৮
শাকিল বাড়িতে চার পাঁচ দিন থেকে মেহেরপুর রওয়ানা দিল। চৌধুরী সাহেবের কথামত সে একটা পিস্তল সব সময় সঙ্গে রাখে। বাস থেকে নেমে রিকশায় করে শাকিল যখন বিলের পাড়ের রাস্তা দিয়ে আসছিল তখন মাগরিবের নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাবে। তাই রিকশাওয়ালাকে বলল, তুমি একটু দাঁড়াও ভাই, আমি নামাযটা পড়ে নিই। সে জন্যে ভাড়া বেশি দেব।
রিকশাওয়ালা শাকিলকে চেনে। বহুবার তাকে এনেছে, বলল, না সাহেব ভাড়া বেশি দিতে হবে না। আমিও নামায পড়ব।
শাকিল আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, এস, বিলের পানিতে অযু করে দুজনে একসঙ্গে নামায পড়ে নিই। বিলের পাড়ের ঘাসের ওপর মসল্লা বিছিয়ে শাকিল রিকশাওয়ালাকে নিয়ে নামাযে দাঁড়াল।
রিকশাওয়ালা ফরয ও সুন্নত নামায পড়ে রিক্সার কাছে ফিরে এল।’
শাকিল ছোট বেলা থেকে মাগরিবের নামাযের পর ছয় রাকাত আওয়াবিন নামায পড়ে। সেই নামায পড়তে তার একটু দেরি হতে লাগল। নামায শেষ করে মসল্লা নিয়ে যখন সে ফিরে আসার জন্য উদ্যত হল তখন পাশের জঙ্গল থেকে পিস্তল দিয়ে তিন বার ফায়ার করল। প্রথম গুলিটা শাকিলের পিঠে লাগতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে ক্রলিং করে দ্রুত সরে যেতে লাগল। ফলে পরের গুলিগুলো তার গায়ে লাগেনি।
গুলির শব্দ পেয়ে রিকশাওয়ালা শাকিলের দিকে ছুটে আসার সময় দেখল, একটা কোট প্যান্ট পরা লোক জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছে। তাকে ধরতে গেলে সে যদি আবার তাকেও গুলি করে, সেই কথা ভেবে রিকশাওয়ালা শাকিলের কাছে ছুটে এল।
রক্তে শাকিলের জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে। সে শক্তিশালী যুবক। তাই গুলি খেয়েও উঠে দাঁড়িয়ে ঘাতককে ফলো করতে গিয়ে রিকশাওয়ালাকে দেখে বলল, লোকটা কোনদিকে গেল বলতে পার?
কিশাওয়ালা বলল, লোকটা বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। তাকে পিস্তল বের করে সেদিকে যেতে দেখে এবং তার জামাকাপড় রক্তে ভিজে গেছে দেখে বাধা দিয়ে বলল, আপনি তাকে ধরতে পারবেন না, আপনার শরীরের রক্ত পড়া বন্ধ করা আগে দরকার।
শাকিল কথাটার সত্যতা উপলব্ধি করে বলল, তোমার গামছা দিয়ে আমার ক্ষতটা কষে বেঁধে দাও।
রিকশাওয়ালা কোমর থেকে গামছা খুলে বেধে দিয়ে তাকে ধরে এনে রিকশায় বসাল।
শাকিল বলল, সদর হাসপাতালে চল। মেহেরপুর সদর হাসপাতালে যেতে হলে চৌধুরী বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। কাছাকাছি এলে শাকিল রিকশাওয়ালাকে বলল, দারোয়ানকে একটু ডেকে আন।
রিকশাওয়ালার কাছে ম্যানেজার সাহেব গুলি খেয়েছে শুনে দারোয়ান লাঠি হাতে করে ছুঁটে এল। কাছে এসে জামা কাপড় রক্তে ভিজে গেছে দেখে চমকে উঠে বলল, কি করে এরকম হল বাবু?
গামছা দিয়ে ক্ষতটা বাঁধলেও রক্ত বন্ধ হয়নি। এতক্ষণ রক্তক্ষরণ হয়ে শাকিল ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে। দারোয়ানের কথার জওয়াব না দিয়ে কোন রকমে ব্রীফকেস ও পিস্তল তার হাতে দিয়ে বলল, আমি সদর হাসপাতালে যাচ্ছি, আপনি নায়েবকে খবরটা দিয়ে এগুলো বেগম সাহেবের কাছে পৌঁছে দিতে বলবেন। তারপর রিকশাওয়ালাকে বলল, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চল।
দারোয়ানের মুখে খবরটা শুনে নায়েব চমকে উঠল। তারপর ব্রীফকেস ও পিস্তলটা নিয়ে বেগম সাহেবের কাছে গিয়ে সেগুলো টেবিলের উপর রেখে খবরটা জানালেন।
নাগিনা বেগম চমকে উঠে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।
ওনার আসার আগেই ডাক্তাররা শাকিলকে অজ্ঞান করে তার শরীর থেকে গুলিটা বের করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। বেডে নিয়ে আসার পর নায়েব নাগিনা বেগমকে নিয়ে সেখানে এলেন।
শাকিলকে দেখে নাগিনা বেগম চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। একদৃষ্টে তার মলিন মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর নায়েবকে দিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে শাকীলের অবস্থা আশংকামুক্ত জেনে ফিরে এলেন।
.
শাকিল গুলি খাওয়ার কিছুক্ষণ আগে এই রাস্তা দিয়ে থানার দারোগা দুজন সিপাই নিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিলেন। দারোগা খুব সৎ ও ধার্মিক। বিলের রাস্তা পার হয়ে সামনের পাড়ার মসজিদে মাগরিবের নামায পড়ে করিম মেম্বারের সঙ্গে চৌধুরী স্টেটের ম্যানেজার শাকিলের কথা ও চৌধুরী মেমোরিয়াল বিদ্যাপীঠের কথা আলোচনা করছিলেন। গুলির শব্দ শুনে বললেন, কি ব্যাপার বলুন তো?
করিম মেম্বার বললেন, বিলের দিকে গুলির শব্দ হল বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে শাকিল সাহেবকে রিকশায় করে যেতে দেখলাম। ওনার কোন বিপদ হল না তো? ততক্ষণে ঐ দিকে কিছু লোকের গোলমাল শুনে দারোগা ও করিম মেম্বার এবং আরো কয়েকজন নামাযি বিলের দিকে আসতে লাগল।
যে লোকটা শাকিলকে গুলি করেছিল, সে কিছুটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এসে। রাস্তায় উঠে দ্রুত হেঁটে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিল।
সামনের পাড়ার আক্কাস একটু আগে রাস্তা থেকে কিছু দূরে জমির আলে একটা বাবলা গাছের আড়ালে বদনা নিয়ে পায়খানা করতে বসেছিল। গুলির শব্দ শুনে ভয়ে তার পায়খানা শুটকে গেল। সে তাড়াতাড়ি জমি থেকে রাস্তায় উঠে এল। এমন সময় একজন লোককে বিলের দিক থেকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো ঐ দিক থেকে আসছেন, গুলির শব্দ শোনেন নাই?
লোকটা বলল; আমার পিছন দিকে কিছু দূরে গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম।
আক্কাস এই গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। আশপাশের অনেককে চেনে। লোকটাকে অচেনা মনে হতে তার পিছনে আসতে আসতে বলল, একটু দাঁড়ান না মিয়া ভাই, আপনি কোন গেরামের মানুষ? আপনাকে তো চিনতে পারছি না?
লোকটা যেতে যেতে বলল, আমি ঢাকার লোক। দুদিন আগে ফুপুদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলাম।
আক্কাস বলল, কোন গেরামে আপনার ফুপুর বাড়ি? ফুপার নাম কি?
লোকটা গুঁইগাঁই করে কি বলল আক্কাস বুঝতে না পেরে তার সন্দেহ হল। সে দৌড়ে লোকটার সামনে এসে পথ আগলে বলল, একটু দাঁড়ান না, দেখি আপনাকে চিনতে পারি কি না। আপনার ফুফুদের গেরামের নাম কি জানি বললেন?
লোকটা রেগেমেগে বলল, আমাকে চেনার দরকার নেই পথ ছাড়। এখানকার গ্রামের যা নাম, আমার মনে থাকে না।
আক্কাস বলল, ফুপার নাম বলুন।
লোকটা আরো রেগে নিয়ে বলল, তুমি তো আচ্ছা লোক, মানুষকে রাস্তায় আটকে জেরা করছ। সর, দেরি করলে বাস পাব না।
আক্কাস বলল, এখন তো ঢাকার বাস নেই। এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? ঢাকার বাস তো রাত ন’টায় ছাড়বে।
তাতে তোমার কি বলে লোকটা আক্কাসকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে যেতে লাগল।
আক্কাসের সন্দেহটা আরো বেড়ে গেল। সে তার পিছনে না গিয়ে জমির আল ধরে একটু ঘুরা পথে ছুটে নিজেদের পাড়ায় যখন এল তখন দারোগাও সেপাই অন্যান্য লোকজনদের নিয়ে এইদিকে আসছিলেন। আক্কাস দারোগাদের কাছে এসে পায়খানা করতে যাওয়া থেকে লোকটার সঙ্গে যা কথা হয়েছে সব বলল।
দারোগা সাহেব বললেন, সেই লোকটা কি এদিকেই আসছে?
আক্কাস বলল, হ্যাঁ।
দারোগা সাহেব সবাইকে রাস্তা ছেড়ে গা ঢাকা দিতে বলে নিজে সিপাই দু’জনকে। নিয়ে রাস্তার ধারে ওৎ পেতে রইলেন।
অল্পক্ষনের মধ্যে লোকটা কাছে আসতে দারোগা সামনে এসে পিস্তল তাক করে বললেন, দু’হাত তুলে দাঁড়ান।
লোকটা চমকে উঠে ছুটে পালাতে গেল, কিন্তু সফল হল না। ততক্ষণে সিপাহী দু’জন তার সামনে এসে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। লোকটাকে পিস্তল বের করতে দেখে দারোগা নিজের পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে তার মাথায় আঘাত করলেন। লোকটা মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল, সিপাহী দু’জন তাকে ধরে পিস্তল কেড়ে নিয়ে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দিল। তারপর দারোগা সাহেব লোকটার হাতে পায়ে গাঁটে গাঁটে রুলের বাড়ি মেরে স্বীকারোক্তি করালেন, আমজাদ চেয়ারম্যান তার শালাকে দিয়ে এই কাজ করানোর জন্য তাকে প্রচুর টাকা পয়সা দিয়ে ঢাকা থেকে আনিয়েছেন।
দারোগা সাহেব চেয়ারম্যান ও তার শালাকে এরেষ্ট করে চৌধুরী বাড়ির কাঁচারিতে এলেন। নায়েব খবর পেয়ে বেরিয়ে এলেন।
দারোগা খুনিদের এরেষ্টের কথা জানিয়ে শাকিলকে দেখতে চাইলেন।
নায়েব বললেন, উনি সদর হাসপাতালে গেছেন। আমি বেগম সাহেবকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
দারোগা বললেন, ঠিক আছে আপনারা যান, আমি খুনিদের থানায় রেখে আসছি।
পরের দিন শাকিলের গুলি খাওয়ার কথা গ্রামের লোক জানতে পেরে তাকে দেখার জন্য হাসপাতালে ভীড় জমাল। দারোয়ান গেট বন্ধ করে প্রধান কর্তৃপক্ষকে জানাল। তিনি গেটের কাছে এসে অবাক। তিনি এর আগে কোনদিন রুগী দেখতে একসঙ্গে এতলোক আসতে দেখেন নি। বললেন, রুগীর অবস্থা ভাল নয়। উনি অজ্ঞান হয়ে আছেন। আপনারা তিন চার দিন পরে আসুন।
নাগিনা বেগম নায়েবকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন শাকিলকে দেখতে যাচ্ছেন। শাকিলের খুব জ্বর, মাথায় বরফ দিতে হচ্ছে। একদিন ফেরার পথে নাগিনা বেগম নায়েবকে বললেন, শাকিলের বাবা মাকে খবরটা দিলে হত না?
নায়েব বললেন, শুনেছি ওনার বাবার শরীর তেমন ভাল নয়? ছেলের খবর শুনে যদি হার্টফেল করেন। তার চেয়ে কয়েকদিন পরে কি রকম থাকেন তা দেখে খবর দেয়া যাবে।
যাদুঘরের ঘটনার দিন শাকিলা বাবাকে জানিয়েছিল সে মেহেরপুর যাবে। মেয়ের কথা শুনে ইয়াসিন সাহেব শাকিলা ও শাকিলের বিয়ের কথা সবিস্থারে নাগিনা বেগমকে জানিয়েছিলেন। শাকিল আহত হওয়ার পরের দিন নাগিনা বেগম শাকিলাকে পাঠাবার জন্য ইয়াসিন সাহেবকে টেলিগ্রাম করতে নায়েবকে বলেছিলেন। টেলিগ্রাফ পেয়ে ইয়াসিন সাহেব মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, কি ব্যাপার দেখত মা।
শালিকা টেলিগ্রাফটা পড়ে শুনাল।
ইয়াসিন সাহেব অবাক হবার ভান করে বললেন, হঠাৎ তোর চাচিআম্মা ডেকে পাঠাল কেন? যাবি নাকি? তুইওতো কয়েকদিন আগে যাবি বলে বলছিলি। ‘
শাকিলা তখন চিন্তা করছে চাচিআম্মা ডেকে পাঠালেন কেন? তা হলে কি শাকিলের কোন কঠিন অসুখ-বিসুখ হয়েছে। তখন তার শাকিলের বিয়ের শর্তের কথা মনে পড়ল “মৃত্যুশয্যায় আপনাকে একবার দেখতে চাই।”
মেয়েকে চুপ করে থাকতে দেখে ইয়াসিন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কিরে কিছু বলছিস না কেন?
শাকিলা বলল, তুমি ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি রাখতে বলো কাল সকালে রওনা দেব।
চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছে চাচিআম্মার মুখে শাকিলের কথা শুনে শাকিলা চমকে উঠল এবং সেই সাথে তার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল বলে ঐদিন শাকিলকে দেখতে যেতে পারল না।
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর নাগিনা বেগম শাকিলাকে পাশে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, আমি শাকিলের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা জেনেছি এবং আরো জেনেছি তুমি তাকে চরিত্রহীন ভেবে শুধুমাত্র চৌধুরী স্টেটের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য তাকে বিয়ে করেছ। পুরুষরা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে চরিত্রহীনের মত কাজ করে ফেললেও মেয়েদের কাছে স্বামী চিরকাল সম্মানের পাত্র। প্রত্যেক মেয়ের উচিত আল্লাহ ও তার রসুলের পরে স্বামীকে সম্মান করা।
শাকিলা চাচিআম্মার কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাদের বিয়ের কথা আপনি কি শাকিলের কাছ থেকে জেনেছেন?
নাগিনা বেগম বললেন না মা, সে এসব কিছু বলেনি। তোমার আব্বা আমাকে জানিয়েছে।
ঘুমাতে গিয়ে শাকিলার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম এল না। চোখ বন্ধ করলেই। শাকিলের অনিন্দ্য সুন্দর মুখটা ভেসে উঠে। এপাশ ওপাশ করতে করতে এক সময় বিছানা থেকে নেমে শাকিলের রুমে এল। টেবিলের উপর বেশ কিছু বই গুছানো রয়েছে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে বইগুলো দেখতে দেখতে একটা ডায়েরী পেল। ডায়েরীর উপরে সুন্দর হাতের লেখায় শাকিলের নাম ঠিকানা দেখে তার মনে ডায়েরীটা পড়ার কৌতূহল জাগল। চেয়ারে বসে ডায়েরীটা খুলে পড়তে লাগল।
তারিখ….. আজ আব্বার বন্ধুকে বাড়িঘর ও জমি জায়গার দলিল দিতে ঢাকায় ওনার বাড়িতে গিয়ে শুনলাম, ওনার একমাত্র মেয়ে শাকিলার বিয়ে একজন বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার এর সঙ্গে হতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার শুনলাম, পাত্র পক্ষ সোনার গহনা স্যাকরা দিয়ে পরীক্ষা করেছে বলে শাকিলার আব্বা মেয়ের বিয়ে না দিয়ে বর ও বরযাত্রীদের ফিরিয়ে দেন। পরে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমার পরিচয় পেয়ে ওনার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার কথা জানিয়ে আমার মতামত জানতে চান। আমি তখন বললাম, আব্বা আম্মার মতামত ছাড়া কিছু বলতে পারব না। উনি বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ। তারপর খাওয়া দাওয়া করিয়ে থাকতে বললেন, আমি আনিসা ও গুলজার চিন্তা করবে বলে চলে আসি। সেদিন ওনার মেয়ের নাম জানার ইচ্ছা হলেও জানতে পারিনি।
পরের পৃষ্ঠা তারিখ… গুলজারের জেদাজেদিতে স্টেডিয়ামে মোহামেডান ও আবহানির বল খেলা দেখতে গেলাম। এক সময় গোল নিয়ে মারামারি শুরু হতে পালিয়ে আসার সময় একটা মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। মেয়েটা আমাকে খারাপ ছেলে মনে করে গালাগালি করল। তখন আমি রেগেমেগে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। কারণ মেয়েটাকে দেখে আমার মনে হল, এই রকম মেয়েকে জীবন সঙ্গিনী করার জন্য যেন খুঁজছি। ততক্ষণে মেয়েটা ভিড় ও ঠেলাঠেলিতে বেশ একটু দূরে চলে গেছে। ভিড়ের মধ্যে পড়ে মেয়েটা হিমসিম খাচ্ছে দেখে আমার সহানুভুতি জাগল। আমি বেহায়ার মত গিয়ে তাকে ভিড় থেকে রক্ষা করে বাইরে নিয়ে এলাম। তারপর মেয়েটার অনুরোধে একটা ক্যাফেতে ডুকে কফি খেতে খেতে তার আপাদমস্তক দেখে আরো মুগ্ধ হলাম। পরে দুজন দুজনের নাম জেনে দুজনেই অবাক হলাম। বিদায় নেয়ার সময় মেয়েটা তাদের বাসায় নিতে চাইলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গেলাম না। শেষে ঠিকানা দিয়ে একদিন যেতে বলল। তখন ঠিকানাটা পড়িনি. পরে পড়ে খুব অবাক হলাম, আমার মানষি আব্বার বন্ধুর মেয়ে।
পরের পৃষ্ঠায় লেখা…… আজ বাড়িতে এসে আব্বার বন্ধুর কথা আব্বা আম্মাকে বললাম। শুনে আম্মা খুব রেগে গেল। তার রাগের কারণ বুঝতে পারলাম না। আব্বা কিছু বললেন, না। দাদি এসে আম্মাকে কিছু বলতে লাগলেন। আমি তখন সেখান থেকে চলে আসি। এরপর অন্য তারিখের পাতায় লেখা….আজ মেডিকেলে গুলজারকে দেখে বেরিয়ে এসে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, শাকিলাদের বাসায় গেলে আমার মত সে নিশ্চয় খুশি হবে। শাকিলা যখন জানবে আমি তার বাবার বন্ধু গরীব স্কুল মাস্টারের ছেলে তখন সে আমাকে কি চোখে দেখবে? আমার মন তখন বলল, সে যেই চোখে দেখুক না কেন, তোমার চোখতো তাকে দেখে শান্তি পাবে। ঠিক করলাম, প্রেসক্লাব থেকে বাসে করে ওদের বাসায় যাব। এই ভেবে বাংলা একাডেমীর মোর পার হয়ে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে শিশু একাডেমীর গেটের সামনে তিন চারটে ছেলের সঙ্গে একটা মেয়েকে কথা বলতে দেখলাম। যেই আমি সেখানে এসেছি অমনি মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আসতে এত দেরী করলে কেন প্রিয়তম, সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। এই ঘটনায় আমি কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে পড়ি। সামলে নিয়ে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছু বলতে যাব এমন সময় তার সঙ্গের দুজন ছেলে আমাকে গালাগালি করতে করতে মারতে লাগল। আর বাকি দুজন আমার হাতঘরি ও টাকা পয়সা পকেটস্থ করে তারাও মারতে লাগল। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাদেরকে শায়েস্তা করতে যাব ঠিক সেই সময় আমার মানষির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম-কি হয়েছে ভাই, আপনারা ভদ্রলোকটাকে মারছেন কেন? তার উত্তরে ছেলেগুলো যা বলল এবং আমার মানষি আমাকে চিনতে পেরে যতটা ঘৃণার দৃষ্টি হেনে চলে গেল, তাতে করে আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। তখন ছেলেমেয়েগুলার ওপর রেগে গেলেও প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। কারণ তখন আমি কি পরিমাণ লজ্জা পেয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আনিসাদের বাসায় এসে রাত্রে ভাতও খেতে পারলাম না। আনিসা জিজ্ঞেস করতে বললাম, শরীর খারাপ, পরের দিন আনিসার কাছ থেকে পথ খরচ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
