অভয়ারণ্য

অভয়ারণ্য

অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা। থমকানো পরিবেশ। জল মেশানো দুধের মতো আলো। এখানে জীবন আর মৃত্যুর লড়াই চলে অহরহ। ঝকঝকে লাল মেঝে। নিষ্প্রাণ একসার বসার আসন। বাতাসে ওষুধের গন্ধ। মাঝেমধ্যে একটা দুটো ট্রলি প্রায় নি:শব্দে এদিক থেকে ওদিকে চলে যাচ্ছে। সাদা পোশাক পরা নার্স। মাথায় বিচিত্র টুপি। ব্লাউজের দু-কাঁধে দুটো কলার। কেউ ফর্সা। কেউ কালো। কোঁদা চেহারা। পাথরের মতো মুখ। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। শুধু নির্দেশ আছে।

করিডরের একেবারে শেষ মাথায় ঘরের দরজার মাথায় আলোর অক্ষরে লেখা অপারেশন থিয়েটার। সাদা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন দীর্ঘদেহী সুপুরুষ এক মানুষ। বুকের দিকটা অ্যাপ্রনে ঢাকা। চোখে রিমলেস চশমা। আলো পড়ে সোনার ডাঁটি ঝিকমিক করছে। একমাথা এলোমেলো চুল। এই শহরের সেরা-গাইনি। হাতের আঙুলগুলো অবিশ্বাস্যরকমের লম্বা।

ধীর পায়ে তিনি এসে ঢুকলেন ভিজিটার্স রুমে।

দেয়ালের ঘড়িতে রাত দশটা। ঘরে চারজন পুরুষ তিনজন মহিলা। পুরুষদের দু-জন প্রৌঢ়। দু-জনেরই চোখে চশমা। দু-জন মহিলাও প্রৌঢ়। তৃতীয় জন তরুণী। ছিপছিপে শরীর। ধারালো মুখ। ভীষণ ফর্সা। চোখে পাতলা সোনালি চশমা। পুরুষদের বাকি দু-জন তরুণ। সুসংস্কৃত চেহারা। একজনের পরনে জিনস। কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। উদ্বেগ থমকে আছে।

ডাক্তারবাবু ঘরে ঢোকামাত্রই সাতজন উঠে দাঁড়ালেন। ঘরটা যেন ছোটো হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘বসুন বসুন।’ তিনি নিজে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। এলোমেলো চুলে একবার হাত বোলালেন। অ্যাপ্রনের পকেট থেকে সাদা একটা গ্লাভস উঁকি মারছে। ডাক্তারবাবু ঠোঁটের ফাঁকে একটা সিগারেট গুঁজে ট্রাউজারের পকেট থেকে লাইটার বের করে হাতে নিলেন। সিগারেটটা ধরাতে গিয়েও ধরালেন না। সাতজোড়া চোখের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকালেন। একটাই প্রশ্ন বাতাসে দুলছে বিশাল এক ঘন্টার মতো, ‘কী হল ডাক্তারবাবু?’ তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে প্রশ্ন ভাষা হারিয়েছে।

ডাক্তারবাবু ঠোঁট থেকে সিগারেটটা বার করে নিলেন, না ধরিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘আপনাদের একটা ডিসিশান নিতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি। বেশি সময় দিতে পারব না।’ সাতটা ‘কী’ প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারিত হল।

‘কী ডিসিশান ডাক্তারবাবু?’

‘হয় বাচ্চা না হয় মা যেকোনো একজনকে মারতে হবে। বাচ্চা চাইলে মাকে পাবেন না, মাকে চাইলে বাচ্চা। দু-জনকে একসঙ্গে বাঁচানো যাবে না, আই অ্যাম সরি। আপনারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে আমাকে জানান, উইদিন হাফ অ্যান আওয়ার। আমি আমার ঘরে আছি।’

সিগারেট ঠোঁটে গুঁজে লাইটার জ্বালালেন। দীর্ঘ শিখা নেচে উঠল নাকের সামনে। লাইটারের আগুনে আলোকিত মুখটা মনে হল নির্দয় কোনো মুখোস। এক ভলক ধোঁয়া ছেড়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সাতজনের একজন, যিনি একটু সাহসী, তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কেন?’

ডাক্তারবাবু ঘরের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। মেজাজী মানুষ। মুখে অসন্তোষের ছাপ। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি সার্জেন?’

প্রশ্ন করেছিলেন মেয়ের মা। মেয়ে শুয়ে আছে ঠাণ্ডা অপারেশন থিয়েটারের ধাতব টেবিলে। একটু আগেই সে ছটফট করছিল। যন্ত্রণায়। নতুন একটি প্রাণ নেমে আসতে চাইছে। মেয়েটির এই প্রথম বাচ্চা হবে। ডাক্তাররা যাকে বলেন, ফাস্ট ডেলিভারি।

মেয়ের মা ভয়ে চুপ করে রইলেন।

ডাক্তারবাবু নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘বাচ্চা যে পোজিশানে আছে, অ্যাকিউট পোজিশান। এক্স-রে প্লেট দেখালে আপনারা বুঝতে পারেন না। আমার সামনে একটা পথই খোলা, যেকোনও একজন। এনি ওয়ান অফ দি টু।’ তিনি ধীর পায়ে ক্রমশ দুর থেকে দুরে চলে গেলেন। আত্মবিশ্বাসী মানুষের চলার ধরন যেমন হয় আর কী! শহরের সেরা গাইনির যেমন হওয়া উচিত।

মেয়েটির নাম সুমিতা। তার স্বামীর নাম ধীমান। ধীমানের বাবা, মা, শ্বশুর, শাশুড়ি, শালাজ, সকালেই এসেছেন। সুমিতা একমাত্র মেয়ে। গুণী মেয়ে। ধীমান খুবই ভালো ছেলে। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। দুটি পরিবারই সম্পন্ন। উচ্চবিত্ত। মধ্যবিত্তের ঠুনকো নোংরামি থেকে মুক্ত। ছোট পাপ নেই। বড়ো পাপ কিছু থাকতে পারে। আবার বড়ো মানুষের পাপ, পাপই নয়। সেটা তাঁদের পূণ্য। যেমন পন্ডিতেরা শব্দপ্রয়োগে ভুল করলে বলা হয় আর্ষ-প্রয়োগ। এই সুবিশাল নার্সিংহোমের বাইরে দু-টি গাড়ি অপেক্ষা করছে। জানলা আঁটা অন্ধকার যেন অপেক্ষা করে আছে ঘটনার পরিণতি জানার জন্যে।

ধীমান ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। ধীমান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। একটু জোর গলাতেই বলে ফেলল, ‘বোগাস! আমি অন্য স্পেশ্যালিষ্টের পরামর্শ নেবো! প্রয়োজন হলে মেডিকেল বোর্ড বসাবো।’

নিজের কন্ঠস্বর নিজের কাছেই বেমানান লাগল। সুন্দর এক স্তব্ধতাকে এভাবে চমকে দেওয়া ঠিক হয়নি। উত্তেজনায় সে অসভ্যতা করে ফেলেছে। না, ব্যাপারটা শুধু একজনের জীবনমৃত্যুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ধীমান নিজের মান সম্মানকেও জড়িয়ে ফেলেছে এর সঙ্গে। ধীমান তার প্রযুক্তির ধারায় ভাবছে। সন্তানের জন্ম একটি দুর্ঘটনা বা ভাগ্য নয়। একটা টেকনোলজি। সেই টেকনোলজিতে সে কি এমন ভুল করে ফেলল, যার ফলে সুমিতার গর্ভে তারই সন্তান চলে গেল—দুরূহ কোণে! সে কী এক আনাড়ি ইঞ্জিনিয়ার! ইলেকট্রনিকসে তার এত সুনাম এই বয়সেই!

ধীমানের পিতাও এক নামী মানুষ। সেরা কলেজের সুখ্যাত প্রিনসিপ্যাল। তিনি ছেলেকে একটু তিরস্কারের গলাতেই বললেন, ‘ডোন্ট বি সিলি। চিৎকার করে মাথা গরম করে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। ডক্টর মল্লিক ইন্টারন্যাশন্যাল স্পেশালিস্ট। তাঁকে অবিশ্বাস করা মানে তাঁকে অসভ্যের মতো ইনসাল্ট করা। তা ছাড়া টাইম ইজ এ ফ্যাকটার। এটা আমেরিকা নয়, আমরা অমেরিকার প্রেসিডেন্ট নই যে আধঘন্টায় বোর্ড বসিয়ে বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করা যাবে! বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয় ধীমান। আপনি কী বলেন মিষ্টার ব্যানার্জি!’

ব্যানার্জি হলেন ধীমানের শ্বশুর। আই. এ. এস. অফিসার ছিলেন। এখন অবসর পেয়ে গেছেন। এক বেসরকারি সংস্থায় অ্যাডভাইসার হয়ে আছেন। ছেলে ব্যবসা করে বড়োলোক। খানতিনেক গাড়ির মালিক। অর্থে, প্রতিপত্তিতে ধীমানদের চেয়ে অনেকটা উঁচুতে। সরকারি বড়ো চাকরি ও অর্থ, ক্ষমতার অহঙ্কারে তাঁর কথাবার্তা বহুকালই একটু বেঁকে গেছে। বাংলা বলেন ইংরেজে উচ্চারণে, আর ইংরেজি বলেন বাঙালির উচ্চারণে।

ব্যানার্জি বললেন, ‘আঃ সিওর। এখানে মাথা হল একটা গ্রেট ফ্যাকটার।’

ধীমানের শ্যালক, অরিন্দম যে তিরিশ বছর বয়সেই মিলিয়নিয়ার, সে বললে, ‘অলরেডি দশ মিনিট চলে গেছে। সেকেন্ড ওপিনিয়ান যখন নেবার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই, তখন ডিসিশান একটাই, কিল দি বেবি, অ্যান্ড সেভ দি মাদার।’

ঘরের বাতাস যেন আলকাতরায় মতো থকথকে হয়ে গেল হঠাৎ। সিলিং ফ্যান ফিনফিন করে ধারালো ব্লেডের মতো বাতাস ছড়াচ্ছে। আজ শহরে বেশ একটু বৃষ্টি হওয়ায় উত্তাপ পাঁচ-সাত ডিগ্রি নেমে গেছে। সকালেরই একটু শীত শীত ভাব।

ধীমান বললে, ‘তা কেন? হত্যার অধিকার কে দিয়েছে আমাদের! সন্তান হল ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ আমরা মেরে ফেলব?’

অরিন্দম বললে, ‘আমি ঠিক এই সন্দেহটাই করেছিলুম। তুমি এই কথাটাই বলবে। তুমি তোমার অফিসের এক মারাঠী মহিলার সঙ্গে ইনভলভড, সে খবর আমাদের কাছে এসেছে। তোমার সামনে এই এক সুযোগ। সুমিতাকে সরাতে পারলে তোমার পথ পরিষ্কার।’

ধীমান জ্বলন্ত দৃষ্টিতে অরিন্দমের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললে, ‘নার্সিংহোম না হলে আমি এই নোংরা কথার জবাব এখুনি তোমাকে অন্যভাবে দিতুম।’

ধীমানের শ্বশুর ব্যানার্জি বললেন, ‘সে আবার কী? শুনিনি তো! সাথমিং ফিসি’!’

অরিন্দম বললে, ‘আজকাল এইটাই ফ্যাশান হয়েছে বাবা। বাঙালির পুরোনো স্বভাব আবার ফিরে এসেছে। ঘরে এক বাইরে এক। ওসব তুমি বুঝবে না।’

ধীমানের বাবা বললেন, ‘আলোচনাটা অবনকসাস দিকে চলে যাচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে ওই আলোচনা চলে না। এবাড়ির সঙ্গে ও বাড়ির ফাটলটা ক্রমশই বাড়ছে। ধীমানের বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগের কোনো বেস নেই। বেসলেস অ্যালিগেশান! আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, ধীমান কিন্তু একটু বেশিমাত্রায় বউ-কাতর। সময় সময় আমরাই তাকে স্ত্রৈণ বলি। ও বেচারা দু-তরফেরই মার খাচ্ছে।’

ধীমানের মা বললেন, ‘ইদানীং ওঁদের বেশ টাকার অহঙ্কার হয়েছে। আর টাকা থাকলে যা হয়, যাকে যা খুশী তাই বলা যায়।’

সুমিতার মা ছিলেন নামকরা এক স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। এখনও তাঁর চেহারাটি জাঁদরেল। গম্ভীর মুখ। গোটা পৃথিবীটাকেই তিনি মনে করেন, নিজের স্কুল। সেই মন নিয়েই বলেন, ‘আমরা কেউ রামকৃষ্ণ নই। টাকা আছে তাই টাকার অহঙ্কারও আছে। আপনারা তো মেয়েটাকে একটা থার্ডক্লাস নার্সিংহোমে ফেলে রেখেছিলেন। কৃপণরা যা করে থাকে। আমরাই এখানে এনেছি। প্রশ্ন হল, আমার মেয়ের এই অবস্থার জন্যে কে দায়ী। কারা দায়ী! আপনারা! নেগলেক্ট করেছেন। প্রপার চেক-আপ হয়নি। কৃমিন্যাল নেগলিজেনস। মেয়েকে আপনারা সবাই মিলে যে টর্চার করেননি তাই বা কে বলতে পারে! আমার মেয়ের যদি কিছু হয়; তাহলে আমি সোজা থানায় যাবো। আপনাদের সব কটাকে আমি জেল খাটাবো।’

ধীমানের মা হঠাৎ বলে ফেললেন, আ মোলো। বসে বসে তিলকে তাল করছে দেখো।

ধীমানের মা তেমন আধুনিকা নন। জেলা শহরের মেয়ে। সহজ, সরল, আন্তরিক। মনে তেমন প্যাঁচও নেই। আধুনিক জগতের খবরও তেমন রাখেন না। সোজাসুজি কথা বলার সময় গ্রাম্য শব্দ বেরিয়ে আসে।

সুমিতার মা সঙ্গেসঙ্গে বললেন, ‘এই তো ও-বাড়ির কালচার! বস্তির ভাষায় সব কথা বলে।’

সুমিতার বাবা বললেন, ‘এঁদের সঙ্গে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। মেয়েটাকে আমার হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছি।’

ধীমান একপাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে শুনছে সব। সত্য কিভাবে বিকৃত হয়। সুমিতার সঙ্গে, তার কী সম্পর্ক, তার মা, বাবার কী সম্পর্ক, তা একমাত্র সুমিতাই জানে। সে কিন্তু এই মুহূর্তে উঠে এসে প্রতিবাদ করতে পারবে না, কারণ সে অসহায়! ধীমান ভেবে পেল না, কেন সে হঠাৎ অমন একটা কথা বলে ফেলল! সত্যিই কি সে চায় না সুমিতা বাঁচুক। অবশ্যই চায়। আবার এটাও ভাবতে পারছে না, নিষ্পাপ একটা প্রাণকে সার্জেনের শিক্ষিত চিমটে হত্যা করে ফেলেছে! কে বলতে পারে কালে সেই প্রাণটি এক মহাপ্রাণ হয়ে উঠত না! চৈতন্য, বুদ্ধ, কি যিশু কি আইনষ্টাইন! আবার প্রবাদেই আছে, এক স্ত্রী মারা গেলে, আর এক স্ত্রী পেতে কতক্ষণ? স্ত্রী পুরোনো হয়ে আকর্ষণ হারায়। জীবন্ত ফার্নিচারের মতো জীবনের সঙ্গেসঙ্গে চলে। সন্তান এক অসীম সম্ভাবনা। চারা গাছের মতো। ভবিষ্যতের মতো। যত বড় হতে থাকে, ততই কৌতূহল, কী হয়, কী হয়। সেই আশাতেই তো মানুষ বাবা হয়।

অরিন্দম বললে, ‘মেয়ে আমাদের, সিদ্ধান্তও আমাদের। কিল দি বেবি সেভ দি মাদার।’

ধীমানের বাবা বললেন, ‘সে আবার কি? মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর সব মেয়েই শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি। তার টাইটেল পর্যন্ত পালটে যায়। এটাই তো হিন্দু আইন। আপনাদের সিদ্ধান্ত নেবার তো কোনও অধিকার নেই। সিদ্ধান্ত নেবে স্বামী। নেবে ধীমান।’

মিস্টার ব্যানার্জি, সারাটা চাকরিজীবন যিনি কানের কাছে শুনে এসেছেন, ব্যানার্জি সাহেব আর স্যার স্যার সম্বোধন, তিনি ফুঁসে উঠলেন, ‘হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টটা তাহলে আমাকে একবার দেখতে হচ্ছে। মেয়ে শ্বশুরের সম্পত্তি না, বাপের সম্পত্তি! মেয়ে কী ছাগল? আমরা খাইয়ে দাইয়ে শিক্ষিতা করে কষাই শ্বশুরের হাতে তুলে দেবো!’

ধীমানের বাবা বললেন, ‘আপনার সরকারি চাল ছাড়ুন। আমি মনুসংহিতা খুলে দেখিয়ে দেবো মেয়ে কার! আর আমাকে কষাই বললেন তো? আপনি কী! সারাজীবন পরের পয়সায় মদ গিললেন, ঘুষের টাকায় বাড়ি হাঁকালেন। আপনারা ক-দিন এসে মেয়ের খরব নিয়েছেন?’

ব্যানার্জি বললেন, ‘আ গেলো! লোকটা বড়ো অসভ্য তো? আনসিভিলাইজড ব্রুট।’

অরিন্দম বললে, ‘এর জবাব আমরা দেবো। একটা মানহানির মামলা ঠুকে দিলেই ঠাণ্ডা।’

ধীমানের মা বললেন, ‘আমি, আ মোলো বলেছিলুম, আপনারা কিন্তু আ গেলো বললেন!’

সুমিতার মা বললেন, ‘আ মোলোর চেয়ে আ গেলো অনেক বেটার।’

ছিপছিপে, বুদ্ধিমতী মেয়েটি হল অরিন্দমের স্ত্রী। সে এতক্ষণ চুপ করে ছিল। আর চুপ করে থাকতে না পেরে বললে, ‘আপনাদের সকলেরই দেখছি মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’

সুমিতার মা, মেয়েটির শাশুড়ি অমনি বাঘের মতো হুঙ্কার ছাড়ছেন, ‘তার মানে? যত বড়ো মুখ না তত বড়ো কথা! মুখ সামলে বউমা।’

অরিন্দম লাফিয়ে উঠল, ‘কেন মুখ সামলে কেন? ওর কী নিজস্ব কোনো ওপিনিয়ান থাকতে নেই। তুমি কী ভাবো ও তোমার বাড়ির ঝি-চাকর!’

সুমিতার মা অমনি স্বামীকে বললেন, ‘তোমাকে আমি কী বলেছিলুম, বউয়ের ভেড়া হয়ে গেছে। বড়লোক শ্বশুর হলে এইরকম হয়। বাপ মা পর হয়ে যায়। তখন বিশ্বাস কর নি। আজ এতগুলো লোকের সামনে এই অপমান সহ্য করো। আমরা নাকি পাগল! মেয়ের বয়সী মেয়ের ঔদ্ধত্যটা একবার দেখো। এরা হল কুকুরের জাত। লাই দিলেই মাথায় চড়ে।’

ব্যানার্জি বললেন, ‘আমার বাবা, মা-ও তোমার সম্পর্কে ঠিক এই কথাই বলতেন।’

সুমিতার মা বললেন, ‘ও তাই না কি? তাই আজ ছেলের বউকে দিয়ে সকলের সামনে অপমান করাচ্ছ। দেখব, দেখব, তোমার ছেলের বউ শেষ পর্যন্ত তোমাকে কেমন আদর করে!’

অরিন্দমের স্ত্রী বললে, ‘আপনি তো আজকাল মা খুব কথামৃত পড়েন। সেখানে পড়েছেন নিশ্চয়, রজ্জুতে সর্পভ্রম। আসলে আমি একটা নিরীহ দড়ি। আপনি ভুল করে আমাকে বিষধর সাপ ভাবছেন!’

ব্যানার্জি বললেন, ‘পড়লে কী হবে! মনের কোনো উন্নতি নেই। সেও ওই ঠাকুরেরই কথা—পাঁজিতে বিশ আড়া জলের কথা লেখা আছে, নিংড়োলে এক ফোঁটাও বেরোবে না।

ধীমান বললে, ‘আর মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে।’

তরুণী বললে, ‘সিদ্ধান্ত তো হয়েই গেছে। গাছ আগে না ফল আগে! গাছ বাঁচলে ফলের কী অভাব! তা ছাড়া একালের হিসেবিরা তো পরিবার ছোটো রাখবার জন্যে হামেসাই অ্যাবরশান করায় হাসতে হাসতে। বিবেকের কোনো প্রশ্নই শোনে না। স্বার্থের অপর নাম মানুষ। আপনি অত ভাবছেন কেন? এ তো অকারণে নয়, মহা এক কারণে! একটু সখে থাকার জন্যেই যখন আকার হচ্ছে, কারণে হতে আপত্তি কী? আপনি কি দিদিকে ভালোবাসেন না?’

ধীমান স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। ভালোবাসা এমন এক শব্দ যে ভালোবাসি বললেই কুঁকড়ে ছোটো হয়ে যায়, রজনীগন্ধার পোকার মতো। ধীমান বুঝতে পারছে, কিছু বলতে গেলেই গলাটা ধরা ধরা শোনাবে। এইসব অবিশ্বাসী কুচুটে লোকগুলোর সামনে সে তার আবেগ প্রকাশ করতে চায় না।

তরুণী বললে, ‘যান, গিয়ে বলে আসুন।’

ধীমান সেই দরজাটার দিকে এগোতে লাগল ধীরে ধীরে। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে। বাইরে থকথকে রাত। সামান্য বাতাসও নেই। প্রকৃতি যেন এক মহাযোগীর মতো কুম্ভক করে বসে আছে। দরজার মাথায় লাল আলোর সঙ্কেত। ধীমানের অনেকটা পেছনে ছটি চরিত্র। একটু ছাড়া ছাড়া। সকলেই অল্পবিস্তর আহত। তাঁরা হাঁটছেন থমকে, পায়ে পায়ে। ধীমান পৌঁছোবার আগেই দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। একটি শিশুর তীব্র চীৎকারের সঙ্গেসঙ্গে বেরিয়ে এলেন সাদা সার্জেন। এক ঝলক ঠাণ্ডা ধীমানের মুখে এস লাগল।

পেছন থেকে ছুটে এল নারীকন্ঠ, ‘যা:, মেয়েটাকে মেরে ফেললে।’

কান্নার শব্দে ধীমানের ভেতরটা নেচে উঠেছিল। পরমুহূর্তেই ভয়ে তার চলা বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তারবাবুর মুখের দিকে সে তাকিয়ে আছে। ঈশ্বরের মুখ না কোনো জল্লাদের। দরজার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন, দীর্ঘদেহী সার্জেন। সাদা অ্যাপ্রন নেমে এসেছে হাঁটু পর্যন্ত। বুকের কাছে পড়ে আছে চেনঝোলা চশমা। মাথার ওপর লাল আলো। হঠাৎ কোথা থেকে একচুমুক বাতাস এসে তাঁর চুলে দোল খেয়ে গেল। থমকে গেছে ধীমান। ধীমানের পেছনে ছটি চরিত্র।

ডাক্তারবাবু ডান হাত তুলে বললেন, ‘ভয় নেই। দু-জনেই সেফ। অসাধ্য সাধন করা গেছে। তবে!’ তিনি থেমে গেলেন। ট্রাউজারের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন।

সাতটি কন্ঠের এক সঙ্গে একই প্রশ্ন—‘তবে?’

ঠোঁটে সিগারেট লাগিয়ে সামনে লাইটার ধরালেন। বাঁ হাতের আড়ালে শিখা জ্বলে উঠল। এক ভলক ধোঁয়া ছেড়ে ডাক্তার বললেন, ‘তবে আর কোনো বাচ্চা হবে না। ওই একটিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।’

পেছন থেকে প্রশ্ন, ‘ছেলে না মেয়ে?’

‘ছেলে।’

‘কত পাউন্ড?’

‘সিকস।’

‘সুন্দর?’

‘সুন্দর।’

হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। বেরিয়ে আসছে একটি ট্রলি। সাদা চাদরে ঢাকা। সবাই একপাশে সরে গেলেন। সুমিতা তার বেডে ফিরে চলেছে অ্যানেসথেসিয়া এখনও জড়িয়ে আছে! ধীমানের মনে হল সুমিতার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে একঝিলিক হাসি। পেছন পেছন চলেছেন সিস্টার। তাঁর দু-হাতে সাদা তোয়ালে জড়ানো এতটুকু একটা মানুষ। লাল টকটকে। ছোট্ট এতটুকু একটা বাতালি লেবুর মতো মুখ। মিছিলটা করিডরের ও প্রান্তে হারিয়ে গেল। যেন কোনো চার্চের শোভাযাত্রা। ফাদার বয়ে নিয়ে চলেছেন পবিত্র ক্রশ।

ডাক্তারবাবু পাশের দাঁড়ানো অ্যাশট্রেতে সিগারেট গুঁজে ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘কাল সকালে।’

সাতটি চরিত্র এক হয়ে প্রায় গায়ে গা লাগিয়ে এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে। হঠাৎ ব্যানার্জি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমরা এরকম করলুম কেন?’

ধীমানের বাবা বললেন, ‘স্নেহে।’

ধীমান বললে, ‘ভোলা যাবে!’

অরিন্দম বললেন, ‘অবশ্যই যাবে। সবাই জানে জঙ্গল খুবই সুন্দর, কিন্তু বাঘ, ভাল্লুকও কিছু থাকে। মানুষ হল সেই অভয়ারণ্য। আমাদের কথাই হল, ধারালো নখ আর দাঁত।’

দুই বেয়ানে হাত ধরাধরি করে সিঁড়ি বেয়ে নামছেন। দুধসাদা আলো।

সবাই যে যার গাড়িতে উঠে বসার আগে বললেন, ‘মিষ্টিমুখ পাওনা রইল।’

দুটো গাড়ি চলে গেল দু-দিকে বাঁক নিয়ে। দু-সার গাছের মাঝে পড়ে রইল নির্জন পথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *