেননি। সজ্ঞানে সত্যপথ থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হননি। আর বাবার দৃষ্টিতে তিনি : ভ্রষ্টাচারী!

করজোড়ে বললেন, কহিয়ে প্রভু, ক্যা পাপ কিয়া হায় ম্যায়নে?

—ক্যা তু গঙ্গাপুত্র পিতামহ ভীষ্ম তো ন হো?

এ-প্রশ্নের কী জবাব? রূপেন্দ্র নীরব রইলেন। পরক্ষণেই বাবা মন্ত্রোচ্চারণ করেন :

ন তপস্তপ ইত্যাহ ব্রহ্মচর্যং তপোত্তমম্।
ঊর্ধ্বরেতা ভবেদ যস্তু স দেবো ন তু মানবঃ।।*

[* সর্বপ্রকার জপ-তপ-পূজাচরণবিধির শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ব্রহ্মচর্য।
যিনি ‘ঊর্ধ্বরেতা’ তিনি মানুষ নন, দেবতা।।]

—হ্যাঁ, ম্যয়নে মানলি! লেকিন মহাভারতকার মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবজী? বহ্ ক্যা থা? দেওত্বা? ব্রহ্মচারীন্? ইয়ে ভ্রষ্টাচারী? কেঁও রে বেটা, তু তো মহাপণ্ডিত হো! বাতা না তু?

কেন এভাবে তিরস্কৃত হচ্ছে তা বুঝতে পারেন না; কিন্তু নিশ্চয় তাঁর কোন অজ্ঞান অপরাধে অসন্তুষ্ট হয়েছেন ত্রিকালজ্ঞ ঋষি। তাই প্রশ্নের জবাবে যুক্তকরে নিবেদন করলেন : মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবজী তো মহান ব্রহ্মচারী, পরমভাগবত থে, প্ৰভু!

—কৈসে? বিদুরজননীকো উন্থোনে লাথ তো নেহি মারা থা, না?

আবার সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। কী বলতে চান উনি? সন্ন্যাসী একই নিশ্বাসে বলে চলেন, সোচ লে মূর্খ! যো মন্দভাগিনী তেরি কৃপা মাংনেকো লিয়ে আয়ী থি বহ্ তো মাতা অম্বিকাকি তরহ্ আঁখ বন্দ নেহি কী! মাতা অম্বালিকাকি তরহ্ পাণ্ডুর ভি ন হো গয়ী। তো?…

দুরন্ত বিস্ময়ে এবার সাদা বাংলায় প্রশ্ন করেন, কার কথা বলছেন প্রভু?

রূপেন্দ্র নিজের অজ্ঞাতসারে হিন্দি ছেড়ে বাঙলায় প্রশ্ন করেন।

এবার ত্রৈলঙ্গস্বামীও হিন্দি ছেড়ে সংস্কৃতে প্রত্যুত্তর করলেন। গদ্যে নয়, তাৎক্ষণিক ছন্দোবদ্ধ পদে শার্দূলবিক্রিড়িতছন্দে :

“বালচাপল্যের কিশলয়, কৈশোরের অর্ধস্ফুট কুসুমকলি আর যৌবনের লীলাকমল।
সৃষ্টিযজ্ঞে পূর্ণাহতি দিতে অর্ঘ্যডালি সাজিয়ে এসেছিল সীমন্তিনী নারী।।
যেন পরমভাগবত ব্রহ্মচারী ব্যাসদেবজীর চরণপ্রান্তে মাতা বিদুরজননী।
অহোবত! কী নিদারুণ নিয়তি! নায়িকার ললাটলিখন শুধু নিষ্ঠুর পদাঘাত।।”

রূপেন্দ্রনাথ বজ্রাহত! এ কী! এ কী বলছেন বাবা? কামার্তা মৃন্ময়ীকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে কখনো তো কোন অনুশোচনা হয়নি। পরদারগমন পাপ নয়? অথচ এই ত্রিকালজ্ঞ সংসারত্যাগী মহাসন্ন্যাসী ছন্দোবদ্ধপদে ব্যাসদেব আর বিদুরজননীর প্রসঙ্গ টেনে এনে…

করযোড়ে সবিনয়ে বলেন, অগর আপ নির্দেশ দেঁ তো ম্যয় ওয়াপস্ যা কে উসে মাফি মাং লুঙ্গা!

সন্ন্যাসী গর্জে ওঠেন : মাফি? হাঃ! ক্যা বহ্‌ বৈঠি হায় তেরে লিয়ে?

—তো?

সন্ন্যাসী তাঁর বিচিত্রভাষে বুঝিয়ে দেন, তোর ‘বচপন-কি-সাথী’ তোর কাছে ‘অমৃৎ’ চাইল, তুই দিলি না! সে তোর কাছে ‘জহর’ চাইল, তাও দিলি না তুই! আর কী করতে পারত সে হতভাগিনী? ধর্মরক্ষার তাগিদে, তার স্বামীনিযুক্ত তামসাচারী পশুর হাত থেকে নারীধর্মকে রক্ষা করার প্রয়োজনে গলায় ফাঁস দিয়ে সেই অভিমানিনী তো সীতামায়ীর মতো পাতালপ্রবেশ করেছে!

থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বালির উপর বসে পড়লেন শ্রোতা। মীনু, মৃন্ময়ী, সেই একফোঁটা মেয়েটা…যে মেয়েটা শেষ সাক্ষাতে বলেছিল, ‘জীবনে আমি সুখী নই, তবু মরতেও আমি চাই না, সোনাদা’,…আর যাকে উনি শেষ সম্ভাষণ করে এসেছেন, ‘গা ঘিনঘিন করছে বলে ডুব দিতে যাচ্ছি’ সে নৈই! সে আজ অমর্ত্যলোকের বাসিন্দা! সে তার কথা রেখেছে : ‘আর কোনদিন তোমার কাছে কিছু চাইতে আসব না, সোনাদা!’– না, আর কেউ কোনদিন তার নারীত্বকে অপমান করতে পারবে না না তার সাতপাকের নিষ্ঠুর অচ্ছেদ্যবন্ধনে আবদ্ধ জরাগ্রস্ত অক্ষম স্বামী, না পুত্রেষ্টি-যজ্ঞের অছিলায় কোনও বামাচারী কামাচারী, না ঊর্ধ্বরেতা থাকার অহঙ্কারে কোনও আত্মাভিমানী ব্রহ্মচারী!

তাকিয়ে দেখলেন, মহাসন্ন্যাসী পুনরায় ধ্যানস্থ।

নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন।

হল না, কিছুই হল না। নারীমুক্তির স্বপ্ন সার্থক হবার নয়। এখন একমাত্র লক্ষ্য : সেই অলক্ষ্যলোক যেখানে প্রতীক্ষা করে আছে সীমন্তিনী কুসুমমঞ্জরী তার স্বামীর পথ চেয়ে, আর মীনু তার সোনাদার।

চলতে শুরু করতেই পিছন থেকে আহ্বান এল : লৌটকর আ যা!

করজোড়ে ঘুরে দাঁড়ালেন আবার।

সন্ন্যাসী নিমীলিতনেত্র, কিন্তু তাঁর দক্ষিণ হস্তের তর্জনীটা ডানে-বামে দুলছে : এক দফে গতি কিয়া, বেটা! ব্যস্! দুসরে দফে, নহী!

রূপেন্দ্র আদৌ বিস্মিত হলেন না। ওঁর আত্মহননের সঙ্কল্পটা যেন ওই সন্ন্যাসীর পক্ষে অনুমান করা নিতান্ত জাগতিক কার্যকারণসূত্রে। বাবা এবার তাকালেন, বুঝিয়ে বললেন, যাদের লীলাখেলা শেষ হয়ে গেছে, তাদের শান্তি বিঘ্নিত করিস না। কিন্তু যাবৎ-জীবন কর্মণ্যেবাধিকারস্তে! তোর কাজ তো শেষ হয়নি। নারীমুক্তি? নারীশিক্ষা? সতীদাহনিবারণ? তুই না তোর ধরমপত্নীকে জবান দিয়ে বসে আছিস? তাকে সরস্বতীমাঈয়ের পায়ের তলায়, পৌঁছে দিবি?

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন রূপেন্দ্র। বললেন, কী করব, বাবা? কী করতে পারি, আপনিই বলুন? মৃত্যু এসে যে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল?

—তো ক্যা হুয়া? তোর মা, তোর জনমভূমি, যে তোর পথ চেয়ে বসে আছে রে বেটা! তার মায়ের অতৃপ্ত বাসনা পূরণ করার ব্রত যে তোর মায়ের! সে তোকে ডাকছে, তুই শুনতে পাচ্ছিস না?

হতবুদ্ধির মতো রূপেন্দ্র বলেন, আমার মা? তাঁর মায়ের অপূর্ণ বাসনা পূর্ণ করবেন বলে আমার সাহায্য চাইছেন? কে তিনি, কোথায় তিনি?

—হাঁ রে বেটা! তেরি চুন্নিমুন্নি মায়ী!

বুঝিয়ে বললেন, কুসুমমঞ্জরীর সাধনা ব্যর্থ হয়নি। সাধনায় প্রাণ দিয়েছে সে, কিন্তু বিদায়ের পূর্বে নতুন প্রাণকে প্রাণবন্তও করে দিয়েছে। মহাকবি ভারতচন্দ্রের আশীর্বাণী ব্যর্থ হবার নয় : “মদনারিরিপুর বিধানে এ মিলন সার্থক হবেই!”

রূপেন্দ্রনাথ এবার পূর্বাভিমুখী।

গঙ্গার স্রোতধারার পথে চলেছেন গৌড়মণ্ডলের দিকে।

জন্মভূমির সন্ধানে, আত্মজার সন্ধানে।

: রূপমঞ্জরীর সন্ধানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *