অব্যবহিতা

অব্যবহিতা

১লা আষাঢ় ১৩৩৭

আমার জীবনের আকাশে যে দুর্যোগ উঠিয়াছিল, তাহা অনেকটা কাটিয়া গিয়াছে। শুধু এইটুকুই নহে, খণ্ড খণ্ড বিক্ষিপ্ত মেঘের আড়ালে আজকাল একটা চন্দ্রকলা মাঝে মাঝে দেখা যায়। অপেক্ষায় আছি, কবে সেটুকু মেঘও বিলুপ্ত হইবে এবং আকাশটা উহারই জ্যোৎস্নায় আলোকিত হইয়া উঠিবে।

বাস্তবক্ষেত্রে এই চাঁদের কণাটুকু সরু রাস্তাটার ওপারে ওই পঞ্চম বাড়িটার জানালার ফাঁকে, কিংবা ছাদের আলিসার আড়ালে, কখনও আধখানা, কখনও বা আরও কম, আবার কখনও আলোর আভাসটুকু মাত্রই দেখা যায়। ঠিক যে তৃপ্তি পাই তাহা বলিতে পারি না, অথচ এই ক্ষণিক দর্শনগুলি যে কেবল অতৃপ্তিরই সৃষ্টি করিয়া আমায় বিভ্রান্ত করিতেছে, তাহা বলিলেও মিথ্যাই বলা হইবে। ওই বাড়ির ওই কিশোরী সমস্ত দিন নিজের খেয়ালে বা সংসারের প্রয়োজনে সমস্ত বাড়িটাতে সাধারণভাবে ঘুরিয়া বেড়ায়, আর পাঁচটা বাড়ির ব্যবধানে থাকিয়াও আমায় সেই অনাড়ম্বর গতিবিধির জন্য অমন হাঁ করিয়া বসিয়া থাকিতেই হয়। নূতন চাকরি, তবুও ইহারই জন্য কয়েকদিন দেরি হইয়া গিয়াছে। এত কষ্টের পর পাওয়া চাকরি, সাবধান হইতেই হইবে; কিন্তু আপাতত সবচেয়ে বড় কথা—আমার এই পাঁচ-পাঁচটা বাড়ির ব্যবধান যে আর সহ্য হয় না।

কখনও, যখন থাকে ছাদের এক প্রান্তে, আর নিম্ন হইতে ডাক পড়ে, সদু! তখন উত্তরে একটা বাঁশীর মত মিঠে আওয়াজে—আসি, যাই, কেন—এই রকম স্বল্পাক্ষরা সঙ্গীতে এ বাড়ির হাওয়াতেও একটা ঝঙ্কার তোলে বটে, কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষার অনুপাতে সে আর কতটুকু?

দুইটি অক্ষরের কাব্য; কিন্তু শুনিয়া শুনিয়া তো আর মন উঠে না। সদু সদু! নিশ্চয় সৌদামিনী—নিশ্চয়ই। হায়,.তাই বলিয়া কি সৌদামিনীর মতই এত বিরল-বিকাশ হইতে হয়!

সে যাই হউক, কিন্তু এ নিষ্ঠুর ব্যবধান যে আর সয় না।

.

১৭ই আষাঢ়

স্বর্গের দুয়ারে বাসা বাঁধিয়াছি। দেবতার অনুগ্রহে মধ্যেকার চারিটা বাড়ির চারি যোজনের ব্যবধান এক কথায় মিটিয়া গিয়াছে। এখন আমি সদুদের সামনের বাড়িটায়,— মাঝখানে মাত্র সঙ্কীর্ণ গলিটি।

যে দেবতার এই অযাচিত অসীম অনুগ্রহ, তিনি সকালে সামান্য এক মানবের বেশে আসিয়া বলিলেন, মশাই, বলতে বড় কিন্তু হচ্ছি, কথা হচ্ছে ছোট বাড়িটাতে অনেকগুলি কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে বড় বিব্রত হয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনি দয়া ক’রে যদি অদল- বদল করেন, ছোট বাড়ি ব’লে আপনার একলার কোন অসুবিধেই হবে না। দুটোই একই লোকের বাড়ি। বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করেছিলাম, তিনি বলেন, আপনি রাজী হ’লে তাঁর আপত্তি নেই।

জিজ্ঞাসা করিলাম, কত দূরে আপনার বাড়িটা? কি জানেন—এ গলি ছেড়ে যাওয়া আমার সুবিধে হবে না।

ছলনাকারী দেবতা বলিলেন, দূর কিছুই নয়; মাঝখানে এই চারটে বাড়ি পেরিয়েই পরের বাড়িটা। আপনারা জিনিসপত্র সমস্তই আমি লোক দিয়ে পৌঁছে দোব। ছোট্টখাট্ট ফিটফাট বাড়িটি!

তা দেখিতেছি, সত্যই চমৎকার বাড়িটি, যেন একটি ফোটা ফুলের মত। সে আর হইবে না? আমার স্বর্গের জ্যোতিষ্কের কল্যাণ-রশ্মি যে সারাক্ষণ তাহার মুখের উপর আসিয়া পড়িতেছে।

মেয়েটির রুটিন আমার মুখস্থ হইয়া গিয়াছে। এক নম্বরের কুঁড়ে—ভয়ানক দেরি করিয়া উঠে। তাহাতে আমি প্রতিবেশী মাত্র, আমারই বিরক্তি ধরে, বাড়ির লোকের তো ধরিবেই। ছোট একটি ভাই আছে, সে তো নামই দিয়াছে ‘কুম্ভকর্ণ দিদি’। সকালে গলির পাশের ঘরটিতেই বসিয়া থাকি, বসিয়া বসিয়া বিভিন্ন কণ্ঠের অনুরাগ শুনি, না বাপু, এ মেয়েকে পারা গেল না; কি অলক্ষুণে ঘুম! হ্যাঁলা, ওঠ না, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তোর কি দুর্গতি হবে? ঠাকুরঝি, ওঠ, শ্বশুরবাড়ির জন্য তোয়ের হওয়া চাই তো? যেদিন খুব দেরি হইয়া যায়, সেদিন একটি বড় স্নেহসিক্ত স্বরও শুনিতে পাই, সদু, ওঠ তো দিদি। তোমরা মেয়েটাকে রাতদুপুর পর্যন্ত খাটিয়ে খাটিয়ে মেরে ফেললে, কদিনই বা আর আছে তোমাদের এখানে বাপু?

এটি ঠাকুরদার কণ্ঠস্বর, সর্বদাই পৌত্রীর আসন্ন বিদায়ের বেদনায় গাঢ়। এ রকম নাতনীগতপ্রাণ মানুষ দেখা যায় না।

এত কাণ্ডকারখানার পর তো বাবু উঠিলেন। তাহার পর সংসারের কাজকর্মে একটু দেখা যায়। কিন্তু এই সময়ে মিনিটে মিনিটে যেমন ‘সদু! ও সদি!’ বলিয়া হাঁকাহাঁকি হইতে থাকে, তাহাতে আমার মনে হয়, মেয়েটি ফাঁকি দেওয়ার নব নব পন্থা আবিষ্কার করিতেই বেশি মনোযোগী। এক-এক দিন আবার ঝাঁজিয়া উত্তর দিতেও ছাড়ে না। খালি ‘সদি, সদি, সদি’, মলেও সদি নিস্তার পাবে না দেখছি!

গলাটা খুব-ই মিষ্টি বলিতে হইবে; কেননা, এমন রূঢ় কথাগুলাও এর চমৎকার শোনায়।

ইহার পর কোলের ভাইপোটিকে বাঁকা কাঁকালে লইয়া ছাতের উপর উঠিয়া পাশের বাড়িতে এক সই আছে, আলিসার আড়াল হইতে তাহার সহিত গল্প জুড়িয়া দেওয়া হয়। এই সময় আমি চেয়ারটা জানালার একেবারে কাছে টানিয়া আনি, কারণ কথাবার্তা যা চলে তাহা একটা শুনিবার জিনিস। অনভিজ্ঞ লোকের ঠিক এই রকম ধারণা দাঁড়াইয়া যাইতে পারে যে, বক্ত্রী একটি সংসারভারনির্জিতা প্রকাণ্ড গিন্নী।—মার দুদিন থেকে শরীরটা কেমন খারাপ যাচ্ছে, দাদা আর বউদির নিত্য ঝগড়ার জ্বালায় আর তো পারা যায় না ভাই, ছোট ভাইটি কোন মতেই বাগ মানছে না, সমস্ত দিন তার টিকিই দেখা যায় না, বাবার সদু ভিন্ন এক দণ্ড চলে না। ঠাকুরদা? উনি নাতনীর হাতের তামাক যে কি চিনেছেন, আর ব’লো না, আমার ভাই, যদি একটু মরবার ফুরসত আছে!

এদিকে কয়দিন হইতে মুশকিলে পড়িয়াছি। খুব তো সংগোপনে ছিলাম কিন্তু একটু অসাবধানের জন্য সেদিন চোখাচোখি হইয়া গেল। আর কিছু দুঃখ নাই, কারণ সেই একটি মুহূর্তে যাহা পাইয়াছি, তাহা জীবনের অতুল সম্পদ হইয়াই থাকিবে; তবে দুষ্টু সেই অবধি অত্যন্ত সাবধান হইয়া গিয়াছে। গলার সে বাঁশি থামিয়া গিয়াছে, সখীর সঙ্গে সে বিশ্রম্ভালাপ নাই। আর দেখা? কোথায় প্রাণ ভরিয়া দেখিতেছিলাম, তাহার বদলে ত্রস্ত সন্দিগ্ধ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের এক-আধটা অতি চপল বিক্ষেপ, তাহাতে কি আশ মিটে?

আবার এই নিষ্ঠুর সঙ্কোচ ঘর-দুয়ারেও যেন সংক্রামিত হইয়া গিয়াছে। স্পর্শকাতর লজ্জাবতী পাতার মত জানালার দুইটি সবুজ পাল্লা খড়খড়ি সমেত প্রায় বুজিয়াই থাকে। ওই একজনের লজ্জা অমন মুখর বাড়িটাকে যেন মৌন নতমুখী করিয়া দিয়াছে। পাশের, আমার এ বাড়ি হইতে সর্বদা যেন একটা তপ্তশ্বাস উঠে।

একদিন দুপুরবেলা আপিস হইতে পলাইয়া আসিয়া একটু সুফল পাইয়াছিলাম। বাহিরের ঘরে ঠাকুরদাদার তামাকের সরঞ্জাম করিতে করিতে মাঝে মাঝে সুমিষ্ট রসালাপ চলিতেছিল : চুরি করিয়া খুব শোনা গেল। এই মেয়ে জাতটা যে কি, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। অতটুকু বেলায় আমাদের জিবের আড় ভাঙে না, আর ওই এক ফোঁটা মেয়ে, হদ্দ তেরো হইতে চোদ্দ বছরের মধ্যে হইবে, সমানে ষাট বছরের বুড়োর সঙ্গে পাল্লা দিয়া গেল। যাহার হাতে পড়িবে, তাহাকে নাজেহাল করিয়া ছাড়িবে দেখিতেছি।

সে কথা যাক, এ রকম ভাবে আপিস-পালানো তো রোজ চলে না। অথচ মন যে ক্ষেত্রে পলাতক, সে ক্ষেত্রে জড়পিণ্ড শরীরটাকে শুধু শুধু বসাইয়া রাখিয়াই বা ফল কি? এ রকম ভাবে সমস্ত দিন একটু দেখার তৃষ্ণা, একটু কথার তৃষ্ণা লইয়া কত দিন চলিবে?

যে সুন্দরী, একেই তো এই গলির আর ওই দেওয়ালগুলার নির্মম ব্যবধানের বাহিরে ঘুরিয়া মরিতেছি, তাহার উপর আবার এই কঠোর মনে তার পাষাণভার কেন?

৩০শে আষাঢ় দারুণ নিরাশায় অবশেষে সাহস আনিয়া দিল। ওর ঠাকুর্দার সহিত আলাপ জমাইয়া লইয়াছি।

গিয়া বলিলাম, আমার একটি বন্ধু আসবে আজ দুপুরবেলা। সে সময় আমায় আপিসে থাকতে হবে। দয়া ক’রে যদি এই চাবিটা তাকে দিয়ে দেন—তাকে বলা আছে, আপনার কাছে আসবে। মানে হচ্ছে, নতুন চাকরি, অসময়ে আপিস ছেড়ে আসাটা— বুঝলেন কিনা—

কথাটা আগাগোড়া বানানো। তা যে রকম অবস্থা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে অত সত্যমিথ্যে বাছিতে গেলে তো মারা যাইতে হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সত্যপ্রিয় বলিয়া ইহলোকে যাঁহারা নাম কিনিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের কাহাকেও এইরূপ একটি চতুরাকে ভালবাসিয়া নাকাল হইতে হয় নাই। সুবোধ এবং সত্যবাদী বলিয়া আমারও একসময় যশ ছিল; এখন দেখিতেছি, তাহা রাখিতে পারিলে হয়।

ঠাকুরদাদা নাকের ডগায় চশমা দিয়া কি পড়িতেছিলেন। নাকটা আরও নীচু এবং চোখটা উঁচু করিয়া আমায় নিরীক্ষণ করিলেন তাহার পর জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি এই সামনের বাড়িটাতে থাক? তা কই, দেখি না তো কখনও?

বলিলাম, থাকি বড় কম; প্রায় সমস্ত দিনটা আপিসে চাকরি সামলাতেই কেটে যায়, আজকালকার বাজার, জানেনই তো।

কি নাম তোমার বাপু? নতুন এসেছ নিশ্চয়? একলা থাক নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ, এই দিন পাঁচ-ছয় হ’ল এসেছি। নামও বলিলাম।

বেশ বেশ, ব’স। তাই তো বলি, আজ সদুকে যখন বললাম ঘোষেরা সামনের বাড়ি থেকে উঠে গেছে, নতুন কারা এল বলতে পারিস? সে বললে, কই, কাউকেও দেখতে তো পাই না।

মনে মনে হাসিলাম, ভাবিলাম, একটা শুভলক্ষণ বটে, মিথ্যা বলাটা তাহা হইলে ও তরফেও দরকার হইয়া পড়িয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, সদু কে? সেই যে ফরসাপানা ছোট ছেলেটি স্কুলে যায় দেখি? মুখে একটুও বাধিল না; সদুর প্রসঙ্গটা উঠিয়াছে, একটু চালাইতেই হইবে।

ঠাকুরদাদা হাসিয়া উঠিলেন। এত হাসিলেন যে আমার ভয় হইল, বুঝি চতুরালি ধরা পড়িয়া গিয়াছে। বলিলেন, না, সে সদু হতে যাবে কেন? সে আমাদের ঝড়ু; সদু হচ্ছে ওর বোন। অমন মেয়ে দেখেছ কি না বলতে পারি না, আর কিছু নয় তো, গড়ন ওরকম— ওরই বের জন্যে দিন দেখতে তো এই পাঁজি নিয়ে বসেছি। এই দেখ না, শ্রাবণ মাসে দুটো দিন আছে। (পাঁজিটা আমার দিকে ঠেলিয়া দিলেন) না, তোমার বুঝি আবার আপিসের তাড়া

নিজের বাঞ্ছিতার জন্য পাঁজি দেখা ইহার পূর্বে কাহারও ভাগ্যে ঘটিয়াছে কিনা জানি না। লজ্জাকে এতদূর পর্যন্ত পরাভব করা অসম্ভব হইয়া পড়িল, বলিলাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, মোটেই বসবাস উপায় নেই; এখন তা হ’লে আসি; দয়া ক’রে চাবিটা—

সে তুমি নিশ্চিন্দি থেকো।—বলিয়া বৃদ্ধ আমায় কবাট পর্যন্ত আগাইয়া দিলেন; আবার বলিলেন, মাঝে মাঝে এসো, এই তো একই বাড়ি।

বলিলাম, নিশ্চয় আসব; আমার তো সঙ্গীর বড়ই অভাব।

বৃদ্ধ বলিলেন, তা যদি বললে, সঙ্গীর অভাব আবার সব অভাবের ওপরে, জানি কিনা। আমার বুড়ো বয়সের সঙ্গী হয়েছে নাতনীটি। তা বলতে কি, এক দণ্ড যদি তাকে না দেখেছি, কি তার কথা না শুনেছি, তো সে আর কি বলব! তোমারও তো ঠিক সেই রকমই হয়?

বলিলাম, হ্যাঁ, হয় বইকি। উত্তর দিয়া কিন্তু বুঝিতে পারিলাম, বৃদ্ধের প্রশ্নটাও বেখাপ্পা হইয়াছে, আমার উত্তরটাও।

কথাটা কিন্তু সত্য, যেন প্রাণের কথা অজ্ঞাতসারে বাহির হইয়া আসিয়াছে। কয়টা দিন যে কি গিয়াছে, তাহা অন্তর্যামীই জানেন। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নাই, আফিস যাইতে পা উঠে না, জানালাটির পাশে সতৃষ্ণ নয়নে চাহিয়া আছি, কখন ছাতে ভিজা নীলাম্বরী শাড়িটি মেলিয়া দিতে আসিবে; ওই কৃপণ বৃদ্ধ জানালার সঙ্কীর্ণ ফাক দিয়া কখন একটু তরল আওয়াজ ভাসিয়া আসিবে, ঠাকুরদাদার ঘরে কখন কলহাস্যের ঢেউ উঠিবে, সেই আশায় বৈষ্ণব ভিখারি নিতাই আসে, তবে আপিসের সময় উতরাইয়া গেল। তবুও কখন কখনও বসিয়া থাকিতাম। দ্রুততালে মন্দিরা বাজাইয়া গান গাহিবে—

(প্যারীর) দরদ ভেল জীবন-নিধি
সঙ্গোপনে মরমে ধরে
সখীরেও নাহিক হয়ে কিছু বাণী
(প্রেমের কথা প্রকাশ করে না, বুকের ব্যথা পুষে রাখে, প্রকাশ করে না)

প্রথমে দরজার কাছে আসিয়াই শুনিত, কিন্তু সেই চোখাচোখি হওয়া অবধি জানালাটি ঠেলিয়া দিয়া আড়ালে দাঁড়াইয়া থাকিত। আমি দেখিতে পাইতাম না বটে, তবু অন্ধের মত প্রাণ দিয়া অনুভব করিতাম। গান শেষ হইয়া গেলে ভিখারি বাদ্যযন্ত্রে দুইটা বড় ঘা দিয়া বলিত, কই গো দিদিমণি, এক মুঠো দিয়ে দাও লক্ষ্মীমণি, আবার অন্য বাড়ি আছে।

লক্ষ্মীমণি ক্ষণিকের জন্য বাহির হইত, ভিখারিকে একসঙ্গে তৃপ্ত করিয়া আবার ত্বরিতে চলিয়া যাইত।

ওর ঠাকুরদাদা ঘরে থাকিলে বৈষ্ণব বাবাজীর জ্যোতিষ জ্ঞানভাণ্ডের মুখটা খুলিয়া কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়া যাইতে হইত। সেসব প্রশ্নও বাঁধা, তাহাদের উত্তরও প্রায় একই। ঠাকুরদাদা জিজ্ঞাসা করিতেন, গোসাঁইজী, তারপর মেয়েটার বরের ভাগ্যি কেমন দেখছেন? গোসাঁইজী বলিত, ওই যে বললাম দাঠাকুর, মা শাপভ্রষ্ট দেবকন্যে; ও আর দেখতে আছে!

ঠাকুরদাদার মুখটা আনন্দের হাসিতে ভরিয়া উঠিত। বলিতেন, না না, সে ভাগ্যি কি আমরা করেছি? তারপর আবার গম্ভীর হইয়া পড়িতেন; প্রশ্ন হইত আচ্ছা, বর জুটতে এত দেরি হচ্ছে কেন বলতে পারেন? আমি ওখানটা বুঝতে পারি না।

বাবাজী বলিত, ঠিক ওইজন্যেই; এক যে-সে এসে বিয়ে ক’রে নিয়ে গেলেই তো হ’ল না দাদাঠাকুর। তবে আমি দেখলাম খড়ি কেটে—বর রথে চড়েছে, আর দেরি নেই। ঠাকুরদাদার তখনকার মত সন্দেহটা মিটিয়া যাইত। বৈষ্ণব খানিকটা ফৌজদারী বালাখানার তামাক কিংবা দুইটা পয়সা লইয়া ‘জয় রাধেশ্যাম’ বলিয়া বিদায় হইত।

এই রকম ছোট্ট ছোট্ট ব্যাপারগুলি সমস্তই আমার অন্তরের বিরহব্যথায় করুণ হইয়া উঠিত। এক-একদিন ভিখারি চলিয়া গেলেও চেয়ারের হাতলে মাথা রাখিয়া বসিয়া থাকিতাম। সকালে নাওয়া-খাওয়া যেমন নিষ্প্রয়োজন বলিয়া বোধ হইত, এ সময় আপিস যাওয়াটাও ঠিক তেমনই একটা বাজে কাজ বলিয়া মনে হইয়া মনটাকে সারা জীবনটা সম্বন্ধেই নিশ্চেষ্ট নিশ্চল করিয়া দিত। ঝকঝকে তকতকে মনোরম ঘরে বসিয়া থাকিতাম, সামনে কোমল শয্যা, আলনায় ভদ্রোচিত কাপড়-চোপড়, প্রয়োজনাতিরিক্ত দুই-একটা শৌখিন দ্রব্যও সাজানো থাকিত; আপিসে সাহেবের অপরিমিত প্রীতিদৃষ্টিও ছিল; কিন্তু কিছুতেই স্বাদ ছিল না, এবং এসবের তুলনায় দুইদিন আগে যে রাস্তায় রাস্তায় সেই নিরুদ্দেশভাবে ঘুরিয়া বেড়ানো, সেটাকে তেমন বিশেষ দুঃখকর বলিয়া বোধ হইত না। মনে হইত, আর যাহাই হউক, তাহার মধ্যে একটা বিশাল স্বাধীনতা ছিল। তখন অমৃতের সন্ধানও পাই নাই, আর সে কারণে, এই দারুণ অভাবের কঠোর যন্ত্রণাও ছিল না। এক কথায়, আমার কাছে দুঃখের স্মৃতিতে আর দুঃখ ছিল না এবং প্রত্যক্ষ সুখের মধ্যেও সুখ ছিল না; সদুর বিরহ-ব্যথা আমার অতীতকালের যন্ত্রণা, বর্তমানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং ভবিষ্যতের আশার আশা—সমস্তকেই আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল। যেন বন্যার জলে সবে একাকার করিয়া দিয়াছে, ফুলের বাগানও ডুবিয়াছে, কাঁটার বনও ডুবিয়াছে, আছে খালি দিগন্ত প্রসারিত গাঢ় জলরাশি।

তাই বলিতেছি, সে যে কি যন্ত্রণায় কয়টা দিন গিয়াছে, তা অন্তর্যামীই জানেন।

.

৭ই শ্রাবণ

ঠাকুরদাদাকে সেই তো ভাব করিয়া চাবি দিয়া আসিলাম; বিকালবেলা দেখা করিতেই বলিলেন, কই ভায়া, তোমার বন্ধু তো এলেন না? আমি সমস্ত দিন এইখানে ঠায় ব’সে, জলখাবার-টাবারও আনিয়ে রাখলাম, কিন্তু কই?

অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া পড়িলাম; একটা মিথ্যা কথা বলিয়া সমস্ত দিন বৃদ্ধকে এতটা কষ্ট দিলাম! আসল কথা, অন্যমনস্ক ছিলাম যে, এ সম্ভাবনাটাই মনে উদয় হয় নাই। ইহার উপর উনি যে আবার আতিথ্যের আয়োজন করিয়া বসিবেন তাহা ঘুণাক্ষরেও বুঝিতে পারি নাই; তা হইলে না হয় মিথ্যা কথাটার উপর আর একটু জুড়িয়া দেওয়া যাইত যে, আগন্তুক বন্ধুর জন্য ঘরে সমস্ত আয়োজন সারিয়া রাখিয়াছি।

সমস্ত দোষ সদুর, ও আমার মন লইয়া যে কি যাদু করিয়াছে, ওই জানে।

ঠাকুরদাদা বলিলেন, তা হ’লে তোমায়ই এনে দিক, একটু জল খেয়ে নাও। না, সে হয় না; তবুও তোমার বন্ধু না খেয়ে তুমি খেলেও আমাদের একটা সান্ত্বনা থাকবে। সদু, ও সদু! বলি, ও বড়গিন্নী! এটি আমার পাতানো সম্বন্ধ। শেষের কথাগুলি বৃদ্ধ বড়গিন্নীর টীকাস্বরূপ আমায় বলিয়া স্মিত হাস্য করিলেন।

ঝড়ু দুয়ারের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল, বলিল, কি?

বলি, সে কোথায়?

ঝড়ু দুয়ারের পিছনে তাকাইল।

ঠাকুরদাদা বলিলেন, হয়েছে; নিজে আড়ালে থেকে বুঝি তোমায় চর পাঠিয়েছেন? বল, সে খাবার জল, পান সব নিয়ে আসতে। ঝড়ু আর একবার অন্তরালে তাকাইয়া বলিল, বলছে—তুই আগে।

কেন? ও, হয়েছে।—বলিয়া ঠাকুরদাদা হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, তোমায় লজ্জা, বুঝেছ ভায়া? আমার এতক্ষণ ঠাওরই হয় নি।

বৃদ্ধ উঠিয়া গিয়া সঙ্কোচে জড়সড়, লজ্জায় রাঙা-মুখ নাতনীকে ধরিয়া আনিয়া আমার হাত-তিনেক দূরে দাঁড় করাইয়া বলিলেন, পাশের বাড়ির লোক, ছেলেমানুষ; ওকে আবার এত লজ্জা? এইবার লজ্জা ভাঙল তো? যাও, খাবার নিয়ে এস। কই হে ভায়া, তুমিও যে দেখছি আবার মুখ নীচু ক’রে রইলে! সব সমান

এটা গেল প্রথম পরিচয়ের কাহিনী। এখন আর সদু আমার সামনে আসিতে জড়সড় হয় না, আমিও উহাকে কাছে পাইলে নিজের হাতের চিরপরিচিত দশটি আঙুল লইয়া গবেষণায় ব্যস্ত থাকি না। ছাতে নীলাম্বরীটার খাতির বাড়িয়া গিয়াছে। সদু একবার তাহাকে অনেকক্ষণ ধরিয়া নিংড়াইয়া খুব পরিপাটি করিয়া ভাঁজ খুলিয়া শুকাইতে দেয়; তাহার পর শুকাইল কি না, সে তদারকও মাঝে মাঝে করিয়া যায়। আমার সহিত এ সময় প্রায়ই দেখা হয়; কখনও হাসিয়া চলিয়া যায়, কখনও ছোট ভাইয়ের কথা পাড়ে—আজ ঝড়ু ঠিক সময়ে পড়তে গিয়েছিল শৈলেনদা? কিংবা ওকে খুব শাসনে রাখবেন, অথবা ওই রকম গোছের একটা কিছু—বলিবার মত কথার অভাবে যা আপনিই ঠোঁটের গোড়ায় আসিয়া পড়ে।

এদিকে সেই অকরুণ জানালা দুইটিও দরদী হইয়া উঠিয়াছে, দুই হাত ভরিয়া আমায় শব্দ-রূপের সম্ভার বিলায়। সকালে ঝড়ু যখন আমার কাছে পড়ে, সদু আসিয়া মাঝে মাঝে জানালার গরাদ ধরিয়া দাঁড়ায়। কয়েকটি নিয়মিত প্রয়োজন থাকে; প্রথমত ঝড়ুকে খাবার খাইবার জন্য ডাকা, তাহার কিছু পরে আমার চা লইয়া আসিবার জন্য ফরমাশ করা, এবং সবশেষে নয়টা বাজিয়া গিয়াছে, স্নানের সময় হইয়াছে, এইসব খবর দেওয়া; যদিও তাহার বিশেষ কোন প্রয়োজন থাকে না, কারণ আমার কাছেও ঘড়ি থাকে, এবং ও-বাড়ির ঘড়িটা ঢং ঢং করিয়া যখন বাজে, তখন ঝড়ুর সতর্ক কর্ণে সবচেয়ে আগে তাহার খবর পৌঁছায়।

মাঝে মাঝে গিয়া ঠাকুরদাদার কাছে বসি। প্রায় দেখি, হুঁকা হাতে করিয়া, নয় পাঁজিটা খুলিয়া, না হয় সদুর ঠিকুজিটা মেলিয়া গভীর মনোনিবেশের সহিত ঝুঁকিয়া চাহিয়া আছেন। বলেন, ভাবনার কথা নয়, শৈলেন ভায়া? ঠিকুজিতে লিখছে, ‘ত্রয়োদশবর্ষপ্রাপ্তৌ’ বিয়ে হয়ে যাবে; তা কোন লক্ষণ কি দেখতে পাচ্ছ? তুমিই বল না। বাপকে বললে বলে, সময় হ’লেই হবে। দিব্যি নিশ্চিন্দি আছে।

আমি বিজ্ঞের মত বলি, নিশ্চিন্দি থাকাটা আর তো কোনমতেই উচিত হয় না।

এ সমর্থনটুকু পাইয়া ঠাকুরদাদার উৎসাহ ও আমার প্রতি শ্রদ্ধা অত্যন্ত বাড়িয়া উঠে। বলেন, এই তো সমঝদারের মতন কথা। ওরা সব বলবে, ছেলেমানুষ! হ্যাঁ হে শৈলেন, তেরো বছরের মেয়ে ছেলেমানুষ হ’ল? তুমিই বল না। তেরো পেরিয়ে গেছে কোন্ দিন, এবার চোদ্দয় পড়বে। ব্রহ্মজ্ঞানী নয়, খ্রীশ্চান নয়—

বলিতে গিয়া কথাটা একটু জড়াইয়া গেলেও আমি বলি, না, ছেলেমানুষ তো আর মোটেই বলা চলে না।

ঠাকুরদাদা মাথা কাত করিয়া চোখ বড় করিয়া বলেন, মো-টেই আ-র বলা চলে না। ঠিক, আমারও এই কথা। না ভায়া, ওই যে বললাম, তুমি ভেতরে ভেতরে চেষ্টা কর। একটু ঘোরাঘুরি করতে হবে, তা কিছু মনে ক’রো না। আমায় তো দেখছই, বাতে পঙ্গু, জ্যান্তে ম’রে আছি। বেশ ভাল করে দেখেছ তো মেয়েটাকে? একেবারে নিখুঁত করে বর্ণনা করবে। না হয়, নিজেই এসে দেখে যাক, কাজ কি? দেখি একবার চোখে দেখলে কোন্ শালা না বিয়ে করে থাকতে পারে।

বৃদ্ধের মুখটা বিজয়ের গৌরবে দীপ্ত হইয়া উঠে এবং এইরূপ সময় সদুর ডাক পড়ে তামাক দিয়া যাইবার জন্যে। আমায় চাপা গলায় বলেন, খুব লক্ষ্য ক’রে দেখ তো ভায়া, গড়ন থেকে নিয়ে ইস্তক চলনটি পর্যন্ত কোন জায়গায় কোন দোষ চোখে পড়ে কি না!

সদু আসিয়া কলিকা তামাক টিকা লইয়া যায়। একটু পরে কলিকায় ফুঁ দিতে দিতে এবং জ্বলন্ত টিকায় মাঝে মাঝে টোকা মারিতে মারিতে ফিরিয়া আসে। কোন দিন নিঃসংশয় চিত্তে এটা সেকথা তুলিয়া একটু দেরি করে; কোন দিন বা অহেতুক ভাবেই লজ্জিত হইয়া পড়ে, তাড়াতাড়ি হুঁকাটা ঠাকুরদাদার হাতে দিয়া, কোনদিকে না চাহিয়া, কাহারও সহিত কথা না কহিয়া বাহির হইয়া যায়।

আমি কিছু দেখি, বাকিটুকু জীবন্ত কল্পনার সাহায্যে পূরণ করিয়া লই। সেটুকু সময়ের মধ্যে ঘরের হাওয়ায় যে কি একটা মধুর বিপর্যয় হইয়া যায়, তাহা বলিতে পারি না। চলিয়া গেলে ঠাকুরদাদা হুঁকায় ঘন ঘন টান দিতে দিতে আমার পানে আড়চোখে চাহেন। বলেন, কি রকম দেখলে বল দিকিন?

প্রথম প্রথম বেজায় লজ্জা করিত, হয়তো বলিতাম, মন্দ কি, কিংবা খুব জোর— ভালই তো। আজকাল কখনও কখনও একটা বিশিষ্ট অভিমতও দিই, বলি রঙটা এদানি যেন একটু আরও মাজা-মাজা বোধ হচ্ছে না? অথবা চলনটা যেন একটু ভারিক্কে হয়ে এসেছে না? আপনি কি বলেন? ওর ঠাকুরদাদার সামনে কখনও কখনও একটু লুকোচুরি, বেহায়াপনা আজকাল বড় মিষ্ট বলিয়া বোধ হয়।

ঠাকুরদাদা উৎফুল্ল হইয়া বলিয়া উঠেন, তোমার চোখ আছে; আমি তো ঠিক ওই কথাটিই বলতে যাচ্ছিলাম।

এক-একদিন ঘরে ঢুকিতেই ঠাকুরদাদা প্রশ্ন করেন, কি ভায়া? কাজ কিছু এগুল? তোমার গিয়ে সেই ছেলেটির কি হল?

ঠাকুরদার তাগিদের ঝোঁক সামলাইবার জন্য একটি কাল্পনিক পাত্রকে খাড়া করিয়া রাখিয়াছি। এক হিসেবে নেহাত কাল্পনিকও নহে। এক বছর এম. এ. পড়িয়া কলেজ ছাড়িয়া এখন চাকুরিতে ঢুকিয়াছে; বাড়ির অবস্থা নিতান্ত খারাপ নয়—মোটা ভাত, মোটা কাপড়টা চলিয়া যায়। ছেলে দেখিতে শুনিতে চলনসই, যেমন গৃহস্থঘরের ছেলে হইয়া থাকে!

ঠাকুরদাদার প্রশ্নের উত্তরে বলি, সে পাত্র তো প্রায় হাতের পাঁচ ঠাকুরদা; আমার ছেলেবেলার বন্ধু, ধ’রে পড়লেই হবে। ওর চেয়ে ভাল যদি পাওয়া যায় তো দেখতে দোষ কি?

ঠাকুরদাদা বলেন, সে কথা হাজার বার বলতে পার; নাতনী আমার রাজা-রাজড়ার ঘরের বেমানান হবে না। তবে, এ পাত্রও বা মন্দ কি শৈলেন? বলছ, তিন-তিনটে পাস, দেখতে-শুনতেও মন্দ নয়। আচ্ছা, গায়ের রঙটা কেমন হবে বল দিকিন—ওর সঙ্গে মানাবে তো? দাঁড়াও, হাতে পাঁজি মঙ্গলবার; সামনেই এনে দিচ্ছি, আর একবার ভাল করে দেখেই বল না। সদু, অ দিদিমণি!

সদু আসে, ঠাকুরদাদার মিথ্যা অছিলা শুনিয়া চলিয়া যায়। ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া পাত্রের রঙটা মনে করিবার চেষ্টা করি। ঠাকুরদাদা অসহিষ্ণুভাবে নানান রকম আভাস দিতে থাকেন, আচ্ছা, সদুর চেয়ে কত ময়লা? যদি পাশে দাঁড় করানো যায় তো উনিশ-বিশ আঠার-বিশ? ধর, তোমার গায়ের রঙ হবে?

আমি পরিত্রাণ পাইবার জন্য তাড়াতাড়ি নিজের হাতের দিকে লক্ষ্য করিয়া বলি, হ্যাঁ, তা হ’লেও হতে পারে।

তা হলে তুমি ঠিক করে ফেল। সত্যি বলতে কি শৈলেন ভায়া, আমার কেমন যেন ছেলেটিকে মনে লেগেছে। থাকতে পারে ওর চেয়ে ঢের ভাল পাত্র; কিন্তু আমার মন যেন বলছে, ঐ আমার সদুর বর।

আমি আজকাল খুবই বেহায়া হইয়া পড়িয়াছি, কিন্তু ইহার পর আর লজ্জা দমন করিয়া বসিয়া থাকা অসম্ভব হইয়া পড়ে; আমি উঠিয়া পড়ি; বলি, তা হ’লে তাই দেখব; এখন তবে আসি।

বৃদ্ধ এক-একদিন আমায় বুকে চাপিয়া ধরেন। শিশুর মত সারল্যে ভরা, চক্ষু দুইটি কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে ছলছল করিয়া উঠে। বলেন, ভাই, আর জন্মে তুমি কে ছিলে আমাদের যে, এই দুদিনেই এত আপনার হয়ে পড়েছ? পরের মেয়ের জন্যে কে এত দেদারি ঘাড়ে করে বল দিকিন?

আর গলির ব্যবধানটিও নাই। আমি গলি পারাইয়া আজকাল সদুদের পাশের বাড়িটিতেই আছি।

এটুকু ঠাকুরদাদার স্নেহের প্রসাদ। একটা বিপদ আসিয়া পড়িয়াছিল, যা বোধ হয় আমায় আমার স্বর্গ হইতে দূরে নিক্ষেপ করিয়া দিত। ঠাকুরদাদার স্নেহে সেটা একটা সম্পদে পরিণত হইয়া আমায় একেবারে স্বর্গের সীমানার মধ্যেই তুলিয়া লইয়াছে।

আমার বাড়িওয়ালা উপরে একটা ঘর তুলিয়া দ্বিগুণ ভাড়ার নোটিশ দিয়া গেল। সেদিন ঠাকুরদাদার কাছে যখন গেলাম, মুখটা বোধ হয় বিমর্ষ ছিল। তিনি সমস্ত কথা না শুনিয়া ছাড়িলেন না। শুনিয়া সদুকে ডাকিয়া তামাক সাজিতে বলিয়া আমায় কহিলেন, র’স, বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিই।

বুদ্ধির গোড়ায় ভাল করিয়া ধোঁয়া পড়িলে বলিলেন, হয়েছে, এ আর শক্ত কথা কি?

সদু দুয়ারের কাছে দাঁড়াইয়া ছিল, ঠাকুরদাদা একটা ঠাট্টা করিতে সে বেচারা দুড়দুড় করিয়া পলাইয়া গেল। ঠাকুরদাদা একটু হাসিয়া চুপিচুপি আমায় বলিলেন, কথাটা একটু গোপনীয়। বলি কি—তুমি আমাদের এই পাশের বাড়িটাতে চ’লে এস; দু মাস থেকে মিছিমিছি ভাড়া গুনছি।

আমি কথাটা ভাল বুঝিতে না পারিয়া মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। ঠাকুরদাদা বলিলেন, দেখ ভায়া, মেয়েটার বিয়ে যে খুবই কাছে, এ কথায় তুমি সন্দেহ ক’রো না। তা যদি হ’ল—আমাদের এই একটি বাড়িতে কি কুলুবে সে সময়? কুলুবে না। আচ্ছা, তা হ’লে আমি তখন বাড়ি পাচ্ছি কোথায়? এই সব ভেবে-টেবে, মিত্তিররা ছাড়বার পর থেকে পাশের বাড়িটা ধ’রে রেখেছি। মন্দ কাজ করেছি? তুমিই বল না, ছেলেকে বলিনি। বললেই, বাজে খরচ বাজে খরচ ক’রে রদ ক’রে দেবে। ভূ-ভারতের মধ্যে আর কেউ জানে না। জানে এক বাড়িওয়ালা আর আমি, আর এই তুমি জানলে।

আমি তো স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। কোথায় কি তাহার ঠিক নাই, অথচ এই বৃদ্ধ এ কি কাণ্ডকারখানা করিয়া বসিয়াছেন! মনে হইল, বলি, ঠাকুরদা, যখন এতই নিশ্চয় তুমি, তা হ’লে বোধ হয় নিজেই বিয়ে করবে ঠিক করেছ—বলিয়া লঘু বিদ্রুপের ঘায়ে সাংঘাতিক ভুলটা ভাঙিয়া দিই। কথাট, ঠোঁটেও আসিয়াছিল, এবং কর্তব্য হিসাবে বলিয়া ফেলাও উচিত ছিল; কিন্তু পারিলাম না। দেখিলাম, অপরিসীম বিশ্বাসভরে এই শিশু-বৃদ্ধ নিজের সত্যমিথ্যা ধারণাগুলি লইয়া জীবনের অবসান-দিনে একবার পুতুল-খেলা খেলিতে বসিয়াছেন; যুক্তির রসায়ন সে অন্ধ-বিশ্বাসের উপর ঢালিয়া তাহাকে গলাইয়া দেওয়া নিতান্ত হৃদয়হীনের কাজ বলিয়া বোধ হইল।

তা ছাড়া অন্তরের মধ্যে প্রিয় সান্নিধ্যের যে একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাহা এখানে আর অস্বীকার করি কেন? এ কথাও ভাবছিলাম যে, আমি ভাড়াটি দিয়া দিলে এই পরিবারটির এই নিরর্থক খরচাটাও বাঁচিয়া যাইবে; কিন্তু ঠাকুরদাদাকে এড়াইয়া তাহা যে পারিব, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আলাদা আছি বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই স্নিগ্ধ পরিবারটির সহিত এক হইয়া গিয়াছি বলিলেও চলে। সবাই এই নিঃসঙ্গ প্রবাসীকে অন্তরের প্রীতি ও স্নেহ দিয়া আমন্ত্রণ করিয়া লইয়াছে। এই গ্রহণের মধ্যে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কেহ একবার একটু থমকিয়া ভাবিয়া দেখিল না; সবাই যেন সব সময়ের জন্য হৃদয়ের দুয়ার খুলিয়া রাখিয়াছে। আমিও দ্বিধাহীন পদে সেই দুয়ার পথে এমন সহজে প্রবেশ করিয়া এমনই সহজে মিলিয়া গেলাম যে, অপরিচয়ের রেখাটা যে কখন অতিক্রম করিয়া আসিলাম, তাহার জ্ঞানই নাই।

চরম সৌভাগ্যের কথা এই যে, সদু আমার এই অকিঞ্চন গৃহখানিতে পা দিয়াছে।

আরশির গায়ে যে ওই ফুলকাটা পরদা, সেই সদুরই হাতের নিদর্শন, বাক্সগুলোর উপর যে রঙিন কাপড়ের ঢাকনা, সেগুলিও সেই পদ্মহস্তখানির কর্ম সৃষ্টি। আমার ব্যবহারের জিনিসগুলার মধ্যে যে এমন শ্রী লুকানো ছিল, তাহা সদু স্পর্শ করিবার পূর্বে জানিতে পারি নাই। দুপুরবেলা আমি যখন আপিসে যাই, চাবিটা সদুর জন্য ঠাকুরদাদার কাছে দিয়া যাইতে হয়। ফিরিয়া আসিয়া দেখি, ঘরটিতে যেন সৌন্দর্যের আরও কয়েকটি নূতন পাপড়ি খুলিয়াছে।

সকালবেলা ঝড়ু যখন পড়ে এবং আমি হেলানো চেয়ারে বসিয়া নানান কথা ভাবিতে থাকি, সে সময় সদু প্রায়ই আসে—কখনও হাতে একটা ঘর-সাজানোর জিনিস লইয়া, আবার কখনও মুখে মিষ্টি অনুযোগ লইয়া—কোন্ জিনিসটা একটু আগোছ করিয়া ফেলিয়াছিলাম, কোন্ জিনিসটা কিনিয়া আনিতে ভুলিয়া গিয়াছি, কোন্ জিনিসটা ব্যবহার করিবার প্রণালী ঠিক বুঝি নাই—এই সব

আমি কখনও কখনও বলি, ব্যাটাছেলে চিরকাল লক্ষ্মীছাড়া অগোছালো—

মেয়েদের এই পরোক্ষ প্রশংসাতে সুন্দর মুখখানি লজ্জায় একটু রাঙা হয় এবং একটু নুইয়া পড়ে। সদু বলে, অমন কথা বলবেন না শৈলেনদা, তা হ’লে এই যে ছেলেটি দেখছেন, ও বাড়িতে একটি জিনিসও গোছানো থাকতে দেবে না; একেই তো গোছাতে গোছাতে আমার প্রাণান্ত।

এই রকমের কথাবার্তায় ভাই-বোনে কখনও কখনও একটু কলহ হইয়া পড়ে। দুইজনেই যখন আমায় মধ্যস্থ মানিয়া বসে আমি পড়িয়া যাই সে এক মহা সমস্যায়; দুইজনেরই পিঠ ঠুকিয়া আর কবে সুবিচার হইয়াছে? সদুর সপক্ষে রায় দিলে ঝড়ু গরগর করিতে থাকে। কেন কে জানে, তাহাতে একটু লজ্জিত হইয়া পড়িতে হয়। ঝড়ুর সপক্ষে বলিলে সদু খানিকক্ষণ একেবারেই কিছু বলে না, তখন মনে হয় এর চেয়ে একটু লজ্জা পাওয়া বরং ছিল ভাল।

কাল আপিস হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম, শরীরটা তেমন ভাল ছিল না। সদু উপরের ছাদে কি করিতেছিল, এমন সময় পাশের ছাদে সেই সখীটি আসিয়া দাঁড়াইল। একটু অভিমান এবং বিদ্রূপের স্বরে বলিল, আর যে বড় দেখি না ভাই, আমাদের ভুলে গেলে নাকি?

সদু হাসিয়া বলিল, তোমার ওই এক কথা ভাই, যদি জানতে, কি খাটুনিটা—। বলিয়া সেই পুরানো ফর্দ আওড়াইতে যাইতেছিল। সখীটি বাধা দিয়া বলিল, তার ওপর আবার একটি নতুন লোকের ঘরকন্নার ঝক্কি নিয়েছ।—বলিয়া মুখের দিকে চাহিয়া একটু হাসিয়া আবার বলিল, না ভাই, রাগ ক’রো না, তোমার বউদি বলছিলেন, তাই জানলাম!

আলসের উপর একটু বুনো ফুলের লতা ছিল; একটি ফুল তুলিয়া সদু সঙ্গিনীর গায়ে ছুঁড়িয়া মারিল, লজ্জিতভাবে একটু হাসিয়া বলিল, তোমরা সব সমান, কেউ কম যাও না। সখীটি ইহার পর আরও সরিয়া আসিল এবং তাহার পর যে কথাবার্তা হইল, সে আর শোনা গেল না।

বোধ হয় এইজন্য আজ সকালে আসে নাই; অনেকক্ষণ পথ চাহিয়া ঠাকুরদাদার ঘরে গিয়া আড্ডা জমাইতে হইয়াছিল। তাও কি সেখানেও একটু দেখা দিল? লজ্জা-রোগটা চাগাইলে আর নিস্তার নাই।

বিকালে আসিয়াছিল; একটু লজ্জিত-লজ্জিত ভাবটা। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আজ সকালে একবারটিও আস নি কেন সদু? ‘একবারটি” কথাটার উপর একটা বেয়াড়া রকম ঝোঁক পড়িয়া গেল।

সদু কি একটা বলিতে যাইতেছিল, একটা ঢোক গিলিয়া মাথাটা নত করিয়া ফেলিল। কানের সোনা দুইটি গালের উপর পড়িয়া ঝিকমিক করিয়া উঠিল।

একটু দেখিলাম, তাহার পর বলিলাম—কি করিয়া যে বলিলাম তাই ভাবি— বলিলাম, তুমি একটু না আসাতে সদু, আমার সমস্ত ওলটপালট হয়ে গেছে।

মুখখানি রাঙা হইয়া উঠিল। একবার ঘাড়টা উঁচু করিয়া চোখ তুলিয়া তখনই আবার নত করিয়া লইল। আর একটি এই চকিত দৃষ্টির আশায় অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিলাম; পুরস্কৃত হইতাম কিনা কে জানে, তবে ঝড়ুটা বাদ সাধিল। ঘরের ভিতর ষান্মাসিক পরীক্ষার পড়া করিতেছিল, মহম্মদ তোগলকের পাগলামি সম্বন্ধে একটা ছাইপাঁশ প্রশ্ন করিয়া সব মাটি করিয়া দিল।

.

২২-এ অগ্রহায়ণ

অনেক দিন কিছু লিখি নাই। একেবারে সদু-ময় হইয়া আছি; একটুও কি ফুরসত আছে আর? মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধবেরাও গঞ্জনা দেয়। যাহাদের বিবাহ হয় নাই, তাহারা বলে, হ্যাঁ রে, তুই হেন যে আড্ডাবাজ, তাকেও পর্দানশীন ক’রে ফেলেছে একেবারে! কেউ সাত পুরুষ আর বিয়ে করে না!

সদুকে এই সব অভিমতের কথা যখন শুনাই, সে কৃত্রিম অভিমানে বলে, থাক না তুমি বন্ধুদের নিয়ে! পায়ে কি শেকল আঁটা আছে?

বলি, আছে যেন একটা।

হাসিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া বলে, আছে যেন একটা! তা সে কি আমি পরাতে গিয়েছিলাম?

না, শিকলটা আমি নিজেই পরিয়াছি। সে খুব সংক্ষিপ্ত কথা। শিকলটা গড়িতেই যা দেরি হইয়াছিল; পরিবার সময় এক কথাতেই পরা হইয়া গেল।

.

ইদানীং সব ছাড়িয়া ঠাকুরদাদা সেই হাতের পাঁচ ছেলেটির বড় তাগাদা দিয়াছিলেন। তাহার রাশি, গণ, মেল ইত্যাদি যোগাড় করিতে করিতে কয়েকদিন কাটাইয়া দিলাম; কিন্তু শেষে আর কোনমতেই রুখিয়া রাখা গেল না। বাড়ি গিয়াছে, কাজের ভিড় প্রভৃতি কয়েকটা অছিলা পর্যন্ত যখন নিঃশেষ হইয়া গেল, তখন একদিন নিরুপায় হইয়া তাহাকে নিমন্ত্ৰণ করিয়া আনিতেই হইল।

সেদিন যে কি মুশকিলেই পড়িয়াছিলাম, বিধাতাই জানেন! দশটা, এগারোটা, বারোটা বাজিয়া গেল, কাহারও দেখা নাই; কেই বা দেখা দিবে? ঠাকুরদাদা এক-একবার গলিতে উঁকি মারিয়া আসিয়া উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করিতেছেন, আমি ক্রমেই মূঢ়ের মত নির্বাক হইয়া আসিতেছি, কি করিয়া সামলাইব? শেষকালে বৃদ্ধ আর থাকিতে পারিলেন না; আমার হাত দুইটা ধরিয়া বলিয়া উঠিলেন, হ্যাঁ শৈলেন, তুমি কি বুড়ো ঠাকুরদাদাকে মিছে আশা দিয়ে পরিহাস করছ ভাই? অনেকে এমনও করে। অশ্রুতে দুইটি শীর্ণ গাল প্লাবিত হইয়া গেল। ইহার পরেও সঙ্কোচ করিয়া থাকা মহাপাতক। আমি মাটির দিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিলাম, ঠাকুরদা, আমিই মস্ত বড় একটা মিছে আশা ক’রে ব’সে আছি; আমায় ক্ষমা করুন! আমি নিজের সম্বন্ধেই এতদিন ব’লে এসেছি।

সব লিখিয়া রাখা অসম্ভব এবং বিশেষ প্রয়োজনও নাই; মোট কথা, ঠাকুরদাদা একটা তুমুল কাণ্ড করিয়া তুলিলেন। তিনি যে আমার কথা এতদিন ভাবেন নাই, এইটিই তাঁহার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য বলিয়া বোধ হইল এবং এই সমস্যা পূরণের ভার উলটাইয়া আমার উপর পড়িল।—হ্যাঁ হে শৈলেন, এমনটা কেন হ’ল বল দিকিন?

আমি বলিলাম, কি জানেন ঠাকুরদা, আলোর নীচেই অন্ধকার; বড় কাছে থাকায় আমি সেই অন্ধকারে পড়ে ছিলাম বোধ হয়।

সম্ভব। তা আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে লব, প্রেম কত কি হচ্ছে, কই, ঘুণাক্ষরেও তো জানতে পারি নি!

সে সব আমরা কেউ অত বুঝি-টুঝি না ঠাকুরদা; আমিও না, আপনার নাতনীও না। সেকেলের চাল ধ’রেই বসে আছি।

সম্ভব। না হ’লে এত সেকেলে মানুষ ঘেঁষা হতে না দুজনেই। কিংবা এও তো হতে পারে যে, বললে আলোর নীচেই অন্ধকার, সেই জন্যেই হাতের কাছে কি হচ্ছে, না হচ্ছে কিছু দেখতে শুনতে পাই নি।—বলিয়া চশমার উপর দিয়া আমার দিকে দৃষ্টি ফেলিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলনে।

.

ঠাকুরদাদার অত্যাচারে তাড়াতাড়ি মাস-খানেকের ছুটি লইতে হইল, এবং ইহারই একটি সার্থক দিনে সদু আর আমার মধ্যকার ক্রমসঙ্কীর্ণায়মান ব্যবধান একেবারেই বিলীন হইয়া গিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *