অবাধ্য
রুনুর মা সেদিন রুনুকে ডেকে বললেন, দেখি, এদিকে এসো তো রুনু।
রুনুর তখন স্কুলে যাওয়ার সময়। দুপাশের দুটি বিনুনি ঝাঁকিয়ে, ফ্রকের বেলট বাঁধতে বাঁধতে বলল, তাড়াতাড়ি বলো মা, সময় হয়ে গেছে।
কিন্তু মা কিছুই বললেন না, শুধু একটু তাকিয়ে দেখে বললেন, আচ্ছা, ঘুরে এসো স্কুল থেকে।
রুনুর মুখখানা লাল হয়ে উঠল। চোখের পাতা গেল নেমে। কোনও রকমে যেন পালিয়ে গেল মায়ের কাছ থেকে। লজ্জা, বিস্ময় আর বিচিত্র একটু বিক্ষোভে মনে মনে বলল, মা যেন কী! এমন করে তাকান যেন কী একটা অন্যায় বুঝি করে ফেলেছে রুনু! গায়ের মধ্যে এমন করে ওঠে।
কেন, কী করেছে রুনু? মা আজকাল প্রায়ই এ রকম করেন। এখানে যেয়ো না, ওখানে যেয়ো না, হেসো না অত জোরে। ও-রকম দাপাদাপি কোরো না রুনু। কেন? না, মা কেবল বলবেন : কেন আবার। বড় হচ্ছ না এখন? কোথাও বেড়াতে গেলে বলবেন, রুনু, তুমি বেশি দূরে যেয়ো না। কাছাকাছি থেকো। কেন? না, বড় হচ্ছ না তুমি?
বড় হচ্ছে, না, ছাই হচ্ছে রুনু। বড় বিরক্তি লাগে।
পর-মুহূর্তেই রুনুর মনটা আবার অন্তঃস্রোতে বহে উজানে। লজ্জা করে বলতে, ভীষণ লজ্জা করে, আর আশ্চর্য আনন্দ বোধ হয়, কোথায় যেন কেমন করে সে সত্যি বড় হয়ে যাচ্ছে। মা যেন ভগবান! ভগবানের মতো সব দেখতে পান!
প্রায় পৌনে এক মাইল হাঁটতে হয় রুনুকে স্কুলে যাওয়ার জন্যে। মফস্বলের এ ছোট শহরে তাদের মোটর বাস নেই স্কুলে যাবার। অনেক মেয়েই হেঁটে যায়। রুনুও যায়। স্কুলে পাঠিয়েও নাকি মায়ের বড় ভাবনা!
স্কুলের মাঠ পেরিয়ে, লাফাতে লাফাতে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে ক্লাস এইটের ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে সব ভুলে গেল রুনু। তখনও ক্লাস বসেনি। মনিটর দীপালি কাজল-ধ্যাবড়ানো ছোট ছোট চোখে এক-একজনের দিকে তাকাচ্ছে আর নাম টুকছে। নামের পাশে পাশে লিখে রাখছে, ‘চেঁচিয়ে হাসি’, ‘অলকার চুল ধরে টানা’, ‘দিদিমণির টেবিলের ওপর বসা’, ‘বাদামভাজার খোসা ছড়ানো’ ইত্যাদি।
রুনুর সে দিকে খেয়াল নেই। তিপুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই দুর্জয় অভিমান ঝিলিক দিল তার চোখে। ঠোঁট দুটিও ফুলে উঠল একটু।
তিপু অর্থাৎ তৃপ্তি ছুটে এসে রুনুর থুতনি তুলে ধরে বলল, রাগ করেছিস ভাই রুনু?
না।
না আবার! রাগ না করলে বুঝি রুনু এমন করে!
তিপু বলল, আজ তোর জন্যে দাঁড়াতুম ঠিক। কিন্তু বাবার সঙ্গে এলুম রিকশায় চেপে, সত্যি। তা নইলে বুঝি দাঁড়াই নে?
রুনু চোখ তুলে তাকায়। মুখের অন্ধকার প্রায় কেটে আসে। সত্যি, বাবার সঙ্গে এলে তো কিছু বলার নেই।
তিপু আবার বলল, আর বাবাকে দাঁড়াতে বললে, বাবা যদি রাগ করত?
তাও তো বটে। বাবারা যে সব সময় কাজ করেন। রুনুর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, একলা একলা আসতে এত খারাপ লাগে
বলতে বলতেই রুনুর চোখে পড়ে যায় তিপুর বিনুনির ভাঁজে পুরনো ফিতের ফুপড়ি বেরিয়ে পড়েছে। বিনুনি ধরে টেনে বলল রুনু, এদিকে আয়, খারাপ দেখাচ্ছে।
বলে সুকৌশলে ফিতের ফুপড়ি ঢুকিয়ে দিল বিনুনির ভাঁজে। তারপর চোখাচোখি হতে হাসল দুজনে।
এ স্কুলে নতুন এসেছে রুনু। এ বছরেই এসেছে। আগের স্কুলটা নাকি বাজে, বাবা বলেছেন। আর এ স্কুলে ভর্তি হয়ে অনেক মেয়ের সঙ্গে মিশতে মিশতে সবচেয়ে তার ভাব বেশি জমে গেছে তিপুর সঙ্গে।
প্রথম প্রথম তিপু দূর থেকে তাকিয়ে থাকত। তখনও ওদের আলাপ হয়নি। প্রথম যেদিন চোখে চোখ পড়ে গেল রুনুর, সেদিন ওর কী অস্বস্তি। আর লজ্জাও করছিল ভীষণ। প্রায় সব পিরিয়ডের দিদিমণিদের কাছেই ওকে বকুনি খেতে হয়েছে অন্যমনস্কতার জন্যে।
কিন্তু কী করবে রুনু! কেবলই মনে হচ্ছিল, তিপু ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কেন? কে মেয়েটা, বারে বারে অমন করে তাকাচ্ছে! আর তো কেউ অমন করে তাকায় না। চোখে যেন পলক পড়ে না মেয়েটার। কী যেন রয়েছে তার চোখে, তার অপলক সুন্দর চোখ দেখে রুনুর লজ্জা করছিল, অস্বস্তি হচ্ছিল, তার মধ্যে কোথায় একটু ভাললাগার ভাবটুকুও এসে গিয়েছিল। শুধু অচেনা হলে মানুষ ওরকম করে তাকায় না। যেন কী হয়ে গেছে মেয়েটার রুনুকে দেখে। ঠোঁটের কোণে একটু হাসির আভাসও বুঝি উঠছিল চমকে চমকে!
সে-ই যে চোখ নামিয়েছিল রুনু, আর কিছুতেই তাকাতে পারেনি। কিন্তু তাকাবার জন্যে মনটা হাঁসফাঁস করছিল ভিতরে ভিতরে। আড়চোখে তাকাতে গিয়েও লক্ষ করেছে, ঠিক তাকিয়ে আছে সে।
পরদিনই আবার চোখাচোখি হয়ে গেল রাস্তায়। একই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিল দুটিতে। মা গো! ধক করে উঠেছিল রুনুর বুকের মধ্যে। পরমুহূর্তেই লজ্জায় চোখের পাতা আনত হল রুনুর। লাল ছোপ ধরে গেল মুখে।
কত মেয়ের সঙ্গে কত সহজে আলাপ হয়ে যায়। পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যে আলাপ হয়ে কত কথাই না হয়ে যায়। আর এখানে কথা বলা দূরে থাকুক, সহজভাবে তাকাতেই পারেনি রুনু। মেয়েটাও কথা বলতে পারছিল না যেন কিছুতেই।
ক্লাসে গিয়েও সেই একই অবস্থা।
তিন দিন চলেছিল প্রায় একই রকম। কিন্তু রুনুর প্রাণ ভিতরে ভিতরে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল মেয়েটির জন্যে। তিপুর নামটা শুনে নিয়েছিল ইতিমধ্যে। কিন্তু আড়চোখে চোখে কত আর তাকাবে রুনু তিপুর দিকে! কেন যে ভাব হয় না মেয়েটার সঙ্গে!
চার দিনের দিন, টিফিনে ক্লাসে কেউ ছিল না তখন। রুনু কোনওদিনই বাড়ি যায় না টিফিনে। মাঠে মেয়েরা খেলা করছিল। রুনু মাঠে না গিয়ে, ক্লাসের জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। তিপু খেলা করবে, রুনু দেখবে লুকিয়ে লুকিয়ে।
সবে দাঁড়িয়েছে জানলায়, পিঠে আঙুলের খোঁচা খেয়ে ফিরতেই, তিপু? কিন্তু লজ্জা পাবার সময় না দিয়েই বলে উঠল তোমার সঙ্গে ভাব করতে এলুম ভাই। উঃ, কী মেয়ে ভাই তুমি। বড্ড গম্ভীর।
রুনুর লঙ্গা-লজ্জা করছিল। তবু হেসে বলল, যাঃ।
তিপু বলল, ইস। নয়? তোমাকে দেখে আমার এত ভাল লাগছিল! যতবারই তোমার দিকে তাকাই, তুমি কেমন গম্ভীর হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে। তোমার ভাই একটু অহঙ্কার আছে।
রুনু হেসে বলল, হ্যাঁ, তাই বুঝি! কিন্তু তুমি কিচ্ছু জানো না, আমার কী ভীষণ লজ্জা করছিল, সত্যি।
সত্যি?
হ্যাঁ।
আমারও। জানো, এত লজ্জা করছিল, কিছুতেই ভাব করতে পারছিলুম না।
তবে আমি এসে ভাব না করলে তুমি কিছুতেই কথা বলতে না, না?
রুনু বলল, মোটেই তা নয়। আমি ঠিক আজকে তোমার সঙ্গে ভাব করে ফেলতুম। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল।
তার পরে সত্যি সত্যি ভাব হয়ে গেল। এত ভাব আর কারুর সঙ্গে হয়নি রুনুর।
মা যে আজকাল রুনুকে পায়ে পায়ে সাবধান করেন, বড় হচ্ছ বড় হচ্ছ বলেন, সেটুকুও তিপুকে না বললে তার চলে না।
এমনকী সেদিন যে অমন হঠাৎ ডেকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে বলেছিলেন, আচ্ছা, স্কুল থেকে ঘুরে এসো। তারপর বিকেলে দরজি ডাকিয়ে নতুন জামার মাপ নিয়ে, তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন অন্য রকম ঝাঁপালো-ফাঁপালো লুজ ফ্রক, সেটুকুও বলে। সব বলে–সবটুকু, তার এই চোদ্দো বছর গহিনের সব কথা, সব অজানা সংশয়, তার রক্তের বিচিত্র বিস্ময়।
তিপুও বলে। কিন্তু তিপু ওর মায়ের কথা তেমন করে বলে না। বাবা নাকি ওর নেই। না-ই বা থাকলেন, তা বলে রুনুকে কি একদিন তিপু ওদের বাড়িতে যেতে বলতে পারে না! নিজেও যেতে বলবে না, আর রুনু এতবার তিপুকে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চায়, তিপু যায় না। খালি বলে, আচ্ছা, আর একদিন যাব, সত্যি, মাইরি! কেন? এমন করে এড়িয়ে কেন যায় তিপু? কষ্ট হয় না বুঝি, রাগ হয় না?
একদিন শনিবারের ছুটির পরে দুজনে ওরা হেঁটে আসছিল। বড় রাস্তার কাছেই একটি রাস্তার বাঁকে রুনুদের বাড়ি। তিপুদের বাড়ি আরও ছাড়িয়ে, সেই বাজার পার হয়ে গঙ্গাধারের কাছাকাছি।
এই দিনে রুনু বলল রাস্তায় চলতে চলতে, তিপু, আজ আমাদের বাড়ি তোকে যেতেই হবে।
তিপু বলল প্রতিদিনের মতো, আজ না ভাই রুনু, আর একদিন যাব।
আজ রুনুর মুখ ভার হয়ে উঠল। হাতে ধরে টানল তিপুর। হাসতে হাসতে হাত-টানাটানি করল দুজনেই। তারপর রুনুর চোখে যেন মেঘ করে এল। হঠাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, থাক তা হলে, আসিস নে।
রাগ করলি ভাই?
না।
তিপু হেসে রুনুর হাত ধরে বলল, আহা, মেয়ে যেন একেবারে মনসা। চল চল যাচ্ছি। তোর মা রাগ করবেন না তো?
ভাগ। সবাই কত যায়। বীণা, কুসুম
তারপরেই দুটি বড় বড় ছেলের দিকে চোখ পড়তেই রুনু বলে উঠল, দেখছিস, লোক দুটো কী রকম করে তাকাচ্ছে!
তিপু বলল, তাকাকগে মুখপোড়াগুলো!
তিপুর এমন পাকা গালাগাল শুনে দুজনেই চাপা গলায় খিলখিল করে হেসে উঠল। পর মুহূর্তেই বোধ হয় রুনুর মনে পড়ে যায়, এ রকম হাসা উচিত নয়। মা দেখলে খুব রাগ করতেন।
বাড়ি গিয়ে, তিপুকে নিয়ে একেবারে মার ঘরে চলে এল রুনু : দেখো মা, কাকে নিয়ে এসেছি আজ।
মা তখন খাটে শুয়ে উপন্যাস পড়ছিলেন। ভেজা চুল ছড়ানো, পান খেয়েছেন ঠোঁট লাল করে। মায়ের এই রূপটি তিপুকে দেখাতে পেরেও রুনু খুব খুশি মনে মনে। এ সময় মাকে তার এত সুন্দর লাগে, ঠিক যেন একটি মহারানি। সুন্দর লাগে, আবার ভয়-ভয়ও করে।
মা বই থেকে চোখ তুলে বললেন, কে?
রুনু বলল, তিপু গো, সেই যার কথা তোমাকে অনেকবার বলেছি।
কিন্তু মা তো কই হেসে, ভালবেসে ডেকে উঠলেন না এখনও তিপুকে! বরং মায়ের ভ্রূ দুটি কেমন যেন মেঘভার আকাশের বিদ্যুতের মতো ঢেউ খেলে গেল। রাগ করেননি, তবু যেন কেমন একটু উদাসীন ভাব। বললেন, ও, তোমার নাম তিপু?
তিপু সলজ্জ হেসে বলল, হ্যাঁ।
মা বললেন, বোসো, তোমাদের বাড়ি কোথায়? গঙ্গার ধারে? অধর পণ্ডিত লেনের কাছে?
তিপু বসে বলল, হ্যাঁ। আপনি চেনেন?
মা বললেন, চিনি বইকী।
তারপরে আরও দু-চারটি কথা বলে মা যেন কেমন সহজেই গা এলিয়ে দিলেন। অন্যমনস্কভাবে ডুব দিলেন বইয়ের পাতায়।
মার বুঝি ঘুম পেয়েছে? না কি বইটা পেয়ে বসেছে মাকে, এক-একটা বই নিয়ে মা অনেক সময় নাওয়া-খাওয়া ভুলে যান। কিন্তু সেদিন ময়নার সঙ্গে মা কতক্ষণ কথা বললেন। এমনকী ময়নার মা কী রান্না করেছেন, সেটুকুও জেনেছেন। আর আজ তিপুকে দেখে মার কেমন যেন গা-এলানো ভাব। তিপু হয়তো মাকে একটা বিচ্ছিরি কুঁড়ে গেঁয়ো মেয়েছেলে ভেবে গেল। মনে মনে বড় রাগ হল রুনুর মায়ের উপর।
কিন্তু তিপু কিছুই বলল না। সহজভাবেই হেসে, ঘুরে সারা বাড়িটা প্রায় দেখল রুনুদের। ছাদে দাঁড়িয়ে বড় রাস্তাটা দেখা যায়। বেলা বুঝি তখন দুটো বেজেছে। ভাদ্রের মেঘলা-ভাঙা রোদ প্রায় ফাঁকা রাস্তাটার উপর ভ্রূ কুঁচকে আছে। বড় জ্বলুনি এই রোদে। শুধু একটি লোক হেঁটে যাচ্ছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে, ছেড়া নেংটি পরে, খালি গায়ে। নিশ্চয় ভিখিরি।
দুই বান্ধবী খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল লোকটির দিকে। তারপর যখন দুজনের চোখাচোখি হল, তখন তাদের দুজনের মনই এক বিস্ময়কর বেদনায় ভরে গিয়েছে। এই প্রথম শরতে অনেকখানি-ছড়িয়ে-পড়া আকাশের তলায় হঠাৎ কেমন উদাস হয়ে যায় দুজনেই। রুনু বলল ফিসফিস করে, ভারী কষ্ট হয় দেখলে, না?
তিপু বলল, হ্যাঁ! জানিস, আমি যখন রাত্রে শুয়ে চোখ বুজব, তখন ঠিক লোকটা অমনি করে হেঁটে যাবে আমার চোখের ওপর দিয়ে। কেন এ রকম হয় ভাই?
রুনুও বলল অসহায়ভাবে : কী জানি! আমিও স্বপ্ন দেখে ঠিক জেগে উঠব অনেক রাত্রে।
কেন যে এই অজানা ব্যথায় ভরে ওঠে মন, এই দুই সখী তা বোঝে না। শুধু কারুর কষ্ট দেখলেই, তাদের বুক ছাপামাপি হয়ে যায়। একটুখানি আনন্দের সন্ধান পেলে হেসে হেসে মরে যায় তারা।
তারপরে তিপু বলল, এবার যাই।
রুনু বলল, আর একটু থাক ভাই। আয়, চল, দুজনেই ভাত খেয়েনি, অ্যাঁ?
তিপু বলল, ভাত, না ভাই, আজ নয়, আর একদিন হবে।
তিপু চলে গেল। তারপরে মার উপরে অভিমানটা আবার ফিরে এল রুনুর মনে। মার কাছে আর গেল না। রান্নাঘরে গেল খেতে। সেখানে তার ভাত ঢাকা দেওয়া আছে।
কিন্তু তার আগেই রুনুর পায়ের শব্দ পেয়ে মা ডাকলেন।
রুনু মুখখানি ভার-ভার করে গেল মায়ের কাছে। কিন্তু মা ওসব চেয়েও দেখলেন না। তিনি ততক্ষণে উঠে বসেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, চলে গেছে তোমার বন্ধু?
হ্যাঁ।
শোনো।
কেন?–মার গলা যেন কেমন শাণিত হয়ে উঠেছে। চাউনিটি যেন রাগ রাগ ভাবের।
রুনু অভিমানে ডুবে গেল। বলল, কী বলছ মা?
মা বললেন, ও-ই যে তোমার তিপু, তা জানতুম না। ওকে আর কোনওদিন বাড়িতে এনো না, ওর সঙ্গে মেশামিশিও কোরো না একদম।
রুনুর দুটি বড় বড় চোখ বিস্ময়ে ও অজানা ভয়ে পলকহারা হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, কেন মা?
মার ভ্রূ দুটি কুঁচকে উঠল। কী ভয় করছে এখন মাকে দেখে! মা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, সব কথা তোমাকে বলতে পারব না, জেনে রাখো, ওরা ভাল নয়। ওদের সঙ্গে কোনও ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ের মেলামেশা একদম উচিত নয়।
কী একটা বিশেষ ভয়াল ইঙ্গিত আছে যেন মার কথায়! তাই মা অমন এলাকাড়ি দিয়েছিলেন তিপুকে দেখে। কিন্তু তিপু! তিপুর তো কোনওদিন কিছু খারাপ দেখেনি রুনু। ক্লাসের মায়া নাকি কাকে কী সব চিঠিপত্র লেখে! শোভা কত রকমের বাজে কথা বলে। তিপু তো সে রকম কথা কোনওদিন বলেনি!
রুনু বলল খুব ভয়ে ভয়ে, জানো মা, তিপু কিন্তু ক্লাসের পড়া খুব ভাল দেয়। ইংরিজিতে
শোনো রুনু।–মার গলা রুনুর বুকে যেন কেটে কেটে বসে। বললেন, তিপু লেখাপড়ায় কত ভাল-মন্দ, আমি ওসব শুনতে চাই নে। তিপুর কী দোষ আছে, গুণ আছে তাও আমি জানিনে। কিন্তু তিপুর সঙ্গে তোমার মেশা দূরের কথা, কথা বলাও উচিত নয়। কী করে ও মেয়েকে স্কুলের দিদিমণিরা পড়তে দিচ্ছে বুঝিনে। খালি জেনে রাখো, ওর মা ভীষণ খারাপ, ভীষণ! যার চেয়ে আর কিছু হয় না, বুঝেছ? বলে রুনুর চোখের দিকে তাকালেন মা। কী একটা বিশ্রী ইঙ্গিত ছিল মায়ের কথায়, রুনুর মুখ লাল হয়ে উঠল। আর তিপুর মার কথা ভাবতে গিয়ে শহরের এক শ্রেণীর মেয়েদের চেহারা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। মার কথা থেকে সেই সব মেয়ের মূর্তিই ভেসে ওঠে।
কিন্তু তিপুর সঙ্গে তো কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তিপুকে রুনু তার চেয়ে সব বিষয়ে অনেক সুন্দর দেখে।
বোধ হয় রুনুর মুখে কিছু সংশয়ের ছায়া দেখে দৃঢ় গলায় মা বললেন, মোট কথা, তুমি এখন বড় হচ্ছ। তিপুর সঙ্গে একেবারে মিশবে না, কথাও বলবে না। যাও, খেয়ে নাও গে। এখুনি তোমার গানের মাস্টার মশাই এসে পড়বেন আবার।
চলে গেল রুনু। কিন্তু তিপুর কোনও দোষের কথা তো মা বললেন না। তিপুর তো কোনও দোষ নেই। কথা বলবে না সে তিপুর সঙ্গে। তবে কী বলবে সে তিপুকে! তিপু যখন হাসবে তার দিকে তাকিয়ে, ডাকবে–এই রুনু, শোন, তখন কী করবে রুনু, সে কথা কেন মা বলে দেবেন না! এমনি মিছিমিছি একজনের সঙ্গে কখনও আড়ি করা যায়? তিপু যদি সেই আগের মতো একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, তখন কী হবে রুনুর?
খেতে বসে বুকের মধ্যে টনটন করতে লাগল রুনুর। মরে গেলেও তো সে তিপুকে তার মায়ের বিষয় জিজ্ঞাসা করতে পারবে না। গান করতে বসে জাগরণে যায় বিভাবরীর স্বরলিপি তুলতে গিয়েও তার মনে হল, আচ্ছা, কেন এত প্যাঁচালো এই পৃথিবীটা! কার সঙ্গে এখন এ বিষয় নিয়ে রুনু আলোচনা করবে! তার আলোচনা করা দরকার, জানা দরকার, বোঝা দরকার।
রাত্রে সে যে বাইরের উঠোনের অন্ধকারে বসে ছিল, মা বোধ হয় তা জানতেন না। শুনতে পেল, মা বাবাকে বলছেন, তবে আর তোমাকে বলছি কী। দেখি রুনুর সঙ্গে একেবারে আমার ঘরে এসে হাজির। আমি তো একেবারে শিউরে উঠেছি দেখে। এ কী, মঙ্গলার মেয়ে এ বাড়িতে কেন? সে যে আবার স্কুলে পড়ে, তা কে জানত!
বাবার গলা শোনা গেল, দিনকাল তো বদলে যাচ্ছে।
মা বললেন, তা বলে একটা প্রস্টিটিউটের মেয়েকে স্কুলে রাখবে? অন্যান্য মেয়েরা খারাপ হয়ে যাবে না?
বাবা বললেন, শুনেছিলুম মঙ্গলা ওর মেয়েকে কোন এক আলাদা বাড়িতে রেখে দিয়েছে।
যতই রাখুক আলাদা, তবু সে যা তাই।
প্রস্টিটিউট শব্দটার আভিধানিক মানে জানে না রুনু। ভাবগত অর্থটা জানে। ঠিক যে সব মেয়েদের কথা ভেবেছিল সে, তবে তা-ই তিপুর মা! তিপুর মতো মেয়ের মা এই রকম কেন হয়? তিপু তো তার চেয়ে মোটেই খারাপ নয়। ও, তাই বুঝি তিপু কোনওদিন রুনুকে তাদের বাড়ি যেতে বলত না!
কিন্তু তিপুকে কী বলবে রুনু! মা বাবার কাছে যেটা সমস্যা, রুনুর কাছে সেটা কোনও সমস্যাই নয়। ওঁদের কাছে তিপু শুধু খারাপ মেয়েমানুষের মেয়ে। রুনুর যে বন্ধু।
কিন্তু রুনু মনে মনে ঠিক জানে, তার আর কিছুতেই তিপুর সঙ্গে কথা বলা চলবে না, মেলামেশা তো অনেক দূরের কথা।
পরদিন আগে আগে বেরিয়ে গেল রুনু স্কুলে। তিপু এসে রোজ দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার মোড়ে একসঙ্গে যাবার জন্য। তার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, তিপু যে এত আগে এসে রোজ দাঁড়িয়ে থাকে, কে জানত! তিপু হেসে বলে উঠল, উঃ, আজ খুব সকাল সকাল এসেছিস তো? রুনু দেখল, আজও ঠিক তিপু বেণী দুটি যা-তা করে বেঁধে এসেছে। ফ্রকের পিঠের বোতামগুলি লাগায়নি ঠিক করে।
রুনু গম্ভীর হয়ে গেল। রাগ করে নয়। বুকটা কী রকম ধড়াস ধড়াস করছে! মার কথাগুলো মনে পড়ছে। কী বলবে সে তিপুকে! মার উপরে, সংসারের উপরে ভীষণ রাগ হচ্ছে আর কান্না পাচ্ছে রুনুর। আর, আর তিপুর উপরেও রাগ হচ্ছে। কেন মরতে ও-রকম মায়ের মেয়ে হয়েছে! হল যদি, তবে রুনুকে কেন ভালবেসেছে!
তিপু কিন্তু থিতিয়ে গেছে রুনুর ভাব দেখে। কেন, এ রকম করছে কেন রুনু! রুনুর মুখে তো সে ভাবের অভিমান লেগে নেই! তিপুর উপর রাগলে তো তাকে এ রকম দেখায় না! তবে, তবে? তিপু যেন সাপ। অ্যাসিডের গন্ধ পেয়ে সতর্ক সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। মাথা নত হল তারও। মুখখানি ভরে গেল একটি বোবা ব্যথার অভিব্যক্তিতে। তোর মা রাগ করেছে, না?
রুনু পিছন ফিরে তাকাল। কে জানে, মা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে কি না! নেই। রুনু কোনও রকমে ঘাড় নেড়ে, হঠাৎ জোরে জোরে হাঁটতে লাগল তার স্লিপারে শব্দ তুলে। তিপু আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল তার শক্ত হিলে খট খট করে।
এর চেয়ে বেশি কিছু বলার দরকার ছিল না তিপুকে। এইটুকুর মধ্যেই আসল গণ্ডগোলটা জানাজানি হয়ে গেল ওদের।
এতে ওরা কে কতখানি আঘাত পেয়েছে, কে কত কেঁদেছে লুকিয়ে, সেটা জানাজানি হওয়ার কোনও উপায় রইল না। মেশামিশি, কথা বলাবলি বন্ধ হয়ে গেল ওদের আপনা থেকেই। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল দুজনে।
কিন্তু রুনুর তবু মনে হয়, তিপু ক্লাসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাই মাঝে মাঝে ও আড়চোখে তাকায়।
আসলে ওরা দুজনেই সোজা চোখে তাকাতে গেছে ভুলে। কিন্তু তাকানোটা এ জীবনে যেন শেষ হবে না আর। আর, বুকের মধ্যে কোথায় যেন আছে একটি মস্ত তেপান্তর। সেখানে যেন পুব-সাগরের ঝড়ো বাতাস মাথা কোটে নিরন্তর।
কে এসে দুজনের মাঝখানে পড়ে রাস্তার ডাইনে বাঁয়ে সরিয়ে দিয়েছে ওদের। কিন্তু বিচ্ছেদের আড়ালে, কাঁদতে গিয়ে হাসবার মতো একটি বিচিত্র খেলা পেয়ে বসেছে দুটিকে।
তিপু অপেক্ষা করে না আগে এসে, রুনু ছুটে আসে না কারুর আশায়, তবু ওদের দেখা হয়ে যায় রোজ। কিন্তু মিশতে মানা, কথা বলতে মানা। রাস্তার দুপাশ ধরে দুজনে যায় হেঁটে। যেন একজনকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে পথের এক পাশে, আর একজনকে টেনে ধরে রাখা হয়েছে আর এক পাশে।
আড়চোখে ওরা দেখে কি না! কে জানে। না দেখাই উচিত, কেন না, ওদের মানা আছে। বেলা দশটার রোদে ওদের ছায়া দুটি শুধু জানে, কী করে ওরা, কী হয় ওদের।
খানিকটা এগিয়ে মিউনিসিপালিটি, তারপরে অনেকগুলো দোকান–মোষের খাটাল, কামারের দোকান, একটা কালভার্ট, সিনেমা-হল, ডাক্তারখানা, ফোটোর দোকান। তারপরে ডান দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে পুব দিকের মাঠে। ওদিকটার কোনও সীমা নেই। বড় বড় গাছের ফাঁকে ফাঁকে মাঠ, ধানক্ষেত, জঙ্গল, দূর গ্রাম। তার পরে আরও যেন কত কী! কত কী! শুধু তার ইশারা নিয়ে পড়ে থাকে আকাশটা।
কিন্তু ওরা যায় সোজা উত্তরে কারখানা পেরিয়ে, পোস্ট-আফিস ডিঙিয়ে, তারপরে স্কুল।
ওদের মানা আছে, ওরা কথা বলে না, মেশে না। যেন দুটি আলাদা জগৎ, নত মুখে, সামনে তাকিয়ে, নিস্পৃহভাবে চলে যায় রাস্তার দুপাশ দিয়ে। রোজ রোজই এই খেলা।
তারপরে একদিন এই খেলার আয়ু শেষ হয়ে আসে। পৃথিবীতে সব খেলারই যেমন একদিন শেষ হয়।
পুজোর ছুটি কেটে গেছে। শরৎ গিয়ে হেমন্তের কাল এসে পড়েছে আকাশে। বাতাসে মাঝে মাঝে উত্তরের ঝাপটা টের পাওয়া যায়। আকাশ যেন বছর কাবারের আগে বড় বেশি নীল হয়ে গেছে। আরও বড়, অনেক বড় হয়ে সে হারিয়ে যেতে চাইছে। রোদে নতুন আমেজ। শীত আসার আগেই পাখিগুলি সারাদিন ডেকে নিচ্ছে প্রাণভরে।
আজও তেমনি না তাকিয়েও মোড়ের মাথায় এসে পরস্পরকে টের পেয়ে গেল ওরা। তারপর যেমন চলে, তেমনি চলতে লাগল।
মিউনিসিপাল অফিস গেল, পার হয়ে গেল দোকানগুলো, মোষের খাটাল, কামারের দোকান, কালভার্ট—
কেন, তিপু কি আজ আর যেতে চায় না? ওর ছায়াটা যেন পিছিয়ে পড়ছে মনে হয় রুনুর।
তারপরে সিনেমা হল, ডাক্তারখানা, ফোটোর দোকান
এ কী, কোথায় যাচ্ছে তিপু? রুনু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল, তিপু পুবদিকের পথটায় চলে যাচ্ছে হনহন করে। কেন রাগ হয়েছে?
রুনুর মনে হল, মা যেন বলছেন, তুমি ওদিকে কী দেখছ রুনু? যাও স্কুলে চলে যাও, ঘণ্টা বাজার সময় হল।
রুনুর বুকটা কী রকম করছে! ওকে স্কুলে যেতে হবে, কিন্তু তিপু আজ কেন এমন করে খেলা ভেঙে চলে যাচ্ছে! তিপু কি একটুও বোঝে না, একটুও কি কষ্ট হয় না তার রুনুর জন্যে!
রুনু যেন শুনতে পাচ্ছে মায়ের শাসানো চিৎকার–স্কুলে যাও বলছি…
কিন্তু এ কী রুনু, অবাধ্য মেয়ে তুই, তুই কেন মাঠের পথে যাস? –নিজেকেই যেন বলে রুনু, আর নিজেই জবাব দেয়, তিপু কি একটুও বোঝে না, কত কষ্টে রুনু চেপে রাখে নিজেকে। না কি তিপু আজ আর সহ্য করতে পারেনি। আর বুঝি সে এমন খেলা খেলতে পারে না।
কিন্তু এ কী, তিপু এত জোরে যাচ্ছে কেন? রুনু পিছু পিছু আসছে বলে? রুনু ডেকে উঠল, তিপু, তি–পু!
অমনি রুনুর কানে বাজল মায়ের হুঙ্কার : খবরদার, খবরদার বলছি রুনু
কিন্তু তিপু এত জোরে ছুটছে কেন? মাথাটা এত নুয়ে পড়েছে কেন ওর? কাঁদছে, না? কাঁদছে তিপু, আর রুনুর কান্না তুই দেখবি নে চেয়ে, না? তোরই খালি কষ্ট হয় ; রাগ হয়, আর আমার বুকটা কেমন করে, তুই জানিস নে? তিপু–তি-পু
গাছের আড়ালে পড়ল তিপু, আবার দেখা গেল। মাঠে পড়ল, আবার গাছের আড়ালে। বই বুকে চেপে, বেণী উড়িয়ে রুনু ছুটছে। দমের অভাবে আর ডাকতেও পারে না। ফিসফিস করে ডাকে শুধু, তিপু, তিপু, তিপু।
তারপরে একটা কুলঝোপের কাছে এসে, বই ফেলে রুনু দুহাতে জড়িয়ে ধরে সখীকে। তিপু মাটিতে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। রুনুও কাঁদতে থাকে তিপুর পিঠে মুখ চেপে।
হেমন্তের উদার আকাশ ভরে বাতাস লুটোপুটি খায়। মাঠে মাঠে পাকাধানের গোছা পড়ে নুয়ে। শব্দ হয় ঝিরিঝিরি, গন্ধ ছড়ায় নতুন ধানের। আর মনে হয়, আকাশ আর মাঠ যেন হাসে ঠোঁটের কোণে লুকিয়ে, তাদের দু-চোখভরা স্নেহ ও বেদনা। এই যে মেয়ে দুটি আজ প্রথম স্কুল পালিয়ে এসেছে, সমাজ ও মায়ের বারণ মানেনি, তাতে তাদের একটুও রাগ হল না। বরং যেন খুশি হয়ে ঠাঁই দিল এ ঝোপের নির্জনে।
দুটিতে অনেকক্ষণ ধরে শুধু কাঁদল, তারপর ফোঁপাতে লাগল। তারপরে এক সময়ে ফোলা-ফোলা চোখ নিয়ে, গায়ে গায়ে জড়িয়ে বসে রইল চুপ করে, দূর মাঠ ও আকাশের দিকে চেয়ে। তখনও কান্নার হেঁচকি উঠছে দুজনের। তারপর শুধু থেকে থেকে কেঁপে যেতে লাগল ওদের বুকের গভীর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস।
দুঃখ দেখলে ওদের বুক ছাপাছাপি হয়ে যায়, আনন্দে হেসে বাঁচে না। ভালবাসার টান ধরলে যে সব অনুশাসনের বেড়া ভেঙে ফেলতে পারে, সেটা ওরা জানে না। না জেনে, বাঁধ ভেঙে ওরা জীবনের অচেনা আঙিনায় এসে বোবা হয়ে রইল অনেকক্ষণ।
তিপু দুজনের বইগুলি গোছাল। রুনু তিপুর বিনুনি দুটি বাঁধল ভাল করে, ফ্রকের বোতামগুলি ঠিক করে লাগিয়ে দিল। আর রুনুর বুকের কাছে একটি পাকা ঘামাচি নখ দিয়ে মেরে দিল তিপু। আবার দুটিতে বসে রইল, গায়ে গায়ে, হাতে হাত দিয়ে! কোথায় যেন মেঠো মানুষের গলা শোনা গেল। গোরু ডেকে উঠল দূর থেকে। কুলগাছে ডেকে গেল পাখি। কখন সূর্য চলে গেল মাথার উপর দিয়ে।
রুনু গুন গুন করে গান গেয়ে উঠল। এতদিন মাস্টারমশায়ের কাছে শিখেছে, বাড়িতে কেউ এলে মা গান করতে বলেছেন। আজ আপনা থেকে গাইছে রুনু—
এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না।
মন উড়েছে উড়ুক না রে মেলে দিয়ে গানের পাখনা।
রুনুর গান শেষ হল। তারপর তিপুও গুন গুন করে উঠল—
তোমার বাঁশী শুনলে ঘরে রইতে পারি না।
তোমার দেখা পেলে আগল বাঁধতে পারি না।
দুজনের গান দুরকম। সুরের কোনও মিল নেই, ভাবে ও ভাষার কোনও মৈত্রী নেই। না-ই বা থাকুক। তারা যা জানে, তা-ই গাইতে লাগল। তাদের সব গান তারা গাইবে আজ পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে।
রুনু। মরি মরি, জাগরণে যায় বিভাবরী
আঁখি হতে ঘুম নিল হরি।
তিপু। সখী এ পথ দিয়ে অনেক গেছি।
তাকিয়েছি মিছামিছি
তোমার দেখা পাই নি
রুনু। কবে তুমি আসবে বলে।
আমি রইব না বসে
আমি চলব বাহিরে।
তিপু। অমন কুঞ্জের ধারে আসব না
ভুজঙ্গ সেথা আছে গো তবু অঞ্জন মাখি নয়নে।
মনোরঞ্জন পাশে আসি গো।
রুনু। আলোকের এই ঝরনা ধারার ধুইয়ে দাও
আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা,
ধুলায় ঢাকা, ধুইয়ে দাও।
তিপু। শিকল দিয়ে বাঁধো নাই তো
কী দিয়ে যে বেঁধেছ বাঁধনে যে এত সুখ
ছাড়া যেন না পাই গো।
এই যেন জীবনে দুজনের প্রথম গান গাওয়া। হাসল তারা দুজনে, গম্ভীর বিষণ্ণ সে-হাসি। এই বয়সের এত কথা, এত কাকলি–সব ছাপিয়ে, যেন ভরা গাঙের টাবুটুবুতে এসে পড়েছে তারা। অবাধ্য হয়ে তারা বাধ্য হল পরস্পরের। জীবনের কোথায় একটা দরজা খুলে গেল নিঃসাড়ে, দেখে শুধু হাসল ওই আকাশ আর পাকাধানের মাঠ।
রুনু বলল, স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বোধহয় পড়ল।
তিপু বলল, চল এবার যাই।
মাথার ওপরে আকাশটি চলল সঙ্গে সঙ্গে, মাঠের বাতাস এল পিছু পিছু।
বাড়ি আসতে মা রুনুর দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলেন। বললেন, কী রে, শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?
রুনুর বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল। বলল, না তো।
তারপরে খেয়েদেয়ে, চুল বাঁধার আগেই আজ রুনুর বড় ঘুম পেতে লাগল। কখন এক সময় ঘুমিয়েও পড়ল মায়ের বিছানায়।
বিকালে ঘরে ঢুকে রুনুকে এমন ঘুমুতে দেখে চমকে উঠলেন মা। গায়ে হাত দিলেন আস্তে আস্তে। না, জ্বর আসেনি। তারপর খানিকক্ষণ রুনুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মায়ের কী যেন হল! তিনি হঠাৎ উপর দিকে মুখ করে চুপিচুপি বললেন, মেয়েটা যেন আমার সুখী হয় জীবনে।
ঘরে ঢুকলেন রুনুর বাবা। বললেন, কী করছ?
মা বললেন, কিছু না। জানো গো, আমার বড় সাধ, রুনু একখানি শাড়ি পরবে।