অভিনিষ্ক্রমণ
পাহাড়ের চূড়ায় দিনের শেষ আলোটা এখনও নিভে যায়নি। বৃষ্টি শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। নরম হলুদ আকাশে ঘরে ফেরা পাখিদের সারি। পাহাড়ের ওপরে তখনও বৃষ্টিস্নাত গোধুলী। কিন্তু উপত্যকাতে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেছে। পাহাড়ী বনগুলোতেও জমতে শুরু করেছে চাপ চাপ অন্ধকার। নিশাচর প্রাণীরা সেই অন্ধকারে আড়মোড়া ভাঙছে।
সেই বনের ধার ঘেষেই জ্বলজ্বলে দুটো চোখ নিয়ে একটা বিরাট লরি পাহাড়ি ঢালু রাস্তা বেয়ে আস্তে আস্তে নিচে নামছে। ঢালু রাস্তায় বারবার ব্রেক চাপা হচ্ছে বলে গাড়িটা খুব কর্কশ শব্দ করছে। মনে হচ্ছে বেশ বড়সড় একটা ক্লান্ত হাতি জ্বলজ্বলে দুটো চোখ নিয়ে বনের ভেতর হারিয়ে গিয়ে পথ খুঁজছে। লাফ মেরে রাস্তা পার হচ্ছে দুই একটা হরিণ আর শিয়াল। লরির হেডলাইটের আলো পড়ে তাদের চোখজোড়া জ্বলে উঠছে।
রাস্তা যত নিচে যাচ্ছে, অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। হেডলাইটের হলুদ আলো অন্ধকার চিরে সামনের বৃষ্টি ভেজা রাস্তাটাকে আলোকিত করছে।
লরিটার ড্রাইভার কম্পার্টমেন্ট অন্ধকার। চালকের মুখ দেখা যাচ্ছে না। আরও কিছুক্ষণ চলার পরে লরির হেডলাইটের আলো পড়ল লাল সাদা ডোরাকাটা রোড ব্লক বারের ওপরে। এই গভীর বনের ভেতর রোড ব্লক! একটা কড়া ব্রেকের তীক্ষ্ণ শব্দ করে লরিটা থেমে গেল। হঠাৎ চারপাশে নীরবতা নেমে এলো। হেডলাইটের হলুদ আলোতে দুজন পুলিশকে দেখতে দেখা গেল লরির দিকে হেটে আসতে। হাতে তিন ব্যাটারির টর্চ।
লরির জানালা নেমে গেল। একটা লোক জানালা দিয়ে মুখ বের করে বলল, “স্লামুওয়ালাইকুম ছার।”
পুলিশ দুটো হাতের লাঠি নাড়িয়ে হেডলাইট বন্ধ করতে বলল। তারপর লরি থেকে নেমে আসার ইশারা করল। লোকটা লরিটা রাস্তার পাশে পার্ক করল। হেডলাইটের তীব্র হলুদ আলো নিভে যেতেই গাঢ় অন্ধকার ঘিরে ধরল লরিটাকে। লোকটা লরি থেকে নেমে এলো। এতক্ষনে রাস্তার পাশের পোর্টেবল ফ্লাডলাইটের আলোটা চোখে পড়ল লোকটার। একটা তাঁবুও চোখে পড়ল। পুলিশের অস্থায়ী চেকপোস্ট। লোকটার কেমন জানি লাগল। এইখানে সাধারণত পুলিশের চেকপোস্ট বসে না। এই গহীন পাহাড়ি বনের ভেতর। তাও এই ভর সন্ধ্যেবেলা! লোকটা পুলিশ দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাব বোঝার চেষ্টা করল। পুলিশ দুজনের মুখে ক্লান্তিজনিত বিরক্তি। লোকটা কিছুই বুঝতে পারল না কি হচ্ছে। সে রোজ সন্ধ্যাবেলা এই রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের ওপাশে তিবংছড়াগ্রামে মুদির দোকানের মালামাল নিয়ে যায়। কোনদিন এইখানে পুলিশের চেকপোস্ট দেখেনি। কৌতূহলী লোকটার ভয় বাড়তে লাগল ধীরে ধীরে
একজন পুলিশ লোকটাকে টর্চ নাড়িয়ে তাঁবুর দিকে যেতে বলল। বৃষ্টি ভেজা বাতাসে আসন্ন শরতের আগমনী বার্তা। সেই বাতাসে তাঁবুর কাপড়টা একটু পরপর পতপত করে শব্দ করছে। লোকটা তাঁবুতে ঢুকতেই ক্যানভাস চেয়ারে বসে থাকা মোটাসোটা একজন পুলিশ অফিসার বললেন, “কি রে মোজাম্মেল নাকি রে?”
“আরে বিয়াই নাকি!?”
লরি চালক মোজাম্মেল যেন একটু সাহস পেল। এই পাহাড়ি এলাকার একমাত্র থানার ওসি আফজাল আলী। তার চেনা পরিচিত। মোজাম্মেল যে এই রাস্তা দিয়ে যে রোজ আসা যাওয়া করে এইটা অন্তত আফজাল আলী জানে। এইটা একটা আশার কথা। কিন্তু তাঁবুর ভেতরে বসে থাকা আফজাল আলীকে কেন জানি খুব ক্লান্ত দেখালো।
“বস বস।” আফজাল আলী একটা বেতের টুলের দিকে ইশারা করলেন। মোজাম্মেল বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো তাঁবুটা দেখল। তাঁবুর এক কোনে চার্জার লাইট জলছে। পুরো তাঁবুতে কেমন আলো আঁধারীর ছায়া।
“তিবংছড়ি থেকে আসছিস?”
“হ্যাঁ বিয়াই। বিষ্টীর জন্যে একটু দেরি হয়ে গেল।”
“হুম।”
“বিয়াই কি হইছে? আজ চেকপোস্ট বসালেন হঠাৎ।”
“ওপর থেকে অর্ডার। সরকারি অর্ডার।”
“কিসের অডার? মানে কিসের জন্যে অডার? কি খুঁজতেছেন?”
“আছে কিছু ব্যাপার। তোর খবর বল।”
“আর খবর বিয়াই। রোজ এই রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ আছে আমার? সেই দুপুরবেলা শহর থেকে মাল বোঝাই করে মরুং আর বিলাইমারীর বাজার হয়ে তিবং-এ পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল পার হয়ে যায়। আবার ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। আচ্ছা বিয়াই, তিবং-এর বাজারে সবাই বলাবলি করতেছিল, কিসের যেন বিকট শব্দ হইছে?”
“কিসের শব্দ? কটার দিকে?”
“কিসের শব্দ কেউ বলতে পারল না। কটার সময় সেইটা শুনি নাই। হবে ওই দুপুর টুপুরের দিকে।”
“ওহ।”
মোজাম্মেল এত শীতল প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। আফজাল আলী পুলিশের লোক হিসাবে আরও কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারত। কেন করল না? নাহ। কোথাও একটা খটকা লাগছে। বিস্ফোরণের শব্দ সবাই শুনেছে আর পুলিশের লোক হয়ে আফজাল আলী শুনবে না! বিস্ফোরণের শব্দটার সাথে কি চেকপোস্ট বসার কোন সম্পর্ক আছে? মোজাম্মেল প্রশ্নটা করতে গিয়েও করল না। সে লরি চালক। এইসব প্রশ্ন করে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মোজাম্মেল নড়েচড়ে বসল। বাইরে বাতাস হচ্ছে। তাঁবুর কাপড়টা আবার পতপত করে শব্দ করছে। আবার বৃষ্টি নামবে বলে মনে হচ্ছে। মোজাম্মেল বলল, “বিয়াই, আমি উঠি। নাকি?”
আফজাল আলী পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করতে করতে বললেন, “আরে দাঁড়া না। ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? যাবি তো শহরে। এক ঘণ্টার রাস্তা।”
“আবহাওয়া ভালো না বিয়াই।”
“লরিতে যাবি, রিক্সায় না। তাড়াহুড়ার কিছু নাই।” বলে আফজাল আলী সিগারেটটা ধরিয়ে ম্যাচের কাঠিটা ফেলে দিলেন। তার বুটের চাপায় কাঠির শেষ আগুনটুকু নিভে গেল। তারপর আফজাল আলী বললেন, “চল বাইরে চল।”
মোজাম্মেল আফজাল আলীর পেছন পেছন বাইরে গেল। পুলিশ দুটো লরির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। আফজাল আলী বললেন, “লরির পেছনে কি?”
মোজাম্মেল খুব অবাক হল। এই প্রশ্ন তাকে কোন পুলিশ আজ পর্যন্ত করেনি। আজ পর্যন্ত সে হারাম কিছু তার লরিতে তোলেনি। কাজেই এই সব প্রশ্নও শুনতে হয়নি। মোজাম্মেল বলল, “যা থাকে। খালি কার্টন টার্টন আছে। ক্যান ছার?”
আফজাল আলী মোজাম্মেলের প্রশ্নের তেমন একট গুরুত্ব দিলেন না। লরির পেছন দিকে যেতে যেতে বললেন, “খোল।”
মোজাম্মেল একরাশ বিস্ময় আর কৌতূহল নিয়ে লরির পেছন দিকের ডালা খুলতে লাগল। তার সকৌতুহল চাহনি আফজাল আলীর দিকে তাকিয়ে আছে। ঘটাং করে শব্দ হল। মোজাম্মেল লরির পেছনে ডালা খুলল। লরির ভেতরে অন্ধকার। মুদিখানার দোকানের মত পুরনো একটা গন্ধ।
আফজাল আলী একজন পুলিশকে ইশারা করতেই পুলিশটা টর্চ জ্বালিয়ে লরির ভেতরে ঢুকল। টর্চের বৃত্তাকার আলো লরির এখানে ওখানে ঘুরতে লাগল।
“ওই ব্যারেলের ভেতরে কি?” আফজাল আলী লরির ভেতরে রাখা পাঁচটা ব্যারেলের দিকে তাকিয়ে বললেন।
“সরিষার তেল, বিয়াই।” মোজাম্মেল বলল।
লরির ভেতরের পুলিশটা ব্যারেলের ঢাকনা খুলে ভেতরে টর্চের আলো ফেলল। কালো কুচকুচে তরলে ব্যারেলটা ভর্তি। পুলিশটা আঙুলে একটু তরল নিয়ে শুঁকে জানালো যে আসলেই সেটা সরিষার তেল।
“আর ওই কালো পলিথিনগুলার ভেতরে?” আফজাল আলী আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
“ওতে পচা বিস্কুট স্যার। বিক্রি হয়নি তাই দোকানদার ফিরায়ে দিল।” মোজাম্মেল বলল।
কালো পলিথিনগুলোও দেখা হল। পচা বিস্কুটগুলো একট শুঁকে দেখল টর্চধারী পুলিশটা। এভাবে চটের বস্তা থেকে শুরু করে কাঠের ক্রেটগুলোও বাদ গেল না। সবকিছু দেখা শেষে পুলিশটা নেমে গেল। মোজাম্মেল ও লরির পেছনের দিকটা লাগিয়ে দিয়ে নিচে নামলো। আফজাল আলী শেষ হওয়া সিগারেটের ফিল্টারটা ফেলে দিয়ে বললেন, “আমার দুইজন লোক যাবে। ওদের শহরে নামায়ে দিস।”
মোজাম্মেল মাথা নাড়ল। তাঁবুর পেছন থেকে দুইজন পুলিশ তার লরিতে উঠে পড়ল। এদেরকে মোজাম্মেল এতক্ষণ খেয়াল করেনি। অন্ধকারে দুজনের মুখও দেখতে পেল না মোজাম্মেল। মোজাম্মেল বিদায় নিয়ে আবার লরি স্টার্ট দিল। জ্বলে উঠল লরির হলুদ দু’জোড়া চোখ।
আরোহী দুইজনের সাথে কিছুটা আলাপ জমাতে চেয়েছিল মোজাম্মেল, আলাপ জমেনি। পুলিশ দুজন হ্যাঁ হু ছাড়া তেমন কোন উত্তরই দেয়নি। মূর্তির মতো বসে থেকেছে। মোজাম্মেলের স্বয়ংক্রিয় আলাপচারিতা তাই পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়নি। মোজাম্মেলের অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না।
প্রায় একঘণ্টা পরে লরিটা জেলা শহরের কাছাকাছি আসল। পুলিশ দু’জন পুলিশ লাইনসে নেমে গেল। মোজাম্মেল লরিটা নিয়ে সোজা চলে গেল জেলা সদর ক্যান্টনমেন্টে, যেখানে তার যাওয়ার কথা না। মুদিখানার মালামাল নিয়ে কেউ ক্যান্টনমেন্টে যায় না। ক্যান্টনমেন্টের মেইন গেটে লরি থামাতেই কর্তব্যরত গার্ডদেরকে মোজাম্মেল বলল, “প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প”। গার্ডরা গেট খুলে দিলে একেবারে ভেতরের একটা গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে মোজাম্মেল লরি পার্ক করল। গ্যারেজের দরজা টেনে দিল। গ্যারেজের লাইটগুলো জ্বালিয়ে আশেপাশে একবার দেখে নিল মোজাম্মেল। তারপর লরির পেছন দিকটা খুলল।
লরির পেছনের দুপাশের লোহার ফলস দেয়ালগুলো সরাতেই বের হয়ে এলেন ডঃ বশির জামান আর আটজন কয়েদী। তারপর সরিষার তেল ভর্তি ব্যারেলগুলো টেনে সরাতেই লরির নিচের ফাঁকা জায়গাটুকু থেকে বের হয়ে আসল বাকি পাঁচজন।
বশির জামান মোজাম্মেলের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “দারুন অভিনয়, মোজাম্মেল, শাবাশ।”
মোজাম্মেল বিনয়ে মাটির সাথে মিশে গেল প্রায়। সে লরির ড্রাইভার। তার কাছে এই প্রশংসাই অনেক। তার ওপর যখন বশির তার হাতে একটা টাকার বান্ডেলভর্তি খাম ধরিয়ে দিল, তখন মোজাম্মেলের মনে হল লোকটার পায়ে একটা চুমু খাওয়া উচিত। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই পেছন থেকে গুলির শব্দ হল। বদ্ধ গ্যারেজে শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয়ে আরও বিকট শোনাল। মোজাম্মেলের মৃতদেহটা ছিটকে পড়ল কয়েক ইঞ্চি দূরে। রক্তের ছিটা পড়ল।
মুনশী মোস্তাক হাতের আগ্নেয়াস্ত্রটা তার পরনের কয়েদীর ইউনিফর্মে ঘষে মোজাম্মেলের নিথর শরীরটার দিকে তাকিয়ে থাকল। তেরোজন কয়েদীদের ভেতরে সে একজন। একসময় ব্যাঙ্ক জালিয়াতিতে তার নাম ছিল প্রথম সারিতে। তারপর সরাসরি ব্যাঙ্ক লুট করা শুরু করে। নিজের লুট করা টাকার একটা অংশে সে পেশাব করত। তেরোটা হত্যা মামলার আসামীও মুনশী। এতক্ষণে যেন সে একটা মজার জিনিস করতে পেরেছে এমনভাবে সে দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
বশির জামান কয়েদীদেরকে ইশারায় লাশটাকে সরিষার তেলভর্তি ব্যারেলে ভরে ফেলতে বললেন।
তারপর মোবাইল বের করে বললেন, “ মেজর জেনারেল, মিশন সাকসেসফুল। আমি একটু পরে ওদেরকে নিয়ে তাকিয়া মহলে আসছি। আপনি থাকছেন তো?”
শুরু হল প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প।
পরদিন ভোর বেলা শংকর সাহেবের বাসায় পুলিশ আসল। দরজায় তালা ঝুলতে দেখা গেল। শংকর সাহেবের স্ত্রী আর কন্যা কোথায় গিয়েছে? কেউ জানে না।
পাহাড়ি শহরগুলোতে পুলিশ শিকারী কুকুরের মত শংকরের গন্ধ শুঁকতে লাগল। তার নামে সমন জারি করা হল। শহরের দেয়ালে দেয়ালে দেখা গেল পোস্টার যেখানে শংকরকে ধরিয়ে দিতে বলা হচ্ছে।
এই ঘটনার পরে কেটে গেল পাঁচটি বছর।