অভিধানের ইতিকথা
অভিধান বা শব্দকোষ। খুব মোটা একটি বই, জায়গা জুড়ে থাকে অনেকখানি। বইটিতে কোনো গল্প থাকে না, ছড়া থাকে না। থাকে শব্দের পর শব্দ; বর্ণনাক্রমিকভাবে সাজানো। প্রথমে থাকে ‘অ’ দিয়ে যে-সব শব্দ শুরু, সেগুলো; তারপর ‘আ’ দিয়ে যে-সব শব্দ শুরু, তারপর ‘ই’ দিয়ে শুরু। এভাবে বর্ণের ক্রম অনুসারে সাজানো থাকে শব্দ অভিধান। যে-গ্রন্থে শব্দের নাম, সংজ্ঞা বা উপাধি অর্থাৎ অভিধা অর্থাৎ অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়, তার নাম অভিধান। অভিধানের অন্য নাম শব্দকোষ। অর্থাৎ শব্দের ভাণ্ডার। অভিধানে সংকলিত হয় ভাষার শব্দরাজি। সব শব্দ কি থাকে? থাকে না। তবে বিপুল পরিমাণ শব্দ সংকলিত থাকে অভিধানে। অভিধান ব্যবহার করি আমরা প্রধানত শব্দের অর্থ জানার জন্যে। তবে শব্দের বানান, উচ্চারণ, শব্দটি এসেছে কোথা থেকে ইত্যাদি জানার জন্যেও ব্যবহার করি অভিধান। কারো কারো মনে হয় শব্দের বানান ও অর্থ সম্পর্কে শেষকথা লেখা আছে অভিধানে। অভিধান জানিয়ে দেয় শব্দের শুদ্ধ রূপ কী, শুদ্ধ বানান কী, শুদ্ধ অর্থ কী। অভিধান মানেই হচ্ছে শুদ্ধতা আর শুদ্ধতা। পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ ভাষারই অভিধান বা শব্দকোষ আছে। আছে বাঙলা ভাষারও।
আদি ও মধ্য যুগে সংকলিত হয় নি বাঙলা ভাষার কোনো অভিধান। দরকার পড়ে নি বাঙালির; দরকার পড়ে নি বাঙলার কবিদের। তখন বাঙলা ভাষার মানরূপ স্থির হয় নি, কোনো আগ্রহ-উৎসাহ দেখা দেয় নি মানরূপ স্থির করার। কোনো জাতি যখন তার ভাষার মানরূপ স্থির করতে উৎসাহী হয়, তখনি তার আগ্রহ জাগে অভিধান সংকলনের। ভাষার মানরূপ স্থির করার জন্যে প্রথমে দরকার হয় শব্দগুলোর রূপ ঠিক করা, তাদের বানান ঠিক করা, অর্থ ঠিক করা। এ-কাজ করা সম্ভব অভিধানের সাহায্যে। ইতালীয়রা, ফরাশিরা এ-কাজ করেছিলো একাডেমি প্রতিষ্ঠা ক’রে; আর ইংল্যান্ডে একজন ব্যক্তিই একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিধান সংকলন ক’রে অনেকখানি স্থির ক’রে দিয়েছিলেন ইংরেজি ভাষার মানরূপ।
আঠারোশতকেও বাঙলি কোনো প্রয়োজনবোধ করে নি আপন ভাষার মানরূপ স্থির করার। তাই অভিধানেরও কোনো প্রয়োজন বোধ হয় নি বাঙালি জাতির। আঠারোশতকের তৃতীয় দশকে একজন বিদেশি পর্তুগিজ—ধর্মযাজক ঢাকা জেলার ভাওয়ালে প্রচার করছিলেন জেসাসের ধর্ম। তিনি দরকার বোধ করেন একটি অভিধানের। বাঙলা তো তাঁর মাতৃভাষা ছিলো না যে তিনি মন থেকেই পাবেন এক একটি শব্দ ও বানান ও অর্থ। তিনি নিজের ও তাঁর শ্রেণীর ধর্মযাজকদের জন্যে সংকলন করেন একটি অভিধান। ওই ধর্মযাজকের নাম মনোএল দা আসসুম্পসাঁউ। তাঁর অভিধানের নাম “ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা, ই পর্তুগিজ”। এটি একটি দ্বিভাষিক অভিধান। এটির প্রথম অংশে দেয়া হয়েছে বাঙলা শব্দের পর্তুগিজ প্রতিশব্দ; আর দ্বিতীয় অংশে দেয়া হয়েছে পর্তুগিজ শব্দের বাঙলা প্রতিশব্দ। পাদ্রি আসসুম্পসাঁউর অভিধান লিসবন শহরে প্রকাশিত হয় ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে। এটিই বাঙলা ভাষার প্রথম অভিধান। আসসুম্পসাঁউ বাঙলা ভাষার প্রথম অভিধানপ্রণেতা। তাই অমর হয়ে আছেন এ-পাদ্রি বাঙলায়। তিনি শুধু অভিধান সংকলন করেন নি, অভিধানের সাথে জড়িয়ে দিয়েছিলেন একটি খণ্ডিত ব্যাকরণ। তাই আসসুম্পসাঁউ বাঙলা ভাষার প্রথম অভিধানপ্রণেতা, ও প্রথম ব্যাকরণরচয়িতা। পর্তুগালে তাঁর নাম মুছে গেছে; কোনো স্বর্গ নেই ব’লে সেখানেও বিরাজিত দেখা যাবে না দূর দেশের এ- পাদ্রিকে। কিন্তু বাঙলা ভাষা তাঁকে স্মরণে রাখবে।
বাঙলা ভাষার মানরূপ প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষ্য ছিলো না আসসুম্পসাঁউর। ভাওয়ালের যে-দরিদ্রের দরোজায় তিনি পৌঁছে দিচ্ছিলেন তাঁর করুণাময়ের করুণ শহীদ পুত্রকে, তাদের দরজা থেকে আসসুম্পসাঁউ সংগ্রহ করেছিলেন আঞ্চলিক সমাজের দৈনন্দিন শব্দ। লিপিবদ্ধ করেছিলেন ওইসব শব্দ রোমান অক্ষরে। তাই আঞ্চলিক শব্দে পূর্ণ তাঁর অভিধান ‘আকল’, ‘বাদাম’, ‘আলিয়া’, ‘আলগুছি’, ‘চামচারা’, ‘আটকল’, ‘আষ্ট’, ‘আজৈন’, ‘বাও’ প্রভৃতির মতো শব্দে ভ’রে আছে ওই অভিধান। তাঁর অভিধানটি বিশেষ প্রচারিত হয় নি। সেটি একটি গোপন গ্রন্থের মতো থেকে গিয়েছিলো পর্তুগিজ ধর্মযাজকদের মধ্যে। তাই এটি বাঙলা ভাষার বিকাশে কোনো ভূমিকা পালন করে নি।
এর পর ইংরেজরা দেখা দেন অভিধানপ্রণেতারূপে। আঠারোশতকের শেষ দশকে। তারা বাঙলা ভাষার উন্নতি সাধন আর বিকাশ ঘটানোর জন্যেই রচনা করেন অভিধান। তাঁদের বিশ্বাস ছিলো বাঙলা ভাষা সংস্কৃত ভাষার আধুনিক রূপ; আর ভারতের সব ভাষার মধ্যে বাঙলাই শ্রেষ্ঠ। তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে বাঙলা ভাষাকে উন্নত ভাষায় পরিণত করতে হ’লে উদারভাবে শব্দ ঋণ করতে হবে সংস্কৃত থেকে। অভিধানে তাঁরা সংকলন করেছেন প্রচুর পরিমাণে আটপৌরে শব্দ; কিন্তু সংস্কৃত শব্দ সংকলন করেছিলেন এতো বিপুল পরিমাণে যে তাদের ভেতর যেনো লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো দৈনন্দিন শব্দরাশি। তাঁরা অনেক শব্দের ভুল রূপকে শুদ্ধ রূপ মনে করেছিলেন, অনেক শব্দের দিয়েছিলেন ভুল অর্থ। কিন্তু তা তাঁদের কৃতিত্বের তুলনায় সামান্য। তাঁরাই প্রথম স্থির করতে উদ্যোগী হন বাঙলা শব্দের বানান, অর্থ নির্দেশ করার চেষ্টা করেন প্রাণপণে, আর সংস্কৃত থেকে ধার ক’রে বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে দেন বাঙলা শব্দের ভাণ্ডার। তাঁদের পরে যখন দেশি পণ্ডিতেরা বাঙলা ভাষার অভিধান সংকলনে উদ্যোগী হন, তখন বহুগুণে বেড়ে যায় সংস্কৃত শব্দ। মনে হয় তাঁরা যেনো বাঙলা ভাষার অভিধান সংকলন করতে ব’সে রচনা করেছিলেন সংস্কৃত ভাষার অভিধান। তাঁদের বহু শব্দ হয়তো কখনোই কেউ ব্যবহার করে নি; কিন্তু প্রচুর পরিমাণ শব্দ পত্রপত্রিকায়, সাহিত্যে ও চিন্তামূলক রচনায় ব্যবহৃত হয়ে গৃহীত হয়ে যায়। আঠারোশতকের শেষ ও উনিশশতকের প্রথমদিকের অভিধানপ্রণেতারা সচেতনভাবে পালন করেন বাঙলা ভাষার মানরূপ পরিকল্পনাকারীর ভূমিকা। তাঁদের ওই প্রচেষ্টা ছাড়া বাঙলা ভাষার বিকাশ এতো দ্রুত ঘটতো না।
‘ইংরাজ ও বাঙ্গালি লোকের সিখিবার কারণ এক বহি’ বেরোয় ১৭৯৩ অব্দে। ‘বহি’টির নাম ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালি বোকেবিলরি। এটি একটি বাঙলা-ইংরেজি শব্দকোষ বা অভিধান। অভিধানটির সংকলকের নাম মুদ্রিত হয় নি অভিধানে; মুদ্রিত হয়েছে প্রকাশকের নাম। কলকাতা থেকে প্রকাশ করেছিলেন আপজন সাহেব। এটিকেই ধরতে পারি বাঙলা ভাষার প্রথম পরিকল্পিত অভিধান ব’লে। এর কয়েক বছর পর, ১৭৯৯ ও ১৮০২ অব্দে, দু-খণ্ডে, বেরোয় বাঙলা ভাষার প্রথম উচ্চাশী অভিধান। সংকলক ছিলেন হেনরি পিটস ফরস্টার। দু-খণ্ডের বিশাল অভিধান এটি। প্রথম খণ্ডটি ইংরেজি-বাঙলা, আর দ্বিতীয় খণ্ডটি বাঙলা-ইংরেজি অভিধান। ফরস্টার উচ্চাশী ছিলেন; ভালোবেসেছিলেন বাঙলা ভাষাকে। তাঁর ইচ্ছে ছিলো বাঙলা ভাষাকে বিকশিত করার। প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন হেনরি পিটস ফরস্টার। তাঁর অভিধানের আকার, অক্ষরের রূপ দেখলেই বিস্মিত হ’তে হয়। ইংরেজি-বাঙলা অংশে তিনি একেকটি ইংরেজি শব্দ নিয়েছিলেন, আর একের পর এক দিয়েছেন তার বাঙলা প্রতিশব্দ। নির্দেশ করেছেন উচ্চারণ। বানানও অনেকটা স্থির করেছেন তিনি। কিছুকিছু প্রতিশব্দ হয়তো ভুল হয়েছিলো তাঁর; কোনোকোনো ক্ষেত্রে তিনি বিশুদ্ধ মার্জিত শব্দের পাশাপাশি বসিয়েছেন তথাকথিত অমার্জিত শব্দ। খুব শিউরে উঠতে হয় তাঁর অভিধান পড়ার সময়; তাতে মুখোমুখি হই এমন সব শব্দের, যাদের মুখোমুখি হওয়া এক চমৎকার অভিজ্ঞতা।
উইলিয়ম কেরি। স্মরণীয় তিনি বাঙলা গদ্যের ইতিহাসে, অবিস্মরণীয় বাঙলা অভিধানের ইতিকথায়। ফরস্টারের পর দেড় দশকের মধ্যে যখন বেরোয় উইলিয়ম কেরির বিশাল অভিধান, তখন নিশ্চয়ই বাঙলা ভাষা তাঁর দিকে তাকিয়েছিলো মুগ্ধ, বিস্মিত, কৃতজ্ঞ চোখে। কেরির অভিধানের নাম এ ডিকশনারি অফ দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ, ইন হুইচ দি ওয়র্ডস আর ট্রেসড টু দেয়ার অরিজিন, অ্যান্ড দেয়ার ভেরিয়াস মিনিংস গিভেন। এর প্রথম খণ্ড বেরোয় ১৮১৫-তে; দশ বছর পর ১৮২৫-এ বেরোয় দ্বিতীয় খণ্ড। কেরির অভিধান অনেক বেশি সুদৃশ্য ও সুশৃ খল ফরস্টারের অভিধানের চেয়ে। শব্দের পরিমাণও অনেক বেশি, বিচ্যুতিও অনেক কম। তিনি প্রায় স্থির ক’রে ফেলেন অধিকাংশ বাঙলা শব্দের সংস্কৃতানুসারী বানান। সে-কালের প্রধান গদ্যলেখকদের বানানে যে-অস্থিরতা দেখা যায়, তা নেই এ- অভিধানে। কেরি বহু শব্দ নিয়েছেন সংস্কৃত অভিধান থেকে, বহু শব্দ নিয়েছেন বাস্তব জীবন থেকে, এবং নিজে তৈরি করেছেন প্রচুর শব্দ। এমন অনেক শব্দ পাই তাঁর অভিধানে যা অভিধানে জায়গা পাওয়ার যোগ্য নয়, কেননা সেগুলো ব্যাকরণের সূত্র দিয়েই তৈরি করা যায়। কেরির অভিধান বেশ সুস্থিত ক’রে দেয় বহু বাঙলা শব্দের রূপ ও বানান; এবং আধুনিক বাঙলা মানভাষার বিকাশে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কেরি যদি বাঙালি হতেন, তাহলে প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন আরো বেশি। মহিমা পেতেন বাঙলা ভাষার প্রধান অভিধানপ্রণেতার। তাঁকে বলতাম বাঙলা অভিধানের জনসন।
উনিশশতক ছিলো অভিধানের শতাব্দী। দশকেদশকে বেরিয়েছে দ্বিভাষিক ও একভাষিক অভিধান; এবং বহুভাষিক অভিধানও বেরিয়েছে কয়েকটি। এসব অভিধান আনুশাসনিক; অর্থাৎ এগুলোর উদ্দেশ্য ছিলো বাঙলা শব্দের শুদ্ধ রূপ, বানান, অর্থ প্রভৃতি নির্দেশ করা। উনিশশতকে যখন গদ্য বিকশিত হচ্ছিলো রচনায় রচনায়, বাঙলা ভাষা অর্জন করছিলো মানরূপ, তখন এ-সমস্ত অভিধান সরাসরি সাহায্য করেছে বাঙলা ভাষার মানরূপ সুস্থিতিতে। কেরির পরে দুটি বিশাল অভিধান সংকলন করেছিলেন চার্লস গ্রেভস হটন ও রামকমল সেন। হটনের “এ ডিকশনারি, বেঙ্গলি অ্যান্ড স্যানসক্রিট” বেরিয়েছিলো ১৮৩৩-এ। রামকমল সেনের “ডিকশনারি ইন ইংলিশ অ্যান্ড বেঙ্গলি” বেরিয়েছিলো ১৮৩৪-এ। উনিশশতকে আর যাঁরা উল্লেখযোগ্য অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন, তাঁরা হলেন পীতাম্বর মুখোপাধ্যায় (১৮০৯), জন মেনডিস (১৮২২), জগন্নাথপ্রসাদ মল্লিক (১৮৩১), মথুরানাথ তর্করত্ন (১৮৬৩)। বিশশতকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অভিধান সংকলন করেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে উনিশশতকে বিভিন্ন অভিধান যে-ভূমিকা পালন করে বাঙলা ভাষার বিকাশে বিশশতকে তা পালন করে নি কোনো অভিধান। উনিশশতকে অভিধান ও বাঙলা ভাষার বিকাশ ছিলো ঘনিষ্ঠ ব্যাপার। বিশশতকে আর তা নেই। একটি অবিকশিত ভাষাকে অভিধান যতোটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বিকশিত ভাষাকে ততোটা পারে না।