এই পর্যন্ত পড়ে শাকিলার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। চিন্তা করল, শাকিলের চরিত্রের ওপর সন্দেহ করে কি দারুণ অন্যায় করেছি। তারপর সে ডায়েরীটা যত পড়তে লাগল তত বুঝতে পারল, শাকিল তাকে কত গভীরভাবে ভালবাসে। অথচ ঘুনাক্ষরেও সে তা আমার কাছে প্রকাশ করে নাই।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে বিয়ের দিনের পাতাটা পড়ে শাকিলা যেমন অবাক হল তেমনি আনন্দে ও দুঃখে তার মনটা ভরে গেল। দ্বিতীয় বার পড়তে লাগল- শাকিলাকে প্রথম দেখার পর থেকে প্রত্যেক নামাযের পর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতাম “ আল্লাহ পাক, শাকিলাকে সহধর্মীনিরূপে দান করে আমাকে ধন্য কর। তোমার কাছে ধনদৌলত, সোনা দানা চাই না। তুমি শুধু তোমার ঐ বেহেস্তের হুরসম বান্দিকে এই নাদান বান্দার স্ত্রীরূপে কবুল করো।” আজ তার সঙ্গে আমার বিয়ে হল। কিন্তু তাকে স্ত্রীরূপে পেলাম না। আজ আমাদের বাসর রাত হবার কথা। এই রাতের জন্য আল্লাহ পাকের কাছে কত কেঁদেছি। সেই রাত এল, কিন্তু মানষিকে পেয়েও পেলাম না। নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে অযু করে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে নফল এবাদতে মশগুল হবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সফল হলাম না। শাকিলার মুখটা মনের পর্দায় ভেসে উঠে এবাদতে ব্যাঘাত ঘটাতে লাগল। শেষে কুরআন শরিফ তেলাওয়াত করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ তেলাওয়াত করার পর আবার শাকিলার স্মৃতি মনে পড়ে বাধা সৃষ্টি করতে কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে ডায়েরী লিখতে বসলাম। ঐদিন বিয়ের আগে শাকিলা যখন বলল, তাদের পূর্ব পুরুষদের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য এক বছরের কন্ট্যাক্টে বিয়ে করবে তখন আমার মনে হল, এর থেকে সে যদি এক পেয়ালা বিষ পান করার জন্য আমার হাতে তুলে দিত, তা হলে আমার মনে অনেক কম ব্যাথা লাগত। সমস্ত পৃথিবীর ঐশ্বর্য একদিকে আর অন্যদিকে শাকিলাকে রেখে কেউ যদি আমাকে বলত-যেটা ইচ্ছা নাও। তখন আমি তাকেই নিতাম। উইল পাওয়ার পরপর আমি উকিলদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম-আমাকে বিয়ে না করে যাতে সে সম্পত্তির মালিক হতে পারে তার ব্যবস্থা করতে। তারা বললেন, উইল মোতাবেক তার সঙ্গে আমার বিয়ে না হলে এবং একবছর তা টিকে না থাকলে সে সম্পত্তির মালিক হতে পারবে না। তাই শাকিলা যখন এক বছরের কন্ট্যাক্টে বিয়ে করতে চাইল তখন মেনে নিলাম। আমার মন আমাকে বলে, সেও আমাকে ভালবাসে। কিন্তু হয়তো কোন কারণে চরিত্রহীন জেনে শঠ ও ধূর্ত ভেবে ঘৃণা করে। আমাকে যতই চরিত্রহীন ও ধূর্ত ভাবুক না কেন, তাতে আমার মনে যতটা দুঃখ ও কষ্ট হয়, শঠ ভাবলে তার থেকে হাজারগুণ বেশি মনে কষ্ট হয়। কারণ শঠ মানে মোনাফেক। আর মোনাফেকের স্থান জাহান্নামে। আমি জাহান্নামকে খুব ভয় করি। চরিত্রহীন গোনাহগাররা তাদের গোনাহর দরুণ জাহান্নামের আগুনে পুড়ে একদিন না একদিন বেহেস্তে যাবে। কিন্তু মোনাফেকরা অনন্ত কাল জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। তাই যেদিন শাকিলা আমাকে শঠ বলেছিল সেদিন রেগে গিয়ে বলতে নিষেধ করেছিলাম।
এতক্ষণ ডায়েরী পড়তে পড়তে শাকিলা চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছিল। চোখ মুখ মুছে ডায়েরীটা বন্ধ করে হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, রাত দুটো। ডায়েরীটা নিয়ে নিজের রুমে ফিরে এসে স্টেডিয়ামে প্রথম সাক্ষাতের পর থেকে যতবার তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়েছে, সেই সব চিন্তা করে বুঝতে পারল, শাকিল যতবেশি আমাকে ভালবাসে, আমি বোধ হয় তার চেয়ে বেশি তার মনে কষ্ট দিয়েছি। আল্লাহর কাছে জানাল “আল্লাহ তুমি শাকিলকে সুস্থতা দান কর। তাকে শিঘ্রী ভাল করে দাও। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমি যেন তার কাছে ক্ষমা চেয়ে ধন্য হতে পারি। আমি যে ভুল করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দাও।” তারপর খাটে শুয়ে ডায়েরীটা আবার পড়তে লাগল-বিভিন্ন তারিখের ঘটনা লেখা-ইন্টারভিউ এর দিন থেকে আহত হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদিনের ঘটনা পড়তে লাগল। মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী প্রথম জীবনে যাই থাকুন না কেন, শাকিলের সংস্পর্শে এসে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। চৌধুরী স্টেটের সব কর্মচারী ও চাকর চাকরানীদের মনে কি ভাবে ইসলামের আইন অনুসরণ করার প্রেরণা জুগিয়েছে, চৌধুরী মেমোরিয়াল বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠার পটভূমিকা, দু দুবার তাকে মার্ডার করার ষড়যন্ত্র এবং তার পরবর্তী ঘটনা, এমন কি গ্রামের দুস্থ ও গরিবদের কি কারণে কখন কাকে কত টাকা দিয়েছে এবং দিতে হবে, প্রতিদিন কোন সময়ে কোন কোন অসুস্থ লোককে দেখতে গেছে এবং যেতে হবে তা সব পড়ল। ডায়েরীটা যত পড়ছে শাকিলা তত শাকিলকে জানতে পারছে, আর সেই সঙ্গে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য অনুশোচনায় দগ্ধিভূত হয়ে চোখের পানিতে তা ঠান্ডা করার চেষ্টা করছিল। এমন সময় ফজরের আযান শুনে ডায়েরীটা শাকিলের রুমে রেখে অযু করে নামায পড়ে কেঁদে কেঁদে শাকিলের জন্য অনেক দোয়া চাইল।
সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় নাগিনা বেগম শাকিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ? চোখ মুখ ফোলা কেন?
না চাচিআম্মা আমার কিছু হয়নি। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, তাই ঐ রকম মনে হচ্ছে। খাওয়া শেষ করে বলল, আমি হাসপাতালে যাব।
নাগিনা বেগম কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু হয়েছে বুঝতে পারলেন। বললেন, আমি নায়েবকে খবর পাঠিয়ে সে ব্যবস্থা করছি।
শাকিলা ড্রাইভারকে বলল, তুমি গাড়ি নিয়ে ফিরে যাও। বাবাকে বলবে, শাকিল সাহেবের খুব অসুখ, আমার ফিরতে দেরি হবে। পরে আমি তাকে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানাব।
আজ পাঁচদিন শাকিল আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। জ্বর কমে নি, ক্ষতস্থানও সারে নি। শাকিলা যখন হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছাল তখন বেলা সাড়ে দশটা। সবে মাত্র ডাক্তার শাকিলকে পরীক্ষা করে বেরিয়ে গেছেন। এখানে কেবিন নেই। শাকিল প্রথমে ওয়ার্ডে অন্যান্য রুগীদের সঙ্গে ছিল। নাগিনা বেগম নায়েবকে দিয়ে অনেক টাকার বদলে আলাদা রুমে শাকিলকে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে এসে দেখল, নার্স শাকিলের গায়ে কম্বল চাপা দিচ্ছে।
তাদের দেখে নার্স নিজের ঠোঁটে একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে ইশারা করে কথা বলতে নিষেধ করল। তারপর ফিস ফিস করে বলল, খুব কষ্ট হচ্ছিল বলে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। উনি এখন ঘুমাবেন। তারপর নার্স বেরিয়ে গেল।
শাকিলা নায়েবকে বলল, আপনি চলে যান, আমি এখানে থাকব। ওনাকে ইতস্ততঃ করতে দেখে আবার বলল, চাচিআম্মাকে বলবেন, দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দিতে।
নায়েব উইলের খবর জানলেও তাদের বিয়ের কথা জানতেন না। ফিরে আসার। সময় চিন্তা করলেন, শাকিল ভালো হয়ে গেলে এবার ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্য বেগম সাহেবকে বলতে হবে।
নায়েব চলে যাওয়ার পর শাকিলা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শাকিলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অত সুন্দর স্বাস্থ্যবান ছেলে শুকিয়ে গেছে। চাচিআম্মার কাছে। শুনেছে, প্রচুর রক্ত গেছে। তাই চেহারা হলুদ দেখাচ্ছে। আপনা থেকে তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। চোখ মুছে সীটের নিচ থেকে টুল টেনে মাথার কাছে এনে বসে তার কপালে হাত রেখে বুঝতে পারল এখনও বেশ জ্বর রয়েছে। বেলা দুটোর সময় শাকিলকে চোখমেলে চাইতে দেখে শাকিলা দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন বোধ করছেন?
শাকিল কোন কথা বলল না। কয়েক সেকেন্ড শাকিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে নিল। তখন তার দু’চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
শাকিলা শাড়ীর আঁচলে শাকিলের চোখ মুছে দিয়ে বলল, কষ্ট কি বেশী হচ্ছে? ডাক্তারকে খবর দেব?
শাকিল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল। তারপর শাকিলার দিকে তাকিয়ে বলল, না ডাক্তারকে খবর দিতে হবে না। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।
শাকিলা বসার পর জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
শাকিলা উত্তর দিতে পারল না। মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে চোখ মুছে মাথা তুলে বলল, ভাল।
আমার অসুখের কথা শুনে এসেছেন জেনে খুব খুশী হয়েছি। আল্লাহ আমার মনের মকসুদ পূরণ করলেন, সে জন্যে তাঁর পাক দরবারে জানাই লাখ লাখ শুকরিয়া।
নার্স এসে রোগকে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কিরকম লাগছে?
শাকিল বলল, একটু ভালো।
নার্স চলে যাওয়ার পর শাকিল শাকিলাকে জিজ্ঞেস করল, কবে এসেছেন?
পরশু চাচিআম্মার টেলিগ্রাফ পেয়ে গতকাল এসেছি। টেলিগ্রাফে আপনার কথা কিছু লেখা ছিল না। শিঘ্রী আসার জন্য বলা হয়েছিল।
এখানে কখন এলেন?
সাড়ে দশটার দিকে।
দুপুরে খেয়েছেন?
খেয়েছি। এবার আপনি চুপ করুন। নার্স বেশি কথা বলতে নিষেধ করে গেলেন না?
আরো আট দশ দিন হাসপাতালে থেকে শাকিল প্রায় সুস্থ হয়ে চৌধুরী বাড়িতে ফিরে এল। শাকিলা এসে প্রথম রাতটা চৌধুরী বাড়িতে ছিল। তারপর হাসপাতালে সব সময় থেকে শাকীলের সেবা শুশ্রূষা করেছে।
শাকিলের ফিরে আসার খবর গ্রামের লোক জানতে পেরে, তারা ও তাদের বাড়ির মেয়েরা তাকে দেখার জন্য কাঁচারি বাড়ির সামনের মাঠে ভীড় করল।
নায়েব তাদেরকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতর বাড়িতে খবর পাঠালেন। শাকিল এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়নি। নায়েব কাঁচারি বাড়ির বারান্দায় তার বসবার ব্যবস্থা করলেন। শাকিল সেখানে বসার পর, নায়েব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনারা আজ শুধু দেখে চলে যান। পরে কথা-বার্তা যা বলার বলবেন। উনি এখনও অসুস্থ।
নায়েব থেমে যাবার পর শাকিল সালাম জানিয়ে বলল, সম্পূর্ন সুস্থ্য হবার পর ইনশাআল্লাহ আমি নিজেই আপনাদের সঙ্গে দেখা করব। অনুগ্রহ করে আজ আপনারা চলে যান। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। তারপর আবার সালাম জানিয়ে নিজের রুমে ফেরার সময় সেই রিকশাওয়ালাকে দেখতে পেয়ে তাকে কাছে ডাকল। তারপর নায়েবকে বলল, এই নোক আমাকে সেদিন একরকম বাঁচিয়েছে। একে পাঁচশ টাকা বখশিস দেবেন। টাকাটা আমার বেতন থেকে কেটে নিতে সরকার চাচাকে বলবেন।
রিকশাওয়ালা দু’হাত জোর করে বলল, মাফ করবেন সাহেব, আমি কোন টাকা নিতে পারব না। আল্লাহর রহমতে আপনি বেঁচে গেছেন, সেটাই আমার মস্ত বড় বখশিস। তারপর সে লোকের ভীড়ের মধ্যে মিশে গেল।
ঐ দিন রাতে শাকিল নিজের রুমে খাচ্ছে। নাগিনা বেগম পাশে বসে আছেন। শাকিলা খাওয়াচ্ছে আর কাজের মেয়েটা সবকিছু এনে দিচ্ছে।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর নাগিনা বেগম সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে বলে উপরে চলে গেলেন। শাকিলাও ওনার সঙ্গে চলে গেল। কাজের মেয়েটা সবকিছু নিয়ে চলে যাওয়ার পর শাকিল ধীরে ধীরে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর ঘুমাবার জন্য খাটে বসে মশারী খাটাবার কথা চিন্তা করছিল। এমন সময় শাকিলাকে রুমে ঢুকতে দেখে তার দিকে তাকাল।
শাকিলাও রুমে ঢুকে তার দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ল।
শাকিল দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, বসুন। এসে ভালই করেছেন। কয়েকটা কথা বলব বলে আপনার কথাই মনে মনে ভাবছিলাম।
শাকিলা চেয়ারে বসে বলল, আমিও কিছু বলব বলে এসেছি।
শাকিল কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে, প্রথমে আমারটা শুনুন। এই কদিন আমার জন্য আপনি যা করলেন, তা চিরকাল আমার মনে থাকবে। আজীবন আমাকে ঋণে আবদ্ধ করে ফেললেন। আল্লাহ জানেন, সে ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব কি না। আমাদের বিয়ের কন্ট্রাক্ট মেয়াদ শেষ হতে আর মাত্র। একমাস বাকি। আপনি ঢাকা গিয়ে এর মধ্যে ডিভোর্সের কাগজপত্র রেডি করে নিয়ে আসুন, আমি সঁই করে দেব। চৌধুরী সাহেবকে আমি কথা দিয়েছিলাম, সারাজীবন এই স্টেট দেখা শোনা করব। আমি যখন থাকছি না তখন আর কি করে তা করতে পারি। তাই আপনার অনুমতি পেলে চাচিআম্মা ও নায়েবের সঙ্গে আলাপ করে আমার জায়গায় একজন উপযুক্ত লোককে নিয়োগ করে যেতে চাই। তা হলে চৌধুরী সাহেবের কাছে যা ওয়াদা করেছিলাম তার কিছুটা অন্তত রক্ষা করা হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখানকার পাঠ মিটিয়ে একেবারে বাড়ি চলে যাব। আমার উইলটা চাচিআম্মার কাছে। আছে। উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে বিষয় সম্পত্তির মালিকানার ব্যাপারে যদি দলিল পত্রে আমার সঁই লাগে, তা হলে সে ব্যবস্থাও করে আনবেন। স্টেটের আয় ব্যায়ের হিসাব নায়েব ও সরকারের খাতা পত্রে আছে। আমি এখানে থাকাকালিন সময়ে যত টাকা পয়সা নিয়েছি এবং যেখানে যা খরচ করেছি, সে সব বুঝে নেবেন। কোন কিছু বুঝতে অসুবিধে হলে, কিংবা সন্দেহ হলে, আমাকে জিজ্ঞেস করবেন। আমার আর কিছু বলার নেই। আব্বা, আম্মা ও দাদির জন্য আমার মন খুব খারাপ লাগছে। যা কিছু করার এই এক মাসের মধ্যে করলে বাধিত হব।
শাকিলা এতক্ষণ মাথা নিচু করে রুমের মেঝের দিকে তাকিয়েছিল। শাকিল থেমে যেতে মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে ছলছল নয়নে বলল, আমি আপনাকে ভুল বুঝে এতদিন যা কিছু বলেছি বা করেছি, সে জন্যে অনুতপ্ত হৃদয়ে ক্ষমা চাইছি। তারপর সে নিজেকে সামলাতে পারল না, দুহাতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
প্রায় দু’বছর আগে শাকিল বল খেলা দেখাকে উপলক্ষ করে শাকিলার সঙ্গে পরিচয় হতে তাকে ভালবেসে ফেলেছিল। সেই সময় শাকিলার মনের খবরও কিছুটা বুঝতে পেরেছিল। তারপর তাকে আব্বার বন্ধুর মেয়ে জেনে ভেবেছিল, তাকে পেতে খুব একটা অসুবিধে হবে না। শিশু একাডেমীর সেই অবাঞ্ছিত ঘটনার পর থেকে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত শাকিলা তাকে ঘৃণা করলেও তার প্রতি শাকিলের ভালবাসা বেড়েছে বই কমেনি। বিয়ের পর দীর্ঘ এক বছরের মধ্যে শাকিল শাকিলাকে নিয়ে অনেক ভেবেছে। এক বছর পর তাকে চিরকালের জন্য ছেড়ে দিতে হবে মনে পড়লে মন খুব খারাপ হয়ে যেত। এবারে আহত হয়ে হাসপাতালে শাকিলাকে দেখে হৃদয় জুড়িয়ে গেছে। তারপর তার অক্লান্ত সেবা ও নম্র ব্যবহারে তার মনে অজানা এক আনন্দের লহরী বইতে শুরু করেছে। প্রথম দেখার পর থেকে সে যেমন শাকিলাকে স্ত্রীরূপে পাওয়ার জন্য সব সময় আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করত, তেমনি বিয়ের পর তার মতিগতি ভাল করে দেয়ার জন্যও ফরিয়াদ করেছে। কিন্তু ঘুনাক্ষরে কাউকেও তা বুঝতে দেয়নি। এখন তার কথা শুনেও তাকে কাঁদতে দেখে আল্লাহ তার দোওয়া কবুল করেছেন বুঝতে পেরে শুকরিয়া আদায় করতে গিয়ে শাকিলের চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, শঠ ও ধূর্ত লোকের ক্ষমার মধ্যেও শঠতা থাকে। যারা সৎ ও বুদ্ধিমান, তারা কোনদিন কোন কারণেই শঠ লোকের কাছে ক্ষমা চায় না।
শাকিল নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না, উঠে এসে শাকিলের পায়ের কাছে বসে বলল, সে সব কথা বলে আমাকে আর লজ্জা দিও না। আমাকে তোমার এই পবিত্র কদমের সেবা করতে দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দাও। বল, ক্ষমা করে তোমার পায়ে ঠাই দেবে? তারপর তার পা জড়িয়ে ধরল।
শাকিল আর একবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে তার দু’গালে ও কপালে চুমো। খেয়ে বুকে চেপে ধরে বলল, তোমার কোন কথা ও কাজকে যদি অন্যায় মনে করতাম, তা হলে আমি যেমন তোমাকে পেতাম না তেমনি তুমিও আমাকে পেতে না। চল জীবনের প্রথম খুশীর খবরটা চাচিআম্মাকে জানিয়ে দোয়া নিই।
শাকিলা স্বামীর সোহাগের প্রতি উত্তর দিয়ে বলল, না। জীবনের প্রথম খুশীর রাতের ভাগ কাউকে দেব না। শুধু আমরা দুজনে তা ভোগ করব। যা করার কাল করা যাবে। এখন চল ঘুমাবে। রাত অনেক হয়েছে।
শাকিল তাকে কোলে বসিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, এই খুশীর রাতে কেউ কোন। দিন ঘুমিয়েছে, না ঘুমাতে পেরেছে?
না, তা কেউ পারে নি।
তা হলে বললে কেন?
এভাবে বসে বসে কি রাত কাটাতে চাও?
তুমি যেভাবে চাও সেইভাবে কাটাব।
কি ভাবে কাটাতে হয় আমি যে জানি না।
সে কথা কাউকে জানতে হয় না, প্রকৃতি জানিয়ে দেয়।
তাই?
হ্যাঁ তাই বলে শাকিল শাকিলাকে আদর সোহাগে ভরিয়ে তুলল।
এক সময় অশ্রুসিক্ত নয়নে শাকিলা বলল, তুমি শিশু একাডেমীর আসল ঘটনাটা আমাকে যদি সে সময় জানাতে, তা হলে তোমার প্রতি আমি এত দুর্ব্যবহার করতাম না। ভাগ্যচক্রে এখানে এসে তোমার ডায়েরীটা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, নচেৎ কি যে হত তা আল্লাহ পাক জানেন। তুমি আমাকে এত ভালবাস আর আমি তা বুঝতে না পেরে তোমার মনে কত আঘাত দিয়েছি। সে কথা মনে হলে-কথাটা সে আর শেষ করতে পারল না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
শাকিল তাকে বুকে চেপে ধরে আদর দিয়ে বলল, তখন বললে তুমি কথাটা বিশ্বাস করতে না ভেবে জানাই নি। তা ছাড়া তুমি নিজের চোখে ও কানে যা দেখেছ ও শুনেছ, আসল ঘটনা বললেও তোমার বিশ্বাস হত না। ভাবতে অন্যায় করে তোমার কাছে ভাল হওয়ার জন্য সাফাই গাইছি। বাদ দাও ওসব কথা, যা ভাগ্যে ছিল হয়েছে। এখন কান্না থামাও। এই শুভরাত কান্নার মধ্যে দিয়ে কাটাতে চাও না কি? একটু আগে তুমিই তো বললে আজকের রাত শুধু তোমার আমার আনন্দের রাত।
শাকিলা কান্না থামিয়ে চোখ মুখ মুছে আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার অন্যায় হয়েছে মাফ করে দাও। তারপর শাকিলকে জড়িয়ে ধরে বলল, আনন্দ বুঝি আমি একা একা করব?
শাকিল তাকে শুইয়ে দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, তা কেন দুজনেই করব। কথা শেষ করে তারা চির আকাংখিত মধুর মিলনে মেতে উঠল।