অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একটি মূল্যায়ন
অভিনয় বা অভিনেতাকে নিয়ে আমাদের দেশে যতটুকু আগ্রহ বা কৌতূহল তা দর্শকসাধারণের। সমালোচক বা বোদ্ধারা এ নিয়ে বিশেষ একটা মাথা ঘামান না। এত সব ফিল্ম সোসাইটি হয়েছে, তার কল্যাণে চলচ্চিত্র উৎসাহীর, চলচ্চিত্র পণ্ডিতের সংখ্যাও বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু চলচ্চিত্র সংক্রান্ত ‘মননশীল’ পত্র-পত্রিকায় ভূ-ভারতের ফিল্ম নিয়ে এত দাঁত ভাঙা সব আলোচনা বেরোয়, কই, কোথাও তো অভিনয় বা অভিনেতা নিয়ে আলোচনা দেখতে পাই না। তবে কি অভিনয় কর্মটা মননের বিষয় হতে পারে না? না কি— অভিনেতারা দর্শকের কাছে নগদ পাওনা তো পেয়েই যাচ্ছে, এই বিবেচনায় ঈর্ষামিশ্রিত আভিজাত্যভিমান থেকে পণ্ডিতরা অভিনয়কে ব্রাত্য করে রাখছেন? আমার অবশ্য সন্দেহ হয় এই পণ্ডিতরা আসলে কিছুই বোঝে না— অভিনয় নিয়ে আলোচনার যোগ্যতা তাদের নেই বলেই ও বিষয়টা অচ্ছুৎ— এই ভান করে দূরে থাকে।
ফ্যান ম্যাগাজিন বা পত্র-পত্রিকার জনমনোরঞ্জক চলচ্চিত্র বিভাগগুলিতে আবার অভিনয় বা অভিনেতা নিয়ে যা সব ছাপা হয় অভিনয়ের সম্পর্কে কোনও সত্যকারের বা সুস্থ বোধ তৈরি হওয়ার পক্ষে সেগুলো মারাত্মক। নির্বোধ, বালখিল্য এমনকি অশ্লীল স্তুতি নিন্দার মধ্যে থেকে অভিনয়কে একটা গুরুতর কাজ বা অভিনেতাকে শিল্পকর্মী বলে ভেবে নেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই অভিনেতারা বেশিরভাগ সময়েই তাঁদের কাজের মূল্যায়নের জন্যে সাধারণ দর্শকের ওপরই নির্ভর করেন। দর্শকের কাছে তাঁরা শ্রদ্ধেয় যদি না-ও হন অন্তত প্রিয় তো বটে।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও এমনি একটি অতিপ্রিয় নাম বাঙালি দর্শকের কাছে। শুধু যদি জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতেই দেখতে হয় তাহলে সেখানেও গত তিরিশ বছরে তাঁর তুলনায় জনপ্রিয় অভিনেতা কমই হয়েছে। উত্তমকুমার যেমন একটা কিংবদন্তি, একটা প্রতীক, একটা ভাবমূর্তি— ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই। বাঙালি মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত তাড়িত-পীড়িত ব্যস্ত-বিব্রত জীবনের কৌতুকদীপ্ত ভাবমূর্তি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ে যেমন উজ্জ্বল তেমন খুব কম অভিনেতার অভিনয়েই দেখেছি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বললে তাই শুধুই একটা হাসাবার যন্ত্র মনে পড়ে না— একটা জীবনধারণা, জীবন সম্পর্কে একটা মন্তব্য যেন মনকে ছুঁয়ে যায়।
আর সব থেকে তৃপ্তিদায়ক হল ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যে অভিনয়শৈলী দিয়ে এই জীবনভাবনাকে প্রকাশ করেছেন সেটা ঘোর বাঙালি। অনেক শক্তিমান কৌতুকাভিনেতার মধ্যেও দেখেছি আদি হলিউডের অসামান্য ক্লাউনদের প্রবল প্রভাব। তুলসী চক্রবর্তীর, ফণী রায়ের বা নবদ্বীপ হালদারের মধ্যে এই সব প্রভাব একেবারেই ছিল না। ভানু-জহরের অভিনয়ে যদি তা কখনও উপস্থিত থেকেও থাকে তা কখনই দৃশ্যমান হয়নি। বলা ভাল স্বকীয়তার মধ্যে বাঙালিয়ানার জারকে তা পরিপাক হয়ে গেছে। এইজন্যেই হয়ত এঁদের তুলনারহিত জনপ্রিয়তা, এই কারণেই হয়ত প্রায় দুই দশক ধরে উত্তম-সুচিত্রার মতো— কিংবা হিসেব করলে দেখা যাবে তার থেকেও বেশি করে ভানু-জহরও ছিল বাংলা ছবির একটা অত্যাবশ্যক institution, অবর্জনীয় অনিবার্য অঙ্গ। একটা ভূমিকার মধ্যে যে পরিমাণ energy— উন্মাদনার এঁরা জন্ম দিতে পারেন তার সমকক্ষতা বিরল।
কিন্তু সিনেমার অভিনয়ের বিচারে জহর রায়ের থেকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি সব সময়েই ওপরে জায়গা দিতে চাই। কারণ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এত মাপের সঙ্গে স্বাভাবিক অভিনয় করার ক্ষমতা— (হাসির হট্টগোলের ভূমিকার মধ্যে থেকেও) আমার সময়ের খুবই কম সিনেমার অভিনেতার মধ্যে আমি দেখেছি। জহর রায়ের অসামান্য ক্ষমতা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে তাঁর মধ্যে অতি-অভিনয়ের প্রবণতা ছিল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়শৈলীর মধ্যে অতি-অভিনয়ের কোনও প্রবণতা নেই। কোনও সময়ে তিনি চরিত্রের সীমা ছাড়িয়ে বাইরে পা বাড়ান না। আর একটা দুর্লভ গুণ এঁর অভিনয়ে চিরকাল লক্ষ্য করেছি— এঁর কোনও প্যাঁচ নেই, আগে থেকে ভেবে নেওয়া চাল নেই, কোনও মুদ্রাদোষ নেই। অভিনয়টা সোজাসরল রাস্তায় চরিত্রটিকে এবং তার বাস্তবতাকে আশ্রয় করে চলতে থাকে। কিন্তু বৈচিত্র্যের ঐশ্বর্য আছে বলেই, তূণে অনেক রকমের বাণ আছে বলেই সব সময়েই অভিনয়টা প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় থাকে। তিরিশ বছর ধরে অভিনয় করছেন, তিনশোর বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে ক’টা আর সত্যিকারের চরিত্র? সবই তো ছাঁচে ঢালা। কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও রসবোধ এই অভিনেতার এত অপর্যাপ্ত যে, আজও মানুষকে আপ্লুত করার ক্ষমতা রাখেন। আমার সময়কার অভিনেতাদের মধ্যে, বিশেষত কৌতুকাভিনেতাদের মধ্যে এত বৈচিত্র্যের ঐশ্বর্য কারোরই নেই। সিরিয়াস ও কমিক— এই দুইয়ের মধ্যে অনায়াস বিচরণের ক্ষমতাও তাঁর মতো কমই দেখেছি।
বাংলা ছবির অভিনেতারা অনেকেই খুব শক্তিমান— কিন্তু অনেকেই graceful নন। কৌতুকাভিনেতারাই এর খানিকটা ব্যতিক্রম। এই জাতের অভিনেতাদের মধ্যেও আবার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অনন্য। অত্যন্ত Sensitive ও বুদ্ধিদীপ্ত অভিনেতা বলেই কি তাঁর অভিনয়ে এত রমণীয়তা, এত লাবণ্য?
তিনশো ছবিতে অভিনয় করার একটা খেসারত আছে। তার ওপর সেই সব ছবিকরিয়েদের অনেকেরই রসবোধ দূরস্থান, আদৌ কোনও বোধ ছিল কিনা সন্দেহ হয়। বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকার ন্যাকামির দৃশ্যের, কিংবা মা ও হাম্বা জাতীয় জীবদের কান্নাসিক্ত দৃশ্যগুলির ভিড়ের মধ্যে অধিকাংশ সময়ে শুধুমাত্র একঘেয়েমি কাটাতে কিংবা নাকের ও চোখের জল মোছবার অবকাশ দেওয়ার জন্যে Comic relief হিসেবে ভানু-জহর, বা কমেডিয়ানদের আমদানি করা হয়ে
থাকে। চিত্রনাট্যে হাসি নেই, অথচ হাসানোর দাবিতেই পয়সা দিয়ে এঁদের নিযুক্ত করা হয়। সেরকম অজস্র ছবিতে অভিনয় করার একটা খেসারত আছে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সেই খেসারত দিতে হয়েছে। অভিনয়-রীতিতে যান্ত্রিকতার, প্রাণশূন্যতার দোষ কখনও কখনও তাঁকেও লেগেছে বইকি। কিন্তু কত দুর্মর প্রাণশক্তি থাকলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিন দশক ধরে বাংলা ছবিকে অভিনয়ের সহজ লাবণ্য দিয়ে সমৃদ্ধ রাখা যায়, আবালবৃদ্ধের মুখে দিনযাপনের গ্লানি ভুলিয়ে হাসি ফোটানো যায়— সেই কথা ভেবে আমার আশ্চর্য লাগে।
আর ভেবে আশ্চর্য লাগে যে এমন অভিনেতাকে নিয়ে আমাদের দেশে কত কম আলোচনা হয়েছে, তাঁর কাজের সম্বন্ধে কতটুকু আগ্রহ বা কতটুকু স্বীকৃতি দেখতে পেয়েছি। তবে কি আমাদের দেশের আরও বহু সুন্দর জিনিসের মতো তাঁর অভিনয়ও অমনোযোগী বিস্মৃতির অমোঘ ভাটায় পড়ে ভেসে যাবে?
আসলে আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতির অভিভাবক যে শ্রেণী তারা অত্যন্ত অন্তসারশূন্য এবং সত্যিকার অর্থে শিল্পরসিকও নয়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ের যে জীবনবোধ যে বাঙালিয়ানা সাধারণ মানুষকে এত তৃপ্তি দেয়, তাকে উপভোগ করার বা স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষমতা এদের নেই। আজ যদি সাহেবদের দেওয়া কোনও পুরস্কারে তিনি চর্চিত হতেন, কিংবা সাহেবদের দেশে যে সব ছবি ফেস্টিভাল উপলক্ষে যায় সে সব ছবিতে ঘন ঘন তাঁকে দেখা যেত তাহলে হয়ত তাঁর সত্যিকারের মূল্যায়ন না হোক অন্তত কফির পেয়ালার ওপর আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি বিবেচিত হতেন। ঘটনা এই যে, তিনি তেমনভাবে পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত আজও নন। সুখের কথা, সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালবাসে, তাঁর অভিনয়ের সেইটেই সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি। এই দেউলিয়া সমাজের সব শিল্পকর্মের মতো তাঁর অভিনয়েও যদি কোনও গুণ থাকে তবে সেটা সাধারণ মানুষই উপভোগ করবে, মনে করে রাখবে— এইটে ভেবেই সান্ত্বনা পাই।