অভিজিৎ এর সঙ্গে আমার পরিচয় আজ থেকে পনেরো-ষোলো বছর আগে। অভিজিৎ তখন সিঙ্গাপুরে থাকতেন। বেশ কয়েকদিনের আলাপে এবং ওঁর বেশ কিছু ব্লগ পড়ে আমি বুঝি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, বিবর্তন, দর্শন, ধর্ম, কুসংস্কার নিয়ে অভিজিৎ আর আমার বিশ্বাসের মধ্যে কোনও অমিল নেই। আমরা মূলত একই আদর্শের মানুষ। অভিজিৎ আমার লেখা বই আগেই পড়েছেন, সুতরাং নারীবাদ, মানববাদ এবং অস্তিত্ববাদে আমার বিশ্বাসের কথা তিনি জানতেন। মুক্তমনা নামে সবে একটা ব্লগ খুলেছেন তখন। মুক্তমনার জন্মটা একেবারে আমার চোখের সামনে। মুক্তচিন্তায় আর যুক্তিবাদে বিশ্বাসী যে কোনও মানুষই তাঁদের মত প্রকাশ করতে পারবেন মুক্তমনায়। এর চেয়ে চমৎকার ঘটনা আর কী হতে পারে, বিশেষ করে আমার কাছে, যার বাক স্বাধীনতা প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের প্রকাশকরা বই ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বই আজ বেরোয় তো বাংলাদেশে পরদিন সে বই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকেই দেশের সমস্ত পত্রপত্রিকা আমার লেখা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। তারা কি আমাকে ভুলে গিয়েছে, না, ভুলে যায়নি, ভুলে গেলে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেও ভুলে যেত, ও কিন্তু ভোলেনি। আমার মত অন্য অনেকের মতের চেয়ে ভিন্ন। এ কারণে আমাকে জীবন দিয়ে পোহাতে হয়েছে দুর্ভোগ। অভিজিতের মুক্তমনা আমার মত প্রকাশের জন্য ছিল খুব প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্ম। যে কথা আমি কোথাও বলতে পারিনি, সবসময় জানতাম সে কথা বলার জন্য একটি মাত্র জায়গা যদি কোথাও থাকে, সে মুক্তমনা। বিস্মিত আমি লক্ষ্য করি, আমি একা নই। অভিজিৎও একা নন। আমাদের মতের সঙ্গে আরও অনেক সাহসী উজ্জ্বল তরুণ-তরুণী একমত। সবাই বাঙালি। বেশির ভাগই বাঙালি-মুসলিম পরিবারের, কিন্তু ধর্মমুক্ত। আমি যে কী ভীষণ উত্তেজিত এবং উচ্ছ্বসিত ছিলাম মুক্তমনা নিয়ে! প্রগতিশীল কারও সঙ্গে দেখা হলে মুক্তমনার লেখাগুলো পড়তে এবং আলোচনায় অংশ নিতে অনুরোধ করতাম। পৃথিবীর অনেক মানুষের অনেক মতই অন্য অনেকের মতের চেয়ে ভিন্ন। বিভিন্ন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের বিভিন্ন মত প্রকাশ চলতে লাগলো মুক্তমনায়। মুক্তমনা দিন দিন সমৃদ্ধ হতে থাকে। বিস্তৃত হতে থাকে। একটা অশিক্ষিত মৌলবাদী মানুষের দেশ আমার দেশ — এই ভাবনাটি আমাকে মাথা নত করিয়েছিল, অভিজিতের ‘মুক্তমনা’ আমার নতমস্তক উঁচু করিয়েছে। ওই মুক্তমনার ব্লগগুলো, বিজ্ঞান আর দর্শন নিয়ে আলোচনাগুলো মানুষকে পড়তে দিয়ে আমি বলতে পেরেছি, আমার দেশেও শিক্ষিত সচেতন মানুষ আছেন, বুদ্ধিজীবী আছেন, বিজ্ঞানী আছেন, দার্শনিক আছেন, ধর্মমুক্ত, কুসংস্কারমুক্ত, চিন্তক, ভাবুক আছেন। ওই সময় ইংরেজিতে লেখা হতো ব্লগ। পরে পাশাপাশা বাংলা শুরু হল। ধীরে ধীরে লক্ষ্য করেছি, বাঙালি ছাড়াও ভিনভাষী বিজ্ঞানমনস্ক নিরীশ্বরবাদী অাসছেন মুক্তমনায়।
অভিজিৎ রায় বয়সে আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের ছোট। কিন্তু স্নেহ নয়, ওঁকে আমি সবসময় শ্রদ্ধা করেছি। বিজ্ঞানের এবং দর্শনের যে সব কঠিন জটিল খুঁটিনাটি সাধারণের পাঠযোগ্য করে অভিজিৎ একের পর এক বই লিখে গেছেন, আমার পক্ষে সেসব লেখা কখনোই সেসব সম্ভব হতো না। অভিজিৎ রায়ের মতো ধৈর্য আর ধীশক্তি আমার নেই। ওঁর সঙ্গে কখনও আমার সামনাসামনি দেখা হয়নি। এই তো গত বছরের ডিসেম্বরে যখন ফোনে কথা হলো, আমি তখন নিউইয়র্কে। অভিজিৎ অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে কথা বলার পর বললেন জর্জিয়ায় ওঁর বাড়িতে বেড়াতে যেতে। একবার কয়েকদিনের জন্য সত্যি যাবো, কথা দিয়েছিলাম। অভিজিৎ আর তাঁর স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা হবে ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম এ বছরের গ্রীষ্মে নয়তো শরতে। অভিজিতের সঙ্গে যে আমার কখনও আর দেখা হবে না, অভিজিৎ যে এই পৃথিবীতে আর মাত্র মাস তিনেকও নেই, তা কি আমি জানতাম! তা কি আমার চরম দুঃস্বপ্নের মধ্যেও ছিল! অভিজিতের সঙ্গে দেখা না হলেও ওঁর বাবা অজয় রায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমার কলকাতার বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। সজ্জন, সচেতন, উদার, আদর্শবান শিক্ষাবিদ মানুষটির স্নেহ এবং সমর্থন আমি অনেককাল থেকে পাচ্ছিলাম। আমার যে কোনও দুর্যোগে দুঃসময়ে তিনি আমার পাশে দাঁড়াতেন। আমার জন্য দুশ্চিন্তা করতেন। আমাকে না আবার হাতের কাছে পেলে কুপিয়ে মেরে ফেলে হিংস্র বর্বর মৌলবাদীর দল। মৌলবাদীর দল মেরেছে কুপিয়ে, তবে আমাকে নয়, হাতের কাছে পেয়েছে ওরা আমার চেয়েও বেশি প্রতিভাবান, আমার চেয়েও বেশি জ্ঞানী যুক্তিবাদী অভিজিৎ রায়কে, অজয় রায়ের হীরের টুকরো ছেলেকে।
এখনও আমার কাছে এ অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা যে অভিজিৎ নেই। তাঁকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে মেরেছে ইসলামী মৌলবাদীরা। আমি ওদের দুর্বৃত্ত বলছি না, ইসলামী মৌলবাদী বলছি। জেনেবুঝেই বলছি। ইসলামী মৌলবাদীরাই অভিজিৎকে দু’তিন বছর যাবৎ খুন করার হুমকি দিচ্ছিল ফেসবুকে। ফেসবুক থেকে খুনীদের নাড়ি-নক্ষত্র বের করে ফেলা এবং এদের গ্রেফতার করে ফেলা সরকারের জন্য মাত্র হয়তো কয়েক মিনিটের কাজ। কিন্তু দু’দিন কেটে গেলো আজও কেউ গ্রেফতার হয়নি। প্রধানমন্ত্রীও জনসমক্ষে এই বীভৎস মৃত্যু নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন না। সিসিটিভির ফুটেজও দেখানো হলো না। বাংলাদেশের এই নোংরা রাজনীতিকে আমি ঘৃণা করি।
কোটি মানুষের ভিড়ে-অন্ধকারে অভিজিৎ ছিলেন আলো হাতে দাঁড়িয়ে। অভিজিৎ বিদেশে থাকতেন বটে, কিন্তু তিনি বাংলায় বই লিখতেন, ব্লগ লিখতেন, ফেসবুক লিখতেন। অশিক্ষিত আর অজ্ঞানকে জ্ঞান দিতেন, শিক্ষিত করতেন। লিখেছেন আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, অবিশ্বাসের দর্শন, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব, স্বতন্ত্র ভাবনা এরকম অনেক মূল্যবান গ্রন্থ। অভিজিৎ রায় বাংলা আর বাঙালির জন্য ছিলেন অমূল্য সম্পদ। বাংলাদেশের ধর্মান্ধদের সেকথা বোঝার কোনও কথা নয়। কিন্তু সরকারের সে কথা বোঝা উচিত ছিল। সরকারের উচিত ছিল অভিজিতের জন্য কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। অভিজিৎ এবার তাঁর মা’কে দেখতে গেছেন দেশে, আর দেখতে গেছেন বইমেলা, তাঁর দুটো বই এবারের মেলায় বেরিয়েছে। যে কোনও বাঙালি লেখককের জন্য বাংলা বইমেলার আকর্ষণ অদম্য। আমি দুই বাংলা থেকেই বিতাড়িত এক বাঙালি লেখক, দুই বাংলার কোনও বইমেলায় যাওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। আমি বুঝি আমি কী হারাচ্ছি। বাংলার দুর্ভাগা কূপমণ্ডুকরা তাদের অমূল্য সম্পদকে শুধু পায়ে ঠেললোই না, কুপিয়ে মেরে ফেললো। শুনেছি মুসলিম মৌলবাদীরা নাকি বলেছে, ‘অভিজিৎ হিন্দু ছিল, মুসলমানের ধর্ম নিয়ে নিন্দা করেছিল, মরেছে, বেশ হয়েছে।’ আবার ভারতের কিছু হিন্দু মৌলবাদী বলছে, ‘ঢাকার রাস্তা রাঙা হয়েছে হিন্দুর রক্তে। মুসলিমরা মেরে ফেলেছে অভিজিৎ রায় নামের এক হিন্দুকে’। ভুল সংশোধনটা এখনই হয়ে যাক। অভিজিৎ রায় হিন্দু ছিলেন না। হিন্দু ছিলেন না অভিজিৎ। অভিজিৎ হিন্দু ছিলেন না। অভিজিৎ রায় হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। অভিজিৎ ছিলেন সকল ধর্মমুক্ত বিশুদ্ধ পবিত্র মানুষ, মানববাদী। আমি যেমন মুসলমান নই, আমি যেমন মানববাদী।
পৃথিবীকে সুস্থ-সুন্দর বাসযোগ্য করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন অভিজিৎ রায়। এরকম নিঃস্বার্থ সবাই হয় না, হতে পারে না। একদিন অভিজিৎ আমার কাছে আসিফ মহীউদ্দিনের ওপর যা যা লিখেছি, সব চাইলেন। তিনি অনেকের লেখা জড়ো করে, অনেকের উদ্ধৃতি দিয়ে, অনেকের সই নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। পৃথিবীর সব মুক্তমনা মানববাদীকে আসিফের ব্যাপারে জানিয়েছিলেন অভিজিৎ, অনুরোধ করেছিলেন আসিফকে মৌলবাদীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনার জন্য। আসিফের ওপর মৌলবাদী আর সরকারি হামলার পর আমি ইংরেজিতে এবং বাংলায় কিছু ব্লগ লিখেছিলাম ওর সমর্থনে। আসিফকে বাঁচানোর জন্য আমি আর কী করেছি, অভিজিৎ করেছেন শতগুণ। আসিফ আজ অনিরাপদ দেশ থেকে বেরিয়ে একটি নিরাপদ দেশে বাস করছে, সেখানে বসে ও নিশ্চিন্তে ভাবতে পারছে, লিখতে পারছে, এর পেছনে অভিজিতের অবদান সম্ভবত প্রায় সবটুকুই। আসিফ বেঁচেছে। অভিজিৎ নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। আমরাও পারিনি অভিজিৎকে বাঁচাতে। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অন্যকে বাঁচানোর জন্য পৃথিবীতে বেঁচে থাকেন, নিজেকে বাঁচানোর জন্য নয়। অভিজিৎ রায় ছিলেন সেরকম দুর্লভ একজন মানুষ।