অবেলায় ফুলকলি
অসময়ে বৃষ্টি হল, দিনের অসময়ে তো বটেই বছরেরও অসময়ে। হোটেল থেকে বেরোতে দেরিও হয়ে গেছিল। রায়পুর এখন মস্ত শহর। ছত্রিশগড়ের রাজধানী হওয়ার পর থেকে তো রমরমা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। সরকারি অফিস-কাছারিও বেড়েছে। সকালে নারায়ণপুর থেকে বেরিয়ে অনেকখানি পথ গাড়িতে এসে মাঝদুপুরে রায়পুরের হোটেলে ফ্রেশ হওয়ার জন্য এসে উঠেছিল অনি। প্রদীপরা আজ মাঝরাতের গাড়ি ধরে নাগপুরে ফিরে যাবে। নাগপুর থেকে ওরা সদলবলে এসেছিল অনিকে বস্তার ঘুরিয়ে দেখাবে বলে। চারটে রাত আর পাঁচটা দিন যেন ঘোরের মতো কেটে গেল। জগদলপুর, দেবী দন্ত্যেশ্বরীর মন্দির, ইন্দ্রাবতী নদী, তার পর নারায়ণপুর। নারায়ণপুর থেকেই বাইসন-হর্ন মারিয়াদের অবুঝমারে যেতে হয়। অবুঝমারের প্রবেশপথের ওপরেই ছোটি ডোংরি নামের একটি বনবাংলোতে সালফি খেয়ে পরে একটি পরিত্যক্ত ঘোটুলে মারিয়াদের নাচ দেখা হল। অনেকে রণপা-তে চড়ে নাচল। ঘোটুলের সামনের হাতায়, যার পুরোটাই কাঠের টুকরোর বেড়া দিয়ে ঘেরা, হ্যাজাকের আলোতে, বর্ণাঢ্য পোশাকে সাজা নারী-পুরুষের নাচ দেখা হল। ওরা এক রকমের লাঠি নিয়ে নাচে যেগুলো নাড়লে-চাড়লে তাদের মধ্যে থেকে বাঁশির মতো আওয়াজ বের হয়। গতরাতেই সেই নাচ দেখেছিল ওরা, এখনও স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। প্রদীপ গাঙ্গুলি, প্রদীপ মৈত্র, তাপস সাহা এবং সঞ্জীব গাঙ্গুলি সস্ত্রীক অনিকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছে।
এখানের সকলেই বলে মেইল। এখন অনেক গাড়ি হয়েছে বটে। আগে নাগপুর, রায়পুর, ভিলাই, জব্বলপুর, বিলাসপুর ইত্যাদির বাঙালিদের কলকাতা যেতে-আসতে বম্বে-হাওড়া আর হাওড়া-বম্বে মেইল ভায়া নাগপুরই ভরসা ছিল। পুরোনো অভ্যেস বলে ওরা এখনও মেইল-ই বলে বম্বে মেলকে।
ভাগ্যিস ট্রেনটা প্রায় আধ ঘণ্টা খানেক লেট ছিল, নইলে ট্রেন ফেল করত আজ। ওভারব্রিজ পেরিয়ে প্ল্যাটফর্ম-এ যখন দাঁড়াল তখন বেশ গরম লাগছিল। ওরা সকলে একটা পাখার নীচে দাঁড়াল। ফার্স্ট ক্লাস এ সি কম্পার্টমেন্ট কোথায় দাঁড়াবে তা, কুলিকে ওরা জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল। অনির ফার্স্ট এ সি-তে চড়ার সামর্থ্য নেই। ওরাই তার জন্যে এই বিলাসিতার বন্দোবস্ত করেছে। তবে বয়েস হওয়াতে চেহারা ভারী হয়ে গেছে। শারীরিক কষ্ট আর সহ্য করতে পারে না। আরাম করে যে এসেছে এবং আরাম করেই ফিরবে তা জেনে স্বস্তি হয়। ট্রেনে একবার উঠে পড়তে পারলে আর চিন্তা নেই কোনো। ভিড়ের প্ল্যাটফর্মে ধাক্কাধাক্কি করে ওঠাই যা ঝামেলা।
ওরা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে গল্প করবার সময়েও সঞ্জীবের ক্যামেরার বিশ্রাম মিলল না। সে সমানে ছবি তুলে যেতে লাগল। অনি ভাবছিল, যখন যৌবন ছিল, চেহারাও সুন্দর ছিল তখন কেউ ছবি তোলেনি আর আজ এই বৃদ্ধর ছবি তোলে কত মানুষ। সাহিত্যিক হয়ে অগণিত মানুষের কাছ থেকে যে ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধা পেল তাদের মধ্যে অধিকাংশই অপরিচিত, তা বলার নয়, ভোলারও নয়। মন ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। সঙ্গে সঞ্জীবের স্ত্রী সুচিত্রাও ছিল। সে-ই ওদের দলে একমাত্র মহিলা। মেয়েকে এক বোনের কাছে রায়পুরে রেখে দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমাতে বেরিয়েছিল ওরা। বসেও ছিল মুখোমুখি টাটাসুমোর পেছনের সিটে। কী প্রেম। কী প্রেম! ওদের দেখে ভারি ভালো লেগেছে ওই চার-পাঁচ দিন অনির।
নিধুবাবুর একটা গান আছে—
‘প্রণয় পরম রত্ন যত্ন করে রেখো তারে, বিচ্ছেদ তস্করে আসি যেন, কোনোরূপে নাহি হরে। অনেক প্রতিবাদী তার হারালে আর পাওয়া ভার, কখন যে সে হয় কার, কে-বা বলিতে পারে।’
সত্যিকথা। ‘প্রেম’-কে নিরন্তর সেবা-যত্ন, সোহাগে উজ্জ্বল করে না রাখতে পারলে, প্রেম অন্যঢালে গড়িয়ে যায়।
প্ল্যাটফর্মে একটা শোরগোল উঠল। ঘুমন্ত অজগর জেগে উঠলে যেমন হয় তেমন দুলে উঠল জনারণ্যের বুক। ট্রেনটা এসে গেল। প্রদীপরা অনিকে নিয়ে কোচে উঠে কম্পার্টমেন্টে বসিয়ে দিল। রিজার্ভেশন চার্ট থাকে না মাঝ-স্টেশনে। গাড়ি ছাড়লে কণ্ডাক্টর গার্ড যাকে, যেখানে যেতে বলবেন তাই যেতে হবে। অনিকে যে-কামরাতে ওঠাল প্রদীপেরা সেটা একটা ফোর বার্থ কম্পার্টমেন্ট। এক ভদ্রলোক বোধ হয় দুপুরে ভদকা বা জিন খেয়ে সব পর্দা-টর্দা টেনে দিয়ে লম্বা ঘুম লাগিয়েছিলেন। রায়পুর স্টেশনের গন্ডগোল এবং আগন্তুকদের আগমনে তিনি ব্যাজারমুখে উঠে বসে আগন্তুকদের দেখতে লাগলেন। অনি ঢোকার একটু পরেই এক অপরূপ সুন্দরী মহিলা, তাঁর বয়েস হবে মাঝ-চল্লিশ, একটি ছাই-রঙা সিল্কের শাড়ি পরে এসে উঠলেন। আর তাঁর সঙ্গে একজন স্টেনগানধারী অলিভগ্রিন পোশাকপরা প্রহরী। একজন সুদর্শন ভদ্রলোকও উঠে এসেছিলেন। মহিলার সঙ্গে অনেক মালপত্র, বড়ো বড়ো স্যুটকেস। ভদ্রলোক বাঙালি কণ্ডাক্টর গার্ডকে ধমকে বললেন হিন্দিতে, সেই মহিলাকে দেখিয়ে, আজেবাজে লোকের সঙ্গে ওঁকে এক কম্পার্টমেন্টে দেবেন না, একলাও দেবেন না ক্যুপেতে। ওঁর কোনো অসুবিধে হলে আপনার চাকরি চলে যাবে।
অ্যাটেন্ড্যান্ট এবং কণ্ডাক্টর-গার্ড দুজনেই না স্যার, না স্যার, কোনো চিন্তা করবেন না স্যার বলে যেতে লাগলেন দু-হাত জোড়া করে।
ট্রেন প্রায় ছেড়ে দেয়, মিনিট চারেকের স্টপেজ বোধ হয়, অনি শুনল, দুই প্রদীপও তাঁদের ডেকে শাসাচ্ছে, বাংলার বড়ো লেখক যাচ্ছেন, বলেই অনির নামটা বলে বললেন, ওঁর যেন কোনো অসুবিধে না হয়। বুঝতেই পারছেন, কলকাতার এমন কোনো কাগজ নেই যারা ওঁর কথা মানে না।
না না স্যার, কী বলছেন স্যার। একথাও দু-হাত জোড়া করে বলতে বলতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। ভদ্রমহিলার সঙ্গে এত মাল ছিল করিডর জ্যাম করে রাখা যে, ট্রেন ছাড়বার সময়ে অনি গিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে পারল না।
ট্রেন ছেড়ে দিলে কণ্ডাক্টর গার্ড এবং অ্যাটেন্ড্যান্ট এসে মহিলাকে বললেন, বলুন, মা আপনার জন্য কী করতে পারি?
তারপর, অনিকে দেখিয়ে বললেন, আপনাকে এবং ওঁকে একটি ফোর-বার্থ কম্পার্টমেন্ট দিয়ে দেব। দেখব যাতে, রাতে কোনো প্যাসেঞ্জার আপনাদের কম্পার্টমেন্টে না ওঠে।
ওঁরা মহিলার সঙ্গে হিন্দিতেই কথা বলছিলেন তবে সে হিন্দি যথার্থ হিন্দিভাষীর বোধগম্য হওয়ার মতো নয়।
ভদ্রমহিলা কিছু বলার আগেই ওঁরা বললেন অনিকে দেখিয়ে, ইনোনে বুজুর্গ আদমি হ্যায় অউর বঙ্গাল কি বহত ভারি রাইটার ভি হে। বলেই অনির নামও বলল, অনিকেত সেন।
ভদ্রমহিলার মাথাতে ঘোমটা ছিল না কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা, ঘোমটারই মতন—আব্রুর দ্যোতক।
উনি চোখ দুটো নীচে নামিয়ে বললেন, ওঁর সঙ্গে এক কামরাতে যেতে আমার আপত্তি নেই। এত বড়ো বরমাল্য, ইজ্জত, অনি, বহুদিন পায়নি।
সেও চোখ নামিয়ে বলল, ধন্যবাদ।
ওঁরা বললেন, আপনারা ম্যাডাম ও স্যার ‘বি’ কম্পার্টমেন্টে চলে যান। আপনাদের সব মালপত্র আমরা পৌঁছে দিচ্ছি। স্টেনগানধারী গার্ডও তাই বলল। বলল, আপ বে-ফিক্কর যাইয়ে মা।
তখন সেই মহিলা আর অনি গিয়ে ‘বি’ কম্পার্টমেন্টে উঠল। ট্রেনটা গতি বাড়িয়েছে। দুলছে কামরা। প্রথম দশ মিনিট কেউই কোনো কথা বললেন না। অনিরই একটু অস্বস্তি লাগছিল। সারাটা রাত একজন অপরিচিতা মহিলা শুধু নন, অত্যন্ত সুন্দরী মহিলার সঙ্গে এককামরাতে যাবেন—এই কথাটা মনের মধ্যে নানারকম উথালপাথাল করছিল। অনির বয়েস হয়েছে অনেক কিন্তু ও বড়ো হয়নি। ওর মধ্যে একটা ছেলেমানুষ চিরদিনের জন্য মৌরসিপাট্টা গেড়েছে সতেরো বছর বয়েস থেকে যে এখনও তেমনই প্রেমিক আছে, তেমনই অবুঝ, তেমনই ভাবাবেগসম্পন্ন হঠকারী। ও, নিজেকে যতখানি ভয় পায়, পৃথিবীর অন্য কোনো কিছুকেই অত ভয় পায় না।
অনি বলল, সঙ্গে স্টেনগানধারী সিকিউরিটি কেন? আপনার স্বামী কি আর্মিতে আছেন?
ইংরেজিতেই বলল।
ভদ্রমহিলা বললেন, পরিষ্কার বাংলাতে, আমাকে চিনতে পারলেন না, অনিদা? আমি তোমাদের লেক রোডের পাড়ার নমু।
নমু। তুমি।
অনি কী বলবে ভেবে পেল না।
বলল, স্টেনগান? নমু হেসে বলল, আমার শ্বশুরমশাই মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী ছিলেন। ছত্তিশগড়ে এমন সি সি-র তান্ডব চলেছে, তাই সিকিউরিটি। আমি তাঁর বড়োছেলের স্ত্রী।
হঠাৎ মধ্যপ্রদেশের রহিস পরিবারের ছেলের, মিনিস্টারের এমন মতি?
আমার শ্বশুরমশায় অচ্যুদানন্দ শর্মা বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙালিদের খুবই পছন্দ করেন। তাই ভালো খানদান থেকে, গ্র্যাজুয়েশন করা সুন্দরী বাঙালি মেয়ে, যদিও তুমি আমাকে পেঁচি বলে ডাকতে, পছন্দ করে নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। তবে পারিবারিক কৌলীন্যটাই বেশি করে দেখেছিলেন। তুমি তো জানো মেদিনীপুর জেলাতে আমাদের মস্ত জমিদারি ছিল এবং আমার ঠাকুরদার রাজা পদবিও ছিল। যদিও তুমি যখন আমাকে দেখেছিলে, তখন বাবা লেক রোডে বাড়ি করে কলকাতাতে আসেন। কিন্তু মেদিনীপুরে আমাদের প্রাসাদ এখনও আছে এবং আমার ছোটোকাকা সেখানে শুধু থাকেনই না, আমাদের অবস্থাও ফিরিয়েছিলেন। ও-পাড়া ছেড়ে আমাদের আলিপুরের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর। ছোটোকাকাও খুব পড়াশোনা করতেন। গান-বাজনার শখ ছিল, ভালো শিকারি ছিলেন। তুমি তো দেখোনি ছোটোকাকাকে।
দেখব না কেন? তিনি তো আসতেন কলকাতাতে মাঝে মাঝে।
ও, দেখেছিলে?
আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে বিহারের চৌপারনে এক শিকারের ক্যাম্পে দেখা হয়েছিল ছোটোকাকার। তার পর ছোটোকাকার নিমন্ত্রণে তিনি যখন অনন্তপুরে আসেন, তখনই আমাকে দেখে ভারি পছন্দ হয়। ছোটোকাকাকে বলেন, আমার বড়োব্যাটা পড়াশোনা শেষ করলেই, একে আমি বহুরানি করে নিয়ে যাব। ইজাজত দিন।
তার পর একটু চুপ করে থেকে বলল, এই তো আমার কথা। আমি এখন কেমন, চোস্ত হিন্দি বলি দেখলে তো। বাড়ির বড়ো বহুরানি হয়ে সকলের মন জুগিয়ে চলি। আমার শ্বশুরমশাইয়ের তো আমাকে না-হলে এক মিনিটও চলে না। এমনকী এজন্য শাশুড়ি-মা অনুযোগ পর্যন্ত করেন।
তাই? সত্যি! গল্পের মতো শোনাচ্ছে না? সিনেমার গল্পের মতো।
তার পর বলল, তোমরা সত্যিই জলের মতো। যে-পাত্রে তোমাদের ঢালা হয় তোমরা সেইরকম হয়ে যাও। মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তোমাদের অসীম।
এখনকার মেয়েরা অন্য রকম। ওদের যে আর্থিক স্বাধীনতা আছে।
তার পরই বলল, এবারে তোমার কথা বলো। বিয়ে তো করেছ নিশ্চয়ই, ছেলে-মেয়ে কী?
তুমি তো জানো নমু। কোনো দিনও সকলে যা করে আমি তা করিনি। করলে, তোমাকে ভালোবেসে ফেলার অপরাধে, তোমার বাবা যখন আমাকে খুন করিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছিলেন, তখনও আমি তোমাকে না ভালোবেসে পারিনি। রাজা-রাজড়াদের রকমটাই এরকম। তুমি একরকম ছিলে, আমি অন্যরকম। আমরা প্রত্যেক মানুষই এক একরকম। পৃথিবীটা তাই হয়তো এত ইন্টারেস্টিং এখনও। তুমি তোমার বাবারই মতো খানদানি হতে চেয়েছিলে, বড়োলোকের মেয়ে রাজার বহুরানি হতে চেয়েছিলে। তাই হয়েছ। এ-সংসারে, যে-যা চায় তাই হয়তো পায়। যদিও সকলেই যে পায়, এমন নয়। তবে অনেকেই পায়। সম্ভবত অধিকাংশ মেয়েই তোমারই মতো। একজন চালচুলোহীন ছেলে, সে যতই মেধাবী ও ভালো হোক না কেন, তোমার যোগ্য সে কোনোদিক দিয়েই ছিল না।
সেটা বাবার কথা। আমার কথা ছিল না, তুমি ভালো করেই জানো তো। কিন্তু এতদিন পরে আবার বাবাকে নিয়ে পড়লে কেন অনিদা? বাবা তো চলে গেছেন আমার বিয়ের পরই।
তাই? মা? মা আছেন?
হ্যাঁ। মায়ের কাছেই তো যাচ্ছি। এখন মা পাকাপাকিভাবেই অনন্তপুরেই থাকেন তবে, ন-মাসে ছ-মাসে আসেনও কলকাতাতে।
তোমার মা ভারি অন্যরকম ছিলেন। তোমাদের পরিবারের সব আড়ম্বর, ভারি ভারি সেকেলে সোনার গহনার মধ্যে একটি ছোট্ট কিন্তু উজ্জ্বল হিরের নাকছাবির মতো। তুমি তোমার বাবার মতো হয়েছিলে। মায়ের মতো হতে পারোনি।
আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু এখনও পাইনি।
নমিতা বলল।
পুরো কম্পার্টমেন্ট ওর মহার্ঘ পারফিউমের গন্ধে ভরে ছিল।
কোন প্রশ্নের?
অনি শুধোল।
ছেলে-মেয়ে কী? বউদি কোথাকার মেয়ে?
আমি বিয়ে করিনি। করলে, অনন্তপুর রাজবাড়ির নমিতাকেই করতাম। যাকে-তাকে নিয়ে আমার চলত না। তবে আমি যাকে চেয়েছিলাম, তার সঙ্গে আজকের তোমার কতখানি মিল আছে জানি না। মিল থাক আর নাই থাক, আমার মনে মনে, তুমি যেমন ছিলে তেমনই আছ। আমার নমু।
নমিতা গম্ভীর হয়ে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, এত লেখাপড়া শিখেও তুমি সেন্টিমেন্টাল ফুল রয়ে গেলে কী করে? আজকাল কেউ কি দেবদাস হয়? সে তো পরমমূর্খামি। আমি কেমন ছিলাম? আমার মধ্যে কী ছিল যা অন্য কোনো মেয়ের মধ্যে ছিল না?
অনি হাসল। বলল, অঙ্গপ্রত্যঙ্গর কথা বলছ? সে তো সব মেয়েরই কম-বেশি সমানই।
শাড়ি খুলে তো তোমাকে দেখতে পাইনি এবং কখনো চাইনি। শরীর ছাড়াও একজন মেয়ের অনেক কিছু থাকে, পৃথকীকরণের চিহ্ণ হিসেবে।
তা কী? মানে, সেসব কী?
তা বলার নয়। পুরুষেরাই সেটা জানে। তোমাকে বোঝাতে পারব না, আর এত বছর পরে তা বলার দরকারই বা কী? লাভ তো নেই-ই।
তুমি কি কলকাতাতে ফিরছ নাকি অন্য কোথাও নামবে পথে?
আমি খড়গপুরে পড়াই আই আই টি-তে। খড়গপুরেই নামব।
তাই? আমিও নামব খড়গপুরে। তার পর ওখান থেকে গাড়িতে অনন্তপুর।
অনন্তপুরে ক-দিন থাকবে?
দিন পনেরো তো বটেই। কেন? তুমি কি আসবে?
না:।
কেন? না কেন?
আমার অনেক কাজ। ক্লাস তো থাকেই, ক্লাসের পরে পড়াশোনা থাকে, ছেলে-মেয়েরা অনেকে বাড়িতে পড়তে আসে। একটি মেয়ে আসে, তার নাম নমিতা। দেখতেও সে প্রায় তোমারই মতো। ওকে দেখে আমার, তোমার কথা মনে হয়।
তুমি কী বিষয় পড়াও?
আর্কিটেকচার। স্থাপত্য।
ও।
তার পর বলল, তোমার কপালের পাশে চুলে পাক ধরাতে তুমি আরও সুন্দর হয়েছ।
যৌবন যখন ছুটি চায়, তখন এইসব কনসোলেশন প্রাইজ দিয়ে যায়, যাওয়ার সময়ে।
অনি বলল, হেসে।
তার পর বলল, তুমি আরও সুন্দরী হয়েছ, অন্য রকম। বহুরানির আভিজাত্য এসেছে তোমার মধ্যে। আচ্ছা তোমার স্বামী কি তোমার সঙ্গে বাংলাতে কথা বলেন?
না, না হিন্দিতেই বলেন।
অসুবিধে হয় না তোমার?
প্রথম প্রথম হত, এখন হয় না। তবে আমার শ্বশুরমশাই সুন্দর বাংলা বলেন, রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত।
আমার কোনো বই পড়েছেন উনি?
জানি না, জিজ্ঞেস করব। তুমি যে লেখক হয়েছ তা পশ্চিমবাংলাতে এলে লোকমুখে শুনি। উনিও সে-কারণেই পড়েননি হয়তো। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ইত্যাদির অনেক বই আছে ওঁর কাছে। পরের প্রজন্মের কারোকেই জানেন না বোধ হয়।
তুমি আমার কোনো বই পড়েছ?
লজ্জিত হয়ে নমিতা বলল, না এখানে এই রায়পুরে বাংলা বই পাই কোথায়? বাংলা কাগজ হয়তো আসে কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো রাখা হয় না। তার পরে লজ্জিত গলাতে বলল, আদত ছুট গ্যয়ি।
হাসল অনি। বলল, তুমি বুঝি এইরকম বাংলা বলো আজকাল?
বুঝতে পারলে তো। তাহলেই হল।
হেসে বলল, নমিতা। তার পরে বলল, তুমি সময় পাও কী করে নিজের চাকরি করে?
সময় আমাদের সকলেরই অনেক। সময় নষ্ট না করলে সময়ের অভাব কী?
তার পরেই বলল, ছেলে-মেয়ে কী?
দুই ছেলে। বড়োটার বয়েস বছর বারো হল। ইচ্ছে আছে বাঙালি বউ আনার। আমার শ্বশুরমশাইয়েরও তাই ইচ্ছে। গরিবের ঘরের মোটামুটি লেখাপড়া শেখা, খুবই সুন্দরী কোনো মেয়ে যদি তোমার নজরে থাকে তো দেখো-না একটু আমার ছেলের জন্যে। এখন থেকেই সাগাই করে রাখব। ছেলের বয়েস কুড়ি হলেই বিয়ে দিয়ে দেব।
ছেলে রোজগার করার আগে?
বাবার ব্যাবসাতে বসবে। রোজগারের জন্য চাকরি তো করতে হবে না। বি এ টা করলেই হল। আমার শ্বশুর আর স্বামীর তো অনেকরকম ব্যাবসা—ব্যাবসা এখন স্বামীই দেখেন। শ্বশুরমশাই রাজনীতি নিয়েই থাকেন আর পড়াশুনো।
গরিবঘরের বাঙালি মেয়ে নিয়ে, সে তাকেও সোনার পায়জোর আর চুটকি আর হিরের নথ পরিয়ে পোষাপাখি করবে তো, তোমাকে যেমন করেছেন শ্বশুরমশাই? সেও তো বাংলা ভুলে গিয়ে তোমারই মতো বলবে আদত ছুট গ্যয়ি? এমন কুকর্ম আমার দ্বারা হবে না।
ওরকম করে বলছ কেন? আমি কি সুখী হইনি?
হয়েছ বুঝি? আসলে সুখ কাকে বলে তাই তুমি ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবে থেকে ভুলে গেছ। আরাম এককথা, সুখ আর-এক।
নমিতা একটু দুঃখ পেল।
বলল, তাই বুঝি?
তাই তো।
আর তুমি সুখী হয়েছ?
আমি কী করে সুখী হব? সেই লেক রোডের নমিতাকে যে এখনও ভুলতে পারিনি। সুখী আমার আর এ জীবনে হওয়া হবে না। আমার যে-ছাত্রীটির কথা বললাম, যে একেবারে তোমারই মতো, ওর মধ্যেই আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি।
তারপর দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে রইল দুজনে দুজনের চোখে চেয়ে। নমিতার গর্বিত ও আদুরে মুখখানির দিকে চেয়ে ভারি ইচ্ছে করছিল অনির যে ওকে একটা চুমু খেয়ে দেয়, অ্যাটেন্ড্যান্ট-এর কামরাতে হাতে স্টেনগান নিয়ে বডিগার্ড থাকলেও। একটি চুমু খেলে নমিতা খুশিই হবে। অথবা কে জানে, ওর মধ্যপ্রদেশীয় শ্বশুরবাড়ির পরিবেশে থেকে থেকে ও হয়তো খুবই রক্ষণশীল হয়ে উঠেছে। থাক। কী দরকার।
এ সি কোচ-এর জানলা দিয়ে রাতের বেলা কিছুই দেখা যায় না। বিরক্তিকর। ট্রেনটা দাঁড়াল কোনো স্টেশনে। দুর্গ হবে হয়তো। একটু পরেই ছেড়ে দিল।
নমিতা চুপ করেই রইল। দু-চোখে ভারি অভিমান নিয়ে।
অনির মনে পড়ে গেল, আগা শাহির তহলবীর একটি শের—
লোর, হম বঁতায়ে গুঁচা-ও-গুল সে ফরক কেয়া?এক বাত হ্যায় কহি-হুয়ি, এত বে-কহি হুয়া।
মানে, ফুলের এবং ফুলকলির মধ্যে তফাত আমি ভালোই জানি।
‘ফুল’ হল বলে ফেলা কথা আর ফুলকলি হল, যে-কথা বলা হয়নি, তা।
ট্রেনটা দুলে উঠতেই দুজনের চোখ দুজনের চোখে পড়তেই হঠাৎই দুজনই একসঙ্গে হেসে উঠল নি:শব্দে।
অনি বলল, দরজাটা তো লক করাই আছে। আমার একটু কাছে এসো তো নমু।
নমিতা কথা না বলে, নীচে রাখা নরম চামড়ার চটিতে পা গলাবার চেষ্টা করতে লাগল। অনি দেখল, নমুর সুন্দর ফর্সা সাদা বাঁশপাতি মাছের মতো পায়ের পাতা দুটি অন্যায় করার উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। কে জানে, কতক্ষণ নেবে নমু, অনির কাছে আসতে। অনি নমুর পায়ের দিকে চেয়ে বসে রইল। ভাবল, যতক্ষণ লাগে লাগুক। প্রায় কুড়িটা বছর পেরিয়ে আসতে সময় তো একটু লাগবেই।