অভিনেত্রীর হার – অনন্যা দাশ

অভিনেত্রীর হার – অনন্যা দাশ

রিন্টি আর গুগাই ট্রেনে করে পাহাড়ে মামার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে। সঙ্গে আছে ওদের ড্রাইভার কৃষ্ণদা। বাবা-মা’র অফিসে কাজ পড়ে গিয়েছে, তাই কৃষ্ণদাকে সঙ্গে আসতে হয়েছে। মামাতো দাদা টিটোর সঙ্গে ওদের গরমের ছুটিটা জমবে ভাল! ওদের কম্পার্টমেন্টে আর-একজন বয়স্ক ভদ্রলোক রয়েছেন। ওঁর নাম অনিকেত চট্টরাজ। রিন্টি আর গুগাই দু’জনেই গোয়েন্দা গল্পের বই খুলে বসল দেখে ভদ্রলোক বললেন, “কে অপরাধী সেটা বলে দিলে তো গল্পের মজাটাই চলে যায়। বইগুলো রেখে দাও। আমি তোমাদের একটা সত্যি ঘটনা বলি। তোমরা শুনে বলো তো দেখি, কে দোষী! বলতে যদি পার, তা হলে বুঝব তোমরা শুধু গোয়েন্দা গল্পই পড় না, মাথাটাও খাটাতে পার!” রিন্টি আর গুগাই তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি!

ভদ্রলোক শুরু করলেন, “অনুপমাদেবী সিনেমার নামী অভিনেত্রী। ‘স্বর্ণধনুক সিনে অ্যাওয়ার্ড’ উৎসবে ওঁর দুটো ছবি উঠেছে এবার। তার মধ্যে একটার জন্যে উনি আবার ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’র পুরস্কার পেতে পারেন এমন সম্ভাবনা আছে! ধনুপুর শহরে অনুষ্ঠানটা খুব ঘটা করে আয়োজিত হয় প্রতিবার। সব নামী অভিনেতা-অভিনেত্রী, নেতা, খেলোয়াড়, লেখক, সাংবাদিকের ছড়াছড়ি। অনুষ্ঠানে কী পরবেন অনুপমাদেবী সেই নিয়ে অনেক দিন ধরে খবরের কাগজে, পত্রিকায় সব জল্পনাকল্পনা হয়েছে। অনুষ্ঠানে পরবেন বলে তিনি তাঁর অতি প্রিয় এবং দামি হিরের হার ‘রিভার অফ ফায়ার’ এনেছেন। ধনুকপুরের সবচেয়ে বড় ফাইভ স্টার হোটেলে উঠেছেন তিনি। কড়া নিরাপত্তা চারদিকে। ওঁর চেনা লোক আর হোটেলের স্টাফ ছাড়া উনি যে তলায় উঠেছেন, সেই তলায় কারও যাওয়ার অনুমতি নেই। তবে এর আগে একটা ঘটনা ঘটেছে। ধনুকপুরের ওসি অজয় সামন্ত একদিন হঠাৎ অনুপমাদেবীর বাড়িতে হাজির। অনুপমাদেবীকে তিনি বললেন, ‘দেখুন ম্যাডাম, আপনি যে স্বর্ণধনুক অনুষ্ঠানে আপনার রিভার অফ ফায়ার হারটা পরবেন, সে-কথাটা চারদিকে রটে গিয়েছে। হোটেলের মধ্যে ব্যাপারটা অন্যরকম, সেখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব এবং নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আপনি যদি হারটাকে অনুষ্ঠানে এবং তার পরের পার্টিতে পরে যান, তা হলে আপনার নিরাপত্তার জন্য আমাদের যে পরিমাণ অর্থ ও লোকবল লাগবে, সেটা ডিপার্টমেন্টের পক্ষে বাঞ্ছনীয় নয়। তাই বলছিলাম কী, আপনি যদি ওই হারটা না পরেন তা হলে আমি আর আমার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’

“অনুপমাদেবী একটু ভেবে বললেন, “দেখুন, আমি তো লোকজন, সাংবাদিক সকলকে ব্যাপারটা বলে ফেলেছি। ভুল করেছি জানি, কিন্তু ছোড়া-তির আর মুখে-বলা কথা তো ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তাই হার আমাকে পরতেই হবে, না হলে তো আমার সম্মান থাকে না। তবে আপনাদের কথা ভেবে আমি একটা কাজ করতে পারি। এখনও সময় আছে। আমি ওই হারটার একটা অবিকল নকল তৈরি করতে পারি। নকলটাই না হয় আমি অনুষ্ঠানে পরব। সেটা হারালেও আপনাদের মাথা ঘামাতে হবে না!

“‘উত্তম প্রস্তাব অনুপমাদেবী! আপনার সহয়োগিতার জন্যে ধনুকপুরের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।’

“সব কিছু প্ল্যান মাফিক চলল। অনুপমাদেবী তাঁর রিভার অফ ফায়ার হারটার নকল তৈরি করিয়ে নিলেন অনুষ্ঠানে পরার জন্যে। এবং অনুষ্ঠানে সেটাই পরে গেলেন। সব কিছু খুব ভালভাবেই সম্পন্ন হল। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন অনুপমাদেবী।

“পার্টি সেরে রাত তিনটে নাগাদ হোটেলের ঘরে ফিরে হারটা রাখতে গিয়েই চমকে উঠলেন তিনি! হোটেলের ঘরের আলমারিতে একটা ভেলভেটের বাক্সে আসল রিভার অফ ফায়ার হারটা ছিল, সেটা হাওয়া।

“রাতবিরেতে অজয় সামন্তর ডাক পড়ল। অনুপমাদেবীকে উনি বললেন, ‘আপনাকে মানা করা সত্ত্বেও আপনি আসল হারটা আনলেন?

“‘বা রে, আপনিই তো বলেছিলেন যে, হোটেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কড়া! তাই আমি ওটা হোটেলেই রেখেছিলাম!’

“অজয় সামন্ত মাথানাড়লেন। মনেমনে ভাবলেন, সত্যি বাবা, এসব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে আর পারা যায় না।

“খোজখবর নিয়ে আর ঘরের বাইরে লাগানো ভিডিও ক্যামেরা থেকে জানা গেল, অনুপমাদেবীর অনুপস্থিতিতে ওঁর ঘরে চারজন ঢুকেছিল। ওঁর ভাই রজত, ম্যানেজার অলোক সিংহ, পরিচারিকা যশোদা আর হোটেলের কর্মচারী বেলা।

“রজতবাবু বললেন, ‘অনুপমাদেবীই ওঁকে শাল নেওয়ার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে লবিতে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করার সময় এসি-তে ওঁর নাকি ঠান্ডা লাগছিল।’

“ম্যানেজার অলোক সিংহ ঘরে গিয়েছিলেন অনুপমাদেবীর অনুষ্ঠানের স্পিচের শেষ সংস্করণটা আনতে। গাড়ি করে অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে স্পিচটা ঝালিয়ে নিতে গিয়ে ওঁর খেয়াল হল, সেটা যে কাগজে লেখা ছিল, সেটা হোটেলের ঘরে ফেলে এসেছেন।

“যশোদা গিয়েছিল অনুপমাদেবীর জন্যে পেপারমিন্টের বাক্স আনতে। সকলেই জানে ওঁর মিন্ট খাওয়ার স্বভাব আছে। অনুষ্ঠানে পৌছে ওঁর খেয়াল হল, পার্সে যে বাক্সটা রয়েছে তাতে মিন্ট নেই।

“তিনজন তিন সময়ে যান ঘরে। বেলা হোটেলের কর্মচারী। সে যায় ঘর পরিষ্কার করতে। হার যে অনুষ্ঠানের সময়ই সরানো হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, অনুপমাদেবী রওনা হওয়ার আগে হারটা দেখেছিলেন।

“অজয় সামন্ত প্রথমে একটু ফাঁপরে পড়লেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বের করে ফেললেন চোর কে!

“তোমরা বলতে পার, হার কে চুরি করেছিলেন?”

উত্তর: গুগাই বলল, “আমি জানি! ওঁর পরিচারিকা যশোদা!”

অনিকেত চট্টরাজ একটু আশ্চর্য হয়েই বললেন, “কী করে বুঝলে?”

“অনুপমাদেবীর পরিচিত যে তিনজন ঘরে ঢুকেছিল, তাঁরাই শুধু জানতেন, তিনি নকল হার পরে অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। হোটেলের কাজের লোকের তো সেটা জানার কথা নয়! তারা উলটে দেখেছে যে, তিনি হারটা পরে বেরিয়ে গিয়েছেন। তাই বেলা প্রথমেই আউট। বাকি তিনজনের মধ্যে রজতবাবু অনুপমাদেবীর শাল আনতে যান। ওটা প্ল্যান করা হতে পারে না। অনুপমাদেবীর যে ঠান্ডা লাগবে সেটা ওঁর জানার কথা নয়। ম্যানেজার অলোকবাবুরও ওই একই অবস্থা। স্পিচটা যে অনুপমাদেবী ফেলে আসবেন, সেটা জানার উপায় ছিল না। যশোদা হারটার কথা জানত। সে তাই অনুপমাদেবীর ব্যাগের পেপারমিন্টের বাক্সটা সুযোগ বুঝে খালি করে রাখে। মিন্ট না থাকলে উনি যে ওকে আনতে পাঠাবেনই, সেটা সে জানত। আগেও নিশ্চয়ই ওরকম হয়েছে। তাই হার সরায় যশোদা।”

অনিকেতবাবু শুনে বললেন, “শাবাশ। তবে এর মধ্যে একটা ক্যাচ আছে। অজয় সামন্ত যশোদাকে চোর হিসেবে ধরিয়ে দেওয়ার পর অনুপমাদেবী খিলখিল করে হেসে উঠে বললেন, ‘ওই দ্বিতীয় হারটাও নকল ছিল কিন্তু! আমি একটু যাচাই করে দেখতে চাইছিলাম যে, আমার চারপাশের লোকজন কতটা বিশ্বাসী। তাই দুটো নকল হার তৈরি করিয়েছিলাম। আসলটা যে ব্যাঙ্কের লকারে আছে সেটা আর ওদের বলিনি!”’

২০ এপ্রিল ২০১০

অলংকরণ: অনুপ রায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *