অবাঞ্ছিত উপদ্রব – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ সাহেব ছিলেন বিখ্যাত সরোদবাদক। তিনি জীবনের শেষ কয়েকটা বছর এই কলকাতা শহরেই কাটিয়েছিলেন। সে সময় শহরের ধনী-নির্ধন অনেকেই তাঁর সাকরেদ হয়ে বাজনা শিখতেন। খাঁ সাহেব শুধু উঁচু দরের বাজিয়ে ছিলেন না, তিনি একজন উঁচু দরের মজলিসী লোকও ছিলেন। তাঁর গল্প এক সময়ে শহরে প্রবাদের মত রাষ্ট্র ছিল। পরলোকগত স্যার আশুতোষ চৌধুরী মহাশয়ের পত্নী লেডি প্রতিমা চৌধুরানী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সঙ্গীত সঙ্ঘের’ অধ্যক্ষ ছিলেন করমতুল্লা খাঁ সাহেব।
আগেই বলেছি, ওস্তাদজী খুবই মজলিসী লোক ছিলেন। যার ফলে আমরা তাঁর জনকতক শিষ্য সেই ভোর থেকে আরম্ভ করে বেলা নটা সাড়ে নটা অবধি আর রাত্রি নটা থেকে রাত্রি বারোটা-একটা অবধি সেখানে আড্ডা জমাতুম। দেশ-বিদেশের আরও অনেক নামজাদা বাজিয়ে-গাইয়ে আসতেন সেখানে—গান-বাজনার জলসা যেদিন হত, সেদিন আর আড্ডা ভাঙবার সময়ের ঠিক থাকত না, সন্ধে থেকে ভোর হয়ে যাওয়াও এমন কিছু বড় ব্যাপার ছিল না।
গ্রীষ্মের ও পূজার সময় সঙ্ঘের লম্বা ছুটি থাকত এবং সে সময় খাঁ সাহেব নিজের দেশে যেতেন। তাঁর বাড়ির মহিলারা কেউ সেখানে থাকতেন না। তাঁদের দেখাশোনা করবার জন্যে বছরে অন্তত এই দুবার দেশে না গেলে তাঁর চলত না। তিনি থাকতেন ভাড়াটে-বাড়িতে এবং প্রতিবারই দেশে যাবার সময় বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতেন এবং ফিরে এসে আবার বাড়ি ভাড়া করে সেখানে গিয়ে উঠতেন। যতদিন না বাড়ি পাওয়া যেত, ততদিন হয় মধু রায়ের লেনে কালী পালের বাড়ি বা কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে গজেন ঘোষের বাড়িতে থাকতেন আর আমরা সবাই ছুটোছুটি করতুম বাড়ির তল্লাসে।
খাঁ সাহেবের পছন্দমত বাড়ি চাই। খোলামেলা আলো-হাওয়া পাওয়া যায় এমন বাড়ি হলে তাঁর চলবে না। চারদিক বেশ বন্ধ থাকবে, অন্য কোন বাড়ি থেকে কিছু দেখা যাবে না, অর্থাৎ তাঁর ভাষায় বাড়িখানি একেবারে ‘সিন্দুকের’ মত হওয়া চাই। এখনকার লোকেরা হয়তো বিশ্বাস করতেই চাইবেন না, কিন্তু সেকালে সব সময়ে সব রকমের বাড়িই ভাড়া পাওয়া যেত।
এই রকম একটা সময়ে খাঁ সাহেব দেশ থেকে ফিরে এসেছেন, শিষ্য-সম্প্রদায় বাড়ির খোঁজে ব্যস্ত, কিন্তু সেবার আর মনের মত বাড়ি জুটছে না। শেষকালে বেশ কিছুকাল খোঁজাখুঁজির পর একখানা বাড়ি পাওয়া গেল। বাড়িখানা মানিকতলা স্ত্রীটে ছাতুবাবুর বাজার ছাড়িয়ে গিয়ে যে কালীমন্দির আছে তার একটু আগে একটা গলির মধ্যে। তখন কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ তৈরি করছেন। এই বাড়িখানাও রাস্তায় পড়েছিল—বাড়িখানার সামনে-পেছনে, ডাইনে-বাঁয়ে সব ভাড়া বাড়ি। কোনটা একেবারে ভেঙে ফেলা হয়েছে, কোনটা আস্তে আস্তে ভাঙা হচ্ছে। মাস পাঁচ-ছয় বাদে এখানাও ভাঙা হবে। অন্তত মাস পাঁচ-ছয়ও থাকা যাবে এই মনে করে খাঁ সাহেব বাড়িটা পছন্দ করলেন এবং দিন-দুয়েকের মধ্যেই জিনিসপত্র এনে এখানে উঠলেন।
আমরা আগের মতন সকাল-সন্ধ্যায় সেখানে জুটতে লাগলুম। রাত্রে অনেকখানি অন্ধকার গলি পার হয়ে তবে বাড়িতে ঢুকতে হত। এইখানে গ্যাস কিংবা অন্য কোন আলো জ্বলত না। তার ওপরে দুপাশে সব ভাঙা বাড়ি থাকায় গলি পার হবার সময় অনেকেরই গা ছমছম করত।
একদিন, তখন রাত্রি প্রায় আটটা হবে, খাঁ সাহেবের একটি শিষ্য ওই গলিটা পার হচ্ছেন, এমন সময় ভদ্রলোকের কানের পাশ দিয়ে একটি বড় ডাব বেরিয়ে গিয়ে সামনে পড়ল। আমরা অনেকেই তখন ওপরে বসেছিলুম। ভদ্রলোকটি আমাদের একথা বলামাত্র আমরা আলো ও লোকজন নিয়ে নিচে গেলুম। দেখলুম ডাবটা তখন পড়ে রয়েছে—সেটি মাথায় লাগলে তাঁকে আর উঠতে হত না। নিশ্চয় কোন বদমাইশ লোকের কাজ মনে করে তো তখনকার মতন আমরা চলে গেলুম।
পরের দিন সকালে এসে শুনলুম যে কাল সারারাত্রি মহা হাঙ্গামা গিয়েছে! কি ব্যাপার! শোনা গেল, রাত্রি এগারোটার সময় স্নানের ঘরে কল খোলার শব্দ পেয়ে নিচে গিয়ে কল বন্ধ করে আসা হয়। সে সময় কলকাতা শহরের অনেক জায়গায় সারা রাত কলে জল থাকত। যা হোক, ওপরে আসবার পরই আবার জল পড়ার শব্দ শুনতে পাওয়া যায় এবং আবার তারা নিচে গিয়ে কল বন্ধ করে আসে। এইরকম বার কয়েক হতেই তারা দু-তিন জন মিলে নিচে গিয়ে কল বন্ধ করে স্নানের ঘরের সামনেই বসে থাকে, কিন্তু একটুক্ষণ পরেই আবার কে কল খুলে দিতেই ভয়ে তারা ওপরে উঠে আসে এবং সারারাত্রি ধরে জল পড়ে।
দোতলায় একটা বড় হলঘর ছিল। এই ঘরে খাঁ সাহেব থাকতেন, তা ছাড়া বাজনার আসর ইত্যাদি এই ঘরেই করবার বন্দোবস্ত হত। সেদিন রাত্রে এই ঘরে বসে আমরা কাল রাত্রের সেই কল খোলা ব্যাপার সম্বন্ধে আলোচনা করছি এমন সময় ওপর থেকে ঝুপঝুপ করে পুষ্পবৃষ্টির মতন আমাদের মাথার ওপরে খানিকটা আস্তাকুঁড়ের ময়লা পড়ল। আমরা তো অবাক! এ-রকম চাষাড়ে রসিকতার চলন সেখানে ছিল না, কাজেই উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একাজ কেউ করেনি। যা হোক, সে জায়গাটা পরিষ্কার করে আবার বসা গেল, কিন্তু বসতে না বসতেই আবার সেই ময়লার বৃষ্টি—যত সব তরকারির খোসা!
ব্যাপার দেখে খাঁ সাহেব তো নানারকম মন্ত্র-তত্র আওড়াতে লাগলেন। ঝাড়ফুঁকও চলতে লাগল। সেদিনকার মত আমরা সরে পড়লুম। পরের দিন এসে শুনি সারা রাত সেইরকম কল খোলা চলেছে এবং রাত্রে আরও দু-একবার ময়লাও পড়েছে। খাঁ সাহেবের দেশের বাড়িতে অনেকগুলি ছেলে মানুষ হচ্ছিল, এবারে তাদের মধ্যে দু-একজনকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে একজন বললে, সিঁড়িতে একজন দাড়িওয়ালা অপরিচিত বৃদ্ধ দাঁড়িয়েছিলেন, আমি কাছে যেতেই তিনি যে কোথায় মিলিয়ে গেলেন তা বুঝতে পারলাম না।
এ ছোকরা ছিল খুবই ওস্তাদ। সমস্ত ব্যাপারটার ওপর একটু রং দেবার জন্যই কথাটা সে বানিয়ে বলেছিল। কিন্তু যাই হোক, শূন্য থেকে আমাদের ওপরে ময়লা পড়া সমানে চলতে লাগল। ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওপর দিকে চেয়ে বসে থেকে দেখেছি হঠাৎ শূন্য থেকে খানিকটা ময়লা ঝুরঝুর করে পড়ল—ফাঁকা জায়গায় নয়, লোকের ওপরে। এদিকে খাঁ সাহেব পাঁচ ওক্ত নেমাজ পড়তে লাগলেন, বাড়িতে কোন প্রকার অনাচার যাতে না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখলেন। ঘরের মধ্যে সর্বক্ষণ গুগ্গুল জ্বলতে লাগল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না—সন্ধের পর লোজন আসরে বসলেই ময়লা পড়া সমানে চলতে লাগল।
ব্যাপার দেখে আড্ডাধারীরা সরে পড়তে আরম্ভ করলে। অনেক বাইরের লোকও কৌতূহল পরবশ হয়ে আসতে লাগল। আমাদের অমন শান্তির নীড় বাজারের হট্টগোলে পরিপূর্ণ হল। খাঁ সাহেবের এক বন্ধু ছিলেন, তাঁর কাবুলে বাড়ি। সকলে তাঁকে সৈয়দ সাহেব বলে ডাকতেন। ভদ্রলোক ঊর্দু বলতে পারতেন না, ফার্শিতে কথা বলতেন, কিন্তু ঊর্দু বুঝতে পারতেন। খাঁ সাহেবও ফার্শি বলতে পারতেন না, তবে বুঝতে পারতেন। এই সৈয়দ সাহেব ধার্মিক লোক ছিলেন, আর ঝাড়ফুঁক ও তন্ত্রমন্ত্রেও ছিলেন ওস্তাদ। হালে পানি না পেয়ে এই সৈয়দ সাহেবের শরণাগত হওয়া গেল শেষকালে। সৈয়দ সাহেব এসে সব শুনে কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে থেকে বললেন, কোন ভয় নেই। এ হচ্ছে একরকম বদমাইশ ভূতের কাজ। দাঁড়াও, ঠাণ্ডা করে দিচ্ছি।
সৈয়দ সাহেব আট-দশটা কাগজে কি সব মন্ত্র লিখে দেওয়ালের জায়গায় জায়গায় মেরে দিলেন। ঘরে খুব গুগ্গুল জ্বালানো হল। তিনি নেমাজ ও সেই সঙ্গে আরও কি কি সব পড়ে বলে গেলেন—ব্যস্। ভূত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। দুদিন পরে আমায় খবর দিও। ঠিক হল সেদিন সন্ধের পরে ভূতের কল্যাণার্থে বিশেষ জলসা হবে। যারা আড্ডায় আসা বন্ধ করেছিল, তাদের কাছে ও আরও অনেকের কাছে বিশেষ নিমন্ত্রণ পাঠানো হল।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় জলসায় অনেকেই এসে উপস্থিত হলেন। সৈয়দ সাহেব দেওয়ালের যে যে জায়গায় তাগা মেরে দিয়েছিলেন, আমরা সেই জায়গাগুলোতে দেওয়ালে গা-সাঁট্টা হয়ে বসলুম। সন্ধ্যা উৎরে গেল। খাঁ সাহেবরা সকলে নেমাজ সেরে এসে আসরস্থ হলেন। সকলের মুখেই ভূতের গল্প—যার যা অভিজ্ঞতা ও শোনা কথা বলতে লাগলেন। রাত্রি আটটা অবধি কোন অত্যাচার—ময়লা পড়া অথবা কল খোলা হল না দেখে খাঁ সাহেব সাজ মেলাতে আরম্ভ করলেন। সেদিন সঙ্গত করেছিলেন বিখ্যাত তবলা-বাদক দর্শন সিং—আজ তাঁরা উভয়েই প্রেতলোকে।
প্রায় নটা নাগাদ খাঁ সাহেব বাজনা শুরু করলেন। বেশ জমিয়ে দরবারী আলাপ করে গৎ শুরু করেছেন—শ্রোতৃবৃন্দ চারদিক থেকে বাঃ, বহুত আচ্ছা প্রভৃতি প্রশংসাসূচক আওয়াজ ছাড়ছেন দেখে অন্তরীক্ষে ভূত মশায় আর সংযম রক্ষা করতে পারলেন না। খাঁ সাহেব ও দর্শন সিং-এর মাথার ওপর বারবার ধরে খানিকটা পুষ্পবৃষ্টি হয়ে গেল—বাদামের খোলা, প্যাঁজ ও আলুর খোসা এবং তৎসহ যথোচিত ছাই কাদা ইত্যাদি—একবার নয়, দু-তিনবার। খাঁ সাহেব বাজনা থামিয়ে সরোদটি নামিয়ে রেখে ওপর দিকে চেয়ে বললেন, তোবা! তোবা!—তারপর একটু থেমে বললেন, কুছু রূপিয়া পয়সা ফেঁকো বাবা!
ওদিকে ব্যাপার দেখে শ্রোতৃবৃন্দ আস্তে আস্তে হাল্কা হতে লাগলেন, কিন্তু তাঁরাও বঞ্চিত হলেন না। তাঁদের ওপরেও কয়েকবার পুষ্পবৃষ্টি হয়ে গেল।
পরের দিন ভোর না হতে সৈয়দ সাহেবকে ডেকে আনা হল। সব শুনে তিনি বললেন, এই হিন্দুপাড়ায় আমি মনে করেছিলুম এ সব হিন্দু ভূতের কাজ, কিন্তু এখন দেখছি তা নয়! কারণ আমি যে মন্ত্র ঝেড়েছি, হিন্দু-ভূত তা কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। এ হচ্ছে জিন—একেও আমি তাড়িয়ে দিচ্ছি, তবে কিছুদিন সময় লাগবে।
খাঁ সাহেব কিন্তু আর সময় দিলেন না। তিনি সেইদিনই জিনিসপত্র নিয়ে এক সাক্রেদের বাড়ি গিয়ে উঠলেন। শিষ্য সম্প্রদায় আবার ছুটোছুটি শুরু করলে নতুন বাড়ির তল্লাসে।