৫
কাঞ্চঙ্গপুরের কাজ শেষ করে ফিরে এসে শাকিল চৌধুরী সাহেবকে সবকিছু জানাল।
চৌধুরী সাহেব বললেন, গোমস্তা ও নায়েবের ব্যাপারে কিছু চিন্তা ভাবনা করেছ?
গোমস্তার ব্যাপারে চিন্তা করার বিশেষ কিছু নেই, ওনাকে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যেতে বলুন। আশা করি ছেলের কাছ থেকে সবকিছু জেনে নিজের ভুল বুঝতে পেরে শুধরে যাবেন। তা যদি না হয় তখন তার ব্যবস্থা আমি করব। আর নায়েবকে আরো কিছুদিন সৎপথে আনার চেষ্টা করব। এখন বয়স হয়েছে। মরণের ভয় সব মানুষেরই আছে। যদি একান্ত ওনার পরিবর্তন না হয়, তখন আপনাকে জানাব।
এরকম কূটীল ও অসৎ লোকেরা কোনদিন শুদরায় না। অনেক আগেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতাম, বাবার আমলের বয়স্ক লোক বলে এতদিন কিছু বলি নাই।
আল্লাহপাকের ইচ্চায় সব কিছু হয়। আমরা যে ওনার সব জাল জোচ্চুরি ধরে ফেলেছি তা উনি বুঝতে পেরেছেন। এখন আমরা যদি ওনাকে কিছু না বলি, তা হলে আমার মনে হয়, উনি যে রকম বুদ্ধিমান লোক, নিজেই শুধরে যাবেন। ওনাকে এখন বরখাস্থ করাও ঠিক হবে না। কারণ ওনার কাছ থেকে এখনও আমার অনেক কিছু শেখার আছে।
ঠিক আছে, তুমি যা ভাল বুঝ কর।
মাস তিনেক পরে আম্মার চিঠিতে দাদীর অসুখের কথা শুনে শাকিল বাড়ি গেল। ফৌজিয়া খাতুন বার্ধক্য জনিত রোগে ভুগছিলেন। শাকিল বাড়িতে এসে ডাক্তার এনে দাদির চিকিৎসা করিয়ে কিছুটা সুস্থ হলে প্রায় পনের দিন পরে মেহেরপুরে ফিরে এল।
বাড়ি থেকে এসে শাকিল শুনল, চৌধুরী সাহেব অসুস্থ। সেদিন রাতে খাওয়ার সময় কাজের মেয়েকে বলল, তুমি গিয়ে চৌধুরী সাহেবকে বল, আমি দেখা করতে চাই।
কাজের মেয়েটা বলল, উনি আপনাকে খাওয়ার পর যেতে বলেছেন।
এতক্ষণ সে কথা বলনি কেন?
খাওয়া শেষ হলে বলতাম।
খাওয়ার পর শাকিল উপরে ড্রইংরুমে গিয়ে দেখল, চৌধুরী সাহেব একটা কৌচে হেলান দিয়ে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন।
শাকিল সালাম জানিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করল।
চৌধুরী সাহেব সালামের জওয়াব দিয়ে সোজা হয়ে বসে বললেন, শরীর তেমন ভালো নয়। বস, তোমাকে ষ্টেটের ব্যাপারে কয়েকটা কথা বলব। তার আগে অন্য দু একটা কথা বলে নিই। তুমি শুধু চৌধুরী বাড়ির নয়, সমস্ত মেহেরপুরের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছ তা প্রশংসার যোগ্য। সেই সব দেখেশুনে আমিও মনের মধ্যে জ্ঞানের আলো পাবার জন্য প্রেরণা অনুভব করে তোমার রুম থেকে বিশ্ব নবী, তাজ কেরাতুল আউলিয়া, সাহাবা চরিত এবং কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যার বই নিয়ে এসে পড়তে থাকি। তার ফলে আল্লাহপাকের করুণায় আমার মনেও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে। গত জীবনের কৃতকর্ম স্মরণ করে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দরবারে মাফ চেয়ে তার ও তার রসুলের (দঃ) প্রদর্শিত পথে চলার চেষ্টা করছি। আমার মনে হয়েছে ইসলামের জ্ঞানই হল আসল জ্ঞান। স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করে সে জ্ঞান পাওয়া যায় না। যদিও সেগুলোতে কিছু কিছু ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও ছেলেমেয়েরা সঠিক শিক্ষালাভ করতে পারছে না। কারণ তারা যা শিক্ষালাভ করছে, তা অনুশীলন করে শুধু ডিগ্রী নেয়ার জন্য। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার এলাকার মধ্যে আমি এমন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে চাই, যার প্রত্যেকটা শিক্ষক, কর্মচারী ও পরিচালকরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (দঃ) শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজেদেরকে ন্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে পুরোপুরি সেই মতো পরিচালিত করে। আর সেই শিক্ষা প্রতিষ্টানের ছাত্র ছাত্রীদিগকে শিক্ষা দেওয়ার। সঙ্গে সঙ্গে সেই পথে পরিচালিত করে প্রকৃত মানুষের মত মানুষ অর্থাৎ আল্লাহর খাঁটি বান্দা তৈরি করবে। যদি আমি তা করতে পারি, তা হলে হয়তো এর অসিলায় আল্লাহ আমার ও আমার পূর্ব পুরুষদের গোনাহ মাফ করতে পারেন। আমি আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই কাজের ভার তোমাকেই দেব। এখন তোমার যদি কিছু বলার থাকে বলতে পার।
চৌধুরী সাহেবের কথা শুনে শাকিল আনন্দে আপ্লুত হয়ে আলহামদু লিল্লাহ বলে বলল, সেই আল্লাহপাকের দরবারে শতকোটি শুকরিয়া জানাই, যিনি আমার মনের বাসনা পূরণ করার জন্য এবং তা বাস্তবায়নের জন্য আপনাকে অনুপ্রানিত করেছেন। আমি আপনার সিদ্ধান্ত সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি। কিন্তু এই গুরু দায়িত্ব কি আমি বহন করতে পারব।
চৌধুরী সাহেব বললেন, ইনশাআল্লাহ পারবে। তোমার মতো ছেলে যদি না পারে, তবে আর কে পারবে? “কেউ ভাল কাজে অগ্রসর হলে, আল্লাহ তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন” এটা যে হাদিসের কথা তা তুমি নিশ্চয় জান? আরো একটা সিদ্ধান্তের কথা বলে এই প্রসঙ্গ শেষ করব। এখন যেভাবে তুমি এই ষ্টেটের সব কিছু দেখাশোনা করছ, আমার মৃত্যুর পরও ঠিক সেই ভাবে দেখাশুনা করবে। তোমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যা কিছু করার আমি করব।
শাকিল বলল, আপনি এত বেশি দায়িত্ব দিতে চাচ্ছেন তা পালন করতে পারব কি
জানি না, তবু কথা দিচ্ছি, আল্লাহপাক আমাকে যতটা তওফিক দেবেন ততটা করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। আপনিও দোয়া করুন, আল্লাহপাক যেন আমাকে আপনার মনের বাসনা পূরণ করার তওফিক দান করেন।
চৌধুরী সাহেব শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, তাতো করবই। তোমার কথা শুনে মনে খুব শান্তি পেলাম। তারপর বললেন, কয়েকদিন আগে নায়েব আমার কাছে অন্যায় স্বীকার করে মাফ চেয়েছেন। আমি তাকে বলেছি, অতীতের অন্যায়ের জন্যে আল্লাহ পাকের কাছে মাফ চাইবেন। আর ভবিষ্যতে যে কোন কাজ থেকে বাঁচার জন্য তার কাছেই সাহায্য চাইবেন।
শাকিল ভিজে গলায় বলল, আল্লাহ কখন কাকে হেদায়েত করেন, তা কেউ বলতে পারে না, তার পাক দরবারে আবার শুকরিয়া জানাচ্ছি। আমার দৃঢ় ধারণা ছিল, ইনশাআল্লাহ উনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে একদিন না একদিন শুধরে যাবেন। এমন সময় বেগম সাহেবকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম জানিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করল।
নাগিনা বেগম সালামের প্রতিউত্তর দিয়ে বসে তাকেও বসতে বলে বললেন, আল্লাহ পাকের রহমতে আমি একরকম আছি। তারপর স্বামীর দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, কিছু দিন থেকে ওনার শরীর খারাপ যাচ্ছে। এখানকার ডাক্তাররা রোগ ধরতে পারছেন না। ওনারা বলছেন, ঢাকায় কোন ভাল প্রাইভেট ক্লিনিকে একবার চেক আপ করাতে। উনি যেতে চাচ্ছেন না। তুমি যদি একবার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে…..।
চৌধুরী সাহেব স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ওসবের দরকার নেই।
শাকিল চৌধুরী সাহেবের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝতে পারল, চাকরি করতে এসে ওনাকে প্রথমে যা দেখেছিল, তার চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছেন। বলল, চাচিআম্মা ঠিক কথা বলেছেন। আমি আপনাকে দু’একদিনের মধ্যে ঢাকা নিয়ে যাব।
নাগিনা বেগম বললেন, হ্যাঁ তাই কর, ওনার কথা শোন না।
দু’দিন পর শাকিল চৌধুরী সাহেবকে নিয়ে ঢাকায় এসে একটা হোটেলে উঠতে চাইলে শাকিল সেই ব্যবস্থা করল। চাচাতো ভাই ইয়াসিন সাহেবের বাসাতে না উঠে কেন হোটেলে উঠলেন সে কথা শাকিল জানে। তাই একটা ভালো হোটেলে থেকে ইবনে সীনা ক্লিনিকে ওনার সব কিছু চেকআপ করাল। বিশেষ তেমন গুরুতর কিছু দোষ ধরা পড়ল না। ডাক্তারের প্রেসক্রিপসান মতো ঔষধপত্র কিনে শাকিল খাওয়াতে লাগল।
একদিন চৌধুরী সাহেব হোটেল থেকে ব্যারিস্টার মুস্তাককে ফোন করে আসতে বললেন। সেদিন শাকিল চৌধুরী সাহেবকে বলে আনিসাদের বাসায় গেছে।
ব্যারিস্টার মুস্তাক অনেক দিন থেকে চৌধুরী বংশের সঙ্গে জড়িত। স্টেটের কাগজ পত্রের কজ উনি দেখাশুনা করে আসছেন। হোটেলে এসে চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করে বললেন, কি খবর বলুন।
চৌধুরী সাহেব বললেন, শরীরটা বেশ কিছুদিন থেকে ভাল যাচ্ছে না। আপনি তো জানেন, আমার এই বিশাল ষ্টেটের কোন ভোগ দখলকারী নেই। ইয়াসিন থেকেও নেই। তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু রাজি করাতে পারিনি। শরীরের অবস্থা যে রকম, কবে কি হয়ে যায় বলা যায় না। তাই আমি একটা উইল করতে চাই।
ব্যারিস্টার সাহেব বললেন, উইলটা কিভাবে করবেন কিছু ঠিক করেছেন?
হ্যাঁ করেছি বলে চৌধুরী সাহেব ব্রীফকেস থেকে একটা খসড়া বের করে তার হাতে দিলেন।
ব্যারিস্টার সাহেব সেটা পড়ে খুশী হয়ে বললেন, শাকিল ছেলেটাকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছা করছে।
চৌধুরী সাহেব বললেন, ও আমার সঙ্গে এসেছে। তার এক আত্মীয়কে দেখতে গেছে। কাল একবার আসুন পরিচয় করিয়ে দেব। আমি উইলের ব্যাপারটা এখন কোন পক্ষকেই জানাতে চাই না। আশা করি, আপনি উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছেন।
ব্যারিস্টার সাহেব মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, পেরেছি।
চৌধুরী সাহেব তার সঙ্গে আরো কিছু গোপন আলোচনা করে আপ্যায়ণ করিয়ে বিদায় দিলেন।
ঢাকায় দু’সপ্তাহ থেকে শাকিল চৌধুরী সাহেবকে নিয়ে মেহেরপুর ফিরে এল। এরপর থেকে সে প্রতিদিন দুবেলা চৌধুরী সাহেবকে দেখাশোনা করতে লাগল।
একদিন চৌধুরী সাহেব শাকিলকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার পরিকল্পনার কাজ কতদূর কি করলে?
শাকিল বলল, আপনাকে নিয়ে ঢাকায় থাকার সময় আমি কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করেছি। ওনারা অত্যন্ত খুশী হয়ে সহযোগীতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। এই কয়েকদিনে এখানকার আমার জানাশুনো বেশ কয়েকজন আদর্শবান শিক্ষকের সঙ্গেও আলাপ আলোচনা করেছি। ওনারাও সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। একমাস পরে বারই রবিউল আউয়াল। ঐদিন আমি মিলাদুন্নবী উপলক্ষে এক মাহফিলের আয়োজন করে ঐ সমস্ত গুণী ও সুধীজনদের নিয়ে এসে আমাদের পরিকল্পনার সবকিছু চূড়ান্ত করার কথা ভেবেছি।
চৌধুরী সাহেব বললেন, শুনে খুশী হলাম। নায়েবকে বল, উনি যেন দু একদিনের মধ্যে গ্রামের গণ্যমান্য লোকদের খবর দিয়ে কাঁচারি বাড়িতে একটা মিটিং এর ব্যবস্থা। করেন।
মিটিং এর দিন শাকিল চৌধুরী সাহেবের পরিকল্পনার কথা যখন বলল তখন বেশীরভাগ লোকজন আনন্দে হাততালি দিতে লাগল। শাকিল তাদেরকে থামিয়ে দিয়ে। বলল, আমরা মুসলমান। আনন্দ প্রকাশ করার রীতি আমাদের রসুল হযরত মুহাম্মদ (দঃ) শিক্ষা দিয়ে গেছেন। হাত তালি দেয়া ইসলামের নিষেধ, এটা করলে বিধর্মীদের অনুকরণ করা হয়ে যায়। আমরা মারহাবা মারহাবা বলে আনন্দ প্রকাশ করব। কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে এমন কয়েকজন ছেলে এখানে এসেছে। তাদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া সবাই শাকিলকে মৌলবাদী বলতে ছাড়ল না। কিন্তু বেশিরভাগ লোকজন ও ছেলেরা তাকে আদর্শবান ও ধার্মিক মনে করল।
মাহফিলের দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শাকিলের আমন্ত্রণে অনেক আলেম, ওলামা, শিক্ষক, অধ্যাপক ও জ্ঞানী গুণীজন এসেছেন। শাকিল চেষ্টা চরিত্র করে শিক্ষা মন্ত্রিকে আনিয়েছেন। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, কমিশনার ও মেম্বারগণও এসেছেন। বিভিন্ন গ্রামের লোকজনের তো কথাই নেই। তারা চৌধুরী বাড়িতে আগে কোনোদিন এরকম মাহফিল হতে দেখেন নি।
মাহফিলের শুরুতে সকলের অনুমতি নিয়ে শাকিল হামদ ও নাত পাঠ করার পর স্বরচিত একটা কবিতা আবৃত্তি করল।
কবিতার নাম-”জাগরে বিশ্বের মুসলিম সন্তান”
জাগরে বিশ্বের মুসলিম সন্তান,
এখনো সময় আছে
হয়ে যাও সাবধান।
জেনে নিয়ে নিজের পরিচয়
রুখে দাঁড়াও সমাজের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে
উড়িয়ে মহা সত্যের বিজয় নিশান।
বিপথগামীর স্রোতে ভেসে চলেছে
সারা দুনিয়ার মানব সন্তান,
তারা জানে না কোথায় তাদের ঠিকানা।
যদি তোমরা ঘুমিয়ে থাক,
তবে তাদেরকে কে রুখবে
একবারও ভেবে দেখা কি উচিত না?
আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (দঃ) বাণী
নিজেরা জেনে ও বাস্তবে মেনে চলে
তাদেরকে ফিরিয়ে আন সত্যের পথে।
তা না হলে, কাল হাশরের মাঠে
কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে
সেই পরওয়ার দেগারের কাছে?
ওহে বিশ্বের মুসলিম সন্তান,
জাগো, ঘুমিয়ে থাকবে আর কতদিন?
তোমরা না শ্রেষ্ঠ জাতি আল্লাহ’র খলিফা?
তোমাদের উদাসীনতায় ও গাফলতিতে
ভরে গেছে দুনিয়া মোনাফেকি আর বেদাতিতে,
ঘুম থেকে জেগে হুশিয়ার হয়ে যাও তোমরা।
পাপের কালিমায় তাদের দিলের
ঈমানের নূর হয়ে গেছে
অমানশির মতো তমসাছন্ন।
ইনশাআল্লাহ তোমরাই পারবে তাদের
দিলে ইমানের সেই নূর আবার জালাতে,
কেননা তোমরা তাদের ভাই, নও তো তোমরা অভিন্ন।
ওগো পীর, অলি, আওলিয়া, ফকির, দরবেশ
আর বিশ্বের আলেম ওলামাগণ,
আপনাদের মোবারক কদমে আরজী জানাই–
ইবাদৎ জিকিরের সাথে সাথে
বিপথগামীদের ফেরার জন্য কিছু করুন,
নচেৎ শেষ বিচারের দিনে থাকবে না নাজাতের উপায়।
আর শুনুন কবি, লেখক ও নাট্যকারগণ,
আপনারাও লেখনীয় চালিয়ে যান–
শরীয়তকে সামনে রেখে।
অশ্লীলতার কুফল আর
শ্লীলতার সুফল বর্ণনা করুন
কবিতায় নভেলে ও নাটকে।
যা পাঠ করে উৎপিড়ীত, নিষ্পেসিত ও
বিপথগামী বিশ্বের মুসলিম,
পারে আবার শীর উঁচু করে দাঁড়াতে।
তা না করে সংস্কৃতির নামে
অপসংস্কৃতি সাহিত্যে ঢুকিয়ে দিলে
মুসলিম জাতি আরো যাবে রসাতলে।
ওগো প্রভু তুমি যে করুনা সিন্ধু।
তোমার করুনা সদাই বর্ষিত হচ্ছে
স্কুল মোখলুকাতের উপর।
বিশ্বের মুসলিম আজ পেতে চায়
সেই সিন্ধু থেকে একবিন্দু করুনা,
তুমি ছাড়া যে তাদের নেই অন্য কোনো দোসর।
কবিতাটা আবৃত্তি করে শাকিল সালাম জানিয়ে বসে পড়ল। আর সমস্ত লোকজন মারহাবা মারহাবা শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলল। তারপর ওয়াজ নসীহত ও রসুলুল্লাহ’র (দঃ) জন্ম দিনের উপর বিভিন্ন বক্তাগণ বক্তব্য রাখার পর শাকিল শিক্ষা। প্রতিষ্ঠানের কথা ব্যক্ত করল। সকলে আনন্দের সঙ্গে সহযোগীতা করার কথা বলল। শেষে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটা কমিটি গঠন করা হল। সেই কমিটির মধ্যে চৌধুরী সাহেব, শাকিল, নায়েব থাকলেন। চৌধুরী সাহেব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি ও বিরাট অংকের টাকা ডোনেশান দিলেন। কথা হল, চৌধুরী সাহেবের টাকাতেই প্রথমে যত শিঘ্রী সম্ভব কাজ শুরু হবে। পরে গ্রামের লোকজনদের কাছে টাকা পয়সা সংগ্রহ করা হবে। সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রতিষ্ঠানের নাম “চৌধুরী মেমোরিয়াল বিদ্যাপীঠ” রাখা হল।
শাকিল ষ্টেটের অফিসের সব কিছু দেখার সাথে সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজও দেখাশোনা করতে লাগল। গ্রামের অনেকে শাকিলকে তার অমায়িক ব্যবহারের জন্য এবং গ্রামের উন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখতে দেখে আগে থেকেই ভক্তি শ্রদ্ধা করত। এখন তাকে এই রকম একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পিছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখে সেই ভক্তি শ্রদ্ধা আরো শতগুণ বেড়ে গেল। তারা বলাবলি করতে লাগল, এই ম্যানেজারের জন্যে চৌধুরী সাহেবের এবং তার আমলাদের চরিত্র পাল্টে গেছে। ক্রমশঃ তার সুনাম আশপাশের গ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। তিন চার মাসের মধ্যে বিল্ডিং তৈরী হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়ে গেল। চালু হবার ছমাস পর হঠাৎ একদিন হার্টফেল করে চৌধুরী সাহেব মারা গেলেন।
চৌধুরী সাহেবের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা গ্রামে বিষাদের ছায়া নেমে এল। ওনার জানাজায় আশে পাশের ও অনেক দূর গ্রামের লোকজন এসে সামিল হল। দাফন কাফনের পর সমস্ত মানুষ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ফিরে গেল।
সমস্ত কাজকর্ম সেরে শাকিল বেগম সাহেবার কাছে এল।
নাগিনা বেগম এতক্ষণ কেঁদে কেঁদে কিছুটা হালকা হয়েছিলেন। শাকিলকে দেখে আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, এই দুনিয়ায় আমার যে আর কেউ রইল না বাবা?
শাকিল ওনাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, অত ভেঙে পড়বেন না চাচিআম্মা। এই পৃথিবীতে কেউ চিরকাল বেঁচে থাকে না। আল্লাহ যার যতদিন হায়াৎ রেখেছেন তার এক সেকেণ্ড বেশি কেউ বাঁচতে পারে না। সময় হলে আমাকে আপনাকে, সবাইকেই এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে যেতে হবে। আল্লাহপাকের কাছে সাহায্য চেয়ে সবর করুন। আপনার কেউ নেই বলছেন কেন? আপনার কোন আত্মিয় স্বজন না থাকতে পারে, আমি তো আছি। সর্বোপরী আল্লাহ পাক আছেন। তিনি যেমন সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা তেমনি পালন কর্তা। আমাকে ছেলে মনে করে দিলে তাসাল্লী দিন। ইনশাআল্লাহ আমার শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতে আপনার কোন রকম কষ্ট হতে দেব না। তারপর ওনার পায়ে হাত দিয়ে বলল, বলুন, আমাকে ছেলে বলে গ্রহণ করলেন?
নাগিনা বেগম শাকিলের মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক কথা বলেছ।
এতদিন তোমাকে ছেলের মতো মনে করতাম, আজ থেকে তুমি আমার পেটের ছেলে।
শাকিল আম্মা বলে ওনার দুপা জড়িয়ে ধরল।
নাগিনা বেগম চির আকাংখিত আম্মা ডাক শুনে শাকিলের মাথা বুকে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, আর একবার আম্মা বলে ডাক বাবা।
শাকিল আম্মা বলে ডেকে বলল, আপনি এবার চুপ করুন আম্মা, আজ থেকে আমিও আপনাকে গর্ভধারিনী মা মনে করব।
চৌধুরী সাহেবের কুলখানি করার পর শাকিল নাগিনা বেগমের অনুমতি নিয়ে। নায়েবকে বলে এবারে প্রায় চার মাস পরে বাড়ি এল। সে আগেই পত্র দিয়ে বাড়িতে চৌধুরী সাহেবের মৃত্যু সংবাদ দিয়েছে। রাত্রে খাওয়ার পর শাকিল দাদির হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছিল।
ফৌজিয়া খাতুন বললেন, তেল মালিশ করতে হবে না, শুতে যা।
কেন দাদি আমি কি দোষ করলাম?
ন’মাসে ছ’মাসে বাড়িতে এসে দু’একদিন তেল মালিশ করিস। বাকি দিনগুলোতে কে করে খোঁজ করেছিস?
আম্মা নিশ্চয়ই করে। আমি ঘরে থাকলে প্রতিদিন করে দিতাম।
তুই না থাকলেও আর একজনকে এনে দিতে পারিস না? আম্মা সারাদিন সংসারের হাল ঠেলবে না আমাকে দেখবে। আমি তাকে তেল মালিস করতে নিষেধ করে দিয়েছি। তোকেও করছি।
শাকিল দাদির মনোভাব বুঝতে পেরে বলল, আপনি আনার ব্যবস্থা করুন।
আমি বুড়ী হয়ে গেছি, কি করে করবো? তোর আব্বাও বেশি চলাফেরা করতে পারে না। তুই নিজে দেখেশুনে করতে পারিস না?
আমি দেখেশুনে করলে সে তো আপনার হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দেবে না। আজকালকার শিক্ষিত আপটুডেট মেয়েরা এসব কাজ করবে না।
করবে করবে। তুই সে রকম মেয়ে আনবি কেন?
আপনার মনের মতো মেয়ে কি খুঁজে পাব? না এ যুগে পাওয়া যাবে? তাই বলছিলাম, আপনি কাউকে দিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দেখুন। যদি সেরকম মেয়ে পাওয়া যায়, তা হলে তাকে নাতবৌ করার ব্যবস্থা করুন।
এতক্ষণ সুরাইয়া খাতুন সবাইকে খাইয়ে তারপর নিজে খেয়ে সবকিছু গোছগাছ করে সেখানে এসে বললেন, দাদি নাতিতে কি এত কথা হচ্ছে?
শাকিল জানে দাদি তার বিয়ের কথা বলবে, তাই সে ঘুমোতে যাই বলে নিজের রুমে চলে এল।
ফৌজিয়া খাতুন বৌকে বললেন, বৌমা তোমরা এবার শাকিলের বিয়ের ব্যবস্থা কর। ওর বিয়ের বয়স হয়েছে। তুমি আর কতদিন সংসার টানবে।
সুরাইয়া খাতুন বললেন, আপনার ছেলে মেয়ের খোঁজ করছে। কয়েকজনকে বলেও রেখেছে। আল্লাহ রাজি থাকলে এ বছর ওর বিয়ের ব্যবস্থা করব।
শাকিল নিজের রুমে এসে শুয়ে শুয়ে বিয়ের কথা ভাবতে গিয়ে শাকিলার কথা মনে পড়ল। মেয়েটাকে তার খুব পছন্দ। তার দেয়া ঠিকানা পড়ে যখন সে জানতে পারল, শাকিলা আব্বার বন্ধুর মেয়ে এবং আব্বার বন্ধুও মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মধ্যখানে ভুল বোঝাবুঝির পর থেকে শাকিলাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ আব্বা আম্মার কথায় সে বুঝতে পেরেছিল, ঐ মেয়েকে তারা বৌ করবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে শাকিলার ছবি তার মনের পাতায় ভেসে উঠে। তাই আজও দাদি বিয়ের কথা তুলতে তার কথা মনে পড়ল। যতবার শাকিল ঢাকায় গেছে। ততবার শাকিলাদের বাসায় যেতে তার মন চেয়েছে। আব্বা আম্মার অনিহা জেনেও সে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শিশু একাডেমীর গেটের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আর যায়নি। ভাবল, এতদিনে হয়তো তার বিয়ে হয়ে গেছে।