অবিশ্বাস্য

অবিশ্বাস্য

কয়েকজন জোর তর্কে মেতে উঠেছিলাম। তর্কের বিষয়বস্তু ছিল ভূত। আমাদের মধ্যে শিবপুর শ্রীদুর্গা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে শ্রাবণ মাসের এক সন্ধ্যায় বৃষ্টিতে আটকা পড়ে আমরা একদল ছিল ভূতের স্বপক্ষে। এবং একদল ছিল বিপক্ষে। বিপক্ষদের মতে, ভয় থেকেই ভূতের জন্ম। ভূত আসলে কল্পনার আতঙ্ক ছাড়া কিছু নয়। ভূতের কোনও অস্তিত্বই নেই।

আলোচনার ঝড় যখন তুঙ্গে উঠেছে তখন সম্ভ্রান্ত চেহারার এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক, যিনি আমাদেরই মতো পথচারী এবং দোকানে বসে ছিলেন, বললেন, “দেখুন, আপনাদের কথায় আমার নাক গলানো উচিত নয় যদিও, তবুও বলছি ভূত আপনারা কেউ বিশ্বাস করুন বা না করুন, ভূত আছে।”

সঙ্গে সঙ্গে একজন বলে উঠল, “তার আগে বলুন আপনি নিজে কখনও ভূত দেখেছেন কি না?”

“না। তার কারণ আমরা যে যুগের মানুষ সে যুগে ভূতের দেখা আর কখনও হয়তো কেউ পাব না। কিন্তু এমন একটা দিন ছিল যেদিন ভূতের উপদ্রবে মানুষে সন্ধের পর ঘর থেকে বেরোতে পারত না।”

“সেইসব ভূতেরা তা হলে গেল কোথায়?”

“উদ্ধার হয়ে গেছে। আসলে সব মানুষ মরেই যে ভূত হয় তা তো নয়। বিশেষ তিথি নক্ষত্রের অবস্থানে মানুষের অপঘাত মৃত্যু হলেই মানুষ সাধারণত প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়ে থাকে। এইরকম আত্মারা উদ্ধার হতে না পারলেই অযথা মানুষের আশপাশে উদ্ধারের আশায় অথবা নিজেদের দলভুক্ত করার জন্য ঘুরঘুর করে।”

একজন বলল, “তাই যদি হয়, তা হলে মানুষ তো অপঘাতে মরে এখনও ভূত হতে পারে। এখন যে হারে খুন-জখম চলছে তাতে সেইসব মানুষরা তো সবাই ভূত হয়ে উপদ্রব করতে পারত। কিন্তু করছে না কেন বলুন?”

প্রৌঢ় ভদ্রলোক হেসে বললেন, “দেখুন, ওইসব মানুষদের কেউ কেউ যে ভূত হচ্ছে না বা হবে না, এমন কথা তো আমি বলিনি। তবে কিনা যেকালে মানুষ মরে ভূত হত সেকালে এত গয়ায় যাওয়ার ধুম ছিল না। কেননা ইচ্ছে থাকলেও মানুষ যেতে পারত না সহজে। কিন্তু এখন ট্রেন, বাস ইত্যাদির দৌলতে দলে দলে মানুষ গিয়ে শ্রীহরির পাদপদ্মে পিণ্ডদান করে প্রেতাত্মার উদ্ধার করে আসছে। কাজেই ভূতের দেখা আজকাল আর পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও ছিটকে-ছাটকে এইসব ব্যাপারগুলো কোথাও যে ঘটছে না তার খবরই বা কে রাখে বলুন?”

আপনি “তা হলে আপনার মতে ভূত এখন না থাকলেও একসময় ছিল? এবং ভূত বিশ্বাস করেন?”

“হ্যাঁ। আমার ধারণায় ছিল। যেমন, একটা ঘটনার কথা আমি বলছি। ঘটনাটা আমার  পিতৃদেবের মুখ থেকে আমি শুনেছিলাম। অন্য কারও মুখ থেকে শুনলে হয়তো অবিশ্বাস করতাম। কিন্তু বাবাকে তো অবিশ্বাস করতে পারি না!”

আমাদের বিপক্ষ দলটি এবার একটু নরম হয়ে একটি নতুন ঘটনা শোনবার জন্য আগ্রহী হয়ে বলল, “এটা আপনার বাবার জীবনেই ঘটেছিল?”

“হ্যাঁ। তিনি ঠিক যেভাবে গল্পটা বলেছিলেন আমিও ঠিক সেইভাবেই আপনাদের বলছি। শুনতে তা হলে ভাল লাগবে।”

আমরা সবাই তর্ক-বিতর্ক বন্ধ রেখে একাগ্রচিত্তে শুনতে লাগলাম। ভদ্রলোক বলতে লাগলেন:

একশো বছর আগে হাওড়া শহর কিন্তু শহর ছিল না। চারদিকে বনজঙ্গল। মাঝেমধ্যে দু-একটি কোঠাবাড়ি—এই ছিল। মধ্য হাওড়ায় এইরকম একটি বাড়ি ছিল । সে বাড়িটাকে সবাই ভূতের বাড়ি বলত।

আমার বয়স তখন কুড়ি-বাইশ বছর হবে। আমি ছিলাম অত্যন্ত সাহসী এবং ডাকাবুকো। ভূত বিশ্বাস করা দূরের কথা, ভূতের নামে জ্বলে যেতাম। আমার বন্ধুরা কিন্তু একেবারে আমার বিপক্ষে ছিল। একবার আমি তাদের সঙ্গে বাজি ধরে ওই ভূতের বাড়িতে রাত কাটাবার কথা ঠিক করলাম। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, হাওড়া শহরে শিবপুর অঞ্চলে সেকালে আমরা অত্যন্ত প্রতিপত্তিশালী লোক ছিলাম। কাজেই আমাকে ঘিরে যেসব বন্ধুবান্ধবের দল ছিল তারা সবসময়ই একটু স্বার্থ নিয়ে থাকত। এই অজুহাতে তারা আবদার ধরল, যদি আমি ওই বাড়িতে একা এক রাত্তির বাস করতে পারি তা হলে ওরা আমাকে দমভর খাওয়াবে। আর যদি আমি ভূত দেখে ভয় পাই বা রাত্রিবাস করতে না পারি তা হলে আমি ওদের দমভর খাওয়াব। তবে এ ব্যাপারে ওদের কিন্তু দৃঢ় ধারণা ছিল যে ও বাড়িতে রাত্রিবাস করতে আমি কিছুতেই পারব না। এবং ওদের ভাগ্যেই জম্পেশ ভোজটা হবে।

যাক। কথামতো কাজ শুরু হল।

প্রথমেই আমি বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বাড়িটা একবার ভাল করে দেখে এলাম। বড় রাস্তার গায়েই বাড়িটা। তখন রাস্তায় পিচ পড়েনি। চওড়া মাটির রাস্তা ছিল। এখন এই রাস্তাটির নাম হয়েছে নেতাজি সুভাষ রোড। তখন এটি রামকৃষ্ণপুর গ্রামের অন্তর্গত ছিল। যাক, বাড়িটা পুরনো, অব্যবহৃত এবং দোতলা। বাড়ির পেছনে পাঁচিলঘেরা বাগান। সামনেও পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এরই একপাশে একখানি টালির ঘর। এই ঘরটিতে রঘুয়া নামে একজন হিন্দুস্থানি দরোয়ান থাকত। বাড়ির মালিক থাকতেন দ্বারভাঙায়। তাঁর নাম ভবতারণ বসু। প্রতি মাসে তিনি দশ টাকা মানিঅর্ডার পাঠাতেন রঘুয়ার নামে। রঘুয়া বাড়ি দেখাশোনা করত—যদিও বাড়ির ভেতর ঢুকত না। এবং তার সেই টালির ঘরে আরও দু-একজন দেশোয়ালি ভাইকে ডেকে এনে রাত কাটাত, তবুও দশটি টাকার লোভে এই বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব সে নিয়েছিল। যাক, আমরা এসে রঘুয়াকে দিয়ে বাড়ির তালা খুলিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরগুলি ঘুরেফিরে দেখলাম। ওপরে উঠলাম। সিঁড়ির একাংশ ভাঙা। তাই মই দিয়ে উঠলাম। বহুদিন অব্যবহৃত থাকার ফলে বাড়ির জানলা দরজাগুলোও সব এঁটে রয়েছে দেখলাম। সবকিছু দেখেশুনে ওই বাড়িতে আমি এক রাত থাকব এবং আমার বন্ধুরা রঘুয়ার ঘরে থেকে আমাকে পাহারা দেবে এই ঠিক করে চলে এলাম।

এই ব্যাপারে প্রথমেই আপত্তি জানালেন আমার বাবা। শুধু বাবা কেন, বাড়ির প্রায় সবাই বাধা দিলেন, আমার এই গোঁয়ার্তুমি রোধ করবার জন্য। সবাই বললেন, “ভূত মানো না মানো আমাদের কথাটা অন্তত মানো। ওসব করতে যেয়ো না।”

আমি কিন্তু কারও কথাই শুনলাম না। কেননা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে পুনরায় মত পরিবর্তন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একে তো ভয় কাকে বলে জানতাম না, তার ওপর শরীরে শক্তিও ছিল খুব। বিশেষ করে আরও যেটা ছিল সেটা হল ভূত আছে কি নেই এ ব্যাপারে দারুণ কৌতূহল। কাজেই আমিই বা সহজে পিছপা হব কেন? অতএব কারও কোনও কথা না শুনে আমার জেদই আমি বজায় রাখলাম।

নির্দিষ্ট দিনে দল বেঁধে বেলাবেলি সেই বাড়িতে এসে হাজির হলাম আমরা। তখন গ্রীষ্মকাল। তাই ছাদে শুয়ে রাত কাটাবার ব্যবস্থা করলাম। রঘুয়ার খাটিয়াটা ম্যানেজ করেছিলাম। সঙ্গে ছিল একটি শতরঞ্চি, একটি মশারি ও একটি টর্চ। কিন্তু মুশকিল হল খাটিয়াটাকে ওপরে ওঠানো নিয়ে। একে তো সিঁড়িই ভাঙা, তার ওপর দোতলার দরজার পরিস্থিতি এমনই যে, সেটাকে না ভেঙে সেখান দিয়ে খাটিয়াটাকে ওপরে ওঠানো একেবারেই অসম্ভব।

আমাদের ভেতর থেকে দু’জন তখন মই লাগিয়ে ওপরে উঠে ছাদে গেল। তারপর সেখান থেকে দড়ি ঝুলিয়ে দিতে আমরা খাটিয়াটাকে বেঁধে দিলাম । এরা তখন সেই অবস্থাতেই অনায়াসে খাটিয়াটা তুলে নিল।

রঘুয়াও অবশ্য এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করল খুব। তবে সে এ-কথাও বলতে ছাড়ল না, “কেন এরকম বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছেন বাবু? আমি নিজে দেখেছি ভূত আছে। কখনও ঘরের ভেতর আলো জ্বালে, কখনও ছাদে পায়চারি করে। কখনও বাগানের ভেতর থেকে চিৎকার করে কাঁদে। এসব তো মিথ্যে নয়।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে। দেখিই না একবার পরীক্ষা করে। আমার বন্ধুরা তোমার ঘরে সারারাত থাকবে। যদি ভয় পাই তা হলে চেঁচিয়ে ডাকব তোমাদের।”

রঘুয়া বলল, “হ্যাঁ বাবু, তাই ডাকবেন। তবে জোর করে যেন কোনও কিছু করতে যাবেন না ওদের সঙ্গে। কেমন?”

আমি আর কথা না বাড়িয়ে ছাদে উঠে খাটিয়ার পায়ায় চারটে ডগলা বাঁশ বেঁধে মশারি খাটিয়ে নিলাম। তারপর শতরঞ্চি বিছিয়ে শোওয়ার ব্যবস্থাটা পাকা করে বসে রইলাম গ্যাঁট হয়ে। বন্ধুরা ছাদ থেকে নেমে সব দরজাতে তালা দিয়ে নীচে বসে রইল।

আমি ছাদে পায়চারি করতে করতে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলাম ওদের সঙ্গে। রাত দশটার পর ওরা রঘুয়ার ঘরে শুতে ঢুকল। আমি একা ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম ছাদময়। চারদিকে গাছপালা। দূরে বনজঙ্গল। মাঝেমধ্যে প্যাঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। ভরা অমাবস্যার রাত। কিন্তু যার জন্য অপেক্ষা করছি সে কোথায়? কোথায় ভূত? আমি সতৃষ্ণ নয়নে গাছপালাগুলোর দিকে তাকাচ্ছি। যদি ভূতের দেখা পাই! কিন্তু না। অনেক প্রতীক্ষার পরও কোনও ভূতই আমার সামনে এল না। আমি তখন হাতজোড় করে বলতে লাগলাম, “হে অশরীরী প্রেতাত্মা, যদি সত্যিই তুমি থাকো তা হলে একবার অন্তত আমার সামনে এসো। আমাকে দেখা দাও। যদি না দাও তা হলে কিন্তু জানব তুমি নেই। আমার জেদেরই জয় হবে তা হলে। অতএব তোমার মহিমা প্রকাশ করতে দেখা দাও।”

কিন্তু কে দেবে? কেউ কোনও সাড়াশব্দই দিল না। ভূতের দেখাও পেলাম না। পকেটঘড়িতে দেখলাম রাত তখন একটা। বসে থেকে থেকে দু’চোখে ঘুম নেমে আসছে আমার। আর অপেক্ষা করে লাভ কী। খাটিয়ার ওপরে মশারির ভেতরে ঢুকে দিব্যি লম্বা হয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগলাম।

ঘুম যখন ভাঙল তখন ভোর হয়ে গেছে। মনের আনন্দে তখন আমি লাফিয়ে উঠলাম। সারারাত এই বাড়িতে একা থেকে প্রমাণ করেছি ভূত নেই। কিন্তু এ কী! এ কী কাণ্ড! খাটিয়ার ওপর উঠে বসে যা দেখলাম তাতে বিস্ময়ের অবধি রইল না আমার। দেখলাম আমি খাটিয়াসুদ্ধু বাড়ির বাইরে রাস্তার ওপর শুয়ে আছি। সেই না দেখেই তো ধড়মড়িয়ে উঠে বসে চেঁচামেচি লাগিয়ে দিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে রঘুয়ার ঘর থেকে বন্ধুরা সবাই হইহই করে ছুটে এল। রঘুয়া এল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী ব্যাপার! আমি এই অবস্থায় কী করে এলাম এখানে?” রঘুয়া বলল, “কী করে আবার। ভাগ্য ভাল যে, বেঁচে গেছেন। যারা নামাবার তারাই নামিয়ে দিয়েছে আপনাকে।”

বন্ধুরা বলল, “এবার ভূত বিশ্বাস করলি তো?”

আমি বললাম, “না। তোরাই কেউ বদমায়েশি করে এ কাজ করেছিস।’

“তা কী করে সম্ভব বল। তুই তো নিজের চোখেই দেখলি কীভাবে খাটিয়াটা ওপরে

ওঠানো হল। আর এই রঘুয়াও সাক্ষী, সারারাত আমরা কীভাবে ঘুমোচ্ছিলাম।” আমি আর কী বলি? এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। তাই বললাম, “দ্যাখ ভাই, যাকে আমি চোখে দেখিনি তার অস্তিত্ব বিশ্বাস করলাম না। তবে অলৌকিক ব্যাপার কিছু যে একটা ঘটেছে তা স্বীকার করলাম। একে ভৌতিক বলো ভৌতিক –অন্য কিছু বলো অন্য কিছু।”

বন্ধুরা বলল, “তা হলে কি আমাদের খাওয়াটা মার যাবে?”

আমি বললাম, “না, তা যাবে না। দমভর লুচি মাংস দই মিষ্টি যে যত পারো খাও। তবে

এটা ঠিক, তোমাদের এই ভুতুড়ে বাড়িতে ভয় তো আমি পেলামই না, উপরন্তু ভূতের দেখাও না। তাই ভূতের ভাবনা মনে আমার রয়েই গেল।”

যাই হোক, সেদিনই বন্ধুদের ইচ্ছামতো ওদের সবাইকে পেটভরে খাইয়ে দিলাম।

এর পর থেকে আমার যেন জেদ চেপে গেল বাড়িটা কেনবার এবং আগাগোড়া বাড়িটাকে সংস্কার করিয়ে দু’-চার ঘর ভাড়াটে বসাবার। এই মনে করে দ্বারভাঙার ভবতারণবাবুদের অনেক চিঠি লেখালেখি করে বাড়িটা প্রায় জলের দরেই কিনে নিলাম। তারপর বাড়িটাকে সংস্কার করার জন্য রাজমিস্ত্রি লাগাতে গিয়েই মুশকিলে পড়লাম। এখানকার কোনও মিস্ত্রিই ও বাড়ি সংস্কারের কাজে হাত দিতে রাজি হল না। শেষকালে গ্রামের দিক থেকে মিস্ত্রি আনিয়ে তাদের দিয়েই বাড়িটাকে প্লাস্টার করিয়ে দরজা জানলার জ্যাম ছাড়িয়ে গোটা বাড়িটা হোয়াইট ওয়াশ করিয়ে একেবারে নতুন করে তুললাম।

সবই হল। কিন্তু ভাড়াটে কই? ভাড়াটে পাব কোথায়? কেউ-ই ভাড়া আসতে রাজি হল না ও বাড়িতে।

এইভাবে প্রায় বছরখানেক কেটে যাওয়ার পর একদিন এক ভদ্রলোক বিয়েবাড়ির জন্য বাড়িটা ভাড়া নিতে এলেন!

আমি সানন্দে রাজি হলাম। বললাম, “বাড়িটা তো আমার এমনিই পড়ে আছে। কাজেই ভাড়া-টাড়া দিতে হবে না। আপনি ক’দিন ইচ্ছে ব্যবহার করুন।”

ভদ্রলোক খুব উৎসাহের সঙ্গে বাড়িটা কাজে লাগালেন। লোকজন পরিপূর্ণ হয়ে বাড়িটার এমন অবস্থা হল যে কারও আর মনেই হল না এটা ভূতের বাড়ি, বা এ বাড়িতে কোনও আতঙ্ক আছে।

যাই হোক, বিয়েতে আমার ও আমার বন্ধুবান্ধবদেরও নিমন্ত্রণ হয়েছিল। তাই বিয়ের দিন সময় আমরা সবাই কিছু কিছু আশীর্বাদী নিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলাম।

সন্ধের আমরা এসে পৌঁছবার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাই বর-কনে দেখে খেতে বসলাম আমরা। খাওয়া সবে শুরু করেছি এমন সময় তুমুল হট্টগোল। কী ব্যাপার! বর নাকি কীরকম করছে।

“খাওয়া তো মাথায় উঠল। কোনওরকমে নমো নমো করে উঠে পড়লাম। তারপর ভিড় কাটিয়ে ওপরের ঘরে যেতেই আমাকে দেখে বরের সে কী চোখরাঙানি, “আমাকে অবিশ্বাস? আমি নেই? এইবার দেখ আমি আছি কিনা?”

আমি বললাম, “কে তুমি?”

“তুই যাকে দেখতে চাস আমি সেই। এই দ্যাখ।”

আমি বললাম, “তাই যদি হবে তা হলে এইভাবে তুমি আমাকে দেখা দিলে কেন? এতদিন পরে? সেদিন রাতে আমার সামনে আসতে কী হয়েছিল?”

“আমি সেদিন ছিলাম না। একটু দূরে অন্য জায়গায় গিয়েছিলাম। শেষ রাতে যখন ফিরলাম তখন দেখলাম তুই ঘুমোচ্ছিস। তোকে তো আমি খাটিয়াসুদ্ধু ছাদ থেকে নামিয়ে দিয়েছিলাম। মনে নেই? তারপরেও তোর অবিশ্বাস?”

আমি চুপচাপ সব শুনে গেলাম।

বরের শরীরে তখন আসুরিক শক্তি ভর করেছে। কেউ তাকে ধরে রাখতে পারছে না। সবাই তখন আমার দিকে তাকাচ্ছে।

আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমার অপরাধ তুমি ক্ষমা করো। তুমি যে আছ তা আমি এবার বিশ্বাস করলাম। দয়া করে শুভ কাজে বিঘ্ন ঘটিয়ো না। ও বেচারাকে ছেড়ে দাও।” কিন্তু কে কার কথা শোনে? বর মেঝেয় শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে তখন। ওর মুখ দিয়ে গেঁজলা উঠছে। বাড়িতে কান্নার রোল উঠল।

আমি ওখান থেকে একটু তফাতে সরে এসে সবাইকে বললাম, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনারা ওকে সাবধানে রাখুন। আমি এলুম বলে!”

হাওড়া কোঁড়ার বাগানে তখন পঞ্চা নামে এক রোজা ছিল। আমি কাউকে কিছু না বলে আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সোজা চলে গেলাম তার কাছে। তারপর সে রাত্রেই টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে ধরে আনলাম। কেননা ভূতের বাড়ির মালিক যখন আমি, তখন এ ব্যাপারে আমারও একটু কৰ্তব্য আছে তো!

পঞ্চা রোজা আমাকে খুব ভালভাবেই চিনত। তাই আমার অনুরোধ এবং তৎসহ টাকার লোভ কোনওটাকেই ঠেলতে না পেরে ওর প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্তর সঙ্গে নিয়ে আমার সঙ্গে চলে এল।

কিন্তু সর্বনাশ! বাড়িতে ঢোকার মুখেই একটা বিপর্যয় ঘটে গেল। দোতলার কার্নিসের একটা অংশ এমনভাবে ভেঙে পড়ল যে, আর একটু হলে দু’জনেই শেষ হয়ে যেতাম আমরা।

তাই দেখে পঞ্চা আর ভেতরে ঢুকল না। পিছিয়ে এসে বলল, “এ ভূত আমি তাড়াতে পারব না দাদাবাবু। কিছু মনে করবেন না। আমার মন্ত্রে কোনও কাজই করবে না এর। এ ভূতের রোজাও এখানে নেই।”

“কোথায় আছে তা হলে?”

“আসবেন কিনা জানি না। তবে এ ভূতের রোজা একজনই আছেন রশিদপুরে। মুসলমান রোজা। নাম করিমসাহেব। নাম বললে সবাই বাড়ি দেখিয়ে দেবে। আপনি কাল খুব ভোরে উঠে সেখানে চলে যান।”

অতএব তাই করলাম। আর বাড়ির ভেতর না ঢুকে বরকর্তা ও কন্যাকর্তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে সব বললাম। এবং বললাম এই রোজা ডাকতে যাওয়ার ব্যাপারটা কারও কাছে না বলতে। বলে আমি বাড়ি চলে এলাম এবং পরদিন খুব ভোরে রওনা দিলাম রশিদপুরের দিকে।

ভাগ্য ভাল। যাওয়ামাত্রই দেখা হয়ে গেল। আমার মুখে সব শুনে এবং আমার পরিচয় পেয়ে করিমসাহেব একটুও দেরি না করে সঙ্গে চলে এলেন। তাতেও দুপুরের আগে আসতে পারলাম না।

বর বেচারির প্রায় শেষ অবস্থা।

করিমসাহেব ঘরে ঢুকেই সর্বাগ্রে তার গায়ে ধুলোপড়া দিয়ে মন্ত্রপূত জল শিশি থেকে বার করে ছেটাতে লাগলেন। যেই না ছেটানো অমনই শুরু হল দাপাদাপি। সে কী প্রচণ্ড ছটফটানি। আর চেঁচানি—“ওরে বাবা রে, মরে গেলুম রে।”

করিমসাহেব বললেন, “আর একবার দেব নাকি?”

বর বলল, “না। আর না।”

“তা হলে ছেড়ে যা ওকে।”

“যাব। কিন্তু তার আগে কথা দে আমাকে তোরা গয়ায় দিবি?”

রোজার হয়ে আমি বললাম, “বেশ তো। এ আর এমন কী কথা। আমি তোমাকে গয়ায় দেব।”

“ঠিক দিবি তো?”

“নিশ্চয়ই দেব। তুমি তোমার পরিচয় দাও।”

“আমার নাম বিভূতি চক্রবর্তী। বাড়ি আন্দুলে। আমি অনেকদিন থেকেই এই বাড়িতে আছি। কিন্তু এখন দেখছি আর থাকা যাবে না।”

করিমসাহেব বললেন, “কিন্তু এত লোক থাকতে তুমি এই নিরীহ বর বেচারাকে ধরে শুভ কাজে বিঘ্ন ঘটালে কেন?”

“কী করব? আমি তো অযথা কারও ক্ষতি করি না। ও যে বন্ধুদের সঙ্গে ছাদে উঠে পান খেতে খেতে আমার গায়ে পানের পিক ফেলে দিয়েছিল।”

“বেশ, ঠিক আছে। এঁরা যখন তোমাকে গয়ায় দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন বলেছেন, তুমি একে ছেড়ে দাও।”

বলার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল কে যেন হুড়মুড়িয়ে চলে গেল ঘরের ভেতর থেকে। যাওয়ার সময় দেওয়ালে টাঙানো একটা কুলোকে ফেলে দিয়ে গেল।

করিমসাহেব বললেন, “আর কোনও ভয় নেই। ও চলে গেছে।” তারপর আমাকে বললেন, “তবে আপনি কিন্তু ওর নামে গয়ায় একটা পিন্ডি দিয়ে আসবেন, কেমন?”

আমি বললাম, “নিশ্চয়ই দেব। খুব শিগগির যাচ্ছি আমি গয়ায়।”

এরপর করিমসাহেব আরও কিছু জলপড়া নুনপড়া দিয়ে কীসব তাবিজ কবজ বেঁধে দিলেন হাতে। বরও রোজার গুণে সুস্থ হয়ে উঠে বসল এবং সেইদিনই বাড়ি খালি করে দিল ওরা।

পরদিন আমি আবার এলাম। এসে সারাদিন লোককে দিয়ে গোটা বাড়িটা পরিষ্কার করালাম। ধুয়েমুছে সাফ করিয়ে ঝকঝকে তকতকে করে সন্ধের সময় তালা দিয়ে বেরোতে যাচ্ছি এমন সময় দেখি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।

আমি বললাম, “কাকে চান?”

ভদ্রলোক হাসতে-হাসতে বললেন, “আপনাকেই। ভেতরে যেতে পারি?”

ভদ্রলোককে দেখে বেশ বিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি বলে মনে হল। বললাম, “আসুন।” ভদ্রলোক গেট পার হয়ে আমার কাছে এলেন।

বললাম, “কী দরকার বলুন? বাড়ি ভাড়া নেবেন?”

ভদ্রলোক তেমনই হেসে বললেন, “আরে না না। আপনিই এই বাড়ির মালিক?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“এই বাড়িতে গতকাল একজনকে কি ভূতে ধরেছিল?”

“হ্যাঁ।”

“ভূতে ধরার পর একজন রোজা এসে বিড়বিড় করে মন্ত্র বলতেই ভূতটা ছেড়ে পালাল, এই তো?”

“ঠিক তাই।”

“আচ্ছা, আপনারা নব্য কালের ছেলেরা এখনও এইসব কী করে বিশ্বাস করেন বলুন তো?”

“বিশ্বাস আমি করতাম না। কিন্তু এমন গোটাকতক ঘটনা হল যাতে বিশ্বাস না করে আমি থাকতে পারলাম না।”

“তা হলে মশাই শুনুন, আমার খুব ভূত দেখবার ইচ্ছে। আপনি যদি দয়া করে আজ রাত্রে এই বাড়িতে আমাকে একটু থাকার অনুমতি দেন তা হলে খুব ভাল হয়।”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ভদ্রলোকের মুখের দিকে।

“হ্যাঁ গো, সত্যি বলছি। রসিকতা করছি না। আমার তো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। আজও মরব, কালও মরব! না হয় ভূতের হাতেই মরি।”

আমি চাবি খুলে ভদ্রলোককে বললাম, “বেশ, থাকুন। যদি কোনও অসুবিধে মনে করেন তা হলে ছাদে উঠে চেঁচাবেন। কেউ না কেউ এসে পড়বে।”

“তুমি থাকবে না?” ভদ্রলোক এই প্রথম আমাকে তুমি বললেন। বলুন। আমার বাপের বয়সি লোক। কোনও আপত্তি নেই।

“আমি? আমার থাকার দরকার কী?”

“আরে থাকো না। দু’জনে বসে বসে গল্প করে কাটিয়ে দেব একটা রাত। ভূত একজন থাকলেও আসবে, দু’জন থাকলেও আসবে।”

আমি বললাম, “তা হলে এক কাজ করুন। এই নিন চাবি। আমি একটু বাড়িতে বলেকয়ে খেয়েদেয়ে আসি। না হলে বাড়ির লোকেরা তো চিন্তা করবে। আমি না আসা পর্যন্ত আপনি বরং বাড়ির চৌহদ্দিটা ঘুরেফিরে দেখুন। বিশ্রাম করুন।”

“ঠিক আছে, তাই যাও। তবে বাবা, তুমি নিজেই একবার বাড়িটা বেশ ভাল করে আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যাও না কেন?”

আমি বললাম, “এ আর এমন কী? দেখুন তা হলে।” বলে ভদ্রলোককে বাড়ির ভেতরে এনে হারিকেন জ্বেলে নীচে-ওপর করে সব ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখালাম।” ভদ্রলোক বললেন, “কই, এবার ছাদটা একবার দেখিয়ে দাও।”

আমি আলো নিয়ে ছাদে ওঠামাত্রই হারিকেনটা হঠাৎ দপ দপিয়ে নিভে গেল। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তখন। আর সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল সিঁড়ির দরজাটা। কোথায় ভদ্রলোক, কোথায় কে! কাউকেই আর দেখতে পেলাম না আমি। তাই বারবার ভয়ার্ত গলায় ডাকতে লাগলাম, “এই যে, ও মশাই! কোথায় গেলেন?”

এমন সময় নীচে বাগানের দিক থেকে সাড়া এল, “আমি এখানে। এই যে—।” “কোথায় আপনি?”

“বাগানে।”

আমি তাড়াতাড়ি ছাদের আলসের কাছে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক বাগানে একটা চাঁপাগাছের নীচে একমনে ফুল কুড়িয়ে চলেছেন।

ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে তখন। আমি ওপর থেকেই বললাম, “কী আশ্চর্য। আপনি ওখানে গেলেন কী করে?”

বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার পিঠের ওপর একটা উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করলাম আমি। পরক্ষণেই মনে হল, আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। মনে হল আমার কানের কাছে মুখ এনে কে যেন বলছে, “তুমি ভূত বিশ্বাস করো না, না? আমার নাম বিভূতি চক্রবর্তী। আজ তোমাকে বিশ্বাস করিয়ে তবে ছাড়ব।”

আতঙ্কে আমি শিহরিত হয়ে উঠেছি তখন।

দেখলাম সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছাদের এককোণে আলসেতে ঠেস দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। তাঁর চোখে চোখ পড়তেই বললেন, “এবার বিশ্বাস হল তো? আমি বিভূতি চক্রবর্তী। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে এই বাড়িতে আমার মৃত্যু হয়েছিল। মানে আমাকে জোর করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আর ওই যে চাঁপাগাছটা রয়েছে বাগানে, একটু আগে যেখানে আমি ফুল কুড়োচ্ছিলাম, ওইখানেই আমার দেহটা পুঁতে রাখা হয়েছিল। তা যাক। তুমি ভাই দয়া করে গয়ায় গিয়ে আমার নামে একটা পিণ্ডি দেওয়ার আগে প্রেতশিলায় পিণ্ডি দিতে যেন ভুলো না। তা না হলে কিন্তু সব পণ্ড হয়ে যাবে।”

আমি বললাম, “আমি তো আপনাকে কথা দিয়েছি। আপনারা জন্য গয়ায় আমি যাবই এবং পিণ্ডি একটা দেবই।”

“হ্যাঁ, কথা অবশ্য দিয়েছ। তবে জেনে রেখো, কথা দিয়ে কথা যদি না রাখো তা হলে কিন্তু তোমার পেছনে আমি শনির মতো লেগে থাকব। কেননা আমার বড় কষ্ট। আমি অনেককে আমার কষ্টের কথা বোঝাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। পাছে কেউ ভয় পায় তাই সচরাচর দেখাও দিই না কাউকে। কিন্তু তোমার সাহস ও জেদ দেখে থাকতে পারলাম না আর।”

আমি বললাম, “আপনার সব কথাই তো আমি শুনলাম। কিন্তু কে আপনাকে হত্যা করেছে তা তো বললেন না?”

“যার কাছ থেকে এই বাড়ি কিনেছ সেই ভবতারণ বসু। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে ওর সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে ও যে আমাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে মেরে ফেলবে তা আমি সত্যিই ভাবতে পারিনি। তুমি বিশ্বাস করো, মরবার সময় আমার বড্ড কষ্ট হয়েছিল।”

“আপনার সব কথা আমি বিশ্বাস করলাম। কিন্তু ভবতারণবাবু তো সম্প্রতি মারা গেলেন। মরণের পরে ভূত যখন হলেনই, তখন কেন আপনি সেই হত্যার প্রতিশোধ নিলেন না? এতবড় সুযোগটাকে আপনি কেন হাতছাড়া করলেন?”

“কে বললে প্রতিশোধ নিইনি? তার একটা ছেলে জাহাজে চাকরি করত। ডেক থেকে ধাক্কা দিয়ে তাকে জলে ফেলে ডুবিয়ে মেরেছি। আর এক ছেলেকে চলন্ত ট্রেনের চাকার তলায় ফেলে দিয়েছি। এই বাড়িতে সর্বক্ষণ ওদের এমনভাবে ভয় দেখিয়েছি যে, এখানকার পাট চুকিয়ে দিয়ে দ্বারভাঙায় পালাতে পথ পায়নি বাছাধনরা। আর ভবতারণবাবু? ওর মৃত্যুর কারণও তো আমি। অন্ধকার ঘরে একা পেয়ে সেদিন ওকে এমন ভয় দেখালাম যে, ভয়ে হার্টফেল করেই মরল বেচারি!”

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “আমার ওপর আপনার কোনও রাগ নেই তো?”

“না না। তোমার ওপর রাগ থাকবে কেন?”

“আমি কথা দিচ্ছি, কালই আমি গয়ায় যাব।”

কী “হ্যাঁ যাও। তবে প্রেতশিলায় পিণ্ডি দিতে যেন ভুলো না। কেমন? আমার বড় কষ্ট। নৃশংসভাবে আমাকে মেরেছিল তা ভাবলেও তুমি আঁতকে উঠবে। দেখবে আমাকে কীভাবে মেরেছিল? এই দ্যাখো।”

বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম দুটো রোমশ হাত একটা কাঁচা বাঁশ দিয়ে বিভূতিবাবুর গলা চেপে ধরেছে। বিভূতিবাবু ছাদের আলসের গায়ে চিলেকোঠার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নিজের হাতদুটি দিয়ে গলার ওপর থেকে সেই বাঁশের চাপ সরিয়ে নিজেকে রক্ষা করবার, কিন্তু সেই প্রচণ্ড শক্তির কাছে সব শক্তিই পরাস্ত হচ্ছে। উঃ, সে কী ভয়ানক দৃশ্য! দুটো চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। গালের কষ বেয়ে গড়িয়ে আসছে রক্তের ধারা। জিভটা এতখানি লকলকিয়ে ঝুলছে। সেই অমানুষিক দৃশ্য দেখা যায় না। ভাবা যায় না। কল্পনাও করা যায় না।

আমি জ্ঞান হারালাম।

পরদিন সকালে যখন জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকালাম, তখন দেখলাম আমি আমার বাড়িতে খাটের ওপর পুরু গদির বিছানায় শুয়ে আছি। আমার ফিরতে দেরি দেখে বাবা লোকজন নিয়ে কাল রাত্রেই ও বাড়িতে গিয়েছিলেন। তারপর ছাদে ওই অবস্থায় আমাকে দেখতে পেয়ে নিয়ে এসেছেন বাড়িতে।

যাই হোক, বিভূতিবাবুর কথামতো সেদিন রাতের গাড়িতে বাবা আর আমি গয়ায় গিয়ে যথাবিহিত ভাবে পিণ্ডদান করে এলাম। তারপর থেকে সত্যি সত্যিই ও বাড়িতে আর কখনও ভূতের উপদ্রব হয়নি। এবং পরবর্তীকালে বাড়িটাও আমরা বেচে দিয়েছিলাম।

এই পর্যন্ত বলে মিষ্টির দোকানের প্রৌঢ় ভদ্রলোক তাঁর গল্প শেষ করলেন। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। আমাদের কারও মুখে কথা নেই। যে যার বাড়ির দিকে কেটে পড়লাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *