অভার্স
দুশ্চিন্তায় সমস্ত রাত থিয়োর চোখে একফোঁটা ঘুম ছিল না। সকাল হতে-না-হতেই সে তৈরি হয়ে নিল, ট্রেনের সময়ের দু-ঘণ্টা আগে থাকতে রওনা হল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। শিশুটিকে নিয়ে বাড়িতে রইল জোহানা। বাড়ির চারতলার ছাদে উঠে সামনের কালো ঝাঁকড়া গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে অপেক্ষা করতে লাগল জোহানা, কখন বাড়ির সামনে দুই ভাইকে নিয়ে গাড়ি এসে থামবে!
স্টেশন থেকে থিয়োর বাড়ি দূর কম নয়। জোহানার মনে হতে লাগল সময় আর কাটে না, অপেক্ষার আর শেষ নেই। শেষ পর্যন্ত খোলা একটা গাড়ি বাঁক ঘুরে রাস্তায় ঢুকল, চোখে পড়ল দুটি উজ্জ্বল মুখ, আরোহীরা হাত নাড়ছে তার দিকে চেয়ে।
থিয়োর পেছনে পেছনে সপদদাপে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ভিনসেন্ট। জোহানা ভেবেছিল থিয়োর ভাই বুঝি হবে কোনো দুর্বল আধোশয্যাশায়ী রোগী। ভিনসেন্ট দৃঢ় বাহুতে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করল, কোথায় সেই রোগী? সমর্থ দেহ, চমৎকার গায়ের রং, হাসিমুখ, চোখে প্রতিভার দৃঢ় দৃষ্টি।
প্রথম দৃষ্টিতেই জোহানার মনে হল—ভিনসেন্টের তো দেখি আমার স্বামীর চাইতেও অনেক সুস্থ সমর্থ চেহারা!
খালি তার ডান কানটার দিকে জোহানা কিছুতেই চোখ তুলে চাইতে পারল না। জোহানার হাত দুটো দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে আর তার মুখের দিকে সপ্রশংস চোখে চেয়ে ভিনসেন্ট বললে—বাঃ, চমৎকার বউ জোগাড় করেছ দেখছি হে থিয়ো!
থিয়ো হেসে বললে—তা-ই নাকি? সত্যি বলছ?
থিয়োর পছন্দ তার মায়েরই ধাঁচের মেয়ে। আনা কর্নেলিয়ার ছিল যেমন মৃদু করুণ ব্রাউন রঙের চোখ, মুখে যেমন স্নেহ সহানুভূতির মিষ্টি ভাব, জোহানারও ঠিক তেমনি। এর ওপর আবার সবে মা হয়েছে, মেদুর মাতৃমূর্তিতে আরও তাকে মানিয়েছে। সুঠাম তার দেহশ্রী, গোল গোল মুখটি, উঁচু ডাচ-কপালের ওপর দিয়ে একরাশ ফিকে হলুদ চুল পেছন দিকে টান টান করে বাঁধা। থিয়োকে সে ভালোবাসে, সেই ভালোবাসাকে সে বিস্তৃত করেছে থিয়োর ভাই ভিনসেন্টের ওপরেও।
থিয়ো ভিনসেন্টকে শোবার ঘরে টেনে নিয়ে গেল, খোকা সেখানে দোলনায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। দোলনার ধারে দাঁড়িয়ে ছলোছলো চোখে ভিনসেন্ট থিয়োর শিশুটিকে দেখতে লাগল। জোহানা বুঝল দুই ভাইয়ের কিছুক্ষণ একলা থাকা দরকার। পা টিপে টিপে সে বাইরে গেল। ভিনসেন্ট তার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললে—ও বোন, শুনছ? বাচ্চাকে অত সিল্ক আর লেস দিয়ে সাজিয়ো না, লোকের নজর লাগবে।
জোহানা চলে যেতে ভিনসেন্ট আবার অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে রইল শিশুটির মুখে। হঠাৎ কেমন একটা ব্যথার গুঞ্জরন উঠল বুকে—নির্বংশ সে, সংসারহীন, সন্তানহীন, তার রক্তধারাকে বহন করবে না কোনো বংশধর, তার মৃত্যুতে হবে একান্ত নির্বাপিত শিখা।
থিয়ো ভাইয়ের মনের কথা বুঝি বুঝতে পারল।
বললে—তোমারও সময় আছে ভিনসেন্ট। মনের মতো স্ত্রী তুমিও একদিন পাবে, যে হবে তোমার দুঃখসুখের সঙ্গিনী।
হাসল ভিনসেন্ট—না ভাই, সে আর হয় না। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
এই তো সে-দিন একটি মেয়ের খবর পেলাম, যে একেবারে তোমার উপযুক্ত সঙ্গিনী হবার মতো।
কে সে?
তুর্গেনিভের উপন্যাসের এক নায়িকা।
ও বাবা! ওই যারা সব নিহিলিস্টদের দলে নাম লেখায়, আর বেআইনি কাগজ লুকিয়ে লুকিয়ে চালান করে, তাদের মতো কোনো মেয়ে?
হ্যাঁ। তোমার যে স্ত্রী হবে, তার অনেকটা ওইরকম মেয়ে হওয়াই দরকার, অতলস্পর্শী দুঃখবেদনার অভিজ্ঞতা যার আছে—
আর আমার মতো পুরুষকে নিয়ে সে করবে কী? যার এক কান কাটা? কথা আর এগুলো না। বাচ্চা ভিনসেন্ট চোখ মেলল, হাসল তাদের দিকে চেয়ে। থিয়ো দোলনা থেকে তাকে তুলে নিয়ে ভিনসেন্টের হাতে দিল।
বুকের কাছে শিশুটিকে ধরে আপন মনে ভিনসেন্ট বললে—কী নরম, কী গরম, ঠিক যেন ছোট্ট কুকুরছানাটি!
দুর বোকা! আরে, কী করে বাচ্চা ধরতে হয় তাও জান না?
কী করে জানব বলো? জানলাম তো খালি তুলি ধরতে।
থিয়ো ছেলেকে নিয়ে কাঁধের কাছে ওর মাথা রাখল, বাচ্চার কোঁকড়া চুলগুলি মিশে গেল নিজের মাথার চুলে। ভিনসেন্টের মনে হল, পিতা আর প্রথম সন্তান, ওরা যেন একই পাথরে কোদা দুটি মূর্তি।
একটা নিশ্বাস ফেলে মুক্তির হাসি হেসে ভিনসেন্ট বললে—বাঃ, চমৎকার দেখাচ্ছে! আমার কী মনে হল জানো? যার যা মিডিয়ম তা-ই নিয়েই তার কাজ। আমার মিডিয়ম রং, তোমার মিডিয়ম সংসার। আমি সৃষ্টি করি ছবি, তুমি সৃষ্টি কর জীবন্ত মানুষ, কী বলো?
ঠিক বলেছ ভিনসেন্ট, বেশ বলেছ।
রাত্রি বেলা ভিনসেন্টের সঙ্গে দেখা করতে কয়েক জন পুরোনো বন্ধু এল থিয়োর ওখানে। সর্বপ্রথম এসে পৌঁছোল শিল্পসমালোচক অরিয়ার। সুপুরুষ যুবা, কোঁকড়া চুলের বাবরি, দাড়ি, থুতনির কাছটা পরিষ্কার। ভিনসেন্ট অরিয়ারকে নিয়ে গেল থিয়োর শোবার ঘরে। সেখানকার দেয়ালে মস্তিচেলির আঁকা একটি পুষ্পস্তবকের ছবি।
ভিনসেন্ট বললে—আপনি আপনার প্রসঙ্গে বলেছেন, মশিয়েঁ অরিয়ার, প্রকৃতির অন্তর্নিহিত প্রাণরহস্যকে আমিই প্রথম উপলব্ধি করেছি। এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি। মন্তিচেলির ছবির কথা মনে করুন—
ঘণ্টা খানেক তর্ক করেও ভিনসেন্ট অরিয়ারের মত বদলাতে পারল না। তখন তাঁর প্রবন্ধের জন্যে শেষ ধন্যবাদ দিয়ে তাঁকে উপহার দিল নিজের আঁকা সেন্ট রেমির একটি ছবি।
হইহই করে ঢুকল তুলস লোত্রেক। সিঁড়ি ভেঙে ওঠার পরিশ্রমে সে হাঁপাচ্ছে, তবু প্রাণটা ফুর্তিতে ডগমগ, মেজাজটার কোনো পরিবর্তন হয়নি এতদিনে।
ভিনসেন্টের সঙ্গে করমর্দন করতে করতে লোত্রেক হেঁকে উঠল—আরে ভিনসেন্ট, সিঁড়ির গোড়াতেই কার সঙ্গে দেখা হল জানো? এক ব্যাটা কফিন–বানানেওলা। বলো তো, লোকটা কার খোঁজে এসেছিল—তোমার না আমার?
তোমার লোত্রেক, তোমার! আমি ওর খদ্দের হতে যাব কেন এরই মধ্যে?
বটে? আচ্ছা বাজি ধরো, কে আগে ওর খদ্দের হবে, তুমি না আমি!
বেশ, রাজি আছি। বাজিটা কী, বলো?
বাজি? কাফে এথেন্সে এক-পেট খাওয়া আর তারপর সন্ধে বেলা অপেরা।
থিয়ো অল্প হেসে বললে—আচ্ছা, তোমাদের ঠাট্টাগুলো কি এমনি অলক্ষুণে না হলেই নয়!
একটি অচেনা লোক ঘরে ঢুকে কোণের একটা চেয়ারে চুপ করে বসল। লোত্রেকের সঙ্গেই এসেছে। লোত্রেক কিন্তু লোকটিকে আলাপ করিয়ে দিল না কারুর সঙ্গে, নিজের খেয়ালে বকবক করেই চলল।
ভিনসেন্ট বললে—তোমার বন্ধুটিকে আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে না?
একগাল হেসে লোত্রেক বললে—বন্ধু? আরে ও আমার বন্ধু নয়, আমার রক্ষক।
কয়েক মুহূর্ত কেমন বেদনাকর স্তব্ধতা।
লোত্রেক বললে আবার—তুমি শোনোনি বুঝি ভিনসেন্ট? মাঝে কয়েক মাস আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সবাই বললে খুব মদ টানার ফলেই, তাই আজকাল স্রেফ দুগ্ধপানের ওপরই আছি। এবার আমার পার্টিতে যে-নিমন্ত্রণপত্রটা পাবে সেটা ভালো করে দেখো। ছবি আঁকা থাকবে তাতে যে তুলস লোত্রেক উঁচু হয়ে বসে দিব্যি হৃষ্টপুষ্ট একটি গাভীর দুধ দুইছে, তবে কিনা বাঁটের দিক থেকে নয়, অন্যদিক থেকে।
খুব জমে উঠল আসর। জবর আড্ডা, সারা ঘর তামাকের ধোঁয়ায় অন্ধকার। মাঝে মাঝে এর-ওর সামনে খাবারের ডিশ এগিয়ে ধরছে জোহানা। প্যারিসের অনেক পুরোনো স্মৃতি ভিনসেন্টের মনে ঘনিয়ে উঠল।
জর্জেস সিউরাতের খবর কী? কেমন করছে সে?
সে কী? তার খবরও বুঝি জান না?
না। থিয়ো তো কিছু লেখেনি।
যক্ষ্মায় সে তিলে তিলে মরছে। ডাক্তার বলেছে বড়োজোর একত্রিশটা বছর তার আয়ু।
যক্ষ্মা! সে কী? জর্জেসের স্বাস্থ্য যে ছিল চমৎকার! তার এ-রোগ কী করে হল?
অতিরিক্ত পরিশ্রমে। তুমি তাকে যা দেখেছিলে তার পর দু-বছরের বেশি গেছে। একেবারে দানবের মতো খেটেছে সে এই দু-বছর, সারাদিনে দু-তিন ঘণ্টা মাত্র ঘুম, বাকি সময় কাজ আর কাজ। অমন মা পর্যন্ত কিনা ওকে এই কালরোগের হাত থেকে ফেরাতে পারল না!
ভিনসেন্ট ভাবতে ভাবতে বললে—তাহলে, জর্জেস তাহলে চলল!
রুসো এল ভিনসেন্টের জন্যে এক ব্যাগভরতি ঘরে তৈরি খাবারদাবার নিয়ে। পিয়ের ট্যাঙ্গি এল ঠিক সেই আগের মতো গোল খড়ের টুপি মাথায় দিয়ে। ভিনসেন্টকে একটি জাপানি প্রিন্ট উপহার দিয়ে সে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে ছোট্টখাট্ট একটি মিষ্টি বক্তৃতাও দিয়ে ফেলল।
রাত দশটা নাগাদ ভিনসেন্ট পথে বার হয়ে এক ঝুড়ি অলিভ কিনে আনল। প্রত্যেককে সে অলিভ খাওয়াল জোর করে, এমনকী লোত্রেকের রক্ষককে পর্যন্ত।
উচ্ছ্বসিত গলায় সে বললে—থাকো তো তোমরা এই শহরের অন্ধকূপে! প্রভেন্সের রুপোলি সবুজ অলিভ কুঞ্জ একবার যদি চোখে পড়ত তাহলে সারা জীবন ধরে অলিভ ছাড়া আর কিছুই খেতে চাইতে না।
লোত্রেক চোখ টিপে বললে—হ্যাঁ, এই অলিভের কথাতেই মনে পড়ল। ওখানকার মেয়েদের কেমন লাগল বলো তো?
পরদিন সকাল বেলা থিয়ো আপিসে যাবার পর ভিনসেন্ট খোকার গাড়িটাকে একতলায় নামিয়ে দিয়ে এল। গাড়িতে শুয়ে মার সঙ্গে বেড়িয়ে বেড়িয়ে বাচ্চা ভিনসেন্টের এখন রোদ পোহানোর সময়। ভিনসেন্ট ঘরে ফিরে এসে সারা ফ্ল্যাটের দেয়ালগুলো দেখতে লাগল ভালো করে। সর্বত্র তার আঁকা ছবি টাঙানো। খাবার ঘরে ম্যান্টেলপিসের ওপর তার ‘আলুভোজীরা’, বসবার ঘরে ‘আর্লসের দৃশ্যপট আর ‘রোন নদীর ওপরে রাত্রি’, শোবার ঘরে ‘ফুটন্ত পুষ্পকুঞ্জ’।
এ ছাড়া খাটের তলায়, টেবিলের তলায়, আলমারির তলায়, মালপত্র রাখার ঘরে, যেখানে যেটুকু ফাঁকা জায়গা, সব ভরে আছে তার ছবির গাদায়।
থিয়োর ডেস্কে কী একটা জিনিস খুঁজতে গিয়ে সে দেখল মোটা ফিতে দিয়ে বাঁধা মস্ত এক বান্ডিল চিঠি। এ কী? সব চিঠি যে তার! বিশ বছর আগে প্রথম ঘর ছেড়ে যে-দিন সে হেগ-এ গুপিল কোম্পানিতে চাকরি করতে বার হয়েছিল সে-দিন থেকে আজ পর্যন্ত থিয়োকে যত চিঠি সে লিখেছে তার প্রত্যেকটি থিয়ো পর পর করে সাজিয়ে সযত্নে সঞ্চয় করে রেখেছে। সবসুদ্ধ সাতশো চিঠি। ভিনসেন্ট ভেবে পেল না তার এইসব পুরোনো চিঠি জমিয়ে রেখে থিয়োর কী লাভ।
ডেস্কের আর-একটা জায়গায় সে দেখল গত দশ বছর ধরে সে থিয়োকে যত ড্রয়িং পাঠিয়েছে সব কালানুক্রমিকভাবে তাড়া করে করে রাখা। বরিনেজের খনিশ্রমিক, ইটেনের মাঠের কৃষাণ-কৃষাণী, হেগ-এর বুড়ো-বুড়ি, গিস্ট-এর খেতমজুর, শেভেনিনজেনের জেলে, নিউনেনের আলুভোজী তাঁতি পরিবার, প্যারিসের রেস্তরাঁ আর রাস্তার দৃশ্য, আর্লসের সূর্যমুখীর কাঁচা স্কেচ আর সেন্ট রেমির বাগানের দৃশ্যাবলী, এসবের অসংখ্য ড্রয়িং আলাদা আলাদা দলে সুন্দর করে গুছিয়ে বাঁধা রয়েছে।
আরে, তাহলে আমার ছবির একটা প্রদর্শনী তো এখুনি লাগানো যায় দেখছি!
দেয়াল থেকে সব ছবিগুলো সে একে একে নামিয়ে নিল, খাট টেবিল প্রভৃতির নীচে থেকে টেনে টেনে বার করল তার সবগুলো বাঁধাই-না-করা ক্যানভাস। ডেস্কের স্কেচের তাড়াগুলোকেও বাদ দিল না। এইবার সমস্ত ছবিকে সে কালানুক্রমে ভাগ করে ফেলল। প্রত্যেকটি ভাগের মধ্যে খুব মনের মতো মনে হল যেসব স্কেচ বা তেলরঙের ছবি সেগুলো সযত্নে নির্বাচন করে আলাদা করে রাখল। ফ্ল্যাটে ঢোকবার পথে সামনের বারান্দায় সে টাঙাল বরিনেজের সাদা-কালো ড্রয়িংগুলো।
বললে—এটা হল প্রদর্শনীর চারকোলের কাজের বিভাগ।
বাথরুমের দেয়ালে সে পাশাপাশি টাঙাল ইটেনে আঁকা চারখানা পেনসিল স্টাডি।
এটা হল পেনসিল স্কেচের বিভাগ।
হেগ আর শেভেনিনজেনের জলরঙের ছবিগুলো সে টাঙাল রান্নাঘরে।
এটা হল তিন নম্বরের বিভাগ। জলরঙের ছবি।
পাশের ছোটো ঘরটার সামনে দেয়ালটার ঠিক মাঝখানে সে টাঙাল তার প্রথম সার্থক তৈলচিত্র, তার পুরোনো বন্ধু ডি গ্রুকদের ছবি—‘আলুভোজীরা’। তার আশেপাশে সে গোটা বারো নিউনেনের স্কেচ আঁটল, কয়েকটা গির্জার আর সমাধিক্ষেত্রের দৃশ্য, কয়েকটি কৃষাণ-কৃষাণীর ড্রয়িং।
নিজের শোবার ঘরে টাঙাল সব প্যারিসের ছবি। বসার ঘরের চারটে দেয়াল সে একেবারে ভরে দিল আর্লসের ছবি দিয়ে। আর থিয়োর শোবার ঘরে সে সাজাল তার সাম্প্রতিক কাজ—সেন্ট রেমির দৃশ্যাবলী।
এই বিচিত্র প্রদর্শনী সজ্জিত করার পর সে সারা বাড়ির মেঝে ভালো করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিজের হাত-মুখ ধুয়ে কোট পরে মাথায় টুপি চাপিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে নেমে গেল নীচে। বাচ্চা ভিনসেন্টের গাড়ি ঠেলে আর জোহানার সঙ্গে নানা গল্প করে কাটিয়ে দিল বেশ কিছুটা সময়।।
বারোটা বাজার একটু পরেই থিয়োর আবির্ভাব। দূর থেকে হাত নাড়তে নাড়তে সে দৌড়ে এল। পেরাম্বুলেটর থেকে বাচ্চাকে তুলে নিল কোলে। গাড়িটাকে নীচে দারোয়ানের জিম্মায় রেখে সবাই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ওপরের ফ্ল্যাটে।
দরজার সামনে পৌঁছোতেই পথরোধ করে দাঁড়াল ভিনসেন্ট। বললে—সাবধান, একটা দারুণ আশ্চর্য জিনিস দেখবার জন্যে প্রস্তুত হও! মহাশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গকের চিত্রপ্রদর্শনী!
কোথায়?
ম্যাজিক! চোখ বোজো দুজনে।
দরজাটা হট করে খুলে দিল। সবাই একসঙ্গে ঢুকল ফ্ল্যাটের মধ্যে। থিয়ো আর জোহানা চারদিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেল।
ভিনসেন্ট আবেগের সঙ্গে বললে—আমি যখন ইটেনে ছিলাম, মনে আছে বাবা একদিন বলেছিলেন—মন্দ থেকে ভালোর সৃষ্টি কখনও হতে পারে না। আমি তর্ক করেছিলাম, বলেছিলাম হতে পারে, শুধু তাই নয়, হতে বাধ্য। লক্ষ্মী আমার ভাই, আমার বোন, এসো আমার সঙ্গে তোমরা। দেখো আমার কথা সত্যি হয়েছে কি না। বিশ বছর আগে খেয়ালি একটা লোকের শিল্পী হবার বাসনা হয়েছিল, কিন্তু অক্ষম সে, নিতান্ত অশক্ত তার হাত, শিল্প সম্বন্ধে জ্ঞান শিশুর চাইতে বেশি নয়। তার বিশ বছরের জীবনের কাহিনি তোমাদের সামনে মেলে ধরেছি, বিচার করো তোমরা কতটা সে সার্থক হয়েছে।
একটার পর একটা ঘরে সে নিয়ে চলল প্রিয় দর্শক দুজনকে। একটা মানুষের সারাজীবনের প্রচেষ্টার ক্রমবিকাশ ভেসে উঠতে লাগল চোখের সামনে। শিল্পীর আত্মপ্রকাশের পথ কত কঠোর, কত বন্ধুর! সার্থকতার পথে কত বেদনা, কত বঞ্চনা! শিক্ষার্থীর দুরন্ত অধ্যবসায়, পদে পদে কত আঘাত, নিররলম্ব প্রচেষ্টার কত ব্যর্থতা স্পষ্ট প্রমাণিত রয়েছে প্রথম যুগের শিল্পচর্চার মধ্যে! প্রকাশশৈলী ও আদর্শবোধ নিয়ে এক বৈপ্লবিক বিবর্তনের ইতিহাস লেখা আছে প্যারিসের ছবিগুলির রঙিন রেখায়। আর্লসের ছবিতে জীবনদর্শনের উজ্জ্বলতম বলিষ্ঠতম উদারতম বিকাশ, তারপর প্রচণ্ড ভাঙনের পরিচয় সেন্ট রেমির ছবিগুলোতে। ভাঙছে, বাঁধ ভাঙছে চৈতন্যের। তবু বেঁধে রাখতে চেতনাকে, সংহত করে রাখতে আপন শিল্পপ্রতিভাকে সে কী উন্মত্ত প্রয়াস, সে কী মর্মন্তুদ আকৃতি! কিন্তু মধ্যাহ্নসূর্য যেমন ঢলে পড়েই, তেমনি ঢলে পড়ছে সৃষ্টির তুঙ্গধৃত গরিমা….. ঢলে পড়ছে, নিভে আসছে জ্যোতি….অপ্রতিরোধ্য তার নিম্নগামী গতি ধূসর দিগন্তের অমোঘ আকর্ষণে। অপরিচিত দর্শকের চোখ দিয়ে ওরা দেখে চলল ছবির পর ছবি, লাগল আধটি ঘণ্টা মাত্র, একটি মানুষের সারাজীবনের ইতিবৃত্ত ওরা পড়ল ওই ক্ষণস্থায়ী কালটুকুর মধ্যে।
.
দুপুর বেলাকার খাওয়া খেতে বসল দুজনে। জোহানা রেঁধেছে খাঁটি ব্রাবান্টের রান্না। ভিনসেন্টের মুখে অমৃতের আস্বাদ। বাসনপত্র টেবিল থেকে জোহানা সরাবার পর দু-ভাই পাইপ মুখে দিয়ে গল্প করতে বসল।
ডাক্তার গ্যাচেট যা বলেন, তাই শুনবে ভিনসেন্ট। একটুও অন্যথা করবে না।
নিশ্চয়ই থিয়ো।
মনে রেখো, ইনি স্নায়বিক অসুখের একজন বিশেষজ্ঞ। এঁর হাতে নিশ্চয়ই তুমি একেবারে ভালো হয়ে যাবে। আর-একটা ব্যাপার জান? গ্যাচেট ছবিও আঁকেন। প্রত্যেক বছর পি. ভ্যান রাইসেল এই ছদ্মনামে তাঁর ছবি ইন্ডিপেন্ডেন্টস গ্যালারিতে টাঙানো হয়।
আঁকেন কেমন? ভালো?
তা বলব না। তবে এক ধরনের লোক থাকে, অন্যের ক্ষমতাকে চিনে নেবার অদ্ভুত ক্ষমতা যাঁদের থাকে। এমনি লোকও বিরল। ডাক্তার গ্যাচেট এই ধরনের লোক। বিশ বছর বয়সে ইনি ডাক্তারি পড়তে প্যারিসে আসেন। কুর্বে, মুর্গার, প্রুধোঁ প্রভৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। তারপর আড্ডা জমে মানে, রেনোয়াঁ, ডেগা, ক্লড মনে প্রভৃতি শিল্পীদের সঙ্গে। ইম্প্রেশনিজমের নাম পর্যন্ত যখন কেউ জানত না, তখন এঁর বাড়িতে বসে দ্যবিনি আর দ্যমিয়ার ছবি এঁকেছে।
সত্যি বলছ?
হয় এঁর বাড়িতে নাহয় এঁর বাগানে বসে ছবি আঁকেনি কে? পিসারো, * গিলামিন, সিসলে, দেলাক্রোয়া অভার্সে এঁর কাছে গিয়ে থেকেছে, ছবির পর ছবি এঁকেছে। সেজান, লোত্রেক আর সিউরাতের তো কথাই নেই। এদের সবাইকার ছবি দেখবে বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে টাঙানো। আজকের দিনের এমন একজন নামকরা চিত্রশিল্পী পাওয়া দুষ্কর, ডাক্তার গ্যাচেট যার বন্ধু নন।
তুমি দেখছি আমাকে ভয় পাইয়ে দিলে হে! এইরকম সব ডাকসাইটে শিল্পী যার বন্ধু, সেখানে কিনা আমি—! আচ্ছা, আমার ছবি দু-একটা দেখিয়েছ?
বোকা কোথাকার। তোমাকে অভার্সে নিয়ে যাবার জন্যে ডাক্তার এত উদ্গ্রীব কেন বুঝতে পারছ না?
কী করে বুঝব?
আর্লসের রাত্রের যে-দৃশ্যগুলো গতবার ইন্ডিপেন্ডেন্টস প্রদর্শনীতে দিয়েছিলাম সেগুলো দেখে তো ডাক্তার গ্যাচেট পাগল! তাঁর মতে ওগুলো প্রদর্শনীর শ্রেষ্ঠ ছবি। এরপর তোমার হলদে সূর্যমুখীর ছবিগুলো তাঁকে দেখাই। বিশ্বাস করো, ভদ্রলোকের চোখে তো জল এসে গেল ওগুলো দেখে। আমাকে বললেন—ভ্যান গক, তোমার ভাই একজন বিরাট শিল্পী! চিত্রশিল্পের ইতিহাসে এর আগে কখনও ওই হলদে সূর্যমুখীর পাশে দাঁড়াবার মতো আর-কিছু আঁকা হয়নি। শুধু এই ছবি কটার জন্যেই তোমার ভাই অমর হয়ে থাকবে।
ভিনসেন্ট মাথাটা একটু চুলকে নিয়ে একগাল হাসল। বললে—আমার সূর্যমুখীগুলো যদি ডাক্তার গ্যাচেটের এতটা পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে মনে হচ্ছে তাঁর সঙ্গে আমার বনবে ভালো।
২
ডাক্তার গ্যাচেট নিজেই স্টেশনে এসেছিলেন ভিনসেন্ট আর থিয়োকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে। ছোটোখাটো চেহারা, নার্ভের ডাক্তার হলে কী হয়, নিজেই যেন অত্যন্ত নার্ভাস ধরনের লোক, ছোটো ছোটো ছলোছলো চোখ দুটি সদা ঔৎসুক্যে ভরা। আগ্রহভরে তিনি ভিনসেন্টের সঙ্গে করমর্দন করলেন।
বেশ বেশ ভায়া, বড়ো খুশি হলাম তুমি আসাতে। তোমারও খুব ভালো লাগবে জায়গাটা, এ একেবারে ছবি-আঁকিয়েদের মনের মতো গ্রাম। বাঃ! ইজেলটা সঙ্গে এনেছ দেখছি! যথেষ্ট রংও এনেছ তো? দেরি করলে কিন্তু চলবে না। চটপট আঁকা শুরু করতে হবে। তারপর সন্ধে বেলা আমার সঙ্গেই ডিনার খাবে, কেমন? নতুন ছবি কিছু এনেছ তো? দেখাতে হবে কিন্তু। ভালো কথা, আর্লসের মতো অমন হলুদ রংটি এখানে পাবে না, তবে হ্যাঁ, অন্য জিনিস, অনেক অন্য জিনিস মিলবে তোমার। আমার বাড়িতে এসেও আঁকতে হবে। জান, আমার ওখানে এমন সব কয়েকটা মজার জিনিস আছে, যা দ্যবিনি থেকে লোত্রেক পর্যন্ত এমন আর্টিস্ট নেই যে আঁকেনি। তুমিও ভায়া আঁকবে সেগুলো… শরীরটা যাই বলো বেশ ভালোই দেখাচ্ছে তোমার। হুঁ, তারপর ক-টা মাস এখানে কাটাও না! একেবারে চাঙা করে তোমাকে ছেড়ে দেব আমি। কী বলো থিয়ো?
স্টেশন প্ল্যাটফর্ম থেকেই দেখা যায় নদী, অদূরে বয়ে চলেছে শ্যামলা উপত্যকার ওপর দিয়ে। কয়েকটি গাছের ফাঁক দিয়ে ভিনসেন্ট দৃশ্যটা দেখতে লাগল। এই অবসরে নীচু গলায় থিয়ো বললে—আমাকে আপনি কিন্তু ঠিকমতো কথা দিন ডাক্তার গ্যাচেট, আমার ভাইয়ের ওপর আপনি খুব নজর রাখবেন। যখনই দেখবেন কোনোরকম মানসিক উপসর্গের লক্ষণ আবার ওর মধ্যে ফুটে উঠেছে তক্ষুনি আমাকে তার করবেন। আমি নিজে এসে থাকব ওর সঙ্গে। লোকে বলে, সত্যি ও নাকি
ছাগলদাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে অসহিষ্ণু গলায় ডাক্তার বললেন, আরে রাখো, রাখো! কী বললে? পাগল তো! নিশ্চয় পাগল। কী হয়েছে তাতে? সব আর্টিস্টই একটু-না-একটু পাগল, পাগল বলেই ওরা শিল্পী, পাগল বলেই ওদের আমি ভালোবাসি। সময় সময় আমার মনে হয়, আমিও যদি অমনি পাগল হতে পারতাম! ‘যে-চরিত্র সত্যিকারের অসাধারণ, তার মধ্যে কিছু-না-কিছু উন্মত্ততা থাকবেই।’ কার কথা জান? অ্যারিস্টটলের।
আমি বুঝি, ডাক্তার। তবে কী জানেন? বয়েস ওর বেশি নয়, সবে সাঁইত্রিশ। সারাটা জীবন ওর সামনে।
ডাক্তার গ্যাচেট মাথা থেকে অদ্ভুতদর্শন টুপিটা খুলে ক-বার তাঁর মাথার এলোমেলো চুলে দ্রুত আঙুল চালিয়ে নিয়ে বললেন—আমার হাতে যখন ছেড়ে দিয়েছ তখন আর ভাবনা নেই। শিল্পীদের ধাত আমার জানা আছে, এক মাসের মধ্যে ওকে আমি নতুন মানুষ করে তুলব। অসুখের সমস্ত দুর্ভাবনা এখুনি ওর মন থেকে তাড়িয়ে দেব। আজ বিকেলেই আমার বাড়িতে ওকে কাজে লাগিয়ে দেব। বলব আমার একটা পোর্ট্রেট আঁকতে। কাজ করলেই সেরে উঠবে ঠিক।
ভিনসেন্ট পায়ে পায়ে এগিয়ে এল কাছাকাছি। গ্রামাঞ্চলের পরিচ্ছন্ন পার্বত্য বাতাস তার নিশ্বাসে। বললে সে—জো আর বাচ্চাটাকে তোমার এখানে নিয়ে আসা উচিত থিয়ো। শহরে বসে ছেলেপুলে মানুষ করা পাপ!
গ্যাচেট চেঁচিয়ে উঠলেন—ঠিক, ঠিক। ধরো, রবিবার। ছুটির দিনে তোমরা সবাই এখানে এসে আমাদের সঙ্গে সারাদিন কাটাবে।
ধন্যবাদ ডাক্তার। বেশ তো, নিশ্চয়ই। আচ্ছা, আমার ফিরতি ট্রেন এল। চলি আমি। ভিনসেন্টকে দেখবেন ডাক্তার। আর হ্যাঁ, তুমি রোজ আমাকে এক লাইন করে চিঠি লিখবে। ভুলো না।
ভিনসেন্টের বাহুমূল ধরে তাকে ঠেলতে ঠেলতে ডাক্তার গ্যাচেট এগোলেন। নার্ভাস গলায় বকবক করা তাঁর স্বভাব। উত্তরের প্রত্যাশা করেন না। নিজের মনেই কথার জাল বুনে চলেন।
এই যে রাস্তাটা দেখছ, এটা সোজা একেবারে গ্রামে চলে গেছে। না, এ–রাস্তায় না। চলো, ওই পাহাড়ের ওপর উঠলে চারিদিকের দৃশ্যটা চমৎকার দেখতে পাবে। ইজেল পিঠে নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না তো? ওই দেখো বাঁ-দিকে, ওটা ক্যাথলিক গির্জে। লক্ষ করেছ যে ক্যাথলিকরা সবসময় পাহাড়ের ওপর গির্জে বানায়, লোককে যাতে মুখ উঁচু করে তার দিকে তাকাতে হয়। নাঃ, সত্যি দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, এই খাড়াইটুকু উঠতে আজকাল কষ্ট হয়। চারিদিকে কী চমৎকার শস্যের খেত দেখছ? এই চাষের খেত অভার্স গ্রামটাকে ঘিরে রেখেছে। হ্যাঁ, প্রভেন্সের মতো অত হলুদ এ-খেত নয় তা ঠিক, তবু এই দৃশ্য তোমাকে আঁকতে হবে, হবে না? এইবার পাহাড়ের মাথায় ওই ডান দিকে দেখো, ওটা হচ্ছে সমাধিক্ষেত্র, সুন্দর জায়গাটা না? আচ্ছা, যে মরেছে তার দেহটা কোথায় কবর দেওয়া হবে তাতে এমন-কিছু এসে যায় না, না? তবু মৃতের প্রতি সম্মান বলে একটা কথা আছে। সমাধিক্ষেত্রের জন্যে বেছে বেছে সবচেয়ে মনোরম জায়গাটা আমরা ঠিক করেছি। চলো না ভেতরে। হ্যাঁ, গেটটা ঠেলে খোলো। দেখো, সমস্ত খোলা উপত্যকাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল, তা-ই না? আর ওই দেখো আমাদের মিষ্টি নদীটা —
ডাক্তার গ্যাচেটের কথার তোড় থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে ভিনসেন্ট কাঁধ থেকে ইজেলটা নামিয়ে তাড়াতাড়ি গেট পার হয়ে এগোল। ঠিক একেবারে পাহাড়টার মাথায় দেয়াল-ঘেরা চৌকো একটুকরো জায়গা। একটা দিকে ঢালু বেয়ে গড়ানো। এইটেই গ্রামের সমাধিক্ষেত্র। সত্যিই ভারি অপূর্ব স্থানটি। পেছনের দেয়ালের ও-পারে চোখের সামনেই অইস নদী। ছায়াঘেরা সবুজ রঙে জলরেখা শস্যশ্যামলা উপত্যকার মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা গতিতে চলেছে। যত দূরে চোখ যায়, স্রোতস্বিনীর দুটি তীর শ্যামায়িত। ডান দিকে উতরাই ছাড়িয়ে গ্রাম, বাড়ির সব ছাদ খড়ে ছাওয়া। অনতিদূরে আর একটি অনুরূপ উঁচু টিলা, তার মাথায় পুরোনো একটা পাকা বাগানবাড়ি। ছোট্ট সমাধিক্ষেত্রটি আলো হয়ে আছে মে মাসের প্রসন্ন সূর্যালোকে আর নববসন্তের রংবাহার কুসুমসজ্জায়। আকাশ জুড়ে পেলব নীলিমা। দিগন্তঘেরা অনির্বচনীয় প্রশান্তি, সে-প্রশান্তি সত্যিই যেন সমাধিপ্রান্তরের।
ভিনসেন্ট বললে—দক্ষিণ ফ্রান্সে যে গিয়েছিলাম তা ভালোই হয়েছিল, ডাক্তার গ্যাচেট। সেইজন্যে উত্তর দিকের দেশটা আবার নতুন করে চোখে ফুটে উঠছে। দেখুন, ওই দূর নদীতীরে, ওই যেখানে সবুজ ঘাসে সূর্যের আলো এখনও পড়েনি, কত ভায়োলেট ওখানে ফুটে আছে!
আপন কথার তোড়ে আপনিই মত্ত ছিলেন ডাক্তার গ্যাচেট। চমকে উঠে উত্তর দিলেন—অ্যাঁ? ও হ্যাঁ, ভায়োলেট, ভায়োলেটই তো! খাসা ভায়োলেট!
আর কী সুস্থ, কী শান্ত, কী শ্রান্তিহারা সমস্ত পরিবেশ!
পাহাড় থেকে নেমে শস্যখেত ছাড়িয়ে ডাক্তার গ্যাচেটের সঙ্গে ভিনসেন্ট চলল গ্রামের মধ্যে।
ডাক্তার বললেন—আমার বাড়িতে তোমাকে থাকতে বলতে পারছিনে বলে দুঃখিত। ঘরের অভাব। তবে, রোজ তুমি আসবে, সেখানেই ছবি আঁকবে।
ভিনসেন্টের হাত ধরে টানতে টানতে সোজা একেবারে নদীর ধার পর্যন্ত চললেন ডাক্তার। ভ্রমণকারীদের জন্যে আধুনিক একটি হোটেল সেখানে। মালিকের সঙ্গে গ্যাচেট কথাবার্তা বলে নিলেন। খাওয়া বাবদ দৈনিক খরচ ছ-ফ্র্যাঙ্ক।
ডাক্তার বিদায় নিলেন—নাও, চটপট গুছিয়ে নাও। ঠিক একটার সময় আমার বাড়ি আসবে, ডিনার খাবে আমাদের সঙ্গে। সঙ্গে ইজেল আর রং-তুলি’ আনতে ভুলো না। আজই আমার একটা পোর্ট্রেট শুরু করতে হবে। নতুন ছবি দু-একখানা এনো। অনেক গল্প হবে তখন। কেমন?
ডাক্তার চোখের আড়াল হবার সঙ্গে সঙ্গে ভিনসেন্ট জিনিসপত্র হাতে তুলে পা বাড়াল।
হোটেলওয়ালা বললে—আরে কী হল মশাই? কোথায় চললেন?
যেখানে খুশি, তবে আপনার এখানে আর নয়। ভেবেছেন কী? আমি কি ক্যাপিট্যালিস্ট? হোটেল খরচ ছ-ফ্র্যাঙ্ক রোজ? আমি দিনমজুর মশাই, দিনমজুর! সোজা বাজার অঞ্চলে গিয়ে ভিনসেন্ট একটা কাফে খুঁজে নিল। কাফেটার নাম রাভো, দৈনিক চার্জ সেখানে ছ-ফ্র্যাঙ্কের জায়গায় মাত্র সাড়ে তিন।
রাভো কাফেটা অভার্সের ধারে-কাছের যত শ্রমিক আর কৃষাণদের আড্ডা। সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেই ডান দিকে একটি মদের বার, আর সারা বাঁ-দিক জুড়ে আধোঅন্ধকার খাবার ঘর, মোটা মোটা কাঠের টেবিল আর বেঞ্চি সাজানো। কাফের পেছনদিকে ময়লা আধছেঁড়া সবুজ বনাত-মোড়া একটা বিলিয়ার্ড টেবিল। এইটেই রাভোর গর্ব। তারপর সিঁড়ি, আর একেবারে শেষে রান্নাঘর। সিঁড়িটা উঠেছে দোতলায়, সেখানে পর পর তিনটে শোবার ঘর। ভিনসেন্টের ঘরের জানলা দিয়ে চোখে পড়ে পাহাড়ের ওপর ক্যাথলিক গির্জার চুড়োটা, সমাধিক্ষেত্রের ঝকমকে ব্রাউন রঙের পাঁচিলের খানিকটা অংশ।
ইজেল, রং-তুলি আর আর্লসবাসিনীর একটি ছবি নিয়ে ভিনসেন্ট ডাক্তার গ্যাচেটের বাড়ির খোঁজে বার হল। বাজারের প্রধান রাস্তাটা যেটা স্টেশন থেকে চলে এসেছে সেটা দিয়ে খানিকটা এগিয়ে পড়ল সে তিন রাস্তার এক মোড়ে। ডান দিকের রাস্তাটি গেছে সেই বাগানবাড়ির পাহাড় ছাড়িয়ে, বাঁ-দিকের রাস্তাটি গেছে শস্যক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে নদীতীর পর্যন্ত। মাঝের রাস্তাটি গেছে পাহাড়ের গা দিয়ে। এই রাস্তাটির কথাই গ্যাচেট বলে দিয়েছিলেন। এই পথেই সে এগোল। রাস্তার ধারে ধারে বাড়ি, কুটিরগুলো ভেঙে পড়ছে, তার জায়গায় উঠছে পাকা বাড়ি, গ্রাম্য রূপের ওপর শহরের আক্রমণ শুরু হয়েছে ধীরে ধীরে।
উঁচু পাথরের পাঁচিল ঘেরা ডাক্তার গ্যাচেটের তিনতলা পাকাবাড়ি। সামনে মস্ত বাগান। সামনের গেটে পেতলের ঘণ্টা। ঘণ্টা বাজাতেই গ্যাচেট নিজে এসে সমাদর করে ভিনসেন্টকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। প্রথমে নিয়ে গেলেন বাড়ির পেছনদিকের উঠোনে, যেখানে হাঁস মুরগি ময়ূর বিড়াল প্রভৃতি গৃহপালিত পক্ষী-পশুর আড্ডা।
সেখানে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটি প্রাণীর পূর্ণাঙ্গ ইতিবৃত্ত বর্ণনা করবার পর তিনি ভিনসেন্টকে টেনে নিয়ে গেলেন বাড়ির ভেতর, বসবার ঘরে।
মস্ত ঘরটা, বিরাট উঁচু ছাদ, সামনে বাগানের দিকে তিনটি কেবল ছোটো ছোটো জানলা। সারা ঘরভরতি চেয়ার টেবিল আসবাবপত্র আর অসংখ্য টুকিটাকির এত ভিড় যে একটু অসাবধানে হাঁটাচলা করলেই বিপদ। জানলার অপ্রাচুর্যে ধরটা অন্ধকার অন্ধকার, তার ওপর প্রত্যেকটি আসবাবের রং কুচকুচে কালো।
গ্যাচেট সেই বস্তুর ভিড়ের মধ্যে এদিক-ওদিক দৌড়োন আর এটা-ওটা জিনিস তুলে ভিনসেন্টের হাতে দেন। ভালো করে ভিনসেন্ট জিনিসটা দেখবার আগেই আবার সেটা ছোঁ মেরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে হাতে ধরিয়ে দেন আর-একটা বস্তু।
এই, এই যে ফুলদানিটা দেখছ। এই ফুলদানিতে ফুল রেখে দেলাক্রোয়া সেটা এঁকে গেছে। দেখো, দেখো, ভালো করে হাত দিয়ে দেখো। ঠিক ছবির আঁকা ফুলদানির মতোই লাগছে নাকি? আর ওই যে চেয়ারটা দেখছ। জানলার ধারে ওই চেয়ারে বসে বসে কুর্বে আমার বাগানের দৃশ্য আঁকত। আচ্ছা, এই পিরিচগুলো কেমন লাগছে? ভারি চমৎকার না? জানো, দিমুলিন জাপান থেকে আমার জন্যে এগুলো এনেছিল।… এই, এটার ওপর ফুল সাজিয়ে ক্লড মনে এঁকেছিল। ছবিটা আমার কাছেই আছে, দোতলায়। চলো তোমাকে দেখাই।
খাবার টেবিলে গ্যাচেটের ছেলে পলের সঙ্গে ভিনসেন্টের আলাপ হল, বছর পনেরো বয়সের ভারি সুদর্শন আর প্রাণখোলা কিশোরটি। গ্যাচেট পেটরোগা মানুষ, ডিনার কিন্তু পঞ্চব্যঞ্জনের। শুকনো কালো রুটি আর দুর্ভোজ্য চচ্চড়ি খেতে ভিনসেন্ট অভ্যস্ত। এমনি রাজভোগ সে খুব বেশি খেয়ে উঠতে পারল না।
খাওয়া শেষ হতেই গ্যাচেট ঘোষণা করলেন—ব্যাস, আর আড্ডা নয়, এবার কাজ। তুমি আমার একটা পোর্ট্রেট শুরু করো ভিনসেন্ট। যেমনি আছি তেমনিই বসে পড়ি, কী বলো?
ভিনসেন্ট সবিনয়ে বললে—দেখুন ডাক্তার, কিছু মনে করবেন না। আপনার সঙ্গে আর-একটু ঘনিষ্ঠ হবার আগে আপনার পোর্ট্রেটে আমি হাত দেব না। নইলে সে-ছবি সত্য ছবি হবে না।
তা বটে; তা বটে! ঠিকই হয়তো বলেছ কথাটা। তবে ভায়া, বসে থাকা চলবে না, আঁকতে একটা-কিছু হবেই আমার সামনে বসে। কেমন করে তুমি আঁক, আমি দেখব না?
তাহলে ধরুন, বাগানের একটা দৃশ্য….
বাঃ বাঃ, চমৎকার! চলো, আমি তোমার ইজেল পেতে দেব। এই পল, মশিয়েঁ ভিনসেন্টের ইজেলটা বাগানে নিয়ে চলো তো। নাও ওঠো এখন, ঠিক কোন জায়গায় ইজেলটা রাখতে হবে দেখিয়ে দেবে। আমিও তোমায় বলতে পারব ঠিক একই জায়গায় বসে অন্য কোনো শিল্পী এঁকেছে কি না।
ভিনসেন্ট আঁকতে শুরু করল। ডাক্তার গ্যাচেট তাকে ঘিরে চারপাশে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াতে লাগলেন, আর ক্ষণে ক্ষণে নানারকম দেহভঙ্গি, মুখভঙ্গি আর চিৎকার করে করে উঠতে লাগলেন—কখনও আনন্দে, কখনও বিস্ময়ে, কখনও আশঙ্কায়, মুহূর্তে মুহূর্তে ভাবে ভাষায় তাঁর উত্তেজনার নব নব অভিব্যক্তি।
দেখি, দেখি! হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ তুমি রংটা, হ্যাঁ, জল হবে লালচে। বাঃ, চমৎকার! অ্যা, এই রে! বলছি গাছটা তুমি খারাপ করবেই! নাঃ, তা তো নয়! ঠিকই তো করলে দেখছি! বহুত আচ্ছা! আরে, ওটা আবার কী রং দিলে? আর–একটু নীল দাও! এ কি তোমার প্রভেন্স প্রেয়েছ নাকি! সাবধান, সাবধান, লাইনটা যেন মোটা করে ফেলো না!….আহা, আর-একটু হলদে করো না ফুলটাকে! হ্যাঁ, এই তো চাই, আঁকছ দৃশ্য, জীবন্ত দৃশ্য, স্টিল লাইফ তো নয়! তবে অমনি সঙের মতো ওটাকে….না, না, আমার ভুল হয়েছে, ঠিক করেছ….আহা তাই বলে অতটা নয়! এই! কেমন, আমার কথা ঠিক হল তো? কী সর্বনাশ, এ যে একেবারে যা-তা….না, না, বুঝতে পেরেছি, ধরতে পেরেছি….হ্যাঁ, ছেড়ো না, চেপে ধরো প্রাণপণে—বাঃ বাঃ, চমৎকার, অপূর্ব! মার্ভেলাস, ভিনসেন্ট!
ডাক্তারের এই সশব্দ অঙ্গবিকৃতি ভিনসেন্ট শেষ পর্যন্ত আর সহ্য করে উঠতে পারল না। ক্লিষ্ট কণ্ঠে সে বললে–দেখুন মশিয়েঁ গ্যাচেট, এতটা উত্তেজনা আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই খারাপ নয় কি? নিজে ডাক্তার হয়ে এটুকু আপনার বোঝা উচিত যে নার্ভকে ঠান্ডা রাখাটা কত দরকার! কিন্তু সামনে বসে যদি কেউ ছবি আঁকে, গ্যাচেটের পক্ষে সে-অবস্থায় ঠান্ডা থাকা অসম্ভব।
আঁকা শেষ করে ডাক্তারের সঙ্গে ভিনসেন্ট বাড়ির মধ্যে গেল ও তাঁকে আর্লসবাসিনীর ছবিটা দেখাল। ডাক্তার চোখ বেঁকিয়ে ছবিটা দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে আপনমনে বহুক্ষণ সরব তর্কবিতর্ক করার পর শেষ পর্যন্ত তিনি হাঁকলেন—না, এ আমি নিতে পারিনে! এ-ছবিকে গ্রহণ করা অসম্ভব আমার পক্ষে। কী তুমি বলতে চেয়েছ এ-ছবিতে?
কিছুই না। আর্লসের সব মেয়ের প্রতিভূ আমার ছবি, এইটুকু বলতে পারেন। সমস্ত আর্লসকন্যার মৌলিক যে-চরিত্ররূপ, তাকে আমি রঙের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছি, এইমাত্র।
দুঃখব্যঞ্জক স্বরে ডাক্তার বললেন—তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমি ছবিটাকে স্বীকার করে নিতেই পারছিনে যে!
ভিনসেন্ট বললে—আপনার শিল্পসংগ্রহগুলি একটু দেখতে পারিনে?
পার, পার। যাও, সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখো। তোমার এই মহিলাটিকে নিয়ে আমি রইলাম, দেখি এর সঙ্গে আমার ভাব জমে কি না।
প্রায় এক ঘণ্টার ওপর ভিনসেন্ট সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে নানা শিল্পসংগ্রহ দেখে বেড়াতে লাগল, সঙ্গে রইল সুবোধ বালক পল। একটা ঘরে সে দেখল এক কোণে নিতান্ত হেলাফেলায় পড়ে রয়েছে গিলামিনের একখানা ছবি—বিছানায় শোয়া নগ্ন নারীমূর্তি। ছবিটার কোনো যত্ন নেই, ক্যানভাসে ফাটল ধরেছে। ভিনসেন্ট যখন ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করছে এমন সময় দ্রুত পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলেন ডা. গ্যাচেট। তার আর্লসবাসিনীর সম্বন্ধে একরাশ প্রশ্ন করে গেলেন।
বলেন কী? এতক্ষণ ধরে একলা একলা ছবিটা আপনি দেখছিলেন নাকি?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আসছে, আসছে! আস্তে আস্তে ধরতে পারছি তোমার সুন্দরীকে! ভিনসেন্ট বললে—রাগ করবেন না ডাক্তার, এমন চমৎকার গিলামিনটা অযত্নে ফেলে রেখেছেন, শিগগির বাঁধাই করিয়ে নিন, নইলে একেবারে যাবে।
গ্যাচেটের কানে গেল না সে-কথা।
তুমি বলছ তুমি ছবিটার ড্রয়িং-এ গগাঁকে অনুসরণ করেছ। আমি তা মানিনে….আর তা ছাড়া পদে পদে প্রতিকূল রঙের এ কী সংঘর্ষ! নারীর নারীত্বটা তো এইখানেই গেছে….না না. কী বললাম? না, তা বোধ হয় ঠিক নয়! তাহলে ও আমার কাছে আসছে কেন? ছবির কাঠামো থেকে বার হয়ে আমার বুকে এসে স্পর্শ করতে চাইছে কেন? যাই, আবার গিয়ে দেখি!
সমস্ত সুদীর্ঘ বিকেল বেলাটা গ্যাচেট ভিনসেন্টের ওই আর্লসবাসিনীকে নিয়ে কাটালেন। কখনও তার সামনে এসে চোখ পাকিয়ে দাঁড়ান, কখনও নেচে বেড়ান চারপাশে, হাজার রকমের মুখভঙ্গি আর দেহভঙ্গি, হাজার প্রশ্ন করেন নিজেকে, নিজেই তার উত্তর দেন। কিন্তু একমুহূর্তের জন্যেও চোখ ফেরে না অন্যদিকে।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল। এতক্ষণে ওই নারী সম্পূর্ণ করে তাঁর হৃদয় জয় করে নিল। তার কাছে ধরা পড়ে গেলেন তিনি। এই ধরা পড়ায় কত তৃপ্তি, কত সংশয়ের অবসান!
শেষ পর্যন্ত ছবিটার সামনে শান্ত, পরিশ্রান্ত, আনন্দ-অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ডাক্তার বললেন—সত্যি, সহজ হওয়া কী শক্ত! এত সুন্দর ও! সহজ বলেই সুন্দর, সহজ বলেই গভীর! একটা ছবির মধ্যেও চরিত্রের এত গভীরতার উপলব্ধি আগে আমার কখনও হয়নি!
ভিনসেন্ট বললে—ভালো যদি লাগে ডাক্তার, নিন আপনি ওকে। আর আজকের আঁকা বাগানের এই ছবিটাও।
কিন্তু এসব ছবি তুমি আমাকে দেবে কেন ভিনসেন্ট? ওগুলোর কি যা–তা দাম?
দু-দিন পরেই হয়তো আমার দেখাশোনা সবকিছু আপনাকেই করতে হবে। তার মূল্য পয়সা দিয়ে আমি দেব সে-সংগতি কোথায়! তার কিছুটা মূল্য দিয়ে রাখতে চাই, ছবি দিয়ে।
কিন্তু আমি কি পয়সার জন্যে তোমার ওপর ডাক্তারি করব বলেছি? সম্পর্কটা তো বন্ধুত্বের।
ঠিক তো, তাহলে আপনাকে ছবি দেওয়াও তো আমার পক্ষে আরও সহজ হয়ে গেল। সম্পর্কটা তো বন্ধুত্বের।
৩
ভিনসেন্ট শান্ত মনে জমিয়ে বসল অভার্সে। নতুন করে আরম্ভ করল শিল্পীজীবন। ঠিক করল রোজ রাত্রে শুতে যাবে ঠিক ন-টায়। ভোর পাঁচটায় উঠে দিনের কাজ শুরু করবে। আবহাওয়াও চমৎকার, মিষ্টি মেদুর রোদ, সারা উপত্যকা জুড়ে সবুজের নবোদ্ভাস। সেন্ট পলের উন্মাদশালায় থাকতে যতবার সে অসুখে পড়েছিল, তার প্রতিফল পাচ্ছে বই কী। হাতে তুলি ধরলে হাত থেকে খসে খসে পড়ে যেতে চায়। বুঝল সে, ছবি আঁকার অভ্যাসটাকেই নতুন করে রপ্ত করতে হবে।
থিয়োকে সে লিখল বার্গের ষাটখানা চারকোলে আঁকা, স্টাডি পাঠাতে কপি করার জন্যে। মানুষের চেহারা, বিশেষ করে নগ্ন দেহ আবার ছাত্রের মতো অনুশীলন করা দরকার, নইলে কোথায় ভুল ধরা পড়ে যাবে। অভার্সে সে এদিক–ওদিক ছোটোখাটো একটা বাড়ির খোঁজ করতে লাগল স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধবার জন্যে। মাঝে মাঝে মনের কোণে একটি মধুর ভাবনা উঁকি দিতে লাগল—থিয়ো যে বলেছিল এখনও তার সময় আছে সংসারী হবার, সত্যিই কি সংসারসঙ্গিনী কোনোদিন আসবে? সেন্ট রেমিতে অর্ধেক আঁকা কয়েকখানি ছবি সাজিয়ে নিয়ে বসল সেগুলোকে সম্পূর্ণ করবার জন্যে।
এ কিন্তু হঠাৎ-আলোর ঝলকানি। নির্বাণোন্মুখ প্রদীপের জ্বলন্ত আকুতি।
উন্মাদাগারে দীর্ঘদিন অজ্ঞাতবাসের পর এক-একটি দিন মনে হয় এক-একটি সপ্তাহের মতো। এত সময় নিয়ে কী করবে সে? কী তার কাজ? আজকাল সে আর ছবি আঁকতে পারে না সারাদিন। ছবি আঁকার সেই উদ্দাম ক্ষিপ্র শক্তিও সে হারিয়েছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে ছবি এঁকে যাবার বাসনাও তার নেই। আর্লসের দুর্ঘটনার আগে প্রতিদিন সূর্যাস্তের সময় সে দুঃখ করত দিনটা আরও দীর্ঘ হল না কেন, এই বলে। এখন দিন আর তার কাটে না।
প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব কমই আজকাল তাকে আকর্ষণ করে। যদি-বা দৃশ্যপট আঁকে, আঁকে শান্ত নির্লিপ্ত নিরাসক্ত মন দিয়ে। উত্তপ্ত রক্তের উত্তেজনা নিয়ে পটের ওপরে রং-তুলির আঘাত করে যাবার দুর্দাম উদ্দীপনা তার চিত্ত থেকে অপগত। আঁকতে পারে না সে আজকাল সত্যিকারের আঁকা যাকে বলে, আঁকা–আঁকা খেলা করে শুধু। সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে একদিনে একখানা ছবি শেষ না-ই হল—কী তাতে আসে যায়!
অভার্সে তার বন্ধু বলতে একমাত্র ডাক্তার গ্যাচেট। রোজ তাঁকে প্যারিসে যেতে হয়, সেইখানেই তাঁর রোগী দেখার প্রধান চেম্বার। প্রায়ই রাত্রের দিকে কাফে রাভোতে এসে ভিনসেন্টের কাজ দেখে যান। ডাক্তারের চোখে কেমন একটা চরম আশাভঙ্গের মূক বেদনার স্পর্শ—কেন, তা ভেবে ভেবে ভিনসেন্ট অবাক হয়।
একদিন সে বলে ফেললে—আপনি এত অসুখী কেন ডাক্তার?
আ ভিনসেন্ট, সখেদে ডাক্তার বললেন—সারাটা জীবন ধরে কত খাটলাম, বুড়ো বয়েসে কেবলই মনে হয় লাভ হল কার কী? ডাক্তার যে, অসুখী হব না? সারাটা কাল অসুখ দেখে দেখেই যে কাটল রোগ, যন্ত্রণা, বেদনা….
কী যে বলেন! আপনার কাজটা আমি যদি পেতাম….
কেমন একটা আত্মহারা উদ্দীপনার আলো জ্বলে উঠল গ্যাচেটের চোখে। বললেন—না ভিনসেন্ট, না। চিত্রকর হওয়া, পৃথিবীতে এর চাইতে মহত্তর কৃতি আর-কিছু নেই! সারাজীবন ধরে আমি ভেবেছি, যদি আমি চিত্রকর হতে পারতাম! পারলাম না কিছুতেই। এখান থেকে ওখান থেকে এক-আধঘণ্টা চুরি করি, কিন্তু পরিপূর্ণ মুক্তি নেই। কত রোগী, যারা আমাকে চায়, তাদের এড়িয়ে যাব কেমন করে?
ডাক্তার গ্যাচেট হাঁটু গেড়ে বসে ভিনসেন্টের খাটের তলা থেকে একগাদা ছবি টেনে বার করলেন। চোখের সামনে মেলে ধরলেন রৌদ্র-উদ্ভাসিত একগুচ্ছ হলুদ সূর্যমুখী।
এইরকম একটি ছবি যদি আমি আঁকতে পারতাম ভিনসেন্ট, তাহলে বুঝতাম জীবন আমার সার্থক। সারাটা জীবন আমি কাটালাম অসংখ্য লোকের ব্যাধি বেদনা সারিয়ে সারিয়ে, কিন্তু কত আর সারাব? মানুষ যে মরণশীল! তোমার এই সূর্যমুখীর গুচ্ছ, এরা চিরন্তন, শতাব্দীপারেও এরা মানুষের অন্তরবেদনাকে ঘোচাবে, যুগান্ত পরেও মানুষের হৃদয়ে করবে আনন্দের সূর্যরশ্মিসম্পাত। সেইজন্যেই ভিনসেন্ট তোমার জীবন সার্থক, কোনো দুঃখ তোমার থাকার কথা নয়।
ক-দিন পরে ভিনসেন্ট ডাক্তার গ্যাচেটের একটা পোর্ট্রেট আঁকল। নীল ফ্রককোট গায়ে, মাথায় সাদা টুপি। ব্যাকগ্রাউন্ডটা গাঢ় কালচে নীল। মুখ আর হাতের রংটা সে দিল ঠিক চামড়ার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে। পোজটা হল এইরকম যে গ্যাচেট একটা লাল টেবিলের ওপর হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন। টেবিলটার ওপরে হলদে রঙের একটা বই আর লাল টকটকে ফুল-ফোটা গাছের একটি টব।
ডাক্তার একেবারে খেপে উঠলেন ছবিটা পেয়ে। এত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ভিনসেন্ট জীবনে কখনও শোনেনি। এমনি আবেগবিহ্বল স্তুতিভাষণের সঙ্গে কখনও হয়নি তার পরিচয়। ছবিটার কপি করতে সে ডাক্তারের কথায় রাজি হল। এতে ডাক্তারের খুশির আর সীমা নেই।
তাহলে ওপরে চলো। সেখানে আমার প্রিন্টিং মেশিন আছে। আমার কারখানা, চলো তোমাকে দেখাই।… প্যারিসে চলো একবার ভিনসেন্ট, সেখানে তোমার সব ছবির আমি লিথোগ্রাফ করিয়ে দেব।
কারখানা ছাদের চিলেকোঠায় পৌঁছোতে হয় সরু একটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছোট্ট এক চোরা দরজা খুলে। কত রকমের অদ্ভুত যন্ত্রপাতিতে ভরতি সেই ঘর। ধুলোপড়া বোতলভরতি কত বিচিত্র রঙের রস। ভিনসেন্টের মনে হল কোন মধ্যযুগের রাসায়নিকের গুপ্তগৃহে বুঝি সে পা দিয়েছে।
আবার নীচে নামতে নামতে তার চোখে পড়ল গিলামিনের আঁকা সেই নগ্ন নারীর ছবিটি তেমনি অযত্নে পড়ে আছে। সে বললে—ডাক্তার গ্যাচেট, সত্যি আপনি একটা মাস্টারপিস নষ্ট করছেন। ছবিটা বাঁধাচ্ছেন না কেন বলুন তো?
হবে হবে। এই বাঁধাব এবার। কবে প্যারিস যাবে বলো তো? যত চাও লিথোগ্রাফ আমি করিয়ে দেব। সেজন্যে যা জিনিস লাগে সব দেব আমি।
মে মাস গেল, এল জুন। পাহাড়ের ওপরের ক্যাথলিক গির্জাটা আঁকতে বসল ভিনসেন্ট একদিন। মাঝপথে বিকেলের দিকে এমন ক্লান্ত লাগল যে ছবিটা শেষ করা হল না। খালি অধ্যবসায়ের গুণেই সে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে কোনো রকমে একটা শস্যক্ষেত্রের দৃশ্য এঁকে তুলল। মাদাম দ্যবিনির বাড়ির একটা বড়ো ছবি সে আঁকল, আঁকল আর-একটা বাড়ির ছবি, দৃশ্যটা রাত্রির। আর সর্বশেষ, সন্ধ্যার একটি দৃশ্য, দিনান্তের হলুদ আকাশের পরিপ্রেক্ষিতে স্তব্ধ কৃষ্ণ দুটি পিয়ার গাছ।
আঁকার মধ্যে পুরোনো রংটুকু আছে, কিন্তু রস নেই কোনো আর। যেটুকু আঁকতে পারে তা শুধু অভ্যাসবশে। উম্মাদ ব্যাকুলতায় গত দশ বছর ধরে প্রতিমুহূর্তের তার আত্ম-উন্মোচন, আকাশচুম্বী তার সৃষ্টিসাধনা, তারই কিছুটা অবশেষ, উচ্ছ্বসিত জীবনাবেগের বাকি কিছুটা রেশ। এর বেশি নয়।
প্রকৃতি আগে তাকে রোমাঞ্চিত করত ক্ষণে ক্ষণে, অধুনা উদাসীন পিঠে ইজেল বেঁধে ছবির সন্ধানে একলা ঘুরতে ঘুরতে আপনমনে সে বলে–নাঃ, কত এঁকেছি, আর নতুন কিছু আঁকবার নেই, বলবার নেই। বাকি শুধু নিজেরই অনুকরণ। তা করে কী লাভ?
প্রকৃতিকে সে ভালোবেসে এসেছে চিরদিন। সে-ভালোবাসা তার মন থেকে মরে যায়নি। সেই প্রকৃতিকে হাতের মুঠোয় আনবার, নিজের ক্যানভাসে বর্ণে রেখায় বন্দি করবার এতদিনের ব্যাকুলতাটা বিসর্জিত হয়ে গেছে। আসলে জ্বলে গেছে তার বুকের ভেতরটা। সৃষ্টির রস গেছে শুকিয়ে। উর্বরতা নেই, শুধু শুষ্ক অঙ্গার।
পুরো জুন মাসটায় পাঁচটা ছবি মাত্র সে এঁকেছে। দেহে মনে ক্লান্তির আর শেষ নেই। খালি হয়ে গেছে সে, নিঃশেষ হয়ে গেছে, যা একদা ছিল রসভারাক্রান্ত ফল তা এখন শুকনো খোসা। মনে জ্বলেছিল যে-অগ্নি, গত দশ বছরে ছবির পর ছবি তার এক-একটি স্ফুলিঙ্গকে হরণ করেছে, এখন নির্বাপিত শিখা, পড়ে আছে শুধু বিবর্ণ ধূমরাশি।
তবু যে আঁকে তা শুধু এই কথা ভেবে যে, থিয়োর ঋণ তাকে হালকা করতে হবে যতটা পারে। কিন্তু আবার যখন ভাবে যে থিয়োরই বাড়িতে এত ছবি তার জমে আছে যে দশ জন্মেও বিক্রি হবে না, তখন আবার বিস্বাব্দে সে ইজেলটা দূরে ঠেলে দেয়।
দিন ঘনিয়ে আসছে, জুলাই মাসে আবার পাগল হওয়ার পালা। শঙ্কিত দুশ্চিন্তায় মন ভরে থাকে, আবার তখন কী না কী করে ফেলবে, এ-গ্রামেও আর মুখ দেখাবার জো থাকবে না তাহলে। প্যারিস থেকে আসবার সময় থিয়োর সঙ্গে পয়সাকড়ির পাকাপাকি ব্যবস্থা করে আসতে পারেনি, থিয়ো কত টাকা যে পাঠাবে তারও ঠিক নেই। এ-দিকে দিনে দিনে গ্যাচেটের চোখের দৃষ্টিতে যুগপৎ প্রশংসা আর আত্ম-অনুশোচনার উদ্দাম জোয়ারভাটা মাথায় তার কেমন একটা ধাঁধা লাগিয়ে দিয়ে চলেছে।
.
অবস্থাটা চরমে পৌঁছোল, যখন খবর এল থিয়োর শিশুর খুব অসুখ।
দুর্ভাবনায় একেবারে অস্থির হয়ে উঠল ভিনসেন্ট। সোজা চেপে বসল প্যারিসের ট্রেনে। তার উপস্থিতি থিয়োর সংসারে বিড়ম্বনা বাড়াল বই কমাল না। থিয়ো নিজে অসুস্থ, তা ছাড়া ভয়ানক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ভিনসেন্ট নানা কথায় তাকে সাহস দিতে চেষ্টা করল।
শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল থিয়ো—একমাত্র ছেলের অসুখের জন্যেই আমি ভাবছিনে ভিনসেন্ট।
কী হল? এ ছাড়া আবার কী থিয়ো?
ভ্যালেডন, আমার অন্নদাতা। ভয় দেখিয়েছে চাকরিটা আমার থাকবে না।
সে কী? গুপিলসে তুমি যে ষোলো বছর ধরে আছ!
তাতে কী এসে যায়! মালিকের অভিযোগ, আমি তার ব্যাবসার দিকে যথেষ্ট নজর দিচ্ছিনে, তা ওই ইম্প্রেশনিস্টদের খাতিরে। সত্যি, ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি তো বেশি বিক্রি করতে পারিনে, যাও-বা বিক্রি হয় খুব সামান্য দামে। ভ্যালেডন বলছে আমার দোকান নাকি গত বছর লোকসান দিয়েছে।
কিন্তু সত্যি কি ও তোমাকে ছাড়িয়ে দিতে পারে?
ইচ্ছে করলে পারবে না কেন? আমাদের ভ্যান গক পরিবারের কোনো স্বার্থই তো এখন গুলিসের কারবারে নেই। সব বিক্রি হয়ে গেছে।
তা….তা যদি করে তো তুমি কী করবে? নিজের একটা দোকান করতে পারবে না?
তা কী করে পারব? মূলধন কোথায় আমার? যে ক-টা টাকা জমেছিল তা তো প্রথমে বিয়েতে আর তারপর বাচ্চার অসুখেই খরচ হয়ে গেল!
ওঃ থিয়ো, এই আমার পেছনে সারা জন্ম কাঁড়ি কাঁড়ি তুমি যদি না ঢালতে…
ও-কথা বোলো না। তুমি জানো আমি….
কিন্তু কী তুমি করবে থিয়ো? এখন আবার জোহানা রয়েছে… খোকাটি হয়েছে তার!
জানিনে তা… যা হয় হবে। বাচ্চার ভাবনাই তো এখন ভাবি। কী বলো?
ভিনসেন্টের উদবিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ম্লান হাসি হাসল থিয়ো। আর দিন কয়েক প্যারিসে রইল ভিনসেন্ট। রুগ্ণ শিশুর যাতে অসুবিধে না ঘটে তাই বেশির ভাগ সময়ই সে বাড়ির বাইরে বাইরে কাটাল। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হল। তার ওপর প্যারিসের জীবন। অনেক হইচই অনেক উত্তেজনা। বাচ্চা ভিনসেন্ট একটু ভালো হতেই সে অবিলম্বে ফিরে গেল অভার্সের শান্ত পরিবেশে।
.
কিন্তু শান্তি কোথায়? পঙ্গপালের মতো তার মাথার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যত দুশ্চিন্তার পাল। থিয়োর চাকরি যাবে, থিয়োর রোজগার বন্ধ হবে। কী হবে তাহলে তার? কে খেতে দেবে? শেষপর্যন্ত আধপাগলা ভিখিরি হয়ে ঘুরতে হবে নাকি পথে পথে? আর জোহানা আর তার শিশু, তাদেরই-বা কী হবে? হ্যাঁ শিশু, বাচ্চা ভিনসেন্ট, প্রিয়তম তার ভাই থিয়োর খোকা, কেমন আছে সে এখন? যদি না বাঁচে? সে শোক কি রোগা শরীর নিয়ে থিয়ো সামলাতে পারবে?
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিনসেন্ট কাফে রাভোর অন্ধকার খাবার ঘরে বসে থাকে। বাসি বিয়ার আর তামাকের বদ্ধ ধোঁয়ার গন্ধভরা কাফে লা মার্টিনের কথা মনে পড়ে। কখনও বিলিয়ার্ড টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে লাঠি দিয়ে রং-চটা বলগুলোতে এলোমেলো ঠোকাঠুকি লাগায়। হাতে পয়সা নেই, মদ কিনতে পারে না, রং কিনতে পারে না। কীসের নেশায় দুর্ভাবনাকে ডোবাবে? এমনি সময় থিয়োর কাছে টাকা চাওয়াও যায় না। এ-দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে জুলাই মাস, তার পাগল হওয়ার দিন। না জানি কী সে করে ফেলবে উন্মত্ত অবস্থায়, তখন সেই সামলাতে আবার কত টাকা খরচ হবে থিয়োর!
মাঝে মাঝে কাজ করতে চেষ্টা যে করে না তা নয়। পারে না। যা-কিছু আঁকবার সব তার আঁকা হয়ে গেছে, সব বলা হয়ে গেছে যা-কিছু ছিল বলবার। সারাজীবন তাকে টেনেছিল প্রকৃতি, আজ সেই আকর্ষণও ফুরিয়েছে। ক্ষান্ত হয়ে গেছে তার শিল্পীজীবন।
জুলাই-এর মাঝামাঝি এল। গরম পড়ল ভীষণ। থিয়োর মাথার ওপর ভ্যালেডনের উদ্যত খড়্গ, এ-দিকে ঘরে রুগ্ণ সন্তান, তবু সে কোনো রকমে পঞ্চাশটা ফ্র্যাঙ্ক জোগাড় করে ভিনসেন্টকে পাঠাল। ভিনসেন্ট সেটা তুলে দিল মাদাম রাভোর হাতে। মাসটা এতেই চলে যাবে। এই শেষ, আর টাকা হাতে আসবে না। তারপর?
গনগনে দুপুরে জ্বলন্ত সূর্যের নীচে সে মুখ বুজে চুপ করে শুয়ে থাকে সমাধিক্ষেত্রের পাশের ফাঁকা খেতের মধ্যে। কখনও-বা নদীর শ্যামল তীর বেয়ে উদ্দেশ্যহারা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। গ্যাচেটের কাছে কখনও যায়, ডিনারে বসে স্বাদবিহীন অভ্যাসে খাবার মুখে পোরে। তার শিল্পকৃতি নিয়ে ডাক্তার উচ্ছ্বসিত ভাষায় আলোচনা করেন, সে শুধু চুপ করে শোনে। মনে মনে ভাবে—কার কথা নিয়ে এত বকবক করছে ডাক্তার? আমি? না না, আমি না। ওসব ছবি আমার আঁকা নয়। কখনও আঁকিনি আমি, জীবনে কখনও তুলি ধরিনি। ছবিগুলোর গায়ে ওসব নামসই, ও আমার নামসই নয়, তুলির একটি আঁচড়ও আমি টানিনি ওসব ছবির ওপর। যে এঁকেছে, সে আমি নই, অন্য কোনো লোক।
অন্ধকারে নিজের ঘরে চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে সে বিনিদ্র প্রহর কাটায়। ভাবে শুধু—হ্যাঁ, এও তো হতে পারে, থিয়োর চাকরিটা যাবে না। ঠিক সে আমাকে মাসে মাসে দেড়শো ফ্র্যাঙ্ক করে পাঠাবে। কিন্তু তখন আমি আমার এই সর্বরিক্ত জীবনটাকে নিয়ে করব কী? প্রবঞ্চিত করব কাকে? না এঁকে উপায় ছিল না, বুকের মধ্যে যে-আগুন-জ্বলেছিল, রং আর রেখায় সে-আগুনকে বুক থেকে নিংড়ে বার করে না দিয়ে উপায় ছিল না, তাই তো বেঁচেছিলাম। ভাইয়ের কাছে এতটা জীবন হাত পেতেও বেঁচেছিলাম। কিন্তু এখন তো আর বুকে কোনো আগুন নেই, নিভে যাওয়া ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শুধু মুঠো মুঠো ছাই। এখন থেকে বেঁচে থাকা শুধু ওই সেন্ট পলের আশাহারা জীবমৃতদের মতো, যতদিন না মৃত্যু নিয়ে আসে চরম পরিত্রাণ!
না এও তো হতে পারে আবার আমি সুস্থ হয়ে উঠব, আবার ফিরে পাব ছবি আঁকার বাসনা। হতে পারে বই কী! অসম্ভব নয়। হ্যাঁ, কিন্তু তখন? তখন আমি আবার কোন মুখে থিয়োর কাছ থেকে টাকা নেব, যে-টাকার এখন থেকে তার কত দরকার জোহানার জন্যে, বাচ্চা ভিনসেন্টের জন্যে! আমার পেছনে টাকা খরচ করা আর তার উচিত নয়। জোহানা আর তার শিশুকে বাইরে পাঠানো উচিত, যেখানে তারা সুস্থ হতে পারে, শক্ত হয়ে উঠতে পারে। দশ-দশটা বছর ভাই আমাকে টেনেছে। তাই কি যথেষ্ট নয়? আর? আমি যদি এখন সরে না পড়ি, বাচ্চা ভিনসেন্টের ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার। আমার যা বলবার তা তো আমি বলেছি, এখন যে আমার নামে যে-শিশুর নাম তার কথা বলার দিন এসেছে।
সবকিছু দুশ্চিন্তার মূলে চরম দুশ্চিন্তা—দিন ঘনিয়ে আসছে। এবারে উন্মত্ততার ফল কী হবে? এখনও তার মাথা ঠিক আছে, বিচারবুদ্ধি আছে, সংকল্প গ্রহণের ক্ষমতা আছে। কিন্তু এর পরের বার আক্রমণের পর আর যদি সেরে না ওঠে, চিরদিনের মতো যদি একেবারে উন্মাদ হয়ে যায়? যদি জড় বস্তুতে পরিণত হয়, কিংবা উন্মত্ত জানোয়ারে? থিয়ো তখন কী করবে? সারাজীবনের মতো
পাগলাগারদে কয়েদ করে রাখবে তাকে?
ডাক্তার গ্যাচেটকে আর দুটো ছবি উৎকোচ দিয়ে সত্যি কথাটা বার করে নিতে সে চেষ্টা করল।
ডাক্তার বললেন—না ভিনসেন্ট, ওরকম আক্রমণ আর হবে না। তুমি একেবারে সুস্থ হয়ে গেছ, আমি বলছি। তবে কিনা, এতটা ভাগ্য সব সন্ন্যাসরোগীর হয় না।
সেসব রোগীর শেষ পর্যন্ত কী হয় ডাক্তার?
বার বার ক্রাইসিসের পর শেষ পর্যন্ত একেবারে পাগল হয়ে যায়।
তখন আর তাদের সারবার কোনো উপায় থাকে না?
না ভিনসেন্ট। শেষ হয়ে যায় তখন তারা। হয়তো জীবনের বাকি কয়েক বছর কোনো উম্মাদাগারে বন্দি হয়ে থাকে, কিন্তু চেতনা আর তাদের ফিরে আসে না।
কোন আক্রমণটা যে চরম ক্রাইসিস তা কী করে বোঝা যায় ডাক্তার?
তা অবশ্য কেউ বলতে পারে না। তবে থামো তুমি। এসব অলুক্ষুণে কথা থাক। চলো, ক-টা এচিং করবে।
পরবর্তী চার দিন ভিনসেন্ট একবারের জন্যেও ঘর থেকে বার হল না। মাদাম রাভো তার ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়ে আসতে লাগলেন। সমানে সে শুধু ভাবতে লাগল। এখন আমি ভালো আছি, সুস্থ আছি, প্রকৃতিস্থ আছি। কিন্তু এবার যখন আমি পড়ব, তখন যদি মাথাটা একেবারে বিগড়ে যায়, একেবারে পাগল হয়ে যাই! তখন আমার আর কোনো উপায় থাকবে না, আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারব না তখন! থিয়ো, থিয়ো! তখন আমার কী হবে!
চতুর্থ দিন বিকেলের দিকে সে গেল ডাক্তার গ্যাচেটের বাড়ি। বসবার ঘরেই ছিলেন গ্যাচেট। সোজা সে গেল যেখানে গিলামিনের নগ্ন নারীর ছবিটি ছিল। ছবিটি হাতে নিয়ে ধমকের সুরে সে বললে–আমি আপনাকে বলিনি ছবিটা বাঁধাতে?
চমকে মুখ তুলে ডাক্তার উত্তর দিলেন—বলেছ ভিনসেন্ট। এই আসছে সপ্তাহে বাঁধাইওলার কাছে নিয়ে যাব।
চিৎকার করে উঠল ভিনসেন্ট—আসছে সপ্তাহে নয়। আজ! এখুনি! এই মুহূর্তে!
কী পাগলের মতো তুমি কথা বলছ ভিনসেন্ট?
পাগলের মতো? পাগল আমি?
রাগে গনগনে চোখে এক মুহূর্ত ডাক্তারের চোখে তাকিয়ে তাঁর দিকে আক্রমণের ভঙ্গিতে সে এগিয়ে গেল। তারপর ডান হাতটা পুরল কোটের পকেটে। ডাক্তার গ্যাচেটের মনে হল পকেটের মধ্যে সে চেপে ধরল একটা রিভলবার।
ভিনসেন্ট! প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
কেঁপে উঠল একবার ভিনসেন্ট। থমকে দাঁড়াল। তারপর চোখ নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে এক দৌড়ে বার হয়ে গেল বাড়ি থেকে।
পরদিন ভোর বেলা ইজেল আর ক্যানভাস নিয়ে পথে বার হল। স্টেশনের রাস্তায় বরাবর গিয়ে পাহাড়ে উঠে সমাধিক্ষেত্র ছাড়িয়ে সে পৌঁছোল হলুদ শস্যক্ষেত্রে। বসে পড়ল সেখানে।
ঠিক দুপুর। ঠিক মাথার ওপর অগ্নিবর্ষী সূর্য। এমনি সময় কোথা থেকে নেমে এল ছায়া। আকাশের কোন কিনার থেকে উড়ে উড়ে এল কাকের পাল, ছায়া কালো কালো। আকাশ তারা ভরে দিল, সূর্যকে তারা নিভিয়ে দিল, তারা উড়ে এল তার মাথায় চোখে মুখে চুলে, ঢুকতে লাগল তার কানের মধ্যে, মুখের মধ্যে, নাকের ছিদ্রপথে, কালো কালো অসংখ্য ডানার ঝাপটে ডুবিয়ে দিল তার চৈতন্য।
ভিনসেন্ট কাজ করে চলল। সোনালি-হলুদ রঙের দিগন্তবিস্তৃত শস্যক্ষেত্র, তার ওপর দিয়ে উড়ে আসছে কৃষ্ণবর্ণ কাকের পাল, আঁকতে লাগল দৃশ্যটা। কতক্ষণ, কতক্ষণ ধরে আঁকল মনে নেই। শেষ হল ছবিটা, ক্যানভাসের এক কোণে লিখল—’শস্যক্ষেত্রে কাকের পাল’। তারপর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে রাভোতে ফিরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। ঘুম এল সঙ্গে সঙ্গে।
.
পরদিন বিকেল বেলা আবার সে বার হল পথে। এবার গেল অন্য রাস্তায়। সেই বাগানবাড়ির পাহাড়টা পার হয়ে সে চলে গেল খোলা প্রান্তরে।
একজন চাষা তাকে দেখেছিল—একটা গাছের ওপর উঠে বসে আছে, আর মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে নেড়ে হেঁকে উঠছে—অসম্ভব, অসম্ভব!
কিছুক্ষণ পরে গাছ থেকে সে নামল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সদ্য-লাঙল-চষা খেতের মধ্যে।
ঘণ্টা বেজেছে এইবার, শেষ প্রহরের ঘণ্টা। এই ঘণ্টার ধ্বনি সে শুনেছিল অনেক আগেই, সেই আর্লসে থাকতেই, কিন্তু তখন শেষ দাঁড়িটা সে টেনে দিতে পারেনি। এবার পারতেই হবে।
এবার বলতে চাই শেষ কথাটি। বলতে চাই—বিদায় দাও। যায় যদি যাক, ছিল সে ভালো, ছিল সে মধুর ধরণীতে। অন্ধকার ছিল বই কী, কিন্তু আলোও ছিল উদার!
বেশ কথাটা গগাঁ বলেছিল একদিন—যেখানে বিষ সেখানেই বিষৌষধি! ঠিক, খাঁটি কথা। তাই এখন জীবনের ম্লান প্রদীপ কালসমুদ্রে ভেসে যাক, কোনো দুঃখ নেই। শুধু বলতে চাই—দাও হাসিমুখে বিদায়টুকু। জীবনের প্রদীপে বারে বারে দুঃখসুখের আলো যারা জ্বালিয়েছ, বিদায় দাও। উরসুলা—তোমার উপেক্ষাই প্রথম সহজ জীবনযাত্রা থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিল সমাজতাড়িতদের বন্ধুর পথে। মেন্ডিস ডা কস্টা তুমি শুনিয়েছিলে আশার বাণী, বলেছিলে, ব্যর্থ হবে না আমার সাধনা, বলেছিলে, আত্মপ্রকাশের মধ্যেই পাব আমার পরিপূর্ণতা। কে ভস—তোমার ওই ‘না না, কখনও না’ এই ক-টি কথা দুঃখের অগ্নিতিলক পরিয়েছে আমার ললাটে! মাদাম ডেনিস, জ্যাকেস ভার্নি, হেনরি ডিক্রুক—প্রিয় বন্ধু আমার তোমরা, তোমরাই আমাকে শিখিয়েছ দুনিয়ায় যারা প্রবঞ্চিত অবজ্ঞাত তাদের ভালোবাসতে! পিটারসেন—তুমি বপন করেছ আমার প্রাণে শিল্পীজীবনের বাসনা-অঙ্কুর! বাবা-মা—যতটা ভালোবাসবার তার চেয়ে কম তোমরা আমাকে বাসোনি। ক্রিস্টিন—স্ত্রী আমার, ক্ষণকালের জীবনসঙ্গিনী আমার! মভ, ডি বক, উইসেনব্রাক—তোমরা আমার প্রথম শিল্পীজীবনের উপদেষ্টা ও বন্ধু! মার্গট—একটিমাত্র নারী, যে আমাকে দিয়েছিলে সর্বসমর্পিত ভালোবাসা! বিদায় দাও আমাকে সবাই!
তারপর প্যারিসের বন্ধুরা! লোত্রেক—যে আবার উন্মাদাগারে বন্দি হয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে। জর্জেস সিউরাত—যে মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে খেটে খেটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। পল গগাঁ—ব্রিটানির পথে পথে যে আজ ভবঘুরে। রুসো—প্যারিসের অন্ধ চিলেকোঠায় যার আস্তানা। সেজান—এক্স-এর নিঃসঙ্গ পর্বতচূড়ায় যে সন্ন্যাসী! হ্যাঁ, আর তুমি বন্ধু, পিয়ের ট্যাঙ্গি—আর তুমি রুলিন—হৃদয়সারল্যের সৌরভে আমাকে মুগ্ধ করেছ যারা, বিদায় দাও!
লক্ষ্মী মেয়ে র্যাচেল, ভ্রাতৃসম ডাক্তার রে, তোমরা দিয়েছ পরম দুঃখতিমিরে স্নেহ-সান্ত্বনার আলো। অরিয়ার আর ডাক্তার গ্যাচেট—সারা পৃথিবীতে দুটিমাত্র লোক, যারা আমাকে স্বীকার করেছ মহৎ শিল্পী বলে, তোমাদেরও কাছে বিদায়–
আর, সবার শেষে, থিয়ো, ভাইটি আমার কিছু পেলে না, সব দিলে আমাকে, এবার চলি ভাই!
ভাষা নিয়ে সে কারবার করেনি কখনও, আঁকিয়ে সে। সব আঁকা যায়, কিন্তু এই বিদায়টুকুকে সে রঙে রেখায় প্রকাশ করবে কেমন করে!
থাক, থাক।
চোখ তুলে ভিনসেন্ট তাকাল আকাশের দিব্যভাতি সবিতার দিকে। ওই নিত্য-আলোকজ্যোতির দিকে অপলক দৃষ্টি রেখে সে রিভলবারের ঘোড়াটা ডান হাতে টানল। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। নরম উষ্ণ কালো মাটি, মুখটা ডুবিয়ে দিল ওই মাটির মধ্যে আশ্রয় পেল যেন মাতৃগর্ভের অন্ধকারে।
৪
প্রায় ঘণ্টা চারেক পরে ভিনসেন্ট টলতে টলতে এসে ঢুকল কাফেতে। রক্তে ভাসছে অঙ্গের পোশাক। মাদাম রাভো সঙ্গে সঙ্গে তার ঘরে গেলেন। তারপর ঘর ছেড়ে দৌড়োলেন ডাক্তার গ্যাচেটের সন্ধানে।
ডাক্তার গ্যাচেট ভিনসেন্টের ঘরে পা দিয়েই আর্তনাদ করে উঠলেন–ভিনসেন্ট ভিনসেন্ট, এ কী কাণ্ড তুমি করেছ!
ডাক্তার গ্যাচেট আঘাতটা পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন।
ভিনসেন্ট, বন্ধু আমার, কোন দুঃখে তুমি এমনি কাজ করতে গেলে? আমি কেন জানতে পারিনি তা? আমাদের সকলের এত ভালোবাসা তোমাকে ঘিরে রয়েছে তবু তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে চাও কেন? তোমার কাজ কি শেষ হয়েছে? কত ছবি কত অপরূপ ছবি যে এখনও তোমার আঁকা বাকি ভিনসেন্ট!
ডাক্তার, দয়া করে আমার কোটের পকেট থেকে আমার পাইপটা দেবেন?
নিশ্চয় বন্ধু!
পাইপে তামাক ভরে ডাক্তার নলটা ভিনসেন্টের দুই দাঁতের ফাঁকে গুঁজে দিলেন।
বাঃ, এবার একটু আগুন।
ভিনসেন্ট শান্তভাবে পাইপ টানতে লাগল।
ভিনসেন্ট, আজ রবিবার। তোমার ভাই দোকানে নেই, বাড়িতেই আছে। বাড়ির ঠিকানাটা কী তার?
তা তো আপনাকে আমি বলব না!
কেন ভিনসেন্ট? তোমার ভাইকে যে এখুনি খবর পাঠানো দরকার!
সপ্তাহের এই একটা ছুটির দিনে থিয়োকে কিছুতেই বিরক্ত করা চলবে না। আমি জানি ও বড়ো ক্লান্ত, দুর্ভাবনার ওর শেষ নেই। এ-দিনটা ওর বিশ্রামের দিন!
শত অনুরোধেও ঠিকানা আদায় করা গেল না। গভীর রাত পর্যন্ত ডাক্তার গ্যাচেট তার কাছে রইলেন, পরিচর্যা করলেন যতটা সম্ভব। তারপর বাকি রাতটা তাঁর ছেলে রইল ভিনসেন্টের পাশে।
সমস্ত রাত ভিনসেন্ট নির্বাক হয়ে পড়ে রইল। চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। শুধু মাঝে মাঝে তামাক ভরে নিয়ে পাইপটা টানতে লাগল সর্বক্ষণ।
পরদিন সকাল বেলা গুপিলসে পৌঁছে থিয়ো পেল ডাক্তার গ্যাচেটের টেলিগ্রাম। দৌড়োল সে স্টেশনে একটি মুহূর্ত দেরি না করে।
থিয়ো, এসেছ ভাই!
কথা বলতে পারল না থিয়ো। বিছানার ধারে হাঁটু গেড়ে বসে শিশুর মতো করে দু-হাতে বুকে জড়িয়ে নিল দাদাকে।
ডাক্তার যখন এলেন, থিয়ো বাইরে বারান্দায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলল। দুঃখভরে গ্যাচেট মাথা নাড়লেন—না, কোনো আশা নেই। শেষ চেষ্টা অপারেশন করে গুলিটা বার করা। কিন্তু এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তাও সম্ভব নয়। আসলে শরীরটা ছিল লোহা দিয়ে গড়া, অন্য কেউ হলে মাঠেই তো মারা পড়ত!
সমস্ত দিন থিয়ো ভিনসেন্টের বিছানার পাশে বসে রইল নিজের হাতে তার ডান হাতটি মুঠো করে ধরে। রাত্রি বেলা আর কেউ কাছে রইল না। একান্ত নির্জনে নীচু গলায় দুই ভাই শুরু করল তাদের ছেলেবেলাকার গল্প।
থিয়ো বললে—রাইসউইকের সেই মিলটার কথা মনে পড়ে ভিনসেন্ট?
হ্যাঁ। ভারি সুন্দর ছিল সেই মিলটা, তা-ই না?
মনে পড়ে, নদীর ধারে বাঁধের ওপর আমরা দুজনে বেড়াতাম, কৃত প্ল্যান করতাম ভবিষ্যৎ জীবনের।
হ্যাঁ। আর শরৎকালে মাথা-উঁচু শস্যখেতের মধ্যে দুজনে খেলে বেড়াতাম। তখন, ঠিক আজ যেমন তুমি আমার হাত ধরেছ, ঠিক এমনি ধরতে, মনে পড়ে?
হ্যাঁ, ভিনসেন্ট।
আর্লসের হাসপাতালে থাকতে জুভেয়ার্টের কথা প্রায়ই মনে পড়ত। তোমার আমার ছেলেবেলার কথা। তারি ভালো কেটেছে সেসব দিন। ভুলে গেছ, সেই যে রান্নাঘরের পেছনের বাগানে আমরা খেলা করতাম আর রান্নাঘরে বসে মা পিঠে ভাজতেন..
ভুলিনি। কতদিন আগেকার কথা সে ভিনসেন্ট!
হ্যাঁ… ঠিক বলেছ….অনেক দিন….ভালো কথা থিয়ো, নিজের দিকে নজর রেখো, নিজের শরীরের যত্ন কোরো এবার থেকে। জো-র মুখ চেয়ে খোকার কথা ভেবে এ তোমাকে করতেই হবে! ওদের নিয়ে শহরের বাইরে কোথাও ক-দিন থেকে এসো, হাওয়া বদলে সকলেরই ভালো হবে।… আর একটা কথা। গুপিলসে আর থেকো না। ওরা তোমার সারাটা জীবন কিনে রেখেছে, তার বদলে দেয়নি কিছুই
আমি আমার নিজেরই গ্যালারি একটা খুলছি ভিনসেন্ট। তাতে প্রথমেই থাকবে শুধু একজনের ছবি, ভিনসেন্ট ভ্যান গকের একক প্রদর্শনী। তুমি আমার বাড়িতে যেমন করে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলে ঠিক তেমনি–
আমার ছবি, আমার কাজ! কম দিলাম না এর জন্যে, বুদ্ধিটা গেল, জীবনটাও গেল শেষ পর্যন্ত—
বন্ধ হল কথাবার্তা। ঘরে নেমে এল সারা অভার্সের নীরব রাত্রির করুণ প্রশান্তি।
শেষরাত্রের দিকে ভিনসেন্ট একবার থিয়োর দিকে মুখ ঘোরা:ে, ফিসফিস করে বললে—ইচ্ছে করে, এবার আমি যাই থিয়ো!
কয়েক মিনিট পরে চোখ বুজোল ভিনসেন্ট।
থিয়োর ভাই বিদায় নিয়েছে, চিরদিনের মতো।
৫
প্যারিস থেকে এল রুসো, পিয়ের ট্যাঙ্গি, অরিয়ার আর এমিলি বার্নার্ড অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে।
কাফে রাভোঁর দরজা বন্ধ, জানলার খড়খড়িগুলি নামানো। সামনে কালো ঘোড়ায় টানা শবাধারবাহক কালো গাড়ি অপেক্ষমাণ।
বিলিয়ার্ড টেবিলের ওপর ভিনসেন্টের শবাধারটি রাখা হল। টেবিলটি ঘিরে দাঁড়াল থিয়ো, ডাক্তার গ্যাচেট, রুসো, পিয়ের ট্যাঙ্গি, অরিয়ার, বার্নার্ড আর রাভো। কথা নেই কারও মুখে, কেউ চোখ তুলে কারও দিকে তাকাতে পারছে না।
কোনো ধর্মযাজকের উপস্থিতির প্রয়োজন কারও মনে এল না।
গাড়ির চালক সামনের দরজায় ধাক্কা দিল, আর দেরি নয়, সময় হয়ে গেছে। চেঁচিয়ে উঠলেন ডাক্তার গ্যাচেট—না না, এমনি করে আমরা ওকে বিদায় দিতে পারিনে!
ভিনসেন্টের ঘর থেকে তার সব ছবিগুলো তিনি নামালেন, পলকে পাঠালেন নিজের বাড়িতে, সেখানে ভিনসেন্টের আঁকা যেসর ক্যানভাস আছে সেগুলো সব নিয়ে আসতে।
ছজনে মিলে বিলিয়ার্ডঘরের সারা দেয়ালে সমস্ত ছবিগুলো টাঙাল। থিয়ো একলা দাঁড়িয়ে রইল কফিনের ধারে।
দেয়ালে দেয়ালে ভিনসেন্টের সূর্যালোকদীপ্ত চিত্রাবলী আধোঅন্ধকার কাফের রূপ ফিরিয়ে দিল, মনে হতে লাগল এ যেন কোনো প্রদীপ্ত উপাসনাগৃহ, কোনো আলোকমন্দির!
ছবি সাজানো শেষ হলে আবার সবাই এসে দাঁড়াল বিলিয়ার্ড টেবিলের চার পাশে। গ্যাচেট একলা কেবল কথা বলতে পারলেন।
আমরা যারা ভিনসেন্টের বন্ধু, দুঃখ করব না আমরা, শোক নেই আমাদের। আমরা জানি অবিনশ্বর তার প্রাণ। তার মানবপ্রেম, তার প্রতিভা, তার শক্তি কখনও ম্লান হবে না, নীরব হবে না কখনও তার বাণী, যে অনির্বচনীয় সৌন্দর্য তার স্পর্শে মূর্ত হয়েছে, তার অনির্বাণ আলো পৃথিবীকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলবে চিরদিন। প্রহরে প্রহরে আমি তার ছবি দেখি, যতবার দেখি, ততবার জীবনের নতুন অর্থ নতুন আশ্বাস খুঁজে পাই। ভিনসেন্ট, ভিনসেন্ট ছিল বিরাট স্রষ্টা….বিরাট শিল্পী….ছিল সে বিরাট দার্শনিক। বৃথা সে জীবন দেয়নি, তার মৃত্যু শিল্পের বেদিমূলে আত্মাহুতি!
থিয়ো ধন্যবাদ দেবার চেষ্টা করল ডাক্তার গ্যাচেটকে—আমি….আমি—
কণ্ঠ তার রুদ্ধ হয়ে এল অশ্রুভারে। আর-একটি কথাও তার মুখে সরল না।
শবাধারের ওপর আচ্ছাদন পড়ল।
দুজন বন্ধু শবাধার বহন করে নিয়ে গেল কাফের দরজা দিয়ে বাইরে। সযত্নে তারা সেটিকে রাখল গাড়ির ওপর।
কালো গাড়ি চলল রৌদ্রখচিত পথ দিয়ে। দু-পাশে সারি সারি গ্রাম্য কুটির! –শেষকৃত্যের বন্ধুরা চলল পেছনে।
স্টেশনের কাছে এসে গাড়ি বাঁ-দিকে মোড় নিল। উঠতে লাগল পাহাড়ের চড়াই বেয়ে। পাশে পড়ে রইল ক্যাথলিক গির্জা। এবার দু-ধারে কাঁচা হলুদ খেত।
সমাধিক্ষেত্রের দরজার সামনে এসে গাড়ি থামল।
স্থাণুর মতো এক পাশে দাঁড়িয়ে রইল থিয়ো। ছজনে মিলে শবাধার নামাল গাড়ি থেকে।
প্রথম দিন ভিনসেন্ট এই সমাধিক্ষেত্রে পা দিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে নদীর কিনার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ শ্যামল উপত্যকার দৃশ্যটি দেখেছিল, ঠিক সেই জায়গাটাই নির্দিষ্ট করেছিলেন ডাক্তার গ্যাচেট।
আর-একবার কথা বলবার চেষ্টা করল থিয়ো। পারল না।
শবাধার অদৃশ্য হল সমাধিগহ্বরে। হারিয়ে গেল গভীরে, নরম মাটি চাপা পড়ল তার ওপর।
সাতজনে মিলে ফিরে এল পাহাড়ের ঢালু বেয়ে শোকাচ্ছন্ন নীরবতায়।
ক-দিন পরে ডাক্তার গ্যাচেট আবার সমাধিক্ষেত্রে এলেন। যেখানে ভিনসেন্ট শুয়ে আছে তার চারিদিকে তিনি পুঁতে দিলেন সূর্যমুখী ফুলের গাছ।
.
ফিরে গেল থিয়ো প্যারিসে। এই শোক তার বাকি জীবনের দিবস-রাত্রির প্রতিটি মুহূর্তকে ঠেলে নিয়ে চলল সান্ত্বনাসীমান্তবিহীন দুঃখতিমিরসাগরে।
ভেঙেছে তার বুক, ভাঙল তার চৈতন্য।
উটেক্ট-এ মানসিক রোগের চিকিৎসাকেন্দ্র। মার্গট আগেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। থিয়োকে জোহানা সেখানে নিয়ে গেল।
ছ-মাস পরে, ভিনসেন্ট যে-তারিখে মারা গিয়েছিল প্রায় সেই দিনটিতেই থিয়োও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। তার সমাধি হল উট্রেক্ট-এ।
কিছু দিন পরে শোকাকুলা জোহানা একদা বাইবেল পড়তে পড়তে একটি লাইনের সামনে চোখ রেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। লাইনটি এই:
এমনকী মৃত্যুতেও তারা বিচ্ছিন্ন হয়নি।
থিয়োর দেহ উট্রেক্ট থেকে জোহানা তুলে নিয়ে গেল অভার্সে। শুইয়ে দিল ভিনসেন্ট যেখানে শুয়েছে তারই পাশে।
চারিদিকে সোনালি হলুদ শস্যক্ষেত্র, মাঝখানে স্বল্পপরিসর সমাধিস্থানটি অভার্সের খরসূর্যের দীপ্ত রশ্মিপাতে উদ্ভাসিত। পরম শান্তিতে থিয়ো শুয়ে আছে তার প্রিয় ভাই ভিনসেন্টের পাশে, দুজনের চরম শয্যার ওপর ছায়ালিম্পন এঁকেছে প্রচুর প্রফুল্ল সূর্যমুখী।